স্বামী ও প্রেমিক – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

স্বামী ও প্রেমিক

রাতভর মাথা খারাপ করে দেওয়া বৃষ্টির পর সকালে রাস্তায় এককোমর জল। আর তার মধ্যে একটা লোক এসে সুকোমলের ফ্ল্যাটের দরজায় ঘণ্টা বাজাল। সুকোমল দরজা খুলে বলল, কাকে চাই?

লোকটা বলল, আপনিই কি সুকোমল বসুরায়?

লোকটার চেহারায় রুক্ষতা। রোগা ঢ্যাঙা গড়ন। লম্বা নাক। পাতলা ঠোঁট। বড় বড় কানে লোম আছে। খোঁচাখোঁচা গোঁফদাড়ি। পরনে যেমন-তেমন প্যান্ট-শার্ট। চওড়া কপালের ওপর অগোছাল চুল সরিয়ে সে সুকোমলকে কুতকুতে চোখ দিয়ে দেখছিল। সুকোমল বলল, হ্যাঁ। আমিই সুকোমল বসুরায়। আপনি কোত্থেকে আসছেন?

তাহলে আপনিই সুকোমল বসুরায়। লোকটা যেন নিজেকে শোনাতেই কথাটা আস্তে উচ্চারণ করল। তারপর সেইরকম কুতকুতে চাউনিতে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, আপনার সঙ্গে গোটাকতক জরুরী কথা আছে।

সুকোমল বলল, বেশ তো। কিন্তু আপনি কোত্থেকে আসছেন—আপনার নামটা?

আমি জ্ঞানেশ মিত্র।

আচ্ছা! বলুন জ্ঞানেশবাবু। সুকোমল একটু হাসল। লোকটার মধ্যে কী একটা অস্বাভাবিকতা আছে, ঠিক ধরতে পারছিল না সে। অথচ ঝটপট কোন আগন্তুকের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার মতো অভদ্র মানুষও সে নয়।

লোকটার ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেছে। সে আবার ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, যাক। চিনেছেন তাহলে। চলুন, ভেতরে গিয়ে বসা যাক।

সে সুকোমলকে একরকম ঠেলেই ঘরে ঢুকে পড়ল। সুকোমল বিরক্ত। কিন্তু সে একটা কোম্পানির গণসংযোগ অফিসার। সে জানে, কিছু লোকের স্বভাব দেখছি। হুঁ, সেটাই আপনার সুবিধা।

সুকোমল তার স্বভাবসুলভ এবং অভ্যস্ত ধৈর্যের সীমানা থেকে হাসবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু আপনাকে আমি চিনি না জ্ঞানেশবাবু। এই প্রথম আপনার নাম শুনলাম। যাই হোক, আপনি বসুন। বলুন কী আপনার জরুরী কথা।

লোকটি রুক্ষস্বরে বলল, চেনেন না?

না। সুকোমল হাসিমুখে মাথাটা একটু দোলাল।

লোকটা সোফার একপাশে বসে পড়ল এবং হেলান দিয়ে চোখ বুজে আস্তে বলল, আমি মহুয়ার স্বামী।

মহুয়া?

বলুন, তাকেও চিনি না।

সুকোমল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল। জ্ঞানেশ মিত্র নামে লোকটা চোখ বুজে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কপালে একটা হাত ঘষছে। সুকোমল নিজেকে সংযত রেখে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন।

মহুয়া গতরাত্রে আত্মহত্যা করেছে।

ও।

জ্ঞানেশ মিত্র চোখ খুলল।…..শুধু ও? ভেবেছিলাম আপনি—

সুকোমল শক্তমুখে বলল, আপনি কী আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছেন?

করার মতো যথেষ্ট ডকুমেন্ট আমার হাতে আছে। জ্ঞানেশ মিত্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল। ……যাই হোক, আপনার বয়স কত সুকোমলবাবু?

কেন?

আমি বেয়াল্লিশ। মহুয়া আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট ছিল। আমার ধারণা আপনি পঁয়ত্রিশ-টয়ত্রিশ। জ্ঞানেশ মিত্র একটা পা লম্বা করে প্যান্টের পকেট থেকে তোবড়ানো সিগারেট প্যাকেট বের করল। সিগারেট জ্বেলে সে হাত বাড়িয়ে অ্যাশট্রেটা নিল। সোফায় নিজের পাশে রেখে বলল, মেয়েরা যদি কাউকে ভালবেসে ফেলে, শিগগির বয়স ডিঙিয়ে তার কাছে পৌঁছে যেতে পারে। পাঁচ বছর আগে মফস্বলের একটা স্কুলে মাস্টারি করতে গিয়ে মহুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বিয়েটা তার ঠিক মাসখানেকের মধ্যেই। আসলে মহুয়ার ওই একটা স্বভাব ছিল—হঠকারিতার। ঝোঁকের মাথায় কোন কাজ—যে কাজই হোক, করে বসত। একটুও ভাবনা-চিন্তা করত না। আমার খালি ভয় হত, ওর স্বভাবটাই ওর সর্বনাশ করবে। করেছিল। করলও।

সুকোমল টের পাচ্ছিল, তার শরীরের ওজন বেড়ে গেছে। বারবার তার মাথার ভেতর একটা ঠাণ্ডা হিম ঢিল গড়িয়ে পড়ছিল। সে একটু নড়ে উঠল এবার।…..কিন্তু আপনি এসব কথা আমাকে শোনাতে এসেছেন কেন?

আপনার জানা দরকার বলে।

আমি তো মনে করি না।

আমি মনে করি।

কী আশ্চর্য! আপনি কী গায়ের জোরে আমাকে শোনাতে চান? আপনি আসুন জ্ঞানেশবাবু! আমার হাতে অনেক কাজ। আপনার লাইফহিস্ট্রি শোনার সময় আমার নেই।

সুকোমল উঠে দাঁড়াল। কিন্তু জ্ঞানেশ মিত্র নির্বিকার মুখে বসে রইল। সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে তার কুতকুতে চোখ দুটো জুলজুল করছে। অথচ তাকে দেখাচ্ছে মৃত মানুষের মতো—শুঁটকো, টানটান আর রুক্ষ।

সুকোমল কঠোর স্বরে বলল, আপনি কী চান আমি পুলিশ ডাকি?

জ্ঞানেশ মিত্র খ্যাঁক করে হাসল।….বেশ তো! ডাকুন না। হেস্তনেস্তটা আরও ভাল করে হবে।

তার মানে আপনি সত্যি সত্যি ব্ল্যাকমেল করতেই এসেছেন। সুকোমল শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে বলল, বলুন, কত দিতে হবে?

জ্ঞানেশ মিত্র হিস হিস করে বলল, লজ্জা করে না সুকোমলবাবু!

আপনারই লজ্জা করা উচিত, স্ত্রীর কেলেঙ্কারি নিজের মুখে গাইতে এসেছেন।

আস্তে সুকোমলবাবু! আপনার ফ্ল্যাটে কেউ নেই, কিন্তু দেয়ালের কান আছে।

সুকোমল মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে আবার বসল। ভারী গলায় বলল, আপনি কী চান জ্ঞানেশবাবু?

একটা আলোচনা।

কিসের আলোচনা?

মহুয়া সম্পর্কে।

কী লাভ তাতে?

মহুয়া হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করল, আমাদের দু’জনেরই সেটা জানার দরকার।

আপনার দরকার থাকতে পারে, আমার নেই।

আছে। কারণ মহুয়ার মরার পেছনে আপনারও হাত থাকতে পারে।

মহুয়ার সঙ্গে আমার গত এক সপ্তাহ দেখা হয়নি। সুকোমল বিব্রতভাবে বলল। তাকে আমি এমন কিছু বলিনি বা তার সঙ্গে এমন কোন ব্যবহার করিনি যে সেজন্য ও মনে আঘাত পেয়ে স্যুইসাইড করতে যাবে।

আমিও তো ঠিক একই কথা বলব, সুকোমলবাবু।

কিন্তু সে আপনার স্ত্রী ছিল!

আপনার প্রেমিকা ছিল, অথবা আপনি তার প্রেমিক ছিলেন। একই কথা।

সুকোমল জোর দিয়ে বলল, মোটেও একই কথা নয়।

জ্ঞানেশ মিত্র পুড়ে যাওয়া সিগারেটের আগুনে আবার সিগারেট ধরাচ্ছিল। হাত তুলে বলল, ওয়েট, ওয়েট। আপনি সমাজ আইন এসবের কথা তুলবেন তো? ওগুলো নিছক বানানো ব্যাপার সুকোমলবাবু। ওগুলো সবই বাইরের। আপনি ভেতরের দিক থেকে দেখুন কী ঘটেছে। মহুয়া নামে একটি মেয়ে আর দুজন পুরুষ। জ্ঞানেশ মিত্র আর সুকোমল বসুরায়। দু’জনের সঙ্গেই অত্যন্ত প্রাইভেট সম্পর্ক ছিল—যা আর কারুর সঙ্গে ছিল না। বলতে দ্বিধা দেখি না যে সেই সম্পর্কটা ছিল দৈহিকও।

সুকোমল বিরক্তমুখে বলল, ধুর মশাই! সে তো একটা বেশ্যার সঙ্গেও……

শাট আপ। মহুয়া বেশ্যা ছিল না।

দেখুন, আমাকে ধমকাবেন না। আমি যথেষ্ট সহ্য করেছি। আর নয়। আপনি উঠবেন কি না বলুন?

উঁহু।

উঠবেন না?

না।

সুকোমল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। এই লোকটাকে সে হয়তো গায়ের জোরে বের করে দিতে পারবে। কিন্তু এ যদি চ্যাঁচামেচি করে, সব ফ্ল্যাট থেকে লোকেরা জুটে যাওয়ার ভয় আছে। ওর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সে উদ্বিগ্ন হচ্ছিল। নাছোড়বান্দা প্রকৃতির লোক সন্দেহ নেই। গোঁয়ার ও জেদি, তা বোঝাই গেছে। তাছাড়া ওর চেহারায় মরিয়াভাব খুব সুস্পষ্ট। যারা একটা চরম বোঝাপড়া করতে চায়, তারাই এভাবে আসে। সুকোমল এবার ভয় পেয়ে গেল।

জ্ঞানেশ মিত্র ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হেসে বলল, ভাবতে অবাক লাগছে সুকোমলবাবু। মহুয়া একসময় আমাকে বলেছিল, ‘যদি আমার কোন প্রেমিক থাকে, জানবে সে দায়িত্ববান প্রেমিক। ঠিক তোমারই মতো।’ আমি ওকে বলতে পারতাম, ‘প্রেমিক তো আছেই। তাকে আমি চিনিও।’ কিন্তু বলতে পারিনি। কোনদিন প্রচণ্ড রাগের মুখেও ওই কথাটা বলতে পারিনি ওকে। আসলে ওকে দেখে আমার মায়া হত। ওকে আঘাত দিতে পারতাম না। কারণ ওর জীবনটা ছিল ট্র্যাজিক। আশা করি, আপনি সেসব কথা জানেন। আমারই মতো প্রাণপণ লড়াই করে ও সদ্য মাথা তুলতে পেরেছিল। বাবা-মা আত্মীয়স্বজনহীন একটা একলা মেয়ে। যাই হোক, আপনি মোটেও দায়িত্ববান প্রেমিক নন দেখতে পাচ্ছি। মহুয়া আপনাকে চিনতে পারেনি।

সুকোমল মুখ নামিয়ে বলল, আপনি তো দায়িত্ববান স্বামী! তবু মহুয়া কেন….

এক মিনিট! মহুয়া সেকথা স্বীকার করত, জানেন কী?

জানি। সুকোমল গলার ভেতর বলল।

বলেছিল আপনাকে?

হুঁ।

জোরে শ্বাস ছেড়ে জানেশ মিত্র হেঁট হয়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে বলল, কী বলছিলেন, এবার বলুন।

তাহলে মহুয়া স্যুইসাইড করল কেন?

ঠিক একটাই আমার জানার ইচ্ছে, সুকোমলবাবু।

আমি কিছু জানি না।

জ্ঞানেশ মিত্র আবার সোফায় পিঠ চেপে মুখ উঁচু করে চোখ বুজল। …. ও মাসে আপনারা গোপালপুর-অন-সি গিয়েছিলেন। ছিলেন স্টিফেন্স লজে। সায়েবের বাতিক, ব্যাচেলার অ্যালাউ করে না। স্যুটের ভেতর বাইবেল রাখে এক কপি করে। ড্রিংক করাও বারণ। তবে বাড়িটা অপূর্ব। সামনে সমুদ্র, বাঁদিকে ব্যাকওয়াটার। অসম্ভব নির্জন সি বিচ। জলের ভেতর বড় বড় কালো পাথর। মহুয়া জেদ করছিল পাথরে গিয়ে বসবে। আপনি তাকে টানাটানি করছিলেন। নির্জন বিচে সিনেমার দৃশ্য!

সুকোমল তাকাল। তাহলে আপনি সত্যই গিয়েছিলেন ফলো করে?

আমি দায়িত্ববান স্বামী। আমার স্ত্রী কোথায় কী বিপদে পড়ছে কি না লক্ষ্য রাখা আমার কর্তব্য।

মহুয়া তাহলে ঠিকই সন্দেহ করেছিল!

করেছিল বুঝি?

লাইট হাউসের ওদিকে বালিয়াড়িতে তাহলে ঠিকই আপনাকে দেখেছিল!

জ্ঞানেশ মিত্র কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বাইনোকুলার বের করল।….দায়িত্ববোধের খাতিরেই জিনিসটা আমাকে ফুটপাত থেকে দুশো টাকায় কিনতে হয়েছিল। আপনি অর্ধেক দামে রাখতে পারেন। চিরদিন তো আর ব্যাচেলার থাকবেন না। থাকছেনও না। কবে যেন আপনার বিয়ে……?

আপনি বড্ড বেশি অপমান করছেন আমাকে। সবাই আপনার মতো বউকে ফলো করে বেড়ায় না।

কারণ সবাই দায়িত্ববান স্বামী নয়।

মহুয়া বলত আপনি নাকি ভীষণ উদার। তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেন। মহুয়া আপনাকে চিনতে পারেনি!

মহুয়া বলত এসব কথা?

সুকোমল চুপ করে থাকল। তার নার্ভে চাপ পড়ছিল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর জ্ঞানেশ মিত্র সেটা লক্ষ্য করল। সে মুখ তুলে দেখল ফ্যানটা ঘুরছে না। রাতভর বৃষ্টির পর আবহাওয়া মোটামুটি স্নিগ্ধ। এখনও মেঘ সরে যায়নি। নিচের রাস্তায় জল ভেঙে চলাচলের শব্দ ভেসে আসছে। সে দেয়ালের দিকে ঘুরে ফ্যানের সুইচ খুঁজল। তারপর রেগুলেটার ফুল করে দিয়ে সুইচটা টিপে দিল। বলল, আপনি নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। তবু উপায় নেই। সিচুয়েশান ফেস তো করতেই হবে। তার আগে প্লিজ একগ্লাস ঠাণ্ডা চল দিন আমাকে।

সুকোমল আড়ষ্টভাবে উঠল। এটা ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং ঘর। ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করল। কাচের গ্লাসে ভর্তি করে এনে নিচু টেবিলে রাখল।

জ্ঞানেশ মিত্র জলটা একটানে খেল না। চুমুকে চুমুকে খাচ্ছিল। খানিকটা খেয়ে গ্লাসটা ধরে রেখে একটু হাসল।…আপনার ফ্রিজট্রিজ আছে। ফ্ল্যাটটাও অপূর্ব সাজানো। কত সুন্দর সব বই। ফ্ল্যাটটা নিশ্চয় কিনেছেন?

সুকোমল অস্পষ্টভাবে হুঁ বলল।

আমি সামান্য স্কুলটিচার। তাহলে মহুয়ার টাকাটা যোগ করলে মোটামুটি ভদ্র একটা ফ্ল্যাটে হয়তো থাকা যেতো—ফ্রিজট্রিজ না কেনা হোক। কিন্তু ওর যা খরচের বহর ছিল। না—নিজে তত সেজেগুজে থাকত না, সে তো দেখেছেন। কিসে এলোমেলো উড়িয়ে দিত। দু’সপ্তা পরেই বলত, ‘তোমার কাছে টাকা আছে?’ আসলে ওর মধ্যে উড়নচণ্ডী স্বভাব—নিজের যা কিছু দায়িত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিতে একটুও ভাবেনি। আপনার কী মনে হয় না জীবনের ওপর, পৃথিবীর ওপর প্রচণ্ড ঘৃণা—অবচেতন ঘৃণা আর দুঃখ থাকলে তবেই মানুষ এমন করতে পারে? বলুন তাই কী না?

আমি জানি না।

ঠাণ্ডা জলে চুমুক দিয়ে জ্ঞানেশ মিত্র গলা নামিয়ে বলল, নিজেকে নিয়ে ও ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছিল—বিয়ের জাস্ট মাস ছয়েক পর থেকে। হঠাৎ একটা পরিবর্তন। তখন আমরা সেই মফস্বলেই আছি। খানিকটা একঘেয়ে লাগে। তাই মাঝে মাঝে কলকাতা চলে আসি। কলকাতায় স্কুলে চেষ্টাচরিত্র করি। তো ভাবলাম, গ্রামে থাকাটা ওর অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই এত অস্থিরতা। পরে বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মহুয়া প্রকৃতি-ট্রকৃতি ভালবাসত—সেকথা আপনিও জানেন। কিন্তু ব্যাপারটা অন্য। রেগুলার পিল খেত ও। ক্রমশ রিঅ্যাকশন হচ্ছিল। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। জোর করে ওটা বন্ধ করলাম। তাছাড়া একটা কাচ্চাবাচচাও হওয়া দরকার মনে হচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, আপনি হয়তো জানেন না সুকোমলবাবু যেই কনসিভ করল, তার একমাস পরেই কলকাতা এসে—আমাকে না জানিয়ে—আর আজকাল তো ব্যাপারটা মেয়েদের কাছে ডালভাত। জাস্ট কয়েকটা দিনেই ফিট হয়ে যায়। তো আমি যখন জানতে পারলাম, ওকে চার্জ করলাম। সোজা বলে দিল, ‘আমি মা হবো না—তুমি যা খুশি ভাবতে পারো!’ এখন আমি জানি, মহুয়া একই সঙ্গে একটা অপারেশন করিয়ে নিয়েছিল। আশা করি, ওর নাভির নিচে কাটা দাগটা আপনি…..

থামুন! সুকোমল প্রায় গর্জন করে উঠল। নির্লজ্জতার একটা সীমা থাকা উচিত।

ত্রুড রিয়্যালিটি, সুকোমলবাবু।….নির্বিকার জ্ঞানেশ মিত্র ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।….মর্গে মহুয়ার শরীরটা এখন কাটাছেঁড়া চলছে। বিকেলের আগে বডি ডেলিভারি দেবে না সম্ভবত। আজকাল স্যুইসাইড বড্ড বেড়ে গেছে। আর ওই বধূহত্যা। ভাগ্যিস মহুয়া স্লিপিং ক্যাপসুল খেয়েছিল। তাছাড়া একটুকরো চিঠিও লিখে গেছে। সেকথায় পরে আসছি। তবে আমরা যা করতে চাইছি মহুয়াকে নিয়ে, সেও একটা শবব্যবচ্ছেদ। ওর লাইফটা কাটাছেঁড়া করা। হুঁ, আসুন। কী যেন বলছিলাম…..অপারেশন! নাভির নিচে একটা কাটা দাগ। যে কোন নিঃসন্তান পুরুষের পক্ষে এটা প্রচণ্ড অপমানজনক। ভাবলাম, ওকে নিষ্ঠুরভাবে চাবকাই। আমার হাত উঠল না। আপনি তো দেখেছেন, যত তেজী হোক, ওর মুখে অসহায় নিঃসঙ্গ মেয়ের একটা ছাপ ছিল। খানিকটা অবুঝ বালিকার আদল। বিশেষ করে ওর চোখ দুটো….

দরজার ঘণ্টা বাজল। সুকোমল ইতস্তত করছিল। হয়তো পুঁটির মা এল এতক্ষণে। ওদের বস্তিতে অগাধ জল জমার কথা। আসেনি এটাই রক্ষা। এলেও সমস্যা। কিন্তু তার চেয়েও সমস্যা হত মনু থাকলে। ভাগ্যিস মনু ছুটি নিয়ে দেশে গেছে।

জ্ঞানেশ মিত্র বলল, যান। দেখুন কে এল।

সুকোমল আড়ষ্টভাবে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখল সত্যি পুঁটুর মা। বুড়ি বলল, সমুদ্দুর! সব ভেসে গেছে। কী কষ্ট করে যে—

সুকোমল বলল, কষ্ট করার কী দরকার ছিল? বাড়ি যাও তুমি।

বুড়ি খচে গেল। ঠোঁট বাঁকা করে বলল, খামোকা বকছেন কেন বাবু? কী চলেছে অবস্থাটা, ভাবুন একবার। এক কোমর জল ভেঙে ভেঙে এলাম, আর বলছেন বাড়ি যাও। বেশ। যাচ্ছি। এক দোর বন্ধ তো শত দোর খোলা। যাচ্ছি।

হ্যাঁ, যাও।

বুড়ি গজগজ করতে করতে চলে গেল। সুকোমল দরজা বন্ধ করে এসে বলল, আপনি আর কতক্ষণ থাকবেন ভাবছেন?

যতক্ষণ না একটা হেস্তনেস্ত হয়!

সুকোমল খাপ্পা হয়ে বলল, কী হেস্তনেস্ত? আপনার স্ত্রী স্যুইসাইড করেছে। সেজন্য আমার কী করার আছে? আপনি চলে যান। অকারণ এসব নোংরা ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না। আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। আর ভদ্রতা রাখা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।

গ্রাহ্যই করল না জ্ঞানেশ মিত্র। তেমন হেলান দিয়ে চোখ বুজে থেকে বলল, তিন বছর আগে আপনিও ছিলেন আমার মতো একজন স্কুলটিচার। বহরমপুরে বি টি পড়তে গিয়েছিলেন। মহুয়া তখন রিফ্রেশার কোর্স করতে গেছে। আপনার সঙ্গে আলাপ হল। আপনার প্রেমে পড়ে গেল। এমনিতেই পুরুষচরিত্র পরকীয়া প্রেমের অনুরাগী। আর মহুয়া পরস্ত্রী হিসেবে ছিল অসাধারণ। আমি একদিন ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গেটা থেকে লক্ষ্য করলাম, আপনারা দু’জনে লনের ওপাশে বসে গল্প করছেন। তখন এই বাইনোকুলারটা ছিল না। কিন্তু চোখ ছিল। বুঝতে পারছিলাম দু’জনের ওই কথা বলার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি—সবকিছুর মধ্যে একটা গাঢ় আন্তরিকতা আছে। সেই তো শুরু। তাই না সুকোমলবাবু?

আপনি যদি এতসব আগাগোড়া জানেন, এতদিন বাধা দেননি কেন আপনার স্ত্রীকে?

দেবার কথা কী ভাবিনি? কোন রক্তমাংসের মানুষ এসব সহ্য করতে পারে? কিন্তু আমার ভয় হত, ওকে তাহলে হারাব। আপনি একে ক্লীবতা ভাবতে পারেন। কিন্তু ঠিক তা নয়। এটা একটা স্যাক্রিফাইস—এটা একটা নিজের স্বাভাবিক মনোবৃত্তির সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই। জানি না আপনাকে বোঝাতে পারলাম কিনা। আসলে আমি চাইছিলাম, ও যা কিছু করুক, আমার হয়ে থাক। আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে অন্তত থাক।

বুঝেছি, সম্পত্তি ভেবেছিলেন স্ত্রীকে! সুকোমল ব্যঙ্গ করে বলল।

না। এ তা নয়। এ ঠিক পোজেশানের মনোভাব নয়, সুকোমলবাবু। মায়ামমতা, করুণা, দায়িত্ববোধ অনেককিছু এর মধ্যে ছিল। ওর সর্বনাশ ঘটুক এ আমি চাইনি—ওর নিজের দিক থেকে বা অন্যের দিক থেকে। আর এই দোটানার মধ্যে পড়ে আমি খানিকটা অসহায়ও বোধ করেছি বৈকি। না পারি গিলতে, না পারি ফেলতে।

সুকোমল বাঁকা হাসল…..তাহলে আর নিজেকে দায়িত্ববান স্বামী বলে বড়াই করছেন কেন? দায়িত্ববান স্বামীরা কী স্ত্রীকে প্রেম করতে দিতে পারে?

পারে—যদি দেখে তার স্ত্রীর সেই প্রেমিকটিও দায়িত্ববান। আমি আপনাকে তাই ভেবেছিলাম। অথচ আপনি তা নন। আপনি ওকে ঠকিয়েছেন তাই নয়, ওকে বাঁচিয়ে রাখতেও পারেননি। ওকে অতল খাদের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন।

কীভাবে?

প্রথম কথা, আপনি ওকে—উইদিন কোটেশান বলছি—’সম্মানজনক’ চাকরির লোভ দেখিয়েছিলেন।

সেটা অন্যায় নয়। তবে চেষ্টা করব বলেছিলাম এই পর্যন্তই।

কিন্তু মহুয়া আপনাকে এত বিশ্বাস করত যে তারপর সে তার স্কুলের দায়িত্বে ভীষণ অবহেলা করতে শুরু করল। যখন-তখন কামাই, ক্লাসে ফাঁকি, পরীক্ষার খাতায় খামখেয়ালি করে নম্বর দেওয়া কলিগদের সঙ্গে ঝগড়া—কত আর বলব! শেষ পর্যন্ত একদিন ঝোঁকের মুখে রিজাইন দিয়ে এসে বলল, ‘চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এলাম।’ আমি কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম। কারণ তখনও জানতাম না যে আপনিই এর পেছনে ছিলেন। আপনারই প্ররোচনায় মহুয়া চাকরি ছাড়ার রিস্ক নিয়েছিল।

আমি ওকে চাকরি ছাড়তে বলিনি।

ওকে লাভ দেখিয়েছিলেন। আশা দিয়েছিলেন। তার রিটন এভিডেন্স আমার হাতে আছে।

আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাইনে। আপনি যা খুশি করুন।

জ্ঞানেশ মিত্র তৃতীয় সিগারেট ধরিয়ে চোখ জল।….আপনি লিখেছিলেন, ‘যদি কখনও মনে করো যে ওখানে অসহ্য লাগছে, তখনই চলে এস। আমার ঘরের দরজা তোমার জন্যে সবসময় খোলা। পৃথিবীতে কোথাও আশ্রয় না জুটলেও আমার কাছে জুটবে।’ লেখেননি?

আপনার দেখছি অসাধারণ মুখস্থ করার শক্তি।

কাল রাত্রে আপনার চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে, সুকোমলবাবু! আপনি ওর স্কুলের ঠিকানায় বড্ড বেশি চিঠি লিখতেন। অতবেশি লিখতেন বলেই আপনাকে দায়িত্ববান—খাঁটি প্রেমিক মানুষ ভেবেছিলাম। নিছক লাম্পট্য মানুষকে এতবেশি কথা বলতে দেয় না। সত্যি বলতে কী, আপনার ওপর আমার সিম্প্যাথির এটাই মূল কারণ।

স্ত্রীর ব্যক্তিগত চিঠি লুকিয়ে পড়তেন—লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল আপনার!

কেন লজ্জা? আপনার চিঠির কথাগুলো আমার নিজেরই কথা আসলে। আমি ঠিক যে কথাগুলো ওকে বলতে চাইতাম, পারতাম না, তারই হুবহু প্রতিধ্বনি! আর সুকোমলবাবু, কাল রাতে যখন আবার চিঠিগুলো নিয়ে বসলাম, বিশ্বাস করুন, আমি নিজেকে গুলিয়ে ফেললাম আপনার সঙ্গে। আমি না আপনি? আপনি না আমি? আর তখন বিছানার ওপর মহুয়া মরে পড়ে আছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরছে। রাস্তায় জল জমতে জমতে সেই জল এসে ঢুকেছে ঘরের মেঝেয়। জলে পা ডুবিয়ে বসে আপনার চিঠি পড়ছি। করবটা কী? কাকে ডাকব ওই দুর্যোগের মধ্যে? কাকে কান্নাকাটি করে বলব আমার স্ত্রী স্যুইসাইড করেছে?

আপনি অদ্ভুত!

মহুয়া তাই বলতে মাঝে মাঝে। এই তো কিছুদিন আগেও আমার পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার বুকের ওপর মাথা তুলে বলল, ‘তুমি এমন কেন গো?’ বললাম, ‘কেমন আমি?’ ও বলল কী জানেন সুকোমলবাবু? বলল, ‘কেন তুমি আমাকে শাসন করো না? কেন আমাকে আটকে রাখো না? আমার যদি কিছু ঘটে যায়?’ বললাম, ‘কী ঘটবে আর? কিছু ঘটবার সুযোগ তো রাখোনি!’ ও একটু সরে গেল। স্বভাবত আমি ওর সেই অপারেশনটার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, ও মৃত্যু ব্যাপারটাকে ঘটনা বলতে চাইছিল। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘তুমি চিরদিন বড় অদ্ভুত মানুষ।’ হ্যাঁ সুকোমলবাবু, আমি হয়তো তাই।

আর কতক্ষণ প্রলাপ বকবেন আপনি?

জ্ঞানেশ মিত্র চোখ খুলল।….প্রলাপ? এ তো আমার-আপনার দু’জনেরই জীবন-মরণের প্রশ্ন।

আপনার হতে পারে। আমার নয়।

সুকোমলবাবু! জ্ঞানেশ মিত্র একটু ঝুঁকে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে একটু হাসল। মহুয়ার সঙ্গে আমার দু’জনেই একইভাবে জড়িয়ে গেছি। ধর্মত এবং আইনত।

সুকোমল ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?

মহুয়া গতকাল কোন একসময়ে—তার মানে বৃষ্টির আগেই ঠিক করেছিল, মরবে। চিঠিটা লিখে বালিশের তলায় রেখেছিল। আমার স্কুল সেই বেহালায়। ভেবে দেখুন কাল কী অবস্থা সন্ধ্যা থেকে। সাতটা অব্দি অপেক্ষা করে তখন মরিয়া হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কখনও বাস, কখনও রিকশো এই করে তিলজলা পৌঁছতে রাত সাড়ে ন’টা হয়ে গেল। রাস্তায় জল জমেছিল। কিন্তু তখনও ঘরে ঢোকেনি। দরজা ভেজানো ছিল। ঢুকে দেখি মহুয়া কাত হয়ে শুয়ে আছে। দরজা খুলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে একটু বকাবকি করে ওকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। সাড়া দিল না। তখনও জানি না ও—যাই হোক, ওকে বিরক্ত না করে জামাকাপড় বদলে কিচেনে গেলাম। দেখলাম খাবার রেডি করা আছে। খেয়ে আলো নিভিয়ে ঘরের কোণায় টেবিলবাতিটা জ্বেলে জানলার ধারে বসে সিগারেট টানছি আর বৃষ্টি দেখছি। আকাশভাঙা বৃষ্টি। উদ্বিগ্নও হচ্ছি, এবার তো ঘরে জল ঢুকবে। সিগারেট শেষ করে দরজার তলায় ওর একটা ছেঁড়া শাড়ি গুঁজে….

আঃ! জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেন বললেন?

জ্ঞানেশ মিত্র গলার ভেতর বলল, বলছি। কাল বৃষ্টিটা কিন্তু মাথা খারাপ করে দেওয়া বৃষ্টি। হঠাৎ টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মহুয়ার শরীরের দিকে তাকিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। এতদিন ওর শরীরের সেই আশ্চর্য স্বাদ আর পাচ্ছি না। ও আমাকে বঞ্চিত রাখছে। আমি জানোয়ার হয়ে গেলাম, সুকোমলবাবু।

জ্ঞানেশ মিত্রের গলা ভেঙে গেছে দেখে সুকোমল তাকাল। চোখের কোণায় জলের ফোঁটা। তাকিয়েই মুখ নামাল সুকোমল।

জ্ঞানেশ মিত্র গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, আমি ওকে জোর দেখাতে গিয়েই থমকে গেলাম। ওর শরীর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হিম। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ।….

কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানার পর চেহারায় আবার আগের মতো রুক্ষতা ফিরিয়ে এনে জ্ঞানেশ মিত্র বলল, মহুয়ার স্যুইসাইডাল নোটে আমাদের দু’জনকেই দায়ী করে গেছে, সুকোমলবাবু। আমাকে এবং আপনাকে।

সুকোমল চমকে উঠেছিল। বলল, আশ্চর্য! আমি কী করেছি?

আপনি করেছেন প্রতারণা আর আমি করেছি মানসিক পীড়ন।

মহুয়া তাই লিখেছে?

হ্যাঁ! জ্ঞানেশ মিত্র নোংরা রুমাল বের করে ফোঁস ফোঁস করে নাক মুছল।

সুকোমল আস্তে বলল, লিখলেই তো হল না। প্রমাণ কোথায়?

প্রমাণ আপনার একগাদা চিঠি।

সুকোমলের মুখ সাদা হয়ে গেল। বলল, বডি তো মর্গে, বললেন।

হ্যাঁ। তবে আত্মহত্যার চিঠিটা আমি পুলিশকে এখনও দিইনি। দিলে প্রচলিত আইনে আমরা এতক্ষণে দু’জনেই অ্যারেস্ট হয়ে যেতাম।

সুকোমল ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করতে চান তাহলে?

আপনিই বলুন সুকোমলবাবু, কী করা উচিত?

বেশ। পুলিশকে দিন।

এবং আপনার চিঠিগুলোও?

সুকোমল তাকাল। তার হাত কাঁপছিল।…..তাহলে তো আপনি সেই ব্ল্যাকমেল করতেই এসেছেন।

না। আমি জানতে এসেছি কেন মহুয়া হঠাৎ আত্মহত্যা করে ফেলল? সুকোমলবাবু, আত্মহত্যার চিঠিতে আত্মহত্যার মূল কারণ লেখা থাকে না।

সুকোমল ক্ষুব্ধভাবে বলল, আমি কেমন করে জানব সেকথা? আগের রবিবার বিকেলে মহুয়া সেই শেষবার এসেছিল। কিছুক্ষণ গল্পটল্প করে চলে গেল। এমন কোন কথা বলেনি, যাতে মনে হবে সে স্যুইসাইড করবে। হ্যাঁ—ফ্র্যাংকলি বলছি শুনুন। আমি ওকে বললাম, ‘কি ডিসিশন নিলে?’ বলল, ‘নাথিং! বেশ তো আছি। এমনি ফ্রেন্ডলি টার্মে থাকব।’ আমি ওকে বললাম, ‘এটা কিন্তু ডেঞ্জারাস গেম থেকে যাচ্ছে। তোমার স্বামী কতদিন চুপ করে থাকবেন, বলা কঠিন। মহুয়া—’

আপনি তাই বললেন?

হ্যাঁ। মহুয়া বলল, ‘ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে।’

মহুয়া তাই বলল? আবার ফোঁস ফোঁস রুমালে নাক মুছল জ্ঞানেশ মিত্র।

হ্যাঁ। গতবছর এমনি জুলাই মাসে আমরা দীঘা গিয়েছিলাম। ঝাউবনে ও একটা অদ্ভুত কথা—

বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি বলে আপনার সঙ্গে যেত, জানতাম।

এবং ফলো করতেন!

আপনি প্লিজ দীঘার কথাটা বলুন!

মহুয়া ঝাউবনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল, ‘জানো? আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বাবার স্বভাবচরিত্রের আশ্চর্য মিল!’ আমি বুঝতে পারতাম, আপনার ওপর ওর খুব শ্রদ্ধাও ছিল।

জ্ঞানেশ মিত্র শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ছিল। তা ছিল।

কিন্তু আমার ধারণা, গত মাসে গোপালপুর-অন-সি তে আপনাকে দেখতে পাওয়ার পর থেকে আপনার সম্পর্কে ওর শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে না দেখতে পেলে স্টিফেন্স লজে আমরা আরও দিন তিনেক থাকতাম।

বোকা মেয়ে! জেদি আর বেপরোয়া! আমার খালি ভয় হতো, কার পাল্লায় পড়ে প্রাণটা না খুইয়ে বসে। জ্ঞানেশ মিত্র ভাঙা গলায় বলল।….ওইভাবে বেড়াতে গিয়ে কতো মেয়ে মার্ডার হয় কিনা বলুন? না না! আপনি কেন মার্ডার করবেন? কিন্তু আজকাল সবখানেই দুর্বৃত্ত মস্তান লোকেরা ঘুরছে। আমি কেমন করে নিশ্চিন্ত থাকি বলুন? আমার মন মানত না সুকোমলবাবু!

সুকোমল ঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে ন’টা বাজে! অফিসের সময় হয়ে গেছে।

তাহলে আপনি জানেন না কেন মহুয়া স্যুইসাইড করল?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না।

কিন্তু—জ্ঞানেশ মিত্র সোজা হয়ে বসল। কিন্তু খবরটা যখন আপনাকে দিলাম, আপনি একটুও চমকে উঠলেন না। আঘাত পেলেন না। শুধু বললেন, ও! অথচ আপনি মহুয়ার প্রেমিক ছিলেন। তার সুন্দর শরীরটাকে আপনি যথেচ্ছ—আমি বলতে চাইছি, আদর করেছেন। আপনি কি লেখেননি ‘তোমার নগ্ন সুন্দর দেহের সবখানে আমার চুমুর দাগ ফুটে আছে খুঁজে দেখো?’ আপনার চিঠি বড় কবিত্বপূর্ণ সুকোমলবাবু! আপনিই তো লিখেছিলেন, ‘তোমার শ্বাসপ্রশ্বাসের গন্ধ আমাকে হঠাৎ বিপন্ন করে!’ সেই শ্বাসপ্রশ্বাস চিরদিনের জন্য থেকে গেছে মহুয়ার। তবু আপনি এতটুকু বিচলিত নন। সুকোমলবাবু, আমি বুঝতে পেরেছি মহুয়া কেন আত্মহত্যা করেছে।

সুকোমল বলতে যাচ্ছিল, কেন, কিন্তু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জ্ঞানেশ মিত্র কাঁধের ব্যাগ থেকে একগাদা নীল কাগজ বের করে হিংস্র ভঙ্গিতে ছিঁড়তে ছিঁড়তে সুকোমলের ওপর ছুঁড়তে থাকল। সুকোমল মুখ নামিয়ে মুহুর্মুহু ওই আঘাত অথবা প্রত্যাঘাত, দলাপাকানো ছেঁড়া চিঠি অথবা রুক্ষ শুকনো ঘৃণার পুঞ্জ সহ্য করল।

একটু পরে লোকটা বেরিয়ে গেলে সে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। তারপর ফিরে এল সোফার কাছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এত চিঠি লিখেছিল মহুয়াকে? এ কী অদ্ভুত ছেলেমানুষি তার! সত্যিই কী মহুয়া এত বেশি চিঠি পাওয়ার যোগ্য ছিল?

চিঠিগুলোর দিকে তাকাতে তার খারাপ লাগল। তাকালেই পড়া হয়ে যাবে। কেন অতসব উচ্ছ্বাস কলমের ডগা দিয়ে বমি করার মতো বেরিয়ে পড়ত, এ মুহূর্তে সে বুঝতে পারছে না। ছেঁড়া দলাপাকানো কাগজ হিসেবেই ঝটপট কুড়িয়ে সে কিচেনে গেল। কিন্তু কীভাবে নষ্ট করবে ভেবে পেল না। শেষে বেসিনে রেখে ট্যাপ খুলে দিল। ভিজে নেতিয়ে গেলে দলাপাকানো একটা বলের মতো করে আবর্জনার বালতিতে গুঁজে দিল।

আশ্চর্য! মহুয়া চিঠিগুলো রেখে দিয়েছিল! ভাবতে ভাবতে সুকোমল বেডরুমে গিয়ে জানলায় উঁকি দিল। রাস্তায় প্রচুর জল জমেছে। গাড়ি বের করা যাবে না। অফিসে ফোন করে দেবে, শরীর খারাপ। সত্যি, গতরাতের বৃষ্টিটা মাথা খারাপ করে দেওয়া।

তারপরেই সুকোমল বসুরায় একটু চমকে উঠল। মহুয়া স্যুইসাইড করেছে। অবিশ্বাস্য মনে হয়। স্যুইসাইড করেছে মহুয়া—সেই নরম ডিমালো মুখ, কালো টানাটানা চোখ, বালিকার অভিমান ঈষৎ পুরু ঠোঁটে, শ্যামবর্ণ ছিপছিপে মেয়ে, একরাশ কোঁকড়ানো চুল এবং নাভির নিচে একটা ক্ষতচিহ্ন। তার সমস্ত শরীরে সুকোমলের ঠোঁট ঘুরে ঘুরে আদর দিয়েছিল। জ্ঞানেশ মিত্র তাকে কী ভেবে গেল? নিছক লম্পট—নিতান্ত ভুল প্রেমিক? আচ্ছা, মহুয়া যদি হতো সুকোমল বসুরায়ের স্ত্রী এবং জ্ঞানেশ মিত্র তার প্রেমিক? সুকোমল বসুরায়ও তো অমনি ভেঙে পড়ত। মাথা খারাপ হয়ে ছুটে যেত জ্ঞানেশ মিত্রের কছে এবং এতক্ষণ সুকোমল বসুরায় এই ফ্ল্যাটে একা বসে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদত এবং বারবার থানা ও মর্গে ফোন করত কখন বডি পাওয়া যাবে—আর তার এই নধরকান্তি চেহারা যেত রাতারাতি শুঁটকো রুক্ষ হয়ে, মুখে খোঁচাখোঁচা গোঁফদাড়ি—কিছু পাকা, কিছু কাঁচা, এবং—

ভীষণ আতঙ্কে জানলার রড আঁকড়ে ধরল সুকোমল বসুরায়। আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। মাথা খারাপ করে দেওয়া এই বৃষ্টি আবার কার কী সর্বনাশ নিয়ে আসছে হয়তো।…….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *