হৃদয়াক্ষী – ১

শিহাব 

আজ শুভ্রাদির বিয়ে। শুভ্রাদি! আমার ছোট্টবেলার প্রেম! আই নাইনটি ফাইভ রুট ধরে আমার কালো রংয়ের পোরশে ছুটে চলেছে ঘন্টায় আশি মাইল বেগে। এখন উইন্টার। রাস্তার দু ধারের গাছগাছালির মাথা এর মাঝেই ন্যাড়া হয়ে গেছে। পাপা আমার পাশে বসে আছে। বারবার বলছে স্পিড কমাতে। আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু স্পিড কমানোর কোনো তাগিদ অনুভব করছি না। প্রস্তরীভূত হয়ে বসে আছি স্টিয়ারিং এ হাত রেখে। আমার মন চলে যাচ্ছে অতীতে। শুভ্রাদির সাথে প্রথম কবে দেখা হয়েছিল তা এখন আর মনে পড়ে না। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা হলদে দুপুরবেলা। আমি আমাদের কাঁঠাল বাগানের এঁদো গলির চারতলা বাসার ছাদের ওপর চেয়ার পেতে বসে আছি। আমার কয়েক হাত দূরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বাদামি রংয়ের স্কার্ট টপ পরে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রাদি। ফর্সা মুখ ঘিরে আছে একরাশ কালো কোঁকড়া চুলে। তখন আমার বয়স তের। শুভ্রাদির সতের। আমার মনে পড়ছে না কিছুতেই ঠিক কী কারণে সেই দুপুরে আমরা ছাদে উঠেছিলাম। চারপাশ হেমন্তের আলসে রোদে থইথই করছে। কয়েকটা চড়ুই পাখি কিচিরমিচির শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। আমি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি শুভ্রাদির ডল পুতুলের মতো টুলটুলে মুখটা। ওর গাল তখন ব্রণে ভরে থাকতো। কেউ ব্রণ নিয়ে কিছু বললেই সে ক্যাটক্যাট করে প্রত্যুত্তর করত, ‘ওগুলো বিউটিস্পট! শুধুমাত্র সুন্দরীদের থাকে। সবার থাকে না!’ 

—‘তোমার হয়েছে কী?’ আমার প্রশ্ন শুনে শুভ্রাদি ওর বিষণ্ন দুটি চোখ তুলে তাকালো। আলসেভাবে একবার থুতু ফেলল রেলিংয়ের বাইরে মুখ নিয়ে। ঠোঁট টিপে বলল, ‘শোন, আমরা আগামী মাসে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’ 

আচ্ছা, এই দিনটা এত স্পষ্ট ভাবে মনে থাকার কারণ এখন আবছা মনে পড়ছে। সেই দুপুরবেলা আমি প্রথমবারের মতো টের পেয়েছিলাম যে শুভ্রাদি দেশছাড়া হলে আমি নির্ঘাৎ মরে যাব। আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। আজ এতদিন বাদে পুরনো সেই ক্ষত পুনরায় ফিরে এসেছে। চব্বিশ বছরের যুবকের খোলস পাল্টে আমি আবারও হয়ে গেছি তের বছরের কিশোর বালক। আমার বুকে ব্যথার মতো বেজে চলেছে টনটনে অভিমান। হেমন্তের আলসে রোদে গা এলিয়ে দেয়া ববকাট চুলের শুভ্রাদির দিকে আমি স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছি। প্রাণপণে বলতে চাইছি, ‘যেও না শুভ্রাদি! প্লিজ যেও না। তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগবে না। পড়াশোনা, খেলাধূলা, কোনো কিচ্ছুতে মন বসবে না। আমি মরে যাব। বিশ্বাস করো! একদম মরে যাব!’ 

.

চার্চের সামনের পার্কিং লটে গাড়ি থামালাম। শুভ্রাদিরা খ্রিস্টান। মনে হয় ওই ধর্মের বেড়িটা থাকার কারণেই ওকে আমার কোনোদিন কিছু বলা হয়ে ওঠেনি মুখ ফুটে। তবুও বলতে চেয়েছিলাম বেশ কয়েকবার। কিন্তু কী যে হয়ে যায় আমার! শুভ্রাদির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই ভেতরে ভেতরে কেমন যেন কাপুরুষ বনে যাই। ওর চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়, বুক কাঁপে। মাঝখানে প্রায় বছর খানেক সময় ওকে দেখিনি। দুমাস হলো শুভ্রাদি চাকরির সুবাদে ওর স্প্যানিশ বয়ফ্রেন্ড জনাথনের সাথে ফ্লোরিডা থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে মুভ করেছে। লিভ টুগেদার করছিল বলে পাপাদের বন্ধুমহলে ওকে নিয়ে খুব নিন্দা হচ্ছিল বিগত কিছুদিন ধরে। উল্লেখ্য, শুভ্রাদি পাপার স্কুলজীবনের বন্ধু জোসেফ আঙ্কেলের মেয়ে। আমরা ছোটোবেলায় একই বিল্ডিং এ থাকতাম। আমার শৈশব কৈশোরের বিচিত্র সুন্দর দিনগুলির অধিকাংশ কেটেছে শুভ্রাদির সান্নিধ্যে। ও ছিল আমার স্বপ্নচারিণী। আজকে আমার সেই স্বপ্নচারিণীর বিয়ে। আমি এসেছি তার বিয়ে খেতে। কী মর্মান্তিক আশ্চর্য ঘটনা! তাই না? 

গাড়ির কালো কাচের জানালার ভেতর থেকে শুভ্র সাদা ওয়েডিং ড্রেস পরা শুভ্রাদিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চার্চের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জোসেফ আংকেলের পাশে। একজন ফটোগ্রাফার একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছে। এখন ঘড়িতে এগারোটা। বিয়ে হবার কথা বেলা বারোটায়। পাপা, মম আর ছোটোভাই জাহিদ নেমে গেছে গাড়ি থেকে। আমার নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার বুকের ভেতর পুরোনো হাহাকার ফিরে এসেছে। রক্তে রক্তে প্রথম প্রেমের ঝাপটা বইছে মাতাল মতিভ্রষ্ট ঝড়ো হাওয়ার মতো। অথচ বিগত কয়েকটা বছর শুভ্রাদিকে আমার তেমন একটা মনে পড়েনি। মাঝে মাঝে স্ন্যাপচ্যাটে ওর ছবি দেখতাম শুধু। ও আগের চাইতেও আরো অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে। আমার বয়স চব্বিশ। শুভ্রাদির আটাশ। কিন্তু ও এখনো একুশে থমকে আছে। দেখলে মনে হয় একটা দিনও বয়স বাড়েনি। 

আমি চোখে রে ব্যান লাগিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে। আজ বিশে ডিসেম্বর। টেম্পারেচার মাইনাস ওয়ান। আমি সাদা শার্টের ওপর কালো কোট পরেছি। গলায় কালো টাই। এতেও শীত মানছে না। গাড়ি থেকে নামতেই কনকনে ঠান্ডায় আমার হাত পা জমে যাবার যোগাড় হলো। শুভ্রাদি এই ঠান্ডার মধ্যে কী করে হাতাকাটা গাউন পরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে আল্লাহ জানে! 

চার্চের বাইরে অতিথিদের অনেকেই ভিড় জমিয়েছে। আমি ধীরপায়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গেলাম। আশেপাশে জনাথনকে দেখা যাচ্ছে না। জনাথনের সাথে আমার সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। ওই স্ন্যাপচ্যাটে ছবি দেখেছি কয়েকবার। শুভ্রাদির সাদা গাউনের কিছু অংশ পেছন দিকে মাটিতে লুটোচ্ছে। ওর চুলটা কেমন করে যেন বাঁধা। ঠিক এই স্টাইলে এমা ওয়াটসন চুল বেঁধেছিল একটা মুভিতে। মুভিটার নাম মনে পড়ছে না। তবে শুভ্রাদিকে এমা ওয়াটসনের চাইতেও বেশি সুন্দর লাগছে। ওর সৌন্দর্য আজ আমার সহ্য হচ্ছে না। একটা অসহনীয় যন্ত্রণায় টনটন করছে বুক। জোসেফ আঙ্কেল হাতের ইশারায় আমাদেরকে ছবি তোলার জন্য ডাকছে। আমার ছবি তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার চারপাশে এখন অমানিশার অন্ধকার। আমার পৃথিবী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন আর চব্বিশ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি নই। আমি ফিরে গেছি কৈশোরে! আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম! আমি রিক্ত, নিঃস্ব এবং দিশাহারা। আমার গলা তৃষ্ণায় চৌচির। ছোটোভাই জাহিদের হাতে একটা কোকের ক্যান ছিল। আমি ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ক্যানটা ছিনিয়ে নিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম। এক মূর্তিমানের সাথে দুম করে ধাক্কা লেগে গেলো। কোকের ক্যান হাত থেকে ফসকে পড়ে গেল মাটিতে। চোখের কিনার দিয়ে দেখতে পেলাম একটা হিজাব পরা মেয়ে একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভীষণ রকমের বিব্রত বোধ করছি। কারণ আমার বাম হাতটা অসাবধানতা বশত মেয়েটার বুক স্পর্শ করে ফেলেছে। সম্ভবত কোকের কিছু অংশ ছিটকে তার জামায়ও পড়েছে। মেয়েটা কর্কশ গলায় বলছে, ‘হোয়াট দ্যা হেল ডিড ইউ জাস্ট ডু? আর ইউ ফাকিং ব্লাইন্ড?’ কী মুশকিলে পড়া গেল! এই হিজাবওয়ালীকে এখন কে বোঝাবে যে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু করিনি। রোদের ঝলকানিতে হিজাবওয়ালীর মুখ ভেসে যাচ্ছে। আমি ওই রোদ ডোবা মুখের ক্যানভাসে এখন শুধু একটা খাড়া নাক দেখতে পাচ্ছি। সেই খাড়া নাকে মাঝারি সাইজের গোল নোজপিন। এইসব নোজপিনওয়ালা মেয়েদেরকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে! নোজপিন জিনিসটার মধ্যে একটা গেঁয়োপনা আছে। আমি লজ্জা, বিরক্তি আর রাগে কাঁচুমাচু হয়ে নতমুখে বললাম, ‘স্যরি ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। আই ডিডন’ট ডু ইট ইন্টেনশনালি।’ মেয়েটা রাগে গজগজ করে কী কী যেন বলতে লাগল। আমি পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। আজকের দিনটাই আসলে কুফা। নিজের ওপরেই নিজের কেমন রাগ ধরে যাচ্ছে। হেঁটে হেঁটে পার্কিং লটে চলে এলাম। দাঁড়ালাম ব্ল্যাক পোরশের গায়ে হেলান দিয়ে। আশপাশটা এক নজর দেখে নিয়ে সন্তর্পণে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরালাম। 

.

আমি শিহাব রেজা। জন্ম ভার্জিনিয়ার লিজবার্গ নামের একটি ছোট্ট শহরে। গায়ের রং বাদামি। উচ্চতা পাঁচ ফিট দশ। চুলের রং কালো। চোখের মণি খয়েরি। আমি সুদর্শন কিনা জানি না তবে আমার আমেরিকান বন্ধুরা সচরাচর আমার চেহারার প্রশংসা করে থাকে। ওরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে আমার গায়ের রং, জ লাইন আর গলার কণ্ঠমণি (Adam’s Apple)। যেটা সাধারণের চাইতে একটু বেশিই প্রকাশ্য। তবে শুভ্রাদি কোনোদিন ভুলেও আমার প্রশংসা করেনি। না না একবার করেছিল। সেটা ছিল এক ঈদের দিন। আমি ঈদের নামাজ পড়ে সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছি। দেখি শুভ্ৰাদি সেজেগুজে বসে আছে আমাদের ড্রইংরুমে। ওরা অন্য ধর্মের হলেও সপরিবারে ঈদ পালন করত মহা উৎসাহ নিয়ে। আমি কী রকম পাঞ্জাবি পরেছিলাম ভুলে গেছি। তবে মনে আছে শুভ্ৰাদি আমাকে দেখা মাত্র বলেছিল, ‘ওরে বাবা! তোকে তো অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে? কাহিনী কী? বড় হয়ে গেছিস নাকি?’ আমি সলজ্জ হেসেছিলাম। ইশ… দ্যাখো না কী কাণ্ড! আবার শুভ্রাদি চলে এলো কথায় কথায়। গত তিনদিন ধরে আমার হয়েছে কী আল্লাহ জানে! মাথায় সারাদিন ওই একটা নাম ঘুরছে। যাই হোক, পূর্বের টপিকে ফিরে আসি। বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আমার নেই। তবে আমার আছে বুক ভরা বাংলাদেশি শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্য। আমার বয়স যখন ছয় তখন সপরিবারে দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। কারণ একটাই, পাপা চেয়েছিল আমরা দু-ভাই যেন দেশীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ বুকে নিয়ে বেড়ে উঠি। জাহিদের বয়স তখন দুই। পাপা আর মম আমাদের দুভাইকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমালো বাংলাদেশে। ছয় বছর হলো আমরা ফিরে এসেছি আমেরিকায়। ঢাকা শহরটাও যে সন্তান বড় করার জন্য, বিশেষ করে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয় পাপা বোধহয় সেই বাস্তবতাটা অবশেষে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখানে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স করেছি। বর্তমানে একটা অটোমোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করছি। অফিস ডিসিতে। মনের দিক থেকে আমি একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবের। নিয়মমাফিক অফিস করতে ভালো লাগে না। ভালো লাগে যখন যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াতে, নতুন জিনিস ট্রাই করতে। এক্সপ্লোর করতে। আরও ভালো লাগে গান শুনতে এবং গাইতে। আর হ্যাঁ, আমি অনেক ফিটনেস ফ্রিক। রোজ নিয়ম করে জিম করি, দৌড়োই। রেসলিং আমার প্রিয় খেলা। ভার্সিটিতে থাকাকালীন আমি একজন নিয়মিত রেসলার ছিলাম। সিগারেট প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে, এমন সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্যে আমার চোখ আটকে গেল। হাইহিল জুতোয় টুকটুক শব্দ তুলে শুভ্রাদি দৌড়ে আসছে আমার দিকে। আমার দম তখন আটকে গেছে। হাতের আঙুলের ফাঁক গলে খসে পড়েছে আধ খাওয়া সিগারেট। থ হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? নাকি আমি পাগল হয়ে গেছি? 

কয়েকটা সেকেন্ড আমার মাথায় কিছুই খেলল না। বোকার মতো চেয়ে রইলাম শুধু। একটা সময় আবিষ্কার করলাম শুভ্রাদি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাঁপাচ্ছে খুব। আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। একটু পরেই তো ওর বিয়ে হবে। এ সময় চার্চের ভেতরে না থেকে মেয়েটা আমার কাছে কী করছে? 

—‘শিহাব শোন! একটা ঝামেলা হয়ে গেছে!’ 

—‘কী হয়েছে?’ 

আমি দেখলাম শুভ্রাদি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে। প্রসাধন মাখা চোখ থেকে রুপোর মতো কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কী হয়েছে আমার শুভ্রাদির? কে ওকে কাঁদাচ্ছে? কার এত সাহস? 

—‘কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?’ 

—‘জনাথন আসবে না!’ 

—‘মানে?’ 

—‘ফোন করে বলেছে। বিয়ে করতে পারবে না।’ 

—‘এসব কোন ধরণের ফাজলামো?’ 

—‘জানি না! শোন শিহাব! তুই… তুই আমাকে বিয়ে করবি?’ 

আমার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। ট্রাস্ট মি গাইজ! এতটা বিস্মিত আমি এর আগে কোনো দিন হইনি। শুভ্রাদি কাঁপা গলায় বলল, ‘চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল! আমি তো জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস!’ 

রুশমি 

একটা স্টুপিড পারভার্ট পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশি ছেলে (ইন্ডিয়ানও হতে পারে) আমার গায়ে কোক ফেলে দিয়েছে। শুধু এই না, সে আমার বুকেও হাত দিয়েছে। এত বড় অসভ্য! ঘেন্নায় সারা গা ঘিনঘিন করছে। বাজে ছেলেটার চেহারা আমি দেখিনি। শুধু লম্বা হাঁসের মতো গলার অ্যাডামস অ্যাপল চোখে পড়েছে। আমার সি গ্রিন কালারের শখের গাউনের কোমর ভিজে জবজবে হয়ে আছে। খুব বাজে দেখাচ্ছে। আমি এখন মেয়েদের রেস্টরুমের বেসিনের সাথে লাগোয়া বিশাল বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সি গ্রিন কালারের হিজাবটা টেনেটুনে ঠিক করছি। প্রয়োজন নেই, তবুও ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা অশোভন দেখায় বলেই কাজটা করছি। টয়লেটের স্টলের সামনে বেজায় বড় লাইন। গাউন পরা সাজগোজ সমৃদ্ধ মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, নিচু স্বরে কথা বলছে। আমার মন আজ সকাল থেকেই অস্থির। বিয়েতে আসার একটা ফোঁটা ইচ্ছে ছিল না। জোসেফ আংকেল বাবাজানের কাছের বন্ধু বলেই আসতে হলো। শুভ্রাদিও আমাকে খুব স্নেহ করে। শুভ্রাদির বিয়েটা মিস করা আমার জন্য কোনোভাবেই উচিৎ কাজ হতো না। অথচ বিয়ে খেয়ে বেড়াবার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। গতকাল লিও’র বার্থডে পার্টি ছিল। লিও, মানে লিওনার্দো সেব্যাশচিয়ান আমার স্কুল ফ্রেন্ড। ওরা ব্রিটিশ। বছর খানেক আগে লন্ডন থেকে আমেরিকায় মুভ করেছে। আমার গাড়ির ব্যাটারি বসে গিয়েছিল বলে স্টেসির গাড়ি করে যেতে হলো লিওর পার্টিতে। 

আম্মুজান বলে দিয়েছে ডিনার করেই ফিরে আসতে হবে। কোনো মতেই লেট নাইট করা যাবে না। আমি বরাবরই বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে। ডিনার সেরে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলাম না। লিওর গাড়িতে চড়ে ফিরে এলাম সন্ধ্যে সাতটার আগেই। বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি থামল। দরজা তখনও লক। সিটবেল্ট আলগা করে লিওকে দরজা খোলার আদেশ দিলাম। লিও আমার আদেশ তো পালন করলই না বরং হুট করে একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরে ঠোঁটে কিস করে ফেলল। আমি ভয়, বিস্ময় এবং লজ্জায় স্তব্ধীভূত হয়ে গেলাম। কী সাংঘাতিক কাণ্ড! আমার বাড়ির ঠিক সামনে! চিন্তা করা যায়? ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাম ওকে। লিও’র সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশ বোঝাপড়ার। প্রেম প্রেম ভাব থাকলেও সত্যিকারের প্রেম কখনোই ছিল না। তবে ওকে যে আমার একটু একটু ভালো লাগে না তা নয়। কিন্তু সেই ভালোলাগা চুমু খাবার মতো গাঢ় নয়। আমার মতে, চুমু খাবার জন্য মনের টান আরও বেশি গভীর হওয়া চাই। চিৎকার করে বললাম ‘লক খোলো!’ ও বেশ হকচকিয়ে গেছে। আমি জানি, ওর মাথা এখন পুরোপুরি ঠিক নেই। আংশিক মাতাল বলা যায়। ভারী জিব নেড়ে ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টে টেনে টেনে বলল, ‘হোয়াটস রং? ইউ আর অ্যাকটিং উইয়ার্ড অ্যাজ হেল!’ আমি আগের চাইতেও দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বললাম, ‘জাস্ট ওপেন দ্যা ড্যাম ডোর!’ লিও দরজা খুলল। আমি রুদ্ধশ্বাসে নেমে এলাম গাড়ি থেকে। নেমেই দেখি পোর্চে আম্মুজান দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটো দুইবোনকে সঙ্গে নিয়ে। ওদের গায়ে জ্যাকেট, মাথায় হিজাব। মনে হয় হাঁটতে বেরিয়েছিল। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। আত্মা শুকিয়ে গেছে। রাত হলেও চারপাশ বেশ আলোয় ঝলমল করছে। আমাদের বাড়ি বাদে নেইবারহুডের প্রায় প্রতিটা বাড়িই ক্রিসমাসের সাজে সজ্জিত। লাল, নীল, হলুদ আলোয় ভরে আছে গোটা পাড়া। এই আলোর জোয়ারের মধ্যে একটু আগে গাড়ির অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা চোখে পড়ে যাওয়া খুব অসম্ভব কিছু নয়। আম্মুজান কি কিছু দেখতে পেয়েছে? কিংবা আমার দুইবোনের যেকোন একজন? মেজোটা দেখলেও চেপে যাবে। আমার ভয় ছোটোকে নিয়ে। ওর খুব পেট পাতলা। আমি আম্মুজানের মুখের দিকে না তাকিয়ে নতমুখে সোজা বাড়িতে ঢুকে গেলাম। রাতে আর ঘুম এলো না। তীব্র অশান্তিতে বুক ভার হয়ে রইল। লিও, তুমি কেন এমন করলে? আম্মুজান যদি কিছু দেখে ফেলে তাহলে তো তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বটুকু আর টিকবে না। আমি যে আমার নিজের কাছেও পাপী হয়ে গেলাম। তুমি জানো না আমি আমার বাবাজানকে কত ভালোবাসি। কোনোদিন তার কাছ থেকে কিছু লুকোইনি। সে আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। আর বাবাজানের চোখে ধুলো দিতে পারলেও আমার আল্লাহকে আমি কী জবাব দেব? তিনি তো সব দেখেছেন। তিনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন? ক্রমেই একটা সুতীব্র ভয় আমার বুকের ওপর দাঁত চেপে বসতে লাগল। খানিক বাদে আবিষ্কার করলাম আমার আসলে লিওকে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে। প্রেম নাকি জানি না কিন্তু লিওর সাথে আমার কিছু একটা ছিল বোধ হয়! যা ছিল তা অন্যরকম ছিল। ভালো ছিল! এমন কি ওর চুমুটার কথা ভাবতেও এখন অত খারাপ লাগছে না। ওই মুহূর্তটুকুর স্মৃতি আমার মেরুদণ্ডে একটা শিরশিরে আনন্দের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু কী হবে যদি বাবাজান জানতে পারে? সে তো আমার ওপর ভরসা করে ওদের সাথে মিশতে দিয়েছে। আম্মুজানকে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বলেছে, ‘আমার মেয়েরা মেলামেশা করবে সবার সাথে, কিন্তু পা ফসকাবে না। তুমি দেখে নিও।’ 

এটা তো ছিল দুর্ঘটনা পরবর্তী বিনিদ্র রাত্রি যাপনের গল্প। পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে যে বিস্ফোরণটা ঘটল, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আম্মুজান বলল, ‘রুশমি শোনো, আমরা ঠিক করেছি তোমার বিয়েটা এই বছরই দিয়ে দেব।’ 

স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার মাত্র একুশ বছর বয়স! এত তাড়াতাড়ি কেউ বিয়ে করে নাকি? মাত্র আন্ডার গ্র্যাড শেষ হলো। আমি তো আরো পড়াশোনা করব। মিনমিন করে বললাম, ‘কিন্তু আমার তো পড়াশোনা শেষ হয়নি এখনও।’ 

এবার বাবাজান কথা বলল, ‘পড়াশোনা তো করতেই হবে। কিন্তু ওটা বিয়ের পরেও করা যাবে। শিক্ষিত ঘরেই বিয়ে দেয়া হবে তোমাকে। বিয়ের পর পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। 

আমার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। অনেক কষ্টে কান্না রুখে বললাম, ‘কিন্তু আমার দোষটা কী?’ 

বাবাজান ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোমার কোনো দোষ নেই। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিতে হয়। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। তাছাড়া আগামী বছর আমাদের হজ্বে যাবার নিয়ত আছে ইন শা আল্লাহ। তোমার বিয়ে না দিয়ে যেতে পারছি না।’ 

আমার বুকটা অপমান আর অভিমানে টনটন করতে লাগল। বাবাজান কেন আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়? আমি তো সজ্ঞানে কখনো তার বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি। গতকাল যা হয়েছে তাতে আমার কোনো দোষ নেই। সত্যি নেই! ভালো মন্দের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে একটা অসহনীয় যন্ত্রণা আমার বুকের ভেতর থেকে থেকে চিলিক মেরে উঠছে। যা এতকাল হয়নি তাই-ই হচ্ছে। আমার কেবলই লিওকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওর সাদা চামড়া, নীল চোখ, ব্লন্ড চুল এই সমস্ত খুঁটিনাটি আমি ভীষণ ভাবে মিস করছি। আমি জানি পাপ হচ্ছে। ভীষণ পাপ! অশান্তির অতল সাগরে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছি আমি। আমার মনটা সর্বক্ষণ দুহাত তুলে মোনাজাতে রত হয়ে আছে। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমাকে পথ দেখাও। আমাকে ধৈর্য দাও। হে আশ্রয়দাতা! হে আশ্রয়দাতা! হে আশ্রয়দাতা! আমাকে আশ্রয় দাও! 

.

আমার নাম রুশমি বিনতে হায়দার। আমরা বাংলাদেশি। ইউ এস এ এসেছি বছর দশেক আগে। আমরা তিন বোন। আমিই বড়। আমার জন্ম হয়েছিল সৌদিআরবের মদিনা শহরে। আমার বাবাজান ওখানকার এক ইউনিভার্সিটির লেকচারার ছিল। আমার বয়স যখন চার, তখন আমরা সৌদিআরব ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে গেলাম। প্রিয় নবীর শহর ছেড়ে আম্মুজান কিছুতেই যেতে চাইছিল না। কিন্তু তখন আমার দাদাসাহেব খুব অসুস্থ। তিনি জীবনের শেষ কটা দিন ছেলে, ছেলের বৌ এবং নাতনিদের সংস্পর্শে থাকতে চান। তাই আম্মুজানের অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও দেশে আমাদের ফিরে যেতেই হলো। ঢাকার একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবাজানের চাকরি হলো। আমরা স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার বড়ফুপু বহুবছর আগে থেকেই ইউএসএর সিটিজেন ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে আমেরিকায় বসবাসরত এক বাংলাদেশি ডাক্তারের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে সে আমেরিকা প্রবাসী। তার সুবাদে একটা সময় আমরাও আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে গেলাম। দাদাসাহেব মারা যাবার পর আমরা সপরিবারে দেশ ছাড়লাম। বাবাজান এখন শিক্ষকতা করে না। ভার্জিনিয়ায় আমাদের রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আছে। ব্যবসার পাশাপাশি বাবাজান স্থানীয় মসজিদে পার্টটাইম ইমামতি করে। 

.

আমার বয়স একুশ হলো এই জুলাইতে। গায়ের রং ফর্সাই বলা চলে। আত্মীয়-স্বজনেরা বলে কাঁচা হলুদের মতো রং। উপমাটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। সত্যিই কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং হলে একজন মানুষকে দেখতে কী বিশ্রী লাগবে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কেউ কেউ বলে আমার চোখে নাকি আল্লাহ সুবহানাতায়ালা জন্ম কাজল পরিয়ে দিয়েছেন। এই কথাটা অল্পবিস্তর বিশ্বাস হয়। আমার কখনো কাজল পরতে হয় না। চোখের নিচের কোল বরাবর একটা কালো দাগ আঁকা থাকে সবসময়। ওটা ডার্ক সার্কেল নয়। ওটা কী আমি জানি না। হয়তো জন্ম কাজলই হবে। আমার উচ্চতা পাঁচ ফিট আড়াই ইঞ্চি। খুব বেশি লম্বা নই। আবার একেবারে বেটেও বলা যাবে না। আন্ডারগ্র্যাড কমপ্লিট করেছি নোভা কমিউনিটি কলেজ থেকে। এবার গ্র্যাজুয়েশন শুরু করব। কিন্তু ফান্ডের ব্যবস্থা হতে হয়তো একটু সময় লেগে যাবে। খেতে ভালোবাসি ভীষণ! আর ভালোবাসি বই পড়তে। শুনতে অবাক লাগলেও এ কথা সত্য বাংলা সাহিত্যে আমার বেশ ভালো দখল আছে। আমার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন বাড়ির বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ‘চোখের বালি’ পড়ে ফেলেছিলাম। মাথামুণ্ডু কিছুই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারিনি অবশ্য। তিন বছর পর আবার পড়েছি। 

রেস্টরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি হলরুমে তেমন কেউ নেই। ওয়েডিং সেরেমনি এতক্ষণে শুরু হয়ে যাবার কথা ছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে মেজো দৌড়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বড়পু! সামথিং ভেরি ব্যাড হ্যাপেন্ড।’ 

.

—‘কী হয়েছে?’ 

—‘শুভ্রাদির বিয়ে তো ভেঙে গেছে!’ 

শিহাব 

তোমায় দেখতে হলে চোখ লাগে না 
মন থাকলেই হয়, 
তোমার নিবাস আমার হৃদমাঝারে
জীর্ণ ধরায় নয়। 

.

বিস্ময়ের প্রবল ধাক্কায় আমি পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। ভেতরটা অবশ! ডিসেম্বরের খর বাতাস আমার চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে অনবরত। ব্ল্যাক স্যুটের মোটা কাপড় ডিঙিয়ে গায়ে কামড় বসাচ্ছে কনকনে শীত। কিন্তু আমার অবশ সত্তা সেই শীতল স্পর্শ টের পাচ্ছে না। যে কথা কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আমার ভেতরের আমিটা বাদে একটা কাকপক্ষীতেও যে কথা শোনেনি কখনো, সেই কথা এমন অবলীলায় কী করে জেনে গেলো শুভ্রাদি? কী করে পড়তে পারল আমার হৃদয়ের কথা? অনেক বছর আগে একটা গান লিখেছিলাম, ‘হৃদয়াক্ষী কন্যা/ তোমায় দেখতে হলে চোখ লাগে না, মন থাকলেই হয়/ তোমার নিবাস আমার হৃদমাঝারে/ জীর্ণ ধরায় নয়। 

‘হৃদয়াক্ষী’ বলে কোনো শব্দ নেই বাংলা ডিকশনারিতে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল ময়ূরের চোখ যদি ময়ূরাক্ষী হয়, মাছের চোখ যদি মীনাক্ষী হয়, তাহলে হৃদয়ের চোখ কেন হৃদয়াক্ষী হবে না? গানটা যখন লিখেছিলাম তখন আমার হৃদয়ের চোখ হরণ করেছিল শুভ্রা নামের মেয়েটা। সকাল সন্ধ্যা মনশ্চক্ষে আমি শুধু ওকেই দেখতে পেতাম। কিন্তু কেন যেন গানটা লিখে ফেলার পর মনে হয়েছিল এই গানের কথাগুলো ওর সাথে পুরোপুরি মেলে না। শুভ্রা নিঃসন্দেহে রূপে, গুণে অনন্যা কিন্তু গভীরতা ব্যাপারটা ওর মধ্যে নেই। ওর দিকে তাকালে শুধু রক্তমাংসের শরীরটাই চোখে পড়ে। আমার অন্তর্দৃষ্টি বারেবারে ওর সুন্দর শরীরটার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে থমকে গেছে, কিছুতেই চামড়ার আচ্ছাদন সরিয়ে সত্যিকারের মনটাকে দেখতে পায়নি তবুও ওর প্রতি একটা দুর্দমনীয় অবসেশন কাজ করে আমার ছোটোবেলা থেকেই। আশ্চর্য ব্যাপার হল, আমার অজান্তে… আমার শুভ্রাদি… আমার লুকানো চাপানো অবসেশনের কথা কী অনায়াসেই না টের পেয়ে গেছে! এতগুলো বছর সব কিছু জেনেবুঝেও সে চুপ করে ছিল। আজকে যখন দৈবদুর্বিপাকে পড়ে বিয়েটা ভেঙে গেল তখন দৌড়ে এসে এই আমারই কাছে এলো সাহায্য চাইতে! এখন আমার ঠিক কী করা উচিৎ? 

আমি শুভ্রাদির নির্মল নিষ্পাপ সৌন্দর্যের পেছনে স্বার্থের বিষধর ছায়া দেখতে পাচ্ছি। বিভ্রান্তির বিকট ঢেউ তেড়ে এসে আমাকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তবে খানিক বাদেই সাময়িক বিভ্রম কেটে গেলো। টের পেলাম ভেতরকার সমস্ত সংশয় ছাপিয়ে উঠে প্রথম প্রেমের চঞ্চল সঞ্চালন ক্রমেই আমাকে উদ্বেল করে তুলছে। আমার অবিবেচক, ছেলেমানুষ, প্রেমিক মনটার কাছে হেরে যাচ্ছে বিবেচক মন। যাকে আমি গোপনে ভালোবেসেছি সারাটা জীবনভর। যাকে কখনো পাব না জেনেও ভীষণভাবে একটিবার কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছি বারংবার। সেই স্বপ্নচারিণী, আরাধিত নারী আজ নিজ থেকে আমার কাছে এসে ধরা দিল! এমন ভাগ্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়! আমার বুকের ভেতর এখন যুদ্ধ জয়ের উল্লাস ধ্বনিত হচ্ছে। নিজেকে বীরপুরুষ মনে হচ্ছে। ডাকাতের মতো হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে। পৃথিবীবাসীকে চিৎকার করে শোনাতে ইচ্ছে করছে আমার বিজয়ের গল্প! 

—‘ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা করার দ্রুত করতে হবে। গেস্টরা চলে যাবার আগেই।’ 

—‘কিন্তু… সবাই তো জানে তোমার জনাথনের সাথে বিয়ে হবে।’

-‘তাতে কী? ওয়েডিংটাই আসল। বর কে, তুই নাকি জনাথন সেটা আনইম্পরট্যান্ট।’ 

অবাক হলাম কিঞ্চিৎ, ‘বলছ কী?’ 

—‘ঠিকই বলছি। তুই কি সেকেলে নাকি?’ 

ওর প্রশ্নের উত্তরে ঢোক গিললাম। না, সেকেলে আমি নই। কিন্তু একালটাও যে চোখ রাঙানো সমাজটার বাইরের কোনো অংশ নয় সেই বাস্তবতাটুকু শুভ্রাদিকে কে বোঝাবে? ও বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। ছোটোবেলা থেকে বাড়াবাড়ি রকমের আহ্লাদী। যা চেয়েছে তাই-ই পেয়েছে। ওর বাবা মা আমাদের বিয়ে হয়তো মেনে নেবে, কিন্তু আমার পাপা মম কিছুতেই মেনে নেবে না। ওদেরকে বাইরে থেকে দেখে প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা বলে মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ রক্ষণশীল। শুভ্রাদি যা ভাবছে তা কখনোই হবে না। আমার প্যারেন্টসদের আমি চিনি। কথাটা শুভ্রাদিকে কী করে বলব বুঝতে পারছি না। আমার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ঝড়ে আনন্দ আর ভয় একইসাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছি আজকে যদি প্যারেন্টসদের সামনে দাঁড়িয়ে সদর্পে মনের ইচ্ছে প্রকাশ করতে না পারি, তাহলে নিজের দিকে নিজে চোখ তুলে কখনো তাকাতে পারব না। আত্মসম্মান রক্ষার্থেই আজকে আমায় লড়তে হবে। 

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল, ‘শুভ্ৰাদি!’ 

চমকে উঠলাম। পার্কিং লটে মানুষজন খুব একটা নেই। গত দশ মিনিটে যে কজন এসেছে, কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে পড়েছে এবং গাড়ি চালিয়ে জায়গাটা থেকে সরে পড়েছে। আমাদেরকে কেউ বিরক্ত করেনি। এই মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত গলার স্বরটা তাই আমাদের দুজনকেই একটু ঘাবড়ে দিল। হিজাব পরা একটা মেয়ে খুব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘শুভ্রাদি, সবাই তোমাকে খুঁজছে। আমি মাত্র শুনলাম ঘটনাটা। আই ফিল রিয়েলি সরি এবাউট দ্যাট।’ 

গলাটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। কবে কোথায় যেন শুনেছি এই কণ্ঠস্বর। ভালো মতো তাকাতেই হিজাবের রংটা লক্ষ্য করলাম। সি গ্রিন। ওহো! এখন মনে পড়েছে। এই চিড়িয়ার সাথেই ধাক্কা খেয়েছিলাম তখন। নোজপিন ওয়ালা বিরক্তিকর মেয়ে! ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বয়সে একটু ছোটো হবে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। ভদ্রতা সূচক একটা হাসি হাসলাম। মেয়েটা হেসে ‘হ্যালো’ বলল। কিন্তু নোজপিনওয়ালী আমার দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ শুভ্রাদির দিকে। আমিও তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। খাড়া নাকে লেগে থাকা অসহ্য রকমের ঝিকিমিকি নোজপিনটাই শুধু চোখে ভাসছে। 

—‘সরি ফিল করার কিছু নেই। তুই সবাইকে বলে দে আজকেই আমার বিয়ে হবে!’ বজ্রসম কণ্ঠে ঘোষণা দিল শুভ্রাদি। কথাটা শুনে গা কেমন ছমছম করে উঠল আমার। ভয় ভয় একটা ফিলিংস হতে লাগল। শুভ্রাদি এত কনফিডেন্ট হয় কী করে? অবশ্য ও ছোটোবেলা থেকেই সাহসী। একবার কাঁঠালবাগানের বাসায় রাত তিনটার সময় একা একা চোর পাকড়াও করে ফেলেছিল। সেই গল্প আরেকদিন বলব। আজকের এই সময়টা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের জন্য উপযুক্ত নয়। নোজপিনওয়ালীকে বলতে শুনলাম, ‘কিন্তু জনাথন তো আসেনি!’ 

শুভ্রাদি দৃঢ় গলায় বলল, ‘তাতে কী? শিহাব আছে না? শিহাব আমাকে বিয়ে করবে!’ 

মেয়ে দুটি স্প্রিংয়ের মতো ঘটাং করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। পুরুষমানুষ হয়ে তিনটা মেয়ের সামনে লজ্জা পাচ্ছি এই ভাবনা মাথায় আসতেই নার্ভাসনেস অতি মাত্রায় বেড়ে গেল। লজ্জা পাওয়া যাবে না, কান্না করা যাবে না এমনই সব অযৌক্তিক, অমানবিক বিধিনিষেধ যে পুরুষদের জীবন মারাত্মক রকমের দুর্বিষহ করে তুলেছে, সে খবর কজন রাখে? আমি সংকোচ উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। নাকের ওপর চেপে বসে থাকা সানগ্লাসটা আঙুল দিয়ে ওপরের দিকে ঠেলে দিলাম একটু। চোখ সরিয়ে নিলাম আকাশের দিকে। মনে হচ্ছে হিজাবওয়ালী আমাকে চিনে ফেলেছে। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কেন যেন খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসবে না তো আবার শুভ্রাদিকে? এই মেয়ে তো বিশ্বাস করেনি যে আমি ওর গায়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে টাচ করিনি। সব মেয়েরাই নিজেদেরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে ভালোবাসে। হিজাবওয়ালীর পাশে দাঁড়ানো ছোটো মেয়েটা বলল, ‘কিন্তু তোমাদের ধর্ম তো এক নয়। কীভাবে বিয়ে হবে?’ 

—‘ধুর, ধর্ম কোনো ম্যাটার না। ওসব কেউ মানে নাকি এখন?’ শুভ্রাদি নির্বিকার। 

.

আকাশে আজ আকাশী নীলের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে সাদা মেঘ পালতোলা নৌকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। গাছগাছালির পাতা সব ঝরে গেছে বিধায় সূর্যরশ্মি উপচে পড়ছে ছায়াহীন পৃথিবীর ওপর। চারিদিকে সাদা আলোর বন্যা। আমি টের পাচ্ছি নোজপিনওয়ালী আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। না ভুল বললাম, মুখের দিকে নয়, গলার দিকে। মেয়েরা আমার গলায় অত কী দেখে বুঝি না! 

—‘আমার জানা মতে ধর্মের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। মুসলিম মেন ক্যান ম্যারি উইমেন, হু আর পিপল অফ দ্যা বুক। শুভ্রাদি মুসলিম হয়ে গেলেই ঝামেলা মিটে যাবে। সিম্পল!’ 

আরে! বিরক্তিকর মেয়েটা তো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলেছে! এই বিষয়টা আমার মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি। কেউ যেন তুড়ি মেরে এতক্ষণের সব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিল মাথা থেকে। আমি সানগ্লাস খুলে নিয়ে নোজপিনওয়ালীর দিকে তাকালাম। ভাবলাম গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলার জন্য তার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু মেয়েটা আমাকে সেই সুযোগ দিল না। ওর মুখের ওপর আমার চোখের দৃষ্টি পূর্ণরূপে নিবদ্ধ হবার আগেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। বুঝিয়ে দিল আমার সাথে কোনোরকম কনভার্সেশনে সে রাজি নয়। আমি অপমানটা মুখ বুজে সহ্য করে শুভ্রাদিকে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘তাহলে তো ঝামেলা মিটেই গেল!’ কিন্তু শব্দগুলো আমার মুখ থেকে বেরোবার আগেই দৃশ্যপটে জোসেফ আঙ্কেল এবং আন্টিকে দেখা গেল। তাদের পাশে পাপা এবং মমও আছে। সকলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে আমাদের দলটার দিকে। 

—‘শুভ্রা! তুমি এখানে কী করছ? পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে আমরা!’ জোসেফ আংকেল বলল। 

—‘কেন? কী হয়েছে?’ ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্নের মুখে প্রশ্ন করে শুভ্রাদি। শুভ্রাদির মা কয়েক পা এগিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে অত্যন্ত ম্লান ভাবে বলল, ‘এখানে থেকে আর কাজ নেই। চলো ফিরে যাই।’ 

শুভ্রাদি মাথার ওপর থেকে মায়ের হাতখানা সরিয়ে দিল, ‘না ফিরে যাব না। আমি… আমি আর শিহাব ঠিক করেছি আমরা বিয়ে করব।’ 

আল্লাহ! এরকম অকপটে কেউ বলতে পারে এসব কথা? একমাত্র শুভ্রার দ্বারাই সম্ভব! আমি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে এখুনি আশেপাশের সব বিল্ডিং খসে পড়বে। মাথার ওপর ভেঙে পড়বে কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো মেপল গাছ। আমি পাপা আর মমের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাতে পারছি না। একটা বীতশ্রদ্ধ গ্লানিতে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। আমি… নাহ এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো অবস্থা নেই। আমি ভাষাহীন! আমার শব্দভাণ্ডার মুহূর্তের জন্য শূন্য হয়ে গেছে। 

রুশমি 

অবাক না হয়ে পারছি না। শেষমেশ শুভ্রাদি এই পারভার্ট ছেলেটাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে? সিরিয়াসলি? এই ছেলে আমার সাথে কী করেছে তা কি আমার শুভ্রাদিকে বলে দেয়া উচিত? আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকাচ্ছি না, ঘেন্না হচ্ছে। এমনিতেও অচেনা ছেলেদের দিকে আমি খুব একটা তাকাই না। আমার আম্মুজান বলে চোখের পর্দা জিনিসটা শুধু পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়, নারীদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। আমি আজ পর্যন্ত শুধু লিও ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকেই সামনাসামনি মন দিয়ে দেখিনি। এরকম জটিল এবং উত্তেজক পরিস্থিতিতেও আমার লিওকে মনে পড়ছে। আশ্চর্য! আসলে ইম্পরট্যান্ট সময়ে আনইম্পরট্যান্ট বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটা আমার অগণিত বদ অভ্যাসগুলোর একটা। কেন যেন যখন যা ভাবা উচিত তখন তা না ভেবে আমি বেকুবের মতো অন্য কিছু ভাবতে থাকি। 

এই মুহূর্তে সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। শুভ্ৰাদি ওই পারভার্টকে বিয়ে করতে চায় একথা শোনার পর জোসেফ আংকেল আর আন্টির মুখের ভাষা হাওয়া হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে আমার নিজেরই কেন যেন খুব লজ্জা লাগছে। অথচ শুভ্রাদির কোনো বিকার নেই। ও গোঁয়ারের মতো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর এসব স্বভাবের জন্য লোকে খুব নিন্দা করে। লোক বলতে ওই আমাদের বাঙালি সমাজ। আম্মুজানও ওকে খুব একটা পছন্দ করে না। বছর তিনেক আগের এক থ্যাংকস গিভিং উইকেন্ডে শুভ্রাদি ওর ফ্রেন্ডের সাথে ভার্জিনিয়া এসেছিল ফ্লোরিডা থেকে। আমাদের বাসায় স্টে করল দু’রাত। আম্মুজান সর্বক্ষণ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখল। তার খুব ভয়, পাছে আমি শুভ্রাদির সাথে একটু বেশি মেলামেশা করে ফেলি, আর ওর মতো ডেয়ারিং, গোঁয়ার হয়ে যাই। অথচ শুভ্রাদির এই খোলামেলা স্বভাবটার জন্যই কিন্তু ওকে আমার এত বেশি ভালো লাগে! ও নাহয় একটু অন্যরকম, তাতে ক্ষতি কী? সবাইকে কেন এক রকম হতে হবে? যে যেভাবে বাঁচতে চায় তাকে সেভাবেই বাঁচতে দাও না! আমার যদি শুভ্রাদির মতো হতে ইচ্ছে হয় তাহলে সেটাই আমাকে হতে দেয়া উচিত। আম্মুজানকে অবশ্য এসব কথা বলিনি কখনো, ছোটো হয়ে বড়দের মুখে মুখে সব কথা বলা যায় না। তবে আমার বাবা মায়ের একটু চাপিয়ে দেয়ার স্বভাব আছে। এই যেমন ছোটোর বয়স মাত্র বারো। এর মধ্যেই ওকে হিজাব ধরিয়ে দেয়াটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আমার কাজিন ঝুম্পা আপু (যাকে আমি বড়বোন হিসেবে গণ্য এবং মান্য করি) একবার বলেছিল, তুমি কী ধরণের ড্রেসআপ করবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কেউ কিছু বলে দেবে না। যদি হিজাব পরো তাহলে সেটা শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাতায়ালার জন্যই পরবে, অন্য কেউ বলেছে বলে নয়। আমার বয়স আঠারো পেরোনোর পর হিজাব ধরেছি। বড় মেয়ে হিসেবে আমাকে যে স্বাধীনতাটা দেয়া হয়েছিল সেই স্বাধীনতা টুকু মেজো আর ছোটোর বেলায় দেয়া হলো না। সবাই ধরেই নিল যেহেতু আমি আর আম্মুজান হিজাব পরছি, সেহেতু মেজো আর ছোটোও একই পথেই হাঁটবে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শুভ্রাদির ইচ্ছে হয়েছে পারভার্টটাকে বিয়ে করতে। দিয়ে দাও না ভাই ওদের বিয়েটা! এত কীসের সমস্যা তোমাদের? 

তবে সমস্যা যে কোন জায়গায় তা খুব ভালো মতো টের পেলাম যখন জোসেফ আঙ্কেল গমগম করে বলে উঠলেন, ‘শুভ্রা! কী আবোলতাবোল কথা বলছ! শিহাব… ও তো একটা বাচ্চা ছেলে!’ 

শুভ্রাদি ঝেঁঝে উঠে বলল, ‘বাচ্চাকেই বিয়ে করব! 

আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। জানি এরকম পরিস্থিতিতে হাসি পাওয়াটা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। হাসির কারণ অন্য কিছুই নয়, পারভার্টটা নাকি বাচ্চা! এটা শোনার পর থেকে কেন যেন হাসি থামাতে পারছি না। এমন সময় বাচ্চা পারভার্ট হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ… উই ওয়ান্ট টু গেট ম্যারিড!’ 

সেকেন্ডও কাটল না, তার আগেই আমি দেখলাম রেজা আঙ্কেল শীতল গলায় বলে উঠল, ‘শিহাব! গেট ইন দ্যা কার! রাইট নাও! 

আমি ভাবছি বাচ্চা পারভার্ট কি তাহলে রেজা আঙ্কেলের ছেলে? হতে পারে! আমি জানতাম রেজা আঙ্কেলের দুই ছেলে। ছোটোজনকে আগে দেখেছি কিন্তু বড়জনকে এই প্রথম দেখলাম। 

— ‘পাপা লিসেন!…’ পারভার্ট বলল। বলে শেষ করতে পারল না অবশ্য। মাঝপথে থেমে গেল। ওকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে এখন। রেজা আংকেল বলল, ‘কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। গাড়িতে ওঠ।’ 

আমি শুভ্রাদিকে দেখছি একনিষ্ঠ ভাবে। বেচারির সারা শরীর কাঁপছে। মুখটা অপমানে লাল। বিয়ের মেকআপ চোখের পানিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। 

‘চলো চলো। আমাদের ফিরতে হবে।’ বাবাজানের গলার স্বরে চমকে উঠলাম। 

.

আমাদের গাড়ি একটু দূরে রাখা আছে। ওই পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। আমার ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে শুভ্রাদিকে ফেলে কোথাও যেতে। অচেনা মানুষজনের বিপদেই আমার খুব সাহায্য করতে ইচ্ছে হয়, শুভ্রাদি তো সে জায়গায় চেনা মানুষ। বাবাজানের কি উচিত হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে ওদের একলা ফেলে রেখে স্বার্থপরের মতো চলে যাওয়া? কিন্তু এসব নিয়ে আমার কোনো কথা বলা সাজে না। আমার বাবাজান আমাকে খুব ভালোবাসে ঠিক কিন্তু বড়দের মুখে মুখে কথা বলাটা একেবারেই পছন্দ করে না। আমরা তিন বোন বাবাজান এবং আম্মুজানের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম পেছনে। শিহাব এখনো রেজা আঙ্কেলের সাথে কী নিয়ে যেন তর্ক করছে। সেই প্রথমবারের মতো আমি ওর মুখের একটা পাশ লক্ষ্য করলাম। চামড়া ফর্সা নয়। আমার বাবাজানের মতোই শ্যামবর্ণ। খয়েরি চোখের মণি। ছোটো করে ছাটা স্ট্রেইট চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোয়ালটা খুব তীক্ষ্ণ আর ধারালো। গলায় উদ্ধত কণ্ঠমণি। এই মুহূর্তে আমার স্টেসিকে মনে পড়ল। আমি জানি স্টেসি এখানে উপস্থিত থাকলে কী বলতো। স্টেসি বলতো, ও গশ! লুক অ্যাট হিম! হি ইজ সো ড্যাম হট! আই ক্যান্ট টেক মাই আইজ অফফ অফ হিম! স্টেসি এমনিতেই বাদামি চামড়ার ছেলেদের খুব পছন্দ করে। আমার মাথাটা মনে হয় একেবারেই গেছে। কীসের মধ্যে কী ভাবছি! আসলে আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ওদের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হলো কিনা। শিহাব এখনো তর্ক করছে। আমাদের কানে এখন আর ওদের কোনো কথা আসছে না। আম্মুজান কী যেন বলছে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে। আমি শুনতে পাচ্ছি না কিছুই। আমার মন পড়ে আছে শুভ্রাদির কাছে। কিন্তু আমি শুভ্রাদিকে দেখছি না। আমি দেখছি শিহাবকে। আমার চোখের পর্দা করার কথা মনে থাকছে না। ও যে খারাপ, ও যে সকালবেলা বিশ্রী ভাবে আমার গায়ে হাত দিয়েছিল সেটাও যেন ভুলে যাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে শিহাব বুঝি শুভ্রাদিকে খুব করে চায়। আমি কী করে যেন ছেলেটার মন পড়ে ফেলতে পারছি …এরকম আমার শুধু বাবাজানের সাথেই হয়। বাবাজান কিছু বলার আগেই আমি তার মনের কথা বুঝে ফেলি … হ্যাঁ শিহাব শুভ্রাকে পছন্দ করে। ‘পছন্দ’ শব্দটাই জুতসই। ভালোবাসা নয়। কিন্তু শুভ্রা? …ঠিক সেই মুহূর্তেই আবিষ্কার করলাম, পারভার্টটাকে এখন আর আমি মনে মনে পারভার্ট ডাকছি না। শিহাবই ডাকছি! 

.

আমরা তিনবোন গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। মেজোর চোখে চাপা উত্তেজনা প্রত্যক্ষ করছি। বুঝতে পারছি বাড়ি ফিরেই ও আমাকে এটা সেটা প্রশ্ন করে পাগল বানিয়ে দেবে। মেজোর ধারণা জগতের সব জ্ঞানের ভাণ্ডার হলো তার বড়পু। অবশ্য আজকে ওর তাকানো দেখে বুঝতে পারছি যে শুধু প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হবে না। অযথা বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেবে নির্ঘাত। ওর পেটে এখন হরেক রকমের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। না বলা কথা গুলো বদ্ধ ঠোঁটের দরজায় যেন উপচে পড়তে চাইছে। বাবাজানের ভয়ে ঠোঁট দুটো খুলতে পারছে না শুধু। ছোটোর মুখে একগাদা প্রশ্নের ভিড়। সে বেচারি মনে হয় মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল বিয়ে খাবে। তার বদলে খেতে হচ্ছে ভয়। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে বাবাজানের থমথমে মুখটা দেখে আমারও কেমন ভয় ভয় হচ্ছে। এমন কি আম্মুজানও ভয়ে চুপচাপ হয়ে আছে। এখন কেউ টু শব্দটি করলেই বাবাজান একটা গগনবিদারী খ্যাঁক দিয়ে উঠবে। মাথা ঠান্ডা থাকলে তার মতো ভালো মানুষ আর হয় না। কিন্তু রেগে গেলে আপাদমস্তক অন্য মানুষ হয়ে যায়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাজান বুঝি রাগের মাথায় খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারবে। ঘটনা ঘটিয়েছে শুভ্রাদি। আমাদের দোষটা কোথায়? আমাদের সাথে অযথা কঠিন ব্যবহার করার কারণ কী? কে বুঝাবে তাকে এসব কথা? …কে আবার? আমিই বুঝাবো! রাগ যখন পড়ে যাবে, তখন পাশে বসে তার হাতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি ধরিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বলতে হবে, ‘বাবাজান! তখন হঠাৎ এতো রেগে গেলে কেন? কারণটা কী? তোমার অকারণ রাগ আমাদের কষ্ট দেয়, এটা কি তুমি বুঝ না? 

এসব বলা যাবে মাথা ঠান্ডার সময়ে। মাথা গরমের সময়ে একটা টু শব্দ করা যাবে না। করলে জীবন নাশের সম্ভাবনা আছে। আম্মুজানের জন্য তাই মাঝে মাঝে আমার খুব কষ্ট হয়। এমনিতে ওরা ভীষণ রোমান্টিক একটা কাপল মাশাআল্লাহ। একজন আরেকজনকে ছেড়ে এক বেলা খাবার খায় না। আম্মুজানের ফুল খুব পছন্দ বলে বাবাজান নানা জাতের ফুলের চারা সংগ্ৰহ করে এনে আম্মুজানকে প্রায়ই চমকে দেয়। সামার এবং ফল সিজনে আম্মুজানের হাতে গড়া বাগান হয় চোখ ধাঁধানো সুন্দর। উইকেন্ডের একটা সন্ধ্যা বাবাজান শুধু আম্মুজানের জন্যেই বরাদ্দ রাখে। সেদিন আমরা তিনবোন ওদের বিরক্ত করি না। সবই ঠিক আছে। কিন্তু মহাশয়ের রাগটাই যত সর্বনাশের গোঁড়া। রেগে গেলে আম্মুজানকে একদম কাঁদিয়ে ছাড়ে। 

.

বাড়ির সামনে এসে আমরা তিনবোন নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। বাবা আর আম্মু এখন যাবে রেস্টুরেন্টে। প্রতিদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত ওদের রেস্টুরেন্টে থাকতে হয়। সানডে আর টিউজডে অফ। রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি আমাদের একটা কফিশপ আছে। আমার আপাতত পড়াশোনা বা জব নেই বলে সানডে, মানডে বাদে সপ্তাহের বাকি পাঁচদিন আমি কফিশপে কাজ করি। ঘণ্টায় এগারো ডলার করে পাই। উপরি হিসেবে আছে টিপস। 

আমার ঘরটা দোতলার একদম শেষ মাথায়। দু বছর হলো আমি আলাদা ঘর পেয়েছি। তার আগ পর্যন্ত মেজোর সাথে ঘর শেয়ার করতে হতো। ছোটো থাকতো বাবা আর আম্মুর সাথে। এখন মেজো আর ছোটো এক বিছানায় শোয়। আর আমার একলা ঘরে আমিই রাজা। আমার ঘরটা খুব কোজি। এই মুহূর্তে কোজি শব্দটার সঠিক বাংলা অর্থ মনে পড়ছে না। জানালার ধার ঘেঁষেই একটা ইয়া লম্বা হোয়াইট আমন্ড ট্রি আছে। স্প্রিং এ গাছটার রূপ হয় দেখার মতো! আমি সারাটা বছর ওর ওই পাগল করা বাসন্তী রূপ দেখার অপেক্ষায় থাকি। লাইটিং আমার খুব ভালো লাগে। নিজের ঘরটা তাই হরেক রকম ল্যাম্পশেড আর ক্যান্ডেল দিয়ে সাজিয়েছি যত্নের সাথে। রাতের বেলা ল্যাম্পশেডের আলোয় চুপচাপ বই পড়তে আমি ভালোবাসি। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি ছুটির দুপুরে নিরিবিলিতে ব্যাক ইয়ার্ডের ডেকের সিঁড়ির ওপর বসে বই পড়তে। ব্যাকইয়ার্ডে কোনো ফেন্স দেয়া নেই। দেবার প্রয়োজনও অবশ্য পড়ে নি। ওপাশটায় শুধু বাঁশঝাড়। কেউ তেমন একটা আসে না। যে রবিবারে খুব ঝলমল করে রোদ ওঠে, সেই রবিবারেই শুধু নেইবারহুডের বাচ্চারা দল বেঁধে আসে খেলা করতে। উইন্টারে অবশ্য ওদের খেলাধুলা বন্ধ। 

জামা কাপড় পাল্টে, গাড়ির চাবি পকেটে পুরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার পাশের ঘরটাই ছোটো দু’বোনের। ওরা কী নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে বললাম, ‘এই আমি একটু বেরোচ্ছি। তোমাদের কিছু লাগবে?’ বাবাজান বাড়িতে না থাকলে আমরা ইংরেজিতে কথা বলি। ছোটোটা বাংলা বলতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কিন্তু আমার বাবাজান ‘বাংলা’ কে এই বাড়ির রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছে। বাড়ির ভেতর কেউ ইংরেজিতে কথা বললেই শাস্তি পেতে হবে। একটা ইংরেজি বাক্যের জন্য দশবার কান ধরে ওঠাবসা। শতবার ডায়েরিতে লেখা ‘আমি দুঃখিত’। এই ধরণের শাস্তি পাওয়ার ভয়ে বাবাজানের সামনে আমরা ইংরেজি একেবারে বলি না বললেই চলে। মেজো বলল, ‘বড়পু, আমি ঠিক করেছি ল্যাশ এক্সটেনশন করবো। ফোনে কথা বলে নিয়েছি। ক্রিসমাস উপলক্ষে ডিল দিচ্ছে ওরা। থার্টি পার্সেন্ট ছাড়। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? 

—‘টাকা আছে তোমার?’ 

—‘নেই।’ 

—‘তবে?’ 

—‘তুমি দেবে তো! দেবে না?’ 

—‘ইশ! এসব ফালতু কাজে কিছুতেই টাকা খরচ করব না। তোমার চোখের পাঁপড়ি এমনিতেই অনেক লম্বা।’ 

—‘বড়পু প্লিজ!’ 

—‘টাকাগুলো ওয়েস্ট হবে শুধু শুধু। তুমি জানো ল্যাশ এক্সটেন্ড করার পর ফাইভ উইকসও ল্যাস্ট করে না।’ 

—‘ওয়ান ইয়ার ল্যাস্ট করে।’ 

—‘বাজে কথা। অন্য কিছু চাইলে চাইতে পার। কিন্তু ল্যাশ এক্সটেনশন… নো ওয়ে!’

ছোটো বলল, ‘বড়পু আমাকে কী দেবে ক্রিসমাস উপলক্ষে?’ 

ছোটো একটা গোলাপি রঙের স্কার্ট টপ পরেছে। বব চুলগুলো ঘাড়ের ওপর ফুলে ফেঁপে ছড়িয়ে আছে। আদর লাগছে দেখে। আমি ওর গালদুটো ইচ্ছে মতো টেনে দিয়ে বললাম, ‘কী চাই তোমার বল।’ 

ফোড়ন কাটল মেজো, ‘আমরা হলিডে ডিলগুলো দেখছি। কিছু পছন্দ হলেই জানাবো তোমাকে।’ 

—‘ঠিক আছে। আমি একটু আসছি। তোমরা কিন্তু লক্ষ্মী হয়ে থেকো। ফ্রিজে পিজা আছে। ক্ষিদে পেলে খেয়ে নিও।’ 

ক্রিসমাস আমরা সেলিব্রেট করি না। কিন্তু হলিডে সিজনে স্কুলের সব বন্ধু বান্ধবদের ক্রিসমাস গিফট নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা দেখে বড় হয়েছি বিধায় আমাদেরও এই উৎসবমুখর দিন গুলোতে মনটা কেবলই গিফট গিফট করে। আমার গাড়ির ব্যাটারি বসে গেছে। ঠিক না করলে ওটা এখন কিছুতেই চালানো যাবে না। নিচে নেমে অনলাইনে মেকানিকের সাথে যোগাযোগ করলাম। মেকানিক চলে এলো মিনিট দশেকের মাথায়। 

শিহাব 

নিজেকে ভীষণ কাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে মাথার চুলগুলো সব একটা একটা করে টেনে ছিঁড়ে ফেলি। কেন আমি এতটা ভীরু হলাম? কেন হলাম এমন মেরুদণ্ডহীন? অবশ্য আমি যে একেবারেই কোনো প্রতিবাদ করিনি তা কিন্তু নয়। পাপাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে শুভ্রাকে আমি পছন্দ করি। পাপা আমার কোনো কথা মন দিয়ে না শুনেই সবার সামনে আচমকা বলে উঠেছে ‘চাবকে তোমার মুখের সবকটা দাঁত ফেলে দেব! বেয়াদব কোথাকার!’ এই অসহনীয় অপমানে আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে জনসম্মুখে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের পিতা এহেন অপমানজনক এবং আক্রমণাত্মক কথা বলতে পারে? ওদিকে শুভ্রাকে তখন জোসেফ আঙ্কেল টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি স্তব্ধীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা দেখলাম। একটা শাণিত ছুরি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার বুকের ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। বিধ্বংসী অন্ধ রাগে আমার চেতনা লুপ্ত প্রায়। দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। পাপা, মম আর জাহিদও উঠে বসল তাৎক্ষণিক ভাবে। অবশ্য আমার অবস্থা এখন এমন যে ওরা গাড়িতে উঠল কি উঠল না তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি পারলে ওদের ছাড়াই গাড়ি চালানো শুরু করে দেই। রাগে আমার হাত পা কাঁপছিল। মম বলল, ‘শিহাব গাড়িটা কোথাও রাখো। ঠান্ডা মাথায় আমরা কথা বলে নেই। তারপর গাড়ি চালাও।’ 

মমের কথা পাত্তা দিলাম না। আমার মাথার ভেতরে প্রলয় ঘটছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে গাড়ি চালাচ্ছি। এতো জোরে চালাচ্ছি যে হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন গাড়িটাও আমার মতো রাগে কাঁপছে। পাপা হঠাৎ ধমকে উঠে বলল, ‘এই ছেলে! আস্তে চালাও! মেরে ফেলতে চাও নাকি আমাদেরকে? পুলিশ ধরবে তোমাকে এখুনি। 

পাপার কথা একেবারে ভুল নয়। আমার ভাগ্য ভালো যে আশেপাশে কোনো পুলিশের গাড়ি ছিল না। থাকলে নির্ঘাৎ তাড়া করত। ডিসি থেকে অ্যাশবার্ন, এই তেতাল্লিশ মিনিটের পথ আমি তিরিশ মিনিটে অতিক্রম করলাম। বাড়ির সামনে থামালাম গাড়ি। বললাম, ‘তোমরা নেমে যাও!’ 

—‘তুমিও নামো। কথা আছে।’ হুঙ্কার ছাড়ল পাপা। 

—‘কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। প্লিজ বিরক্ত কর না।’ 

মম কাতর কণ্ঠে বলল – ‘শিহাব, লক্ষ্মী আব্বু আমার! এমন করে না! বড়দের কথা শুনতে হয়।’ 

উপায়ান্তর না দেখে গাড়ি পার্ক করলাম। নেমে দেখি জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে গ্যারেজের সামনে। এ বছর উনিশে পড়ল ও। এর মাঝেই ঠ্যাং ঠ্যাঙা লম্বা হয়ে উঠেছে একদম। গায়ে মাংস বলতে কিচ্ছু নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বাঁশের কঞ্চি। একটু হাওয়া লাগলেই উড়ে যাবে। আজকে অবশ্য ব্ল্যাক স্যুটে ওকে অতটা শুকনা দেখাচ্ছে না। ভালো দেখাচ্ছে। আমার কুঞ্চিত কপালের দিকে চেয়ে একটু চাপা গলায় বলল, ‘তুমি আর শুভ্রাদি? ইজ ইট ফর রিয়েল ব্রো?’ 

আমি আগুন চোখে তাকালাম, ‘গেট লস্ট! আই অ্যাম গননা পাঞ্চ ইউ ইন ইওর ফেস!’ 

জাহিদ ফিচেল হেসে কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আমি ওর নাক বরাবর একটা ঘুষি মারার জন্য উদ্যত হলাম। ও চট করে সরে গেলো সামনে থেকে। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে দেখি পাপা মম প্যাটিওতে বসে আছে। আমি যন্ত্রের মতো হেঁটে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখ না তুলেই বললাম, ‘কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো!’ 

—‘বসো!’ আদেশ করল মম। 

—‘বসবো না।’ 

পাপা কথা বলল এবার, ‘তোমার কি আক্কেল বলতে কিছু নেই? ওই মেয়েটা তোমাকে বলল বিয়ে করবে আর অমনি তুমি রাজি হয়ে গেলে?’ 

আমি পাপার চোখে চোখ তুলে চাইতে পারলাম না। অপমানে বুক এখনো টনটন করছে। তাকে এখন কে বোঝাবে যে শুভ্রাদি বলেছে বলে নয়, বরং শুভ্ৰাদিকে আমি ছোটো বেলা থেকে পছন্দ করি বলেই ওকে বিয়ে করতে চাইছি। 

—‘আমি…. আমিও চাই।’ গলা দিয়ে অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে শব্দ গুলো 

বের করলাম। 

—‘কী চাও?’ 

—‘ওকে বিয়ে করতে।’ 

মম বিলাপ করার সুরে বলে উঠল, ‘ওই বেয়াদব মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করতে চাও? ওর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছু জানো? কয়টা ছেলে ঘুরিয়েছে এই পর্যন্ত সেই হিসেব আছে?’ 

ওয়েল …আই নো দ্যাট ভেরি ওয়েল যে, শুভ্রাকে সে সময় পাড়ার অনেক ছেলেই পছন্দ করত। ওকে পটাতে না পেরে শেষমেশ ওরই নামে বাজে কথা বলে বেড়াতো। কিন্তু ছেলেরা শুভ্রাকে পছন্দ করলে এখানে শুভ্রার দোষ কোথায়? আমি তো ওর কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছি না! 

—‘বাজে কথা বলো না তো মম। সবারই পাস্ট থাকে।’

—‘সবারই পাস্ট থাকে? আমার জানা মতে তোমার তো কোনো পাস্ট নেই! নাকি আছে?’ পাপা বলল গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে। 

আমি চিবুকটা বুকের ওপর কোনো রকমে লটকে রেখে বললাম, ‘আমার পাস্ট …ওই শুভ্রাদিই…!’ 

—‘কী বলছো?’ মম উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি মমের দিকে না তাকিয়েই বললাম, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।’ 

নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। যেন আমি নই, আমার হয়ে অন্য কেউ কথাগুলো বলে দিচ্ছে। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আছে ভেতরটা 1 চব্বিশ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে পাপা আর মমের সাথে এই প্রথমবারের মতো কোনো মেয়েকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। মম অনেক বার ছলে বলে কৌশলে জানতে চেয়েছে আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা। আমি সাফ না করে দিয়েছি। আমার তো শুভ্রা ছাড়া অন্য কোনো পছন্দ ছিল না কোনো কালেই। কিন্তু শুভ্রাকে পাবার দুঃসাহস কখনো দেখাতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে। আমি আমার নিজেকে বড় বেশি অবমূল্যায়ন করে ফেলেছি 1 আমার উচিত ছিল অনেক আগেই শুভ্রাকে মনের কথা খুলে বলা। 

—‘এসব ভুলে যাও। ওই মেয়ে সুযোগসন্ধানী। ওর বিয়ে ভেঙে গেছে বলে তোমাকে ইউজ করতে চাইছে।’ মম বলল। 

আমার ভেতর থেকে কে যেন গমগমে গলায় বলে উঠল, ‘বেশ তো! ইউজ করুক, সমস্যা নেই।’ 

পাপা এবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে, ‘একটা থাপ্পড় মেরে তোমার দাঁত সব ফেলে দেব।’ 

মম পাপাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল, ‘আহা বারবার তুমি গায়ে হাত তোলার কথা বলছ কেন? এভাবে আজকাল কেউ শাসন করে নাকি?’ 

—‘শাসন করা হয়নি বলেই তো মাথায় উঠে নেচে বেড়াচ্ছে।’ 

মম বলল, ‘ও ছোটোমানুষ বুঝতে পারছে না। আমি জোসেফ ভাইয়ের সাথে কথা বলব।’ 

আমি মমের দিকে সরাসরি চেয়ে বললাম, ‘বিয়ে করলে শুভ্ৰাকেই করব। নইলে কাউকেই করব না।’ 

পাপা দাঁত খিঁচুনি দিয়ে উঠে বলল, ‘এই শিহাবের মা! তোমার ছেলেকে ধরে বেঁধে কালকেই বিয়ে দিয়ে দাও। 

আমাদের তিনজনের গলার স্বর উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির মিস্টার রবার্ট ওর জার্মান শেফারর্ড কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। দেখা হলে রোজ সে হাত নাড়ে, কুশল বিনিময় করে। আজ আমাদের উত্তেজিত অবস্থা দেখে একটু থমকে গিয়েছে। একটা সৌজন্য হাসি হেসে দ্রুত বাড়ির সামনের রাস্তাটা পার হলো সে। এরপর মম আমাকে এমন একটি কথা বলল যা শোনার পর মনে হলো, হয় আমি ভুল শুনছি নয় মম পাগল হয়ে গেছে। ওর মানসিক চিকিৎসা দরকার। 

—‘শিহাব শোনো, আমরা তোমার জন্য মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। খুবই ভালো এবং লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওই মেয়েটির সাথেই তোমার বিয়ে দেব।’ 

—‘তোমরা কি পাগল হয়ে গেছ? বিয়ে করব আমি আর মেয়ে পছন্দ করছ তোমরা। এটার মানে কী? তাহলে বিয়েটাও বরং তোমরাই করে ফেল।’ 

কথাটা বলা শেষ করে আমি আর কিছুতেই ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হাঁটা শুরু করলাম। শুনতে পেলাম পাপা চিৎকার করে বলছে, ‘বেয়াদবির একটা সীমা থাকা চাই। বাবা মায়ের মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা হচ্ছে!’ 

মম যেন ছোটো শিশুকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এমন ভাবে বলল, ‘উত্তেজিত হবার কিছু নেই। আমাদের ছেলে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করবে না। এতটুকু বিশ্বাস ওর ওপরে আমার আছে।’ 

গ্যারেজে ফিরে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। পাপা মম নিজেদের ইচ্ছে আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। সমাজের এসব সংকীর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে আমাকে লড়তেই হবে। আমি কিছুতেই পিছিয়ে যাব না। শুভ্রাকে আমার চাই। যে কোনো মূল্যে চাই! এসব ভাবতে ভাবতে জিপিএস ডিভাইসে শুভ্রার এপার্টমেন্টের এর ঠিকানা লিখলাম। 

রুশমি 

গাড়িটা ওয়াশ করা এসেনশিয়াল হয়ে পড়েছিল। মাঝখানে অনেক দিন কারওয়াশ সেন্টারে যাওয়া হয়নি। আজকে সুযোগ পেয়েই চলে এলাম। লিও আমাকে অনবরত টেক্সট করে যাচ্ছে। আজ বিকেলে মিট করতে চায়। বিকেল বলতে আসলে কিছুই নেই উইন্টারে। বেলা পাঁচটায় সন্ধ্যে নামে। আমার স্মার্ট ফোনের মুসলিম প্রো অ্যাপ আসরের আজান দেয় দুপুর আড়াইটায়। মাগরিব পৌনে পাঁচটায়। অতএব লিও যে সময়টাকে বিকেল বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে সেই সময়টা আসলে সন্ধ্যা। সূর্যমামার আজকাল আলো ছড়াতে বড়ই কার্পণ্য। এদিকে আলো চলে যাবার পর খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি নেই আমার। পার্টি থাকলে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে নিতে হয়। বাবাজান বলে দিয়েছে সারাদিন ইচ্ছেমতো ঘুরাঘুরি করতে পারব, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারব কিন্তু বাড়ি ফিরে আসতে হবে দিনে দিনে। 

এখন আমার সাদা রঙের নিশান অল্টিমার চারধারে বৃষ্টির মতো পানির ছিটে। বিশাল বড় লম্বাটে দুটা লাল রঙের ব্রাশ গাড়ির ওপর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। আমি বসে আছি ড্রাইভিং সিটে। সামনের কাচে আছড়ে পড়া জলের ফেনারাশির ওপর আমার চোখ নিবদ্ধ। উইন্ডশীল্ড নড়ছে ক্রমাগত, আর আমি ভাবছি লিওর প্রতি আমার অনুভূতিটা নিশ্চয়ই ভালোবাসা নয়। প্রকৃত প্রেম বা ভালোবাসা জিনিসটা কী রকম তা আমি জানি না। কিন্তু কী করে যেন বুঝতে পারছি যে লিওকে আমি ভালোবাসি না। বরং ওর প্রতি ফিলিংসটাকে ভালো লাগার অ্যাডভান্স স্টেজ বলা যেতে যেতে পারে। যে অ্যাডভান্স স্টেজটা আরেকটু গড়ালে ভালোবাসায় রূপ নেবার সম্ভাবনা আছে। আমার এক মন বলছে এখুনি সময় সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার। ডিলিট অপশনে ক্লিক করো আর চিরতরে ডিলিট করে দাও লিওকে তোমার লাইফ থেকে। আবার আরেকটা মন বলছে একটু দেখা করলে কীই বা এমন ক্ষতি হয়? বেচারা যেহেতু অতটা চায় আমাকে। হ্যাঁ চায়… ও যে আমাকে খুব চায় তা আমি ওর চোখের চাউনি দেখেই বুঝতে পারছিলাম কদিন ধরে। কিন্তু ওই চাওয়াটা কোনো মতেই ভালোবাসা নয়। আমার শুভ্রাদির কথা মনে পড়ল। জনাথন তো ওকে ভালোবেসেছিল। ওদের কত সুন্দর সুন্দর যুগল ছবি দেখতাম রোজ স্ন্যাপচ্যাটে। এত ভালোবাসার পরেও জনাথন কেন এভাবে ঠকালো শুভ্রাদিকে? হঠাৎ শুভ্রাদিকে দেখতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো একবার ওর সাথে দেখা করাটা বাঞ্ছনীয়। এ সময় ওর মেন্টাল সাপোর্টের খুব প্রয়োজন! 

শিহাব 

শুভ্রা বাসায় একা। আঙ্কেল আন্টি নাকি ওর সাথে ঝগড়া করে একটু আগেই ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। শুভ্রা ড্রইং রুমে তিন চারটা মদের বোতল খুলে বসেছে। মাথার চুলে এখনো সকাল বেলার সাজ। গায়ে একটা স্লিভলেস টিশার্ট আর শর্ট প্যান্ট। ওকে দেখতে ভীষণ এলোমেলো লাগছে। চোখদুটো টুকটুকে লাল। মুখের কথা জড়ানো। আমাকে দেখা মাত্র চিৎকার করে বলেছে, ইউ নো হোয়াট? তুই একটা কাওয়ার্ড! এত ভীতু আর কাপুরুষ কেন তুই শিহাব! ছিঃ’ 

কথাটা শুনে আমার রাগ হলো না। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমি অপমানিত বোধও করলাম না। চুপচাপ বসে থেকে তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্রাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। ওর হাতে ভদকার বোতল। তরলটা বিরতিহীন ভাবে গলায় ঢেলে যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, ‘জনাথন! আই হেট দ্যাট বিচ! আই অ্যাম গন না কিল দ্যাট বিচ সাম ডে! আই সোয়্যার!’ 

—‘জনাথন আসেনি কেন বিয়েতে?’ 

শুভ্রা আগের মতোই দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘মরছে শালা। 

—‘সিরিয়াসলি শুভ্রাদি, বলো না! কেন আসেনি সে?’ 

—‘হিজ এক্স কেইম ব্যাক।’

—‘স্ট্রেঞ্জ! বিয়ের দিনই ব্যাক করতে হলো?’ 

শুভ্রা ওর লাল টুকটুকে চোখ দুটো আমার মুখের ওপর নিবদ্ধ করে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লিসেন শিহাব, প্লিজ ম্যারি মি! ম্যারি মি রাইট নাও! আমি ওই জনাথন বিচকে শিক্ষা দিতে চাই। প্লিজ হেল্প মি আউট!’ 

কথাটা শোনামাত্র আমি বুকের ওপর হঠাৎ একটা ভারী পাথরের চাপ অনুভব করলাম। আমার যন্ত্রণা বিদ্ধ হৃৎপিণ্ড ক্ষণিকের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। জনাথনকে শাস্তি দেবার জন্যে শুভ্রা আমাকে বিয়ে করতে চায়? তাহলে কি মমের কথাই ঠিক? শুভ্রা আমাকে ইউজ করছে… বেশ তো করতে দাও! 

পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই একটা মানুষের অধিকার আছে আমাকে ব্যবহার করার। আজকে যদি শুভ্রার আমাকে সত্যিই প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই প্রয়োজনীয়তাটুকু পূরণ করতে আমি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বোধ করব না। তবে এই মুহূর্তে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্টের স্বরূপ সম্পর্কে আমি অজ্ঞাত। কোথায় এর উৎস তাও জানি না। আমি আমার নাম না জানা কষ্টটা প্রাণপণে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। শুভ্রার আমাকে প্রয়োজন। এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা! হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। শুভ্রা ভারী জিব নেড়ে বলল, ‘দ্যাখতো কে আসছে। জনাথন হলে মুখের মধ্যে একটা পাঞ্চ করবি দুম করে। এক সেকেন্ডও দেরি করবি না।’ 

একটা বড় শ্বাস পড়ল আমার। বুঝলাম শুভ্রার মাথায় জনাথন ছাড়া কিছুই নেই। তার অবচেতন মন জনাথনের উপস্থিতিই কামনা করছে সর্বক্ষণ। কিন্তু আমি জানি প্রাণ নিয়ে বাঁচতে চাইলে জনাথন আর কখনোই এমুখো হবে না। দরজা খুলে দেখলাম একটা ছিপছিপে গড়নের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো ওভার কোটে গা ঢাকা। পায়ে লং বুট। মাথায় কালো হিজাব। মনে হলো এই মুখটা আমি আগে কোথায় যেন দেখেছি। হঠাৎ চোখ পড়ল মেয়েটার তীক্ষ্ণ নাকের বাম পাটায় লেগে থাকা নোজপিনের ওপর। এবারে চিনতে পেরেছি। আজব কাণ্ড। এই মেয়ে আমার পিছু ছাড়ছে না কেন? যেখানে যাচ্ছি সেখানেই হাজির হচ্ছে! এর সমস্যা কী? মেয়েটা আমার দিকে হতভম্ভ ভাবে চেয়ে আছে। চোখের সামনে ভূত দেখলেও বোধহয় মানুষ এতটা বিস্মিত হয় না। ওর ত্বকের রং খুব ফর্সা। ঠোঁটের নিচে বাম দিকে একটা কালো তিল। আর …এই প্রথমবারের মতো আমি ওর চোখজোড়া লক্ষ্য করলাম। এরকম চোখ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু কী এমন বিশেষত্ব ওই চোখে তা এই মুহূর্তে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হঠাৎ মনে হলো মেয়েটা বুঝি ক্রমেই কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠছে। মুখে একটু লাজুক ভাব। অবাক হলাম! আজকালকার মেয়েরা আবার লজ্জা টজ্জা পায় নাকি? 

শুভ্রার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘কে এসেছে?’ 

আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘কাম ইন!’ 

মেয়েটা ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল নিঃশব্দে। আমি দরজা আটকে দিয়ে ড্রইং রুমে ফিরে এলাম। এসে দেখি শুভ্রা সেন্টার টেবিলে মাথা হেঁট করে, পা গুটিয়ে বসে আছে কার্পেটের ওপর। হাতে ধরা মদের বোতলটা খালি। বোঝা গেল এই মাত্র চুমুক দিয়ে পুরোটা শেষ করেছে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে অনেক কষ্টে মাথাটা একটু উঁচু করল সে, জড়ানো গলায় বলল, ‘কে এসেছে?’ 

কী বলব? যে এসেছে তাকে তো আমি চিনি না। তবে এই মুহূর্তে ওই আগন্তুককে আমার ডিজাস্টার ছাড়া অন্য কিছুই মনে হচ্ছে না। এসেছিলাম শুভ্রার সাথে নিভৃতে দুটা কথা বলতে। এই বিশেষ স্পৃহণীয় সময়টিতেই মিস ডিজাস্টারকে হাজির হতে হলো। আমার বুকের যন্ত্রণা এবং পীড়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়লাম। ডিজাস্টার কতক্ষণে বিদেয় হবে কে জানে! 

চোখের কিনার দিয়ে দেখতে পেলাম মেয়েটা ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। শুভ্রা অর্ধনিমীলিত চোখ মেলে তাকালো। তারপর অপ্রকৃতস্থের মতো দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বলল, ‘রুশ! তুই এসেছিস? আয় এদিকে আয়।’ কথাগুলো বলতে বলতে শুভ্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়াবার বৃথা চেষ্টা করল। ঢলে পড়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই। মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল ওকে। সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘একী শুভ্রাদি! তোমার মাথা তো পুরা আউট মনে হচ্ছে! এত ড্রিঙ্ক করেছ কেন?’ 

—‘আমাকে তো লাইফই আউট করে দিল। একেবারে বোল্ড আউট বুঝলি?’ পাগলের প্রলাপ বকতে লাগল শুভ্রা। বুঝতে পারছি কোনো জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করবার মতো মানসিক বা শারীরিক অবস্থা ওর এখন নেই। আজ রাতের মধ্যে এই নেশা ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। আমার এখন উঠে পড়া উচিত। কাল সানডে, ছুটির দিন। সকাল সকাল একবার এসে ঘুরে যাব না হয়। কিন্তু শুভ্রাকে এই অবস্থায় একলা ফেলে যেতেও খারাপ লাগছে। বেচারির বাবা মা কেউ সঙ্গে নেই। মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে। যদি হতাশা থেকে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? 

—‘এই রুশ, তুই একে চিনিস? এর নাম শিহাব। আমার হবু বর। আমি একেই বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।’ 

আমি জানি মাতাল লোকের কথার দাম দিতে নেই। তবুও শুভ্রার বলা কথাগুলো আমাকে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে ফেলে দিল। মেয়েটা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে এখন। রুশ আবার একটা নাম হলো? নিশ্চয়ই বাবা মায়ের দেয়া বাঙালি নাম অন্য কিছু। রুশ হয়তো আসল নামটির আমেরিকান ভার্সন। মেয়েটা ওভার কোট খুলে রেখেছে। তার পরনে একটা সাদা কালো ফুল হাত চেক শার্ট। কালো জিন্স। শার্টটা অত্যন্ত বড় এবং ঢোলা। হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে একেবারে। 

শুভ্রা সোফার ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ডান হাতটা ঝুলছে সোফার বাইরে। চোখ বন্ধ করে বলল, ‘শিহাব! ওগো আমার ফিউচার বর! এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, এ হলো রুশমি।’ 

শুভ্রার মাথাটা একদম গেছে। মাতলামোর চূড়ান্ত করছে এখন। এবার ভীষণ বিরক্ত হলাম মনে মনে। ভদ্রতা রক্ষার্থে বিরক্তি ভাবটা মুখ থেকে লুকোনোর চেষ্টা করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘হ্যালো। আমি শিহাব।’ মেয়েটি আমার বাড়ানো হাতের দিকে চাইলো এক নজর, কিন্তু হাতটা ধরল না। অদ্ভুত চোখ দুটো আমার মুখের ওপর মেলে দিয়ে লঘু গলায় বলল, ‘আমি রুশমি।’ 

আমার বাড়ানো হাতটা শূন্যে আটকে থাকলো টানা কয়েক সেকেন্ড। তারপর যখন বুঝতে পারলাম অপর পক্ষর এই করমর্দনে বিন্দুমাত্র সম্মতি নেই তখন চট করে হাতটা নামিয়ে নিলাম। এই প্রত্যাখ্যান আমার ভালো লাগল না। মেয়েটা নিজেকে ভাবে কী? আশ্চর্য! সোফার ওপর বসে পড়লাম আবার। অপমানটা সহজে হজম করতে পারলাম না। একদিকে শুভ্রার মাতলামো অন্যদিকে এই বিরক্তিকর মেয়ের উপস্থিতি এবং চরম অভদ্রতা! সব মিলিয়ে এক বীভৎস রাগ এবং গ্লানিতে আমার ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলতে লাগলো। শুভ্রা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। শোয়ার পর ওর শর্ট প্যান্ট উরুর অনেক খানি উপরে উঠে গেছে। আমি কয়েক হাত দূরে বসে থেকে ওর ফর্সা মসৃণ দুটি উরু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই মিস ডিজাস্টার যদি এখানে উপস্থিত না থাকতো তাহলে হয়তো শুভ্রাকে খুব কাছ থেকে আজ আমি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। ওকে এমন নিভৃতে এর আগে কখনো পাইনি তো! পেলেও সেই সময় ওকে কাছে টানার একরত্তি সাহস ছিল না। ও আমার দূর অন্তরীক্ষের হীরকখণ্ড তারা ছিল। যে তারা বহু দূর থেকে আলো দেয়, ভাবায় এবং স্বপ্ন দেখায়। আকাশের তারাকে ছুঁয়ে দেয়া অসম্ভব জেনেও অনেক লোকেই যেমন তাকে একটিবার ছুঁয়ে দেখার ব্যর্থ বাসনা বুকে ধারণ করে, ঠিক তেমনি শুভ্রাকে একটিবার কাছে পাবার ব্যর্থ বাসনা আমি আমার বুকের মধ্যে লালন করে এসেছি সেই কিশোর বেলা থেকে। আজকে আমার সেই দীর্ঘ দিনের রাত জাগানিয়া আরাধ্য বাসনা হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও বাস্তবে রূপ নিত। যদি না …এই অসহ্য মেয়েটা এখানে কাবাব মে হাড্ডি হবার জন্য উড়ে এসে জুড়ে না বসতো। আমি কথাগুলো ভাবছিলাম শুভ্রার ফর্সা দুই উরুর দিকে তাকিয়ে থেকে। একসময় চোখ সরে এসেছিল অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। মেয়েটা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। অদ্ভুত দুটি চোখ মেলে। এবার মনে হয় ওর অদ্ভুত চোখের বিশেষত্বটা আমি একটু একটু বুঝতে পারছি। ওই চোখে কোনো কৃত্রিম কাজল দেয়া নেই। চোখের কার্নিশে লেপ্টে থাকা কাজল কালো রেখা জন্মগত ভাবে পাওয়া। ওই চোখজোড়ার দিকে তাকালে পৃথিবীর যেকোন মানুষের মনে শুধুমাত্র একটি ছোট্ট অথচ শক্তিশালী শব্দের দৈব আবির্ভাব হবে, সেই শব্দটি হলো, ‘সুন্দর!’ 

আমার মনের দেয়ালেও ওই ছোট্ট শব্দটা উড়ে এসে বসলো ক্ষণকালের জন্য। কেন যেন আমি ওর জন্ম কাজল পরা চোখ দুটোর দিকে কিয়ৎ সময় স্থিরভাবে চেয়ে রইলাম। মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিল। শুভ্রা উঠে বসেছে তখন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘রুশ, প্লিজ হ্যান্ড মি আ ওয়াটার বটল।’ 

রুশমি 

সেন্টার টেবিলের ওপর মদের বোতলের পাশাপাশি কয়েকটা পানির বোতল রাখা ছিল। আমি একটা পানির বোতল হাতে তুলে নিতে নিতে আড়চোখে দেখলাম শিহাব বসা থেকে উঠে বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শুভ্রাদির দিকে বোতলটা এগিয়ে দিলাম। এক ঢোঁক পানি গিলতে গিয়ে ওর নাস্তানাবুদ অবস্থা হলো। হাত কাঁপছে সমানে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে পানি। টেবিলে ন্যাপকিন হোল্ডার রাখা ছিল। চট করে কয়েকটা ন্যাপকিন নিয়ে আমি ওর ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিলাম। শুভ্রাদির মুখটা খুব ধারালো রকমের সুন্দর। এখন সেই সৌন্দর্যের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। কপালের কাছের চুল হয়ে আছে এলোমেলো। লাল লিপস্টিকের দাগ ঠোঁটের সীমানা অতিক্রম করেছে। আমার বড় মায়া হচ্ছে ওকে দেখে। সে এক ঢোক পানি গিলেই শুয়ে পড়ল আবার। আমি নরম গলায় বললাম, ‘তোমার কি বেশি মন খারাপ লাগছে?’ 

শুভ্রাদি দাঁতে দাঁত চেপে বলল – ‘জনাথন … তুই জানিস? জনাথন একটা কুত্তার বাচ্চা। আ সান অফ আ বিচ!’ 

আমি হাঁটু গেঁড়ে বসলাম কার্পেটের ওপর। ওর মাথার ওপর একটা হাত রেখে বললাম, ‘ঠিক বলেছ। জনাথন মোটেও ভালো মানুষ না। তোমার উচিত ওকে ভুলে যাওয়া। কেন শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ?’ 

শুভ্রাদি রক্তলাল চোখজোড়া মেলে তাকালো এবার আমার দিকে। খুব চাপা স্বরে, যেন ষড়যন্ত্র করছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘শোন, জনাথনকে একটা শিক্ষা দিতে হবে, জন্মের শিক্ষা। ও ভেবেছে আমি ওর জন্য কেঁদে কেঁদে পাগল হবো। না সেটা কখনোই হবে না। আমি দুদিনের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলব!’ 

এই কথার প্রত্যুত্তরে কী বলা উচিত তা ঠিক বুঝে পেলাম না। শুভ্রাদি বিয়ে করলে যে জনাথনের খুব বেশি কিছু আসবে যাবে না এই বাস্তব সত্যটুকু আমি বুঝতে পারছি কিন্তু শুভ্রাদি কেন বুঝতে পারছে না? ও তো আমার থেকে বয়সে কম করে হলেও সাত বছরের বড় হবে। 

—‘তুমি বিয়ে করলে জনাথনের শিক্ষা হবে? তুমি শিওর?’

—‘আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর।’ 

—‘তাই?’ 

—‘হুম! শিহাবকে দেখে ওর হিংসা হবে। আমি এটাই চাই!’ 

হঠাৎ আমার চোখের সামনে যেন একটা জটিল সমীকরণের সমাধান হয়ে গেল। আমি চট করে বুঝে গেলাম যে এই পারিপাট্য প্রহসনের একমাত্র বলির পাঁঠা হলো শিহাব। ওই ছেলেটা শুভ্রাদিকে চায় এ কথা সত্য। কিন্তু কামনা করা আর ভালোবাসার মধ্যে তো বিস্তর ফারাক আছে! শিহাব এবং শুভ্রা এরা একে অপরকে ভালোবাসে না কোনোভাবেই। এই বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। কী করে নিশ্চিত হলাম জানি না। তবে মাঝে মাঝে আমি কিছু জিনিস টের পাই 

—‘তাড়াহুড়া করে কোনো ডিসিশন নেয়া ঠিক হবে না শুভ্রাদি।’ 

—‘তাড়াহুড়া করছি না। শিহাব আমাকে লাভ করে অনেক আগে থেকে। আমি একবার লুকিয়ে ওর ডায়রি পড়ে ফেলেছিলাম। পুরো ডায়রিতে শুধু আমার নাম লেখা ছিল। গাধাটা অবশ্য জানে না যে আমি ওসব পড়েছি।’ 

— ‘কিন্তু শুভ্রাদি, তুমি তো ওকে ভালোবাসো না।’

—‘ভালোবাসতে কতক্ষণ? তুই ওকে দেখেছিস? জনাথনের চেয়ে ও কোনো অংশে কম নয়।’ 

আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে জনাথনকে আমার কখনোই তেমন একটা ভালো লাগেনি। খুব বেশি ফর্সা, আর বেশি সুন্দর। ছেলেরা বেশি সুন্দর হলে মেয়েলি মনে হয়। আমার চোখে জনাথনের কোমল সৌন্দর্যের চাইতে শিহাবের ধারালো পৌরুষ হাজার গুণ বেশি আকর্ষণীয়। কিন্তু ছেলেটা আজ সকালে আমার গায়ে হাত দিয়েছিল। শুভ্রাদিকে কি ব্যাপারটা জানানো উচিত? কে জানে হয়তো ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। হুম …এখন মনে হচ্ছে শিহাব ইন্টেনশনালি ওই কাজ করেনি। ওর চোখের চাউনি দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে ও ক্যারেক্টারলেস না। তবে ওই ছেলে যত বড় সাধুই হোক না কেন, শুভ্রাদির জন্য কোনোভাবেই পারফেক্ট ম্যাচ নয়। শুভ্রাদির এখন উচিত নিজেকে সময় দেয়া। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া। হঠকারীতা কখনো সুফল বয়ে আনে না। নোবেল লরিয়েট অথর জন স্টেইনবেক তার টিনেজ পুত্রকে একবার চিঠিতে বলেছিলেন, ‘If it is right, it happens, The main thing is not to hurry. Nothing good gets away.’ শুভ্রাদিকে আমার এখন ঠিক এই কথাটিই শোনাতে হবে। কিন্তু আমি বল পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে শুভ্রাদি আমার কথা শুনে রেগে যাবে, ভুল বুঝবে। তবুও স্থিরসংকল্প হলাম। বোকা মেয়েটাকে যে করেই হোক বুঝিয়ে ছাড়ব যে সে ভুল করছে। 

—‘শুভ্রাদি শোনো, আমার মনে হয় তোমার এই মুহূর্তে শিহাবকে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না।’ 

—‘কেন?’ শুভ্রার চোখের তারা তখন দপ করে জ্বলে উঠেছে। একটু ভয় পেয়ে গেছি আমি। ওই রক্তচক্ষুর দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বলছি, 

—‘না মানে, আমার মনে হয় শিহাব তোমার যোগ্য নয়। ইউ ডিজার্ভ বেটার।’ 

শুভ্রাদি চোখ বন্ধ করল আবার। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে অস্পষ্ট গলায় কী যেন একটা বলল। বুঝতে পারলাম না। এদিকে ফোনের রিংটোন বেজে চলেছে। আমি টেবিলের ওপর রাখা পার্সটা হাতে নিয়ে, সেলফোন বের করলাম। লিও ফোন করছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে তিনটা বাজে। আমাকে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। লিওর সাথে আজ দেখা করা সম্ভব না। কিন্তু ও তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। তা হোক! যে কাজটা সে করেছে তার জন্যে একটু শাস্তি হওয়া উচিত। ওকে বুঝতে হবে আমি অন্য সব মেয়েদের মতো সহজলভ্য নই। আমাকে চাইলেই পাওয়া যায় না। আমাকে পাবার জন্য সাধনা করতে হয়। ওরে বাবা! নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠছি আমি। হঠাৎ ‘সাধনা’ শব্দটা মাথায় এলো কেন? সাধনা তো বড় কঠিন জিনিস। হায় রুশমি, একটা মেয়েকে পাবার জন্য সত্যিকারের সাধনা করবে এমন পুরুষ কি আজকের দুনিয়ায় আর আছে? সেসব শুধু রূপকথার গল্পে আর নাটক সিনেমায় হয়। বাস্তব পৃথিবীতে হয় না। আর তোমার জন্য এতটা কষ্ট কে করবে? নিজেকে তুমি ভাবো কী? … নিজেকে আমি তেমন কিছুই ভাবি না। কিন্তু এই মুহূর্তে ‘সাধনা’ শব্দটা আমাকে ভাবাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সাধনাতেই প্রকৃত সিদ্ধিলাভ হয়। আর সাধনার অভাবেই মানুষের জীবনের সম্পর্কগুলো, অনুভূতিগুলো ঠুনকো হয়ে যায়। সস্তা আবেগে ভেসে যায় মানুষ, শুভ্রার মতো। ভাবনার ঘোর ভাঙল শিহাবের আগমনে। আমি এখনো কার্পেটের ওপর বসে আছি শুভ্রাদির দিকে তাকিয়ে। শিহাবকে দায়সারা গলায় বলতে শুনলাম, ‘আই অ্যাম লিভিং। ইউ গাইজ হ্যাভ আ গুড ডে।’ 

শুভ্রাদি ওর গলার স্বর শুনতে পেয়ে উঠে বসল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম শিহাব সোফায় বসে একটু ঝুঁকে জুতোর ফিতে বাঁধছে। ওর গায়ে এখন কোট নেই। ফর্মাল সাদা শার্ট আর কালো টাই। কালো কাপড়ের প্যান্ট। শুভ্রাদি টাল মাটাল পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। শিহাব জুতো বাঁধা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে, ‘তুমি আবার উঠলে কেন? যাও রেস্ট নাও। পরে কথা হবে।’ 

দেখতে পেলাম শুভ্রাদি দু’হাত বাড়িয়ে শিহাবের গলা জড়িয়ে ধরছে। চোখ সরিয়ে নিলাম। আসলে শুভ্রাদি একটা ইম্পসিবল মেয়ে। ওকে যতই বোঝাও না কেন দিনশেষে ও নিজের মনমতো কাজটাই করবে। একটা তিক্ততা অনুভব করছিলাম ভেতরে ভেতরে। সোফার হাতলে ঝুলিয়ে রাখা কোটটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়ালাম। আমার আর এখানে থেকে কাজ নেই। শুভ্রাদির একটা ঘুম দরকার। ঘুমিয়ে মাথা পরিষ্কার হলে তবেই ওর সাথে কথা বলা যাবে। কোর্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে শুনলাম শিহাব বলছে ‘উঁহু এভাবে নয়।’ 

—‘কেন?’ শুভ্রাদির ছেলেমানুষি প্ৰশ্ন। 

খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। কোটের সবগুলো বোতাম লাগানোর পর যখন ঘুরে তাকালাম তখন দেখি শুভ্রাদি গুটিগুটি পায়ে সোফার দিকে ফিরে আসছে। শিহাব নেই ঘরে। 

শিহাব 

আমাদের বাড়ির পেছনে একটা উইলো ফরেস্ট আছে। জঙ্গলটা বেশ গভীর। এই নেইবারহুডে প্রতিটি বাড়ির সামনে এবং পেছনে যথেষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা থাকায় জঙ্গলের দিকে সাধারণ লোকের খুব একটা যাতায়াত নেই। উইন্টারে তো কেউ ভুলেও জঙ্গলমুখো হয় না। তবে আমার বনভ্রমণের জন্য কোনো বিশেষ ঋতু লাগে না। অরণ্য আমাকে সর্বদা টানে। উইলো ফরেস্টের গভীরে একটা ছোট্ট ক্রিক আছে। ‘ক্রিক’ শব্দটার বাংলা অর্থ আমি জানি না। ডিকশনারি দেখে জেনে নিতে হবে। মন খারাপের সময়গুলোতে আমি ক্রিকের ধারে চুপচাপ বসে থাকি। পাথরের ওপর দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ পানি বয়ে যায়। পানির স্রোতের শব্দে আশ্চর্য রকমের একটা টনিক আছে। শুনতে শুনতে নেশা লাগে। রক্তে একটা ঝিমঝিম ভাব হয়। কষ্টগুলো, দুশ্চিন্তা গুলো ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসে। এই মুহূর্তে আমি ক্রিকের ধারের একটা পাথরের ওপর বসে আছি। উইলো ফরেস্টের গাছগুলোর মাথায় কোনো পাতা অবশিষ্ট নেই। সারি সারি খয়েরি গাছ ডালপালা মেলে নির্জীব ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উইন্টারের এমন সবুজবিহীন বিষণ্ন সন্ধ্যাগুলোর একটা অন্যরকম তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য আছে। প্রকৃতি যেন এ সময় হিমালয় শৃঙ্গে ধ্যানমগ্ন কোনো জটাধারী ঋষি। সাদা আকাশ তার শান্ত, স্থির মুখ। ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলো ওর গেরুয়া রঙের পোশাক, আর খয়েরি গাছের ডাল মাথা ভর্তি চুলের জট। ভাবনাটা অদ্ভুত আমি জানি তবে শীতের সন্ধ্যাগুলোর খরসান সৌন্দর্য আমাকে জটাধারী ঋষির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় কেন যেন। একটু বাদেই সন্ধ্যা নামবে। পশ্চিমাকাশে আবীর রং। পাথরের ওপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে চলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এখন। সরু ক্রিকের ওপারে আমার মুখোমুখি অবস্থানে একটা চেরি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। চেরিগাছটা আমার ভীষণ প্রিয়। ওকে আমি ‘ড্রিমি চেরি ফেয়ারি’ ডাকি। বসন্তে মুক্তো দানার মতো ফুলে ওর শরীর যখন ভরে যায় তখন সত্যি ওকে দেখে একটা গোলাপি রঙের পরী বলে ভ্রম হয়। চেরি ফেয়ারির একটা লম্বা শুকনো ডাল ক্রিকের পানির ওপর হেলে পড়েছে। একটা নীল পাখনার কিংফিশার এই মুহূর্তে হেলে পড়া ডালটার ওপর উড়ে এসে বসেছে। পানির শব্দের সাথে পাখিটার টিউটিউ ডাক মিলেমিশে একটা সুরের মূর্ছনা তৈরী হয়েছে। 

আমার গায়ে নেভিব্লু রঙের মোটা জ্যাকেট, মাথায় হুডি। এক হাতে স্টারবাক্সের কফি অপর হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। মন বড় অশান্ত। পানির স্রোতের বশীকরণ শব্দ আর পাখির গান আজ আমাকে বশ করতে পারছে না। উইলো ফরেস্টের নিশ্ছিদ্র নির্জনতা ভেদ করে কী করে যেন অসংখ্য বিষধর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শব্দ আমার মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় অনবরত দুর্বোধ্য সব শাব্দিক কোলাহল তৈরী করে যাচ্ছে। ভেতরটা তুষানলে দগ্ধ হচ্ছে। পাপা আমার সাথে কী সব জরুরি কথা বলতে চেয়েছিল। আমি এড়িয়ে গেছি। রোজ প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় ওয়ার্কআউট করি। বাড়ির বেজমেন্টে ওয়ার্কআউট ইকুইপমেন্ট বসিয়ে ছোটোখাটো একটা জিম বানিয়ে ফেলেছি। ব্যায়াম করার সময় ফুল ভলিউমে গান শোনা আমার অভ্যাস। আজকেও তাই করছিলাম। মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটালো জাহিদ। হঠাৎ কোনো নোটিশ ছাড়াই বেজমেন্টে এসে হাজির হল। ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছি। ঘামছি দরদর করে। এমন সময় জাহিদ চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ভাইয়া, পাপা ডাকছে।’ আজকে আমার মেজাজটা মারাত্মক রকমের খারাপ। এতো মেজাজ খারাপ খুব কম সময়েই হয়ে থাকে। পাপার অহেতুক বকবকানি শোনার মতো অবস্থা আমার নেই। আমি জাহিদকে পরিষ্কার গলায় বললাম, ‘আজ নয়। পরে কথা বলব। মে বি টুমোরো।’ 

—‘পাপা এখনই কথা বলতে চায়।’ আমি হাপধরা গলায় বললাম, ‘পাপা চাইলেই তো হবে না। আমারও চাইতে হবে!’ জাহিদ আমার কথাটা শুনে কী বুঝল কে জানে। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। আমি জানি পাপা খুব রাগ হবে। কিন্তু আমি যে এ মুহূর্তে নিজের রাগটাকেই দমন করতে পারছি না কোনো ভাবে। অন্যের রাগের ধার ধারি কী করে? 

কাহিনী হচ্ছে, আমি ওদের কথা শুনতে পেয়েছিলাম। শুভ্রা আর রুশমির মধ্যে আজ বিকেলে আমাকে নিয়ে যে কথোপকথনটা হয়েছিল তার অংশবিশেষ আমার কানে এসেছে। বারান্দা থেকে ড্রইংরুমে ঢুকবার মুখেই শুনতে পেলাম রুশমি, দ্যা আল্টিমেট ডিজাস্টারকে শুভ্রা বলছে – ‘ভালোবাসতে কতক্ষণ? তুই ওকে দেখেছিস? জনাথনের চেয়ে ও কোনো অংশে কম নয়।’ 

এরপর মিস ডিজাস্টারকে স্পষ্ট গলায় বলতে শুনলাম, ‘আমার মনে হয় শিহাব তোমার যোগ্য নয়। ইউ ডিজার্ভ বেটার।’

প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলাম মেয়েটা আমাকে কিছুতেই সহজ ভাবে নিতে পারছে না। আমার সাথে হ্যান্ডশেক করতেও তার আপত্তি ছিল। এরকম অপমান আমাকে এর আগে কেউ কোনোদিন করেনি। কিন্তু শুভ্রাকে যে সরাসরি আমার বিরুদ্ধে বলে বসবে …তা ছিল ভাবনার অতীত টিপিক্যাল বাংলাদেশি আচারবদ্ধ মেয়েদের দ্বারাই এসব সম্ভব। এরা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে ভালোবাসে। শুভ্রাকে আমি পছন্দ করি কথা ঠিক। কিন্তু ওকে পাবার জন্য নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে কোনো মতেই রাজি নই। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুভ্রা মন থেকে আমাকে ভালো না বাসলে বিয়েটা আমি করব না। আজকে চলে আসার সময় ও আমাকে চুমু খেতে চেয়েছিল। আমি বলেছি ‘এভাবে নয়।’ একটু পরে বুঝেছি কথাটা আসলে আমি বলিনি আমার ভেতর থেকে অন্য কেউ বলে উঠেছিল। যে বলেছে তাকেই হয়তো সচরাচর আমরা ইগো নামে অভিহিত করে থাকি। সত্যিই এভাবে ওকে কখনো চাইনি। মাতাল শুভ্রার ভালোবাসার কোনো দাম নেই আমার কাছে। আমি চাই ও সজ্ঞানে এবং সচেতন মনে আমাকে ভালোবাসুক। আমি অপেক্ষা করব। যতদিন না শুভ্রা আমাকে মন থেকে চাইবে, ততদিন পর্যন্ত ওর সাথে কোনো রকমের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হব না। আমি জানি শুভ্রা আজ নয় কাল আমাকে ভালোবাসবেই। বাসতেই হবে। এতকাল আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। আমি শুধু একজন সত্যিকারের মানুষ হতে চেয়েছিলাম। ভালো চাকরি, দামি বাড়ি, গাড়ি বিলাসিতা আমার স্বপ্ন ছিল না কোনোকালে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমার এই বিষয়বিমুখ, উদ্দেশ্যহীন জীবনে আচমকা একটা লক্ষ্যযুক্ত তীরের আবির্ভাব হয়েছে। সেই লক্ষ্যের নাম শুভ্রা। শুভ্রার মনটা আমাকে পেতেই হবে। এসব ঘটনার বহুদিন পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে সেই বিকেলে আমার বুকের ভেতরে যে দুর্দমনীয় অভীষ্ট ‘লক্ষ্য’ হঠাৎ করেই আসন গেড়ে বসেছিল, সেই লক্ষ্য বা গন্তব্য আদতে শুভ্রা নামের কোনো মানুষী ছিল না। ছিল অন্য কিছু বা অন্য কেউ। 

হ্যাংলামো জিনিসটা আমার একেবারে পছন্দ না। শুভ্রা আজ মাতাল হয়ে হ্যাংলামো করছিল। ওকে সেই মুহূর্তে আমার একটুও ভালো লাগছিল না। এর চেয়ে বরং আমার সেই পুরোনো দিনের একটু মুডি, একটু রাশভারী, আর একটু অহংকারী শুভ্রাদিই অনেক বেশি ভালো ছিল। যাই হোক, ওর সবটা নিয়েই আমি ওকে ভালোবেসেছি। খারাপ হোক, ভালো হাক, ওকেই আমার চাই। এই মুহূর্তে অবশ্য চাওয়া পাওয়ার কথা আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি হারজিতের কথা। আমার মনে হচ্ছে যে কোনো উপায়ে শুভ্রার ভালোবাসা আমাকে জিতে নিতেই হবে। রুশমি নামের মেয়েটা আমাকে বড় বেশি অবমূল্যায়ন করে ফেলেছে। এতটা ঠুনকোও আমি নই। কী মেয়েরে বাবা! দেখে বোঝার উপায় নেই এই মেয়ে একবিংশ শতাব্দীর, প্রথম বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের একজন শিক্ষিত নাগরিক। অবশ্য এই কথাগুলো যখন ক্রিকের ধারে একলা বসে আনমনে ভাবছিলাম আমি, তখনও জানতাম না মাত্র কদিন পরেই আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যে ঘটনাটি আধুনিক যুগের যেকোনো মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। সত্যিই মানুষের জীবন কী বিচিত্র সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ সর্বদা! ভাবতে অবাক লাগে! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *