হরি ঘোষের গোয়াল
বাংলা প্রবাদের জগতে হরি ঘোষের গোয়ালের কথা বেশ পরিচিত। কোনো বাড়িতে বা স্থানে অনেক লোকের হৈ হল্লা কিংবা কোলাহল হলে আমাদের মুখ থেকে অবলীলায় বেরিয়ে আসে হরি ঘোষের গোয়ালের নাম। কিন্তু এই প্রবাদ-পুরুষ হরি ঘোষের পরিচিতি আমাদের কাছে তেমন স্পষ্ট নয়।
হরি ঘোষের পরিচিতি উদ্ধারের চেষ্টা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। তবে এ চেষ্টা হয়তো সম্পূর্ণ সার্থক নয় আবার সম্পূর্ণ ব্যর্থও নয় বলে মনে হয়। আমরা সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া হরি ঘোষের পরিচয় এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরছি। এক্ষেত্রে কিছু অনাবশ্যক কথাও এসে যেতে পারে বলে পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্টের ইটার পঞ্চখণ্ডে (মতান্তরে নদীয়ার নবদ্বীপে ) জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত ন্যায়শাস্ত্রবিদ্ পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি। তিনি কাণভট্ট শিরোমণি এবং তার্কিক চূড়ামণি ভট্টাচার্য নামেও পরিচিত ছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৫-১৫৩৩ খ্রি.) সাথে নবদ্বীপে শিক্ষা গ্রহণকালে তিনি অনেক যুক্তি ও মতামত আদান-প্রদান করেছেন বলে কথিত আছে। নবদ্বীপের তুখোড় পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের (আনু, ১৪২০/৩০-১৫৪০ খ্রি.) ছাত্র ছিলেন এই রঘুনাথ শিরোমণি।
নবদ্বীপের টোলের পাঠ শেষ করে রঘুনাথ উচ্চতর শিক্ষার জন্য মিথিলায় (দ্বারভাঙ্গা) যান এবং সেখানকার অধ্যাপক পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রের কাছে ন্যায়শাস্ত্র (তর্কশাস্ত্র) অধ্যয়ন করেন। অতঃপর তর্কবিদ্যায় পণ্ডিত হয়ে গুরু পক্ষধরকে বিতর্কে পরাজিত করে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের খ্যাতি লাভ করেন এবং শিরোমণি উপাধি পান। নবদ্বীপ থেকে ন্যায়শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের অধিকার লাভ করে বাংলার জন্য প্রভূত গৌরব বয়ে আনেন রঘুনাথ শিরোমণি। এর আগে নবদ্বীপের পণ্ডিতরা ন্যায়শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি দেবার অধিকারী ছিলেন না। স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনাথ সর্বত্র তর্কযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে প্রাচীন শাস্ত্র যুগোপযোগী করায় মনোযোগ দেন। এ কারণে তিনি নবন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পণ্ডিত-সমাজে সুখ্যাত।
নারায়ণ সান্যাল (১৯২৪-২০০৫ খ্রি.) তার রূপমঞ্জরী (১৯৯০) গ্রন্থে বলেছেন যে, আনুমানিক ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে রঘুনাথ শিরোমণির জন্ম। ১৪৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পক্ষধরের সাথে ন্যায়শাস্ত্র বিষয়ে তার বিতর্ক হয়। তখন রঘুনাথ তরুণ।
কুমুদনাথ মল্লিক (১৮৮০-১৯৩৮ খ্রি.) তার নদীয়া কাহিনী (১৯১১) গ্রন্থে জানিয়েছে যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে মাত্র ২০ বছর বয়সে রঘুনাথ মিথিলায় উপস্থিত হন। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (১৯১০) রচয়িতা অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির (১৮৬৬-১৯৫৪ খ্রি.) ভাষ্যমতে, রঘুনাথ ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তবে দীনেশচন্দ্ৰ সেন (১৮৬৬-১৯৩৯ খ্রি.) এ প্রসঙ্গে বলেন যে, চৈতন্যদেবের সতীর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা এই সময় নির্ধারণের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে কি না তা বলা যায় না। দীনেশচন্দ্র সেন অনুমান করেছেন যে, রঘুনাথ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে জন্মগ্রহণ করে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি সম্পর্কে অনেক উপগল্প প্রচলিত হলেও একথা জানা যায় যে, তিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন এবং কমপক্ষে ৩৮টি গ্রন্থ তার রচনা। মিথিলার পাঠ শেষ করে নবদ্বীপে রঘুনাথ ফিরে এসেছিলেন এবং সেখানে উন্নতমানের টোল খোলার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেক্ষেত্রে আর্থিক প্রয়োজন, উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের অভাব এবং অস্তিমান অনেক পণ্ডিতের বিরুদ্ধে ও নেতিবাচক মানসিকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে।
ষোড়শ শতকের সেই কালে নবদ্বীপে বাস করতেন হরি ঘোষ নামে এক ধনী গোয়ালা। গরু রাখার জন্য তার ছিল বিশাল এক গোয়ালঘর বা গোশালা। রঘুনাথের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করেছিল হরি ঘোষকে। অবশেষে টোল খোলার জন্য তার গোয়ালঘরে স্থান পেলেন রঘুনাথ। নবদ্বীপে এই শ্রেষ্ঠ টোল বা চতুষ্পাঠী অচিরেই বিদ্যার্থী ছাত্রদের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে। এ কারণে প্রবাদে পরিণত হলো হরি ঘোষের গোয়াল বা হরের গোয়াল নামটি।
এখানে মনে করা যায় যে, ঐ সময়ে নবদ্বীপের তথাকথিত উন্নত পণ্ডিত এবং অভিজাতদের কাছে যথাক্রমে রঘুনাথ এবং হরি ঘোষ হয়তো কিছুটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে ছিলেন। সে কারণে উভয়ের প্রতি এ প্রবাদের মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আভাস পাওয়া যায়। মনে হয় অন্যান্য টোলের পণ্ডিত ও শাস্ত্র-ব্যবসায়ীদের মতো কঠোর না হওয়ায় সাধারণ ঘরের সন্তানদের শিক্ষার স্থান হয়েছিল রঘুনাথের টোলে। আর এই টোল হরি ঘোষ প্রদত্ত আশ্রয়ে হওয়ায় তা গোয়ালঘর হোক বা না হোক তা হরি ঘোষের হিসেবে আখ্যাত হয়েছিল উন্নাসিক এবং ধর্ম-ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা।
দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন—
‘মিথিলায় তিনি তাহার গুরু বাসুদেবের ন্যায়-সম্বন্ধীয় অনেক পুস্তক কণ্ঠস্থ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। যেহেতু মিথিলায় টোলের নিয়ম ছিল না যে, তথাকার পুথি কোনো বিদেশী ছাত্র নকল করিয়া স্বদেশে লইয়া যায়। যে করিয়াই হউক রঘুনাথ যেদিন নবদ্বীপে হরি ঘোষের বাড়িতে টোল খুলিলেন, সেই দিন হইতে মিথিলার সূর্য অস্তমিত হইল; নবদ্বীপে টোলে পাঞ্জাব, কনোজ, মদ্র ও তামিল দেশের ছাত্রেরা পড়িতে আসিতে লাগিল। হরি ঘোষ গয়লা ছিলেন—সেই টোলগৃহ অল্পদিনের মধ্যে শত শত ছাত্রের গুঞ্জরণে এরূপ কোলাহলময় হইয়া উঠিল এবং ন্যায়ের পরিভাষা-দুর্বোধ তর্কযুদ্ধে এবংবিধ মুখরিত হইতে লাগিল যে, লোকে সেই টোলের নাম দিল—হরের গোয়াল।’
সুবলচন্দ্র মিত্র (১৮৭২-১৯১৩ খ্রি.) তার সরল বাঙ্গালা অভিধানে হরি ঘোষের গোয়াল সম্পর্কে ভিন্নতর কথা বলেছেন—
‘বাস্তবিক ইহা গরুর গোয়াল নহে। হরি ঘোষের একটি সুপ্রশস্ত বৈঠকখানা ছিল। শতশত নিষ্কর্মা লোক দিবারাত্র সেইখানে বসিয়া খোশগল্প করিত। তাহাদের অন্নের চিন্তা ছিল না; হরি ঘোষের অবারিত দ্বার; ভোজনাগারে যে যখন আসিত, তখনই সে খাইতে পাইত। এইজন্য যেখানে অনেক নিষ্কর্মা লোক একত্র বসিয়া গোলমাল বা বৃথা গল্পে কালক্ষেপ করে, সেইখানে এই বাক্য ব্যবহৃত হয়। কলিকাতায় হরি ঘোষের স্ট্রিট আছে। সেইখানেই হরি ঘোষের বাড়ি ছিল।’
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানে বলা হয়েছে যে, হরি ঘোষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান ছিলেন। বাংলা ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ইংরেজিতেও তার দখল ছিল। দেওয়ানি থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় বাস করেন। প্রচুর অর্থদান করতেন সৎকাজে। উত্তর কলকাতায় তার বাড়িতে বহু গরিব ছাত্র থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেতো। তাছাড়া তার সুপ্রশস্ত বৈঠকখানায় খোশগল্পের আসর বসত। শতশত নিষ্কর্মা লোকও সুযোগ বুঝে সেখানে আড্ডা দিতো এবং খাওয়া-দাওয়ার কাজ সারতো। তা থেকেই হরি ঘোষের গোয়াল-প্রবাদের উৎপত্তি।
ড. অতুল সুর (১৯০৪-১৯৯৯ খ্রি.) প্রায় একই রকম বক্তব্যে বলেন- ‘হরি ঘোষ কোম্পানির দেওয়ানি করে বহু পয়সা উপার্জন করেছিলেন তার আবাসবাটিতে অনাহুতদের অনুপ্রাপ্তির বিঘ্ন ঘটতো না। সেজন্যই প্রবাদ আছে—হরি ঘোষের গোয়াল।’ কলকাতার আড্ডা প্রসঙ্গেও অতুল সুর বলেছেন যে, হরি ঘোষের বাড়িতে পরিচিত অপরিচিত সবাই একত্রিত হয়ে আড্ডা দিতো ও হরি ঘোষের অন্ন ধ্বংস করতো।
ষোড়শ শতাব্দীর পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কথিত হরি ঘোষের সুস্পষ্ট পরিচিতি পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালের অর্থাৎ আঠার-উনিশ শতকের কলকাতাবাসী হরি ঘোষের পরিচয় ঐতিহাসিকভাবে পাওয়া যায়। এই ধনাঢ্য হরি ঘোষের পরিচিতি আমরা আলোচনা করতে চাই, যদিও সে তথ্যও আংশিক।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত The Modern History of the Indian Chiefs, Rajas, Zamindars, & c. গ্রন্থে লোকনাথ ঘোষ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন হরি ঘোষ সম্পর্কে। সুদীর্ঘ লেখা থেকে হরি ঘোষ সম্পর্কে কিছু তথ্য সংক্ষেপে উল্লেখ করছি এখানে। যারা বিস্তারিত পড়তে চান তারা যে কোনো পণ্ডিত ইতিহাসবিদের সহায়তায় সহজেই পড়তে পারবেন।
বঙ্গজ কায়স্থ হরি ঘোষের পূর্বপুরুষ মকরন্দ ঘোষ সম্ভবত সেন আমলে কনৌজ থেকে এসে গৌড়ের রাজদরবারে চাকরি করেন বলে জানা যায়। তার পরবর্তী ১৯তম বংশধর মহাদেব ওরফে মনোহর ঘোষ সাধারণ গোমস্তা হিসেবে আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) রাজস্বমন্ত্রী টোডরমলের (১৫৬০- ১৫৮৯ খ্রি.) অধীনে কাজ করেন। অতঃপর বাংলার রাজস্ব বন্দোবস্তের সময় (১৫৮২) তিনি মোহরার নিযুক্ত হন। সে সময় মনোহর বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। মনোহর ঘোষের পৌত্র বলরাম ঘোষ এবং বলরামের দ্বিতীয় পুত্র শ্রীহরি ঘোষ বা আমাদের আলোচ্য হরি ঘোষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান ছিলেন। লোকনাথ ঘোষের বর্ণনামতে—
After his retirement from the post of Dewan at the Monghyr Fort, Sri Hari Ghose settled down at Calcutta, where he maintained many of his kinsmen and several destitute people of his own caste at his residence. On account of the shelter he gave to so many houseless people, his house was known as a Gohal or crib, these people themselves being ironically called Garu or cow.
Hari Ghose’s Gohal has long since run into a proverb, which is applied commonly to overcrowded houses. Besides paying the marriage expenses of the daughters of several poor Brahmans and Kayasthas and discharging the debts of such as were unable to meet their liabilities, Dewan Sri Hari Ghose used to feed his dependents with the same food, which was eaten by his sons and the other near members of his family.
শেষ জীবনে সংসারে বীতশ্রদ্ধ হরি ঘোষ কাশীতে চলে যান এবং ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
প্রবাদ-পুরুষ হরি ঘোষ এবং তার পরিচিতি উদ্ধারে আমরা সামান্য চেষ্টা করলাম। তবে লোকনাথ ঘোষের কথা থেকে মনে হয় যে, ঐতিহাসিক হরি ঘোষের কাহিনীর আগে থেকেই হরি ঘোষের গোয়াল- প্রবাদটি চালু ছিল। হয়তো কলকাতার হরি ঘোষের বৈঠকখানা ঐ প্রবাদকে আরো শক্তিশালী করেছে। তাই যতক্ষণ আসল গবেষণা করে আমাদের গবেষকরা সঠিক তথ্য না দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা উভয় সময়কাল অর্থাৎ যথাক্রমে পঞ্চদশ ও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ প্রবাদের জন্ম ও পরিপুষ্টির কাল বলে মনে করছি।