স্বভূমি – ২

 হেমনলিনী মুখোপাধ্যায়

কর্তাকে নিয়ে আর তো পারা যায় না। যা উদ্বেগ করা স্বভাব হচ্ছে দিনকে দিন। কর্তা বলছেন ওই প্লেনেই ছিল। আরে বাবা কেন থাকবে? তার সামনের হপ্তায় মিটিং—আমার বাপু বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস না করলে কী হবে কর্তা তো বিছানায় কাত হয়ে পড়েছেন। আচ্ছা, গেলবারে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে এসেছিল বলেই যে এবারেও তাইতে আসবে তার কোনও মানে আছে? ওরা তো এয়ার ইন্ডিয়ার সার্ভিস একেবারেই পছন্দ করে না। বলে—বাস্কোপ্যাঁটরা হারিয়ে ফেললে ওরা সহজে কমপেনসেশন দেয় না, যাত্রীর জান নিকলে দেয়, তাছাড়া ইন্ডিয়ান যাত্রীদের এয়ার ইন্ডিয়া মনিষ্যিজ্ঞান করে না। এদানি টোরোন্টোর ফ্লাইটে নাকি বেশি বেশি পাঞ্জাবের গ্রামের বউ বাচ্চার যায়। তারা না জানে ইংরেজি, না জানে সভ্যতাভব্যতা, না জানে বাথরুম ব্যবহার করতে আর স্টুয়ার্ডেসরা সেসব তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেবার বদলে, হাতে হাতে সাহায্য করার বদলে নাক উঁচু করে, মুখ ফিরিয়ে থাকে। ডাকলেও যায় না। ঘেন্নায়। তাই আমাদের যখনই ওরা টিকিট পাঠায় চেষ্টা করে এয়ার ইন্ডিয়ায় না পাঠাতে—ওই অযত্নের ভয়ে। বুড়োবুডি, একা যাতায়াত করি! কর্তা বলছেন মুখে যতই রাগ করুক নিজেরা এলে দেশের সরকারকেই টাকাটা দিতে চেষ্টা করে ও, এবারেও নিশ্চয়ই ওতেই আসবে। আমি তো কোনওই কারণ দেখি না—ওই প্লেনে গতবারে এসেছিল বলে এবারেও কেন সেই এক এরোপ্লেনেই আসতে হবে। কিন্তু কর্তার কেমন বিশ্বাস হয়েছে ও নির্ঘাত এয়ার ইন্ডিয়াতে আসছিল। কিন্তু ‘নির্ঘাত’ উনি কী করে বলছেন? আলো চিঠি লিখেছে, ও প্রথমেই দিল্লিতে যাবে। ওর কাকা—কাকির কাছে টেলিগ্রাম করবে কবে পৌঁছোচ্ছে। তারপর ওর কানপুরের কনফারেন্স সেরে, কলকাতায় চলে আসবে। এই সপ্তাহেই আসছে একথা কোথাও লেখেনি। কবে রওনা হচ্ছে, কোন প্লেনে আসছে, কিছুই না। সেসব লিখবে কাকা—কাকিকে। ওরাই দিল্লির এয়ারপোর্টে যাবে তো। কর্তার এদানি স্বভাবই হয়েছে দুর্ভাবনা করা। তাই বলছেন আগামী সপ্তাহে কানপুরের কনফারেন্স করতে হলে ওকে এই সপ্তাহের এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটা ধরতে হবেই। এতশত হিসেব কষে উনি সিধে শয্যা নিয়েছেন মেয়ের শোকে। কী বললাম? মেয়ের শোকে? কী কথাই যে বেরোয় পোড়ামুখ থেকে। বুড়ো হয়ে আমার এই এক রোগ হয়েছে রেগে গেলে যা—তা বলা। কর্তার বুড়ো হয়ে কেবলই প্রেশার বাড়ছে, আর প্রেশারের সঙ্গে মেজাজ, আর মেজাজের সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ করার স্বভাবটা। সত্যি। আগেই কু—ডাকা ওঁর অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন যে এত কু গাইছেন জানি না যে কাগজটা খুললেন অমনি চিৎকার। অথচ আমরা তো মোটে জানিই না, আলোর কোন প্লেনে আসার কথা! নগেন বলছে কালই নাকি টিভিতেও বলেছে, রেডিয়োতেও বলেছে; আমরা কাল টিভি খুলিনি, আর রেডিয়োর ব্যাটারি ফুরিয়েছে। তাই সকালে কাগজ খোলা পর্যন্ত কর্তার উদ্বেগটা তবু এড়ানো গেছে কপালজোরে।

বয়েস তো আমাদের কম হল না। কর্তা রিটায়ারই করেছেন বিশ বছর। ঈশ্বরের অসীম দয়া তাই এই বৃদ্ধ বয়েসে সুখের মুখ দেখিয়েছেন, জীবনে কষ্ট তো কম করিনি। ছেলেমেয়েদুটো সোনার টুকরো হয়েছে, এ যেমন তাদের বাপের শিক্ষায়, তেমনই আমার ঠাকুরের কৃপার জোরেও বটে। কোনওদিন নিজের জন্যে কিছু চাইনি—কেবল বলেছি—ঠাকুর ছেলেটাকে তুমি দেখো, মেয়েটাকে তুমি দেখো। তা ঠাকুর কথা রেখেছেন বই কী। ছেলেমেয়ে দু’জনেই বাপমায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

ছেলে হলে কী হবে—কালো চিরকালই ঠান্ডা, রোগা ছেলে। যমজের ছোট জন তো, বড়র তুলনায় নির্জীব। আলোটা বরং মেয়ে হলেও, ষণ্ডা গুন্ডা। বেশি দুধ খেয়ে নিত, কালোর হাত থেকে ব্যাটবল সব কেড়ে নিত, মেরে ধরে শেষ করে দিত ছেলেটাকে। ওদিকে পড়াশুনোর বেলাতেও আলোকে ঠেকায় কে? কালো লক্ষ্মী ছেলে, নিয়মিত পড়ে সে যত নম্বর পেত, আলো প্রায় কিছু না পড়েই কালোকে ধরে ফেলত। চিরকাল একই ক্লাসে দু’ভাইবোন পড়েছে, তবে দুটো ইস্কুলে। দু’জনেই ফার্স্ট হয়ে ক্লাস উঠত। বি এস সি—তে দু’জনেই ফার্স্টক্লাস অনার্স পেল, একজন ফিজিক্সে, একজন বায়োলজিতে। কর্তার ফুর্তি দ্যাখে কে? আমাকে বললেন—”হেম! তুমি রত্নগর্ভা!” কর্তার মুখে যেন জ্যোতি ফুটে বেরুচ্ছিল আহ্লাদে। পুরুষমানুষ এমন সন্তানঅন্ত প্রাণ আমি আর দুটি দেখিনি। আমার ভাইরাও রয়েছে, দেওররাও রয়েছে, প্রত্যেকেরই ছেলেপুলে রয়েছে। কাউকেই এমন ধারা আতুপুতু করতে দেখিনি বাপু। আগে আগে আমার তো মাঝে মাঝে রাগই হয়ে যেত। মায়েরাই ছেলেপুলেদের নিয়ে থাকে। বাপেরা চিরকাল দেখেছি মায়েদের থ্রু দিয়ে ছেলেমেয়ের খবর নেয়। তা নয়, ঘুম ভেঙে চোখটি মেলেই ইনি ছেলেমেয়ের পেছনে। তাদের ব্যায়াম, তাদের হেদোয় সাঁতার, তাদের চিরতার জল। আদা—ছোলা, দুধ—কলা—মুড়ি—বাপরে বাপ! বড়লোকেরা তাদের ছেলেদের ডিম—টোস্ট খাওয়াতে পারে রোজ, আমরা কেন পারি না, সেই নিয়ে কর্তার কী দুঃখু। এখন সেই ছেলেমেয়ে মনের সুখে ডিম খাচ্ছে, দুধ খাচ্ছে, মাছ খাচ্ছে, মুরগি খাচ্ছে—খেয়ে খেয়ে তাদের মুখ পচে যাচ্ছে। আর সেই দেখে দেখে, কর্তার আমার খুশি ধরে না।

ওদের কাছে যখনই যাই—এই তো বছর দশেক হল আমরা যাচ্ছি—তার আগে যাওয়া এত সহজও ছিল না। ওদেরও অত টাকাকড়ি হয়নি। ছেলেপুলে ছোট ছিল, খরচপত্রও বেশি ছিল। আজ এখানে কাল সেখানে ঘুরে ঘুরে কেবলই চাকরি বদল করত। কালো তখনও সরকারি চাকরি পায়নি, আর ফ্রেডের চাকরি পাকা হয়নি। বারো পুরে তেরো বছর চলছে ফ্রেড এই চাকরিতে বহাল আছে। এই বাড়িতেই আছে ওরা আট বছর। কালোও বলতে নেই গ্রিনকার্ড পেয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে তাও প্রায় বারো বছর হল। ওদের কাছে যখনই যাই—কর্তার মেজাজ একেবারে বদলে যায়। কী হাসিখুশি, কী আপনভোলা, যেন ছেলেমানুষ হয়ে যান। প্রায় বছর বছরই নিয়ে যায় তো ওরা আমাদের। এটা কালোর ফ্ল্যাট। ঠিক উলটোদিকের ফ্ল্যাটটা আলো কিনেছে। ভাড়া দেয়নি, ফাঁকাই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে দু’—চার হপ্তা এসে থাকে। বাকি সময় চাবিবন্ধ। আমি খুলে ঝেড়ে—মুছে রাখি। ছেলেমেয়েরা যেই যখন আসে ওখানেই থাকে। এবারে আলো বলেছিল ফ্ল্যাটের জন্যে দিল্লি থেকে কীসব পেতলের জিনিসপত্তর কিনে আনবে, গত বারে দেখে গেছে ফেরার সময়ে। কিন্তু উনি যে কী ‘কু’ গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। আমারও বাবা বুক টিপটিপ করছে। ”ওর চুয়াল্লিশ চলছে গো”—এটাও বললেন। চুয়াল্লিশ চলছে তো কী হয়েছে। চুরাশি বছর বেঁচে থাকবে আমার আলো। অমন কুষ্ঠীর মুখে আগুন!

ছেলেমেয়েরা আমার দূরে থাকলে কী হবে, ঘরে—থাকা ছেলেমেয়ের চেয়ে বাবা—মায়ের জন্যে ঢের বেশি করে। ঢের বেশি ভাবে। আলোর মনটা তো পড়ে আছে এখানেই। আমিও খুশি। ওরা যেখানে আছে খুব ভাল আছে, ভাল থাক। এখানে বাস করে কী হবে? নিজের চোখে গিয়ে দেখে আসতে পেরেছি ছেলেমেয়ের ঘর—সংসার—যেন ছবির মতন।

কর্তা ঠিকই বলেন। যখনই একসঙ্গে গল্প করি মনে করিয়ে দেন—কতটুকুনি ছোট্ট একটা পৃথিবীর বাসিন্দা ছিলুম আমরা মুক্তারামবাবুর লেনে! আমার ছেলেমেয়েদের কল্যাণেই আজ আমি কত বড় জগৎ একটা দেখেছি। বাপেরবাড়িতে, শ্বশুরবাড়িতে কেউই তো আমার মতো ভাগ্যবতী নেই, আমার বোনেরা, আমার জায়েরা আমায় কত হিংসে করে। বছর বছর বিলেত যাচ্ছি কর্তা—গিন্নিতে, এ কি মুখের কথা? বিলেত দূরস্থান, আমার যে কখনও মথুরা—বৃন্দাবন দেখা হবে ভাবিনি। মেয়ের কল্যণে তো সব তীর্থই ঘোরা হল, আলোই নিজে আমাদের কুণ্ডু স্পেশ্যালের টিকিট কিনে দিয়েছে। দ্বারকা থেকে বদ্রীনারায়ণ সবই দেখা হয়েছে। ওদিকে লন্ডন—নিউইয়র্ক—মন্ট্রিয়াল, কী দেখিনি? কর্তার আবার রোম—প্যারিস আর এথেন্সনগরী দেখবার খুব শখ। কালো বলেছে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একবার তাও বাবাকে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুতেই সেটার ওর সময় হচ্ছে না। জগতে এত কিছু রয়েছে তা কি জানা হত কোনওকালে, যদি সন্তানরা না উপযুক্ত হত? যমজ সন্তানের দুটিই যে এমন ধারা হয়েছে, লোকে কম হিংসে করে? কতজন বাপ—মা’র কপালেই বা এ ভাগ্যি জোটে? একটা সন্তানকে বিলেত পাঠাতেই জীবন শেষ হয়ে যায়, সে ছেলেটা তারপরে আর বাপ—মা—কে মনেও রাখে না। এমনও তো দেখেছি। এই বিশুর বেলাই কী হল। বিশুর বাপ বসতবাড়ি বাঁধা দিয়ে ছেলেকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে পাঠালে। বিশুটা ব্যারিস্টারি পাশও করলে না, দেশেও ফিরলে না। বাড়ি বিক্রি হয়ে বুড়ো বাপ—মা পথে দাঁড়িয়েছে। কিংবা ওই চৌধুরীদের জামাই, শ্বশুরের পয়সায় বিলেত গেল, ডাক্তারি পাশ করে কত নাকি পসারও হয়েছে শুনতে পাই। একটা মেমকে নিয়ে শেষকালে ওখানেই থেকে গেল। বউকে আর নিলেই না। চৌধুরীদের মেয়েটা বেশি বয়সে দু’—তিনটে পাশ দিয়ে এখন একটা মেয়েদের কলেজে পড়াচ্ছে। বাপের টাকা ছিল, তাই তাকে পথে দাঁড়াতে হয়নি। চোদ্দো—পনেরো বছর ধরেই নিজের ছেলেমেয়েকে চোখে দ্যাখে না, এমন তো কত লোকও আছে—তারা চিঠিপত্তর লেখে, মাঝে মাঝে টাকাকড়িও কিছু কিছু পাঠায়, ব্যস। আমার কালো—আলোর মতন আর ক’জন? এই তো চিত্তর যখন বাপ মরে গেল, চিত্ত টোরোন্টোতেই মাথা কামালে, লেকের জলে পিণ্ডি দিলে, শ্রাদ্ধশান্তি করলে। ভটচায্যি মশাই একদিন ছুটি নিয়ে পাঁজির মতে শ্রাদ্ধের মন্তরটন্তর পড়িয়ে তাকে দিব্যি শ্রাদ্ধ করিয়ে দিলেন। বেশ কাজটাজ হল। টোরোন্টো সুদ্ধু ধন্যি ধন্যি। কিন্তু আমি ভাবছিলুম চিত্তর মা’র কথাটা। দশবছর চিত্ত দেশে যায় না। বাপ মরতেও গেল না। মা পড়ে আছে কেরানি ছোট ছেলের কাছে। জ্যেষ্ঠপুত্তুর সে কিনা বাপের শ্রাদ্ধ করলে সাগর পারে বসে! ভটচায্যি মশাই অতবড় একটা চাকরিও করেন, আবার উদিকে দিব্যি টোরোন্টোর বাঙালিদের সব বিয়েথায়, শ্রাদ্ধশান্তিতে, পুজোআচ্চায় পুরুতগিরিও করেন। মাথাটা যে ঘুরিয়ে দিয়েছে, আমেরিকা।

সত্যি, আমেরিকায় গিয়ে মাথাটা ঘুরে যেতেই পারে! এমনও আশ্চর্য দেশ হয়? ফল—দুধ—মাছ—মাংস দু’হাতে ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে। টি.ভিতে যখন দেখতুম কুকুর বেড়ালের জন্যেও মাংসের কালিয়া রান্না করে, টিন ভরে ভরে বিক্রি করছে, কী কষ্টই হত মনে দেশের লোকের জন্যে। আমরা? আলোকালো যখন ছোট ছিল, দু’মাসে একদিন মাংস রাঁধলেই বাড়িতে হইচই পড়ে যেত। কলকাতায় এখন মাছের যা দর, চুনো মাছ দিয়েও রোজ দু’বেলা মাছ—ভাত খাওয়ানো যায় না গেরস্থবাড়ির মানুষজনকে। ওরা যেখানে আছে ভাল আছে, ওখেনেই থাকুক বাবা। কেরোসিনের লাইন নেই, গ্যাসের জন্যে হত্যে দেওয়া নেই, লোডশেডিংয়ের অত্যেচার নেই, ট্রাম—বাসের এই ভিড় নেই। ধুলো নেই ধোঁয়া নেই ভিখিরি নেই, পথেঘাটে কুষ্ঠরুগি যক্ষ্মারুগির থুথু কাশি পড়ে থাকে না, গু—গোবরে পথঘাট ভরতি থাকে না, মশা নেই, মাছি নেই—দরাদরি নেই, ওজনে ঠকায় না। সোনার দেশ, বাবা, সত্যি। ওখানে থাকলে মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। আমাদের এই পোড়া দেশে থাকলে সোমত্ত যুবতীও বুড়িয়ে যায়, আর ওদেশের বুড়িরাও ছুঁড়ি থাকে। থাকবে না কেন? এই মিনিটে মিনিটে যুদ্ধু তো আর করতে হয় না তাদের? এখানে কেবলই নেই—নেই আর নেই—নেই! আমার তো বাপু খুব ভালো লাগে ওদেশে। ওটা যেন প্রাণের রাজ্য—আর এটা মরণের দেশ। ওদের দোকানপাট ঘুরে ঘুরে চোখের দেখা দেখতেও আনন্দ। যেন সিনেমার ছবি। সত্যি সত্যি বলে বিশ্বাস হয় না। যখন প্রথম প্রথম গেলুম সর্বক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে কাটত যেন। রঙিন টিভি, বাড়িতে ভিডিও সিনেমা, বাড়িতে সাঁতারের পুকুর—যা দেখি তাতেই অবাক হই। ইলেকট্রিক যন্তরে কাপড় কেচে, নিংড়ে শুকিয়ে রেডি করে দিচ্ছে! কোনওটা আবার আলু কুচিয়ে দিচ্ছে। আদা পেঁয়াজ বেটে, মাংসের কিমা করে দিচ্ছে। চালের গুঁড়ো, ডালবাটা চোখের পলকে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর দুধ, ওঃ, কী দুধ! কাগজের কৌটো ভরা ভরা কতরকমের দুধ। মাখনতোলা, মাখনওলা, চকোলেটগোলা, কত কী! এমনকী ঘোল পর্যন্ত! কৌটোভরা তৈরি করা টাটকা কমলালেবুর রস রোজ গয়লায় দোরগোড়ায় রেখে যাচ্ছে দুধের সঙ্গে ভোরবেলা। যত দেখতুম তত অবাক হতুম। তবে হ্যাঁ মন্দও আছে। যা নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েগুলো ওদেশে। শরীরে লজ্জা বলে কিছু নেই গা? আর যা নিঘিন্নে নোংরা অভ্যেস সব। ১২/১ মুক্তারামবাবুর গলি থেকে আমেরিকাতে গিয়ে পড়ে, প্রথম প্রথম অনেক ব্যাপারেই খুব অসুবিধেও হত। এক তো বাথরুম! ওঃ, বাথরুমের সে কী শোভা। বাহারি কার্পেট, ভেলভেটের পর্দা, পাথরের ফুলদানি, গোলাপি রঙের পাখা, দ্যালে ছবি টাঙানো, ঝাড়লণ্ঠন, আয়না আলমারি, কী নেই? ঘরে আবার সুগন্ধী আতর স্প্রে করা! যেন বৈঠকখানা! ওখানে নাইবই বা কেমন করে, পায়খানাই বা যাব কেমন করে? মেঝেতে একটি ফোঁটাও জল ফেলা চলবে না। ওই টবের মধ্যে নেবে বসে খুব সাবধানে আগে বালতিতে ভরে জল নিয়ে, মগে করে অল্প অল্প মাথায় ঢালি, গা পুঁছে শুকনো করে নিয়ে তারপর খুব সাবধানে নীচে কার্পেটের ওপর পাতা মোটা তোয়ালের পাপোষের ওপর পা রাখি—ভয়ে ভয়ে প্রথমে আমার তো স্নান করতে ইচ্ছেই করত না। কোথায় মুক্তারামবাবুর গলির কলতলা, শ্যাওলা—পড়া চৌবাচ্চা আর মজে—যাওয়া নর্দমা! আর পায়খানা? কাগজের রোলটি দেখেই তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলুম। যাক জলটলের ব্যবস্থা একটা হল, শিক্ষাদীক্ষাও হল, অভ্যেসও হল। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়! সয় না যার, সে হল মন! তা মনও কি আর সইতে শেখে না! সব সয়ে নেয়। দুধের ব্যাপারটাই ধরা যাক। প্রথম প্রথম দুধের ব্যাপারটা নিয়ে বেজায় মুশকিল হত! কাঁচা দুধটা সোজাসুজি বোতল থেকে ঢালছে আর খাচ্ছে, জ্বাল দেওয়াদেয়ির ব্যাপার নেই—এ আমার কিছুতেই সহ্য হত না। তারপর ওই ঠান্ডা দুধ খাওয়া! দুধ খেতে হয় গরম গরম! এই তো জানি চিরকাল। জ্বাল না—দেওয়া কাঁচা দুধ ঠান্ডা ঠান্ডাই জলের মতন খেয়ে নিচ্ছে নাতি—নাতনিরা, এ দৃশ্যে আমার গায়ে কাঁটা দিত! সে অস্বস্তিও কেটে গেল আস্তে আস্তে। আর খারাপ লাগত যখন তখন মদ খাওয়া। বিয়ার আর ওয়াইন না কী যেন বলে, সে তো আকছারই খাওয়া হচ্ছে। আলোও খাচ্ছে মায়াও খাচ্ছে, কালো আর ফ্রেড তো খাচ্ছেই। রোজ রোজ খাবারের সঙ্গে। জলের মতন যেমন দুধ খায় তেমনই কিছু ভাল রান্না—বান্না হলেই দেখি খাবারের সঙ্গে জলের মতনই গেলাসে গেলাসে ওয়াইন খায়,—নাতি, নাতনিগুলোকে পর্যন্ত দেয়। আর গোমাংসের ব্যাপারটা না হয় বাদই দিচ্ছি। হ্যাঁ এসবগুলো সত্যি সত্যি খুব খারাপ লেগেছিল। খারাপ লেগেছিল ছেলের বউয়ের ফ্রক পরে চাকরি করতে বেরুনো। আলোও তো বেশিরভাগই দেখি পেন্টুলুনই পরে কাজকর্ম করে—বেড়াতে যাবার সময়ে কেবল শাড়ি পরে বেরোয়।

আর সবচেয়ে ঘেন্না করেছিল, একদিন। আলোর পাশের বাড়ির অল্পবয়সি বউটা, জুড়ি, প্রায়ই এসে এসে গল্প করে আলোর সঙ্গে, কফি খেয়ে যায়। ছোট ছেলেটাকে নিয়েই বেড়াতে আসে। ছেলেটার গালে কী একটা কালিঝুলি লেগেছে। মা অম্লানবদনে রুমালে থুতু লাগিয়ে নিয়ে ছেলের গালটি যত্ন করে পুঁছে পরিষ্কার করে দিলে। আমার মনে হল যেন কুকুর মা কুকুর ছানাকে চেটে সাফ করছে। কী ঘেন্না। কী ঘেন্না। একথা ঠিকই যে সাহেবদের ঘেন্নাপিত্তি একটু কম। নইলে যতই শীত হোক, ঘরের ভেতরটা তো ইন্দ্রপুরীর মতন গরম—তবে কেন কাগজ ব্যবহার করতে হবে বাথরুমে? কল খুললেই গরম জলেরও তো অভাব নেই? ওঃ ওই কলের গরম জলটা! ওদেশে গিয়ে আমার ওটা যেমনই আরামের, তেমনই আশ্চর্য লেগেছিল বাপু, সত্যি। যেন ম্যাজিক!

প্রথমবার আলোকালোদের সংসার দেখে এসে নিজের মুক্তারামবাবুর গলির বাড়িতে ঢুকে কান্না পেয়ে গিয়েছিল। তারপরে অভ্যেস হয়ে গেল। যেন সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি। ওখানে গেলে একটা জগৎ, এখানে ফিরে এলে আরেকটা। এই সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে আর কলকাতার জীবনটা ততটা কষ্টকর লাগছে না। দু’ঘরের ফ্ল্যাট হলেও এ বাড়িতে আলো—বাতাস আছে। রাস্তাগুলো চওড়া, অনেক ফাঁকা জায়গা চাদ্দিকে, গাছপালাও আছে। এখানে এসে প্রাণটা জুড়িয়েছে। তবে হ্যাঁ ও দেশে থাকতে থাকতে আমাদের মেয়েদেরও বড্ড লজ্জা কমে যায়। এই যে বউমা যেমন ঠ্যাং বের করে ফ্রক পরে রোজ আপিসে যায়। তিন ছেলেমেয়ের মা, তোকে কি ফ্রক পরা মানায়? না। ওতেই ওর সুবিধে। পরো না, বললে তো শুনবে না। যা করার ঠিক তাই করবে। মুখে চুপচাপ থাকে। কাজে জেদি। দু’ টুকরো করে ন্যাকড়া পরে বাড়ির সুইমিং পুলে ঝাঁপাঝাঁপি করে আমার সোমত্ত নাতনিরা। শুধু কি নাতনিরাই? মেয়ে করে না? বউমা করে না? আমার বাপু দিশি চোখে এসব ভালো লাগে না। কর্তারও লাগে না। আমরা ওই সময়ে সামনের বাগানে বসি, কিংবা টিভি দেখি। কক্ষনও ওদের সাঁতার কাটা দেখতে যাই নে। আরেক দোষ সিগারেট। মেয়েমদ্দ, ছেলেবুড়ো সব্বাই যেমন মদ খাচ্ছে তেমনই মেয়েরা হরদম সিগারেট ফুঁকছে। নাতনিরা নাকি সিগারেট খায়, কর্তা আমায় বলেছিলেন, বাথরুমে গন্ধ পেয়েছেন। আম অবিশ্যি বুঝিনি। কিন্তু শুনেই যা মন খারাপ হয়েছিল আর বলবার নয়। আমাদের ঘরের মেয়েরা সিগারেট খাবে? তা লুকিয়েই হোক আর হাটের মধ্যিখানেই হোক, ভদ্রঘরের মেয়েরা বিড়ি—সিগারেট ফোঁকে কখনও? কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার। আলো যে খায় না; বউমা যে খায় না, তাই রক্ষে। নাতনিরা তো বলতে গেলে মেমসাহেবই, ওইখানেই তাদের জম্মোকম্মো, তারা আর দিশি মেয়েলি আদবকায়দা শিখবে কেমন করে? প্যান্ট পরে বসে, দাঁড়ায় পা ফাঁক করে। ঠিক যেন ব্যাটাছেলে। অনেক করে বারণ করলেও মনে রাখে না। হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে, স্কার্ট পরলেই পা জুড়ে বসব, দেখো। কর্তা বলেন খিটখিট কোরো না। ওরা যেমন আছে থাকতে দাও, ওদের বাবা—মা ওদের মানুষ করুক। তুমি তোমার ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছ তাতেই তৃপ্ত থাকো, ছেলেমেয়ের ছেলেমেয়েকেও আর তোমাকে মানুষ করতে হবে না! ওরা ঠিকই আছে!

তা অবিশ্যি ঠিক। নাতি—নাতনিরা যতই সাহেব—মেম হোক, দাদু—দিদাকে ভালবাসে খুব। কালোর ছেলেটা আমাদের একমাত্র নাতি, বংশের সলতে। দিদা বলতে অজ্ঞান! গত বছর স্ট্যানফোর্ডে গেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। মউ—পিউ এখনও হাইস্কুলে, এবছরই পাশ করে বেরিয়েছে এবারে কলেজে যাবে। ওরাও দু’বোনে যমজ।

ও দেশে গেলে কর্তার মন মেজাজ অত ফুর্তিতে থাকে, কেবল নাতি—নাতনিদের কাছে পেয়ে। আমারও তাই, কিন্তু আমি বাপু অত হুল্লোড় করতে পারি না ওদের সঙ্গে। একটু ভারী মানুষও বটে, ইংরেজিও অত বুঝতে পারি না—চার নাতি—নাতনির কেউই তো পারতপক্ষে বাংলায় কথা বলে না। বাংলা বোঝে অবিশ্যি সবাই। তবু ইংরিজি জানি না বলে আমার আনন্দ আমি পুরোটা ঠিক প্রকাশ করতে পারি না, কর্তা যেমন পারেন। আমি বেশিরভাগ রান্নাঘরেই কাটিয়ে দিই, যেখানেই থাকি না কেন। কী বউমা, কী আলো, দু’জনকেই চেষ্টা করি খানিকটা ছুটি দেবার। সারাবছরই তো বেচারিরা পরিশ্রম করে। বিশ্রাম তো পায় না? তবে হ্যাঁ। ওদের যেমন রান্নাঘর! অমন ঘরে রেঁধেও সুখ। জীবনে কি কোনওদিন কল্পনাও করেছিলুম যে অমন সব রান্নাঘরে আমি রাঁধতে পারব? রান্নাঘর বলতে আজন্মই জেনেছি—ঘুপচি অন্ধকার, অ্যালামাটি রং করা, ঝুলকালি লাগা নিচু ছাদের গরমে ভ্যাপসা, আরশোলা ভরতি একটি বিশ্রী ঘর। ছেলেমেয়েদের রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মার্বেল পাথরের মেঝে, স্টেনলেসের লম্বা লম্বা টেবিল, স্টেনলেসের ডবল বেসিন, তাক, রঙিন পালিশ করা ঝকঝকে নতুন সব সানমাইকার তাক, আর কাবার্ড, কতরকমের ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, বাসন ধোয়ার মেশিনে বাসন ধোয়া চলছে—শিল নোড়ার কাজ হামানদিস্তের কাজ সবই চলছে ইলেকট্রিকে। একটা মিনি—টেবিলফ্যান ঘুরছে সবসময়ে। আর ভাঁড়ার? সে যেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সবকিছুই অফুরন্ত উপছে পড়ছে। চালের কোয়ালিটি কী? পাটনা রাইসই বলো আর দেরাদুনের বাসমতীই বলো, কী শস্তা ওখানে। অথচ দেরাদুনে? গতবছর তো কেদার—বদ্রীর পথে আমরা দেরাদুনে দেরাদুন—রাইসই খুঁজে পেলুম না! ওদেশে সব মশলাপাতি পরিষ্কার। গরমমশলা? ঘি—মাখন? কী শস্তা! কী শস্তা! রেঁধেও সুখ আছে বটে ওদেশে।

টোরোন্টোর চিনে বাজারে ভারতীয় সবজি সবই আসে। ওসব দেশে খাইয়েও সুখ আছে। সাধে কি আর আলো অত লোকজন নেমন্তন্ন করে? মাসে দু’তিনবার তো খাওয়ানো লেগেই আছে। হয় মেয়ের বন্ধুদের, নয় নিজের বন্ধুদের, নয় ফ্রেডের বন্ধুবান্ধবদের—নিত্যই ডিনার, নিত্যই লাঞ্চ। নিজেরা স্বামী—স্ত্রী অনবরত নেমন্তন্ন খেতেও যাচ্ছে—আবার খাইয়েও যাচ্ছে! অক্লান্ত খাটতে পারে বাবা আলো। অথচ দেশে? কুটোটি ভেঙে দুটো করত না!

কালোর বউ নিজেও চাকরি করে বলে ঠিক অতটা লৌকিকতা পেরে ওঠে না। তবে ঘরে বউমাও ভাল রাঁধুনি। অত ভাল ভাল উপকরণ পেলে খারাপ রাঁধুনি হওয়াটাই শক্ত। তবু, মায়ার রান্নার হাতটাও পাকা! একেবারে গরিব ঘরের মেয়ে তো, ছোট থেকেই মা কাজকর্ম করতে শিখিয়েছে। তা জাতে যাই হোক মায়া কিন্তু বামুনবাড়ির সঙ্গে শেষপর্যন্ত বেশ মিশ খাইয়ে নিয়েছে।

আলো তো ভায়ের বউয়ের সুখ্যাতিতে পঞ্চমুখ। ননদে ভাজে এমন ভক্তি—এ বড় একটা দেখা যায় না। অবিশ্যি এতে গুণ মায়ারও যতটা আমার মেয়েরও ততটাই। কালোর সঙ্গে মায়াও একই আপিসে চাকরি করছে এখন। কে জানে একই চাকরি কিনা? পড়াশুনো, ডিগ্রিটিগ্রি একসঙ্গেই করেছে তো দু’জনে। স্বামী—স্ত্রীর একই চাকরি করাটা ঠিক নয় কিন্তু। স্বামীকে সব সময়ে স্ত্রীর চেয়ে একটু এগিয়ে থাকতে দিতে হয়। নইলে সংসারে শান্তি থাকে না।

ফ্রেডকে বিয়ে করার পর আলো যখন স্কলারশিপ ছেড়ে দিল—কর্তা তখনও এইরকমই একবার শুয়ে পড়েছিলেন। সেই চিঠিটা ওঁর যেন মাথায় বাজ হয়ে পড়েছিল। ফ্রেডকে বিয়ে করবে শুনেও উনি ঠিক এতটা ভেঙে পড়েননি, যতটা ভেঙে পড়লেন আলো পড়াশুনো ছেড়ে দিল শুনে। ”কেন? কেন? তবে তো এই ছেলে ভাল জামাই নয়? সে যদি আমার মেয়ের পড়াশুনো বন্ধই করে দেয় তা হলে আর তাকে ভাল বলব কোন মুখে?” যখন ফ্রেডকে নিয়ে আলো আর কালো প্রথমবার দেশে এল, তখনই জামাইকে কিন্তু আমাদের দারুণ পছন্দ হয়ে গেল। আর কালোই ওর বাবাকে বোঝাল যে ওখানে দু’জনে একসঙ্গে পড়াশুনো করা যায় না। আলোর, তা ছাড়া, বাচ্চার খুব শখ। বাচ্চাকাচ্চা হলে, একজনের ঘরে থাকা দরকার। সত্যিই তো, আমি রাতে কর্তাকে বোঝাতে গেলুম—”মা যদি হয়, তবে পড়াশুনো হবে কেমন করে? এখন কিছুদিন ঘরে থাকাই কি ভাল নয়? সংসার, স্বামী, সন্তানের প্রতি দৃষ্টি রাখাই কি যথেষ্ট জরুরি ব্যপার নয়? ঈশ্বর কি তাতে সন্তুষ্ট হন না? এদের সেবাযত্ন কি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন নয় কেবল পড়াশুনো, চাকরিবাকরিই জীবনের উদ্দেশ্য?”

ওরে বাবা—কর্তা এসব কথা শুনে ভুলবেন কেন? তিনি বললেন, ”স্বয়ং কি জীব নয়? তবে নিজের সেবাও তো জীবে দয়া? নিজের প্রতি অবিচার করাও জীবের প্রতি নির্দয়তা? স্কলারশিপ ছেড়ে দিয়ে ঘরকন্নায় মন দেওয়াটা ঈশ্বর সেবা নয়, মনুষ্য সেবাও নয়, স্রেফ বোকামি। ফ্রেডেরই উচিত ছিল বাধা দেওয়া। ফ্রেড তো জানে আলো লেখাপড়ায় কত ভাল। একজনের পড়াশুনো বন্ধ করতে হলে, ফ্রেডেরই উচিত ছিল চাকরি নেওয়া। সে নিজে লোক্যাল পার্সন, আমার আলো ফরেন স্টুডেন্ট। পড়তেই ওদেশে গিয়েছে সে। তার পড়া বন্ধ করাটার মানে তার যাত্রার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দেওয়া।”—বুদ্ধি করে, কী সৌভাগ্য, কথাগুলো মেয়ে—জামাইকে আর বলেননি। ফ্রেডের সঙ্গে কালোরও অত ভাব দেখে ওঁর মন গলল। কালোই তার বাপকে বোঝাল, ফ্রেড কত আলাদা ধরনের ছেলে। আলোই নিজের ইচ্ছেয় পড়ছে না। ফ্রেডের ইচ্ছে নয় আলো পড়া বন্ধ করে। এখন বাচ্চাকাচ্চা হওয়াও ফ্রেডের ইচ্ছে নয়। সেও আলোর নিজের শখ। সেই যে কোষ্ঠীতে কী সব আছে না? সবই আলোর নিজের ঝোঁক, ”ওফ। আবার সে সবও করছে? সাত সাগর পেরিয়েও তার কোষ্ঠী—বাতিক গেল না? মা যে কী অন্যায় করেছেন।” তখন ওর বাবা চটে উঠেছিলেন আমার শাশুড়ির ওপরে। ঠিকুজি কোষ্ঠী করানো তাঁরই নেশা ছিল। আলোর কোষ্ঠীতে আছে, হয় তেইশ—চব্বিশ বছরের মধ্যেই মা হতে হবে, নইলে আর মা হওয়াই হবে না। ওরা যমজ ভাইবোন, একঘণ্টা পনেরো মিনিটের ছোটবড় মাত্র, অথচ কোষ্ঠীতে দু’জনের কত তফাত। বলতে নেই কোষ্ঠীর বিচারে কালো আমার দীর্ঘায়ু। অষ্টআশিকে তো দীর্ঘায়ুই বলব। —আর আলোর কোষ্ঠী পঁয়তাল্লিশে শেষ। কর্তার কোষ্ঠীও অবিশ্যিও চৌষট্টিতে শেষ। বলতে নেই, তাঁর কোষ্ঠীর মুখে ছাই দিয়ে আরও চোদ্দো বছর তো বেঁচে রয়েছেন কর্তা! কাজেই ওসব কোষ্ঠী ফোষ্ঠি আমি আর মানি না। পঞ্চাশে আমারও ঘোর বৈধব্য যোগ ছিল, বিশ বছর আগে, ঠিক যখন উনি রিটায়ার করলেন। বলতে নেই, কিন্তু সেও তো বাবা ফলেনি। আলো—কালোর কোষ্ঠী বিচার করিয়েছিলেন আমার শাশুড়ি। তিনি আর নেই। তবে ছেলের চৌষট্টি পার—হওয়া তিনিও দেখে গেছেন। পঁচাশিতে মা যখন গেলেন, কর্তারও তখন ঊনসত্তর। আলো—কালোর ছেলেমেয়ে তিনিও দেখে গেছেন। সেই কর্তার এখন আটাত্তর চলছে, আলো—কালোর চুয়াল্লিশ। কিচ্ছু ঠিকঠাক ফলেনি। আলোর যে বিদেশির সঙ্গে বিয়ে হবে, বিদেশে সংসার হবে কোষ্ঠীতে সেসবও কিছুই ছিল না। এত বুদ্ধি, এত বিদ্যে, তবুও আলোটা কেন যে এইসব মানে। অবিশ্যি আলোর ঠাকুরদেবতা, পুজোআচ্চাটা আমার ভালই লাগে। ম্লেচ্ছ বিয়ে করলে কী হবে? চমৎকার একটি ঠাকুরঘর আছে ওর। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো করে, পাঁচালি পড়ে। একেবারে পাগল। ফ্রেড নিজে হিন্দু হয়নি, কিন্তু তা বলে সে ক্রিশ্চানও নয়। সে মানুষের ধর্মে বিশ্বাসী। যে যেমনভাবে খুশি পুজো করুক তার কোনও আপত্তি নেই, কেবল একজন অন্যজনের ওপর ধর্মের নামে অত্যাচার না করলেই হল। কর্তা এ ব্যাপারটা জানার পর থেকে ফ্রেডকে ভয়ানক পছন্দ করতে শুরু করলেন। উনিও জীবনে পুজোর ঘরে পা দিতেন না, ব্রাহ্মঘেষা ঈশ্বরবিশ্বাসী কিনা! কিন্তু শাশুড়ির লক্ষ্মীপুজোয় বাধা দেননি। শাশুড়ি গত হবার পরে আমি যখন সেটা কন্টিনিউ করলুম, তাতেও না। অথচ আলোর এই পুজোআচ্চাটা কর্তার নিজের কিন্তু একেবারেই পছন্দ নয়। আলো—কালোর কাছে আমরা বেড়াতে যাই সামারে। একবার আলো টিকিট পাঠায়, একবার কালো। ছেলেমেয়ে বিদেশবাসী হলেও বছর বছর তাদের দেখতে পাই। তিন—চার মাস তো আমরা ওদেশেই থাকি—কালোর কাছে প্রায় দু’মাস, আলোর কাছে পাক্কা দু’মাস—টিকিট যেই পাঠাক না কেন। দেশের পুজো দেখা প্রায় বন্ধই আজকাল। ওদের টোরোন্টোর পুজোটাই দেখি। প্রচুর বাঙালি, বিরাট পুজো হয়। আর আলোই তো তার মস্ত পাণ্ডা। আলোর পাণ্ডা হওয়া স্বভাব—সর্বত্রই সে পাণ্ডাগিরি জুটিয়ে নেয়। কালোর ঠিক উলটো স্বভাব। লুকিয়ে থাকা। কক্ষনও পাণ্ডাগিরি করে না। মায়ার স্বভাবটাও চুপচাপ, সাতেপাঁচে থাকে না। গরিবের মেয়ে তো, নিজে থেকে ঠেলে গিয়ে কিছু করবার জোরটা পায় না। অবিশ্যি আমরাই বা কী ধনী ছিলুম? উনি দরিদ্র স্কুলমাস্টার। কিন্তু আলো তো শান্তশিষ্ট ছিল না। এখনও দুর্দান্ত। চুয়াল্লিশ বছর বয়স কে বলবে, মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োচ্ছে, সাঁতার কাটছে, দড়ি কুড়ুল নিয়ে খাড়া পাহাড়ে চড়েছে—যেন দুটি বোন। ফ্রেডেরই বরং বয়স হয়েছে মনে হয়—শান্ত মানুষটি, চুপচাপ একধারে সরে থাকে, পাইপ মুখে লাগিয়ে মৃদু মৃদু হাসে। বউ অন্ত প্রাণ। কপাল জোরে জামাই পেয়েছি বটে, রত্ন! কর্তা বলেছিলেন—”হেম। তুমি রত্নগর্ভা!” তা গর্ভে যাকে ধরিনি সেই আমার সবচেয়ে দামি রত্ন। যেমন ঠান্ডা, তেমনই মায়া—মমতা, তেমনই উদার। সাহেব হলে কী হবে, কোনও বদ খেয়াল নেই। বউমেয়ে আর চাকরি নিয়েই আছে। কি পরিশ্রমই করে বাড়িটার পেছনে। বাগানটা নিজের হাতে তৈরি করেছে। অত বড় সুইমিং পুলটা নিজে বসিয়েছে। নিজেই পরিষ্কার রাখে। অত বড় বাড়ি—আলোর কষ্ট হবে বলে হপ্তায় একদিন জামাই নিজে পরিষ্কার করে দেয়। আমার বাঙালি জামাই হলে এত করত না। আমার কালোই তো কিছু করে না। চাকরি করলেও মায়াকেই করতে হয় উইক এন্ডে বাড়ি পরিষ্কার। ওরা তাই সুইমিং পুল বসায়নি—কোনও রকমে বাগানটা চালু রেখেছে, মালী রেখে। কালোর একটি ছেলের পর দু’টি যমজ মেয়ে—সবাই ওখানেই জন্মেছে। পরপর তিনটে বাচ্চা, তাদের তো খেলবার ঠাঁই একটু থাকা চাই? বেবি—সিটারের কাছে বাচ্চা ফেলে রেখে চাকরি করতে যেত বলে আমি বউমার ওপর রাগ করতুম। কর্তা কিন্তু সমানেই বলেন, ওই ঠিক করেছে। বরং আলোই গোড়ায় ভুল করেছিল। এখন বুড়ো বয়সে তাই নতুন করে পি—এইচ—ডি শেষ করতে ভরতি হয়েছে। অনেকট এগিয়েওছে। রিসার্চ প্রায় শেষ। ভাইরাস—টাইরাস নিয়ে কী সব গবেষণা যেন করছে আলো। ফ্রেডের বিষয়ও তাই। বার্কলিতে দু’জনেই একই সঙ্গে রিসার্চও শুরু করেছিল। একজন কবে সেসব শেষ করে, উনিশ—বিশ বছর চাকরি করে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হয়ে গেল—আর অন্যজনের এখনও পি—এইচ—ডি করাই হল না।—কপাল! মেয়েদের কপালটাই এরকম। ওদেশে প্রায়ই এটা হয় শুনেছি—বউরা পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করে বরকে উচ্চশিক্ষার খরচ জোগায়। আমার আলোও গোড়ায় গোড়ায় তাই করত। তারপরে বাচ্চা হল, যখন ফ্রেড থিসিস সাবমিট করেছে। বাচ্চার জন্যেই আলো পড়েনি, এটা কিন্তু ঠিক কথা নয়। পড়েনি ফ্রেডের জন্যে। ফ্রেডকে পড়াবে বলে। ফ্রেডের স্কলারশিপ ছিল না। বাপের টাকাও ছিল না। আলোর স্কলারশিপে তো ফ্রেড পড়তে পেত না। কর্তা এসব টের পেয়েই রাগারাগি করেছিলেন। কিন্তু জামাই আমার অকৃতজ্ঞ নয়। শতমুখে সব সময়েই আলোর গুণকীর্তন করছে। কর্তার আবার সেটা পছন্দ নয়। বউয়ের গুণগান বরের মুখে? নিজে তো জীবনে কখনও বউয়ের গুণকীর্তন করেননি কিনা? আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর হবে এবছর—আলো আসছে এখানে একটা হইচই, খাওনদাওন করবে—তারই বন্দোবস্ত করতে। জামাই পরে আসবে নাতনিকে নিয়ে। কলকাতাতে আসার আগে কানপুরে কী যেন একটা কনফারেন্সে যাবে আলো। ওর পি—এইচ—ডি থিসিস জমা দেবার সময় হয়ে এসেছে। দু—একটা পেপার নাকি খুব প্রশংসা পেয়েছে এর মধ্যেই। আলো দেরিতে শুরু করলেও আমার বিশ্বাস ঠিক ফ্রেডকে ধরে ফেলতে পারবে। যা পরিশ্রমী মেয়ে। আর কর্তা বলেন ওর মাথা কালোর চেয়ে বেশি চটপটে, যদিও কালো ফিজিক্সে জগৎজোড়া নাম করে ফেলেছে। সেধেই মস্ত চাকরি দিয়েছে তাকে শেষপর্যন্ত মার্কিন গভর্নমেন্ট। এমনকী তার বউকেও দিয়েছে। এই অ্যাকসিডেন্টের খবরটা পেয়ে অবধি কর্তা যে শুয়ে পড়েছেন, সেটা কিন্তু আমার একটুও ভালো লাগছে না। ওঁকে কখনও এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি আগে। যত বুড়ো হচ্ছেন তত মনটা দুর্বল হচ্ছে আর কি। তাই রাগও বাড়ছে, উদ্বেগও বাড়ছে। আমাদের বয়েস হচ্ছে তো, এখন বুঝে—সমঝে চলতে হবে। বেশিরভাগ জিনিসেই আমরা এখন পরনির্ভর। একটা চিঠির কাগজ পর্যন্ত পোস্টাপিস থেকে অন্যে কিনে না এনে দিলে চিঠি লিখতে পারি না। ওঁর চোখে আবার আধোপাকা ছানি। সে ছানি পাকছেও না কাটাও যাচ্ছে না। ছাপার বড় বড় স্পষ্ট হরফ ছাড়া উনি পড়তে পারেন না। টিভি, রেডিয়ো, এসবই ওঁর ভরসা হয়েছে এখন। সত্যি, চোখটা বড্ড ভোগাচ্ছে। তবু কাগজটি পড়া চাই! কিন্তু আলো নিশ্চয় ওই প্লেনে ছিল না। কেনই বা সে থাকবে? কুটনোটা কোটা এতক্ষণে শেষ হল—বেলাও তো কম হয়নি আজ? শুরু করতেই দেরি হয়েছে—রান্না শেষ হতে সাড়ে বারোটা একটা হয়ে যাবে। বুড়ো হয়ে উনি আর মোটে খিদে সইতে পারেন না, চেঁচিয়ে ওঠেন খেতে দিতে দেরি হলে। আজ তো জলখাবারটা ঠেলে দিলেন। খেলেন না। ফলে বেশি তাড়াতাড়ি খিদে পেয়ে যাবে। আমাকে হাত চালিয়ে নিতে হবে। একবার দিল্লিতে ফোন করে ওদের কাকা—কাকির কাছে বরং খোঁজ নিতে বলি ওঁকে—অযথা এত উদ্বেগ না করে। তাদের কাছেই টেলিগ্রাম করে আলো জানিয়েছে কবে কোন প্লেনে আসছে। উনি শুয়ে না থেকে ভাইকে বরং একটা ফোন বুক করুন। আর ফোন করাও তো প্রায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। উঃ! যাই, বলিগে যাই। দেখেও আসি অমনি এখন কেমন আছেন। রাধরমণ কম্পাউন্ডারকে একটা খবর দিই বরং—একটু প্রেশারটা এসে দেখে যাক। শুয়ে—পড়াটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না। নগেনকে বলি, যাক ডাক্তারখানাতে। নিশ্চয়ই শরীরটাই খারাপ—নইলে হঠাৎ কোথায় কী অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে এখানে উনি নিলেন বিছানা! রোজই তো কাগজে প্লেন—অ্যাক্সিডেন্ট আর ছিনতাইয়ের খবর বেরোয়। এই সেদিন টি—ডব্লু—এ—র প্লেনটা ছিনতাই হল। একটা প্লেন পড়েছে সমুদ্রে, তিনশো উনতিরিশ জন মারা গেছে, তার মধ্যে মেয়েকেও থাকতেই হবে কেন? হ্যাঁ, মন কি আমারও খারাপ হচ্ছে না? অতগুলো মানুষ! অতগুলো প্রাণ! একসঙ্গে শেষ হয়ে গেল। সোজা কথা নাকি? কত বাপ—মায়ের সন্তান ছিল ওর মধ্যে, কত সন্তানের মা—বাপ ছিল, কত পরিবারের সর্বনাশ হয়ে গেল। কালোরাও এ বছর আসছে, ফ্রেডদের সঙ্গেই আসছে—ওই আমাদের বিয়ের স্বর্ণ—জয়ন্তী উৎসব করতে। সত্যি ওদের এটা বাবা বাড়াবাড়িই। ওই প্লেনেও অমন কত না জানি ছেলেমেয়ে দেশে আসছিল বুড়ো মা—বাপকে দেখতে। আমারও কি বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠেনি? তবে কর্তার কাণ্ডটাও অদ্ভুত। কাগজ খুলেই বুকে হাত দিয়ে—”সর্বনাশ হয়ে গেল গো—আঃ আমার আলো মা!” বলে শুয়ে—পড়া, সেটাও বাপু বাড়াবাড়ি। আমি—”কী হয়েছে, আলোর আবার কী হয়েছে?” বলে ছুটে গেলুম। ”ওই প্লেনেই যদি সেও থাকে! হেম? ওটা যে টোরোন্টোরই প্লেন! দিল্লিতেই আসছিল!”—”সে কেন থাকবে? তার তো সামনের হপ্তায় আসার কথা। তুমিও যেমন?”

—”সামনের হপ্তায় ওর কনফারেন্স, এ হপ্তাতেই তো সে দিল্লি আসছে। মনে নেই? তুমি কেবল কলকাতাতে আসবার তারিখটাই গুনছ!”

”না না, ও প্লেনে আমার মেয়ে থাকতে পারে না”—

—”না হেম, না আমার মন বলছে সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের!” আবার ভালো করে কাগজটা যে পড়বেন, তাও পড়লেন না—”কেউ বাঁচেনি যখন, তখন আরও খবরে কাজ কী?” বলে শুয়ে রইলেন চোখ বুজে। চা—ও জুড়িয়ে গেল, মোহনভোগও জুড়িয়ে গেল, ছুঁলেনও না। না বাপু, লোকটার রকমসকম দেখে এবারে আমারও একটু বুক কাঁপছে—যদি…? না না! ওসব কু—কথা আমি ভাবতেই পারব না—অ নগেন, যা তো বাবা মোড় থেকে রাধারমণকে ধরে নিয়ায়, তোর বাবার প্রেশারটা দেখে দিয়ে যাক। নারায়ণ! নারায়ণ! ঠাকুর! রক্ষে করো ঠাকুর!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *