স্মৃতির চোরা পথে
পুরোনো খবরের কাগজের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় আরেকবার হাত বুলিয়ে নিলো নন্দিনী৷ জ্বলে যাওয়া ছবিটা আছে, আর নামটা তো রয়েছেই৷ বিয়ের পর নিজের সব জিনিস ও বাড়ি থেকে না আনলেও এই কাগজের কাটিংটা মনে করে ভরেছিলো শ্বশুর বাড়ি থেকে দেওয়া গায়ে হলুদের বাক্সের মধ্যে৷ শুধু কি একটা নাম ছিলো এর মধ্যে! না, বেশ কিছু অপরাধবোধের স্মৃতিও বোধহয় ছিল খবরটাতে৷
অঙ্কুশ ভৌমিক, বয়েস তেইশ, ভ্রূতে একটা কাটা দাগ, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম৷ পরনে ছিল আসমানী রঙের টিশার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স৷
চোখের সামনে ভেসে ওঠে অঙ্কুশের সেই কলেজবেলার ছবিটা৷ ছটফটে প্রাণচঞ্চল একটা ছেলে৷ নন্দিনীকে লেগপুল না করে যার শান্তি ছিলো না৷ মুখচোরা নন্দিনী একমাত্র জব্দ হতো অঙ্কুশের কাছে৷ এমন এমন কথা বলতো ছেলেটা যে নন্দিনীর মতো স্বল্পভাষীও কথা বলতে বাধ্য হতো৷ নন্দিনীর ছিলো বেঙ্গলি অনার্স, অঙ্কুশ ম্যাথের স্টুডেন্ট৷ ওদের দেখা বলতে কলেজ ক্যান্টিন, অথবা ক্যাম্পাসের সবুজ প্রান্তরে৷ অঙ্কুশ যেন দায়িত্ব নিয়েছিলো, নন্দিনীকে স্মার্ট, প্রেজেন্টেবেল করবেই৷ প্রচেষ্টার ত্রুটি ছিলো না অঙ্কুশের৷ কীভাবে ছেলেদের ইভটিজিং-এর জবাব দিতে হবে সেগুলো পর্যন্ত শেখাতো অঙ্কুশ৷ লজ্জা করতো নন্দিনীর৷ চোখ নীচু করে নিতো৷ অঙ্কুশ ফিচেল হেসে বলতো, এই নন্দিনী তুই আবার লজ্জা পাচ্ছিস, তার মানে আমার এত পরিশ্রম বিফলে গেলো! এর থেকে তো একটা পাহাড় একা হাতে কাটলে গিনিসবুকে নাম উঠতো রে৷ তোর পিছনে এত খাটনি অরণ্যে রোদন হয়ে গেল৷ ওর কথার ঝাঁজেই আবার উজ্জীবিত হতো নন্দিনী৷ ভরা ক্লাসে প্রফেসরের সামনে দাঁড়িয়ে বলতো, স্যার আমি জানি আপনার কোশ্চেনের অ্যানসার৷ ক্লাস শুদ্ধু সবাই হেসে বলেছিলো, ও বাবা! নন্দিনী বলবে বলছে৷ দেখিস অজ্ঞান হয়ে যাস না রে! সকলের বিদ্রুপ মিশ্রিত কথায় হাত পা কেঁপে উঠেছিলো নন্দিনীর৷ তবুও অঙ্কুশের বলা কথাগুলো কানের কাছে বাজছিলো৷
নন্দিনী পারবি, তুই ঠিক পারবি৷ তোর মধ্যে সব কিছু আছে, শুধু বহিঃপ্রকাশ করতে হবে বুঝলি৷ সেদিন সব বাঁধা কাটিয়ে নন্দিনী ব্যাখ্যা করেছিলো, কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্ন পত্রের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল উপন্যাসের বীজ৷ প্রফেসরের চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল ওর উত্তর একদম ঠিক ছিল৷ ক্যান্টিনে গিয়ে অঙ্কুশের হাতটা জড়িয়ে ধরে নন্দিনী বলেছিলো, আজ শুধু তোর জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে পারলাম৷ লিখতে নয়, আমি ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলতেও পারি৷ নন্দিনী আপ্লুত গলায় বলেছিলো, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অঙ্কুশ৷ গোটা কলেজ জানতো ওদের বন্ধুত্বের কথা৷ বন্ধুরা মজা করে রাহুল আর অঞ্জলী বলে রাগাতো ওদের৷ এমনকী নন্দিনীর অমন রাশভারী বাবাকে পর্যন্ত কব্জা করে ফেলেছিলো অঙ্কুশ৷ কলেজ এক্সকারসনে বাবা বলেছিলো, যদি অঙ্কুশ যায় তো তুইও যাবি৷ নন্দিনীর জন্মদিনের রাতেই বাবার সাথে আলাপ হয়েছিলো অঙ্কুশের৷ তারপর প্রায়ই হোস্টেল থেকে চলে আসতো নন্দিনীর বাড়িতে৷ নন্দিনী হয়তো তখন গানের স্কুলে, বাবা মায়ের সাথে গল্প করে, মায়ের হাতের রান্না খেয়ে চলে যেতো৷ নন্দিনী বাড়ি ফিরে শুনতে পেতো, ছেলেটা বড্ড ভালো রে৷ কামারপুকুরের ছেলে হলে কি হবে, ভীষণ স্মার্ট৷ বাবা তো বলেই ফেলেছিলো, আমার মেয়েটাকে দেখো, কে বলবে ওর জন্ম কলকাতায়! না, হিংসে হয়নি নন্দিনীর বরং আনন্দই হয়েছিলো, কামারপুকুরের ছেলেটার প্রশংসা শুনে৷ মা ভালো কিছু বানালেই অঙ্কুশের জন্য টিফিন বক্সে দিয়ে দিতো৷ অঙ্কুশ বলতো, বুঝলি, আন্টি আমাকে না দিয়ে খেতেই পারবে না৷ নন্দিনী কপট রাগ দেখিয়ে বলতো, আমার বাড়িতে গিয়ে চড়াও হয়ে আমার জায়গাটা তো নিয়েই নিলি রে৷
সেদিন ছিলো এমনই এক শ্রাবনের দুপুর৷ আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা৷ অঙ্কুশ বললো, কলেজ বাঙ্ক করে মুভি না দেখলে নাকি কলেজের মজাই নেই৷ নন্দিনী ভয়ে ভয়ে বলেছিল, যদি বাবা জানতে পারে তো… ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে অঙ্কুশ বলেছিলো, চল রঞ্জু তুই আমি, সুমন আর কেয়া মিলে মুভি দেখে আসি৷ গুড গার্ল ক্লাস করুক৷ অঙ্কুশ অন্যদের সাথে মুভি দেখতে যাবে আর ও যাবে না ভেবেই রাগে গা রিরি করে উঠেছিলো নন্দিনীর৷ রাগী গলায় বলেছিলো, আমিও যাবো৷ অঙ্কুশের ঠোঁটে ফাজিল হাসির আনাগোনা চোখ এড়ায়নি নন্দিনীর৷ রঞ্জনা বলেছিলো, ফাইনাল ইয়ার তো প্রায় শেষ৷ আর কদিনই বা থাকবো একসাথে৷
হইহই করে ওরা গিয়েছিলো মুভি দেখতে৷ সবার টিকিটের দাম অঙ্কুশ দিয়েছিলো৷ নন্দিনী কানে কানে বলেছিলো, লটারি লেগেছে তোর?
ও ফিসফিস করে বলেছিলো, আজ এই অধমের জন্মদিন৷ কাউকে বলিস না যেন৷
হকচকিয়ে গিয়েছিলো নন্দিনী৷ জন্মদিনের মতো ভালো একটা দিনকে লুকিয়ে রাখার কারণটা ঠিক কি, সেটাই খোঁজার চেষ্টা করছিলো৷ কিছুই খুঁজে না পেয়ে, বললো, তুই লুকাতে চাইছিস কেন রে?
অঙ্কুশ ওর স্বভাবসিদ্ধ স্বরে বলেছিলো, আমি জন্মে কার কোন কার্যসিদ্ধি হয়েছে, যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে৷ চুপচাপ মুভি দেখতে দে, বকিস না৷ তোর বকবকানির চোটে আমির খান কি বললো শুনতেই পেলাম না৷ থামিয়ে দিয়েছিলো নন্দিনীকে৷ তবুও নন্দিনীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, অঙ্কুশকে কি গিফট দেওয়া যায়৷ অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে হওয়ার সুবাদে হাত খরচ মন্দ পেতো না ও৷ জমেছেও বেশ কিছু৷ ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো, অঙ্কুশেরই অসাবধান মুহূর্তে বলা একটা কথা৷ অঙ্কুশ বলেছিলো, যদি কখনো টাকা জমাতে পারি তাহলে একটা গিটার কিনবো৷ গিটার বাজিয়ে এলোমেলো গান গাইবো, তুই শুনবি৷ আমিও ভালো গাইতে পারবো না, তুইও ভালো শ্রোতা নোস, তাই অ্যাডজাস্ট করে নেবো৷
ভালো শ্রোতা নই মানে? বলে, দুটো কিল মেরেছিলো নন্দিনী৷
মুভি থেকে বেরিয়েই সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো ওরা দুজনে৷ নন্দিনী সোজা গিয়েছিলো একটা গিটারের দোকানে৷ অঙ্কুশকে বলেছিলো, নন্দিনী গিটার বাজাতে চায়৷ ও যেন পছন্দ করে দেয়৷ অঙ্কুশের চোখে ভালোলাগার রেশ দেখেছিল৷ সব গুলো গিটার ছুঁয়ে দেখার পর একটা পছন্দ করেছিল ও৷ নন্দিনী অ্যাডভান্স দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলো৷
পরেরদিন গিটার হাতে কলেজে ঢুকেছিলো৷ সবাই চমকে উঠে বলেছিলো, হারমোনিয়াম ছেড়ে কবে থেকে গিটার ধরেছে নন্দিনী৷
নীল ভেলভেটের ব্যাগটা অঙ্কুশের হাতে দিয়ে বলেছিলো, বার্থ ডে গিফট৷
এত কথা বলা ছেলেটা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলো মুহূর্তের মধ্যে৷ ওর দু-চোখ ছাপিয়ে জল নেমেছিলো৷ নন্দিনী হেসে বলেছিলো, এমন বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হলাম আমি৷ অঙ্কুশ ভৌমিকের চোখেও নোনতা জল পড়ে তাহলে৷ সামলে নিয়ে অঙ্কুশ বলেছিলো, কিন্তু এত দামি গিফট আমি নিতে পারবো না৷
নন্দিনী রাগ দেখিয়ে বলেছিলো, গাইতে পারবি না সেটা স্বীকার করে নে, অজুহাত দিস না৷ গিফটের কখনো দাম হয় না৷
সকলকে চমকে দিয়ে অঙ্কুশ গিটারের তারে আঙুল ছুঁইয়ে ছিলো৷ দরাজ গলায় গেয়েছিলো… সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা৷
বন্ধুদের হাততালির শব্দে সম্বিৎ ফিরেছিলো নন্দিনীর৷
যথারীতি কলেজের পার্ট মিটিয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলো নন্দিনী৷ অঙ্কুশও এম. এস. সি. ভর্তি হয়েছিলো৷ রোজ দেখা হতো না আর৷ তবে সপ্তাহে তিনদিন অবশ্যই দেখা করতো ওরা৷
নন্দিনীকে যেদিন প্রথম দেখতে এলো পাত্রপক্ষ সেদিনই মারাত্মক ঝগড়া করেছিলো অঙ্কুশ৷ কেন নন্দিনী এত কম বয়সে বিয়ে করে ফেলবে সেই নিয়েই ঝগড়া৷ তারপরেই সেই অপ্রত্যাশিত কথাটা বলেছিলো অঙ্কুশ৷ যেটা এতদিনে একবারও কল্পনা করতে পারেনি নন্দিনী৷ অঙ্কুশ চিৎকার করে বলেছিলো, না তুই অন্য কারোর হতে পারিস না নন্দিনী৷ তুই আমার, আমি তোকে ভালোবাসি৷
অবশ হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর হাত পা৷ গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো, শ্রবনেন্দ্রিয়ও যেন অকেজো হয়ে গিয়েছিলো৷ এসব কি বলছে অঙ্কুশ!! নন্দিনী কোনোদিন অঙ্কুশকে প্রেমিক ভাবে নি৷ কোনোদিন ভাবেনি অঙ্কুশ ওর শয্যাসঙ্গী হবে, ওকে সিঁদুর পরাবে, ও নিজে নন্দিনী ভৌমিক হবে কি করে! নন্দিনী সব সময় ভেবেছে, অঙ্কুশ ওর বিয়েতে এসে হইহুল্লোড় করে বলবে, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে তাই আজ মটনটা আমি একটু বেশি খাবো৷ বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে প্রথম তত্ত্ব নিয়ে যাবে অঙ্কুশ৷ নন্দিনী নিজে সেজেগুজে যাবে অঙ্কুশের জন্য মেয়ে দেখতে৷ পৃথিবীর সেরা মেয়েটাকে ও খুঁজে নিয়ে আসবে ওর বন্ধুর জন্য৷
এসব গল্পও ওরা বহুবার করেছে৷ তারপরেও অঙ্কুশ কি করে ওদের বন্ধুত্বকে অপমান করতে পারে?
দু-চোখে ঘৃণা ফুটিয়ে নন্দিনী বলেছিলো, ছি… তুই আমাকে এতদিন এই চোখে দেখেছিলিস! আমি তো ভাবতেই পারছি না তুই এতটা নোংরা মানসিকতার৷ দু-চোখের জলে চারিদিক ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো নন্দিনীর৷ তবুও বলে যাচ্ছিলো ও৷ একদিন কম কথা বলার রোগটা অঙ্কুশই সারিয়ে ছিলো, আজ সেটাই হয়তো কাজ করেছিলো৷ একবারও না থেমে বলছিল নন্দিনী… এই তোর পবিত্র বন্ধুত্ব? তুই তো বন্ধুর নামে কলঙ্ক৷ কেন রে অঙ্কুশ, একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে প্রেম ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক কি থাকতে পারে না? লজ্জা করছে আমার, তোকে আমি এতদিন বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবেছি বলে৷ একমুহূর্তও দাঁড়ায়নি নন্দিনী৷ কাঁপতে কাঁপতে অটো ধরেছিলো৷ বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠছিলো৷ এটাই ওর বন্ধু অঙ্কুশ! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো৷ আর পাঁচটা ছেলের সাথে কোনো পার্থক্য নেই অঙ্কুশের৷ বাড়ি ফিরেই বাবাকে বলেছিলো, আমার অনিরুদ্ধকে পছন্দ হয়েছে, তোমরা এগোতে পারো৷
বাবা একটু চমকেই গিয়েছিলো৷ যে মেয়ে সকালেও গাইগুই করছিলো বিয়ের কথায় সেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলো! মা বললো, নিশ্চয়ই অঙ্কুশ বুঝিয়েছে, যে অনিরুদ্ধ ভালো ছেলে, বিয়েটা করে ফেল৷ মেয়ে তো তোমার অঙ্কুশের কথায় ওঠে বসে, তাই রাজি হয়ে গেছে৷ অঙ্কুশ নামটা আর শুনতেই ইচ্ছে করছিলো না নন্দিনীর৷
ইচ্ছে করছিলো, বাবা মায়ের সামনে ওর মুখোশটা খুলে দিতে৷ ও এ বাড়িতে এতদিন ছেলের মতো এসেছে, তারপর ওকে নিয়ে কি ভেবেছে সেটাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো নন্দিনীর৷
তবুও সামলে নিয়েছে নিজেকে৷ না, ছোটো করেনি ও অঙ্কুশকে কারোর চোখে৷
বেশ কয়দিন ধরেই আর কোনো যোগাযোগ নেই অঙ্কুশ আর নন্দিনীর৷
বিয়ের মার্কেটিং শুরু হয়ে গেছে নন্দিনীর৷ অথচ ওর সব থেকে কাছের বন্ধুর পাত্তা নেই৷ অবশ্য আর কি অঙ্কুশকে বন্ধু বলাটা সমীচিন হবে!
তবুও ফোনটা করেই ফেললো নন্দিনী৷
হোস্টেলের ছেলেরা জানালো অঙ্কুশ হোস্টেলে নেই, বাড়ি গেছে৷ অঙ্কুশের বাড়ির নাম্বারে ফোন করেছিলো নন্দিনী৷
বড়ো মুখ করে একদিন বলেছিলো, তোর বিয়েতে আমিই হবো কন্যা পক্ষের প্রতিনিধি৷ তোর বরকে গিয়ে বলবো, এই বুদ্ধুটাকে আমি মানুষ করলাম৷ তোর বর হয়তো আমার হাতে দামি সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বলবে, ভাগ্যিস মানুষ করেছিলে, তাই আমি ছাগলকে বিয়ে করলাম না৷ নন্দিনী রেগে গিয়ে ওকে মারার জন্য ছুটতো৷ এমনই ছিলো তো ওদের সম্পর্কটা৷ বৃষ্টির জলের মতো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার৷ এ পিঠে দাঁড়ালে ওদিকটা দেখা যেতো৷ হঠাৎ কি ঘটে গেলো, কেন অঙ্কুশ ছোটো করলো ওদের পবিত্র সম্পর্কটাকে৷ চোখের শিরা ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো নন্দিনীর৷
অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে ফোনটা কানে চেপে বললো, হ্যালো৷ মহিলা কণ্ঠ বলে উঠলো, তুমি নন্দিনী৷ আমার ছেলেকে নাচানোর সময় মনে ছিলো না, এখন আবার ফোন করে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছ?
ফোনটা মাঝপথে কেড়ে নিলো কেউ৷ একটুক্ষন চুপ থেকে অঙ্কুশ বললো, মায়ের কথায় কিছু মনে করিস না৷
আমি রঞ্জনার কাছে খবর পেলাম তোর বিয়ের৷ যাবো রে, নিশ্চয়ই যাবো তোর বিয়ের আগেই যাবো৷ তোকে গিফটটা আগেই দেবো৷
নন্দিনীর কানে তখনো অঙ্কুশের মায়ের কথাগুলো ভাসছিলো৷ ছেলে নাচানো শব্দটা ওলটপালট করে দিচ্ছিলো ওর ভাবনা চিন্তাকে৷
ছি ছি, অঙ্কুশ তার মানে নিজের মায়ের কাছে এমন কিছু বলেছে যে ওর মা নন্দিনীকে খুব খারাপ মেয়ে ভেবেছেন৷ আর ইচ্ছে ছিলো না নন্দিনীর অঙ্কুশের মুখোমুখি হতে৷
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিলো, কিছুতেই যেন ওই মুখটা ওর সামনে আর না আসে৷ পুরোনো সব স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছিলো নন্দিনীর৷
ওদের কলেজ ক্যান্টিন, ওদের খুনসুটি, নবীন বরণ, মুভি, ফুচকা সব কিছু…
বিয়ের ঠিক পাঁচদিন আগে সন্ধ্যেবেলা চমকে উঠেছিলো অঙ্কুশকে সামনে দেখে৷
নন্দিনী তখন এক মনে একটা উপন্যাস পড়ছিলো৷ কি উপন্যাস আজ আর মনেও নেই৷ হয়তো বুদ্ধদেব গুহর কোয়েলের কাছে, অথবা একটু উষ্ণতার জন্য৷
মায়ের গলার আওয়াজে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো… মা হাসি হাসি মুখে বলেছিলো, এই তোর ছেলের মতো কাজ? নন্দিনীর বিয়েতে তুইই নেই৷ কত কাজ বলতো, তোর আঙ্কেল তো রোজ একবার করে তোর নাম বলছে রে৷ অঙ্কুশের মুখেও মেকি হাসি…
নীল কভারে মোড়া গিটারের ব্যাগটা ফেরত দিয়ে বলেছিলো, এটা কয়েকদিন তোর কাছে রেখে দে৷ আর এই যে এটা তোর গিফট৷
একদিন রাস্তার ধারে একটা দোকানে একটা তাজমহলের শোপিস দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো নন্দিনী৷ বলেছিলো, দেখ পুরো কপি৷ আমি যখন আগ্রা গিয়েছিলাম যে তাজমহল দেখেছিলাম এটা অবিকল ওরকম৷ শিল্পীর হাতের কাজ আছে বলতে হবে বলেছিলো অঙ্কুশ৷ দুজনেই ঢুকে দাম জিজ্ঞেস করেছিলো৷ পাঁচ হাজার টাকা দাম বলায় মুখ শুকনো করে নন্দিনী বলেছিলো, বাবা, শো পিসের এত দাম!
সেটাই আজ ওর বিয়েতে গিফট এনেছে অঙ্কুশ৷
নন্দিনী জানে ওর সব পছন্দ অপছন্দ মনে রেখেছে অঙ্কুশ৷ কয়েকদিন আগে হলেও তাজমহলটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতো ও, কিন্তু আজ যখন অঙ্কুশের মানসিকতা ওর সামনে পরিষ্কার, আর ওর মায়ের বলা কথাগুলো মনের মধ্যে রক্ত ঝরিয়েই চলছে তখন আর আনন্দিত হতে পারলো না ও৷ তবুও ক্লান্ত হেসে বলেছিলো, এত খরচ করতে গেলি কেন?
অঙ্কুশ বলেছিলো, একবারই তো তোকে উপহার দেবো৷ মায়ের হাজার অনুরোধেও সেদিন খেয়ে যায়নি অঙ্কুশ৷
তারপরের দিনই খবরটা বেরিয়েছিলো কাগজে৷ যাদবপুর ইউনিভার্সিটির এম. এস. সি.-র স্টুডেন্ট অঙ্কুশ ভৌমিককে কে বা কারা হোস্টেল থেকে কিডন্যাপ করেছে৷ নীচে অঙ্কুশের চেহারার বর্ণনা আর ওর একটা ছবি৷
খবরটা দেখে অবধি তোলপাড় চলছিলো মনের ভিতরে৷ বাবা মায়ের মুখেও হাসি নেই৷ বিয়ে বাড়ির পরিবেশে গাম্ভীর্য্যের চাদর বিছিয়ে দিয়েছিলো অঙ্কুশের খবরটা৷
অনিরুদ্ধদের বাড়িতে কিছু জানানো হয়নি বলেই বিয়েটা হচ্ছিলো৷ না হলে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনী৷
কোথায় গেলো ছেলেটা…
ওর বাবা মা এসে হাজির হলো নন্দিনীর আইবুড়ো ভাতের দিন৷ যাচ্ছেতাই করে অপমান করে গেলো নন্দিনীকে৷
ওর জন্যই নাকি অঙ্কুশের আজ এই অবস্থা৷ একটা কথাও না বলে নন্দিনী সহ্য করছিলো বন্ধুত্বের দায়৷
এর মধ্যেই চলছিলো বিয়ের কাজ কর্ম৷
অনিরুদ্ধদের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব পৌঁছে গেছে নন্দিনীদের বাড়িতে৷ হলুদ শাড়ি পরে নন্দিনীর গায়ে হলুদের মাখামাখি৷ ঠিক সেই মুহূর্তে রঞ্জনা, কেয়া ফিসফিস করে বললো, ওটা কিডন্যাপ ছিলো না রে, অঙ্কুশ সুইসাইড করেছে৷ আজ বডি পাওয়া গেছে৷ এই মাত্র টিভিতে দেখলাম৷
গায়ে হলুদের পিঁড়ি থেকে ছুটে গিয়ে টিভি চালিয়েছিলো নন্দিনী৷ খবরে বলছিলো, অঙ্কুশ ভৌমিকের কিডন্যাপিং এর ঘটনাটা সত্যি নয়, কারণ ডেড বডির পকেটে পাওয়া গেছে একটা চিরকুট৷ তাতে লেখা ছিলো, ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়৷ জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণাই ওর মৃত্যুর কারণ৷
পাগলের মতো কেঁদেছিল নন্দিনী৷
মাথা নেড়ে বলেই যাচ্ছিলো, এটা বন্ধুত্ব নয় রে অঙ্কুশ৷ তুই আমার বন্ধু হলে আজকের দিনে আমাকে এভাবে বিপদে ফেলতে পারতিস না৷ এটা বন্ধুত্ব হতে পারে না রে অঙ্কুশ৷ বন্ধু তারাই হয় যারা সবসময় পাশে থাকে, সব পরিস্থিতিতে সাথে থাকে৷ নিজেকে শেষ করে তুই আবার আমাদের বন্ধুত্বকে অপমান করলি৷
মায়ের আঁচলে চোখের জল মুছেছিলো নন্দিনী৷
আশেপাশের বাড়ির আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলো ও৷ লোকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলো, ওর জন্যই নাকি ছেলেটা সুইসাইড করলো৷ লুজ ক্যারেক্টার মেয়ে, ভালো ছেলে পেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলো, প্রেমিকের দিকে ফিরেও তাকালো না৷
নন্দিনী কাউকে বোঝাতেই পারছিলো না ওরা প্রেমিক প্রেমিকা ছিলো না৷ ওরা শুধু ভালো বন্ধু ছিলো, খুব কাছের বন্ধু৷ অবুঝ অভিমানে কেঁদেছিলো নন্দিনী, অঙ্কুশ এভাবে প্রতিশোধ নিলো ওর ওপরে, এভাবে সারাজীবনের জন্য অপরাধী করে দিলো ওকে৷ বিয়ের পিঁড়িতে যখন শুভদৃষ্টি, সিঁদুর দান হচ্ছিলো তখনো বারবার নন্দিনীর মনে হচ্ছিলো ওই বোধহয় দায়ী অঙ্কুশের মৃত্যুর জন্য৷
কাউকে প্রেমিকের মতো না ভেবে বন্ধুর মতো ভালোবাসলে সেটাও কি অপরাধ হয়! কেউ প্রোপোজ করলে, সেটা অস্বীকার করলেও অন্যায় হয়ে যায়! এই সব প্রশ্নগুলো নন্দিনীর মাথার চিন্তাশীল কোষগুলোকে অকেজো করে দিচ্ছিলো ক্রমাগত৷
অঙ্কুশ নাকি অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে হোস্টেলের অব্যবহূত স্টোররুমে চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছিলো৷
রাতে ঘুমের মধ্যেও চমকে চমকে উঠতো নন্দিনী৷
অনিরুদ্ধ সবটা শুনে ওকে অনেক বুঝিয়েছিলো , এতে নন্দিনীর দোষ নেই, অঙ্কুশের বোঝার ভুল৷ ওদের বন্ধুত্বটাকেই ও প্রেম মনে করেছিল৷ অনেক বুঝিয়েছে আপনজনেরা, তবুও অঙ্কুশের মৃত্যুর দায় নিজের কাঁধ থেকে নামাতে পারেনি নন্দিনী৷ তাই আজও স্বপ্নের মধ্যে বারবার হানা দেয় অঙ্কুশ৷ ও ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠে বলে, তুই কেন এমন করলি অঙ্কুশ৷ কেন আমাদের বন্ধুত্বকে অস্বীকার করলি, কেন আমাকে অপমান করলি!
অনিরুদ্ধ বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ভয় পেও না নন্দিনী আমি আছি তোমার সাথে৷
ভয় করে নন্দিনীর, আর কাউকে বিশ্বাস করতেই ভয় করে৷ আর কাউকে বন্ধু ভাবতেই ভয় করে ওর৷ মনে হয় এই বুঝি সে অবিশ্বাসী হাসি হেসে বলবে, তোর জন্যই সব হলো… তুই দোষী…
হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের ওপরে প্রতিবার এই দিনে দু-ফোঁটা জল পড়ে নন্দিনীর চোখের৷ জ্বলে যাওয়া ছবিটা যেন বলে ওঠে, কাঁদিস না নন্দিনী, তোর দোষ নেই রে, আমিই ভুল করে তোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷
নন্দিনী ছবির ছেলেটার ভ্রূর নিচের কাটা দাগটা খোঁজার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে ওদের ধূসর স্মৃতির মধ্যে থেকে রামধনু রঙের দিনগুলো খুঁজে বের করতে৷ ওদের সেই বন্ধুত্বের দিনগুলোকে ফিরে দেখতে চায় নন্দিনী৷ বারবার বলতে চায়, অঙ্কুশ তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলিস, প্রেমিকের থেকেও বেশি, হাজবেন্ডের থেকেও বেশি… ফিরে আসিস অঙ্কুশ, বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েই ফিরে আসিস পরের জন্মে৷
জ্বলে যাওয়া ছবিটাতে হাত বুলিয়ে নন্দিনী বললো, আজ তোর জন্মদিন অঙ্কুশ, তাই তোর গিটারটা বাজিয়ে আমি তোর প্রিয় গানটা গাইবো, তুই হয়তো হেসে উঠে বলবি, তোর দ্বারা জীবনমুখী গান হবে না রে নন্দিনী৷
নন্দিনী ধীরে ধীরে গিটারটাতে আঙুল ছোঁয়ালো, অঙ্কুশের স্পর্শ লেগে আছে এর গোটা শরীরে৷
টলমল জল চোখে নিয়েই নন্দিনী, গাইলো… সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা…
বাইরে আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি নামলো৷ জানলার কাঁচগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো৷ বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা যেন নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছে, মনে রাখিস নন্দিনী, আমায় মনে রাখিস৷ আবার জন্ম নেবো, তোর বন্ধু হয়ে, শুধুই ভালো বন্ধু হয়ে৷