সৈকত রহস্য – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

(১)

এত বয়েস হয়ে গেল আদিত্যর এখনও ভাল করে সমুদ্র দেখা হল না। খুব ছোটবেলায় সে একবার পুরী গিয়েছিল। মা তখনও বেঁচে। সেই ভ্রমণের স্মৃতি তার প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু টুকরো টুকরো কিছু ছবি মনে আছে। তারা যে বাড়িটায় থাকত তার সদর দরজাটা ছিল সবুজ রঙের, দরজা দিয়ে বেরলেই বালি। আর একটা ছবি—রাস্তায় খুব ভিড়, বাবা-মা আগে আগে হাঁটছে, তাদের পুরোনো লোক জহরদাদা, যার কোলে-পিঠে চড়ে আদিত্য বড় হয়েছে, তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর হাতে একটা রাঙা লাঠি, সেটা উঁচিয়ে ধরে সে মাঝে মাঝে জহরদাদাকে বলছে, হ্যাট হ্যাট, যেন সে একজন রাজপুত্তুর, লাঠিটাই যার তরোয়াল, আর জহরদাদা যার ঘোড়া। আরও দু-একটা ছবি মনে আছে, যেমন, পুরী যাবার পথে কোনও একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে একটা লোক ডিম সেদ্ধ বিক্রি করছিল। কিন্তু, কী আশ্চর্য, পুরীর সমুদ্রের কোনও স্মৃতি আদিত্যর নেই। অথচ বাবার কাছে অনেকবার গল্প শুনেছে, পুরীতে বাবার কোলে উঠে সমুদ্রে স্নান করার সময় সে ঢেউএর ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে সমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। সেসব কথা আদিত্যর কিচ্ছু মনে নেই।

কয়েক বছর আগে একবার নিজের কাজে আদিত্য কয়েক দিনের জন্যে মুম্বাই গিয়েছিল। তখন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল এবং হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট যাতায়াতের পথে চলমান গাড়ি থেকে আদিত্য কিছুক্ষণের জন্যে সমুদ্র দেখতে পেয়েছিল। সমুদ্রের ওপরে যে বিরাট লম্বা ব্রিজটা হয়েছে তার ওপর দিয়ে পারাপার করার সময়ও দেখা দিয়েছিল আরব সাগর। কিন্তু ওইটুকু সময় সমুদ্র দেখতে পেয়ে তার আশ মেটেনি। তাই গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্টে চারদিন কাটাতে পারবে ভেবে আদিত্য বেশ উত্তেজিত বোধ করছে। তার ওপর, সঙ্গে কেয়া থাকবে সেটা একটা মস্ত লাভ।

কেয়া আগে দুবার পুরী গেছে। একবার ইস্কুলে পড়ার সময় বাড়ির সঙ্গে, আর একবার সাত-আট বছর আগে হস্টেলের বন্ধুদের সঙ্গে। তার ওপর আদিত্য তো একটা কাজ নিয়ে যাচ্ছে। সেই কাজে সে নিশ্চয় ব্যস্ত থাকবে। তাই এই চারদিনের ভ্রমণ নিয়ে কেয়ার ততটা উত্তেজনা নেই। তবে একেবারে যে নেই তাও নয়। সে আর আদিত্য এক সঙ্গে চারদিন সমুদ্রের ধারে কাটাবে এটাই বা কম কী।

 আসলে কেয়া চেয়েছিল আরও বেশিদিনের জন্যে, আরও দূরে কোথাও মধুচন্দ্রিমা যাপন করবে। সিমলা-কুলু-মানালি বা গোয়া, কেরালা কিংবা রাজস্থান। আদিত্য তাকে বুঝিয়েছে মধুচন্দ্রিমা যাপনের সময় বেশি দৌড়দৌড়ি না করাই ভাল। অতএব কেরালা বা রাজস্থান বাদ। সিমলা-কুলু-মানালিতে গেলেও ঠিক এক জায়গায় বসে থাকা যাবে না। অতএব ঠিক হয়েছে এবার পুজোর ঠিক পরে তারা গোয়া যাবে। কেয়া বলেছে, ওটাই হবে তাদের আসল হানিমুন। আদিত্য মেনে নিয়েছে।

এখন আদিত্য আর কেয়া ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে বসে আছে। যে গাড়িটা করে তাদের রিসর্টে যাবার কথা তার ড্রাইভার ফোন করেছিল। রাস্তায় গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। ড্রাইভার রিসর্টে খবর দিয়েছে। আর একটা গাড়ি এসে আদিত্যদের নিয়ে যাবে। তারা যেন এয়ারপোর্টেই অপেক্ষা করে। নতুন গাড়ির ড্রাইভার এসে তাদের ফোন করবে।

আদিত্যর ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। সকালে উঠতে তার এমনিতেই গায়ে জ্বর আসে, তার ওপর ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে কোথাও বেরতে হলে তো কথাই নেই। সকাল ছটা পনেরো মিনিটে ইন্ডিগোর একটা ফ্লাইট ছিল। সেটা ধরতে গেলে অন্তত ভোর চারটেতে উঠতে হত। আদিত্য ওটা প্রথমেই নাকচ করে দিয়েছে। পরের ফ্লাইট এয়ার ইন্ডিয়ার। সকাল নটা দশে। সাতটায় চেক ইন করতে হলে ছটায় তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরতে হবে। সেটাও বেশ কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটা সম্পন্ন করে আদিত্য আর কেয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছে দ্যাখে প্লেন এক ঘণ্টা লেট। খবর নিয়ে বেরলে এত তাড়াহুড়ো করতে হত না।

আদিত্যরা মনিটারের দিকে চোখ রেখে বসে আছে তো বসেই আছে। লেটের বহর ক্রমশ বাড়ছে। এক ঘণ্টা থেকে বেড়ে হল দেড় ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা থেকে দু ঘণ্টা। শেষে প্লেন ছাড়ল পৌনে বারোটায়। রিসর্টের ড্রাইভারের সঙ্গে ইতিমধ্যে কয়েকবার কথা হয়েছে। শেষবার সে বলেছিল রিসর্ট থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে তার আড়াই ঘণ্টা লাগবে। তাই সে রওনা দিয়ে দিচ্ছে। দরকার হলে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবে। তারপর ভুবনেশ্বর পৌঁছে এই গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার দুঃসংবাদ! আদিত্য ভাবছিল, এর থেকে রাত্তিরের ট্রেন ধরে চলে এলে ঢের ভাল হতো।

কেয়ার খুব খিদে পেয়ে গেছে। তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কেয়ার সব ভাল, শুধু শারীরিক কষ্ট সে মোটে সহ্য করতে পারে না। এবং খিদে পাওয়ার মতো শারীরিক কষ্ট আর কী আছে? অথচ ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে দুপুরে খাবার তেমন জুৎসই জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেয়া রেগে টং হয়ে আছে। আদিত্য দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ আর দু-কাপ কফি নিয়ে এসে দেখল কেয়ার পাশের জায়গাটা, যেখানে সে এতক্ষণ বসেছিল, বেদখল হয়ে গেছে।

‘তুমি বললে না এখানে তোমার স্বামী বসেছিল। সে খাবার আনতে গেছে, এখনি ফিরে আসবে?’ আদিত্য একটু রেগেই গেছে।

‘আমি কিচ্ছু বলিনি। আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। আমাকে এখানে আনলে কেন?’

সব দোষ যেন আদিত্যর। যেন কেয়া নিজে থেকে আসতে চায়নি, আদিত্য তাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। খিদে পেলে কেয়ার সমস্ত যুক্তি গুলিয়ে যায়।

একটু পরে স্যান্ডউইচটা খেয়ে কেয়া খানিকটা কথা বলার অবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু তার পেট এখনও ভরেনি, ফলে মেজাজ চড়া। সে আদিত্যকে বলল, ‘ওই দিকে তো একটা জায়গা খালি আছে। গিয়ে বোসো না। আমার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

আদিত্য কথার উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বার করে অসীম দত্তর নম্বরটা ডায়াল করল। সে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। ফোনটা ধরল একজন পুরুষ। বলল সে অসীম দত্তর সেক্রেটারি।

‘স্যার একটু ব্যস্ত আছেন। একটু পরে ফোন করুন।’ সেক্রেটারির গলায় বিরক্তির আভাস।

‘চন্দ্রিমা সেন নেই? উনিই তো অসীম দত্তর সেক্রেটারি।’ আদিত্যর গলায় সন্দেহ।

‘শুনুন, চন্দ্রিমা ম্যাডাম আসতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আপনার যা বলার আমাকে বলতে পারেন। আর একটু তাড়াতাড়ি বলুন। আমারও কাজ আছে।’ লোকটা রুক্ষভাবে বলল।

‘আপনি অসীমবাবুকে জানিয়ে দেবেন আদিত্য মজুমদার ফোন করেছিল। আমরা ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে স্ট্র্যান্ডেড হয়ে আছি। আপনাদের রিসর্ট থেকে গাড়ি আসার কথা ছিল। আসেনি। আপনি অসীমবাবুকে বলবেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে না পৌঁছলে আমরা নেক্সট অ্যাভেলেবল ফ্লাইটটা ধরে কলকাতা ফিরে যাব।’ লোকটা কিছু বলার আগেই আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অসীম দত্তর ফোন।

‘আদিত্যবাবু, আই অ্যাম রিয়ালি সরি। আমি জানতামই না আপনাদের কাছে গাড়ি পৌঁছয়নি। আমি ভাবছিলাম আপনারা এখানে পৌঁছে বিশ্রাম করছেন। আসলে কাল সকালেই তো রিসর্টের ইনগরেশন। এই শেষ মুহূর্তে এত রকম কাজ! আমি খোঁজ নিতে পারিনি আপনারা এলেন কিনা। প্লিজ কনভে মাই সিন্সিয়ারেস্ট অ্যাপলজি টু ম্যাডাম।’

আদিত্য চুপ করে আছে।

‘এখন খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনাদের জন্যে যে গাড়িটা পাঠানো হয়েছিল সেটা মাঝপথে খারাপ হয়ে গেছে। এটা খুব আনইউজুয়াল। যাইহোক, আর একটা গাড়ি অনেকক্ষণ রওনা হয়ে গেছে। আর আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। প্লিজ বেয়ার উইথ আস। প্লিজ।’

এতবার প্লিজ বললে তো রাগ করে থাকা যায় না। আদিত্য কয়েকবার ‘ঠিক আছে’, ‘ঠিক আছে’ বলে ফোনটা কেটে দিল।

কেয়ার পাশের জায়গাটা আবার খালি হয়েছে।

রিসর্টটা চমৎকার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন একেবারে সমুদ্রের ভেতরে বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে। আরও কাছে গেলে বালির ভেতর দিয়ে রিসর্টে পৌঁছনোর রাস্তাটা চোখে পড়ে। দূর থেকে রিসর্টটা দেখে আদিত্যর মনটা ভাল হয়ে গেল। কেয়ারও। এয়ারপোর্টে বসে কেয়া সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছিল, সারাক্ষণ গাড়িতে বসেও আর মুখ খোলেনি। এই এতক্ষণ পরে তার মুখে কথা ফুটল।

‘কী সুন্দর! না গো?’ কেয়ার গলায় মুগ্ধতা।

একটু আগে ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রটা একবার উঁকি দিয়েছিল। এক ঝলক দেখা দিয়েই হারিয়ে গিয়েছিল আবার। তারপর কিছুক্ষণ আর তার দেখা নেই। গাড়ি হঠাৎ একটা বাঁক নিতেই সব আড়াল সরিয়ে ফেলে সমুদ্র ওদের সামনে নিজেকে উজাড় করে মেলে দিয়েছে। দিগন্তব্যাপী জল বিকেলের রোদ্দুরে চিকচিক করছে। আদিত্য অন্তরাত্মা পর্যন্ত তন্ময় হয়ে আছে।

রিসর্টের ঘরগুলো একতলা, বাংলো প্যাটার্নের। একটা গোল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সামনে, একটু এগোলেই পুরী-কোনারক মেরিন ড্রাইভ। পেছনে বালি, জনহীন সমুদ্র-সৈকত, সমুদ্র। বেয়ারা আদিত্যদের যে ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তুলল সেটা বেশ বড়, পঞ্চভুজাকার। একদিকে দুটি আরাম কেদারা, চায়ের টেবিল, চা-কফি বানানোর সরঞ্জাম রাখা ক্যাবিনেট, একটা ছোট রেফ্রিজারেটার। অন্যদিকে বিছানা, বিছানার সামনে দেয়াল জুড়ে পেল্লায় টেলিভিশন, লেখার টেবিল-চেয়ার। ঘরের তিনদিকের জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কেয়ার মুখ দেখে বোঝা যায় ঘরটা তার খুব পছন্দ হয়েছে।

‘এখন খাবার কিছু পাওয়া যাবে? আমাদের লাঞ্চ খাওয়া হয়নি।’ আদিত্য বেয়ারাটিকে জিজ্ঞেস করল। সে একটু আগে জেনে নিয়েছে বেয়ারাটির বাড়ি মেদিনীপুর।

‘নিশ্চয় যাবে সাহেব। আপনি টু-থ্রি-টু-থ্রি ডায়াল করুন।’ বেয়ারা বিছানার পাশে রাখা ইন্টারকমটার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল। ‘ওটা রুম সার্ভিসের নম্বর। ওরা বলতে পারবে এখন কী পাওয়া যাবে।’ দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেয়ারা চলে গেল।

 বিছানার পাশে সাইড টেবিলে একটা মেনু রাখা আছে। আদিত্য কেয়াকে মেনুটা দেখিয়ে বলল, ‘বল, কী অর্ডার দেব?’

‘তুমি যা ভাল বোঝ অর্ডার দাও। আমি বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি।’ এখানে সমুদ্রের ধারে তেমন শীত নেই। কেয়ার মেজাজ একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে।

কেয়া বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার পর আদিত্য মেনুতে চোখ রাখল। সাড়ে চারটে বেজে গেছে। এই অবেলায় খুব বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। আবার খিদে পেয়েছে এটাও সত্যি। সে অনেক ভেবেচিন্তে দু-প্লেট ফিস অ্যান্ড চিপস অর্ডার দিল। সঙ্গে এক পট দার্জিলিং চা। মনে হচ্ছে আপাতত এতেই চলে যাবে।

খাবারের অর্ডার দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখার মিনিট খানেকের মধ্যে ইন্টারকমটা আবার বেজে উঠল। অসীম দত্ত।

‘আপনারা পৌঁছে গেছেন খবর পেয়েছি। পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?’

‘না, না। কোনও অসুবিধে হয়নি।’

‘ওই গাড়িটা কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদেরই জন্যে। যখন খুশি ড্রাইভারকে ডেকে নেবেন। ও আশেপাশেই আছে।’

‘ড্রাইভার সেটা আমাদের বলেছে। আর যে ঘরটা আমাদের দিয়েছেন সেটা সুপার্ব।’

‘ঘর পছন্দ হয়েছে?’

‘খুব পছন্দ হয়েছে।’

‘বাঃ, বাঃ। আচ্ছা, আমি একটা বিশেষ কারণে ফোন করলাম। আজ রাত্তিরে রিসর্টের ব্যাঙ্কোয়েট হলে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার জন্মদিন পালন করবে। প্রথমে বোধহয় কেক-টেক কাটা হবে। তারপর, আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছি, একটু গান-টানও হতে পারে। শেষে ডিনার। আমি বলেছি, আমার দুজন গেস্ট আসবেন। বুঝতেই পারছেন, আপনারাই সেই গেস্ট। ওরা রাজি হয়েছে। তবে যদি জানত গোয়েন্দা আদিত্য মজুমদার আর তার স্ত্রী আমার গেস্ট, তাহলে কী বলত জানি না। যাই হোক, সাড়ে সাতটায় সস্ত্রীক ব্যাঙ্কোয়েট হলে চলে আসবেন। রাত্তিরে ডিনার খেয়ে ফিরবেন। ওখানে আমার পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ঠিক আছে? রাখছি তাহলে?’

‘চলো এবার সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে আসি।’ কেয়া বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। স্নান করেছে। চুলে, মুখে বিন্দু বিন্দু জল। আদুড় গায়ে আলগা করে শাড়ি জড়ানো। কেয়ার শরীরটা আদিত্যকে হঠাৎ ভীষণ টানছে।

আদিত্য মুখে বলল, ‘খাবার অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। খেয়ে বেরই? তার আগে অবশ্য আমি একটু গায়ে জল দিয়ে আসব।’

ঘণ্টা খানেক পরে তারা বাইরে এসে দেখল চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। শুধু অনেক দূরে, দিগন্ত যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে আছে সেখানে, মেঘ আর ডুবন্ত সূর্যের সঙ্গে মিলে আকাশ বিচিত্র সব আলোর কেরামতি দেখাচ্ছে। সি বিচের ধারে অনেকগুলো চেয়ার পাতা রয়েছে। আদিত্য আর কেয়া সেখানে বসে কিছুক্ষণ আকাশের কেরামতি দেখল। তাদের মতো আরও অনেকে বসে আছে। সব মিলিয়ে জনা কুড়ি তো হবেই। সকলেই রিসর্টের। আস্তে আস্তে আকাশেও অন্ধকার নেমে এসেছে। একটা দুটো তারা ফুটতে শুরু করেছে। আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে সাতটা বাজতে এখনও দেরি আছে। আর এক কাপ চা খেলে হত। কয়েকজন বেয়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললে নিশ্চয় চা দিয়ে যাবে। কেয়া বলে দিল সে আর চা খাবে না।

একটু পরে চা খাওয়া হয়ে গেলে আদিত্য বলল, ‘চল, একবার সমুদ্রের ধারে হেঁটে আসি।’

সমুদ্র-সৈকত প্রায় জনমানবহীন। এখান থেকে পুরী প্রায় তিরিশ কিলোমিটার, অন্য দিকে দশ কিলোমিটার গেলে কোনারক। ওসব জায়গার ভিড় এখনও এত দূর এসে পৌঁছয়নি। সমুদ্রের ধারে হাঁটতে অসম্ভব ভাল লাগছে। হাওয়ায় কেয়ার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। সমুদ্র-সৈকতের কাঁকড়ারা অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে যাচ্ছে। তারা মানুষের পায়ের শব্দ খুব বেশি শোনে না।

আরও অনেকক্ষণ সমুদ্রের ধারে থাকতে পারলে ভাল হত, কিন্তু সাতটা বেজে গেছে। সাড়ে সাতটায় ব্যাঙ্কোয়েট হলে পৌঁছবার আগে কেয়া বলেছে একবার শাড়িটা বদলাবে। মনে হয় একটু সাজবেও। একটা ফর্মাল ডিনার তো বটে। আদিত্য এই জামা-প্যান্টটা পরেই নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাবার মতলব করছিল, কিন্তু কেয়া থাকতে সেটা হবার নয়। এইসব নিয়ে কথা বলতে বলতে ওরা রিসর্টের সীমানায় প্রায় পৌঁছে গেছে, যেখানে একটু আগে ওরা চেয়ারে বসেছিল, হঠাৎ আদিত্যর চোখে পড়ল, এক বয়স্ক দম্পতী রিসর্টের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এসে দুটো ফাঁকা চেয়ার দখল করে বসল। দুজনেই আদিত্যর চেনা। আদিত্য ভাবছে লুকিয়ে পড়বে নাকি এগিয়ে গিয়ে কথা বলবে। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। প্রদীপ চক্রবর্তী।

‘আরে, আদিত্যবাবু, আপনি এখানে?’প্রদীপ চক্রবর্তীর গলায় অকৃত্রিম বিস্ময়।

‘আপনাকে বললাম না, দেখবেন, ঠিক চেনা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ঠিক সেটাই তো হল।’ আদিত্য মৃদু মৃদু হাসছে। ‘আলাপ করিয়ে দিই আমার স্ত্রী কেয়া। আর ইনি প্রদীপ চক্রবর্তী আর তাঁর স্ত্রী রাখি চক্রবর্তী।’

‘আপনার সঙ্গে আমার যখন এখানে আসা নিয়ে কথা হল তখন আপনি জানতেন এখানে আসছেন?’ প্রদীপের বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি।

‘জানতাম। আপনাকে কিছু বলিনি কারণ ভাবলাম আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।’ আদিত্য এখনও মিটিমিটি হাসছে। ‘কেয়া আপনার মতোই একটা স্কুলে ফিজিক্স পড়ায়।’ আদিত্য রাখি চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বলল।

‘বসুন না। আমার উঠে দাঁড়াতে অনেকটা সময় লেগে যায়।’ রাখি চক্রবর্তী কেয়ার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বললেন।

‘আপনি উঠবেন না। আমি বসছি।’ কেয়া রাখি চক্রবর্তীর সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল।

বিকেলের তুলনায় জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা। সম্ভবত এই কারণে যে এখন আকাশের সেই ম্যাজিক আর নেই। অন্ধকার এসে আকাশ, সমুদ্র সব কিছু গ্রাস করে নিয়েছে। এখানে বসে থাকলে মাঝে মাঝে ঢেউএর ওপর ফসফরাস জ্বলে ওঠা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। তবু কেউ কেউ এখনও বসে আছে। হয়তো সমুদ্র থেকে হঠাৎ দৌড়ে আসা এক ঝলক হাওয়ার আশায়। কিংবা অন্ধকারটাকেই দেখবে বলে।

‘আপনি কোন স্কুলে পড়ান?’ কেয়া রাখির সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে। কেয়ার পছন্দে সাদা-কালো অতি প্রবল। আদিত্যর মনে হল রাখিকে দেখেই তার পছন্দ হয়ে গেছে।

‘পড়াই না, পড়াতাম। কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছি। হেমলতা গার্লস স্কুল। বেলেঘাটায়। জানেন স্কুলটার কথা?’

‘খুব জানি। কয়েকবার আমাদের মেয়েদের ওখানে হায়ার সেকেন্ডারির সিট পড়েছিল। আমি পড়াই বিডন স্ট্রিটের রামমোহন শীল মেমরিয়াল স্কুলে।’

‘ও আচ্ছা, আচ্ছা।’ রাখি চক্রবর্তী স্কুলটার কথা শুনেছেন।

আলাপ ক্রমশ জমে উঠছে দেখে আদিত্য বলল, ‘ম্যাডাম, আমাদের একটা নেমন্তন্ন আছে। ব্যাঙ্কোয়েট হলে সাড়ে সাতটায় পৌঁছতে হবে। আমরা আজ একটু এগোচ্ছি। কাল নিশ্চয় দেখা হবে। তখন ভাল করে গল্প করব। আজ আসি?’ তারপর প্রদীপ চক্রবর্তীর দিকে ফিরে বলল, ‘আসছি প্রদীপবাবু।’

‘আপনারা কি এই হোটেল মালিকের আত্মীয় নাকি?’ প্রদীপের গলায় এখনও বিস্ময়। ‘বেয়ারার কাছে শুনলাম, ব্যাঙ্কোয়েট হলে সাড়ে সাতটা থেকে নাকি এই হোটেলের মালিক অসীম দত্তর আত্মীয়স্বজন তার জন্মদিন পালন করবে।’

‘আমরা আত্মীয় নই, অসীম দত্তর বিশেষ অতিথি।’ প্রদীপ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে আদিত্য রহস্যময়ভাবে হাসল। তারপর আর কিছু না বলে কেয়াকে নিয়ে পা চালাল ঘরের দিকে।

প্রদীপ চক্রবর্তী তাদের গমনপথের দিকে কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে।

যখন আদিত্যরা নিজেদের ঘরে ফিরল তখনও সাড়ে সাতটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি।

(২)

‘উই হ্যাভ অ্যাসেম্বল্ড হিয়ার টু সেলিব্রেট দ্য সিক্সটি সিক্সথ বারথ অ্যানিভারসারি অফ আওয়ার ডিয়ার দাদু…’

আদিত্যরা ব্যাঙ্কোয়েট হলে ঢুকে দেখল কর্ডলেস মাইক্রোফোন হাতে একটি অল্পবয়সী মেয়ে কথা বলছে। মাজা রং, পরনে জিনস ও টি শার্ট। বেশ লম্বা।

‘তোর দাদু হতে পারি, তা বলে আমি সবার দাদু নাকি?’ ধুতি এবং সিল্কের পাঞ্জাবি পরা অসীম দত্ত এক পাশ থেকে বললেন।

‘বাংলায় বল, বাংলায় বল। এখানে সবাই বাঙালি।’ মেয়েটিরই বয়সি একটি ছেলে সামনে থেকে বলে উঠল। ছেলেটিও বেশ লম্বা তবে গায়ের রং মেয়েটির মতো মাজা নয়, একেবারে টকটকে ফরসা। অসীম দত্তর মতো।

‘তাহলে তুই বল।’ মেয়েটি ছেলেটির হাতে মাইক্রোফোনটা ধরিয়ে দিল।

ব্যাঙ্কোয়েট হলে আট-নজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ছোট ছোট টেবিল ঘিরে চারটে করে চেয়ার, আপাতত সব কটাই ফাঁকা। মনে হয় ডিনার শুরু হলে সেগুলোর সদ্ব্যবহার হবে। এই চেয়ার-টেবিলগুলোর পেছনে টানা লম্বা আর একটা টেবিল যার ওপর অনেকগুলো ছোট ছোট উনুন। উনুনগুলো এখন জ্বলছে না। মনে হয়, পরে খাদ্যবস্তু এসে পৌঁছলে ওগুলো খাবার গরম রাখার কাজে ব্যবহার করা হবে। লম্বা টেবিলের পেছনে বেয়ারাদের দাঁড়াবার জায়গা। আদিত্য আগে খেয়াল করেনি, এতক্ষণে লক্ষ করল, যেখান থেকে মেয়েটি কথা বলছিল তার ডানদিকে একটা ছোট টেবিলে ঢাকা দেওয়া একটা গোলাকৃতি বস্তু রাখা আছে। তার পাশে স্বচ্ছ, ফিতে লাগানো বাহারি প্লাস্টিকের ছুরি। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, ঢাকা দেওয়া বস্তুটা অসীম দত্তর বার্থডে কেক যেটা অচিরেই ওই ছুরি দিয়ে উনি কাটবেন।

একজন ফটোগ্রাফার ঘুরে ঘুরে সকলের ছবি তুলছে। আদিত্যদেরও কয়েকটা ছবি তুলল।

অসীম দত্ত আদিত্যদের দেখতে পেয়েছেন। হাত নেড়ে সামনে আসতে বলছেন। কেয়াকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল আদিত্য।

‘আজ বিখ্যাত শিল্পপতি অসীম দত্ত ছেষট্টি বছর পূর্ণ করলেন। সেই উপলক্ষে আমরা, ওঁর নিকটজনেরা, এখানে মিলিত হয়েছি।’ ছেলেটি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে শুরু করেছে। ‘এই দিনটা আমাদের কাছে ভীষণ আনন্দের একটা দিন। এই জায়গাটা, যেখানে আমরা মিলিত হতে পেরেছি, সেটাও খুব উল্লেখযোগ্য। কারণ এই রিসর্ট অসীম দত্তেরই…’ এইটুকু বলে ছেলেটি নিচুগলায় মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ব্রেনচাইল্ডের বাংলা কী রে?’

‘তুই ভেবে বল। আমি অত বাংলা জানি না।’ মেয়েটি ফিসফিস করে বলল। ‘ব্রেনচাইল্ডই বল না। কেউ তোকে বকবে না। আর তাড়াতাটি শেষ কর। না হলে লোকে বোর হয়ে যাবে।’

‘এই রিসর্টটা অসীম দত্তেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।’ ছেলেটা ব্রেনচাইল্ডের একটা বাংলা খুঁজে পেয়েছে।

ছেলেটা আরও অনেক কিছু বলছিল। আদিত্য আর শুনছে না। সে আর কেয়া সামনের দিকে একটু ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে ঘরের অন্যদের দেখা যায়। আদিত্য মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছিল। নামগুলো, চরিত্রগুলো সবই তার জানা। এবার দাঁড়িয়ে থাকা এক-একজনের সঙ্গে এক-একটা নাম মিলিয়ে দিতে হবে। আদিত্যর মনে হল অসীম দত্তর বড় ছেলে অনিকেত আর তার স্ত্রী ছন্দা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। এরা দুজনেই খুব ফরসা, তাই ছেলেটাও অত ফরসা। যে মাইক্রোফোনে কথা বলছে সেই যে অনিকেত-ছন্দার ছেলে শুভ্র তাতে সন্দেহ নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, জিনস, টি শার্ট পরা লম্বা মেয়েটা তার পিসতুতো বোন স্বাতী। স্বাতী তার বাবার কাছ থেকে হাইটটা পেয়েছে। স্বাতীর বাবা, অসীম দত্তর জামাই জয়ন্ত মল্লিক ছ’ফুট দু-তিন ইঞ্চি লম্বা, বউকে নিয়ে একটু পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকলেও সবার ওপরে তার মাথাটা জেগে রয়েছে। তার স্ত্রী শ্বেতা মল্লিকও মেয়েদের আন্দাজে বেশ লম্বা, তবে যতটা না লম্বা তার চেয়ে বেশি চওড়া। ইন্সপেক্টার মাজি শ্বেতা মল্লিককে জাঁদরেল বলেছে। খুব একটা ভুল করেনি। জয়ন্ত মল্লিক এবং অনিকেত দত্ত দুজনেই স্যুট-টাই পরেছে। জয়ন্ত মল্লিকের স্যুটটা আবার থ্রি-পিস। একেবারে পেছন দিকে অন্য সকলের সঙ্গে একটু দূরত্ব রেখে এক মধ্য তিরিশের যুবক চাপা পাজামা ও কুর্তা পরে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন অন্যদের থেকে সে অনেকটাই আলাদা। এই ব্যক্তি অনির্বাণ দত্ত না হয়ে যায় না। আদিত্য তার ভূতপূর্ব স্ত্রীকেও ঘরের মাঝখানে আবিষ্কার করল। অনেকের মধ্যে সে মিশে আছে। ময়লা রং, অসম্ভব লাবণ্যময় মুখশ্রী, যেন নিজেকে ভিড়ের ভিতর লুকিয়ে রাখতে চায়। আদিত্য ভাবছিল, সুভদ্র মাজির চরিত্রচিত্রণ কী নিখুঁত।

এছাড়া অসীম দত্তর পাশে একজন সাফারি স্যুট পরা বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক পেছনে আরও একজন। বোঝাই যাচ্ছে এরা অসীম দত্তর দেহরক্ষী।

শুভ্র দত্তর বক্তৃতা শেষ হয়ে আসছে। সে বলছিল, ‘আমি আর আপনাদের বেশি সময় নেব না। আমাদের পরম-প্রিয় অসীম দত্তকে তাঁর জন্মদিনের কেক কাটার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করব।’

অসীম দত্ত কেক কাটতে যাচ্ছিলেন। কী মনে হতে প্লাস্টিকের ছুরিটা নামিয়ে রেখে শুভ্র দত্তর কাছ থেকে মাইক্রোফোনটা চেয়ে নিলেন।

 ‘তোমরা আমার জন্যে যে আয়োজনটা করেছ তাতে আমার যে কী আনন্দ হয়েছে বলে বোঝাতে পারব না। তোমরা আমার আপনজন। যদিও একা একা থাকি, তোমাদের কথাই সব সময় মনের মধ্যে ঘোরে। বিশেষ করে আমার নাতি এবং নাতনি যে উদ্যোগ নিয়ে এমন একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে তাতে আমার গর্বের শেষ নেই। তোমাদের ভাল হোক, তোমাদের সকলের খুব ভাল হোক।’

অসীম দত্ত কিছুক্ষণ থামলেন। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে আবার যখন বলতে শুরু করলেন তখন তাঁর গলার স্বরটা বদলে গেছে।

‘এই এত আনন্দের মধ্যে একটা ব্যাপার কিন্তু আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। তোমরা সকলেই জান কিছুদিন আগে কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। আমি বরাত জোরে বেঁচে গেছি। কে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল? কে আমার মৃত্যু চাইতে পারে? কে আমার মৃত্যুতে লাভবান হতে পারে? আমার চেনা কেউ? আমার কোনও নিকটজন? এইসব প্রশ্ন দিনের পর দিন আমাকে ভাবিয়েছে। সত্যি বলতে কি, একটা ভয়ও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যে আমাকে একবার খুন করার চেষ্টা করেছিল সে কি আর একবার চেষ্টা করবে না? দেখতেই পাচ্ছ, এখন আমাকে সিকিউরিটি নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এছাড়া আমার একজন গেস্ট সস্ত্রীক এখানে উপস্থিত আছেন।’

অসীম দত্ত হাত নেড়ে আদিত্যদের কাছে ডাকছেন। আদিত্য আর কেয়া তার কাছে পৌঁছবার পর অসীম দত্ত দুজনকে পাশে দাঁড় করিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।

‘আলাপ করিয়ে দিই ইনি আমার গেস্ট আদিত্য মজুমদার। পাশে ওঁর স্ত্রী। যারা আদিত্য মজুমদারকে চেনে না তাদের বলি, ইনি একজন বিখ্যাত বেসরকারি গোয়েন্দা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটা জটিল রহস্য সমাধানে পুলিশকে সাহায্য করেছেন। তোমরা কেউ কেউ হয়তো এর নাম খবর কাগজে দেখে থাকবে।’

অসীম দত্ত দম নেবার জন্য একটু থেমেছেন। ঘরে অখণ্ড নীরবতা।

‘যে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল তাকে ধরার জন্য আমি আদিত্য মজুমদারের শরণাপন্ন হয়েছি। এখানে আমরা যে ক’দিন আছি, আদিত্যবাবু তোমাদের সকলের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবেন। ওঁর সঙ্গে কোঅপরেট করার জন্য তোমাদের সকলকে অনুরোধ করছি।’

ঘরে একটা গুঞ্জন উঠেছে। মনে হচ্ছে এই রিসর্টে বেড়াতে এসে আদিত্যর গোয়েন্দাগিরি সহ্য করতে অনেকেই রাজি নয়।

‘তোমরা আর একটু ধৈর্য ধরে শোনো। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। যে আমাকে মারার চেষ্টা করেছিল সে কিন্তু পরের বার সফল হতেই পারে। যদি সে সফল হয়, মানে আমি যদি সত্যি সত্যি খুন হয়ে যাই, খুনিকে ধরার ভার আমি আদিত্যবাবুর ওপরেই দিয়ে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত, খুনি খুন করে পার পাবে না। আদিত্য মজুমদার তাকে ঠিক খুঁজে বার করবেন।’

একটু থেমে অসীম দত্ত বললেন, ‘এবার আমি কেক কাটব।’

ঘরের মানুষগুলোর ভেতর সেই গা-ছাড়া, হালকা ভাবটা আর নেই। অসীম দত্তর কথাগুলো পরিবারের সকলের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে। আদিত্যর নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। সেই ভারী পরিবেশেই কেক কাটা হয়ে গেল। স্বাতী মল্লিক তার দাদুর মুখে এক খণ্ড কেক পুরে দিচ্ছে। কয়েকজন বেয়ারা ছোট ছোট কাগজের প্লেটে কেকের টুকরোগুলো অতিথিদের হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে। শুভ্র দত্ত আবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়েছে। ফটোগ্রাফার নিষ্ঠাভরে ছবি তুলে যাচ্ছে।

‘আমরা ডিনারের আগে একটু গান-বাজনার আয়োজন করেছি। কলকাতা থেকে সুমিত এবং ঐন্দ্রিলা তাদের ব্যান্ড নিয়ে আমাদের গান শোনাতে এসেছে। মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্টগুলো সেট আপ করতে এদের একটু সময় লাগবে। ততক্ষণ সকলে একটু বোসো। চেয়ার টেবিল সব খালি আছে।’

‘তুই আসল কথাটাই তো বললি না।’ স্বাতী শুভ্রর হাত থেকে মাইক্রোফোনটা ছিনিয়ে নিয়েছে। সে মাইক্রোফোনে বলল, ‘শুভ্র আসল কথাটা বলতে ভুলে গেছে। তোমাদের বাঁদিকের টেবিলে কিছু স্ন্যাক্স রাখা আছে। নিজেরাও নিতে পারো আবার ওয়েটারকে বললে সেও সার্ভ করে দেবে। তবে বেশি খেও না, তাহলে ডিনার খেতে পারবে না।’

পরিবারের লোকেরা সকলেই সকলকে চেনে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের ভেতরে আদিত্য আর কেয়া ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। মনে হয়, অসীম দত্ত সেটা বুঝতে পারলেন। তিনি আদিত্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমার সঙ্গে আমার টেবিলে বসবেন।’

অসীম দত্তর টেবিলটা একেবারে সামনের সারিতে। চারটে চেয়ারের মধ্যে একটাতে একজন বসে আছেন। দীপশিখা মজুমদার দত্ত। অসীম দত্তর ছোট ছেলে অনির্বাণ দত্তর স্ত্রী। উনিও বোধহয় অন্যদের সঙ্গে তেমন করে মিশতে পারছেন না। অসীম দত্ত অন্য টেবিলগুলোর দিকে পেছন করে বসলেন। তাঁর ঠিক উল্টোদিকে আদিত্য। যেদিকে খাবার রাখা আছে সেই দিককার চেয়ারে কেয়া। দীপশিখা তার মুখোমুখি। অসীম দত্তর সঙ্গে আদিত্যরা টেবিলে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কালো স্যুট লাল টাই পরিহিত এক সুপুরুষ ব্যক্তি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘আলাপ করিয়ে দিই, এই রিসর্টের ম্যানেজার রঘুনন্দন পানিগ্রাহী, সংক্ষেপে রঘু। রিসর্ট চালানোর ব্যাপারে রঘুই আমার সব থেকে বড় বল-ভরসা।’ অসীম দত্তর মুখে স্মিত হাসি।

‘স্যার আমাকে স্নেহ করেন বলে এসব বলছেন। স্যার না থাকলে আমি কিছুই না।’ রঘু বিনয়ী গলায় বলল।

‘আপনার বাংলাটা কিন্তু চমৎকার।’ আদিত্য না বলে পারল না।

‘আমি প্রায় পনেরো বছর কলকাতায় চাকরি করেছি। বাংলা তো শিখতেই হয়েছে।’

‘রঘুর অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাব বলে ওকে ওর কাজের জায়গা থেকে জোর করে তুলে আনলাম। ও কোথায় কাজ করত জানেন?’

প্রশ্নটা করে অসীম দত্ত নিজেই উত্তরটা দিতে গিয়ে কলকাতার একেবারে প্রথম সারির একটা হোটেলের নাম করলেন। আদিত্য আন্দাজ করল, জোর করে নয়, বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে রঘুনন্দনকে এখানে তুলে আনা হয়েছে।

‘আপনারা কী খাবেন স্যার? আমাকে বলে দিলে আমি ওয়েটারের হাত দিয়ে খাবারটা পাঠিয়ে দিতে পারি। কিংবা ওই টেবিলে ফুড কাউন্টার আছে। ওখানে ফুড আইটেমগুলো ডিসপ্লে করা আছে। গেলেই দেখতে পাবেন। দেখে কী খাবেন সেটা চুজ করা হয়ে গেলে ওখানে যে ছেলেটা ডিউটি করছে তাকে বলবেন খাবারগুলো এক নম্বর টেবিলে পাঠিয়ে দিতে।’

আদিত্যর একটু খিদে খিদে পাচ্ছে। বিকেলে যে ফিশ অ্যান্ড চিপসটা খেয়েছিল সমুদ্রের ধারে হেঁটে সেটা প্রায় হজম হয়ে গেছে। সে জানে কেয়ারও খিদে পেয়েছে কারণ এই নিয়ে একটু আগেই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।

‘আমি একটা সুইট ফ্রেশ লাইম সোডা খেতে পারি?’ দীপশিখা নিচু গলায় বলল।

‘নিশ্চয় ম্যাডাম। আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর কিছু খাবেন না?’

‘চিকেন স্যান্ডউইচ খাও। এরা এটা খুব ভাল করে।’ অসীম দত্ত তাঁর বিবাহবিচ্ছিন্ন-সম্ভবা পুত্রবধূকে বললেন। তারপর তার সম্মতির অপেক্ষা না করেই রঘুনন্দনকে বললেন, ‘শোনো, এই ম্যাডামের জন্যে দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ পাঠিয়ে দাও।’

‘আর আপনারা কী খাবেন স্যার?’ রঘুনন্দন একবার আদিত্যর দিকে তাকাল, আর একবার কেয়ার দিকে।

‘আমি বরং গিয়ে দেখি কী খাওয়া যায়।’ আদিত্য দাঁড়িয়ে উঠে বলল।

‘আমার জন্যেও কিছু নিয়ে এস। বুঝে।’ কেয়ার ধারণা আদিত্যর মতো পছন্দ সে নিজে করতে পারবে না। আদিত্য অনেক খাবারের নাম জানে যেগুলো কেয়া চেনেই না।

‘আপনার জন্যে স্যার?’ রঘুনন্দন অসীম দত্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘একটা ব্ল্যাক কফি পাঠিয়ে দাও। এখন আর কিছু খাব না।’

‘ঠিক আছে স্যার।’

ফুড কাউন্টারে তেমন ভিড় নেই। মাত্র একজন আদিত্যর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য তাকে চিনতে পারল। অনির্বাণ দত্ত। খাবার অর্ডার দিয়ে পেছন ফিরে আদিত্যকে দেখে সে ভুরু কোঁচকাল।

তারপর মুখে ব্যাঙ্গের হাসি এনে কেটে কেটে বলল, ‘আ হা, মিস্টার স্লিউথ, নাইস টু সি ইউ।’

আদিত্য উত্তর দিল না। উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। সে নিবিষ্ট চিত্তে টেবিলে ডিসপ্লে করা খাদ্যসম্ভারের দিকে তাকিয়ে ছিল।

উত্তর না পেয়ে অনির্বাণ দত্তর বোধহয় ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। সে তীক্ষ্নস্বরে বলল, ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট স্লিজি, স্নিকি, স্লাইমি বামস লাইক ইউ অ্যামং আস।’ বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে হনহন করে চলে গেল। আদিত্য দেখল, লোকটা একাই একটা টেবিলে গিয়ে বসেছে। আদিত্য মুচকি হেসে খাদ্য নির্বাচনে মন দিল। খাবার বাছতে বাছতে আদিত্য লক্ষ করল, অসীম দত্তর জামাই জয়ন্ত মল্লিক ব্যাঙ্কোয়েট হলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।

আদিত্য যখন তার টেবিলে ফিরে এল, অসীম দত্ত চেয়ারে নেই আর কেয়া দীপশিখার সঙ্গে মশগুল হয়ে গল্প করছে। টেবিলে অসীম দত্তর কফি, দীপশিখার আধ-খাওয়া স্যান্ডউইচ এবং ফ্রেশ লাইম সোডা।

আদিত্য ফিরে এসেছে দেখে কেয়া উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জান, দীপশিখা আমাদের কলেজেই ইকনমিক্স পড়ত। তবে আমার থেকে বারো বছরের জুনিয়ার। তাছাড়া আমাদের কলেজ হোস্টেলের পাশেই ওদের বাড়ি। আমাদের যেসব প্রফেসর অঙ্ক পড়াতেন, তাদের অনেকে ওদেরও পড়িয়েছেন।’

আদিত্য আর কিছু উত্তর ভেবে না পেয়ে বলল, ‘বাঃ।’ তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘অসীম দত্ত গেলেন কোথায়?’

‘ওঁর মেয়ে এসে ওঁকে ডেকে নিয়ে গেল। ওই তো ওই কোণে দাঁড়িয়ে উনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন।’ কেয়া মনে হচ্ছে অসীম দত্তর পরিবারের অনেককে চিনে ফেলেছে।

আদিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ব্যাঙ্কোয়েট হলের এক কোণে শ্বেতা মল্লিক হাত পা নেড়ে তার বাবাকে কীসব যেন বোঝাচ্ছে আর তার বাবা অসহায় মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন পালাতে পারলে বেঁচে যায়।

খাবার এসে গেছে। একটি করে স্লাইডার, অর্থাৎ ছোট হ্যামবারগার, একটি করে চিংড়ির কাটলেট এবং এক পিস করে প্লাম কেক। সঙ্গে আদিত্যর জন্য চা, কেয়ার জন্য সুইট ফ্রেশ লাইম সোডা।

‘তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছ আমি সুইট ফ্রেশ লাইম খেতে চাইছি। কী করে বুঝলে গো?’ আদিত্যর পছন্দে কেয়া খুব খুশি।

‘আপনারা চিকেন স্যান্ডউইচটা খেলে পারতেন। সত্যিই ভাল করেছে।’ দীপশিখা কেয়ার সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গ হয়েছে।

মাইক্রোফোনটা হঠাৎ জেগে উঠল। টেস্টিং চলছে। এবার বোধহয় গান শুরু হবে। অসীম দত্ত এখনও মেয়ের খপ্পর থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁর কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য খেয়াল করল, অসীম দত্তর বড় ছেলে অনিকেত দত্ত হল থেকে বেরিয়ে গেল। জয়ন্ত মল্লিক এখনও ফেরেনি। অনির্বাণ দত্ত তার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ভাইপো-ভাগ্নির টেবিলে বসেছে। অনির্বাণের উপস্থিতিতে ওদের দুজনকেই কিছুটা অস্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে। অসীম দত্তর দুজন দেহরক্ষী ঘরের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে সবার ওপর নজর রাখছে।

‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন, ভাইও আউর বহেনও, দাদারা ও দিদিরা, গুড ইভিনিং, শুভশাম, শুভসন্ধ্যা। আমি সুমিত। আমি এবং আমার পার্টনার ঐন্দ্রিলা কলকাতা থেকে আপনাদের গান শোনাতে এসেছি।’ গায়ক ছেলেটি হাতে মাইক্রোফোন তুলে নিয়েছে।

গায়কের গায়ে ঝলমলে কোট, গলায় গিটার ঝুলছে। তার সঙ্গী মেয়েটির পরনে ঝলমলে পোশাক। যেরকম সিনেমায় দেখা যায়। আদিত্য ভাবছিল, মাইক্রোফোনের আওয়াজটা আর একটু কম হলে ভাল হত। কতক্ষণ এই আওয়াজ সহ্য করতে হবে কে জানে।

‘আজ যার জন্মদিন তার জন্য আমরা কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করব। তারপর অন্য গান গাইব।’

রবীন্দ্রসঙ্গীত? সেরেছে। আদিত্য মনে মনে ভাবল। গানের আগে মিউজিক শুরু হয়ে গেছে। অসীম দত্ত ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসলেন। কফির কাপটা হাত দিয়ে দেখলেন।

‘ঠান্ডা হয়ে গেছে।’ দীপশিখা বলল। সে হাত নেড়ে নিকটবর্তী ওয়েটারকে ডাকার চেষ্টা করছে।

গান শুরু হল। ছেলেটি গাইছে, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’। আদিত্য একটু অবাক হয়েই লক্ষ করল ছেলেটার গলাটা বেশ সুরে। তার ধারণা ছিল এইসব অনুঠানে গায়ক-গায়িকাদের গলায় কিছু খামতি থাকে যে খামতিগুলো চড়া মিউজিক বাজিয়ে ঢাকতে হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেশ চড়া। এতটাই চড়া যে মিউজিকের ধাক্কায় ছেলেটার গলার আওয়াজটা মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে। আদিত্যর মনে হল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক গায়ককে সাহায্য না করে তার অসুবিধে করছে। অসীম দত্তর জন্যে গরম কফি এসেছে। আদিত্য বেয়ারাকে তার নিজের জন্যে এক কাপ চা আনতে বলল। আদিত্যর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন ওঠাটা ঠিক হবে না।

আগের গানটা শেষ হয়ে আবার একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হল। এবার মেয়েটা গাইছে। ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’। মেয়েটার গলাটা সরু, রিনরিনে। প্রথাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মতো নয়। কিন্তু তাতে আদিত্যর কিছু যায় আসে না। আদিত্য খেয়াল করল এর গলাটাও বেশ সুরে। শুধু সঙ্গের মিউজিকটা আর একটু চাপা হলে ভাল হত।

রবীন্দ্রসঙ্গীত শেষ হয়ে এখন হিন্দি ফিলমের গান শুরু হয়েছে। বর্তমান বলিউডের গান। আদিত্য এসব গান কোনও দিন শোনেনি, শুনতে চায়ও না। কেয়া চাপা গলায় দীপশিখার সঙ্গে গল্প করে যাচ্ছে। অনির্বাণ দত্ত ভাইপো-ভাগ্নির টেবিল থেকে উঠে গিয়ে আবার একা একা নিজের টেবিলে বসেছে। মনে হয় ভাইপো-ভাগ্নি তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। অসীম দত্ত আবার উঠে গেছেন। তিনি এখন তাঁর নাতি নাতনির সঙ্গে বসে গল্প করছেন। সুদীপ-ঐন্দ্রিলা জুটি ষাট-সত্তর দশকের বলিউডের গান গাইছে। সেসব গান শুনতে আদিত্যর রীতিমতো ভালো লাগছে। অনিকেত দত্ত ফিরে এসেছে। স্ত্রী এবং বোনের সঙ্গে এক টেবিলে বসেছে। কিন্তু জয়ন্ত মল্লিক এখনও ফিরল না।

সাড়ে নটার সময় সঙ্গীতানুষ্ঠান শেষ হল। রঘুনন্দন পানিগ্রাহী মাইক হাতে নিয়ে বলল, ডিনার রেডি। ডিনার খাবারও একই ব্যবস্থা। টেবিলে বসে অর্ডার দেওয়া যায় আবার উঠে ফুড কাউন্টারে গিয়েও অর্ডার দেওয়া যায়। ফুড কাউন্টারে চার-পাঁচজনের লাইন পড়েছে।

কেয়া আদিত্যকে বলল, ‘একটু বসি? ভিড় কমলে গিয়ে দেখব কী খাওয়া যায়?’

আদিত্য ঘাড় নাড়ল। দীপশিখা বলল, আমিও তখন আপনাদের সঙ্গে যাব।’

টেবিলের ওপর অসীম দত্তর মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। ওটা নিশ্চয় সাইলেন্ট মোডে আছে তাই কোনও রিং শোনা যাচ্ছে না।

আদিত্য দেখল মোবাইলে একটা নম্বর ফুটে উঠেছে। তার মানে যে ফোন করছে তার ফোন অসীম দত্তর মোবাইলে সেভ করা নেই। তবু নম্বরটা দেখে অসীম দত্তকে একটু চিন্তান্বিত মনে হল। অসীম দত্ত ফোন ধরার পর আদিত্য শুধু এক দিকের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে।

‘হ্যালো’

……

‘বুঝেছি।’

……

‘বুঝতে পারছি। ঠিক আছে।’

……

‘আমি এখনই যাচ্ছি।’

 মোবাইল রেখে দিয়ে অসীম দত্ত বললেন, ‘আমাকে মনে হচ্ছে একবার অফিসে যেতে হবে। কাল ইনগরেশনে উড়িষ্যার মিনিস্টার অফ ট্যুরিসম আসছেন। মন্ত্রী আসা মানে অনেক ঝামেলা। আমি দু-একটা কাজ সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছি। আপনারা ডিনার শুরু করে দিন।’

‘আপনার অফিসটা কত দূরে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘কত দূরে আবার? এই রিসর্টের মধ্যেই। রিসেপশনের পেছনে আমার অফিস। আপনারা প্লিজ খেতে শুরু করুন। দীপশিখা তুমিও খেয়ে নাও। তোমাদের খাওয়া শেষ হবার আগেই আমি এসে পড়ব।’

অসীম দত্ত একজন দেহরক্ষীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অন্যজন রয়ে গেল। সেও মনে হল সঙ্গে যেতে চাইছে, কিন্তু, আদিত্য খেয়াল করল, অসীম দত্ত তাকে থাকতে বললেন।

শ্বেতা মল্লিক ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

মিনিট পাঁচেক পরে, যখন ফুড কাউন্টার কিছুটা ফাঁকা হয়েছে, আদিত্য উঠে দাঁড়াল, তার সঙ্গে কেয়া এবং দীপশিখাও।

দীপশিখা খাবার পছন্দ করছে। তার পেছনে কেয়া। সবশেষে আদিত্য। আদিত্য টের পেল তার পেছনে আরও দুজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের একজনের গা থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। আদিত্য পেছন দিকে না তাকিয়েই আন্দাজ করল, এ জয়ন্ত মল্লিক না হয়ে যায় না। এতক্ষণ নিশ্চয় রিসর্টের বারে ছিল। পরে সে খাবার অর্ডার দেবার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল, তার অনুমান নির্ভুল। মনে হচ্ছে, জয়ন্ত মল্লিকের বউ তাকে বার থেকে ধরে নিয়ে এসেছে।

বিরাট খাদ্যতালিকা। মোগলাই, পাঞ্জাবি, বাঙালি-ওড়িয়া, গোয়ান-কঙ্কনিজ ছাড়াও চিনে এবং ইয়োরোপীয় নানারকম পদের ভিড়ে আদিত্য প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। সে কেয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী অর্ডার দিলে?’

‘গুলৌটি কাবাব, রুমালি রুটি, মাটন চাঁপ আর ফিরনি। আর কিচ্ছু না। চেনা জিনিস খাওয়াই ভাল।’

আদিত্য অনেক ভেবেচিন্তে প্লেন রাইসের সঙ্গে ডাল ও ঝিঙ্গা ফ্রাই অর্থাৎ চিংড়িমাছ ভাজা এবং কষা মাংসর সঙ্গে লুচি দিতে বলল। শেষে গরম গুলাব জামুন। দীপশিখা মজুমদার দত্ত চিনে খাবারের অর্ডার দিয়েছে।

তারা আবার টেবিলে গিয়ে বসেছে, কিন্তু খাবার তখনও আসেনি, স্বাতী মল্লিক মাইক্রোফোন হাতে সামনে এসে দাঁড়াল।

‘ডিনার খাবার পর কেউ চলে যেও না যেন। আমাদের প্রোগ্রামের লাস্ট পার্টটা এখনও বাকি আছে।’ সে ঘোষণা করল। ‘দাদুর জন্যে একটা বার্থ ডে গিফট আছে। সেটা দাদুর হাতে তুলে দিয়ে আমরা এই প্রোগ্রাম শেষ করব। কিন্তু দাদু গেল কোথায়?’ শেষ প্রশ্নটা আদিত্যদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে।

‘উনি একটু আগে ওঁর অফিসে গেলেন। বললেন, এক্ষুনি চলে আসবেন।’ আদিত্য গলাটা একটু তুলে বলল।

খাবার এল। খাবার প্রায় শেষ হতে চলল। অসীম দত্ত এখনও ফিরলেন না। খেতে খেতে আদিত্য লক্ষ করছিল অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার একটু পরে ফিরেও আসছে। বোধহয় তারা বাথরুমে গিয়েছিল। কারা কারা বাইরে গেল আদিত্য আর হিসেব রাখতে পারছে না। আদিত্যদের টেবিলে সকলের খাওয়া শেষ। ওরা তিনজনেই হাত ধুয়ে এসেছে। পৌনে এগারোটা বাজতে চলল। সকলেই উসখুস করছে। অসীম দত্ত এখনও ফিরছেন না কেন?

যে দেহরক্ষীটি অসীম দত্তর সঙ্গে গিয়েছিল সে দরজা ঠেলে ঢুকেছে। অন্য দেহরক্ষীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। এবার তারা দুজনেই আদিত্যর দিকে এগিয়ে আসছে। লোকগুলো মনে হয় অবাঙালি। একজন নিচু হয়ে আদিত্যর কানে ফিসফিস করে বলল, ‘কুছ গড়বড় মনে হচ্ছে সাব। দত্তা সাব অফিসের দরওয়াজা খুলছেন না। দরওয়াজা ভেতর থেকে বনধ আছে। সমুন্দরের দিক থেকে অফিসে ঢোকার অর একটা দরওয়াজা আছে। ওয় ভি অন্দর সে বনধ।’

‘ঘরে জানলা নেই? খিড়কি? জানলা দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না?’ আদিত্য উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘খিড়কি হ্যায়। রিসেপশান কি সাইড মে ভি হ্যায় অর সমুন্দর কি সাইড মে ভি। লেকিন খিড়কি সে কুছ দিখাই নেহি দেতা। দোনো খিড়কি মে ভিনিশিয়ান ব্লাইন্ড ফৈলা হুয়া হ্যায়।’

আদিত্য উঠে দাঁড়াল। রঘুনন্দন কি ঘরের মধ্যে আছে? না, তাকে দেখা যাচ্ছে না। দেহরক্ষীদের সঙ্গে আদিত্য বাইরে বেরোল। রিসেপশানে গিয়ে দেখল সেখানে একটি ছেলে ডিউটি করছে।

‘ম্যানেজার রঘুনন্দন পানিগ্রাহীকে এক্ষুনি রিসেপশানে চলে আসতে বলুন। বলুন এমার্জেন্সি।’ আদিত্য প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

মিনিট পাঁচেক পরে রঘুনন্দনের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে অসীম দত্তর অফিসের দরজা খোলা হল। ঘরে আলো থইথই করছে। একদিকে বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, রিভলভিং চেয়ার, তার উল্টোদিকে কয়েকটা গদি-মোড়া চেয়ার অতিথিদের জন্য। আপাতত সব ফাঁকা। টেবিলের পেছনে সুদৃশ্য ফাইল ক্যাবিনেট। কয়েকটা ফাইল, একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। অনুমান করতে কষ্ট হয় না ফটোগ্রাফটা অসীম দত্তর প্রয়াত স্ত্রীর। টেবিলের ওপর ক্যালেন্ডার, টাইমপিস, ডেস্কটপ, নোট লেখার ছোট কাগজ। টেবিলের এক কোণে অসীম দত্তর মোবাইল-চার্জারের এক দিকের মুখটা রয়েছে। প্লাগের দিকটা সকেটে লাগানো। কিন্তু মোবাইলটা নেই। দেখে মনে হয় মোবাইলটা চার্জ দিতে দিতে কেউ খুলে নিয়ে চলে গেছে।

ঘরের অপর প্রান্তে আর একটা দরজা। সেটা বন্ধ। এই দরজাটা খুললে মনে হয় সমুদ্রের দিকে যাওয়া যাবে। দরজাটার ঠিক সামনে, অসীম দত্ত চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। বুকের বাঁ দিকে একটা ক্ষত। আদিত্যর অভিজ্ঞ চোখ বলে দিচ্ছিল ক্ষতটা পিস্তলের গুলি থেকে হয়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় দেহে প্রাণ নেই।

(৩)

আদিত্য শুনেছিল ডিএসপি সাহেব নিজে তদন্ত করতে আসছেন। তাই সে লালবাজারে তার বন্ধু গৌতমকে বলে রেখেছিল যেন কলকাতা থেকে তার সম্বন্ধে কিছু ভাল ভাল কথা এদিকের ওপর মহলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে, আর কিছু নয়, তদন্তের সময় আদিত্য পুলিশের সঙ্গে থাকতে পারবে। অসীম দত্ত খুন হয়ে যাবার পর থেকে সে বিরাট হীনমন্যতায় ভুগছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই তো লোকটা তাকে নিয়োগ করেছিল। সেই কাজে আদিত্য শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নিজের সম্বন্ধে তার নিশ্চয় একটা অহেতুক উঁচু ধারণা হয়েছিল। ফলে সে কাজে মন দেয়নি। যার এই মর্মান্তিক পরিণতি। অসীম দত্তর মৃত্যুর পর থেকে আদিত্য কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না।

সারা রাত্তির আদিত্যর ঘুম হয়নি। কেয়া অবশ্য ভালই ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা ঘরে চা দিয়েছিল। চা খাবার পর কেয়া জানলা খুলে সমুদ্র দেখছে। আকাশে মেঘ আছে। হাওয়া এলোমেলো। তাই সমুদ্রও কিছু অবিন্যস্ত।

‘ব্রেকফাস্ট খেতে যাবে না?’ কেয়া জানলার ধার থেকে জিজ্ঞেস করল। আটটা থেকে রিসর্টের মূল ডাইনিং হলে বুফে ব্রেকফাস্ট শুরু হয়।

‘আমার খুব একটা খিদে হয়নি। সারা রাত ঘুম হয়নি তো। চল তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। একটা কফি খাব আর হয়তো একটা ডোনাট বা ক্রোয়াসঁ গোছের কিছু।’

‘ডিএসপি আসবে বলছিলে, এলেই তো তোমার ডাক পড়বে। আর কিছু খাবার তো সময়ই পাবে না। এখন একটু কিছু খেয়ে নাও।’

‘দেখি কী খাওয়া যায়। কিন্তু ডিএসপি এসে গেলে আমাকে বোধহয় সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হবে। তুমি একা একা কেন বোর হবে? গাড়িটা তো পড়ে আছে। কোনারক, নন্দন কানন এসব ঘুরে এসো না। পুরীতেও ঘুরে আসতে পার।’

‘একা যেতে আমার বয়েই গেছে। তার থেকে ঘরে বসে জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখব।’

ওরা নীচে গিয়ে দেখল অনেকেই ব্রেকফাস্ট খেতে শুরু করেছে। তার মধ্যে অসীম দত্তর পরিবারেরও কেউ কেউ আছে। একটা টেবিলে প্রদীপ এবং রাখি চক্রবর্তী ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন। আদিত্য আর কেয়া খাবার নিয়ে সেখানে বসল।

‘জানেন তো কাল রাত্তিরে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’ আদিত্য সাবধানী গলায় বলল।

‘জানি। রিসর্টের মালিক অসীম দত্ত খুন হয়েছে। একটু পরেই নাকি পুলিশের বড় কর্তারা আসবে। আমরা ভেবেছিলাম আজ কোনারক যাব। এখন মনে হচ্ছে যাওয়াটাই আটকে গেল।’ প্রদীপ চক্রবর্তীর গলায় বিরক্তি।

‘না, না। আমার মনে হয় না আপনাদের আটকাবে। আপনারা তো সাধারণ গেস্ট। অসীম দত্তকে চেনেনই না। অসীম দত্তর পরিবারের লোকেদের হয়তো পুলিশ আটকে রেখে জেরা করবে। আপনারা কীভাবে কোনারক যাবেন ভেবেছিলেন?’

‘একটা গাড়ি ভাড়া করতাম। রিসেপশানই ঠিক করে দেবে বলেছিল। কিন্তু এখন এই ডামাডোলের মধ্যে কি আর গাড়ি পাওয়া যাবে?’

‘প্রদীপবাবুদের সঙ্গে কোনারক ঘুরে আসবে নাকি?’ আদিত্য কেয়ার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল।

‘তুমি কী করবে?’ মনে হচ্ছে প্রস্তাবটা কেয়ার একেবারে অপছন্দ হয়নি। ওদের সঙ্গে যেতে সে খুব একটা অস্বস্তি বোধ করবে না। রাখি চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে।

‘আমাকে তো পুলিশের সঙ্গে থাকতে হবে।’

তারপর সে প্রদীপ চক্রবর্তীকে বলল, ‘আপনারা হয়তো জানেন না, অসীম দত্ত তার প্রোটেকশানের জন্য আমাকে এখানে আসতে বলেছিল। প্রোটেকশান তো দিতে পারিনি। এখন দেখি খুনিকে ধরার ব্যাপারে পুলিশকে কিছু সাহায্য করতে পারি কিনা।’ আদিত্যর মুখ বেজার।

একটু থেমে সে রাখির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একটা গাড়ি আছে। সেই গাড়িটা করে কেয়ার সঙ্গে আপনারা কোনারক, নন্দন কানন ঘুরে এলে আমার খুব ভাল লাগবে। কেয়া একা যেতে চাইছে না। আমিও এই অবস্থায় ওর সঙ্গে যেতে পারছি না। আপনারা ওর সঙ্গে গেলে সব দিক থেকে ভাল হয়। না হলে কেয়া একা ঘরে বসে বসে সারাদিন বোর হবে।’

কেয়া বা প্রদীপ-রাখি কাউকেই খুব বেশি জোর করতে হল না।

ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রিসর্টের ভিতরে পুলিশের তিনটে গাড়ি ঢুকে পড়েছে। কেয়াদের সি-অফ করে আদিত্য ততক্ষণ লাউঞ্জেই বসে ছিল।

কৃষ্ণগোপাল পধি, সংক্ষেপে কৃষ্ণ পধি, ডিএসপি, ডিআইবি, পুরী ডিস্ট্রিক্ট, নাদুস-নুদুস চেহারার হাসিখুশি একজন মানুষ। সমস্ত পুরী জেলায় তিনি যে পুলিশের তিন নম্বর ব্যক্তি, সেটা তাঁর হাভভাব দেখে বোঝা যায় না। অথচ আদিত্য দেখেছে তাঁর থেকে ঢের নিচু পদমর্যাদার কেউ কেউ কী প্রচণ্ড রোয়াব নিয়ে থাকে। তাছাড়া কৃষ্ণ পধি বহুদিন পুরী জেলায় চাকরি করছেন এবং চাকরিসূত্রে বাঙালি পর্যটকদের ঝক্কি সামলেছেন। ফলে বাংলা ভাষাটা তিনি শুধু যে বুঝতে পারেন তাই নয়, মোটামুটি বলতেও পারেন।

সাধারণ খুন-টুন হলে ডিএসপি সাহেবের নিজের আসার কথা নয়। কিন্তু অসীম দত্তর খুনটা হাই প্রোফাইল মার্ডার। শুধু উড়িষ্যা বা পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা দেশের মিডিয়াতে বড় করে বেরিয়েছে। উপরন্তু এখানে পরের দিন মন্ত্রীর আসার কথা ছিল। যে রিসর্ট উদ্বোধনে মন্ত্রীর আসার কথা সেখানে আগের দিন রিসর্টের মালিক নিজেই খুন হয়ে গেলে খবরটা তো গুরুত্ব পাবেই। তাই ডিসপি সাহেব নিজেই তদন্তে এসেছেন। সঙ্গে স্থানীয় থানার দারোগাবাবুকেও অবশ্য নিয়ে এসেছেন। দারোগাটির বয়স বেশি নয়, চল্লিশের এদিক-ওদিক। নাম প্রশান্ত পণ্ডা। বোধহয় ডিএসপি সাহেব পথ বাতলে চলে গেলে প্রশান্ত পণ্ডা সেই পথে আরও বিশদ অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে।

‘আজ সকালে কলকাতা থেকে অ্যাডিশনাল কমিশানার সাহেব নিজে আমাকে ফোন করেছিলেন। আপনার কথা অনেকবার বললেন। আপনাকে আমাদের সঙ্গে পেয়ে খুব ভাল হল।’ ডিএসপি কৃষ্ণ পধি জানালেন।

প্রয়াত অসীম দত্তর অফিসে বসে কথা হচ্ছিল। ‘আপনি তো অসীম দত্তকে আগে থেকে চিনতেন। আপনি যেটুকু জানেন, জানালে আমাদের কাজের খুব সুবিধা হয়।’ কথাগুলো বলে ডিএসপি সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।

এই অনুরোধটা যে আসবে আদিত্য আন্দাজ করেছিল। তাই সে মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। অসীম দত্ত সম্বন্ধে সে যেটুকু জানে সেটা বলতে মিনিট পনেরো লাগল। সুভদ্র মাজির ফাইল থেকে সে যে নোট নিয়েছিল তার কথাও বলল। নোটগুলো সে তার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আদিত্য ডিএসপি সাহেবকে বলল, ‘আপনি আমার এই নোটগুলো ফটোকপি করে নিতে পারেন। এই রিসর্টেই নিশ্চয় ফটোকপির ব্যবস্থা আছে।’

একটি কন্সটেবল নোটগুলো নিয়ে ফটোকপি করার জন্য রিসেপশনে চলে যাবার পর কৃষ্ণ পধি বললেন, ‘প্রথমেই যাঁরা বডিটা দেখেছেন আপনি তাদের একজন। খুনটা কীভাবে হয়েছে আপনার মনে হয়?’

‘দেখুন, এটা পরিষ্কার যে খুনি অসীম দত্তর চেনা। সে সমুদ্রের দিকের দরজা দিয়ে এসেছিল। অসীম দত্তই তাকে দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ডিনারের ঠিক আগে অসীম দত্তর একটা ফোন এসেছিল। আমরা তার সাক্ষী। ফোনটা খুনির হবারই বেশি সম্ভাবনা। ফোনে কথা বলতে গিয়ে অসীম দত্তকে খানিকটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। আমরা অবশ্য একদিকের কথাগুলোই শুনেছি।বেশিক্ষণ কথা হয়নি। ফোনটা নামিয়ে রেখে অসীম দত্ত বেরিয়ে গেলেন।’

‘অসীম দত্ত যখন বেরিয়ে গেলেন তখন আপনার কিছু অড মনে হয়নি?’

‘আমার দু’টো জিনিস অড মনে হয়েছে। একটা অসীম দত্ত বেরিয়ে যাবার সময়। আর একটা তাঁর মৃতদেহটা দেখার সময়। অসীম দত্ত যখন বেরিয়ে গেলেন তখন একজন বডিগার্ড তাঁর সঙ্গে গেল। অন্যজনও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অসীম দত্ত নিজেই তাকে বারণ করলেন। এটা কেন করলেন? একজনের বদলে দু’জন বডিগার্ড থাকলে তো আরও ভাল হত। বিশেষ করে অফিসের দু’দিকে যখন দু’টো দরজা, তখন এটাই তো স্বাভাবিক যে দু’জন দু’টো দরজা পাহারা দেবে।’

‘আর দ্বিতীয় অড জিনিস?’

‘দ্বিতীয় অড ব্যাপারটা হল, খুনি অসীমবাবুর মোবাইলটা সঙ্গে নিয়ে গেছে। আমি ধরে নিচ্ছি ওটা খুনিই নিয়ে গেছে, কারণ আর কেউ তো ওই ঘরে ঢোকেনি।’

‘এটা কেন অড বলছেন? মোবাইলটাতে খুনির নম্বরটা রেকর্ডেড আছে। সেই নম্বরটা সে পুলিশকে জানাতে চায় না। তাই সে মোবাইলটা নিয়ে গেছে।’

‘তাই কি?’ আদিত্য নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আজকাল পুলিশের হাতে যা টেকনোলজি আছে তাতে অনায়াসে জানা যায় গত এক মাস কোন কোন নম্বর থেকে অসীম দত্তর মোবাইলে ফোন এসেছিল। এটা কি খুনি জানত না? যদি জানত, তা হলে সে মোবাইল নিয়ে যাবার ঝামেলাটা করতে গেল কেন?’

‘মোবাইল নেওয়াটাকে ঝামেলা বলছেন কেন?’

‘এই জন্যে বলছি, খুনি নিশ্চয় বেশ তাড়ার মধ্যে ছিল। এবং সে নিশ্চয় আগে থেকে জানত না যে মোবাইলটা সে টেবিলের ওপরেই পেয়ে যাবে। বস্তুত, সে যত বেশিক্ষণ অফিস-ঘরের মধ্যে থাকছে তত তার ধরা পড়ার রিস্ক। সে জেনেশুনে রিস্কটা নিল কেন?’

‘হয়তো পুলিশের টেকনোলজির ব্যাপারে খুনির খুব ভাল ধারণা নেই, তাই সে রিস্কটা নিয়েছিল।’ ডিএসপি সাহেব তাঁর তত্ত্বে অনড়।

‘হতেও পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে আরও কিছু আছে। হয়তো মোবাইলটার ভেতর এমন কিছু ছিল যেটা খুনি পুলিশকে জানতে দিতে চায় না। যদি দ্যাখেন, যে-নম্বরটা থেকে অসীম দত্তর মোবাইলে শেষ কলটা এসেছিল সেটা ট্রেস করা যাচ্ছে না, তা হলে ধরে নিতে হবে পুলিশের টেকনোলজির ব্যাপারটা খুনি ভালই জানে।’

‘দেখা যাক। সেটা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু আপনি প্রথম যে ব্যাপারটা অড লেগেছে বললেন তার কোনও এক্সপ্লানেশন কি আপনার মাথায় আছে?’

‘একটা পসিবল এক্সপ্লানেশন আমি ভেবেছি। অসীম দত্ত খুনির সঙ্গে গোপনে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তিনি খুনিকে সমুদ্রের দিকের দরজা দিয়ে আসতে বলেছিলেন যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। সেইজন্যে তিনি সমুদ্রের দিকের দরজায় কোনও গার্ড রাখেননি। একজন সিকিউরিটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন যে শুধু রিসেপশানের দিকের দরজায় গার্ড দিতে পারবে।

‘খুনি এসে সমুদ্রের দিকের দরজাটায় টোকা দিল। অসীম দত্তর সঙ্গে খুনির আগেই কথা হয়ে গিয়েছিল যে সে সমুদ্রের দিকের দরজাটা দিয়ে ঢুকবে। সেই অনুযায়ী অসীম দত্ত দরজা খুলে দিলেন। খুনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করল। সমুদ্রের গর্জনে গুলির শব্দটা চাপা পড়ে গেল। তারপর খুনি ঘরের মধ্যে ঢুকে অসীম দত্তর মোবাইলটা পকেটে পুরে নিল। মোবাইলটা টেবিলের ওপরে ছিল। অসীম দত্ত সেটাতে চার্জ দিচ্ছিলেন। মোবাইলটা নিয়ে খুনি সমুদ্রের দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দরজার লকটা টিপে দিয়ে বাইরে থেকে টেনে দিল। দরজা লক হয়ে গেল। আমার মনে হয়, মোটামুটি এইরকমই একটা কিছু ঘটেছিল।’

‘আপনি যেভাবে ব্যাপারটা বললেন তাতে মনে হচ্ছে ঠিক এটাই ঘটেছিল। আর কিছু কি আপনার নজরে এসেছে?’ কৃষ্ণ পধির গলাটা চিন্তান্বিত শোনাচ্ছে।

‘আর একটা জিনিস নজরে এসেছে। যদিও ব্যাপারটা নিয়ে আমি এখনও শিয়োর নই তবু আপনাকে জানিয়ে রাখা ভাল।’ আদিত্য একটু ইতস্তত করে বলল।

‘বলুন না। বলুন, বলুন।’

‘মৃতদেহটা দেখে মনে হল গুলিটা একটা ছোট হ্যান্ডগান থেকে করা হয়েছিল। খুব সম্ভবত .৩২পিস্তল। অবশ্য ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা এলে শিয়োর হওয়া যাবে।’

‘সেটা তো হতেই পারে। কিন্তু .৩২ পিস্তল দিয়ে খুন যদি হয়ও তাতে কী প্রমাণিত হল?’ ডিএসপি সাহেব কিঞ্চিত অধৈর্য।

‘হ্যাঁ, সেটা তো হতেই পারে। যদি হয়, তাহলে বলতে হবে আগের বার অসীম দত্তকে যে ধরনের পিস্তল দিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, একই ধরনের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে এবার তাকে খুন করা হল। অর্থাৎ এটা খুবই সম্ভব যে দু’টো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি একই অস্ত্র থেকে গুলি চালিয়েছিল।’

‘হুঁ, বুঝলাম।’ ডিএসপি সাহেব মাথা নাড়লেন।

‘কিন্তু দু’টো জিনিস বোঝা যাচ্ছে না।’ কথাটা বলে আদিত্য চিন্তায় ডুবে গেল।

‘কী জিনিস?’

‘মাস দেড়েক আগে যে গুলিটা অসীম দত্তর মোবাইল পেরিয়ে তাঁর শরীরে প্রবেশ করতে পারেনি সেটা ১৯৫২/৫৩ সালে তৈরি একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন .৩২ রিভলভর। সম্ভবত ওই অস্ত্রটা দিয়েই গত রাত্তিরে অসীম দত্তকে খুন করা হয়েছে। প্রথম কথা হল, খুনি এত প্রাচীন একটা অস্ত্র ব্যবহার করছে কেন? অস্ত্রটা সম্ভবত বেআইনি, অর্থাৎ কারোর নামে ওটার লাইসেন্স নেই। বেআইনি অস্ত্র বাজারে নিশ্চয় ভাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু ভাড়া করতে গেলে, নাইন এম এম চাইনিজ রিভলভর জাতীয় আরও আধুনিক কিছু ভাড়া পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এত পুরোনো অস্ত্র এবং তার কার্তুজ কি বাজারে ভাড়া পাওয়া যাবে? যদি না যায়, তাহলে খুনি এই অস্ত্রটা পেল কোথায়?’ আদিত্য থামল।

কনস্টেবল, আদিত্যর নোটগুলো ফটোকপি করে নিয়ে এসেছে। সে ফটোকপিটা ডিএসপি সাহেবের হাতে দিয়ে অরিজিনালটা আদিত্যকে ফিরিয়ে দিল। কাগজগুলো হাতে নিয়ে ডিএসপি সাহেব বললেন, ‘আর দ্বিতীয় কোন জিনিসটা বুঝতে পারছেন না?’

‘দ্বিতীয় ধাঁধাটা হল, অসীম দত্ত কেন খুনিকে দরজা খুলে দিলেন? তিনি ঘরপোড়া গোরু, একবার গুলি খেয়ে অতি সাবধানী হয়ে গেছেন। তাহলে তিনি কেন খুনিকে তাঁর অফিসে ঢোকার সুযোগ করে দিলেন? তাহলে কি তিনি খুনিকে একেবারেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন? যদি ধরে নিই, তাঁর আত্মীয়দের কেউ তাঁকে খুন করেছেন, তাহলে খুঁজে বার করতে হবে কোন আত্মীয়কে তিনি সন্দেহের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন?’

‘বুঝলাম, বুঝলাম। আপনি আমাদের কাজ অনেকটা এগিয়ে দিচ্ছেন। আপনাকে শুধু আর দুটো জিনিস জিজ্ঞেস করব। এক, অসীম দত্তর মৃত্যুর পর কারা তাঁর সম্পত্তির মালিক হবেন? দুই, গতকাল রাত্তিরে অসীম দত্ত ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং অসীম দত্তর বডিগার্ড ব্যাঙ্কোয়েট হলে ফিরে আসা এই দু’টোর মধ্যে যে সময়টা, সেই সময়ে কারা কারা ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়েছিল আপনার কি মনে আছে?’

‘আপনার প্রথম প্রশ্নটা আমি অসীম দত্তকে করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তিনি তাঁর উইলে সমস্ত সম্পত্তি মেয়ে এবং ছেলেদের মধ্যে মোটামুটি সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। তবে নাতি এবং নাতনির জন্যেও আলাদা করে কিছু রাখা আছে। আর তাঁর ছোট ছেলের বউ-এর জন্যেও তিনি আলাদা করে কিছু রেখেছেন। তিনি এটাও বলেছিলেন, ছোট ছেলে যদি তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেই যায় তাহলে তিনি ছোট ছেলের অংশ ছোট বউমাকেই দিয়ে যাবেন। এবং এটা তিনি ছোট ছেলেকে জানিয়েও দিয়েছিলেন।’

‘আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর?’

‘আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া আর একটু কঠিন। আমার ধারণা, খাওয়ার পরে প্রত্যেকেই হাত-মুখ ধুতে বাইরে বেরিয়েছিলেন। আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন বাথরুমটা ব্যাঙ্কয়েট হলের বাইরে। সত্যি বলতে কি, কে কতক্ষণ বাইরে ছিল আমি খেয়াল করিনি। শুধু এইটা মনে আছে, দীপশিখা মজুমদার দত্ত মুখ ধুতে বেরিয়ে বেশ খানিকটা পরে ফিরেছিলেন। ফিরে এসে আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন, বন্ধ ঘরে বসে বসে ওঁর মাথা ধরেছিল বলে কিছুক্ষণ সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। দীপশিখাকে লক্ষ করেছিলাম কারণ উনি আমাদের টেবিলেই বসেছিলেন।’

ডিএসপি সাহেব কিছু বলার আগেই আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। কেয়া। আদিত্য কৃষ্ণ পধিকে ‘প্লিজ এক্সকিউজ মি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরল।

‘আমরা ফিরে এসেছি।’ কেয়ার গলায় চাপা উত্তেজনা।

‘সে কী! কেন? ফিরে এলে কেন?’ আদিত্য উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘কোনারকে গিয়ে রাখিদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মন্দিরের সামনে একটা স্ট্রাকচার রয়েছে যেটাতে উঠতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। মন্দিরটা এই স্ট্রাকচারটার পেছনে। রাখিদি ওই স্ট্রাকচারটাতে জোর করে উঠলেন। ওখানে ওঠা ওঁর উচিত হয়নি। ওপরে বিশেষ কিছু নেই। আমি ওঁকে সিঁড়ি ভাঙতে বারণ করলাম। উনি শুনলেন না। বললেন, ঠিক পেরে যাব। প্রদীপদাও বারণ করলেন। বললেন, হয়তো পারবে, কিন্তু দরকার কী? কারও কথা না শুনে উনি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন। তারপর আবার ওখান থেকে নেমে মন্দির দেখলেন। এবং তারপর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমাদের ফিরে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

‘এখন উনি কেমন আছেন?’

‘অনেকটা ভাল। আমি তো এতক্ষণ ওদের ঘরেই ছিলাম।’

‘তুমি এখন ঘরে যাবে তো? চাবি রিসেপশনে আছে।’

‘একটু ঘরে যাব। বাথরুমে যেতে হবে। লাঞ্চ খেয়েছ?’

‘খাইনি এখনও। তুমি?’

‘আমিও খাইনি। চল একসঙ্গে লাঞ্চ খাব। তুমি ঘরে যাও আমি একটু পরেই যাচ্ছি।’

‘তারপর আবার তো তোমাকে ডিএসপির সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে।’

‘ভাবছি, আজ বাকি দিনটা তোমার সঙ্গে কাটাব। দেখি ডিএসপি সাহেবের কাছ থেকে ছুটি পাই কিনা।’

‘সত্যি বলছ?’ কেয়া আদিত্যর কথাগুলো বিশ্বাসই করতে পারছে না।

একটু পরে আদিত্য অসীম দত্তর অফিসে ঢুকে বলল, সরি, ফোনে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। আপনাদের এখন কী প্ল্যান?’

কৃষ্ণ পধি ইন্সপেক্টার প্রশান্ত পণ্ডার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আগে লাঞ্চ খেতে হবে। তারপর অসীম দত্তর রিলেটিভদের ইন্টারোগেট করব। আপনি চাইলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন।’

‘আমি ভাবছিলাম আজ বিকেলে একটু পুরী ঘুরে আসব। আসলে আমার স্ত্রী তো একা একা খুব বোর হচ্ছে। ওর সঙ্গে একটু সময় কাটানো দরকার। তাই যদি আপনাদের সঙ্গে ইন্টারোগেশনের সময় না থাকি খুব অসুবিধে হবে? কাল সকালে বরং আপনাকে একটা ফোন করে আপনার অফিসে একবার ঘুরে আসব?’ আদিত্য কুণ্ঠিত গলায় বলল।

‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনি ঘুরে আসুন। হ্যাভ এ নাইস টাইম।’ ডিএসপি সাহেবকে দরাজ শোনাল। ‘কাল চলে আসবেন। আমি দশটার মধ্যে অফিসে পৌঁছে যাই।’

ঘরের দিকে আসতে আসতে আদিত্য ভাবছিল জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশের সঙ্গে থাকলে নিশ্চয় লাভ হত, কিন্তু এখন কেয়ার সঙ্গে সময় কাটাতে তার ভীষণ ইচ্ছে করছে। যে কাজটা এখানে বাকি রয়ে গেল সেটা কলকাতায় ফিরে পুষিয়ে দিতে হবে।

(৪)

এই ফেব্রুয়ারি মাসেই চড়া রোদ্দুর। আদিত্যরা ভেবেছিল ডাইনিং হলে লাঞ্চ খেয়েই বেরিয়ে পড়বে। রোদ্দুরের তেজ দেখে ভরসা হল না। সমুদ্রের ধারটা যেন ঝলসে যাচ্ছে। এখন কিছুটা বিশ্রাম করে নিয়ে বিকেলের দিকে বেরোনোটাই বুদ্ধির কাজ হবে।

ঘরে ফিরে, পোশাক পালটে কেয়া বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। বাংলা চ্যানেলে কী একটা পুরোনো উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখাচ্ছে। মিনিট তিনেক অলস চোখে টিভি দেখতে দেখতে আদিত্যর চোখ দু’টো ঘুমে ঢুলে এল। ঘুমের আর কী দোষ, কাল রাত্তিরে আদিত্যর একেবারে ঘুম হয়নি। যখন ঘুম ভাঙল তখন পৌনে চারটে বাজে। টিভি বন্ধ। কেয়া নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে।

আদিত্য রুম সার্ভিসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চা আসতে আসতে মনে হয় কেয়ার ঘুম ভেঙে যাবে।

‘কেমন বেড়ালে আজকে?’ একটু পরে চা খেতে খেতে কেয়াকে জিজ্ঞেস করল আদিত্য।

‘ভালই তো বেড়াচ্ছিলাম। রাখিদি জেদ করে অতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে না গেলে নন্দন কানন, উদয়গিরি খণ্ডগিরি সব দেখা হয়ে যেত। চা-টা খেয়ে ওদের একবার ফোন করতে হবে। রাখিদি কেমন আছে কে জানে?’

‘ওরা লোক কেমন?’ আদিত্য আলগোছে জিজ্ঞেস করল।

‘খুব ভাল লোক। বিশেষ করে রাখিদির তো তুলনাই হয় না। অত ভারী একটা অসুখ, তবু সব সময় মুখে হাসি লেগে আছে। প্রদীপদাও কিন্তু রাখিদিকে খুব সাপোর্ট দেয়। বউকে খুব ভালবাসে। তোমার মতো নয়। বউকে অন্যদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ডিএসপির সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় না।’ শেষের কথাগুলো কেয়া আদিত্যকে ঠেস দিয়ে বলল।

‘আরে না, না। আমিও বউকে যথেষ্টই ভালবাসি। তাই তো আজ বউকে নিয়ে পুরী বেড়াতে যাব।’ আদিত্য হাত বাড়িয়ে কেয়ার হাতটা ছুঁয়ে রয়েছে।

‘জান তো, ফেব্রুয়ারির শেষে রাখিদির একটা খুব বড় অপরেশন হবে। বম্বেতে একজন ডাক্তার আছেন, অরুণ কুলকার্নি। উনি দু’তিন মাসে একবার করে কলকাতায় এসে অপরেশন করেন। উনি নাকি সারা দেশে এক নম্বর। ওই অপরেশনটা যদি সাকসেসফুল হয় তাহলে রাখিদির আয়ু অনেকটা বেড়ে যাবে। আর সেটা না হলে কী হবে কেউ জানে না। রাখিদি এসব কথা হাসতে হাসতেই বলছিল। আমার তো শুনতে শুনতে চোখে জল এসে যাচ্ছিল।’

‘তোমার মনটা খুব নরম। এসব নিয়ে বেশি ভেবো না। ভেবে তো লাভ নেই। আমরা কিছুই করতে পারব না। তার থেকে তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমরা রওনা হয়ে যাই।’

বেরোনোর জন্যে তৈরি হতে হতে আদিত্য অন্য কথা ভাবছিল। অরুণ কুলকার্নির নাম সেও শুনেছে। বিরাট ডাক্তার। কিন্তু এক নম্বরের অর্থপিশাচ। ওকে নিয়ে আদিত্য একটা লেখা পড়েছিল। অবিশ্বাস্য সব অপরেশন করেছে। কিন্তু পুরো টাকা না পেলে অরুণ কুলকার্নি অপরেশন করে না। আর সেটাও অবিশ্বাস্য অঙ্কের একটা টাকা। ওকে দিয়ে অপারেশন করানোর টাকা প্রদীপ চক্রবর্তী পাচ্ছে কোথায়? প্রদীপ চক্রবর্তীকে দেখে মনে হয় না অনেক টাকা জমাতে পেরেছে। হয়তো স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে লোকটা বাড়ি-টাড়ি যা কিছু আছে সব বিক্রি করে দিচ্ছে। নাঃ, মানতেই হবে, প্রদীপ চক্রবর্তী বউকে ভালবাসে।

আদিত্যর দেবদ্বিজে ভক্তি নেই। কেয়ার আছে। অবশ্য ভক্তি না বলে ভয় বলাই সমীচীন। পুরীতে এসে জগন্নাথ মন্দিরে না গেলে ঠাকুর পাপ দিতে পারে এই ভয়ে কেয়া মন্দিরে যাবার কথা আগেভাগেই বলে নিয়েছে। অগত্যা আদিত্যকেও রাজি হতে হল।

 স্বর্গদ্বারের সামনে সমুদ্র সৈকতটা এতটাই ঘিঞ্জি এবং অপরিষ্কার যে ওখানে বসতে মন চাইল না। সৌভাগ্যবশত, স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে পুরী শহর আরও এগিয়ে গেছে। সমুদ্রের ধার দিয়ে নতুন রাস্তা হয়েছে নিউ মেরিন ড্রাইভ। এদিকটা এখনও অনেকটাই ফাঁকা। গাড়িটাকে খানিক দূর অবধি নিয়ে গিয়ে তারপর ছেড়ে দেওয়া হল। দরকার হলে পরে ডেকে নেওয়া যাবে। আদিত্য আর কেয়া এখন সমুদ্রের ধারে অনেকক্ষণ হাঁটবে। নিউ মেরিন ড্রাইভে অনেক নতুন হোটেল হয়েছে। গতবার যখন কেয়া পুরী এসেছিল তখন এগুলো ছিল না। এই ফেব্রুয়ারি মাসে বিকেলের আয়ু বেশি নয়, কিন্তু স্থান-মাহাত্ম্যের কারণে হাওয়ায় দাঁত নেই, শুধু লবণাক্ত আর্দতা আছে। তাই এই পড়ন্ত বিকেলেও সাহস করে কেউ কেউ সমুদ্রস্নানে নেমেছে।

আকাশ জুড়ে হাওয়ার রাখাল মেঘেদের গাভীর মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শ্যামলী, ধবলী, পাটলী সব মেঘ। তাদের দীর্ঘ ছায়া সমুদ্রে পড়েছে। আদিত্য দেখল, আদিগন্ত সমুদ্রে ছোট-বড় কত রকম ঢেউ। উঠছে, নামছে, ভাঙছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেন আকাশের মাঠে হাওয়া আর মেঘেদের খেলায় খুশি হয়ে বিরাট সমুদ্রটা হাততালি দিচ্ছে। এই সমুদ্রই আদিত্য দেখতে চেয়েছিল।

সূর্যটা পশ্চিমদিকের আকাশে টুপ করে ডুবে গেল। এবার একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসবে। আদিত্যর চা-কফি কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করছে। কথাটা সে কেয়াকে জানাতে কেয়া বলল, ‘একটু আগে আসার সময় একটা কফিশপ দেখলাম না? ওখানেই তো কফি খাওয়া যায়।’

খেয়াল করেনি, ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে। কফিশপ অবধি ফিরে যেতেই প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। কফিশপের দোরগোড়ায় পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়ে কেয়া বলল, ‘এখন যদি কফি খেতে ঢোকো, মন্দিরে গিয়ে আরতি দেখব কী করে?’

আদিত্য ভেবে দেখল কথাটা ঠিক। ঘড়িতে সোয়া ছটা বাজে। তারা রিসর্টের রিসেপশন থেকে জেনে এসেছে সাতটায় সন্ধ্যারতি। মন্দিরে বেশ ভিড় হয়। তাই একটু আগে আগে পৌঁছে যাওয়া ভাল। এখান থেকে গাড়িতে স্বর্গদ্বারের মোড় পর্যন্ত যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তারপর গাড়ির পক্ষে খুব তাড়াতাড়ি এগোনো শক্ত। মন্দিরের রাস্তায় সন্ধেবেলা খুব জ্যাম থাকে। ড্রাইভার বলেছিল, গাড়িটা স্বর্গদ্বারের কাছে রেখে রিকশা নিয়ে নিলে তাড়াতাড়ি হবে। সব মিলিয়ে আদিত্যর মনে হল কফি খাওয়ার প্ল্যানটা আপাতত পরিত্যাগ করাই ভাল। সে ফোন করে ড্রাইভারকে কফিশপটার সামনে চলে আসতে বলল।

রিকশায় যেতে যেতে আদিত্য ভাবছিল এটাই প্রকৃত ভারতবর্ষ। মন্দিরের রাস্তায় কাতারে কাতারে লোক চলেছে। দু-দিকে দোকান শাড়ি, গামছা, বাসনকোসন, খেলনাপত্র। চাল-ডাল, মশলাপাতির দোকানও আছে। দু-একটা দোকানে গরম জিলিপি ভাজছে। আদিত্যর দেখেই খেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কেয়াকে বললেই ধমক খেতে হবে সেই ভয়ে আদিত্য মনের ইচ্ছেটা মনেই চেপে রাখল। রাস্তার দু-ধারে ভিখিরিরা সার দিয়ে বসে ভিক্ষে চাইছে। পাশাপাশি অনেকে। টাফ কম্পিটিশন। তাদের পাশেই মস্ত হাঁড়ি নিয়ে বসেছে একজন ছানাপোড়া ও ক্ষীরমোহন বিক্রেতা। এক প্রৌঢ় পুণ্যার্থী রাস্তার মাঝখানে উবু হয়ে বসে একটা পেল্লায় ষাঁড়কে শসা খাওয়াচ্ছে। সাত-আটজন গৈরিক ধুতি-চাদর পরিহিত মুণ্ডিতমস্তক দীর্ঘ শিখাধারী পুরোহিত রাস্তার ধার দিয়ে লাইন করে চলেছে। দেখতে দেখতে মন্দির এসে গেল।

সন্ধারতিটা আদিত্যর বেশ ভালই লাগল। কেয়াদের বাড়ির এক পাণ্ডা আছেন, বৃদ্ধ মানুষ, নাম গোবিন্দগোপাল শৃঙ্গারী, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি আদিত্যদের সন্ধ্যারতি দেখার ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মন্দির থেকে বেরিয়ে আদিত্যকে আবার চা খাবার বাসনাটা পেয়ে বসল। কিন্তু মন্দিরের কাছাকাছি তেমন কোনও জায়গা পছন্দ হল না যেখানে কেয়াকে নিয়ে নিরিবিলিতে বসে এক কাপ চা বা কফি খেতে পারে। অগত্যা আবার স্বর্গদ্বার। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে সে কিছু ভাতের হোটেলের কথা বলল যেখানে সন্ধেবেলা কফি-টফিও পাওয়া যায়। কিন্তু সেরকম জায়গা আদিত্য ঠিক চাইছে না।

অবশেষে আদিত্যরা ঠিক করল নিউ পুরীর সেই কফিশপটাতেই আবার ফিরে যাবে। রাত্তির এমন কিছু হয়নি। সবে আটটা।

কফিশপের ভেতরটা প্রায়ান্ধকার। বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকলে প্রথমে কিছুই দেখা যায় না। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে ঘরের ভেতরের অবয়বগুলো একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আদিত্য দার্জিলিং চা খাবে, কেয়া কফি লাটে। আদিত্য ভেবেছিল সঙ্গে দুপ্লেট মাডকেক বলবে। কেয়া রাজি হল না। বলল, অনেক রাত্তির হয়ে গেছে। এখন কিছু খেলে রাত্তিরে ডিনার খেতে পারবে না।

এই কফিশপটার সব থেকে বড় আকর্ষণ হল এখানে জানলার ধারে বসে সমুদ্র দেখা যায়। অবশ্য সমুদ্র প্রায় পুরোটাই এখন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে, শুধু দু-একটা ঘর-ফেরতা নৌকোতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে।

আধো-অন্ধকারে দুটি ছায়ামূর্তি আদিত্যদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। একজন পুরুষ, একজন নারী। আদিত্য তাদের চেনে। কফিশপে তাদের উপস্থিতি আদিত্য আগেই খেয়াল করেছিল, কেয়াকে কিছু বলেনি। এবার তারা আদিত্যদের টেবিলের একেবারে সামনে চলে এসেছে।

মেয়েটি বলল, ‘আমাদের চিনতে পারছেন? আমি স্বাতী, অসীম দত্তর নাতনি। আমার সঙ্গে আমার মামাতো ভাই শুভ্র। আমরা এখানে একটু বসতে পারি?’

‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। বোসো তোমরা।’ আদিত্য কিছু বলার আগেই কেয়া বলে উঠল। ‘অন্ধকারে আমি তো প্রথমে তোমাদের চিনতেই পারিনি।’

‘কফি খাবে?’ দুজন বসার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘না, না। আমরা দু-বার কফি খেয়েছি। আর কফি খেলে রাত্তিরে ঘুম হবে না।’ শুভ্র তাড়াতাড়ি বলল। ‘আমরা আপনাদের সময় বেশি নষ্ট করব না। দু-একটা কথা বলেই চলে যাব।’

‘তোমরা মোটেই আমাদের সময় নষ্ট করছ না। তোমাদের সঙ্গে বসে কফি খেতে আমাদের খুব ভাল লাগবে।’ কেয়া বলল।

আদিত্যর চা এবং কেয়ার কফি লাটে এসে গেছে।

‘আচ্ছা, তোমরা ছাড়া পেলে কী করে? আজ তো ডিএসপি কৃষ্ণ পধি তোমাদের সকলকে ইন্টারোগেট করবেন বলেছিলেন। ইন্টারোগেশন শেষ হয়ে গেছে?’ আদিত্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আরে না, না। ইন্টারোগেশন আজ হয়নি। ডিএসপি সাহেবের কী একটা দরকারি কাজ পড়ে গেছে। কাল সকাল থেকে ইন্টারোগেশন শুরু হবে। আমাদের সবাইকে হোটেলে থাকতে বলেছে। অনেক বলে-টলে আজ আমাদের ছুটি করিয়ে নিয়েছি। আজ আমরা যেখানে খুশি যেতে পারি। তবে পুরীর মধ্যে। পুরীর বাইরে কোথাও যাওয়া যাবে না।’ স্বাতী গড়গড় করে বলে গেল। সে একটু তাড়াতাড়ি কথা বলে।

ইন্টারোগেশন হয়নি শুনে আদিত্য মনে মনে খুশি হল। কাল ইন্টারোগেশন হলে সে প্রথম থেকেই পুলিশের সঙ্গে থাকতে পারবে।

‘আমরা আপনাকে একটা ছোট্ট কথা বলতে এসেছি।’ শুভ্র আদিত্যর দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিতভাবে বলল। ‘যখন দেখলাম আপনারা এই রেস্টোরেন্টে ঢুকছেন, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করলাম আপনার সঙ্গে কথা বলতেই হবে।’

‘বল কী বলবে।’ আদিত্য পূর্ণদৃষ্টিতে শুভ্র দত্তর দিকে তাকাল। কাল ছেলেটার চেহারায় যতটা হাসিখুশি, আত্মবিশ্বাসী ভাব আদিত্য দেখেছিল, আজ তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছে না। একদিনে যেন ছেলেটার দশ বছর বয়েস বেড়ে গেছে। তার দিদিকে কিন্তু ততটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে না।

‘আমরা যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, পুলিশ যেন ধরেই নিয়েছে দাদুকে তার পরিবারের কেউ খুন করেছে। এটা কিন্তু সত্যি নয়। আমাদের পরিবারে সকলেই সমান ভাল বা সৎ তা বলছি না। কিন্তু আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি টাকার লোভে দাদুকে খুন করবে এমন খারাপ লোক আমাদের পরিবারে নেই।’

‘শুভ্র, তোমার সেন্টিমেন্টটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু পুলিশকে তো শুধু আবেগ দিয়ে তুমি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। পুলিশ মোটিভ খুঁজবে, প্রমাণ দেখতে চাইবে। আর এটা তো তুমি মানবে যে তোমার দাদুকে খুন করার মোটিভ তোমাদের পরিবারের সকলেরই ছিল।’

শুভ্র মাথা নিচু করে রইল। তার কাছে আদিত্যর কথার কোনও উত্তর নেই। তার দিদি বলল, ‘আপনি তো দাদুর সঙ্গে আগে কথা বলেছেন। আপনার কি মনে হয়েছে দাদু তার পরিবারের লোকেদেরই সন্দেহ করত?’

‘করতেন না এটা বলা যাবে না। বরং জোর দিয়ে বলা যায় কিছুটা সন্দেহ করতেন। না হলে এই পারিবারিক গেট টুগেদারের মধ্যে আমাকে আসতে বলবেন কেন? তাছাড়া গত রাত্তিরে কেক কাটার আগে তিনি যা বলেছিলেন তাতে এটাই মনে হয় না কি তিনি তাঁর পরিবারকে সন্দেহের বাইরে রাখেননি?’

‘কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন। পরিবারের কেউ যদি এই কাজটা করত তাহলে সে তো কলকাতাতে বসেও কাজটা করতে পারত। এই জায়গাটা বেছে নিল কেন? এই জায়গাটা বেছে নেবার মানে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে পরিবারের কেউ খুনটা করেছে। কারণ এখানে পরিবারের লোক ছাড়া দাদুর চেনা আর কেউ ছিল না। পরিবারের কেউ এই কাজটা করলে সে অন্য জায়গা বেছে নিত না কি?’ স্বাতী মল্লিক থেমে থেমে কথাগুলো বলল।

আদিত্য মনে মনে ভাবল, মেয়েটার বেশ বুদ্ধি আছে। স্বাতীর কথার উল্টো যুক্তি আদিত্য দিতে পারত কিন্তু তা না দিয়ে সে স্বাতীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে তোমাদের মতে কে খুনটা করেছে?’

‘আমাদের মনে হয় কোনও বাইরের লোক খুনটা করেছে। দাদুর তো শত্রুর অভাব ছিল না। তারাই হয়তো কেউ প্রফেশানাল লোক দিয়ে কাজটা করিয়েছে।’

‘কারা তোমাদের দাদুর শত্রু ছিল তোমরা জান?’

‘দাদুর অনেক শত্রু ছিল। একটা পুরোনো স্ক্যান্ডেল …’ বলতে বলতে শুভ্র থেমে গেল। মনে হল টেবিলের তলা দিয়ে স্বাতী তাকে চিমটি কাটল।

‘স্ক্যান্ডেল? কীসের স্ক্যান্ডেল?’ আদিত্য উদগ্রীব।

‘না, না। আমি ভুল বলছিলাম। কিছু নয়, সেরকম কিছু হয়নি। আমি ভুল বলেছি।’

‘আমার কাছে কোনও তথ্য লুকোলে আমি কিন্তু তোমাদের সাহায্য করতে পারব না।’ আদিত্য হতাশ গলায় বলল। শুভ্র দত্ত নিশ্চুপ। আদিত্য বুঝল তার কাছ থেকে আর কোনও কথা বার করা যাবে না। তার দিদির থেকেও না।

‘আমি তোমাদের দুজনকেই একটা প্রশ্ন করব।’ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আদিত্য বলল। ‘গত রাত্তিরে তোমাদের দাদু ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে যাবার পর তোমরাও কি বেরিয়েছিলে?’

‘আমি বেরিয়েছিলাম। রেস্টরুমে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ বাদেই আবার ফিরে এসেছিলাম।’ স্বাতী বলল।

‘তুমি কি কাউকে রিসেপশানের দিকে কিংবা রিসর্টের পেছন দিকে যেতে দেখেছিলে?’

‘না, আমি কাউকে দেখিনি।’

‘তুমি?’ আদিত্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।

‘আমিও রেস্টরুমে যাবার জন্য বেরিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ফিরেও এসেছিলাম। বাইরে কারও সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তবে আমি যখন রেস্টরুমের ভেতরে বেসিনে হাত ধুচ্ছিলাম তখন কাকাও আমার পাশে আর একটা বেসিনে হাত ধুচ্ছিল। তারপর আর কাকাকে দেখিনি।’

‘ঠিক আছে। এবার তা হলে উঠে পড়া যাক। রিসর্টে ফিরে ডিনার খেতে হবে। আমার তো বেশ খিদে পেয়ে গেছে।’ আদিত্য বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বিল আনার ইশারা করল।

‘কতদিন পুলিশ আমাদের আটকে রাখবে জানেন? আমাকে তো দিল্লি ফিরে গিয়ে অফিস জয়েন করতে হবে।’ স্বাতীর গলাটা উদ্বিগ্ন শোনাল।

‘ঠিক জানি না। তবে খুব বেশিদিন আটকে রেখে পুলিশের লাভ কী?’ আদিত্যর যেটা মনে হয়, সেটাই সে বলল। তারপর শুভ্রকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমিও কি ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাবে?’

‘আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স তো সবে এক বছর কমপ্লিট হয়েছে। এখনও তিন বছর বাকি। ব্যাঙ্গালোরের এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটা খুব এক্সপেন্সিভ। বাবার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। দাদু টাকা দিল তাই ভর্তি হতে পারলাম। জানি না এখন কে টাকা দেবে।’

‘তোমার বাবাই দেবেন। তোমার বাবা কি চান না তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করো?’ কেয়া জিজ্ঞেস করল।

‘হয়ত চান। কিন্তু চাইলেও বাবার টাকা নেই।’

‘কিন্তু এখন তো আর সে সমস্যা রইল না। তোমার দাদুর টাকা তো কিছুটা তোমার বাবার হাতে আসবে।’ আদিত্য আশ্বাস দেবার মতো করে বলল।

‘জানি না কত টাকা বাবার হাতে আসবে। বাজারে বাবার অনেক ধার। দাদুর টাকা বাবার হাতে এলেই পাওনাদারেরা ছেঁকে ধরবে। সমস্ত ধার মেটানোর পর কতটুকু আর থাকবে বাবার হাতে?’ শুভ্র দত্তর গলায় অপরিসীম অবসাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *