রুশমি
মাঝে মাঝে ওর কথা শুনে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না। কথা তো খুব বেশি হয় না আমাদের। অল্প বিস্তর যা হয়, তার মধ্যেই কিছু উক্তি হঠাৎ হঠাৎ আমার মনে ছাপ ফেলে দেয়। ওর কথায় মাত্রাতিরিক্ত জ্ঞানের গাম্ভীর্য নেই, আঁতেল পনাও নেই বরং একটা ধারযুক্ত স্বচ্ছতা এবং অকপট ভাব আছে। এই সাবলীল অকপট কথা শুনলে কেউ টের পাবে না যে মানুষটা চরিত্রগত ভাবে অন্তর্মুখী। একটু আগে ও বলল, আমার যা ভালো লাগে, যা আমার প্রিয়, তা আমি আমার করেই রাখতে চাই সারাজীবন। ত্যাগের মহিমার কাছে নিজের সুখটুকু বিক্রি করতে চাই না।
কথাটা ভালো লেগেছে। ওই কথার ছাপ পড়ে গেছে আমার মনের মধ্যে। আমিও এখন আকুল হয়ে ভাবছি, যা আমার প্রিয়, যা আমার ভালোলাগার তা নিজের করে চাওয়ার মধ্যে আসলে লজ্জার কিছু নেই। আর কতদিন ধোঁকা দেব নিজেকে? একবার নাহয় প্রস্তাব দিয়ে দেখি যে এই নামমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ককে একটি বাস্তবরূপ দেবার চেষ্টা করা যায় কিনা? কিন্তু সেই প্রস্তাব যদি সে নাকচ করে দেয় তখন কোন নদীতে গিয়ে ডুববো শুনি? নিজের কাছেই নিজের মুখ দেখানোর জো থাকবে না। তাছাড়া ও তো ভালোবাসে অন্য একজনকে। এটা জানার পরেও কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো বিয়ে টিকিয়ে রাখার আবদার করা কি বিবেচক মানুষের কাজ হবে?
শিহাব নিচে নেমে গেছে। আমি অন্ধকারে বসে আছি আর নানামুখী দুর্ভাবনা আমার মস্তিষ্কে ক্রমে ক্রমে এক অভেদ্য জট পাকিয়ে তুলছে। এমন সময় আম্মুজান ফোন করে জানালো আগামী সপ্তাহে ফুপি আসছে নিউইয়র্ক থেকে। ফুপির আগমনের সংবাদ বাবাজান ছাড়া আমাদের পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকেই কখনো আনন্দ দেয় না। এবারেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। আমার খারাপ হওয়া মনটা এই খবর শুনে আনন্দিত হবার বদলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেলো। আম্মুজান বলল ফুপি নাকি এই যাত্রায় আমার শ্বশুরবাড়ি আসতে চায়। নিজ চোখে দেখতে চায় আমার সংসার। অতএব ফুপিকে সর্বাত্মক আপ্যায়ন করার প্রস্তুতি আমার এখন থেকেই নেয়া শুরু করা উচিত। তার আপ্যায়নে কোন রকম ঘাটতি হলে বাবাজান কষ্ট পাবে। অথচ এ সংসারে আমার নিজের অবস্থানই এখনো পাকাপোক্ত নয়। এমতাবস্থায় অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি নেয়া আমার জন্য কোনভাবেই আনন্দের কিংবা স্বস্তির হবে না। আমার ফুপি অত্যন্ত খুঁতখুঁতে এবং নাকউঁচু স্বভাবের মহিলা। পৃথিবীতে একমাত্র তার নিজ পুত্র এবং রক্ত সম্পর্কের ভাইটি ছাড়া অন্য সব মানুষের মধ্যে সে কারণে অকারণে ত্রুটি খুঁজে পায়। এখানে এসে কত রকমের দোষ ধরবে আল্লাহ জানে! নানারকম দুশ্চিন্তা আমার মনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে এখন। ভাবছি দুদিন পরে যখন বিয়েটা আমার ভেঙে যাবে তখন এসব সো কল্ড আত্মীয় স্বজনদের মুখ দেখাবো কী করে? ডিভোর্স বিষয়টাকে এরা কেউ সাদা চোখে দেখতে পারে না। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে থাকা মানুষগুলোর কাছে আশ্চর্যজনকভাবে ‘ডিভোর্স’ এখনও ভয়ংকর রকমের কোন দুর্ঘটনা। অথচ সবার জীবনে তো এক চান্সে লটারি জেতা সম্ভব না। কারো কারো একাধিক বার সুযোগ নেবার প্রয়োজন বা তাগিদ থাকতেই পারে। জীবনের বিচিত্র সব বাস্তবতাকে সহজ ভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতাই হলো আধুনিকতা। যত্রতত্র বিস্ময় প্রকাশ করে বেড়ানো আধুনিকতার লক্ষণ নয়। যারা করে, তারা মন মানসিকতায় এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এই যেমন বছর দেড়েক আগে আমাদের কফিশপে একটি তরুণী মেয়ে কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। মেয়েটি সদ্য বাংলাদেশ থেকে এসেছে। তো আমাদের এক প্রতিবেশী আপু প্রায় উইকেন্ডেই কফিশপে চলে আসত আড্ডা দিতে। আপুর নাম সিনথিয়া। ওর তখনও বিয়ে হয়নি। বয়স তিরিশের আগে পিছে। মেডিকেল স্কুলে যায়। তার পরিবার বেশ মুক্তমনা বিয়ের জন্য কোন প্রকার চাপ নেই। এক বিকেলে নতুন মেয়েটির সাথে আপুর পরিচয় হলো। কথায় কথায় মেয়েটি সিনথিয়া আপুর কাছে জানতে চাইল, ‘আপনার হাজবেন্ড কী করে?’
—‘আমি তো এখনো বিয়ে করিনি।’ আপুর উত্তর।
মেয়েটির চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেলো।
—‘এখনো বিয়ে হয়নায় আপনার? হায় আল্লাহ!’
আপু থমকে গেছে। আমি বিব্রত বোধ করছি। আম্মুজান কাউন্টারে কাজ করতে করতে বাঁকা চোখে দৃশ্যটা দেখছে। মেয়েটি কিছুক্ষণ বিস্ময় সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার পর বলল ‘কেনো আপু? বিয়ে করেন না কেনো?’
আপুর মুখটা অপমানে এতটুকু হয়ে গেছে। বেচারি কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। তিরিশ বছর বয়সী একটি মেয়ের বিয়ে না করাটা যেন কোন বড় ধরণের অপরাধ। আম্মুজান এগিয়ে এসে বলল, ‘ও ডাক্তারি পড়ছে তো, পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করবে না। এই দেশে ডাক্তার হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়াও অন্য যেকোন কারণে বা প্রয়োজনে মানুষ অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। এসব বিষয় নিয়ে ওভার রিঅ্যাক্ট করাটা উচিত কাজ নয়। বুঝলে?’ মেয়েটি কী বুঝল বিধাতাই জানে। কোনও প্রত্যুত্তর না করে ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে রইল আম্মুজানের দিকে।
ঘুম এসে গিয়েছিল। পেটে খিদে। সেই সাথে চিনচিনে ব্যথা আর মুখে অরুচি। মাঝরাতে দরজায় টোকা পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। জাহিদ এসেছে। আমার নাকি একবার নিচে নামতে হবে। অথচ এই মুহূর্তে নিচে যেতে একটা ফোঁটা ইচ্ছে করছে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও জাহিদের মন রক্ষার্থে নিচে নেমে আসতে হলো। মন ভয়ংকর খারাপ। আমি জানি সাশাকে ঈর্ষা করা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু না চাইতেও এক দুর্দমনীয় ঈর্ষাবোধ আমাকে ভেতরে ভেতরে হিংস্র করে তুলছে। এই হিংস্রতা এতো তীব্র যে, মেয়েটার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাচ্ছি না পর্যন্ত। কী বোকা ছিলাম আমি, তাই না? মেয়েটা খুব সম্ভবত এখনো জানে না একটু পরে তার সারপ্রাইজ বার্থডে পার্টি হবে। কী করে তাকে এই বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে সেই খবর আমি রাখিনি। রাখতে চাইও না। ওকে ঘিরে আমার বর এবং দেবরের আকাশচুম্বী আদিখ্যেতা কোনভাবেই সহ্য হচ্ছে না। শিহাবের বন্ধুরা এখনো উপস্থিত আছে। এদের কারো সাথেই আমার এর আগে পরিচয় হয়নি। আজকে পরিচিত হবার পর বোঝা গেলো এরা সকলেই বেশ আন্তরিক এবং মিশুক প্রকৃতির ছেলে। আমার সাথে গল্প করতে চাইছে, আড্ডা দিতে চাইছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার আজকে আড্ডায় মন নেই। আমি ড্রইং রুমের কর্নারের সোফায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছি। কয়েক হাত দূরে শিহাব আর সাশা পাশাপাশি বসেছে। এই সাশা আমার সাথে আজ অবধি একটা কথা বলেনি নিজ থেকে। অথচ দ্যাখো, আমার বরের গা ঘেঁষে কেমন নিশ্চিন্তে বসে আছে। মন চাচ্ছে বেয়াদব মেয়েটাকে… ধ্যাত্তেরিকা! রাগটা আমি কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছি না!
রাত বারোটা প্রায় বেজে গেছে। সাশাকে অন্ধকার ডাইনিং হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি ড্রইং রুমে একলা বসে আছি। পাশের ঘরে যাবার তাগিদ অনুভব করছি না। শিহাবের বন্ধুরা আমাকে ডেকেছে। ডেকেছে জাহিদও। আমি সাড়া দেইনি। মিনিট না গড়াতেই কান ফাটানো হইচই কানে এসে লাগল। সবাই উল্লাস করছে, বার্থডের গান গাইছে, হাততালি দিচ্ছে। ওই উল্লাস আমার বুকের মধ্যে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। এমন বাজে জায়গায় আর একটা মুহূর্তও থাকতে মন চাইছে না।
কেক কাটা হয়ে গেলে অতিথিদের অনেকেই ড্রইংরুমে এসে বসল। বাইরে থেকে খাবার আনানো হয়েছে। শিহাবের বন্ধুরা সাথে করে হুইস্কির বোতলও নিয়ে এসেছে। বোতল খুলে মদ্যপান করা হচ্ছে এখন। আমি জায়গাটা থেকে নিঃশব্দে সরে পড়লাম। ডাইনিং এ এসে দেখি সাশা আর জাহিদের জামা কাপড়, মুখমন্ডল কেক দিয়ে মাখামাখি হয়ে গেছে। শিহাব কিচেনের সিংক এর সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছে। এর মানে তার মুখেও কেক মাখামাখি হয়েছিল। আমি দৃশ্যটা দূর থেকে দেখে প্রস্থানোদ্যত হলাম। এখানে আমার আর থেকে কাজ নেই। ওরা ওদের মতো এনজয় করুক। পা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। পেছন থেকে ডাক ছুটে এলো।
—‘রুশানিয়া!’
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। শিহাব কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল,
—‘সাশাকে উইশ করেছ?’
—‘তোমার সাশার সাথে আমার এখন পর্যন্ত ঠিকমতো পরিচয়ই হয়নি!’
—‘বলো কী!’
সাশাকে আড়চোখে দেখলাম একবার। কানে হিয়ারিং এইড লাগানো। এর মানে আমাকে শুনতে পেয়েছে সে। কিন্তু বাংলা বোঝার কথা না। তাই নির্বোধের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
শিহাব খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘সাশা, তোমার কি আমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয়েছে?’
সাশা হা করে তাকিয়েই আছে। কিছু বলছে না। ওর ফাঁকা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে হলদে দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে। সারামুখে একটা বোকা বোকা ভাব। শিহাব এখন ডান হাত আমার কাঁধের ওপর রেখেছে। কী আশ্চর্য! ওই একটুখানি স্পর্শ আমার হৃৎপিণ্ডে কেমন কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আমি নিঃশ্বাসের সাথে ওর দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছি। মনটা অদ্ভুত রকমের দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। সাশাকেই যদি ও ভালোবাসে তবে আমাকে এতো কায়দা করে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কারণ কী? আমার কি হিসাবে কোথাও গোলমাল হচ্ছে? স্বচ্ছভাবে কিছুই চিন্তা করতে পারছি না কেনো? চোখের সামনে অরা (Aura) দেখতে পাচ্ছি। লাল, নীল, হলুদ রংয়ের সর্ষেফুল ভাসছে হাওয়ায়। শরীর অতিশয় দুর্বল। মস্তিষ্ক বুদ্ধিভ্রষ্ট। চোখের সম্মুখে জ্বলতে থাকা লাল নীল তারার ভেতর দিয়ে দেখলাম সাশা ওর নিজস্ব ভাষায় হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে। শিহাব কী বুঝেছে জানি না কিন্তু ওর মুখটা একটু লালচে হয়ে উঠেছে। চোখে লজ্জাজড়িত হাসি।
—‘মেয়েটা কী বলছে?’ আমার প্রশ্ন।
শিহাব সাশাকে বলল, ‘তুমি এইমাত্র যা বললে, তা লিখে দিতে পারো কি?
সাশা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে পকেট থেকে সেলফোন বের করে টাইপ করল। শিহাবের মোবাইলে টুং করে একটা বাজনা বাজিয়ে নিমেষেই উপস্থিত হলো বার্তাটা। শিহাব ফোন উঁচু করে ধরল আমার সামনে। সাশা লিখেছে, ‘ইউ গাইজ আর মেড ফর ইচ আদার। মে গড ব্লেস ইওর ম্যারেজ। উইশ ইউ আ ভেরি হ্যাপি কনজুগ্যাল লাইফ।’
লাইনগুলো বিড়বিড় করে পড়ছি আমি। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। শিহাবের দিকে চেয়ে দেখি ওর ঠোঁটে হাসি, চোখে হাসি। আমার বুক ভর্তি হয়ে আছে বিভ্রম, দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে। সবকিছু তেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সাশা আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কাঁপা হাতে ওর হাত ধরেছি। আমরা কেউ কিছু বলছি না। শুধু হাত ঝাঁকাচ্ছি নীরবে। ওকে যে একবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো উচিত সেটাও আমার দুর্বল মস্তিষ্ক বেমালুম ভুলে গেছে। এই ছিল সাশার সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের দিন! কে জানত এই মেয়েটা একদিন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুতে পরিণত হবে! শিহাব ওকে কতটা ভালোবাসে জানি না। কিন্তু আমি, আমি ওই সবুজ চোখের বোকাটে চেহারার অসম্ভব ভালো মনের মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি!
সেই রাতে অতিথিরা বিদায় নেবার পর আমি যথারীতি ড্রয়িং রুমের সোফায় শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে। দরজায় কার যেন ছায়া পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে শিহাবকে দেখলাম।
—‘আসব?
—‘হুম, এসো।’
সিলিং এ ঝুলতে থাকা ঝাড়বাতির ঝলমলে আলোয় ওকে সুন্দর দেখাচ্ছে। অফ হোয়াইট টিশার্ট, কালো ট্রাউজার। গালে অবহেলার গুড়িগুড়ি দাড়ি। ছোট ছাটের চুলগুলি কপালের কাছটায় একটু এলোমেলো হয়ে আছে। দুই ঠোঁটের প্রান্তিক কোণে গম্ভীর কুঞ্চন। দেখলে বোঝা যায়, নিবিড় কোনও ভাবনা ভাবছেন মহারাজ!
—‘তুমি এখানে ঘুমাবে?’ উল্টোদিকের সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে ও। আমি ভাবছি একটা মানুষ এতো নিখুঁত কী করে হয়? ও কি আসলেই এতটা সুন্দর? নাকি আমার চোখের ভ্রম? বড় একটা নিশ্বাস পড়ে বুক চিরে। কিছুই জানে না আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগল মস্তিষ্ক! আমি এক ‘না জানা’র অন্তহীন, অথৈ, সাগরে ভেসে চলেছি অনবরত।
—‘এখানেই তো ঘুমাই।’
—‘কেনো?’
— ‘ইচ্ছা।’
—গেস্টরুমে ঘুমালেই তো পার।’
আমি চুপ করে আছি। শিহাব সোফার পিঠে নিজের পিঠ এলিয়ে দিয়েছে। চিবুক উঁচু। চোখ সরু। গলার চামড়ায় ভাসমান কণ্ঠমণি।
—‘সোফায় ঘুমাতে তোমার কষ্ট হয় না?’ একটু গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে ও। –’হয়’ কেনো বললাম কথাটা কে জানে! বলার পর নিজেই কেমন বেকুব বনে গেছি। চোখ নামিয়ে নিয়েছি নিচে। কার্পেটের দিকে
—‘কেনো শুধু শুধু এতো কষ্ট করছ?’
—‘জানি না!’
—‘ম্যাক্সিমাম প্রশ্নের উত্তর কেনো জানি না হয় বলতে পার?’
—‘পারি না!’
এ কথার পর ও চুপ করে গেলো। সরু আর তীব্র চোখে পা নাচাতে নাচাতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবতে লাগল গভীর ভাবে। ওর চোখের দৃষ্টি আমার ঠোঁটের নিচের কালো তিলের ওপর থমকে গেছে। আমার অস্বস্তি লাগছে, লজ্জা লাগছে আবার প্রচন্ড ভালোও লাগছে!
—‘কী ভাবছ?’ হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করে বসলাম।
শুনে ও হাসলো। অসহ্য হাসিটা।
—‘কী ভাবছি বলব?’ গলায় রহস্যের সুর টেনে প্রশ্ন করে সে।
—‘নিশ্চয়ই।’
—‘তুমি রেগে যেতে পারো।’
—‘কেনো?’ আমি ভীষণ অবাক।
—‘তোমার যে কথায় কথায় রেগে যাওয়া অভ্যাস!’
—‘রেগে যাওয়ার মতো কিছু বললে তো রাগবোই!’
—‘হুম, তাহলে থাক।’
—‘না থাকবে কেনো? বলো!’
—‘তুমি সত্যিই শুনতে চাও?’ —চাই!’
ও একটু সময় গভীরভাবে আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকে। ঠোঁটের কোণে কুঞ্চন ফেলে কী যেন ভাবে। বাদামী চোখের তারায় লজ্জাজড়িত হাসির আভাস পড়ে। তারপর অনেকটা নিস্তরঙ্গ গলায় বলে,
—‘তোমার বুকে একটা কালো তিল আছে। তুমি নিশ্চয়ই জানো?’ আমি থ’ বনে গেছি। চমক লাগা বড় চোখে তাকিয়েছি ওর দিকে।
—‘তুমি কী করে জানলে?’
ও কাঁধ ঝাঁকায়, ‘জানি…’
আমার কান এখন ঝাঁঝাঁ করছে। রাগে আর অপমানে শক্ত হয়ে এসেছে মন। অনেক কষ্টে প্রশ্ন করলাম,
—‘হ্যাঁ আছে তো কী হয়েছে?’
শিহাব অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অদ্ভুত গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তিলটা এখন আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!’
শিহাব
এরকম কিছু একটা ঘটবে বলেই আশংকা হচ্ছিল মনে মনে। আমার সহজ সরল গোপন মনস্কামনার কথা শোনামাত্র আমার বৌ ভস করে জ্বলে উঠে রণরঙ্গিণী মূর্তি ধারণ করবে এ বিষয়ে মোটামুটি সুনিশ্চিত ছিলাম। সব জেনেশুনেও কেনো যে বুকটা হঠাৎ অমন দুর্জয় সাহসে ভরে উঠেছিল তা একমাত্র আল্লাহ জানে! বিচার বিবেচনা না করে বেকুবের মতো কথাটা বলে বসলাম। এবার সামলাও ঠ্যালা শিহাব রেজা! এই মেয়ে আজকে তোমার বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়ে তবেই ছাড়বে। কিন্তু সে নিজেই তো আমাকে সাহসটুকু দিয়েছিল তাই না? আমি তো ওকে সতর্ক করেছিলাম যে কথাটা ওর রাগের কারণ হতে পারে। কিন্তু ও রাগবে না বলে অভয় দিয়েছে এবং কথাটা সে শুনতে চায় এরকম স্পৃহাও জ্ঞাপন করেছে। অথচ কী কান্ড! এখন চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পারলে তেড়ে আসে আমাকে মারতে।
এই মুহূর্তে ভীষণ বিপন্ন বোধ করছি। মনের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে এসেছে। যে অপমানের ভয়ে কখনো কিছু মুখ ফুটে বলতে পারিনি, সেই বিশ্রী রকমের অসহনীয় অপমানটা আজ আরো একবার আমার ভাগ্যে না চাইতে জুটে গেলো। ও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। সারা পিঠ আচ্ছন্ন করে কোমর পর্যন্ত ছেয়ে আছে নিবিড় কালো চুল। পরনে স্লিপিং স্যুট। সাদা ঢোলা শার্ট, ঢোলা প্যান্ট। বুকের কাছে অসাবধনতা বশত দুটা বোতাম খোলা। ওখানে একটা স্বর্ণের চেইন ঝুলছে। ওই জন্মকাজল আঁকা সুন্দর দুটি চোখের ভেতর এখন ফুটন্ত পানির মতো রাগ ফুটছে টগবগ করে। নোজপিন পরা নাকের পাটা ফুলে ঢোল।
—‘কী বললে তুমি?’ কোমরে হাত রেখে ঝগড়াটে গলায় প্রশ্ন করে রুশমি আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কিছুটা রাশভারী গলায় বললাম, ‘এতো ওভার রিঅ্যাকট করার মতো কিছু বলিনি। যাই হোক, রাত হয়েছে অনেক শুয়ে পড়ো। আমার কাজ আছে।’
রুশমির গলার স্বর আরো একধাপ উঁচুতে উঠে গেলো, ‘ওভার রিঅ্যাকট করছি আমি তাই না? তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলেদেরকে কী করা উচিত জানো? জুতা পেটা করা উচিত!’
শেষ কথাটা বিষধর তীরের মতো এসে বিঁধলো কানের পর্দায়।
—‘আমি ক্যারেক্টারলেস?’ বিস্মিত, আহত এবং বিব্ধস্ত গলায় প্রশ্ন করলাম।
—‘ক্যারেক্টারলেস, বাজে আর অসভ্য একটা মানুষ তুমি!’
কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর সুন্দর দুটি পাতলা ঠোঁট ঘেন্নায় বেঁকে গেলো। আর ওই ঠোঁট বাঁকানো দেখে ভীষণভাবে কুঁকড়ে গেলো আমার মন। মেজাজটাও টং করে চড়ে গেলো সপ্তমে।
—‘বাড়াবাড়ি করো না রুশমি!’ হিমশীতল গলায় সতর্ক বাণী আওড়ালাম।
—‘তোমার দিকে এ মুহূর্তে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। প্লিজ চলে যাও এখান থেকে। ভবিষ্যতে এধরণের কথা কোনো মেয়েকে বলার আগে একশোবার ভেবে নেবে।’
রক্তে অ্যালকোহোল মিশে আছে। অল্পবিস্তর মদ্যপান করেছি বন্ধুদের সাথে। খুব পরিষ্কারভাবে কিছু চিন্তা করার মতো পর্যায়ে আমার মস্তিষ্ক এখন নেই। স্নায়ু টানটান। প্রতিটা ইমোশন সূক্ষ্মভাবে জাগ্রত। রুশমির কথাগুলো আমার এলোমেলো মাতাল বুকে বন্দুকের তীক্ষ্ণমুখ ছররার মতো বর্ষিত হচ্ছিল। অদৃশ্য এক রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সেখানে। পৃথিবীটা অর্থহীন লাগছে। আমার সামনে আশ্চর্য সুন্দর পরীর মতো এক নেশা জাগানিয়া মেয়ে, যে মেয়ে কিনা ধর্মত আমার স্ত্রী। কিন্তু আমার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে দেখা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, ভালো লাগে এই কথাটাও মুখ ফুটে বলা যাবে না। এসব কতক্ষণ সহ্য হয়? মানে সিরিয়াসলি! সবকিছুর একটা সীমা থাকা চাই!
—‘দুনিয়ার সবকটা মেয়েকে গিয়ে বলব। যা ইচ্ছে তা বলব! তোমার কী?’ রুশমি এবার মনে হয় একটু থমকে গেছে। আমার রাগটা এখন আর ঠিক নিয়ন্ত্রণে নেই। মাথায় আগুন, চোখের সামনেটা ঝাপসা, রক্তে ঝিমঝিম ভাব।
—‘ছিঃ কী বাজে! যাও যাও পৃথিবীর সব মেয়েদের গিয়ে এসব বাজে কথা বলো। শুধু আমাকে বলতে এসো না।’
—‘কেনো বলব না? একশোবার বলব!’
— ‘কী?’
—‘কী আবার? শুনতে পাওনি?’
–’এতো সাহস তোমার?’ চোখ মুখ খিঁচিয়ে প্রশ্ন করে ও।
—‘হ্যাঁ, এতই সাহস আমার। তুমি আমার বৌ। তোমার সাথে যা ইচ্ছে করতে পারি, যা ইচ্ছে!’
রুশমি দাঁত কিড়মিড় করে বলে-’মোটেও না, কোনোদিন ও না…’
—‘দেখতে চাও?’ কথাটা বলে ওর দিকে দু পা এগিয়ে গেলাম। দুজনের মধ্যিখানে সেন্টার টেবিলটা বাধ সেধেছে। আমি টেবিলের একদম কাছাকাছি চলে এসেছি। ঠিক সেই সময় রুশমি একটা কাণ্ড করল। টেবিলের ওপর আধখাওয়া একটা জলের গ্লাস রাখা ছিল। ও চকিতে গ্লাসের ভেতরের তরলটুকু ছুঁড়ে মারল আমার মুখে।
রুশমি
এই ছেলের আজকে কী হয়েছে জানি না। এতটা একরোখা আর জেদি ওকে এর আগে কখনো দেখিনি। ওই কথাটা শোনার পর আমার সারা গা রাগে একদম রি-রি করে উঠেছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এতো সুন্দর দেখতে একটা মানুষ এহেন কুৎসিত কথা বলতে পারে। দুনিয়ার সকল পুরুষমানুষই কি তবে শরীর সর্বস্ব? মন বলে কিছু নেই এদের? এমন বিশ্ৰী একটা কথাই কেনো বলতে হলো তার? মার্জিত কিছুও তো বলতে পারত, শোভন কিছু বলতে পারত। কতই না ভালো হতো যদি সে মুখ ফুটে আমার একটু প্রশংসা করত। কিংবা হাত ধরে বলতো, ‘দোতলায় চলো, আমাদের ঘরে। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না।’
না, সেইসব রোমান্টিকতার বালাই তো নেই-ই, বরং আছে যতসব ইতর আর লুচ্চা শ্রেণীর মনোভাব। রাগে আর অপমানে আমার মাথায় একদম আগুন ধরে গিয়েছিল। তাই শুনিয়ে দিয়েছি দু চার কথা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ডোজ একটু মাত্রাতিরিক্ত পড়ে গেছে। মহাশয় ক্ষেপেছে এখন। দুর্ব্যবহার করছে আমার সাথে অবলীলায়। এতটা রূঢ়ভাবে কথা বলতে ওকে এই প্রথম দেখলাম। বলে কিনা পৃথিবীর সব মেয়েদের নাকি সে আজেবাজে কথা বলে বেড়াবে। কী সাংঘাতিক! আমিও বলে দিয়েছি, যা ইচ্ছা করুক। শুধু আমার সাথে যেন এসব ফালতু কথা বলতে না আসে। শুনে আগুন রঙের চোখ বানিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছে,
—‘একশোবার বলব!’
—‘কী?’
—‘কী আবার? শুনতে পাওনি?’
—‘এতো সাহস তোমার?’
—‘হ্যাঁ, এতই সাহস আমার। তুমি আমার বৌ। তোমার সাথে যা ইচ্ছে করতে পারি আমি।’
—‘মোটেও না, কোনোদিন ও না…’
—‘দেখতে চাও?’
তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্নটা করে ও আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওই খ্যাপাটে রূপ দেখে হৃৎপিণ্ডে আমার রক্ত চিলিক দিয়ে উঠেছে। ভাবনা চিন্তা কিছু না করেই টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটা তুলে চট করে পানি ছুঁড়ে মারলাম ওর দিকে। পানির ঝাপটায় ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, চোখ বুজে ফেলেছে, কপালে ফুটে উঠেছে অনভিপ্রেত কুঞ্চন। কাকভেজা হয়ে গেছে সারা মাথা। কয়েকটা সেকেন্ড ওরকম অবস্থায় চোখ মুখ খিঁচে প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল ধারালো নিষ্ঠুরতা। একটা সময় চোখ দুটো প্রসারিত হলো। ঠিকরে বেরোলো তেজ। আমি ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার বুক কাঁপছে তীরন্দাজ শিকারির কবলে পড়া পলায়নরত ভীত হরিণীর মতো। কম্পমান বক্ষ নিয়ে দেখতে পেলাম শিহাব সেন্টার টেবিলটা পাশ কাটিয়ে বুনো ষাঁড়ের মতো তেড়েমেড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার মুখ দিয়ে ভয়ে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না। চিৎকার করার শক্তিও নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও শূন্যে তুলে ফেলল আমাকে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলতে লাগল, ‘তোমার সাহস বেশি বেড়ে গেছে তাই না? স্যরি বলো এক্ষুনি। নইলে খবর আছে আজকে।’
আমি অনেক কষ্টে এবার মুখ খুলতে পেরেছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছি, ‘অ্যাই স্টুপিডহেড অসভ্য ছেলে! ছাড়ো আমাকে! অ্যাসহোল! বিচ!’ সেসব দিনের কথা লিখতে গিয়ে আমার মন কেমন করছে! বহমান সময়কে যথার্থ মূল্যায়ন না করাটা মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। ফেলে আসা সময় যখন স্মৃতির আকাশে তারা হয়ে জ্বলে ওঠে, ঠিক তখনই আমরা তার দীপ্তি বা জেল্লাটা টের পাই। সময় থাকতে সময়ের মূল্য বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। সেদিন ওর কোলের মধ্যে বন্দি অবস্থায় ছটফট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলাম, আর্তনাদ করছিলাম, এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মেরে আঘাত করছিলাম ওর বুকের ওপর। অথচ আজ এতদিন পর এসে আমি ওই কপট রাগের পেছনের চালচিত্রটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সেদিন যা ছিল লুকায়িত এবং ঝাপসা। আজকে তা প্রকট ভাবে দৃশ্যমান। অনেক চেষ্টা করেও ওই বাজে, অসভ্য, পাগলাটে ছেলেটাকে আমি ঘৃণা করতে পারছিলাম না। বরং ওই জেদ এবং একগুঁয়েমি ওর প্রতি আমার আসক্তিটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আজকে লিখতে গিয়ে কেনো যেন বুক খালি হয়ে আসছে। দক্ষিণা বাতাসে ভেসে আসা বুনো ফুলের পাঁপড়ির মতো সুন্দর একেকটা দিন ছিল। আহা আমার সারাটা জীবন ওই পনের সালের এপ্রিল মাসে আটকে যাক। সময় থমকে যাক ম্যাগনোলিয়ার গালিচা পাতা হলুদ বসন্তে! সমস্ত সত্তা একযোগে প্রবিষ্ট হোক প্রথম প্রেমের উত্তাল দিনগুলোতে!
সিঁড়ি অন্ধকার। ওপরে জাহিদের ঘরের দরজাটা আধখোলা। ওই ঘর থেকে এক টুকরো ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে দোতলার হলওয়েতে। আমি হাত পা ছুঁড়ে চিৎকাররত অবস্থায়ই লক্ষ্য করলাম জাহিদ আস্তে করে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। হইচই শুনে ভড়কে গেছে বোধহয় বেচারা। শিহাব ছোট ভাইকে একটা কর্কশ ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল, ‘এখানে কী করছ? ঘরে যাও!’
জাহিদ ধমক খেয়ে পড়িমরি করে পালিয়ে বাঁচল। আমি শিহাবের টি- শার্টের গলা খামচে ধরেছি। ভাবছি হাতে একটা জোর কামড় বসিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। আচ্ছা একটা শিক্ষা হতো শয়তানটার।
শিহাব বেডরুমে ঢুকতে ঢুকতে গর্জন তুলে বলল, ‘তুমি স্যরি বলো রুশমি বিনতে হায়দার! নইলে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।’
আমিও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই স্যরি বলব না। হাত পা নেড়ে প্ৰতিবাদ করে যাচ্ছি সমানে, ‘ছাড়ো আমাকে!’
বাথরুমের দরজা খুলেছে ও। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলছে, ‘আমার গায়ে পানি ছুঁড়ে মারো! এতো সাহস তোমার। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!’
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আমি নিজেকে বাথটাবের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। হ্যান্ডহেল্ড শাওয়ারহেড শিহাবের হাতে উঠে গেছে তখন। পরমুহূর্তেই জলপ্রপাতের মতো দুর্দান্ত স্রোতধারায় সারা গা ডুবে যেতে লাগল। কনকনে শীতে শিউরে উঠল হাত পা। পানির আক্রমনে চোখ মুখ খোলা রাখা দায়। ঝরঝর শব্দে সয়লাব হয়ে উঠেছে চারপাশ। শাওয়ার কার্টেইন টানা হয়নি বলে পানি বাথটাবের বাইরের মেঝেতেও ছিটকে পড়ছে। চিৎকার করতে গিয়ে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে আমার। জল ঢুকে যাচ্ছে নাকের ছিদ্রপথে। নিশ্বাস নেয়া দায়। সেই নাস্তানাবুদ অবস্থায় অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে ওকে আঘাত করার চেষ্টা করছি। নাগাল পাচ্ছি না। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তি লেগে গেলো। আমি ওর হাত থেকে শাওয়ার হেড কেড়ে নিতে চাইলাম প্রাণপণে। কিন্তু অমন লম্বা চওড়া ষণ্ডা যুবকের সাথে শক্তিতে পারা যায় নাকি? আর সে তো বড় হয়েছে শুধু গায়ে গতরে। ভেতরটা ছেলেমানুষি একগুঁয়েমিতে ভরা। লড়তে লড়তে একটা সময় আমার পেট ব্যথাটা জানান দিয়ে উঠল। ওর হাতে শাওয়ার হেড ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। ঝর্ণার ফ্লো কমে এলো আস্তে আস্তে। ভেজা চোখের পাঁপড়ি তুলে দেখলাম ওর ঠোঁটে রাজ্য জয়ের হাসি। ভঙ্গিটা এমন, ‘শিক্ষা হয়েছে? আর কখনো লড়তে আসবে আমার সাথে?’
এদিকে পরাজয়ের গ্লানিতে আমার বুক ভরে গেছে। মনে মনে প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ আমাকে এতো বেশি শক্তিশালী করে দাও যেন এই ছেলেকে এক ঘুষিতে কুপোকাত করে দিতে পারি। অন্তর জ্বলছে প্রতিশোধের আগুনে। আল্লাহ আমার প্রার্থনা কবুল করলেন না। বরং শারীরিক দুর্বলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। লক্ষ্য করলাম ওর চোখের দৃষ্টি আমার জলসিক্ত শরীরের ওপর নেমে এসেছে অনায়াসে। ঠোঁটের কোণে গম্ভীর কুঞ্চন। চোখে কুণ্ঠামিশ্রিত আরক্ত ছায়া। আমি সীমাহীন সংকোচ নিয়ে আবিষ্কার করেছি সাদা স্লিপিং স্যুটের ওপর দিয়ে আমার পার্পল কালারের লঞ্জারি ভেসে উঠেছে। খানিক আগে করা ওর আবদারটা এখন মনে পড়ছে আবার। এবার তেমন রাগ হচ্ছে না তবে অদম্য অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে গেছে ভেতরটা। ওই বাদামি চোখের মদির চাউনি আমার বুক কাঁপাচ্ছে প্রবলভাবে। দুনিয়াজোড়া লজ্জা এসে জাপটে ধরেছে চারপাশ থেকে।
শিহাব
আগুনের মতো রূপ, কথাটা আগে কোথাও শুনেছিলাম। আজকাল রুশানিয়াকে যখন দেখি, তখন এর মর্মার্থ টের পাই। আশ্চর্য সুন্দর দুটি বাঙময় চোখ তখন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। পাতলা ঠোঁটের ওপর টলমল করছে কয়েক বিন্দু রূপো রংয়ের জল। লম্বা, ঘন চোখের পাপড়িগুলো ভেজা। মোমের মতো মসৃণ তন্বী দেহের সাথে লেপটে আছে জলসিক্ত জামা। সাদা কাপড়ের ভেতর থেকে ঝিলিক দিচ্ছে একটা বেগুনি রংয়ের আভা। আমি শাওয়ার হেড যথাস্থানে ফিরিয়ে রাখলাম। রুশমি সরে যাচ্ছিল জায়গাটা থেকে। পেছন থেকে ওর একটা হাত খামচে ধরলাম।
—‘আর কখনো বেয়াদবি করবে আমার সাথে?’
—‘আমি কোনো বেয়াদবি করিনি। তুমি করেছ।’ আমার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ও।
—‘আবার বেয়াদবি?’
—‘শিহাব আমার হাত ছাড়ো! বিরক্ত করো না!’
—‘এতো তেজ দেখাচ্ছ কেনো? একটু আগে তো পেট ব্যথায় মরে যাচ্ছিলে। এখন হঠাৎ এতো শক্তি এলো কোত্থেকে?’
—‘ইউ আর সাচ অ্যান এভিল পার্সন। প্লিজ ছাড়ো আমাকে। ব্যথা পাচ্ছি!’
—‘ব্যথা পাওয়াই উচিত। এই শাস্তি তোমার প্রাপ্য।’
—‘কেনো? কী দোষ করেছি আমি?’
—‘সবসময় আমাকে অপমান করে কী আনন্দ পাও?’
—‘অপমান কি আর সাধে করি?’
—‘তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।’
—‘কীসের জন্য?’ ওর টুলটুলে মুখটা এখন কাঁদো কাঁদো। চোখে শঙ্কা। ঠোঁট ফোলা। অভিমানে নাকি রাগে কে জানে!
—‘তুমি যে আমাকে কষ্ট দাও সেই জন্য।’
—‘আমি কখন তোমাকে কষ্ট দিলাম?’
—‘সবসময় কষ্ট দাও!’
ও একটু সময় চুপ করে থাকে। তাকানোর ভঙ্গি তীক্ষ্ণ হয়। সন্দিহান গলায় বলে,
—‘তুমি কি ড্রাঙ্ক?’
—‘না।’
—‘আই থিংক ইউ আর ড্রাঙ্ক। এজন্যেই উল্টাপাল্টা করছ। ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।’
—‘ঘুমাবো, কিন্তু তার আগে তোমাকে শাস্তি দিতে হবে।’
রুশমি এ পর্যায়ে একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। আমারও হয়েছে কী কে জানে! সত্যিই কি দুশ্চরিত্র আর লম্পট হয়ে গেলাম? রুশমির ধারণাই কি তবে সঠিক? কোথায় গেলো আত্মমর্যাদাবোধ! কোথায় গেলো ইগো! কোত্থেকে এক বাধছেড়া একগুঁয়েমি এসে ভর করেছে মাথায়। মনে হচ্ছে যে করেই হোক, এই মেয়েটিকে আমার জিতে নিতেই হবে। ও আমার, শুধুই আমার! এ পৃথিবীতে ওর জন্ম হয়েছে শুধু আমার জন্য। কেনো সে আমাকে ঘৃণা করবে? কোন সাহসে?
ধাক্কাটা খুব একটা কাজে লাগলো না। আমাকে জোরপূর্বক দূরে ঠেলে দেয়া ওর মতো দুর্বল শরীরের মেয়ের কম্ম নয়। বরং ওই ধাক্কার প্রচেষ্টা আমার জিদ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আরো শক্ত করে চেপে ধরেছি ওর হাতের কব্জি। পিঠ জাপটে ধরে টেনে এনেছি নিজের খুব কাছে। ওর মাথাটা এখন আমার বুক বরাবর। ঘাড় উঁচু করে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে বলেছে, ‘অসভ্য! আনকালচার্ড!’
—‘এতো ঢং করো কেনো তুমি?’
শ্লেষ জড়ানো কণ্ঠে কেটে কেটে করলাম প্রশ্নটা। আমি খেই হারিয়ে ফেলছি। বুদ্ধি ও বিবেচনার বিরুদ্ধে গিয়ে ভেসে যাচ্ছি এক লাগামছাড়া পাগলামোতে।
—‘কীসের ঢং?’
—‘হোয়াই ডু ইউ প্রিটেন্ড টু হেইট মি?’
—‘স্ট্রেঞ্জ! আমি কেনো প্রিটেন্ড করব?’
—‘ঢং না করে উত্তর দাও রুশমি, ডোন্ট ইউ ফাইন্ড মি অ্যাট্রাকটিভ?’
—‘অসহ্য!’
—প্রশ্নের উত্তর দাও।’
—‘অসহ্য লাগে তোমাকে আমার!’
—‘তাহলে এ বাড়িতে পড়ে আছ কেনো? চলে গেলেই তো পার!
ওর চোখ দিয়ে এখন টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
—‘চলেই যাব। নিশ্চয়ই যাব!’
—‘কখন যাবে?’
—‘কালকেই যাব!’
আমি ওর হাত ছেড়েছি অবশেষে। ফর্সা হাতের কব্জি রক্তলাল হয়ে গেছে। নিজের সেই রক্তলাল কব্জির দিকে তাকিয়ে থেকে নত মস্তকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুশমি। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে কান্না দেখলাম কিছুক্ষণ। তারপর খুব অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসলাম। ওর চিবুকে হাত রেখে অশ্রুসজল মুখখানা ওপরের দিকে তুলে ধরলাম। মাথা নত করে আকস্মিক, খুব আকস্মিক ওই জলসিক্ত গোলাপি অধরে একটি প্রগাঢ় এবং প্রলম্বিত চুমু খেয়ে ফেললাম। রুশমি হতভম্ব হয়ে গেছে। কান্না থামিয়ে বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চন্দন চর্চিত দুটি গাল এখন আলতা রঙে রাঙা। আমার নিজের ওপর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস উঠে গেছে। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন স্বাভাবিক নয়। রক্তের ঝিম ভাব কাটেনি। সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে আর আবছা।
টানা কয়েক সেকেন্ড পর ও হাঁপধরা গলায় বলল, ‘এটা কেনো করলে? এখানে তো শুভ্রা নেই!’
আমি বিব্রত। কিছুটা লজ্জিতও। চোখ নামিয়ে নিলাম নিচে, ‘এটা তোমার পানিশমেন্ট!
—‘কীসের পানিশমেন্ট?
—‘আমার সাথে বেয়াদবি করার পানিশমেন্ট।’
রুশমি
অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটে যাবার পর আমি স্তব্ধীভূত হয়ে গেছি। কিয়ৎক্ষণ হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক কষ্টে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, ‘এটা কেনো করলে? এখানে তো শুভ্রা নেই।
ওর মুখে রক্তের আভাস। চোখে গুচ্ছ গুচ্ছ কুণ্ঠা। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। তারপর চোখ নিচে নামিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘এটা তোমার পানিশমেন্ট।’
—‘পানিশমেন্ট?’
—‘আমার সাথে বেয়াদবি করার পানিশমেন্ট।’
কথাটা বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে জায়গাটা থেকে সরে গেছে সে। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি ঠাঁয়। একটু আগে যে কান্নার জোয়ার আমার ভেতর থেকে ঊর্ধ্বগতিতে বেরিয়ে আসতে চাইছিল সেই জোয়ারে ভাটা পড়েছে। রক্ত তরঙ্গে বইছে এখন অন্যরকম সুর। আমি ভাবছি পানিশমেন্ট যদি এতো সুন্দর হয় তাহলে এরকম পানিশমেন্ট আমার প্রতিদিন পেতেও কোনও আপত্তি নেই। ডিয়ার শিহাব রেজা, তুমিই কিন্তু আমাকে উদ্ধত হতে শেখালে। এখন কী হবে দ্যাখো, তোমার এই পানিশমেন্টের মোহে পড়ে আমি আরো বেশি বেয়াদব হয়ে উঠব দিনকে দিন। ভাবতে ভাবতে নিজের মনে হাসছি আমি। একটু আগে ও যখন বলছিল, ‘তুমি আমার বৌ। তোমার সাথে আমি যা ইচ্ছে করতে পারি’ তখন উত্তেজনার বশে কথাটার গভীরতা বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন আমার মনের কানে ওই কথাটা সুখের ঘণ্টাধ্বনির মতো বেজে চলেছে। যদি মদ খেয়ে একেবারে বেহেড না হয়ে থাকে তবে ওই বক্তব্য থেকে এতটুকু অন্তত পরিষ্কার যে মুখে যতই অস্বীকার করুক না কেনো, মনে মনে ও আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই সত্যটুকু অনুভব করতে পেরে আমার শরীর আর মনে আশ্চর্য রকমের এক প্রশান্তি নেমে আসছে। ওর সর্দারিটা খারাপ লাগছে না একটুও। অথচ বাড়ির বড় মেয়ে বলে সর্দারি মেনে নেবার অভ্যাস আমার নেই। বাবার কথা মান্য করেছি সব সময় একথা ঠিক। বাবা আম্মুও বড় মেয়ে হিসেবে আমার ওপর নানা বিষয়ে নির্ভর করেছে। তাদের নিরবিচ্ছিন্ন ব্যস্ততার দিনগুলিতে আমি ছোট দুইবোনের দায়িত্ব নিয়েছি এবং পালন করেছি সুনিপুণভাবে। আমার তাই কথা শুনে নয় বরং শুনিয়েই অভ্যাস। কিন্তু আজকে আমার ওই মানুষটার আধিপত্য মেনে নিতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বেশিরভাগ মেয়েরা বোধহয় এমনই হয়। জীবনের অধিকাংশ সময়ে তারা নিজস্ব পুরুষটির অনুগত হয়ে থাকতে চায়। মেয়েরা নিজেদের সমর্পণ করতে ভালোবাসে। তবে সমর্পণ করার মতো যোগ্য পুরুষমানুষ কপালে জোটা চাই। আমার আম্মুজান প্রায়ই একটা কথা বলে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, যদি গুণবান পতি থাকে তাহাদের সনে। এর অর্থ ভেঙে বুঝিয়ে দিয়েছিল আম্মু একবার। কথাটা সত্য। অতিমাত্রায় সত্য!
বাবাজানের ওপর কী রাগটাই না করেছিলাম জোর করে ওর সাথে আমায় বিয়ে দিয়েছিল বলে। অথচ আজ সেই বাবাজানের প্রতিই কৃতজ্ঞতায় আমার বুক ভরে উঠছে। এমনকি ফুপি, যে ফুপি কিনা জন্মের পর থেকেই সীমাহীন বিরক্তির কারণ হয়ে এসেছে, যে কিনা নানা অজুহাতে আমার আম্মুকে নীরব এবং সুচারু অপমান করে এসেছে, আমাদের বোনদের ওপরে বিধি নিষেধের অনর্থক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। সেই একরোখা, জেদি, অহংকারী ফুপিকেও আজ আমার ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করছে। কারণ আমি জানি এই বিয়ের পেছনে ফুপির প্রত্যক্ষ প্ররোচনা আছে। আমার বাবাজান বড়বোনের হুকুম ছাড়া কোনও পারিবারিক সিদ্ধান্তই বলতে গেলে নিতে পারে না। হঠাৎ মনে হলো ভাগ্যিস শিহাবের কোন বড় বোন নেই। যদি থাকত এবং আমার ফুপির মতো কঠোর হতো, তাহলে বিপদের শেষ থাকতো না। আমি তো আম্মুর মতো সহনশীল নই। ব্যক্তিগত জীবনে তৃতীয় পক্ষের দখল মেনে নিতে আমি নারাজ।
টাওয়েল নিয়ে মাথা মুছে নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই ঘরের ক্লজেটে আমার কিছু জামাকাপড় রয়ে গেছে এখনো। ভাবছি ভেজা জামা এখানেই পাল্টে নেব। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। বাথরুমের দরজা গলে আসা টুকরো আলোয় দেখলাম শিহাব বিছানায় শুয়ে পড়েছে আড়াআড়ি ভাবে। পা দুটো ঝুলছে বাইরে। না ঝুলছে না। মাটি ছুঁয়ে আছে স্থিরভাবে। দুহাত দুদিকে প্রসারিত। চোখ নিবদ্ধ সিলিং এ। ল্যাম্পশেড জ্বালিয়ে দিলাম। ও চিত্রার্পিত, কোনো নড়চড় নেই।
—’ভেজা কাপড় নিয়ে শুয়ে পড়লে যে?’
হৃদয়াক্ষী-২৪
৩৬৯
ও কিছু বলছে না। ওপরের দিকে চেয়ে আছে নিষ্পলক। যেন ছাদটা তাকে জাদু দিয়ে বশ করে ফেলেছে।
www
—‘অ্যাই!’ আমি শিহাবের ডান হাঁটুর ওপরে একটা হাত রাখলাম। খানিক বাদে উঠে বসল শোয়া থেকে। মুখে বিপন্ন ভাব খেলছে। চোখ রক্তাভ। চাউনিতে কেমন অসহায় ভাব। আমার নজর পড়ল ওর মেটে রংয়ের ঠোঁটজোড়ার ওপর। ওপরেরটা পাতলা, নিচেরটা ভারী। স্টেসির বলা কথাটা মনে পড়ল আরেকবার। সংকুচিত হলো মন। কিন্তু ওই ঘোরলাগা বিপন্ন চোখের দৃষ্টি লাজুকভাব কাটিয়ে দিয়ে কেমন মায়ার উদ্রেক করল মনের ভেতর। আর মাথায় এলো অন্য এক চিন্তা। আচ্ছা, মানুষটা কি আমাকে সত্যিই জীবনসঙ্গী হিসেবে সারা জীবনের জন্য পাশে চায়, নাকি এই আগ্রহটা কেবলই ক্ষণস্থায়ী এক শারীরিক আকর্ষণ? কী ভীষণ এলোমেলো এবং অস্থির চিন্তাধারা ছিল আমার, তাই না? এই সব অস্থির ভাবনার পেছনের কারণটা আসলে এই ছিল যে, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম শরীর যেখানে অদৃশ্য হয়, ঠিক সেখানেই নিকষিত প্রেমের জন্ম হয়। আর অদৃশ্য আত্মায় নিকষিত প্রেমের অলৌকিক অস্তিত্বই দুটি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে অমর করে তোলে। আমি চাই না ক্ষণিকের শারীরিক সুখের জন্য আমরা একে অপরের সাথে বাঁধা পড়ি। আমি চাই, মনের বাঁধন। এসব কথা যখন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম তখনও শিহাবের দুটি চোখ কেমন এক গহন নেশায় মগ্ন। ও আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তোয়ালেটা সেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছি,
—‘মাথা মুছে নাও।’
—‘তুমি নিজেকে কী ভাবো রুশানিয়া? বিশ্বসুন্দরী?’
বুঝলাম আমার হাত ছাড়িয়ে নেয়াটা তার পছন্দ হয়নি। এমনিতেও আজকে খুব আবোলতাবোল বকছে। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে নির্ঘাত। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,
— ‘বিশ্বসুন্দরী কিনা জানি না তবে লোকে তো সুন্দরীই বলে।’
ও বাঁকা হাসে, ‘লোকের ফালতু কথা বলে বেড়ানো অভ্যাস। তুমি নিজেকে যা ভাবো, বাস্তবে তুমি তা নও।’
কেমন লাগে এসব কথা শুনলে? এভাবেই আমার ভালো হওয়া মেজাজ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খারাপ করে তোলার ওস্তাদ ছিল সে। আসলে আমাদের বিবাহিত জীবনের বয়সটা এতো অল্প ছিল যে, এর কোনও অংশ ভুলে যাবার কোনো অবকাশ নেই। আমার পুরো জীবনটাই তো পাঁচটা মাসের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। ওই পাঁচটি মাস শুধু আমি বাঁচার মতো করে বেঁচেছিলাম। ভাবতে গেলে মাঝেমাঝে অবাক হই। পাঁচ মাস? নাকি পাঁচ যুগ? আমি তোয়ালেটা ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছি, ‘তা আমি যেহেতু সুন্দরী নই, যাও না তোমার সুন্দরী বান্ধবীদের কাছে।’
আচমকা তেড়ে আসা তোয়ালের ঝাপটায় ওর ঘাড়টা একটু পেছনে সরে যায়। মুখের ওপর লেপটে পড়া তোয়ালে হাত দিয়ে খামচে ধরে বলে, ‘হুম যাবো।’
—‘ঝগড়া না করলে তোমার ভালো লাগে না, না?’
—‘তুমি হাতটা সরিয়ে নিলে কেনো?’
—‘তো কী করব?’
‘কী করবে তুমি জানো না? শিখিয়ে দিতে হবে?’
আমি চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থাপন করলাম ওর মুখের ওপর, ‘শিহাব রেজা, তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছ বাই এনি চান্স?’
এই প্রশ্নে ওর চাবুকের মতো ধারওয়ালা সুন্দর মুখখানায় দারুণ একটা হতবুদ্ধি ভাবের প্রাদুর্ভাব হলো। কিছুক্ষণ অপ্রস্তুত চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। বাদামি গাল দুটোয় লালচে রংয়ের ফিনফিনে এক আস্তর পড়ল। তারপর তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হেসে কপট ভর্ৎসনার গলায় বলল, ‘মাথা খারাপ!’
কথাটা বলে শেষ করে সে তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মোছা আরম্ভ করেছে। আমি ওর নার্ভাসনেসটা এখন টের পাচ্ছি। টের পেয়ে কেনো যেন মনে মনে এক ধরণের নিষ্ঠুর আনন্দ হচ্ছে।
—‘আচ্ছা, প্রেমে পড়নি। বাট ইউ ওয়ান্ট টু স্লিপ উইদ মি। রাইট?’
ওর হাত থেমে গেছে। কাটা কাটা নাকে মুখে ফুটে উঠেছে আরক্ত ভাব। কপালের চামড়ায় তিনটি বিব্রত ভাঁজ। কয়েক সেকেন্ড কেটে যাবার পর কিছুটা দুর্বল গলায় বলল,
‘নো, আই নেভার উড হ্যাভ থট দ্যাট…’
মিথ্যুক একটা! দ্যাখো এই মিথ্যুক ছেলে এখন আমার দিকে একবার ফিরে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না। তাকাচ্ছে না কারণ আমার চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলার সাহস ওর নেই। কিন্তু ওর কামুক মনটা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। যতই ধানাই পানাই করুক না কেনো, আমি জানি ওর মন আমার মনের ওপরে পড়েনি, পড়েছে শরীরে! কী বাজে! হবে না কিছুই এর সাথে আমার!
এই মানুষ ভীষণ রকমের কমপ্লিকেটেড। যন্ত্র একটা! অনুভূতি বলতে কিছু নেই এর ভেতরে। ভাল্লাগে না ছাই!
ক্লজেটে ঢুকে জামা পাল্টে নিলাম। অনেক রাত হয়ে গেছে। আমার নিশ্চয়ই এখন নিচে নেমে ঘুমিয়ে পড়া উচিত। তাছাড়া এখানে থেকেও বা করব কী? মানুষের সাথে রাত কাটানো যায়, যন্ত্রের সাথে যায় নাকি? ঘর ছাড়ার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার আস্তে করে বললাম, ‘যাই!’
শিহাব ঘুরে তাকিয়েছে আমার দিকে। তাকিয়েছি আমিও। ওকে ছেড়ে যেতে যে কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু সে কথাটা মুখ ফুটে বলব কী করে? বলতে তো পারব না মনে হয় মরে গেলেও! না বললে কি বুঝে নেয়া যায় না? মনের কথা পড়তে পারা কি এতই কষ্টের?
সেই থেকে আমাদের অব্যক্ত ভালোবাসার অদ্ভুত গল্পটির সূচনা হলো। গল্পটা খুবই ছোট্ট অথচ কী সুগভীর এর প্রভাব! খুব সম্ভবত সেদিনই প্রথমবারের মতো জেনেছিলাম যে এই মানুষটার সাথে এক অদৃশ্য সুতোর অবিনশ্বর গাঁটছড়ায় আমি বাঁধা পড়ে গেছি। হ্যাঁ অবিনশ্বর! এক বিন্দুও ভুল বলিনি কথাটা।
পরে ভেবে দেখেছি আমাদের দুজনের মধ্যে এতরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং ভুল বুঝাবুঝির মূল কারণ ছিল একটাই। আমরা দুজনেই ভীষণ রকমের ইন্ট্রোভার্ট। যেকোনো সম্পর্কে এক পক্ষকে এগিয়ে আসতে হয়, মাথা নত করতে হয়। যে ভালোবাসায় অহংকার এবং ইগোর স্থান আছে সে ভালোবাসায় সুখ নেই। ভালোবাসায় থাকবে আত্মসমর্পণ এবং নতিস্বীকার। তবেই জীবন হবে সহজ এবং সুন্দর। ঠেকে শিখেছিলাম এসব! সেই শিক্ষাটাও হয়েছিল বড্ড অসময়ে!
শিহাব
অফিসে একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল সেদিন। লাঞ্চ ব্রেকের খানিক আগে হাইহিল জুতোয় টুকটুক আওয়াজ তুলে, শ্যানেলের লাল পাউচ হাতে নিয়ে, শুভ্রা হেঁটে এলো নির্বিকার চিত্তে আমার ডেস্ক বরাবর। ওর পরনে কী পোশাক ছিল তা আর মনে পড়ে না। শুধু লাল রংয়ের শ্যানেল পাউচটা কোনো এক বিচিত্র কারণে স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
—‘শিহাব বাইরে চল। লেটস হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার।’
ব্যক্তিগত কেবিন নেই বলে এই অফিসে আমার প্রাইভেসির একেবারে রফাদফা অবস্থা। পাশেই ম্যাক্সের ডেস্ক। ও কাজ ফেলে শুভ্রাকে আগাগোড়া একবার দেখে নিয়ে আমার মুখের ওপর ইঙ্গিতময় দৃষ্টি ফেলেছে। আমি বিব্ৰত বোধ করছি।
—‘কেনো? হঠাৎ লাঞ্চ কেনো?’
—‘কেনো মানে? একটা দিন আমাকে সময় দিতে পারবি না? এতই পর হয়ে গেলাম?’
ভাষা বুঝতে না পারায় ম্যাক্স এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মনোযোগ দিয়েছে কাজে। বুঝতে পারছি শুভ্রার প্রস্তাবে রাজি না হলে ও অযথা একটা হাঙ্গামা বাঁধাবে। তাই অনিচ্ছাসত্তেও বেরিয়ে আসতে হল। অফিসের কাছাকাছি একটা স্প্যানিশ রেঁস্তোরায় বসলাম আমরা।
—‘সো, ফাইনালি ইউ গট ওভার মি! রাইট?’ চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল শুভ্রা।
আমি পলক তুলে একবার ওকে দেখে নিয়ে মেন্যুতে চোখ ডুবালাম পুনরায়।
—‘কথা বলছিস না যে?’
ওয়েইটার এসে দাঁড়ালো টেবিলের পাশে। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়ে গেলে শুভ্রাকে স্পষ্ট গলায় বললাম,
—‘তোমাকে আমি কখনো ভালোবাসিনি শুভ্রাদি। একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল তোমার প্রতি। ওটা কেটে গেছে।
শুভ্রার চোখে কৃষ্ণাভ মেঘের ছায়া পড়ল।
—‘রুশমিকে ভালোবাসিস তুই?’
এই নামটায় মনে হয় জাদু আছে! শোনামাত্র দিগ-দিগন্তের একরাশ ভালোলাগা ঝাপটা মারল মনে। একটা বদ্ধ কপাট যেন খুলে গেলো দমকা হাওয়ায়। খোলা কপাটে রংধনুর সাত রং উপচে পড়তে লাগলো। এটা কি ভালোবাসা? নাকি তার চাইতেও গভীরতর কিছু?
—‘শুভ্রাদি, আনিসকে তোমার মনে পড়ে? হ্যাংলা পাতলা, শ্যামলা রংয়ের ছেলেটা। স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিল। ভীষণ ব্রাইট স্টুডেন্ট। বুয়েটে চান্স পাবার পরেও পড়েনি।’
শুভ্রা গ্লাসে চুমুক দিয়ে পানি খায়, তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, ‘ওই পাগলটা? হ্যাঁ মনে আছে তো। কী হয়েছে সেই পাগলের?’
—‘এভাবে বলো না। ও পাগল হয়েছিল পরিস্থিতির চাপে পড়ে।’
—‘হয়েছে তো বেশ করেছে। এখন সেই পাগলের কথা কেনো আসছে?’ আনিসের প্রতি তাচ্ছিল্যটা ভালো লাগছে না। ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছি এই বিরক্তিকর মেয়েটাকে একটা সময় কী করে এতটা পছন্দ করতাম। আমার সেই পুরোনো শুভ্রাদি হারিয়ে গেছে। এই দামি ব্র্যান্ড মোড়ানো চাকচিক্যময় দেহের কোথাও আর সেই ববকাট চুলের, ডলপুতুলের মতো দেখতে, মায়াবী শুভ্রাদির অস্তিত্বের ছিঁটেফোটা নেই।
—‘আনিস প্রায়ই আমাদের বাসায় আসত। মনে আছে? মা মরা ছেলে বলে মম ওকে যত্ন করে খাওয়াতো। আনিসও মমের রান্না ভালোবাসত খুব।’
শুভ্রা যার-পর-নাই বিরক্ত, ‘তো?’
‘তো?’
—‘আনিস একবার তোমার সম্পর্কে একটা কথা বলেছিল।’
শুভ্রার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, ‘কী বলেছিল?’
—‘বলেছিল যে তোমার ওই সুন্দর মুখটার পেছনে একটা লোভী আর কুৎসিত মন আছে। তুমি নাকি সে সময় ‘জ’ কোম্পানির (কোম্পানির নাম উহ্য রইল) এম ডির সাথে প্রেম করতে। শুধুমাত্র দামি গিফট পাবার লোভে। তোমার বয়স মাত্র সতের। এম ডির মনে হয় পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ ছিল। এত বয়সের তফাতে কী করে প্রণয়ের সম্পর্ক হয় তা আমার মাথায় আজও ঢোকে না। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। আমি বাদে পাড়ার সকলেই বিশ্বাস করেছিল। তুমি তো জানো পাড়ার লোকে তোমাকে নিয়ে কথা বলত। সব সুন্দরীদের নিয়েই বলে মনে হয়।’
শুভ্রার ডার্ক লিপস্টিক দেয়া ঠোঁট অপমানে বেঁকে গেছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘শিহাব তুই কি আমাকে ইনসাল্ট করতে চাইছিস?’
—‘ইনসাল্ট করতে চাইছি না। জাস্ট ট্রাইং টু ফিগার ইট আউট যে ঠিক কীসের লোভে পড়ে আজ এতদিন পরে এসে তুমি আমাকে চাইছ। আমি তো নামীদামী কোম্পানির কর্মকর্তা নই, জনাথনের মতো বড় চাকরিও আমার নেই। বছরে মাত্র হান্ড্রেড কে স্যালারি পাই। আমার ধারণা তুমি আমার চাইতে আরো অনেক বেশি পাও। অর্থ এবং বিলাস ব্যাসনের কমতি নেই তোমার জীবনে। তাহলে আমাকে, আমাকে ঠিক কী কারণে প্রয়োজন তোমার শুভ্ৰাদি?’
শুভ্রা হকচকিয়ে গেছে। একটা বোকাটে ভাব ছড়িয়ে পড়েছে ওর গোলগাল ফর্সা মুখে। ওয়েইটার খাবার নিয়ে এসেছে। খুব সম্ভবত চিকেন ফাহিতাজ অর্ডার করেছিলাম সেদিন। আমি দ্রুত খাবারে মনোযোগ দিয়েছি। অফিসে ফিরে যেতে হবে। নতুন বস লাঞ্চ ব্রেকে কে কতক্ষণ সময় নিচ্ছে এসব খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। গতরাতটা পুরোপুরি নির্ঘুম কেটেছে। রুশমি নিচে নেমে যাবার পর আরো ঘণ্টা দেড়েক সময় জেগে থেকে প্রেজেন্টেশনের স্ক্রিপ্ট তৈরী করেছি। তাছাড়া একজন জব ক্যান্ডিডেটের ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে আজ আমাকে। জীবনে প্রথমবারের মতো। কিন্তু আমার মাথা পরিষ্কার ভাবে কাজ করছে না। নির্ঘুম মগজ নানাভাবে রেড সিগন্যাল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার খাদ্য দরকার। সেই খাদ্যটা হলো বিশ্রাম। খাদ্যের অভাবে সে অসংলগ্ন আচরণ করা শুরু করেছে।
যেখানে টু স্ট্রোক ইঞ্জিনের এফিশিয়েন্সি রেঞ্জ নিয়ে প্রশ্ন করার কথা ছিল, সেখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসলাম। ডু ইউ নো? হাও ফ্যাস্ট ইজ আ পেরেগ্রিন ফ্যালকন ইন মাইলস পার আওয়ার?
ইন্টারভিউ বোর্ডে উইয়ার্ড প্রশ্ন করে ক্যান্ডিডেটদের থট প্রসেস যাচাই করার ট্রেন্ডটা আজকাল খুব চলছে। আমার প্রশ্নে তাই বোর্ডের বাকি সদস্যরা সন্তুষ্ট। আমি বাদে আরো তিনজন উপস্থিত আছে এখানে। ক্যান্ডিডেট ছেলেটাও দারুণ স্মার্ট। হাসিমুখে জানিয়ে দিল, ‘আই হ্যাভ নো ব্লু!
সঠিক উত্তর আমার নিজেরও জানা নেই। ছেলেটাকে ভড়কে দেবার জন্য প্রশ্নটা করেছিলাম। কিন্তু এই ছেলে ভড়কালো না। সে জানে, যে প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে ধারণা নেই, সেই প্রশ্নের উত্তরে হাসিমুখে বলতে হয়, আমি জানি না। না জেনেও জানার ভান করে আবোল তাবোল উত্তর দেয়া আহাম্মকের কাজ।
—‘তোকে কখনো বলা হয়নি। তোর জন্য সব সময় আমার মনে একটা আলাদা জায়গা ছিল।’ শুভ্রার কথায় ঘোর ভাঙল।
—‘তোমার মনটা কত বড় শুভ্রাদি? ক’জনের জায়গা হবে ওখানে?’
—‘স্টপ মেসিং অ্যারাউন্ড, শিহাব!’
—‘উত্তরটা দাও প্লিজ!’
—‘অনেস্টলি স্পিকিং, তোকে আমার সবসময় ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল মনে হয়েছে। মানে আমার একটা প্ল্যান ছিল যে মন মতো কাউকে না পেলে তোকেই বিয়ে করব।’
হো হো শব্দে ডাকাতিয়া হাসি হেসে উঠলাম।
—ওয়াও! তুমি তো দারুণ ক্যালকুলেটিভ! ব্রিলিয়ান্ট!
শুভ্রা আমার মকারি ধরতে পারল কিনা জানি না। কেমন গম্ভীর গলায় বলল, ‘কিন্তু রুশমি তো ঝামেলা বাঁধিয়ে দিল।’
নামটা কেমন অমৃতের মতো লাগে কানে, সুখের মতো বাজে বুকে! আমি খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। চোখের সামনে শুভ্রার জমকালো সাজওয়ালা অবয়বটা ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। গতকাল রাগের মাথায় রুশমিকে বলেছিলাম বাবার বাড়ি ফিরে যেতে। ও সত্যিই এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেনি তো আবার? খাওয়া শেষ করে দ্রুত উঠে পড়লাম।
—‘আজকে আর সময় নেই। আমাকে উঠতে হবে।’
—‘এত তাড়া কীসের? আরেকটু বয়।’
—‘না, সম্ভব হচ্ছে না।’
শুভ্রার গাড়িতেই এসেছি। আমাকে পুনরায় অফিসে ড্রপ করল ও। ফিরে যাবার আগে একবার কেমন আহ্লাদী গলায় বলল, ‘এই উইকেন্ডে একবার মিট করবি? এটাই লাস্ট। আর বিরক্ত করব না। কথা দিচ্ছি!’
সে রাতে রুশমির সাথে আমার দেখাই হলো না। বাড়ি ফিরে দেখি জাহিদ ড্রইংরুমের সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। গোয়াকামলি ডিপ দিয়ে পটেটো চিপস খাচ্ছে আর সিকটম টিভি সিরিজ ‘দি অফিস’ দেখছে। একটু পর পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সারা বাড়ি কাঁপাচ্ছে। ওর কাছ থেকে জানা গেলো রুশমি তার এক কাজিনের বেবি শাওয়ারে গেছে। ফিরতে রাত হবে। আমি ভীষণ ক্লান্ত। বিছানায় শোয়ামাত্র রাজ্যের ঘুম আঁকড়ে ধরল। ভোরে ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ল আমার বৌকে। সে ফিরেছে কি? নাকি থেকে গেছে বাবার বাড়িতেই? মন কাঁটা দিয়ে উঠল এক অদ্ভুত শঙ্কায়। হাত মুখ ধুয়েই নিচে নেমে গেলাম। ড্রইংরুম ফাঁকা। ছুটে চললাম গেস্টরুমে। কেউ নেই!
আমার চোখে একটা মেদুর রংয়ের ছায়া পড়েছে। ওই ছায়াটা সেদিন অনুধাবন করিনি। কিন্তু আজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। নিজেকে নিজে ভোলাবার চেষ্টা করছি আমি। মস্তিষ্ক খাটাতে চাইছি নানামুখী বাস্তবিক চিন্তায়। কিন্তু আমার মনমাছি’টা বারবার উড়ে উড়ে একটা জায়গায় স্থির হতে চাইছে। অদ্ভুত বিষণ্নতায় ভার হয়ে উঠেছে বুক। এতো নিষ্ঠুরও মানুষ হয়? যাবার আগে একটাবার বলে যেতে তো পারত!
বাইরে তখন রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে। আকাশ ধোঁয়াটে। মাকড়সার জালের মতো আবছা একটা নরম আলো উইলো ফরেস্টের সারি সারি বৃক্ষরাজির মাথায় আলগাভাবে ঝুলে আছে। ভোরবেলাটা আমার ভীষণ পছন্দের। এ সময় প্রকৃতিকে বড় আপন বলে মনে হয়। পৃথিবীটাও যেন ভোরের ধোঁয়াটে আকাশের নিচে ক্ষণিকের জন্য আমারই মতো একা এবং বিষণ্ণ সত্তায় রূপান্তরিত হয়। হঠাৎ করে ওই ছোট্ট শব্দটা বুকের কলিজা কাঁকড়ার মতো কামড়ে ধরল। ‘একা!’ কী ভীষণ রকমের একা আমি। একা ছিলাম, একা আছি। হয়তো একাই থাকব আজীবন! সেদিনের সেই উপলব্ধি একদিন বাস্তব সত্যে রূপান্তরিত হবে তা কে জানতো! রুশানিয়া, তুমি সেদিনও ছিলে না, আজও নেই, কোথাও না থেকেও কী অলৌকিকভাবে আমার সমস্তটা জুড়ে রয়ে গেছ! সত্যি, তুমি বোধহয় জাদু জানো!
উইলো ফরেস্ট পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে। রেশমের মতো নরম বাতাস আমার চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে অনবরত। ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। আমি হাঁটছি নিত্য দিনের লাল মাটির চেনা পথে। আমার মন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে এক রংহীন গাঢ় বিষণ্ণতায়। পথের ধারের বেগুনি আর হলদে ফুলের সমারোহ নজর কাড়ছে না আজ। আমি জানি ওরাও ক্ষণিকের অতিথি। দুদিন পরে বসন্ত চলে যাবার সময় ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যাবার আগে শূন্য করে দেবে আমার ড্রিমি চেরি ফেয়ারির ঝাঁকড়া মাথা। সবাই চলে যায়। সবাইকে যেতে হয়। এই জীবন আসা যাওয়ার এক নিরর্থক নিষ্ঠুর খেলা বৈ অন্য কিছুই নয়।
ক্রিকের পানির শব্দ ভেসে আসে হাওয়ায় হাওয়ায়। আমি মন্থর পায়ে অনাবিষ্ট ভাবে হাঁটতে থাকি। একটা সময় ক্রিকের ধারে এসে দাঁড়াই। আজকের উইলো ফরেস্ট কেমন যেন ভেঙেচুরে গেছে। কোথাও কোনো স্নিগ্ধতা নেই। চেরিফুলেও যেন রং নেই। শুধু জলের শব্দ, পাখির শব্দ, আর জঙ্গলের গভীরতর বুক থেকে ছুটে আসা ঝাঁকবাঁধা সিকাডার নূপুরের মতো ঝুমঝুম একচেটিয়া ডাকের শব্দ।
পাথরের ওপর বসে আলসেমি নিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। বেঁচে থাকাটা বড়ই অর্থহীন লাগতে থাকে। মাথার ওপরের ধূসর থমথমে আকাশটার দিকে উদাস চোখে চেয়ে থাকি। বুকের মধ্যে নাম না জানা কষ্ট গিজগিজ করে। মনে হয় এই সুবিশাল প্রাণময় পৃথিবীতে আমার মতো হতভাগা বুঝি আর একটিও নেই।
হঠাৎ জনমানবহীন অরণ্যে একটা অন্যরকম শব্দের উৎপত্তি হয়। কেউ একজন খুকখুক শব্দে কাশছে। চমকে উঠে তাকালাম সামনে। তাকানো মাত্র বুকের খাঁচার হৃৎপিণ্ড ক্রিয়া বন্ধ করল ক্ষণিকের জন্য। তারপর… হ্যাঁ ঠিক তার পরমুহূর্তেই ধূসর আকাশ থেকে ভোরের পবিত্র নরম রশ্মি ঠিকরে এসে পড়ল ভাঙাচোরা উইলো ফরেস্টের আনাচে কানাচে। কাচের টুকরোর মতো ভাঙা ভাঙা দৃশ্যগুলো একটার পর একটা জোড়া লাগতে থাকল চোখের সামনে। নাকে এসে ধাক্কা খেলো বুনো ফুলের গন্ধ। বসন্ত নাচতে লাগলো হাওয়ায় হাওয়ায়! অচল পৃথিবী সচল হয়ে উঠল এক নিমেষে!
চেরি গাছতলায় একখানা পরিষ্কার চাদরের ওপর আসন গেঁড়ে রুশানিয়া বসে আছে। কোলে রাখা খোলা বই। ওর ঠিক সামনে, চাদরের ওপর একটা নীল সিরামিকের চায়ের কেটলি, দুটো কাপ পিরিচ। তার পাশে বাদামি রংয়ের মাঝারি আকৃতির একটা রাস্টিক বাস্কেট। আমি সিগারেট ফুঁকতে ভুলে গেছি। চোখ আটকে গেছে ক্রিকের ওপারের দৃশ্যে। বুকের তারে একটা দুর্বোধ্য কম্পন টের পাচ্ছি। আধো আধো আলোতে রুশমির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মুহূর্তটাকে আমার স্বপ্ন বলে ভ্রম হচ্ছে। কয়েকটা থমকে থাকা মুহূর্ত বড় ধীর গতিতে পার হবার পর রুশমি একসময় স্তিমিত কণ্ঠে বলল, ‘চা খাবে?
রুশমির প্রশ্নটা আমার কান অবধি পৌঁছেছে কিন্তু মস্তিষ্কে সচলভাবে প্রবেশ করেনি। প্রশ্নটা শুনতে পেয়েও তাই উত্তর না দিয়ে চুপ করে চেয়ে আছি সামনে। সেই অনুভূতিটুকু আমার সীমিত বাংলা জ্ঞান দ্বারা সুচারু রূপে বর্ণনা করা অসম্ভব। আমি যেন ডুবে যাচ্ছিলাম অথৈ জলের নিস্তল সমুদ্রে। রুশানিয়ার নিষ্কপট, পবিত্র মুখখানি চোখের সামনে দপ করে জ্বলে উঠতেই কেউ একজন শক্ত হাতে টেনে তুলল জলের নিচ থেকে। নিঃশ্বাসে ফিরে এলো অক্সিজেন। এখন আমি নিজের অজান্তেই হেসে ফেলেছি। কী ভয়টাই না পেয়ে গিয়েছিলাম রুশমি চলে গেছে ভেবে। আচ্ছা এই মেয়েটা যদি সত্যিই কোনদিন আমার জীবন থেকে চলে যায়, তাহলে আমি বেঁচে থাকব কী করে?
সেদিনের সেই কুয়াশার মতো আবছা রংয়ের বিশুদ্ধ ভোরবেলাটায় বসন্তের ভিজা ভিজা ফুলেল গন্ধওয়ালা মিষ্টি বাতাসে ডুবে ডুবে রুশানিয়ার ঐশ্বরিক দুটি গভীর চোখের দিকে আবিষ্ট মনে চেয়ে থেকে, একটি আশ্চর্য রকমের পরম সত্য বচন আমার কানে দৈববাণীর মতো এসে ভিড়ল। আমি জানলাম যে, আমার সাদামাটা অতি সাধারণ জীবনটা আর এক বিন্দুও আগের মতো নেই। আগের মতো নেই আমার ভেতরের আমিটাও। সবকিছু পাল্টে গেছে। এই পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতি আমাকে ক্রমেই আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। বুকের খুব গভীরে একটা সর্বনাশের ফিসফিসানি ডাক শুনতে পাচ্ছি আমি আত্মবিশ্বাস লুপ্ত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন প্রাণপাখিটা পাঁজর থেকে খুলে নিয়ে ওই মেয়েটার হাতের তালুতে গছিয়ে দিয়েছে। এবার আমার বাঁচা মরা নির্ভর করছে তার সিদ্ধান্তের ওপর। আমি ভয়ংকর রকমের অসহায় বোধ করছি। এরকম তো হবার কথা ছিল না। এরকম হওয়াটা একেবারেই উচিত হয়নি। এরকম না হলেই বরং বেঁচে যেতাম। বেঁচে থাকতাম!
রুশমি একটা হালকা বেগুনি রংয়ের ঘের ওয়ালা লম্বা জামা পরেছে। ফুল হাতা জামার কব্জির কাছটায় কুচি। এ ধরণের পোশাক আমি এখনকার মেয়েদের খুব একটা পরতে দেখি না। রুশমি কোত্থেকে এসব যোগাড় করে কে জানে। ওর কোমর ছোঁয়া চুল, যা কিনা কোমর ছুঁয়ে থাকলেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে, সেই চুলগুলো আজ ঘাড়ের কাছে খোঁপার মতো করে বাঁধা। কানের পেছনে এক থোকা চেরিফুল। একটা দুটা দলছুট চেরি ওর চুল থেকে গড়িয়ে পড়েছে কোলের ওপর, বইয়ের খোলা পাতায়। চেরিগাছের ছাউনির নিচটা এখনো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। তবে অন্ধকার হলেও রুশানিয়ার মুখটা আমি কী করে যেন এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওর চোখের বড় বড় পাঁপড়িগুলো তির তির করে কাঁপছে। ও যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তখন ঠিক এভাবেই চোখ ব্লিঙ্ক করে। এই মুহূর্তে সিদ্ধান্তহীনতা আর দ্বিধার পাশাপাশি ওই মুখে খেলছে সংকোচ। আর সংকোচের প্রসাধনটাই বোধহয় ওকে অন্যরকম সুন্দর করে তুলেছে। আমার আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু এই পবিত্র ভোরের পাতলা আলোর মধ্যে চুপ করে বসে থেকে মাথায় চেরিফুল গোঁজা রুশানিয়াকে মন ভরে, চোখ ভরে, জীবন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে!
সিগারেট শেষ করে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। ক্রিকের পাথর বিছানো এবড়োথেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি চেরিগাছ তলায়। রুশমি মুখ তুলে তাকিয়েছে আমার দিকে। মুচকি হাসি হেসে বলেছে, ‘বসো!’
আমি বসেছি ওর কথা মতো। চাদরের ওপর পা ভাঁজ করে। আমাদের দুজনের মধ্যিখানে চায়ের কেটলি, কাপ পিরিচ আর বাস্কেট। লক্ষ্য করলাম চায়ের কাপের সংখ্যাটা। দুটো কাপ কেনো? ও কি জানতো, আমি আসব? ও কি জানে রোজ ভোরবেলায় আমি একবার এখানটায় আসি?
জঙ্গলের পাখিরা এতো বেশি কথা বলছে যে মনে হচ্ছে বুঝি এই রাজ্যে এখন মানুষের কথা বলা বারণ। এই নির্দিষ্ট সময়টুকু বুঝি মানুষের কথা বলার জন্য নয়, শুধুমাত্র পাখিদের কলকাকলির জন্য বরাদ্দ।
—‘চা খাবে?’ দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্নটা করল রুশমি।
–‘খাবো না। পান করব।’
ও হাসে আমার কথা শুনে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের লিকার কাপে ঢালতে ঢালতে বলে, ‘আমি জানি ড্রিংকিং এর বাংলা পান করা। ওটা এমনিই বলেছি।’
—‘আমি জানি তুমি জানো। ভুল করে ভুল করোনি। জেনেশুনেই ভুল করেছ। এটা কী চা? কোন ফ্লেভার?’
—‘পেপারমিন্ট। তোমার অপছন্দ?’
—‘নাহ, চলবে।’
ঝিরিঝিরি মিষ্টি একটা বাতাসে আমাদের মাথার ওপরের চেরিফুলের ঝালর পুরোনো দিনের রাজকীয় পাখার মতো দুলছিল। দুলছিল রুশমির কপালের কাছে পড়ে থাকা এক গাছি চুল আর ক্রিকের ওপারে, যেখানটায় আমি বসে থাকি রোজ, ঠিক সেখানটায় একটা বাদামি চামড়ার মায়াবী চোখের মা হরিণ আর বাচ্চা হরিণ খুব চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রিকের জলের ঢেউয়ে চুমুক দিয়ে জল পান করছে।
—‘তোমার এই জায়গাটা পছন্দ রুশানিয়া?’ ওর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে প্রশ্ন করলাম।
রুশমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। একটা ছোট্ট, বিদ্যুতের মতো তীক্ষ্ম হাসির স্টিকার ওর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে। আমি সেই স্টিকারের ওপর চোখ নিবদ্ধ করে বললাম, ‘কোন জিনিসটা ভালো লাগে?’
—‘ক্রিকের পানির শব্দ আমার ভালো লাগে।’
—‘আর?’
—‘চেরিগাছ, সাউদার্ন ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ এই সবকিছুই ভালোলাগে।’
ঠিক সেইসময় লক্ষ্য করলাম ওর নাকে আজ নাকফুল নেই। নাকফুলের জায়গাটায় একটা কালচে এবং প্রকট গোল দাগ নাকফুলের অনুপস্থিতিকে আরো বেশি করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
—‘তোমার নোজপিন কোথায়?’
রুশমি এখন চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ধূসর আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজছে নিবিষ্ট মনে। যেন আকাশে কিছু একটা থাকার কথা ছিল।
—‘রুশানিয়া?’
—‘হুম?’
—‘একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে।’
—‘কী?’
—‘নোজপিন কোথায়?’
ও আকাশ থেকে চোখ নামালো। কেমন যেন অবহেলার সুরে বলল, ‘হারিয়ে গেছে!’
—‘হারিয়ে গেছে?’
—‘হুম!’
—‘খুঁজে দেখোনি?’
—‘নাহ!’
—‘কেনো?’
—‘ইচ্ছে করেনি।’
আমি চুপ করে গেলাম। নাকফুল হারিয়ে যাবার পেছনের রহস্যটা বোধহয় আমি জানি। আর জানি বলেই আজকে এই মুহূর্তে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ বলে হচ্ছে। একটা সুখের শিহরণ ময়ূরের পাখনার মতো নরম হয়ে আমার মন ছুঁয়ে দিচ্ছিল। অপ্রতিরোধ্য এক ভালোলাগার আবেশ রুশমির নিষ্কলুষ মুখটার আনাচে কানাচেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গোলাপি পাতলা ঠোঁটের কোণে বিদ্যুৎ হাসির স্টিকার লেগে ছিল তখনও। আর ঠোঁটের নিচের ওই কালো বিন্দুটা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিল সব সময়ের মতো। মন চাইছিল সামনে বসে থাকা পরীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে কাছে টেনে এনে আদর করি, ভালোবাসি, এ কথা বলতে আজ আর কোনই দ্বিধা নেই যে ওকে দেখলেই আমার আদর করতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর অন্য কোনো মানবী কখনো এমন তীব্রভাবে আকর্ষণ করেনি। করবে কী করে? রুশানিয়া তো পৃথিবীতে একটাই আছে তাই না?
—‘কী বই পড়ছ?’
রুশমি বইয়ের মলাটটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরল। হারুকি মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড।
‘কেমন লাগছে?’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করি।
—‘লেখা তো দারুণ!’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম, কিন্তু এই উপন্যাসের মূল চরিত্রকে আমি বুঝতে পারছি না।
কথার মাঝখানে ঠোঁট উল্টায় ও। ডান চোখের ওপর চুল এসে পড়ে। আঙুল দিয়ে চুল সরিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে দুদিকে। ঝাঁকি খেয়ে কানের পাশের ছোট ছোট মুক্তোদানার মতো চেরি ফুলের কয়েকটা পাঁপড়ি গড়িয়ে পড়ে ঘাড়ের ওপর।
—‘ভীষণ কমপ্লিকেটেড একটা চরিত্র।’ গমগমে কণ্ঠে রায় ঘোষণা করে সে।
—‘কেনো? এতো কমপ্লিকেটেড লাগার কারণ কী?’
ও চোখ সরু করে তাকায় আমার দিকে, ‘তুমি পড়েছ?’
—‘পড়েছিলাম আগে। এক জাপানি বন্ধু সাজেস্ট করেছিল। জাপানের
প্রতিটি মানুষ নাকি এই বই পড়েছে।’
—‘তোমার কেমন লেগেছে?’
—‘ভালোই, খারাপ কী?’
—‘অদ্ভুত লাগেনি?’
—‘নাতো!’
রুশমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল এই পর্যায়ে।
—’টরু ওয়াতানাবিকে তোমার অদ্ভুত লাগেনি?’
—‘না!’
ওর মুখটা শক্ত হয়ে গেছে। চোখে তেজযুক্ত চাপা আগুন। ঠোঁটের কোণে মৃদু ভর্ৎসনা। গোলাপি রংয়ের পাতলা সুন্দর দুটি ঠোঁট বাঁকা করে কিছু একটা বলল ক্ষীণ কন্ঠে আক্ষেপের সুরে। ক্রিকের জলের শব্দ আর হাজার পাখির
কলকাকলিতে ওর বলা কথাটা হারিয়ে গেলো। অবশ্য হারিয়ে যাওয়া কথাটির প্রতি তেমন আগ্রহ বোধ করছি না এই মুহূর্তে। আমার বরং চুপ করে ওর দিকে চেয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। ভালো লাগছে ওই মোমের মতো হেম রংয়ের মসৃণ গাল, টানা দুটি গভীর চোখের কোল বরাবর বয়ে যাওয়া কালো কাজলরেখা, কানের কাছে গোজা চেরিফুল, খাড়া নাক। যে নাকের অগ্রভাগে কিছু একটা চিকচিক করছে হীরের মতো। কী ওটা? গ্লিটারস? নাকি ঘাম?
—‘তুমি কি ওকে সাপোর্ট কর? এইযে যার তার সাথে রাত কাটানো…’
—‘আর কী করবে বেচারা? ওর গার্লফ্রেন্ড তো ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।’
—‘গার্লফ্রেন্ড নয়, ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড।’
—‘ফ্রেন্ডের মৃত্যুর পর তো ওই মেয়েটার সাথেই প্রেম হয়েছিল।’
রুশমি কঠোর গলায় বলল,
—‘ছাই প্রেম হয়েছে। প্রেম হবার আগেই তো…’
—‘ফিজিক্যাল রিলেশন হয়ে গেছে। তাতে প্রব্লেমটা কোথায়?’
রুশমির চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠল, ‘প্রব্লেমটা কোথায় মানে? ফিলিংস ছাড়া এসব হয় কী করে?’
আমি ওর অপাপবিদ্ধ সুন্দর মুখ নিঃসৃত সহজ সরল নিষ্পাপ কথা শুনে কিছুক্ষণ থম ধরে রইলাম। তারপর হাসতে হাসতে বললাম, ‘তুমি কোন প্ল্যানেটে থাকো রুশানিয়া? সেই প্ল্যানেটের নাম কী?’
প্রশ্ন শুনে ও একটু অপ্রতিভ হয়ে গেছে। মুখটা পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া বাচ্চাদের মতো চুপসে গেছে। কিছুক্ষণ থমথমে মুখ নিয়ে বসে থেকে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো একবার। চোখা ভাবে বলল, ‘তুমি হলে কী করতে?’
কঠিন প্রশ্ন! এভাবে তো কখনো ভাবিনি! আসলে গল্প উপন্যাসকে গানের মতো করে খুব মন দিয়ে অনুভব করা বোধহয় হয়ে ওঠেনি কখনো আমার। আমি গানের মানুষ, রুশমির মতো বইয়ের মানুষ নই। তবে বই পড়তে আমার ভালোলাগে। গানের পরপর আমার জীবনের দ্বিতীয় ভালোলাগা নিশ্চয়ই বই! এই বইটা পড়া হয়েছিল বছর দেড়েক আগে মেট্রোতে যাওয়া আসা করার সুবাদে। তখনও গাড়ি কেনা হয়নি। পাপা বলে দিয়েছে গাড়ি কেনার জন্য কোনো সাহায্য তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। কিনলে নিজের যোগ্যতায়ই কিনতে হবে। তখন মাত্র মাস্টার্স শেষ করে ভার্জিনিয়া ফিরে এসেছি। জয়েন করেছি মেরিল্যান্ডের একটা স্টার্টআপ কোম্পানিতে। আসা যাওয়া করি মেট্রোতে। রোজ এক ঘণ্টার যাত্রা পথ। ট্রেনে বসে কিছু করার থাকত না বলে বই পড়তাম। সে সময় ওরহান পামুক, কাজুও ইশিগুরো এবং জনগ্রীন মোটামুটি পড়ে শেষ করেছি। কোনো বই নিয়েই খুব বেশি ভাববার সময় ছিল না। বই পড়তাম সময় কাটানোর জন্য। আজকে রুশমির প্রশ্নটা একটু বিপদে ফেলে দিয়েছে আমাকে। ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
—‘উত্তর দাও!’
—‘তোমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝিনি।’
—‘তুমি যদি ওয়াতানাবি হতে তাহলে কী করতে?’
—‘আমি কেনো ওয়াতানাবি হতে যাব?’
—‘ইশ তোমার ইম্যাজিনারি পাওয়ার এতো লো! জাস্ট চিন্তা করো যে তোমার সাথেও এমনই কিছু একটা হয়েছে। তোমার জীবন থেকে তোমার ভালোবাসার মানুষটা চলে গেছে অনেক দূরে। তুমি একা। এখন তুমি কী করবে? অপেক্ষা করবে? নাকি যার তার সাথে… ইউ নো হোয়াট আই মিন!’
—‘তোমার কি ধারণা ওয়াতানাবি অপেক্ষা করেনি মেয়েটির জন্য? পুরো উপন্যাসে তোমার শুধু ওর যৌন জীবনটাই চোখে পড়ল? ওর একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, জীবনে চলার পথে বারবার ধাক্কা খাওয়া এই বিষয়গুলো তোমাকে নাড়া দিতে পারেনি? মুরাকামির দর্শন তোমাকে ভাবায়নি রুশমি? ভেবে দ্যাখো, ওয়াতানাবির জীবনটা কিন্তু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সেদিনই, যেদিন ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু মাত্র সতের বছর বয়সে কাউকে কিছু না বলে সুইসাইড করে ফেলেছিল।’
—‘তাই বলে যার তার সাথে শুয়ে পড়াটা মোটেও সমীচীন কাজ নয়। ওর যেকোনো একজনকে বেছে নেয়া উচিত ছিল।’
—‘তাহলে সেই একজনের সাথে অন্যায় করা হত।’
—‘ওর কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো।’
কমলা আর লাল পাখনাযুক্ত একজোড়া কার্ডিনাল পাখি উড়ে এসে বসেছিল আমাদের চাদরের কিনার ঘেঁষে। ওরা মানুষ ভয় পায় না। বরং মানুষের ধারে কাছে উড়ে বেড়াতে ভালোবাসে। মা হরিণ আর বাচ্চা হরিণ তখনও নিঃশব্দে জল খেয়ে যাচ্ছে। ক্রিকের পানি ঝিরিঝিরি শব্দে বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এদিকে এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠে পুবের আকাশের অদৃশ্য স্বর্ণখচিত দরজা খুলে অবহেলায় একবার উঁকি দিয়েছেন দিনমণি। ওই এক ঝলকেই আকাশের বুক চিরে একটা নরম আলোর ফোঁয়ারা জন্ম নিয়েছে আড়াআড়ি ভাবে। সেই আলোর ফোঁয়ারার একটু খানি ছিটে লম্বা লম্বা উইলো গাছের সবুজ প্রাচীর ভেদ করে অরণ্যের মাটি ছুঁয়ে দিয়েছে আলতো ভাবে। দূর হয়েছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ঝুপসি অন্ধকার। ভোরবেলার অপার্থিব পেলব আলো মুহূর্তের মাঝে জায়গাটাকে কেমন স্বর্গের মতো সুন্দর করে তুলেছে। আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে চাদরের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। চেরি ফুলের ঝালর আর উইলো গাছের সবুজ পাতার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সাদাটে আলোর ফোঁয়ারা মাখা টুকরো আকাশের দিকে চোখ রেখে বললাম,
—‘আজকের ভোরবেলাটা এতো সুন্দর! আজকে নাহয় এসব কথা থাক!’ রুশমি নাছোড় গলায় বলল, ‘আমি জানতে চাই।’
—‘কেনো জানতে চাও?’
—‘এমনি!’
—‘আমার কাছে মনটাই আসল। ভালোবাসা মনের ব্যাপার, শরীরের নয়।’
—‘তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষটির জন্য অপেক্ষা করবে?
—‘নিশ্চয়ই করব, দ্যাখো, পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম হয় না। তুমি যা করছ সেটাই সঠিক আর বাদ বাকি সব ভুল এরকম ভাবাটা উচিত নয়। জাস্ট বিকজ ইউ ডোন্ট এগ্রি, ডাজ’ন্ট মিন দ্যাট ইউ আর রাইট। আর আমার ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাইলে বলতে হয়, যে মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে, ওকে ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের ধারে কাছে যেতে আমার ইচ্ছে করে না। এর মানে আমার শরীর আর মন এই দুটো সত্তা এখনো একই সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে। যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকব ততদিন শরীর থেকে মন বিচ্ছিন্ন হবে না। যদি কখনো আমার মনুষ্য সত্তার ইতি ঘটে সেদিন কী হবে তা বলতে পারছি না রুশানিয়া! তবে শরীর তো একটা সময় ক্ষয়ে যাবে, ক্ষয়ে যাবে না শুধু হৃদয়! আমি জানি শরীর ক্ষয়ে যাবার পরেও আরো অনেকদিন… হয়তো… অনন্তকাল ধরে… সেই মেয়েটি আমার এই অক্ষত চিরঞ্জীব হৃদয়ের হৃদয়াক্ষী হয়ে রয়ে যাবে।’
—’ভেজা কাপড় নিয়ে শুয়ে পড়লে যে?’
এবং
—‘অ্যাই!’ আমি শিহাবের ডান হাঁটুর ওপরে একটা হাত রাখলাম।
…..এর মাঝে কিছু অতিরিক্ত অক্ষর ঢুকে গেছে। জানায়ে রাখলাম যাতে সংশোধন করা যায়।