সোনার জন্য চিঠি – মহাশ্বেতা দেবী

সোনার জন্য চিঠি – মহাশ্বেতা দেবী

প্রিয় সোনা

এবার গরমের ছুটিতে তোদের ওখানে যেতে পারলাম না। একটুও ভাল লাগছে না জানিস? এখানে ভীষণ গরম। ঘরের মধ্যে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি ছুই ছুই করছে। লু হাওয়া শরীর থেকে সমস্ত জল নিয়ে শুকনো করে দিয়ে চলে যায়। কলকাতায় অতটা গরম নয় নিশ্চয়ই। এবার আমার মাধ্যমিক তোর উচ্চমাধ্যমিক। মা তো বলে সারাদিন ঘরে বসে পড়ো পড়ো আর পড়ো। তোরও নিশ্চয়ই একই অবস্থা।

সেই মনে আছে তোর আমি প্রতিবার গরমের ছুটি পড়তেই বাবার সাথে ট্রেনে চড়ে চলে আসতাম তোদের বাড়িতে। সেই টানা দু তিন সপ্তাহ থাকতাম ওখানে। কি মজা হত। আমি তখন হয়তো ক্লাস টু আর তুই ফোরে পড়িস। আমরা বেশির ভাগ সময়, না, প্রায় সব সময় একটাই খেলা খেলতাম – গরিব গরিব খেলা। তুই আর আমি দুই বোন, আর একটা পুতুল হত আমাদের ছোট বোন। আর যথারীতি আমরা খুব গরিব। আমাদের একটা ঝুপড়ির মত বাড়ি একটা পচা ডোবার ধারে। এসব আমরা তোদের বাড়ির ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে একটা ফাঁকা জায়গায় খেলতাম। রান্নাবান্নার জন্য নিচে রান্নাঘর থেকে মশলাপাতি আনতে যেতে হত আমাকেই। তুই সব সময় বলতিস যে আমি বেড়াতে এসেছি। তোদের বাড়ির অতিথি। আমি চাইলে সেজোপিসি মশলাপতি ঠিক দিয়ে দেবে। সেজোপিসি বোধহয় সবই বুঝত। তোরই মা তো ! তারপরে তোর রান্নাবান্না হয়ে গেলে আমরা খেতাম। তুই যেহেতু বড়, পুতুল বোনকে খাওয়ানোর দায়িত্ব সবসময়ই তোর ছিল। তারপর আমরা মাদুর পেতে আমাদের কাল্পনিক ঝুপড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম। আর ঠিক সেই সময়ই আমাদের পুতুল বোনের রক্ত বমি হত। প্রতিবার এই এক ছকেই চলত খেলা। যাইহোক তারপর পুতুল বোনের অসুখ সারাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হত আর যথারীতি খুব দামি ট্রিটমেন্ট। অতএব বেরিয়ে পড়তাম ভিক্ষে করতে। তুই অতটুকু বয়সেও রাস্তার ভিখিরিদের খুব ভালো নকল করতে পারতিস। তাই পুতুল কোলে তুই আর তোর হাত ধরে আমি একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়াতাম তোদের ছাদে। তারপর কী হবে সে সব তুইই ভেবে বের করেছিলিস। সে একেবারে হিন্দি সিরিয়ালের গল্প। ভিক্ষা করেও যথেষ্ট পয়সা না পেয়ে বোনের অসুখ সারানোর জন্য আমরা যজ্ঞ করতে বসতাম। ইতিমধ্যে তুই সিনেমা দেখে দেখে বেশ কয়েকটা পপুলার মন্ত্র জানতিস। সেইগুলো তুই বেশ দখলের সাথেই বলতিস আর তোর পিছন পিছন আমিও আমার অপটু উচ্চারণে মন্ত্রগুলো যথাসাধ্য বলার চেষ্টা করতে থাকতাম |

এই যজ্ঞের কথায় একটা ঘটনার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। তোরও হয়তো মনে আছে। সেদিন সন্ধেবেলা আমরা আমাদের ফেভারিট গরিব গরিব খেলা খেলছিলাম। খেলা হচ্ছিল তোর ঠাম্মার ঠাকুরঘরে। খেলা তখন জমে উঠেছে। বোনের অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে পারিনি বলে তখন যজ্ঞ করার কথা ভাবা হচ্ছে। তখনই হঠাৎ ঠাকুরের আসনের কাছে জলন্ত প্রদীপটাকে দেখে ঠিক করা হল আজকে সত্যি সত্যিই যজ্ঞ করা হবে। অতএব ঠাকুরের নিজস্ব রিজার্ভ থেকে নেয়া হল তেল আর ঘি। প্রদীপটায় ফিল্মি কায়দায় ঢালতে লাগলাম তেল আর ঘি। আমার কাজ ছিল দরজাটাকে গার্ড দেওয়া। ওই দরজাটায় কোনও ছিটকিনি ছিল না। যজ্ঞটা কতক্ষণ চলেছিল মনে নেই। আমাদের পুতুল বোনের সেরে উঠার আনন্দে আমরা যজ্ঞের আগুনের চারধারে নাচছি এমন সময় সেজোপিসির ডাকে আমাদের টনক নড়ল।

সেজোপিসি ভাত খেতে ডাকছিল আমাদের দুই বোনকে। তারপর আগুন জালাবার প্রমান লোপাট করতে তুই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক বোতল জল ঢেলে দিলি যজ্ঞের আগুনের উপর। কিন্তু ফল হল উল্টো। আগুনের শিখাটা আরও বেশ পাঁচ হাত মতো উঁচুতে উঠে গেল। সেজোপিসি আমাদের অনেকবার ডাকা সত্ত্বেও সাড়া না দেওয়াতে নিজেই চলে এল ঠাকুরঘরে, কী হয়েছে তার খোঁজ নিতে। দরজা খুলেই দেখলো ঘর ভর্তি ধোঁয়া আর আমরা দুই বোন কাশতে কাশতে বেরোচ্ছি। কী বকটাই না খেয়েছিলাম সেদিন ! তারপর থেকে গরিব গরিব খেলা হলেও যজ্ঞটাকে বেশ একটু এড়িয়েই চলতাম আমরা।

অনেক কিছু লিখে ফেললাম বল? চিঠিটা পড়িস কিন্তু। এই গরমের ছুটিতে হল না কিন্তু পরের ছুটিতে কিন্তু আসবই আসবো। খুব মজা হবে।

ভালো থাকিস

ঝিলিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *