সোনার কলম

সোনার কলম

আজ বিশ্বকর্মা পুজো বলে সমুদ্রের অফিস ছুটি৷ নিজের ঘরে বসে সমুদ্র তার বন্ধু প্রতাপের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজের মোবাইল ফোনটার ভাঙা জায়গাটিতে লিউকোপ্লাস্ট লাগাচ্ছিল৷ দরজা খোলাই ছিল৷ প্রতাপ ঘরে ঢুকে সমুদ্রকে কাজটা করতে দেখে বলল, ‘এবার তোমার ভাঙা মোবাইল সেটটা পাল্টাও৷ বাজারে কত নতুন ধরনের সেট বেরিয়েছে৷ আর তুমি কিনা ঐ আদ্যিকালের মোবাইল সেটটাকে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে কাজ চালাচ্ছ!’

প্রতাপের কথা শুনে সমুদ্র মৃদু হেসে বলল, ‘আমার এই ভাঙা মোবাইল সেট আমার ছদ্মবেশেরই অঙ্গ৷ ঠিক যেমন আমার চোখের সস্তা দামের মোটা ফ্রেমের চশমাটা বা সরকারি অফিসে ছাপোষা কেরানির চাকরি৷ আসলে তুমি অন্যদের চোখে যত সাধারণ মানুষ দেখাবে ততই সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পারবে৷ এর চেয়ে বড় ছদ্মবেশ আর হয় না৷ আমার অফিসের হরিদাসবাবুর সঙ্গে পাশাপাশি বসে পাঁচ বছর কাজ করছি৷ কিন্তু তুমি তাঁকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারবে না যে আমিই গোয়েন্দা সমুদ্র বসু৷’

প্রতাপ হেসে বলল, ‘বুঝতে পারলাম৷ তোমার ঐ ভাঙা মোবাইল সেটই থাক, তবে আমি কিন্তু ক’দিন হল একটা নতুন মোবাইল সেট কিনেছি৷’ এই বলে সে নতুন কেনা মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে এগিয়ে দিল সমুদ্রের দিকে৷

সমুদ্র সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘বেশ বড় আর সুন্দর সেট তো!’

প্রতাপ বলল, ‘অ্যান্ড্রয়েড সেট৷ ইন্টারনেট, ফেসবুক সব কিছু করা যায়৷ আমি একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছি৷ ইতিমধ্যে কুড়িজন ফেসবুক বন্ধু হয়েছে৷ তুমি তো জানো যে সাহিত্য জগৎ নিয়ে আমার আগ্রহ আছে৷ ঐ বন্ধুদের মধ্যে কেউ কবি-সাহিত্যিক, কেউ বা নিবিষ্ট পাঠক৷ নানা ধরনের লেখা, গল্প-উপন্যাসের খবর পাচ্ছি ওদের থেকে৷ অনেক সময় সাহিত্য অনুষ্ঠানের বা সাহিত্যিকদের ছবিও থাকে৷ দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি৷’

প্রতাপ এরপর সমুদ্রের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কয়েক মুহূর্ত খুটখাট করার পর প্রথমে বলল, ‘এই দেখো৷’ কিন্তু তার পরমুহূর্তেই বলে উঠল, ‘হায় ভগবান!’

সমুদ্র জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’

প্রতাপ বলে উঠল, ‘একজন ফেসবুকে লিখেছেন, প্রয়াত হলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক জলধর ঘোষাল!’

‘নামটা যেন আমারও শোনা মনে হচ্ছে৷ তুমি তাঁকে চিনতে নাকি?’

বিষণ্ণভাবে প্রতাপ জবাব দিল, ‘চিনতাম মানে সাহিত্যের বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখেছি৷ রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসের বিখ্যাত লেখক৷ আমি ওঁর লেখার একজন বড় ভক্ত৷ এই তো তিনদিন আগেই উনি ‘সোনার কলম’ পুরস্কার পেলেন৷ সাহিত্য জগতের খুব নামী পুরস্কার ওটা৷ মধুসূদন মঞ্চে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দর্শক আসনে তাঁর গুণমুগ্ধদের মধ্যে আমিও উপস্থিত ছিলাম৷’

‘খুব বেশি বৃদ্ধ হয়েছিলেন? কীভাবে মারা গেলেন? এখন মনে পড়ছে, আমি ওনার লেখা ‘কালো চিতা’ গোয়েন্দা সিরিজটা পড়েছি৷’

সমুদ্রের কথা শুনে প্রতাপ বলল, ‘হ্যাঁ, ‘কালো চিতা’ উনিই লিখতেন৷ ভদ্রলোক কীভাবে মারা গেছেন তা ফেসবুকে লেখা নেই৷ শুধু মারা যাবার খবরটাই পরিবেশিত হয়েছে৷ বয়স তো বেশি নয় ভদ্রলোকের৷ ওনার বয়স সম্ভবত পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে৷ ওনাকে দেখে আমার তাই মনে হয়েছে৷ সাহিত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল ওনার মৃত্যুতে৷ ‘কালো চিতা’র অভিযান আর পাবে না পাঠকরা৷’

এরপর একটু চুপ করে থেকে প্রতাপ ভারাক্রান্ত গলায় বলল, ‘আমি তবে আজ উঠি৷ আমার সাহিত্যপ্রেমী এক বন্ধু সমীরণ পালিত ওঁর বাড়ি একবার গেছিল৷ শ্যামবাজারের দিকে প্রয়াত সাহিত্যিকদের বাড়ি৷ সমীরণ পালিতের থেকে ঠিকানা নিয়ে ফুলের স্তবক দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি প্রয়াত সাহিত্যিককে৷’

ঠিক এই সময় সমুদ্রের ভাঙা মোবাইলটা বেজে উঠল৷ মোবাইল ফোন কানে দিয়ে এক মিনিট ‘হ্যাঁ-না’ করার পর রাইটিং প্যাড টেনে নিয়ে সমুদ্র কী যেন লিখল৷ তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে প্রতাপকে বলল, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে ভদ্রলোককে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি৷ তাঁর ‘কালো চিতা’ সিরিজের কয়েকটা গল্প বেশ ভালো লেগেছিল আমার৷ তবে তোমার সাহিত্যিক বন্ধুর থেকে আর ঠিকানা জানার দরকার নেই৷ ঠিকানাটা আমি জেনে গেছি৷’

‘ঠিকানা কীভাবে পেলে?’ বিস্মিত ভাবে জানতে চাইল প্রতাপ৷

প্রতাপের বিস্ময়ের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে সমুদ্র বলল, ‘পুলিশের অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার সাহেব ফোন করলেন এইমাত্র৷ তিনি ঠিকানাটা দিলেন৷ আসলে সাহিত্যিক জলধর ঘোষালের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয় বলে পুলিশের ধারণা৷ সে জন্য আমাকে কমিশনার সাহেব ঘটনাস্থলে যেতে অনুরোধ জানালেন৷ এত বড় একজন সাহিত্যিকের যদি সত্যিই অপঘাতে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে সংবাদ মাধ্যম আর রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না পুলিশকে৷ তাই কমিশনার সাহেব আমার শরণাপন্ন হলেন৷ পুলিশের পাশাপাশি আমাকেও ঘটনার অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিতে বলছেন তিনি৷’

প্রতাপ সত্যিই অবাক হয়ে গেল এ ঘটনা শুনে৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে সমুদ্র বাড়ি ছেড়ে একটা ট্যাক্সি ধরে প্রতাপকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল প্রয়াত সাহিত্যিকের বাড়ির উদ্দেশে৷

৷৷ ২৷৷

বেশ ভিড় বাড়িটার সামনে৷ সাহিত্যিকের মৃত্যুসংবাদ ইতিমধ্যে চাউর হয়ে গেছে৷ তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তরা ইতিমধ্যে ফুল-মালা নিয়ে হাজির হতে শুরু করেছে সাহিত্যিককে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য৷ মিডিয়ার লোকরাও কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে হাজির৷ কিন্তু পুলিশ কাউকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না৷ অপেক্ষমাণ জনতার মধ্যে এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে৷ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগঅলা লোক, সম্ভবত কোনো উঠতি সাহিত্যিক হবেন, তিনি চেঁচাচ্ছেন—‘পুলিশের এ কি অভব্যতা! এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি অথচ বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিচ্ছে না৷ এদিকে কেন ঢুকতে দিচ্ছে না সে ব্যাপারে কিছু বলছেও না!’ গাড়ি থেকে নেমে ঐ লোকটার পাশ দিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে হেঁটে যাবার সময় কথাগুলো কানে আসতেই সমুদ্র চাপা স্বরে প্রতাপকে বলল, ‘তার মানে পুলিশ এখনও বাইরের লোকের কাছে ব্যাপারটা খোলসা করেনি৷’

সমুদ্রকে অবশ্য বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারে বেগ পেতে হল না৷ দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় থানার ওসি, মিস্টার রক্ষিত৷ তিনি সমুদ্রর পূর্ব-পরিচিত৷ সমুদ্রকে দেখে তিনি বললেন, ‘কমিশনার সাহেব জানিয়েছিলেন আপনি আসছেন৷ আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি৷ ভিতরে গেলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন৷’

বাড়িতে ঢুকে প্রথম যে ঘরে সমুদ্ররা পা রাখল সেটা সাহিত্যিকের বৈঠকখানা৷ বেশ কয়েকটা আলমারিতে থরে থরে বই সাজানো৷ দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে মানপত্র, মেমেন্টো ইত্যাদি৷ একটা সোফায় তিনজন লোক বসে আছে সে ঘরে৷ বিমর্ষ মুখ৷ তাদের একজন সম্ভবত কাঁদছেনও৷ তাঁর মুখে রুমাল চাপা দেওয়া৷ সে ঘর অতিক্রম করে রক্ষিত সমুদ্রদের নিয়ে উপস্থিত হলেন পাশের একটি ঘরে৷ সে ঘরে ঢোকার সময় সমুদ্র খেয়াল করল দরজার ছিটকিনিটা ভাঙা হয়েছে৷ মাঝারি আকারের একটা ঘর৷ বই ঠাসা দুটো র‌্যাক এ ঘরেও আছে৷ তাছাড়া নানা ধরনের কাগজপত্র, ম্যাগাজিন অবিন্যস্ত ভাবে ঘরের এদিক-সেদিকে রাখা৷ ঘরের একপাশে একটা ক্যাম্পখাটে বিছানা পাতা৷ আর ঘরের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় রাইটিং টেবিল৷ চামড়ার গদি আঁটা চেয়ারে বসা একটা লোক, তার মাথাটা একপাশে ফিরিয়ে ঝুঁকে পড়ে আছে টেবিলের ওপর৷ সাহিত্যিক জলধর ঘোষাল!

কয়েকজন পুলিশকর্মী রয়েছেন ঘরের ভিতর৷ সমুদ্ররা গিয়ে দাঁড়াল টেবিলটার সামনে৷ সমুদ্র প্রথমে মৃত জলধর ঘোষালের মুখটা লক্ষ করল৷ মুখটা যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে৷ চোখের মণিগুলো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে৷ লিখতে লিখতেই মৃত্যু হয়েছে ভদ্রলোকের৷ টেবিলের ওপর একতাড়া লেখার কাগজের ওপরই ঢলে পড়েছেন তিনি৷ মৃত ব্যক্তির ডান হাতটাও টেবিলের ওপর রাখা৷ সে হাতে তখনও ধরা আছে সোনালি রঙের একটা ফাউন্টেন কলম৷

রক্ষিত সমুদ্রকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে?’

সমুদ্র নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল মৃত সাহিত্যিকের মুখের ওপর৷ ভালো করে কী যেন দেখলে সে৷ বার দুই জোরে জোরে শ্বাস টেনে কী যেন শোঁকারও চেষ্টা করল৷ তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার ধারণা এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়৷ বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে৷ সে জন্যই মুখ অমন বিকৃত হয়ে গেছে৷ তাছাড়া ঠোঁটের কষে এক বিন্দু শুকনো রক্তও লেগে আছে৷ এটা সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক নয়৷ এই মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রথমে নজরে এল কীভাবে?’

রক্ষিত বললেন, ‘আমারও ধারণা বিষক্রিয়া৷ মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত বারো-চোদ্দ ঘণ্টা আগে৷ রাইগার মর্টাসিসও শুরু হয়ে গেছে৷ ব্যাপারটা সবার নজরে আসে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ৷ জলধর ঘোষাল সংসার পাতেননি৷ এই ভাড়াবাড়িতে তিনি একাই থাকতেন৷ একতলায় উনি, আর দোতলায় বাড়ির মালিক৷ জলধরবাবুর আত্মীয় বলতে এক ভাইপো আছে৷ সে আবার জলধরবাবুর সহায়কেরও কাজ করে৷ রাতে না থাকলেও এ বাড়িতে তার রোজই যাওয়া-আসা৷ তার নাম প্রকাশ ঘোষাল৷ আজ সকাল সাতটা নাগাদ সে এ বাড়িতে আসে৷ সে দেখে এ ঘরের দরজা বন্ধ৷ তার ধারণা হয় যে রাত জেগে লিখে কাকা ঘুমোচ্ছেন৷ সে কাকার ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে৷ আটটা নাগাদ এক প্রকাশক আসেন জলধরের থেকে লেখা নিতে৷ ভদ্রলোকের ফেরার তাড়া ছিল৷ তাই প্রকাশ আবার তার কাকার দরজাতে ধাক্কা দেয়৷ বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কানো ও ডাকাডাকিতে দরজা না খোলাতে সন্দেহ হয় তার মনে৷ ইতিমধ্যে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ওপর থেকে নেমে আসেন বাড়িঅলা মাখন পাল৷ প্রকাশক, বাড়িঅলা ও ভাইপো তিনজন মিলে আরও একপ্রস্থ দরজা ধাক্কানো, হাঁকডাকের পরও জলধরবাবু দরজা না খোলাতে শেষে তারা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে এ অবস্থা৷ বাড়িঅলাই ফোন করে ব্যাপারটা পুলিশকে জানায়৷ পাশের ঘরেই তারা তিনজন আছে, আপনি কথা বলতে পারেন তাদের সঙ্গে৷’

সমুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ, বলব৷ তার আগে ভালো করে ঘরটা দেখে নিই৷’ সমুদ্র প্রথমে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল টেবিলটা৷ টেবিলে অন্য জিনিসের মধ্যে আছে কয়েকটা বই, একটা কালি ভর্তি দোয়াত, ফুলদানির মতো একটা পাত্রে একগোছা নানা রঙের ফাউন্টেন পেন বা ঝর্না কলম৷ জলধরবাবুর হাতের কলমটাও দেখল সমুদ্র৷ সোনালি রঙের ফাউন্টেন পেন৷ নিব খোলা৷ কালো রঙের ক্যাপটা কলমের মাথায় পরানো৷ মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও সম্ভবত লিখছিলেন তিনি৷ কলমটা ভালো করে দেখার পর সমুদ্র মন্তব্য করল, ‘কলমটা তো সোনার কলম মনে হচ্ছে! টেবিলের অন্য কলমগুলোও বেশ দামি৷ লেখক মানুষ বলেই হয়তো দামি কলমের শখ ছিল৷’ এ কথা শুনে প্রতাপ বলল, ‘সেদিন ‘সোনার কলম সাহিত্য পুরস্কারে’ ওঁকে একটা সোনার কলম, শাল, মানপত্র দেওয়া হয়েছিল৷ সেটা মনে হয় এই কলমটাই৷’

সমুদ্র বলল, ‘তাই নাকি?’ তারপর সে ঘুরে ঘুরে ঘরটা পরীক্ষা করতে শুরু করল৷ ক্যাম্পখাটের পাশে একটা ছোট টেবিলের ওপর কয়েকটা ওষুধের শিশি রাখা আছে৷ সমুদ্র সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখল৷ আর ক্যাম্পখাটের নীচে এঁটো থালা-বাটি আর জলের বোতল রাখা৷ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে সমুদ্র বলল, ‘সম্ভবত ভদ্রলোক রাতের খাওয়া সেরে লিখতে বসেছিলেন৷ রক্ষিতবাবু আপনি এই থালা-জলের বোতল-ওষুধের শিশিগুলো ফরেনসিক টেস্টের জন্য পাঠান৷ দেখা যাক ওতে বিষাক্ত কিছু পাওয়া যায় কিনা? এখন প্রশ্ন হল, জলধরবাবু নিজে বিষ খেলেন, নাকি তাঁকে বিষ খাওয়ানো হল? ওঁর পাঞ্জাবির পকেটগুলো একবার দেখুন৷’

একজন কনস্টেবল মৃতের পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াতে পকেট থেকে শুধু একটা কাগজ বেরিয়ে এল৷ একটা লিফলেট জলধরবাবুর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের৷ কাগজটাতে লেখা—‘রাধা-বিনোদ স্মৃতি স্বর্ণকলম সাহিত্য পুরস্কার৷ প্রাপক: প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী জলধর ঘোষাল’—এই শিরোনামের পর জলধর ঘোষালের একটা সংক্ষিপ্ত জীবনী আর অনুষ্ঠানের স্থানকাল দেওয়া আছে৷ সমুদ্র সেটা দেখিয়ে প্রতাপকে বলল, ‘সোনার কলম পুরস্কারের পুরো নামটা জানলাম৷’

প্রতাপ বলল, ‘এখন খেয়াল হচ্ছে বুকে সাদা সুতোর কাজকরা গেরুয়া রঙের এই পাঞ্জাবিটা পরেই তিনি পুরস্কার নিতে গেছিলেন৷ এই লিফলেটটা সভাস্থলে বিলানো হচ্ছিল৷ তাই ওঁর পকেটে রয়ে গেছে৷ এটা আমার কাছেও একটা আছে৷’

সমুদ্র এরপর মিস্টার রক্ষিতকে বলল, ‘এ ঘরে আপাতত আমার কাজ শেষ৷ আমি এবার এক এক করে ঐ তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলব৷ আর বাইরের লোকদের জানিয়ে দিন যে আপাতত তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা যাবে না৷ বডি পোস্টমর্টেমে যাবে৷’

৷৷ ৩৷৷

বাড়িরই অন্য একটা ঘরে গিয়ে এবার বসল সমুদ্র, প্রতাপ আর মিস্টার রক্ষিত৷ একজন কনস্টেবল প্রথমে সে ঘরে হাজির করল বছর তিরিশের এক যুবককে৷ জলধর ঘোষালের ভাইপো প্রকাশ৷ রুমাল দিয়ে ঘন ঘন চোখ মুছছে সে৷ দৃশ্যতই সে খুব ভেঙে পড়েছে৷ সমুদ্র তাকে বলল, ‘এ সময় আপনাকে বিব্রত করতে খুব খারাপ লাগছে তবু কয়েকটা কথা জিগ্যেস করছি৷ আপনি কোথায় থাকেন? শুনেছি আপনি কাকার অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করতেন৷ কী কী কাজ করতে হত আপনাকে? বেতন পেতেন?’

প্রকাশ বলল, ‘আমি দক্ষিণ কলকাতার নাকতলাতে থাকি স্ত্রী-পরিবার নিয়ে৷ কাকা তো লেখা নিয়েই মগ্ন থাকতেন৷ ওঁর অন্য সব বাইরের কাজই আমি করতাম৷ প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, লেখা কাগজপত্র দেওয়া-নেওয়া, ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিস ইত্যাদি সব কাজই৷ এ সব কাজের জন্য সাত হাজার টাকা প্রতি মাসে পেতাম৷’

‘এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে ঐ টাকাতে সংসার চলে আপনার? আর কিছু করেন আপনি?’

‘শেয়ার মার্কেটে সামান্য কিছু কাজকর্ম করি৷ ওতে আরও হাজার কয়েক টাকা আয় হয়৷’ জবাব দিল প্রকাশ৷

‘আপনার কাকার সঙ্গে শেষ কবে কখন দেখা হয় আপনার?’

প্রকাশ বলল, ‘গতকাল রাতে আমি এ পাড়ারই অন্নপূর্ণা কেবিন থেকে রাত আটটা নাগাদ খাবার কিনে দিয়ে যাই৷ দুপুরে ইদানীং তিনি ওখানে গিয়েই খান৷ আর রাতের খাবার এনে দিয়ে বাড়ি চলে যাই৷ গতকাল রাতে সেই শেষ দেখা৷’

মিস্টার রক্ষিত জানতে চাইলেন, ‘উনি কী বরাবর হোটেলের খাবারই খান?’

প্রকাশ জবাব দিল, ‘না, গত কুড়ি বছর তিনি এ বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসাবে থাকতেন৷ এখানেই খেতেন৷ একমাস হল বাড়িঅলার সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়৷ তারপর তিনি হোটেলের খাবার খাওয়া শুরু করেন৷’

‘কী নিয়ে মনোমালিন্য?’

‘বাড়িঅলা বাড়িটা ছেড়ে দিতে বলছিলেন৷ এই ব্যাপার নিয়েই মনোমালিন্য৷’ জবাব দিল প্রকাশ৷

সমুদ্র এরপর বলল, ‘একটা শেষ প্রশ্নর উত্তর দিয়ে আপনি যেতে পারেন৷ কাকার মৃত্যুতে তাঁর টাকার উত্তরাধিকারী কী আপনি?’

মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে প্রকাশ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ৷’ তারপর সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷

প্রকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরই ঘরে ঢুকলেন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চশমা চোখে এক ভদ্রলোক৷ বয়স সম্ভবত পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন৷ তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্টই বিমর্ষ ভাব৷ ঘরে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘আমি ভাবতেই পারছি না জলধর ঘোষাল আর নেই৷ দু’দিন আগেই ওনার হাতে আমি সোনার কলম সম্বর্ধনা তুলে দিলাম৷ উনি আজ আসতে বলেছিলেন পুজোর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে যেতে৷ কিন্তু কী যে হল৷ আমাদের প্রকাশকদের আর সাহিত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল ওঁর এভাবে চলে যাওয়ায়৷’

তাঁর কথা শুনে সমুদ্র জানতে চাইল, ‘মৃত্যুর সময় হাতে ধরে থাকা সোনার কলমটা কী তবে আপনারই দেওয়া? আপনার পুরস্কারটা যাঁর নামে উৎসর্গ করা তিনি কে? আপনার আর আপনার প্রকাশনা সংস্থার নামটা বলবেন?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম বিদ্যাবিনোদ পালিত৷ প্রকাশনা সংস্থার নাম ‘পালিত প্রকাশনা’৷ পুরস্কারটা আমার অকাল প্রয়াত দাদার নামে উৎসর্গ করা৷ হ্যাঁ, ঐ সোনার কলমটা আমারই দেওয়া৷’

উত্তর শুনে সমুদ্র প্রশ্ন করল, ‘আপনার সঙ্গে ওঁর কত বছরের চেনা? লেখালেখি করে ওঁর কেমন আয় হত বলতে পারেন?’

পালিত বললেন, ‘আমার বাড়ি হিদারাম মল্লিক লেনে৷ জলধরবাবু একসময় ঐ পাড়াতেই থাকতেন৷ তবে তখন অবশ্য তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল না৷ উনি লেখক আর আমি প্রকাশক হবার পর দুজনের পরিচয় হয়৷ সে পরিচয় বলা যেতে পারে দশ বছরের৷ অন্য কোনো প্রকাশক তাঁকে কী টাকা দিত তা আমার জানা নেই৷ তবে আমি ওঁর কুড়িটা বইয়ের রয়ালিটি বাবদ বছরে তিন লাখ টাকা মতো প্রকাশের হাতে দিতাম৷ আর পুজো সংখ্যার উপন্যাস বাবদ একলাখ অগ্রিম দিতে হত৷ এবারও তাই দিয়েছি৷’

সমুদ্র তাঁর কথা শোনার পর বলল, ‘আপনাকে শেষ দুটো প্রশ্ন—এক, লেখক নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসাবে জলধরবাবু কেমন ছিলেন? ইদানীং তিনি কী কোনো ঘটনায় বিব্রত ছিলেন? অথবা এমন কোনো কথা কী তিনি আপনাকে বলেছিলেন যা একটু অস্বাভাবিক?’

পালিত প্রথম প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘মানুষ হিসাবে জলধর খুব শান্ত-নির্বিবাদী মানুষ ছিলেন৷ লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল৷’ একথা বলার পর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘বাড়িঅলার সঙ্গে কী একটা মনোমালিন্য চলছিল সে ব্যাপারে মাসখানেক আগে কী যেন বলেছিলেন৷ তবে সেদিন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে গ্রিনরুমে আমাকে একলা পেয়ে বলেছিলেন যে রয়ালিটির বা উপন্যাসের টাকাগুলো যেন এরপর থেকে আমি সরাসরি তাঁর হাতে দেই৷ একথার অন্য কোনো তাৎপর্য আছে কিনা আমার জানা নেই৷’

পালিত চলে যাবার পর সবশেষে ঘরে ঢুকলেন বাড়ির মালিক মাখন পাল৷ মাঝবয়সী, বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা৷ পরনে ফতুয়া আর ছাপা লুঙ্গি৷ তাঁকে সমুদ্র সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আপনার সঙ্গে কী জলধরবাবুর মনোমালিন্য চলছিল?’

মাখন পাল একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, এতবড়ো পুরোনো বাড়ি আমি মেইনটেইন করতে পারছি না৷ প্রমোটারের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ সে বাড়ি নিয়ে এখানে একটা ফ্ল্যাট বানাবে বলছে৷ কিন্তু জলধরবাবু বাড়ি ছাড়তে চাচ্ছিলেন না৷ এদিকে খাওয়া খরচ সমেত ভাড়া দিতেন মাত্র দেড় হাজার টাকা৷ মনোমালিন্য হবার পর অবশ্য মাসখানেক তিনি বাইরেই খাচ্ছিলেন৷ তবে কথা কাটাকাটি হলেও কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি তাঁর সঙ্গে৷’

সমুদ্র বলল, ‘এই বাজারে দেড় হাজার টাকা বেশ কমই৷ জলধরবাবু কী মৃদু কৃপণ স্বভাবের ছিলেন?’

মাখন পাল বললেন, ‘মৃত মানুষের সমালোচনা করতে নেই৷ তবু বলি, আপনার ধারণা সঠিক৷ বেতন বাড়ানো নিয়ে ক’দিন আগেই খুড়ো-ভাইপোর ঝগড়া হচ্ছিল৷ জলধরবাবু প্রকাশবাবুকে বলছিলেন তিনি বেতন বাড়াতে পারবেন না৷ নতুন লোক রাখবেন৷’

সমুদ্র শেষ প্রশ্ন করল, ‘আপনার সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছিল জলধরবাবুর?’

বাড়িঅলা বললেন, ‘মনোমালিন্য হলেও টুকটাক কথাবার্তা হত৷ খবরের কাগজে ওঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর দেখে ভদ্রতাবশত পরশু সকালে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেছিলাম৷ উনি বেশ খুশিও হলেন৷’

৷৷ ৪৷৷

এদিন সকালেও নিজের ঘরে বসেছিল সমুদ্র৷ রবিবার, ছুটির দিন৷ বেলা আটটা বাজে৷ সাহিত্যিক জলধর ঘোষালের মৃত্যুর দশ দিন কেটে গেছে৷ তদন্তে শুধু উঠে এসেছে বিষক্রিয়ায় জলধর ঘোষালের মৃত্যু হয়েছে৷ সায়ানাইড বিষ৷ তবে তাঁর খাবারের থালায়, জলের বোতলে, ওষুধের শিশিতে কোথাও সায়ানাইড মেলেনি৷ তাঁর মৃত্যুটা আত্মহত্যা না খুন সেটাও বোঝা যাচ্ছে না৷ এ নিয়ে খবরের কাগজে পুলিশের তুলোধোনা করা হচ্ছে৷ এদিনের খবরের কাগজে তেমনই একটা লেখা বেরিয়েছে৷ সেটাই পড়ছিল সমুদ্র, এমন সময় ঘরে ঢুকল প্রতাপ৷ সে সমুদ্রকে প্রথমে জিগ্যেস করল, ‘জলধরবাবুর মৃত্যুরহস্যের ব্যাপারে আর কিছু এগোনো গেল?’ সমুদ্র খবরের কাগজটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে একটু হতাশ ভাবে বলল, ‘না এগোয়নি৷ এ কেসটাতে সমুদ্র বসু মনে হয় পরাস্তই হল৷ জলধরবাবুর মৃত্যুটা যদি খুনের কেস বলে ধরি তবে তাঁর খুনে লাভবান হবে প্রকাশ ঘোষাল আর মাখন পাল৷ তাদের কেউ যদি খুনটা করে থাকে তবে কী পদ্ধতিতে জলধরবাবুকে বিষ খাওয়াল সেটাই তো পরিষ্কার নয়৷’

প্রতাপ একটু চুপ করে থেকে পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ বিকাল পাঁচটায় কলেজ স্ট্রিটে একটা ছোট হলে সাহিত্যিক জলধর ঘোষালের স্মরণসভা৷ ‘পালিত প্রকাশনা’র উদ্যোগে হচ্ছে৷ আমি যাব ভাবছি৷ তুমি যাবে?’

কার্ডটা হাতে নিল সমুদ্র৷ কার্ডে জলধর ঘোষালের একটা ছবিও ছাপা আছে৷ নিজের ঘরের সেই রাইটিং টেবিলে বসে আছেন সাহিত্যিক৷ তাঁর সামনে একতাড়া কাগজ৷ হাতের কলমটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে নিবিষ্ট মনে কাগজের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন জলধর ঘোষাল৷

ছবিটা কয়েক মুহূর্ত দেখার পরই সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলো তো আর একবার জলধর ঘোষালের বাড়ি যাব৷ আমি রক্ষিতকে ফোন করে দিচ্ছি, যাতে ওরা লোক পাঠিয়ে ঘরটা খুলে দেবার ব্যবস্থা করে৷’

এরপর আধঘণ্টার মধ্যেই জলধর ঘোষালের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল সমুদ্ররা৷ পুলিশও এসে গেছিল৷ ঘরটা খুলে দিল তারা৷ এক ভদ্রমহিলা, সম্ভবত তিনি মাখন পালের স্ত্রী হবেন, তিনি দোতলার ব্যালকনি থেকে জানালেন যে মাখন পাল বাড়ি নেই৷ বিকালে তিনি জলধর ঘোষালের স্মরণসভায় যাবেন বলে ফুল কিনতে গেছেন৷ পুলিশকর্মী আর প্রতাপকে নিয়ে মৃত সাহিত্যিকের সেই ঘরটাতে ঢুকল সমুদ্র৷ ঘরের সব জিনিস মোটামুটি একরকমই আছে৷ সমুদ্র টেবিলের কাছে গিয়ে পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে সেটা দিয়ে কলমদানিতে রাখা কলমগুলো এক এক করে তুলে নিয়ে কী যেন পরীক্ষা করল৷ তারপর প্রতাপকে বলল, ‘আপাতত আমার এখানকার কাজ শেষ৷ আমাকে এখন অন্য জায়গাতে যেতে হবে৷ তুমি ফিরে যাও৷ আশা করছি কলেজ স্ট্রিটে জলধরবাবুর স্মরণসভায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে৷’

৷৷ ৫৷৷

পাঁচটাতেই স্মরণসভায় পৌঁছে গেল প্রতাপ৷ ছোট হলঘরটাতে ভিড় বেশ ভালোই হয়েছে৷ মঞ্চে একটা টেবিল ও ক’টা চেয়ার৷ টেবিলের ওপর প্রয়াত সাহিত্যিক জলধর ঘোষালের একটা বেশ বড় বাঁধানো ছবি৷ ঠিক যে ছবিটা ছাপানো হয়েছে আমন্ত্রণপত্রে৷ সেই ছবিটার পাশে একটা তেরো-চোদ্দ বয়সী ছেলের বাঁধানো ফটোগ্রাফও আছে৷ দর্শকদের ভিড়ের মাঝে সমুদ্র, প্রকাশ ঘোষাল, মাখন পাল আর সাদা পোশাকে মিস্টার রক্ষিতকেও দেখতে পেল প্রতাপ৷ সমুদ্রের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ইশারায় চুপ থাকতে বলল তাকে৷

নির্ধারিত সময়ই অনুষ্ঠান শুরু হল৷ প্রথমে মঞ্চে উঠে বিদ্যাবিনোদ বললেন, ‘আজ এই স্মরণসভায় প্রয়াত সাহিত্যিক জলধর ঘোষালকে আমরা শ্রদ্ধা জানাব৷ তিনি ক’দিন আগেই ‘রাধাবিনোদ স্বর্ণকলম’ পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ ঘটনাচক্রে আজ আমার অকাল প্রয়াত ভ্রাতা রাধাবিনোদেরও মৃত্যুদিন৷ মঞ্চে তার প্রতিকৃতিও আছে৷ তাতেও মাল্যদান করব আমরা৷’ মাল্যদান পর্ব এরপর শুরু হল৷ প্রথমে মালা দিলেন বিদ্যাবিনোদই৷ ছবি দুটোতে মালা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি৷ এরপর জলধর ঘোষালের আত্মীয়স্বজন, গুণমুগ্ধ ভক্তরা তাঁর প্রতিকৃতিতে মালা দিল৷ তাদের মধ্যে প্রকাশ, মাখন পালও ছিল৷ প্রতাপও মালা দিল৷ এরপর শুরু হল লেখকের সম্বন্ধে বক্তৃতা৷ বেশ কয়েকজন লেখক-প্রকাশক-ভক্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন প্রয়াত সাহিত্যিককে শ্রদ্ধা জানিয়ে৷ এভাবে ঘণ্টা দুই সময় কেটে গেল৷ ঠিক সাতটায় অনুষ্ঠান শেষ হল৷ সভা ভেঙে যেতেই লোকজন সব বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে৷ রয়ে গেল শুধু সমুদ্র, প্রতাপ, প্রকাশ, মাখন পাল, রক্ষিত আর সাদা পোশাকের পুলিশকর্মী৷ আর বিদ্যাবিনোদ অবশ্য মঞ্চের ওপরেই ছিলেন৷ সমুদ্র, প্রতাপকে ইশারা করলে মঞ্চের দিকে যাবার জন্য৷ সমুদ্র প্রতাপ আর রক্ষিতকে সঙ্গে করে উঠে পড়ল মঞ্চে৷ তাদের দেখে বিদ্যাবিনোদ বললেন, ‘খুব ভালো লাগল আপনারা এসেছেন বলে৷ আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে৷’

সমুদ্র বলল, ‘আপনাকে যে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে এখন৷’

তিনি বললেন, ‘কেন, থানায় কেন?’

সমুদ্র বলল, ‘আপনি তো সোনার কলমটা জলধর ঘোষালকে উপহার দিয়েছিলেন তাই না? ওঁর মৃত্যু আপনিই ঘটিয়েছেন৷’

‘এসব কী বলছেন আপনি?’ চিৎকার করে উঠলেন বিদ্যাবিনোদ৷

সমুদ্র শান্ত স্বরে বলল, ‘জলধর ঘোষালের একটা অভ্যাস ছিল লিখতে লিখতে চিন্তা করার সময় কলমের মাথাটা কামড় দেওয়া৷ এ অভ্যাস অনেকেরই থাকে৷ জলধরবাবুর টেবিলে রাখা অন্য কলমগুলোর মাথাতেও দাঁতের দাগ দেখেছি আমি৷ এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপিতেও জলধরবাবুর ওরকমই ভঙ্গিমার একটা ছবি ছাপা আছে৷ লেখকের ঐ অভ্যাসের কথা আপনি জানতেন৷ আপনি জলধরবাবুকে যে সোনার কলম দিয়েছিলেন তার ক্যাপে সায়ানাইড মাখানো ছিল৷ আপনি জানতেন তিনি কোনো না কোনো সময় ওখানে মুখ দেবেন৷ কলমটা পুলিশের হেফাজতে আছে৷ ওর ক্যাপে বিষের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন হবে না৷’

বিদ্যাবিনোদের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হল প্রতাপের৷ তিনি বললেন, ‘আমি খুন করতে যাব কেন ওঁকে?’

সমুদ্র এবারও শান্ত স্বরে বলল, ‘আমি আপনার পাড়ায় আজ ঘুরে এসেছি৷ যেখানে জলধরবাবু একসময় থাকতেন৷ আপনার পাড়ায় আমার পরিচিত লোকের মুখে আমি জেনেছি যে আপনার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর সঙ্গে জলধর ঘোষালের একটা সম্পর্ক ছিল৷ ব্যাপারটা আপানি বলবেন না আমি বলব?’

বিদ্যাবিনোদ পাকা ক্রিমিনাল নন৷ সম্ভবত আর চাপ সহ্য করতে পারলেন না তিনি৷ একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে তিনি কঁকিয়ে উঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সায়েনাইড মাখিয়েছিলাম কলমে৷ আমি আমার দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলাম ঐ সোনার কলম দিয়ে৷’ এই বলে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন৷

বেশ কিছুক্ষণ পর কান্না থামালেন বিদ্যাবিনোদ৷ রুমাল বার করে চোখ মুছে বললেন, ‘তাহলে সে ঘটনার কথা আপনাদের বলি৷ পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা৷ জলধর ও আমার দাদা রাধাবিনোদ তখন আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে ক্লাস টেনে পড়ে৷ একই স্কুলে৷ জলধর আর আমার দাদার বরাবরই শখ ছিল নানা ধরনের কলমের৷ একদিন দাদাদেরই ক্লাসের এক সহপাঠী একটা সোনালি ঝর্না কলম নিয়ে হাজির হল স্কুলে৷ জলধর আর দাদা দুজনেই তার কাছ থেকে কলমটা কিনতে চাইল৷ কিন্তু সে রাজি হল না৷ কিন্তু ক-দিনের মধ্যেই কলমটা খোয়া গেল তার ব্যাগ থেকে৷ ছেলেটা শিক্ষকমশাইকে ব্যাপারটা জানাতেই তাঁর নির্দেশে সবার ব্যাগ খোঁজা হল৷ আর দাদার ব্যাগ থেকেই বেরোল কলমটা৷ শিক্ষকমশাই তাকে তিরস্কার করে চোর অপবাদ দিয়ে দাদাকে বললেন স্কুল থেকে তাকে রাস্টিকেট করবেন৷ দাদা বলল, জলধর আমাকে কলমটা দিয়েছিল রাখতে৷ সে বলেছিল কলমটা সে ছেলেটার কাছ থেকে কিনেছে৷ কিন্তু মাস্টারমশাই বিশ্বাস করলেন না দাদার কথা৷ জলধরও ব্যাপারটা অস্বীকার করল৷ বাড়ি ফিরে দাদা আমাকে জানাল সে কথা৷ আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতাম৷ সেদিন রাতেই দাদা লজ্জা-অপমানে স্কুল থেকে বহিষ্কারের ভয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল৷ দাদার সেই গলায় ফাঁস লাগানো, জিভ বার করা ঝুলন্ত দেহটা আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই৷ দাদার মৃতদেহ দেখার পরই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে একদিন এ ঘটনার আমি প্রতিশোধ নেব৷ এত বছর ধরে ভাবনাটা মনে পুষে রেখেছিলাম৷ এবার প্রতিশোধ নিলাম৷’—এই বলে আবার মুখ ঢাকলেন তিনি৷

তাঁকে ঘিরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সবাই৷ মিস্টার রক্ষিত একসময় তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘এবার উঠুন৷ থানায় যেতে হবে৷’

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন বিদ্যাবিনোদ৷ তারপর বললেন, ‘এক মিনিট৷ আমার দাদার ছবিতে যাবার আগে শেষ ভালোবাসা জানাই?’ এই বলে তিনি রাধাবিনোদের ছবিটা তুলে নিলেন টেবিল থেকে৷ পরম মমতায় ছবিটাতে হাত বুলিয়ে যেন চুমু খেলেন ছবির ফ্রেমে৷ কিন্তু ছবিটা আর তিনি টেবিলে নামিয়ে রাখতে পারলেন না৷ তার আগেই ঢলে পড়লেন মাটিতে৷ তাঁকে যখন ধরাধরি করে টেবিলের ওপর শোয়ানো হল তখন আর তাঁর দেহে প্রাণ নেই৷ তাঁর মুখ বিকৃত হয়ে গেছে৷

বিদ্যাবিনোদের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে সমুদ্র আফশোসের সুরে বলল, ‘দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন বিদ্যাবিনোদ৷ খুনের দায় তাঁকে নিতে হল না৷ সম্ভবত তিনি ধারণা করেছিলেন তিনি ধরা পড়তে পারেন৷ ছবির ফ্রেমটাতেও তিনি বিষ মাখিয়ে রেখেছিলেন ঐ সোনার কলমটার মতো৷ বিষটা নিশ্চয়ই সায়েনাইড৷ নইলে এত দ্রুত মৃত্যু ঘটত না৷ প্রতাপ, আজকের অনুষ্ঠানের তোমার দেওয়া আমন্ত্রণলিপিতে জলধর ঘোষালের ঠোঁটে কলম ছোঁয়ানো ছবিটাই যাবতীয় রহস্যের সমাধান ঘটাল বলতে পার৷’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *