হিন্দু বিবেকানন্দ
পঞ্চতন্ত্রের একটি গল্পে চারজন ব্রাহ্মণ-বালকের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয় এবং তারা নিজেরাই ঠিক করে দেশান্তরে গিয়ে বিদ্যালাভ করবে। এই ভাবনাবশেই তারা কান্যকুব্জে গিয়ে একটি বিদ্যামঠে বহুকাল বিদ্যাচর্চা করল। তাতে নানা শাস্ত্রে তাদের প্রচুর ব্যুৎপত্তি হল বটে, কিন্তু চারপাশের বাহ্য জগৎ যেভাবে চলে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা বা থাকায় লোকাচার-জ্ঞানহীন সেই ব্রাহ্মণ-বালকেরা একসময় নিজেরাই ভাবল, তাদের বিদ্যা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং উপাধ্যায় গুরুর কাছে গিয়ে তারা বলল—আমরা সমস্ত বিদ্যার পারে এসে পৌঁছেছি—এবার আমরা বাড়ি যাব। একথা বলেই তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
কিছু দূর পথ চলার পরেই বামুনরা দেখল—রাস্তা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। তারা রাস্তায় বসে পড়ে শাস্ত্রানুযায়ী ভাবতে থাকল—কোন পথে যাওয়া যায়? ইতোমধ্যে ঘটনা ছিল এইরকম যে, ওই নগরে এক বণিকের ছেলে মারা গেছে। তার শবদেহ নিয়ে শ্মশানের দিকে যাচ্ছিল বহুসংখ্যক সমব্যথী লোক। তাদের দেখে রাস্তায় বসে থাকা চিন্তাশীল ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের একজন পুঁথি খুলে বলল—রাস্তা পেয়ে গেছি—মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ—মহাজন যে পথে যায় সেটাই পথ। আমরা এই পথেই যাব।
এখানে সামান্য টিপ্পনী এইটুকুই যে, মহাজন মানে যেমন গুণীজন কিংবা বড়ো মানুষ বোঝায়, তেমনই মহাজন শব্দের এটাও একটা অর্থ যে, বেশিরভাগ মানুষ বা বহুল মানুষ যে পথ ধরে যাচ্ছে, সেই পথেই চলা উচিত। বামুনদের পুঁথিগত বিদ্যা আছে, অতএব সেই বিদ্যানুযায়ী শাস্ত্রের একদেশিক অর্থ ধরে নিয়ে তারা শ্মশানযাত্রী বণিকদের পিছন পিছন শ্মশানে এসে পৌঁছোলো। কিন্তু মহাজনের অনুগমন করে শ্মশানে পৌঁছে আবারও পণ্ডিত-ব্রাহ্মণেরা ইতিকর্তব্যতার বিভ্রান্তিতে বসে পড়ল। এই অবস্থায় হঠাৎই তাদের একজনের নজরে পড়ল শ্মশানের মুখে একটি গাধা দাঁড়িয়ে আছে। অমনি সে পুঁথি খুলে বলে উঠল—রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ—অর্থাৎ রাজদ্বারে শ্মশানে যে মানুষ পাশে থাকে, সেই প্রকৃত বন্ধু। অতএব নিশ্চয়ই এই গর্দভ আমাদের বন্ধু।
এই কথা বলেই বামুনরা সেই গর্দভকে গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল এবং গাধাটিকে নিয়ে গা ঘষাঘষি করে চলতে আরম্ভ করল। এইভাবে সামান্য একটু এগোতেই একটু দূরে তাকিয়ে তারা দেখতে পেল—একটি উট তীব্র গতিতে ছুটছে। পুঁথিগত এক বামুন এই দৃশ্য দেখে বই খুলে বলল—দ্যাখো ধর্মের গতি খুব তীব্র হয়—ধর্মস্য ত্বরিতা গতিঃ—অন্যায় কর্ম করলে ধর্ম খুব শীঘ্রই তার কাজ করে। এই উটের তীব্র গতি দেখেই বুঝতে পারছি—এ সাক্ষাৎ ধর্ম। অপর ব্রাহ্মণ তখন আর এক পুঁথি খুলে বলল—দ্যাখো ভায়েরা সব! অভীষ্ট বস্তুকে সব সময় ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়—ইষ্টং ধর্মেণ যোজয়েৎ—অভীষ্টা স্ত্রীকেও মানুষ তার পালনীয় ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করলেই তবে সে সহধর্মিণী। তাই আমাদের অভীষ্ট বন্ধু এই গাধাটিকে যুক্ত করতে হবে এই ধর্মস্বরূপ উটের সঙ্গে। এই কথা বলেই ব্রাহ্মণেরা সেই গাধাটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল সেই উটের সঙ্গে। তারপর পথ চলতে লাগল ধর্ম এবং অভীষ্ট বন্ধুকে নিয়ে।
এই পঞ্চতন্ত্র কাহিনির অবশিষ্ট অংশ এখানে আর বললাম না, কিন্তু প্রথমাংশটুকু বললাম এইজন্য যে, সেটা আমাদের প্রস্তাবিত প্রবন্ধের পরিকথা। ভারতবর্ষের কেন্দ্রশাসিত সরকার এবং তদনুগামী রাজনৈতিক দল এবং তাদের অন্তর্যামী সাক্ষী চৈতন্য হিসেবে অবস্থিত একটি সংঘ হিন্দু, হিন্দু ধর্ম এবং যুগপুরুষ বিবেকানন্দকে যেভাবে এবং যে অর্থে দেখেন এবং ব্যবহার করেন, সেটা অনেকটাই ওই মূর্খ পণ্ডিতদের মতো। প্রথম কথাটাই হল ‘হিন্দু’-শব্দটি। যাঁরা আজকে ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুধর্ম’ কিংবা ‘হিন্দুস্থান’ বলে উল্লম্ফন করছেন, তাঁরা প্রথমেই জেনে রাখুন—হিন্দুরা কিন্তু হিন্দুদের নামকরণ করেননি এবং আধুনিক কালে যে-সময়ে ‘হিন্দু’ নামটি যে বিষয়ে ব্যবহার কর হয়েছে, সেটাও কোনো জাতিবোধক নাম নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এখনকার হিন্দুরা যে ধর্মগ্রন্থগুলিকে হিন্দুদের জাতি-ধর্ম-ব্যবহার এবং আচারের উপাদান বলে মনে করেন সেই বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ভগবদগীতা, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি—কোথাও একবারের জন্যও হিন্দু-শব্দটি পাবেন না।
তবে হ্যাঁ, হিন্দু বলতে ভারতবর্ষের জনজাতিবোধক একটি শব্দের ব্যবহারিক প্রয়োগ যাঁরা করেছেন, তাঁদের মধ্যে আদিতম হলেন রামমোহন রায়—যিনি ব্রিটিশদের মুখে এই ব্যবহারিক প্রয়োগ শুনেই সম্ভবত হিন্দু নামটি ব্যবহার করেছেন ১৮১৬ এবং ১৮১৭ সালে। তাই বলে এটা ভাবারও কারণ নেই যে, হিন্দু শব্দটি ইংরেজদেরই ব্যবহারিক সুবিধার্থে এদেশীয় জনজাতির নামকরণ। বস্তুত হিন্দু শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুস—hindus সিন্ধুনদীর ওপার এবং এপারে থাকা সমস্ত ভৌগোলিক অঞ্চলকে পারসিক উচ্চারণে হিন্দু বলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাই বলে আমরা প্রাচীনকালে আমাদের কেউ হিন্দু নামে ডাকিনি। বরঞ্চ আমাদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত ছিল এই নাম, যেটাকে বিষ্ণুপুরাণ বলেছে—বর্ষং তদ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ। সন্ততি মানে সন্তান—’ভারতী সন্ততি’ মানে ভারতের সন্তান, ভারতবর্ষীয়রা।
কিন্তু এই ভারত এবং ভারতীয় নামটি প্রযুক্ত না হয়ে আমরা যে ভিনদেশী এই হিন্দু-শব্দের জালে পড়ে গেলাম, তার কারণ ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পূর্ণ তিনশো বছর ধরে ভারতীয় প্রাদেশিক রাজ্যগুলির সঙ্গে মুসলমানদের যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলল, সেই দ্বন্দ্বে মুসলমান রাজশক্তি কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি সেই পারসিক-দারায়ুসী শব্দটাই চাপিয়ে দিল—হিন্দু। আমাদের চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্য-চরিতামৃত খুললেও এই মুসলমান-বিদ্বিষ্ট হিন্দুশব্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে সম্ভবত ১৮২০ সাল থেকে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের হিন্দু নামে পরিচিত করতে থাকে মুসলমানদের বিপ্রতীপে এবং তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনে এবং এখন যাঁরা হিন্দু এবং হিন্দুস্তান—এই দুটি নাম নিয়ে আনন্দমুকুলিত নেত্রে উল্লম্ফিত হন, তাঁরা কিন্তু এই দুটি পারসিক তথা তথাকথিত যবনোচ্ছিষ্ট শব্দই আত্মসাৎ করেছেন মধ্যযুগীয় তৎপরতায়—না জেনে, না বুঝে।
সমস্যা হচ্ছে, এটা যদি উদারতা হয়, তাহলে নিজেদের আত্মীকৃত শব্দের গ্রন্থিভঙ্গের কথা নিজেরাই না বুঝে বিবেকানন্দের ব্যবহৃত হিন্দু-শব্দটি দলীয় সংকীর্ণতাতেই আত্মসাৎ করে নিয়েছে বিজেপি অথবা সংঘ পরিবার। বিবেকানন্দ যে হিন্দুর কথা বলেন, সে হিন্দুও দারায়ুসী হিন্দু, কিন্তু সেটা একেবারেই ভৌগোলিক পর্যায়ের হিন্দু, যেখানে The word Hindu as an ethnogeographic category came to englobe all those who lived in India, without ethnic distinction—এটাই Harjot Oberoi-এর দারায়ুসী হিন্দু। কিন্তু বিবেকানন্দের এই উদার হিন্দুবাদিতার কথা কিছুই না বুঝে বিজেপি সেই পণ্ডিত-মূর্খদের মতো ‘হিন্দু’ শব্দটিকে মধ্যযুগীয় মন্ত্রণায় মুসলমানদের বিদ্বিষ্ট তাৎপর্যে গ্রহণ করেছে। সত্যিই মধ্যযুগে যখন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন চলছিল, তখন হিন্দু-মুসলমানে এমনই সাম্প্রদায়িক রেষারেষি তৈরি হয়েছিল, তাতে হিন্দুদের দিক থেকে যে যবন-বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিল, সেটা ছোঁয়াছুঁয়ি, মুখ দেখাদেখির অমঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
তবে কিনা এই শেষ অস্পৃশ্যতার মতো অভ্যাস তো এদেশের হিন্দু ব্রাহ্মণদের বহুকালের অভ্যাস—তাঁরা তো শূদ্র এবং অন্ত্যজ জাতির প্রতিও এই ব্যবহার করতেন এবং বিবেকানন্দ, গান্ধী কিংবা অন্য মহাত্মাদের এ-বিষয়েও লড়াই করতে হয়েছে। সেখানে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ এবং অস্পৃশ্যতা তো অভ্যস্ত বিদ্যার মধ্যেই থাকার কথা হিন্দুদের, বিশেষত উচ্চবর্ণ হিন্দুদের। তবে কিনা আমার কাছে আশ্চর্য এবং কৌতুককর লাগে এটাই যে, ভারতবর্ষের মধ্যযুগে যেহেতু মুসলমানেরা শাসকের সিংহাসনে বসেছিলেন, তাতে ধর্মান্তরিত করা থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য প্রশাসনিক অনুষঙ্গের কারণে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হিন্দুদের বিদ্বেষ না হয় স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এ কেমন কৌতুক যে, ছোঁয়াছুঁয়ি, মুখ-দেখাদেখির মধ্যে যে ধর্মীয় অকল্যাণ-আশঙ্কা চিরাভ্যস্তভাবে হিন্দুরা করে থাকেন, ঠিক সেই ভাব, সেই রসাভাস মুসলমানদেরও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল নাকি? তা নইলে চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে যবন হরিদাস বৈষ্ণব ধর্ম পালন করছিলেন বলে তাঁকে ধর্ম বোঝানোর সময় মুসলমান মুলুকপতি যা বলছেন, তাতে দেখা যাবে—হিন্দুদের আচার-অভ্যাস এবং অস্পর্শের মানসিকতা কি মুসলমানেরাও রপ্ত করে ফেলেছিলেন? তা নইলে মুলুকপতি মুসলমান হরিদাসকে বুঝিয়ে বলছেন—
আপনে জিজ্ঞাসে তাঁরে মুলুকের পতি।
”কেনে, ভাই, তোমার কিরূপ দেখি মতি?
কত ভাগ্যে, দেখ, তুমি হৈয়াছ যবন।
তবে কেনে হিন্দুর আচারে দেহ’ মন?
আমরা হিন্দুরে দেখি’ নাহি খাই ভাত।
তাহা ছাড়’ হই’ তুমি মহা-বংশ-জাত।
জাতি-ধর্ম্ম লঙ্ঘি’ কর অন্য-ব্যবহার।
পরলোকে কেমনে বা পাইবা নিস্তার?
না জানিয়া যে কিছু করিলা অনাচার।
সে পাপ ঘুচাহ করি’ কলমা উচ্চার।”
অস্বীকার করি না, মুসলমান শাসনের কালে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এইরকমই আন্তরিক বিভেদ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ইংরেজ-শাসনের কালে যখন মুসলমানদের রাজ্যপাট সব চলে গেছে, তখন তো তারা হিন্দুদের সঙ্গে সমাসনে বসে ইংরেজ-শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। বিশেষত নবম-দশম খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংরেজদের কাল পর্যন্ত যে মুসলমানরা এই ভারতবর্ষের অধিবাসী, তাঁরা তো হিন্দুদের সঙ্গে শাসিত-বিজিতদের সঙ্গেই থেকে গেল। এটা ইংরেজদের দোষ, তাঁরা স্বস্বার্থে ভৌগোলিক অধিবাসের ভিত্তিতে হিন্দুদেরও ভারতবর্ষীয় বলে গ্রহণ করেননি, মুসলমানদেরও ভারতবর্ষীয় বলে গ্রহণ করেননি। তাঁরা ধর্মের ভিত্তিতেই দুই পক্ষের বিচার করে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ-বিভাজন জীইয়ে রেখে দিলেন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এবং এঁরা যাতে ভৌগোলিক সমতায় কোনোভাবেই একত্রিত না হয়, সেইজন্য হিন্দুদেরও তাঁরা জাতি হিসেবে গ্রহণ করেননি।
লক্ষণীয়, বিজেপি কিংবা সংঘ-পরিবারও কিন্তু এ ব্যাপারে ইংরেজদের অনুগামী। তারাও ধর্মের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদের বিচার সম্পন্ন করে। বিবেকানন্দ যখন শিকাগোতে গিয়ে হিন্দুধর্মের প্রচার করে এলেন, সেখানে ভারতীয় দর্শন, বিশেষত বেদান্তদর্শনের ‘সমঃ সর্বেষু ভূতেষু’-র গরিমা প্রকাশ করাটাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তিনি যে হিন্দুধর্মের প্রচার-অভিযান করেছিলেন, সেখানে তাঁর ধর্মবিজয়ের অভিযান তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে সমাপতিত হয়েছিল। ফলত সেই শিকাগো বক্তৃতার সাফল্য স্বামীজিকে সেই সময়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ করে তুলেছিল। এখানে সমস্যা এটাই যে, বিবেকানন্দ যেহেতু শিকাগোতে এক ধর্ম-মহাসভায় কথা বলতে গিয়েছিলেন, তাই সেখানে হিন্দু ধর্মের কথাই তাঁকে বলতে হয়েছে প্রধানত। আর সেই ধর্মের কথা বলতে গিয়ে স্বামীজিকে যেহেতু বারবার হিন্দু-শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়েছে, তাই মূর্খ-পণ্ডিত এক রাজনৈতিক দলের কাছে সেটা হিন্দু-জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। এরা বক্তৃতার ভিতরে কী আছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করেননি কোনোদিন, কিন্তু স্বামীজি-ব্যবহৃত হিন্দু শব্দটি তাঁদের এমনভাবেই জাগ্রত করে যে, পঞ্চতন্ত্রের ‘মহাজন’ শব্দটি শোনার পরেই বিদ্যাবণিকদের পিছন পিছন তাঁরা শ্মশানে গিয়ে পৌঁছান। এঁরা জানেন না যে, বক্তৃতার শেষে বিবেকানন্দ বলেছিলেন—কেউ যদি স্বপ্নেও ভেবে থাকেন যে, অন্য সব ধর্ম ধ্বংস করে দিয়ে শুধু তার নিজস্ব ধর্মকেই ঐকান্তিক প্রতিষ্ঠায় টিকিয়ে রাখবেন—If any one dreams of the exclusive survival of his own religion—তাহলে সেই মানুষটাকে আমি আন্তরিকভাবে করুণা করি।
এটা মানতেই হবে যে, হিন্দু-জাতীয়তাবাদের একটা বিকারগ্রস্ত দিক আছে, যেখান থেকে হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির উৎপত্তি। এঁদেরই কাজ হল বিবেকানন্দের মতো এক সর্বাশ্লেষী ব্যক্তিত্বের উদার শব্দগুলি নিজের মতো করে ব্যবহার করা। যে হিন্দুত্বের মধ্যে বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এবং ধর্ম-দর্শনকে উদার মাহাত্ম্যে প্রোথিত করেছিলেন, সেটা ব্যবহৃত হতে থাকল বর্জনীয়তার রাজনীতির মধ্যে, যেখানে মুসলমান-ক্রিশ্চান আর ভারতীয় থাকেন না, শিখ, বৌদ্ধ, জৈনরাও কোনো মতে হিন্দুয়ানির প্রান্তিক চাষ-আবাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বৌদ্ধ, শিখ-জৈনরাই যেখানে এই রাজনৈতিক হিন্দুত্বের দয়ায় কোনো মতে একটা হিন্দুত্বের ‘টিপ’ পরে বসে আছেন, সেখানে মুসলমান-ক্রিশ্চানরা যে অবশ্যই তাঁদের কাছে অগণ্য—The other—সেটা বুঝতে সময় লাগে না, কিন্তু বিবেকানন্দের হিন্দু-ভাবনার সঙ্গে কি সেটা কোনোভাবেই মেলে?
বিবেকানন্দ লিখেছিলেন—
”অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি। প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেই ভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব খ্রীষ্টানদিগের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেই-সব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব, যাঁহারা সকলের হৃদয়-কন্দর-উদ্ভাষণকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।”
বিবেকানন্দের এই ভাষণের মধ্যে তিনি কোন ‘হিন্দুদের’ পাশে বসতে চান, সেটা যদি বোঝা যায়, তাহলে সেই উদার জলধির মাঝখান থেকে কোন হিন্দুদের তিনিও exclude করছেন, সেটাও বোঝা যায়। অথচ সেই excluded হিন্দুরাই কিন্তু এখন সমস্ত ধর্মসেতুর ‘কর্তা-বক্তা-অভিরক্ষিতা’ হয়ে উঠেছেন। তাঁদেরই দরকার পড়ে বিবেকানন্দের হিন্দু-বোধকে নিজের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করার এবং বিকৃত বোধে আত্মসাৎ করার।
একটা গোটা রাজনৈতিক দল—স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই বাংলার শত-সহস্র যুবকদের মতো যাদের এতটুকুও রক্তক্ষরণ হয়নি, সেই তাঁরাও একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করে গেলেন, অথচ সে আন্দোলনটা যতখানি তাঁরা যে উদ্দেশে করলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি বোধহয় করলেন মোঘল আমলের বিরুদ্ধে। এই মৌলিক বিষয়বস্তুটা আমরা যেদিন থেকে বুঝে ফেলেছি, তখন থেকেই তাদের এই খল প্রবৃত্তিটা জন্মেছে অন্যের, বিশেষত অন্য মহত্তর বড়ো মানুষের একার্থে ব্যবহৃত শব্দ অন্য অর্থে অপব্যাখ্যা করার। বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের যে উদার অবভাস তৈরি করেছিলেন, সেখানে সেই উদারতার অংশটুকু বাদ দিয়ে, শুধু হিন্দু-শব্দটির সঙ্গে আপন অভীষ্ট জাতীয়তাবাদের ধারণাগুলি যুক্ত করে দিল বিজেপি। পঞ্চতান্ত্রিক মূর্খ-পণ্ডিতেরা লোকাচার, লোক-ব্যবহার জানত না, কিন্তু কোনোভাবেই তারা খল ছিল না। কিন্তু এই রাজনৈতিক দল যাদের উৎপত্তির মধ্যেই প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি আছে, তারা কিন্তু খলবুদ্ধিতেই তাঁদের ইষ্ট জাতীয়তাবাদকে বিবেকানন্দের হিন্দুধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিল—অনেকটাই সেই উটের গলায় গাধা জোতার মতোই।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পূর্ব-সময়ে হিন্দু এবং হিন্দুত্বের যে সংজ্ঞা তৈরি হয়েছিল, সেখানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষকে একত্র করার আহ্বান ছিল। সেখানে ধর্ম হিসেবে কোনো বর্জনীয়তার ইতিহাস ছিল না। কিন্তু পরিভাষায় যেটাকে exclusivist politics বলি, সেটা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উপকরণ হয় এবং সেখানে যদি হিন্দুত্ব একটা হাতিয়ার হয়ে ওঠে, যেমনটা এই গত ছয়-সাত বছর ধরে হয়েছে এবং হচ্ছে, তাহলে সেটা বিজেপির মতো একটা রাজনৈতিক দলেরই অন্তর্জাত প্রকরণ, বিবেকানন্দের হিন্দু এবং হিন্দুত্ব সেখানে করুণায় অশ্রুবর্ষণ করে।
বিজেপির জাতীয়তাবাদ এতটাই স্বকল্পিতভাবে সংকীর্ণ যে, সেটাকে এই উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে দেশাত্মবোধ বলেও ভুল করা যায় না। এই ধরনের জাতীয়তাবাদ বরঞ্চ মুসলিম লিগের বিপরীতে একটা সম্ভাব্য হিন্দু লিগের মতো। এমন একটা ‘রেসিয়াল’ জাতীয়তাবাদের মধ্যে বিবেকানন্দের ব্যাখ্যাত হিন্দুধর্মের সংযুক্তি ঘটে কী করে? সবচেয়ে বড়ো কথা, হিন্দুদের ধর্ম এবং ধর্মবোধ যা একান্ত ব্যক্তিগত স্তরে পালনীয় হয়ে ওঠার কথা, সেই ধর্মবোধ যদি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয় উটের গললগ্নীকৃত গাধাটির মতো, তাহলে সেই ধর্মাত্মক জাতীয়তাবাদ কি মুসলিম রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদের বিপ্রতীপে অন্যতর এক হিন্দু-কাউন্টারপার্ট হয়ে ওঠে না? বিবেকানন্দ কোনোভাবেই এইরকম হিন্দু-জাতীয়তাবাদের কোনো নাট্যরঙ্গ তাঁর শিকাগো বক্তৃতাতেও উপস্থাপনা করেননি, কিংবা তাঁর অন্য কোনো লেখাতে হিন্দু-শব্দ শতবার ব্যবহার করেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু-প্রভ্যুত্থানের কথা বলেননি।
হিন্দু এবং হিন্দুধর্ম বলতে স্বামী বিবেকানন্দ কী বুঝেছিলেন, সেটা তিনি মহম্মদ সরফরাজ হোসেনকে লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন—
”বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম-ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব-সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানব জাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেটিকেই বাছিয়া লইতে পারে।
আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই-বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ-একমাত্র আশা’।”
এবার আপনারাই বলুন যে, স্বামী বিবেকানন্দের এই সরলোদার সমন্বয়ী হিন্দুত্বের বোধকে কীভাবে আপনি বিজেপির হিন্দু কিংবা হিন্দু-জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মেলাবেন? নাকি যাঁরা বিবেকানন্দের বিবেক চুরি করে স্বকল্পিত হিন্দুত্বের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব বলে, তাঁদের জানাই, এই মেলামিশিটা তেলে-জলের মতোও হবে না। হিন্দুত্বের বিবেক কখনও অবিবেকী মানুষের ধারণযোগ্য হয় না। এটা লক্ষণীয় যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক রকমের সরকার দেখলাম—কংগ্রেস সরকার, মিলিজুলি দলের সরকার, কংগ্রেস মিলিজুলি, বিজেপি মিলিজুলি—অনেক রকম দেখলাম; তাতে এই সাত-আট বছর আগেও একটা ব্যাপার হয়েইছিল, যাতে একটা ‘সোস্যাল ইকুইলিব্রিয়াম’ তৈরি হয়েছিল। এমনকী অটলবিহারীর মতো বিচক্ষণ পর্বতের সানুদেশেও এমন মানসিকতা দেখিনি, যখন সামাজিক সাম্যবোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল—এমন কথা বলা যায়। কিন্তু গত ছয়-সাত বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান আর গোরু এমনভাবেই রাজনীতির মঞ্চে আলোড়িত হচ্ছে এবং তা এতটাই সোচ্চারে যে তাতে রাষ্ট্রের অন্বেষ্টব্য বিষয়গুলি—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পনীতি, অর্থনীতি—সব হারিয়ে গেছে। আমরা সারাক্ষণ এখন হিন্দু-মুসলমান নিয়ে আছি, আর সঙ্গে আছে গোরু। এই তিনটির মাঝে আবার নতুন করে চাগিয়ে উঠছে জাতীয়তাবাদ এবং এক অলৌকিক দেশাত্মবোধ, যার মধ্যে আবার জড়িয়ে গেছে বিবেকানন্দের মতো এক যুগপুরুষকে নিয়ে প্রাণহীন মৌখিকতার আড়ম্বর।
ঠিক এইখানেই আলোচ্য হয়ে ওঠেন Jacques Barzun নামে এক ফরাসি ঐতিহাসিকের একখানি বই—একুশ শতকের সন্ধানে—Towards the Twenty-First Century. ১৯৭২ সালে লেখা এই বইতে সাতচল্লিশ সাল পরে ভারতবর্ষে যা ঘটছে, তার আঁচটা যে তিনি কোন ভবিষ্যদ-দৃষ্টিতে বুঝলেন, এটাই আমি ভেবে পাই না। জ্যাক বারজুঁ লিখেছিলেন—অতীতে যত রাজনৈতিক ‘বাদ’ বা ‘ism’ বলতে যা যা বোঝাত, সেইরকম কোনো ‘বাদ’ টিকে না থাকলেও একটিমাত্র বাদ এখনও প্রকারান্তরে টিকে আছে এবং সেটা হল জাতীয়তাবাদ। ভাবনাগতভাবে জ্যাক বারজুঁ যে কতটা সঠিক ছিলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ততটা বিস্তারিতভাবে নিশ্চয়ই জানতেন না, কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিতে এটাই তাঁর মত ছিল যে, ১৯২০ সাল থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে তীব্রভাবে এবং সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেই সব আন্দোলনের ফলে দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল, তখনই কিন্তু জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য ফুরিয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হয়নি, জাতীয়তাবাদ টিকে রইল অন্যতর এক সংকীর্ণ প্রত্যয়ের মধ্যে এবং সেটা আর যাই হোক, দেশাত্মবোধ নয়; সেটা অন্যতর মানুষদের গ্রহণও করে না, সমন্বিতও করে না—
The only political ism surviving in full strength from the past is nationalism. This was partly to be expected from the liberation of so many colonies simultaneously, beginning in the 1920s. But this nationalism differs from the old in two remarkable ways: it is not patriotic and it does not want to absorb and assimilate. On the contrary, it wants to shrink and secede, to limit its control to its one small group of like-minded-we-ourselves-alone. It is in that sense racist, particularist, sectarian, minority-inspired.
আমাদের এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই একটা সমান্তরাল শক্তি কাজ করতে থাকে যেখানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা তীব্র হয়ে উঠছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতাও চাগিয়ে রাখছিলেন। দেশের সামগ্রিক জাতীয়তাবাদী ভাবনা এবং আন্দোলনের পাশাপাশি ধর্মের মিশেল দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁরা ইংরেজদের সঙ্গে মুসলমানদেরও ‘টারগেট’ করছিলেন। সমস্যা হল—এঁরা অনেকেই ছিলেন কংগ্রেসের নেতা। যে কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখ, তাঁদের সঙ্গেই তাঁরা দিনরাত ওঠা-বসা করতেন, এবং তাঁদের অন্তঃপোষিত ধর্মীয় ভাবনাগুলিকে মিশিয়ে দিতেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী মানসের সঙ্গে। এটা ভাবুন যে, মদনমোহন মালব্য, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন, কে. এম. মুন্সী অথবা শেঠ গোবিন্দদাস—এঁরা সব কংগ্রেসের বড়ো বড়ো নেতা হলেও ১৯২২-২৩ সাল থেকেই গোরক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ দেখাতে থাকেন এবং হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করারও শুদ্ধিবচন দিতে থাকেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে স্বাদেশিকতার দ্বৈরথ আরম্ভ হয় এখান থেকেই। মাড়ওয়ারি মহাসভা, হিন্দু মহাসভা এবং ১৯২৫-এর নবজাতক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ—এঁরা এত সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দিচ্ছিলেন যে, মূলস্রোতী কংগ্রেসীরা এই মিশেলটাকে না পেরেছেন ধরতে, না পেরেছেন ফেলতে। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য, জগৎনারায়ণ লাল অথবা শেঠ গোবিন্দদাসের মতো কংগ্রেসীদের গান্ধী-নেহেরুরা ফেলবেন কী করে, বিশেষত মালব্যের মতো পণ্ডিত এবং জাতীয়তাবাদীকে? বিখ্যাত জি. ডি. বিড়লা, আত্মারাম খেমকা, যমনালাল বাজাজ—তাঁরা কিন্তু প্রকটভাবেই গান্ধীবাদী মানুষ ছিলেন। ফলত কংগ্রেসীরা কংগ্রেসীদের আটকাবেন কী করে? তাতে সেই সমান্তরাল শক্তি ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসীদের বার্ষিক সভার সঙ্গে-সঙ্গেই হিন্দু মহাসভার বার্ষিক আয়োজন করে গেছেন এবং সেখানে আয়োজনে, প্রস্তাবনায় বিবেকানন্দও ব্যবহৃত হয়েছেন পাণ্ডিত্যের সূক্ষ্ম মন্ত্রণায়। জি. ডি. বিড়লার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার—তিনি কতটা সূক্ষ্ম ছিলেন এবং কতটা কৌশলী বুদ্ধিমান যে, একজন গবেষক লিখেছেন—Poddar was equally at ease with Gandhi and Hindu Mahasabha.
দ্বৈরথে এবং সমরথেই যাঁরা এতটা বুদ্ধিমান এবং কৌশলী, তাঁরা যে বিবেকানন্দ, নেতাজি এবং অন্যান্যদের স্বকার্য-সাধনে ব্যবহার করবেন, এটা খুব স্বাভাবিক। তার মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মতো পণ্ডিত বিদ্বান যখন এই সমান্তরাল দলের প্রমুখ নেতা হয়ে ওঠেন, তখন এই বঙ্গীয় মহাপুরুষদের বিশেষত বিবেকানন্দের ব্যাপারে আর এস এস-বিজেপিরা যে কবিদের মতোই ‘অপূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ’ হয়ে উঠবেন তাতে সন্দেহ কী! তবু কিন্তু শেষ জায়গায় তেলে-জলে মিশল না। বিজেপি-র হাজার তন্ত্রযুক্তির মধ্যে বিবেকানন্দ রইলেন জলের মধ্যে ভাসা তেলের রামধনু—ছোপের মতো। বিজেপি সরকার এখন রাষ্ট্রশাসন করছে—সত্যি বলতে কী, শাসনই করছে বড়ো বেশি—তারা দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাদ দিয়ে বছর ভর শুধু হিন্দু-মুসলমান করে যাচ্ছেন, গোরু-গোরু করছেন, রামমন্দির করছেন এবং লক্ষ-লক্ষ লোককে নাগরিকত্বের অগ্নিপরীক্ষায় ঠেলে দিচ্ছেন এবং সেটাও কিন্তু হিন্দু-মুসলিমেরই ব্যাপার। ধর্মেরই ব্যাপার।
এই প্রবন্ধের শেষে আমাদের সিদ্ধান্ত, সমাধান এবং জিজ্ঞাসা একটাই—বিবেকানন্দ কি এত ধর্ম চেয়েছেন রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য? সবচেয়ে বড়ো কথা—বিজেপি তাদের জাতীয়তাবাদ বোঝানোর জন্য ধর্মের সংক্রমণ ঘটায় রাষ্ট্রনীতির মধ্যে, আর বিবেকানন্দ শিকাগোতে হিন্দুধর্মের কথা বলতে গিয়ে তাঁর জাতীয়তাবাদের ভাবনা সংক্রমিত করেছেন রাষ্ট্রনীতির মধ্যে। তিনি বলেছেন—
…but the crying evil in the East is not religion—they have religion enough––but it is bread that the suffering millions of burning India cry out for with parched throats. They ask us for bread, but we give them stones. It is an insult to a starving people to offer them religion; it is insult to a starving man to teach him metaphysics. In India a priest that preached for money would lose caste and be spat upon by the people. I came here to seek aid for my impoverished people, and I fully realised how difficult it was to get help for heathens from Christians in a Christian land.
বিজেপির প্রকল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রেও হিন্দুত্ব ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড় অথবা রাষ্ট্রের অর্থনীতির কথা কি বলা সম্ভব? নাকি বললেও তাঁদের কানে পৌঁছোবে! আমরা কিন্তু জানি, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের যে জোর আছে, সেটা যদি নেতৃত্বের ব্যক্তিত্বে ধর্মান্ধতার পথ পরিবর্তন করিয়ে দিতে পারত, তাহলে ভারতবর্ষ আজ অন্য সিংহাসনে বসে থাকত। দুর্ভাগ্য, সেটা কোনো দিন হবে না বলেই মনে হয়। শৈব নয়, শক্তি নয়, বৈষ্ণবও নয়, হিন্দুধর্ম বলে যেটাকে বিজেপি ভাবে, সেই ধর্ম থেকে তারা কোনো দিন বেরোতেই পারবে না, কেননা ওটা হিন্দুধর্মই নয়।