হরবোলা ছেলেটা
সকাল থেকে সাদেরালির মনে ধাঁধা, ছেলের পেণ্টুল কাচতে গিয়ে পকেটে কাঁইবিচির সঙ্গে একটা দু টাকার নোট পেয়েছিল।
বছর দশেক বয়েস হল ছেলেটার। এখনও মাঝে মাঝে বিছানা ভেজায়। শোবার আগে মাথায় ফুঁ, তুকতাক, পীরের সিন্নি, মৌলবির তাবিজ, এমন কী মা ষষ্ঠীর থানের ধুলোতেও ফল ফলেনি।
পাশের বাড়ির আয়মন বুড়ির এক পেল্লায় মোরগ আছে। ভোরবেলা দরমা থেকে ছাড়া পেলেই সে সাদেরালির খড়ের চালে নখের আঁচড় কাটতে কাটতে মটকায় ওঠে। আর তক্ষুণি টের পায় সাদেরালি। তার কলজেয় নখের আঁচড় পড়ছে খর খর খর খর। একঠেঙে ভিখিরী-সিখিরী মানুষ সে। ক্রাচে ভর করে কষ্টেসিষ্টে সারাটা শীতকাল মাঠে মাঠে ঘুরে চেয়েচিন্তে ওই খড়গুলো এনেছিল। আয়মনের মোরগ চালটা ঝাঁঝরা করে ছেড়েছে। মটকায় চড়ে বাং দিলে পাড়ার মুর্গির ঝাঁকও তার সঙ্গে প্রেম করতে আসে।
তাই রোজ ভোরে সাদেরালির প্রথম কাজ মোরগ তাড়ানো। দ্বিতীয় কাজ কাঁথাকানির তলায় হাত চালিয়ে ছেলের পেণ্টুল পরখ। ভিজে থাকলে ছেলের ঘরপালানী মায়ের নামে একনাগাড়ে গালমন্দ দেয়। শুকনো থাকলে ওর কপালে হাত রেখে ডাকে, সোনা রে! মানিক রে! হরবোলা রে!
হরবোলা বলার কারণ, ছেলেটা পাখপাখালি আর জন্তু জানোয়ারের ডাক নকল করতে পারে। যখন আপন মনে একলা হেঁটে যায়, দুপুরবেলার নিঃঝুম ঘোরলাগানো ঘুমঘুম স্বরে ঘু ঘু ডাকে—ঘু ঘু ঘু…ঘু ঘু ঘু। ওই তার যেন নিজের ডাক।
আগে জীবন্তীর বাজারে বেড়ালের ঝগড়া শুনিয়ে দুটো লেবনচুস কী একটা জিলিপি রোজগার করত। রিকশোওলারা কুকুর শেয়ালের ডাক শুনতে চাইত। এক গেলাস চায়ের লোভে ছেলেটার কচি গলা চিরে যেত। সাদেরালি বারণ করেছিল। খামোকা গলার কষ্ট করা। লোকেরা মাঙনি আমোদ লুটতে চায়। দুনিয়া জুড়ে খালি আমোদগেঁড়ের ভিড়।
আজকাল বাপব্যাটা আলাদা হয়ে বেরোয়। খোঁড়া মানুষ। খানতিনেকের বেশি গাঁ ঘুরতে বেলা গড়িয়ে যায়। আর ছেলেটা ধুকুর ধুকুর হেঁটে পাঁচ-সাতটা গাঁ সেরে আসে। বাজারের মুখে খালের ধারে বটতলায় দুজনের দেখা হয়। ওখানেই সকালবেলা ছাড়াছাড়ি, সন্ধেবেলা ফের দেখা। কাল সাদেরালি ভেবে সারা হচ্ছিল। মাঠে তখন বুনোপায়রার পাখনায় মুখ গুঁজে থাকার মতো ছাইরঙা সন্ধেবেলাটা ঝিম মেরে আছে। গাঁয়ের গোরস্থানে শিমুল গাছটা কুয়াশার জোব্বা আর টুপি পরে নমাজে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা। এমন সময় খালের ওপরে কোথাও ঘুঘু ডাকল। ঘু ঘু ঘু…ঘু ঘু ঘু। সাদেরালির বাপের হৃদয় খুব নাড়া খেয়েছিল।
কিন্তু তখনও টের পায়নি ওর পেণ্টুলের পকেটে একগুচ্চের তেঁতুল বিচির সঙ্গে একটা লালচে নোট আছে।
একসঙ্গে কে ওকে দু-দুটো টাকা দিতে পারে, কে এমন দয়াল দাতা, সাদেরালির মনে পোকা ঢুকেছে। বটতলা থেকে বাজার, বাজার থেকে কয়েক একর নীচু মাঠ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছনো অব্দি ছেলে তাকে সারাদিনের পুরো বৃত্তান্ত খুঁটিয়ে বলতে ভোলে না। সাদেরালিও জিগ্যেস করতে ছাড়ে না, কারণ তার বাপের মন। আর ছেলেও বাপেরটা জেনে নেয়। কে কত কামাতে পেরেছে, তাই নিয়ে ঠাট্টাতামাশাও চলে। হঠাৎ কাল সন্ধে থেকে তাল কেটে গেছে, সাদেরালি আজ সকালে সেটা ঠাহর করেছে।
কাল সন্ধে থেকে ছেলেটার মুখে অন্য ভাব। টুকটুকে ফর্সা ছেলেটা ধোঁয়াটে নীল চোখ। মাছের মতো তাকাচ্ছিল লম্ভের আলোয়। আঙুলের ডগায় ভাত ঘাঁটছিল।
আর কী যেন বলতে যাচ্ছিল অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে, সাদেরালির চোখে ঘুমের পাথর তখন। সকালে পেণ্টুল কাচতে গিয়ে তেঁতুলবিচি আর লাল রঙের নোট দেখে একে একে সব মনে পড়েছিল। তারপর থেকে লাল নোটটা তার খুলির ভেতর খসখস করে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। মাথা থেকে ভাপ বেরুচ্ছে। বার বার ছেলেকে জেরা করছে। ঠিকঠাক জবাব নেই। খালি বলে, পেয়েছি।
পেয়েছিস, তো বুলিস নি ক্যানে? ধমক দেয় সাদেরালি। থাপ্পড় তুলে চ্যাঁচায় ফের, একটো লয় আধটো লয়। দু-দুটো টাকা। টাকা কি গাছের ফল?
ছেলেটা ঘাড় গুঁজে আবার বলে, পেয়েছি।…
বেরুতে খানিকটা দেরি হল আজ। আলপথে গিয়ে ইটভাটার কাছে সাদেরালি হঠাৎ দাঁড়াল। ছেলেটা পিছনে হাঁটছে। কেমন ঝিমধরা আড়ষ্ট চেহারা। ফাঁড়ির সেপাইদের কাছে পাখপাখালির ডাক শুনিয়ে কবে একটা খাকি পেণ্টুল পেয়েছিল। হিসির দিন ওটা অনিচ্ছাসত্বেও পরতে হয়। পেণ্টুলটা হাঁটু পেরিয়ে ঝোলে। আর এই শীতের হিম থেকে বাঁচতে ওই সাইজেরই একটা ঘিয়ে রঙের সোয়েটার আছে। মেদীপুরের হিঙন আলি হাজি পেল্লায় মানুষ। তার বাড়ি দিনকয়েক রাখালী করতে গিয়েছিল গত বছর। দাতা হাজিসায়েব তাকে টুটাফাটা ওই সোয়েটার পরিয়ে বলেছিলেন, যা ব্যাটা! বাদশা বানিয়ে দিলাম। কদিন পরে হাজিসায়েবের বদনার গুঁতো খেয়ে পালিয়ে আসে। গায়ে তখন সোয়েটারটা ছিল। তারপর আর বাপ ব্যাটা ভুলেও মেদীপুরের দিকে পা বাড়ায় না।
সাদেরালি চাপা স্বরে বলল, হ্যা রে বাছা, চুরিচামারি করিস নি তো?
ছেলেটা জোরে মাথা দোলায়।
ভয় পাওয়া গলায় সাদেরালি ফের বলে, বাপ নাদেরালি! এখনও খুলে বল। আমি তোর জন্মদাতা। চুরি করিস নি তো?
ছেলেটা এবার ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ন্না।
তবে কে দিলে টাকা?
দিয়েছে।
কে দিয়েছে রে?
সেই ধোঁয়াটে নীল চোখ। নিষ্পলক মাছের মতো চাহনি। নাকের ফুটো একটু একটু ফুলছে। পাতলা চিমসে রুক্ষু ঠোঁট চাটল একবার। দুপায়ে শিশিরভেজা ঘাসের কুটো, নিস্পন্দ দু একটা পোকাও লেগে আছে।
উঁচু রাস্তায় এক্সপ্রেস বাসটা জীবন্তীর বাজার ছেড়ে জোরে বেরিয়ে গেল। রোজ সকালে দুজন গিয়ে নৈমুদ্দির চায়ের দোকানে বসে এই বাসটার অপেক্ষা করে। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে বাসটা। যাত্রীরা চা খেতে নামে। সাদেরালি আর তার ছেলে নাদেরালি দু গেলাস চা আর অন্তত এক টুকরো পাঁউরুটির পয়সা কামিয়ে নেয়। সাদেরালি হেঁড়ে গলায় সুর ধরে বলে :
ঘরবাড়ি বালাখানা…
নাদেরালি চেরা গলায় বলে ওঠে :
রবে না রবে না।
ধনদৌলত খানাপিনা…
রবে না রবে না।।
রূপযৌবন পোশাক আশাক…
রবে না রবে না।।
সাদেরালি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে পা বাড়াল। ছেলের স্বভাব সে জানে। একবার গোঁ ধরলে আর কিছুতেই নোয়ানো যাবে না। জবাই করতে গলায় ছুরি ঠেকালেও না। তবে একথা ঠিক, চুরিচামারি করা স্বভাব নয় ছেলেটার। সেই এতটুকু থেকে দেখে আসছে। শিক্ষা সহবতও দিয়েছে। ন্যায়-অন্যায় ভালমন্দ সমঝে দিয়েছে। বার বার বলেছে, দ্যাখ বাপ! কপালদোষে ভিক্ষ মেঙে খাই বটে, আমরা ভিখমাঙা বংশ নই। নেহাৎ এই পাটা কাটা গেল, শরীলে আধিবেধি ঢুকল। গতর খাটিয়ে খেতে পারিনে বলেই ভিখ মাঙি দোরে দোরে। তুই বড়োসড়ো হ। খাটতে শেখ। তখন আমার জিরেন।…ছেলে বাপের কথা কান করে শুনেছে। জিগ্যেস করেছে, পা কিসে কাটা গেল বাপজী? সাদেরালি একটু হেসেছে।…সে শুনে তুই কী করবি বাছা? সে বড়ো অনাছিষ্টির কথা।
না শুনে ছাড়বে না। ছেলেটার এই স্বভাব। কথাবার্তা কমই বলে। হাসেটাসেও যৎকিঞ্চিৎ। কিন্তু জেদ ধরলে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেবে। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। একঠেঙে কমজোরী মানুষের পক্ষে তাকে নড়ানো কঠিন। অগত্যা সাদেরালি তার পা খোয়ানোর কাহিনী ইনিয়ে-বিনিয়ে শুনিয়েছে। শোনালে মনটাও হাল্কা হয়। কতজনকে তো শুনিয়ে ছেড়েছে।
আমার এই পা, বুঝলি বাপ—এই পায়ে হেসোর কোপ মেরেছিল তোর মা। বলেই সাদেরালি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েছে। মনের ভাবটা আঁচ করতে চেয়েছে। মায়ের কথা জানতে-টানতে ওর আগ্রহ নেই কোনদিনও। মা কী জিনিস, হয়তো বোঝেও না। সেই দেড় বছর বয়সে মায়ের সঙ্গছাড়া।
ক্যানে মেরেছিল বাপজী?
এই প্রশ্ন শুনে সাদেরালি মুশকিলে পড়ে গেছে। সত্যি কথাটা অতটুকু ছেলেকে বলা যায় না। অথচ খালি মনে হয়েছে, ও জানুক। ওর জানা উচিত। অগত্যা ভেবেচিন্তে সাদেরালি বলেছে, তোর মায়ের সঙ্গে আমার কাজিয়া হয়েছিল।
ক্যানে বাপজী?
ভুরু কুঁচকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছে সাদেরালি। বলবে নাকি, বলা কি উচিত হবে অতটুকু দুধের বাচ্চাকে—তোর মা ছিল খানকী মেয়ে?
মুখে বলবে কী, মনের ভেতর ছবি এখনও স্পষ্ট। সেই খরার দুপুরবেলাটা চোখের সামনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। কাঁকরগড়ার সোলেমান ঠিকেদার রাস্তা মেরামতের কাজে মুনিশ খুঁজতে আসত এ গাঁয়ে। তখন সাদেরালির শরীরে জোর ছিল। মাটি কোপানোর কাজে তার জুড়ি ছিল না। সেই সুবাদে সোলেমান সাইকেলে চেপে তার বাড়ি আসত। বোকাসোকা সরল মানুষ সাদেরালি হুঁশ করে নি কেন ঠিকেদার সকালসন্ধে তার মতো মুনিশখাটা লোকের বাড়ি আড্ডা দেয়। তারপর একটু করে সন্দ জেগে উঠেছিল। এক খরার দুপুরে মাথা ধরেছে বলে সাদেরালি কাজ ফেলে হুট করে বাড়ি ফিরেছিল। এসেই দেখে, উঠোনে দেড় বছরের বাচ্চাটা আপনমনে খেলছে। ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল, ঠেলতেই খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঠেলে বেরিয়ে গেল হারামজাদা সুলেমান ঠিকেদার। ভেতরে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মেয়েটা তখন আলুথালু চুল আর গতরের কাপড়খানা সামলাচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাদেরালি। গলা টিপে ধরতে গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটা যেন তৈরী ছিল। আচমকা হেসো ছুড়েছিল। হেসোটা হাটুর নীচে লাগল। সাদেরালি আর্তনাদ করে বসে পড়েছিল।
সেই ফাঁকে মেয়েটা বেরিয়ে যায়। দেড় বছরের ছেলেটা তখন মোরগঝুঁটি ফুলগাছটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করছে।
পরে পায়ের ঘা বিষিয়ে যায়। ওই নিয়ে মুনিশ খেটেছে। জলকাদা ঘেঁটেছে। ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে মেহনত করেছে। পা ফুলে ঢোল হয়েছে। যন্ত্রণা বেড়েছে। তখন অগত্যা জীবন্তীর হাসপাতালে গিয়েছিল সাদেরালি। ছেলেটাকে রেখে গিয়েছিল আয়মন বুড়ির কাছে। মাস দুই পরে ক্র্যাচে ভর করে বাড়ি ফিরল। দয়াবতী আয়মন ছেলেটার যত্নআত্তির ত্রুটি করেনি।
ভেবেছিল, হারামজাদী মেয়েটা ছেলের টানে ফিরে আসবে। আসে নি। আরও কিছুদিন পরে তার বাপ এসে তালাক চাইল মেয়ের জন্যে! লোকের পরামর্শে সাদেরালি পাঁচশো টাকা চেয়েছিল। শেষঅব্দি দুশোয় রফা হয়। সাদেরালি পরে জেনেছিল, টাকাটা সোলেমানের।
টাকাগুলো পুঁজি করে তিন-চারটে বছর সে কত কী করেছে। একটা গাই গরুও কিনেছিল। দুধ বেচে খাওয়া-পরাটা জুটছিল। তার কপাল! গাইগরুটার কী অসুখ হল। পিরিমল হাড়ি নামকরা গোবদ্যি। সারাতে পারল না। ব্লকে পশুডাক্তার আছেন। সেও ছমাইল দূরে। শেষঅব্দি হাল ছেড়ে দিয়েছিল। নকড়ি কসাই এসে নিয়ে গেল। পঞ্চাশ টাকার বেশি দেয় নি। সেই টাকায় অল্পস্বল্প মনোহারী জিনিস কিনে জীবন্তীর বাজারে হাটবারে গিয়ে বসত। চুড়ি, সেপটিপিন, চুলের ফিতে আর প্লাস্টিকের কাঁটা বেচত। ছেলেটা ভারি বশ। বাপের সঙ্গে ধুকুর ধুকুর হেঁটে আসে। তেলেভাজা খায়। চটের কোনায় চুপ-চাপ বসে থাকে। খোঁড়া সাদেরালি দোকানদারি করে। পুঁজি ভাঙিয়ে পেট চালায়।
এইসব কথা ছেলেকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেকবার বলেছে। শুধু ওই কেলেঙ্কারিটুকু গোপন করেছে। অথচ যত দিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে, ওকে সবটাই বলা উচিত। ওর জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে। জানুক ওর মা মেয়েটা কেমন ছিল। আজ আট-নটা বছর কেটে গেল। নিদয়া মেয়েটার মনে একবারও ছেলের কথা বাজল না। বড় তাজ্জব লাগে সাদেরালির। লোকের কাছে বরাবর খবর পেয়েছে, হারামজাদী কাঁকরগড়ায় সোলেমান ঠিকেদারের ঘর করছে। খুব সুখেই আছে। কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চাও বিইয়েছে! দামী শাড়ি আর গয়নাগাঁটি পরে মাঝেমাঝে শহরে সিনেমা দেখতে যায়। সাদেরালি গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘোরে বলেই আবছা নানান কথা কানে আসে।
কিন্তু ভুলেও সে কোনদিন কাঁকরগড়া যায় নি। না খেয়ে মরে গেলেও ওদিকে পা বাড়াবে না। আর ছেলেটাকেও বলা আছে, হুঁশিয়ার বাপ! কাঁকরগড়ায় যদি পা দাও, আমার মরা মুখ দেখবে।
ক্যানে বাপজী?
প্রশ্ন শুনে মুশকিলে পড়েছে সাদেরালি। ছেলেটা মায়ের খবর জানতে চায় না। সাদেরালি তাকে ভুলেও বলে নি, তার মা আছে কাঁকরগড়ায়! অন্য কেউ বলেছে কি না, তাও কৌশলে জেনে নিয়েছে। ছেলেটা এমন কিছু বলে না যাতে বোঝা যায়, ব্যাপারটা সে টের পেয়েছে।
ফের প্রশ্ন করলে সাদেরালি একটা রূপকথার গল্প শুনিয়েছে ছেলেকে। আহিরজান নামে এক বাদশার ব্যাটা ছিল। সে গেল শিকারে। বনের মধ্যে হরিণ চরে। বাদশার ব্যাটা তীর ছুঁড়ল। সেই তীর বিঁধল হরিণের বুকে। কিন্তু মারা পড়ল না। পালিয়ে গেল গহন বনের ভিতরে। আহিরজান তাকে ঢুড়ে হয়রান। হেনসময়ে দেখা এক ফকিরের সঙ্গে। ফকির বললেন, হরিণ গেছে উত্তরে। কিন্তু হেই বাপ হুঁশিয়ার। ক্যানে? না—সবদিকে যাও, উত্তরে যেও না। গেলেই বিপদ। কি বিপদ? না, ওই হরিণ হরিণ না। তবে কী? না—আক্ষুসী। মানুষের কলজে খায়।…
দম নিয়ে সাদেরালি অনেক বলেছে, তাই বলি নাদেরালি, সব বাগে যেও। খোদাতালার দুনিয়াটা অনেক বড়ো। ইচ্ছেমতো চরে ফিরে খেও। কিন্তু হুঁশিয়ার, উত্তরে পা দিও না। আর দ্যাখো বাপ, আমি একদিন গোরে যাব। তুমি লায়েক হবে। তখনও কথাটা মনে রেখো।
উত্তরে কাঁকরগড়া মাইল তিনেকের বেশি দূরে না। পাকা রাস্তায় যাওয়া যায়। মাঠের পথেও যায়। কতবার ওই মাঠ পেরিয়ে দুজনে দূর-দূরান্তের গাঁয়ে গেছে। সাদেরালি ওদিকে তাকালেই চোখে কাঁকর পড়ে। তাকায় নি। ছেলেকেও নানান কথায় ভুলিয়ে রেখেছে। যদি কখনও বলেছে, চলো না বাপজী, আজ ওই গাঁয়ে যাই।
অমনি সাদেরালি রেগে ধমক দিয়েছে। কতবার বলেছি না ওদিকে যেতে নেই? গেলেই বিপদ। কাঁকরগড়ায় কলজেখাকী ডাইনী আছে।
ছেলেটা যেদিন থেকে আলাদা হয়ে ঘুরছে, সেদিন থেকে সাদেরালি আরও হুঁশিয়ার। কাঁকরগড়ার কথাটা রোজ সকালে তুলতে ভোলে না। সন্ধ্যাবেলায় ও ফিরে এসে বটতলায় দাঁড়ালো। ছল করে জেনে নেয়, ও তল্লাটে গিয়েছিল নাকি। তবে সাদেরালি বুঝেছে, ছেলে বাপকে ভীষণ মানে। এতটুকু অবাধ্যতা তো কোনদিন করে নি। যা বলে তাই শোনে।
তবু মাঝে মাঝে কাঁটার মতো সংশয় বেঁধে। নাবালক ছেলে। দৈবাৎ গিয়ে পড়তেও তো পারে। শেষে ভাবে, যদি গিয়েও পড়ে, মাকে তো চিনবে না। আর ও নিদয়া হারামজাদীও ছেলেকে কি চিনতে পারবে? কত ছেলে-পুলে ভিখ মেঙে গাঁয়ে-গাঁয়ে।
কাল সন্ধেবেলা কি যে হয়েছিল, কাঁকরগড়ার কথাটা অভ্যাসমতো জিগ্যেস করে নি। সকালে পেণ্টুলের পকেটে কাঁইবিচির সঙ্গে লাল নোটটা পেল, তখনও মাথায় আসে নি।
এতক্ষণে নৈমুদ্দির চায়ের দোকানে বসে চা আর পাঁউরুটি তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার পর সাদেরালি সেই লাল নোটটা বের করল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার কলজেয় কী চিড়িক করে উঠল। তার খুলির ভেতরটা ফাঁপা মনে হল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দেখল, হাতটা কাঁপছে।
কোনরকমে পয়সা মিটিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে সে বাকি পয়সাগুলো ফতুয়ার পকেটে রেখে ক্রাচটা ওঠায়। রোজকার মতো ছেলেটা তাকে অনুসরণ করে। পীচের রাস্তায় ক্রাচটা আওয়াজ করে সাদেরালি একটু জোরেই হাঁটতে থাকে। সাঁকো পেরিয়ে খালের ধারে বটতলায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এখানেই দুজনে ছাড়াছাড়ি হবে। কে কোন গাঁয়ে যাচ্ছে, পরস্পরকে জানাবে।
কাল সকালে ছাড়াছাড়ির সময় ছেলেটা হাসি মুখে বলেছিল, আজ আমি চণ্ডীতলা যাব বাপজী! নাককাটীর গান শুনে অনেক চাল দিয়েছিল।
নাককাটীর গানটা সাদেরালি শেখায় নি! কী ভাবে কোথায় শিখেছে কে জানে।
…নাকটি ছিল বাঁশির মতো
কতজনায় দেইখ্যে যেতো
পথেঘাটেতে হায় গো…
মোড়লবুড়া বদের গোঁড়া
কেইট্যে লিলে নাকের গোড়া
পথেঘাটেতে হায় গো…
গানটা শুনলে সাদেরালি হাসিতে গা ঘুলোয়। সে বলেছিল, তাই যাস চণ্ডীতলা।
তা পরে যাব কাপাসী।
তাই যাস বাপ! যেথা মোন চায় যাস। হরবোলার খুব কদর হয়েছে। তার কুকুর ডাক শুনে গাঁয়ের সব কুকুর ছুটে এসেছিল। বাপ-ব্যাটায় হেসে খুন। খানিক পরে ছেলেটা খালের ধার দিয়ে চলে গেল। ঘু ঘু ঘু…ঘু ঘু ঘু…দূর থেকে ভেসে আসছিল তার ঘুঘুপাখির ডাক।
আজ বটতলায় দুজনের মনে অন্য ভাব। মুখে থমথমে ছায়া কাঁপছে। সাদেরালি ভুরু কুঁচকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা তাকিয়েই দৃষ্টি সরালো। ধোঁয়াটে নীল চোখে দূরের দিকে তাকাল। রুক্ষু ঠোঁটটা চাটল একবার। তারপর ঘড়ঘড়ে গলায় সাদেরালি ডাকল, নাদেরালি!
হাঁ?
তুই কাল কাঁকরগড়া গিয়েছিলি, তাই না?
হুঁ।
দম আটকানো স্বরে সাদেরালি বলে, হুঁ! তাই বটে। তো টাকাটা তোকে কাঁকরগড়ায় দিয়েছে?
ছেলেটা গলার ভেতরে বলে, হুঁ।
হাঁ করে দম নেয় সাদেরালি। তারপর শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, তো মরদমানুষ দিলে, কী মেয়েমানুষ দিলে টাকাটা?
ছেলেটা মুখের দিকে তাকায়।
সাদেরালি গর্জন করে, মরদমানুষ, কী মেয়েমানুষ?
বাপের মূর্তি দেখে নাদেরালি কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলে, একটা মেয়েমানুষ দিলে। আমি…আমি তেঁতুলতলায় কাঁইবিচি কুড়িয়ে দীঘির ঘাটে গেলাম। পানির পিয়াস লেগেছিল। তাপরে—তাপরে কলজেখাকীটা ধরে নিয়ে গেল।
হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে ছেলেটা। তখনি খোঁড়া লোকটা তার কাঁধ খামচে ধরে। থাপ্পড় মারে গালে। নেমকহারাম!
ছেলেটা পড়ে যায়। কান্না সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছে। নিষ্পলক তাকিয়ে বাপের মার খায়। সাদেরালি হাঁফাতে হাঁফাতে তাকে টেনে ওঠায় ফের। বেধড়ক মারতে থাকে। কষা কেটে রক্ত ঝরে। হিঙন হাজির ঘিয়ে রঙের সোয়েটারে ধুলো আর রক্তের ছোপ।
সাদেরালি চ্যাঁচায়, আজ থেকে তুই ফের আমার সঙ্গে ঘুররি। তারপর পকেট থেকে সেই পয়সাগুলো ছুড়ে ফেলে খালের জলে। বার বার থুতু ফেলে। ছেলেটা আস্তে আস্তে উঠে বসল।
কিছুক্ষণ পরে ছেলেটার কাঁধ খামচে ধরে সে মাঠের পথে নেমেছে। খোদাতালার আসমানকে শুনিয়ে বলছে, আজ আমি শুওর খেলাম। যতদূর যায়, খোঁড়া লোকটা ধুয়োর মতো আওড়ায় কথাটা।
কাঁকরগড়ার দীঘির ঘাটে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে সোলেমান ঠিকেদারের বউ। পাড়ের তেঁতুলবনে বৃষ্টি। কাঁকে একটা পেতলের ঘড়া।
ঘু ঘু ঘু…..ঘু ঘু ঘু!
তেঁতুলবনে ঘুঘু ডাকল। হরবোলা ছেলেটা এসে গেছে। হেই বাপ! আর অমন করে গাঁয়ে গাঁয়ে ভিখ মেঙে ঘুরিস নে। সোনার গতর কালি হয়ে যাবে। রোজ এই তেঁতুলতলায় এসে দাঁড়াস। রোজ তোকে টাকা দেব। চাল দেব। খন্দ দেব। পেণ্টুল দেব। জামা দেব। সব দেব।
চঞ্চল চোখে চারদিকটা দেখে নিয়ে সোলেমানের বউ পাড়ে ওঠে। কেয়া ফণিমনসা নাটাকাঁটার জঙ্গলে চুপিচুপি হেঁটে যায়। ঘুটিঙ কাঁকরে ঢাকা মাটিতে পায়ের তলায় কষ্ট। আর ওই ঘু ঘু আজ তুরপুনের মতো ঘুরে ঘুরে কলজের শুকনো ঘায়ে ঢুকে যাচ্ছে। বড্ড টাটায়।
ঘু ঘু ঘু…ঘু ঘু ঘু!
বুকের কাছে চালের পুটুলিটা লুকোনো, তাতে একটা দশ টাকার নোট। ঠিকাদার টের পেলে জবাই করবে। রূপসী বউয়ের আর সে রূপ নেই। চুলেও পাক ধরেছে একটা দুটো। ঠিকেদারের চোখে আর সেই নেশার রঙটা খেলে না। কথায় কথায় তেড়ে আসে। শহরের মেয়ে নিকে করে আনবে বলে শাসায়।
তেঁতুলবনে ঢুকেই সোলেমান ঠিকেদারের বউ থমকে দাঁড়ায়। জাং দুটো ভারী লাগে। মাথার ওপর ডালপালায় বসে একটা ঘুঘু ডাকছে।
রাগে দুঃখে সে বলে ওঠে, মর মর! তারপর মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে ঝাপসা চোখে। বিশাল মাঠ হু হু করে জ্বলে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে ঘাটে ফিরে আসে। ভাবে, তাহলে কি একটা স্বপ্ন দেখেছিল? ঘড়ায় জল ভরে তেঁতুলবনের দিকে তাকাতে তাকাতে সে বাড়ি ফেরে। হরবোলা ছেলেটা এল না। কিন্তু কাল থেকে তার মাথার ভেতর যে ঘুঘু পাখিটা ঢুকে গেছে সে সমানে ডাকছে আর ডাকছে।
আর তখন দূরের গাঁয়ে এক মোড়লের বাড়ির উঠোনে হরবোলা। ছেলেটাকে মেয়েরা সাধাসাধি করছে ঘুঘু পাখি ডাকতে। সে পাথরের মতো চুপ। তার খোঁড়া বাপটা তার চুল খামচে ধরলে এবার সে কাঁদে আর শুধু বলে জানি না।