শিহাব
রুশমি যখন ওদের বাড়ির প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিল সে আমাকে ঘৃণা করে এবং আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় তখনও আমি জানতাম যে ও মিথ্যে বলছে। মনে হচ্ছিল যেন কোনো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের সমুদ্রে আকণ্ঠ ডুবে আছি কিংবা এটা একটা প্র্যাঙ্কের অংশ। এক্ষুনি হয়তো রুশমি এবং ওর বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলবে, ভয় পেও না। আমরা একটু মজা করছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। দুঃস্বপ্নের তমসাচ্ছন্ন সমুদ্রে আমি ক্রমশ ডুবে যেতে লাগলাম। আমার আর ভেসে ওঠা হলো না, জেগে ওঠা হলো না। রুশমি ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে গেলো। খোঁজ পেলাম নিউইয়র্কে ওর মায়ের এক বান্ধবীর বাসায় উঠেছে। ওর বাবাও সাথে আছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম রুশমি ওর বাবার প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। লোকটার ওপর রাগ হয়েছিল ভীষণ। ফোন করে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দিয়েছি। আমার নিজের মাকেও সন্দেহ হচ্ছিল। তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমার স্ত্রীর প্রস্থানে সে মনোঃক্ষুন্ন হয়নি, বরং তৃপ্ত হয়েছে। শুধু আমার মা কিংবা রুশমির বাবা নয়, গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধেই আমি লড়তে পারতাম যদি রুশমি আমার পাশে থাকত। কিন্তু মেয়েটা অনবরত বলে যাচ্ছে সে আমাকে ভালোবাসে না বরং ঘৃণা করে। আমার ছায়াটুকু পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করতে সে নারাজ। তাহলে আমি লড়ব কার জন্য? কীসের জন্য? এদিকে জাহিদের অবস্থার কোনও উন্নতি হচ্ছে না। পাপার ওপেন হার্ট সার্জারি সাকসেসফুল কিন্তু এখনো ডাক্তারি পর্যবেক্ষণের ভেতরে আছে। ভেবেছিলাম এদিকটা একটু সামলে নিয়ে নিউইয়র্ক যাব। রুশমির সাথে আরো একবার সরাসরি কথা বলব। কিন্তু তার আগেই ওরা নিউইয়র্ক ছেড়ে হাওয়া হয়ে গেলো।
আমাকে আমার পরিবার থেকে বারংবার বলা হচ্ছে, যে মেয়েটি আমাকে দু পয়সার পাত্তা দিল না, বৈবাহিক সম্পর্ককে শ্রদ্ধা জানাতে পারল না। অকপটে, দৃঢ় চিত্তে জানিয়ে দিল সে আমাকে আর চায় না, ভালোবাসে না, অন্য একজনকে ভালোবাসে। সেই স্বার্থপর বেইমান মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য কেন আমি এতো ব্যাকুল হচ্ছি? আমার আজন্ম লালিত হৃষ্টপুষ্ট আকাশচুম্বী আত্মসম্মান বোধ এবং ইগো এখন কোথায় গেলো? আমার উচিত ওই মেয়েকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করা। কিন্তু জীবনকে ছাড়া জীবনযাপন করা যে রীতিমতন অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার এই সহজ কথাটা ওদেরকে আমি কী করে বুঝাই? ওরা তো জানে না, রুশানিয়াই আমার জীবন!
রুশমির পরিবার খুব দ্রুত ভার্জিনিয়া ছেড়ে টেক্সাস চলে গেলো। ওদের ভিয়েনার বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে। সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত এবং রহস্যময়। মম বলছে এখানে থাকলে আমি ওদের পরিবারকে বিরক্ত করব বলেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভীষণ অযৌক্তিক কথা। কারণ রুশমি চলে যাবার পর আমি আর একটা বারের জন্যও ওদের বাড়িতে যাইনি। পুলিশ রিপোর্ট করতে চেয়েছিলাম কিন্তু রুশমির বারণ উপেক্ষা করে কাজটা করতে পারিনি। সে আদেশ দিয়েছিল আমি যেন তার পরিবারকে কোনো রকম হেনস্থা না করি। বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের পেছনে তার পরিবারের কোনও হাত নেই। আবার আমি ভাবছি পুলিশ কেস করেও বা হবে কী? আমার স্ত্রী যদি নিজ ইচ্ছায় আমাকে ছেড়ে দিতে চায়, তালাক চায় তাহলে আইনের কোনো এখতিয়ার নেই তাকে বেঁধে রাখার। কিন্তু ঝুম্পা আপুর বলা সেই কথাটা আমার মনে পড়ে প্রায়ই। কেন সে আমার মায়ের দিকে আঙুল তুলেছিল? রুশমির অন্তর্ধানের পেছনে আমার মায়ের ভূমিকা কী হতে পারে?
রুশমি কোথায় আছে সেটা জানার কোনো উপায় নেই। কারণ তার ব্যাপারে কেউ আমাকে কিছু জানাবে না। সবাই বলছে সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। আমি যে শহরে আছি সেই শহরের প্রতিও নাকি তার ঘেন্না। এসব কথা শুনে আমার মাঝে মাঝে পাগল হবার দশা হয়, অভিমান হয়। মনে মনে ওকে ভুলে যাবার প্রতিজ্ঞা করি, ভুলে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করি। তবুও বুকের ভেতরের দগদগে ঘা শুকোয় না। উড়ো খবর শোনা যাচ্ছে রুশমি নাকি লিওকে বিয়ে করবে, তারপর লন্ডনে সেটেল্ড হবে। প্রথম বিয়ে বহাল থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে সে কী করে করবে সেটা একটা প্রশ্ন। আমাদের এখনো ডিভোর্স হয়নি। এর মাঝে একবার টেক্সাস গেলাম রুশমির পরিবারের সাথে দেখা করতে। রুশমির বাবার এমন বিনয়ী রূপ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আমাকে হাতজোড় করে বলল, ‘আমার মেয়ের সিদ্ধান্তের ওপরে আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। জোর করে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম। সে সুখী হয়নি। এখন সে তার সুখ খুঁজে নিতে চায়। তাই আমি তোমাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না। ক্ষমা করো আমাকে।’
আশ্চর্য ব্যাপার হলো রুশমি আমার জীবন থেকে সরে যাবার পর ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা যেন আরো বেশি ম্যাগ্নিফাইড হয়েছে, বিবর্ধিত হয়েছে। অনুভূতিরা এমন এক উঁচু তারে বাঁধা পড়ে গেছে যে, আমার সর্বক্ষণ মনে হয় ও আমার সাথেই আছে। ডিপ ডাউন ইনসাইড আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, ওর সাথে আমার আবারও দেখা হবে। খুব শীঘ্রই দেখা হবে। আমার প্রতিটা দিন শুরু হয় ওকে এক নজর দেখতে পাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, আর শেষ হয় দেখতে না পাবার ব্যর্থতা নিয়ে। আমি চাকরি করি না, জিমে যাই না। গান ছেড়ে দিয়েছি। পিয়ানোর রিডে ধূলো জমেছে। সারারাত নাইট ক্লাবে পড়ে থাকি, দিনে ঘুমাই। এ সংসারের কোনো মানুষের সাথে আমার যোগ নেই, কথা নেই, সম্পর্ক নেই। মমের ওপর এতো বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল যে মনে মনে ঠিক করেছিলাম আর কোনোদিন তার চোখে চোখ রেখে কথা বলব না। একদিন মম বলল, ‘শিহাব আমরা ঠিক করেছি তোমাকে আরেকটা বিয়ে দেব।’
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘মম, রুশমি চলে যাওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ। তাই না?’
মম একটু অপ্রস্তুতভাবে চুপ করে যায়। খুকখুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে ‘হ্যাঁ খুশি হয়েছি। এমন স্বার্থপর বেইমান মেয়ে তোমার জীবন থেকে চলে গেছে এটা স্বস্তির খবর। এবার দেখবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পাপা এই বিষয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইত না। একদিন শুধু আমাকে রাত করে বাড়ি ফিরতে দেখে বলল, ‘শিহাব, মানুষের জীবন একটাই। সেই এক জীবনের পরিসরটা অত্যন্ত ছোট। বাজে কাজে সময় নষ্ট করো না। সময় থাকতে জীবনটাকে গুছিয়ে নাও। নইলে শেষ জীবনে আফসোস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’
সাশা খুব বিরক্ত করে। এতো দুর্ব্যবহার করি তবুও মেয়েটা রাগ করে না, হাল ছাড়ে না। মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরে এসে ওকে লিভিং রুমে অপেক্ষারত অবস্থায় পাই। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেই বাড়ি থেকে। অপমান করি। লাভ কিছুই হয় না, পরদিন আবার এসে হাজির হয়। একদিন মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছি। দেখলাম খুব কাঁদছে। কেন কাঁদছে প্রশ্ন করতেই বলল, ‘তোমার কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না। চলো তোমাকে আমি রুশমির কাছে নিয়ে যাব।’
—‘তুমি জানো ও কোথায় আছে?’
—‘সঠিক জানি না। তবে একটা চান্স নিয়ে দেখতেই পারি।’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘কী হবে ওর কাছে গিয়ে? সেই একই কথাই তো বলবে, আমাকে ঘেন্না করে, আমাকে চায় না। সাশা, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া রুশমির এই আচরণের পেছনের কারণ টা ঠিক কী?’
সাশা চোখ নিচে নামিয়ে ঘাড় নাড়ে, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া। কিন্তু আমি তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তুমি নিজেই ওকে প্রশ্ন করো কেনো ও এরকম করছে?’
—‘তোমার কি মনে হয় এসবের পেছনে আমার মা কোনোভাবে রেস্পন্সিবল?’
সাশা একটু সময় চুপ থেকে দ্বিধা নিয়ে টাইপ করে মোবাইলে, ‘আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড, শি ইজ!’
দুহাজার পনেরোর শেষের দিকে সাশা আমাকে আলাস্কার একটা ছোট্ট গ্রামে নিয়ে গেলো। গিয়ে জানতে পারলাম আমরা যে, রাতে পৌঁছেছি তার ঠিক আগের দিন সকালেই রুশমি প্রস্থান করেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল দুহাজার আঠারোতেও। সাশার কথা মতো নর্থ ডাকোটা ছুটে গেলাম। পেলাম না রুশমিকে। এবার আমি মিসিং পার্সন কেস ফাইল করলাম। দুহাজার আঠারোর শেষ থেকে দুহাজার বিশের শুরু, এই দেড় বছরে পুলিশ ওর কোনো হদিশ পায়নি। সাশা বলেছে আগে মাঝে মাঝে রুশমি ওকে ফোন করত। কিন্তু আঠারোর নভেম্বর মাসের পর থেকে রুশমির কাছ থেকে সে আর কোনো ফোন পায়নি। দুহাজার ঊনিশের শুরুর দিকে আমি একবার টেক্সাস গেলাম। রুশমির মায়ের ঠিকানায় গিয়ে ওদেরকে পেলাম না। প্রতিবেশীদের কাছে জানতে চেয়ে খবর পেলাম ওরা টেক্সাস ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কেনো গেছে সেই তথ্য কেউ দিতে পারল না। বেদনার প্রদাহ সময়ের সাথে সাথে নিস্তেজ হয়ে আসে। মৃতের শোক ভুলে স্বজনরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। আমার ছোট ভাইয়ের পা ভেঙে গিয়েছিল কার অ্যাকসিডেন্টে, ঠিক সেই সময় আমার মনটাও ঠিক মাঝখান থেকে দোফালা হয়ে ভেঙে গিয়েছিল রুশমির অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্থান এবং প্রতারণায়। আমার ভাই ভাঙা পায়ের পরিবর্তে নকল পা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আমি কোনো নকল মন জোটাতে পারিনি। ভাঙা এবং আহত মন নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একসময় জীবনতরীর ছেঁড়া পালটা টেনে ধরতে হলো। দুহাজার বিশের শুরুর দিকে নিউইয়র্কের একটা অটোমোবাইল কোম্পানিতে চাকরি হলো। তখন করোনা মহামারির দুর্দান্ত প্রকোপ চলছে পৃথিবী জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে যে একটা চাকরি জুটেছে সেটা কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়। এমনিতেও অ্যাশবার্নের বাড়িতে আর মন টিকছিল না। পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। পাপা মম আমাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। রুশমির সাথে আমার এখনো ডিভোর্স হয়নি, এই ব্যাপারটা ওদের মাথায় ঢুকছে না।
ম্যানহাটনে ওয়ান বেডরুমের ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছি। তিন মাসের মাথায় সাশা কুপার এসে হাজির স্যুটকেস সমেত। আমি তো অবাক।
‘কী ব্যাপার? তুমি এখানে?’
ও নির্বিকারে বলল, ‘তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছিল না। তাই চলে এসেছি।’
মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম। ভার্জিনিয়ায় এই মেয়েটা আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি ওর উপস্থিতি কোনো মতেই আমার যন্ত্রণা লাঘব করছে না, বরং সীমাহীন বিরক্তির উদ্রেক করছে। সাশার চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো তার আত্মসম্মান বোধ বলতে গেলে প্রায় শূন্য। এটা কি শুধু আমার ক্ষেত্রেই নাকি গড়পড়তা সব মানুষের জন্যই সে এমন সস্তা এবং ঠুনকো তা আমার ঠিক জানা নেই। রুশমির অন্তর্ধানের পর প্রায় সাড়ে চার বছর কেটে গেছে। এই সাড়ে চার বছর ওর সাথে কম দুর্ব্যবহার করিনি। দুর্ব্যবহার করার মূল কারণ ছিল ওর গায়ে পড়া ভাব এবং অনধিকার চর্চা।
—‘শিহাব এতো বেশি ড্রিঙ্ক করছ কেন? এটা ঠিক না।’
–‘গান করো না কেন? গান করলে ভালোলাগবে। প্লিজ গানটা আবার শুরু করো।’
—‘জিমে যাও, তোমার শরীরে মেদ জমছে।’ ব্লা ব্লা ব্লা…
একদিন চুপচাপ বসে আছি আমার ঘরে। হঠাৎ সাশা হাজির হলো।
—‘পিয়ানো বাজাও, আমি শুনব।’
—‘মুড নেই।’ সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম।
—‘মুড লাগবে না। আমি বলছি, তুমি বাজাও।’
—‘জাস্ট গেট লস্ট! তোমাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে! তুমি বোঝো না কেন?’
ও নির্বিকার, ‘কিছু বুঝতে চাই না। তোমাকে আবার আগের মতো হতে হবে। যা হবার হয়ে গেছে। লেট্ ইট গো, অ্যান্ড মুভ অন!’
সেদিন ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করতে হয়েছিল। এসব পাকামো আর কোন ভাবেই সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু মেয়েটার ধৈর্য শক্তি দেখে অবাক না হয়ে পারি না। অপমান সহ্য করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে এই মেয়ের! মনে পড়ে না কবে ওর সাথে আমি হাসিমুখে কথা বলেছি। এহেন বিরূপ এবং বৈরী আচরণ সহ্য করেও সে কেন আমার পিছে পড়ে আছে দিনের পর দিন সে এক অজানা অপার রহস্য!
খুব কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। বেচারি এতটা পথ পাড় হয়ে এসেছে শুধুমাত্র আমার সাথে একটাবার সাক্ষাতের জন্য। এমতাবস্থায় দুর্ব্যবহার করাটা সমীচীন হবে না। এই প্রথম ওর জন্য আমার মনের ভেতরে একটু মায়া অনুভূত হলো। একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বিরক্তিটা হজম করলাম। ঠান্ডা ভাবে বললাম,
—‘তুমি কি কোনও হোটেলে উঠেছ?’
—‘না!’
—‘তাহলে কোথায় থাকবে? কদিনের জন্য এসেছ?’
—‘তোমার কাছেই তো আসলাম। তুমি আমাকে থাকতে দেবে না?’
—‘এই বাসায় একটাই বেডরুম। তুমি কোথায় থাকবে?
ও হলদে দাঁতের পাটি বের করে হাসল। ইশারায় বলল, ‘লিভিংরুমে থাকব, ডোন্ট ওরি।’
সেই যে এলো সাশা আমার একাকী ভাঙ্গাচোরা অগোছালো সংসারে অসময়ের অতিথি হয়ে, আর যাবার নাম করল না। আমি রোজই একবার ওকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা উপায়ে বুঝাবার চেষ্টা করি, বলার চেষ্টা করি, যে অনেক দিন তো হয়ে গেলো, এবার তোমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু এই মেয়ের গায়ের চামড়া গণ্ডারের চেয়েও শক্ত। আমার সমস্ত অবহেলা অপমান মুখ বুজে সহ্য করে গাঁট হয়ে পড়ে রইল দুই রুমের সেই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে।
ওর আগমনের ঠিক কদিন পরের ঘটনা তা স্পষ্ট মনে নেই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। লিভিং রুমের বাতি নেভানো। সাশা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। আমি আর বাতি জ্বালালাম না। অন্ধকারেই লিভিংরুম পার হয়ে ছোট্ট হলওয়ের সাথে লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা এক টানে খুলে ফেললাম। খোলার সাথে সাথে বেশ অপ্রস্তুত অবস্থার সম্মুখীন হতে হলো। সাশা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাথরুমে বাথটাব নেই। কাচ দিয়ে ঘেরা আলাদা শাওয়ার স্পেস আছে। দেয়ালে লাগানো সারি বাঁধা পাঁচটা হলদে বাল্বের ঝকঝকে আলোর জোয়ারে ওর নগ্ন শরীরটা আমার চোখের তারায় ঝলসে উঠল আচমকা। বেকায়দায় পড়ে বললাম, ‘ইউ শ্যুড হ্যাভ লকড দ্যা ডোর!’
দরজা আটকে বিব্রত মন নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এই অ্যাপার্টমেন্টটা বিশতলার ওপরে। রাত গভীরের নির্ঘুম আলো ঝলমলে ম্যানহাটনের অনেকখানি দেখা যায় বারান্দা থেকে। কতক্ষণ কেটেছিল জানি না। হঠাৎ টের পেলাম সাশা দু হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে আমার পিঠ জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েদের চোখ পড়তে পারার মতো যথেষ্ট বয়স এবং বুদ্ধি আমার হয়েছে। কিন্তু সাশা, যাকে কিনা আমি কখনো বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবিনি, তার কাছ থেকে এই আচরণ মেনে নেয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল আমার জন্য। আমি ওর হাতের বন্ধন ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে ফেলল ঠোঁটে। প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলেছিলাম কিন্তু ক্রমেই বিরতিহীন চুম্বনে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। রুশমি চলে যাবার পর থেকে কোনো মেয়েকে আমি ছুঁইনি। ছুঁতে পারিনি। মনের দাবির কাছে শরীরের দাবি বরাবরই পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। আমি দুটি হাত সাশার কাঁধের ওপর রেখে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘হোয়াট আর ইউ ট্রাইং টু ডু গার্ল? আই অ্যাম নেভার গননা লাভ ইউ! আই ক্যান্ট! ডোন্ট ইউ নো দ্যাট?’
সাশা আমার কথাগুলো শুনল না। কারণ ওর কানে হিয়ারিং এইড নেই। শোনার কোনো ইচ্ছে আছে বলেও অবশ্য মনে হচ্ছে না। আমার ঠোঁটে, গালে অনবরত চুমু খেয়ে যাচ্ছে। আমি রক্তে উষ্ণতার উচ্ছ্বাস টের পাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো আমারও বুঝি এবার মনটাকে অন্যদিকে ধাবিত করা প্রয়োজন। আই নিড আ ডিস্ট্র্যাকশন, অর রিবাউন্ড। রুশমি যদি আমাকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারে, তবে আমি কেন ভালো থাকার চেষ্টা করব না? আমি তো কোনো দোষ করিনি। কাউকে ধোঁকা দেইনি। রুশমির মতো মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয়ও করিনি। আই ডিজার্ভ টু লিভ! আমার বেঁচে থাকার শতভাগ অধিকার আছে। সাশার নুডলসের মতো কোঁকড়া ভেজা সোনালী চুলের গোছা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে অনেকটা অপ্রকৃতস্থর মতো বললাম, হোয়াট? ইউ ওয়ান্ট টু বি মাই ডিস্ট্র্যাকশন, রাইট? ওকে, বি মাই ডিস্ট্র্যাকশন! কথাটা বলতে বলতে আমি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসলাম বেডরুমে।
সকালে নাশতার টেবিলে ও আমাকে প্রশ্ন করল, ‘হু ইজ রুশানিয়া?’
বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগল। অনেকদিন হলো এই নামটার ওপর ধূলোর আস্তরণ জমেছে। কোনো কোনো একলা গভীর নির্ঘুম রাতে আমি বিস্তৃত খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকের অন্তঃস্থল থেকে রুশানিয়া! রুশানিয়া! বলে চিৎকার করে ডাকি। নির্বাক আকাশ শুধু ভর্ৎসনার চোখ মেলে চেয়ে থাকে আমার দিকে। সাড়া দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। এই নাম কখনো কেউ কোনোদিন উচ্চারণ করেনি আমার সামনে। আজ হঠাৎ নামটা শুনতে পেয়ে আমি স্তম্ভিতভাবে চেয়ে রইলাম সাশার দিকে। বেশ খানিকক্ষণ কিছু বলতে পারলাম না। একটা সময় অনেক কষ্টে প্রশ্ন করলাম,
—‘কেন জানতে চাইছ?’
—‘আজ ভোরবেলা ঘুমের মধ্যে এই নামটা ধরে ডাকছিলে বারবার।’
—‘তুমি কী করে শুনলে? তোমার তো শুনতে পাবার কথা নয়!
—‘আমি ড্যাডের সাথে ভিডিও কলে ছিলাম। কানে হিয়ারিং এইড ছিল।’ আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সিরিয়াল খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। তারপর আলতো গলায় বললাম, ‘রুশমিকে আমি রুশানিয়া ডাকতাম।’
সাশা বুদ্ধিমতী মেয়ে। চট করে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল, ‘অ্যাবাউট লাস্ট নাইট, ডিড ইউ লাইক ইট?’
আমি সিরিয়াল চিবোতে চিবোতে কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বললাম, ‘আই ডোন্ট নো! বাট আই থিঙ্ক আই কাইন্ড অফ নিডেড ইট! থ্যাংক ইউ!’
সাশা খুশি হয়েছিল আমার কথা শুনে। ভালো লেগেছিল আমার ওকে খুশি করতে পেরে। এই ভালোলাগায় কোনো পাপবোধ কাজ করেনি সেদিন। কিন্তু পাপবোধটা জন্ম নিলো কদিন পরে। যখন আমি হাড়েহাড়ে টের পেলাম ওকে শুধু শরীরটাই দিতে পারছি, মন দিতে পারছি না কিছুতেই। রাতের অন্ধকারে ওকে আদর করার সময় চোখের সামনে রুশমির মুখটাই ভেসে ওঠে বারংবার। মনে হয় যেন সাশা নয়, রুশমিই আছে আমার সাথে। বেডরুমের দেয়ালে রুশমির একটা ছবি টাঙ্গানো আছে। সাশা এঁকেছিল। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যেন ছবির ভেতর থেকে রুশমি আমার দিকে পলক তুলে চেয়ে আছে। ওর অদৃশ্য অস্তিত্ব সর্বক্ষণ আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এটা ঠিক হচ্ছে না। সহজ সরল বোবা কালা মেয়েটাকে আমি ঠকিয়ে যাচ্ছি। এই প্রতারণা ওর প্রাপ্য নয়।
দু-হাজার বিশ সালের নভেম্বরের এক তুষারাবৃত ঝকঝকে সাদা ভোরে আমি সাশার জন্য একটা নোট লিখে রেখে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পা বাড়ালাম।
‘ডিয়ার সাশা!
আমি জানি এই চিঠি পেয়ে তোমার মন খারাপ হবে। তোমাকে কষ্ট দিতে কেন যেন আমার একদম ইচ্ছে করে না! অনেক চেষ্টার পরেও ভাঙা মনটাকে পুনরায় জোড়া লাগাতে ব্যর্থ হলাম। কোনো পার্থিব বস্তুতে মন বসছে না। বুকের মধ্যে সারাক্ষণ এক ধূ ধূ শূন্যতা বিরাজ করে। এই শূন্যতাবোধের সঠিক কারণ আমার জানা নেই। তুমি তো জানো আমি রুশমিকে নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখছিলাম। লিখতে লিখতে একটা বিষয় অনুভব করলাম যে ওর সাথে আর একটাবার দেখা না হলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না। কোথায় পাব ওর হদিশ তা আমি জানি না। তবে আমার মন বলছে দেখা হবে। তোমার সাথে এই তিনটা মাস কাটিয়ে একটা সত্য খুব ভালোমতো অনুধাবন করতে পেরেছি। রুশমি হয়তো আমাকে কখনো সত্যিকারের ভালোবাসেনি, হয়তো সে আমাকে ঠকিয়েছে, কিন্তু আমি…, আমি জানি না ওর প্রতি যে অনুভূতিটা আমার হৃদয়ের গভীরে এখনো বেঁচে আছে সেটা ভালোবাসা, ঘেন্না নাকি প্রতিশোধ পরায়ণতা, শুধু জানি এই অনুভূতি ধ্রুব, অবিনাশী এবং অবিচল। রুশমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারী আমার হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবে না কোনোদিন! যদি পারত, তবে সেই নারী নিঃসন্দেহে তুমিই হতে!
সাশা কুপার! আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমিও তোমাকে একরকম ভালোই বেসেছি। কিন্তু পৃথিবীতে সব ভালোবাসার স্বরূপ তো একরকম হয় না। যে ভালোবাসা তোমার প্রাপ্য আমার পক্ষে সেই ভালোবাসা তোমাকে দেয়া কখনোই সম্ভব নয়। আমি মনেপ্রাণে চাই তোমার জীবনটা সবদিক থেকে পূর্ণতা পাক। আমি তোমার যোগ্য নই। প্রার্থনা করি যেন খুব শীঘ্রই তোমার জীবনে উপযুক্ত একজনের আগমন ঘটে। চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। চাকরি-বাকরি আমার দ্বারা আর হবে না মনে হয়। হাতে যে পরিমাণ টাকা আছে তা দিয়ে কতদিন টিকে থাকা যায় দেখা যাক। এরপর নাহয় একটা ব্যবস্থা করে নেয়া যাবে। এই অ্যাপার্টমেন্টটা ছ’মাসের জন্য লিজ নিয়েছিলাম। আগামীকাল লিজের কনট্র্যাক্ট শেষ হবে। তেমন কোনো জিনিসপত্র কেনা হয়নি। বিছানা আর লিভিংরুমের কাউচটা ট্র্যাশ করে দিও। কিংবা ক্রেগ লিস্টে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখতে পারো। নতুন জিনিস। বিক্রি করলে ভালো দামই পাবে।
আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষীটি! যদি পারতাম, তবে রুশমিকে ভুলে গিয়ে তোমাকেই ভালোবাসতাম। এমনটা হলে আমি বোধহয় এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতাম। কিন্তু ‘সুখ’ নামক স্বর্গীয় অনুভূতিটি এই জগতে সবার জন্য বরাদ্দ থাকে না। আমি সেইসব দুর্ভাগা মানুষদেরই একজন, যাদের কাছে সুখ হলো দূরের মরীচিকা। যাকে মাঝে মাঝে শুধু দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না!
ভালো থেকো সাশা … যতটা ভালো থাকা যায়!
পি এস : তোমার আঁকা রুশমির ছবিটা সঙ্গে নিয়ে গেলাম।
ইতি
শিহাব
১১/০৯/২০
দুহাজার বিশ সালের নভেম্বরের সাদা সকালটায় আমার নিরুদ্দেশ যাত্রার সূচনা যখন হলো, পৃথিবী তখন ভয়ঙ্কর অসুখে আক্রান্ত। বর্তমান প্রজন্ম শুধু এতকাল মহামারি বা অতিমারি শব্দগুলো শ্রবণ করে এসেছে। মহামারির দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও অনেকের কাছে এই ব্যাপারটি ছিল আদ্দিকালের রূপকথার দৈত্যের মতো, যা কোনো এক কালে ছিল। এখন আর নেই। তাদের ধারণা ছিল কলেরা, ইবোলা, স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মরণঘাতি ভাইরাস আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আকাশচুম্বী সাফল্যের কাছে কিছুতেই মাথা উঁচু করে টিকতে পারবে না। বর্তমান প্রজন্মের এই প্রযুক্তি ভিত্তিক অহংবোধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোভিড নাইনটিন নামের একটি ছোট্ট প্রাণঘাতি ভাইরাস, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী প্রায় সাত কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাইরাস অসংখ্য বার মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান এর সাথে লড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিষয়ে কারুরই সঠিক কোনো জ্ঞান নেই। সবাই যার যার মতো মনগড়া কথা বলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতেই চীন এই ভাইরাস উহানের ল্যাবে তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি গোপন ল্যাবে করোনা ভাইরাস তৈরি করেছে বিল গেটস, এরকম গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। এর কারণ হলো দুহাজার পনের সালে ভ্যাঙ্কুবারের এক কনফারেন্সে, বিল গেটস বলেছিল, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি কোনো কিছুর কারণে এক কোটি মানুষ মারা যায়, তাহলে কী হতে পারে? সেটি কোনো যুদ্ধের কারণে নয় বরং সংক্রামক ভাইরাসের কারণে হওয়ার শঙ্কাই বেশি। অতএব এই মরণঘাতি ভাইরাসের জন্য বিল গেটসকে দায়ী করা যায় অনায়াসে। মোদ্দা কথা হলো মারাত্মক দুঃসময়ে এসেও মানুষ তার চরিত্রের সহজাত দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। যে যেভাবে পারছে অন্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।
এই ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো এটি খুব সহজে সংক্রমিত হয়। আর এই সংক্রমণ ঠেকাতে পৃথিবীর মানুষকে রাতারাতি বদলে ফেলতে হয়েছে জীবনযাত্রার ধরণ। কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। অফিসের কাজ চলছে বাড়িতে বসে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করছে অনলাইনের মাধ্যমে। রেস্টুরেন্ট গুলোর ডাইনিং বন্ধ। শুধু টেক আউট চালু আছে তাও সব রেঁস্তোরা নয়। এর মাঝেই বেশ কিছু দোকানপাট মন্দার কারণে পুরোপুরি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও ছোট, মাঝারি বিভিন্ন ধরণের শিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিশ্বের অর্থনীতি হুমকির মুখে। সব মিলিয়ে দুহাজার বিশ সালটা পৃথিবীবাসীর কাছে একটি বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভয়াল দুঃস্বপ্নের বিরুদ্ধে কী করে লড়তে হবে কেউ জানে না। তবুও সবাই যার যার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমেরিকায় এই পরিস্থিতিকে নিউ নরমাল হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। যেন এই নব পরিবর্তিত, ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রাকে মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে শেখে।
যে কোনো পাবলিক প্লেসে মাস্ক ছাড়া যাওয়া বারণ। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব স্থাপন করাই করোনা ভাইরাস মোকাবেলার প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা কার্যকরী পদক্ষেপ। আমি এমনিতেই খুব একটা সোশ্যাল নই। রুশমি চলে যাবার পর থেকে আমার সামাজিকতার গণ্ডিটা যেন আরো ছোট হয়ে গেছে। চেনাজানা অনেক পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে সম্পর্ক ছুটে গেছে। আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও যোগাযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। বাঙালিরা জন্মগতভাবেই একটু গায়ে পড়া স্বভাবের হয়ে থাকে। রুশমির সাথে আমার বিচ্ছেদ নিয়ে বন্ধু এবং আত্মীয় মহলে সীমাহীন প্রশ্ন এবং কৌতূহল বিদ্যমান আছে। দৈবক্রমে কারো সামনে পড়ে গেলেই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে রুশমির কথা টেনে নিয়ে আসে। এমনকি শুভ্রার সাথে আমার প্রণয়ঘটিত সম্পর্কই নাকি এই বিবাহ বিচ্ছেদের একমাত্র কারণ, এমন গুজবও রটিয়ে গেছে। ওদিকে শুভ্রা এক মস্ত বড়োলোক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড হয়েছে বছর দেড়েক হলো। সে যাই হোক, বাঙালিদের আমি বলতে গেলে বেশ একটু এড়িয়েই চলি আজকাল। তাই করোনা ভাইরাসের কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা আমার জন্য তেমন পীড়াদায়ক বিষয় নয়। ইদানিং মৃত্যু সম্পর্কেও একটা উদাসীনতা কাজ করে আমার ভেতরে। মাঝে মাঝে মনে হয় এতো লোক করোনায় মরছে, আমি মরি না কেন? তবে একথা শুনে কেউ আবার ভেবো না যে আমি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করছি না। খুব নিপুণ ভাবেই সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে চলছি কারণ আমার এক মুহূর্তের অসতর্কতা হয়তো অন্য মানুষের প্রাণ নাশের কারণ হতে পারে। আমি হয়তো অ্যাসিম্পটমিক। আমার কোনো উপসর্গ নেই। কিন্তু নীরবে এই ভাইরাস আমার শ্বাসনালিতে বাসা বেঁধেছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বাতাসে ছড়াচ্ছে এবং আক্রান্ত করছে বৃদ্ধ কিংবা দুর্বল রোগপ্রতিরোধ সম্পন্ন কোনো মানুষকে। অতএব সর্বাবস্থায় আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে সুসংবাদ হলো এর মাঝেই ভ্যাক্সিন এসে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার এবং বিভিন্ন ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা ভ্যাক্সিন পেয়ে গেছে। তবে এই ভ্যাক্সিন কতটা কার্যকরি হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। গত কয়টা মাস গোটা দেশজুড়ে চলেছে নির্বাচনী প্রচারণা। তেসরা নভেম্বর সংগঠিত হলো ৫৯তম চতুর্বার্ষিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী জো বাইডেন। ট্রাম্প সাপোর্টাররা এই বিজয় এখনো মেনে নিতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল চলছে। দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
ওদিকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। এর মাঝেই বেশকিছু পরিচিত জনের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি। আমার এক ডাক্তার বন্ধু সপরিবারে আক্রান্ত। গতকাল ওর বাবা মারা গেছে। আমি কোনও সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে যুক্ত নই, তবে জাহিদ বলেছে ফেসবুকে রোজ কেউ না কেউ প্রিয়জন হারানোর সংবাদ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে বাস করছি আমরা। কখন কার প্রাণ যাবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এখনই সচেতন না হলে বাংলাদেশে ইতালি কিংবা চায়নার মতো শোচনীয় অবস্থা হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।
ভার্জিনিয়ার দিকে যাবার ইচ্ছে ছিল না। আমি গাড়ির জিপিএসে কোনো ডেস্টিনেশন সেট করিনি। কিন্তু আমার গাড়ি কোনো এক অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তির কবলে পড়ে ভার্জিনিয়ার দিকেই যাচ্ছে। পাঁচ ঘণ্টা টানা ড্রাইভ করে অ্যাশবার্ন এসে পৌঁছলাম। মম আমাকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলল। মানুষ যত বড় দুঃসময়ই পার করুক না কেন প্রিয়জনের আনন্দ তাকে সবসময় সুখী করে তুলবে, এটাই স্বাভাবিক। যেদিন করবে না, সেদিন বুঝতে হবে তার মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে। মায়ের আনন্দ অশ্রু দেখে আমার মনের ভেতর যে ক্ষীণ স্বস্তির শিহরণটা বয়ে গেলো তাতে বুঝলাম মনুষ্যত্ব এখনো সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি আমার ভেতর থেকে। অনেকদিন বাদে আমি মমের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললাম। আজ ছুটির দিন। পাপা, জাহিদ বাড়িতে আছে। ছোটমামা এসেছে। আমরা ড্রইংরুমে বসে কথা বলছি। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রেসিডেন্সি ইলেকশন এবং করোনা ভাইরাস। টিভিতে ডেইলি শো চলছে। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে নানারকম রসিকতা করা হচ্ছে। আমরা কথার ফাঁকে ফাঁকে টিভি দেখছি, হাসছি, চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি মম কিচেনে রান্না করছে। গরুর মাংস ভুনার সুগন্ধে ভরে উঠেছে সারা বাড়ি। আমার মনে হচ্ছে আমি দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে বাংলায় কথা বলছি, বাঙালি খাবারের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আমার বোধহয় একটু একটু ভালোই লাগছে। কিন্তু ভালোলাগা আর বিষাদ এই দুই বিপরীতমুখী অনুভূতি কী রকম ওতপ্রোতভাবে একইসাথে মিলেমিশে বুকের ভেতর বাসা বাঁধতে পারে তা আমার চাইতে যথার্থ রূপে মনে হয় কেউ জানে না। পারিবারিক মজলিশে ঘরভর্তি প্রিয়জনের মাঝে বসে থেকেও একটা অস্বাভাবিক শূন্যতাবোধ আমার ভেতরটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, বুক মোচড় দিচ্ছে। সব আছে, সবই তো আছে আগের মতো! তবুও কী যেন একটা নেই! কী নেই? কী নেই? সেই মানুষটা নেই, যে মানুষটাকে একটা সময় আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম! সে চলে গেছে, অথচ তার স্মৃতি এখনো এ বাড়ির আনাচে কানাচে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো সেই ভূতগুলোকে শুধু আমিই দেখতে পাচ্ছি, অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ঐতো পাপা যে কাউচটায় বসে আছে, আমার মুখোমুখি, ওখানে আমি এখন পাপাকে দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাচ্ছি রুশমিকে। ওর পরনে আকাশি রংয়ের টপ, সাদা ঘেরওয়ালা স্কার্ট। আমার এই মুহূর্তে সঠিক মনে পড়ছে না ওটা কোন মাস, কী বার বা কত তারিখ। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি সদর দরজার সামনে। এক্ষুনি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। টুলে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছি। রুশমি কাউচে বসে মনোযোগ দিয়ে দাঁত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ খুঁটছে। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজকে আমাদের বাসায় ডিনার করতে বলেছে আম্মুজান। তুমি অফিস থেকে ওখানে চলে যেও, ভিয়েনা।’
আমি মুখ তুলে তাকালাম। ও মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। কোমর পর্যন্ত ঝুলে থাকা চুলগুলো বুকের ডানপাশে জড়ো করে রাখা। বাম কানের লতিতে স্বর্ণের একটা ছোট্ট দুল। যেখানে ও বসেছে তার ঠিক পেছনের জানালাটার একটা পাল্লা খোলা। খোলা জানালা পেরিয়ে সকাল বেলার আলসে রোদ হামাগুড়ি দিয়ে এসে পড়েছে ওর সিল্কের মতো নরম ঝরঝরে চুলে, গালে আর গোলাপি রংয়ের পাতলা অধরের নিচের চিবুক ঘেঁষা ছোট্ট তিলে। চোখের কোল ফোলা। লম্বা পাঁপড়ি ঘেরা জন্মকাজল দুটি চোখ এখন আরো বেশি সতেজ, আরো বেশি সুন্দর। আমার এখন আর অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। মন চাইছে এখানটায় সারাদিন বসে থাকি, আর চুপচাপ ওকে দেখি। ওকে যে সুন্দর লাগছে এই কথাটা মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি বলব না। কারণ আমাদের এখনো পুরোপুরি ভাব হয়নি। হবো হবো করছে। ওর আকাশ ছোঁয়া অহংকার এখনও আমার গাত্রদাহের কারণ হয়। এমনিতেই সে নিজেকে রানি ভিক্টোরিয়া মনে করে। হুট করে প্রশংসা করে বসাটা বোকামি হবে।
—‘কী হলো?’ রুশমি প্রশ্ন করল ক্যাটক্যাট করে।
—‘কী হবে?’
—‘তাকিয়ে আছ কেন?
—-’আমার ইচ্ছা!’
ও গোলাপের পাপড়ির মতো সুন্দর দুটি ঠোঁট অদ্ভুতভাবে বাঁকায়, তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
—‘বাজে!’
—‘মানে কী?’ আমার জুতোর ফিতে বাঁধা শেষ। উঠে দাঁড়িয়েছি বসা থেকে।
— মানে, বাজে লোকেরা মেয়েদের দিকে এরকম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।’
—‘তুমি কি মেয়ে নাকি?
এই প্রশ্নে রুশমি একদম সাপের মতো ফোঁস করে উঠল, ‘তো আমি কী? কী মনে হয় তোমার?’
হেসে ফেললাম, দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার আগে আলতো গলায় বললাম, ‘তুমি আমার বৌ!’
রুশমি কথাটা শুনতে পায়নি। ওর সেলফোন বেজে উঠেছে। রিংটোনের শব্দে ঢাকা পড়ে গেছে আমার গলার স্বর। একটা ঝকঝকে কাচের গ্লাস ঝলক দিয়ে উঠেছে চোখের সামনে। মম দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ধরা গ্লাসে বাদামের শরবত। আমি ঘোর লাগা চোখে গ্লাসটার দিকে চেয়ে আছি। নড়তে পারছি না। কিছু বলতেও পারছি না। আমার মনটা চেতন অবচেতনের মাঝবরাবর আটকে গেছে। রুশমি এখনো আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়নি। একই সাথে আমি পাপা মম, জাহিদ এবং ছোটমামাকে দেখতে পাচ্ছি। পাপা যে কাউচে বসে আছে তার ঠিক সামনেই রুশমি দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত রেখে, ঝগড়াটে ভঙ্গিতে। ওর দিকে চেয়ে থেকেই আমি মমের হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা তুলে নিলাম। অথচ এই দুটি দৃশ্য একত্রে অবস্থান করাটা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ মম এবং বাদামের শরবত বর্তমান আর রুশমি অতীত। দুটি সময়ের ডাইমেনশন সম্পূর্ণ ভিন্ন। মনোবিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত মানসিক অবস্থার কী নাম দেবে আমি জানি না। আমার নিশ্চয়ই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
খাওয়াদাওয়ার পর আমার বেডরুমে এসে বসেছি। পিয়ানো বাজাই না বহুদিন। ইচ্ছেও করে না। খোলা জানালা দিয়ে উইলো ফরেস্টের লম্বা লম্বা গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে। যা কিছু অবশিষ্ট আছে দুদিন পরে তাও থাকবে না। পত্রপল্লব বিহীন রুক্ষ প্রান্তর সাদা তুষারে ঢেকে যাবে। এমনই এক শীতের দিনে রুশমি এ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিল। ঠিক তার পরের শীতকালেই মেয়েটা আমার জীবন থেকে চিরতরে উধাও হয়ে গেলো। আশ্চর্য!
ছোটমামা আমার ঘরে প্রবেশ করেছে। আমি ডেস্ক সংলগ্ন চেয়ারে বসে আছি। আমার মুখের সামনে ল্যাপটপটা খোলা। ছোটমামা আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপের পর্দার দিকে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কী লিখছিস?’
আমি একটু অপ্রস্তুত গলায় বললাম, ‘তেমন কিছু না।’
—‘জীবন কাহিনী?’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম, ‘যা একটা জীবন! তার আবার কাহিনী!’
-–‘ভালোই তো লিখছিস! এতকাল জানতাম শুধু গান লিখিস। গদ্য রচনা শুরু করেছিস কবে থেকে?’
আমি চুপ করে আছি। মাথাটা নিচু। বিছানার ওপর বসতে বসতে মামা বলল, ‘লেখাটা আমাকে পাঠাস তো, পড়ে দেখব।’
—‘কেন?’
—এতো ভালো লেখা এমনি এমনি রেখে দেয়া কি ঠিক হবে? পাবলিশ করার ব্যবস্থা করব।’
—‘ধুর, কী যে বলো। এসব আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত কিছু কথা। তাছাড়া তেমন ভালো কিছুও হয়নি যে পাবলিশ করতে হবে।’
অ্যাশবার্নের বাড়িতে আমার মন টিকল না। প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে যেন রুশমির ছোঁয়া লেগে আছে। ওর স্মৃতি আমাকে স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না। অথচ যে মানুষটা আমার সাথে প্রতারণা করেছে, ব্যবহার করা পুরনো জিনিসের মতো ট্র্যাশ করে দিয়েছে, ছেড়ে যাবার সময় চোখে চোখ রেখে দৃঢ়চিত্তে বলে গেছে সে আমাকে ঘৃণা করে, আমার ঊনত্রিশ বছরের জীবনে যে এসেছিল শুধুমাত্র পাঁচটি মাসের জন্য ক্ষণিকের অতিথি হয়ে, সেই মানুষটাকে এতদিন পরেও মনে রাখা, তার স্মৃতিতে কাতর হওয়া চরম আহাম্মকের কাজ। নিজেকে আমার মাঝেমাঝে নিরেট মূর্খ বলে মনে হয়।
ভোরবেলা অ্যাশবার্ন ছাড়লাম। পাপা মমকে কিছু না জানিয়েই। জানি না কীসের আশায় কোথায় ছুটে চলেছি। কোনো স্থানে, কোনো মানুষে, কোনো বিনোদনেই আমার আর মন লাগে না। আমাকে শুধু ছুটে চলার তীব্র নেশায় পেয়েছে। রাত দিন গাড়ি চালাচ্ছি। মন চাইলে থামছি। রাস্তার ধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছি। সিগারেট ফুঁকছি। ড্রিঙ্ক করছি না। কারণ ড্রিঙ্ক করলে গাড়ি চালাতে সমস্যা হবে। ফোনের চার্জ খতম হয়ে গেছে। তবে মোবাইল ছাড়া চলাফেরা করতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। এই অনির্দিষ্ট কালের যাত্রাপথে আমি একটা বিষয় সুচারুরূপে অনুভব করলাম যে, সংসার থেকে আমার পুরো দমে মন উঠে গেছে। আজ ভাবতে গেলে অবাক হই যে, এই আমিই এক সময় বাবা-মায়ের বাধ্য, ভদ্র, অনুগত সুপুত্রটি ছিলাম। আদর, স্নেহ, ভালোবাসা আর মাধুর্যে পরিপূর্ণ একটা জীবন ছিল আমার। মাথার ওপরে নিরাপদ ছাদ ছিল, দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন ছিল, গলায় গানের সুর ছিল, মনের ভেতর কবিতা ছিল। সময় কাটানোর মতো চমৎকার কিছু মনের মতো বন্ধু ছিল! অথচ এসব পার্থিব সুখ থাকা না থাকায় আমার আর এখন কিছুই এসে যায় না। এটা নিশ্চয়ই খুব একটা বাহাদুরির কথা নয়। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা একটা সাজানো গোছানো ছিমছাম নিশ্চিন্ত জীবনের জন্য তড়পাচ্ছে, স্ট্রাগল করছে। আমি যা না চাইতেই পেয়ে গেছি অনেকের কাছে তা দূর দ্বীপে পড়ে থাকা স্বপ্নের হীরকখণ্ড। দুনিয়াটা এমনই। লোকে যা পায়, তার মূল্য দিতে জানে না। যা পায় না, তার পেছনে হাহাকার করে মিছিমিছি নষ্ট করে মূল্যবান সময়। এ মুহূর্তে আমিও তাইই করছি। জেনে বুঝে সজ্ঞানে নষ্ট করছি একটিমাত্র অমূল্য জীবন। কী করব, জীবনটা যে আমার ভালো লাগছে না! বোঝার মতো লাগছে!
একে তো শীতকাল, তার ওপর অতিমারির প্রকোপ। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সর্বত্রই জনমানবহীন নিস্তেজ প্রান্তর। তবে চিরায়ত এই প্রকৃতিকে দেখে কে বলবে যে, পৃথিবী এমন গুরুতর অসুখে ভুগছে। বরং মানুষের পদচারণা কমে যাওয়ায় মাদার নেচার তার প্রকৃত স্বরূপ ফিরে পেয়েছে। তখন মধ্যরাত। টেনেসির গ্যাটলিনবার্গের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছি। খিদে পেয়েছে কিন্তু ধারে কাছে কোনো রেস্টুরেন্ট আছে কিনা জানা নেই। গাড়ির জিপিএস কাজ করছে না। নেটওয়ার্ক নেই। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে উঁচুতে। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর চোখে পড়ছে না। ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে। গাড়িটা কোথাও রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারি অনায়াসে। কিন্তু খিদে পেটে নিয়ে ঘুম আসবে না। কোথায় যাব, কী করব বুঝতে পারছি না। এমন সময় হঠাৎ আকাশ থেকে তুলো ঝরতে শুরু করল। মুহূর্তের মধ্যে সাদা হয়ে উঠল চারপাশ। কিছুই আর দেখা যায় না। তুষার ঝড়ের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো মারাত্মক বিপজ্জনক। তাছাড়া আমার তো কোথাও যাবার তাড়া নেই। কেউ আমার জন্য কোথাও অপেক্ষা করে নেই। বিনা কারণে এই বিপজ্জনক রাস্তায় গাড়ি চালানোর কোনো মানে হয় না। রাস্তার ধারে ইমার্জেন্সি লাইট অন করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই তুষার ঝড় কখন থামবে কে জানে! ইন্টারনেট নেই, জি পিএস নেই, পেট ভরানোর
Cor
জন্য খাবারও নেই। গাড়ির হিটার অন করে কপর্দকশূন্য অবস্থায় বসে আছি। চারপাশ নিস্তব্ধ। চিঁচিঁ করে তুষার ঝরার শব্দ হচ্ছে শুধু। এখন যে রাস্তায় আমি আছি এর এক পাশে গভীর খাদ, অন্য পাশে পাহাড়। মনে হচ্ছে যেন আমি বাদে কোনো দ্বিতীয় মানুষের উপস্থিতি নেই এই তল্লাটে। রাত জাগা নিস্তব্ধ বনস্থলী আর পাহাড়ের বুকে সাদার জোয়ার নেমেছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। আমার জানালার কাচে ধাক্কা পড়ছে। তুষারে ঝাপসা চারিদিক। কিছুই দেখা যায় না। বুকটা হালকা কাঁপল। এই নির্জন মাঝরাস্তায় ঘোরতর তুষারপাতের ভেতর কে আমার জানালায় টোকা দিচ্ছে? পুলিশ নয়তো? কিন্তু পুলিশের লাইট তো চোখে পড়ল না! জানালার কাচ নামালাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি লম্বা ছায়ামূর্তি মুখ নামিয়ে এনে বলল, ‘একটু হেল্প করবে? আমরা খুব বিপদে পড়েছি।’
লক্ষ্য করলাম লম্বা ছায়ামূর্তির পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। নাক পর্যন্ত হুডি টানা। শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে।
—‘কী হেল্প চাই?’
—‘গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। হিটার কাজ করছে না। শীতে মারা যাচ্ছি প্রায়। তোমার গাড়িতে বসতে দেবে?’
একটু দ্বিধা নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। দ্বিধাটা কোত্থেকে আসছে বুঝতে পারছি না। দুটা মানুষ বিপদে পড়েছে, সাহায্য করাটাই নৈতিক কাজ। কিন্তু যদি এরা ডাকাত হয়? ছিনতাইকারী হয়? খুনি হয়? পাহাড়ি নির্জন রাস্তায় খুন করে রেখে গেলে সকাল অবধি কেউ টের পাবে না। ফোনটা চার্জশূন্য। বিপদ হলে নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করব সেই উপায়ও নেই। পরমুহূর্তে ভাবনারা রং বদলায়। এমন কোনো মহামূল্যবান জিনিস আমার সাথে নেই যা ছিনতাই হয়ে গেলে খুব বড় ক্ষতি হবে। একটা নগদ টাকাও আমার সঙ্গে নেই। ক্রেডিট কার্ড চুরি করে লাভটা কী হবে? ব্যাংকে ফোন করে কার্ড ক্লোজ করে দেব। আর যদি মাতলামোর বশে আমাকে খুন করে ফেলে তাতেও কিছু এসে যায় না। আমার ভেতরে জীবনলিপ্সা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মরতে পারলে বেঁচে যাই!
—‘উঠে বসো পেছনে।’ দরজার লক খুলে দিয়ে আদেশ করলাম ওদের।
হুড়মুড় করে পেছনের সিটে উঠে পড়ল মানুষ দুজন। একটি নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে! তুমি একজন জীবনরক্ষক!
গলাটা চেনা চেনা লাগল। কোথায় যেন শুনেছি এই কণ্ঠস্বর। বাতি জ্বালিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম পেছনে। মেয়েটি মাথার হুডি ফেলে দিয়েছে। উষ্কখুষ্ক কালো রংয়ের খোলা চুল। শীতে জমে যাওয়া ফর্সা লালচে গাল। হ্যাঁ, এই মুখটা আমি আগে কোথাও দেখেছি, কোথায় যেন দেখেছিলাম? ঠিক মনে পড়ছে না তো!
মেয়েটির চাউনি দেখে মনে হলো সেও আমাকে চিনতে পেরেছে, ‘তুমি?, কেমন আছ?’
ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আমাদের কি আগে কখনো দেখা হয়েছিল?’
—‘তুমি চিনতে পারনি আমাকে?’
—‘চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না।’
—‘ক্যালিফোর্নিয়ায় দেখা হয়েছিল তোমার সাথে, একটা স্ট্রিপক্লাবে।’
মনে পড়ল। বছর পাঁচেক আগে ক্যালিফোর্নিয়ার এক স্ট্রিপক্লাবে মেয়েটির সাথে পরিচয় হয়েছিল। ম্যাক্স একে জোগাড় করেছিল আমার জন্য। আমি ওর নাম ভুলে গেছি। এমনকি সে স্মরণ করিয়ে না দিলে এটাও হয়তো মনে করতে পারতাম না ঠিক কোথায় কী পারপাসে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি হেসে বললাম, ‘বাহ চমৎকার! আবার দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। পৃথিবীটা সত্যিই খুব ছোট!’
মেয়েটি বলল, ‘ওর সাথে মিট করো। আমার বয়ফ্রেন্ড, স্যাম।’
পাশে বসা পুরুষটির দিকে তাকালাম। বেশ লম্বা চওড়া ষণ্ডা চেহারা। গালে সোনালী দাড়ি। হাতের কব্জিতে উল্কি আঁকা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোমরা এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিলে?’
মেয়েটি বলল, ‘কাছেই আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি আছে। ওখানেই যাচ্ছিলাম। এখান থেকে দু তিন মাইল দূরে হবে।’
—‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে পৌঁছে দিতে পারি গন্তব্যস্থলে। কিন্তু তোমাদের গাড়ির কী হবে?’ ভদ্রতাসূচক প্রস্তাব রাখলাম। পুরুষটি এতক্ষণে কথা বলল, ‘তুমি যদি আমাদের নিয়ে যেতে পার তো খুব ভালো হয়। এতো রাতে এমনিতেও মেকানিক পাব না। গাড়ি এখানে থাকুক। ভোরবেলা আমি মেকানিক ডাকব।’
অগত্যা, ওদের দেখানো পথে চলতে শুরু করলাম। তুষার ঝড়ের মধ্যে পাহাড়ি খাঁজ কাটা রাস্তায় চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সাবধানে ড্রাইভ করতে হচ্ছে। তবে একদম চুপচাপ বুনো রাস্তায় ভূতের মতো বসে থাকার চাইতে মানুষের উপকার করতে পারাটা আমার কাছে স্বস্তির। গন্তব্যস্থল খুব বেশি দূরে নয়। মাইল খানেক চলার পরেই রাস্তার ধারের একটা বাড়ির সামনে থামতে হলো। ছেলেটি বলল, ‘তোমরা একটু বসো। আমি দরজা নেড়ে দেখি ওদের ঘুম থেকে জাগানো যায় কিনা। ফোন করছি, ফোন ধরছে না।’
ছেলেটি গাড়ি থেকে নেমে যাবার পর আমি মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমরা আসবে এই খবর তোমাদের বন্ধু জানে না?’
মেয়েটি একটু সামনের দিকে ঝুঁকল। গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘তুমি গাড়ি স্টার্ট দাও।’
চমকে উঠলাম, ‘মানে?’
—‘সময় নষ্ট করো না। যা বলছি তাই করো!’
—‘কিন্তু তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
—লেট হিম রট ইন হেল! আমি ওর হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই। প্লিজ তুমি গাড়ি চালু করো।’
লক্ষ্য করলাম মেয়েটির পুরুষ সঙ্গী বাড়ির পর্টিকোতে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ছে। সদর দরজা খোলা। অতএব মালিক জেগে উঠেছে। আমরা এখন অনায়াসে এই বাড়ির অতিথি হতে পারি। কিন্তু মেয়েটির কথায় আমি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। এই শীতের রাতে একটা আশ্রয় পাওয়া গেছে সেটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার। আশ্রয়স্থল ফেলে রেখে পুনরায় রাস্তায় নেমে পড়ার কোন মানে হয়? বললাম, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড তো তোমাকে ডাকছে!’
—‘ডাকুক! তুমি প্লিজ আমাকে বাঁচাও। চলো চলো! তাড়াতাড়ি করো!’
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি। কী করা উচিত বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি চাপা গলায় বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ? তোমার ভয়ের কিছু নেই। আমি নিজ ইচ্ছেয় তোমার সাথে যাচ্ছি। কেউ তোমাকে কিডন্যাপার বলবে না।’
একটা বড় শ্বাস টেনে নিলাম। যে মানুষের জীবনের মায়া নেই, বেঁচে থাকার প্রতি আকর্ষণ নেই, তার আবার ভয় কীসের? কিডন্যাপার মনে করে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেলেও আসলে কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না। বরং মেয়েটির কথা যদি সত্য হয়, যদি সত্যিই তার বয়ফ্রেন্ড বিপজ্জনক লোক হয়ে থাকে, তাহলে আমার উচিত একে সাহায্য করা। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে বললাম, ‘আমার ভয় কীসের? হোয়াই উড আই কেয়ার? ইওর ডিসিশন, নট মাইন!’
গাড়ি ঘুরে যেতে দেখে মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড হইহই করে তেড়ে আসছে। দৌড়োচ্ছে গাড়ির পেছন পেছন। উচ্চস্বরে কিছু একটা বলছে। বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। মেয়েটি আমার কানের কাছে চ্যাচাচ্ছে, ‘ড্রাইভ ফ্যাস্ট! ইয়েস, উই ডিড ইট!’
তুষার ঝড় থেমে গেছে এখন কিন্তু পিচ ঢালা রাস্তায় বরফ জমে গেছে। দ্রুত গাড়ি টানতে গিয়ে গাড়ির চাকা পিচ্ছিল রাস্তায় স্লিপ করল দু একবার। আমি বললাম, ‘দ্যাখো তোমার বয়ফ্রেন্ড যদি গাড়ি নিয়ে আমাদের পিছু নেয় তাহলে খুব সহজেই ধরে ফেলবে। কারণ এই আবহাওয়ায় দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মেয়েটা নির্বিকার গলায় বলল, ‘চিন্তা করো না। ওই লোক গাড়ি নিয়ে পিছু করবে না। অত গরজ নেই তার।’
—‘তুমি শিওর?’
—‘হ্যাঁ শিওর। তুমি আস্তে ধীরে গাড়ি চালাও। এখন আর তাড়াহুড়ার কিছু নেই।’
আমি বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে মেয়েটার দিকে একবার তাকালাম। সে বলল, ‘আর ইউ ফিলিং নার্ভাস?’
—‘নো আই অ্যাম নট নার্ভাস। জাস্ট আ লিটল কনফিউজড।’
—‘হোয়াই?’
—‘দ্যাট ওয়াজ ইওর বয়ফ্রেন্ড, রাইট?’
—‘রাইট। দ্যাট ওয়াজ মাই বয়ফ্রেন্ড। দ্যা ব্যাড ওয়ান!’
—‘কোথায় যাবে তুমি? কোথায় ড্রপ করব তোমাকে?’
মেয়েটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে গদির পিঠে হেলান দিল, ‘আই হ্যাভ নো প্ল্যান। জাস্ট গো হোয়্যারেভার ইউ ওয়ান্ট টু গো।’
আমার গলার স্বর উঁচুতে উঠে গেলো, ‘এটার মানে কী? তোমার কোথাও যাওয়ার নেই? স্ট্রেঞ্জ!’
—‘আপাতত কোন গন্তব্য নেই। তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
আমি গমগম করে বললাম, ‘জানি না!’
মেয়েটি যেন আমার উত্তরে খুব খুশি হয়ে উঠল, ‘তুমিও তাহলে আমার মতোই। ওয়েলকাম টু দ্যা ক্লাব! বাই দ্যা ওয়ে, হাও ইজ ইয়োর লাভিং ওয়াইফ? যার জন্য তুমি সেই রাতে আমাকে ইগনর করেছিলে? হোয়্যার ইজ শী?’
মনে মনে থমকালাম। অনেকদিন হয় আমার সামনে কেউ রুশমিকে নিয়ে কথা বলে না। ওর প্রসঙ্গ তোলে না। আজকে হঠাৎ প্রায় অপরিচিত এই মেয়েটি ফট করে ওর কথা বলে বসায় আমার শিরদাঁড়ায় কেন যেন কাঁটা ফুটে উঠল ক্ষণিকের জন্য। হৃৎপিণ্ডের গতি বর্ধিত হলো। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। স্টিয়ারিং থেকে হাত না সরিয়েই একটু নড়েচড়ে বসলাম। হিটার বাড়িয়ে দিলাম। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, ‘তোমার নাম কী?’
রুশমি
দিবস রজনি আমি যেন কার
আশায় আশায় থাকি
জাগরণে তারে না দেখিতে পাই
থাকি স্বপনের আশে
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়
বাঁধিব স্বপনপাশে
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
প্রায় সকালে ঘুম চোখে আধো চেতনার ভেতর আমি একটি মায়াবী দৃশ্য দেখতে পাই। আমি দেখি জানালার কার্নিশে একটি ছোট্ট লাল কার্ডিনাল উড়ে এসে বসেছে। কার্ডিনাল হলো ভার্জিনিয়ার জাতীয় পাখি। ভার্জিনিয়ার পথে, ঘাটে, বনে জঙ্গলে যেখানেই তুমি যাও না কেন, ছোট্ট লালচে ডানার অপূর্ব সুন্দর পাখিটা তোমার নজর কাড়বে। আমার জানালায় উড়ে এসে বসা কার্ডিনাল বাস্তবের নয়, স্বপ্নের। ও স্বপ্নের দেশ থেকে এসেছে প্রথম সূর্যের স্বর্ণ ধোঁয়া ঝকঝকে রোদ্দুর নিয়ে। হেম রংয়ের রোদটা জানালার কাচ টপকে এসে আমার ঘরের কাঠের মেঝে ছুঁয়ে দিয়েছে। ছুঁয়ে দিয়েছে বিছানার চাদর। আর ওই একগুচ্ছ স্বর্ণগলিত আভার ভেতর দিয়ে আমার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এসেছে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক যুবক। আমার পাশে বসেছে। কপালে আলতো ভাবে হাত রেখে মুচকি হেসে বলেছে, ‘গুডমর্নিং রুশানিয়া!’
এই যুবক আমার স্বামী। বছর পাঁচেক আগে, তার সাথে যখন আমার বিয়ে হয়েছিল, তখন সে দেখতে অসম্ভব রকমের সুদর্শন ছিল। ওরকম সুন্দর আমি শুধু হলিউডের সিনেমার পর্দায় দেখেছি, বাস্তবে দেখিনি। এখন সে দেখতে কেমন হয়েছে কে জানে! আমি তো তাকে দেখি না বহুদিন! এই সকাল বেলার স্বপ্নে সে চব্বিশ বছরের যুবকটিই রয়ে গেছে। একটা দিন বয়সও বাড়েনি।
ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে আজ দুহাজার বিশ সালের নভেম্বরের দশ তারিখ। আমি লিখতে বসেছি বহুদিন পর! মাঝের দুটো বছর কেমন করে যে কেটে গেলো! এই দুবছরে আমার একটা শব্দও লিখতে ইচ্ছে হয়নি। আর লিখবই বা কী? আমি তো আর পেশাদার লেখক নই। লিখতে গেলে ঘুরেফিরে নিজের জীবনের কথাই চলে আসবে। আমার জীবনে আর লেখার মতো আছে কী? আছে শুধুই শূন্যতা। এই শূন্যতার গল্প আর কত বলব? তাছাড়া লিখতে বসলেই দুহাজার পনের সালটা নীরব ঘাতকের মতো চুপিসারে এসে আমার স্মৃতির দরজায় হানা দেয়। আমি বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। যে স্মৃতিগুলো আমি ভীষণভাবে ভুলতে চাই, সে স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে বিনা আমন্ত্রণে ফিরে আসে। জট লেগে যায়। পিছন দিকে ফিরে তাকাতে চাই না তবুও মনটা পেছনের দিকে ঘুরে যেতে চায়।
দুহাজার আঠারোর শেষে সাশার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য বর্ডার ক্রস করে মেক্সিকো চলে গিয়েছিলাম। আম্মুজান জানালো শিহাব নাকি আমার নামে মিসিং পার্সন কেস ফাইল করেছে। তাই ইউ এস এ ফিরে আসার সিদ্ধান্ত স্থগিত করলাম। কয়েকমাস বাদে উড়াল দিলাম লন্ডনের উদ্দেশ্যে। ওখানে মাস্টার্স করলাম। আম্মুজান আমার সাথে ছিল। ছোট দুইবোন নিউইয়র্কে, ঝুম্পা আপুর তত্ত্বাবধানে। আমরা ভার্জিনিয়া ছাড়ার কিছুদিন পরেই ঝুম্পা আপুরা নিউইয়র্ক মুভ করেছিল। লন্ডনে লিও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। যে ছেলেটা এক রাতের বেলায় বন্ধুবেশে আমার শোবার ঘরে প্রবেশ করার অপরাধে বাবাজান আর ফুপি জোর করে আমার অমতেই আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ অচেনা অজানা এক পুরুষের সাথে, সেই ছেলেটাই লন্ডনের দিনগুলিতে আমাদের পরিবারের পরম বন্ধু হয়ে উঠল, হয়ে উঠল আম্মুজানের আস্থাভাজন। দিনগুলো খারাপ কাটেনি। লন্ডনে যাবার পর মনে হয়েছে আমার পলাতক জীবনের বুঝি সমাপ্তি ঘটল। কেউ আমাকে খুঁজছে না, ধাওয়া করছে না। আমার দুর্বিষহ কালো, কলঙ্কময় অতীত খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে না। সেরকম উৎসুক মানুষজনের উপস্থিতিই নেই এখানে। কর্মব্যস্ততা, পড়াশোনা এবং সর্বোপরি বিরতিহীন জীবনযুদ্ধে লিপ্ত থেকে সময় কেটে গেছে হু হু করে। যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও আমাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। যেসব আত্মীয়রা বাস্তবিক অর্থে কোনো উপকারে আসে না, বরং সুযোগ পেলেই দুর্বল জায়গায় আঘাত করে বসে সমবেদনার নাম করে, সেসব আত্মীয়র সাথে যোগাযোগ থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। আমার দুর্ঘটনার কথা বিস্তারিত কাউকেই বলা হয়নি কিন্তু শিহাবের মায়ের রটানো গল্পে অনেকেই বিশ্বাস স্থাপন করেছে। তাদের ধারণা আমি আমার স্বামীর সাথে প্রতারণা করে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় প্রেমিকের হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে গেছি। এবং আমার এই কুকীর্তির জন্য এসব নির্বোধ লোকেরা আমার বাবা- মায়ের অহংবোধকে দায়ী করছে। তাদের মতে ধর্মীয় চেতনা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে আমার বাবা-মায়ের আকাশচুম্বী অহংকারের কুফল হলাম আমি। সমালোচনার তীর আমার ফুপির দিকেও যে যায়নি তা নয়। আজীবন সংসারে রাজরাণীর মতো চলা মানুষটা আমার দুর্ঘটনা এবং নিজের একমাত্র আদরের ভাইয়ের বিয়োগের পর ভীষণ ভাবেমুষড়ে পড়েছিল। বাবাজান চলে যাবার ঠিক তিনমাস পর, ঈদের আগের রাতে রোগে শোকে জীর্ণ হয়ে মৃত্যবরণ করল ফুপি। এরপর থেকে আমাদের পরিবার অভিভাবক শূন্য। তিনটি যুবতী মেয়ে নিয়ে আম্মুজানকে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হলো। পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব অনেকখানিই আমার ওপরে বর্তায়। আমার ছোট দুটি বোন যেন সুস্থ এবং স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে, অতীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা যেন কোনোভাবেই ওদের মানসিক বিকাশে প্রভাব না ফেলে সেদিকে আমার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ। আমরা নিজেদের মতো করে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছি। পুরুষবিহীন জীবন যাপনে আমরা অভ্যস্থ। এদেশে নারীপুরুষের সর্বত্র সমান অধিকার। মেয়ে বলে কোথাও আমাদেরকে হেনস্থা হতে হয় না। অন্যরকম ট্রিটমেন্ট পেতে হয় না। আমরা মেয়ে হয়েও ঘরে বাইরের সমস্ত কাজ নিজ হাতে করছি, এবং পাশাপাশি নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করে চলছি। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, ভোরবেলায় কোরান তেলাওয়াত করি, ছুটির দিনে মা বোনরা বসে গল্প করি, অবসরে বই পড়ি। তবে নিজেদের গণ্ডির বাইরে যে মানুষগুলো আমাদের বন্ধু হয়েছে, বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সমন্বয়ে যে ছোট বৃত্তটি তৈরী হয়েছে জীবনকে ঘিরে, সেই বৃত্তের মানুষগুলোকে কোনো ভাবেই অসম্মান করার স্পর্ধা আমাদের নেই। আমার ছোট বোনরা বন্ধুবান্ধবীদের সাথে মেলামেশা করে, তাদের বাড়িতে যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এসব বিষয়ে কোনো বাঁধা নেই। কারণ আমাদের মনটা বাবাজানের আদর্শ মোতাবেকই গঠন হয়ে গেছে। আমরা জানি কখন কোথায় রাশ টেনে ধরতে হয়। আমার জীবনে সাবলম্বী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত আর কোনো চাওয়া নেই। শৌখিন সুখ দুঃখ মেশানো মনটার ওপর পাথর চাপা দিয়েছি বহু আগে। এখন যে মনটা বেঁচে আছে, সে শুধু হিসাব বোঝে, দায়িত্ব বোঝে। কর্মজীবনকে ঘিরেই আমার নিশ্বাস ওঠানামা করছে। কাজের মধ্যে থাকলে ভালো থাকি। বেঁচে থাকি!
লন্ডনের দিনগুলিতে আমার অতীত নিয়ে কেউ কোনও কথা বলত না। আম্মুজানের কড়া নিষেধ ছিল। কেউ যেন আমার ফেলে আসা জীবনকে বর্তমানে টেনে না আনে। আমি এই নিষেধাজ্ঞায় প্রীত ছিলাম, তৃপ্ত ছিলাম। ফেলে আসা অতীতকাল আমাকে খুব একটা বিব্রত করেনি কখনও। শুধু একদিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। স্টেসি লন্ডনে এসেছে। সঙ্গে চার মাসের এমিলি। আমরা তিন বন্ধু ছোট্ট এমিলিকে নিয়ে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন-অ্যাভনে বেড়াতে এসেছি। মহাকবি শেক্সপিয়ারের জন্মভিটায় পা রাখা মাত্রই আমার মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। এই ভাবান্তর শুধুমাত্র প্রিয় কবির অস্তিত্বের সান্নিধ্যের কারণে নয়, বরং এই স্থানটি আমাকে ফেলে আসা একটি দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমি অতীতের কথা ভাবতে চাইছি না। কিন্তু না চাইতেও কী করে যেন অ্যাভন নদী তীরের এই স্নিগ্ধ সকালের আকাশ ফুঁড়ে আমার পৃথিবীতে ধূমকেতুর মতো নেমে আসছে দুহাজার পনেরোর এক গ্রীষ্মের দিন। রবিবার ছিল। দুদিন পর শিহাব জাপান চলে যাচ্ছে। আমার মন ভীষণ খারাপ। ক্রিকের ধারের ড্রিমি চেরি ফেয়ারির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। চাদরের ওপর শিহাব বসে আছে কোলে হাওয়াইন গিটার নিয়ে। পরনে একটা লাইট অলিভ গ্রিন কালারের টিশার্ট। শুধু লাইট অলিভ গ্রিন বললে রংটার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যাবে না। বলতে হবে ওশেনসাইড লাইট অলিভ গ্রিন। এই রংটা এতো স্নিগ্ধ যে দেখলে চোখের আরাম হয়। ওর সামনে ঝুড়ি ভর্তি স্ট্রবেরি, চায়ের কেটলি আর কাপ পিরিচ। তখন শেষ বিকেল। রোদে তেজ নেই। সোনালী রংয়ের নরম আলোতে ভাসছে গ্রীষ্মকালের গাঢ় সবুজ উইলো ফরেস্ট। ক্রিকের জলে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। বুনো ঝোপের আনাচে কানাচে অসংখ্য ড্যানডেলিয়ন ফুল ফুটে আছে। দমকা বাতাসে ওদের পাখির পালকের মতো সাদা পাপড়ি দূর দুরান্তে উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন তুলোর একটা ঝড় উঠেছে প্রকৃতিতে। শিহাব আমার বিষণ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জাপান থেকে ফিরে এসেই আমরা ঘুরতে যাব, কেমন?’
—‘কোথায় যাবে?’
—‘তুমি কোথায় যেতে চাও?’
আমি মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বললাম- ‘সিটি অফ লাভ; রোম অথবা প্যারিসে।’
—ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে রোমান্টিক রাজ্য হচ্ছে ভার্জিনিয়া। ভার্জিনিয়া ইজ ফর লাভারস, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট?’
আমি শেষ বিকেলের নীলচে নরম আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছুটা ভাবালু গলায় বললাম, ‘ভেরোনা যেতে চাই। জুলিয়েটের বাড়ি। সেই ফেমাস ব্যাল্কনির রেলিংয়ে জুলিয়েটের মতো গালে হাত রেখে দাঁড়াব। তুমি গার্ডেন ওয়াল ক্লাইম্ব করে ব্যাল্কনির নিচে আসবে। আমাকে দেখে বলবে- It is my lady, O, it is my love! She speaks, yet she says nothing; what of that?
—‘আচ্ছা?’
আমার চোখ তখনও নীল নির্জন গগনে নিবদ্ধ, কণ্ঠে ভাবের রেশ কাটেনি।
—‘আর আমি বলব, O Romeo, Romeo! wherefore art thou Romeo? Deny thy father and refuse thy name …
আমার কথা থমকে গেলো অট্টহাসির শব্দে। তাকিয়ে দেখি শিহাব হো হো করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে।
—‘হাসছ কেন? হাসির মতো কী হলো?’
ওর হাসি থামেই না। যেন এইমাত্র সে উঁচুদরের একটা রসিকতা শুনে ফেলেছে।
—‘তুমি এতো আঁতেল কেন রুশানিয়া?’
আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠল, ‘আঁতেলের কী হলো এখানে?’
—‘সিরিয়াসলি? রোমিও জুলিয়েট? মরে গেলেও আমি জুলিয়েটের বাড়ি যাব না। রোমিও হবার কোনও শখ নেই। আর তুমি কি স্কুল থিয়েটারে ছিলে নাকি?’
—‘ইচ্ছে ছিল। বাবাজান দেয়নি।’
—‘ভালো করেছে। এসব ঢং আমার একদম পছন্দ না।’
আমার মাথায় আগুন ধরতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘রুচিহীন মানুষদের রুচিশীল জিনিস ঢং বলেই মনে হয়। ফালতু একটা। আমি একাই যাব বুঝলে? পৃথিবীর সব সাহিত্যের তীর্থস্থান গুলোতে আমি একা একা যাব। তোমাকে নিব না।’
—‘বেশ তো! জুলিয়েটের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে রোমিওর নাম ধরে ডেকো। হয়তো কোনও রোমিও ছুটে আসতে পারে তোমার ডাক শুনে।
রাগে অপমানে আমার ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে এখন। কেন এই মানুষটার ভেতর একটা ফোঁটা গভীরতা নেই? কেন এরকম রসকষবিহীন আমসত্ত্ব টাইপ ছেলেকে আমি ভালোবাসতে গেলাম?
— একশবার আসবে।’
—গ্রেট! উইশ ইউ লাক!’
—‘আমি পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াব একা একা। তোমাকে সাথে নিব না।’ ও মুখে কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে কাতর স্বরে বলল, ‘কেন নিবে না আমাকে রুশমি? প্লিজ নিয়ে যাও!’
—‘ফাজলামো করছ কেন?’
—‘ইচ্ছে হচ্ছে তাই।’
—‘এডিনবার্গ যাব। সিটি অফ লিটারেচার!’
—‘সিটি অফ লাভ, সিটি অফ লিটারেচার, কী শুরু করলে তুমি?’
—‘স্ট্র্যাটফোর্ড যাব, শেক্সপিয়ারের বার্থপ্লেস।’
—‘আল্লাহ তাই?’
—‘আমস্টারডাম যাব, অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি।’
—‘ওয়াও!’
—‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাব! কুঠিবাড়ি যাব, কুষ্টিয়া।’
—‘চমৎকার!’
—‘শান্তিনিকেতন যাব!’
—‘অসাম!’
—‘ফ্রান্তস কাফকা মিউজিয়ামে যাব!’
—‘যাও ভাগো!’ একটু থেমে বলল, ‘আমেরিকায় কিছু নেই? সব আমেরিকার বাইরে?’
—‘ভারমন্ট যাবার ইচ্ছে আছে। রবার্ট ফ্রস্টের হোমটাউন। যেখানেই যাব, একা যাব, তোমাকে নিব না।’
—‘কেন নেবে না? নিয়ে যাও নিয়ে যাও! আমি কাঁদব না নিলে!’ গিটারে টুংটাং সুর তুলতে তুলতে ফাজলামো করতে লাগল ফাজিলটা।
—‘কাঁদো, তোমার কাঁদাই উচিত।’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে যাব। পা বাড়িয়েছি এমন সময় ও পেছন থেকে বলল, ‘অ্যাই রুশানিয়া, গান শুনবে?’
—‘না!’
‘কেন?’
আমি কোনও উত্তর দিলাম না। যে মানুষ আমার মন বোঝে না। ভালো লাগার দাম দেয় না। তার সাথে অযথা সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। এর চেয়ে ভালো কোন গল্পের বই পড়ে সময় কাটানো উত্তম। ও আমাকে কিচ্ছু বুঝে না। আমার ভালোবাসাও বুঝে না। কোনও ডিপনেস নেই ওর ভেতরে। হনহন করে হেঁটে ক্রিকের ধারে চলে এলাম। বিকেল শেষে তেজহীন কমলা রোদ ঝিকমিক করে নেচে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছ জলের ওপর। একটা সারস পাখি এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রিকের ধার ঘেঁষে। আমাকে দেখতে পেয়ে দূরে সরে গেছে। আমি সাবধানে পাথরের ওপর পা ফেলে ক্রিক পাড় হচ্ছি। ঝিঁঝিঁ পোকা আর সিকাডা ডাকছে। সেই ঝুমঝুম ডাকের মাঝেই শিহাবের গলার স্বর শুনতে পেলাম পেছন থেকে,
It is my lady, O, it is my love!
She speaks, yet she says nothing; what of that?
ঘুরে তাকিয়ে দেখি ও সেলফোনের পর্দায় রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট পড়ছে। এখন ওর কণ্ঠস্বরে ব্যাঙ্গাত্মক সুর নেই। বরং গভীরতা আছে।
‘Two of the fairest stars in all the heaven,
Having some business, do entreat her eyes
To twinkle in their spheres till they return.’
আমি ধীরেধীরে ফিরে যাচ্ছি ওর কাছে। গিটারটা এখন এক পাশে রাখা। ও আসন গেঁড়ে বসে আছে চাদরের ওপর। আমি পাশে বসলাম। ও পড়ে যাচ্ছিল,
See how she leans her cheek upon her hand
O that I were a glove upon that hand,
That I might touch that cheek!
বাতাসে ড্যানডেলিয়নের সাদা তুলো উড়ছিল এলোমেলো স্বপ্নের মতো। That I might touch that cheek! লাইনটা উচ্চারণ শেষ করে ও আমার গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। তারপর আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তোমার মন রাখতে গিয়ে এখন বোরিং শেক্সপিয়ার পড়তে হচ্ছে। দিস ইজ নট ফেয়ার!’
ওর চুলের ওপর তুলো এসে পড়েছে। কাটাকাটা নাকের অগ্রভাগে খেলছিল রোদ। মুখে হাসি। গালের চামড়ায় ভাঁজ। আমি ওর কন্ঠমণিতে একটা চুমু খেলাম। তারপর বুকের ওপর মাথা রেখে বললাম, ‘যাবে আমার সাথে শিহাব? স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভনে? ভেরোনা যাবে? জুলিয়েটের বাড়ি?’
ও আমার চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার সাথে তো আমার নরকে যেতেও আপত্তি নেই রুশানিয়া!’
আজ আমি অ্যাভন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি। হেনলি স্ট্রিটের অলিতে গলিতে ঘুরছি। কিন্তু আমার পাশে সে নেই। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ছোট্ট এমিলির স্টুলার চালানোর দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপরে। ধ্যানভঙ্গ হল ওর কান্নার আওয়াজে। লিও আর স্টেসি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। মেয়ের কান্না শুনে দৌড়ে এলো। আমার চোখভর্তি জল। ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েছি। আশেপাশের কতিপয় মানুষ হা করে চেয়ে আছে। আমি এমিলিকে তার বাবা-মায়ের কাছে গছিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোমরা থাকো। এনজয় করো। আমি আর একটা মুহূর্তও এখানে থাকতে পারব না!’
স্টেসি আমাকে ছাড়বে না।
—‘কেন রুশ? হঠাৎ কী হলো? আমাদের সঙ্গ কি তোমার ভালো লাগছে না?’
আমি ওর প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে পাগলের মতো বাস স্টেশনের দিকে ছুটতে লাগলাম।
অতীতের কথা থাক। এবার নাহয় বর্তমান নিয়ে কিছু বলি। দুটি বছর অতিক্রান্ত হবার পর মনে হলো নিজের সম্পর্কে আর কয়েকটা লাইন লেখাই যায়। কারণ অবশেষে আমার জীবনতরী এমন একটা জায়গায় এসে ভিড়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি অন্তত এতটুকু বলতে পারি যে একজন সাবলম্বী, স্বাধীন নারী হিসেবে আমি কিছুটা হলেও সফল। একটি স্বপ্ন অন্তত পূরণ করতে পেরেছি। পাঁচ মাস হলো একটা ফার্ম লিজ নিয়েছি। আমার নিজের নামে নয়, আম্মুজানের নামে। আমার নামে তো মিসিং পার্সন কেস ফাইল করা আছে। লিজ দেবার সময় ওরা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে। এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য আম্মুজানের নামে লিজ নেয়াটাই নিরাপদ মনে হলো। পুলিশ অবশ্য এখনো আমার কোনো হদিশ পায়নি। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলাম। হয়তো এর মাঝে কেসটা ক্লোজ হয়ে গেছে।
আমার শারীরিক অবস্থা এই ভালো তো এই খারাপ। হাসপাতাল থেকে দূরে আছি আপাতত। এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া! কদিন আগে জন্ডিস থেকে সেরে উঠেছি। লিভারে কিছু ইনফেকশন রয়ে গেছে। সে যাই হোক, শারীরিক অসুস্থতার কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। আমি বরং তোমাদেরকে আমার ফার্ম সম্পর্কে কিছু বলি। আমার ফার্মটা যুক্তরাষ্ট্রের একটি নাতিশীতোষ্ণ রাজ্যে অবস্থিত। এখন নভেম্বর মাস। ভার্জিনিয়া, নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য আরো অনেক স্টেট বরফ ঢাকা নিষ্প্রাণ শ্মশান ঘাট হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের এখানে এখনো গাছে গাছে সবুজ পাতা আছে। দুপুরে আদুরে রোদ্দুর আছে। আকাশে নীলের বাহার আছে। আর এতো প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলেই আবাদ করার জন্য এই জায়গাটাকেই উপযুক্ত মনে হয়েছে আমার। মূলত সবজির আবাদ করাই আমাদের কাজ। তবে এর পাশাপাশি ফার্মে দশটা গরু আছে, চারটা ঘোড়া আছে এবং মুরগির জন্য আলাদা খামার আছে। কয়েকজন কর্মচারী আছে। কয়েক মাসের মধ্যেই আমি ফার্মের কাজ মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি। পুরো ফার্মটা প্রায় তিরিশ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে। এর সাথে লাগোয়া একটি ছোট লেক আছে। সেই লেকের ধারেই আমাদের বাড়ি। না নিজের কেনা নয়, ভাড়া বাড়ি। পুরোনো বাড়ি বলে খুব কম ভাড়ায় পেয়ে গেছি। তবে বাড়িটা বেশ বড়। নিচতলার দুটি ঘর নিয়ে এয়ারবিএনবির বিজনেস আরম্ভ করেছি। এটা আমার নয়, মেজোর আইডিয়া। নিচে দুটা বেডরুম, একটা লিভিং এবং চমৎকার ব্যাকইয়ার্ড আছে। ব্যাকইয়ার্ড থেকে লেকের ঘাট মাত্র চল্লিশ কদম দূরে। বাড়ির মালিকের নিজস্ব নৌকা আছে। ইয়ার্ডে বাঁধা থাকে। অতিথিরা চাইলেই লেকের পানিতে নৌকো ভাসাতে পারে। সাঁতার কাটতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকোয় ভেসে ভেসে মাছ ধরতে পারে। তাজা মাছ গ্রিল করে খেতে পারে। ব্যাকইয়ার্ডে বারবিকিউ গ্রিলও রাখা আছে। অর্থাৎ আশেপাশে কোথাও ঘুরতে না গিয়েও একজন অতিথি এই বাড়িতে পুরো একটি গ্রীষ্মের ছুটির দিন সানন্দে কাটিয়ে দিতে পারে।
সবজি এবং ফুলের চাষ করতে আমি ভালোবাসি। ফলনের পর সৃষ্টিসুখের উন্মাদনা হয় বুকের মধ্যে। মাইল খানেকের মধ্যেই বেশ কিছু গ্রসারি শপে আমরা পাইকারি দামে সবজি সাপ্লাই দেই। প্রতি শনিবার গ্রামে হাট বসে। স্যাটারডে মার্কেটে তাজা সবজি আর ফুল বিক্রি করি আমরা। ফার্মের পরিধি এখনো ছোট বলে সাপ্লাইও কম। তবে আল্লাহ চাইলে দিনে দিনে প্রচার প্রসার দুটোই বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের এয়ারবিএনবি তে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অতিথি থাকে। এক রাতের ভাড়া আশি ডলার। আমি নিজেই ঘরদোর সাফ করে অতিথিদের জন্য ঝকঝকে তকতকে করে রাখি। বাগানের তাজা ফুল দিয়ে ঘর সাজাই। আমার অতিথি আপ্যায়নে কোনোরকম ত্রুটি নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সাজানো গোছানো ঘরে এসে অতিথিদের মন ভালো হয়ে যায়। ঘরে ফ্রিজ আছে, মাইক্রোওয়েভ আছে। কফিমেশিনও আছে। এছাড়া আছে সময় কাটানোর জন্য গল্পের বই। একটা পুরোনো দিনের গ্রামোফোন। দেয়ালে উঁচুদরের পেইন্টিং। আর জানালার ওপাশে রেডহিলসের চমৎকার সবুজ বনবনানী। অতিথিরা আমার ব্যবহারে এবং আপ্যায়নে খুশি হয়ে ভালো রেটিং দেয় ওয়েবসাইটে। গত কয়েক মাসে কেউ চারের নিচে রেটিং দেয়নি।
লিও আর স্টেসি এই উইকেন্ডে আমাদের এখানে বেড়াতে আসছে। ও আচ্ছা বলা হয়নি, ওরা বিয়ে করেছে গত বছর। স্টেসির মেয়ের এ বছর চার পূর্ণ হলো। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে স্টেসি সমস্ত দায়িত্ব নিপুণ ভাবেই পালন করছিল। ব্যাপারটা এমন নয় যে ওর সন্তানের একজন পিতার প্রয়োজন ছিল বলে লিও ওকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পেছনের কারণটা দায়িত্ববোধ নয়, বরং সত্যিকারের ভালোবাসা। প্রিয়জনের সুখ মানুষের কাছে সবচেয়ে দামি এবং স্বস্তির। ওদের দুজনের সাজানো গোছানো সুন্দর সংসার আমাকে তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়, জীবনের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। মেজো আর ছোট পড়াশোনার খাতিরে নিউইয়র্কেই থাকছে। আসছে থ্যাংক্স গিভিং এ ওরা চলে আসবে আমাদের ফার্ম হাউজে। প্রিয় মানুষগুলোকে একত্রে পাশে পাব এই ভাবনাটা আমাকে নিরন্তর আনন্দে ভাসাচ্ছে। বাবাজানকে মিস করি। ওই একটা মানুষের অনুপস্থিতির কারণে আমাদের পরিবারটায় কখনোই পূর্ণতা আসে না। বাবা নিশ্চয়ই ওপার থেকে দেখছে আমাদেরকে। দেখছে আমরা ভালো আছি। বেঁচে আছি। আমার মতে এই পৃথিবীতে মানুষ কখনো পরিপূর্ণ রূপে সুখী হতে পারে না। সেরকম হলে দুনিয়া আর দুনিয়া থাকতো না। জান্নাত হয়ে উঠত। দুনিয়ার জীবনকে জান্নাত বানানোর কোনো অভিলাষ আমার নেই। আল্লাহ সুবহানা তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে পার্থিব জীবনে নানারকম অভাব অনটন এবং বিপদ আপদের মাধ্যমে সম্মানিত করে থাকেন। কষ্টের সাথে সম্মানের বিষয়টা জড়িত থাকার কারণ হলো, কষ্ট আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলে। সেই নৈকট্য থেকেই বুকের ভেতর স্বস্তির উদ্রেক হয়। তবে আমি যে পাপিষ্ঠা! তাই আমার মনে মেঘ আসে। রবি ঠাকুরের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে, ‘মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না!’ কিংবা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে/বাসনার বশে মন অবিরত/ধায় দশ-দিশে পাগলেরও মতো/স্থির আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে/ রয়েছ নয়নে নয়নে।’
বাসনার বশে পড়ে আমার পাপী মন হতাশায় ডুবে থাকে প্রায়শই। বুকজোড়া হু হু করা গহন শূন্যতা! অনির্বচনীয় এক অতৃপ্তি! এই অতৃপ্তি আর শূন্যতার বিনাশ ঘটে না কেন? একা হলেই কেন আমার বুকের ভেতরটা অমন মোচড় দিয়ে ওঠে? কেন মনে হয় জীবনটা ঠিক এরকম হবার ছিল না। স্টেসি আর লিওর মতো আমারও একটা ছিমছাম সুন্দর সংসার হবার কথা ছিল। সবার হয় একরকম। আমার পোড়া কপালেই হলো অন্যরকম! তবে হতাশাকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না একেবারেই। কাজের কথাই ভাবতে চাই সারাক্ষণ। কীভাবে ফার্মের প্রসার হবে, প্রফিট বাড়বে, ফলন ভালো হবে, কর্মচারীদের কাজের উন্নতি হবে এসব চিন্তায় মনকে ব্যস্ত রাখি। তাছাড়া আম্মুজানের শারীরিক অবস্থা, তার খুশি, অখুশি, চাওয়া, পাওয়া, ছোট দুবোনের ভবিষ্যৎ, পড়ালেখা এসব সাংসারিক বিষয় দিয়ে ভাবনার এলাকা টইটুম্বুর থাকে সর্বক্ষণ! যার সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছি, সেই বিশেষ মানুষটিকে আমি ভাবতে চাই না। তবুও সেই মানুষটার স্মৃতি অবচেতনে আমার বুকে এসে হানা দেয়। কর্মব্যস্ত, সুশৃঙ্খল জীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন হিসেবি মনটা চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মুহূর্তের মাঝে দুনিয়াদারি অর্থহীন হয়ে ওঠে। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ ঘুমের মাঝে মনে হলো বহুদূরের ঘণ্টাধ্বনির মতো একটা ডাক ভেসে আসছে কানে। কে যেন ডাকছে আমায় আত্মহারা হয়ে। কে ডাকছে? কেন ডাকছে? কী প্রয়োজন তার আমার সাথে? কেন মনে হচ্ছে এই অশরিরীর ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে না গেলে এই মুহূর্তে জান কবজ হয়ে যাবে?
ঘুম ছুটে যাবার পর ধড়ফড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। আশেপাশে কেউ নেই। রেডহিলসের জঙ্গলে একলা একটা শেয়াল হুক্কাহুয়া করছে। বাকি সব ঘুমন্ত। স্বপ্নের মধ্যে কে যেন আমাকে রুশানিয়া বলে ডাকছিল। পৃথিবীতে একজন মাত্র মানুষ আছে যে আমাকে রুশানিয়া ডাকত। এই নামটা প্রায় ভুলেই গেছি! কতদিন কেউ আমাকে ওই নাম ডাকে না! এমন নয় যে এসব কথা আমি জাগরণে ভেবেছি, স্মৃতিচারণ করেছি। সচেতন অবস্থায় ওকে ভাবি না বহুদিন! কিন্তু বুকের পাঁজরের ভেতরে, হৃৎপিণ্ড যেখানে স্পন্দিত হয় দিবারাত্রি, তারই আনাচে কানাচে কোথাও হয়তো এখনো বেঁচে আছে আমার হৃদয়াক্ষী! গভীর রাতে পার্থিব চিন্তারাজ্য যখন ঘুমের মায়াজালে আটকা পড়ে, ওই নিভৃতে ভারী সন্তর্পণে উন্মোচিত হয় সেই অলৌকিক সত্তা! ঘুরেফিরে সেই মানুষটার কথা ভাবায়, যার জন্য আমার ‘চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি/ চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই/সদা মনে হয় যদি দেখা পাই/ কে আসিছে বলে চমকিয়ে চাই/কাননে ডাকিলে পাখি/জাগরণে তারে না দেখিতে পাই/থাকি স্বপনের আশে/ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়/বাঁধিব স্বপনপাশে/এত ভালোবাসি, এত যারে চাই/মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই,/যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে/তাহারে আনিবে ডাকি।’
শিহাব
এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে?
এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
– হেলাল হাফিজ
.
আজ সকালে সাশার ইমেইল পেলাম। ও লিখেছে,
ডিয়ার শিহাব,
জানতাম তুমি একদিন চলে যাবে। কিন্তু সেই চলে যাওয়াটা যে এরকম হবে, অর্থাৎ আমি তোমাকে বিদায় জানাবার কোনো সুযোগ পাব না এমনটা কখনোই আশা করিনি। তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ কিংবা অভিযোগ নেই। থাকবেই বা কেন? আমি তোমাকে ভালোবেসেছি নিঃশর্তে। তোমার আমার সম্পর্কের কোনো কমিটমেন্ট ছিল না। রুশমির অন্তর্ধানের সুযোগ নিয়ে আমি যদি তোমাকে সারা জীবনের জন্য বেঁধে ফেলতে চাই তবে সেটা হবে মারাত্মক অন্যায়। গত তিনমাস তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার মতো বোবা, কালা, ডিজেবল্ড একটা মেয়েকে তুমি যথেষ্ট সম্মান এবং ভালোবাসা দিয়েছ। আমি এতোটা পাবার যোগ্য নই। ছোটবেলা থেকে আমি মানুষের করুণা পেয়ে অভ্যস্ত। আমার বাবার পরে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ণ করেছে, সম্মানিত করেছে। যদি তুমি চলে না যেয়ে আমার শরীরটাকে দিনের পর দিন ভোগ করতে শিহাব, তাহলে হয়তো এই সম্মানটুকু আর অবশিষ্ট থাকত না। তাই চলে গিয়ে তুমি ভালো করেছ। তবে জেনে রেখো তোমার জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা।
পি এস : ভার্জিনিয়ায় ফিরছি না আপাতত। নিউইয়র্কেই আছি। সেইম নেইবারহুড। তবে তোমার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিয়েছি। সাবলেট থাকছি একজনের সাথে। এদিকে এলে যোগাযোগ করো। দেখা করে যেও একবার।
সাশা কুপার
১১/১৩/২০
ঘড়িতে সকাল আটটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামিয়েছি একটু আগে ড্রাইভ থ্র খাবার কিনে নেয়া হয়েছে। কার্লি ফ্রাইজ আর চিজ বার্গার। জোয়ানা গাড়ির পেছনের সিটে বসে কুটুর মুটুর শব্দে বার্গার খাচ্ছে। রাস্তার দুধারে প্রায় তিন চার ইঞ্চি বরফ জমে গেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। রোদের দেখা নেই। দ্রুত বরফ গলার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। গাড়িতে তেল ভরে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি। আমার গায়ে একটা কালো রংয়ের লেদারের মোটা জ্যাকেট। মাথায় হুডি টেনে দেয়ার পরেও ঠান্ডা বাতাস কানের কাছে গুনগুন করছে। সেলফোন এখন পুরোপুরি চার্জড আপ। মমের সাথে ফোনে কথা বললাম। মম ফোন পেয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছে। বলেছে যেখানেই আছ সাবধানে থাকো। করোনাকালীন সময়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হচ্ছে না। খুব দ্রুত বাড়ি ফিরে এসো। আমি আশ্বাস দিয়ে বলেছি যে ভালো আছি। চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি ফিরে যাব খুব শীঘ্রই। কথাটা মিথ্যে নয়। বেঁচে থাকলে বাড়ি তো ফিরতেই হবে আজ নয় কাল! প্রতিটা মানুষকেই রোজ সন্ধ্যাবেলায় পাখির মতো নীড়ে ফিরতে হয়। কিন্তু মনের পাখিটা একবার ঘরছাড়া হয়ে গেলে তাকে ফেরাবার মন্ত্রটা বোধহয় এখনো মানুষ আয়ত্ব করে উঠতে পারেনি। যদি পারত তাহলে পৃথিবীর কোনো মানুষ সংসারত্যাগী হতো না, সন্ন্যাসী হতো না! কত মানুষ শূন্য বুক নিয়ে ঘরে ফেরে রোজ! দেহখানা পড়ে থাকে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে আর মনপাখি উড়ে বেড়ায় অজানার ইথারে। তাই তো সেসব মানুষের মনের সাথে কখনও সংসারের যোগ ঘটে না।
বাড়ির লোকে আজকাল আর আমার কাছ থেকে কিছু আশা করে না। একটা কল করে আমার কর্তব্য পালন হয়ে গেছে। আমি যে বেঁচে আছি এখনো এটুকু জানতে পেরেই আমার মা নিশ্চিন্ত হয়েছে। এদিকে সাশা ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছে আমার প্রতি তার কোনো রাগ নেই, অভিযোগ নেই।
তুষারাবৃত সেই সকালের শীত-গন্ধী আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, বুকভর্তি নিকোটিনের ধোঁয়া টানতে টানতে হঠাৎ মনে হলো, আমার বুঝি আর কোথাও যাবার নেই। কোথাও কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে না। কোথাও কোনও হিসেব বাকি নেই। সমস্ত জাগতিক দায়িত্ব কর্তব্য থেকে আমি মুক্ত। এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু হলে পৃথিবীর একটা ধূলি কণাও নড়বে না। কারো কিছু এসে যাবে না। আমার বাবা-মায়ের আরেকটি পুত্র আছে। সেই পুত্রকে নিয়েই তাদের জীবন বৃত্তটা এখন ঘুরছে। আমি এর মাঝেই লস্ট কজ বনে গেছি তাদের কাছে। এই পাঁচ বছরে তারা একটা বিষয় অন্তত বুঝে গেছে যে আমার দ্বারা আর কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো হবে না। আমাকে নিয়ে পাপার অনেক স্বপ্ন ছিল। তার ধারণা ছিল আমি একদিন নামকরা বিজ্ঞানী হব। পত্র পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে আমার নাম ছাপা হবে। দেশের মানুষের সামনে বুক ফুলিয়ে সে নিজ পুত্রের গুণগান গাইবে। আমিও ভাবতাম একদিন লোকে আমাকে চিনবে, জানবে। তবে বিজ্ঞানি হিসেবে নয়, গায়ক হিসেবে। সেসব স্বপ্নের বাস্তবায়ন তো হলোই না, বরং এক আপাদমস্তক অথর্বে পরিণত হলাম। জোয়ানা বলছিল ওকে যেন আমি মায়ামি পৌঁছে দেই। বিনিময়ে সে আমাকে দু বেলা খাবার কিনে দেবে। গাড়ির তেলের খরচ দেবে। আমি প্রস্তাবটা এখনো নাকচ করিনি। রাস্তায় রাস্তায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে কিন্তু খারাপ লাগছে না। ফ্লোরিডার রাস্তা হোক, আর ভার্জিনিয়ার রাস্তা। রাস্তা তো রাস্তাই। গন্তব্যবিহীন সব রাস্তাই একই রকম। পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর মাঝে অন্যরকম তৃপ্তি আছে। পথ শুধু বুক উজাড় করে আশ্রয় দেয়। বিনিময়ে কিছু চায় না। বাড়ি ফিরলেই মানবিক মনটা নানারকম আবদার নিয়ে হাজির হয়। বাড়ি মানেই মায়ার প্রবঞ্চনা, ভালোবাসার মিছে আকাঙ্ক্ষা। বাড়ি থেকে দূরে আছি। ভালো আছি!
সিগারেটটা শেষ করে গাড়ির জানালায় মুখ নামিয়ে জোয়ানাকে বললাম, ‘শোন, তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি। মায়ামি কখন পৌঁছুতে হবে তোমার?’
জোয়ানা স্ট্র দিয়ে পেপসি সিপ করছিল। ঢোঁক গিলে বলল, ‘কোনো ডেডলাইন নেই। আমি আমার বৃদ্ধা গ্র্যান্ডমা কে দেখতে যেতে চাই। কটা দিন থাকব ওর সাথে।’
—‘তুমি যে ঠিকানা দিয়েছ তাতে পৌঁছুতে প্রায় তের ঘণ্টা লেগে যাবে।’
—‘সমস্যা নেই। তুমি থেমে থেমে চালাতে পার। আই ডোন্ট মাইন্ড!’
—‘ইউ আর বায়িং মাই ফুড। রাইট?’
—‘শিওর!’
যাক শেষমেশ আমার একটা গন্তব্য হলো। বাড়ি ছেড়েছি দুদিন। এই দুদিনে জিপিএস চালু করিনি। কিছুদূর গাড়ি চালিয়েছি, ইচ্ছে হলে থেমেছি, ইচ্ছে হলে ঘুমিয়েছি, ড্রাইভ থ্র খাবার কিনে খেয়েছি। দাড়ি কামাই না প্রায় সপ্তাহ খানেক হয়ে গেলো। গাল ভর্তি বিজবিজে দাড়ি। চুল ছুঁয়েছে ঘাড়। সব মিলিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার। শরীরও বেশ ক্লান্ত। আশেপাশে কোনো হোটেলে যাত্রাবিরতি নিলে হয়তো ভালোই হতো। কিন্তু মেয়েটি উপস্থিত থাকার কারণে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। অতএব ক্লান্ত শরীর নিয়েই ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
জোয়ানা ড্রাইভিং সিটের পাশে এসে বসেছে। সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলছে, ‘তোমার সমস্যা কী বলো তো? ক্যালিফোর্নিয়ায় তোমার সাথে যখন দেখা হয়েছিল তখনও তুমি এমনই বিষণ্ন ছিলে। তোমার দুচোখ ভর্তি অতৃপ্তি আর হতাশা ছিল, এবারেও ঠিক তাই। মুখ দেখেই বোঝা যায় তুমি ব্রোকেনহার্টেড। কী কষ্ট তোমার? এতোগুলো বছরেও কি তোমার কষ্ট ফুরোয়নি? তোমার পেইন কি এন্ডলেস?’
কথাগুলো আমার বুকের মধ্যে অতর্কিতে একটি নাড়া দিয়ে গেলো। মেয়েটা যেন এই মুহূর্তে চিরকালের চিরাচরিত আমাকে একটি মাত্র শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে তুলল, ‘ব্রোকেনহার্টেড!’ সত্যিই তো, পাঁচ বছর পূর্বে আমি ভগ্নহৃদয় ছিলাম, বিরহাতুর ছিলাম, বিভ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত ছিলাম। পাঁচটি বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও আমার হৃদয় চরাচরে একই আবহাওয়া বিরাজমান। সেখানে আজও বিরহজনিত অন্তর্দাহ। লোকে এখন আমার চোখ মুখ দেখেই সেই অন্তর্দাহ টের পায়। এই অবস্থার জন্য দায়ী একজন মাত্র নারী। সে নারীর কারণেই এমন অন্তহীন দুর্দশার জালে আমার সারাটা জীবন আটকে গেছে। পুরোনো স্মৃতি ঘাঁটতে গেলে টের পাই, রুশমি এ জীবনে আসার পর থেকে আসলে আমার ভেতর থেকে শান্তি জিনিসটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। যতবার ওকে ভালোবেসে কাছে টানতে চেয়েছি, ওর কাছে যেতে চেয়েছি, শুধু বাধার পর বাধা এসেছে আমাদের দুজনের মাঝে। কখনো আমি ওকে বুঝিনি, কখনো ও আমাকে বোঝেনি, আবার যখন আমরা দুজন দুজনকে বুঝেছি তখন পরিবার আমাদেরকে বোঝেনি। অবশেষে বিঘ্ন, ব্যাঘাত ভরা কণ্টকময় পথ অতিক্রম করে যখন মনে হলো কোনো রকমে গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি, ওকে পাবার মতো করে পেয়েছি, তখনই ঘটল আমার জীবনের চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি। আমি জানলাম এতদিন যা ছিল ভুল ছিল, মিথ্যে ছিল! ও নাকি আমাকে কখনো ভালোই বাসেনি! কী অদ্ভুত! কী বিস্ময়! এতটা বোকা আমি কী করে হলাম? আজও কেন সেই বিশ্বাসঘাতক নারীর স্মৃতি আমাকে ভূতের মতো তাড়া করে বেড়ায়? এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে? এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে? কার লেখা কবিতা ভুলে গেছি, তবে কবিতার লাইনগুলি আমার এখন মনে পড়ছে।
জোয়ানা আমার দিকে চেয়ে ছিল। আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। জানালা খোলা। চলার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে বাতাসের আর্তনাদ। দুর্মর হাওয়ায় দম আটকে আসার অবস্থা। জোয়ানা চিৎকার করে কিছু একটা বলছে কিন্তু বাতাসের শব্দ ওর গলার আওয়াজ ঢেকে দিয়েছে। আমি ওর মুখের কথা বুঝতে পারছি না। বুঝতে চাইও না। আমি শুধু ছুটে যেতে চাই। বাতাসের চেয়েও দ্রুতবেগে ভেসে যেতে চাই, পেরিয়ে যেতে চাই এই অভিশপ্ত জীবনের শেষ সীমানা!
“পেট ভরানোর
Cor
জন্য খাবারও নেই।”
সংশোধন প্রয়োজন