সোনার কাঠির স্পর্শ

সোনার কাঠির স্পর্শ

নির্মলা রায় কোনওদিন ভাবতে পারেনি যে, তার জীবনে কখনও কোনও আকস্মিক ঘটনা ঘটবে। নিজেকে নিয়ে ভাববারই বা সময় কোথায়? বেশির ভাগ মানুষেরই জীবন কেটে যায় নিস্তরঙ্গ দিঘির মতো। কিছু আনন্দ-দুঃখ, অভাব, কিছু স্বপ্নভঙ্গ কিছু চাওয়া এবং পাওয়ার অমিল। নাটক নভেলের মতো আকস্মিক ঘটনা প্রবাহ বা হঠাৎ জীবনের গতি বদলানো কজন মানুষের জীবনে হয়।

নির্মলা ট্রামের অপেক্ষায় ছিল। একটু রাত হয়েছে, ঠিক শীত নেই, হাওয়াতে কেমন যেন গা-টা শিরশির করে। অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে ট্রাম আসতে। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে, সারাদিন একটুও বিশ্রাম নেই।

পাশের পানের দোকানে দু-তিনটে ছেলে বসে জটলা করছে। নির্মলা একটু সরে দাঁড়াল। ছেলেগুলোর জন্য নয়, দোকানের আয়নায় তার মুর্তি ভেসে উঠছে বলে। নির্মলা নিজের রূপ দেখতে চায় না। একটা শুকনো বাঁশপাতার মতো চেহারা তার। উপমাটা সে নিজের মনে ভেবেছে। তার রূপ নেই, তার রং ফরসা নয়, তার স্বাস্থ্য নেই। এরপর তার চোখ নাক কীরকম, সে কথাই আসে না। নিজের কথা ভেবে কখনও তার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে, যেন তার পায়ের নীচে এক অতলস্পর্শ পাতাল, দিনের-পর-দিন সে একটু-একটু করে নেমে যাচ্ছে। সমস্ত জীবনটাই তার শুধু কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকার চিন্তা, শুধু ট্যুইশন আর মাস্টারি।

ক্লান্তি আর ক্ষিদে মিলে কেমন যেন একটু অভিমান আসে। কার বিরুদ্ধে অভিমান সে নিজেই জানে না। বুকের মধ্যে খানিকটা বাষ্প জমা হয়ে ওঠে। শেষের ট্যুইশনটা এমন বিরক্তকর। এক বড় লোক বেনেতি মসলার দোকানদারের মেয়েকে পড়াতে হয়। ওর মামা-মা জীবনে কখনও বই ছুঁয়ে দেখেনি বোধহয়। বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে, একটু বর্ণপরিচয় করানো দরকার। কিন্তু। বিয়ের নামেই মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে ঘেন্না করে নির্মলার। দূরে একটা বাস দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু তার যে ট্রামের মান্থলি টিকিট আছে। শুধু-শুধু বেশি পয়সা খরচা করবে?

মনে-মনে যখন নির্মলা এই অতিরিক্ত পয়সা খরচ নিয়ে তর্ক করছে তখনই তার জীবনের সেই নাটকীয় ঘটনাটি ঘটল। নির্মলা যা কোনওদিন ভাবেনি। স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের মতো। একটা চকচকে নতুন মডেলের মোটর এসে দাঁড়াল তার সামনে। তার মধ্যে থেকে একটা ঝকমকে চেহারার। যুবক মুখ বাড়িয়ে বলল, নির্মলা দেবী, চিনতে পারেন? নমস্কার।

নির্মলা অবাক হয়ে নমস্কার করল, কিন্তু চিনতে পারে না। অথচ কেমন যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই রকম মুখ তার অনেকবার দেখা।

চিনতে পারলেন না তো?  যুবকটি হাসল। আমার নাম সুবিমল চৌধুরী। অনুশীলনাকে মনে আছে তো? আমি তার দাদা। সেই যে অনুশীলার বিয়েতে…

নির্মলার মনে পড়ল। সে যখন কলেজে পড়ত, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল অনুশীলার। কিন্তু সেসব দিনের কথা এখন আর তার মনে পড়ে না…

কোথায় অনুশীলা আছে সে খবরও সে রাখে না। অনুশীলার বিয়েতে সে গিয়েছিল ঠিকই। বিরাট বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে, সেখানে তার দাদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কি না মনে পড়ল না। তবু সে বলল, কেমন আছেন? অনুশীলা কেমন আছে?

একটুক্ষণ এই সব কথা হল। অনুশীলা আছে কালিম্পং-এ, তার স্বামী মিলিটারি অফিসার। গত বছর কলকাতায় এসেছিল সে—পুরোনো বন্ধুদের খোঁজ করছিল…তার একটা ছেলে হয়েছে। আপনার সঙ্গেও দেখা করবার খুব ইচ্ছে ছিল…।

নির্মলা ভাবল, দেখা না হয়ে ভালোই হয়েছে। দেখা হলেই বা সে কী করত?

সুবিমল চৌধুরী বলল, আপনি কোন দিকে যাবেন? যদি অনুমতি করেন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।

না, না, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না…আমি এমনিই চলে যাব। ওই যে ট্রাম এসেছে।

ততক্ষণে গাড়ির দরজা খুলে সুবিমল চৌধুরি নেমে এসেছে। সমস্ত শরীরে তার একটা আশ্চর্য উজ্জ্বলতা। নিখুঁত ইস্ত্রি করা দামি পোশাক, চুল আর জুতো সমান চকচকে। মনে হল তার সমস্ত শরীরে, পোশাকে, তার গাড়িতে কোথায় এতটুকু ধুলো নেই। কোনও কিছুই মলিন নয়। সে বলল, আমার এখন কোনও কাজ নেই…আপনাকে পৌঁছে দিতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না, উঠুন।

নির্মলার আপত্তি টিকল না। তাকে গাড়িতে উঠতে হল। সুবিমল চৌধুরী গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, দেখুন, আপনাকে আমি কেমন দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছি। আর আপনি তো আমাকে চিনতেই পারলেন না।

নির্মলা গোপনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল তার দিকে। তার কথা শুনে একটু হাসল। ভাবল, এমন যুবকদের ভুলে যায় দু-ধরনের মেয়েরা। এক, যারা অতুলনীয়া সুন্দরী এবং ভাগ্যবতী–যারা একটু আঙুল হেলালে এরকম অসংখ্য যুবক ছুটে আসে। আর যারা নির্মলার মতো। যাদের রূপ নেই, বিত্ত নেই,—যারা স্বপ্নেও এসব যুবকদের পাওয়ার আশা করে না, তারাও এদের সঙ্গে কখনও আলাপ হলেও ভুলে যায়। এদের মনে রাখে, যারা মাঝারি রকমের সুন্দরী–যারা সব কিছুতে মাঝারি। তারাই এদের পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে, দুঃখও পায়।

কিন্তু এই সুবিমল চৌধুরী হঠাৎ তার দিকে এমন মনোযোগ দেখাচ্ছে কেন? নির্মলা খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তার প্রতি এমন সৌজন্য দেখাবারই বা কী দরকার। অনুশীলার দাদা। অনুশীলার সঙ্গেই কতকাল দেখা হয় না তার দাদাকে মনে রাখবার তো কথাই ওঠে না। কিন্তু নির্মলা রায়, একটা শুকনো বাঁশপাতার মতো যার চেহারা—তার প্রতি উৎসাহ দেখাল এমন একজন মানুষ। নির্মলা একটুও খুশি হল না, এমন একজন মানুষের সঙ্গ পেয়ে।

সুবিমল চৌধুরী ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আজ সন্ধেটা কিন্তু সুন্দর। এ-বছর এমন সুন্দর সন্ধে একটিও আসেনি। চলুন, কোথাও গিয়ে যদি একটু চা খাই, আপনার খুব আপত্তি হবে?

নির্মলা প্রত্যাখ্যান করার একটু সুযোগ পেল। বলল, দোকানে চা খেতে আমার একেবারে ভালো লাগে না। আপনি আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।

না, না, কী আশ্চর্য সুবিমল সঙ্গে-সঙ্গে বাধা দিল নির্মলাকে চা খাওয়াটা না হয় বন্ধ থাক।

না, তা হয় না, আমার জন্য আপনি চায়ের তৃষ্ণাটা নষ্ট করবেন। সুবিমলের গলার স্বরটি খুব মিষ্টি। বলল, চায়ের তৃষ্ণাও অন্যান্য সব তৃষ্ণারই মতো। যতক্ষণ না মেটানো যায় ততক্ষণই ভালো লাগে। আজকের এমন সুন্দর সন্ধেটা—তাকে কিন্তু ফিরিয়ে আনা যাবে না।

আপনাকে যদি সোজা পথে না গিয়ে একটু ঘুরিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিই—আপনার কি খুব আপত্তি হবে?  সুবিমল চৌধুরীর গলায় কোনও জড়তা নেই। যেন নির্মলার সঙ্গে তার কতকালের। পরিচয়। যার সঙ্গে আলাপের কথা নির্মলা মনেও করতে পারে না, সে কি করে তাকে রাত্রিবেলা গাড়িতে করে বেড়াবার কথা বলতে পারে। তবু সুবিমল চৌধুরীর গলায় কী যেন আছে, তার কথায় আপত্তি করা যায় না। তা ছাড়া নির্মলার লোভ হল—শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখতে। কেন সে সোজা পথ চায় না।

সুবিমল আবার বলল, দেখবেন, আজ সন্ধেবেলা বেড়াতে আপনার খুব ভালো লাগবে।

নির্মলার ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে কে কবে ভেবেছে? তার তো কিছু ভালো লাগা মন্দ লাগা নেই। তার শুধু বেঁচে থাকা। নির্মলা শুধু ভেবে-ভেবে কারণ বার করার চেষ্টা করতে লাগল। তবে কি লোকটা সেই ধরনের প্রতারক যারা মেয়েদের নানা রকমভাবে মুগ্ধ করে, তারপর সুযোগ নেয়। কিন্তু নির্মলা ভাবল, এমন সভ্য, সুন্দর প্রতারক তো তার ছাব্বিশ বছরের জীবনে কখনও আসেনি।

খুব দামি গাড়ি সুবিমল চৌধুরীর। চলবার সময় প্রায় শব্দ হয় না। গঙ্গার পাড় ধরে চলেছে। অন্ধকার। সামনের সিটের এক কোণে নির্মলা রায়, এক কোণে সুবিমল চৌধুরী। গাড়ির মধ্যে একটু আলো। নির্মলা গোপনে দেখতে লাগল সুবিমল চৌধুরীকে। আশ্চর্য উজ্জ্বলতা। আশ্চর্য সুন্দর সে। তার শরীরের কোথাও যেন কোনও অসামঞ্জস্য নেই। পুরুষ মানুষ যদি নিখুঁতভাবে। সুন্দর হয়, তবে তাকে কেমন যেন নির্বোধ দেখায়। কিন্তু সুবিমল চৌধুরী অন্যরকম। তাকে দেখলে তৃপ্তি আসে। পোশাক-পরিচ্ছদগুলো নিপুণভাবে তার গায়ে এঁটে আছে। স্টিয়ারিং হুইলের ওপর তার একখানা হাত, তার চোখের মধ্যে লাল আভা, স্বাস্থ্যের দীপ্তি। তার পাশে। নির্মলা দেখল নিজেকে। একটা শুকনোবাঁশ পাতার মতো চেহারা। ধপধপে তাঁতের শাড়িখানা যেন তাকে বিদ্রুপ করছে। তার হাতের আঙুলগুলোও কেমন যেন ফ্যাকাসে, রুগ্ন মনে হচ্ছে। সমস্ত দিকে তার দুঃখ আর অভিশাপ। তার বাবার হাঁপানি রোগ–প্রেসের কম্পোজিটরের কাজ। তারা চার বোন। একটা ভাইও নেই। প্রত্যেকটা বোনকে তারই মতো দেখতে। বাড়িতে প্রতিদিন কারণে-অকারণে বাবা, মা, বোনেদের মধ্যে ঝগড়া। গরিব হলে ঝগড়ার কোনও কারণ দরকার হয় না। যাদব সরকার বাইলেনের অন্ধকার ঘরের নির্মলা রায় বসে আছে এই দামি গাড়িতে, এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

হঠাৎ নির্মলা নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে করতে লাগল। মনে হল তাকে বাঁচাবার কেউ নেই। এই যুবকটি তাকে মহত্ব দেখাতে এসেছে। কৃপা করে তাকে কৃতার্থ করতে এসেছে। সে কত। বড়লোক কত সুন্দর, সে দয়া করে এই কুরূপা মেয়েটির সঙ্গে আজ এই সন্ধেটা বিসর্জন দিতে এসেছে। নির্মলার আর কিছু ছিল না, কিন্তু আত্মসম্মানটুকু ছিল…তাও সে হারাতে বসেছে।

গাড়িটা কলকাতার ভিড় ছাড়িয়ে একটু বাইরে এসেছে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কথা বলল। সুবিমল চৌধুরী আপনি হয়তে বিশ্বাস করবেন না নির্মলা দেবী, আপনাকে আমি খুঁজছিলাম। প্রথম যেদিন আমি আপনাকে দেখি—তারপর থেকেই আমি আপনার কথা ভেবেছি।

নির্মলা চুপ করে রইল। মনে-মনে বলল, মিথ্যে কথা। এসব কথা মেয়েদের কাছে এসে বলতে হয়—স্তুতি মেয়েদের প্রাপ্য। কিন্তু তার কাছে স্তুতি কেন—সে কি স্তুতির যোগ্য, তার কী দেওয়ার আছে?

সুবিমলের গলায় একটু দ্বিধা নেই। একটুও মনে হয় না—সে বানিয়ে বলছে। বলল, শীলার বিয়েতে ওর অনেক বন্ধু এসেছিল, তাদের কয়েকজনকে আমি চিনতুম আগের থেকে। কিন্তু এক ঘর মেয়ের মধ্যে প্রথম আপনার ওপরই চোখ পড়ে।

মিথ্যে-মিথ্যে।

আপনার ওই চোখ—অমন উজ্জ্বল, অমন গভীর চোখ আমি আর কখনও দেখিনি।

মিথ্যে, মিথ্যে। নির্মলা চোখ বুজল। তার গা-হাত-পা কাঁপছে। এসব কী শুনছে সে? এ রকম দুর্বোধ্য কথা সে কখনও শোনেনি। সে একটা কথাও বলতে পারল না।

সুবিমল এক ঝলক তাকিয়ে দেখল নির্মলার দিকে। একটু সরে এল। নির্মলার একটা হাত ধরল সে। আপনি কি মনে করবেন জানি না, আমি…

ছাড়ন নির্মলা এক টানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। এইবার সে বুঝতে পেরেছে সব। সমস্ত কিছুই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বলল, আপনি গাড়ি থামান, আমি এখানেই নেমে যাব।

সুবিমল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করল।

নির্মলার সমস্ত লজ্জা, সমস্ত দ্বিধা চলে গেছে। একটুও ভয় পেল না সে। সুবিমলের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বলল, সত্যি করে বলুন, আপনি কে? কী আপনার উদ্দেশ্য। অনুশীলার কোনও দাদার কথা আমার মনে নেই। যতদূর মনে পড়েছে তার বিয়ের সময় কোনও লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি।

আপনি কে?

সুবিমল একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তার আশ্চর্য সুন্দর মুখে একটা রেখাও বদলাল না। নির্মলার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, আপনি সত্যিই আমাকে এখনও চিনতে পারেননি?

না। এক-একবার মনে হচ্ছে, আপনি একটি প্রতারক। সভ্যতার, সৌজন্যের মুখোশ পরে

এসেছেন। কখনও মনে হচ্ছে আপনি একটি ভাবপ্রবণ মাতাল। কী করছেন আপনার নিজের খেয়াল নেই। আর কখনও মনে হচ্ছে, আপনি সাক্ষাৎ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। আমার মতো সামান্য মেয়েদের দয়া করাই আপনার পেশা।

সুবিমল বলল, আর থাক।

আপনি গাড়ির দরজা খুলে দিন—আমি এখানেই নেমে যাব।

সুবিমল চমকে উঠল। সে কি, এত দূরে এই অন্ধকার রাস্তায়?

হ্যাঁ, এখানেই। গাড়ির মধ্যেও কম অন্ধকার নয়। নির্মলার প্রত্যেকটা কথা উঁচু সুরে বাঁধা যেন ঝনঝন করছে। ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে। কলকাতা ছাড়িয়ে এসে নির্জন পথে গাড়ি থেমে আছে। একঘেয়ে ঝিঝির ডাক, গাছের পাতার শব্দ, অন্ধকার রাত। সুবিমল বলল, না, তা হয় না, এখানে পথে চোর-ডাকাতের ভয় আছে।

চোর-ডাকাতেরা আমাকে ছেড়ে দেবে। আমার কাছ থেকে তাদের নেওয়ার কিছুই নেই।

সুবিমল বলতে গেল,—আপনি ভুল করছেন। নির্মলা তাকে চুপ করিয়ে দিল। হঠাৎ নির্মলা দু হাতে মুখ ঢেকে ছেলে মানুষের মতো কেঁদে ফেলল। কান্না মেশানো গলায় বলল, বলুন আপনি কে? কেন এসেছেন আমার কাছে। আমাকে অপমান করবার, আমার চেহারা নিয়ে বিদ্রুপ করবার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে। কে চেয়েছে আপনার দয়া?

মানুষের বাইরের রূপটুকুই বুঝি সব?

নির্মলা কথা বলল না, কাঁদতে লাগল শুধু। কান্নার আবেগে তার সমস্ত শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠেছে। ওসব কথা শুনলে তার ন্যাকামি মনে হয়। বাইরের চেহারাটা কদাকার হলে, ভেতরের রূপ কে দেখতে চায়?

সুবিমল অত্যন্ত ধীর এবং শান্ত গলায় বলল, আপনি যখন আমাকে চিনতে পারেননি, তখন আর আমার অন্য কিছু পরিচয় দেওয়ার নেই। আমাকে আপনি বিশ্বাস করুন। আপনাকে আমি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

সমস্ত ফেরার পথটায় একটাও কথা হল না। নির্মলা শুধু সেই হাতে মুখ ঢেকে চুপ করে বসে রইল। শুধু একটানা মৃদু শব্দ শোনা যেতে লাগল—যন্ত্রের কিংবা কান্নার।

নির্মলার বাড়ির গলিতে গাড়ি ঢোকে না। একটু দূরে বড় রাস্তায় গাড়ি থামল। নির্মলা একটিও কথা না বলে নেমে গেল গাড়ি থেকে। যতক্ষণ গলির মধ্যে নির্মলাকে দেখা গেল—ততক্ষণ গাড়িটা দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে চলে গেল। নির্মলা একবার ফিরেও তাকাল না যুবকটির দিকে।

বাড়িতে ঢুকবার আগে নির্মলা যেন নিজেকে ফিরে পেল। নিজেকে প্রস্তুত করে নিল একটু। এতক্ষণ সে কোথায় ছিল? এই তো তার নিজের জায়গা, তার চিরকালের জায়গা। প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত, অবসন্ন নির্মলা রায়। বাড়িতে পাঁচ ঘর ভাড়াটে। একটু রাত হয়েছে—তাই কলকাকলি একটু কম। তাদের ঘরেও সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। রান্নাঘরে শুধু মা তার ভাত নিয়ে বসে আছেন—যেন বিধবা মা তার একমাত্র ছেলের জন্য বসে আছে। নির্মলা একমাত্র ছেলেরই মতো। তারই টুইশান, মাস্টারিতে সংসার চলে। কিছু খেতে পারল না নির্মলা। অন্য দিনের চেয়ে আজ আরও অনেক-অনেক ক্লান্তি লাগছে।

নির্মলা কাপড়টা পর্যন্ত বদলাল না। কিছুক্ষণ নিঝুম হয়ে বসে রইল। তিনটে বোন শুয়ে আছে— নয় থেকে কুড়ির মধ্যে বয়েস। প্রত্যেকেই কালো। কেউই সুন্দরী নয়। এদের একদিন কেউ। এসে হয়তো অপমান করে যাবে—দয়া দেখাতে আসবে। নির্মলা দেওয়ালের কাছে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাত্রে মেয়েদের আয়নায় মুখ দেখতে নেই। নির্মলা দেখল, তার মুখে এখনও চোখের জলের দাগ শুকোয়নি। আয়নার মধ্যে যেন দেখা গেল সেই যুবকটিকে, সুবিমল চৌধুরি। ওই লোকটা আজ তাকে স্পর্শ করেছে। তার ছাব্বিশ বছরের জীবনে কখনও এমন হয়নি। ওই লোকটাকে সে ঘৃণা করবে? ওকে ভুলে যাওয়াই উচিত। সত্যি ও কে? কোথা থেকে এসেছিল? ও তো ইচ্ছে করলেই কত সুন্দরী মেয়েদের পেতে পারে, তবু নির্মলাকে ছুঁতে এসেছিল কেন?

দিদি, তুই শুবি না?

নির্মলা ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। নবছরের মেয়েটা ঘুম-ঘুম চোখে কিছুক্ষণ। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে মুগ্ধ গলায় বলল, দিদি, আজ তোকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। রংটাও ফরসা হয়ে গেছে। তার কী হয়েছে রে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *