রুশমি
হৃদয়াক্ষী! সেই প্রথম শুনেছিলাম শব্দটা। শিহাব আমার এক হাত দূরে চাদরের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পরনে মেরুন রংয়ের পাতলা টি-শার্ট আর ছাই রংয়ের থ্রি কোয়ার্টার মোবাইল প্যান্ট। শ্যামবর্ণের ছেলেদেরকে এসব ব্রাইট কালার মানায় না বলেই জানতাম এতদিন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি মেরুন রংটা ওকে মানিয়ে গেছে। আজকে ওর চুলগুলো বড্ড এলোমেলো। ঘুম থেকে উঠে আঁচড়ায়নি মনে হয়। সামনের কিছু চুল কপাল বরাবর নিচু হয়ে নেমে এসেছে চোখের কাছাকাছি। মাথার তালুর চুল খাড়া হয়ে আছে সজারুর গায়ের কাটার মতো। গালে ছোপ ছোপ আবছা দাড়ি। নিজের সাজসজ্জা সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নয় ছেলেটা। অফিস যাবার সময় কোনরকমে চুলে একটু চিরুনি বুলিয়ে নেয়। কোন কোন দিন টাই পর্যন্ত বাঁধতে ভুলে যায়। শুধুমাত্র ব্যায়াম করা ছাড়া নিজের প্রতি অন্য কোনও বিশেষ যত্ন নিতে নারাজ এই মানুষ।
—‘হৃদয়াক্ষী মানে কী? ‘
—‘তুমি এর অর্থ খুঁজে বের করতে পারবে?’
—‘কেনো পারব না? ডিকশনারি দেখেই জেনে নিতে পারব।’
—‘ডিকশনারিতে নেই।’
—‘ডিকশনারিতে নেই? তাহলে এই শব্দ তুমি কোথায় পেলে?’
—‘আবিষ্কার করলাম।’
—‘বাহ! তুমি কি কবি নাকি?’
—‘না আমি কবি নই।’
—‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই লেখক।’
শিহাব হাসে, ‘জোক অফ দ্যা সেঞ্চুরি!’
—‘জোক হবে কেনো? তুমি এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারো, নিশ্চয়ই সুন্দর লিখতেও পারবে…’
কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। শিহাব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমি বিব্রত বোধ করছি।
—‘আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি?’ আমার চোখে চেয়ে প্রশ্নটা করেছে ও। আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। ওর মাথাটা শক্ত মাটির ওপরের পাতলা চাদরে রাখা। একটা ইয়া বড় কালো কাঠপিঁপড়া কিলবিল করে হেঁটে যাচ্ছে ওর ডান কানের কাছ দিয়ে। ও পিঁপড়াটাকে দেখতে পায়নি। ঘাড় বাঁকা করে চেয়ে আছে আমার দিকে নিষ্পলক। আমি আগপাছ কিছু চিন্তা না করে কোল থেকে বইটা নামিয়ে রাখলাম। নড়েচড়ে বসলাম হাঁটু ভাঁজ করে। তারপর কোলের ওপর যেখানটায় বই ছিল ঠিক সেখানটায় একটা হাত রেখে শিহাবকে বললাম, ‘তুমি চাইলে এখানে মাথা রাখতে পারো।’
ও হকচকিয়ে গেছে। বিস্ময় আর জিজ্ঞাসায় চোখের পাল্লা সরু হয়ে এসেছে। আমি অপ্রস্তুত বোধ করছি, আবার করছিও না। আসলে প্রত্যুষের এই সাবান ফেনা পানির মতো আবছা পবিত্র আলোয়, ঝিরিঝিরি মন ভালো করা স্নিগ্ধ বিশুদ্ধ বাতাসে, ক্রিকের জলের ঢেউয়ের শব্দে, পাখির শব্দে, শত শত সিকাডার ঝুমঝুম গানের শব্দে আর সাউদার্ন ম্যাগনোলিয়ার পাগল করা বুনো ঘ্রাণে আকণ্ঠ ডুবে থেকে আমার মনের ওপরের শক্ত মিথ্যে ঝিনুকতুল্য খোলসটা ক্রমেই কেমন অদৃশ্য হয়ে আসছিল। যে কথাগুলো আটপৌরে নাগরিক জীবনের নানামুখী বাস্তবিক চাপে কখনো মুখ ফুটে বলা যায় না, সেই কথাগুলোই যেন এই গভীর অরণ্যের আশ্চর্য ভোরবেলায় অনায়াসে বলে ফেলা যায়!
—‘পিঁপড়া, তোমার কানের কাছে। এদিকে উঠে এসো। কামড় দেবে।’
শিহাব অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসেছে। অস্বস্তি লাগছে আমারও। আমি তো লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ওকে কাছে ডেকেছি। এখন সে আমার প্রস্তাবে সাড়া না দিলে অপমানের ধকটা মনে হয় সইতে পারব না। প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়েই কখনো কিছু বলতে পারি না। অতিরিক্ত আত্মসম্মান বোধ থাকাটাও যে ভালো কিছু নয় তা আজকাল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
ও উঠে দাঁড়ায়নি। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে। এটা উত্তেজনা? ভয়? নাকি দুশ্চিন্তা তা আমি সঠিকভাবে জানি না। শুধু জানি, ও যখন বিনা বাক্যব্যয়ে বাধ্য ছেলের মতো এগিয়ে এসে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল, তখন এক অদম্য ভালোলাগা আমার নাকে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেলো। পবিত্রতায় ছেয়ে গেলো ভিতর বাহির। সারি সারি উইলো গাছ অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ঘিরে আছে আমাদের। বাতাস ভরে আছে হোয়াইট ম্যাগনোলিয়ার বুনো ঘ্রাণে। গাছটা দেখতেও খুব সুন্দর হয়েছে। ডিম্বাকৃতির স্বাস্থ্যবান শরীর জুড়ে সাদা রংয়ের থোকা থোকা ফুল। দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। আমাদের মাথার ওপরের চেরিফুলের ছাউনি দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। গোলাপি রংয়ের পাপড়িগুলো এলোমেলো ঝরে পড়ছে ওপর থেকে, বৃষ্টির মতো। চাদর ছেয়ে গেছে ফুলের পাঁপড়িতে। শিহাবের চুলে কয়েকটা পাঁপড়ি আটকে গেছে। আমি ওর চুল থেকে পাঁপড়িগুলো সরিয়ে দিয়েছি। তারপর উষ্কখুষ্ক চুলগুলোতে চিরুনির মতো আঙুল চালিয়ে ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করছি। ও এখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওই কাটাকাটা মুখটা দেখলে মাঝে মাঝে পাথরে খোদাই করা পৌরাণিক দেবতাদের মুখের কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক সেরকমই নিখুঁত গড়ন। কোথাও কোনো খুঁত চোখে পড়ে না। আমার একুশ বছরের তরুণী মন ওই নিখুঁত চেহারার পরম সুদর্শন যুবকের সান্নিধ্যে ক্রমেই কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, হৃৎপিণ্ড কাঁপছিল এক কষ্ট কষ্ট সুখে! শিহাব চোখ কপালের ওপর তুলে একবার তাকালো আমার দিকে
—‘তুমি কী করবে রুশানিয়া? যদি তোমার সাথে কখনো এমন হয়?’
—‘কেমন হয়? কীসের কথা বলছ?’
—‘যদি তোমার ভালোবাসার মানুষটা তোমাকে ছেড়ে চলে যায়?’
আমি ওর মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে রুদ্ধশ্বাস গলায় বললাম, ‘মরে যাব!’ শিহাব একটা হাত বাড়িয়ে আমার চুলের খোঁপা খুলে দিল, হেসে বলল ‘এভাবে বলতে নেই!’
আমার খোলা চুল ওর কপালের ওপর গিয়ে পড়েছে। ঝরে পড়েছে কানে গোজা চেরিফুল। আমি চুল সরিয়ে নিলাম ওর কপাল থেকে। আমার মেরুদণ্ড শিরশির করছে। আমি ওর জাদুকরী হাসিটার দিকে চেয়ে আছি একদৃষ্টে। ও হঠাৎ হাসি বন্ধ করে কেমন অন্যরকম গলায় বলল, ‘তোমাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল রুশানিয়া?’
আমি মনে মনে চমকে উঠেছি। এই প্রথম ও আমার কোনো প্রশংসা করল। ভালোলাগায় আমার নিশ্বাস ভরে গেছে। এতো বেশি ভালো লেগেছে কথাটা যে, এই কথার প্রেক্ষিতে আমি আর কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আনন্দে পুরোদস্তুর বোবা হয়ে গেছি। মুখ লুকাতে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে চাইলাম। এই মুহূর্তে আমার ভেতরকার গোপন ভালোলাগা আমি ওর কাছে প্রকাশ করতে চাই না। এই অনুভূতি একান্তই আমার…!
—‘গতকাল রাতে আমি যখন তোমার হাত ধরেছিলাম, তুমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিলে কেনো?’
আমি ঘাড় নামালাম আবার। মাথা নিচু করে ওর মুখের ওপর চোখ ফেলে একটা হাত রাখলাম বুকের ওপর। আলতোভাবে বললাম, ‘তুমি চাইলে হাতটা ধরতে পারো।’
শিহাব চিবুক গলার সাথে লাগিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখা আমার হাতের দিকে একবার দেখলো। আড়চোখে তাকালো আমার দিকে। তারপর আমার হাতের ওপর হাত রেখে দুই চোয়ালে ভাঁজ ফেলে চমৎকার হেসে বলল, ‘এই হাতটা এখন আমার?’
—‘হ্যাঁ, এই হাতটা এখন তোমার!
—‘ওর সাথে যা ইচ্ছে করতে পারি?’
—‘পারো, ইচ্ছে হলে কেটে ফেলে দিতে পারো ক্রিকের পানিতে! আপত্তি নেই।’
শিহাব
রুশমির চন্দন রংয়ের মসৃণ, কোমল হাতটা এখন আমার হাতের মুঠোয়। এই হাতের কর্তৃত্ব কিছুক্ষণের জন্য আমার। আমি চাইলে নাকি এই হাত কেটে ফেলে দিতে পারি ক্রিকের পানিতে। কী অদ্ভুত কথা! মেয়েটাকে আমি কী করে বোঝাই যে শুধু একটা হাত নয়, আমার ওর সমস্তটা চাই! সবচেয়ে বেশি করে চাই এই রক্ত মাংস আর চামড়ার খোলসের নিচে যে অদৃশ্য মন আছে, সেই মনটাকে। হ্যাঁ, সেই মনটাকেই আমি চিরদিনের জন্য নিজের করে চাই। রুশানিয়া, তুমি কি তোমার মনটা লিখে দেবে আমার নামে?
ওর হাতের অনামিকায় একটা হীরের পাথর খচিত স্বর্ণের আংটি দেখতে পাচ্ছি। রিং ফিঙ্গারে পরেছে অর্থাৎ এটা বিয়ের আংটি। বিয়ের সময় এই আংটি আমার নজরেই পড়েনি। মম কিনেছিল খুব সম্ভবত। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বিবাহিত লোকের চিহ্ন হলো এই রিং ফিঙ্গারের আংটি। আমার আংটিটা বিয়ের পরদিন খুলে রেখেছিলাম। তাই অফিসের কেউ বিয়ের ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। হঠাৎ কেমন যেন একটা গ্লানি হলো মনের ভেতর। আমি বিয়ের আংটি খুলে রেখেছি, কিন্তু রুশমি তো পরে আছে এখনো। আমার আঙুলে আংটির অনুপস্থিতি কি ওকে কষ্ট দেবে?
সিকাডা ডেকে যাচ্ছিল অনবরত। ঝুম ঝুম ঝুম গানের মতো সুরে জঙ্গল মাতিয়ে রেখেছে ওরা। হয়তো চেরিগাছটাই আপাতত ওদের আস্তানা। রুশমির এলোমেলো উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছিল আমার কপালে। লম্বা খোলা চুলের ঝাপটা লাগছে মুখে। মাথার চুলের ভেতর ওর আঙুলের নিরবিচ্ছিন্ন বিচরণ টের পাচ্ছি। একটা ঝিরিঝিরি রেশমি বাতাস থেকে থেকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল আমাদের। আর সেই ঝিরিঝিরি বাতাসে চেরিফুলের গোলাপি পাঁপড়িগুলো তেরছা সরল রেখা হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছিল ক্রিকের জলের স্রোতে। বসন্ত বাতাসে ফুলের পাঁপড়ি ঝরে পড়ার মতো সুন্দর দৃশ্য মনে হয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর আজকের এই সময়টা… কেবলই মনে হচ্ছে, এতো সুন্দর সময় আমার জীবনে এর আগে কখনো আসেনি। এই মনোরম প্রকৃতির কানায় কানায় আজ একটি আশ্চর্য রকমের দিব্য সুখের আবেশ ছড়িয়ে আছে। সেই সুখ আমার শরীরের প্রতিটি রক্ত কণায় চারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। জান্নাত কি এর চেয়ে সুন্দর বা সুখের হয় কিনা আমি জানি না। তবে আমার জান্নাত কখনো রুশানিয়াকে ছাড়া পরিপূর্ণ হবে না। আমার জান্নাত কোনো স্থান নয়, কাল নয় বরং আমার জান্নাত এই আশ্চর্য রকমের ঐন্দ্রজালিক মানবীটি!
—‘রুশানিয়া!’
—‘হুম!’
—উড ইউ মাইন্ড প্লেসিং ইওর হ্যান্ড অন মাই হার্ট?’
ওর হাতটা একটু একটু কাঁপছিল। কাঁপা হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে এসে ও আমার বুকের বাঁ পাশে রাখল। আমি ওর চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলাম—‘ডু ইউ ফিল ইট?’
ও একটু সময় সমুদ্রের মতো গভীর দুটি চোখ মেলে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর অস্ফুটে বলল—‘আই ডু!’
আমার মনের ভেতর অনেক দিন আগের পুরনো একটা গানের কথা ঝর্ণার মতো ঝরঝর শব্দে বয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই গুনগুনিয়ে উঠলাম।
রুশমি বলল, ‘গুনগুন না করে গানটা গেয়ে ফেল, গায়ক সাহেব।’
আমি গাইলাম;ওর চোখের দিকে চেয়ে,
It’s amazing how you can speak right to my heart
Without saying a word, you can light up the dark
Try as I may I can never explain
What I hear when you don’t say a thing!
All-day long I can hear people talking out loud
But when you hold me near, you drown out the crowd
Try as they may they could never define
What’s been said between your heart and mine!
You say it best when you say nothing at all!
—‘নটিং হিলের সাউন্ডট্র্যাক ছিল না? কত বার যে দেখেছি মুভিটা!’
—‘আমি দুবার দেখেছি। জুলিয়া রবার্টসকে খুব ভালোলাগে। তোমার ওকে ভালোলাগে রুশানিয়া?’
—‘আমার হিউ গ্র্যান্টকে ভালোলাগে। হি ইজ চার্মিং, ইজন’ট হি?’
—‘ইয়েস হি ইজ! বাট, ওর বয়স কত জানো তুমি?’
—বয়স বুঝি জুলিয়া রবার্টসের বাড়েনি?’
—‘দেখে তো মনে হয় না!’
রুশমি
পাঁচ আঙুলের নিচে ওর হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে বিরতিহীনভাবে। ওই স্পন্দন আমার হাতের শিরা, উপশিরা আর রক্তকণিকা ভেদ করে এসে ধাক্কা খাচ্ছে ঠিক কলিজা বরাবর। মেরুদণ্ড ঝিনঝিন করছে। ও আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমি কি ওকে অনুভব করতে পারছি কিনা? উত্তরে আমি হ্যাঁ বলেছি। কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যিই বুঝতে পারছি ওই হৃৎপিণ্ড এখন স্পন্দিত হচ্ছে শুধুমাত্র আমার জন্য। আর এই মাত্র গানের কথায় কথায় ও জানালো, আমি মুখ ফুটে কিছু না বললেও সে অনেক কিছু শুনে ফেলে!
ও বলল, when you hold me near, you drown out the crowd, Try as they may they could never define, What’s been said between your heart and mine!
এরপর তো আসলে আর নতুন করে কিছু বলার থাকে না। সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তবুও আমার চিরাচরিত, সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ নারী মনটা ভেতরে ভেতরে বেঁকে বসে। সে ভালোবাসার পুরুষটির কাছ থেকে আরো স্পষ্ট এবং ধ্রুব স্বীকারোক্তি চায়। সে চায় তার নিজস্ব পুরুষটির বুকের ভেতরের ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও যেন অন্য নারীর দখলে না যায় কখনো। সে বড়ই হিংসুক, কুচুটে এবং লোভী! তাই তো সেই লোভী মনের প্ররোচনায় আমি জুলিয়া রবার্টসের প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে খুব সাবধানী গলায় প্রশ্ন করে বসলাম, ‘আচ্ছা, তুমি কি সেই মেয়েটাকে কিছু বলেছ? মানে, তুমি যে বলেছিলে তুমি একজনকে পছন্দ করো। তো, মেয়েটাকে কি তোমার মনের কথা খুলে বলেছ?’
শিহাব আমার প্রশ্ন শুনে একটু থমকে গেছে বোধহয়। নির্বাক চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর শোয়া থেকে উঠে পা ভাঁজ করে আসন গেড়ে বসল, আমার মুখোমুখি। আমার হাতটা ওর হাতের মুঠোয় ধরা। ও এখন চিবুক উঁচু করে সরু চোখে তাকিয়েছে আমার দিকে। কপালে কুঞ্চন, চোখে হালকা হাসি মিশ্রিত দ্বিধার রেশ। ঠিক এমন ভঙ্গিতে ও যখন কোনও নিবিড় চিন্তায় মগ্ন থাকে, তখন ওকে ভারী সুন্দর দেখায়। আমার সম্মুখে এই মুহূর্তে প্রকটভাবে দৃশ্যমান ওর গলার মাঝ বরাবর আটকে থাকা সুডৌল কণ্ঠমণি। ঠিক ওখানটায় একটা চুমু খেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে। যেদিন ও আমাকে প্রপোজ করবে, (আদৌ কোনদিন করবে, নাকি এসব হেয়ালি কথা বলেই জীবন কাটিয়ে দেয়ার ধান্ধা করছে কে জানে!) সেদিন নিশ্চয়ই আমি ওখানেই চুমু খাবো সবার প্রথমে। কী সব এলোমেলো চিন্তা! এসব এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি নিজের মনে হাসছি। শিহাব তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করছে, ‘হাসছ কেনো?’
আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলছি, ‘এমনি, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’
—‘ভাবছি মেয়েটাকে সব খুলে বলব। না বললে মনে হয় বুঝবে না। প্রচণ্ড গাধা টাইপের একটা মেয়ে।’
কী ফাজিল ছেলে! পরোক্ষভাবে সে আমাকে গাধা বলে ফেলল। একটা বালিহাঁস প্যাকপ্যাক শব্দে উড়ে এসে ক্রিকের ধার ঘেঁষে বসেছিল। কুচি কুচি পাথর ভাসা টলটলে স্বচ্ছ জলে ঠোঁট ডুবিয়ে পানি পান করছিল। আমি সেই বালিহাঁসের ছাই রংয়ের পাখনায় চোখ রেখে হালকা ঝাঁঝ নিয়ে বললাম, ‘গাধা হোক আর মানুষ হোক, তোমার উচিত মুখ ফুটে মনের কথা খুলে বলে ফেলা। প্রপোজ করা।
ওর চিবুকটা আরো একটু চোখা হয়ে ওঠে। ঠোঁটের কোণে কুঞ্চন রেখা পড়ে। কেমন অদ্ভুত মুদ্রায় চোখ নাচায়। তারপর তীর্যক গলায় বলে, ‘মেয়েরা জীবনটাকে সিনেমা ভাবতে খুব ভালোবাসে, তাই না? মানে প্রপোজ করার কী আছে? বলারই বা এত আছে কী? বুঝে নেয়া যায় না?’
কথাটা শুনে আমার কেন যেন একটু বিরক্তি ভাব হলো। শিহাবের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বললাম, ‘মানুষের তো আর খেয়ে দিয়ে কাজ নেই তোমার না বলা কথা বুঝতে থাকবে সারাজীবন ধরে!’
ও হাসে, হাসতে হাসতে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নড় করে, ‘টুশে!’
একটু থেমে পরমুহূর্তেই আবার কপট রাগ ফুটিয়ে তোলে গলায়, ‘কী ব্যাপার? হাত সরিয়ে নিচ্ছ কেনো? এটা আমার!’
—‘তোমার ছিল, এখন আর নেই। টাইম এক্সপায়ার হয়ে গেছে।’
—‘টাইম এক্সপায়ার হলেও কিছু এসে যায় না। এটা আমি আর ফেরত দিচ্ছি না।’
—‘কী সাংঘাতিক!’
—‘হ্যাঁ সাংঘাতিক।’
—‘ডাকাত একটা তুমি!’
—‘একদম ঠিক! আচ্ছা বলো তো, সেই বোকা মেয়েটাকে ঠিক কীভাবে প্রপোজ করা যায়?’
—‘আমি কী জানি!’
—‘ভেবে বলো।’
—‘ওর পছন্দের কোনো জিনিস উপহার দিতে পারো। তারপর তোমার পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে পারো…’
—‘ওর পছন্দের জিনিস কী?’
—‘প্রবাবলি ফ্লাওয়ার্স, বুকস অ্যান্ড ক্যান্ডেলস!’
সেই সময় আমাদের চারপাশে ফুলের বৃষ্টি হচ্ছিল। কী ভালো যে লাগছিল! একটা উতলা পাগল বাতাস উত্তর দিক থেকে তেড়ে এসে তির্যক ভাবে বয়ে যাচ্ছিল অরণ্যের ওপর দিয়ে। সেই বাতাসে গাছের গা থেকে ফুলের পাঁপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছিল ক্রিকের ধারের পাথরের ওপর, জলের ওপর, চাদরের ওপর। আবার হয়তো আমাদের মনের ওপরেও!
—‘হোয়াট ফ্লাওয়ার?’
—‘পৃথিবীর সব ফ্লাওয়ার!’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম!’
—‘অ্যান্ড হোয়াট ক্যান্ডেল সেন্ট ডাজ শি লাইক মোস্ট?’
—‘ল্যাভেন্ডার, সি স্প্রে, ওশেনমিস্ট, স্যান্ডালউড…!’
—‘তোমার কি মনে হয়? মেয়েটা আমার প্রস্তাবে রাজি হবে?’
বালিহাঁসটা তখন প্যাকপ্যাক শব্দ করে উড়ে গেছে ভোরের আকাশের আবির রং মাখা পলকা মেঘের দলের দিকে। আমি সেই আবির রংয়ের মেঘের দলে ঘোলা চোখে তাকিয়ে ঘোলা গলায় বললাম, ‘কে জানে! রাজি হতে পারে, নাও হতে পারে!
—‘হবে না কেনো?’
ওর দিকে চোখ নামিয়ে এনে গলায় তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে বললাম, ‘হবে কেনো? নিজেকে কী ভাবো তুমি?’
—‘ফাজলামো করছ?’
—‘ফাজলামো নয়, আই অ্যাম সিরিয়াস!’
—‘তুমি কি তোমার পানিশমেন্টের কথা ভুলে গেছো রুশানিয়া? কথা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলো, কেমন?’
—‘এরকম পানিশমেন্ট তুমি জীবনে কয়টা মেয়েকে দিয়েছ শিহাব রেজা?’
ও হাসে, ‘তুমিই প্ৰথম!
একটা পাজি হতচ্ছাড়া মৌমাছি ভনভন শব্দে পাখা নেড়ে একদম আমার ঘাড়ের কাছটায় এসে নাচতে লাগল। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম বসা থেকে। শিহাবের হাত থেকে নিজের হাতটা উত্তেজনাবশত ছাড়িয়ে নিতে চাইছিলাম, ও হাত ছাড়েনি। আমার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে। কেমন গমগমে স্বরে বলছে, ‘আমার জিনিসটা তুমি বারবার আমার কাছ থেকে নিয়ে নিতে চাইছ রুশমি। এটা ঠিক না।
সেই সুযোগে পাজি মৌমাছি ভস করে আমার চুলের নিচে ঢুকে পড়ল। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল একদম! লাফ দিয়ে উঠে তাড়াতে চাইলাম ওটাকে। কানের কাছে কী রকম ভনভন আওয়াজ! মনে হচ্ছে যেন আমার দুনিয়া ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কামড় দিয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু ঘাড়ের একটা জায়গায় জ্বলছে খুব। মৌমাছির কামড় সাংঘাতিক। কামড়ে দিয়ে থাকলে কী হবে এখন? শিহাব হাত নেড়ে কী করল জানি না, কিছুক্ষণের মধ্যে পোকাটা অন্যদিকে উড়ে গেলো। আমি হাঁপাচ্ছিলাম। এখনো ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে। শিহাব আমার ভীতিগ্রস্থ মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ?’
—‘জানি না!’
ও এক পা এগিয়ে এসে আমার ঘাড়ের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল পেছনে। হেসে উঠল নিঃশব্দে। তারপর খুব ক্ষীণ গলায় বলল ‘বেচারা মৌমাছির দোষ নেই। ফুল ভেবে ভুল করেছিল। আমারও মাঝে মাঝে ভুল হয়!’
আমি ওর কথার মেটাফোর ধরতে পেরেছি। ধরতে পেরে আনন্দে বুকের ভেতরটা রমরম করছে একদম! ভালো লাগছে ভীষণ! ভোরের আকাশে সূর্য তখন পূর্ণ দাপটে প্রকাশ পেয়েছে। পাখিদের শোরগোল একটু কমে এসেছে। তবে সিকাডা ডেকে যাচ্ছে অনবরত। পুরো গ্রীষ্মকালটাই ডাকাডাকি করবে ওরা বিরতিহীন ভাবে। কেউ একজন সাইকেল চালাচ্ছে বনপথে। টুংটাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি হালকা। লোকালয়ে রোজকার কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়ে গেছে। শিহাবকে অফিসে যেতে হবে। আমার আজ থেকে ক্লাস শুরু। কিন্তু আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মন চাইছে এই অরণ্যের মধ্যে লুকিয়ে থেকেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেই।
শিহাব আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল -’তোমার হাতটা কেটে নিয়ে, পকেটে করে অফিসে নিয়ে যাই?’
আমি হেসে উঠলাম, কিছু বললাম না।
—‘কিংবা ব্ল্যাক ম্যাজিক করে তোমাকে ছোট্ট, এই একটুখানি বানিয়ে ফেলি।’
‘এই একটুখানি’ শব্দ দুটা উচ্চারণ করার সময় ও হাতের দুই আঙুল চোখের সামনে তুলে ধরে পরিমাপটা দেখিয়ে দিল। বলতে লাগলো,
—‘তারপর ল্যাপটপের ব্যাগে ভরে আমার সাথে নিয়ে যাব। কেউ জানবে না। শুধু আমার মন চাইলে ব্যাগ থেকে তোমাকে বের করে একটু দেখব, দেখা শেষ হলে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখব। কেমন?’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না। আসলে বলার মতো কিছু খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। হাসিতে, খুশিতে আর এক্সাইটমেন্টে আমার মস্তিষ্কে একদম শব্দের খরা লেগে গিয়েছিল।
—‘তুমি আজ সন্ধ্যায় ফ্রি আছ?’ ও প্রশ্ন করল।
—‘ক্লাস আছে চারটা পর্যন্ত।’
—‘সাড়ে ছটার দিকে রেডি থেকো।
—‘কেনো?’
—‘তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।’
সেদিন গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের ওরিয়েন্টেশনে একেবারেই মন বসল না। আমি জানি সন্ধ্যেবেলায়ই ওর সাথে আবার দেখা হবে। ও তো শুধু আমার প্রেমিক নয়, স্বামীও! ওর সাথে যে আমার জনম জনমের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক! এই এতো কিছু জানবার পরেও যে কী দারুণ ভাবে মিস করছিলাম মানুষটাকে! আমার সমস্ত চৈতন্যে ওর অস্তিত্ব মিশে ছিল। অনাগত, বর্ণিল, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমাকে বিভোর করে তুলছিল। নিজের ভাগ্যকে নিজেই মনে মনে ঈর্ষা করছিলাম আমি। আহা কী সুখের দিন ছিল!
শুভ্রার ফোনটা পেলাম লাঞ্চ টাইমে। ফুড ট্রাক থেকে কাবাব কিনছিলাম। এরা হালাল মাংসের কাবাব বিক্রি করে। ট্রাকের সামনে ছাত্রছাত্রীদের ছোটখাটো একটা ভিড় আছে। শুধু ছাত্রছাত্রীই নয়। ডিসির রাস্তায় রাস্তায়, মোড়ে মোড়ে অসংখ্য ব্যাংক, হাসপাতাল, সরকারি, বেসরকারি কর্পোরেট অফিস আছে। অফিসের কর্মচারীরাও ফুডটাকের খাবার খায় মাঝে মাঝে। শুভ্রার ফোন ধরব, না ধরব না করেও ধরে ফেললাম কী মনে করে যেন।
–‘রুশমি, তোর একটু সময় হবে?’
—‘না হবে না, ব্যস্ত আছি।’
—বেশি সময় নেব না, খুব জরুরি কথা।’
— ‘বলো।’
—‘দ্যাখ রুশমি, আমি তোর বড়বোন। আমি নিশ্চয়ই তোর ভালো চাই।’
— ‘উফ শুভ্রাদি ভ্যাজর ভ্যাজর না করে আসল কথা বলো।’
—‘শিহাব তোর জন্য সঠিক মানুষ নয়।’
আমি শ্লেষের হাসি হাসলাম, ‘তাই? আমার জন্য সঠিক মানুষ নয়, তো কার জন্য সঠিক শুনি? তোমার জন্য?’
—তুই রেগে আছিস আমার ওপর। মাথা ঠান্ডা করে কথা শোন।’ এটুকু বলে ও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর গলাটা খাদে নামিয়ে খুব গম্ভীর স্বরে বলে, ‘তোর বর কিন্তু এখনো আমার সাথে ফ্লার্ট করে, তুই জানিস?’
আমি থমকালাম, হাত থেকে কাবাব প্ল্যাটারের বক্সটা আরেকটু হলে পড়েই যেত। সামলে নিলাম কোনরকমে।
—‘শুভ্রাদি লিসেন, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।’
—‘তুই একটা গাধা!’
মনে পড়ল শিহাবও আমাকে গাধা বলেছিল আজ সকালে। শুভ্রা যোগ করল, ‘তুই শুধু গাধা তাই-ই না। তুই খুব ইনোসেন্টও। শিহাব তোকে ঠকাচ্ছে। শোন এসব প্লেবয় টাইপ ছেলেদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। এরা মেয়েদের নাচাতে ভালোবাসে।’
—‘চুপ করো তো!’
—‘আমি নাহয় চুপ করে গেলাম। কিন্তু তোর কী হবে রুশমি? তোর মতো রিলিজিয়াস, পায়াস, ইনোসেন্ট, ডিসেন্ট একটা মেয়ের কিনা শেষ পর্যন্ত এরকম বাজে ছেলের সাথে জীবন কাটাতে হবে?
নাহ, শুভ্রার কথা আমি বিশ্বাস করি না। একেবারেই করি না। তবুও কী কারণে যেন আমার মনের মধ্যে এখন সুয়োরাণী আর দুয়োরাণীর লড়াই চলছে। সুয়োরাণী বলছে শুভ্রার বোগাস কথা পাত্তা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর দুয়োরাণী বলছে, যদি শুভ্রার বলা কথাগুলো বাই এনি চান্স সত্য হয়ে থাকে তাহলে কী হবে?
—‘রুশমি ডিয়ার! প্লিজ ওয়েক আপ! শিহাবের অফিসে একটা মেয়ে আছে, মানে কলিগ ক্যাথরিনা নাম। তুই কি জানিস ওই মেয়ের সঙ্গে তোর বরের সম্পর্ক কেমন? আর একটা বিষয়! তোর বর কিন্তু অফিসে জানায়নি এখনো যে সে বিবাহিত।’
—‘উফ, শাট আপ শুভ্রাদি! স্ক্রু ইউ! ‘আর কখনো আমাকে ফোন করবে না। প্লিজ অন্যের লাইফ নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিয়ে নিজের লাইফ নিয়ে ভাবো।’
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শেষ করে ফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাগে, উত্তেজনায় আর অপমানে হাত পা কাঁপছে আমার। সুচের মতো কী যেন একটা বিঁধে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। সেদিন আর অন্য কোনো কাজে মন বসল না। অফিস থেকে স্টুডেন্ট আইডি আর ক্যাম্পাস ম্যাপ কালেক্ট করে গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে গেলাম ভিয়েনা, আমাদের বাসায়। কেনো যেন বাবাজান আর আম্মুজানকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওরা বাসায় নেই। ছোট স্কুলে। মেজো স্কুল থেকে ফিরে এসে কিচেনে কী সব হেলদি ফুড রান্না করছে। আমাকে দেখামাত্র কলকল করে বলে উঠল, ‘ওয়াও। পারফেক্ট টাইমিং বড়পু! ঝুম্পা আপু এসেছে কিছু ভেজিটেবলের চারা নিয়ে। ব্যাক ইয়ার্ডে আছে। তুমি একটু দেখো তো ওর কিছু লাগবে কিনা। আমি এসব গার্ডেনিং এর কিছুই বুঝি না।’
ব্যাক ইয়ার্ডে এসে দেখি ঝুম্পা আপু বাগানে কাজ করছে। হাতে গ্লাভস, পায়ে ওয়াটার প্রুফ ট্র্যাকশন বুট, মাথায় হ্যাট, গায়ে এপ্রোন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একবার। হেসে বলল, ‘আন্টি করলার চারা চেয়েছিল বুঝলি? আমার কাছে এক্সট্রা কয়েকটা ছিল তাই নিয়ে এলাম। আন্টির কফিশপ সামলে বাগানের কাজ করতে কত কষ্ট হয়। তাই ভাবলাম আমিই চারাগুলো লাগিয়ে যাই।’
—‘ভালো করেছ ঝুম্পা আপু। আম্মুজান খুব খুশি হবে। তোমার খবর কী? আছ কেমন?’
ডেকের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে প্রশ্ন করলাম। আজ খুব কড়া রোদ উঠেছে। সানস্ক্রিন না লাগিয়ে বাইরে বেরোনোটা একেবারেই উচিত কাজ হয়নি বলে মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে আসার পর আমার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে শুভ্রার কথাগুলো হজম করতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। ওর এতো সাহস কী করে হয় যে আমার বরের নামে এমন কলঙ্ক রটায়! অসভ্য একটা মেয়ে! ভেবেছে এসব বলে আমাকে আমার বরের বিরুদ্ধে উসকে দেবে। এতোও সোজা না ভাই!
হ্যাঁ, শুভ্রার বলা কথাগুলো ঠিক এভাবেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেদিন। উড়িয়ে দিতে পেরে আমার ভালো লাগছিল। আমি সুখী ছিলাম। সন্তুষ্ট ছিলাম। আর উত্তেজিত ছিলাম এই ভেবে যে, আজ সন্ধ্যায় হয়তো আমার জীবনের ফার্স্ট ডেট হতে চলেছে। এই দিনটার স্বপ্ন দেখছি সেই বয়ঃসন্ধি থেকে। আজ আমার অনেকদিনের আরাধ্য স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু ভাগ্যের ফের! এমন নিখাদ সুখ আমার কপালে সইল না!
ঝুম্পা আপু বাগানের কাজ শেষ করে ডেকে উঠে এসেছে। চেয়ারে বসে পায়ের জুতোর ফিতে খুলছে। খুলতে খুলতেই বলল, ‘শিহাব কেমন আছে?’
—‘আলহামদুলিল্লাহ।’
—‘শোন রুশমি, আঙ্কেল তো ঠিক মতো কিছু খোঁজ খবর না নিয়েই তাড়াহুড়া করে তোর বিয়েটা দিয়ে দিল। তুই জানিস তো, তোর বর কাদের সাথে মেলামেশা করে? মানে ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে পরিচয় হয়েছে?’
কেনো জানি না, এই কথায় আমার বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠল।
-–‘এসব কেনো বলছ?’ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম।
ঝুম্পা আপু বড় শ্বাস ফেলল। একটু চিন্তার রেশ গলায় ঢেলে বলল, ‘তোর দুলাভাই গতকাল দুপুরে শিহাবকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখেছে। একটা মেয়ের সাথে। তোর দুলাভাইয়ের কাছে মেয়েটাকে স্প্যানিশ বলে মনে হয়েছে। তুই কিছু জানিস নাকি? কে এই মেয়ে? না মানে তুই জানলে ঠিক আছে। ফ্রেন্ড হবে হয়তো, তাই না?’
আমার নিশ্বাস থমকে গেছে। এতক্ষণের হাসতে থাকা, খেলতে থাকা, উড়তে থাকা ফুরফুরে মনটা ঝুপ করে ডানা হারিয়ে পড়ে গেছে গভীর কোনও অন্ধকার খাদে। আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। নিশ্চল দৃষ্টি মেলে শুধু চেয়ে আছি ঝুম্পা আপুর দিকে।
—‘হ্যাঁ, চিনি মেয়েটাকে, ওর অফিসের কলিগ। আমার সাথে কথা হয়েছে এ ব্যাপারে!’
মিথ্যেটা বলার জন্য চোখ লুকোতে হলো। নিদারুণ এক অনুশোচনায় ভরে গেছে বুক। বড় বোন বলতে সত্যিকার অর্থে কাউকে যদি এ জীবনে গণ্য এবং মান্য করে থাকি তবে সেই ব্যক্তি একমাত্র ঝুম্পা আপু। আমার মেজো খালার জ্যেষ্ঠ মেয়ে। বয়সে প্রায় আট বছরের বড়। আমি জানি আপু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। মনে প্রাণে সে আমার মঙ্গল কামনা করে। অথচ আজ হয়েছে কী দ্যাখো। একমাত্র বড় বোনের কাছে স্বামীর সম্মান বাঁচানোর নিমিত্তে ছলনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তাও আবার সেই স্বামী, যাকে কিনা চিনেছি মাত্র চার মাস হলো। যার ব্যক্তিগত এবং কর্মগত জগৎ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান আমার নেই। সেই অর্ধ পরিচিত, দুর্বোধ্য এবং দুর্জ্ঞেয় মানুষটার জন্য আজ চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে প্রিয়জনের কাছে মিথ্যে বলছি। কিন্তু কেনো? ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে কন্ঠনালী ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসতে চায় একটা বিস্ফোরক ‘কেনো!’ অথচ এই ‘কেনো’র উত্তর আমার জানা নেই। শিহাবকে তো আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করিনি। করতে বাধ্য হয়েছি। আজকে যদি তার চরিত্রে কোনো প্রকার দুর্বলতা থেকে থাকে, তবে সেই দায় হবে পরিপূর্ণভাবে আমার পরিবারের। বাবাজানের একটা উচিত শিক্ষা হবে। অনুমতি ব্যতীত জোরপূর্বক মেয়ে বিয়ে দেবার উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করবে সে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার মেজো এবং ছোট বোনের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে। ওদের বিয়ে নিয়ে পরিবার থেকে আর কোন ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা করা হবে না। আমার নিশ্চয়ই এসব পরিণতির কথা ভেবে মনে মনে তৃপ্ত হওয়া উচিত। খুশি হওয়া উচিত। আমি আমার ভেতরে পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াচ্ছি সেই প্রতিশোধ পরায়ণ মনটা। কিন্তু সে মন এখন নাগালের বাইরে। চোখের সামনে কেবলই ওই সহজ সরল অভিব্যক্তির নিষ্কলুষ মুখটা ভেসে উঠছে। ওই চোখের চাউনিতে আমি কোনো রকম ভণ্ডামি দেখিনি। ওই চোখের দৃষ্টি আমার প্রতিশোধপরায়ণ মনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মায়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমি যখনই ওর কথা ভাবছি ঝর্ণাধারার মতো একরাশ মায়া ঝরে পড়ছে মন চরাচরে। আমি এখনও ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছি নিজ কানে। যে হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হয় শুধুমাত্র আমার জন্য!
অথচ ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গেলে ব্যাপারটা অন্যরকম। যেকোন বুদ্ধিমতী মেয়ে এরকম সময়ে আবেগকে দূরে রেখে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করবে। আমি খুব বুদ্ধিমতী নই, তবে আমার মাথা একেবারে নিরেটও নয়। দুইয়ে দুইয়ে যে চার হয় সেই অতি সাধারণ জ্ঞানটুকু আমার আছে। শুভ্রার সাথে ঝুম্পা আপুর কথা কিছুটা হলেও মিলে গেছে। আর একথা তো সত্য যে শিহাব এখনো অফিসের কাউকে জানায়নি যে সে বিবাহিত। এই গোপনীয়তার কারণ কী? আমার চোখে অন্যমনস্কতার ছায়া পড়ছিল ধীরে ধীরে। আপু তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। আমি অস্বস্তি বোধ করছি। নাম না জানা এক কষ্ট ক্যাকটাসের কাঁটার মতো দাঁত কামড়ে বসেছে কলিজার ওপর। হাঁসফাঁস লাগছে। হে আল্লাহ! এ কেমন পরীক্ষায় ফেললে তুমি আমাকে?
—‘শোন রুশমি, আজ সকালে আন্টি ফোন করেছিল। বলল তোর ফুপির কানে নাকি শিহাবের নামে কী সব কথা গেছে।
চকিতে একটা রাক্ষুসে ত্রাস এবং ভয় আমাকে বিহ্বল করে তুলল, ‘বলছ কী? আম্মু তো আমাকে কিছু বলেনি!’
—‘আন্টি তোকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইছে না। তবে আমার মনে হয়েছে তোকে বিষয়টা জানানো উচিত। নইলে তোর ফুপি যা একটা মহিলা! দেখা যাবে এসেই বড়সড় ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছে। তোর উচিত মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা।’
আমার বুক কাঁপছে প্রবলভাবে।
—‘কিন্তু ফুপিকে কে কী বলল? কেনো বলল?’
আপুকে খুব গম্ভীর দেখায়।
‘আমি জানি না। তবে একটা ব্যাপার জানিস? আন্টির সাথে কথা বলার পরে তোর দুলাভাইয়ের মুখে যখন রেস্টুরেন্টের ঘটনাটা শুনলাম তখন কেনো যেন খুব দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসল। তোদের বিয়েটা দুজনের অমতে হয়েছে। শিহাবের কি অন্য কোথাও অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার আছে নাকি আল্লাহ জানে।’
কথাটা শেষ করে ঝুম্পা আপু সতর্কতামূলক নীরব দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘বিয়ে হয়েছে এখনো ছয় মাসও হয়নি। সিন্ধান্ত নেবার এটাই সময়। তুই ভেবে দ্যাখ। সত্যিই যদি ছেলেটার প্রব্লেম থেকে থাকে, তাহলে আমরা অন্যভাবে চিন্তা করব। আমাদের মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিতা, গুনবতী। যোগ্য পাত্রের অভাব হবে না।’
আমার মাথাটা পাগল পাগল লাগছে। দুমদুম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে বুকের পাঁজরে। আমি আপুকে কোন উত্তর না দিয়ে অবিন্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ড্রইং রুমের সোফার ওপর রাখা ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে নিলাম সেলফোন। কাঁপা হাতে ডায়াল করলাম আম্মুকে। ধরল না।
কী করব এখন? কী করা উচিত? শিহাবের সাথে সরাসরি কথা বলব? কথা বলে লাভ হবে কি আদৌ? সে কি দোষ স্বীকার করবে? দুশ্চরিত্র লোকেরা কি কখনো নিজের চরিত্রের দুর্বলতা স্বীকার করে নেয়?
নাহ, তোমরা যাই বলো না কেনো ভাই, আমার শিহাব ওরকম নয়। আমি ওর মনের ভেতরটা পড়তে পেরেছি। দুনিয়া উল্টে গেলেও ও আমাকে কখনো ঠকাবে না!
ঝুম্পা আপু আমার পাশে এসে বসেছে।
—‘রুশমি, তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেনো? খুলে বল সবকিছু। শেয়ার কর আমার সাথে। দেখবি ভালো লাগবে।’
আমার এখন শরীর খারাপ লাগছে। কাউকে বলা হয়নি যে শরীরটা কদিন যাবৎ আসলে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। এ বছর রেগুলার চেকআপটাও নানামুখী ব্যস্ততার চাপে করা হয়ে ওঠেনি। আমি পেটের ওপর কুশন চেপে ধরে, দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে বসে আছি। আপু আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। আমি উত্তর দিচ্ছি না। দিতে পারছি না। আমার বুকের ভেতর দুর্ভাবনার গ্যাঁজলা উঠে গেছে। দম আটকে আসছে প্ৰায়।
এমন সময় জানালার বাইরে আম্মুজানের গাড়ি দেখতে পেলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গাড়ি পার্ক করে বাড়ির ভেতরে ঢুকল আম্মু। হাতভর্তি বাজার সদাই। মেজো দৌড়ে গিয়ে প্যাকেটগুলো আম্মুর হাত থেকে লুফে নিল।
—‘বাহ্… তোমরা কখন এলে?’
অসময়ে আমাকে আর ঝুম্পা আপুকে দেখে আম্মুর নির্বিকার প্রতিক্রিয়া। আমি কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে বসলাম, ‘কথা আছে তোমার সাথে ‘
আম্মুকে খুব একটা অপ্রস্তুত হতে দেখা গেল না। তবে তার শান্ত সুশ্ৰী মুখে দুশ্চিন্তার কালো ছায়াটা আমার চোখ এড়ালো না। হিজাব খুলতে খুলতে সোফায় বসল। হাঁক ছেড়ে মেজোকে বলল, ‘আমাকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যাও তো ঝুমি!’
মেজো মিনিট না গড়াতেই পানি নিয়ে এলো। আম্মু ঢকঢক করে পানি পান করল আস্তে ধীরে। তারপর হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘ঝুম্পা তোমাকে কিছু বলেছে?’
—‘হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু এর মানে কী? ফুপিকে কে কী বলল?’
আম্মু একটা বড় হতাশার শ্বাস ছাড়ল, ‘আমরা কিছুই জানি না। এমন কি তোমার ফুপিও সংবাদদাতা লোকটাকে চেনেন না। তোমার ফুপি প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। উল্টো বকাঝকা করে ফোন রেখে দিয়েছেন। কিন্তু সেই লোক নাকি কী সব ছবি পাঠিয়েছে মোবাইলে। আপত্তিকর ছবি। তোমার ফুপিকে তো চেনোই। খুব রেগে গেছেন এসব ছবি দেখে। ঘটনা কী রুশমি? তুমি কিছু জানো নাকি?’
— ‘কী ছবি?’
—‘জানি না, তোমার ফুপিতো মোবাইলে ছবি পাঠাতে পারে না। উনার ছেলে আর ছেলের বৌ গেছে ডালাস। ওরা ফিরে এলে পাঠিয়ে দেবে।’ কিয়ৎক্ষণের জন্য থামল আম্মু। তারপর স্নেহসিক্ত নরম গলায় বলল, ‘তোমার কী মনে হয় মামণি? ছেলেটা আসলে কেমন? আমি আর তোমার বাবাতো দুশ্চিন্তায় নিশ্বাস নিতে পারছি না এ ঘটনা শোনার পর থেকে আমার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে তখন। চারপাশটা কাচের মতো ভাঙছে ঝনঝন শব্দে। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে এতো জোরে কামড়ে ধরেছি যে, ওই জায়গাটা রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। রক্তের নোনতা স্বাদ টের পাচ্ছি। আম্মু আমার পাশে এসে বসল। কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে খুব সাবধানী গলায় প্রশ্ন করল,
—‘তোমাদের বিয়ে কি কনসামেট হয়েছে?’
আমি চুপ। আম্মু অধৈর্য হলো, ‘উত্তর দাও!’ আমি এবারেও চুপ।
—‘হয়নি, তাই না?’
মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে আম্মু তৃপ্ত হলো।
—‘অত চিন্তার কিছু নেই। এসব ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন মানে হয় না।’
কথা বলতে বলতে আম্মু আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি ভাবছি শরীর সঙ্গম আমাদের হয়নি এ কথা ঠিক, কিন্তু মনের সঙ্গম? সেতো হয়ে গেছে কবেই! সেই অদৃশ্য মিলন তো বাস্তবতার মুখোশ পরা ভণ্ড সমাজের চোখে ধরা পড়বে না। আমি জানি আম্মু এখন মনে মনে ঠিক কী ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। আম্মু ভাবছে কুমারী মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে দেয়াটা খুব সহজ কাজ হবে। আমি যেন খেলার পুতুল। ওদের মন চাইল তো খেলাঘর বেঁধে দিল, আবার মন চাইল তো ভেঙে দিল! স্বার্থপর, স্বার্থপর, দুনিয়ার সব মানুষ স্বার্থপর!
আম্মুজান বলে যাচ্ছে, ‘ভালো হয়েছে যে শুরুতেই এসব ঘটনা উঠে এসেছে। ডিভোর্স হলে সামাজিকভাবে আমাদের হেও হতে হবে এ কথা ঠিক। কিন্তু আমাদের কাছে তোমার সুখটাই বড়। জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন সৎ এবং ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি খুব প্রয়োজন। তোমার বাবাজান ভেবেছিল ছেলেটা তার নিজের বাবার মতো ধার্মিক এবং সচ্চরিত্রের অধিকারী। বিয়ের আগে আমরা শুনেছিলাম ছেলে নাকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কিন্তু বিয়ের পর দেখি জুম্মার দিনেও সে অফিসের অজুহাতে মসজিদে যায় না। উল্টো গান বাজনা নিয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ। তুমি তো জানো তোমার বাবা গানবাজনা একেবারেই পছন্দ করে না। তবুও আমরা ভেবেছিলাম ছেলের বয়স কম এখনো, সঠিক নির্দেশনা পেলে ভবিষ্যতে দ্বীনের পথে চলতে শিখবে। কিন্তু চরিত্রগত দোষ যদি থেকে থাকে, হায় আল্লাহ! ভাবতে গিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আল্লাহ আমার মেয়েকে বাঁচাক। আল্লাহ আমার মেয়েকে রক্ষা করুক! আজকে আর ও বাড়িতে যাবার দরকার নেই রুশমি। থেকে যাও এখানে। তুমি না এলেও তোমার বাবাজান রাতে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসত। ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনের আগে ওখানে আর যাবার প্রয়োজন নেই।’
কথায় আছে অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। আমি সেই মুহূর্তে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বুকের ভেতর আবেগ নেই, মাথার ভেতর মগজ নেই, মুখে বাকশক্তি নেই। পুরোদস্তুর এক নেই রাজ্যে হারিয়ে গেছে সমস্ত চেতনা। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ধাক্কা এসে লাগে। মনে হয় কেউ বুঝি এভারেস্টের চুড়ো থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল নিচে। নিমেষে পৃথিবীর সব আলো বাতাস উধাও হয়ে গেলো। এক ভয়ংকর অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে ফেলল। খিঁচুনি দিয়ে উঠল হাত পা। বিয়ের দিন যার মুখ থেকে ভয়ে মূর্ছা গিয়েছিলাম, আজ সেই মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে, পুনরায় মূর্ছা গেলাম।
শিহাব
অফিস ছুটির নির্ধারিত সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়লাম। অফিসের কাছাকাছি একটা নার্সারি থেকে গুণে গুণে একশোটা লাল গোলাপ কিনলাম। বার্ন অ্যান্ড নোবেল থেকে কিনলাম চার্লস ডিকেন্স এবং ভার্জিনিয়া উলফ সমগ্র। চার্লস ডিকেন্সের কয়েকটা বই রুশমির বইয়ের তাকে দেখেছিলাম কিন্তু ভার্জিনিয়া উলফ দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। টার্গেট থেকে ভিন্ন ভিন্ন সুগন্ধির পঞ্চাশটা মোমবাতি কিনলাম। এর মাঝে রুশমির পছন্দের সুগন্ধিও আছে। ভেতরে ভেতরে দারুণ রকমের একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। আজ নিশ্চয়ই আমি নির্দ্বিধায় মনের কথা খুলে বলব। কী বলব, কী করে বলব, তা সঠিক জানি না। শুধু জানি, বলতে আমাকে হবেই। রুশানিয়া এমনটাই চায়। আর রুশানিয়ার চাওয়া আমাকে যে কোনো উপায়ে, নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে হলেও পূরণ করতে হবে!
সন্ধ্যা ছটার দিকে বাড়ি ফিরে রুশমিকে পেলাম না। ভার্সিটি থেকে তো এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। ওর ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই। কোনো সোশ্যাল মিডিয়াতেই আমি তেমন একটা অ্যাকটিভ নই। কী করব, কীভাবে ওর সাথে যোগাযোগ করব, এসব ভেবে মাথাটা কেমন গোলমাল লাগছিল। অবশেষে বাস্তব বুদ্ধির উদয় হলো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মস্তিষ্কে। জাহিদকে ফোন করে রুশমির ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। কী কারণে যেন বুকটা এক অর্থহীন আশঙ্কার দুঃসহ প্রাবল্যে দুরদুর করে কাঁপছে। রুশমিকে আমার বরাবরই ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল বলে মনে হয়। মেয়েটা কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। এই ভালো তো এই খারাপ।
ওর নম্বরে জীবনে প্রথমবারের মতো ডায়াল করলাম। ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ ফোন ধরল। গলা শুনে চিনতে পারলাম। আমার শাশুড়ি।
—‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। আম্মু বলছেন?’
—‘কে? শিহাব?’
—‘জি, শিহাব বলছিলাম।’
—‘বলো, কী ব্যাপার?’
—‘রুশমি কোথায়?’
—‘ওর শরীরটা একটু অসুস্থ। ঘুমিয়ে আছে। থমকালাম ক্ষণিকের জন্য –’অসুস্থ, হঠাৎ?’
শাশুড়ি আমতা আমতা করল, ‘উইক হয়ে গেছে খুব। পলেনে এলার্জি আছে তো। এ সময় মেয়েটার প্রতি বছর জ্বরজারি হয়।’
—‘ওর সাথে কথা বলা যাবে?’
—‘ঘুমোচ্ছে তো!’
—‘আচ্ছা, ও ঘুম থেকে উঠলে আমাকে একটা কল করতে বলবেন আম্মু?’
—‘দেখি, এখন রাখছি তাহলে।’
আজব কাণ্ড! পলেনের এলার্জিতে আহামরি জ্বর হবার প্রশ্নই আসে না। আর যদি হয়েও থাকে, রুশমি তো জানে আজ ওর আমার সাথে বেরোনোর কথা ছিল। আমাকে কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে যাবার মানে কী? আমি আর সময় নষ্ট না করে সোজা ভিয়েনা চলে গেলাম, শ্বশুরবাড়ি। দরজা খুলল রুশমির মেজো বোন। তার মুখটা অত্যধিক শুকনো। হালকা বুক কাঁপল আমার।
—তোমার আপু কোথায়?
—‘বড়পু তো ঘুমাচ্ছে।’
ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। আমার জানা আছে রুশমির ঘরটা দোতলার কোনদিকে। সিঁড়ি ভাঙতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে শ্বশুরমশাইয়ের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। তার পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। আঁতরের সুগন্ধে ম্ ম্ করছে চারপাশ। হাতের আঙুলে ঝুলছে গাড়ির চাবি। একটু পর মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হবে। খুব সম্ভবত এখন তার মসজিদে যাবার সময়।
আমাকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল -’কী ব্যাপার?’
সালাম দিয়ে বললাম, ‘শুনলাম রুশমি অসুস্থ।’
—‘হ্যাঁ, ওর শরীরটা একটু খারাপ।’ সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দরাজ গলায় কথাটা বলল শ্বশুর আব্বা।
—‘হঠাৎ কী হলো বুঝলাম না। আজ সকালেও তো সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।’
—‘হুম, ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। কয়েকটা দিন আমাদের এখানে থাকুক।’
কথার ধরণ শুনে মনে হলো রুশমির শারীরিক অসুস্থতা নয়, বরং কয়েকটা দিন এ বাড়িতে অবস্থান করাটাই মুখ্য বিষয়।
—‘তা নাহয় থাকল, কিন্তু ও তো আমাকে কিছু জানায়নি!’
—‘জানানোর সুযোগ পায়নি হয়তো। ও এখন ঘুমোক। ডিস্টার্ব করো না।’
কথাটা পছন্দ হলো না। নিজের স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাওয়া মানে ডিস্টার্ব করা? শ্বশুর আব্বা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, ‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও। রুশমি সুস্থ হয়ে উঠুক। তারপর পাঠিয়ে দেব।’
আমার এখন বড় বড় শ্বাস পড়ছে। মাথায় আগুনের মতো ঝলসে উঠতে চাইছে এক করাল অন্ধ রাগ। সেই করাল রাগের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে করতে লোকটার চোখে চেয়ে স্তিমিত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
—‘আমি আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই।’
লোকটার শান্ত মুখশ্রী কঠোর হতে খুব বেশি সময় লাগল না। মেহেদী পরা লালচে লম্বা দাড়িতে কয়েকবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বজ্রের ন্যায় প্রকট গলায় ঘোষণা করল, ‘আজ দেখা হবে না। কয়েকটা দিন যাক। তারপর এসো।’
কথাটা শেষ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো সদর দরজার কাছাকাছি। একটু থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আর কিছু বলবে?’
আমার বুকের ভেতর ধিকিধিকি অঙ্গার জ্বলছে। সন্দেহের একটা বীজ ছড়িয়ে গেছে বাতাসে। নার্ভাস বোধ করছি। শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে বরাবরই বেশ পছন্দ করত। এ বাড়িতে এসেছি, কিন্তু জামাই আদর হয়নি এরকম ঘটনা আমার মনে পড়ে না। আজ হঠাৎ কী হয়ে গেলো যে আমার প্রতি এদের আচার আচরণ ভেলকি দিয়ে পাল্টে গেলো? এই বিরূপ মনোভাবের কারণ কী? আমার নড়তে কষ্ট হচ্ছিল। শরীরটাকে বোঝা মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকারও আর কোনো মানে হয় না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অকাট সত্য কথা হলো যে এ বাড়ি থেকে আমাকে একরকম অপমান করে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই অপমান মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আমার আপাতত কিছু করার নেই। রুশমি ওপরে বসে থেকে করছেটা কী? ও কি আমাকে মানুষ বলে গণ্য করে না? ও কি বোঝে না যে আমারও আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই মানবিক আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন একটা সত্যিকার মন আছে? বারবার আমার মন ভেঙে দেবার অধিকার ওকে কে দিয়েছে? মাথা হেঁট করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম নিঃশব্দে। ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ যেন ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল বুক। আমার অপরাধ কী জানি না। কেউ কি বলে দেবে ঠিক কোন অপরাধের শাস্তি স্বরূপ আজ আমি আমার রুশানিয়ার সাথে একটা মুহূর্তের জন্য দেখা করতে পারছি না?
বার্ক লেকে বসে রইলাম ঘণ্টা খানেক সময়। প্রায় গোটা বিশেক সিগারেট পুড়িয়ে ছাই করলাম। মম ফোন করছিল। ধরলাম না। এ মুহূর্তে এসব জটিল বিষয় ওদেরকে জানাতে ইচ্ছে করছে না। তিনদিন পর ওদের ফিরে আসার কথা। এবার পাপা মমের সাথে আমার দাদাজানও আসছে। জীবনে প্রথমবারের মতো দাদা আমাদের আমেরিকার বাড়িতে আসবে, এটা দারুণ রকমের সুখবর!
চোখের সামনে সন্ধ্যা নামলো। পশ্চিমাকাশের লাল, গোলাপি বেগুনি দিগন্ত রেখা বিলীন হলো ধীরে ধীরে। লেকের বুকের আঁশটে গন্ধ ডানায় মেখে দীর্ঘক্ষণের সাঁতার শেষে ভেজা পালকে ঝাড়ন দিয়ে লেকের পাড়ে উঠে এলো রাজহাঁসের দল। একটা সময় গাড়িতে উঠে বসলাম পুনরায়। গন্তব্য ভিয়েনা। এবারে দরজা খুলল শাশুড়ি।
—‘রুশমি উঠেছে ঘুম থেকে?’
পেছন থেকে শ্বশুরমশাইয়ের গলার আওয়াজ পেলাম, ‘না এখনো ওঠেনি। তুমি কাল রাতে একবার এসো। তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।’
—‘কথাগুলো কি আজ বলা যায়?’
—‘না আজ নয়। এখনো বলার সময় হয়নি।’
ফিরে এলাম। এবার বার্ক লেকের অন্ধকার স্রোতস্বীনি জলে রক্ত রংয়ের লাল টুকটুকে একশোটা গোলাপ ভাসিয়ে দিলাম নির্দ্বিধায়। আমার মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না। মস্তিষ্ক এক অনুভূতি শূন্য প্রান্তরে গিয়ে ঠেকেছে। বুকের ভেতর শুধু দহন টের পাচ্ছি। শ্মশানঘাটের কাঠকয়লার মতো পুড়ছে মন। বোধশক্তি, আবেগ, অনুভূতি, চেতন, অবচেতন সমস্তটাই দগ্ধ হচ্ছে… শুধু দগ্ধ হচ্ছে…!’
মনে আছে সেই রাতে গাড়ির চাকায় অনর্থক পা দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছিলাম। পাগলের মতো লাগাতার অনেকক্ষণ লাথি মারতে মারতে একটা সময় ডান পায়ের গোড়ালির রগে টান পড়ে গেলো। অন্ধকার লেকের ধারের শক্ত আগাছাযুক্ত মাটির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে পা ব্যথায় কোঁকাতে লাগলাম। কতক্ষণ কেটেছিল জানি না। একটা সময় একজন বৃদ্ধ লোকের মাথা চোখের সামনে আবিষ্কার করলাম। অন্ধকারেও বৃদ্ধর গলায় ঝোলা ক্রস চিহ্ন চোখে ঝিলিক দিল। বৃদ্ধ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভারী নরম এবং উদার গলায় বলল, ‘আর ইউ ফিলিং সিক মাই চাইল্ড? নো ওরিজ, জেসাস লাভস ইউ।’
রুশমি
জ্ঞান ফেরার পর ক্লান্তি এবং উদ্বেগের দরুন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম শোবার ঘরের বিছানায়। শিয়রে বাবাজান বসে আছে। আমাকে নড়ে উঠতে দেখে বলল, ‘কাল বিকেলে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। যখন তখন জ্ঞান হারাবার প্রব্লেমটা তো আগে ছিল না। হঠাৎ এই রোগ কোত্থেকে উদয় হলো?’
আমার মাথা এখনো টলছে। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট নেড়ে অনেক কষ্টে বললাম, ‘বাবাজান আমার একবার ওই বাসায় যেতে হবে।’
—‘এই শরীর নিয়ে কোথাও যেতে হবে না।
আমি গলায় মিনতির সুর ফুটিয়ে তুললাম, ‘প্লিজ বাবাজান! আজকে আমাকে যেতেই হবে!’
—‘আজ নয়, আমাকে কয়েক দিন সময় দাও মামণি। আমি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি একবার। ওই ছেলের বিরুদ্ধে পাওয়া এলিগেশন যদি সত্য হয় তাহলে এই সম্পর্ক কিছুতেই কনটিনিউ করা যাবে না। আমার নিজের ভুল নিজেকেই শোধরাতে হবে। আমি কোনো লম্পট দুশ্চরিত্র ব্যক্তির হাতে মেয়ের জীবন সপেঁ দেব না।’
বাবাজানকে আমি চিনি। পৃথিবী দুই ভাগ হয়ে গেলেও তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে এক ইঞ্চি টলানো যাবে না। একমাত্র বড়বোন ছাড়া দুনিয়ার আর কোন মানুষ তার চিন্তা জগতে প্রভাব ফেলতে পারবে না। বাবা এই সংসারের একচ্ছত্র কর্তা। তার মুখের কথার ওপর কথা বলার সাহস কারো নেই। অথচ আমার স্বামীর সাথে আমাকে দেখা করতে না দেবার অধিকার কিন্তু পৃথিবীর কারুরই নেই। সোজা আর সরল ব্যাপার হলো, বাবাজানের এখন শিহাবের ওপর রাগ হয়েছে, সন্দেহ হয়েছে, এ কারণেই… শুধু মাত্র এ কারণেই সে শিহাবের কাছে আমাকে যেতে দেবে না। এইসব স্বেচ্ছাচারিতাই চলে আসছে এ বাড়িতে দিনের পর দিন। বাবা এখনো আমাকে তার ছোট্ট মেয়েটাই ভাবছে। আমি যে বিবাহিতা, আমার ওপরে আমার স্বামীর একটা হক আছে, অধিকার আছে এসব বিষয় তার মাথায়ই খেলছে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে আমার আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। এ সবই পরীক্ষার অংশ। আমি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছি, ‘ইয়া আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য দাও, ধৈর্য দাও!’
হায়, বোকা আমি তখনও জানতাম না, আসল পরীক্ষার দিনগুলি তো সম্মুখে অপেক্ষারত!
—‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে বাবা, ষড়যন্ত্র!’ হঠাৎ বলে উঠলাম, অপ্রকৃতস্থ কন্ঠে।
—‘কীসের ষড়যন্ত্র?’
—কেউ একজন ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে। শিহাবকে ফাঁসানো হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীর নাম যদিও বা আমি সুনিশ্চিতভাবে জানি, তবুও বাবার সামনে সেই ব্যভিচারিণীর নামটা উচ্চারণ করলাম না।
—‘যে ছবিগুলো তোমার ফুপুর মোবাইলে গেছে ওগুলো ফেইক নয়।’
—‘তুমি কী করে বুঝলে?’
—‘বোঝা যায়।’
—‘তুমি কি ছবিগুলো দেখেছ?’
—‘আমি দেখিনি, তোমার ফুপু বলেছে। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো। এলিগেশন মিথ্যে হলে তো সব ঝামেলা মিটেই যাবে। এতো অস্থির হচ্ছ কেনো?
অস্থির হচ্ছি কেনো? জানি না কেনো, তবে এ কথা সত্য যে, এক ভয়াবহ অস্থিরতা আমার শ্বাসবায়ু কেঁড়ে নিতে চাইছে। আমার মনে হচ্ছে ওকে একটাবার দেখতে না পেলে আমি এই মুহূর্তে মরে যাব! আমার যে ওকে কত কথা বলার ছিল, কত কথা শোনার ছিল, কিছুই তো হলো না! কেনো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তোমরা বাঁধা সৃষ্টি করছ? কেনো আমাদের সমস্যা আমাদের মত করে সমাধান করতে দিচ্ছ না? ও লম্পট হলে লম্পট নিয়েই থাকব সারা জীবন। লম্পটকেই ভালোবেসে ফেলেছি, কী আর করা! লম্পটের সংসারই করব। কোন আপত্তি নেই! এসব কথা মনে মনে ভেবে গেলেও বাবার সামনে মুখ ফুটে বলার মতো সাহস ছিল না। কিছু বলতে না পেরে তাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার মনের কথা বোঝার মতো কি একটা মানুষ নেই এই পৃথিবীতে?
খানিক বাদে মেজোর কাছ থেকে জানতে পারলাম শিহাব এসেছিল আমার খোঁজে। বাবা ওকে আমার সাথে দেখা করতে দেয়নি। খবর শুধু এটুকুই নয়। আরো খবর আছে। জাহিদ নাকি ওকে ফোন করে বলেছে আগামীকাল শিহাবের বার্থডে। ওরা রাত বারোটার সময় একটা সারপ্রাইজ পার্টির প্ল্যান করছে। এই সিচুয়েশনে আমার উপস্থিতি ওই বাড়িতে ভীষণ ভাবে কাম্য।
কী একটা অবস্থা! এইতো মাত্র দুদিন আগে সাশার জন্মদিন গেলো। দুদিনের ব্যবধানেই আবার শিহাবের জন্মদিন! আমি তো কিছুই জানি না! জানব কী করে? জাহিদের উচিত ছিল আমাকে আগেই জানানো। জাহিদ একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলে! ঠিক করলাম রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর এই বাড়ি ছেড়ে পালাবো। আমার সেলফোন বাবাজান নিয়ে গেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত যে গাড়ির চাবিটা নেয়নি। আমি খুব যত্ন করে বালিশের তলায় চাবিটা লুকিয়ে রেখেছি। এবার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা।
প্রায় জোর জবরদস্তি করে আমাকে ডিনারের টেবিলে নিয়ে আসা হয়েছে। বাবাজান আমার পাশে বসেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, ‘নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখো রুশমি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো।’ আমিও বুঝতে পারছি যে আমাকে খেতে হবে। রুচি না থাকলেও জোর করে খেতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে আমার মাথার ভেতর যে ঘূর্ণন প্রক্রিয়া চলছে, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ভিয়েনা থেকে অ্যাশবার্ন ড্রাইভ করে যাওয়াটা আমার জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া আমার হালকা পাতলা মোশন সিকনেস আছে। অভুক্ত অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করলে অসুস্থ বোধ করি।
মেজো আমার প্লেটে ওর নিজের বানানো আভ্যাকাডো চিকেন সালাদ তুলে দিয়েছে। আম্মুজান বলছে এসব সালাদ টালাদ খাওয়ার উপযুক্ত সময় এখন নয়। এখন আমার শরীর দুর্বল। এই অবস্থায় ডায়েট চলবে না। আম্মুজান সালাদের প্লেট সরিয়ে নিয়েছে সামনে থেকে। তার বদলে সাদা ভাত, সবজি, মুরগির মাংস আর ডাল পরিবেশন করেছে। আমি এক লোকমা ভাত মুখে তুলে চিবোনো আরম্ভ করেছি। মনে হচ্ছে ভাত নয়, পাথর চিবোচ্ছি। বাবা গম্ভীর এবং ভারী গলায় বলছে, ‘আল্লাহ সুবহানাতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দা বান্দিদের দুনিয়ায় নানা অভাব অনটন এবং বিপদ আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রেখে, ধৈর্য ধারণ করে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর আস্থা রাখতে হয়। শুকরিয়া আদায় করতে হয়। তাড়াহুড়োর কাজ কখনো ফলপ্রসূ হয় না।’
বাবার কথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরটা এক ব্যাঙ্গাত্মক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। ‘তাড়াহুড়োর কাজ ফলপ্রসূ হয় না’ এ সত্যবচন যদি জানতে এবং মানতে তাহলে অত তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিয়েছিলে কেনো শুনি? তখন তোমার এসব নীতিজ্ঞানের ঝুড়ি ছিল কোথায়? নিজের বাবা বলে আজ মুখ ফুটে কোনো কটু কথা বলতে পারছি না। চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দিতে পারি, কিন্তু কী লাভ হবে? বেচারাকে ছোট বোনদের সামনে অপমান করা হবে। এতো কিছুর পরেও মানুষটাকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। সেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাই আমার মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। আমাদের সমাজটা কেমন যেন অদ্ভুত নিয়মে গড়া! ছোটদের ভুল ধরিয়ে দেবার মানুষ আছে, কিন্তু বড়দের ভুল ধরিয়ে দেবার মানুষ নেই।
আমি প্রাণপণে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছি যেন বাবা আম্মুর মনে সন্দেহের কোনো রেশ না পড়ে। বাবা ভার্সিটির প্রথমদিনের কথা জানতে চাইছে। আমি সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনা করছি। এই অভিনয়টুকু করতে আমার কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তা বলে বোঝাবার মতো ভাষা নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউ বুঝবে না। এ বাড়ি থেকে ওকে পরপর দুবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, কথাটা মনে পড়লেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। না জানি বাবা ওর সাথে কী রকম ব্যবহার করেছে। বাবা রেগে গেলে খুব কর্কশ আচরণ করে, এটা আমি জানি।
সাধারণত রাত দশটা বাজার কিছু আগেই বাবা-আম্মু ঘুমোতে চলে যায়। আজ নিয়মে গড়মিল হলো। আম্মু খাওয়া দাওয়ার পর নিজের ঘরে না গিয়ে আমার পাশে এসে শুলো। আমি নিভে গেলাম। মনটা দেবে গেলো একদম। আমাকে যেন এক অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এই কূপ থেকে বেরোবার কোনো পথ সামনে খোলা নেই। অথচ যে করেই হোক বারোটার আগে আমাকে অ্যাশবার্ন পৌঁছুতে হবে। আম্মু আমার পাশে শুয়ে নানা কথা বলছে। ফুপি মোবাইলে ছবিগুলো পাবার পর কী রকম ভয়ানক ক্ষেপে গেছে সেই কথা বলছে। ফুপি নাকি আগামীকালই ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে, উইকেন্ড পর্যন্ত আর অপেক্ষা করবে না। আমি কথাগুলো শুনছি আবার শুনছিও না। ফুপির রাগ কথন আমাকে মোটেও ভাবাচ্ছে না। আমি ভাবছি আম্মুকে খুলে বলি ওর জন্মদিনের ব্যাপারটা। যদি একটু মায়া হয় অন্তরে। বলব কি বলব না এই ভেবে ভেবেই প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে গেলো। একটা সময় আম্মুর নিশ্বাস ভারী হলো। আমি আল্লাহর নাম জপতে জপতে পা টিপে টিপে নেমে এলাম বিছানা থেকে। পাছে আম্মু জেগে যায় এই ভয়ে নিশ্বাস পর্যন্ত নিচ্ছিলাম না। খুব আস্তে করে দরজার নব ঘুরিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। বাবার ঘরটা আমার ঘরের মুখোমুখি। ভেতর থেকে নাক ডাকার গর্জন ভেসে আসছে। অর্থাৎ বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেজোর ঘরে বাতি জ্বলছে। দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে বললাম, ‘আমি যাচ্ছি, শ্বশুরবাড়ি। আম্মুকে জানিয়ে দিও সকালে, কেমন?’
মেজো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো বাধ্য মেয়ের মতো। দ্রুত পায়ে নেমে এলাম নিচে। বুক ধড়ফর করছিল এমনভাবে যেন আর একটু হলেই প্রাণ পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়াল দেবে দেহপিঞ্জর ছেড়ে। আল্লাহর অশেষ রহমত যে আমার গাড়িটা আজ স্ট্রিট পার্কিং করা ছিল। নইলে গভীর রাতে গ্যারাজ খোলার শব্দে বাবাজানের ঘুম ভেঙে যেত। বিসমিল্লাহ বলে যাত্রা শুরু করলাম। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের এদিকটা রাত আটটার পর সুনসান নীরব হয়ে যায়। সে তুলনায় এখন তো গভীর রাত। গোটা নেইবারহুডের একটা মানুষও বুঝি জেগে নেই। দ্রুত পৌঁছাবার জন্য শর্টকাট রাস্তা ধরলাম। বেশ খানিকটা পথ যাবার পর মনে পড়ল এই শর্টকাট রাস্তায় টোল আছে। আমার গাড়িতে ইজিপাস নেই। টোল দিতে হবে কার্ড অথবা ক্যাশে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম ওয়ালেট ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছি। সঙ্গে একটা পয়সা নেই, কার্ড নেই, আইডি নেই, শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা আছে গাড়ির ভেতরে। কী বিপদ! সঙ্গে সঙ্গে রুট চেঞ্জ করলাম। নামলাম টোলবিহীন রাস্তায়। খুব নার্ভাস ফিল করছি। বিরতিহীন ভাবে দোয়া ইউনুস পড়ছি। তবুও আমার ভয় কাটছে না। বুক কাঁপছে ধুকপুক করে। হাইওয়ে ঝুম নীরব। গাড়ির সংখ্যা অত্যন্ত কম, হাতে গোণা যায়। অ্যাশবার্ন পৌঁছুলাম পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট পর। এতরকম উদ্বেগ, উত্তেজনার মধ্যেও এটা ভাবতে ভালো লাগছিল যে শেষ পর্যন্ত আমি গন্তব্যে পৌঁছুতে পেরেছি।
শিহাব রেজা! তুমি শুনছ? শুধু তোমাকে এক নজর দেখব বলে এই গভীর রাতের ঝুম অন্ধকারে, দুর্বল শরীর নিয়ে, বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে, প্রায় একত্রিশ কিলোমিটার পথ পাড় হয়ে, পাগলের মতো ছুটে এলাম। এর পরেও কি তুমি আমাকে ভালোবাসবে না? বিশ্বাস করবে না? আপন করে নেবে না? তুমি নিশ্চয়ই এই অসময়ে আমাকে দেখে অবাক হবে। কী ভাববে? কী বলবে? খুশি হবে তো? নাকি অর্থহীন ইগো সর্বস্ব অহংকারে ন্যুব্জ হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে?
আমার সাথে চাবি নেই। দরজায় একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছিলাম। জাহিদ দরজা খুলে জহুরি চোখে দেখতে লাগল আমাকে। আশেপাশে কী যেন খুঁজে নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া কোথায়?’
—‘শিহাব বাসায় নেই?’
—‘না! ভাইয়া তো বিকেল থেকে হাওয়া। ফোনও বন্ধ।’
বুকটা খালি হয়ে গেলো। দুশ্চিন্তায়, অস্থিরতায় এবার আমার সত্যিকারের পাগল হবার দশা। কোথায় গেছে ছেলেটা কাউকে কিছু না বলে কয়ে? কোনো বিপদ আপদ ঘটে থাকলে কী হবে এখন? সাশা ড্রইং রুমে বসে ছিল। জাহিদ মেজোর কাছ থেকে সমস্তটাই শুনেছে। অতএব সাশার ও ঘটনা অজানা নয়। আমি ওর সাথে কোনো কথা না বলেই ওপরে উঠে এসেছি। বার্থডে পার্টির প্ল্যান করার মতো মন মানসিকতা এখন আর নেই। শুভ্রা ডাইনীটাকে একবার কল করব কিনা ভাবছি। এমতাবস্থায় আমার শাশুড়ি ফোন করে জানালো, ফুপি নাকি তাকে ফোন করে শিহাবের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক বিরূপ মন্তব্য করেছে। শাশুড়ির গলার স্বরে. আমি ক্রোধ টের পাচ্ছি। সে শান্তশিষ্ট বিনয়ী মানুষ হলে কী হবে, প্রাণপ্রিয় পুত্রের সমালোচনা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। আরো জানালো ছেলেকে ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রিচ করতে পারছে না। এদিকে ভয়, অপরাধবোধ আর দুশ্চিন্তায় আমি একদম চুপসে গেছি। কী বলব, কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। হাত পা কাঁপছে মৃগী রোগীর মতো।
—‘দ্যাখো রুশমি, আমার ছেলেকে আমি চিনি খুব ভালোমতো। আজকালকার যুগে আমার ছেলের মতো ভদ্র এবং মার্জিত মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। তোমার ফুপি একটা ডিসেন্ট ছেলেকে নিয়ে যা তা কথা বলতে পারে না। উনার কথায় সমস্যা আছে। কোনো ভদ্রলোক এভাবে কথা বলে না।’
—‘আমি ভীষণ স্যরি মম। ফুপি একটু স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বলে। এমনি মনের দিক থেকে মানুষটা খারাপ না।’
মম রেগে গেলো আমার কথায়, ‘থাক, তোমার আর উনার সাপোর্টে কথা বলতে হবে না। আমার ছেলেকে নিজের যোগ্য মনে না হলে তুমি যেকোনো ডিসিশন নিতে পার। আমরা বাঁধা দেব না। এখন আমার ছেলে কোথায় আছে খুঁজে বের করো। প্লিজ!’
সেই প্রথম মম আমার সাথে এতো কঠিন স্বরে কথা বলল। খারাপ লাগল, সত্যি খুব বেশি খারাপ লাগল! এতো খারাপ লাগলো যে ফোনের লাইন কাটার পর আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। শুধু মমের কঠিন ব্যবহারই নয়, ফুপির আচরণ, বাবাজানের আচরণ, শিহাবের নিরুদ্দেশ হওয়া এই এতো এতো দুঃসংবাদ আমার একুশ বছরের দুর্বল মনটা কিছুতেই আর সইতে পারছিল না। কান্নারত ঘোলা চোখ মেলে ল্যাম্পশেডের মরা আলোয় আবিষ্কার করলাম কেউ একজন ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে। আমি বিছানার সামনে কার্পেটের ওপর বসেছিলাম পা ছড়িয়ে। সাশা এগিয়ে এলো আমার দিকে ধীরপায়ে। কান্নার দমকে আমার সারা শরীর কাঁপছে। সাশা আমার পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ চিত্রার্পিত বসে থেকে কান্না দেখল আমার। তারপর আমার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে খুব যত্নের সাথে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি ওর বুকে মাথা রেখে মনের অর্গল খুলে কান্না করতে লাগলাম অবুঝ শিশুর মতো। ও যেন আমার মা, ও যেন আমার বোন, ওই যেন আমার একমাত্র পরম বন্ধু!
খানিক বাদে সাশা একটা লেখার কাগজ আর কলম নিয়ে এলো। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে কেঁদো না,
প্লিজ!’ আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘শিহাবকে কোথায় খুঁজব? কোথায় যেতে পারে? তুমি কিছু জানো?’
সাশা লিখল, ‘ও সময়তমতো চলে আসবে। চিন্তা করো না।’
—‘কিন্তু এরকম তো আগে কখনো করেনি!’
সাশা একটু অদ্ভুত হেসে কাগজে লিখল, ‘এরকম ভালোও তো বাসেনি আগে কখনো কাউকে!’
আমি কান্না থামিয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। এই মেয়েকে আমি বুঝি না!
সে রাতে শিহাব ফিরল না। আমি জায়নামাজে বসে রাত কাটালাম। ভোরের দিকে আম্মুজান ফোন করল বাসার ল্যান্ডফোনে।
—‘রুশমি, এটা তুমি একটা কাণ্ড করলে?’
আমি চুপ।
—‘তোমার বাবাজান ভয়ংকর রেগে গেছে। তুমি ওর সামনে এসো না আজ। সামনে পেলে তোমাকে খুন অবধি করে ফেলতে পারে।’
—‘এতো রেগে যাবার মতো তো কিছু হয়নি। আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি ফিরে এসেছি। অপরাধ তো করিনি।’
—‘তাই বলে কাউকে না বলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবে? একটা ক্যারেক্টারলেস উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের সাথে সংসার করবে আজীবন? এটাই ঠিক করেছ?’
—‘এভাবে বলো না আম্মু। ও ক্যারেক্টারলেস নয়। আর হলেও কিছু করার নেই। আমি ডিসাইড করে ফেলেছি। ওকে ছাড়ব না।’
আম্মু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শ্লেষের গলায় বলল, ‘কী বলছ পাগলের মতো? তুমি কি ভেবেছ এসব করে আমাদের জব্দ করবে? শোনো ক্ষতি আমাদের কিছুই হবে না, যা ক্ষতি হবার তোমারই হবে, রাখছি ফোন। তোমার সাথে কথা বলা আর গাছের সাথে কথা বলা একই কথা। তোমার মাথাটা গেছে।’
জাহিদ বাড়ি ছেড়েছে খুব সকালে। আমি এক কাপ কফি তৈরী করে প্যাটিওতে এসে বসলাম। মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর জুড়ে অবসাদ। স্টেসি টেক্সট করে জানিয়েছে, বেলা দশটার দিকে লিওকে সঙ্গে নিয়ে একবার আসবে এ বাড়িতে। কী নাকি জরুরি কথা আছে। দেখলাম সাশা লনের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে। কানে হিয়ারিং এইড, পরনে সাদা স্লিভলেস গেঞ্জি, জিন্সের শর্টস, কাঁধে ব্যাগ। ম্যাগনোলিয়ার কয়েকটা পাঁপড়ি বাতাসে উড়ে এসে বসেছে ওর নুডলসের মতো কিরিকিরি সোনালী চুলে। ওদের বাড়ি কাছেই। হেঁটেই যাতায়াত করা যায়। কাছাকাছি এসে ইশারায় জানতে চাইল, ‘খবর কী?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘কোনো খবর নেই।’
ও আমার সামনে চেয়ার টেনে বসল। একটু সময় চুপ থেকে মোবাইল বের করে টাইপ করল, ‘তুমি কি শিহাবের জন্মদিনে আমার দেয়া উপহারটা দেখেছ?’
—‘নাতো!’
সাশা আমার হাত ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসলো। লিভিং রুমের কোণায় চাদরে ঢাকা একটা বোর্ড রাখা আছে। ও এগিয়ে গিয়ে বোর্ডের গা থেকে চাদরটা তুলে নিল। আমি অবাক হয়ে ছবির ভেতরে একটা মেয়েকে আবিষ্কার করলাম। মেয়েটা অবিকল আমার মতো দেখতে!
বিস্ময়বিদ্ধ গলায় বলে উঠলাম – ‘এটা তুমি এঁকেছ?’
—‘হ্যাঁ, ভাবলাম এটাই শিহাবের জন্য বেস্ট উপহার হবে!’
আমার বুকে কীসের যেন একটা ধাক্কা এসে লাগল। অদ্ভুত ফিনফিনে অনুভূতিতে ভিজে উঠল চোখের কার্নিশ। হঠাৎ মনের খুব অতলে, ভারী সূক্ষ্মভাবে আমি টের পেলাম যে এই মেয়েটার স্বার্থহীন, নীরব ভালোবাসার কাছে আমি বোধহয় হেরে গেছি। ভালো কী করে বাসতে হয়, তা সাশার চেয়ে ভালো বুঝি আর কেউ জানে না!
শিহাব
প্রচণ্ড শীত করছে। লেকের ধারের জোরালো বাতাস বর্শার ধারালো ফলার মতো শরীরে বিঁধছিল। কনকনে ঠান্ডায় জমে আসছিল হাত পা। আমার গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। শুধু অফিসের ফর্মাল শার্ট প্যান্ট। বৃদ্ধ লোকটা আমাকে বলেছে রিল্যাক্স পজিশনে থাকতে। সে আমার পায়ের গোড়ালিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অত্যন্ত যত্নের সাথে। পায়ের ব্যথাটা এখন আর আমাকে পীড়া দিচ্ছে না। রুশমি আজ আমাকে যে মানসিক আঘাতটা দিয়েছে তার তুলনায় এই শারীরিক যন্ত্রণা অতিশয় ক্ষুদ্র এবং অর্থহীন। মনে হচ্ছে একটা ভারী পাথর বুকের ওপর চেপে আছে। সেই পাথরের চাপে নিশ্বাস নেয়াও দায়! এসব ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। লিখতে গিয়ে টের পাচ্ছি সেদিনের কষ্টটা কালবৈশাখীর উদ্দাম ঝড়ের মতো পুনরায় তেড়ে আসতে চাইছে ভেতরে। অস্থির লাগছে। কিন্তু না লিখলেই কি এই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি আর সন্তাপ মরে যাবে? ক্ষয়ে যাবে? বিলীন হয়ে যাবে? না, তা কিছুতেই হবার নয়। বরং কথাগুলো বলতে না পেরে, কাউকে জানাতে না পেরে দিনকে দিন যন্ত্রণার ওজনটা বেড়ে যাচ্ছে। লিখতে ভালো লাগছে না। আবার না লিখেও শান্তি পাচ্ছি না।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটানা জিসাসের গুণগান করে যাচ্ছিল। এই রবিবারে চার্চে যাবার আমন্ত্রণও জানিয়ে ফেলল। আমি একটা সময় উঠে বসলাম শোয়া থেকে। মৃদুস্বরে বললাম, ‘আই ডোন্ট ফলো ইওর রিলিজিওন স্যার! বাট আই রিয়েলি অ্যাপ্রিশিয়েট ইওর কাইন্ড ওয়ার্ডস। ইউ আর আ নাইস অ্যান্ড থটফুল পার্সন।’ কথাটা বলে শেষ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। বৃদ্ধের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধোঁয়াশা মুখের দিকে একবার চেয়ে বললাম, ‘ডু ইউ নিড আ রাইড?’
বৃদ্ধ আঙুলের ইশারায় ওর সাইকেলটা দেখালো, ‘আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি গুড। ইউ হ্যাভ আ সেফ ড্রাইভ স্যার!’
ভাবছিলাম আজকের সকালটা কতই না সুন্দর ছিল! এত সুন্দর একটা দিনের সমাপ্তি এতো ভয়ঙ্কর হবে তা কে জানত? সাবধানে ড্রাইভ করার মতো মানসিক স্থিরতা ছিল না আমার। মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বলছে। হিংস দুর্মর অচেনা এক পৌরুষ বুকের গভীর থেকে সিংহের মতো গর্জন করে উঠছে থেকে থেকে। পুরো পৃথিবীটাকে এক ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিছুতেই এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব না। এর একটা বিহিত আমাকে করতেই হবে। আমি কাউকে ছেড়ে দেব না। রুশমির চৌদ্দ গুষ্টিকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। তবে এই সব প্রতিশোধপরায়ণ দগ্ধ ভাবনার পুরু আস্তর ভেদ করে একটি অনভিপ্রেত ভয় আমার হৃৎপিণ্ডের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল এই ভেবে যে, রুশনিয়াকে বুঝি এবার আমি সত্যিই হারাতে চলেছি। হয়তো ও আমাকে চায় না, হয়তো আমাকে ওর ভালোলাগে না, হয়তো নিজ উদ্যোগে এই সম্পর্ক ছেদ করতে সংকোচ হচ্ছিল বলে বাবা-মায়ের আশ্রয় নিয়েছে শেষমেশ।
কিন্তু কাজটা তুমি ঠিক করলে না রুশমি। সেই প্রথমদিকেই তো জানিয়ে দিয়েছিলে আমাকে তুমি ঘৃণা করো। আজকেও নাহয় নিজ মুখেই বলে ফেলতে কথাটা। বিষয়টা আমরা নিজেদের মধ্যেই তো মীমাংসা করে ফেলতে পারতাম। তা না করে কেনো এই ছলনার আশ্রয় নেয়া? কেনো আমাকে অযথা আর দশটা মানুষের সামনে অপদস্থ করা? ভুল করেছি, এই মেয়েকে ভালোবেসে মস্ত বড় ভুল করেছি। যদি পারতাম! তবে এই হৃদয়হীনা, স্বার্থপর, কুচক্রী মনের অধিকারী মেয়েটাকে এই মুহূর্তে ডিলিট বাটন প্রেস করে পুরো জীবন থেকে মুছে ফেলতাম। গাড়ি চালাচ্ছিলাম সর্বোচ্চ গতিতে। কোন দিকে যাচ্ছি জানি না। খুব সম্ভবত এটা কোনো হাইওয়ে হবে। গাড়ির হেডলাইট ছাড়া অন্য কোনো আলো নেই। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে টাল খাচ্ছে গাড়ি। দুপাশে গহীন অরণ্য, রাস্তা বলতে গেলে খালি। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা গাড়ি চোখে পড়ছে। আমি সবাইকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আশেপাশে পুলিশের গাড়ি থাকলেই পাকড়াও করবে, করলে করুক। নিয়মকানুনের কোনো ধার ধারতে পারছি না এই মুহূর্তে। ছুটে চলেছি শুধু। কোথায় চলেছি কে জানে! হঠাৎ একটা বোকা হরিণ অন্ধকারে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির মুখোমুখি পড়ে গেলো। খুব জোরে ব্রেক কষে থেমে পড়লাম। নিরীহ হরিণটার পায়ের সাথে গাড়ি ধাক্কা খেয়েছে। হরিণটা ছিটকে পড়েছে রাস্তার এক পাশে। গাড়ির হেডলাইটের হলুদ আলোয় আমি রাস্তায় ছিটকে পড়া আহত হরিণের তাজা রক্ত দেখতে পাচ্ছি। আমার কষ্ট হচ্ছে না, ভয়ও হচ্ছে না বরং এক ঘিনঘিনে অনুভূতিতে ক্রমশ গা গুলিয়ে উঠছে। ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাশলাইট অন করে গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। গাড়ির কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা জানি না। চোখের সামনের অন্ধকার জনমানবহীন রাস্তায় আহত হরিণটা তড়পাচ্ছে। আমার হাত পা কাঁপছে, বমি বমি লাগছে। গলা তৃষ্ণায় চৌচির। ভেতর থেকে কে যেন হাঁক ছেড়ে ভর্ৎসনার গলায় ডেকে উঠছে বারবার, খুনি খুনি খুনি! কী আশ্চর্য! আমার মনে হচ্ছে আমি এখন ঠান্ডা মাথায় মানুষও খুন করতে পারব!
সেই রাতটা খুব খারাপ কাটল। রুশমিকে হারানোর ভয় আমাকে অবোধ, বিমূঢ় এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট করে তুলছিল ক্রমেই। আমি পাগলের মতো এই রাস্তা থেকে সেই রাস্তায় নিরুদ্দেশ ছুটে চলেছি। সেদিনই প্রথম এই দিব্যজ্ঞানটুকু লাভ করেছিলাম যে, এই মানবীটিকে ছাড়া আমি বোধহয় কখনোই বাঁচার মতো করে বাঁচতে পারব না। ভালোবাসার কী কল্পনাতীত অপরিসীম শক্তি তাই না? একটা মানুষকে কলের পুতুলের মতো ইশারায় নাচাতে পারে এই ঘাতক অনুভূতি! ভার্জিনিয়ার বাইরে চলে গিয়েছিলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল তখন আবিষ্কার করলাম নিউজার্সি চলে এসেছি। রাস্তার ধারের কোনও সাইনবোর্ড আমি লক্ষ্য করিনি। গাড়ির তেল লোড করতে গিয়ে গ্যাসস্টেশন অ্যাটেনডেন্টস দেখে বুঝলাম এটা নিউজার্সি। এখানে সেলফ সার্ভিস ফুয়েল ফিলিং ইললিগ্যাল। আমেরিকার অন্য কোন রাজ্যে এই সুবিধাটুকু পাওয়া যায় না। নিজের গাড়িতে নিজেকেই ফুয়েল ভরতে হয়।
সকালে আরেকবার রুশমিদের বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ আমার আর অফিস যাওয়া হবে না। কাজ করার মতো শারীরিক অবস্থাও নেই। ভার্জিনিয়া ফিরে আসতে আসতে সকাল দশটা বেজে গেলো। এসে দেখি রুশমিদের বাড়ি তালা দেয়া। কেউ নেই! ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল। সারারাত উপোস কাটিয়েছি। দুর্বলতার দরুন চোখের সামনে সর্ষেফুল দেখছি। সেই বলহীন, কাহিল শরীর নিয়েই রুশমিদের বাড়ির সামনের পোর্চে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা আইকিয়ার চেয়ার টেবিলগুলো লাখি মেরে ফেলে দিলাম। পাতাবাহারের টব শূন্যে তুলে নিয়ে আছড়ে ফেললাম মাটিতে কেনো এসব করলাম জানি না, তবে এই ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পেরে আমার পীড়িত মন কিছুটা হলেও তৃপ্ত হলো। বাড়ি যখন ফিরলাম তখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। গাড়ি পার্ক করে রেখে মচকানো পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সদর দরজার সামনে এসেছি। হঠাৎ দেখি দরজাটা খুলে যাচ্ছে। এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। রুশমির বন্ধু লিও। ওকে দেখামাত্র আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো। এই অসভ্য ছেলেটা রুশমিকে স্পর্শ করেছিল বদ্ধ গাড়ির ভেতর। আমি কিছুই ভুলিনি!
হিংস্র বুনো সিংহটা পায়ে পায়ে হেঁটে এসে বুকের খাঁচার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়, পুরুষোচিত হুংকার ছাড়ে, গর্জন করে বজ্রের ন্যায়! ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাওয়া বুদ্ধিভ্রষ্ট মস্তিষ্ক নিয়ে পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি ছেলেটার ওপর। টুটি চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলি, ‘হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুইং হিয়ার? হোয়াট আর ইউ আপ টু বিচ!’
প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে একরকম টেনে হিঁচড়ে লনের ওপর নিয়ে এসেছি। নিজের কৃতকর্ম আমাকে একটুও লজ্জিত করছে না। আমার এতকালের লালিত পালিত মার্জিত, সভ্য মনুষ্যত্ব হার মেনেছে বিবেকহীন, স্বার্থপর, ভগ্নহৃদয় সত্তার কাছে। আমি নষ্ট হয়ে গেছি, উচ্ছন্নে গেছে আমার কাণ্ডজ্ঞান। ছেলেটা বেশ ভয় পেয়েছে। বড় বড় বাক্যহারা চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। মুখে অতঙ্ক। ঠিক সেই সময় বাড়ির ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। আমি আমার পাগল পাগল ঘোলাদুটি চোখ মেলে দেখলাম রুশমির বান্ধবী স্টেসি বেরিয়ে আসছে দরজা ঠেলে। আর স্টেসির পেছনে অন্ধকারের অথৈ দিকহারা সমুদ্রে একবিন্দু আলোর দিশার মতো ঝলক দিয়ে ভেসে উঠেছে রুশানিয়ার স্ফূরিতাধর মুখখানা। এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলাম। থমকে গেলো আমার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন। নিঃশেষিত, ক্ষয়প্রাপ্ত চেতনাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল। রুশমি বিস্ময়বিমূঢ় মুখে চেয়ে আছে আমার হাতের দিকে। যে হাত দিয়ে আমি লিওর কলার চেপে ধরেছি। ওই ঐশ্বরিক সুন্দর চোখজোড়া এখন জবজব করছে গরল বিদ্বেষে। আমি জানি ওর বন্ধুর সাথে দুর্ব্যবহার করার দরুণ ও আমাকে আগের চাইতেও আরো বেশি ঘৃণা করবে। আমার ভেতরে দুর্মর প্রতাপে জ্বলতে থাকা ক্রোধের স্ফূলিঙ্গটা ওই মুখ দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে ভস করে নিভে গেছে। আমি লিওর কলার ছেড়ে দিয়ে অপরাধী চোখে তাকিয়েছি এখন রুশমির দিকে। ও আমার দশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা হালকা হলুদ রংয়ের সালওয়ার কামিজ। এলোমেলো খোলা চুল। রাগ, বিস্ময় আর উদ্বেগের প্রাবল্যে মুখটা একটুখানি হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি বন্ধুকে হেনস্থা করার অপরাধ ও খুব সহজে ক্ষমা করবে না। আমার ভাগ্যটা এমন কেনো? সারারাত ভেবেছি ওর সাথে দেখা হলে এটা বলব, সেটা বলব, অথচ এখন এত কাঠখড় পুড়িয়ে যাও অবশেষে দেখা হলো, নিজেরই বোকামির বশে সব হারাতে হলো।
আমি মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছি। প্যাটিওতে সোনালী রংয়ের রোদ থইথই করছিল। একটা পলকা বাতাস রুশমির খোলা আলুথালু চুলগুলি উড়াচ্ছিল ধীর লয়ে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রুশমি, লিও, স্টেসি এরা প্রত্যেকে আমার মুখের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। আমি যেন চিড়িয়াখানার জন্তু। টিকেট কেটে আমাকে দেখতে এসেছে ওরা। নিজেকেই নিজের খুব ঘেন্না হচ্ছে এই মুহূর্তে। ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর দুর্বল বোধ করছি। একটা অপরাধবোধ কাঁটার মতো বিঁধে আছে মনে। একটু আগের অমার্জিত, কুরুচিপূর্ণ আচরণের জন্য মনে মনে ভীষণভাবে লজ্জিত! কী দরকার ছিল ছেলেটার সাথে অযথা অমন অভদ্র ব্যবহার করার? আমার তো শুধু রুশানিয়াকে প্রয়োজন ছিল। একটা বার শুধু ওর চোখে চেয়ে বলতে চেয়েছিলাম ওকে আমার কতটা চাই! এখন তো বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। ও আমার আর কোনো কথাই শুনতে চাইবে না। উল্টো ভুল বুঝবে। শারীরিক ক্লান্তি, স্নায়বিক দুর্বলতা এবং মানসিক উত্তেজনা আমাকে মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। অনেক কষ্টে গলা দিয়ে ঠেলেঠুলে আমতা আমতা করে কয়েকটা শব্দ বের করলাম, ‘আমি স্যরি, আসলে কী করছিলাম, কেনো করছিলাম নিজেও … ‘
ঠিক সেই সময় খুব অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটল। রুশমি হঠাৎ দৌড়ে ছুটে এসে ওর বন্ধুদের সামনেই দু হাত বাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর একটি দৃঢ়, নিমগ্ন এবং দীর্ঘ চুমু খেয়ে ফেলল ঠোঁটে। আমার স্তম্ভিত হৃৎপিণ্ড দম নিতে ভুলে গেলো সেকেন্ডের জন্য। অনন্তকাল থমকে গেলো সেই মুহূর্তটির মাঝে। শার্সি ফাটার মতো ঝনঝন করে এতক্ষণের জমাট বাঁধা বিষণ্ণতার কাচগুলো ভেঙে পড়তে লাগল চতুর্দিকে। রুশানিয়ার গোলাপের পাঁপড়ির মতো নমনীয় দুটি ঠোঁট চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকল আমার শুষ্ক, মলিন দুটি ঠোঁটের পরে। এক সর্বনাশা সুখ শিরা উপশিরা বিদীর্ণ করে বিদ্যুতের মতো প্রবাহিত হতে থাকল রক্তের স্রোতে! একটা সময় রুশমি আমার বুকের ওপর মাথা রাখল আলতোভাবে। প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে শিহাব!’
আমার মনে পড়ল, আজকে আমার জন্মদিন…’ আর হ্যাঁ, ওটা ছিল আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর জন্মদিন!