হাতের কাজ
এখন যেটা বাংলাদেশ আটত্রিশ বছর আগে তাকে বলা হতো পূর্ব বাংলা। ভারতবর্ষ ভাগাভাগি হবার পর পূর্ব বাংলা হলো পূর্ব পাকিস্তান। তারপর এই সেদিন অনেক লড়াই করে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলো। এখন তার নাম বাংলাদেশ। এ-সব ইতিহাস সকলেরই জানা।
আমি যে গল্পটা বলতে যাচ্ছি সেটা এখনকার বাংলাদেশের নয়, আটত্রিশ বছর আগের পূর্ব বাংলার।
পূর্ব বাংলা জলের দেশ। চারদিকে বিরাট বিরাট সব নদী-পদ্মা, মেঘনা, কালাবদর, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, ইছামতী-এমনি কত যে, তার লেখাজোখা নেই। এ ছাড়া রয়েছে অগুনতি খাল বিল। নৌকো স্টিমার বা মোটর লঞ্চ ছাড়া কোথাও এক পা যাবার উপায় নেই।
সেবার আমাদের ছোট্ট শহর রাজদিয়া থেকে ‘গয়নার নৌকো’য় উঠেছি। যাব তিনটে নদী পেরিয়ে অনেক দূরে নবাবগঞ্জ বলে একটা জায়গায়। ওখানে আমার মামার বাড়ি।
আমার বয়স তখন দশ-এগারো, ক্লাস ফাইভে পড়ি।
‘গয়নার নৌকো’ ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। ট্রেন যেমন নানা স্টেশনে থেমে কিছু প্যাসেঞ্জার তুলে, কিছু প্যাসেঞ্জার নামিয়ে চলতে থাকে, ‘গয়নার নৌকো’ও অবিকল তা-ই। নদীর পাড়ে এক-একটা ঘাটে থামতে থামতে সেটা এগিয়ে যায়।
রাজদিয়া থেকে উঠেছিলাম সন্ধেবেলায়। সঙ্গে আমার মেজো কাকা। নবাবগঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে পরের দিন দুপুর হয়ে যাবে। তার মানে সারাটা রাত আমাদের নৌকোতেই কাটাতে হবে।
আমরা যে ‘গয়নার নৌকো’টায় উঠেছিলাম সেটা প্রকাণ্ড। মাঝি-মাল্লা ছাড়া একশ জন যাত্রীর তাতে জায়গা হয়ে যায়।
রাজদিয়ায় নৌকোটা ছাড়ার সময় খুব বেশি ভিড় টিড় ছিল না। সব মিলিয়ে কুড়ি-বাইশ জন প্যাসেঞ্জার।
তখন অঘ্রান মাস। আর কিছুদিনের মধ্যেই শীত পড়ে যাবে। খোলা নদীর ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। ‘গয়নার নৌকো’র এক কোণে গায়ে চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। মাথার ওপর ছইয়ের সঙ্গে অনেকগুলো বড় বড় হ্যারিকেন বাঁধা রয়েছে। ভেতরে প্রচুর আলো।
মেজো কাকা খুব গম্ভীর মানুষ, রাজদিয়া হাই-স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার। বাঘের মতো মেজাজ। তাঁর দাপটে গোটা স্কুল থরথর করে কাঁপতে থাকে। নৌকোয় উঠেই তিনি ব্যাগ খুলে একখানা মোটা বই খুলে বসেছিলেন। তার আগে শুধু একবার বলেছিলেন, কিরে, খিদে পেয়েছে?
একটা গোটা রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত নৌকোয় থাকতে হবে। তাই বাড়ি থেকে প্রচুর খাবার-দাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সন্ধেবেলায় রাতের খাওয়া চুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছিল না। বললাম, না।
খিদে পেলে বলিস।
আচ্ছা।
একসময় ‘গয়নার নৌকো’ ছেড়ে দিল। মাঝিরা তার আগেই পাল খাটিয়ে দিয়েছে। নৌকো নদীর ওপর দিয়ে বিশাল একটাজলপোকার মতো ভাসতে ভাসতে চলেছে।
সেটা ছিল পূর্ণিমার রাত। আকাশে রুপোর থালার মতো গোল একখানা চাঁদ উঠেছে। কিন্তু সেই অঘ্রান মাসে চারপাশে প্রচুর কুয়াশা, তাই জ্যোৎস্নাটা কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। ছইয়ের ভেতরে বসে থাকতে আমার একদম ভাল লাগছিল না। ইচ্ছা হচ্ছিল, বাইরে মাঝিদের কাছে গিয়ে চারপাশের দৃশ্য-টুশ্য দেখব। ভয়ে ভয়ে সে কথা একবার মেজো কাকাকে বললামও কিন্তু বই থেকে মুখ তুলে চোখ কুঁচকে এমনভাবে তাকালেন যে ভীষণ দমে গেলাম। মেজো কাকা কড়া গলায় বললেন, ঠাণ্ডা লাগিয়ে অসুখ বাধাবার ইচ্ছে?
কাজেই ছইয়ের ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে যেটুকু চোখে পড়ে, দেখে যাচ্ছিলাম। নদীটা খুব চওড়া। আমাদের নৌকো নদীর একটা পাড় ঘেঁষে যাচ্ছিল। এই পাড়ে মাঝে মাঝে ধানক্ষেত আর গাছগাছালির ফাঁকে আবছা আবছা দু-একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অন্য পাড়টা এত দূরে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ওদিকটা একেবারে ধুধু। তবে সারা গায়ে কুয়াশা আর চাঁদের আলো মেখে আমাদের নৌকোর ওপর দিয়ে অনেক রাতজাগা পাখি উড়ে যাচ্ছিল। নদীতে ভুস ভুস করে কত যে শুশুক ভেসে উঠেই তক্ষুনি আবার জলের তলায় অদৃশ্য হচ্ছিল!
আকাশ, নদী, শুশুক, চাঁদের আলো, কুয়াশা-সব মিলিয়ে দারুণ একখানা ছবি। সে সব দেখতে দেখতে চলেছি।
এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা পর পর আমাদের ‘গয়নার নৌকো’টা এক-একটা ঘাটে এসে থামছে। কিছু যাত্রী তুলে, কয়েক জনকে নামিয়ে আবার দৌড় লাগাচ্ছে।
দু-তিনটে ঘাট পেরিয়ে যাবার পর মেজো কাকা হাতের বইটা বন্ধ করে বললেন, অনেক রাত হয়েছে। এবার খেয়ে নেওয়া যাক− কি বলিস?
এতক্ষণে বেশ খিদেও পেয়ে গিয়েছিল। মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
বাড়ি থেকে প্রচুর খাবার-দাবার সঙ্গে করে এনেছিলাম। লুচি, আলু-কপির তরকারি, বেগুনভাজা, ডিমের ডালনা আর চমচম।
আমরা একটা হোল্ড-অলে কম্বল বালিশ টালিশও নিয়ে এসেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে মেজো কাকা বিছানা পাতছেন, আমি তাঁকে সাহায্য করছি-এই সময় ‘গয়নার নৌকো’টা আরেকটা ঘাটে এসে থামল। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে প্রচুর লোকজন উঠে পড়ল। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এরা ভীষণ গরীব। পরনে ভালিমারা ধুতি বা লুঙ্গি আর বহুকালের ধুদ্ধরে পুরনো নোংরা জামা। তার ওপর জ্যালজেলে পাতলা চাদর জড়ানো। কারো পায়েই জুতো-টুতো নেই। সবার গালেই খাপচা খাপচা দাড়ি, এলোমেলো চুল।
যে নৌকোয় একশ জন ধরে সেখানে এখন প্রায় দেড়শ লোক। মাঝিরা এবং অন্য যাত্রীরা তাদের অনেক করে বোঝালো, তোমরা কয়েকজন নেমে যাও, নইলে নৌকো ডুবে যাবে।
কে কার কথা শোনে! খানিকক্ষণ হৈচৈ চেঁচামেচি চলল কিন্তু কাউকেই নামানো গেল না। বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত মাঝিদের নৌকো ছেড়ে দিতে হল।
এদিকে আমরা যে তোফা একটা ঘুম লাগিয়ে নৌকোয় রাত কাটিয়ে দেব, তার আর উপায় রইল না। তাড়াতাড়ি বিছানা-টিছানা গুটিয়ে আবার হোল্ড-অলে পুরে ফেলা হল।
ঘুমোতে তো পারবই না, একটু আরাম করে যে বসে যাব, তেমন জায়গাও নেই। গাদাগাদি ভিড়ে কোনরকমে হাত-পা বুকের ভেতর গুঁজে গুটিসুটি মেরে মেজো কাকা আর আমি বসে আছি। অন্য সবারও একই অবস্থা। কোথাও আধ ইঞ্চি ফাঁক নেই।
নতুন যে লোকগুলো উঠেছে, তারা নিজেদের মধ্যে কি সব পরামর্শ করছিল। কথা শুনে মনে হল, ওরা সব চাষী, নিজেদের জমি-টমি নেই, অন্যের জমিতে মজুরি নিয়ে কাজ করে। এখন তারা ধান কাটতে যাচ্ছে নবাবগঞ্জে, অর্থাৎ কিনা আমার মামাবাড়ির দেশে।
কিছুক্ষণ পর আরেকটা ঘাট এসে গেল। নৌকোটা ভিড়তে না ভিড়তেই হুলুস্থুল কাণ্ড। বোঝা যাচ্ছে, আরো নতুন লোক উঠছে।
‘গয়নার নৌকো’টা আগাপাশতলা বোঝাই হয়ে আছে। এর ওপর একটা মাছি উঠলেও সবসুদ্ধ জলের তলায় চলে যেতে হবে।
কিন্তু যারা উঠল তাদের ঠেকানো যায় না। তারা হল একজন ছোট দারোগা, চার জন কনস্টেবল এবং একটি চোর।
ছোট দারোগার বিরাট মুখ, বিশাল গোঁফ আর প্রকাণ্ড ভুঁড়ি। পরনে খাকির হাফ শার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত খাকিরই হাফ প্যান্ট। তলার দিকে প্যান্টটার মস্ত ঘের, তার ফাঁক দিয়ে সরু সরু লিকলিকে দুটো পা নেমে এসেছে। কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্ট আর পায়ে জবরদস্ত বুট।
ছোট দারোগাকে দেখে মনে মনে ফিক করে হেসে ফেললাম। ওই রকম রোগা রোগা পায়ের লোকটা তিন মণ ওজনের একটা শরীর বয়ে বেড়ায় কি করে?
ছোট দারোগার মতো অত বড় মাপের না হলেও চার কনস্টেবলেরও ভুড়ি এবং গোঁফের বাহার আছে। তাদের সবার কাঁধেই রাইফেল বাঁধা এবং গলায় টোটার মালা।
এদের মধ্যে সব চাইতে দর্শনীয় হল চোরটা। রোগা টিনটিনে ফড়িঙের মতো চেহারা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল, গোেল চোখ, চোখা থুতনি। লোকটার চোখ সারাক্ষণ চরকির মতো ঘুরছে।
চোরটার দু-হাতে লোহার হ্যাণ্ড কাফ, কোমরটা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই দড়ির একটা মাথা একজন কনস্টেবলের হাতে।
দারোগা-পুলিশ দেখে সবাই তটস্থ, কেউ টু শব্দটি করছে না। নৌকো ডুবে তলিয়ে যাক, তবু তাদের নেমে যেতে বলার সাহস কারো নেই।’
ছোট দারোগা এদিক সেদিক তাকিয়ে পছন্দমত একটু জায়গা খুঁজছিল, হঠাৎ মেজো কাকাকে দেখতে পেল সে। বেশ খুশি হয়েই বলল, ‘মাস্টারমশাই যে−’
মেজো কাকা বললেন, ‘আরে সমাদ্দার সাহেব, আপনি এখানে!’
‘এসে বলছি।’ বলেই যে সব চাষী-টাষীরা দম আটকে বসে ছিল তাদের দিকে ফিরে বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার ছাড়ল ছোট দারোগা বা সমাদ্দার সাহেব, ‘অ্যাই, তোরা সরে সরে বস্, যাবার জায়গা দে।’
চাষীরা নিজেদের শরীরগুলো কুঁকড়ে এই এ্যাত্তটুকু করে রাস্তা বানিয়ে দিল। ছোট দারোগা চোর এবং কনস্টেবলদের নিয়ে আমাদের কাছে চলে এল। তারপর সে নিজে বসল মেজো কাকার গা ঘেঁষে, চোর আর কনস্টেবলরা চাষীদের ভেতর জায়গা করে নিয়ে ঠাসাঠাসি করে বসল। চোরের কোমরের দড়িটা সেই কনস্টেবলটার হাতেই থেকে গেল।
ছোট দারোগা বলল, ‘আপনার সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। আপনার মতো পণ্ডিত লোকের দেখা পেয়ে বড় ভাল লাগছে। দিন রাত চোর-ছ্যাঁচড় ঘেঁটে ঘেঁটে মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। তা চললেন কোথায় মাস্টারমশাই?’
বুঝতে পারছিলাম ছোট দারোগার সঙ্গে মেজো কাকার জানা-শোনা আছে। আমাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘ওকে নিয়ে নবাবগঞ্জে ওর মামার বাড়ি যাচ্ছি।’
‘ছেলেটি কে?’
‘আমার ভাই-পো।’
মামা বাড়ি কেন যাচ্ছি, এ নিয়ে ছোট দারোগা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
মেজো কাকা এবার হেসে হেসে বললেন, ‘এত রাত্তিরে এই বাহিনী নিয়ে চললেন কোথায়?’
‘হবিবপুরে। যা একখান চাকরি জুটেছে তাতে রাতবিরেত বলে কিছু নেই, চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি।’ একটু থেমে ফের বলল, ‘তিন বছর একটানা কাজ করছি। কাল ভেবেছিলাম মাসখানেকের ছুটি নিয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম করব, কিন্তু ওই ব্যাটার জন্যে সব প্ল্যানের বারোটা বেজে গেল।’ বলে আঙুল বাড়িয়ে চোরটাকে দেখিয়ে দিল।
একটা চোর কীভাবে ছোট দারোগার ছুটি বানচাল করে দিল, বুঝতে না পেরে মেজো কাকা তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মেজো কাকার মনের কথাটা যেন ধরতে পারল ছোট দারোগা। বলল, ‘ওই ব্যাটা বিখ্যাত চোর। ওর নাম যুধিষ্ঠির।’
**তার কথা শেষ হতে না হতেই হ্যান্ডকাফ-পরা হাত দুটো জোড় করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘চোর ছিলাম ছোট সাহেব। এখন তো একরকম সাধুই হয়ে গেছি।’
জবরজং মোটা গোঁফে চাড়া দিয়ে সস্নেহে চোরটাকে দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল ছোট দারোগা, ‘তা বটে, তা বটে। ব্যাটা একেবারে ধর্মপুত্তর যুধিষ্ঠিরই বনে গেছে। কিন্তু মাস্টারমশাই, ওর লাইফ হিস্ট্রি যদি শোনেন আপনার মাথার ভেতর বাঁই বাঁই করে দশখানা নাগরদোলা ঘুরতে থাকবে।’
মেজো কাকার মজাও লাগছিল, আবার কৌতূহলও হচ্ছিল ভীষণ। বললেন, ‘কি রকম?’
ছোট দারোগা এর পর যা বলে গেল তা এইরকম। ভূভারতে যুধিষ্ঠিরের মতো চোর নাকি আর একটাও জন্মায় নি। পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরীতে যত স্ট্রিমার, মোটর লঞ্চ আর ‘গয়নার নৌকো’ যায় তার যাত্রীদের রক্ষে নেই। যুধিষ্ঠির তাদের সব লোপাট করে দেয়।
কান খাড়া করে শুনে যাচ্ছিল যুধিষ্ঠির। সে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে, কাঁচমাচু মুখ করে ছোট দারোগার একটা ভুল শুধরে দিল, ‘ওসব তিন বছর আগের কথা ছোট সাহেব। এখন তো আমি সাধুই হয়ে গেছি।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ’−ঘাড়টা সামনে পেছনে নাচাতে নাচাতে ছোট দারোগা বলল, ‘তিন বছর আগের কথাই এ সব। −তারপর শুনুন মাস্টারমশাই। যুধিষ্ঠির ব্যাটার হাতের কাজ ছিল দারুণ সূক্ষ্ম। আপনার সঙ্গে কথা বলছে কথা বলছে, হঠাৎ একসময় দেখলেন ও সামনে নেই। সেই সঙ্গে আপনার বোতাম আর ঘড়ি লোপাট হয়ে গেছে।’
শুনতে শুনতে আমার চোখ গোল হয়ে গিয়েছিল। মেজো কাকা সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘বলেন কি সমাদ্দার সাহেব।’
‘ঠিকই বলি মাস্টারমশাই। ব্যাটা একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিসিয়ান। ওর কাণ্ডকারখানা লিখলে বাইশখানা মহাভারত হয়ে যাবে।’
চোখেমুখে গর্ব গর্ব একটা ভাব ফুটিয়ে যুধিষ্ঠির তাকিয়ে ছিল। এবার সে বলল, ‘সেই বউটার কথা এঁদের বলুন ছোট সাহেব।’
হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে, এমন একটা ভঙ্গি করে ছোট দারোগা বলতে লাগল, ‘ব্যাটার হাতের কাজ যে কতটা ফাইন এই ব্যাপারটা থেকে বুঝতে পারবেন। সেবার মুন্সিগঞ্জের স্টিমারঘাটা থেকে গোয়ালন্দের স্টিমার ছাড়বে ছাড়বে করছে। প্রায় সব প্যাসেঞ্জারই উঠে পড়েছে। শুধু একটি বউ বাকি। যে কাঠের পাটাতন দিয়ে প্যাসেঞ্জাররা জেটি থেকে স্টিমারে ওঠে, বউটা ছুটতে ছুটতে তার ওপর দিয়ে
আসছিল। দু’পা গেলেই সে উঠতে পারবে কিন্তু তার আগেই স্টিমার ছেড়ে দেবার ঘন্টি বেজে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে জেটির খালাসিরা পাটাতন ধরে দিয়েছে টান। বউটি হুড়মুড় করে জলেই পড়ে যেত। স্টিমারের ভেতরে গেটের কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিল যুধিষ্ঠির, হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত ধরে এক টানে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। প্রাণ বাঁচাবার জন্যে বউটি কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাবে, ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে দেখল তার আঙুলের দুটো আংটি সুদ্ধ উধাও হয়ে গেছে যুধিষ্ঠির। তক্ষুনি যুধিষ্ঠিরের খোঁজে দলে দলে প্যাসেঞ্জাররা রে রে করে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু কোথাও তার পাত্তা মিলল না, একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে।
খুশিতে এবং গর্বে যুধিষ্ঠিরের চোখ চক চক করছিল। সে বলল, ‘একবার নরসিংপুরের জমিদারের টাকার ব্যাগ কেমন করে হাত সাফাই করেছিলাম, সেটা বলুন ছোট সাহেব।’
ছোট দারোগা দু-হাত তুলে, শরীরটা বেঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর আঙুল ফোটাতে ফোটাতে হেসে হেসে বলল, ‘আর পারি না রে ব্যাটা। তোর কীর্তিকলাপ বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।’
মেজো কাকা সেই কথাটা ভোলেন নি। বললেন, ‘যুধিষ্ঠিরের হাত-সাফাইয়ের অনেক গল্পই তো করলেন। কিন্তু ও কী ভাবে আপনাকে ছুটি নিতে দিল না সেটা কিন্তু বলেন নি।’
ছোট দারোগা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘আরে তাই তো, দাঁড়ান দাঁড়ান, বলছি। জানেন মাস্টারমশাই, যুধিষ্ঠির তো হাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার টিকি ছোঁবার যো নেই। বজ্জাতটা একেবারে ইন্দ্রজাল জানে মশাই। এই হয়ত তাকে দেখা গেল, এই নেই। এদিকে তার নামে থানায় রোজ গণ্ডা গণ্ডা ডাইরি হচ্ছে। এস. পি থেকে পুলিশের বড় বড় কর্তারা ওকে অ্যারেস্ট করার জন্য জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে ছাড়ছে। উল্লুকটার জন্যে মনে আর সুখ নেই।’
‘তারপর?’
‘তারপর ব্যাটার কপাল! একদিন ধরা পড়ে মাধবগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট জেলে চলে গেল। পাক্কা তিন বছরের জেল। এ অঞ্চলের লোকের হাড় জুড়লো মশাই।’ ছোট দারোগা বলতে লাগল, ‘কাল যখন ছুটির দরখাস্ত দিতে যাব তখন ও. সি বললেন যুধিষ্ঠিরের জেল খাটার মেয়াদ শেষ হয়েছে। ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ও. সি’র বাতের ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। তাই আমাকে হাত ধরে বিশেষ করে রিকোয়েস্ট করলেন যাতে মাধবপুর থেকে যুধিষ্ঠিরকে হবিবপুরে নিয়ে যাই। ওখান থেকেই ওকে কিছু সই টই করিয়ে মুক্তি দেওয়া হবে। ওকে ও. সি. ‘র কাছে পৌঁছে দিলেই আমার কাজ শেষ। কাল থেকে আমি ছুটি পাব।’
এই সময় যুধিষ্ঠির বলে উঠল, ‘তিন বছর আগের কথাই খালি বলে গেলেন ছোট সাহেব। মাঝখানের ব্যাপার-স্যাপার তো মাস্টারমশাইকে কিছুই জানালেন না।’
ছোট দারোগা নড়েচড়ে বসল। মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল, ‘আরে তাই তো, আসল কথাটাই বলা হয় নি। তিন বছর জেল খেটে ওই ঘাঘী জাঁহাবাজ যুধিষ্ঠির পুরোপুরি বদলে গেছে। কি রে, বদলাস নি?’
মাথাটা ডান দিকে দু’ ফুট হেলিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘তা আর বদলাই নি, পা থেকে মাথা পর্যন্ত একেবারে পাল্টে গেছি। আমার ভেতর একটা ভক্তি ভাব এসে গেছে, পাপ কাজে এখন বড ঘেন্না লাগে।’
ছোট দারোগা বলল, ‘মাধবপুর জেলের জেলারের কাছে শুনলাম, দিনরাত যুধিষ্ঠির নাকি আজকাল ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ বা ‘মা কালী মা কালী’ করছে। ব্যাটা সত্যিকারের ধম্মপুত্তুর বনে গেছে। আখের কলে যেমন রসটুকু বার করে ছিবড়েটা ফেলে দেয়, তেমনি তিন বছর ঘানি ঘুরিয়ে ওর বডি থেকে সব খারাপ জিনিস বেরিয়ে গেছে। −না কি বলিস রে ব্যাটা?’ বলে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকালো।
যুধিষ্ঠির তক্ষুনি সায় দিল, ‘ঠিক বলেছেন ছোট সাহেব। জেলে আমার সঙ্গে আর যে সব চোর ডাকাত খুনী ছ্যাঁচোড়রা ছিল তারা তো আমাকে মহাপুরুষ বলতে শুরু করেছিল।’ বলতে বলতে বিনয়ে মাথা নুইয়ে, হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘আমি অবিশ্যি অতটা এখনও হই নি। তবে আপনাদের আশীর্বাদ পেলে’ এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল।
ছোট দারোগা বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আশীর্বাদ না হয় দেওয়া যাবে। এখন একটা কথা মন খুলে বল্। জেল থেকে তো বেরিয়ে এলি, আগের মতো হাতের কাজ আবার শুরু করবি না কি?’
যুধিষ্ঠির শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি জিভ কেটে, কানে হাত দিয়ে বলল, ‘আপনিই বললেন আমি ধম্মপুত্তর হয়ে গেছি, আবার এখন এ কী বলছেন। যে সাধুমহাত্মা হয়ে হিমালয়ে চলে যাবে তার এ সব শোনাও পাপ।’ বলতে বলতে মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠল যুধিষ্ঠিরের।
ছোট দারোগা হাত তুলে বলল, ‘আহা, কাঁদিস না ব্যাটা, কাঁদিস না। ঠাট্টাও বুঝিস না?’
প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতেই যুধিষ্ঠির বলল, ‘কবে ওসব করেছি, এখন কি আর তার কায়দা টায়দা মনে আছে? অভ্যেস না থাকলে সূক্ষ্ম হাতের কাজ করা যায়?’
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যুধিষ্ঠিরকে শান্ত করল ছোট দারোগা।
এদিকে রাত আরো বেড়েছে। সবার চোখ বুজে আসছে। কথা বলতে বলতে ছোট দারোগার গলা জড়িয়ে এল। এক সময় বসে বসেই ঢুলতে লাগল সে, সঙ্গে সঙ্গে নাকের ডাক শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকোর একটা লোকও আর জেগে রইল না। চার কনস্টেবল, যুধিষ্ঠির এবং অন্য যাত্রীরা−সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আর ঘুমের ঘোরে ঢুলে চুলে এ ওর ঘাড়ে পড়ছে।
ট্রেনে স্টিমারে বা নৌকোয় উঠলে সহজে আমার ঘুম আসে না। কিছুক্ষণ পর আমার চোখও জুড়ে আসতে লাগল। তার মধ্যে আবছা আবছা দেখতে পেলাম, নৌকোয় যত লোক আছে তাদের মধ্যে সব চাইতে বেশি ঢুলছে যুধিষ্ঠির। ঢুলতে ঢুলতে তার চারপাশে যত চাষী-টাষী রয়েছে সবার ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়ছে। তাদের সঙ্গে ওর মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে।
ভোর রাত্তিরে, তখনও বেশ অন্ধকার আছে, যুধিষ্ঠির এবং কনস্টেবলদের নিয়ে হবিবপুরে নেমে গেল ছোট দারোগা। ‘গয়নার নৌকো’র যাত্রীদের কারো ঘুম ভাঙেনি তখন পর্যন্ত। সবাই জড়াজড়ি করে ঢুলছে।
আরো দু-ঘণ্টা পর কুয়াশা আর অন্ধকার কেটে গেল। ঝলমলে সোনালী রোদে চারদিক ভেসে যেতে লাগল। এই সময় ‘গয়নার নৌকো’টা পেয়ারাতলির ঘাটে এসে ভিড়ল। এর পর চার পাঁচ ঘণ্ট। কোথাও আর না থেমে দুপুরবেলা সোজা নবাবগঞ্জে গিয়ে ভিড়বে। তার মানে যাদের সঙ্গে খাবার-দাবার নেই, পেয়ারতলি থেকে কিছু চিড়ে মুড়ি-টুড়ি কিনে না নিলে দুপুর পর্যন্ত তাদের উপোস দিয়ে থাকতে হবে।
আমাদের সঙ্গে লুচি মিষ্টি-টিষ্টি আছে। কিন্তু যে চাষীরা নবাবগঞ্জে ধান কাটতে যাচ্ছে তাদের কয়েকজন মুড়িটুড়ি কিনবার জন্য জামার পকেট বা লুঙ্গির কষি থেকে পয়সা বার করতে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপরই একসঙ্গে তারস্বরে মড়াকান্না জুড়ে দিল।
হঠাৎ কী হল, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। লোকগুলোকে থামানোও যাচ্ছে না। মেজো কাকা সমানে বলতে লাগলেন, ‘কী হয়েছে তোমাদের, কী হয়েছে?’
অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর চাষীরা জানালো, বাড়ি থেকে বেরুবার সময় রাস্তায় খরচের জন্য পাঁচ সাতটা করে টাকা সঙ্গে এনেছিল, কিন্তু সেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না-সব চুরি হয়ে গেছে। এখন তারা কী করবে?
মেজো কাকা তাদের সবাইকে দুটো করে টাকা দিয়ে বললেন, ‘যাও, কিছু কিনে টিনে আনো।’
এদিকে আমার মাথার ভেতর বন বন করে একটা চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। মনে পড়ছে, যাদের টাকা চুরি হয়েছে তাদের মধ্যেই কাল রাত্তিরে গাদাগাদি করে বসে ছিল যুধিষ্ঠির। ঘুমের ঘোরে আমার চোখে পড়ছিল, ঢুলতে ঢুলতে সে ওদের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়ছে। তখন বুঝতে পারি নি, যুধিষ্ঠির কী করছে।
হাতে হ্যান্ডকাফ, কোমরে দড়ি, চারপাশে দারোগা-পুলিশের পাহারা-এর মধ্যেই যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে দিয়েছে সে কত বড় ম্যাজিসিয়ান। তিন বছর জেলের ঘানি ঘুরিয়ে যখন তার ভেতর থেকে সব খারাপ জিনিস বেরিয়ে গেছে, যখন সে সাধু মহারাজ হতে যাচ্ছে, সেই সময় সূক্ষ্ম একটি হাতের কাজ দেখিয়ে আমার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়ে গেছে যুধিষ্ঠির।
***