সোমরস

সোমরস

মদ্যপান ব্যাপারটা যত খারাপই হোক, এ কিন্তু প্রায় আমাদের সভ্যতার সমবয়সি। আর্য সভ্যতার প্রাক-পর্বে মহেঞ্জোদারো কিংবা হরপ্পায় কোনো অদ্ভুত পাত্র-খণ্ডকে পণ্ডিতেরা পানপাত্র বলে চিহ্নিত করতে পেরেছেন কিনা, সে খবরটা আমাদের প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিকদের খুঁচিয়ে জেনে নিতে হবে। কিন্তু বৈদিক সভ্যতার আরম্ভ থেকেই মদ্যপানের রেওয়াজ শুরু হয়েছে, সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

তবে বৈদিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ এবং পবিত্র পানীয়টিকে ঠিক মদ্য বলা যাবে কিনা, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত নন। বেদের মধ্যে যে পানীয়টি প্রায় দেবতার সম্মান পেয়ে আসছে তা হল সোমরস। সোম জিনিসটা যে ঠিক কী, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বিস্তর। কেউ বলেন এটি এক ধরনের লতা-বল্লী, কেউ বলেন এটি ওষধি, কেউ বা বলেন এটি দুর্লভ কোনো গাছ। কিন্তু সত্যিই সঠিক এটা কী—তা বৈদিকরাই ভাল করে আন্দাজ করতে পারেন না, তো অন্যে পরে কা কথা।

১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরে এক বিদ্বৎ-সভা বসেছিল। সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যের এই বিশ্ব-বিদ্বৎ সমাবেশে ভারতীয়দের মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে মহারাষ্ট্র থেকে দাণ্ডেকর, কাশীকরের মতো পণ্ডিতরা ছিলেন। ছিলেন পণ্ডিতপ্রবর ঘাটগে। বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন আমার গুরু অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য। সেবারে এই সভার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন এক সাহেব। নাম আর. গরডন ওয়াসন। বিদ্বান-সজ্জন সকলেই সেবার ওয়াসন সাহেবের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি নাকি সোমের স্বরূপ প্রকাশ করবেন তাঁর পত্রিকা-ভাষ্যে।

ওয়াসন সাহেবকে সামরিক কারণে কারাবন্দি হতে হয়েছিল। জেলের ভিতরেই সোমের স্বরূপ নিয়ে তিনি ভাবনা-চিন্তা করতে থাকেন এবং আবিষ্কার করেন যে, এক বিশেষ ছত্রাক বা ব্যাঙের ছাতাই সোমরসের উৎস। তিনি প্রায় একশো-দেড়শো কিসিমের ছত্রাক পরীক্ষা করে দেখেন যে মাত্র একটি বিশেষ ধরনের ছত্রাকের সঙ্গে ঋগবৈদিক সোম-বর্ণনার মিল আছে। জেলের মধ্যে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার অনেক সমস্যা ছিল। এমনও হয়েছে একেকটি ছত্রাক ছেঁচে খেয়ে তিনি তাঁর আপন মূত্র পরীক্ষা করে দেখতেন অর্থাৎ নিজেই পান করে দেখতেন যে, সেটি মাদকতা আসে কিনা।

ঋগবেদের মধ্যে সোমের যে বর্ণনা আছে তাতে বোঝা যায়, প্রথমেই এটি লতা বা বল্লী ছিল না। এটির বর্ণনা এমন আছে যা রাতের আঁধারে জ্যোতিষ্মান এবং দিনে ঈষৎ রক্তবর্ণ ধারণ করে, কখনও বা শ্বেতবর্ণও। সেই সমস্ত বর্ণনা মিলিয়ে ওয়াসন সাহেব দেখেছিলেন যে, একটি বিশেষ ধরনের ব্যাঙের ছাতাই ঋগবেদে উল্লিখিত বিভিন্ন সোম-বর্ণনার সঙ্গে মেলে। এই বিশেষ ছত্রাকটির ল্যাটিন নাম ‘আমানিটা মুসকারিয়া’ (Amanita Muscaria)। বাংলায় এই নামের তর্জমা করা সম্ভব নয়। তবে ওয়াসন সাহেব জানিয়েছিলেন, উত্তর ভারতের পার্বত্য এবং প্রত্যন্তদেশে হিমালয়ের পাদদেশে—ক্ষরন্তঃ পর্বতাবৃধঃ—এই বিশেষ ধরনের ছত্রাক পাওয়া যায় এবং বৈদিকরা এই ছত্রাকই ব্যবহার করতেন সোমরস প্রস্তুত করার জন্য।

ওয়াসন সাহেব তাঁর বইটির নাম দেন—Soma : The Divine Mushroom of Immortality. বইটিতে এই বিশেষ ছত্রাক ছাড়াও আরও কতগুলি ব্যাঙের ছাতার অপূর্ব রঙিন ছবি আছে, যা দেখলে পরে পাঠক নিজেকে ধন্য মনে করবেন। হলফ করে বলতে পারি—ব্যাঙের ছাতারও যে অমন স্বর্গীয় মনোহর রূপ হয়, তা পাঠক কখনও দেখেননি। বইটি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পেতে পারেন, কিন্তু আর কোথাও সে বই আছে বলে জানি না।

ঋগবেদে সোমের বর্ণনায় অনেক বিশেষণ আছে। ক্যানবেরার বৈদিক পণ্ডিতেরা সে সব প্রশ্ন তুলে ওয়াসন সাহেবের পূর্বপক্ষতা তৈরি করার চেষ্টা করেন। সাহেব অতকাল ধরে অত খেটে যে অভিমত তৈরি করেছেন, সেই অভিমত তাতে নস্যাৎ করা যায়নি। দাণ্ডেকর-কাশীকররা সামনাসামনি নানা ওজর-আপত্তি তুললেও ভারতবর্ষে ফিরে এসে তাঁরা ওয়াসনকে মেনে নিতে থাকেন। পণ্ডিতদের পরম্পরায় যা শুনেছি, তাতে দাণ্ডেকর-কাশীকররা নাকি চিঠি লিখে ওয়াসন সাহেবকে জানিয়েছেন যে, তাঁর গবেষণা ঠিক পথেই চলছে।

আমরা আজকে হয়তো ভাবতেই পারছি না বৈদিকেরা যে সোমরস নিয়ে এত মাতামাতি করেছেন, তা স্বরূপত একটি ছত্রাক। তবে সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীর পানশৌণ্ডরাও কি পানকালে নির্দিষ্ট তরল পদার্থের স্বরূপ এবং মৌল নিয়ে ভাবনা করেন কখনও? কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, সোমরস অত্যন্ত স্বাদু পানীয় হলেও, এর কোনো মাদকতা ছিল না। হয়তো মহান ঋষিরা অনেকেই সোমরসের রসজ্ঞ ছিলেন বলে পরবর্তী ভদ্র পণ্ডিতেরা সোমরসের মাদকতা সম্বন্ধে কথঞ্চিৎ রুদ্ধবাক হয়েছেন। কিন্তু বেদের মধ্যে সোমরসের যে বর্ণনা আছে এবং সেখানে যে সব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে সোমরসের মাদকতাই কিন্তু মোটামুটি সিদ্ধ হয়।

ঋগবেদে একটি পুরো সূক্তই আছে যার সাতটি ঋকের প্রত্যেকটিতে ধ্রুবপদ বাঁধা হয়েছে—হে সোম! তুমি মাদক পদার্থের মধ্যে সকলের ধারক—মদেষু সর্বধা অসি। অন্যেরা বলতে পারেন—এখানে ‘মদ’ শব্দটা মোটেই ‘মদ্য’ নয়, আসলে সোমরস গ্রহণ করলে শরীরে একটা শক্তি আসে, একটা চনমনে ভাব আসে, এমনকি একটু সাহংকার চেতনাও আসে, আর তার জন্যই ‘মদ’ শব্দটার প্রয়োগ হয়েছে। নইলে সোমরস মোটেই মদ নয়।

দেব-দ্বিজের সম্মানার্থেই শুধু এই মতটা আমরা মানতে রাজি আছি। কিন্তু বেদের আরও কিছু শব্দ এবং বাক্য-বিন্যাস খেয়াল করতে দেখা যাবে—খুব উচ্চস্তরের হলেও ওই তরলটিকে মাদকতার সামঞ্জস্যেই দেখা ভালো। আমরা এটা বলছিনা যে, শ্রদ্ধেয় ঋষিমুনিরা সোমরস পানের জন্য উদগ্রীব হয়েই যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন অথবা এও বলছি না যা, যজ্ঞশেষে মাদকতাই তাঁদের একমাত্র কাম্য ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, সোমরসের ভাগ তাঁরা কতটুকুই বা পেতেন? যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশে সোমরস অর্পণ করা হত এবং যজ্ঞ শেষ হয়ে গেলে হুতশেষ অর্থাৎ আহুতি দেবার পর যেটুকু পড়ে থাকত সেইটুকুই পান করতেন পুরোহিতেরা। ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছাড়া অন্য কোনো যজ্ঞ-সম্পর্কহীন ব্রাহ্মণও সোমরস পান করতে পারতেন না। ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র তো দূরের কথা।

কিন্তু সামান্য হলেও যেটুকু হুতশেষ সোমরস মিলত, সেটুকুও বড়ো ব্যাকুলতা জাগাত ব্রাহ্মণের মনে এবং শরীরে। মদ নয় বললে কী হবে, মন্ত্রবর্ণ যখন বলে—অভিত্যং মদ্যং মদ-মিন্দবিন্দ্র ইতি ক্ষর—সোম! যেহেতু তুমি সবার ওপরে এক মদকর পদার্থ, তাই তুমি ক্ষরিত হও—তখন এই মন্ত্রস্থ ‘মদ্য’ শব্দটার শব্দপ্রমাণই কি কম কথা! কলশে কলশে পাত্রস্থ করার সময় যে ফেনা উঠত, তাতে তার মাদকতার অনুমান-প্রমাণই কি কম—অত্যূর্মি-র্মৎসরো মদঃ সোমঃ পবিত্রে অর্যতি। ঋগবেদের নবম মণ্ডলের সোমসূক্তের আরম্ভই হলো—’স্বাদিষ্ঠ’ আর ‘মদিষ্ঠ’ এই দুটি বিশেষণ দিয়ে—স্বাদিষ্ঠয়া মদিষ্ঠয়া পবস্ব সোম ধারয়া।

যাই হোক, সোমরসের মধ্যে মাদকতা ভালরকমই থাকুক, আর কমই থাকুক, সোমপানের জন্য দেবতাদেরও আকুতির অন্ত ছিল না। দেওয়া-নেওয়ার রীতিতে বিশ্বাসী বৈদিকরা নিজের জন্য বা নিজ পরিবার বা গোষ্ঠীর জন্য দেবতাদের কাছে যদি কিছু আকাঙ্ক্ষা করতেন, তবে দেবতার তুষ্টির জন্য সোমরসের ব্যবস্থা একটা রাখতেনই। এখনকার দিনে বড়ো বড়ো বিজনেস ম্যাগনেটদের খাদ্যপানীয়ে তুষ্ট করে যেমন আপন কর্ম সিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়, বৈদিক যুগে দেবতাদের সঙ্গে প্রায় সেই ব্যবহারই করা হয়েছে। ঋগমন্ত্রে লক্ষ করে দেখুন—অভীষ্ট দেবতা যাতে যজ্ঞস্থলে উদয় হয়ে সবার আগে তাঁর সোমরসের পাত্তরটি পান, তার জন্য ঋষি বলছেন—দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে তুমি এখানে এস অগ্নি! তোমার জন্য সোমরসের মধু তৈরি করে আগাম পানপাত্র সাজিয়েই রেখেছি—অভি ত্বা পূর্বপীতয়ে/সৃজামি সৌম্যং মধু।

সোমরস তৈরির কায়দা ছিল। জটিল না হলেও সেটা খুব সরলও নয়। সোমলতা খুব সহজে পাওয়া যেত না। বৈদিক যুগের শেষ কল্পেই সোমলতা প্রায় দুর্লভ হয়ে যায়। বহুদূর থেকে সোমলতা সংগ্রহ করে এনে যজ্ঞের নিয়ম মেনে মন্ত্রবর্ণ উচ্চারণ করে তবে সেই সোমলতার রস বার করা হতো। এই সোমরস সোজাসুজি পান করা হতা না। সোমকে স্বাদুতর করার জন্য নানা মিশ্রণের ব্যবহার ছিল। ঋগবেদের বিভিন্ন সূক্তগুলি পাঠ করার পর যে ধারণা হয়, তাতে বলা যায় সোমবল্লীর কচি কচি যে ডগাগুলি—যাকে ‘অংশু’ বলা হত, সে ডগাগুলি পাথরে (অদ্রি) ছেঁচে প্রথমে রস বার করা হত। তারপর সেই রসকে পরিষ্কার টলটলে করার জন্য একটি মেষলোমের তৈরি ছাঁকনি ব্যবহার করা হত। এই লোম-ছাঁকনিটিকে বলা হত ‘অব্য’—অচ্ছা কোশং মধুশ্চতুমসৃগ্রং বারে অব্যয়ে। ছাঁকনি দিয়ে ঢালার মাধ্যমে সোমরসের এই পরিশুদ্ধি-প্রক্রিয়াটিকেই বলা যায় ‘পবমান’ বা ‘পুনান’। আধুনিক ভাষায় একে বলা যায় ‘ফিলটার’ করা সোমরস। এই পরিশুদ্ধরস এবার কলশে কলশে ভরে রাখা হত।

কলশে কলশে সোমরস স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক ঋষিদের মন্ত্রের ধুম পড়ত। আমাদের দেশে যেমন পুজো চলবার সময় হঠাৎ একেক সময়ে মেয়েরা ডুকরে উলু দিয়ে ওঠে, এই মন্ত্র পড়ার ধুমও তেমনই। ঋষিরা নিজেদের এই শব্দাগম কলশের ভিতর প্রবেশ করিয়েছেন—অভিক্রন্দন কলশং বাজ্যযতি। আমি সত্যি কেমন করে ওই অপ-তুলনা করি—আধুনিক পানশৌণ্ডরা যেমন কাচনির্মিত পাত্রে রাখা একটি বিশেষ তরল দেখলেই আনন্দিত হন, বৈদিক ঋষিরাও কলশের সোমের অবস্থান দেখে তেমনই আনন্দিত হয়েছে—তা কলশেষু ধাবতি পবিত্রে পরিষিচ্যতে। ‘কলশ’ শব্দটা ছাড়াও পাত্র হিসেবে ‘দ্রোণ’ শব্দটাও ব্যবহার করা হয়েছে—অভি দ্রোণান্যাসদম—এবং ভি. এম. আপ্তের মতো পণ্ডিত সেই দ্রোণ শব্দের ইংরেজি করেছেন ‘ভ্যাট’।

অবশ্য মেষলোমময় ‘অব্য’ অথবা কুশময় ‘পবিত্র’ বা ছাঁকনির মধ্য দিয়ে দশ অঙ্গুলির পেষণে কলশ বা দ্রোণের মধ্যে যে তরলটিকে পাত্রস্থ করা হলো, এখনও তার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি হয়নি। এটির সংস্কারপর্ব বা মিশ্রণ-পর্ব এখনও বাকি। এই মিশ্রণকার্যের পারিভাষিক নাম ‘আশির’। এই মিশ্রণের মাধ্যমগুলি দই, দুধ আর যব—সোমাসো দধ্যাশিরঃ। ঋগবেদ বলেছে—দেবতাদের মত্ততার জন্য এই দুগ্ধজাত বস্তুর সঙ্গে ছাঁকনি-ছাঁকা পরিশুদ্ধ সোমরস মেশালে সেটা সুবাসিতা পানযোগ্য হয়—যদগোভির্বাসয়িষ্যসে। পরিস্রুত এই সোম-তরলের রং একেবারে ঝকঝকে সাদা, দেখলে মনে হবে, তা থেকে জ্যোতি বেরোচ্ছে—বৃহচ্ছ্রুক্রং জ্যোতিরজীজনৎ। শুভ্রেভি শুভ্রশস্তমঃ। কখনও এর রঙ ঈষৎ হরিদবর্ণ বা ঈষৎ পিঙ্গলবর্ণ—অসাবি সোমো অরুষ বৃষা হরি/হরিশ্চন্দ্রো মরুদগণঃ। গোরুর চামড়া দিয়ে পাত্র নির্মাণ করে তাতেও রাখা হতো সোমরস যা মত্ততার জন্য পান করতেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র—এষ সোমো অধি ত্বচি গবাং ক্রীড়ত্যদ্রিভিঃ, ইন্দ্রং মদায় জোহুবৎ।

দেখুন, বহু বিস্তারে না গিয়ে সামান্য যতটুকু বর্ণনা দিয়েছি তাতে সোমরসকে সম্পূর্ণ মাদকতাহীন শুধু এক উন্নত-উজ্জ্বল পানীয় ভাবার কোনো কারণ নেই। দেবতাদের মধ্যে সোমরস গ্রহণের আকুলতা আছে এতটাই যে, সোমরসের পাত্র সামনে রেখে তাঁদের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হয়ে গেছে। সুপ্রাচীন ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এই ঘটনা বলা আছে যে, পুরাকালে প্রধান দেবতারা সকলেই ‘আমি আগে’ ‘আমি আগে’ বলে সোমপান করার জন্য দৌড় লাগিয়েছিলেন। কিন্তু এভাবে তো চলে না। দেবতাদের শক্তি কারুরই কম নয়। অতএব তাঁরা নিজেরা মিলেই ঠিক করলেন যে, ঠিক আছে। একটি সোমপাত্র লক্ষ হিসেবে স্থাপন করা হোক। তারপর আমরা দৌড় লাগিয়ে যে আগে পৌঁছব, সেই প্রথম সোমপানের অধিকারী হব।

নির্দিষ্ট কথামতো ইন্দ্র, বায়ু, মিত্রাবরুণ এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় দৌড়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু ইন্দ্রের দুর্ভাগ্য, তিনি দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান বা ‘পারয়িষ্ণুতম’ হওয়া সত্ত্বেও বায়ুর আগে সোমপাত্রের স্পর্শ পেলেন না। বায়ু এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন, দ্বিতীয় অবশ্যই ইন্দ্র, তৃতীয় মিত্রাবরুণ এবং অশ্বিদ্বয় চতুর্থ স্থান অধিকার করলেন। পরে অবশ্য ইন্দ্রের বুদ্ধিতে সোমরস ভাগ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে অন্য কথা। সোমপানের জন্য দেবতাদের আকুলতা হল এইরকম। সত্যি কথা বলতে কি, মদ্যলোভী পানশৌণ্ডিকের মতো দেবতারা সোমরসের নাম শুনতেই যথেষ্ট ভালবাসেন—দেবেভ্যো দেব্রূশ্রূত্তমম—আর পান লাভ করলে তো কথাই নেই। সে পান মধুর হইতে সুমধুর—তং ত্বা দেবেভ্যো মধুমত্তমম।

দেবতারা সকলেই এই ‘মধুমত্তম’ সোমরসের রসজ্ঞ হলেও, দেবযোদ্ধা ইন্দ্রের জন্যই প্রধানত সোমরসের ব্যবস্থা। লক্ষ করে দেখবেন—সোমকে অন্তত পঞ্চাশ বার টগবগে একটি ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ঋগবেদে। আর সোম কথার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়ই এসেছে যুদ্ধের কথা। ইন্দ্রকে প্রভূত পরিমাণ সোম পান করিয়ে তাঁর শক্তিবর্ধন করা এবং সেই মাদকশক্তিতে যজমানের শত্রুবিনাশ করে দেবার প্রার্থনা বারবার এসেছে ঋগবেদে। বস্তুত আধুনিক থেকে প্রাচীন সমস্ত যোদ্ধা-পুরুষের বলবর্ধনের জন্যই যে রস-পানের ব্যবস্থা আছে, সে কথা না বললেও চলে। অপিচ ইন্দ্র যেহেতু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা পুরুষ, অতএব তাঁকে সোমরস পান করানোর জন্য পুরোহিতদের চেষ্টার অন্ত নেই।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সোমপানের ব্যাপারে সমস্ত দেবতাদের চেয়ে ইন্দ্রের নেশাটাই সবচেয়ে বেশি। আর তা হবেই বা না কেন? ইন্দ্র জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি তাঁর পূজনীয়া জননী তাঁর মুখে এক ফোঁটা সোমরস দিয়েছিলেন! মুখে মধু দেওয়ার প্রচলন বোধহয় এখান থেকেই। এই স্বাদ কি কেউ ভুলতে পারে? আস্তে আস্তে সোমরস তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়াল। আর শেষটা এমন হলো যে, ইন্দ্রকে যদি কোনো কর্মে মানুষের প্রয়োজন হয়, তবে তাঁর কছে কোনো প্রার্থনা জানানোর আগে সোমরসের জোগাড় করতে হবে ঋষিদের, তারপর ইন্দ্রকে আহ্বান করা—সোমা সুতা…. ঋতস্য সাদনে ইন্দ্রায় মধুমত্তমাঃ। বেশিরভাগ সময়ে বেশির ভাগ সোমই যেহেতু ইন্দ্রের জন্য রক্ষিত হত তাই এই মহান তরলের নামই হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রিয় রস—অর্থাৎ ইন্দ্রের জন্য তৈরি তরল—মদিন্তমো মৎসরঃ ইন্দ্রিয়ো রসঃ।

আর সত্যি, ইন্দ্রের পান করার ক্ষমতাও অসম্ভব। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে ইন্দ্রের এই পানশক্তি হয়তো একটু আলংকারিক অতিশয়োক্তির পর্যায়ে পড়েছে বটে, কিন্তু অতিশায়িনী হলেও তা উক্তি তো বটে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থ বলেছে—তিনি একেক চুমুকে তিনশো জালা সোম শেষ করে দিতেন—একেনৈব প্রতিধাপিবৎ সোমং সরাংসি ত্রিংশতম। হতেও বা পারে। সবার ক্ষমতা তো একরকম নয়। জন্মলগ্নে জননীর কোমল অঙ্গুলির মধু তো আমরাও লাভ করেছি, কিন্তু ভবিষ্যতে সব মনুষ্যই কি একই রকম মধুব্রত হতে পারেন। আসল কথা, যিনি পারেন, তিনি পারেন। তার জন্য দেবতারাও ইন্দ্রকে হিংসা করেন না। আর মর্ত্যের মানুষের যা স্বভাব, যিনি খেতে পারেন, তাঁকে আরও খাওয়াতে ভাল লাগে। ঋষিরা যে অন্য দেবতার উদ্দেশে তাঁদের উৎকৃষ্ট শ্বেতবর্ণ সোমপান নিবেদন করেননি, তা মোটেই নয়। কখনও অশ্বিদ্বয়, কখনও বরুণ, কখনও রিভুরাও ঋষিদত্ত সোমের অংশভাগী হয়েছেন।

হয়েছেন। তবে ওই নেমন্তন্ন-বাড়িতে যেমন—আরে এই এঁকে একটু দিলে না—এইভাবে যেমন অবসরপ্রাপ্ত বসে থাকা মানুষের পাতে খাদ্য দিই সেইভাবে অশ্বিদ্বয় কি মিত্রাবরুণের ভাগে সোমপান জুটেছে, এমনকি বায়ুকেও প্রায় এইভাবে সৎকার করেছেন ঋষিরা—মধুমাঁ অস্তু বায়বে। কখনও বা বায়ুকে যদি খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে থাকে তখন বায়ুর উদ্দেশেও একবার-দুবার ঘটা করে মন্ত্রবর্ণ উচ্চারণ করে সোম নিবেদন করেছেন ঋষিরা। তবে বায়ুর কাছে সোমের সুস্নিগ্ধ পদসঞ্চার সালংকারা নববধূর মতো। সারাদিন গা ঘষে-মেজে পরিষ্কার হয়ে নানা অলংকার পরিধান করে নববধূকে কন্যাপিতা স্বামীর হাতে তুলে দেন—পরিষ্কৃতাস ইন্দবো যোষেব পিত্র্যাবতী—সোমও সেইরকম সলজ্জে বায়ুর কাছে গমন করেন—বায়ু সোমা অসৃক্ষত।

কিন্তু ইন্দ্রের বেলায় সোমের কোনো লজ্জা, ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নেই; ঋষিরাও তাই একেবারে একটি সূক্তের প্রথম ঋকটি থেকে ইন্দ্রকে আপন সখার মতো সোমপানের জন্য ডাকেন। সেই ডাকের মধ্যে পরম বন্ধুত্ব ফুটে ওঠে, ফুটে ওঠে কাছের মানুষের উচ্ছ্বাস—এই ইন্দ্র! এস এস! সোমপান কর, পান করে মাতাল হয়ে ওঠ—পিবা সোমম ইন্দ্র মন্দতু ত্বা। শুনলে মনে হবে যেন ভোজপুরী ভাষায় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি। পিবা সোমম ইন্দ্র—এ হল বশিষ্ঠ ঋষির জবান, আবার সোমসাধনের এই মন্ত্রবর্ণ যখন উশনা কবির মুখে বসবে, তখন তিনি বলবেন—ইন্দ্র! তোমার জন্যই এই সোম প্রস্তুত করেছি, তোমার জন্য এ ক্ষরিত হচ্ছে, অতএব তুমিই এটা পান কর—অয়ং সোম ইন্দ্র তুভ্যং সুন্বে তুভ্যং পবতে ত্বমস্য পাহি।

ধরে নিলাম, ইন্দ্র একটু বেশি রকমই জড়িত সোমপানের সঙ্গে। কিন্তু সোমের যে এত বর্ণনা, সোমের যে এত স্তুতি তা কি সোমরসকে শুধুই দেবভোগ্য করে রাখার জন্য? দেবতাদের সঙ্গে ঋষিদের জন্যও যে এই মহান সোমরস নিষ্কাশন করা হচ্ছে, তা কিন্তু ঋগবেদেই আছে। স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে ঋষিদের সর্বক্ষণ ওঠাবসা, দেওয়া-নেওয়া যেখানে চলছে, সেখানে ঋষিরা নিজেদের হাতে তৈরি অভিনব রসটি দেবতাদের পান করাবেন এবং নিজেরাও হুতাশেষ পান করবেন এইটাই স্বাভাবিক। ঋগবেদ বলেছে যে, এই রস দেবতাদের বলাধান করে আর মানুষকে দেয় অনাবিল আনন্দ—রসো দক্ষো দেবানাম অনুমাদ্য নৃভিঃ।

সত্যি কথা বলতে কি, দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদন করতে করতে মানুষও এই সোমরসের মাহাত্ম্য এবং রসত্ব বুঝতে পেরেছে। বেদে এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে সোম সম্বন্ধে যেভাবে লেখা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, এটি খেচরান্নের মতো কোনো সহজ বস্তু নয় যে, বিলি করে বেড়াতে হবে। জাতিবাদী পণ্ডিতেরা বলবেন—এই হল পুরোহিত-তন্ত্র। নিজেরা দেবতাদের নাম করে ভাল জিনিস মেরে দিয়ে বলতেন—ওতে ত্রৈবর্ণিক ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের অধিকার নেই। আমরা সবিনয়ে জানাই, ক্ষত্রিয়রা সেযুগের ব্রাহ্মণের চেয়ে কম হলেও খুব কম ক্ষমতাশালী ছিলেন না। বিশেষত রাজদণ্ড ছিল তাঁদেরই হাতে। কিন্তু তাঁরাও যেহেতু সোমপানের অধিকার পাননি, তার মানে জিনিসটা সত্যিই দুর্লভ ছিল।

বিশেষ কোনো ছত্রাক হোক, লতা হোক অথবা যাই হোক, যে বস্তু অত কষ্টে করে জোগাড় করতে হত এবং যা অসংখ্য মন্ত্র পড়ে অত কষ্ট করে বানাতে হত, সে বস্তুকে কি দানছত্র করা যায়? তা ছাড়া যজ্ঞে আহুতির ব্যাপারটা মোটেই এখনকার ঠাকুর-ভোগের মতো ছিল না। এখন যেমন অভীষ্ট দেবতার উদ্দেশে অন্ন-পান নিবেদন করে তাঁকে মানসোপচারে সন্তুষ্ট করি, আর দেবতা ভদ্রলোক আমাদের হৃদয়ের ভাব-ভক্তিটুকু গ্রহণ করে অন্ন-পাকটুকুও সম্পূর্ণ অক্ষত রেখে দেন, তখন এমন ছিল না। তখন যজ্ঞকুণ্ডের মধ্যে দেবতার জন্য যে আহুতি উৎসর্গ করতে হত, তা আর ফিরে আসত না। অর্থাৎ সেটা গেল। আর যেটুকু থাকল, সেইটুকুও যদি অত পরিশ্রমের পর ঋষিরা না পান, তাহলে সোম-প্রস্তুতির পরিশ্রম তাঁদের পোষাবে কেন?

হুতশেষ সামান্য যা পেতেন, তাতে মোটেই মন ভরত না বলেই সোমের জন্য একটা অন্য আকুতি ফুটে উঠেছে বৈদিক মন্ত্রের মধ্যে। অতি দুর্লভ এবং অতি উত্তম বস্তু আমাদের করতলগত হলে আমরা অল্পেই সন্তুষ্ট হই এবং সাগ্রহে বলি—এসব দেবভোগ্য জিনিস, ভালর অল্প ভাল, ঠিক তেমনই ঋষিদের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে—আরে! এ হল স্বর্গীয় পানীয়—দিবং পীযূষমুত্তমম… সুনোতা মধুমত্তমম—মাদকতা সৃষ্টি করে এমন পানীয়ের মধ্যে তুমি হলে শ্রেষ্ঠ, সোম!

বেদের মধ্যে সোমপানের পরবর্তী যেসব উত্তেজনার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত দেবযোদ্ধা ইন্দ্রদেবকে বৃত্র-শম্বর ইত্যাদি অসুর বধের আগে যেভাবে সোমপান করিয়ে তাঁকে সামরিক কায়দায় উন্মত্ত করে তোলা হয়েছে, তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে, সোমরসের মাদকতা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু সমস্যা একটাই, বেদের মধ্যে যে সোম-প্রস্তুতির যত বর্ণনা পাই, তাতে সোমরসের তৈরিতে ‘ফার্মেন্টেশনের’ কোনো ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয় না। সোমরসে উত্তেজনা হত, শক্তিবৃদ্ধি ঘটত এবং জিনিসটাও অত্যন্ত স্বাদু হত, কিন্তু ‘ফার্মেন্টেশনের’ ব্যবস্থা না থাকায় সোমরস পান করে একবারে ‘বুঁদ’ হয়ে পড়ে থাকা যেত না।

একটা অসাধারণ কথা ঋগবেদেই লক্ষ করবেন—ঋষিরা বলছেন—সোম! তোমাকে ইন্দ্রের মাদকতা এবং অহংকারের জন্য তৈরি করেছি। কিন্তু তুমি আসলে মনঃ-স্বরূপ, তুমি মনের অধিপতি—মনশ্চিন মনসম্পতি। সত্যি কথা বলতে কী, সোমপানে শরীরে একটা উত্তেজনা যেমন আসে, তেমনই মনটাকে একেবারে ফুরফুরে করে তোলে। সোমকে মনের সঙ্গে তুলনা করে এবং তাকে মনের অধিপতি করে দিয়ে বৈদিক ঋষি-কবিরা নিজেদের কাব্যের পথ প্রশস্ত করেছেন নিশ্চয়ই। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর প্রথম কবিতা সৃষ্টির ব্যাপারে এই ‘মনশ্চিন মনসম্পতি’ সোমের অবদান একেবারে কম মনে হয় না।

‘ফার্মেন্টেশনের’ কোনো উপযোগিতা না থাকলেও সোমকে মদ এবং মদ্যের একাত্মতাতেই দেখা হয়েছে, যেহেতু সোম যুদ্ধ এবং সৃষ্টির উত্তেজনাটুকু নিশ্চয়ই দিত। বেদের মধ্যে সোম দেবতাদের প্রিয় উত্তেজনা—দেবানামসি প্রিয়ো মদঃ। এই উত্তম পানীয় জিহ্বায় স্পর্শ করানোর পরেই ওষ্ঠপ্রান্তে যে স্বাদুতাসূচক শব্দটুকু হত—তাতে একে মধূত্তমের মর্যাদা দেওয়া যায় বটে, কিন্তু কোনোভাবেই মালমদ্যের সমতায় সোমরসকে টেনে নামানো যায় না। এমন নয় যে, বৈদিকরা সুরা কাকে বলে জানতেন না। জানতেন, খুব ভালই জানতেন, কিন্তু সোমরস সুরা নয় কোনোভাবেই।

বৈদিক সত্যতার প্রথম কল্পে যখন সোম, সে ছত্রাকই হোক অথবা লতা-বল্লী, তখনও এর মর্যাদা নিহিত ছিল দুর্লভতার মধ্যেই। এমনকি যখন সোম এবং সোমবল্লী দুইই অপ্রাপ্য হয়ে গেল, তখন যাগযজ্ঞে সোমরস নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হল ‘পূতিকা’ নাম একটি বিকল্প ওষধি দিয়ে, কিন্তু তখনও এর মর্যাদা নষ্ট হয়নি, যদিও স্বাদুতা নিশ্চয়ই কমে গেছে, নইলে সোমের সম্বন্ধে যে ভীষণ রকমের উচ্ছ্বাস শোনা গেছে বৈদিকদের মুখে, ‘পূতিকা’ নিয়ে তা হয়নি। সোমের মর্যাদা আরও বেশি এইজন্য যে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতেরা কখনও সুরাপান করতেন না। সুরা প্রধানত ক্ষত্রিয়ের পানীয় ছিল এবং অবশ্য ত্রৈবর্ণিকের।

বেদ-বিধির নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মণ একটি মাত্র যজ্ঞ-কর্ম উপলক্ষে সুরাপান করতে পারতেন এবং সেটা সৌত্রামণি যাগ। এই যাগ ছাড়া সুরাপান করলে সে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠত। সুরার মধ্যে যে মাদকতা ছিল, যে উত্তেজনা ছিল অথবা সুরাপানের উত্তর ফল হিসেবে যে ঘনঘোর ভাবটি আসত, বৈদিকরা তার নিন্দা করেছেন। শতপথ ব্রাহ্মণে সোমরস এবং সুরার সার্বিক মর্যাদার তফাতটা খুব ভাল করে বোঝানো আছে। বলা হয়েছে—সোম হলেন সত্য, সৌন্দর্য এবং পরমজ্যোতির অভিব্যক্তি আর সুরা হল অসত্য, পাপ আর অন্ধকারের আধার।

একথা কেন বলেছেন, আমি জানি। সুরাপানে মানুষ উন্মত্ত হয়ে জগৎ ভুলে যায়। সেইজন্য সুরা হল তমিস্রার প্রতীক। সুরাপান করলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়, লঘু-গুরু বোধ থাকে না, সবচেয়ে বড় কথা, শতপথ ব্রাহ্মণ বলেছে—সুরাপান করে মানুষ রেগে ওঠে আর মেজাজ হারিয়ে ফেলে—সুরাং পীত্বা রৌদ্রমনা। বৈদিকেরা যেভবে সুরার সমস্যা নিবেদন করেছেন, তাতে কি সুরার বিপরীতে এইটা আমাদের ভাবতে হবে যে, সোমপান করলে নেশাটা কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছত না যাতে কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়ে অন্ধকার নেমে আসে সোমপায়ীর চোখে!

ব্রাহ্মণ যেহেতু বেদবিদ্যা অধিগত করে সর্বপ্রকারের শিক্ষা অধিগত করে জগতের মঙ্গলের কাজেই নীতিগতভাবে ব্যাপৃত, ব্রাহ্মণের পক্ষে সুরা তাই অমঙ্গলের আধার। শতপথের ভাষায়—অশিব ইব বা এষ ভক্ষোযৎ সুরা ব্রাহ্মণস্য। তাই বলে, অতি বড়ো মানুষ, অতি-শিক্ষিত ব্যক্তি বা অতি সাত্বিকেরও বছরে একদিন মাতাল হয়ে পাতালপানে ধাওয়া করতে ইচ্ছে করে না? তার জন্য উপায় একটাই—সৌত্রামণি-যাগ।

সুরা আসলে রজোগুণসম্পন্ন ব্যক্তির পানীয়, যিনি সুরাপান করেও আপন শক্তিতে তা ধারণ করতে পারেন। যদি পানীয়ের মধ্যেও একটা মর্যাদা-বিভাগ করা যায় তবে সোম হলেন রাজা—সোমং রাজানং হবামহে—আর সুরা নেহাতই ক্ষত্রিয়—ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলেছে—যৎ সুরা ভবতি ক্ষত্ররূপম। মনুষ্য সমাজে সুরার মতোই সুন্দরী রমণীও যেহেতু আরও এক মধুর মত্ততা, তাই সুরাকে বৈদিকরা বলেছেন স্ত্রী আর সোমকে বলেছেন পুরুষ—পুমান বৈ সোমঃ স্ত্রী সুরা। সাধারণ মানুষ, এমনকী রাজপুরুষ ক্ষত্রিয়রাও যেহেতু সোমরসের নাগাল পেতেন না, তাই সোমরস তার আপন দুর্লভ মর্যাদা নিয়ে দেবতা এবং যজ্ঞযাজী ঋষি-মুনিদেরই পানীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। আর সাধারণ মানুষ—শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়—তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট পানীয় হয়ে গেল সুরা।

বেদ-ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে সোমরসের ‘ফার্মেন্টেশনের’ কথা সেইভাবে উচ্চারিত নাহলেও সুরার ফার্মেন্টেশন-প্রক্রিয়া ছিল সুবিদিত। বনজাত বিশেষ ওষধির ফল ধরা শেষ হয়ে গেলে, সেই ওষধির সঙ্গে জল মিশিয়ে সুরা তৈরি করার একটা রীতি ছিল—অপাং চ বা এষ ওষধীনাঞ্চ রসো যৎ সুরা। আবার এখনকার দিনে ভাত পচিয়ে যে সুরা তৈরি হয়, তারও উচ্চমার্গের রীতি-প্রক্রিয়া বৈদিক সমাজের লোকেরা জানতেন। ওঁরা ভাল ভাষায় বলেছেন—সুরা হল অন্নের রস—যৎ সুরা ভবতি… তদথো অন্নস্য রসঃ। খাদ্য অন্ন জল মিশিয়ে রেখে ফার্মেন্টেশন করেই যে সুরা তৈরি হত তার প্রমাণ মিলবে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও—যদন্নস্য শমলমাসীৎ সা সুরা।

সোম এবং সুরা ছাড়াও আরও একটি উত্তেজক পানীয় বৈদিক সমাজে প্রচলিত ছিল। এর নাম পরিস্রুৎ। সুরা তৈরির ক্ষেত্রে মজানো বা ফার্মেন্টেশনের যে পুরো সময়টা দেওয়া হত পরিস্রুৎ-মদ্যের ক্ষেত্রে এই পুরো ‘ফার্মেন্টেশন’ ব্যাপারটা হত না। সেইজন্য পরিস্রুৎ সোমের মর্যাদাও পায়নি, আবার সুরার মর্যাদাও পায়নি—নৈব সোম ন সুরা যৎ পরিস্রুৎ। কিন্তু পুরোপুরি না হলেও ‘ফার্মেন্টেশনের’ একটা প্রক্রিয়া যেহেতু পরিস্রুৎ-মদ্যের প্রস্তুতি-পদ্ধতিতে অবশ্যই ব্যবহৃত হয়, অতএব সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণের পক্ষে পরিস্রুৎ অপেয়—অনাদ্য উ বৈ ব্রাহ্মণেন পরিস্রুৎ।

সোমরস, পরিস্রুৎ এবং সুরা—এই তিনটি শ্রেষ্ঠ পানীয়ের পরম্পরা আমরা যেভাবে দেখালাম, তাতে বুঝি ব্রাহ্মণরা নিজেদের জন্য সোমরসের সৃষ্টিসুখ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজে বৈকল্পিক পানীয় এসে গেছে। এই তিনটি পানীয়ের নির্মাণ-কৌশল থেকে এটাও বোঝা যায় যে, ব্রাহ্মণদের যত আপত্তি ‘ফার্মেন্টেশনে’। যে জিনিস জল মিশিয়ে পচতে দেওয়া হল, দিনের পর দিন পর্যুসিত হয়ে যে পানীয় মাদকতা-প্রাপ্ত হল, তা যতই পরিস্রুত হোক, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা তা পান করবেন না। এই সামান্য আলোচনা থেকে তাহলে কি এটাই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ‘ফার্মেন্টেশন’ ছাড়াই সোমরসের এমনই এক মধুর মাদকতা ছিল, যা একাধারে শক্তি, সৌন্দর্য এবং উজ্জ্বলতার সমগোত্রীয়! সোম মানুষকে বিভ্রান্ত করত না, সম্ভ্রান্ত করত। সোম মানুষের শিরা-উপশিরা অচল করত না, সচল করত। সোম মানুষের চোখে অন্ধকার বয়ে আনত না, তার দৃষ্টি উজ্জ্বল করত। সোম মানুষকে অবসন্ন করত না, প্রসন্ন করত।

দেবতার পরম পানীয় এই সোমরসই কি তাহলে ‘অমৃত’?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *