সোনালি ডানার ঈগল – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

সোনালি ডানার ঈগল

প্রথম ঈগল

গোপালপুরের লাইট হাউস ছাড়িয়ে, ওবেরয় পামবিচ হোটেল পিছনে ফেলে, সমুদ্রতীর ধরে অনেক, অনেকখানি এগিয়ে গেলে, ‘ফ্যালকনস্ নেস্ট’ নামে সেই দোতলা বাড়িটি এখনও টিকে থাকার কথা নয়। ১২ বছর আগে আমি যখন যাই তখনই জেরবার অবস্থা। বাড়ির মালিক ক্যাপ্টেন রিচার্ড জেমস স্মিথের বয়স তখনই ৮৮। লাংসে দুরারোগ্য ফাইব্রোসিস। তখনই তাঁর মেরেকেটে আর দু-সপ্তাহ বাঁচার কথা ছিল।

তবু, কোনো না কোনোভাবে আজও তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আমি একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি না। যদি বাড়ি না থাকে তার ভগ্নস্তূপ থাকবে। যদি ক্যাপ্টেন স্মিথ না থাকেন, আমার বিশ্বাস, সেই ভগ্নস্তূপের ওপর কখনো কখনো একটি ঈগল পাখিকে বসে থাকতে হবে। বিশেষত, রাতের অন্ধকারে। যখন তার কোটরাগত চক্ষুবিন্দু থেকে বেরিয়ে আসবে, মেশিনগানের গুলির মতো, ঈগলের মর্মভেদী দৃষ্টির অনর্গল নিক্ষেপ। ১২ বছর আগে যখন প্রথম এবং শেষবার গোপালপুর যাই, তখন ওঁর বয়স বলেছিলেন ৮৮। বর্ন এইট্টিন নায়েন্টি ফাইভ। এখন ঠিক ১০০ হবে। অনেকেই তো থাকে ১০০ বছর। থাকে না?

বয়:সন্ধিকাল বলে কিছু একটা কথা আছে। সাধারণত যৌনতার উন্মেষ-সময় থেকেই এই বিভাজন করা হয়। আমার মনে হয়, জীবনে যখন যে-সময় থেকে ভ্রমণের ইচ্ছা জাগে, যখন থেকে মনে হতে থাকে এখানে কিছু নেই, আমার জন্যে যা আছে তা আছে দূরে কোথাও—এবং সেখানে যাবার ইচ্ছা মন জুড়ে জেগে ওঠে—বয়স-সন্ধিকালের সূচনা হিসাবে এর দাবিও কিছু কম না। যে-সব বালিকা, যুবতী ও নারীকে কামনা করা গিয়েছিল কিন্তু পাওয়া যায়নি, তার সঙ্গে যেসব জায়গায় যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি—এই দুই-এর মধ্যে প্রায় হুবহু মিল আছে।

অন্তত, কামনার দিক থেকে। আমার তো ধারণা—ভ্রমণে মানুষের অপরিতৃপ্ত বহুগামিতাই চরিতার্থ হয়। যাই হোক, এহ বাহ্য। এবং, গোপালপুর ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে আমার পৌঁছে যাবার কথা ছিল অনেক আগেই। আমার সবচেয়ে দেরি হয়েছিল গোপালপুর যেতে। ইতিমধ্যে পূর্বে পুরীর পর পুরী, পশ্চিমে কোভালম, দক্ষিণে, বিশেষত পরিত্যক্ত শোর টেম্পলের সামনে প্রস্তুরীভূত ষণ্ডশ্রেণির দিকে এগিয়ে আসা ঘননীল ঢেউ-এর পরে ঢেউ—পূর্ণিমায় মন্দিরের চাতাল অবধি উঠে আসে—ওখানেও, এমনকি, দু-দু’বার যাওয়া হয়েছে। শুধু গোপালপুরই হয়ে ওঠেনি।

যতদূর মনে পড়ে, গোপালপুর যাবার ইচ্ছা প্রথমে মনে জাগে অসীম রায় নামে তখন এক অপরিচিত গ্রন্থকারের ‘দ্বিতীয় জন্ম’ নামে একটি ছোট উপন্যাস ফুটপাথ থেকে কিনে পড়ার পর থেকে। সেখানে নায়ক একা গোপালপুর যায় এবং সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে সাক্ষাৎ পায় এক ব্রোঞ্জ দেবমূর্তির। যদি সেখান থেকে ধরি, তাহলেও, গোপালপুর যেতে অন্তত ৩০ বছর দেরি হয়েছে বলতে হবে। কারণ ৫৭-৫৮ সালের আগে বইটি প্রকাশিত হয়নি।

কাজেই, যেতে-পারি এবং যেতে-হবে এমন জায়গাগুলির মধ্যে মনে-মনে গোপালপুর লালন পেয়েছে সবচেয়ে বেশি সময় জুড়ে। গোপালপুর সম্পর্কে যেখানে যা শুনেছি মনে রেখেছি। সংগ্রহ করেছি ট্যুরিস্ট ম্যাপ, হোটেল ও তার বিবরণ, অজস্র ছবি— প্রিন্টেড এবং ফোটোগ্রাফ, এ-সব তো বটেই—মায় আমার ভাইঝি কমবেশি নামকরা গাইনি ডাঃ হিমানী গাঙ্গুলী সেবার যখন ভুবনেশ্বরের সেমিনার থেকে গোপালপুর যাবে বলল, আমি তাকে বলি, ‘এক মুঠো বালি আনিস তো!’ ফিরে এল আমার জন্যে স্টাফড এক সমুদ্র-ঈগল নিয়ে। মিনিয়েচার। বলল, ‘উড়িষ্যার হেলথ সেক্রেটারি উমাকান্ত মিশ্রর সঙ্গে আলাপ হল আমার। যাও না, ঘুরে এসো না এবারেই। উনি সব বুকটুক করে দেবেন।’

আমার ধারণা ছিল সমুদ্রতীর আছে পৃথিবীর এমন যে-কোনো জায়গা আকর্ষণীয় হতে বাধ্য। কারণ, যেখানেই থাক, পৃথিবীর তিনভাগ জল সে ছুঁয়ে আছে। আর নামটাও কী সুন্দর। গোপালপুর-অন-সি! কতই তো শহর আছে পৃথিবীতে—যারা সমুদ্রের ধারে—পশ্চিমে আলজিরিয়ার ওরান থেকে সূদূর পূর্ব আমেরিকার নানটুকেট পর্যন্ত—কেউ তো সমুদ্র পদবিধারী নয়! তারও ‘ধারে’ নয়, তাহলে তো গোপালপুর-বায়-সি হত। কী? না, সমুদ্রের ওপর গোপালপুর! কিন্তু, দুঃখের বিষয়, আমার এতকাল ধরে লালিত গোপালপুর-ধারণা প্রথম দর্শনেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি গিয়েই পড়লাম এমন বিপদে—যা ছিল কল্পনাতীত।

ফ্যালকনস্ নেস্ট

উমাকান্ত মিশ্রর সঙ্গে টেলিফোন-কথা অনুযায়ী সার্কিট হাউসে লাঞ্চ খাবার কথা (অঁচ্ছা অঁচ্ছা, মগুর মৎস্যের কারি— সে আমি কহি দিব)— কিন্তু সকালের ট্রেন পৌঁছল দুপুরে। বেহরামপুর থেকে অটো নিয়ে গোপালপুর পৌঁছতে লাগল আরও এক ঘণ্টা। গিয়ে দেখা গেল—ভুবনেশ্বর থেকে স্বয়ং স্পিকার এসে গেছেন—সঙ্গে তাঁর অ্যাসেম্বলিও—গোটা সার্কিট হাউসটির নিশ্ছিদ্রভাবে দখল নিয়েছেন তিনি এবং তাঁর দলবল। অবশ্য, স্বাস্থ্যসচিব প্রেরিত একটি সৌজন্য-বার্তা আমার জন্যে পড়ে আছে : উনি দুঃখিত। তবে কেয়ারটেকার আমাকে অন্যত্র বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবে।

আমার লাঞ্চতৈরি আছে কেয়ারটেকার কালীচরণ পানিগ্রাহী আমাকে বললেন। প্রত্যাখ্যান করে আমি সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে এলাম।

রাস্তা একটাই। সার্কিট হাউস থেকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। পা রেখেই বোঝা যায়, এই রাস্তা সমুদ্রতীরে নিয়ে যাবে। দু-পাশে ঝাঁট-দেওয়া বালি। ঢেউ পড়ার ঝপাঝপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। বোঝা যায়, কাছেই, হয়ত ওই বাড়িগুলোর পরেই।

সমুদ্রতীরে জগদীশ-কাফেতে বসে কেকের অর্ডার দিতে যাচ্ছি—দেখলাম, তেলেভাজা চড়েছে। আপাতত এক কাপ কফির কথা বলে আমি সেজন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক করলাম আমি এখনই ফিরে যাব। ট্রেন না পাই, বাসে ভুবনেশ্বর চলে যাব রাতারাতি। ওখানে থেকে কলকাতা। কিন্তু, তার আগে, ভুবনেশ্বর গিয়ে কিছু ভাল-মন্দ শুনিয়ে যাব উমাকান্তকে। টেলিফোনে কলকাতা থেকে ডেকে এনে, সার্কিট হাউস-ভরতি এম-এল এ—সঙ্গে স্পিকার? চালাকি!

কিন্তু এও ঠিক যে, আমি অভুক্ত এবং অস্নাত, বুকিং-করা থাকার জায়গা অপ্রত্যাশিতভাবে হাতছাড়া—এ সবের সঙ্গে প্রথম দর্শনেই গোপালপুর অত খারাপ লাগার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের দেশ-গাঁয়ে চৌধুরিদের জোড়াদীঘিতে স্নান করে—পোস্ত-ভাত আর অড়র-ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে এক ঘুম দিয়ে এলেও আমি একই কথা বলতাম।

আমি এই প্রথম একটা সমুদ্র দেখলাম, যা তটভূমি থেকে অনেকখানি নিচে। লোকজন যা, ওপরে পিচঢালা রাস্তায়, বিচ অত্যন্ত অপ্রশস্ত, তাই জল-সীমানায় প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। এটা কি একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়? ডাঙার মানুষের একটা জল-টান থাকবেই। আপনি যে-দিক দিয়েই যান, সব ডাঙাই তো শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে কোনো-না-কোনো সমুদ্রের কাছে। যে-কোনো মরুভূমি পেরলেও, শেষ পর্যন্ত সেই তো সমুদ্র! আর সেখানে পৌঁছে মানুষ জলের কাছে ছুটে যাবেই। বারবার এগিয়ে যাবে জল ছুঁতে, আর ছুটে পালিয়ে আসবে। আমি যত সমুদ্রতীরের ছবি দেখেছি, দেখেছি হাজার হাজার অভিভূত মানুষ তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। কন্যাকুমারিকার তীরে কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় একই সঙ্গে চন্দ্রোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে লক্ষ মানুষ তীরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুপোর ঘণ্টার মতো চাঁদ ওঠে। আর এখানে? উঁচু প্লাটফর্মে পায়চারি করছে মেরে-কেটে মাত্র অর্ধশত নরনারী— বলি, এটা কি পার্ক, এই কি পায়চারি করার জায়গা! ছি:!

দূরে-কাছে ভাঙা জেটি দু-একটা, বোল্ডার ইত্যাদি—একটিও সমুদ্র-চিল কি থাকতে নেই? আর সবচেয়ে যা অস্বস্তিকর, সেদিন একটুও হাওয়া ছিল না। এখান থেকেই নাকি এককালে জাভা, সুমাত্রা আর বালিতে পালতোলা জাহাজ যেত। যেত হয়ত। একদিন হয়ত গোপালপুর ছিল একটা বিখ্যাত বন্দর। আসত বিদেশ থেকে জাহাজও। কিন্তু আজ? আজ, বন্দরের রূপহীন বর্ণহীন স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে বলিরেখাময় কুৎসিত এক বৃদ্ধাগণিকা।

জগদীশবাবু নিজের হাতে এক প্লেট তেলেভাজা দিয়ে গেলেন। অবাক কাণ্ড! আমি খেতে শুরু করে প্রথমটির ভেতর পেলাম একটি লঙ্কা। ভাবলাম, এই রে! আমার আবার লঙ্কা একদম চলে না। কিন্তু পরেরটি মুখে দিয়েই দেখি, পনির! আরও এগিয়ে কোনওটায় ফুলকপির টুকরো, কোনওটায় ক্যাপসিকাম ইত্যাদি পেতে থাকি ভারি মজার খাবার তো। আমি আর-এক প্লেট অর্ডার দিই।

জগদীশবাবুই আমাকে লাইট হাউস ছাড়িয়ে, ওবেরয় পামবিচ হোটেল পেরিয়ে, ক্যাপ্টেন স্মিথের ফ্যালকনস্ নেস্ট-এর খবর দেন। এখন কোনো ট্রেন নেই, উনি আমাকে বললেন। বাস আছে, তবে চিল্কা হয়ে ভুবনেশ্বর রাত ১২টার আগে তা পৌঁছাবে না। ক্যাপ্টেন স্মিথের জায়গাটা অনেক দূর। ওখানে খুব কম লোক যায়। রিকশ থেকে নেমে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হয় প্রায় আধ ঘণ্টার মতো। আমি যেন, এক রাতের জন্যে ওখানেই চেষ্টা করি। পুজোর সময়—উনি যতদূর জানেন এখানকার ছোটখাট মুষ্টিমেয় হোটেলগুলির একটিতেও জায়গা নেই। যদিও দু-একটি থেকে থাকে, তিরুপতি এক্সপ্রেস এসে সেগুলিও নিশ্চিত ভরিয়ে দিয়েছে—জগদীশবাবু আমাকে বললেন।

‘হু ইজ দেয়ার?’

দ্য ফ্যালকনস নেস্ট-এ পৌঁছাতে অন্ধকার হয়ে গেল। ইটের রাস্তা ওবেরয় হোটেল পেরলেই শেষ। রিকশ আর গেল না। যতদূর দেখা যাচ্ছিল ওখান থেকে—এরপর আর কোনো বাড়ি-টাড়ি নেই বা বসতি। শুধু ঝাউবন, বালি, আর সমুদ্র। তবে, স্বস্তির ব্যাপার এই যে, এখান থেকে সমুদ্র আর জমি অনুভূমিক। মিউনিসিপ্যাল এলাকা শেষ এখানেই—শেষ রাস্তার টিমটিমে আলোর। আমরা টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চললাম। আমি আর রিকশওয়ালা। পৌঁছে দেবার ভাড়া সে দ্বিগুণ চেয়ে রেখেছে। একটা লম্বা ঝাউবন পেরিয়ে ফ্যালকনস নেস্ট এক মাঝারি দোতলা বাড়ি। দোতলায় গভীর বারান্দা। বারান্দার দুদিকে, বাইরে থেকে দেখে যা বুঝলাম, দুটো বেশ বড়ো বড়ো ঘর। এখানে জাজ ধরনের কিছু বাজছিল এবং সঙ্গে নাচও হচ্ছে— বোঝা যায় দোতলার মেঝে কাঠের। গেটের মাথায় একটি ৪০ পাওয়ারের বাল্ব।

পরিচারিকা দুজন। দুজনেই বর্ষীয়সী। দুজনেই পৃথুলা। কৃষ্ণাঙ্গী এবং দক্ষিণ ভারতীয়। হিন্দিতে একজন আমাকে জানাল, ভাড়া শুধু দোতলাটা দেওয়া হয়। এবং মাদ্রাজ থেকে আসা রেল-অফিসের এক অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পার্টি ৭ দিন হল তার দখল নিয়েছে। সবচেয়ে যা হতাশার, বাড়ির মালিক শুয়ে পড়েছেন আজকের মতো। তাঁর শরীরও খারাপ।

আজ আর দেখা হবে না।

বাঁদিকের ঘর থেকে বৃদ্ধের ভাঙা, কাঁপা-কাঁপা গলা, সঙ্গে কাশি, ‘ভীনা, ভীনা, হু ইজ দেয়ার?’

‘ট্যুরিস্ট হ্যায় সাব। রাতকো সাহারা মাংতা।’

‘ভেজ দেও। অন্দর ভেজ দেও।’

রিকশওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে গিয়ে দেখলাম সাহেব উঠে বসবার চেষ্টা করছেন। পরে বুঝতে পেরেছি, তখুনি টের পেয়েছিলাম, কিন্তু মনস্থ করতে পারিনি যে, উঠে বসার তুলনায় সেটা ছিল একটা উড়াল দেওয়ার চেষ্টা। রোগা, অস্থি ও চর্মসার চেহারা ক্যাপ্টেন স্মিথের। বালিশের নিচে থেকে বের করে কটাকট দাঁত পরে নিলেন দু-পাটি। তাতে গালের গর্ত অনেকটা অন্তর্হিত হল ঠিকই। কিন্তু, আরও হিংস্র দেখাতে লাগল তাঁকে। আরও বলতে, চোখদুটির তুলনায়। গভীর কোটরের মধ্যে নির্মম, ক্ষমাহীন চোখদুটির তুলনায়। খয়েরি রংয়ের মনুষ্য-চক্ষু আমি আগে দেখিনি। অহো, ছানি-পড়া আঁশফলের মতো মণিদুটির চাহনি কী তীক্ষ্ণ। আর, ওহো, অসহ্য। বৃত্তাকার শক্ত হাড় ঠেলে সামনের দিকে অনেকখানি বেরিয়ে। দৃষ্টি একদম সরাসরি। সত্যি বলছি, ঐ কোটর দুটি থেকে তাঁর দৃষ্টি বেরিয়ে আসছিল মেশিনগানের গুলির মতো।

‘সো ইট ইজ ইউ?’

চেনেন নাকি ভদ্রলোক আমাকে? কিন্তু আমি তো…ক্যাপ্টেন স্মিথ বললেন, ‘ওয়েল, ইউ ক্যান স্টে।’

‘ভীনা, জেনেসকো কামরা খোল দেও।’

‘সার?’ ভীনা স্তম্ভিত।

তাকে উত্তর না দিয়ে সাহেব একবার ইশারায় ঘরটি খুলে দিতে বললেন। আমাকে বললেন, ‘দ্যাটস মাই ডটারস রুম। বাট শি লিভস অ্যাব্রড। ইউ ক্যান স্টে দেয়ার ফর ওয়ান নাইট। কাল উয়োলোগ’, দোতলার নাচ ও বাজনার দিকে আঙুল তুলে, ‘চল যায়ে গা। দেন অন, ইউ ক্যান স্টে হিয়ার আজ লঙ অ্যাজ ইউ উইশ টু স্টে।’

দোতলায় ৮/৯ জনের পার্টি। তাদের থেকে একজনের খাবার স্বচ্ছন্দে বেঁচে যাবে। জানা গেল, আমি রাতের খাবার পাব। আজ, মাগুর মাছের ঝোলই হয়েছে এখানে। আশ্চর্য যোগাযোগ। আমি অনুপস্থিত জেনিসের ঘরে ঢোকার সময় সে রাতের মতো লোডশেডিং হয়ে গেল।

ইগলের স্বপ্ন

সমুদ্রে এখন হাওয়া নেই। থাকলে ঘরে ঢোকেনি। অত্যন্ত আরামদায়ক বিছানার জন্যে, ভারি নরম বালিশ আর তার থেকে নতুন কোরা কাপড়ের গন্ধের জন্য, শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত পথিকের একটা আশ্রয় মিলে গেলে যা হয়—আমার বেশ গভীর ঘুম হল। যদিও পাখা চলছে না। আমি তখনই টের পেয়েছিলাম, এ-ঘরের বিছানা-বালিশ সবই পাখির পালকের। একটা পাখি পাখি গন্ধ ছিলই সারা ঘরে।

বোধ হয়তো সেই কারণেই সে রাতে আমি এক প্রকাণ্ড ঈগল পাখির স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, সমুদ্রের ধারে এক গিরি-কন্দর সে চুপ করে বসে আছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে এত বরফ, নিশ্চয় বিদেশ! তার ডানার পালক তিরতির করে কাঁপছে। স্বপ্নের আসল মজা হল, কাল ও স্থান-বিপর্যয়ের জন্য। যেজন্য ভবিষ্যত অনায়াসে বসে থাকে আর অতীতও কত অবলীলভাবে ঢুকে যায় ভবিষ্যতে। আমরা যাকে বর্তমান বলি, তার অস্তিত্ব স্বপ্নে নেই বললেই চলে।

যে জন্যে, যা যা ঘটবে তা আগেই বুঝেছিলাম এবং ঠিক সেইরকমই ঘটতে লাগল। পাখিটা হওয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ সে ডানাদুটি মুড়ে, প্লেন থেকে পড়া বোমার মতো নিচে পড়ে যেতে লাগল। এভাবে তো—হ্যাঁ, কে যেন বলেই গেল, আমাকে, ঈগল এভাবেই ঝাঁপায় শিকারের দিকে। এবং এই ব্রোঞ্জরঙা বিশাল পাখিটি একটি ঈগল! এখন তার আগে ছুটে চলেছে কঁক-কঁক শব্দে এক ভয়ার্ত, চিত্রবিচিত্র চিনে হাঁস— ঈগল তার বিশাল ডানা দিয়ে পাখিটাকে জাপটে ধরল। …আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে সমুদ্রের গর্জন। ঢেউ এর পর ঢেউ-এ আছড়ে পড়ে ডাঙাকে জানাচ্ছে পৃথিবীর তিনভাগ জলের অস্তিত্ব-শব্দ।

আচ্ছা, এবারে বলুন, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ব কিনা, যদি ঘুম থেকে উঠে আমার প্রথমেই চোখে পড়ে জেনিসের ওয়ার্ডরোবের ওপর একটি প্রকাণ্ড সোনালি ঈগল— অবিকল সেই ব্রোঞ্জবর্ণ, এবং, এমনকি তাঁর ঠোঁটের কাছে এবং পায়ের পাতার লোমগুলিও সাদা রঙের—যেমনটা স্বপ্নে ছিল। নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি এখনও ভেবে স্বস্তি পেতে যাব—দেখলাম, ভীনা নাদার আমার বিছানার মশারি তুলছে। ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে সাহেবের ঘরে। আমি যেন গোসল করে ওখানে যাই। সে বলল।

আমার বিস্ফারিত চোখ ঈগলের দিকে চেয়ে আছে দেখে ভীনা বলল, ‘মরা হুয়া হ্যায়।’

অর্থাৎ স্টাফড। এবং সত্যিই তাই। দেখে চিনলাম আমি পাখিটাকে। ওরনিথোলজিস্ট না হয়েও, পাখির বই আমি খুব পড়ি, এই পক্ষী প্রজাতিটিকে আমি বিলক্ষণ চিনি। কেন্ট গার্ডনারের একটি বই-ই আছে এই গোল্ডেন ঈগল নিয়ে। আমেরিকায় এক সময় কমতে কমতে ৩৩টিতে দাঁড়ায়। তখন ন্যাশনাল বার্ড হিসাবে ঘোষণা করা হয়। যদিও এদের দেশের বাড়ি হল নরওয়ের ডেনমার্ক অঞ্চলে। বিশাল পাখি—এদের পা-দুটিই হয় ১০ইঞ্চি উঁচু। থাই-এর কাছে পায়ের ব্যাস ৩ ইঞ্চি। এই সমর্থ বলশালী পা থেকে ৩ ইঞ্চি (সোজা করলে ৬) নখ বের করে এরা দুশো-তিনশো ফুট থেকে বোমার মতো নেমে আসে ঘণ্টায় আড়াই শো মাইল বেগে—মাটি থেকে ছাগলছানা, কুকুর এ-সব তো বটেই এমনকি বাছুরও তুলে নিয়ে যায়। পা থেকে পিঠ পর্যন্ত অন্তত ২ ফুট উঁচু, লম্বায় দেড়হাত, এরা যখন বুক ফুলিয়ে ডানা ছড়ায়, শুধু তখনই বোঝা যায় এদের ক্ষমতা।

ওয়ার্ডরোবের ওপর এই সেই নরওয়ের গোল্ডেন ঈগল। মৃত। মৃত? তাহলে ওর পায়ে ঐ চামড়ার বেল্ট বাঁধা কেন? হয়ত বাস্তবতা আনার জন্যেই— ঐ রকম ভেবে আমি মৃত ঈগলের আরও কাছে গেলাম। দেখলাম ওর কোটরাগত চোখদুটি। সেই দৃষ্টি—যা শুধু সামনের দিকে এগিয়ে আসে—মেশিনগানের গুলির ছররার মতো অনর্গল—যা জীবন্ত ঈগলের। একটু পরেই আবার মরে গেল তার চোখদুটি। নিশ্চয়ই মনের ভুল। আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম। গরমকালে আমি বাথরুমে থেকে বেরই একদম বাইরে বেরবার জন্যে তৈরি হয়ে। শেভিং তো বটেই, স্নানও সারা হয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন স্মিথের দাবি-দাওয়া

ক্যাপ্টেন স্মিথের ঘরে ঢোকার আগে বারান্দায় দাঁড়াই। দেখলাম, বাইরে ঝকঝকে রোদ। সমুদ্রের ঢেউ এখানে বলতে গেলে একটা। রংও একটাই—নীল। তারই বিভিন্ন পর্যায়, কোথাও-বা সবুজাভ। বাতাস এত হালকা যে নাভিমূল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। দিনের বেলায় যদিও বাড়িটা দেখে মনে হল, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে এর আর খুব দেরি নেই। দূরে সমুদ্রে তিনটি নৌকো। দুটির পাল সাদা। মাঝেরটি সবুজ। ধীরে পর পর দুটি সবুজ একটি সাদা হাইফেন স্থান বদল করে। আমি ঠিক করলাম, এখানে কয়েকদিন থেকেই যাব।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখি সায়েব তিন-চারটি বালিশ পিঠের কাছে ঠেসে, আধশোয়া অবস্থায়। আর একজন লোক ওঁর সামনে বসে এক নীল রঙের প্ল্যান বিছিয়ে ওঁকে কী সব বোঝাচ্ছে।

‘না-না। ওখানে নয়।’ ক্যাপ্টেন স্মিথ লোকটিকে বলছেন, ‘আমি কি রোদে পুড়ব, আর বর্ষায় ভিজব এই বুড়ো বয়সে?’

আমি ভেবেছিলাম স্মিথসাহেব বুঝি কোনোও জমি-জমা কিনছেন। ওদের কথা শুনে বুঝি, জমি ঠিকই। কিন্তু কবরের জমি। তাঁর তো কেউ নেই। দুটি বাচ্চা নিয়ে একমাত্র সন্তান জেনিস থাকে উত্তর নরওয়ের সমুদ্র উপকূলে। জায়গাটার নাম বোডো, উনি আমাকে কালই বলেছিলেন, তার সম্পর্কে শেষ সংবাদ ওখান থেকে আসে। কেউ নেই, তাই নিজের কবরের জায়গা নিজেই ঠিক করছেন ক্যাপ্টেন রিচার্ড জেমস স্মিথ (৮৮)।

‘না-না, ওপরে, আমি আরও ওপরে চাই। আর একটা বড়ো গাছ থাকবে আমার মাথায় ওপর।’

‘কিন্তু স্যার, ওখানে যা জমির দাম আর আপনি যা বাজেট বলছেন—’

‘না-না। আমার ঐ টাকা। ওতেই দিতে হবে। নইলে আপনি আসুন। আই শ্যাল বি এনটুম্বড ইন বেহরামপুর।’

এককালে প্রচুর অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান থাকত এই গোপালপুর আর বেহরামপুরে। এখানে অনেক চার্চ, কবরখানারও অভাব নেই। এখন অভাব খ্রিস্টান মৃতদেহের।

‘মিঃ স্মিথ, এ কী বলছেন আপনি? বেহরামপুরের ঐ পচা সিমেটারি আর নরসিংপুরে টিলার ওপর আর সমুদ্রের ধারে আমাদের লেডি অফ দ্য ফ্লাওয়ার সিমেটারি—আপনি তুলনা করছেন কীভাবে?

ক্যাপ্টেন স্মিথ এবার নরম হলেন। ‘ওককে-ওককে। ফিক্স অ্যাট টেন থাউজেণ্ড দেন। তবে আমার মাথার ওপর একটা ছাদ যেন থাকে। আমি রোদে পুড়তে পারব না। আর টিলার একেবারে ওপরের দিকে দিতে হবে।’

আমি এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম। জানতে চাইলাম, ‘ওপর দিকে কেন মিঃ স্মিথ?’

‘দা ভিউ। দা ভিউ উইল বি বেটার।’

১২০০০-তে ঠিক হল। একটি সিন্দুক খুলে ২ হাজার টাকা অগ্রিম দিলেন স্মিথ সাহেব। ফর্মের বিভিন্ন জায়গায় সই করলেন। প্ল্যানে, একটি পিপুল গাছের নিচে, একটি জায়গা চিহ্নিত হল।

দোতলার অতিথিরা ভোরের প্রথম বাসে বেহরামপুর চলে গেছে। বাড়িতে অতিথি বলতে শুধু আমি। আমি দোতলার সবটা ভাড়া নিতে চাইলাম।

স্মিথ বললেন, ‘না-না, তুমি জেনিসের ঘরেই থেকে যাও।’

‘লোকটা পাগল’

গোপালপুরে সমুদ্র ছাড়া কিছু নেই। দেখতে হয় সমুদ্র দেখ—নইলে ঘরে বসে থাক। একটু পরে জগদীশবাবুকে ধন্যবাদ দিতে ওঁর কাছেতে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্মিথ আমাকে মেয়ের ঘরে থাকতে দিয়েছেন শুনে অবাক হলেন।

‘মেয়ে? কে ওর মেয়ে?’ জগদীশবাবু বললেন।

‘আজ সকালেই যে বললেন আমাকে! নরওয়ের বোডো শহরে ঠাকুর্দার সঙ্গে থাকে?’

‘ধুর! ঐ বুড়োটা পাগল!’

‘ওঁর স্ত্রী ওঁকে ত্যাগ করে এক নাবিকের সঙ্গে আমেরিকা—’

‘বললাম তো আপনাকে।’ জগদীশবাবু বললেন, ‘আপনি কি থাকছেন ক-দিন? তাহলে হলিডে-হোমে চলে আসুন। দোতলায় ছাদের ধারে ওদের রেস্ট রুমটা আজ দুপুরে খালি হবে এবং অ্যাডভান্স বুকিং নেই। এদের খাওয়া-দাওয়াও ভালো।’

আমি বেশ খানিকটা হাঁটাহাঁটি করে দেখলাম। সেই গোপাল মন্দির পর্যন্ত। এই হোটেল পাড়ার দিকটা সত্যিই বাজে। ঠিক করলাম, যে ক-দিন থাকব, এদিকে আর আসব না।

সমুদ্রের জলরাশি ছুঁয়ে আমি ফ্যালকনস্ নেস্টের দিকে ফিরে গেলাম। ফিরে দেখি, স্মিথ ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভীনা নাদার দুপুরে খেতে ডাকলে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। এই খাবার-দাবারের ব্যাপারটা ভীনার ব্যবসা। দামও সেই ১৯৮৩-র পক্ষে যথেষ্ট বেশি। ৩০ টাকা প্লেট। তবে ভাত ঝরঝরে চামরমণির। এবং চিংড়ির গন্ধও পেলাম।

খেতে খেতে ভীনার সঙ্গে দু-একটা কথা হল। হ্যাঁ জেনিসই ওঁর মেয়ের নাম। নাম জেনিস ইলিন সুশান হুড। সাহেব তাই বলেন। থাকে বিলেতে। ঠাকুরদার কাছে। সাহেব তাই বলেন। কিন্তু সে কখনও আসেনি। কেউ তাকে দেখেনি। সে তো কখনও একটা চিঠিও দেয় না। দুঃখ করে ভীনা নাদার জানায়, থাইরয়েডের প্রবল অসুখ নিয়ে সাহেব গোপালপুরে আসেন। সে অনেক, অনেক কাল আগের কথা। একটা ঘণ্টাও ঘুম হত না তখন সাহেবের। কিন্তু এখানে এসে একদম সুস্থ হয়ে যান। তারপর মিসেস জার্ডিন এক রকম জোর করে জলের দামে এই বাড়িটা ওঁকে বিক্রি করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে বৌ-এর কাছে চলে যান।

আমি হঠাৎ জানতে চাইলাম, ‘আর ঐ ঈগলটা?’ আমি জেনিসের ঘরের দিকে তাকাই।

‘ওটাই তো একমাত্র জিনিস যা হাতের ওপর বসিয়ে সাহেব এখানে আসেন। তখন নাকি জ্যান্ত ছিল। তাই পায়ে বাঁধা ছিল স্ট্র্যাপ। মৃত্যুর পরেও সে-ভাবেই থেকে গেছে।’

‘কিন্তু এখনও বাঁধা কেন? আর তো পালাতে পারবে না?’

‘সাহেবের ধারণা’ ভীনা ফিসফিস করে বলল, ‘ও এখনও বেঁচে।’

এই সময় ‘ভীনা’ ‘ভীনা’ বলে ক্ষীণস্বরে ক্যাপ্টেন স্মিথ ডাকতে লাগলেন। যাই, ভীনা বলল, ‘আপনার যা লাগবে নিয়ে নেবেন। সব টেবিলের ওপর আছে, এখন বুড়োকে স্নান করাতে হবে।’

পাপের বেতন মৃত্যু

কোথা থেকে কী, সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেল। আমি তখন সমুদ্রের কিনারা ধরে অনেক দূরে। একদম ভিজে চুপসে গেলাম।

ফ্যালকনস নেস্টে ফিরে দেখি, পাশে চেয়ারে বসে একটি স্কার্ট পরা দেশি খ্রিস্টান মেয়ে। পরে জেনেছি, তার নাম নোরো এস নাইয়ার। তাকে কিশোরীই বলা চলে। এক পলক দেখে তাকে এক অনাঘ্রাতা কুসুমের মতো লাগে। আরও শুনলাম, সে গোপালপুরের গডস চার্চের পাদরির ছোট মেয়ে।

এখন ক্যাপ্টেন স্মিথের ঘরটির একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার যা যথাস্থানে দিতে ভুলে গেছি। স্মিথের ঘরটি, যদি এক কথায় বলতে হয়, ধুলি-ধূসর। উনি হাসপাতালের সিঙ্গল বেডে শুয়ে থাকেন। পাশেই একটা মাত্র বই-এর র‍্যাকে একটি বই, ডেয়লি বাইবেল রিডিং। মস্ত মোট বইটা আমাদের রামায়ণ-মহাভারত সাইজের—এ ঘরে ঐ একটাই জিনিস যা চকচকে। নিত্য ব্যবহার হয় বোঝা যায়। এতে বছরের ৩৬৫ দিনের জন্যে— ৩৬৫টি বাইবেল-কাহিনি বা তার প্রসঙ্গ আছে। বই-র‍্যাকের ওপর একটা টেলিফোন। গত দুদিনে যদিও একবারও বাজেনি। মৃত না জীবিত, কে জানে। টেলিফোনের ওপর অনেক দিনের ধুলো।

‘বাইবেল, বাইবেল!’ ক্যাপ্টেন স্মিথ আমাকে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড ইন বাইবেল ওনলি।’

কবরের জন্যে অগ্রিম নিয়ে স্যামিসন যখন চলে গেল, তারপর আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা ক্যাপ্টেন স্মিথ, আপনার এই কাঠের গরাদগুলো পালটে লোহার শিক বসিয়ে নেন না কেন?’

‘হোয়াই?’

‘না-না, মানে চোর ডাকাত—’

‘টাকা ব্যাঙ্কে থাকে। লাগবে বলে, ওটা আনিয়ে রেখেছিলাম। তাছাড়া’ ক্যাপ্টেন স্মিথ হাঃ হাঃ করে ভৌতিকভাবে হাসতে লাগলেন, ‘এখানে চোর কোথায়? ঐ অতবড় চোর থাকতে?’ বলে সমুদ্রের দিকে হাত তুললেন, ‘লোহার গরাদ হলে তো সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় মরচে পড়তে পড়তে— এতদিনে— হাঃ হাঃ হাঃ। কাঠ বলেই আছে।’ আবার সমুদ্র দেখিয়ে, ‘কিসসু করতে পারেনি।’

এবার নোরার কোলের ওপর ‘ডেয়লি বাইবেল’-টা খোলা। বুঝলাম সে আসে মৃত্যুপথযাত্রীকে বাইবেল শোনাতে।

সন্ধ্যেবেলা। ভীনা আর পার্বতী এই সময় বাজার করতে যায়। আমি ওদের একটুও বিরক্ত না করে নিঃশব্দে বারান্দায় বসে থাকলাম। আজ থেকে আমার ওপরে শোবার কথা।

বারান্দায় মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অনুচ্চ, কিন্তু কী স্পষ্ট উচ্চারণ। কণ্ঠস্বরটিও সুরেলা। আর কত ধীরে থেমে থেমে পড়ছে যে বারান্দা থেকেও সব শোনা যাচ্ছিল। সে তখন ডেভিড ও বাথসেবা উপাখ্যানটি পড়ছিল। ঝমঝমিয়ে হঠাৎ একচোট বৃষ্টির পর, এখন, শব্দ বলতে শুধু ঢেউ-পড়ার আদিমতম আওয়াজ। একমনে বাইবেলের গল্প শুনতে শুনতে সমুদ্র-ধোয়া গোপালপুর আর মরু-ঘেরা জেরুজালেমের ব্যবধান বেশ কমে গেছিল কখন, নিজেরই অজান্তে।

‘গিভ মি দা কিস।’

পর্দার ওপার থেকে ক্যাপ্টেন স্মিথের সনির্বন্ধ কণ্ঠস্বর। আমি যে ভুল শুনিনি বোধহয় সেটাই জানাতে আবার বললেন এবং এবার গলা বেশ আদেশসূচক।

‘কাম অন অ্যান্ড ডু ইট কুইকলি!’

ছি-ছি-ছি। পবিত্র বাইবেল-পাঠের মধ্যে একি ব্যাভিচারী আবেদন, এ কি ভয়ঙ্কর পাপ-প্রস্তাব। এবং ঐটুকু মেয়ে, ঐ অনাঘ্রাতা কুসুমের প্রতি!

এরপর যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখতে দেখতে শিউরানিতে আমি প্রায় অবশ হয়ে গেলাম। আমার বোধবুদ্ধি বলতে প্রায় আর কিছুই রইল না।

আমি দেখলাম : স্কার্টের ভেতর থেকে বের করে তার কচি কলা গাছের মত মসৃণ ডান পা থেকে সে হাঁটু অব্দি টানা মোজাটা খুলে ফেলেছে। এবার সে তার পায়ের পাতাটি তুলে ক্যাপ্টেন স্মিথের মুখের কাছে নিয়ে যায়। আমি দেখলাম, এইসময় হঠাৎ হাওয়ায় পর্দাও সম্পূর্ণ উঠে গেল, নোরার পায়ের বুড়ো আঙুলটি সম্পূর্ণ ক্যাপ্টেন স্মিথের মুখের মধ্যে। ক্যাপ্টেন স্মিথের মুখ-নিঃসৃত লালায় তার পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে।

হোলি বাইবেল গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়।

পর্দা পড়ে গেল। আমিও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু, ঘরের ভেতর থেকে, শিশুর স্তন্যপানের চকচক শব্দ ভেসে আসতেই থাকল।

আমি বুঝলাম সবই। অনুরোধ তো নয়, ক্যাপ্টেন স্মিথের কণ্ঠস্বরে ছিল আদেশের সুর। অর্থাৎ এ নিত্যদিনের ব্যাপার। আর সেইজন্যেই এই টাইমিং। সন্ধ্যেবেলা। যখন ভীনা আর পার্বতী বাজারে যায়। ‘গিভ মি দা কিস’— এই ‘দা’ আর্টিকেলটির প্রয়োগও সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। নইলে তো ‘এ’ থাকত।

ক্যাপ্টেন স্মিথের স্বীকারোক্তি

জামাকাপড় গুছিয়ে পরদিন ভোরেই ভীনাকে বললাম বিল দিতে।

‘আপনি আজই চলে যাচ্ছেন স্যার?’

‘হ্যাঁ’, আমি ঘৃণার সঙ্গে বললাম, ‘আজই।’

‘চেক-আউট বারোটায়। আপনি ইচ্ছে করলে বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারেন।’

‘কিন্তু আমি সে ইচ্ছা করি না।’ আমি বললাম ‘বিল আনো।’

একে বেশি কিছু বলার প্রবৃত্তি ছিল না। ভীনার প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝেছিলাম, আমি যা দেখেছি, তা ওরাও দেখেছে। ওদের এই কিছু দেখিনি কিছু শুনিনি ভাব একটা মুখোশ।

এই সময় পার্বতী এসে বলল, ‘স্যার, স্যার আপকো বুলায়া।’

এরপর এ-কাহিনি আর বিলম্বিত না করে ক্যাপ্টেন স্মিথ আমাকে সেদিন যা বলেছিলেন তা প্রায় হুবহু উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট। শুধু এই যে, বলতে বলতে মাঝে মাঝে চুপ করে থাকছিলেন বহুক্ষণ। তখন বুকের ওঠা-পড়াও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বুঝি মরেই গেছেন। পাছে ভীনা বা পার্বতী শোনে এবং জানতে পারে, তাই আগাগোড়া ইংরেজিতে উনি আমাকে। যা বলেছিলেন তা এই—

‘শোনো চ্যাটার্জি, আজ তোমাকে এমন একটা কথা বলব, যা আগে কাউকে বলিনি। কোনো না কোনো মানুষকে কথাগুলো বলে যেতেই হত আমাকে। বাইবেল বল, মহাভারত বল, সবই তো তৈরি হয়েছে এভাবেই। পূর্বপুরুষের বলে যাওয়া উপাখ্যান থেকে। ছাপাখানা, বই, এ-সব তো হয়েছে অনেক পরে।

‘শোনো আমি তোমার কাছে আজ একটি মৃত্যু-পূর্ব স্বীকারোক্তি রেখে যাব। না-না, মিঃ চ্যাটার্জি, তুমি কাল সন্ধ্যায় যা দেখেছ, সে কথা নয়। তুমি যে তখন বারান্দায় বসে, সে আমি জানি। আর, সেই কনফেশন তো আমি নোরার বাবা রেভারেন্ড যোশেফের কাছে করে যাব। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কনফেশন গ্রহণ করে সে ব্যাটা তার পাদ্রি-জীবন সার্থক করবে। এবং, তারপরেও সে এই পাপী মৃতের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করবে— যদি সে প্রকৃতই পাদ্রি হয়ে থাকে।

‘শোনো আমি আর কয়েকদিন মাত্র বেঁচে থাকব। আমার লাংসে ফাইব্রোসিস হয়েছে। এ-রোগে কেউ কোনোদিন বাঁচেনি। আর এই বয়সে মেরে ফেলার জন্যে তো একটু নিমোনিয়াই যথেষ্ট।

‘শোনো, তুমি আজই চলে যাও। কিন্তু তার আগে তোমাকে বলি, আমার মেয়ে নেই, জামাই নেই, আন্না আর অ্যালকে বলে আমার দুই নাতনি নেই—জগদীশ তোমাকে বলেছে নিশ্চয়ই—সে কথা ঠিক নয়। তবে ওরা থাকে অনেক দূরে—সেই সুদূর নরওয়ের উত্তর প্রান্তে, নর্থ সি-র কাছাকাছি বোডো বন্দরে। অতদূর থেকে ছানা-পোনা নিয়ে উড়ে আসা কি চাট্টিখানি কথা।

‘উড়ে-আসা শুনে চমকে উঠ না চ্যাটার্জি। হ্যাঁ, উড়েই তো আসতে হবে ওদের। আমার মেয়ে-জামাই আর নাতনিরা থাকে সাগর-কূলে টালিন পর্বতের এক ফাটলের মধ্যে। প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচুতে। হোক কাঠকুটো দিয়ে তৈরি, মানুষের চেয়ে অনেক শক্তপোক্ত আর নিরাপদ বাসা ওদের।

‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আরিজোনার গোল্ডেন ঈগল বংশীয়। অবশ্য, ওখানে আমাদের বংশের এখন আর কেউ নেই। পেটের ধান্দায় সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। আমার স্ত্রী সুজানের মৃত্যুর পর— আঃ, কী সুন্দরী যে ছিল সে। উত্তর স্কটল্যাণ্ডের গার্বাডিন পাহাড়ের নিচে যে বিশাল উপত্যকা—তারই আকাশে চক্কর মারতে মারতে আমার সঙ্গে একদিন গোধূলি লগ্নে ওর দেখা হয়ে যায়। ও ছিল কেন্ট ম্যাকাফার্সন নামে এক পক্ষী প্রেমিকের পোষা পাখি। বিরাট খাঁচায় থাকত সে। একটা সুন্দর বিছানা ছিল তাঁর। খাঁচার মধ্যে তার জন্যে একটা ৪ ফুট গভীর আর ৬ ফুট লম্বা সুইমিং পুল ছিল। আর খাবার জন্যে পাখি-পায়রা? সে সব তো চাইবার আগেই। কেন্ট তাকে রোজ উড়তেও দিত কিছুক্ষণ। পাহাড়ের মাথা থেকে শিস দিত নানারকম। ও সেভাবে উড়ত। বেশিদূর যেত না। প্রথম কদিন সে মনিবের খাঁচায় ফিরে গিয়েছিল। রাতে আমিও যেতাম তার খাঁচার পাশে। কিন্তু, রাখোয়ালের তদ্বির ছেড়ে, কেই বা উচ্ছন্ন প্রেমিকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে চায় বল!

‘কিন্তু, ঐ যে বলে না, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম! একদিন ও চক্কর মারছে নিচে, আমি খানিকটা ওপরে, দেখলাম ও আমার সঙ্গেই চলে আসছে। দেখতে দেখতে আমরা গার্বাডিন উপকূলের দিকে উড়ে গেলাম। দু-দিন ওখানে লুকিয়ে ছিলাম আমরা। আকাশে একদম যাইনি। কারণ কেন্ট একটা ক্ষুদে প্লেন নিয়ে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমাদের আর দুম-দুম করে বন্দুক ছুঁড়ছিল প্লেন থেকে। যাতে আমরা ভয় পেয়ে গুহা থেকে বেড়িয়ে পড়ি। ওখান থেকে সুযোগ বুঝে নর্থ সি পেরিয়ে আমরা আয়ারল্যাণ্ড চলে যাই। ওখানেই আমাদের মেয়ের জন্ম, ওর বিয়ে, নাতি-নাতনি সব। মৃত্যুর আগে সুজান সব দেখে গেছে। শি ডায়েড এ ভেরি হ্যাপি লেডি, ইউ নো।

‘কী করে আমি শেষ পর্যন্ত গোপালপুরে এলাম, সে কাহিনি নাই বা শুনলে। এই যে হাওয়া, এ তো এখন আসছে ঐ দিক থেকে। ঐ, ঐ যেদিকে নরওয়ে। এই হাওয়া বোডো বন্দরের আকাশ থেকে আসছে না, তুমি কি নিশ্চয় করে বলতে পার! আমি আজ, তখনও ভোর হয়নি, নাতনিদের ‘দাদু-দাদু’ ডাক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম এই হাওয়ায়। তাহলে? আহা, কী মিষ্টি যে ওদের গলা। তা, তুমি কি এই হাওয়ার কাছে জানতে চাইবে, কী করে কীভাবে তোমরা এখানে আসতে পারছ?

‘আর শোনো চ্যাটার্জি। জানিয়ে যাই। জেনিসের ঘরে যে স্টাফড মেয়ে-ঈগলটি দেখেছ, উনিই লেডি সুজান। জেনিসের মা। জামাই থিওডোরের শাশুড়ি। তার ছোট্ট দুই নাতনি আন্না আর অ্যালকের ঠাকুমা। এবং জ্যাক-এর স্ত্রী।

‘হ্যাঁ, জ্যাক দা রিপার। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল খুনী। সে যে কে ছিল, তা কেউ জানে না। আরে বাবা, জানবে কী করে। জ্যাক তো মানুষই ছিল না। আর, সেটা পুলিস ভাববে কী করে। গড সেই বুদ্ধিই দেয়নি মানুষকে। ওসব ঈগলের আছে। ইলেকট্রিক চেয়ারে বসে বা ফাঁসি হবার আগে, কত লোক চেঁচিয়ে বলে গেছে—আই অ্যাম জ্যাক দা রিপার। শুধু অমর হবার বাসনায়।

‘হাঁঃ-হাঁঃ-হাঁঃ। কিন্তু, কেউ না।’ এত বলে আবার ভূতের মত, না, ভূতও পাগল হয়ে যায়— পাগল ভূতের মতো হাসতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন রিচার্ড জেমস স্মিথ। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে তাঁর হাসি মিলিয়ে যাচ্ছিল বটে কিন্তু দম ফিরে পেলেই আবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছিল তাঁর মুখ।

‘সো দিস ইজ মাই কনফেশন। জ্যাক দা রিপার। তুমি বল তো চ্যাটার্জি নোরার পাদ্রি-বাপ—যে কনফেশন শুনে তিড়ি-বিড়িং লাফাবে—সে আর জ্যাক দা রিপারের কাছে কী? একটিপ নস্যি, তাই নয় কি?

১৯৯৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *