হৃদয়াক্ষী – ১৩

শিহাব 

শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল রাতে। খুব ভোরে ঘুম ভাঙার পর দেখি মম আমার পাশে বসে আছে ঠায়। বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে। আমি নড়ে উঠতেই চোখ মেলে তাকালো। ক্লান্তি আর নিদ্রাহীনতায় তার চোখজোড়া ছোট হয়ে এসেছে। আমাকে জেগে উঠতে দেখেই কপালে হাত রেখে বলল, ‘এখন কেমন লাগছে?’ 

—‘বেটার।’ 

—‘তুমি আর মন খারাপ করে থেকো না। কাল তো ছুটির দিন। কাল বিকেলে আমি একবার রুশমিদের বাসায় যাব। ওর বাবার সাথে তোমার পাপার বেশ ভালোই তর্কাতর্কি হয়েছে টেলিফোনে। তবে ওর মা মহিলাটা অতটাও অভদ্র নন। উনার সাথেই গুছিয়ে কয়েকটা কথা বলব বলে ঠিক করেছি। আশাকরি ঝামেলা মিটে যাবে। তুমি চিন্তা করো না বাবা!’ 

এতো অশান্তির মধ্যেও মমের কথাগুলো আমার বুকে একটা প্রচ্ছন্ন শান্তির ভাব উদ্রেক করল। ভালো লাগল এটা জানতে পেরে যে, মম আমার মনের কথা বুঝে নিয়েছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি। গতকাল সে প্রতিজ্ঞা করেছিল রুশমির ফুপি ক্ষমা না চাইলে কিছুতেই ও বাড়ির সাথে আপোষ করবে না। এক রাতের মধ্যে এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলাটা আমার মায়ের জন্য একটা বিশাল বড় পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ সে শুধুমাত্র আমার মুখের দিকে চেয়ে নিয়েছে। এর চেয়ে স্বস্তির খবর আমার জন্য আর কী হতে পারে? তবে আমার মা ওই বাড়িতে গেলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। সমস্যা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ওই বাড়ির লোকজন আমার মায়ের সাথে অভদ্র আচরণ করে বসতে পারে, যেমনটা আমার সাথে করা হয়েছিল। মায়ের অপমান আমি কিছুতেই সহ্য করব না। তাই রুশমিদের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্তটাকে তাৎক্ষণিকভাবে অতটা কার্যকর বলে মনে হলো না। কোনো মতামত না দিয়ে চুপ করে রইলাম। 

ফোনটা এলো খানিক বাদে। রুশমি দেখা করতে চায়। দ্রুত তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। 

রাগ হচ্ছিল প্রচণ্ড। রুশমির অপরাধগুলো শোকের ছায়া ঘেরা শবযাত্রার মতো মনের সবকটা রাস্তা দখল করে আছে। আমাকে অবিশ্বাস করা, গালে চড় মারা, কিছু না বলে কয়েই নিজের বাবার সাথে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া, পাপা মম ফিরে আসবার পরেও তাদের সাথে একটা বার দেখা করতে না আসা, এমনই সব খুঁটিনাটি ত্রুটি আমার মন বিষিয়ে তুলছিল ধীরে ধীরে। যদিও বুকের খুব গভীরে টের পাচ্ছি যে আজ ভোর বেলায় এই ফোনটা এসেছিল বিধায় বেঁচে গেছি। নইলে হয়তো মরেই যেতাম। এই মেয়েটা সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে! এতটা কষ্ট জীবনে কেউ কোনোদিন দেবার সাহস করেনি। ও আমাকে এতটা ভোগাচ্ছে কেন? এবার ওকে সামনে পেলে বোধহয় খুন করে ফেলব! 

নির্দিষ্ট স্থানে দশ মিনিট আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজকের দিনটা মেঘলা। বৃষ্টিটা নামবে নামবে করেও নামছে না অনেকক্ষণ হলো। বাতাস বাস্তবিকই এত ঠান্ডা নাকি জ্বরের কারণে আমার ঠান্ডা লাগছে জানি না। তবে শীতল ভাবটা জ্বালাচ্ছিল খুব। মাথায় এখনো চিনচিনে ব্যথা, মেজাজ খিটখিটে। ভালো লাগছে না কিছু। আকাশের চমকানো বিদ্যুৎটা যেন আমার মাথার ভেতরেও ধীরে ধীরে চারিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আকাশে চমকাচ্ছে নাকি আমার মাথায় চমকাচ্ছে তা ঠাওর করে ওঠা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ হঠাৎ। 

রুশমি এলো পাঁচ মিনিট দেরিতে। দেরি দেখে মেজাজের মাত্রা আরো কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেলো। সাদা শার্ট, ব্লু জিন্স আর সাদা রংয়ের হিজাব পরেছে ও। জন্মগতভাবে পাওয়া চোখের ওই কাজলরেখা ছাড়া মুখে অন্য কোনো প্রসাধন নেই। ঠোঁটদুটো শুকনো, গালের চামড়া রক্তিম। ওই চোখে কী যেন আছে! একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। আজকে এই তাকিয়ে থাকার হতচ্ছাড়া ইচ্ছেটার ওপরেও রাগ হচ্ছে। এই মেয়েটা কেন এতো বেশি সুন্দর হলো, যে ওর দিকে তাকালেই আমার বুক জ্বালা করে? ওর প্রব্লেমটা কী? আমি কেন হাজার চাইলেও একে ঘেন্না করতে পারি না? ভুলতে পারি না? ওর জন্যই আমার জীবনের এই চরম দুর্দশা হলো। ওর দোষ, সব ওর দোষ! 

লেকের জল স্রোতস্বিনী। বাতাসে টলমল করছে। একজন মাঝবয়সী মহিলা এতক্ষণ পানিতে ছিপ ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করছিল। বৃষ্টি নামার লক্ষণ টের পেয়ে এই মাত্র সরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে সে পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে গেছে। এদিকটায় এখন কেউ নেই। আছে, লেকের পানিতে সাঁতার কাটতে থাকা রাজহাঁসের দল আছে! 

—‘কী খবর?’ সে প্রশ্ন করল। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। আমি নিশ্চুপ চেয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। ও আবার বলল, 

—‘কেমন আছ?’ 

আমি চুপ। 

—‘প্লিজ কিছু তো অন্তত বলো।’ 

বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো দু পা এগিয়ে গিয়ে শক্ত হাতে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরলাম। ওর মুখ দিয়ে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ বেরিয়ে এলো। হিজাব সরে গেলো কপাল থেকে। মুখ আকাশের দিকে তাক করা, চোখ বন্ধ, ফর্সা গালে রক্তের ছাপ, কপালে যন্ত্রণার চিহ্ন। এই মুখটার আকর্ষণী শক্তি প্রবল। এতো ক্ষোভ আর বিতৃষ্ণার ভেতরেও সেই আকর্ষণের প্রাবল্য এক মহাসমুদ্র পরিমাণ উদ্দাম মুগ্ধতার সঞ্চার করছিল আমার ভেতরে। ছিনিমিনি খেলছিল আমার পঁচিশ বছরের শক্ত পোক্ত টগবগে মনটা নিয়ে। পৃথিবীতে এরকম বশীকরণ চেহারা আর একটিও নেই। এ এক আশ্চর্য জিনিস! অগাধ এবং অভেদক এর রহস্য! 

—‘লিভ মি শিহাব। ইট হার্টস!’ আকুতি করল রুশমি। আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আরো কঠিনভাবে চেপে বসল ওই চুলের গোছায়। রুশমির চোখ উপচে এখন জল গড়িয়ে পড়ছে। কাজলকালো দুটি চোখ থেকে টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে রূপো রংয়ের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। আমি সেই যন্ত্রণাবিদ্ধ আশ্চর্য সুন্দর মুখটার দিকে চেয়ে রইলাম নিবিড় চোখে। চেয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় বশীভূতের মতো নিজের অজান্তেই ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওই ঠোঁটের ওপর। চুমু খেলাম প্রগাঢ়ভাবে। চুলের গোছার ওপর থেকে হাত আলগা হয়ে এলো। হিজাবটা খুলে পড়ল মাথা থেকে। বৃষ্টির ঘ্রাণওয়ালা বিভীষণ হাওয়া ওর আধখোলা চুল নিয়ে এলোমেলো খেলতে লাগল। সিডার গাছের গায়ের সাথে রুশমির পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। আমার ঠোঁট অনবরত ওর কপোল-কপাল, ওষ্ঠ আর চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সাদা শার্টের বোতামের ওপর যখন আমার হাত পৌঁছে গেছে তখন ওকে চাপা গলায় বলতে শুনলাম, ‘কী করছ?’ 

—‘কেন তোমার আপত্তি আছে?’

—‘এখানে, এভাবে নয়!’ 

—‘কেন নয়? কী সমস্যা?’ 

—‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’ 

রুদ্ধশ্বাসে বললাম – ‘হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি, বাসায় চলো!’ 

—‘কার বাসায়?’ 

—‘কার বাসায় আবার? আমাদের বাসায়!’ 

রুশমি 

—‘বাসায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’ শিহাবের চোখজোড়া ধক করে জ্বলে ওঠে।

—‘কেন ঠিক হবে না?’ 

—‘না মানে, আমার কথা মন দিয়ে শোনো, একটা দিন সময় দাও আমাকে। বাবাজানের সাথে একটু খোলামেলা কথা বলে নেই। তুমিও তোমার বাসায় কথা বলো। দুই ফ্যামিলির মধ্যে ঝামেলাটা মিটে যাক।’

—‘তুমি সেদিন চলে গেলে কেন এভাবে তোমার বাবার সাথে?’ 

—‘তুমি তো আটকাওনি আমায়!’ 

—‘রুশমি, আই ওয়াজ ম্যাড অ্যাট ইউ! ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? শোন, মম খুব সম্ভবত কাল বিকেলে তোমাদের বাসায় যাবে। তুমি দেখো, আমার মাকে যেন কেউ অপমান না করে বসে।’ 

—করবে না, কথা দিচ্ছি।’ 

—‘কাল সন্ধ্যায় আমার কনসার্ট আছে। তুমি আসবে না?’ 

—‘নিশ্চয়ই আসব।’ 

—‘এক কাজ করো। মম তোমাদের বাসায় যেহেতু যাচ্ছেই, তোমরা দুজন একসাথে চলে এসো কনসার্টে।’ 

—‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব। আমার বাবাজান গানবাজনা হেইট করে, জানো তো!’ 

—‘আমি যে গানবাজনা ভালোবাসি এটা সে জানে?’ 

—‘আগে জানত না, এখন জানে। জানে বলেই তো এতো রাগ।’ 

—‘তার রাগের আমি ধার ধারি না। এবার যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে তোমার বাবা, খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি; তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না। অনেক বেশি মিস করি তোমাকে! তুমি কি বুঝতে পার?’ 

আমি ওর বুকের ওপর মাথা রাখলাম। রাখবার সঙ্গে সঙ্গে কীরকম একটা সুখের আবেশে জুড়িয়ে গেলো মন প্রাণ! প্রগাঢ় কণ্ঠে বললাম, 

—‘আমিও যে তোমাকে অনেক চাই শিহাব! তুমিও তো কিচ্ছু বোঝ না!’ 

শিহাব আমার মাথাটা ওর বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল, ‘ঠিক মতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারবার সব এলোমেলো হয়ে যায়! এরকম কেন হচ্ছে রুশানিয়া?’ 

—‘এই কদিন আমি একটুও ভালো ছিলাম না, জানো?’ 

—‘আমিও না, সারাক্ষণ তোমাকে মনে পড়ছিল!’ 

—‘প্রায় দুদিন লিকুইড ছাড়া কিছু খাইনি, কারো সাথে কথাও বলিনি হসপিটালে ছিলাম এক রাত।’ 

—‘সেকী? কেন?’ 

—‘ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স। সোডিয়াম, পটাশিয়াম লো হয়ে গিয়েছিল।’ 

—এতকিছু ঘটে গেলো, তুমি একটাবার আমাকে জানালে না!’ 

—‘আমি চেয়েছিলাম বাবাজানকে একটা শিক্ষা দিতে।’ 

—‘দিতে পারলে শেষমেশ?’ 

—‘কিছুটা কাজ হয়েছে বলেই তো বাড়ি থেকে বেরোতে পারলাম। বেরোবার সময় বাবাজান দেখেছে কিছু বলেনি। সে বুঝেছে আই অ্যাম নট দ্যাট লিটেল, ইনোসেন্ট রুশমি এনিমোর। আই হ্যাভ চেঞ্জড আ লট! আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেল্ফ।’ 

একটু থেমে আবার বললাম, ‘কিন্তু আমার খুব ভয় করে! 

—‘কীসের ভয়?’ 

—‘তোমাকে হারানোর ভয়। 

–‘হারাবে কেন?’ 

—‘শিহাব, তুমি কি চিরকালের জন্য শুধু আমার হয়ে থাকতে পারবে?’

ও আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি তো তোমারই! 

—‘তোমার অফিসের সুন্দরী কলিগ যদি তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয় তখন কী হবে?’ 

এ কথা শুনে ও হাসতে লাগল। মুখ তুলে তাকালাম। 

—‘তোমার হাসিটা খুব সুন্দর! তুমি জানো?’ 

ও হাসতে হাসতে বিষম খায়, বিস্মিত গলায় বলে, ‘তুমি বলেছিলে আমার হাসি তোমার অসহ্য লাগে।’ 

—‘হ্যাঁ অসহ্যই তো, এতো বেশি সুন্দর যে সহ্য হয় না!’ 

অকপটে বলে ফেললাম কথাটা। ভাগ্যিস বলেছিলাম! নইলে এ জীবনে আর কখনো বলাই হতো না! 

সেই সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। নিমেষে ঝাপসা হয়ে ওঠে চারপাশ। বৃষ্টির ফোঁটা সুচের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে মুখের চামড়ায় লাগতে থাকে। লেকের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ সুর তৈরী হয়। পাগল বাতাস নিশ্বাস কেড়ে নিতে চায়। আমরা দৌড়ে ছুটে যাই গাড়ির কাছে। ব্ল্যাক পোরশের পেছনের সিটে উঠে বসি। শিহাব আমাকে নির্দ্বিধায় কাছে টেনে নেয়। আমি বাধা দেই না। ক্রমেই আমরা একজন আরেকজনকে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয়ে উঠি। ভাঙা কাচের মতো বৃষ্টির জল ঝরঝর করে আছড়ে পড়তে থাকে গাড়ির জানালায়। বিদ্যুৎ চমকায় চারপাশ নীল করে। চুম্বনের শব্দ আর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মিলনের মধুরেণ হর্ষ-বীণ মিশে যায় মেঘের গর্জনের সাথে, উড়তে থাকে হাওয়ায়। ওই সুঠাম, সুন্দর শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে যেন আমি ওর হৃদয়টাকেই ছুঁয়ে দিতে চাই পাগলের মতো। ছুঁতে পারি আবার পারিও না! পাওয়া না পাওয়ার দুর্ভেদ্য দ্বৈরথে বন্দি হওয়া দম আটকানো মুহূর্তে হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ও গভীর গলায় বলে ওঠে, ‘রুশানিয়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ 

শিহাব 

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সময় বয়ে চলেছে। বহমান সময় চির অমুখাপেক্ষী এবং স্বার্থপর। তার পরাক্রমশালী শক্তির কাছে হার মেনেছে সর্বযুগের ইতিহাসখ্যাত রাজা, মহারাজা, বীর, পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বৈজ্ঞানিক এবং পৃথিবীর প্রতিটি সাধারণ মানুষ। এই ইহজগত যেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সময়ের ঘূর্ণিপাকে কারারুদ্ধ এক বাজিকর ফাঁদ। 

কিন্তু চোখের দেখা জগতের বাইরেও আরো একটা জগত আছে বলে আমার বিশ্বাস। সেই অদৃশ্য জগত সময়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওখানে মানুষের আটপৌরে জীবনের ছায়া পড়ে না। মনের ভেতরের কোনো এক লুকায়িত গভীর গহ্বরে সেই জগৎটা ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো আসন গেড়ে বসে থাকে, বোধন লাভ করে, ধীরে ধীরে আলোকিত করে তোলে মনের পথঘাট; উন্মোচিত হয় হৃদয়াক্ষী। সময়ের দাপটে সেই জগতের এক চুল পরিবর্তনও হয় না। মানুষের বয়স বাড়ে, চামড়া ঝুলে যায়, চোখে ছানি পড়ে, কিন্তু সেই ধ্যানমগ্ন হৃদয়াক্ষীলব্ধ ঋষি চির তরুণ, অবিনাশী এবং জ্যোতির্ময়! এই অতিলৌকিক মনোগত অমরত্ব লাভের যেমন প্রচ্ছন্ন এক প্রশান্তি আছে, তেমনি পীড়াও কিছুমাত্র কম নয়। পাঁচ বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমার ভেতরের ক্ষতস্থান এখনো শুকোয়নি। বরং কাটা ঘা দিনকে দিন গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। রুশমির প্রতি আমার ভালোবাসা যেমন আগের মতোই ঝকঝকে, অমলিন এবং অবিকৃত অবস্থায় আছে, ঠিক তেমনি ওর কাছ থেকে পাওয়া কষ্টটাও চির জাগ্রত এবং চির প্রতিক্রিয়াশীল। ও চলে যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটিক্ষণ যে অসহনীয় যন্ত্রণা এবং বিরহভার আমার এই দুর্বল হৃৎপিণ্ডকে বহন করতে হচ্ছে, তা প্রকাশ করার মতো ভাষাজ্ঞান আমার শব্দভাণ্ডারে নেই। ওর সাথে অন্তত আর একবার দেখা না হলে এই যন্ত্রণা লাঘব হবে না। কিন্তু কোথায় আছে সে? কেমন আছে? তার অস্তিত্বের একটুখানি সংবাদ পাবার জন্য আমার অতৃপ্ত মন ছটফট করে অহর্নিশি। কিন্তু সে আছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তার পরিবারের সদস্যরাও নাকি তার কোনো হদিশ জানে না। এই রহস্যের সমাধান আমি কী করে করি? কে আমাকে সাহায্য করবে? কে আমার মনটাকে বুঝার মতো করে বুঝবে যে পাঁচ বছর কেন, পাঁচ শতাব্দী পার হয়ে যাবার পরেও ওকে আমি ভুলতে পারব না। 

লেকের ধারের বৃষ্টিমুখর সেই সকালটার মাঝে আমার পুরো জীবনটা বন্দি হয়ে পড়লে বেশ হতো! সেদিন আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করলাম। ইচ্ছে না থাকলেও অফিস যেতে হলো। অফিস থেকে গানের প্র্যাকটিসে। এরমাঝে কয়েকবার রুশমির সাথে ফোনে কথা হয়েছে। জানা গেছে ওদের বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক। ধারণা করা যাচ্ছে আগামীকাল মম ওদের বাড়ি গিয়ে খোলামেলা কথা বললেই ঝামেলা মিটে যাবে। আমি বাড়ি ফিরেছি রাত দশটায়। কিন্তু ফেরার পর আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ওকে খুব বেশি মনে পড়ছে। থাকতে না পেরে ড্রাইভ করে সোজা চলে গেলাম ওদের বাড়ি। পা টিপে টিপে দাঁড়ালাম ব্যাক ইয়ার্ডে। রুশমিকে কল করে নিচে নামার অনুরোধ করলাম। 

ডেকের কিনার ঘেঁষা বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে ক্রমাগত। উড়ছে জোনাকি। আকাশ এখনো মেঘাচ্ছন্ন। হাওয়া শীতল। ওদের বাড়ির লোকজন বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। প্ৰায় মিনিট পাঁচেক পরে রুশমি বেজমেন্টের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। ডেকের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি ওর হাতে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়ে নামিয়ে আনলাম বাগানে। ও খুব ভয় পেয়ে গেছে। ফিসফিস করে বলছে, ‘কী করছ শিহাব? বাবাজান জানলে কী হবে? ছিঃ 

আমি ওর কথার প্রত্যুত্তরে শুধু আদর করলাম। আদরে আদরে একসময় রুশমির গলার স্বর বুজে এলো। কী আশ্চর্য! তখনও জানতাম না যে আর ঠিক কয়টা দিন পরে এই মেয়েটা আমার জীবন থেকে চিরতরে উধাও হয়ে যাবে। ভাবতে গেলে এখনো ঘটনাটাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। মনে হয় যেন কোনো দীর্ঘ বিরতিহীন দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছি আমি। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ভেঙে আবিষ্কার করব সব আগের মতোই আছে। কিছুই বদলায়নি 

কনসার্টের ইভেন্টটা চমৎকারভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। রুশমির আম্মু নিজ থেকেই সেদিন সকালে মমের কাছে ফোন করেছে এবং রুশমির ফুপির দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। আমার বাড়ির লোকজন জল আর বেশি ঘোলা করেনি। অতএব দুপক্ষ থেকেই ভদ্রতা বজায় রেখে সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা দুজন যেন নর্দমার জল থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমাদের মন প্রশান্ত, স্নিগ্ধ এবং প্রথম প্রেমের দুর্বার নেশায় উন্মত্ত। এর চেয়ে বেশি সুখ আর হয় না পৃথিবীতে। যে মেয়েটাকে রোজ ভোরবেলা দূর থেকে দেখে আমার চোখ জুড়াতো, সেই মেয়েটাকে এখন আমি বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। সারাদিন, সারাক্ষণ, সারারাত ও শুধু আমার। 

রুশানিয়া আমাকে ভালোবেসেছিল। কখনো মুখ ফুটে বলেনি কথাটা কিন্তু আমি জানতাম ও আমাকে ভালোবাসে। ছেড়ে যাবার দিন ও যখন আমার চোখে চেয়ে নির্দ্বিধায় বলেছিল, ‘আই হ্যাভ নেভার লাভড ইউ শিহাব! ইট ওয়াজ অলওয়েজ লিও!’ তখনও ডিপ ডাউন ইনসাইড আমি জানতাম যে ওটা মিথ্যে কথা। আমার রুশানিয়া আমারই চোখের ওপর চোখ রেখে জীবনের সবচেয়ে বড় ডাহা মিথ্যেটা বলে ফেলেছিল সেদিন। 

মে মাসের পনের তারিখ আমাকে জাপান যেতে হবে। টানা তিরিশ দিনের ট্রেনিং। খুব ইচ্ছে ছিল রুশমিকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। কিন্তু ওর ক্লাস চলছে। এদিকে দাদাজান আমেরিকায় আর খুব বেশিদিন থাকছে না। বাকি দিনগুলিতে সে নাতবৌকে কাছে চায়। এমনিতেও অফিশিয়াল ট্যুরে রুশমিকে খুব একটা সময় দেয়া হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া রুশমির ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে এর মাঝে। তাই সাতপাঁচ নানা কারণে ওর আর জাপান যাওয়া হলো না আমার সাথে। থেকে গেলো। ঠিক হলো ফিরে আসার পর অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে আমরা কোথাও ঘুরতে যাব। রুশমি বলেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক সিটি রোম অথবা প্যারিসেই হবে আমাদের প্রথম হানিমুন। ওর খুব ইচ্ছে আমার সাথে একবার ইটালির ভেরোনায় যাবে, জুলিয়েটের বাড়ি। সে গিয়ে দাঁড়াবে জুলিয়েটের সেই লেজেন্ডারি ব্যাল্কনিতে। আর আমাকে রোমিওর মতো দেয়াল বেয়ে ব্যাল্কনিতে উঠতে হবে, জানাতে হবে ভালোবাসার কথা। আমি হেসে বলেছিলাম, তোমার ধারণা ভুল। পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক রাজ্য হলো ভার্জিনিয়া। জানো তো, ভার্জিনিয়া ইজ ফর লাভার্স! 

জাপান পৌঁছানোর পরদিন সকালবেলা রুশানিয়ার সাথে আমার শেষবার কথা হয়েছে। দুপুরে ফোন করলাম। সে ধরল না। রাতেও একই পরিস্থিতি। পরদিন সকালে মমকে ফোন করে জানতে পারলাম রুশমি নাকি স্টেটের বাইরে গেছে ওর কোন এক কাজিনের বাসায়। আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে কাজিনের বাসায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেনো? আর কাজিনের বাসায় গিয়েছে তো হয়েছেটা কী? আমার ফোন তো অন্তত রিসিভ করবে! রাগে আর দুশ্চিন্তায় অস্থির লাগছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার শ্বশুর-শাশুড়িও ফোন রিসিভ করছে না। এমনকি রুশমির ছোট বোনরাও গায়েব। জাহিদকে পাওয়া গেলো ফোনে। সে অত্যন্ত বিষণ্ণ গলায় জানালো, রুশমিদের বাড়ির কোনো খবর তার কাছে নেই। আমি নিরুপায় হয়ে রুশমির বান্ধবী স্টেসির সাথে যোগাযোগ করলাম। স্টেসি বলল আপাতত সে কিছু জানে না, তবে শীঘ্রই খবর নিয়ে জানাচ্ছে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। রুশমির দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। স্টেসি ঘণ্টা দেড়েক পরে যে খবরটা দিল তার সারমর্ম অনেকটা এরকম যে, রুশমি টেক্সাস গেছে এক কাজিনের বাসায়। ওর ফোন হারিয়ে গেছে বিধায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। শীঘ্রই ফোনের ব্যবস্থা করে যোগাযোগ করবে। কেমন যেন খটকা লাগল। অজানা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে গেলো মন। সাশাকে টেক্সট করেছিলাম। সে জানালো রুশমিদের বাড়ি খালি। ফুল ফ্যামিলি ভ্যাকেশনে গেছে। সেই রাতে রুশমির মায়ের নম্বর থেকে একটা এসএমএস পেলাম, ‘আমি ভালো আছি। আমার এক কাজিনের হঠাৎ করেই খুব শরীর খারাপ হয়েছে। ব্যস্ত আছি তাকে নিয়ে। কয়েকটা দিন যোগাযোগ করতে পারব না। ভালো থেকো। 

—’রুশমি।’

অসংলগ্ন এবং অসম্পূর্ণ তথ্য পেয়ে থ্ বনে গেলাম। একটার পর একটা বিনিদ্র রাত্রি কাটতে লাগল। কিছুতেই আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। পাপা মমও তেমন একটা গা করছে না বিষয়টা নিয়ে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি। পরিষ্কারভাবে কিছু ভাবতে পারছি না। ভাবনার জগৎ অসংখ্য কাটা ছেঁড়া দাগে হিজিবিজি হয়ে আছে। কোথাও কোনো হিসেব মিলছে না। বেহিসেবি, বেসামাল মন নিয়ে মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়া দিকভ্রান্ত নাবিকের মতো দিশাহারা বোধ করছি। রাগ হচ্ছে। বারুদের গন্ধে আমার আকাশ ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে একটা প্রকট বিস্ফোরণ ঘটবে। সারারাত রুশমির ফোনের আশায় জেগে থাকি, দিনে কনফারেন্স রুমে বসে বসে ঝিমোই। বাজে রেপুটেশন হয়ে যাচ্ছে। এই চাকরিটা মনে হয় থাকবে না। ষোল দিনের মাথায় কাজে ইস্তফা দিয়ে ইউ এস এ’র ফ্লাইট ধরলাম। আমার বৌ নিখোঁজ আর আমি চাকরি বাঁচাবার জন্য মুখ বুজে এখানে পড়ে থাকব তার প্রশ্নই আসে না। ফিরে এসে সরাসরি গেলাম শ্বশুরবাড়ি। সাশার কথাই ঠিক। বাড়িতে তালা। কেউ নেই! এর মানে কি সবাই একসাথে টেক্সাস চলে গেছে? যাবার আগে আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না? আরো বেশি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ওদের রেস্টুরেন্ট এবং কফিশপ দুটোই বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমি আশ্চর্য হবার ক্ষমতাও এখন হারিয়ে ফেলেছি। এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? 

বাড়ি ফিরে মমকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, 

—‘রুশমি কোথায়?’ 

মম আমাকে দেখে বিস্মিত, ‘তুমি এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? তোমার না আগামী মাসে ফেরার কথা ছিল?’ 

—‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, রুশমি কোথায়?’ 

মমের মুখে আতঙ্কের সুস্পষ্ট ছাপ। চোখের দৃষ্টি অস্থির। আমার হাত পা কাঁপছে। বুকে ঠকঠক করে পড়ছে হাতুড়ির বাড়ি। 

—‘শিহাব শোনো, মাথা ঠান্ডা করে একটা কথা শোনো!’ 

তখন আমার মাথা ঠান্ডা করার সময় না। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠে বললাম, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’ 

কান ফাটানো চিৎকারে মম বিব্রত হয়ে পড়েছে। পাপা উঠে এসে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে স্বান্ত্বনা দেবার গলায় বলছে, ‘তুমি বসো শান্ত হয়ে, তারপর বলছি।’ 

আমি চোখে লাল পট্টি বাঁধা বুনো ষাড়ের মতো ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ফেলে বললাম, –’এখনই বলো!’ 

মম অর্ধনিমীলিত চোখে বলল, ‘রুশমি বলেছে ও এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায় না, ওরা চলে গেছে।’ 

—‘তুমি আমার সাথে ফাজলামো করছ?’ 

—‘ফাজলামো নয় শিহাব, এটাই সত্য। ওরা ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।’ 

—‘আমার বৌ কীভাবে আমার অনুমতি ছাড়া চলে যায়? তোমরা আমাকে আগে কিছু বলো নি কেন?’ 

আমি এতো জোরে চিৎকার করছিলাম যে মনে হচ্ছিল যেন এক্ষুনি কন্ঠনালী ছিঁড়ে যাবে। একটা করাল হিংস্র থাবা আমার হৃৎপিণ্ডটাকে দুমড়ে মুচড়ে ছারখার করে দিচ্ছিল। লিখতে কষ্ট হচ্ছে। সেদিনের কষ্ট বহুদূর থেকে ছুঁড়ে দেয়া লক্ষ্যভেদী তীক্ষ্ণধার বর্শাফলকের মতো ছুটে এসে আঘাত হানছে বুকে। গোটা অন্তর ছটফট করছে শরবিদ্ধ শিকারের ন্যায়। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। শব্দগুলো সাজাতে পারছি না। বর্ণনার ভাষা পাচ্ছি না। 

রুশমির আত্মীয়-স্বজনদের ফোন নম্বর কালেক্ট করার চেষ্টা করলাম। আসলে আত্মীয় বলতে ওদের তেমন কেউ নেই ভার্জিনিয়ায়। টেক্সাসের কাজিনের ব্যাপারে কোন কিছুই কখনও আমাকে বলেনি রুশমি। কাছের মানুষ বলতে ঝুম্পা আপু আর নিউইয়র্কের সেই ফুপুকেই চিনি। ফুপুর খোঁজ পাওয়া গেলো না। তবে ঝুম্পা আপার দর্শন মিলল। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছু একটা জানে। আমার উপর্যুপুরি প্রশ্নের চাপে পড়ে একসময় বলল, ‘তোমার মায়ের সাথে কথা বলো। আমাকে তো কিছু বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কোরান শরীফ ছুঁইয়ে ওয়াদা করানো হয়েছে। কী করে বলি?’ 

বিধ্বস্ত ভগ্নহৃদয় মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, ‘মম তুমি কী করেছ? রুশমি কোথায়?’ 

মম আমার দিকে কিছুক্ষণ ঠান্ডাভাবে চেয়ে থেকে বলল, ‘তোমার কাছে নিজের মায়ের চেয়ে দুদিনের পরিচিত ওই মেয়ে বড় হয়ে গেলো? আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন?’ 

—‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও! রুশমি কোথায়?’ 

—‘বললাম তো, মেয়েটা এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায় না।’ 

—‘তুমি মিথ্যে বলছ, কেনো মিথ্যে কথা বলছ মম? ফর গড সেক! সত্যটা আমাকে জানাও!’ 

সেই বিকেলে জাহিদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হলো। ও তো ড্রাইভ করে না। ছিল বন্ধুর গাড়িতে। বন্ধু স্পট ডেড। জাহিদের ইনজুরি মারাত্মক। হাতে পায়ে ফ্র্যাকচার। কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। চোখে ভাঙা কাচ ঢুকে গেছে। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দুর্ভোগের আর সীমা রইল না। পাপা মম কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। দিনরাত কান্নাকাটি করছে। জাহিদের দুর্ঘটনার শোকভার পাপা নিতে পারল না। তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলো। মমের শারীরিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। মম আকুতি ভরা গলায় আমাকে বলেছে, বাবা তুমি রুশমির চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদেরকে একটু দ্যাখো। নিজের পরিবারের কথা ভাবো। আমাদের আর কেউ নেই তুমি ছাড়া। 

কথা সত্য। বাস্তবিকই আমার বাপ-মা ভাইয়ের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকেই বহন করতে হবে আমার পরিবারের ভার। রুশমি তো আমাদের কথা ভাবেনি। আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে তাকে আমি পাশে পেলাম না। সে সময় আমার পরিবারের ওপর দিয়ে যে বিপদটা গেছে তার বর্ণনা লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। আমি এখন পারিবারিক স্মৃতিকথা লিখছি না। তাই পরিবারের গল্প বাদ দিয়ে বরং রুশমির গল্পটাই বলে শেষ করি। 

পনেরটা দিন কেটে গেছে। এই কদিন আমি রুশমির কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। খোঁজ নেয়ার মতো সময় হয়ে ওঠেনি। সমস্ত সময় চলে গেছে হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ির পেছনে। জাহিদ তখনও হাসপাতালে। ডাক্তার আশঙ্কা করছে ওর একটা পা বাঁচানো যাবে না। পাপাও হাসপাতালে অ্যাডমিটেড। হার্টে রিং পরাতে হবে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ছোটমামা কাছে আছে, কিন্তু আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি। সেইসব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বিধ্বস্ত দিনগুলির একটিতে হঠাৎ স্টেসি ফোন করে জানালো, রুশমির পরিবার ফিরে এসেছে। 

রুশমি 

Truth is stranger than fiction, but it is because Fiction is obliged to stick to possibilities, Truth isn’t! 

— Mark Twain 

.

দুটা সপ্তাহ আমরা বাঁচার মতো করে বেঁচেছিলাম। আমাদের জীবন সবদিক থেকে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু এ জীবনে বুঝি সব সুখেরই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। আমাকেও শোধ করতে হয়েছিল। দুহাজার পনের সালের ষোলই মে। আমার জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর দিন। মনে পড়লে আজও আমার পৃথিবী বাস্তবিক অর্থে অন্ধকার হয়ে আসে। ত্রাসিত বক্ষ থরথর করে কাঁপতে থাকে। সেই দিনটার আগ পর্যন্ত আমার সব ছিল। বাবা-মা, বোন নিয়ে সুন্দর একটা পরিবার ছিল, ভালোবাসার মানুষ ছিল, ছিমছাম সংসার ছিল, ঊজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল, স্বপ্ন ছিল! কিন্তু সেই দিনটা। সেই দিনটা বিধ্বংসী কালাঝড়ের মতো কোন জাহান্নাম থেকে যে উড়ে এসেছিল আমার জীবনে! হে আল্লাহ এরকম যেন কোনোদিন কারো সাথে না হয়! 

আমার হাত কাঁপছে। লিখতে পারছি না। এসব কথা লেখা যায় না। আমি নিশ্চয়ই এখনো পরিপূর্ণ লেখক হয়ে উঠতে পারিনি। লেখক হলে সেদিনের বর্ণনা লিখতে গিয়ে এমন অসহনীয়, বীভৎস ত্রাসে শরীর মন জর্জরিত হয়ে উঠত না। আমার বরং সুখের স্মৃতিগুলো ভাবতেই ভালো লাগছে। শিহাব জাপান যাবার আগের রাতটার কথা মনে পড়ছে। আমরা ক্রিকের ধারে অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়েছি। ও আমাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। বলেছিল, রুশানিয়া তুমি আমার জীবনে না আসলে আমি জানতাম না যে, এ পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা বলে কিছু আছে। ভালোবাসা আমার কাছে কোন এক জাদুর দেশের অসম্ভব বস্তু ছিল। তুমি এসে জিয়ন কাঠি ছুঁইয়ে দিয়ে সেই অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তরিত করলে! এরকম অসংখ্য ছোট ছোট কথা ও ভারী সুন্দর করে বলত। কথাগুলো আমি চুপ করে শুনে শুনে বাঁধাই করা ফটোফ্রেমের মতো সাজিয়ে রেখেছিলাম মনের ভেতর। মাঝে মাঝে হৃদয়াক্ষী মেলে হৃদয়ের দেয়াল দেখি। দেয়ালজোড়া সাজিয়ে রাখা সুন্দর সুন্দর ফ্রেমবন্দি কথাগুলো এখনো দূরের অরণ্যের বুনো ফুলের সুবাস ছড়ায় বুকে। 

শিহাব জাপান চলে যাবার পরদিন আমি ক্লাস সেরে আমাদের বাসায় এসেছি। রাতে শ্বশুরবাড়ির দিকে একটা দাওয়াত আছে। যে জামাটা পরতে চাইছি সেটা আমাদের বাসায় রয়ে গেছে। ভেবেছিলাম চট করে জামাটা নিয়েই অ্যাশবার্ন ফিরে যাব। শাশুড়ির সাথে বিকেলে শপিং এ যাবার কথা। আমাদের বাড়ি এখন এই ভর দুপুরবেলায় ঝুমঝুম নীরব। বাবা-আম্মু কাজে। ছোটবোনরা স্কুলে। জামা নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চায়ের তেষ্টা পেলো। আর সেই চায়ের তেষ্টাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। এই রান্নাঘরে ইলেকট্রিক রেঞ্জ নেই। গ্যাসের চুলা। আমি চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছি। দাঁড়িয়ে আছি পাশে। আমার গাউনের হাতাটা বেশ বড়, কব্জি থেকে অনেকখানি ঝুলে আছে লেজের মতো। তবে এটা পরলে বেশ স্টাইলিশ দেখায়। আজকে আমার মন ভালো বিধায় পছন্দের জামা পরেছি। সেজেছিও একটু। বাড়ি থেকে বের হবার আগে শিহাব রেজাকে সেলফি তুলে পাঠিয়েছি। ওই শয়তানটা আদর করার নামে আমার গালে কয়েকটা বিশ্রী দাগ করে দিয়েছে। সেই দাগ কনসিলার দিয়ে ঢাকতে হয়েছে। তাই দেখে সে ব্যথিত গলায় বলেছে, ‘হোয়াই ডিড ইউ হাইড ইট? ওগুলো তো লাভ বাইট রুশানিয়া! আমার ভালোবাসার সাইন তুমি এসব বাজে মেকআপ দিয়ে ঢেকে ফেলতে পারলে?’ 

—‘বিশ্রী দাগ! লোকে কী বলবে?’ 

—‘কী বলবে আবার? চিহ্ন থাকুক, তুমি আমার! ছেলেরা যেন তোমার দিকে ফিরেও না তাকায়!’ 

স্টোভের পাশে দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম আর হাসছিলাম মিটিমিটি। হাতে সেলফোন। ইনস্টাগ্রামে শিহাবদের কনসার্টের ভিডিও দেখছি। কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া আমার মজ্জাগত স্বভাব। সেদিনও বিনা কারণেই অন্যমনস্ক হয়ে গেছি। স্টোভের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম কল্পনা করছি, নিজের মনে হাসছি, কমেন্ট পড়ছি। গাউনের ঝুলন্ত হাতার একটা অংশ যে স্টোভের আগুনের ওপর পড়ে গেছে সেদিকে বেখেয়ালি আমার নজর নেই। হঠাৎ করে দলা পাকানো কালো ধোঁয়া শ্বাসনালিতে এসে ধাক্কা খেলো। খকখক করে কাশতে শুরু করলাম। টের পেলাম গাউনের হাতা উত্তপ্ত হয়ে গেছে। কেউ যেন বুকের খাঁচার হৃৎপিণ্ডটা সজোরে কিক করে ছুঁড়ে মারল উপরের দিকে। পিলে চমকে উঠল বুক। তীব্র হাড়কাঁপানো ভয়ে জমে উঠল হাত পা। পানির সসপ্যানটা ছোট্ট। কখন পানি শুকিয়ে সসপ্যানের গায়ে আগুন ধরে গেছে নোটিস করিনি। ততক্ষণে লেলিহান বহ্নিশিখা আমার গাউনের হাতা বেয়ে দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে উঠে এসেছে গলার দিকে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী সিলিং ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। আতঙ্কিত, উৎসন্ন এবং কম্পিত বক্ষ নিয়ে আবিষ্কার করলাম স্টোভের পাশে রাখা মাইক্রোওয়েভের ওপর আগুনের লিকলিকে শিখাটা ফরফর করে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মিনিট না গড়াতেই আমার চারপাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। কিন্তু বাড়িতে তো কেউ নেই। আমার চিৎকার শুনবে কে? আমি মাতম করছি আর আল্লাহকে ডাকছি। অগ্নি স্ফুলিঙ্গ চামড়া ভেদ করে ছুঁয়ে দিয়েছে মাংস। অব্যাখ্যেয় যন্ত্রণায় কাঠকয়লার মতো পুড়ছে দেহ। বাথরুমে ছুটে যাচ্ছিলাম গায়ে পানি দেবার জন্য। কিন্তু তার আগেই মনে হলো জ্ঞান হারাব। এই প্রদাহ আর সইতে পারছি না। উচিত ছিল আরো আগেই গা থেকে জামাটা খুলে ফেলা। কিন্তু মাথায় কোনো বুদ্ধি খেলেনি। তারস্বরে ফায়ার এলার্ম বেজে উঠল। ততক্ষণে বিষাক্ত ধোঁয়া আমার হৃৎপিণ্ড বিকল করে দিয়েছে। পুড়ে ছারখার হওয়া শরীর থেকে চেতনা ছিন্ন হওয়ার আগে আমার বাবা-মা বোন, বন্ধু কারো কথাই মনে পড়ল না। মৃতপ্রায় মস্তিষ্কে একটিমাত্র ভাবনা বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে গেলো, 

মরে যাবার আগে শিহাবকে আমি আর একটাবার দেখতে পেলাম না। মানুষের জীবন এতো বেশি ছোট কেন? 

লিখতে পারছি না, ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে বসে কাঁদছি এখন। কাঁদছি এ কারণে যে জাহান্নামের আগুন নাকি পৃথিবীর আগুনের চাইতে আরো সত্তরগুণ বেশি উত্তপ্ত হবে। পৃথিবীর আগুনই আমরা সইতে পারি না, জাহান্নামের আগুন সইব কী করে? আল্লাহ আমাকে কীসের শাস্তি দিয়েছেন আমি জানি না, তবে সেই দিনটার পর থেকে আমি জানি যে আমাদের এই বিশ্বসংসার এক মায়াপ্রপঞ্চময় ঠুনকো খেলাঘর বৈ অন্য কিছুই নয়। এই খেলাঘরের একটা মুহূর্তের ভরসা নেই! মানবজীবন পদ্মপাতায় জমে থাকা টলটলে শিশিরবিন্দুর মতো নাজুক এবং ক্ষণস্থায়ী। যখন তখন গড়িয়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। অ্যালার্ম বেজে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের লোক ছুটে এসেছিল। আমাদের কিচেন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কয়লা হয়ে গিয়েছিল ড্রইং রুমের সোফা, ডাইনিং এর টেবিল, চেয়ার, কার্পেট। সময় মতো দমকলবাহিনী না আসলে পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। 

এরপরের স্মৃতিগুলো কী বীভৎস, কী কষ্টের! শারীরিক যন্ত্রণা এতো বেশি অসহনীয় পর্যায়ের ছিল যে, আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো এর চেয়ে মৃত্যুই ঢের ভালো ছিল। এতো কষ্ট যেন আমার শত্রুরও না হয়। দেহের চল্লিশ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। শ্বাসনালী দগ্ধ হয়নি, শ্বাসনালী দগ্ধ হলে আমাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। সেই দিনগুলো ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না! ইনটেনসিভ কেয়ারের ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাময় স্মৃতি আমাকে আজও ইলেকট্রিক শকের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে যায় বারে বারে। লাশকাটা ঘরের মতো নিশ্ছিদ্র শীতল অন্ধকার দিনগুলোতে হঠাৎ একদিন আমার শাশুড়ির আবির্ভাব হলো। কেবিনে তাকে ঢুকতে দেখেই আমি কাতর কণ্ঠে বললাম, ‘মম শিহাব কোথায়? এতবড় দুর্ঘটনার কথা শোনার পরেও আমাকে একবার দেখতে এলো না?’ 

আমার শাশুড়ি স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর, নাহ সেসব কথা আমি আর মনে করতে চাই না, চাই না, চাই না! আমার স্মৃতি থেকে সেই দিনগুলো, সেই কথাগুলো হারিয়ে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক, শূন্যে মিলিয়ে যাক চিরতরে! 

শেষবার তার সাথে দেখা হয়েছিল গ্রীষ্মের বিকেলে। পরনে একটা ছাই রংয়ের কুঁচকানো টিশার্ট, কালো হাফ প্যান্ট। গালভর্তি এবড়োথেবড়ো দাড়ি। চোখের দৃষ্টি দিশাহারা, কপালের ভাঁজে ভাঁজে দুশ্চিন্তার প্রলেপ। তবুও সেই লম্বা, চওড়া শরীরে রেস লাগা দুরন্ত ঘোড়ার মতো ঝরঝরে, টগবগে সৌন্দৰ্য বিরাজমান। আমি পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটু দূরে চেয়ার পেতে লিও, হেইলি আর স্টেসি বসে আছে। ওদেরকে পাশে রাখা হয়েছে সঙ্গত কারণে। শিহাব গাড়ি থেকে নেমে মন্থর পায়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বিগত কদিনের নারকীয় যন্ত্রণা আমাকে আগের চাইতে অনেক বেশি শক্ত করে তুলেছে। মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসা মানুষের কাছে পার্থিব আবেগ অনুভূতি কতটা তুচ্ছ সেটা যারা ভুক্তভোগী তারাই বোঝে। তবে এই মুহূর্তে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা শুধুমাত্র আমার জীবনে নয়, মৃত্যুতেও এক এবং অনন্য দুর্বলতা। এই মুখটা এক নজর দেখবার জন্য আমি শত সহস্র বছর ডহর বহ্নিশিখায় নিরন্তর জ্বলে পুড়ে খাঁক হতে রাজি আছি। 

শিহাব আমার দিকে স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছে। নাকের পাটা ফোলা, অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বুক ওঠানামা করছে। ওর সেদিনকার অসহায় মুখটা এখন আমার মনে পড়ছে আর বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। বুঝে উঠতে পারছি না কোন দহন বেশি কষ্টের, আগুনের নাকি বিরহের। লম্বা গাউনে আমার শরীর ঢাকা। হিজাবটা এমন ভাবে পরেছি যেন মুখের একপাশ আবৃত হয়ে থাকে। আমার মন চাইছে ছুটে গিয়ে ওর বুকের ওপর পড়ি। লক্ষ চুম্বনে ধুয়ে দেই ওই মুখ। কিন্তু আজ আমার কাছে থেকে সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। আজ আমাদের দুজনের মধ্যিখানে অনতিক্রমণীয় দূরত্ব। 

—‘রুশানিয়া!’ 

আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ও আমার দিকে এগিয়ে আসছে। গলার স্বর অসম্ভব কাঁপছে। ঢোঁক গিলছে ক্রমাগত। 

আমি হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলাম, ‘যা বলবার ওখান থেকেই বলো!’ 

ও আমার কথা গ্রাহ্য করল না। ক্ষিপ্র পদক্ষেপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘কোথায় ছিলে এতদিন? কী হয়েছিল?’ 

আমি দু পা পিছিয়ে এলাম। এখনো শরীরের ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি। হাসপাতাল থেকে ফিরলাম মাত্র গতকাল। খুব সাবধানে থাকতে বলেছেন ডাক্তার। পোড়া চামড়া দিয়ে জীবাণু ঢোকার সম্ভাবনা থাকে। একবার ইনফেকশন হয়ে গেলে ভয়াবহ বিপদ! ওর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা বড় শ্বাস নিলাম। আমাকে খুব সংক্ষেপে কথা সারতে হবে। বেশি সময় নেয়া যাবে না। এমন কিছু করতে হবে যেন ও আমাকে ঘেন্না করে। সেই ঘোর তীব্রতা যেন ওর মন থেকে আমার সমস্ত স্মৃতি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। 

—‘শিহাব শোনো, তোমাকে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। আমার পক্ষে আর তোমার সাথে থাকা সম্ভব না।’ 

ওর ঠোঁটজোড়া বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে। বারান্দায় বিকেল শেষের রোদ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সেই রোদের আলোয় ওর যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমার বুক গুড়িয়ে যাচ্ছে দুঃসহ কষ্টে। এখন মনে হচ্ছে এই দেখাটা না হলেই বরং ভালো হত। কিছু না বলেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু শেষবারের মতো ওকে দেখবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। 

—‘তুমি এসব কী বলছ?’ কেটে কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করল ও। 

আমার হাত পা কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে। দাঁত দিয়ে শক্ত করে ঠোঁট চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম কাঠ হয়ে। কোনো উত্তর দিলাম না। শিহাব আরো এক পা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরার চেষ্টা করে বলল, ‘চলো বাসায় চলো! অনেক হয়েছে!’ 

চট করে পিছিয়ে গেলাম, ‘তুমি চলে যাও! আর কোনোদিন আমাদের বাসায় এসো না। বিরক্ত করো না!’ 

শিহাব ক্রুদ্ধ হয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরতেই লিও চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। শিহাবের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ব্যাক অফ ম্যান!’ 

স্টেসি আর হেইলি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। শিহাবকে দেখে মনে হলো কেউ ওর কলিজা বরাবর উত্তপ্ত লৌহ শলাকা বিঁধে দিয়েছে। চোখজোড়া রক্তলাল, কপালের শিরা স্ফিত। শক্ত চোয়াল রাগে আর অপমানে কাঁপছে ঠকঠক করে। লিওকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল সামনে থেকে। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হয়নি। আমার সামনে স্টেসি আর হেইলি দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীর হয়ে। ও মেয়েদের গায়ে হাত দেবে না, জোর করবে না। এটা আমি জানি। 

—‘রুশমি তুমি কেন এরকম করছ আমার সাথে? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো!’ 

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আই হ্যাভ নেভার লাভড ইউ শিহাব! ইট ওয়াজ অলওয়েজ লিও। 

—‘লিও কোত্থেকে আসল? মিথ্যা কথা বলছ কেন?’ 

—‘মিথ্যা নয়, এটাই সত্যি।’ 

—‘আমার ভাইটা অসুস্থ, পাপা অসুস্থ। এরকম অবস্থায় তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না! দয়া করো!’ 

ওর বাদামি চোখের কার্নিশ উপচে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে এখন। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। আজকের এই দেখা করাটা ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। আমার উচিত ছিল কাউকে কিছু না জানিয়েই চলে যাওয়া। আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শেষ বিকেলের রোদ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে গ্রীষ্মের উত্তপ্ত আকাশ। কেউ দেখছে না এই রক্তক্ষরণ। এই রক্তক্ষরণ দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছি। দরজা বন্ধ করার আগে ওকে কাঁপা গলায় বলতে শুনলাম, ‘রুশানিয়া প্লিজ! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। খোদার কসম!’ 

আমি স্বগতোক্তি করছিলাম, আজকের এই কষ্ট তোমার জীবনটাকে অনেক বেশি দৃঢ় এবং সবল করে তুলবে। ভেবে দ্যাখো একজন পুরুষ একজন নারীর কাছে কী চায়? যা চায় তা দেবার মতো কোনো সামর্থ্য তো আমার আর রইল না। তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে ঘেন্না করো। আমার মতো অপয়া মেয়ের তোমার জীবন থেকে চলে যাওয়াই উত্তম। সময়ের পরিক্রমায় মৃত্যু শোকও ধুয়ে মুছে যায়। বিগত পাঁচটি মাসের স্মৃতি তোমার সুসজ্জিত, আলোকিত জীবনের এক কোণায় ময়লা আবর্জনার মতো অবহেলায় পড়ে রবে। একটা সময় শোকের দাহ থেমে যাবে। তোমার জীবনে নতুন কেউ আসবে। তুমি আবার ভালোবাসবে কিন্তু শিহাব! শোনো লক্ষ্মীটি, একটা কথা বলি? আমাকে যতটা ভালোবেসেছ তার চাইতে একটু কম ভালোবেসো ওকে কেমন? আর আমাকে যেভাবে আদর করতে…. ঠিক সেভাবে তাকে আদর করো না যেন কখনো…, আর তোমার কণ্ঠমণিতে কখনো চুমু খেতে দিও না তাকে, এই আমার শেষ চাওয়া তোমার কাছে! 

দরজায় ডাকাত পড়েছে। একটার পর একটা লাথি পড়ছে। পুরো বাড়ি কাঁপছে থরথর করে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। ও তারছেঁড়া পাগলের মতো আমার নাম ধরে চিৎকার করে যাচ্ছে ক্রমাগত। এই পাগলামো দেখে ভয় করছে আমার। আম্মুজানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাল সকালে ফ্লাইট। আমাকে ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। শিহাবের মাকে কথা দিয়েছি যে, আমার অলক্ষণে ছায়া তার ছেলের জীবনে আর কোনদিন পড়বে না! 

আমাদের ভিয়েনার বাড়িটা ছেড়ে দিতে হলো। ওখানে আমার এতো এতো স্মৃতি যে আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য ঐসব জ্বলজ্যান্ত স্মৃতি চোখের সামনে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করা রীতিমতন দুষ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাসিখুশি প্রাণবন্ত পরিবারটা হঠাৎ করেই কঙ্কালসার প্রাণশূন্য জড়বস্তু হয়ে উঠেছে। প্রলয়ঙ্করী দুর্ধর্ষ ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন মুষড়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবেই মুষড়ে পড়েছে এই পরিবারের সদস্যরা। এ বছর মেজোর গ্র্যাজুয়েশন পার্টি হবার কথা ছিল। আমার দুর্ঘটনার পর সেই বেচারির গ্র্যাজুয়েশন পার্টির কথা আর কারো মনেই রইল না। বাবাজান আমার সাথে নিউইয়র্ক এসেছে। আম্মুজানের এক বান্ধবীর বাসায় উঠেছি আমরা। আমার চিকিৎসা হচ্ছে। পোড়া ক্ষত অনেকখানি শুকিয়েছে। কিন্তু পোড়া ঝলসানো চামড়ার যত্ন আত্তি করা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। একটু এদিক সেদিক হলেই ইনফেকশন হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। ব্রিটেনের মতো চমৎকার হেলথকেয়ার আমেরিকায় নেই। ইন্স্যুরেন্স থাকার পরেও এখানকার হাসপাতালে নিয়মিত সেবা নেবার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হয়। আমার চিকিৎসার খরচ বাবাজানই দিচ্ছে। সেই তো দেবে। সে ছাড়া আমার আর আছে কে? কিন্তু তার মাথার ওপর এই বিপুল ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমি একটুও শান্তি পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে ভুগছি। আগামীকাল আমার অপারেশন হবে। জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্টেজ থ্রি। ডাক্তার বলেছে এখনো শরীরের অন্য কোথাও সংক্রমিত হয়নি। তাই যতদ্রুত সম্ভব ওটা কেটে ফেলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে আমার শারীরিক অসুস্থতার বিস্তারিত বিবৃতি এই উপন্যাসে ইচ্ছাকৃত ভাবেই উহ্য রাখা হলো। এসব বিষয় নিয়ে আমার কথা বলতে কখনওই ভালো লাগে না। তাই যতটুকু একেবারে না বললেই নয়, ততটুকুই বলছি। 

সার্জারির খবরটা আমাকে খুব একটা বিচলিত করেনি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা পোড়া ঝলসানো চামড়ার এক বিধ্বস্ত মেয়ের জন্য শরীরের একটা অংশ কেটে ফেলে দেয়া তেমন কোনো গুরুতর ব্যাপারই না। দ্রুত অপারেশন করে বিপদমুক্ত হওয়াই এখন আমাদের সকলের একমাত্র প্রত্যাশা। আমার শুধু শিহাবকে একটা বার দেখতে ইচ্ছে করছিল। একটাবার ওকে জানাতে ইচ্ছে করছিল যে, ওর রুশানিয়া গত কয়েকটা দিন কী ভয়াবহ নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছে। মনে হচ্ছিল ওকে একবার সামনে পেলে, ওর বুকে একটাবার মাথা রাখতে পারলে সমস্ত জ্বালা মিটে যাবে। আমার জীবনের জিয়নকাঠি যে ওই একটা মানুষেরই হাতে! 

বাবাজান সর্বক্ষণ আমার সাথে আছে। এতো ভালো সে আমাকে অনেকদিন বাসেনি! বিশেষ করে বিয়ে সংক্রান্ত নানা জটিলতার মুখে পড়ে আমি ভেবেছিলাম আমার শৈশবের সেই প্রাণপ্রিয়, লাভিং, কেয়ারিং বাবাটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। অসুস্থতার উছিলায় আমি আমার পুরোনো বাবাকে ফিরে পেয়েছি। সে একজনই আমার টেক কেয়ার করার জন্য যথেষ্ট। তবে এই মানুষটা গত এক দেড় মাসের ভেতর মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে। তার মুখের দিকে তাকালে আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। জীবনে কখনো আমি তাকে এতটা অসহায় অবস্থায় দেখিনি। আজীবন আমরা তার প্রতিটি আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছি। আমার বাবা মেনীমুখো, নরম সরম পুরুষ ছিল না। সে ছিল প্রতাপবান, রাগী স্বভাবের একরোখা পুরুষ। কিন্তু কন্যার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা তাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। সে এখন জানে ব্যক্তিগত জিদ, সামাজিক নিয়মনীতি, এবং পারিবারিক মান মর্যাদার চাইতে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। শিহাবের মায়ের পরিকল্পনা কোনো মতেই কাজ করত না যদি বাবাজানের ভেতরে এই পরিবর্তন টুকু না আসত। দুর্ঘটনার দিনই সেই মহিলা বাবাজানকে বলেছিল শিহাবকে আপাতত কিছু বলার দরকার নেই। দূরে আছে, দুশ্চিন্তা করবে। বাবা, আম্মুর কাছে এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক মনে হয়েছে। সত্যিই তো, এতো বড় দুর্ঘটনার ধাক্কা সইতে পারবে না ছেলেটা। দূর থেকে কিছু করতেও পারবে না। দুশ্চিন্তার দরুন অফিশিয়াল কাজেও মন দিতে পারবে না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবার পরেই তাকে জানানো হবে। পরিবারের বড়রা ছোটদেরকেও সতর্ক করে দিল, কোনো মতেই যেন জামাইয়ের কানে দুর্ঘটনার খবর না যায় আপাতত। বেচারা একদম ভেঙে পড়বে। আত্মীয়দের মধ্যেও ঘটনাটা খুব একটা ছড়ালো না। ভার্জিনিয়ায় আমাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় বলতে ঝুম্পা আপুরাই আছে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ এই খবর জানতে পারল না। বস্তুত আমার পরিবারের সদস্যদের তখন বিষয়টা কাউকে বলে বেড়াবার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। একটু লুকোচুরি মনোভাবও কাজ করেছে তাদের মাঝে। মেয়ে আগুনে পুড়ে গেছে এই খবরটা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে লুকোতে পেরেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল তারা। 

শিহাবের মা যেদিন আমার কেবিনে আসলো, তার আগেই ডাক্তার আমার সাথে ক্যান্সারের রিপোর্ট নিয়ে কথা বলেছে। শিহাবের মায়ের কানে কথাটা কী করে গিয়েছিল জানি না তবে আমার ওই মহিলার প্রতি বিশেষ কোনো রাগ অথবা বিদ্বেষ নেই। বরং মনে মনে আমি তার প্রতি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। কেন না, আমার দুর্ঘটনা কবলিত কষ্ট জর্জরিত মন পরিষ্কারভাবে তখন কিছুই ভাবতে পারছিল না। কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার সামর্থ্য তখন আমার কিংবা আমার পরিবারের সদস্যদের ছিল না। ওই মহিলা নিদারুণ কিছু সত্য কথা অকপটে বলে ফেলায়, আমার চোখের সামনে বাস্তব দুনিয়াটা 

মুহূর্তের মধ্যে ঝিনুকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমি এক নিমেষে বুঝে গিয়েছিলাম যে শিহাবের রুশানিয়া হারিয়ে গেছে, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই পোড়া দগদগে ঘা ওয়ালা শরীরের রুশমিকে শিহাব কখনো ভালোবাসেনি। এখন তো ডাক্তার অপারেশন করে আমার সব ফেলে দেবে! এই বাস্তব সত্য উপলব্ধিটা যে মানুষ আমার ভেতরে সর্বপ্রথম জাগ্রত করেছিল সে আমার শাশুড়ি। আমার প্রাণপ্রিয় স্বামীর প্রাণাধিক প্রিয় মা। সেই মহিলার প্রতি আমি একরকম কৃতজ্ঞই বলা চলে। কারণ সে আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছে। 

ভার্জিনিয়া ছেড়ে নিউইয়র্ক আসার পরদিন শিহাব বাবাজানের মোবাইলে ফোন করে খুব দুর্ব্যবহার করল। তার ধারণা বাবাজানের কথা মতোই আমি এই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে নাকি বাবাজানের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করবে। দেখে নেবে দশ হাত। আমি ওকে কলব্যাক করে শাসালাম। বললাম আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে জানি। অন্য কারো সাধ্য নেই আমার ওপর মতামত চাপিয়ে দেবার। পুলিশে রিপোর্ট করে আমার পরিবারকে যদি সে হেনস্থা করে, তবে তার প্রতি চড়াও হওয়া ঘেন্নাটা আরো দ্বিগুন হবে, কমবে না কোনো অংশেই। এবং আমিও উল্টো তার বিরুদ্ধে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের মিথ্যে কেস করব। সে সময় শিহাবের বাবা এবং ছোট ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। বেচারা সবদিক থেকেই ভেঙে পড়েছে। আমার পেছনে চোরপুলিশ খেলার মতো পর্যাপ্ত সময় এবং মানসিক দৃঢ়তা তার সেই মুহূর্তে নেই। নিউইয়র্কে থাকা অবস্থায় বাবাজানের ফোন থেকে কয়েকবার ওর সাথে কথা হয়েছে। ফোন করে গালিগালাজ করত। আমাকে, আমার বাবা-মাকে, আমার পুরো পরিবারকে। আমি কখনওই ওর ফোন কল এড়িয়ে যাইনি। কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে এটা বিশ্বাস করানো যে কোন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি ওকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেইনি। বরং ওর প্রতি আমার মন থেকে বিতৃষ্ণা এসে গেছে বলেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। সে যখন মনে প্রাণে এটা বিশ্বাস করতে পারবে যে আমি তাকে আর চাই না, তখন আমাকে ভুলে যাওয়াটা তার জন্য খুব সহজ হবে। হওয়া উচিত। একদিন বলল, ‘তুমি কি লিওকে বিয়ে করবে?’ 

—‘কেন নয়?’ 

—‘তোমার ধর্মপ্রাণ বাবা একজন বিধর্মী ছেলের সাথে তোমাকে বিয়ে দেবে?’ 

—‘ও মুসলিম হবে।’ 

এখানে একটা কথা জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে লিও সেই সময় অনির্দিষ্ট কালের জন্য ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছিল ওর গ্র্যান্ড মা’র কাছে। তাই ভার্জিনিয়ায় ওর অনুপস্থিতি শিহাবকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে লিও এই মুহূর্তে আমাদের সাথেই আছে। 

—‘আমি তোমার মতো বাজে মানুষ জীবনে আর একটিও দেখিনি, তুমি জানো?’

—‘জানলাম।’

—‘আই ক্যান্ট এক্সপ্লেইন যে তোমাকে আমি কতটা ঘৃণা করি।’

—‘বেশ তো। এতই যদি ঘৃণা করো তো রোজ ফোন করে বিরক্ত করো কেন? প্লিজ আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও, নিজেও শান্তিতে থাকো।’ 

—‘তোমাকে শান্তিতে আমি থাকতে দেব না। যে কষ্টটা তুমি আমাকে দিয়েছ তার প্রতিশোধ নেবই নেব!’ 

অপারেশনের পর নিউইয়র্কে আমরা আর খুব বেশিদিন থাকলাম না। কেমো দেয়ার কারণে মাথার চুল টুলও পড়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের চেহারা দেখে নিজেই শিউরে উঠি। কিছুতেই চাই না আমার এই বীভৎস রূপ কখনো শিহাব প্রত্যক্ষ করুক। এবার আমাকে পালাতে হবে। জীবনটাকে শুরু করতে হবে নতুনভাবে। কতিপয় চেনাজানা লোকের চোখে আমি এখন সম্পূর্ণ করুণার পাত্রী বনে গেছি। এদের করুণা আমাকে পীড়া দেয়। আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে। আমাকে এই পরিচিত সমাজ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। যেখানে শুরু থেকে এই কুৎসিত আমাকেই লোকে চিনবে। তারা জানবে যে আমি একজন সাহসী জীবন যোদ্ধা। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে না, আহারে মেয়েটা কী সুন্দর ছিল, আর কী হয়ে গেলো! 

আজকাল চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে। টাকা আর ধৈর্য থাকলে সব সম্ভব। বাবা বলেছিল আমাকে প্লাস্টিক সার্জারি করাবে। আমার এই ঝলসানো চামড়ার চেহারা বোধহয় ওদেরও আর সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু প্লাস্টিক সার্জারির পেছনে যে পরিমাণ খরচ হবে তাতে বাবাজানের এ যাবৎ কালের উপার্জনের পুরোটাই ধ্বংস হবে। তার ব্যবসার অবস্থা এখন এমনিতেই ভালো নয়। উপরন্তু আমার চিকিৎসার পেছনে হাজার হাজার ডলার খরচ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় তার ওপর প্লাস্টিক সার্জারির খরচের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার মানে হলো সরাসরি গলায় ছুরি চেপে ধরা। আমার ছোট দুটো বোন আছে। ওদের ভবিষ্যতের কী হবে? তাছাড়া নার্ভ ড্যামেজ, ব্লাড ক্লট, অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন, পিগমেন্টেশনের মতো সার্জিক্যাল ঝুঁকি তো থেকেই যায়। সার্জারির পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সময়টাও বেশ লম্বা। সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হবার সম্ভাবনা কম। কারণ আমার শরীর মাত্র ক্যান্সার থেকে আরোগ্য লাভ করেছে। এখনই প্লাস্টিক সার্জারির মতো গুরুতর মেডিকেল ট্রিটমেন্টে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে হাসপাতালে দীর্ঘদিন একটানা কাটাবার পর আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। যেকোনো উপায়ে এই নরক থেকে মুক্তি চাই। বাবা কেন? ওবামা এসেও যদি বলে তোমার সার্জারির খরচ আমি দেব, তবে আমার উত্তর হবে ‘না!’ 

শিহাবকে ফিরে পাবার জন্য নতুন চামড়া লাগিয়ে নতুন মানুষ হবার বাসনা আমার নেই। শিহাবের মা বলেছে, আমি তার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরে গেলেই নাকি তার ছেলে ভালো থাকবে, নিরাপদে থাকবে। আমার মতো মিসফরচুন, অসুস্থ একটা মেয়ের উপস্থিতি তার ছেলের জন্য পীড়াদায়ক হবে। স্বাভাবিকতা বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না তার জীবনে। সে আমার কাছে হাতজোড় করে তার ছেলের স্বাভাবিক জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। আমার কানে এখনো কথাগুলো বাজে। শিহাবের মা অন্ধকার কেবিনে আমার চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

—‘মম শিহাব কোথায়? এত বড় দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরেও সে আমাকে একবার দেখতে এলো না?’ 

—‘রুশমি শোনো, তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমার একটা অপারেশন করতে হবে?’ 

আমি থমকে গেলাম। ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ‘জি জানি।’ 

—‘কথাগুলো শুনতে নিশ্চয়ই তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। আমার ছেলেটাকে তুমি বাঁচাও। ও তোমার এই অবস্থা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।’

লেলিহান আগুনের শিখা আমার শরীর পোড়াতে পেরেছিল শুধু, হৃদয় ছিল অক্ষত। কিন্তু সেই অক্ষত হৃদয়েও এই মাত্র আগুন লেগে গেলো। আমি ভদ্রমহিলার কথা র নিগূঢ় অর্থটা ধরে ফেলেছি। শুনেছিলাম স্বার্থ মানুষকে অন্ধ এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তোলে। আজকে সেই শোনা কথার চাক্ষুস প্রমাণ পেলাম। 

—‘দ্যাখো রুশমি, প্রথম কিছুদিন হয়তো শিহাব তোমাকে ভালোবাসবে, কিন্তু তারপর? বাকি জীবনটা তুমি তোমার স্বামীর কাছে শুধুমাত্র করুণার পাত্রী হয়ে থাকবে। তোমাদের বিয়ে হয়েছে ছয়মাসও হয়নি। এক্ষুনি যদি তুমি শিহাবকে ছেড়ে দাও, তাহলে তোমাদের দুজনের পক্ষেই একে অপরকে ভুলে যাওয়াটা খুব সহজ হবে। আমার ছেলেটার সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। ও কেন এভাবে সাফার করবে? ওর দোষটা কোথায়? তোমাকে তো ও নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেনি। আমি জোর করে আমার পছন্দ ওর ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। নিজ হাতে নিজের ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।’ এই বলে শিহাবের মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এমন সময় আমার বাবাজান আর আম্মুজান প্রবেশ করল ঘরের ভেতর। শিহাবের মা তাদের দেখে হাতজোড় করে বলল, ‘আপনারা দয়া করুন। আমার ছেলেটাকে বাঁচান।’ 

বাবাজানকে আমি কখনো কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। তার মতো শক্তপোক্ত জেদি পুরুষমানুষ কাঁদতে পারে, তা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু সেদিন আমি তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুনলাম, ‘আমার মেয়েটা মরে যাচ্ছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে। মৃত্যুর সাথে লড়ে যাচ্ছে অনবরত। এরকম অবস্থায় আপনি স্বার্থপরের মতো এই কঠিন কথাটা বলতে পারলেন? আপনি কি মানুষ?’ 

—‘আমি মনে প্রাণে চাই আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠুক। কিন্তু দয়া করে এই দুর্ঘটনার খবরটা আমার ছেলের কানে দেবেন না। আমি আমার ছেলের একটা স্বাভাবিক জীবন চাই। আমি বংশধর চাই। যা দেবার ক্ষমতা আপনার মেয়ের নেই।’ 

বাবা খুব রেগে গেলো এবার। চিৎকার করে উঠে বলল, 

—‘আপনি বেরিয়ে যান এখান থেকে! এক্ষুনি বেরিয়ে যান!’ 

শিহাবের মা থতমত খাওয়া চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বাবার ক্রোধ জর্জরিত হিংস্র মুখটার দিকে। তারপর কান্নার ঢোঁক গিলে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। যা করার আমাকেই করতে হবে।’ 

আম্মুজান কথা বলল, ‘কী করবেন আপনি? আমি এক্ষুনি জামাইকে ফোন করে জানাচ্ছি পুরো ঘটনা। সবটা শোনার পর সে যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমরা মেনে নেব।’ 

—‘আমার ছেলে কী সিদ্ধান্ত নেবে আমি জানি। সে সহমরণে যাবে! আজীবন এই অসুস্থ মেয়ের বোঝা নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবে। আমি চাই না! কিছুতেই চাই না এমনটা হোক।’ এটুকু বলে শিহাবের মা আমার দিকে ফিরে তাকালো, ‘অ্যাই রুশমি, তুমি কি চাও শিহাবের চোখে আজীবন করুণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে? 

আম্মু তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আপনি এখান থেকে যান। আমার মেয়ের সাথে আর একটা কথাও বলার চেষ্টা করবেন না। যান এক্ষুনি নইলে আমি নার্স ডেকে বলছি আপনি রোগীকে বিরক্ত করছেন।’ 

শিহাবের মা বেরিয়ে যাবার পর আম্মুজান বলল, ‘আমি শিহাবকে ফোন করে সব বলছি। এই মহিলা খুব ডেঞ্জারাস। এর কথা মতো চুপ করে থাকা যাবে না।’ 

আমি বললাম, ‘আম্মু দাঁড়াও। এই মুহূর্তে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমাকে চিন্তা করতে দাও।’ 

বাবাজান বলল, ‘তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। তোমার স্বামীকে এই দুর্ঘটনার খবর জানানো আমাদের দায়িত্ব।’ 

এবার আমি কেঁদে ফেললাম, ‘বাবাজান প্লিজ! আমার কথাটা একটু শোনো। একটাবারের জন্য শোনো! শিহাবের মা ভুল কিছু বলেনি। আমি এই করুণার জীবন চাই না। আমি চাই শিহাব যেন আমার এই দুর্দশার কথা কোনো দিন জানতে না পারে!’ 

বাবাজান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ঘাড় ঘুরাতে পারি না। আমার ঘাড় থেকে শুরু করে কোমর অবধি ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। নড়লেই তীব্র যন্ত্রণা হয়। চোখের কোণায় আমি বাবাজানের আবছা মুখটা দেখতে পাচ্ছি। সে কুঞ্চিত কপাল আর রক্তলাল চোখ নিয়ে বলছে, ‘শিহাব কী করবে সেই ডিসিশন ওকেই নিতে দাও। ঘটনা জানার পর সে যদি তোমাকে ছেড়ে দিতে চায় তো দিক! এরকম স্বার্থপর নিষ্ঠুর বিবেকহীন পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্ক থাকার চাইতে না থাকাই ভালো।’ 

আমি কাঁদতে লাগলাম, ‘বাবাজান তুমি বুঝতে পারছ না। শিহাব কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেবে না। আমার সাথে থেকেই ও নিজেকে নিজে নিঃশেষ করে তুলবে দিনকে দিন। ও একটা বেটার লাইফ ডিজার্ভ করে, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ডিজার্ভ করে। আমি ওর এতো বড় সর্বনাশ করতে পারব না। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বাবা!’ 

বছর দেড়েক আগে পত্রিকায় নিউজ এসেছিল এক মা তার নিজ সন্তানকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। কী অসম্ভব ঘটনা! বাবাজান সেই ঘটনা পড়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ তায়ালা যা ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তা খণ্ডাবার সাধ্য কারো নেই।’ বাবার বলা কথাটা যে কী ভীষণ সত্য তা আমি এখন প্রতিনিয়ত হাড়ে হাড়ে টের পাই। মার্ক টোয়াইনের প্রসিদ্ধ একটি উক্তি খুব মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। বিকজ ফিকশন ইজ অব্লাইজড টু স্টিক উইদ পসিবিলিটিস। ট্রুথ ইজ নট।’ এই অতিশয় সত্য বচন আজকাল আমার মধ্যে নিগূঢ় এক উপলব্ধির সঞ্চার করে। আদতেই সত্য কল্পনার চাইতে অনেক বেশি অদ্ভুত। ফিকশন হ্যাজ টু বি পসিবল বাট ট্রুথ ডাজ নট! মানবমন ততটুকুই কল্পনা করে যতটুকু দেখা বা শোনার অভিজ্ঞতা তার আছে। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের অজ্ঞাতসারে যে কাহিনী প্রতিনিয়ত লিখে যায়, সেই কাহিনী মানুষের কল্পনার বাইরে! আমরা কল্পনাও করতে পারি না প্রকৃতি আমাদের ভাগ্য নামক জার্নালে ঠিক কোন অসম্ভবটাকে সম্ভব করে তোলার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। 

শিহাবকে আমরা কিছুই জানালাম না। শিহাবের মা-বাবা ছেলের কাছ থেকে এই তথ্য গোপন করার জন্য যা যা প্রিকশন নেয়া প্রয়োজন তার সবটাই নিল। কোথাও কোনো ত্রুটি রইল না। তবে সত্য গোপন করার এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করল তাদের নিজ পরিবারের ওপর ধেয়ে আসা দুর্যোগ। কারণ সেই সময় জাহিদের অ্যাকসিডেন্ট না হলে, পাপার হার্ট অ্যাটাক না হলে শিহাব যেকোনো উপায়ে আমার হদিশ উদ্ধার করে ফেলত। কিন্তু পরিবারের চরম দুর্দশার দিনে তার পক্ষে আমার পেছনে অতটা মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। যখন পরিস্থিতি অল্পবিস্তর ধাতস্থ হয়েছে, তখন আমি তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছি। অথচ দ্যাখো কী কাণ্ড! দুহাজার পনের সাল ক্যালেন্ডারের পাতায় অদৃশ্য হয়েছে সেই কবে! আঠারো শেষ হয়ে এলো। কিন্তু শিহাব এখনো আমাকে ভুলতে পারেনি। মনে পড়ে সেই সময় আমার আম্মুজান জায়নামাজে বসে কেঁদেছিল অনেক। বলেছিল শিহাবের মা কোনোদিন সুখী হবে না। তার কৃতকর্মের ফল আজীবন তাকে তাড়া করে বেড়াবে। তবে কি আমার আম্মুর অভিশাপই লেগে গেলো ওদের পরিবারে? জাহিদটার একসিডেন্টে পা ভেঙে গিয়েছিল। এখন নকল পা লাগিয়ে চলাফেলা করে। চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো নয়। যে কোনো মুহূর্তে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সব শেষে একটা কথাই মনের ভেতর দূর সমুদ্রে জেগে ওঠা চরের মতো ভেসে ওঠে বারংবার, স্বার্থপর মানুষেরা দিনশেষে কখনো ভালো থাকে না! 

দু-হাজার পনের থেকে দুহাজার আঠারো, এই তিন বছরে আমি মোট দশবার স্থান পরিবর্তন করেছি। আমার পরিবার ভার্জিনিয়া ছেড়ে টেক্সাসে সেটেল্ড হয়েছে। বিক্রি করে দেয়া হয়েছে রেস্টুরেন্ট এবং কফিশপ। বাবাজান চলে গেলো দুহাজার সতেরোর শেষে। মারা যাবার সময় সে আমার সাথেই ছিল। নিউ অর্লিপ্স এর ছোট্ট একটা গ্রামে। বাবার মৃত্যুর পর আমি চললাম লুইজিয়ানা। আম্মুজান এবং ছোটবোনদের সাথে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল সাশার সাথেও। সাশা আজ বিকেলে আমার এখানে আসবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ওর এখানে আসাটা ঠিক হচ্ছে না। শিহাব নাকি সন্দেহ করছিল যে, আমার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সাশা কিছুটা হলেও জ্ঞাত। মোদ্দা কথা হলো, ইদানিং মনে হচ্ছে মা বোন এবং সাশার সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখাটা আমার পলাতক জীবনের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এদের মাধ্যমে শিহাব যেকোনো মুহূর্তে আমার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলতে পারে। সেই সম্ভাবনার কারণেই আমি ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আর কত? এখন মনে হচ্ছে এবার সাশার সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তবেই ওদের জীবন থেকে আমার ছায়া সরে যাবে চিরতরে। ধরা পড়ে যাবার ভয়টা আজকাল আমাকে খুব তাড়া করে বেড়ায়। আমি কিছুতেই শিহাবের সামনে এই চেহারা নিয়ে হাজির হতে চাই না। প্রথম কটা দিন ভালোবাসবে, তারপরের কটা দিন করুণা করবে। বাকি জীবন অসুস্থ এক নারী ভাগ্যে এসে জুটেছে বলে মনে মনে আফসোস করবে। মানুষ তো! ফেরেশতা তো নয়! আমি চাই না আর দশজনের মতো সেও আমার ওপর করুণার দৃষ্টি স্থাপন করুক। যে মানুষটা আমাকে একদিন সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিল সে মানুষটা আমাকে পোষা খোঁড়া গৃহপালিত বেড়ালের মতো করুণা করছে, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। যা পেয়েছি, যতটুকু পেয়েছি, ওর চোখের ভেতরে নিজেকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছি, সেই অমূল্য পাওয়াটুকু নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চাই। বেশি লোভ করতে গিয়ে শেষ সম্বলটুকুও হারাতে চাই না। 

আমার নতুন জীবনটা কিন্তু খারাপ ছিল না। শহর থেকে দূরে, সো কল্ড আত্মীয়-স্বজনদের চোখের দৃষ্টির বাইরে, প্রকৃতির একদম কাছে, ছিমছাম, নির্ঝঞ্জাট এক জীবন! সুস্থভাবে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তাই আমি আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের শুকরিয়া আদায় করি আল্লাহর কাছে। শুধু একটাই সমস্যা। দুহাজার পনের সালটা হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের মতো তেড়ে এসে আমার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিতে চায়। মাঝেমাঝে মনে হয় নর্থ ডাকোটার এই বুনো বাংলোতে শুধু আমার শরীরটাই উপস্থিত আছে। ভেতরকার সত্ত্বাটা রয়ে গেছে দুহাজার পনেরোর সেই বসন্ত দিনে, অ্যাশবার্নের দোতলা বাড়িতে, প্রশস্ত জানালা ওয়ালা ঘরটার পিয়ানোর রিডে, উইলো ফরেস্টের ক্রিকের ধারে! চোখ বন্ধ করলে আমি এখনো ওর আশ্চর্য সুন্দর হাসিটা দেখতে পাই। আমার শরীর মন পবিত্রতায় ভরে যায়। বাতাসে ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ ফিরে আসে। টের পাই। আমাদের ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে! দূরে চলে এসেছি বলেই ভালোবাসাটাকে বাঁচাতে পেরেছি। কাছে থাকলে দয়া, কৃপা আর অনুকম্পার প্রাবল্যে এই স্বৰ্গীয় ভালোবাসার রমণীয় রূপ এবং মাধুর্য নষ্ট হয়ে যেত। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *