হিরোহিতোর গবেষণা
চিঠিটা পেলাম বিকালের ডাকে।
আমি তখন সবেমাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরেছি। খামের কোণে নীল রঙের এমব্লেম আর বোস্টনের ছাপ দিখেই ধারণা করেছিলাম চিঠিটা প্রফেসর হিরোহিতোরই হবে। মনটা সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠল। ছ-মাস তার কোনো খবর পাইনি। স্বেচ্ছ্বানির্বাসনে আছেন তিনি। এমনকী টেলিফোন লাইনও তিনি কেটে দিয়েছেন। পাছে কেউ তাঁর গবেষণার কাজে ব্যাঘাত ঘটায় সে জন্য।
খামটা খুলতেই দেখলাম, আমার অনুমানই সত্যি। আমাকে ছোট্ট একটা চিঠি পাঠিয়েছেন হিরোহিতো। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম চিঠিটা।
‘বন্ধুবর, প্রফেসর মজুমদার,
আশা করি আপনি কুশলে আছেন। কাজের চাপে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। আসলে আমার ভয় ছিল আমি কাজটা শেষ করতে পারব কিনা তা নিয়ে। কিন্তু আপনি জেনে খুশি হবেন যে, শেষ পর্যন্ত আমি এক অসাধ্যসাধন করেছি। রোবট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার হাল আমলের ”নেক্সি” কে পিছনে ফেলে চমকে দেবে পৃথিবীকে।
আপনি আমার গবেষণার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবগত আছেন। গোপনীয়তার কারণে চিঠিতে তার আর উল্লেখ করা সমীচীন বোধ করছি না।
যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসি। বিশ্বের কাছে আমার আবিষ্কার তুলে ধরার আগে আমি আপনাকে তা একবার দেখিয়ে নিতে চাই। এর একটা কারণও আছে। আপনি জানেন আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এক দিকে মারণ রোগ, অন্য দিকে গবেষণার কাজে প্রচণ্ড পরিশ্রম—এই দুয়ের মিলিত কারণে আমার শরীর ভেঙে পড়েছে। যদি আমার তেমন কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমার অবর্তমানে বিশ্বের কাছে আমার আবিষ্কার উপস্থিত করতে পারবেন আপনি। আমরা দুজনই এশীয়। তাছাড়া আপনি সৎ ব্যক্তি। আমি জানি, সে ক্ষেত্রে আমার আবিষ্কার আপনি আত্মসাৎ করবেন না। আমার অনুরোধ, এই চিঠি পাওয়ার পর যত শীঘ্র সম্ভব আমার এখানে চলে আসুন।
ধন্যবাদ্য সহ
প্রফেসর আকিরা হিরোহিতো
বোস্টন।
পুনশ্চঃ আমাদের আর এক বন্ধু ডক্টর ম্যাককেও আমি আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমার ধারণা তিনি এবার তাঁর মত পরিবর্তনে বাধ্য হবেন। প্রয়োজন বোধ করলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দুজনে একসঙ্গে আসতে পারেন।’
চিঠিটা পাঠ করে মনের মধ্যে একইসঙ্গে আনন্দ ও দুঃখের অনুভূতি হল। প্রফেসর হিরোহিতো দীর্ঘদিন রোবট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বাপেক্ষা কঠিনতম গবেষণায় রত। তা হল, রোবটের মধ্যে মানবিক অনুভূতির সঞ্চার ঘটানো। অর্থাৎ কোনো ঘটনা দেখে মানুষ যেমন তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কাঁদে—হাসে, ক্রুদ্ধ হয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, তেমনই অভিব্যক্তির প্রকাশ রোবটের মধ্যে ঘটানো। রোবট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা জটিল কাজ এটা। রোবটের এই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে কয়েক দশক ধরেই গবেষণা চলছে। সাফল্যও কিছু এসেছে। অতি সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা ‘নেক্সি’ নামে এক যন্ত্রমানব তৈরি করেছে, যা তার চোখে বসানো দুটো সিসিডি ক্যামেরা দিয়ে পরিবেশ থেকে হাসির উপাদান খুঁজে নিয়ে হাসতে পারে। তাকে নিয়ে ফ্রান্সের ‘লাভালে’ এক প্রদর্শনীও হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রোবট বিজ্ঞানীরা তাকে দেখে একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে এযাবৎ কালের মধ্যে রোবট বিজ্ঞানের সেরা আবিষ্কার হল নেক্সি।
প্রফেসর হিরোহিতোর আবিষ্কার নেক্সিকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে? হ্যাঁ, এমনটাই তো দাবি করেছেন হিরোহিতো! আমি নিজেও একজন প্রযুক্তিবিজ্ঞানী। তাই প্রফেসর হিরোহিতোর সাফল্যের খবর পেয়ে বেশ আনন্দিত ও উত্তেজিত বোধ করলাম। হয়তো এই আবিষ্কার প্রফেসরকে নোবেলও এনে দিতে পারে। আবার তার পাশাপাশি চিঠির শেষ অংশ পড়ে মনটা ভারী হয়ে গেল। প্রচণ্ড মেধা ও ধীশক্তির অধিকারী, সদা হাস্যময়, মিষ্টভাষী হিরোহিতো সকলের কাছেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ব্যক্তি। মারণ রোগ তাঁকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে জেনে মনটা একইসঙ্গে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
চিঠিটা পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। যত দ্রুত সম্ভব প্রফেসর হিরোহিতোর আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য যাব। এরপর আমি টেলিফোন করলাম ডক্টর ম্যাককে, সে হিরোহিতোর কোনো আমন্ত্রণ পেয়েছে কিনা তা জানার জন্য। ম্যাকও বোস্টনে থাকে। বোস্টন আর্মি হাসপাতালের স্নায়ুরোগ বিভাগের প্রধান সে। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমি যখন ভারত থেকে, আর হিরোহিতো জাপান থেকে নিজ নিজ কাজে এদেশে আসি, তখন ম্যাক আর আমরা দুজন এই বাল্টিমোরে একই মেসে থাকতাম। বহু দিনের পরিচয় আমাদের তিনজনের। তবে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে’র বিষয় নিয়ে একটা বিরোধ আছে প্রফেসর হিরোহিতো আর ডক্টর ম্যাকের মধ্যে। ম্যাক মানতে চায় না যে যন্ত্রের মধ্যে মানবিক গুণ সঞ্চার করা সম্ভব। সে মনে করে রোবটকে মানুষের আকৃতি প্রদান, হাঁটানো, চলানো, কথা বলানো যায় সত্যি, কিন্তু তার মধ্যে মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো? নৈব নৈব চ। আর হিরোহিতোর মত হল মানবদেহও তো একটা যন্ত্র ভিন্ন কিছুই নয়। তাই তার মধ্যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটলে যন্ত্রের মধ্যেও তা ঘটানো সম্ভব। অবশ্য তাদের দুজনের মধ্যে এ বিরোধ নিছকই দর্শনগত। ব্যক্তিগত স্তরে তার কোনো ছাপ নেই। তারা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে, সম্মান করে।
ম্যাককে ফোন করতেই আমার উল্লেখিত ধারণা যে ভ্রান্ত নয় তা বুঝতে পারলাম। ম্যাক আমাকে উৎফুল্লভাবে জানাল যে, গত ছ-মাস ধরে তারও প্রফেসর হিরোহিতোর সঙ্গে দেখা না হলেও তাঁর চিঠি সেও পেয়েছে। যদিও সে ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে, হিরোহিতো যদি সত্যি সাফল্য লাভ করে থাকেন তবে আমার চেয়ে সে কম সুখী হবে না। ম্যাকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ঠিক হল, একদিন পরেই আমি পৌঁছব ম্যাকের বাড়িতে। তারপর দুজনে একসঙ্গে যাব প্রফেসর হিরোহিতোর বাড়িতে।
।।২।।
একদিন বাদে আলোচনা মতো বাল্টিমোর থেকে লং ড্রাইভে বিকাল নাগাদ পৌঁছে গেলাম বোস্টনে ডক্টর ম্যাকের বাড়িতে। প্রাণচঞ্চল বোস্টন শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে ম্যাকের বাড়ি। একসময় আমি প্রায় চলে আসতাম এখানে। এখন কাজের চাপে আর আসা হয় না। বেশ অনেকদিন পর এলাম বোস্টনে। ম্যাকের বাড়িতে ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়াল ম্যাক আর তার স্ত্রী ন্যান্সি। সেও আমার পূর্বপরিচিতা। দুজনেই আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল।
ম্যাক বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কী প্রফেসর হিরোহিতোর চিঠিটা পাবার পর থেকে আমিও বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলাম। যখন তুমি আমাকে ফোন করলে, তখন আমি তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’ তার কথা শুনে আমি হেসে বললাম, ‘প্রফেসরের চিঠি পড়ে আমার যা মনে হচ্ছে তাতে তুমি তার কাছে সম্ভবত হেরেই গেলে।’
ম্যাক জবাব দিল, ‘সেটা ওর ওখানে না গেলে ঠিক বোঝা যাবে না। আমি কিন্তু আমার ধারণাতেই অটল।’
আমি এরপর জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, তুমি আর প্রফেসর তো একই শহরে থাক। এরমধ্যে তোমাদের দুজনের দেখা হয়েছে?
ম্যাক বলল, ‘না, গত ছ-মাসে একদিনের জন্যও দেখা হয়নি। তবে তার বাড়িতে যে ছোকরা চাকরটা ছিল বিল নামের, তার সঙ্গে মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হত আমার। যদিও খুব বেশি সংবাদ তার থেকে আমি প্রফেসরের সম্বন্ধে পাইনি। দিন সাতেক আগে সে একবার বলছিল প্রফেসরের শরীরটা নাকি বিশেষ ভালো নেই। আজ সকালে আবার হঠাৎ দেখা হয়েছিল বিলের সঙ্গে। সে দুঃখ করে বলল, দু-দিন হল হিরোহিতো নাকি চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করেছেন।’
আমি বললাম, ‘কেন, বরখাস্ত করলেন কেন? বিল তো বেশ প্রিয়পাত্র ছিল হিরোহিতোর। তার মুখে ওর প্রশংসাও শুনেছি।’
ম্যাক জবাবে বলল, ‘তা জানি না, বিল যা বলল তাতে তারও নাকি ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। রোজকার মতো কাল সকালে সে প্রফেসরের বাড়িতে যেতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হিরোহিতো নাকি তাকে বলেছেন যে তাকে আর কাজে আসতে হবে না। বেচারাকে বাড়ির ভিতরেও ঢুকতে দেননি তিনি। তার হাতে একটা চেক ধরিয়ে দিয়ে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন।’
আমি শুনে মন্তব্য করলাম, ‘প্রফেসর তো খুব হৃদয়বান মানুষ। নিশ্চয় বিলকে বরখাস্ত করার পেছনে কোনো কারণ আছে যেটা বিল চেপে গেছে। হিরোহিতোকে কোনোদিন কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি।’
ম্যাক বলল, ‘তা হতে পারে।’
ম্যাক এরপর হিরোহিতোর সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে চলে গেল আমাদের পুরোনো দিনের প্রসঙ্গে। যুবা বয়সে আমরা কেমন যখন-তখন লং ড্রাইভে গিয়ে আনন্দ করতাম, আমাদের পুরোনো সঙ্গীরা কে কোথায় কী করছে এসব বিষয়ে অনেক দিন পর স্মৃতি রোমন্থন হতে লাগল। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে খাওয়া হয়নি আমার। ন্যান্সি খাবার নিয়ে এল আমার জন্য। গল্পগুজব, খাওয়া সেরে, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আমরা যখন হিরোহিতোর বাড়ি যাবার জন্য বাইরে এলাম তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আজ ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ। এদিকে বেশ ঠান্ডাও পড়তে শুরু করেছে। আমাদের যেতে হবে শহরের বাইরে বোস্টন বন্দরের দিকে। অতঃপর আমরা রওনা হয়ে গেলাম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে।
শহরের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম আমরা। ক্রিসমাস আর নিউইয়ার্স ইভের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বড় বড় হাইরাইজ আর শপিং মলগুলো সেজে উঠেছে আলোকমালায়। একসময় এই আলোকোজ্জ্বল নগরীকে পেছনে ফেলে বন্দরের দিকে এগোতে লাগলাম। তারপর তার কাছাকাছি পৌঁছে সমুদ্রের সমান্তরাল গাছে ঘেরা একটা নির্জন রাস্তা ধরলাম। এদিকে লোকজন বিশেষ থাকে না। অনেক দূরে দূরে কয়েকটা বাড়ি আছে মাত্র। বোস্টন বন্দরের জাহাজের ‘ভোঁ’ ছাড়া নগরীর অন্য কোনো কোলাহল এদিকে এসে পৌঁছয় না। নিরিবিলিতে কাজ করার পক্ষে একদম আদর্শ জায়গা বেছেছেন হিরোহিতো। যত তার বাড়ি এগিয়ে আসতে লাগল তত বুকের ভিতর কেমন যেন একটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম আমি। সেই রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ি চলার পর অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম আমরা।
।।৩।।
গাড়ি থেকে নামার পরই বুঝতে পারলাম বাইরে বেশ ঠান্ডা। প্রাচীর ঘেরা বিরাট কম্পাউন্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গাছে ঘেরা সাবেকি আমলের বাড়িটা। এ বাড়ি আগে কোনো জাহাজীর ছিল। পরবর্তীকালে হিরোহিতো কিনে নেন। এ বাড়িতে এর আগে আমরা অনেকবার এসেছি। অকৃতদার হিরোহিতো একলাই থাকেন এখানে।
অন্ধকারের মধ্যে কুয়াশার চাদর মুড়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বড় বাড়িটা। কোনো আলো জ্বলছে না। ম্যাক বলল, ‘কেমন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ, তাই না। পাওয়ার কাট? নাকি উনি বাড়িতে নেই?’
কম্পাউন্ডের ভিতরে ঢুকে গাছে ঘেরা মোরাম বিছনো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেল বাজালাম। কয়েক বার সেটা বাজাবার পর ভিতর থেকে সম্ভবত প্রফেসরেরই গলা ভেসে এল, ‘কে—?’
আমি উচ্চ কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘আমি মজুমদার, আর ম্যাক। আমরা এসেছি।’
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর দরজার ওপাশে একটা মৃদু খসখস শব্দ পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন প্রফেসর হিরোহিতো। তাঁর হাতে একটা মোমবাতি। একটা লম্বা ঝুলের ওভারকোট তাঁর গায়ে। পায়ে জুতো, হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি। কপালের অর্ধেক অংশ তাতে ঢাকা পড়ে আছে। আমি ভেবেছিলাম এতদিন বাদে তার সঙ্গে দেখা হবার পর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি উল্লসিত হয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু তিনি মোমবাতিটা একটু উঠিয়ে ধরে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। যেন তিনি অপরিচিত কাউকে দেখছেন।
আমি কয়েক মুহূর্ত পর হেসে ফেলে বললাম, ‘তা আমরা কি ঠান্ডার মধ্যে বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। ভিতরে ঢুকব না।’
মোমের আলোতে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল। প্রফেসরের মুখে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ভিতরে আসুন।’
প্রফেসরের পিছন পিছন আমরা গিয়ে বসলাম ড্রয়িংরুমে। ঘরের চারপাশে বইয়ে ঠাসা আলমারি। দেওয়ালের মাথার দিকে এক জায়গাতে ঝুলছে আমাদের তিনজনের বাঁধানো ফটোগ্রাফ। অনেকদিন আগে আমরা এ ছবিটা তুলেছিলাম। আমার বাড়িতেও একটা কপি আছে। প্রফেসর হিরোহিতো মোমটা আমাদের সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে উলটো দিকের একটা চেয়ারে বসে দেওয়ালে ঝোলানো ফোটোগ্রাফটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীরভাবে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
ম্যাক চারপাশে একবার তাকিয়ে বলল, ‘ইলেকট্রিসিটি নেই দেখছি। কোনো কিছু খারাপ হয়েছে নাকি?’ হিরোহিতো কোনো জবাব দিলেন না। একইভাবে চেয়ে রইলেন।
আমি হিরোহিতোকে এরকম নিশ্চুপ দেখে এবার বললাম, ‘প্রফেসর, আপনার শরীরটা কি ইদানীং খুব বেশি খারাপ হয়েছে?’
হিরোহিতো সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘এখন ঠিক আছি।’ তারপর আমাদের চমকে দিয়ে বললেন, ‘তা আপনারা দুজন হঠাৎ আমার কাছে কেন এলেন বলুন তো?’
আমি বললাম, ‘আমরা দুজন আপনার চিঠি পেয়ে এখানে এসেছি। আপনার আবিষ্কার দেখব বলে।’
হিরোহিতো আমার কথা শুনে দু-হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বললেন, ‘ও! আসলে শেষ ক-দিন আমার এত পরিশ্রম গেছে যে মাঝে মাঝে কিছুই মনে রাখতে পারছি না।’
ম্যাক বলল, ‘আমার মনে হয় আপনার টানা কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। আপনার কাজ তো শেষ হয়ে গেছে বলে চিঠিতে লিখেছেন।’
হিরোহিতো শুধু ঘাড় নাড়লেন তার কথা শুনে। তারপর চেয়ে রইলেন টেবিলের দিকে।
আমি এরপর আবিষ্কারের প্রসঙ্গটা উত্থাপন করব ভাবছিলাম। কিন্তু ঠিক তখনই এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল যে তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। কথা শুরু করতে যাব আমি, এমন সময় একটা রিনরিন শব্দ শুনে দেখি ঘরের উলটোদিকের একটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে হিরোহিতোর আদরের ছোট্ট পাগ জাতীয় কুকুরটা। কোথাও মনে হয় সে এতক্ষণ বাঁধা ছিল। চেন সমেত খুলে চলে এসেছে। মাটির সঙ্গে চেনের ধাতব ঘষটানিতে রিনরিন শব্দ হচ্ছে। ম্যাক নিজে পশুপ্রেমী। তার বাড়িতেও একসময় কুকুর ছিল। পাগটাকে দেখেই সে উৎফুল্লভাবে ডাকল, ‘আয়, আয়, এদিকে আয়।’
কুকুরটা কিন্তু কাছে এল না। আমাদের একবার দেখে নিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রফেসর হিরোহিতোর দিকে তাকিয়ে গজরাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রফেসর। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘যা, ভাগ বলছি এখান থেকে, ভাগ ভাগ। দু-দিন ধরে তুই জ্বালিয়ে মারছিস আমাকে। যা ভাগ—’
হিরোহিতোর কথা শুনে চলে না গিয়ে চিৎকারের মাত্রা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল কুকুরটা। আর তার পরক্ষণেই এক অস্বাভাবিক কাণ্ড করে বসলেন প্রফেসর। চেয়ার ছেড়ে ছুটে গিয়ে চেন সমেত কুকুরটাকে তুলে নিয়ে আমরা তাকে বাধা দেবার আগেই দরজার কাছে গিয়ে বাইরে অন্ধকারের মধ্যে আছড়ে ছুড়ে ফেললেন কুকুরটাকে। প্রাণীটার করুণ আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হল বাইরের অন্ধকারে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাক প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এ আপনি কী করলেন প্রফেসর?’ প্রফেসর ফিরে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘যা করেছি ঠিক করেছি। আপনি আমার কুকুরের ব্যাপারে বলার কে?’ তার কথা শুনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল ম্যাক। সদাহাস্যময়, সহৃদয় প্রফেসরের থেকে এরকম কর্কশ অমানবিক ব্যবহার আমরা আশা করিনি। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। আর হিরোহিতো ম্যাকের কথার জবাব দিয়ে আবার নিজের চেয়ারে ফিরে এসে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন আমাদের। পুরো ব্যাপারটাতে ধাতস্থ হতে আমাদের বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল। আমি ভাবলাম হিরোহিতো নিশ্চয়ই তাঁর স্বভাববিরুদ্ধভাবে হঠাৎ কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তাই ঘরের পরিবেশটাকে আবার অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে আমি বললাম, ‘তাহলে প্রফেসর, এবার আমরা আপনার সেই আশ্চর্য আবিষ্কার দেখতে পারি কি?’
আমার কথা শুনে প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘আমি দুঃখিত, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছি আমি। আপনাদের সেটা দেখানো সম্ভব নয়।’
ম্যাক বলে উঠল, ‘তার মানে শুধু শুধু আমাদের এখানে ডেকে আনলেন আপনি। অবশ্য আমি এখনও বিশ্বাস করি যে যন্ত্রের মধ্যে পুরোপুরি মানবিক গুণ সঞ্চার করা সম্ভব নয়। খুব বেশি হলে ওই নেক্সির মতো তাকে হাসানো বা কাঁদানো যেতে পারে। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।’
ম্যাকের কথার শেষ অংশের শ্লেষটা ধরতে পেরে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হিরোহিতো ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এ বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আমি তর্ক করতে যাব না। আমার এখন কাজ আছে। আপনারা এবার যান।’
হিরোহিতো যেন এই কথাটা বলার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। এরপর আর বসে থাকা যায় না, তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের পিছনে সশব্দে দরেজা বন্ধ করে দিলেন প্রফেসর।
ম্যাক বাইরে চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করল, ‘আশ্চর্য! এমন অদ্ভুত ব্যবহার করলেন কেন উনি?’ আমিও তখন ম্যাকের মতোই বিস্মিত প্রফেসরের ব্যবহারে। কিছু দূরে মাটিতে নিশ্চুপভাবে পড়েছিল হিরোহিতোর কুকুরটা। ম্যাক তাকে পরীক্ষা করে বলল, ‘এখনও কুকুরটার প্রাণ আছে। তবে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আর ও বাঁচবে না। এটাকে আমি এখন নিয়ে যাই।’ এই বলে সে কোলে তুলে নিল প্রাণীটাকে। আমরা এরপর তাকে নিয়ে এগোলাম কম্পাউন্ডের বাইরে দাঁড়ানো গাড়ির দিকে।
সারা রাস্তা আমরা আলোচনা করলাম প্রফেসর হিরোহিতোর অদ্ভুত আচরণ নিয়ে। কিন্তু তার কারণটা কেউই বুঝতে পারলাম না।
সে রাতটা ম্যাকের বাড়িতেই কাটালাম। পরদিন ভোরে রওনা দিলাম বাল্টিমোরে ফেরার জন্য। ফেরার সময় ন্যান্সিও আমার সঙ্গী হল। বাল্টিমোর পর্যন্ত আমার সঙ্গে এসে সে চলে গেল ওয়াশিংটনে তার ছেলের কাছে ক্রিসমাস, নিউইয়ার্স ইভের ছুটি কাটাতে।
।।৪।।
বোস্টন থেকে ফিরে আসার পর চারটে দিন কেটে গেল। এর মধ্যে যে হিরোহিতোর কথা আমার মনে পড়েনি তা নয়, তবে কাজের কিছু চাপ ছিল, বেশি ভাবার সুযোগ পাইনি। পঁচিশে ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে বোস্টনে ম্যাককে ফোন করলাম বড়দিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর প্রফেসর হিরোহিতোর কোনো সংবাদ আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করতেই ম্যাক বলল, ‘না, তার কোনো খবর নেই। আমি ভাবছি তার বাড়িতে আজ বিকেলে একবার যাব। আমার মনে হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে তার স্নায়বিক কোনো সমস্যা হয়েছে, তাই তিনি আমাদের সঙ্গে ওরকম রুক্ষ ব্যবহার করলেন। স্নায়বিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার ওকে সাহায্য করা প্রয়োজন। তাছাড়া ওর কুকুরটাও সুস্থ হয়ে উঠেছে। প্রফেসর আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। হয়তো তিনি এখন আমাদের প্রতি ব্যবহারে দুঃখিত, কিন্তু লজ্জায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।’
ম্যাকের কথা শুনে আমি সহমত পোষণ করলাম। ম্যাক বলল, প্রফেসর হিরোহিতোর বাড়ি থেকে ফিরে রাতে সবিস্তারে সব কিছু জানাবার জন্য ফোন করবে আমাকে।
সেদিন রাতে ম্যাকের ফোন কিন্তু এল না। গভীর রাত পর্যন্ত তার ফোনের অপেক্ষায় থাকার পর তার সেলফোনে বা ল্যান্ডফোনে—কোথাও তাকে ধরতে পারলাম না আমি।
পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ ওয়াশিংটন থেকে ফোন এল ন্যান্সির। একটু উদ্বিগ্নভাবে সে আমার কাছে জানতে চাইল ম্যাকের কোনো খবর আমার জানা আছে কী না? গত চব্বিশ ঘণ্টায় সে ম্যাককে অনেকবার ফোন করেও পায়নি।
আমি তাকে আগের দিন সকালে টেলিফোনে ম্যাকের সঙ্গে কথোপকথনের কথা বললাম। আমিও যে তাকে ধরতে পারছি না সেটাও জানালাম।
ন্যান্সি ফোন ছেড়ে দেবার পর আমি আবার ম্যাকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। তার বাড়ির ফোনটাতে রিং হয়ে গেল, সে ধরল না। আর তার মোবাইল ফোনটা সুইচড অফ। এরপরই আমার ম্যাকের জন্য কেমন যেন দুশ্চিন্তা শুরু হল। তার কিছু বিপদ হয়নি তো? আমার হাতে এখন কিছু কাজ নেই। ঠিক করলাম আর একবার বোস্টনে ঘুরে আসি। সেইমতো আমার গাড়ি নিয়ে সেই রাতেই বাড়ি ছাড়লাম আমি।
।।৫।।
বোস্টনে পৌঁছে প্রথমেই আমি উপস্থিত হলাম ম্যাকের বাড়ি। দেখলাম তার বাড়ির সদর দরজায় তালা বন্ধ। দরজার সামনে পড়ে আছে দু-দিনের সংবাদপত্র। তার মানে কি দু-দিন বাড়ি ফেরেনি ম্যাক? ওর ল্যান্ডফোনটা কেউ ধরেনি কেন এবার তা বুঝতে পারলাম। ম্যাকের বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাববার পর আমি আমার পরবর্তী গন্তব্য স্থির করে নিলাম। আমি যাব প্রফেসর হিরোহিতোর বাড়ি। ম্যাক আমাকে জানিয়েছিল সে সেখানে যাবে। আর সেদিন সন্ধ্যা থেকেই সে নিখোঁজ। এমন হতে পারে ম্যাক কোনো কারণে প্রফেসরের বাড়িতেই রয়েছে। হয়তো হিরোহিতোকে কোনো সাহায্য করার জন্যই। অথবা সে অন্য কোথাও গেলে সেকথা প্রফেসরকে জানিয়েও যেতে পারে। যদিও প্রফেসর আমাদের সঙ্গে সেদিন খুব একটা ভালো ব্যবহার করেননি, তবু এসব কথা চিন্তা করে হিরোহিতোর বাড়ির উদ্দেশে এরপর রওনা দিলাম আমি।
নির্জন দুপুর। প্রফেসরের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল প্রফেসরের বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের একটা ক্যাডিলাক গাড়ি। ও গাড়ি আমি চিনি। তার মানে ম্যাক এখানে এসেছে। উৎসাহিত হয়ে কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে সোজা এগোলাম বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনের দিকে সব দরজা-জানলা ভিতর থেকে বন্ধ। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমি বার কয়েক কলিং বেল বাজালাম। তারপর দরজায় ঘা দিয়ে প্রফেসরের নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া এল না। হঠাৎ আমার মনে হল, বাড়ির পিছন দিকে যে দিকে— প্রফেসরের ল্যাবরেটরি, সেদিক থেকে মাঝে মাঝে কীসের যেন শব্দ ভেসে আসছে। মনে হল, হয়তো প্রফেসর সেদিকে আছেন বলে আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। গাছে ঘেরা বাড়িটাকে বেড় দিয়ে এরপর আমি পা বাড়ালাম বাড়ির পিছনের অংশে যাবার জন্য। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। একটা গাছের তলায় মরে পড়ে আছে প্রফেসরের পাগটা। প্রাণীটার দেহে পচন ধরেছে। গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রাণীটা কেন মরল, বা মৃতদেহটা বা কেন এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার পাশ কাটিয়ে এগোলাম বাড়ির পিছন দিকে।
উপস্থিত হলাম বাড়ির পিছন দিকে। সেদিকের দরজাটা হাট করে খোলা। হ্যাঁ, সেই শব্দটা আসছে বাড়ির ভিতর প্রফেসরের ল্যাবরেটরি বা তার সংলগ্ন কোনো ঘর থেকেই। আমি প্রবেশ করলাম বাড়ির ভিতর। তারপর উপস্থিত হলাম প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে। বিরাট ল্যাবরেটরির চারপাশে অজস্র নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে আছে কিন্তু হিরোহিতো বা ম্যাক সেখানে নেই। এবার আমি বুঝতে পারলাম ল্যাবরেটরি থেকে যে লম্বা বারান্দাটা চলে গেছে বাড়ির সামনের অংশে, সেই বারান্দার দু-পাশের কোনো একটা ঘর থেকে শব্দটা আসছে। ল্যাবরেটরি ছেড়ে আমি পা রাখলাম বারান্দাতে। বারান্দার দু-পাশে সার সার ঘর। কিন্তু সেই শব্দটা কেন জানি না থেমে গেল। আর একটা তীব্র পচা গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। এত পচা গন্ধ যে গা গুলিয়ে আসছে। রুমাল চাপা দিতে হল নাকে। কয়েক পা এগিয়ে বারান্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আমি চিৎকার করে ডাকলাম, ‘প্রফেসর হিরোহিতো, আপনি কোথায়?’
ঠিক সেই সময় আবার শব্দটা হল। বারান্দায় একটা ঘরের ভিতর থেকে কেউ বন্ধ দরজা ধাক্কাচ্ছে। আর তারপরই সেই ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকের কণ্ঠস্বর। ‘মজুমদার, তুমি! শিগগির দরজা খুলে দাও, শিগগির!’
আমি ম্যাকের কণ্ঠস্বর শুনে সেই ঘরের কাছে ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই ম্যাক সেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। রক্তাক্ত তার চেহারা। মুখে একটা আতঙ্কের ভাব!
আমি তাকে দেখে বললাম, ‘ম্যাক তোমার কী হয়েছে? তোমার এ অবস্থা কেন? প্রফেসর কোথায়?’
আমার প্রশ্নের জবাবে ম্যাক শুধু বলল, ‘শয়তানটা এমনভাবে হঠাৎ আমার মাথায় মারল যে রিভলভার বার করারও সময় পাইনি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। দু-দিন ধরে আমায় ঘরে বন্ধ করে রেখেছে ও।’
আমি বললাম, ‘কার কথা বলছ তুমি?’
ম্যাক কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, ‘সব কথা তোমাকে পরে বলছি। এখানে আর কোনো কথা নয়। বাঁচতে হলে এই মুহূর্তে আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে হবে।’ এই বলে সে আমার হাত ধরে টেনে এগোল বাড়ির বাইরে যাবার জন্য। বারান্দা অতিক্রম করে প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। অপর দিকে দরজা দিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করলেন প্রোফেসর হিরোহিতো। তার পরনে, আগের দিনের মতোই সারা দেহ ঢাকা পোশাক। শুধু টুপির নীচ থেকে মুখমণ্ডলটা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত বাইরে থেকে এইমাত্র ফিরলেন তিনি।
আমি তাকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম, ‘প্রফেসর হিরোহিতো!!’ আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কী অন্তর্ভেদী পলকহীন সেই দৃষ্টি! যেন আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো পর্যন্ত পাঠ করতে চাইছে সেই চোখ। আমি অনুভব করলাম ম্যাকের বাঁ হাত ক্রমশ চেপে বসেছে আমার কবজিতে। আর এরপরই ম্যাক একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। তার জামার তলা থেকে আর্মি রিভলভারটা ডান হাতে বার করে তাগ করল হিরোহিতোর দিকে। ভয়ংকর কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে আমি বলে উঠলাম, ‘ম্যাক তুমি কি করতে যাচ্ছ? নিজেদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে নাও। আর প্রফেসর হিরোহিতো, আপনারই বা কী হয়েছে? আপনি কি ম্যাককে আটকে রেখেছিলেন?’
আমার কথার কেউ কোনো জবাব দিল না। শুধু যেন একটু ক্রুর হাসি ফুটে উঠল হিরোহিতোর ঠোঁটের কোণে। উদ্ধত রিভলভার দেখেও অচঞ্চলভাবে ধীর পদক্ষেপে প্রফেসর এগোতে লাগলেন আমাদের দিকে। ম্যাকের হাত কাঁপছে। চোখের মণি দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি শেষবারের মতো এবার নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম ম্যাককে। কিন্তু সে এক ধাক্কায় আমাকে পাশে ঠেলে দিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কে দু-হাতে রিভলভার চেপে চালিয়ে দিল গুলি। রিভলভারের প্রচণ্ড শব্দে আর বারুদের ধোঁয়ায় ভরে গেল ঘর। কিন্তু ম্যাকের প্রথম গুলিটা মনে হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পাতলা ধোঁয়ার আস্তরণের মধ্যে দেখলাম হিরোহিতো মুহূর্তের জন্য একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর আবার এগোতে লাগলেন আমাদের দিকে। মাত্র ফুট দশেকের ব্যবধান। তাঁর মুখের হাসিটা যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, আর তারপরই ম্যাক তাকে লক্ষ্য করে পরপর বেশ কয়েকটা গুলি চালিয়ে দিল। গুলিগুলো প্রফেসর হিরোহিতোর শরীরে কোথায় লাগল জানি না। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে পরমুহূর্তেই এক বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটল। প্রফেসর হিরোহিতোর শরীর থেকে বৈদ্যুতিক স্পার্ক নির্গত হতে লাগল চট পট শব্দে, একটা নীলাভ বৈদ্যুতিক জাল যেন ঘিরে ধরল তাকে। থরথর করে কাঁপতে থাকল প্রফেসর হিরোহিতোর শরীর। আর তারপরেই একটা প্রচণ্ড ধাতব শব্দ তুলে হিরোহিতোর দেহ কোমরের কাছ থেকে বিভক্ত হয়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। না কোনো রক্ত তাতে নেই। সামান্য একটু ধূম উদগীরণ হল মাত্র।
প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে আমার কিছুটা সময় লাগল। তারপর আমি ম্যাককে বললাম, ‘তুমি কি ধরতে পেরেছিলে ব্যাপারটা?’
ম্যাক বলল, ‘প্রফেসরের হঠাৎ আচরণ পরিবর্তন, চাকরকে বরখাস্ত করা, আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বাতি নিভিয়ে রাখা, সবসময় দেহ ঢাকা পোশাক পরা—এসবে আমার একটা সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি যখন যন্ত্রমানবটা আমার মাথায় আঘাত করে। ওটা ছিল ধাতব আঘাত। এক আঘাতেই মাথা ফেটে জ্ঞান হারাই আমি। তবে কুকুরটা কিন্তু প্রথম থেকেই পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছিল। আমরা যেদিন প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে আসি সেই প্রথম দিনের মতোই আমি একলা যখন সেদিন এখানে আসি তখন পাগটা ওকে দেখেই গজরাতে শুরু করেছিল। যন্ত্রমানুষটা তাই মেরে ফেলল ওকে।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু তাহলে আমাদের হিরোহিতো কোথায় গেলেন?’
ম্যাক বলল, ‘চলো, বাড়িটা এবার ভালো করে খুঁজে দেখা যাক।’
একটু খোঁজাখুঁজির পর, বারান্দায় দুর্গন্ধের উৎসটা আবিষ্কার করলাম আমরা। একটা বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে খাটের ওপর গলিত একটা মৃতদেহ দেখতে পেলাম। বিকৃত হলেও সেটা যে প্রফেসর হিরোহিতোর তা বুঝতে অসুবিধা হল না। তার পাশে পড়ে আছে একটা নোট বুক। তুলে নিলাম সেটা। তার শেষ পাতাতে কাঁপা কাঁপা হাতে মাত্র কয়েকটা কথা লেখা। তারিখটা লেখা আছে আঠেরোই ডিসেম্বর। অর্থাৎ আমরা যেদিন হিরোহিতোর বাড়িতে প্রথম এলাম তার দু-দিন আগের ঘটনা।
হিরোহিতো লিখেছেন, ‘যন্ত্রের মধ্যে মানবিক গুণ সঞ্চারে আমি সফল হলাম ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটার পরিণতি এত ভয়ংকর হবে ধারণা ছিল না। লোকজনকে চমকে দেবার জন্য ওকে নিজের অবয়বে তৈরি করেছিলাম, সেটাই আমার কাল হল। ওর মধ্যে আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সঞ্চারিত করার সঙ্গে সঙ্গে আমার অজান্তেই ওর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব সৃষ্টিশক্তি, চিন্তাশক্তি। বিজ্ঞানের এ এক অদ্ভূত সাফল্য। কিন্তু আমার অবয়বধারী যন্ত্রমানব এখন চাইছে আমাকে খুন করে আমি হয়ে বেঁচে থাকতে। আমাকে ঘরে বন্দি করে রেখেছে সে। মজুমদার বা ম্যাকের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হল না। ওরা এসে পড়লে হয়তো আমি মুক্তি পেতাম। বর্তমানে এই যন্ত্রমানবের ইচ্ছাশক্তি বা দৈহিক শক্তিকে প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। ওই তো সে আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে….! বাইরের বারান্দায় তার স্পষ্ট পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি আমি! সে আসছে! সে আসছে…’
আর কোনো কথা লিখে যেতে পারেননি হিরোহিতো। বোধহয় এরপরই তার জীবনে অন্তিম পরিণতি ঘনিয়ে এসেছিল।
ম্যাক বিষণ্ণ দৃষ্টিতে লেখাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যিই প্রফেসর হিরোহিতোর কাছে হার মানলাম আমি।’ আর তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজার বাইরে একটা শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, যন্ত্রমানবের দেহের ঊর্ধ্বাংশ দু-হাতে ভর দিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যন্ত্রমানবের চোখে ফুটে আছে জিঘাংসা!
ম্যাক তার রিভলভারের শেষ গুলিটা চালাল যন্ত্রমানবের মাথা লক্ষ্য করে। ছোট্ট একটা বিস্ফোরণ। তারপরেই যন্ত্রমানবের মাথা থেকে বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার চিপস ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। এবার সত্যি নিথর হয়ে গেল হিরোহিতোর যন্ত্রমানব। তার দিকে তাকিয়ে ম্যাক বলল, ‘ওর আর কোনো মানবিক বোধ নেই। তবে আমাদের একটা মানবিক কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে। প্রফেসর হিরোহিতোর মরদেহের অন্তিম সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
—