রুশমি
সেই সকালটা আমার চোখের সামনে আজও চলচ্চিত্রের মতো ভাসছে। এক আকাশ নীল মাথায় নিয়ে আমি আর শিহাব দাঁড়িয়ে আছি অ্যাশবার্নের দোচালা বাড়ির প্যাটিওর সামনে। আমি নিজেকে ওর ভুজবন্ধনে দেখতে পাচ্ছি। মাথাটা ওর বুকের ওপর রাখা। ওই বুকের ভেতরের হৃদযন্ত্রের নিরবিচ্ছিন্ন ধুকপুকানি নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি। আমার মন এখন শান্ত। শিহাব যে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসেছে এটাই আমার জন্য অনেক। এর চেয়ে বেশি কিছু যেন কখনোই চাওয়ার ছিল না। আমি চোখ বুজে সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করছিলাম ওর শান্তিময় অস্তিত্ব।
কতক্ষণ কেটেছিল সঠিক বলতে পারব না। শিহাব আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘একটু দাঁড়াও, আসছি।’
লিও আর স্টেসি তখন সাইকেলে চড়ে প্রস্থানোদ্যত হয়েছে। শিহাব লিওর পথরোধ করে দাঁড়ালো। বিনীত ভাবে বলতে লাগল কিছু একটা। আমার কানে ওদের কথোপকথন আসছে না। কী বলছে, কী চলছে ওদের ভেতর তা আমি জানি না। কেনো যেন জানার কোনো আগ্রহও বোধ করছি না। আমি জানি শিহাব কেন লিওর সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এই দুর্ব্যবহারে আমার কিছুই এসে যায়নি। আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। লিওর সাথে কথোপকথন শেষ করে শিহাব ফিরে আসছে। একটু কেমন খুঁড়িয়ে হাঁটছে ও। চোখ লাল। অবিন্যস্ত চুল। হালকা নীল রংয়ের ইন করা ফর্মাল শার্টের ডানদিকের সামনের অংশ প্যান্টের ভেতর থেকে অসাবধানতাবশত বেরিয়ে এসেছে। খেয়াল করলাম শার্টটা বেশ একটু কুঁচকেও গেছে বুকের দিকে। ও আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। কেমন যেন লজ্জা লাগছে এখন আমার। এক অপ্রতিরোধ্য সংকোচে কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। বুক কাঁপছে প্রবল ভাবে। আমি সদর দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শিহাবই প্রথম কথা বলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো? তোমার কী হয়েছিল?’
—‘আমার আবার কী হবে?’
—‘তোমার বাসায় গিয়েছিলাম গতকাল। তোমার বাবা, আউট অফ নো হোয়্যার; হি ওয়াজ অ্যাকটিং উইয়ার্ড।’
ড্রইং রুমের ল্যান্ড ফোনটা বেজে যাচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে। এবার মনে হলো ফোনটা রিসিভ করা দরকার। শিহাবের কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুললাম। মেজোর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
—‘বড়পু শোনো, বাবাজান তোমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তোমার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। ফুপি বলেছে যে করেই হোক তোমাকে ওই বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হবে কয়েকটা দিন। তোমার শাশুড়ির সাথে নাকি ফুপির একটা কোল্ড ওয়ার হয়ে গেছে। অবস্থা ভয়াবহ।’
—‘এসব কখন হলো? তুমি কোথায়?’
—‘আমি আম্মুজানের সাথে কফিশপে এসেছিলাম। বাবাজানও এখানে ছিল এতক্ষণ। এইমাত্র বেরিয়েছে তোমার শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে। তুমি, তুমি বাসা থেকে বের হয়ে যাও। বাবাজান যেন তোমাকে খুঁজে না পায়।’
ভয়ে আমার হাত পা জাড় হয়ে আসার উপক্রম হলো। শিহাব আমার রক্তশূন্য মুখ দেখে বিচলিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে?’
আমি মেজোকে বললাম, ‘ওরা বললেই তো হবে না। আমার লাইফ, যা ডিসিশন নেয়ার আমিই নেব।’
—‘তুমি তো বাবাজানকে চেনো বড়পু। ফুপির আদেশ সে যে করেই হোক পালন করবে। সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও। শিহাব ভাইয়াকে খুঁজে বের করে ওর সাথে খোলামেলা কথা বলো।’
—‘ঠিক আছে, এখন রাখি পরে কথা হবে। খবরটা দেয়ার জন্য থ্যাংকস হানি! লাভ ইউ!’
—‘লাভ ইউ টু বড়পু! স্টে সেইফ!’
কামিজের ওড়নাটা হিজাবের মতো মাথায় কোনোরকমে জড়িয়ে নিয়ে, পায়ে স্যান্ডেল পরে শিহাবের হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। শিহাব একটু ঘাবড়ে গেছে। কপালে ভাঁজ, ভ্রুজোড়ায় কুঞ্চন। বেচারা এমনিতেই ক্লান্ত। সারারাত কোথায় কোথায় ঘুরে বেরিয়েছে কে জানে। এই অবস্থায় ওকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নেবার সুযোগ না দিয়ে রাস্তায় টেনে নিয়ে আসতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। বাবাজানের সামনে পড়ে গেলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করতে পারব না। বড়দের মুখের ওপর কথা বলার অভ্যাস নেই আমার। বাবা যা বলবে মাথা নত করে তাই-ই মেনে নিতে হবে। এর চেয়ে বরং তাকে এড়িয়ে চলাই ভালো। শিহাবকে ঠেলেঠুলে গাড়িতে তুললাম। স্টার্ট দেবার আগে জরুরিভিত্তিতে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার সাথে ওয়ালেট আছে তো? আমার কাছে টাকা পয়সা নেই কিন্তু।’
শিহাবের মুখে চূড়ান্ত বিস্ময় খেলছিল। এবার ওর গলা চড়ে গেলো, ‘রুশমি প্লিজ! আমাকে সবটা খুলে বলো। হয়েছে কী? কে ফোন করেছিল?’
—‘বলব, তার আগে আমার কিছু খেতে হবে। আই অ্যাম স্টারভিং। নাও বাকল আপ!’
শিহাব একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বাধ্য ছেলের মতো সিটবেল্ট বাঁধল। ডেনিজ এ পৌঁছে জানালার ধার ঘেঁষা একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আমরা। ওয়াফেল আর প্যানকেক অর্ডার দিলাম। শিহাব অর্ডার করল চিজ বার্গার। আমি ভেতরে ভেতরে এখন একটু স্বস্তি বোধ করছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত যে, মেজো ঠিক সময়ে তথ্যটা দিয়েছিল। শিহাব টেবিলের ওপর ডান কুনুই রেখে হাতের তালুতে চিবুক ঠেকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমার মুখের চামড়া অজস্র প্রাচীন দুর্বোধ্য অক্ষরে ঠাঁসা কোনো শিলালিপি। এসব হিজিবিজি অক্ষরের অর্থ উদ্ভাবনের দায়িত্ব পড়েছে সামনে বসা মানুষটার ওপর। মানুষটা অতি মনোযোগের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। বাদামি চোখের ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে বুদ্ধির দ্যুতি। ওই সপ্রতিভ, বিচক্ষণ দৃষ্টির সামনে পড়ে আমার কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। আমি বুঝতে পারছি এই মুহূর্তেই ওকে সবটা খুলে বলা খুব জরুরি। কিন্তু কী হয়েছে জানি না, আমি কোনো কথা গুছিয়ে নিতে পারছি না। জিব জড়িয়ে যাচ্ছে, ভারী হয়ে আসছে।
—‘তোমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল কেন? রাতে ঘুমোওনি?’
মনে মনে রাগ হলো প্রশ্নটা শুনে। যে মানুষের দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুম হারাম করে জেগে বসে থাকলাম সেই মানুষ কিনা এখন রং ঢং করে প্ৰশ্ন করছে ‘রাতে ঘুমোওনি?’
যার জন্য চুরি করা সেই বলে চোর!
কী উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, নার্ভাস লাগছিল। সত্যিই চেহারাটা এক রাতের ধকলে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি, মুখের ত্বক রুক্ষ, চুলে জটা। অথচ শিহাবকে কিন্তু একটুও খারাপ দেখাচ্ছে না। শীর্ণ মুখে ক্লান্তির রেশ আছে। কিন্তু এই ক্লান্তি এবং শীর্ণতা যেন তার চেহারার শ্রী বর্ধন করেছে, নিধন করেনি কোনো অংশেই। ঈর্ষা ভরা চোখে কিছুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থেকে বললাম,
—‘ঘুম হয়নি’
—‘কেন হয়নি সেটাই জানতে চাইছি রুশমি। তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছ?’
—‘মম তোমার খোঁজ করছিল। তোমার ফোন বন্ধ কেন?’
—‘চার্জ নেই।’
—‘আমার গাড়িতে চার্জার আছে, চার্জ দিয়ে নিও।’
ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খাবারে মনোযোগ দিলাম। খেতে খেতে একবার বললাম, ‘তুমি গতকাল আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে চেয়েছিলে শিহাব; আজকে যাবে?’
ও হাসে, ‘আমি কী করে নিয়ে যাব? ইনচার্জ তো তুমি!’
—‘ঠিকানা দিলেই তো যেতে পারি।’
ও কিছু বলে না। মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। আমি বিব্রতভাবে প্যানকেক চিবোই। সারারাত ভেবেছি ওকে এক মুহূর্তের জন্য সামনে পেলেই মনের সব কথা উজাড় করে দেব। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে আর দেরি করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। অথচ এখন মানুষটার সামনে বসে থেকে সারা শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ ওকে রসিকতার গলায় বলতে শুনলাম,
—‘এনিওয়ে, বার্থডে উইশ করার জন্য থ্যাংকস রুশানিয়া। ইট ওয়াজ আ নাইস জেশচার!’
আমার মুখটা আরো বেশি নত হয়ে গেলো সেই মুহূর্তে। পারলে খাবারের ভেতর ঢুকেই যাই। আমি ওর কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি। ধরতে পেরে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেছে ভেতরটা।
—‘রুশানিয়া!’
—‘হুম।’
— ‘তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ?’
—‘ন্যাহ’
—‘তোমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।’
—‘আমার মুখ কিছুই হয়নি; তোমার চোখ খারাপ হয়েছে।’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম’
—‘বলতে চাইছিলাম, তুমি যে আমাকে দেখামাত্র ছুটে এসেছ, জড়িয়ে ধরেছ।’
—‘চুপ করো!’
—‘কেন?’
—‘খাবার সময় এতো কথা বলতে হয় না, চুপ করে খাও।’
শিহাব
ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। নির্জন নীল আকাশে নিরুদ্দেশ উড়ছে কয়েকটা পলকা মেঘ। সূর্যের সোনালী আলো উপচে পড়ছে বসন্তের নবীন সবুজ পৃথিবীর ওপর। আমরা খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছি। রুশমি চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করছে। আমি ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে আড়চোখে ওকে দেখছি। দেখতে আমার ভালো লাগছে। গতকাল দীর্ঘসময় ব্যাপী দেখতে পাইনি বলেই হয়তো আজ এক সেকেন্ডের জন্যও ওই মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। গতরাতের ক্ষতিটুকু আজ কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নিতে চাইছে হিসেবী মন। গতকাল ভেবেছিলাম রুশমি আমাকে চায় না একথা মুখ ফুটে বলতে পারবে না বলেই বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ আজ সকালে ও যখন দৌড়ে ছুটে এসে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন বুঝলাম আমার ধারণা কতটা ভুল ছিল। এটা বুঝবার পর থেকে মনটা এক স্বর্গীয় সুখের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর সব্বাইকে ক্ষমা করে দিই। ক্ষমার মহানুভবতায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে অন্তর্লোক। এপাশ থেকে আমি রুশমির খাড়া নাক দেখতে পাচ্ছি। অদ্ভুত সুন্দর ঐশ্বরিক দুটি চোখের ওপরে সুবিন্যস্ত ভাবে পড়ে থাকা লম্বা পাপড়ি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি ফর্সা গাল। মাথায় জড়ানো ওড়নাটা কপাল থেকে ঈষৎ সরে গেছে। কয়েকটা রুক্ষ এলোমেলো চুল পড়ে আছে রোদ ডোবা কপালে। আমি ওর গালের ওপর একটা আঙুল রাখলাম আলতো ভাবে। ও মুখটা একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে লাজুক গলায় বলল, ‘দুষ্টুমি করো না, অ্যাক্সিডেন্ট করব।’
আমি হাত সরালাম না। ওর গালটা টেনে দিয়ে বললাম–‘তোমার সমস্যাটা কী?’
—‘কীসের সমস্যা?’ ভ্রুকুটি করে তাকায় রুশমি।
—‘তোমার মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতেই পারছি না!’ ও মিটমিট করে হাসে, কিছু বলে না।
—‘সমস্যাটা কি তোমার নাকি আমার?’
—‘আমার কোনো সমস্যা নেই!’
—‘নিশ্চয়ই আছে, নইলে তোমাকে দেখলেই এমন আদর করতে ইচ্ছে করে কেন?’
রুশমি মুখ লুকাতে জানালার বাইরে চোখ সরিয়ে নিল। গাড়ি চলছিল স্কাইলাইন ড্রাইভ ধরে। কখন এতটা পথ চলে এসেছি খেয়াল করিনি। আমাদের ডান পাশে উঁচু পাহাড়, বাম পাশে খাদ। খাদের ওপারে আকাশ ছোঁয়া পর্বত। ব্লুরিজ মাউন্টেইনের কোল ঘেঁষে সাপের মতো আঁকাবাঁকা চিকন রাস্তাটা উঠে গেছে তিন হাজার ফিট উঁচুতে। সাদা রংয়ের ফুরফুরে মেঘেরা নীল আকাশ থেকে নেমে এসে, শঙ্খচিলের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের সবুজ বনানীর ওপর, পিচঢালা রাস্তার ওপর। রুশমি একটা নির্জন পশ্চিমমুখী ভিউ পয়েন্টের সামনে গাড়ি থামালো। নামতে নামতে বলল, ‘এসো, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’
রাস্তার ধারের পাথুরে প্রাচীরের ওপর বসলাম আমরা। ওপারের পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে। রাস্তা দিয়ে একটা দুটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। তবে এদিকটায় কোনো ভিজিটর নেই আপাতত। আজ ওয়ার্কিং ডে। স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় কম হবার কথা। প্রাচীরের ওপাশে উত্রাই হয়ে নিচে নেমে গেছে মাটি। পাহাড়ের গায়ে সেজে আছে সদ্য জন্মানো গাঢ় সবুজ আগাছা আর নানা রংয়ের জংলী ফুল। ওপর থেকে উপত্যকাটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ে আছে। আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে রূপালি ফিতার মতো সর্পিল নদী, শেনানডোয়াহ। আরো আছে ছোট ছোট বাড়িঘর। রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি, দূর থেকে যেগুলোকে খেলনা বলে ভ্রম হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ব্লুরিজ মাউন্টেনের উঁচু শৃঙ্গ। মিশে গেছে আকাশের সাথে। একদম উঁচুতে, আকাশের নীল আর পাহাড়ের সবুজ এখন আর আলাদা করা যাচ্ছে না। রোদের প্রলেপ পড়ায় সবটা একই রকম দেখাচ্ছে। শুধু পর্বতের চূড়োগুলোতে পাতলা একটা সীমারেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেউ যেন কাঠপেন্সিল দিয়ে এই মাত্র পাহাড়ের মাথায় একটা মুকুট এঁকে দিয়েছে। জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে এখানে এসে চুপচাপ পাহাড় আর আকাশের অলৌকিক মিলনরেখার ওপর চোখ রেখে বসে থাকি। পাহাড়ের চূড়োয় সূর্যের আলো নানারকম অপার্থিব রূপের খেলা দেখায়। সেইসব অপার্থিব খেলা পার্থিব মনের জটিলতা ক্রমশ অপসারণ করে তোলে। মন ভালো হয়ে যায়। রুশমিরও বোধহয় এই জায়গাটা পছন্দ। আমি তো ওকে বলিনি এখানকার কথা। ও নিজ উদ্যোগেই এসেছে।
—‘শিহাব!’
—‘বলো, আমি শুনছি।’
রুশমি মুখটা একটু নিচু করে বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘আমার ফুপির কাছে কেউ একজন তোমার কিছু ছবি পাঠিয়েছে, আপত্তিকর ছবি। তো আমার ফুপি খুব রেগে গেছে ছবিগুলো দেখে। বাবাজানও রেগে গেছে।’
আমি বিস্ময়বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে আছি রুশমির দিকে। একটা অনভিপ্রেত চমক আমাকে বাকরুদ্ধ করে তুলেছে। মুখের ভাষা পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলেছি। ঠিক সেই সময় আমার সেলফোনটা বেজে উঠল। মমের নাম্বার থেকে কল আসছে। ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বিক্ষুব্ধ গলার স্বর ভেসে এলো।
—‘শিহাব, বাবা তুমি ঠিক আছ?’
—‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।’
—‘রুশমি কোথায়?’
—‘আছে, আমার সাথেই আছে।’
—‘শোনো, ওকে ওর বাবার বাড়িতে রেখে এসো আপাতত।
—‘কেনো?’
—‘ওর ফুপু আমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন ওদের মেয়েকে আমরা জোর করে তুলে নিয়ে এসেছি। এই বিয়ে যেন ওদের অমতে হয়েছে। এতো অসভ্য ফ্যামিলি আমি জীবনেও দেখিনি।’
আমি অপ্রস্তুতভাবে ফোনের স্পিকারের ভলিউম চেক করলাম একবার। রুশমি কথাগুলো শুনতে পেলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। বসা থেকে উঠে রাস্তার অপর প্রান্তে হেঁটে এলাম। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললাম, ‘এতো চিন্তার কিছু নেই মম। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে।’
—‘তুমি আমার কথা শোনো। মেয়েটাকে ওদের বাড়িতে রেখে এসো। এইমাত্র ওর ফুপু ফোন করে বলেছে তুমি নাকি ওদের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছ। তোমার পাপা খুব দুশ্চিন্তা করছে এসব শোনার পর থেকে। রুশমির বাবাকে ফোন করেছে বেশ কবার। লোকটা ফোন ধরেনি। অভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে ফেলছে এরা, ছিঃ
আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘আমার বৌকে নিয়ে আমি পালিয়ে গেলে ওদের সমস্যা কোথায়?’
—‘সমস্যা কোথায় আমি জানি না বাবা! শুধু বুঝতে পারছি এরা মানুষ সুবিধার নয়। খুব বড় ভুল করে ফেলেছি এদের সাথে সম্পর্ক করে। তাছাড়া তোমার কীসব ছবির কথা বলল ওরা। আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।’
—‘শোনো মম, ফোন রাখছি। পরে কথা বলব। একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। ছবির ব্যাপারটা তুমি বিশ্বাস করেছ?’
—‘না করিনি।’
—‘তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। প্রব্লেম সলভ হয়ে যাবে।’
—‘তুমি মেয়েটাকে ওদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। ঝামেলা মিটে যাবার পর ওরা যখন নিজ ইচ্ছায় মেয়ে ফিরিয়ে দেবে তখনই আমরা গ্রহণ করব।’
—‘আই লাভ ইউ মম। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো।’
মমের কন্ঠস্বর এবার কাঁপতে লাগল, ‘আমি সব সময় তোমার জন্য দোয়া করি বাবা। তোমরা ছাড়া আমার আর আছে কে?’ ফোন কেটে দিলাম। আমার মায়ের কান্না আমার সহ্য হয় না। সরু রাস্তাটার ওপর রূপো রংয়ের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল কুয়াশার মতো। মেঘের সারির ভেতর দিয়ে লক্ষ্য করলাম রুশমি সীমাহীন উদ্বেগ আর কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। উদ্বেগ এখন আমারও হচ্ছে। কোত্থেকে যেন একটা গা ছমছমে ভয় এসে এতক্ষণের শান্ত স্থির মনটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। একটা দলা পাকানো কষ্টে বুক ভারী হয়ে উঠেছে। আমি রুশমির কাছে এসে দাঁড়ালাম, প্রাচীরের সামনে।
—‘কী ছবি পাঠিয়েছে? কে পাঠিয়েছে?’
রুশমির মুখটা দুশ্চিন্তায় একটুখানি হয়ে গেছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি বিস্তারিত জানি না। মনে হয় শুভ্রার কাজ।’
—‘কিন্তু ওর কাছে তো আমার কোনো আপত্তিকর ছবি থাকার কথা না। ইনফ্যাক্ট কারো কাছেই থাকার কথা না। আরেকটা কথা হলো, সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই তোমার বাড়ির লোকেরা বাড়াবাড়ি করছে কেন? এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
—‘বাড়াবাড়ি করা আমাদের বাড়ির নিয়ম।’
—‘নিয়ম পালন করতে গিয়েই তোমার বাবা সমস্ত জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে তুলছে। নিয়ম পালন করা ছাড়াও মানুষের জীবনে অন্য কাজ আছে। উনাকে কথাগুলো বোঝাতে পার না?’
—‘শিহাব প্লিজ! বাবাজানের বিরুদ্ধে কিছু বলো না। আমার খারাপ লাগবে। তোমার মম কী বলল?’
ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে, ভারী গলায় বললাম, ‘মম বলছে তোমাকে তোমাদের বাসায় রেখে আসতে।’
—‘ও!’ ছোট করে শব্দটা উচ্চারণ করে রুশমি চুপ করে গেলো। পাহাড়ের সবুজ গাছগাছালির ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই শব্দে হাওয়া ছুটে যাচ্ছিল। রুশানিয়া ওর লম্বা চুলগুলো মুড়িয়ে খোঁপা বেঁধেছে। ওড়নাটা গলায় জড়ানো। ও বসে আছে। আমি দাঁড়িয়ে। আমাদের দুজনের মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে ধোঁয়াটে মেঘ চলাচল করছে। পেছনের পাহাড়ের সবুজ জঙ্গলে ডাকছে অজস্র নাম না জানা পাখি। দূরের বিস্তৃত আকাশে ছড়িয়ে আছে নিষ্কলঙ্ক নীল! সেই নিষ্কলঙ্ক নীলের ওপর দূরগত চোখ রেখে আমি বললাম, ‘তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, তবে অন্য লোকে কী বলল তাতে আমার কিছুই এসে যায় না।’
রুশমি বসা থেকে উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। এক টুকরো সোনাবরণ রোদ, পলকা মেঘের আস্তর ভেদ করে ওর গালের ওপর উড়ে এসে বসেছে। জন্মকাজল পরা চোখদুটি ঈষৎ জলসিক্ত। রোদের ছটায় চিকিচিক করছে ওই জলবিন্দু। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে ওকে!
—শিহাব, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি!’
হঠাৎ আমার বুকটা অপরিসীম সাহসে টইটুম্বুর হয়ে উঠল। মনে হলো রুশমি পাশে থাকলে বুঝি আমি পৃথিবীর সমস্ত বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করতে পারব। আমি ওর চিবুকে হাত রেখে মুখটা একটু ওপরের দিকে তুলে ধরলাম -’তুমি কি তোমাদের বাসায় ফিরে যেতে চাও?’
—‘তুমি চাইলে আমিও চাইব। তোমার চাওয়াটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ!’
—‘আমি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাই না!’
রুশমি ওর আশ্চর্য সুন্দর চোখজোড়া আমার চোখের ওপর স্থিরভাবে স্থাপন করে নরম গলায় বলল – ‘তাহলে আমাকে তোমার কাছেই থাকতে দাও, অন্য কোথাও যেতে দিও না!’
রুশমি
একটা কাঠঠোকরা ঠকঠক শব্দে কাঠ ঠুকরে যাচ্ছে অনেকক্ষণ হলো। শিহাব আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে পাথরের প্রাচীর টপকে ঢালু পাহাড়ের ওপর নেমে পড়েছে। নামা মাত্র প্রাচীরঘেঁষা ঝোপঝাড়ে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই লালচে গায়ের এক বুনো শেয়াল ঝোপ থেকে লাফ দিয়ে দৃশ্যমান হলো। পাহাড়ের গা বেয়ে তরতর করে নেমে গেলো নিচে। শিহাব হলদে আর বেগুনি রংয়ের জংলী ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছিল। খানিক বাদে মুঠোভর্তি ফুল নিয়ে প্রাচীর টপকে ফিরে এলো পূর্বের জায়গায়। মুখোমুখি দাঁড়ালো। ফুলগুলো আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর ভঙ্গিতে বলল, ‘রুশানিয়া, তুমি কি আমার হৃদয়াক্ষী হবে?’
আমি কাঁপা হাতে ফুলগুলো তুলে নিলাম। শিহাব আমার দুই বাহু চেপে ধরে নিজের অনেক কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতে পারছি না। কিছু বলতেও পারছি না। বুক ধড়ফড় করছে অসহনীয় আনন্দ এবং উত্তেজনায়। শিহাব বলছিল,
—‘তোমার মতামতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। তুমি মানো আর না মানো তুমিই আমার হৃদয়াক্ষী। আমার অন্ধকার হৃদয়কে আলোকিত করার আশ্চর্য কৌশল তোমার জানা আছে!’
ঝকঝকে রোদ জড়ানো উড়ো হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছিল মুখে। সেই হাওয়ায় কী সুন্দর একটা বনজ ঘ্রাণ! আমি বুক ভর্তি করে তাজা নিশ্বাস টেনে নিলাম। নিজের ভেতর অফুরান প্রাণশক্তি টের পাচ্ছি এখন। দুনিয়ার সব ক্লেশ, জরা আর বেদনা যেন কেটে গেছে, ক্ষয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে!
ওর চোয়ালের ওপর একটা হাত রেখে গাঢ় স্বরে বললাম,
—‘আমিই তোমার হৃদয়াক্ষী। কেউ মানুক আর না মানুক এটাই সত্য! আর তুমি, তুমি আমার কী জানো?
— ‘কী?’
আমি ওর সুন্দর, সুডৌল কণ্ঠমণিতে নিবিড়ভাবে ঠোঁট স্পর্শ করলাম একবার। আমার অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত, অভিলাষিত, অপূর্ণ চাওয়া পূর্ণ হলো। আমি তৃপ্ত হলাম, তুষ্ট হলাম! এক অনির্বচনীয়, অমর্ত্য সুখে আমার সমস্ত সত্তা আবিষ্ট হয়ে এলো। ওই বাদামী চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, ‘তুমি আমার সবকিছু!’
ও আমার সারা মুখে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলো। একখণ্ড রূপালি মেঘ তখন আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। আড়াল করে ফেলেছে জাগতিক পৃথিবী থেকে। আমার বদ্ধ চোখের কার্নিশ উপচে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। আমি ভেসে যাচ্ছি অনুভূতির আদিগন্ত জ্বলোচ্ছাসে। হঠাৎ কেমন গভীর গলায় ওকে বলতে শুনলাম, ‘তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো, রুশানিয়া?’
—‘যাব না!’
—‘টিল ডেথ ডু আস অ্যাপার্ট!’
আমি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বিড়বিড় করে বললাম, ‘টিল ডেথ ডু আস অ্যাপার্ট!’
বলেছিলাম বটে কথাটা। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই বলেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই শপথ রক্ষা করতে পারিনি। পৃথিবীতে সব মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না। আমিও সেইসব দুর্ভাগা মানুষ-মানুষীদেরই দলভুক্ত একজন। তবে ওই একটা দিন আমার একশ বছরের নিস্তরঙ্গ জীবনটাকে অমৃত সুখের প্রস্রবণে নিমজ্জিত করে তুলেছিল। সেই সুখ জীবনে অব্যয় হয়নি বটে, তবে সেই সুখের রেশ আজও আমার মনের অতলান্তে ধ্রুব সিদ্ধি হয়ে বিরাজমান। ওই সিদ্ধি বা উপলব্ধি এই গভীর রাতের নির্জন অরণ্যবাসে কোত্থেকে যেন জান্নাতের সুগন্ধি নিয়ে এসেছে। একটা পবিত্র ঘ্রাণে ভরে গেছে চারপাশ। অনুভূতিগুলি এখনো কী ভীষণ জীবন্ত! ব্লুরিজ মাউন্টেইনের ওপর নিরুদ্দেশ ভাসতে থাকা ছন্নছাড়া মেঘদের স্পর্শ আমি টের পাচ্ছি। ওই তো পাথুরে প্রাচীরটার ওপর অবিন্যস্ত পা ফেলে হাঁটছি আমি। শিহাব আমার হাত ধরে প্রাচীরের নিচে হাঁটছে, আমার পাশাপাশি। যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই আমি পড়ে যাব। আমাদের কী হয়েছে কে জানে! আমরা একজন আরেকজনের চোখের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছি না। জনম জনমের সব দেখা যেন আজ একদিনেই দেখে ফেলব।
এখন আমরা পাথুরে প্রাচীরের ওপর পাশাপাশি বসেছি। শিহাব আমার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখেছে। বাতাসটা এতো জোরে বইছে যে, মনে হচ্ছে যেন কোনো নাবালিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। লালঝুটি মাথাওয়ালা কাঠঠোকরাটাকে এই মুহূর্তে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। উৎরাই ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মেপল গাছের গা ঠোকরাচ্ছে ঠকঠক করে। শেনানডোয়া কালো ভাল্লুকের জন্য বিখ্যাত। আমার মাথায় হঠাৎ ভাল্লুকের ভয় ঢুকল কেন জানি না। শিহাবকে বললাম,
—‘এখন বিয়ার আসলে কী হবে?’
—‘বিয়ার আসলে বিয়ারের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবে, পারবে না?’
—‘বিয়ারের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’
শিহাব আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, ‘আমি থাকতে তোমার ভয় কীসের রুশানিয়া?’
আমি চুপ করে রইলাম। ও মাঝে মাঝে সাধারণ কথাও এতো সুন্দর করে কথা বলে যে, সেই কথার মাধুর্য আমাকে বিবশ করে তোলে। আমি বোবা হয়ে যাই। এখন আমার মাথাটা ওর কাঁধের ওপর রাখা। নিশ্বাসে নিশ্বাস এসে লাগছে। প্রথম প্রেমের এই তীব্র আলোড়ন আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ড সইতে পারছে না, অস্বাভাবিক গতিতে ঢিপঢিপ করছে। খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে। শিহাব হাত দিয়ে চুলগুলো কপালের কাছ থেকে সরিয়ে, কানের পাশে গুঁজে দিল। বলল, ‘লিওর সাথে মিসবিহেভ করেছি বলে তুমি রাগ করেছ?
আমি মৃদুস্বরে বললাম, ‘না করিনি।’
—‘কেন?’
—‘আমি তো জানি ওই সময় তোমার মাথা গরম ছিল।’
—‘আমাকে বুঝার জন্য ধন্যবাদ। কেন এসেছিল ওরা অত সকালে?’ আমার এতক্ষণে মনে পড়ল ওদের কথা। সারাদিনের উদ্বেগ উত্তেজনায় ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়তেই দুশ্চিন্তা হতে লাগল স্টেসির জন্য। বন্ধু হিসেবে আমি বোধহয় একদম যুৎসই নই। বন্ধুর বিপদে বন্ধুর পাশে না থেকে নিজেকে নিয়ে মত্ত হয়ে আছি।
—‘এসেছিল একটা জরুরি কথা বলতে। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।’
—‘কী অ্যাকসিডেন্ট?’
—‘স্টেসি,শী ইজ এক্সপেক্টিং।’
শিহাব ভালোই চমকালো, ‘কী বলছ!’
—হুম ঠিকই বলছি, বেচারি খুব কান্নাকাটি করছিল। বাসায় এখনো কিছু জানাতে পারেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর বয়ফ্রেন্ড বাচ্চাটা চায় না। অ্যাবরশন করতে বলছে। বাট স্টেসি অ্যাবরশনের বিপক্ষে।’
—‘ওরা কি ক্যাথলিক? ক্যাথলিকরা খুব সম্ভবত অ্যাবরশন সাপোর্ট করে না। অ্যাকর্ডিং টু দেম অ্যাবরশন ইজ আ মোরাল ইভিল।’
—‘হ্যাঁ ওরা ক্যাথলিক। ওর ফ্যামিলি কীভাবে নেবে ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। প্যারেন্টসদের সেপারেশন চলছে। বাবা থাকে সিয়াটল। নিউ গার্লফ্রেন্ডের সাথে। মা খুব একটা রেস্পনসিবল পারসন না। ড্রাগ এডিক্ট। মেয়েটা একদম একলা পড়ে গেছে।’
—‘ওর বয়ফ্রেন্ড করে কী?’
—‘আপাতত উবার চালায়।’
—‘বাচ্চা চায় না কেন?’
—‘হি ইজ অনলি টোয়েন্টি টু! এই বয়সে বাবা হতে কে চায় বলো?’
—‘হুম’
ছোট্ট করে শব্দটা উচ্চারণ করে শিহাব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলে, ‘ডু ইউ লাইক কিডস?’
— ‘হ্যাঁ … বাচ্চাদের তো সবাই পছন্দ করে। তুমি?’
—ভীষণ! আমার যদি একশোটা ছানাপোনাও হয়, আমি কিছুই মাইন্ড করব না!’
–‘একশোটা? আর ইউ ক্রেজি?’
শিহাব হাসতে লাগল, ‘সংখ্যাটা একশোর চেয়ে বেশি হলেও সমস্যা নেই।
—‘পাগল! স্টেসির বয়ফ্রেন্ডের জায়গায় তুমি হলে কী করতে?’ হঠাৎ করে ফেললাম প্রশ্নটা।
শিহাব তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উত্তর দিল না। দূরের পাহাড়ের দিকে সরু চোখে চেয়ে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগল। আমি ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালাম না। ভাবনার সময়টায় ওকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখি ওর চিন্তাযুক্ত কপালের কুঞ্চন, ঈষৎ উঁচু করে রাখা চিবুক, পাথরে খোদাই করা দেবতাদের মতো নাক, বুদ্ধিদীপ্ত বাদামি চোখে রোদের ঝিকিমিকি! চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন নেশা লেগে যায় চোখে। ভালো লাগতে থাকে। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে ও বলল, ‘আমি যে করেই হোক বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখতাম। একটা নিষ্পাপ প্রাণ হত্যা করার চাইতে বড় অপরাধ আর হয় না।’
শিহাব
অফিস থেকে ক্রমাগত ফোন আসছিল। বেলা দুটার দিকে তাই অফিসে যেতে হলো। তার আগে আমরা শুভ্রার এপার্টমেন্টে একবার ঢুঁ মারলাম। ফ্ল্যাট খালি, তালা দেয়া। ফোন রিচ করছে না। উধাও হয়ে গেছে মেয়েটা। রুশমি আমাকে অফিসে ড্রপ করে স্টেসিদের বাসায় গেলো। অফিস থেকে উপর্যুপরি ফোন আসার কারণ ছিল আমার বার্থডে সেলিব্রেশন। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, তবুও ওই এক টুকরো স্মৃতি মনে গেঁথে আছে আজও। কলিগরা আমার জন্মদিন মনে রেখেছে। ফুলের তোড়ায় ভরে গেছে ডেস্ক। বিকেলে ওদেরকে নিয়ে ডিনারে যেতে হলো। আটটার দিকে মেট্রো আর বাসে করে বাড়ি ফিরলাম। বাস স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত প্রায় দশ মিনিটের হাঁটার পথ। আকাশে এখনো আলো আছে। সন্ধ্যেটা সুন্দর। আমাদের নেইবারহুডের রাস্তার দুপাশ ম্যাগনোলিয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। এখন ফুল ঝরে পড়ার সময়। গোটা রাস্তা গোলাপি ম্যাগনোলিয়ার পাঁপড়িতে ভরে গেছে। হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় যেন গোলাপি গালিচা। সূর্য অস্তগামী। পশ্চিমের আকাশে লাল, নীল আর বেগুনি রংয়ের নকশা। হাঁটতে ভালো লাগছিল আমার। হাঁটতে হাঁটতে পুরো সময়টাই রুশমির কথা ভাবছিলাম। আমার মনটা অন্যরকম এক স্বস্তিতে ছেয়ে আছে। আজ আমি বুঝতে পারছি গত কয়েক মাস যাবৎ কেন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় অবিদিত উৎকণ্ঠায় আমার ভেতরটা কাঁটা হয়ে থাকত। রুশমিকে দেখতে পাব কি পাব না, দেখতে পেলেও বা সে আমার সাথে কী রকম ব্যবহার করবে, আমিই বা কী বলব, কী করব, কী করলে একটু বেশি সময় ওর পাশে থাকতে পারব, এমনই সব অহেতুক দুশ্চিন্তা মনের অবচেতনে আমার নিশ্চিন্ত, ঘটনাবিহীন, অতি সাধারণ জীবনটাকে তিলে তিলে দুর্বিষহ করে তুলছিল। অথচ আজ, আজ আমি জানি যে শুধু আজকে নয়; আজকের পর থেকে প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন রুশানিয়া শুধু আমার!
বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি রুশমি লনের ঘাসের ওপর বসে বই পড়ছে। হাতে ম্যাগনোলিয়ার একটা ছিপছিপে ডাল। অন্যমনস্কভাবে ফুল ছিঁড়ছে ডালটা থেকে। চোখের দৃষ্টি বইয়ের পাতায় নেই। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে দূর আকাশে। সূর্য যেখানে অস্ত যাবার বিপুল আয়োজনে মত্ত। আমাকে দেখতে পায়নি সে। আমি ধীরপায়ে হেঁটে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।
—‘এইযে আমার ভাবুক বৌ! এতো কী ভাবছেন আপনি? লেখক হবার ইচ্ছে আছে নাকি?
রুশমি আমার দিকে চেয়ে ঝলমলে একটা হাসি দিল, ‘হতেই পারি!’
—‘অভ্যাস আছে লেখালেখির?’
—‘ডায়েরি তো লেখাই হয়।’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম।’
—‘বাংলা লিখতে পারো তুমি?’
রুশমি হাসে, ‘পারব না কেন?’
বিস্মিত না হয়ে পারি না, ‘আসলেই?’
—‘আসলেই!’ শব্দটা উচ্চারণ করে একটু সময় চুপ থাকে রুশমি। তারপর বলে, ‘লিখলে বাংলায়ই লিখব!’
—ভেবে বলছ? লিটারেচার ইজ সামথিং এক্সটা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, সাহিত্যের ভাষাটা ঠিক সেরকম নয়, জানো তো?,
—‘সাহিত্যের ভাষা কেমন তা জানি না। তবে লিখলে আমার মনের ভাষা দিয়েই লিখব।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘তুমি পড়বে?’
—‘নিশ্চয়ই পড়ব। মনের ভাষার চেয়ে সুন্দর আর কোন ভাষা হতেই পারে না!’
—‘তুমি তো গান লেখো। আমার বিশ্বাস তুমি ভালো গদ্য লিখতে পারবে।’
হো হো করে অট্টহাসি হেসে উঠলাম, ‘আমার লেখার মতো কিছু নেই।
—‘প্রতিটা মানুষের জীবনেই এমন কিছু কথা থাকে যা মুখ ফুটে বলা যায় না। শুধু লেখা যায়।’
—‘আমার জীবনে সেরকম কিছু নেই।’
—‘শুভ্রাকে নিয়েই নাহয় লিখে ফেলো।’
আমি সরু চোখে তাকালাম ওর দিকে, ‘শুভ্রাকে নিয়ে?’
—‘হ্যাঁ ওকে নিয়ে তো কম গান লিখলে না। এবার নাহয় অন্য কিছু লেখো।’
—‘প্রেমের উপন্যাস আমি হেইট করি। সস্তা ন্যাকামো যত্তসব।’
—‘সব প্রেমের উপন্যাসতো আর সস্তা হয় না। যেমন ধরো গ্রেট গ্যাটসবি।’
—‘ওটা লাভস্টোরি নয়, ট্র্যাজেডি।’
—‘ট্র্যাজিডির ভেতরের ভালোবাসাটা তুমি দেখতে পাওনি? অবশ্য না পাওয়ারই কথা। তোমার ভেতরে ওসব নেই।’
—‘কী নেই?’
প্রশ্ন শুনে ও চুপ করে থাকে। মিটমিট করে হাসে।
—‘তুমি কি আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাইছ রুশানিয়া?’
—‘তা কেন?’
— শুভ্রাকে নিয়ে খোঁটা দিচ্ছ কেন?’
রুশমি মুখ বাঁকালো কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে। তারপর সকৌতুকে বলল, ‘এই খোঁটা আপনাকে অনেকদিন শুনতে হবে শিহাব রেজা! বিয়ের রাতে বলেছিলেন আপনার শুভ্রাকে চাই। কোনোদিন ভুলব না!’
—‘তুমিও তো বলেছিলে তুমি আমাকে হেইট করো। সেটাও আমি কোনদিন ভুলব না।’
সেই সময় জাহিদ আর সাশাকে দেখলাম সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। কাছাকাছি এসে জাহিদ বলল, ‘ভাইয়া, তুমি ঠিক আছ? সব ঠিকঠাক?’
আশ্বস্ত করলাম ওকে, ‘সব ঠিকঠাক, চিন্তার কিছু নেই।’
জাহিদ রুশমির দিকে তাকালো এবার, ‘ভাবি, আঙ্কেল এসেছিল দুপুর দেড়টার দিকে। তোমাকে না পেয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিল। আর তোমার সেলফোনটা দিয়ে গেছে। বলেছে তুমি আসলেই যেন কল করো উনাকে।’
রুশমি বলল, ‘ফোনটা পেয়েছি।’
—‘কথা বলেছ উনার সাথে?’
—‘না বলিনি, এখন বলব।’
গাড়ির ব্যাকডালা থেকে রুশমির জন্য কেনা মোমবাতি আর বইগুলো তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। জন্মদিন উপলক্ষে ঘর সাজিয়ে একাকার করে ফেলেছে ওরা। সাশা নিজ হাতে কেক বানিয়েছে। বিশাল সাইজের দোতলা কেক। কেকের চাইতেও আমার বেশি পছন্দ হয়েছে ওর হাতে আঁকা ছবি। কী নিখুঁতভাবে এঁকেছে! যদিও ছবির রুশানিয়ার চাইতে বাস্তবের রুশানিয়া আরো অনেক বেশি সুন্দর! আমার বন্ধুরা এসেছে নানারকম খাবার দাবার নিয়ে। লক্ষ্য করলাম রুশমি একটু অন্যমনস্ক। আড্ডায় মন নেই।
কেউ কিছু জানতে চাইলে সঠিক উত্তর দিতে পারছে না। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলছে। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ বুঝে একবার প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার কী হয়েছে?’
—‘শরীরটা ভালো লাগছে না।’
—‘কেমন লাগছে?’
—‘বলে বোঝাতে পারব না।’
—‘ইউ শ্যড কনট্যাক্ট ইওর ডক্টর।
—‘আই অলরেডি ডিড। টিউজডেতে এপয়েন্টমেন্ট আছে।’
—‘মন ভালো?’
—‘একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
—‘কী নিয়ে?’
—‘বাবাজানকে নিয়ে।’
—‘ফোন করে কথা বলো।’
—‘সাহস হচ্ছে না!’
—‘সাহস করে কথা বলো রুশমি। নাকি আমি কথা বলব?’
—‘চিন্তা করে দেখি, একটু সময় দাও।’
গেস্টরা যেতে যেতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। দোতলার শোবার ঘরে উঠে এসে দেখি রুশমি সারাঘর মোমবাতির আলোয় আলোকিত করে ফেলেছে। সুগন্ধে ভরে আছে চারপাশ। আমি দরজার চৌকাঠে একটু সময় থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তটি কোনো সাধারণ মুহূর্ত নয়। এইযে রুশমিকে আমার যেচে পড়ে ঘরে ফিরে আসার অনুরোধ করতে হয়নি, ও নিজ থেকেই ফিরে এসেছে, এর থেকে সুখকর এবং স্বস্তির বিষয় যেন আর হতেই পারে না। পাঁচ বছর কেটে গেছে, অথচ আমার মনে হচ্ছে যেন এইতো সেদিন! বেগুনি রংয়ের সিল্কের জামা পরা রুশমিকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। অর্ধশত প্রজ্বলিত মোমবাতির মাঝে মুখজোড়া এক অদ্ভুত অভিনিবেশ নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে মেঝের ওপর বসে আছে ও। এমন ভাবে বসে আছে যে দেখে মনে হচ্ছে যেন আমারই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। হঠাৎ মনে হলো আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এই মেয়েটিই একমাত্র পরম এবং শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আমি যেন এতটা পাবার যোগ্য নই। এই মানবী আমার অতি সাধারণ আটপৌরে জীবনের এক আশ্চর্য অমূল্য উপহার!
রুশমি
শিহাবের জন্মদিনে এত লোক আসবে আমি ভাবতেও পারিনি। সত্যি বলতে কি আমার ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা না থাকলে হয়তো আজকের রাতটা বেশ উপভোগ করতাম। কিন্তু উপভোগ করার মতো কোনো উপায় রইল না। সারাটাক্ষণ স্নায়বিক চাপ অনুভব করছি। অজ্ঞাত অশুভ আশঙ্কায় বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয় হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি বাবাজান অথবা ফুপি চলে আসবে। এসেই শিহাবের সাথে দুর্ব্যবহার করবে, জোরপূর্বক ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে আমাকে এ বাড়ি থেকে। কিংবা আমার শাশুড়ি ফোন করে কড়া সমালোচনা করবে ফুপি আর বাবাজানের বিরুদ্ধে। মন মতো আতিথেয়তা করতে পারলাম না। সাশা ছোটমানুষ হলে কী হবে, চমৎকারভাবে সামলে নিল সবকিছু। আমাকে বলল রুশমি তোমার শরীর খারাপ লাগলে রেস্ট নাও। আমি দেখছি এদিকটা। কথা রাখল সে। আমাকে আর কোন কাজেই হাত লাগাতে দিল না। একাই টেবিল সাজিয়ে ফেলল। খাবার অবশ্য শিহাবের বন্ধুরাই নিয়ে এসেছিল। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করাটাই বিশাল ঝক্কি ঝামেলার কাজ বলে মনে হচ্ছিল আমার কাছে। দুর্বিষহ দুশ্চিন্তার চাপ নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। সাশা এই ঝামেলা থেকে বাঁচালো আমাকে। মেয়েটা ভারী লক্ষ্মী, গুণীও বটে।
শিহাব আমাকে অনেকগুলো ক্যান্ডেল আর বই উপহার দিয়েছে। উপহারগুলো আমার মনে নিষ্কলুষ আনন্দের উদ্রেক করেছে এবং সেই সাথে উদ্রেক করেছে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধের। অপরাধবোধ এই কারণে যে, জন্মদিনে ওকে আমি কিছুই উপহার দিতে পারিনি। আমার মাথাটা কেমন গোলমেলে হয়ে আছে। কোনো কাজ প্ল্যান মোতাবেক করতে পারছি না। এখন বেডরুমে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছি অনেকক্ষণ হলো। শিহাব ওর বন্ধুদের সাথে নিচে আছে। এই বন্ধুরা কখন প্রস্থান করবে জানা নেই। আমার সময় কাটছে না। অপেক্ষার সাগরে আকণ্ঠ ডুবে আছি। কখন ওকে একটু নিরিবিলিতে নিজের করে পাব সেই আকাঙ্ক্ষায় পথ চেয়ে আছি। এই বন্ধুগুলোর ওপর রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। লাস্ট উইকেন্ডেই তো লেট নাইট আড্ডা দিলে তোমরা, গানের প্রাকটিসও করলে। আজকের রাতটা আমাদের স্বামী- স্ত্রীর জন্য একটু ছেড়ে দাও না ভাই! জন্মদিন তো প্রতি বছর তোমরা নিয়ম করেই পালন করো, এ বছর নাহয় নিয়মের একটু ব্যতিক্রম হলো।
আমার বই পড়ায় মন বসছে না। দুরুদুরু হৃৎপিণ্ড নিয়ে সেলফোন হাতে বসে আছি। মেজোকে বলেছি ওই বাড়ির হালচাল যেন আমাকে যথাসময়ে জানিয়ে দেয়। কোনো আপডেট মিস করতে চাই না। সময়টা কেমন দম- চাপা আর পাগল পাগল। দিশাহারা লাগতে থাকে রীতিমতন। হঠাৎ দরজাটা খুলে যায় ওপাশ থেকে। সাদা পাঞ্জাবি পরা মানুষটা দরজার চৌকাঠে একটু সময়ের জন্য দাঁড়ায়। উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখে একনজর। আমার এতক্ষণের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ফুৎকারে উড়ে যায়!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ও ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকে দিল। কয়েক পা এগিয়ে এসে ঘরের মেঝেতে সাজিয়ে রাখা ক্যান্ডেলগুলোর ওপর চোখ রাখলো। তারপর আমার দিকে চেয়ে নীরবে হাসলো একবার। আমার বুকের জমিনে ঝরে পড়ল রাশিরাশি শিউলি ফুল। মনে হলো যেন ওই এক টুকরো হাসির জন্যই আমার তৃষিতা বক্ষ এতক্ষণ ধরে জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছিল।
ওকে দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চায়। পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখে ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ পায়চারি করল। একটা সময় পায়চারি থামিয়ে পিয়ানোর ডালা খুলে বসে পড়ল টুলে। ঘরটা মোমবাতির রহস্যময় আলো আর মিষ্টি সুগন্ধে ভরে আছে। পিয়ানোর মুখোমুখি জানালাটা খোলা। হাওয়া নেই এক ফোঁটাও। তবে আকাশ ভরা তারা! তারকা খচিত ঝলমলে এক আশ্চর্য আকাশ উইলো ফরেস্টের তমসাচ্ছন্ন গভীর বৃক্ষরাজির দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে চেয়ে আছে। জানলার ধার ঘেঁষে সবুজ পাখনার জোনাকি উড়ছে। বড্ড গরম আজ। আমার অনেকদিনের শখ ছিল ও যখন পিয়ানো বাজায় গভীর মনোযোগের সাথে ধ্যানমগ্ন হয়ে, তখন হঠাৎ একদিন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওকে চমকে দেব। কিন্তু আজ আমি সেসব কিছুই করলাম না। তার বদলে বেরসিক গলায় বললাম, ‘জানালা বন্ধ করে এসি অন করে দেই।’
ও পিয়ানোতে সুর তুলছিল। মৃদু স্বরে প্রত্যুত্তর করল, ‘দাও’
আমি সেলফোনটা বিছানার ওপর রেখে এয়ারকন্ডিশন অন করলাম। জানালার কাচ টেনে দিলাম। শিহাব আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। ওর চোখ পিয়ানোর রিডের ওপর। আমি বিছানার কাছে ফিরে এসে ওর পিয়ানো বাজানো দেখতে লাগলাম। একটু স্তিমিত গলায় বললাম,
—‘জন্মদিনে তোমাকে কী উপহার দেই বলো তো? তোমার কী পছন্দ?’
শিহাব পিয়ানোর রিড থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ঘুরে তাকালো। কিছুক্ষণ আমার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে অকপটে বলল,
—‘আমার তো রুশানিয়াকে পছন্দ!’
আমি লজ্জা পাই। লাজুক গলায় বলি, ‘ধুর, সবসময় ফাজলামো ভালো না।
—‘ফাজলামো না, সিরিয়াসলি!’
—‘আমি ভাবছি জন্মদিনে তোমাকে কী উপহার দেয়া যায়। তাই পছন্দ অপছন্দ জানতে চাইছিলাম।’
—‘যা চাইব তা দেবে তো?’
—‘চেষ্টা করব।’
—তোমাকে দেখতে চাই। সম্পূর্ণ তোমাকে! -’আবার ফাজলামো!’
—‘ফাজলামো কেন হবে? তুমি তো আমারই! যা আমার জন্য বরাদ্দ, তা নিজের করে পেতে চাওয়ার মাঝে অপরাধের কিছু নেই।’
আমি কথা বলতে পারছি না। মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছি। আনস্মার্ট মেয়েদের মতো দাঁত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ খুঁটছি। ওর প্রখর দৃষ্টিবাণ আমাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। মেরুদণ্ড ঝিনঝিন করছে। আমি জানি ও আমাকে চায়, আমি এ-ও জানি যে আমিও ওকে চাই। এই চাওয়ার মধ্যে পাপ নেই। সব কিছু জেনেবুঝেও আমার মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে আছে। হঠাৎ শিহাবের সেলফোনটা বেজে উঠল। ওর দৃষ্টি সরল অন্যদিকে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
শিহাব
ছোটমামা চিরকাল অসময়ে ফোন করে। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। আমার মনে নেই মামা সেই রাতে ঠিক কী বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছিল। রুশমি দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক হাত দূরে জড়োসড়ো হয়ে। যেন আরেকটু হলেই লজ্জায় মিশে যাবে মাটির সাথে। ফোনটা বেজে উঠতেই ও পালিয়ে বাঁচলো। ক্লজেটের ভেতর আড়াল করল নিজেকে। মামা কী বলছিল মনে পড়ে না। আমি বিরক্ত বোধ করছিলাম। কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত করে কল কেটে দিতে চাইছিলাম দ্রুত। কিন্তু লাইন কাটার আগেই ক্লজেটের দরজা নড়ে উঠল। হঠাৎ আমার চোখের দৃষ্টি বাঁধা পড়ল এক মোহনিয়া অপার্থিব দৃশ্যে। শ্বাস নালীর ছিদ্রপথে আটকে গেলো বাতাস। দম বন্ধ অবস্থায় স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলাম কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অপার রহস্যাবৃত, অসহনীয় রূপবতী মানবীটির দিকে। বুক কাঁপছিল প্রবল ভাবে। কানে চেপে ধরা সেলফোন চমক লাগা হাত থেকে খসে পড়ে গেছে মেঝেতে। রুশমি ধীরপায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছিল। কোমর পর্যন্ত চুলগুলোর একটা পাশ সামনে, অন্যপাশ পেছনে। মোমবাতির স্পর্ধিত, নির্লজ্জ আলোটা স্বর্ণের মতো জড়িয়ে আছে ওর ত্রুটিহীন, নিটোল ব্যঞ্জনে বিভাজিত অমর্ত্য সুন্দর শরীরটার সাথে। আমার চোখ আটকে গেছে ওর বুকের কালো তিলের ওপর, নার্ভাস লাগছে…, এক দুর্বোধ্য আলোড়নের রহস্যময় সঞ্চারে বিবশ হয়ে আসছে হাত পা।
রুশমির ফোনে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠেছে। বিছানার ওপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিতে দেখলাম। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম পেছন থেকে। ঘাড়ের ওপর পড়ে থাকা চুল সরিয়ে কণ্ঠগ্রীবায় চুমু খেলাম। বললাম, ‘রুশানিয়া, তুমি জানো? তুমি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস!’
আর ঠিক সেই মুহূর্তে যা ঘটল তা আজও মনে পড়লে দুঃসহ গ্লানিতে সমস্ত চেতনা অসাড় হয়ে আসে। রুশমি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিল। ওর চোখ রোষানলে জ্বলছে। নিশ্বাস তেজযুক্ত। হাতে ধরা সেলফোনটা আমার মুখের সামনে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এসবের মানে কী?’
আমি এতটাই বিস্মিত হয়ে গেছি যে, জিব নাড়াবার শক্তিটুকু পর্যন্ত পাচ্ছি না। এক দুর্ধর্ষ অপমানবোধ আমাকে নিশ্চল জীবাশ্মে পরিণত করে দিয়েছে। থাপ্পড়টা আমার একটু আগের পাগলপ্রায়, আসক্ত এবং ব্যাকুল হৃদয়কে গলা টিপে হত্যা করেছে যেন। এখন আমার নিশ্বাসে শুধু ক্রোধ আছে, প্রাণ নেই। ঘর থেকে বেরোবার আগে একবার অনেক কষ্টে ওকে বলতে পারলাম, ‘তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো!’
রুশমি
শিহাব ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলছিল, ‘তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো!’ এই কথাটা যেন আমার সহস্রাব্দের সংস্কারবদ্ধ জানালায় সুতীব্র এক আঘাত করল। কয়েকশ ভোল্টের ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল অবচেতন মনকে। হায় আল্লাহ! সত্যিই তো ওকে আমার বিশ্বাস করার কথা ছিল। তার বদলে এ আমি কী অনর্থ করে ফেললাম! এতো জোরে চড় বসিয়ে দিলাম মানুষটার গালে। ওর শ্যামবর্ণ চামড়া লালচে হয়ে গিয়েছিল। চোখ ফেটে যাচ্ছিল অপরিসীম ক্রোধ এবং অপমানে। তবুও সে আমার গায়ে হাত তোলেনি। এমনকি কড়া কোনও কথাও শোনায়নি। শুধু যেতে যেতে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছে আমার প্রতিশ্রুত কর্তব্যর কথা।
এই ভুল আমি দ্বিতীয় বারের মতো করলাম। আগের বার ও আমাকে ক্ষমা করেছিল। কী হবে এবার যদি ক্ষমা না করে? ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাবাজান ফোন দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জানি তার মাথা গরম হয়ে গেছে ফুপির পাঠানো ছবি দেখে। কিন্তু তার ফোন ধরার সময় এখন নেই। নাইটিটা কোনও রকমে গায়ে পরে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম হলওয়েতে। শিহাব মাঝ সিঁড়িতে পৌঁছে গেছে। দ্রুত নামতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে, রুদ্ধশ্বাসে!
মনে পড়ে হলওয়েতে একটা হলুদ আলো জ্বলছিল টিমটিম করে। সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সেই আলোটাই যথেষ্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কী কারণে যেন আমার চোখের সামনে এক দুর্ভেদ্য অন্ধকার নেমে এসেছে। পা দুটো শরীরের ভর নিতে পারছে না। টলমল করছে পদ্মপাতায় জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো। শারীরিক জোর না থাকলেও মানসিক জোর আকাশচুম্বি। ওই দ্যাখো রেলিং ধরে বৃদ্ধা মহিলার মতো ধুঁকে ধুঁকে একেকটা সিঁড়ি পার হচ্ছি। ওটা ছিল দু হাজার পনেরোর এপ্রিল মাসের শেষ দিন। রাত দুপুর। আমি বিস্রস্ত শ্লথ পায়ে প্যাটিওতে এসে দাঁড়িয়েছি। কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই এখানে। প্যাটিওর স্পটলাইটটা নিভানো কেন তা আমার বিচলিত মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। আকাশে সপ্তর্ষি জেগে আছে বিধায় সম্মুখের পথটা একটু একটু দেখতে পাচ্ছি। শিহাব হনহন করে হেঁটে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি যখন দুর্বল পায়ে প্যাটিও পার হয়ে গ্যারেজের কাছাকাছি আসলাম তখন গ্যারেজের দরজা খুলে গেছে। আমি শিহাবের একটা হাত চেপে ধরলাম, ‘শোনো!’
—‘রুশমি প্লিজ! বিরক্ত করো না আমাকে।’
আমার কী রকম কষ্ট লাগছে তা কাকে বোঝাই? কী করে বোঝাই? মন চাইছে চিৎকার করে কান্না করি। অনেক কষ্টে বলতে পারলাম ‘ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও প্লিজ!’
শিহাব আমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। আমার বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে একটার পর একটা। অনুশোচনায় ডুবে যাচ্ছে মন। গ্যারেজে জ্বলতে থাকা ফকফকে আলোর নিচে ওর মুখটা একবার দেখলাম, মুখ রক্তিম। কপালের রগ ফুলে উঠে দপদপ করছে। ঠোঁটের বাঁকে জন্মের নিষ্ঠুরতা! ও অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলছে, ‘দ্যাখো রুশমি, মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। ইচ্ছে হলে একটা মানুষকে মাথায় তুলে নিলে, আবার পরমুহূর্তেই মাথা থেকে ধপ করে ফেলে দিলে মাটিতে। জীবনটা এমন হিপোক্রেসি দিয়ে চলবে না।’
আমার এখন ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। কেন যেন একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছি না। কী করে বলব যে, ছবিতে ওর পাশে একটা মেয়েকে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছ্যাঁত করে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেছে। মেয়েটা ওর কাঁধের ওপর মাথা রেখেছে। কে সেই মেয়ে আমি চিনি না। হয়ত এই ছবির পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আছে। তাছাড়া আজকের যুগে এটা এমন কোনো গর্হিত কাজ নয়। বন্ধু হিসেবেও কাঁধে মাথা রাখা যায়। কিন্তু আমার যে সহ্য হয়নি, আমি কী করব? আমি যে ওর শরীর এবং মনের ইঞ্চি পরিমাণ জমিরও অংশীদারি মেনে নেব না! ওর ভেতর বাহির সমস্তটাই যে আমার একার মালিকানাধীন!
—‘ছবিটা, ছবিটা দেখে খুব খারাপ লেগেছে।’
মিনমিন করে বললাম। ভীষণ নরম হয়ে গেছি। অনুশোচনা আর অপরাধবোধ আমার এতকালের মেয়েলি অহংকার আর ব্যক্তিত্বকে থেঁতলে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। শিহাব আগের চাইতেও গম্ভীর গলায় বলল, ‘সেদিন অফিসে হ্যালোইন পার্টি ছিল। যে মেয়েটাকে ছবিতে আমার পাশে দেখেছ, ওর নাম ক্যাথরিন, আমার কলিগ। মদ খেয়ে টাল হয়ে গিয়েছিল। টোটালি আউট অফ কন্ট্রোল যাকে বলে। কী করছিল নিজেও জানে না। এরকম ছবি শুধু আমার সাথে নয়, অন্যান্য কলিগদের সাথেও আছে। যাকে পাচ্ছিল তাকেই জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছিল। তুমি তো জানো এসব পার্টিতে কী হয়, নাকি জানো না?’
কথাগুলো বলে একটু থামল ও। তারপর বলল, ‘তোমার তো আমাকে বিশ্বাস করার কথা ছিল!’
আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম, ‘ভুল হয়ে গেছে, এবার ক্ষমা করে দাও। এরকম ভুল আর হবে না।’
শিহাব পুনরায় হাত ছাড়িয়ে নিল। রিমোট চেপে গাড়ির তালা খুলতে খুলতে বলল- ‘এভাবে হয় না। ইউ নো হোয়াট? নক ইট অফ! আই নিড টু বি এলোন। তুমি ভেতরে যাও।’
—‘শিহাব প্লিজ, এতো রাতে কোথাও যেও না।’
—‘রুশমি বাড়ির ভেতরে যাও। আমাকে বিরক্ত করো না।’
কত অনুনয় বিনয় করলাম! কিন্তু একরোখা, জেদি মানুষটাকে ফেরাতে পারলাম না!
শিহাব
রাত বারোটার সময় শুভ্রার অ্যাপার্টমেন্টে হানা দিলাম। দরজা ধাক্কাতে হলো টানা পাঁচ মিনিট। অবশেষে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে শুভ্রা দরজা খুলল। ওর পরনে সাদা ব্লাউজ আর শর্টস। মাথার চুল আলুথালু। আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ বেহেড চোখে চেয়ে থেকে অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠ নিয়ে অস্ফুটে বলল,’তুই?’
আমি বিনা অনুমতিতেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। এক দোর্দণ্ড প্রতাপ, বিভীষণ রাগ পাগল নৃত্য নেচে চলেছে মাথায়। শুভ্রার চেহেরাটা দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে সেই রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমার এখন মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে গুঁড়ো করে দিতে পারব। কোনো ভূমিকা ছাড়াই যা কোনোদিন করিনি ঠিক তাই-ই করে বসলাম। শুভ্রার গলা চেপে ধরে ঠেলতে ঠেলতে ওকে নিয়ে গেলাম লিভিং রুমের দেয়ালের সীমানায়। ওর শরীরটা দেয়ালে ঠেকে গেলো। মুখ বিকৃত হয়ে গেলো ব্যথায়। চোখ উল্টে যাবার উপক্রম। আমার হাত ওর গলার ওপর থেকে সরছে না। ক্রোধের প্রকট আস্ফালনে আমার চেতনা লুপ্তপ্রায়। মাথার মধ্যে শুধু প্রলয়ের সর্বনাশা সাঁইসাঁই শব্দ। শুভ্রা হাত দিয়ে আমার পাঞ্জাবির বুক খামচে ধরেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ করছে। আমি দাঁত কিড়মিড় করে বলছি, ‘এই জঘন্য কাজটা তুমি কেন করলে?’
উত্তর পাবার আশায় ওর গলা থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। ও খুকখুক করে কাশতে লাগল। ফর্সা চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে। টানা দু মিনিট সময় লাগল ধাতস্থ হতে। শ্লেষের গলায় বলল, ‘মেরে ফেলতে চাইছিলি আমাকে?’
আমি নিরুত্তর, শুভ্রা দু পা এগিয়ে এলো আমার দিকে। তারপর আমার পাঞ্জাবির কলার দু হাত দিয়ে চেপে ধরে প্রচণ্ড দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘এই জঘন্য কাজটা কেন করেছি জানিস? করেছি তোকে ফিরে পাবার জন্য। আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক শিহাব! আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক!’
আমি স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ! এই শুভ্রাকে আমি চিনি না। আজ থেকে দশ বছর আগে কাঁঠাল বাগানের এঁদো গলির পাঁচতলা বাড়ির ছাদে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা যে তরুণী মেয়েটির প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছিলাম, সেই তরুণীর সাথে এই নিষ্ঠুর, পরশ্রীকাতর, কুচক্রী যুবতীর কোনো মিল নেই। আমি ওর সাঁড়াশির মতো আটকে থাকা হাতদুটো পাঞ্জাবির গলা থেকে সরিয়ে দিলাম।
—‘যা কখনো তোমার ছিলই না তা তুমি ফেরত চাও কোন যুক্তিতে?’
শুভ্রার চোখে কোত্থেকে যেন রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো। হতভম্ব গলায় বলল,
‘কিন্তু তুই তো আমাকে ভালোবেসেছিলি!’
—‘ওটা ভালোবাসা ছিল না। মোহ ছিল! মোহ কেটে গেছে।’
শুভ্রা কয়েক পলক দিশাহারা চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ আমাকে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।
—‘এভাবে বলিস না শিহাব, কষ্ট হয়!’
— সিরিয়াসলি? তোমার কষ্ট হয়? কষ্ট কী তুমি জানো? আর তোমার এসব কষ্ট, এসব ফিলিংস এতদিন কোথায় ছিল? তুমি তো কখনো আমাকে ভালোবাসোনি!’ কথাটা বলতে বলতে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে কাউচের ওপর ফেলে দিয়েছি। ও উঠে এসেছে পুনরায়। দাঁড়িয়েছে আমার মুখোমুখি। ওর চোখে এখন তেজ নেই। তার বদলে আছে সীমাহীন বিস্ময়, ক্লেশ আর আকুতি।
—‘আমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করছিস কার জন্য? ওই স্টুপিড বিচটার জন্য?’
—‘বাজে বোকো না। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। ওই ছবিগুলো তুমি কোথায় পেয়েছ? কে দিয়েছে তোমাকে?
—‘উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
—‘উত্তর দাও! নইলে…’
—‘নইলে কী? মেরে ফেলবি?’
—‘হ্যাঁ মেরে ফেলব, খুন করব তোমাকে আমি শুভ্ৰা!’
—‘বেশ তো! মেরেই ফ্যাল।’
ঘৃণা ভরা চোখ নিয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম, ‘তুমি এতো জঘন্য একটা মানুষ! এই সত্যটুকু যদি আগে জানতাম…!’
কথাটা শেষ করার তাগিদ অনুভব করলাম না। মাঝপথে থেমে পড়লাম। শুভ্রা আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘শিহাব শোন। আজকের রাতটা আমার এখানে থাক। স্টে উইদ মি।
—‘ব্যাক অফ!’
—‘আই হ্যাভ অলওয়েজ লাভড ইউ শিহাব! আই লাভড ইওর স্মাইল, আই লাভড ইওর স্ট্রাইকিংলি অ্যাট্রাকটিভ লুক, আই লাভড ইওর…’
—‘শাট আপ! একটা সময় ছিল যখন তোমার প্রতি আমার অবসেশন কাজ করত। কিন্তু রুশমি আমার লাইফে আসার পর থেকে কী হয়েছে কে জানে! ওকে ছাড়া আমার আর কিছুই ভালো লাগে না।’ কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর বললাম, ‘স্যরি টু সে শুভ্রাদি, তোমাকেও আমার আর আগের মতো ভালো লাগে না। যে ভালোলাগা টুকু ছিল তা কেটে গেছে। ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যকার তফাৎটা আমি এখন জানি।’
শুভ্রা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আমাকে। নাক ঘষছে আমার বুকের ওপর। জড়ানো কণ্ঠে বলছে,
—‘আজকে অন্তত আমাকে ছেড়ে যাস না! তোর জীবন থেকে একটা রাত চাইছি শুধু। প্লিজ!’
—‘পারব না!’
—‘ভালো হবে না শিহাব, আমার অভিশাপ লেগে যাবে তোর জীবনে। সুখী হতে পারবি না।’
আমি হাসলাম, ‘বাংলায় একটা কথা আছে শুভ্রাদি জানো? কথাটা এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। শকুনের দোয়ায় কখনো গরু মরে না।’
রুশমি
রাতে ঘুম হলো না। এরকম অবস্থা চললে শুধু আমার নয়, শিহাবেরও শরীর খারাপ করবে। আমি তো এমনিতেই রোগে শোকে কাতর একজন মানুষ। এক বেলা খাবার না খেলেই প্রেশার লো হয়, চোখে সর্ষে ফুল দেখি। শরীরচর্চা করি না, নিয়মনীতির বালাই নেই। এখন ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছি, কফিশপেও যাচ্ছি না কদিন হলো। নিজের জন্য ভাবছি না। শিহাবকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। এতো সব ঝক্কি ঝামেলা আর মানসিক অশান্তির ভেতরেও বেচারার অফিস করতে হচ্ছে। এ কারণেই আমার চাকরবৃত্তি পছন্দ নয়। জীবনে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। আমি কখনো চাকরি করব না। আমার নিজস্ব ফার্ম থাকবে। আমিই হবো সেই ফার্মের একচ্ছত্র মালকিন। দিবাস্বপ্ন দেখতে আমি ভালোবাসি। জানি এটা স্বপ্ন দেখার উপযুক্ত সময় নয় তবুও আমার চোখের তারায় স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা ফার্মল্যান্ড ফ্ল্যাশ লাইটের মতো জ্বলে উঠল যেন। আমার শুধু সবজি আর ফুলের খেত হবে। শিহাবকে বলব চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে ফার্মল্যান্ডের কাজে যোগ দিতে। যদিও আমার শ্বশুর খুব রাগ হবে। সে চায় তার ছেলে বিদ্যার জাহাজ হোক। আমি জানি সে কী বলবে। বলবে, এতদূর পড়াশোনা করে শেষমেশ কিনা কৃষিবৃত্তি? আমি স্বপ্নচোখে আমাদের ফার্মল্যান্ড সংলগ্ন কাঠের দোতলা বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি। বাড়িটা ছিমছাম আর খোলামেলা। বারান্দায় দাঁড়ালে দূরের পাহাড় দেখা যায়। আমি রোজ বাগানের তাজা ফুল দিয়ে ঘর সাজাই। মন দিয়ে ফার্মের কাজ করি, মন দিয়ে সংসার করি। ছুটির দিন গুলোতে আমি আর শিহাব নদীর কাছাকাছি জঙ্গলে বেড়াতে যাই। ওখানে আমাদের একটা ট্রি হাউজ আছে। সন্ধ্যে নামার মুখে, সূর্য যখন খুব স্নিগ্ধ আর নরম, আমরা তখন ট্রি-হাউজের ওপর উঠে বসি। সোনা গলানো সূর্যের বিশুদ্ধ আলো আমাদের মুখ ধুয়ে দেয়। রূপকথার রাজকন্যা আর রাজকুমারের মতো আমরাও সুখে শান্তিতে বসবাস করি। আমাদের গল্পের শেষেও লেখা হয়, অ্যান্ড দে লিভড, হ্যাপিলি এভার আফটার! হায়! কে জানতো যে লেখাটা আদতে হবে ‘হ্যাপিলি নেভার আফটার!’
আমি ভীষণ স্বার্থপর! শুধু নিজের স্বপ্নের কথাই ভেবে যাচ্ছি। আমার জানতে হবে শিহাব কী চায়। ওর কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ আছে কিনা। এখন পিয়ানোর টুলের ওপর বসেছি। সম্মুখের খোলা জানালায় তারকা খচিত সুবিশাল আকাশ উঁকি দিয়ে আছে। একটু একটু বাতাস বইছে উইলো ফরেস্টের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথার ওপর দিয়ে। পিয়ানোর রিডের ওপর হাতের আঙুল রেখেছি। হঠাৎ করেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ রূপ নারানের কূলে জেগে উঠেছিলেন, আর আমি জাগলাম অ্যাশবার্নের উইলো ফরেস্ট ঘেঁষা গভীর রাতের নিঝুম নিরালা বাড়িতে!
সেলফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম বাবাজানের দশটা মিসডকল। কল ব্যাক করিনি আমি, করবও না। জানি আগামীকাল একটা প্রলয় হবে। প্রলয় মোকাবেলা করার জন্য মনে মনে প্রস্তুত। পৃথিবী উল্টে গেলেও এ বাড়ি ছেড়ে যাব না। কিন্তু এই দুঃসময়ে শিহাবকে আমার পাশে চাই। এটা কি রাগ করে থাকার সময়? ছেলেটা এমন অদ্ভুত কেন? ওর নম্বরে এই প্রথমবারের মতো কল করলাম। করামাত্রই আবিষ্কার করলাম মহারাজ সেলফোন বাড়িতেই ফেলে গেছেন। ওই তো মেঝের ওপর পড়ে থাকা ফোনটা আলো বিকিরণ করে বাজনা বাজাচ্ছে। এবার ভীষণ দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসল। পিয়ানোর টুলের ওপর কাঠ হয়ে বসে রইলাম। জানালার ওপাশের রাতের অন্ধকার ভোরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো একটা সময় অদৃশ্য হলো। পুবাকাশে লালচে দুটি দিগন্তপ্রসারী আলোর রেখা জেগে উঠল ফেরেশতার পবিত্র ডানার মতো। ভোর ছটার দিকে নিচে নেমে এলাম আমি। বিনিদ্র চোখ জ্বালা করছে। পেটভর্তি খিদে কিন্তু মুখে অরুচি। তবুও সুস্থ থাকার জন্য খেতে হবে বিধায় কিচেনে দাঁড়িয়ে নাক চেপে ধরে এক গ্লাস দুধ খেলাম। জাহিদ শঙ্কিত চোখ নিয়ে পরখ করল আমাকে। খুব বেশি কথা বলল না। চুপচাপ নাশতা সেরে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। আমি ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেলা দুটা পর্যন্ত কেউ এলো না। শিহাবও না, বাবাজানও না। খিদে, ক্লান্তি আর নিদ্রাহীনতায় আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে এসেছিল। কাউচের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা। চোখ মেলে দেখি শিহাব বাড়ির ভেতর ঢুকছে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়েই তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলো। আমিও উঠে এলাম। দাঁড়ালাম ওর মুখোমুখি। ও আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে মেঝের ওপর থেকে মোবাইল আর টেবিলের ওপর থেকে চার্জারটা তুলে নিল। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পেছন পেছন সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ানোর মতো শক্তি আমার শরীরে আর অবশিষ্ট নেই। বিছানায় ঢলে পড়লাম। তবুও এখন একটু শান্তি লাগছে এটা ভেবে যে, শিহাব বাড়ি ফিরেছে। দুর্বল শরীর জুড়ে আবারও ঘুম নেমে এলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, চোখ মেলে মাথার ওপরে বাবাজানের মুখটা আবিষ্কার করলাম। তাকাতেই গম্ভীর গলায় বলল,
—‘রুশমি আমি তোমাকে নিতে এসেছি মা! চলো আমার সাথে।’
আমার মন কেমন করে উঠল। স্বয়ং বাবাজান নিতে এসেছে আমাকে। ফিরিয়ে দিই কী করে? তাছাড়া যে মানুষকে কেন্দ্র করে এই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক, সেই মানুষ তো আমার সাথে কোনো কথাই বলছে না। আমি কেমন আছি তা একবার জানতে পর্যন্ত চাইছে না। জেদ নিয়ে বসে আছে গাঁট হয়ে। তার জন্য আমি কেন নিজের বাবার সাথে যুদ্ধ করব? কোন যুক্তিতে করব? নিঃশব্দে শোয়া থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ক্লজেটে গিয়ে জামা পাল্টে বাবাজানের সামনে নতমুখে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘চলো’
ড্রইংরুমে শিহাব বসে আছে। হাতে ধরা সেলফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ। আড়চোখে একবার দেখল আমাদের বাবা মেয়েকে। কিছু বলল না। তার মুখটা রাগে আর গাম্ভীর্যে থমথম করছে। ভেবেছিলাম বাবাজানের সম্মানার্থে একটাবার অন্তত উঠে দাঁড়াবে, সালাম দেবে কিংবা সৌজন্যমূলক কিছু বলবে। কিন্তু এসব ভদ্রতার ধার ধরল না সে। গাঁট হয়ে বসে রইল। আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে হ্যাংলামো হয়, বাবাজানের অসম্মান হয়। তাই চুপচাপ বেরিয়ে এলাম। তখনও আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, এসব ঝামেলা আর মনোমালিন্য দুদিন বাদেই ঠিক হয়ে যাবে। শিহাবের রাগ ভাঙবে, আমার শাশুড়ি আর ফুপির মধ্যকার বিবাদ মিটে যাবে। দুই পরিবারের আত্মীয়তা গভীর হবে। আমাদের জীবন সুখে, শান্তিতে আর স্বস্তিতে ভরে উঠবে। এসব লিখতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে। কাল সন্ধ্যায় সাশা আসবে আমার এই গহীন জঙ্গলের ভাঙাচোরা বাড়িতে। ও আমার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চায়। আমার মনে কেমন একটা সন্দেহের কাঁটা লেগে আছে। সাশা আমার ঠিকানা শিহাবকে দিয়ে দেয়নি তো? যদি সঙ্গে করে শিহাবকে নিয়ে আসে তাহলে কী হবে? দু হাজার আঠারো প্রায় শেষ হয়ে এলো। ভাবছি এবার এখান থেকে সরে পড়তে হবে। দূরে, আরো দূরে কোথাও!
শিহাব
রুশমি চলে গেছে। আমি বাধা দেইনি। অথচ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর বাবার হাত থেকে জোরপূর্বক ওকে ছিনিয়ে নেই। কিন্তু কাজটা আমি করিনি। টানা দু তিনদিনের নিদ্রাহীনতার পর আমার মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না। তাছাড়া গতরাতে ছোটমামার বাসায় রাত জেগে ড্রিঙ্ক করেছি। অফিসে সম্পূর্ণ বিনা কারণে ক্যাথরিনের সাথে পা মাড়িয়ে ঝগড়া করেছি। আমার বিরুদ্ধে হেডঅফিসে কমপ্লেইন গেছে। রুক্ষ একটা দিনের শেষে বাড়ি ফিরে রুশমিকে যখন দেখেছিলাম তখন অপরিসীম শান্তিতে বুক ভরে গিয়েছিল এ কথা অস্বীকার করব না। তবে রাগ কিংবা অভিমান যাই হোক না কেন, ওই বিরূপ অনুভূতিটা তখনো মনের ভেতর কাঁটা হয়ে রয়ে গেছে। এখনো আছে। কয়েকটা সাধারণ ছবিকে ঘিরে এই আধুনিক যুগে, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের বাসিন্দা হয়ে যে পরিবারের মানুষজন এমন হীন এবং সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিতে পারে, সেই পরিবারের মানুষকে নিজের সততা সম্পর্কে প্রমাণ দেবার বিন্দুমাত্র অভিরুচি আমার নেই। ঘেন্না এসে গেছে। এতো নোংরামি সহ্য হচ্ছে না। রুশমি যদি আমাকে সত্যিই বিশ্বাস করে থাকে, তবে ওকে ফিরে আসতেই হবে।
নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। ভীষণ খালি খালি লাগে; খাঁ খাঁ করে বুক। এতো অপমানের পরেও রুশানিয়ার কথা সারাক্ষণ মনে পড়ে। একবার ওকে চোখের দেখা দেখার জন্য তৃষ্ণায় চৌচির হয় বুক অথচ ওর কোনো খবর নেই। পাপা মম যেদিন ফিরে এলো, ভেবেছিলাম সেদিন অন্তত একটা খবর নেবে আমাদের। এ বাড়ির বৌ হিসেবে এতটুকু কর্তব্যবোধ অন্তত থাকা উচিত ছিল। আমি নাহয় দুশ্চরিত্র, অযোগ্য এবং পাপী। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের দোষ কোথায়? তাদের সাথে এমন বিরুদ্ধাচার করা কেন? এবার দাদাজানও এসেছে। নাতবৌ দেখার সাধ নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিল বৃদ্ধ মানুষটা। সে আশায় গুড়ে বালি।
পাপা মমকে এতদিন পর কাছে পেয়ে আমার ভালো লাগছিল। বাড়িটায় অনেকদিন বাদে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আমার শ্বশুরালয়ের দুর্নামে এ বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে আছে। মম বলেছে রুশমির ফুপি যদি নিজ থেকে ক্ষমা না চায় তাহলে দুই পরিবারের মধ্যকার সম্পর্ক কোনোদিনও আগের মতো স্বাভাবিক হবে না। তাছাড়া এতদিন পর পাপা মম বাড়ি ফিরে এসেছে অথচ রুশমি একটা বারও তাদের সাথে দেখা করতে আসেনি এ ব্যাপারটাকে অনেক বড় অভদ্রতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে আমার পরিবারের লোকজন। আমি এসব বিষয়ে কোনো মতামত দেই না। কানকাটার মতো সব কথা হজম করে যাই। কেন যেন কিছুই ভালোলাগে না। রাতে ঘুম পায়, কিন্তু ঘুম আসে না। চোখের পাতা ভারী হয়ে থাকে। দিশাহারা লাগে। ভারী অদ্ভুত পরিস্থিতি। রুশমি চলে যাবার তিনদিন পর, মধ্যরাতে হঠাৎ পাগলের মতো বাসা থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম ভিয়েনা। রুশমিদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। বিকল হয়ে বসে থাকলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেন করলাম এই কাণ্ড জানি না। ভোরের দিকে রুশমির মা বাগানের গাছে পানি দিতে আসল। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম। ফিরে আসার পর ভোরবেলা কী কারণে যেন শরীর জুড়ে জ্বর এলো। চোখে জ্বালা। মাথা প্রচণ্ড ব্যথা। অফিস যেতে পারলাম না। আইবুপ্রোফেন খেয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে রইলাম। জঙ্গলে একটা শেয়াল ডাকছে বিশ্রীভাবে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে হাত পা। ছিন্নভিন্ন অগোছালো তন্দ্রায় রুশানিয়ার মুখটা বারে বারে এসে হানা দিচ্ছে। বুকের ভেতর এক তীব্র যন্ত্রণা টের পাচ্ছি। চোখ বন্ধ করতেই আশ্চর্যজনকভাবে হৃদচক্ষু উন্মীলিত হচ্ছে এবং আবছায়া চেতনার ঘোলা কুয়াশা ভেদ করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সমুদ্রের মতো গভীর একজোড়া ঐশ্বরিক চোখ।
আধো চেতনার মধ্যে টের পেলাম মম এসে বসেছে আমার পাশে। আরো একজন আছে। দাদাজান মনে হয়। মম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কী কারণে কাঁদছে জানি না, তবে আমারও এই মুহূর্তে খুব মমকে জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি যে কাঁদি না বহুদিন। শেষবার কবে কেঁদেছিলাম মনে পড়ে না।
রুশমি
আমি ঠিক করেছি মরে যাব। হ্যাঁ, আমি মরে গেলেই বাবাজানের একটা উচিত শিক্ষা হবে। গত দুদিন কোন খাদ্য স্পর্শ করিনি। কারো সাথে কথাও বলিনি। আমার একগুঁয়েমি দেখে বাবা আরো বেশি রেগে গেছে। আমার ওপর চড়াও হওয়া রাগটা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ওপর ঝাড়ছে। আম্মুর সাথে কারণে অকারণে উচ্চস্বরে কথা বলছে। ছোটবোনদের বকাঝকা করছে। এরা কেউ বুঝতে পারছে না যে, আমি আর নাবালিকা নই। এই দেশে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ওপর জোর প্রয়োগ করা আইনগত অপরাধ। যতদূর জানি বাংলাদেশেও আজকাল বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার ছোটবেলার যে কজন বন্ধুবান্ধব আছে তারা প্রত্যেকে স্বাধীন এবং আধুনিকমনস্ক। অথচ আমাকে দ্যাখো, আমার পরিবারকে দ্যাখো, মনে হচ্ছে যেন ষাটের দশকের সংস্কারবদ্ধ, পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষের একান্নবর্তী পরিবারের একটি। ফুপি আমাকে নানারকম উপদেশ দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আবোলতাবোল বকছে অষ্টপ্রহর। তার ছেলে বিদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠার পরেও কী রকম ভদ্রস্থ এবং শালীন জীবন যাপন করেছে, কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, এসব আজাইরা বুলি আওড়াচ্ছে কানের কাছে। শিহাব একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম ঘরের ছেলে হয়ে কী করে বিধর্মী মেয়েদের সাথে এমন আপত্তিকর ছবি তুলতে পারল, মেলামেশা করতে পারল এটা তার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। আমি এসব কথার কোনো উত্তর দেইনি। থম ধরে বসে থেকেছি। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। জাগতিক দুঃখ কষ্ট ছাড়িয়ে আমার মন গিয়ে ভিড়েছে যেন এক মহাজাগতিক অসীম শূন্যতায়। চোখের সামনে বারবার ওর থমথমে গম্ভীর মুখটা ভেসে উঠছে। ওই প্রখর গম্ভীর একরোখা চেহারার পেছনে যে কতটা কষ্ট লুকোনো ছিল তা অন্য কেউ পড়তে না পারলেও আমি পড়তে পেরেছি। আমি জানি দুনিয়া উল্টে গেলেও ও নিজ থেকে আমার কাছে আর আসবে না। আমাকেই এবার যা করার করতে হবে। করবও ঠিক ঠিক। হয়তো পালিয়ে যাব। নইলে মরে গিয়ে বাবাজানকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দেব। এতসব এবড়োথেবড়ো উশৃঙ্খল চিন্তা যখন করছিলাম, তখনও জীবনের চরম সত্য উপলব্ধিটুকু আমার লব্ধ হয়নি। আমি তখনও জানতাম না যে, কোনো অপরাধ, তা যত গুরুতরই হোক না কেন, সেই অপরাধের শাস্তি দেবার অধিকার মানুষের নেই, আছে প্রকৃতির। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের অংশ হিসেবেই মানুষ তার কর্মফল ভোগ করে। এই নিয়মটা আবার সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কারণ কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে শুধুমাত্র ভাগ্য নামক স্পর্ধিত এক শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন কলের পুতুল হয়ে রয়। তাদের কর্ম ভালো কিংবা মন্দ যাই হোক না কেন, ফলাফল সর্বদা শূন্য। তবে কথায় আছে, হোয়াট ইউ বিলিভ, ইউ রিসিভ। আমি বিশ্বাস করি এসব হিসাব চুকে বুকে যাবে একদিন। এই জীবনে না হলেও পরের জীবনে। আহা! পরের জীবনে নিশ্চয়ই হারানো মানুষগুলোর সাথে দেখা হবে!
বাবাজান! তোমার সাথেও দেখা হবে খুব শীঘ্রই। আমার কখনোই ভালোবাসার মানুষগুলোকে মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠেনি যে কতটা ভালোবাসি। তোমাকেও তো কত্ত ভালোবাসতাম বাবা! ঐযে অন্ধকার ঘরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে এক বুক কষ্ট নিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকা একুশ বছরের রুশমিকে দ্যাখো একটাবার। সে চাইলেই সেদিন সমস্ত বিধিনিষেধ অমান্য করে তোমাদের সকলের নাকের ডগার ওপর দিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু কেনো যায়নি জানো? যায়নি কারণ সে তোমাকে ভালোবাসত!
ওই তিনটা দিন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেছি কখন তুমি আমার ঘরে একটাবারের জন্য আসবে, ছোটবেলার মতো আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলবে, ‘আমার রুশমি মা কী চায়? সে যা চায়, তাই হবে!’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি জানব, তোমার কাছে শুধু আমার সুখটুকুই মুখ্য। বাদবাকি সব গৌণ। আমি তৃপ্ত হব, সুখী হব, আনন্দিত হব! কিন্তু তুমি এলে না। পাঠালে আম্মুজানকে। আম্মুজান চিরকাল তোমার বড়ই বাধ্য। তোমার রাজকপাল ছিল বাবা! কপালজোরে আম্মুজানের মতো স্ত্রী পেয়েছিলে। সবাই পায় না! তোমরা দুজনে ভালোবেসেছিলে একজন আরেকজনকে গভীরভাবে! তবুও তোমাদের ভালোবাসা সিক্ত মন আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেমকে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে পারেনি। যখন পেরেছে, তখন জল গড়িয়ে গেছে বহুদূর!
আম্মুজান আমার ঘরে এলো রাত সোয়া বারোটায়। আমি সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ফিরেছি। না খেয়ে না দেয়ে শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সোডিয়াম, পটাশিয়ামের ঘাটতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ইমার্জেন্সিতে অ্যাডমিটেড ছিলাম গোটা একদিন। তবুও মরিনি। মরা বোধহয় অতটাও সহজ না। আম্মুজান আমার পাশে এসে বসেছে। খুব মৃদু গলায় বলছে, ‘রুশমি, তুমি কী চাও স্পষ্টভাবে আমাদেরকে বলো। জীবনটা একদিনের নয়। এখন তোমার বয়স অল্প। তরুণ বয়সে মানুষের মন্দ জিনিসও ভালো লাগে। আজকে হয়তো তুমি তোমার স্বামীকে ক্ষমা করে দিতে পারছ, কিন্তু ভেবে দ্যাখো একই ঘটনা যদি বারবার ঘটে, তুমি কি তাকে বারবার ক্ষমা করতে পারবে? তুমি তো জানো আমাদের ধর্মে মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো পর্যন্ত হারাম। সে জায়গায় তোমার স্বামী মেয়েদের সাথে খোলামেলা ভাবে মিশছে। এটা কি ঠিক?’
আমি অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছি। মনে মনে বলছি, মেলামেশায় আমার কোনোই আপত্তি নেই। কারণ আমি তাকে বিশ্বাস করি। আর মেয়েদের সঙ্গ যদি সে আমার ভয়ে ত্যাগ না করে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার ভয়ে ত্যাগ করে তবে তার চাইতে উত্তম আর কী হতে পারে? সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করাটা কি খুব কষ্টের? আম্মু বলছে, ‘আমরা চাই না জীবনটার সাথে তুমি কোনো রকম বোঝাপড়া করো। এতো কিছুর পরেও যদি তোমার মনে হয় তুমি একে ছাড়তে পারবে না তাহলে আমাদের আর কিছু বলার নেই। তবে তোমার শাশুড়ি তোমার ফুপির সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছে। এদিকে তোমার শ্বশুর তোমার বাবার বন্ধুমানুষ। তিনিও টেলিফোনে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন তোমার বাবাকে। আমাদের সাথে মনে হয় ওই পরিবারের সম্পর্ক আর আগের মতো হবে না। কিন্তু তোমার মনের ওপর চাপ পড়ুক এটা আমরা চাই না। তুমি সিদ্ধান্ত নাও কী করবে। যদি আজ থেকে অনেক বছর পর তোমাদের বৈবাহিক সম্পর্কে কোনো জটিলতা দেখা দেয়, তখন যেন তুমি আমাদেরকে দোষারোপ করো না। কারণ আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমাদের মতো রক্ষণশীল পরিবারগুলোর জন্য বিদেশের মাটিতে সন্তান বড় করা কতবড় চ্যালেঞ্জ সেটা তুমি যেদিন মা হবে সেদিন বুঝবে।’
ভোরবেলা শিহাবকে ফোন করলাম। ও ফোন ধরে চুপ করে আছে। আমি ও চুপ। শত শতাব্দী যেন পার হয়ে গেলো শুধু পরস্পরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে। একটা সময় আমি ধরা গলায় বললাম, ‘দেখা করতে পারবে?’
—‘কখন?’
—‘এখন ফ্রি আছ?’
—‘কোথায় দেখা করতে চাও?’
—‘ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি।’
সকালটা ভারী মেঘলা। ছাই রংয়ের ভ্রুকুটিবক্র মেঘেরা সাদাটে আকাশের দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জটাধারিণী ডাইনির চুলের মতো। আসন্ন বৃষ্টির ছোঁয়াচে বাতাস ভারী এবং শীতল। এদিকে আমার মন বড্ড আনমনা। আমার ভেতরকার আমিটা যেন ঠিক আমার মধ্যে নেই। ভাবনাগুলো টুকরো টুকরো ভাসন্ত মেঘের মতো ধোঁয়াশাবদ্ধ হয়ে উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। আমার পদক্ষেপ অবিন্যস্ত। বুকে অস্বাভাবিক চাপ। কী করছি নিজেও জানি না। ওই মানুষটাকে এক নজর দেখতে পাবার দুর্দমনীয় তৃষ্ণা আমাকে বিভ্রান্ত, বিমূঢ় এবং বাহ্যজ্ঞানরহিত করে তুলেছে।
দেখা হলো অবশেষে, দেখা হলো বার্ক লেকে। লেক সংলগ্ন এলাকা অনেক বড়। নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। শিহাব আমার আগেই চলে এসেছে। সপ্তাহের মাঝামাঝি দিন বলে লোকজনের আনাগোনা নেই এদিকটায় একেবারেই। তাছাড়া এখানকার মানুষ মেঘলা দিনে আউটিং করতে ভালোবাসে না। এরা ভালোবাসে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। একটা সিডার গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল শিহাব। লেদারের পাতলা কালো রংয়ের জ্যাকেট ওর পরনে, কালো জিন্স। আজকে ওর চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। মনে হয় জেল দিয়েছে। পার্কিং লট থেকেই ওকে দেখতে পাচ্ছি। আমি হাঁটছি আবার হাঁটছিও না। মনে হচ্ছে পা দুটো মাটিতে পড়ছে না, পড়ছে শূন্যে। বুকের ভেতরটা একদম খালি। হাতে পায়ে বেসামাল কম্পন। ও গাছের গায়ে হেলান দিয়ে স্থির এবং ক্রুর চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। কুঞ্চিত ভ্রু, কপালে ভাঁজ, ঠোঁটের কোণে এক আকাশ নিষ্ঠুরতা তবুও ওর মুখটা গা ছমছমে সুন্দর! ওই গা ছমছমে সৌন্দর্য আমার শূন্য বুকের মধ্যে একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। প্রেমের অমিয় সুধা উত্তাল স্রোতের মতো তেড়ে এসে এতদিনের সযত্নে লালিত মেয়েলি অহং আর দর্প, মূল্যহীন খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে।
আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। ওর হাতদুটো জ্যাকেটের পকেটে রাখা। চিবুকটা উঁচু, চোখজোড়া সরু এবং তীব্র। ভয় হচ্ছে ওই প্রদাহপূর্ণ ক্ষিপ্ত চাউনি দেখে।
—‘কী খবর?’
শিহাব চুপ, বাদামি চোখের তারা দুটি স্থির হয়ে আছে আমার মুখের ওপরে।
—‘কেমন আছ?’ আবারও প্রশ্ন করলাম। লাভ হলো না। মহারাজ খুব সম্ভবত নিশ্চুপ থাকার ব্রত পালন করছেন। মুখে কোনো রা নেই। আমি অসহায় গলায় বললাম, ‘প্লিজ কিছু তো অন্তত বলো!’
সেকেন্ড না গড়াতেই একটা কাণ্ড হলো। শিহাব আমার চুলের গোছা খচ করে খামচে ধরল পাঁচ আঙুল দিয়ে। কী জোর সেই হাতে! ব্যথায় আমার মুখ কুঁকড়ে গেলো।