হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী

হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্ৰ মন্ত্ৰী

সাধারণ অর্থ হলো মূর্খ ও নির্বোধ রাজার জ্ঞানহীন ও আহাম্মক মন্ত্ৰী। প্রবাদটির মর্মার্থ হচ্ছে-নির্বোধের পরামর্শে চলা নির্বোধ লোক। কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকের বুদ্ধিতে কাজ করে কেউ হাস্যাস্পদ ও বিপন্ন হলে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। হবু রাজার গবু মন্ত্রী অথবা হবচন্দ্র রাজার গবচন্দ্র মন্ত্রী হিসেবেও প্রবাটির ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

প্রবাদটির উৎস আলোচনায় আমরা কিছু কাহিনী-কিংবদন্তির উল্লেখ করতে চাই। এর মধ্যে কিছু কিছু ইতিহাসের কথাও আছে।

মন্টেগোমারি মার্টিনের ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (১৮৩৮) গ্রন্থে রংপুরের রাজা ভবচন্দ্রের কথা আছে। ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের (মে-জুন ১৮৮২) বঙ্গদর্শন পত্রিকায় কামরূপ-রঙ্গপুর প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪ খ্রি.) বলেছেন—

‘এক সময়ে এই কামরূপ রাজ্য অতি বিস্তৃত হইয়াছিল। পূর্বে করতোয়া ইহার সীমা ছিল; আধুনিক আসাম, মণিপুর, জয়ন্ত্যা, কাছাড়, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, রঙ্গপুর, জলপাইগুড়ি ইহার অন্তর্গত ছিল। আইন আকবরীতে লেখে যে, ভগদত্তের বংশের ২৩ জন রাজা এখানে রাজত্ব করেন। যাহাই হউক, পৃথুনামা রাজার পূর্বে কোনো রাজার নামের নির্দেশ পাওয়া যায় না। পৃথু রাজার রাজধানী তল্মা নদীতীরে, চাকলা বোদা ও পরগণা বৈকুণ্ঠপুরের মধ্যস্থলে ছিল, অদ্যাপি তাহার ভগ্নাবশেষে আছে।

তারপর পালবংশীয়েরা রঙ্গপুরে রাজা হয়েন। ইতিপূর্বে রঙ্গপুর কামরূপ হইতে কিয়ৎকালজন্য পৃথক রাজ্য হইয়াছিল। বোধ হয় রঙ্গপুরে পালবংশের প্রথম রাজা ধর্মপাল। এই পালেরা ইউরোপের বুর্বোবংশের আর আসিয়ার তৈমুরবংশের ন্যায় নানা দেশে রাজা ছিলেন। গৌড়ে পাল রাজা, রঙ্গপুরে পাল রাজা, কামরূপে পাল রাজা ছিল। বোধ হয়, এই রাজবংশ অতিশয় প্রতাপশালী ছিল। ধর্মপালের রাজধানীর ভগ্নাবশেষ, ডিমলার দক্ষিণে আজিও আছে। তাহার ক্রোশেক দূরে, রাণী মীনাবতীর গড় ছিল। রাণী মীনাবতী ধর্মপালের ভ্রাতৃজায়া। মীনাবতী অতি তেজস্বিনী ছিলেন—বড় দুর্দান্তপ্রতাপ। গোপীচন্দ্র নামে তাহার পুত্র ছিল। মীনাবতী ধর্মপালকে বলিলেন, “আমার পুত্র রাজা হইবে, তুমি কে?” ধর্মপাল রাজ্য না দেওয়াতে মীনাবতী সৈন্য লইয়া তাহাকে আক্রমণ করিলেন এবং যুদ্ধে তাহাকে পরাভূত করিয়া গোপীচন্দ্রকে সিংহাসনে স্থাপিত করিলেন। কিন্তু গোপীচন্দ্ৰ নামমাত্র রাজা হইলেন, রাজমাতা তাহাকে রাজ্য করিতে দিবেন না, স্বয়ং রাজ্য করিবেন ইচ্ছা। পুত্রকে ভুলাইবার জন্য তাহার এক শত মহিষী করিয়া দিলেন, কিন্তু পুত্র ভুলিল না। তখন মাতা পুত্রকে ধর্মে মতি দিতে লাগিলেন। এইবার পুত্র ভুলিয়া যোগধর্ম অবলম্বন করিয়া বনে গমন করিলেন।

গোপীচন্দ্রের পর তাহার পুত্র ভবচন্দ্র রাজা হইলেন। পাঠক, হবচন্দ্ৰ রাজা, গবচন্দ্র পাত্রের কথা শুনিয়াছেন? এই সেই হবচন্দ্র। নাম হবচন্দ্র নয়— ভবচন্দ্র, আর একটি নাম উদয়চন্দ্র। ভবচন্দ্র গবচন্দ্রের বুদ্ধিবিদ্যার পরিচয় লোকপ্রবাদে এত আছে যে, তাহার পুনরুক্তি না করিলেও হয়। লোকে গল্প করে, গবচন্দ্র, বুদ্ধি বাহির হইয়া যাইবে ভয়ে, ঢিলে দিয়া নাক কান বন্ধ করিয়া রাখিতেন। তাহাতেও সন্তুষ্ট নন, পাছে বুদ্ধি বাহির হইয়া যায় ভয়ে সিন্ধুকে গিয়া লুকাইয়া থাকিতেন, রাজার কোনো বিপদ আপদ পড়িলে, সিন্ধুক হইতে বাহির হইয়া, নাক কানে পুটলি খুলিয়া বুদ্ধি বাহির করিতেন।

একদিন রাজার এইরূপ বিপদ উপস্থিত, নগরে একটা শূকর দেখা দিয়াছে। শূকর রাজসমীপে অনীত হইলে রাজা কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না যে, এ কী জন্তু। বিপদ আশঙ্কা করিয়া মন্ত্রীকে সিন্ধুক হইতে বাহির করিলেন। মন্ত্রী ঢিপলে খুলিয়া অনেক চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন, এটা অবশ্য হস্তি, না খাইয়া রোগা হইয়াছে, নচেৎ ইন্দুর, খাইয়া বড় মোটা হইয়াছে।

আর একদিন দুইজন পথিক আসিয়া সায়াহ্নে এক পুষ্করিণীতীরে উত্তীর্ণ হইল। রাত্রে পাকশাক করিবার জন্য সরোবরতীরে স্থান পরিষ্কার করিয়া চুলা কাটিতে আরম্ভ করিল। নগরের রক্ষিবর্গ দেখিয়া মনে করিল যে, যখন পুকুর থাকিতেও তার কাছে আবার খানা কাটিতেছে, তখন অবশ্য ইহাদের অসৎ অভিপ্রায় আছে। রক্ষিগণ পথিক দুইজনকে গ্রেপ্তার করিয়া রাজসন্নিধানে লইয়া গেল। রাজা স্বয়ং এরূপ গুরুতর সমস্যার কিছু মীমাংসা করিতে না পারিয়া পরম ধীমান পাত্র মহাশয়কে সিন্ধুকের ভিতর হইতে বাহির করিলেন। তিনি নাক কানের ঢিপলে খুলিয়াই দিব্যচক্ষে কাণ্ডখানা দর্পণের মতো পরিষ্কার দেখিলেন। তিনি আজ্ঞা করিলেন, “নিশ্চিত ইহারা চোর! পুকুরটা চুরি করিবার জন্য পাড়ের উপর সিঁধ কাটিতেছিল। ইহাদিগকে শূলে দেওয়া বিধেয়।” রাজা ভবচন্দ্র, মন্ত্রীর বুদ্ধিপ্রাখর্যে মুগ্ধ হইয়া তৎক্ষণেই পুষ্করিণীচোরদ্বয়ের প্রতি শূলে যাইবার বিধি প্রচার করিলেন।

…পুকুরচোরেরা শূলে যাইবার পূর্বে পরামর্শ করিয়া হঠাৎ পরস্পর ঠেলাঠেলি মারামারি আরম্ভ করিল। রাজা ও রাজমন্ত্রী এই বিচিত্র কাণ্ড দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ব্যাপার কী? তখন একজন চোর নিবেদন করিল যে, “হে মহরাজা! দেখুন, দুই শূলের মধ্যে একটি বড়, একটি ছোট। আমরা জ্যোতিষ জানি। আমরা গণনা করিয়া জানিয়াছি যে, আজি যে ব্যক্তি এই দীর্ঘ শূলে আরোহণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিবে, সে পুনর্জন্মে চক্রবর্তী রাজা হইয়া সদ্বীপা সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হইবে, আর যে এই ছোট শূলে মরিবে, সে তাহার মন্ত্রী হইয়া জন্মিবে। মহারাজ! তাই আমি দীর্ঘ শূলে চড়িতে যাইতেছিলাম, এই হতভাগা আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে, আপনি বড় শূলে মরিয়া সম্রাট হইতে চায়।”

তখন দ্বিতীয় চোর জোড়হাত করিয়া বলিল “মহারাজ! ও কে, যে ও চক্রবর্তী রাজা হইবে? আমি কেন না হইব? আজ্ঞা হউক, ও ছোট শূলে চড়ু ক, আমি সম্রাট হইব, ও আমার মন্ত্রী হইবে।” তখন রাজা ভবচন্দ্ৰ ক্রোধে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিলেন, “কী, এত বড় স্পর্দ্ধা! তোরা চোর হইয়া জন্মান্তরে চক্রবর্তী রাজা হইতে চাহিস! সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হইবার উপযুক্ত পাত্র যদি কেহ থাকে, তবে সে আমি। আমি থাকিতে তোরা!!” এই বলিয়া রাজা ভবচন্দ্র তখন দ্বারিগণকে আজ্ঞা দিলেন যে, এই পাপাত্মাদিগকে তাড়াইয়া বাহির করিয়া দাও। এবং মন্ত্রিবরকে আহ্বানপূর্বক সদ্বীপা সসাগরা পৃথিবীর সাম্রাজ্যের লোভে স্বয়ং উচ্চ শূন আরোহণ করিলেন। মন্ত্রী মহাশয়ও আগামী জন্মে তাদৃশ চক্রবর্তী রাজার মন্ত্রী হইবার লোভে ছোট শূলে গিয়া চড়িলেন। এইরূপে তাহাদের মানবলীলা সমাপ্ত হইল।

এ ইতিহাস নহে—এ সত্যও নহে—এ পিতামহীর উপন্যাস মাত্র। তবে এ ঐতিহাসিক প্রবন্ধে এই অমূলক গালগল্পকে স্থান দিলাম কেন? এই কথাগুলি রাজার ইতিহাস নহে, লোকের ইতিহাস বটে। ইহাতে দেখা যায়, সে রাজপুরুষদিগের সম্বন্ধে এতদূর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক গল্প বাঙ্গালির মধ্যে প্রচার লাভ করিয়াছে। ভবচন্দ্র রাজা ও গবচন্দ্র পাত্রের দ্বারাও বাঙ্গালায় রাজ্য চলিতে পারে, ইহা বাঙ্গালির বিশ্বাস। যে দেশে এই সকল প্রবাদ চলিত, সে দেশের লোকের বিবেচনা এই যে, রাজা রাজড়া সচরাচর ঘোরতর গণ্ডমূর্খ হইয়া থাকে, হইলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। বাস্তবিক এই কথাই সত্য। বাঙ্গালায় চিরকাল সমাজই সমাজকে শাসিত ও রক্ষিত করিয়া আসিয়াছে। রাজারা হয় সেই বাঙ্গালা কবিকুলরত্ন শ্রীহর্ষদেবের চিত্রিত বৎসরাজের ন্যায় মোমের পুতুল, নয় এই ভবচন্দ্র হবচন্দ্রের ন্যায় বারোইয়ারি সং।’

নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮ খ্রি.) তার বিশ্বকোষ ষোড়শ ভাগে প্রায় একই ধরনের কিংবদন্তির কথা লিখেছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন-

“ভীষণ ঝটিকায় কোনো এক বণিকের নৌকা ডুবিয়া বিস্তর ক্ষতি হয়। রাজার নিকট সে এই ব্যাপার জ্ঞাপন করিলে রাজা মন্ত্রীর সহিত বিশেষ বিবেচনা করিয়া বলিলেন যে, কুম্ভকারের পুঁইশালা হইতে ধূম উত্থিত হইয়া সম্ভবত মেঘের উৎপত্তি হইয়াছে এবং তাহাই ঝড়ের কারণ, সুতরাং কুম্ভকারই বণিকের ক্ষতিপূরণ করিতে বাধ্য।’

সুবচন্দ্র মিত্র (১৮৭২-১৯১৩ খ্রি.) তার সরল বাঙ্গালা অভিধানে রঙ্গপুর ভুক্তিতে জানিয়েছেন-

‘ভবচন্দ্র ও তাহার মন্ত্রী গবচন্দ্রের নামে নির্বুদ্ধিতার অবতারস্বরূপে অদ্যাপি জনশ্রুতি জাগাইয়া রাখিয়াছে।’ কোচবিহারের ইতিহাসে (১৯৩৬) খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ বলছেন—

‘গোপীচান্দ রাজার পুত্রের নাম ভবচন্দ্র; ভবচন্দ্রের পুত্রের নাম হবচন্দ্র রাজা এবং সেই হবচন্দ্র রাজার গবচন্দ্র মন্ত্রীর নাম নানা প্রবাদবাক্যে শুনিতে পাওয়া যায়। রঙ্গপুরের দক্ষিণে বাদুয়ারে বাগদেবীর মন্দির আছে; কথিত আছে যে, এই বাগদেবী ভবচন্দ্রের ইষ্টদেবী ছিলেন। সেই মন্দিরের নিকট অবস্থিত পালের গড় এক্ষণে দানেশ নগর নামে পরিচিত হইতেছে। পীরগঞ্জের দুইক্রোশ দক্ষিণপশ্চিমে, লোরারপাটে ভবচন্দ্রের আত্মীয় লোরা রাজা বাস করিতেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে।’

কোচবিহারের ইতিহাসমতে, ‘কেহ কেহ তাহাকে (হবচন্দ্র) পালবংশের রাজা বলিয়া অনুমান করিয়া থাকেন। করতোয়া নদীর তীরবর্তী হাওড়া হইতে ঘোড়াঘাটের দক্ষিণ পর্যন্ত ভূভাগে অবস্থিত অনেক ধ্বংসাবশেষ হবচন্দ্র রাজা এবং গবচন্দ্র মন্ত্রীর কীর্তির চিহ্ন বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। কথিত আছে যে, হবচন্দ্র রাজা প্রথমে গোপীনাথপুরে এবং পরে বাদুয়ারে বাস করিতেন; রঙ্গপুর নগরের ধাপ নামক স্থান তাহার ধাপরাজ্যের স্মৃতি রক্ষা করিতেছে। ডোমারের নিকট বিন্নার দিঘি নামক যে বৃহৎ দিঘি আছে, তাহা হবচন্দ্রের অধীন বিন্না রাজা নামক কোনো সামন্তের খনিত বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে; ঐ দিঘি দৈর্ঘ্যে সাতশত গজের ন্যূন নহে।’ অতঃপর পূর্বোক্ত কাহিনীর অবতারণা করেছেন আমানতউল্লাহ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি.) হবুচন্দ্র ও গবুচন্দ্র নিয়ে হিং টিং ছট্‌ ও জুতা- আবিষ্কারের মতো মজার কবিতা লিখেছেন।

আমাদের আলোচ্য প্রবাদের উৎস রঙ্গপুর বা রংপুর। ইতিহাসের দীর্ঘ আলোচনা ও কিংবদন্তির বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যায়। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ইত্যাদি উপজেলার নানা স্থানের চাক্ষুষ পরিচয় পণ্ডিত ইতিহাসবিদগণের অবশ্যই থাকার কথা। যাদের নাই তারা যদি কেউ ঐ অঞ্চলের ইতিহাসে ঐতিহ্য নিয়ে জ্ঞান দান করন তবে তা অবশ্যই লজ্জার। বাগদুয়ার, উদয়পুর, দানেশনগর, পালেরগড়, লোরার পাট কিংবা ধাপ অতি পরিচিত স্থান বলে সেসব স্থানের অতীত আলোচনা না করে বরং হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর প্রসঙ্গটি কিংবদন্তি ও প্রচলিত কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *