সৈকত রহস্য – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ

(১)

‘আমার স্বামী গত ৩ জানুয়ারি মারা গেছেন।’ মেয়েটি বলল।

তারপর একটু থেমে বলল, ‘খুন হয়েছেন।’ বলতে গিয়ে মেয়েটির গলাটা একটু কেঁপে গেল।

আরও একটু থেমে সে বলল, ‘আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি।’

আদিত্য মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকাল। এই নিয়ে বোধহয় তিন-চার বার। মেয়েটির বয়েস তিরিশের কম তো হবেই, সম্ভবত পঁচিশেরও কম। বেশ ফরসা রঙ। এত ফরসা রঙ বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। ছোটখাটো, ছিপছিপে শরীরের ওপর দৃষ্টি-নন্দন মুখ। একটু বেশি তীক্ষ্ন একটা নাক, বিষণ্ণ, রহস্যময় একজোড়া চোখকে সঙ্গ দিচ্ছে। চোখের নীচে গভীর কালি। ওষ্ঠের ঠিক ওপরে যে ছোট তিলটা রয়েছে সেটার কারণে মুখমণ্ডলে কিছু অপ্রত্যাশিত চটুলতা। মেয়েটি কথা না বললে আদিত্য তাকে অবাঙালি ভাবত।

কেয়া চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। ‘একটু মিষ্টি খাও।’ টেবিলে মিষ্টির প্লেট নামিয়ে রাখতে রাখতে কেয়া বলল। আদিত্য ট্রে থেকে তার চায়ের কাপটা তুলে নিল।

‘আমি কিছু খেতে পারব না দিদি। প্লিজ। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছি। শুধু একটু চা খাব।’ মেয়েটির গলায় কাকুতি।

‘একটা সন্দেশ খাও অন্তত। তোমাকে কিচ্ছু না খাওয়ালে আমার বন্ধু আমার ওপর খুব রেগে যাবে।’ কেয়া আন্তরিকভাবেই বলল।

আদিত্য ভাবছিল, কেয়া ঘরে ছিল না বলে শুনতে পায়নি, এই মেয়েটির স্বামী কিছুদিন আগে মারা গেছে। খুন হয়েছে। শুনতে পেলে নিশ্চয় জোর করত না। কিন্তু মেয়েটির স্বামীর কথাটা কেয়াকে কী করে জানানো যায়? আদিত্য উদাস হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল।

একটু পরে কেয়ার প্রবল পেড়াপেড়িতে মেয়েটি যখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে নিয়ে হাতে ধরে বসে আছে আর কেয়া, একটা ফোন এসেছে বলে, পাশের ঘরে গিয়ে কথা বলছে, আদিত্য নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হল না।’

‘আমার নাম অনিতা, অনিতা শর্মা চৌধুরি।’

‘তার মানে বিয়ের আগে আপনার পদবি ছিল শর্মা। আপনারা কি বাঙালি?’

প্রশ্নটা শুনে মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আদিত্যর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। আমরা বাঙালি নই, হিমাচল প্রদেশের বাসিন্দা। তবে অনেক দিন বাংলায় আছি। আমার ঠাকুরদাদা রেলে চাকরি নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। রেল কোম্পানিকেই নানারকম সাপ্লাই করতেন। থাকতেন কাঁচড়াপাড়ায়। বাবা-কাকারা ওখানেই বড় হয়েছেন। বাবা পরে কলকাতায় চলে আসেন। কাকার সঙ্গে অন্য ব্যবসা শুরু করেন। পরে অবশ্য কাকা অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। আমি কলকাতাতেই পড়াশোনা করেছি।’

‘তাই আপনার বাংলা শুনে বোঝা যায় না আপনি বাঙালি নন।’

‘আমার শ্বশুরবাড়ি কিন্তু বাঙালি। তবে…’ অনিতা শর্মা চৌধুরি একটু থেমে বলল, ‘ওরা ব্রাহ্মণ নয়। আর আমার বাপের বাড়ি খাঁটি ব্রাহ্মণ।’

‘এটা নিয়ে কি কোনও সমস্যা ছিল?’ আদিত্য খানিকটা সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল। তারপর কৈফিয়ত দেবার গলায় বলল, ‘আপনাকে সাহায্য করতে গেলে আমাকে সবটাই তো বুঝতে হবে।’

‘খুবই সমস্যা ছিল। আমার বিয়েটা বাপের বাড়ি থেকে কোনও দিনই মেনে নেয়নি। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে সৈকতকে বিয়ে করেছিলাম। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অবশ্য বিয়ে নিয়ে কোনও আপত্তি করেননি।’

কেয়া ফোন শেষ করে আবার ঘরে ঢুকেছে। মেয়েটির হাতে তখনও সন্দেশ ধরা আছে দেখে বলল, ‘তুমি এখনও খাওনি? তাড়াতাড়ি এই সন্দেশটা খেয়ে নাও। তারপর অন্তত একটা পান্তুয়া খেতেই হবে। পান্তুয়াটা আমাদের পাড়ার দোকানের। একেবারে টাটকা, এখনও গরম আছে।’

‘আমি সত্যিই খেতে পারছি না। সত্যিই পারছি না।’ অনিতা এবার আদিত্যর দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল। যেন আদিত্য তার অসুবিধেটা বুঝতে পারবে।

‘কেয়া, ওঁকে খাবার নিয়ে জোর কোরো না। উনি ভীষণ বিপদের মধ্যে আছেন। ওঁর স্বামী কিছুদিন আগে খুন হয়েছেন। আমার কাছে সেই জন্যেই এসেছেন। ওঁর কথাটা ভাল করে শোনা যাক।’ আদিত্য সুযোগ পেয়ে বলল।

কেয়া খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। এতক্ষণে অবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছে। কেয়ার অপ্রস্তুত মুখটা দেখে অনিতা তাড়াতাড়ি বলল, ‘ না, না। আমি একটা সন্দেশ খেয়ে নিচ্ছি। আপনি এত করে বলছেন।’ যেন সন্দেশ খাওয়াটা তার দায়িত্ব। পরে সন্দেশটা কোনোক্রমে গলাধঃকরণ করে সে কয়েক চুমুকে জলের গেলাসটা খালি করে দিল। আদিত্যর সন্দেহ হল তার গলায় সন্দেশ আটকে গেছে।

অনিতা শর্মা চৌধুরি কিন্তু কেয়ার রেফারেন্সেই আদিত্যর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কেয়ার কলিগ শাশ্বতী শাসমল অনিতাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। শাশ্বতী কেয়াকে বলেছে অনিতা তার ছোট বোনের মতো, সম্প্রতি ভীষণ বিপদে পড়েছে, কেয়ার স্বামী আদিত্য যদি অনিতাকে একটু সাহায্য করতে পারে, খুব ভাল হয়। এর বেশি আর কিছু শাশ্বতী কেয়াকে বলেনি। তাই কেয়া জানে না অনিতার বিপদটা ঠিক কী।

‘আপনি আপনার বিয়ের কথা বলছিলেন। আপনি বললেন, আপনাদের বিয়েটা আপনার বাপের বাড়ি মেনে নেয়নি, কিন্তু আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি মেনে নিয়েছিলেন।’ আদিত্য খেই ধরিয়ে দিল।

‘হ্যাঁ। আমাদের পরিবার খুব গোঁড়া। আমাদের কমিউনিটির মধ্যেই আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। আমি কমিউনিটির বাইরে বিয়ে করব এটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। তার ওপর আবার সৈকতরা ব্রাহ্মণও নয়।’

‘আপনার স্বামী খুন হয়েছে বললেন। আপনার সমস্যাটা কি আপনার স্বামীর মৃত্যু সংক্রান্ত?’

‘হ্যাঁ। একেবারেই তাই। তবে সমস্যাটা বোঝাতে গেলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে পারলে ভাল হয়। একটু সময় লাগবে। আমাকে একটু সময় দেবেন?’ অনিতা খুব কুণ্ঠিতভাবে বলল।

‘আপনি যত খুশি সময় নিন। কোনও তাড়া নেই।’ আদিত্য দরাজ গলায় বলল। তার খুব সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেয়ার সামনে সে সিগারেট ধরাতে সাহস পেল না।

মাঘ মাসের আলগা রোদ্দুর পুবদিকের জানলা খোলা পেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। তবে খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। আদিত্যর পড়ার টেবিলের পায়ের কাছে একটা হলুদ চতুষ্কোণ রচনা করে থেমে রয়েছে। রবিবার। শিগগিরই এগারোটা বাজবে। কেয়া তার চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আদিত্যর পাশে একটা মোড়ায় বসে পড়ল।

‘আমার স্বামী সৈকত চৌধুরি ছিল পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।’ অনিতা বলতে শুরু করল। ‘যাদবপুর থেকে পাশ করেছিল। আমার কলেজের বন্ধু শুক্তি সৈকতের মাস্তুতো বোন। শুক্তির বাড়িতেই সৈকতের সঙ্গে আলাপ। আমি তখন সিটি কলেজে হিস্ট্রি পড়ি। থার্ড ইয়ার। সৈকত খুব ভাল ক্রিকেট খেলত। ইউনিভার্সিটির ক্যাপ্টেন ছিল। টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম। ভীষণ জোভিয়াল। এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। আমার সঙ্গে যখন আলাপ হয় তখন ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছে, তবে খেলা ছাড়েনি। রাজস্থান ক্লাবে খেলে। আমাকে বলল, সামনের রবিবার ইডেনে আমার খেলা আছে। শুক্তির সঙ্গে তুমিও দেখতে এসো। আমার বয়েস তখন সবে একুশ। সৈকতকে প্রথমবার দেখেই আমি একেবারে হেড ওভার হিলস।’ বলতে বলতে অনিতা শর্মা চৌধুরি লজ্জা পেয়ে থেমে গেল। আদিত্যর মনে হল, সে তার স্বামীর সঙ্গে প্রথম আলাপের স্মৃতিটা উপভোগ করছে।

‘তারপর? তারপর কী হল?’ কেয়া সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল। সে অনিতার গল্পে বেশ রস পেয়ে গেছে।

‘পরের রবিবার শুক্তির সঙ্গে ইডেনে খেলা দেখতে গেলাম। সৈকত সেদিন সেঞ্চুরি করে দলকে জেতাল। যতদূর মনে পড়ছে, খেলাটা ছিল কালীঘাটের এগেন্সটে। লিমিটেড ওভার ম্যাচ। খেলার শেষে সৈকত আমাদের নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে গেল। আমাকে বলল, আজকের সেঞ্চুরিটা তোমাকে ডেডিকেট করলাম। আমরা ফ্লুরিজে চা-পেস্ট্রি খেলাম। অনেকক্ষণ বসলাম। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল। কেন দেরি হয়েছে বলতে গিয়ে বাবা-মাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হল। এর আট মাস পরে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সৈকতকে বিয়ে করি।’

‘আপনার স্বামী তখন কী করতেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

সৈকত কোনও দিনই চাকরি করতে চায়নি। ও ওর ফ্রিডমটা খুব ভ্যালু করত। কারও গোলামি করা ওর ধাতে ছিল না। তাই পাশ করার পরে ও ওর এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম শুরু করেছিল। আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন ফার্মটা বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। তবে সৈকত ব্যবসাটার দিকটা কোনও দিনই তেমন বুঝত না। ও ভাল ইঞ্জিনিয়ার ছিল, কিন্তু ব্যবসার ব্যাপারটা পুরোপুরি ওর পার্টনার মণিময় গুপ্তর ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। সেই সুযোগে ওর পার্টনার মণিময় গুপ্ত ওকে ঠকায়।’

‘এই ব্যবসার ব্যাপারটা আর একটু ভাল করে বলবেন?’ আদিত্য একটা খাতায় নোট নিচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা তো বলতেই হবে। সৈকতের মৃত্যুর সঙ্গে ওর ব্যবসার একটা সম্পর্ক থাকতেই পারে। তবে ওটা একটু পরে বলছি। তার আগে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা বলে নিই।’

‘ঠিক। ঠিক। আপনি আপনার মতো করে বলুন।’ আদিত্য খাতা থেকে মুখ তুলে বলল।

‘বিয়ের মাস দুয়েক আগে আমি বাড়িতে সৈকতের কথা জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার শুরু হল। বাবা, মা, দাদা, বউদি সকলেই আমার ওপর চাপ দিতে লাগল। বলতে লাগল, সৈকতের সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে দিতে হবে। আমাকে আমার ঘরে আটকে রাখা হল। বাড়ির বাইরে এক পা বেরোবার হুকুম নেই। আমার এক মাসি, হিমাচল প্রদেশের হামিরপুরে থাকে, আমার জন্যে সেখানে একটা সম্বন্ধ দেখে রেখেছিল। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বাড়িতে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল আমার ছোট ভাই জয়। জয় আমাকে সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সাহায্য করত। ও তখন টুয়েলভ-এ পড়ে। তারপর একদিন আমি জয়ের সাহায্যে বাড়ি থেকে পালালাম। বাড়ির বাইরে একটু দূরেই সৈকত অপেক্ষা করছিল। সৈকত আমাকে শুক্তিদের বাড়িতে নিয়ে গেল। এর দুদিন পরে, ক্রিক রোতে একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে আমাদের বিয়ে হয়।’

‘তোমার বাড়িতে ব্যাপারটা কবে জানাজানি হল?’ কেয়া জিজ্ঞেস করল।

‘আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছি দেখে এফ আই আর করা হয়েছিল। তবে জয়কে কেউ সন্দেহ করেনি। নাহলে তার ওপরেও খুব অত্যাচার করা হত। যাই হোক, আমার বিয়ের তিন-চার দিন পরে বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির। বাড়িতে মানে সৈকতদের বাড়িতে। আমি তখন ওখানে থাকতে শুরু করেছি। আমি পুলিশকে আমার বার্থ সার্টিফিকেট দেখালাম, আধার কার্ড দেখালাম। বুদ্ধি করে ওগুলো সঙ্গে এনেছিলাম। ম্যারেজ সার্টিফিকেটটাও পুলিশকে দেখালাম। পুলিশ যখন দেখল আমি সাবালিকা, নিজের ইচ্ছেতে সৈকতকে বিয়ে করেছি, তখন তারা ফিরে গেল।’

‘আপনার বাপের বাড়ির কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি?’

‘জয় তো প্রত্যেক সপ্তাহে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এখন আর আসে না। ও কাকার কাছে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। কাকা-কাকিমার ছেলেমেয়ে নেই তো, ওরাই ওকে নিয়ে গেছে। ওখানে এমবিএ করছে। কিন্তু অন্যরা তো এখানেই আছে। তারা কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। আর আমার দাদা, সঞ্জয়, ভীষণ কনজারভেটিভ, আর প্রচণ্ড রাগী, তাছাড়া অনেকদিন রাগ পুষে রাখতে পারে, মাঝে মাঝেই ফোন করে ভয় দেখাত আমাদের দুজনকে খুন করে ফেলবে। একমাত্র তাহলেই নাকি পরিবারের ইজ্জত বাঁচবে। আমি জানি না, দাদা আমাদের শুধু ভয় দেখানোর জন্যে ফোন করত, নাকি সত্যি সত্যি আমাদের খুন করতে চেয়েছিল।’

‘আপনার দাদা কাকে ফোন করত? আপনাকে? নাকি আপনার স্বামীকে?’

‘দুজনকেই করত। আমরা একটা নম্বর ব্লক করে দিলে, সিম বদল করে আবার ফোন করত। আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।’

‘শেষ কবে আপনার দাদার কাছ থেকে ফোন এসেছিল?’

‘আমার ঠিক মনে নেই। বছর খানেক হবে। আসলে একটা ঘটনা ঘটার পর দাদা ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছিল।’

‘কী ঘটনা?’

‘একদিন রাত্তির বেলা সৈকত একা অফিস থেকে বেরিয়েছে, গাড়িতে উঠবে। সেই সময় দুজন লোক সৈকতকে ফিজিকালি অ্যাসল্ট করার চেষ্টা করে। দুজনের মধ্যে একজন আমার দাদা। আর একজন মনে হয় কোনও ভাড়াটে গুন্ডা।’

‘তারপর?’

‘সল্ট লেক ফাঁকা জায়গা। ওরা ভেবেছিল সৈকতকে মারধোর করে পালিয়ে যাবে। কেউ ওকে বাঁচাতে আসবে না। কিন্তু ওরা সৈকতের আনইউজুয়াল ফিজিকাল স্ট্রেংথের কথা জানত না। সৈকত একাই দুজনকে মেরে প্রায় আধমরা করে দিল। নিজেও খানিকটা ইঞ্জিয়োরড হল। দাদা আর অন্য লোকটা কোনও রকমে একটা গাড়িতে উঠে পালাল। সৈকত ওই অবস্থাতেই গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এরপর থেকে দাদা আর ভয় দেখিয়ে ফোন করেনি।’

‘আপনারা কি পুলিশে ডায়েরি করেছিলেন?’

‘আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সৈকত বলল, যেহেতু এটার মধ্যে আমার দাদা ইনভলভড, এটা একটা ফ্যামিলি স্ক্যান্ডেল হয়ে যাবে। তাই শেষ অব্দি ডায়েরি করা হয়নি।’

‘ইন্টারেস্টিং।’ আদিত্য কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘এবার বলুন, আপনার স্বামী কবে, কীভাবে খুন হলেন?’

‘মাস দেড়েক আগে আমার স্বামী খুন হন।’ অনিতা শর্মা চৌধুরির গলাটা আবার ধরে এল।

‘কীভাবে, কোথায়?’

‘বলছি। বলছি।’ অনিতা নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্যে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হয়তো সে বীভৎস কিছু বলার আগে শক্তি সঞ্চয় করছিল। ‘দিনটা ছিল শনিবার। আমি প্রত্যেক শনিবার একটা কুকিং ক্লাসে যেতাম, মানে, তখন যেতাম এখন আর যাই না, সেদিনও গিয়েছিলাম। বাড়িতে সৈকত তখন ছিল না। সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিল। বেশি কাজ থাকলে শনিবারও ওকে অফিস যেতে হত। মাঝে মাঝে ওর বাবা-মার সঙ্গেও দেখা করতে যেত।’

‘আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি কোথায় থাকেন?’

‘আমার শ্বশুর কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। রিটায়ার করার পর কল্যাণীতে বাড়ি করেছেন। তিনি এবং আমার শাশুড়ি ওখানেই থাকেন।’

‘আপনার স্বামী ছাড়া ওদের আর ছেলেমেয়ে নেই?’

সৈকতের এক দিদি আছে, অ্যামেরিকায় বিয়ে হয়েছে। খুব বেশি দেশে আসে না। আমি বিয়ের পর একবারই আসতে দেখেছি।’

‘আপনার কত বছর বিয়ে হয়েছে?’

‘সামনের মার্চে ছবছর হবে।’

‘ঠিক আছে। বলুন তারপর কী হল।’

‘আমি যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে ফ্ল্যাটের মেন দরজার চাবি থাকে। আমি চাবি খুলে দেখি বাড়ি একেবারে অন্ধকার। ভাবলাম সৈকত নিশ্চয় এখনও ফেরেনি। বসার ঘরে আলো জ্বালালাম। ফাঁকা বসার ঘর। শোবার ঘরে গিয়ে বাইরের ড্রেসটা চেঞ্জ করলাম। তারপর ভাবলাম চা খাব। সন্ধেবেলার চা-টা সাধারণত আমরা একসঙ্গে খাই। বিশেষ করে শনি-রবিবার। মনে হল, সৈকতকে একবার ফোন করে জেনে নিই ও কখন ফিরছে। যদি দেখি ও শিগগির ফিরে আসছে তাহলে দু’কাপ চা ভিজিয়ে দেব।

সৈকতকে ফোন করতেই পাশের ঘরে ফোনটা বেজে উঠল। পাশের ঘরটা সৈকতের স্টাডি। ভাবলাম সৈকত নিশ্চয় ফোনটা ফেলে গেছে। ফোনের খোঁজে পাশের ঘরে গিয়ে আলো জ্বালাতেই দেখি মেঝের ওপর সৈকত পড়ে রয়েছে। সাদা কুর্তার ওপর টকটকে লাল রক্ত। মেঝেতেও রক্ত।’

বলতে বলতে অনিতা হু-হু করে কেঁদে উঠল। তার কান্না আর থামে না। কেয়া তার পিঠে হাত দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল।

(২)

চৌকো রোদ্দুর চেয়ারের পায়ার কাছ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে আলমারির ওপর পড়েছে। আদিত্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল রবিবারের রাস্তা প্রায় ফাঁকা। শুধু রাস্তার যেদিকটায় বাজার বসে সেদিকে একটা চাষি-বউ চার-পাঁচটা রুগণ ফুলকপি আর কয়েক আঁটি শুকনো পালং শাক নিয়ে খদ্দেরের আশায় এখনও বসে রয়েছে। তার অনতিদূরে দুটো কুকুর পাশ ফিরে শুয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গী আর একটা কুকুর আধবসা অবস্থায় তাকিয়ে রয়েছে আদিত্যদের বাড়ির দিকে। তার চোখে খুব মায়া।

এখনও কেঁদে চলেছে মেয়েটা। যেন ভেতরে অনেকটা কান্না লুকিয়ে বসেছিল, এখন লোকজনের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে পড়ছে সেসব। এই রকম অবস্থায় আদিত্য বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। তাই সে মেয়েটাকে সামলানোর দায়িত্ব কেয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়েছিল। কেয়া যে মেয়েটাকে খুব ভাল সামলাতে পারছে, তা নয়। মাঝে মাঝে মেয়েটার পিঠে আলতো চাপড় মারছে, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর সময় মায়েরা যেমন চাপড় মারে।

ভাগ্যবশত, একটু পরে অনিতা শর্মা চৌধুরি নিজের থেকেই সামলে গেল। ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছে আদিত্যর দিকে তাকাল।

আদিত্য বলল, ‘আপনার স্বামী খুন হবার ব্যাপারটা কি আপনি বাপের বাড়িতে জানিয়েছিলেন?’

‘ঘটনাটা ঘটার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি জয়কে ফোন করে ব্যাপারটা বলি। জয় অত দূর থেকে কী করবে? তবে ও সঙ্গে সঙ্গে আমার বাড়িতে সব কিছু জানিয়েছিল। কিন্তু আমার বাবা, মা বা দাদা কেউই আসেনি, আমাকে ফোনও করেনি।’

‘জয় ছাড়া আর কাউকে কি আপনি ঘটনাটা জানিয়েছিলেন?’

অনিতা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার পড়শিরা তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। জয়কে ফোন করার পর শাশ্বতীদির বাড়িতে আমি নিজেই চলে গিয়েছিলাম। তারপর যতদূর মনে পড়ছে প্রদীপদাদের বাড়ি। কিন্তু ফোনে আর কারও সঙ্গে আমার এটা নিয়ে কথা হয়নি।’

আদিত্যর মনে হল অনিতা শর্মা চৌধুরি পুরো সত্যিটা বলছে না।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রদীপদা কে?’

‘প্রদীপ চক্রবর্তী। আমাদের নীচের তলায় থাকেন।’

‘আপনাদের বাড়িটা কোথায়?’ আদিত্য কথা ঘুরিয়ে বলল।

‘জামির লেনে। বালিগঞ্জ স্টেশনের খুব কাছে।’

‘আপনাদের নিজেদের বাড়ি?’

‘বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট। আগে এখানে একটা দোতলা বাড়ি ছিল। দোতলায় বাড়িওলা থাকত। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একতলায় ভাড়া থাকত। সৈকত ওখানেই বড় হয়েছে। আমার শ্বশুর তখন কলকাতার একটা কলেজে পড়াতেন। তারপর উনি চাকরি নিয়ে কল্যাণী চলে গেলেন। সৈকত তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে। নিজের ফার্ম করেছে। সে ওই বাড়িতেই রয়ে গেল। আমি বিয়ের পর ওখানেই গিয়ে উঠেছিলাম। বাড়িটা ভেঙে যখন ফ্ল্যাটবাড়ি হল তখন সৈকত নিজের নামে একটা ফ্ল্যাট নিল। তবে এখনও সব টাকা শোধ হয়নি।’

‘বাড়িটা এখন কত তলা?’

‘চারতলা। দোতলা বাড়ি ভেঙে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। খুব বেশি জায়গা ওখানে ছিল না।’

‘কটা ফ্ল্যাট?’

‘একতলায় শুধু গাড়ি রাখার জায়গা, কোনও ফ্ল্যাট নেই। দোতলায় দুটো ফ্ল্যাট, তিনতলায় আরও দুটো ফ্ল্যাট আর চারতলার পুরোটা নিয়ে পুরোনো বাড়িওলা থাকে। আমাদের ফ্ল্যাটটা তিনতলায়।’

‘শাশ্বতীরা কি তোমাদের তলাতেই থাকে?’ কেয়া জিজ্ঞেস করল। ‘শাশ্বতী অনেকবার যেতে বলেছে, যাওয়া হয়নি। ইচ্ছে আছে একদিন যাব।’

‘হ্যাঁ। শাশ্বতীদি-দীপকদারা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। ওরা না থাকলে আমি যে কী করতাম!’

আদিত্য ধরে নিল শাশ্বতী শাসমলের স্বামীর নাম দীপক। সে বলল, ‘দোতলার ফ্ল্যাটে কারা থাকে?’

‘পুব দিকের ফ্ল্যাটে প্রদীপ চক্রবর্তীরা স্বামী-স্ত্রী থাকেন। ওঁদের ছেলে-মেয়ে নেই। প্রদীপদা কোনও একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। বেশ কিছুদিন রিটায়ার করেছেন। সৈকতকে খুব ভালবাসতেন। সৈকতও ছিল প্রদীপদা বলতে অজ্ঞান। সৈকত বলত, আমাদের পুরো ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রদীপদাই একমাত্র লেখাপড়া জানা লোক। আসলে প্রদীপদা খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। সিক্সটিজে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স পড়তেন। কলেজে পড়ার সময় নকশাল হয়ে গিয়ে আর খুব বেশি লেখাপড়া হয়নি। পরে বিএসসিটা পাশ করেছিলেন। প্রদীপদার স্ত্রী রাখিদিও নকশাল করতেন। প্রদীপদারই ক্লাসমেট। রাখিদি একটা স্কুলে পড়াতেন। উনিও রিটায়ার করেছেন।’

আদিত্যর মনে হল অনিতা মেয়েটার একটু বেশি কথা বলা স্বভাব। প্রথম দিকে একটু আড়ষ্ট ছিল। এখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে।

‘তাহলে তো বলতে হয়, শুধু শাশ্বতী শাসমলরা নয়, প্রদীপ চক্রবর্তীরাও আপনার একটা ভরসা।’

‘ভরসা তো বটেই। তবে …’ অনিতা কিছু একটা বলতে ইতস্তত করেছে।

আদিত্য জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। অনিতা যেটা বলতে চায় সেটা যতক্ষণ সে নিজে থেকে না বলছে ততক্ষণ আদিত্য ঠিক করেছে তার দিকে তাকিয়েই থাকবে।

কিছুক্ষণ পরে অনিতা বলল, ‘আসল ব্যাপারটা খুব বেশি কেউ জানে না। রাখিদির ব্রেনে টিউমার হয়েছে। ম্যালিগনেন্ট। এটা জানার পর থেকে প্রদীপদা ভেতরে ভেতরে এতটাই ভেঙে পড়েছে যে ওকে আর আমার সমস্যাগুলো নিয়ে বিব্রত করতে ইচ্ছে করে না।’

‘দোতলায় আর কারা থাকে?’

‘আমাদের ঠিক নীচে পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটে মলয়া বিশ্বাস মেয়ে নিয়ে থাকে। ওর স্বামী সুব্রত বিশ্বাস ব্যাঙ্কে চাকরি করে। শিলিগুড়িতে পোস্টেড। মাঝে মাঝে আসে। মলয়া বিশ্বাস খুব ডিফিকাল্ট মহিলা। সব সময় ওর মনে হয় ওকে সবাই ঠকাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে একটা লিফট আছে। ওরা দোতলায় থাকে বলে খুব একটা লিফট ব্যবহার করে না। তাই কিছুতেই মেনটেনেন্স-এর পুরো টাকা দেবে না। অথচ মেনটেনেন্স-এর টাকায় লিফট চলবে জেনেই তো ফ্ল্যাট কিনেছিল। বারান্দায় জামাকাপড় শুকোতে দিলেও খ্যাচখ্যাচ করে। ওদের বারান্দায় নাকি জল পড়ছে। বিশ্বাসদের বারান্দাটা আমাদের বারান্দার ঠিক নীচে। আমরা কোথায় জামাকাপড় শুকোতে দেব?’

‘আর বাড়িওলারা? তারা কতজন চারতলায় থাকে?’

‘সেখানে থাকে শুধু বুড়ো-বুড়ি। একটা ফ্ল্যাট ছেলের জন্যে রাখা আছে। কিন্তু ছেলে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। সেখানেই সে ফ্যামেলি নিয়ে থাকে। আর মেয়ে থাকে ক্যানাডায়। সেখানেই এখন বুড়ো-বুড়ি বেড়াতে গেছে। এই ঘটনার সময় তারা টরোন্টোতেই ছিল।’

‘একটা প্রশ্ন। আপনাদের ফ্ল্যাটবাড়ির মূল ফটকে নিশ্চয় সিকিউরিটি থাকে। ঘটনার দিন সিকিউরিটি কি বাইরের কাউকে ঢুকতে দেখেছিল?’

প্রশ্নটা শুনে অনিতা যেন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ থেমে বলল, ‘সিকিউরিটি কাউকে দেখেছিল কিনা আমি বলতে পারব না। পুলিশ হয়তো বলতে পারবে। তারা শুনেছি সিকিউরিটিকে অনেকক্ষণ ধরে ইন্টারোগেট করেছে। আমি যখন বাড়ি ঢুকছি তখন কিন্তু সিকিউরিটি গেটের পাশেই বসেছিল। বাইরে থেকে কেউ এসে থাকলে সে নিশ্চয় বলতে পারবে।’

আদিত্য চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে এল। রোদ্দুরটা এতক্ষণে গায়ের ওপর এসে পড়েছে। এতক্ষণ যা শুনেছে কিছু সময় ধরে সেসব খাতায় নোট করল। তারপর মুখ তুলে অনিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার স্বামীর ব্যবসার ব্যাপারটা এবার একটু বলবেন? আপনি বলছিলেন না আপনার স্বামীর পার্টনার আপনার স্বামীকে ঠকিয়েছে?’

 ‘চলে যাবার কিছুদিন আগে থেকে সৈকত আমাকে তাই বলছিল। একবার নয়, বারবার। সৈকতের পার্টনার মণিময় গুপ্ত কলেজে ওর কয়েক বছরের সিনিয়ার ছিল। বলতে গেলে মণিময়দাই ছিল ওর ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড। মণিময়দার কথাতেই সৈকত চাকরির চেষ্টা না করে ব্যবসায় নেমেছিল। মণিময়দাকে ও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত। অথচ সেই মণিময়দাই ওকে ঠকাল। আসলে সৈকত সব মানুষকেই এক কথায় বিশ্বাস করে ফেলত।’

‘কীভাবে মণিময় গুপ্ত সৈকতবাবুকে ঠকিয়েছিল আপনি জানেন? মানে, আপনার স্বামী আপনাকে বলেছিলেন?’

‘দেখুন, সৈকতের টাকাপয়সার দিকটা আমি কিছুই জানতাম না। আমার যেটুকু দরকার সৈকতের কাছ থেকে না চাইতেই পেয়ে গেছি। তবে শেষের দিকে সৈকতকে ভীষণ চিন্তিত দেখাত। চিন্তিত না বলে বলা ভাল ডিপ্রেসড দেখাত। আমি জিজ্ঞেস করলেই বলত মণিময়দা ওকে ঠকিয়েছে।’

‘আপনাদের কি তখন কোনও টাকাপয়সার টানাটানি হয়েছিল?’

‘হলেও আমি টের পাইনি। সংসারটা সৈকতই চালাত। সেটা আগের মতোই চলছিল।’

সৈকতবাবু চলে যাবার পর কি এখন আপনার কোনও অর্থকষ্ট হচ্ছে? মাফ করবেন, সত্যিটা জানার জন্য এই ডেলিকেট প্রশ্নটা আমাকে করতেই হচ্ছে।’ আদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলল।

‘একটু অসুবিধে তো হচ্ছেই। সৈকতের তো একটা ভাল রোজগার ছিল। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া সৈকত কোনওদিনই খুব জমাতে পারেনি। তবে যেটুকু ও রেখে গেছে তা দিয়ে আমার আপাতত চলে যাচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে একটা কাজ-টাজ খুঁজতে হবে।’ অনিতার গলাটা কিছু বিপন্ন শোনাল।

‘আচ্ছা মণিময় গুপ্তর কাছ থেকে তো আপনার কিছু পাওনা থাকতে পারে? আপনি গিয়েছিলেন তার কাছে?’

‘মণিময়দা গত কয়েক সপ্তাহ ল্যাটিন অ্যামেরিকা ট্যুর করছে। একা মানুষ, বিয়ে করেনি, তাই সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। কাউকে জানায় না কোথায় আছে। যেমন এখন মণিময়দা কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না। সৈকতের ব্যাপারটা মণিময়দা এখনও জানেই না। সৈকত মারা যাবার কয়েকদিন আগেই মণিময়দা বেরিয়ে পড়েছিল। পুলিশ এখনও মণিময়দার সঙ্গে কনট্যাক্ট করে উঠতে পারেনি। এবার বোধহয় মণিময়দার ফেরার সময় হয়েছে। ফিরলে আমি যোগাযোগ করব।’

সৈকতবাবুর অফিসটা কি এখন তাহলে বন্ধ রয়েছে?’

‘বন্ধ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বজিৎ মজুমদার বলে একজন আছে, সৈকতদের কম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। ও তো এই সেদিনও ফোন করেছিল। মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নেয়। সৈকতদের অফিসে এখনও কুড়ি-বাইশজন কাজ করে। মনে হয়, মণিময়দা ফিরে এসে আবার অফিসের হাল ধরবে।’

‘আপনি সৈকতবাবুর অফিসের ঠিকানাটা দিতে পারেন? একবার ওখানে যাওয়া খুব দরকার।’

‘একজ্যাক্ট ঠিকানাটা অফ হ্যান্ড বলতে পারছি না। অফিসটা সল্ট লেক সেক্টর থ্রিতে। স্টেডিয়ামের কাছে। আমি দু-তিনবার গেছি।’ তারপর একটু থেমে অনিতা বলল, ‘দাঁড়ান। বিশ্বজিৎকে ফোন করে জেনে দিচ্ছি।’

 অনিতা যখন ফোন করছে তখন আদিত্য এক মনে খাতায় লিখছিল। কেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। লিখতে লিখতে আদিত্য আশা করছিল কেয়া হয়ত চা করতে গেছে। আর এক কাপ চা খেতে আদিত্যর খুব ইচ্ছে করছিল।

অনিতা ফোনে বিশ্বজিৎকে ধরে ফোনটা আদিত্যকে দিল। ‘আপনি কথা বলে নিন।’

কিছুক্ষণ পর কথা শেষ করে অনিতার ফোনটা ফেরত দিয়ে আদিত্য খাতায় লিখতে লিখতে বলল, ‘গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স। আই বি ৯৪৫ সল্ট লেক। সেক্টর থ্রি। সাদা দোতলা বাড়ির একতলায়।’ যেন মুখে না বললে ঠিকানাটা ভুলে যাবে।

আদিত্য আরও কীসব খাতায় লিখে রাখছিল। অনিতা কিছুটা ব্যাগ্র হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার লেখা শেষ করে সে খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আপনার স্বামীর খুন হবার ব্যাপারটা খানিকটা জানতে পারলাম। এখন প্রশ্ন হল, আপনি আমাকে ঠিক কী করতে বলছেন?’

অনিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘খাতাটা এখনই বন্ধ করবেন না। আসল কথাটা এখনও বলা হয়নি। আসল কথাটা বললে বুঝতে পারবেন কেন আপনার কাছে এসেছি।’

কেয়া সত্যি সত্যি আবার চা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। সে অনিতাকে বলল, ‘আমরা কর্তা-গিন্নি খুব চা-খোর। তুমিও আমাদের সঙ্গে আর একবার চা খাও।’

অনিতা উত্তর দিচ্ছে না। গভীরভাবে অন্য কথা ভাবছে। যেন কেয়ার কথাটা সে শোনেইনি। যেন খুব দরকারি কিছু বলার আগে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর সে বলতে শুরু করল।

‘মারা যাবার কিছুদিন আগে আমার স্বামী একটা ইনশিয়োরেন্স করেছিলেন। পাঁচ কোটি টাকার লাইফ ইনশিয়োরেন্স। অনেক টাকার প্রিমিয়াম। বেনিফিশিয়ারি আমি। আমি কিন্তু এই পলিসিটার কথা কিছুই জানতাম না। সৈকত চলে যাবার পর জানতে পেরেছি। কেন সৈকত এত মোটা টাকার পলিসি করেছিল বুঝতে পারছি না। একটা প্রিমিয়ামও দিয়েছিল। আর একটা প্রিমিয়াম ডিউ হবার আগেই ও চলে গেল। সৈকত কি ওর জীবনের আশঙ্কা করছিল?’

‘তার মানে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে আপনি এখন পাঁচ কোটি টাকা পাবেন? আপনার আর্থিক সমস্যা তো তাহলে মিটে গেল।’ আদিত্য খানিকটা বিভ্রান্ত।

‘না। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। পলিসিতে লেখা আছে, সৈকত যদি আত্মহত্যা করে কিংবা যদি প্রমাণ হয় যে পলিসির বেনিফিশিয়ারিই সৈকতকে খুন করেছে, তাহলে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিকে এক পয়সাও দিতে হবে না। এখন, ব্যালিসটিক রিপোর্ট জোর দিয়ে বলছে সৈকতের মৃত্যুটা আত্মহত্যা নয়, খুন। সেই রিপোর্টটা ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি উড়িয়ে দিতে পারছে না। অতএব তারা এটা প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে যে পয়সার লোভে আমিই সৈকতকে খুন করেছি। আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? সৈকত চলে যাবার পর একে আমি ডিভাস্টেটেড হয়ে গেছি। তার ওপর রোজ ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির লোক এসে নানারকম প্রশ্ন করে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওরা তো চেষ্টা করবেই। পাঁচ কোটি খুব কম টাকা নয়।’

অনিতা থামল। আদিত্য লিখছে।

‘সব মেয়েদের একটা করে বাপের বাড়ি থাকে। আমার তো তাও নেই। আমি কার কাছে যাব? শাশ্বতীদি বলল আপনার কাছে এলে একটা সুরাহা হতে পারে। তাই আপনার কাছে এলাম। আপনি আসল খুনিকে ধরে দিন, এটাই আপনার কাছে আমার আর্জি। আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, এক্ষুনি আপনাকে কোনও ফিস দিতে পারব না। আমার সে সামর্থ্য নেই। তবে যদি কখনও ইনশিয়োরেন্সের টাকাটা পাই কিংবা যদি মণিময়দা সৈকতের প্রাপ্য বলে আমাকে কিছু টাকা দেয়, তাহলে আপনার সমস্ত ফিস আমি মিটিয়ে দেব। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?’ অনিতার শেষ কথাগুলো প্রায় আর্তির মতো শোনাল।

‘টাকা-পয়সার কথা আপতত বাদ দিন। আমি একটা অন্য কথা ভাবছি। আপনার বাড়িটা কোন থানার আওতায় পড়বে? পুলিশের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেলে সুবিধে হত।’

‘গড়িয়াহাট থানা। ওখান থেকেই তো একজন পুলিশ ইন্সপেক্টার তদন্ত করতে এসেছিল।’

‘ঠিক আছে। আমি ওখানেই আগে খোঁজ নেব। সৈকতবাবুর আপিসেও যেতে হবে একদিন। বিশ্বজিৎবাবুর সঙ্গে তো আলাপ হয়েই গেল। উনি কতদিন এই কোম্পানিতে আছেন, জানেন?

‘অনেকদিন। ঠিক কতদিন বলতে পারব না।’

‘ঠিক আছে। আপনাদের বাড়িতেও খুব শিগগির একদিন যাচ্ছি।’

(৩)

মাত্র ছ-সাত মাস হল কেয়া সংসার পেতেছে, অথচ এর মধ্যেই সে যে কী করে এত চমৎকার গৃহিণীপনা রপ্ত করে ফেলল ভেবে আদিত্য অবাক হয়ে যায়। পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে সে যখন কাজের মাসিকে অনায়াসে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে, কিংবা যখন সারাদিন ক্লাস নিয়ে ইস্কুল থেকে ফিরেই আবার সদ্য ইউ-টিউবে শেখা নারকেল দিয়ে লাউয়ের খোসা ভাজার নতুন রেসিপি অথবা উচ্ছে দিয়ে কাঁচা মুগের সাবেকি তেতোর ডাল নিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তখন আদিত্য আড়াল থেকে তাকে দ্যাখে। যেন নিষিদ্ধ কিছু দেখছে। দ্যাখে আর মুগ্ধ হয়ে যায়। আদিত্যর অভিজাত নাগরিক সত্তা টের পায়, এই মুগ্ধতার আড়ালে আর একটা হাবাগোবা গ্রাম্য আদিত্য মজুমদার লুকিয়ে রয়েছে। থাকলে থাকুক, কিছু এসে যায় না। অভিজাত, নাগরিক, হাবাগোবা, গ্রাম্য, বুদ্ধিমান, বোকা আদিত্যর সবকটা সত্তা এখন নতুন দাম্পত্যের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে।

বাড়িটা ছোট। পশ্চিমে শোবার ঘরের জানলা খুললে খাড়া দেয়াল। দেয়ালের আড়ালে একটা লোহা-লক্কড়ের কারখানা আছে। জানলা দিয়ে সেটা দেখা না গেলেও লোহা পেটানোর শব্দে কানে তালা ধরে যায়। তাই জানলাটা দিনের বেলায় খোলা যায় না। রাত্তিরে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে আদিত্য জানলাটা খুলে দেয়। একদিন রাত্তিরবেলা আদিত্য যখন অন্ধকারে আকুল হয়ে কেয়াকে আদর করছে তখন খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে তাদের বেআব্রু করে দিয়েছিল।

পুব-দক্ষিণেও জানলা আছে। সেদিক দিয়ে তাকালে রাস্তা দেখা যাবে। বড় রাস্তা নয়, বড় রাস্তা থেকে বেরোনো একটা শাখা। তবে বড় রাস্তার ট্র্যাফিক লাইট এড়াতে প্রায় সারাদিন সেখানে গাড়ি-অটো চলে। কালেভদ্রে বাড়িঘর-কাঁপানো ট্রাক। জানলার সামনে আদিত্য একটা আরাম-চেয়ার পেতেছে। ওটাই তাদের বসার ঘর। বাইরের কেউ এলে এই ঘরেই বসানো হয়। আদিত্যর সখের আরাম-চেয়ার ছাড়াও ঘরে তিনটে আলগা আলগা বেতের চেয়ার, একটা ছোট সেন্টার টেবিল, আর এক কোণে একটা ডিভান আছে। ডিভানের পেটে সুটকেস, কম্বল, বাড়তি বালিশ-চাদর-বেডকভার, কাগজপত্র এবং আরও হাবিজাবি জিনিস রাখার বন্দোবস্ত। ডিভানের ওপরে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কেয়া পরীক্ষার খাতা দ্যাখে। খুব শিগগির একটা টিভি কেনা হবে বলে সে শাসিয়েছে। ওটা কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে এখন জল্পনা চলছে।

আর একটা খুব ছোট কাজের ঘর আছে। সেখানে এক সেট চেয়ার টেবিল, দেয়ালে বই রাখার খোলা র‌্যাক, কাগজপত্র রাখার ছোট আলমারি। আদিত্যর সিডিগুলো বই-এর র‌্যাকের এক ধারে জায়গা পেয়েছে। আদিত্য বা কেয়া, যার যখন দরকার, এই ঘরে বসে লেখাপড়ার কাজ করে। এটা আদিত্যর গান শোনার ঘরও বটে।

 এছাড়া আছে একটা রান্না ঘর। সেখানে রান্নার ব্যবস্থা এবং খাবার চেয়ার-টেবিল। ওগুলো কিছুদিন আগে অন-লাইনে কেনা হয়েছে। রান্নাঘরে আদিত্যও মাঝে মাঝে রান্না করে। বিশেষ করে লাঞ্চ। কেয়ার ইস্কুলে বেরোনোর তাড়া থাকলে আদিত্য লাঞ্চ বানিয়ে দেয়। একটু সাহেবি ধরনের খাবার সে বানাতে পারে। স্যান্ডউইচ, বয়েলড ভেজিটেবলস, পাস্তা, কিংবা স্রেফ আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ, মাখন-পাঁউরুটি। কাজের মাসি কেটে-বেটে দেয়, রান্না করে না। তবে আদিত্য বা কেয়া কেউই রুটি করতে শেখেনি। একটু রাতের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে আদিত্য বাইরে থেকে রুটি কিনে আনে। রাস্তার মোড়ে বিহারিদের একটা রুটির দোকান আছে।

আজকাল আদিত্যর একটু নামডাক হয়েছে, বিশেষ করে সরকারি মহলে। সরকারি কাজ নিয়ে গত মাসে দু’বার দিল্লি যেতে হয়েছিল। আসল কাজটা হয়ে গেলেও এখনও কিছু সরকারি লৌকিকতা বাকি রয়ে গেছে। তার মধ্যে বড় কাজ একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট লিখতে হবে। সেটা লিখতে আদিত্যর আলস্য লাগছিল। রিপোর্ট লেখার থেকে অনিতা চৌধুরির ব্যাপারটা চিন্তা করা অনেক সন্তোষজনক। সকালবেলা ঘণ্টাখানেক রিপোর্ট লেখা নিয়ে ধস্তাধস্তি করার পর আদিত্য ঠিক করল গড়িয়াহাট থানায় সৈকত চৌধুরির কেসটা সম্বন্ধে জানতে যাবে। কিন্তু তার আগে, যে ইন্সপেক্টার মামলাটার তদন্ত করছে তার কাছে লালবাজার থেকে একটা ফোন গেলে ভাল হত। ফোনের বন্দোবস্ত করতে কিছুটা সময় লেগে গেল।

শ্যামবাজার থেকে মেট্রোতে কালীঘাট। অফিস যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা কামরা, আদিত্য কোনও ক্রমে একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছে। সে তেরচাভাবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। আশ্চর্য, এখনও আপিসযাত্রীদের ভিড় কমল না! সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে কামরা ফাঁকা হচ্ছে। চাঁদনি, এসপ্লানেড পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিট আসার আগেই আদিত্য বসার জায়গা পেয়ে গেল। ভবানীপুর স্টেশন, ইতিহাসকে কাঁচকলা দেখিয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছে নেতাজী ভবন, পৌঁছতেই এক ঝাঁক বাচ্চা হুড়মুড় করে কামরায় উঠে পড়ল। তাদের সঙ্গে তাদের মায়েরা। নিশ্চয় কোনও মর্নিং ইস্কুল ছুটি হয়েছে। বসার জায়গা থাকা সত্ত্বেও বাচ্চারা বসতে চায় না। কামরাটাই এখন তাদের খেলার মাঠ। কোনও কোনও মা অবশ্য তাদের বাচ্চাদের পাশে বসিয়ে টিপিন খাওয়াচ্ছিল। আড়ি পেতে বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে আদিত্যর খুব ভাল লাগে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে সুযোগ পাওয়া গেল না, দেখতে দেখতে ট্রেন পৌঁছে গেল কালীঘাট।

মাঘ মাসের মিঠে রোদ্দুর। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে আদিত্য হাঁটার মতলব করছিল। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অটোতে উঠে পড়তে বাধ্য হল। ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহাকে সোয়া একটায় টাইম দেওয়া আছে। দেরি হয়ে গেলে সে থানা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।

‘বসুন স্যার।’ ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা তার সামনের চেয়ারটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে বলল। ‘আপনার কথা অনেক শুনেছি।’

‘কার কাছে শুনলেন আমার কথা?’ আদিত্য একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।

‘আপনার কথা লালবাজারে তো সকলেই জানে। তবে আমি শুনেছি এমন একজনের কাছ থেকে যার সরাসরি সৌভাগ্য হয়েছে আপনার সঙ্গে কাজ করার। সুব্রত চাকিকে আপনার মনে আছে?’

‘বিলক্ষণ মনে আছে। চাকি আপনাকে আমার কথা বলেছে? সে এখন কোথায় পোস্টেড?’

‘আমাদের এখানেই স্যার। গড়িয়াহাট থানায়। চাকি আর আমি এক ব্যাচ, খুব বন্ধু। আপনার কথা চাকি খুব বলে। বলে, কুমুদিনী মামলায় আপনার সঙ্গে ও কাজ করেছিল।’

‘অবশ্যই করেছিল। চাকি কোথায়? তাকে ডাকুন না একবার?’

‘চাকি থানায় নেই স্যার। একটা কেসে সমন পেয়ে আলিপুর কোর্ট গেছে। আপনার সঙ্গে দেখা হল না বলে খুব আপশোষ করে গেল।’

‘আরে আজ দেখা হল না তো কী হয়েছে? আমি তো জেনে গেলাম চাকি এখানে পোস্টেড। আর একদিন সময় করে আসব।’

‘ঠিক আছে স্যার। আমি চাকিকে বলে দেব। একটু চা খাবেন তো স্যার? চা-টা আমাদের এখানে খুব ভাল করে।’ আদিত্যর সম্মতির অপেক্ষা না করেই অচিন্ত্য সাহা গলা তুলে কাউকে বলল, ‘আমার টেবিলে দুটো চা দিস গোবিন্দ।’

অন্তরীক্ষ থেকে উত্তর এল, ‘দিচ্ছি দাদা।’

চা-টা ভাল। আদা দেওয়া। চায়ে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে আদিত্য বলল, ‘আপনার কাছে একটা সাহায্য চাইতে এসেছি। জানতে পারলাম জামির লেনের সৈকত চৌধুরির খুনের কেসটা আপনি ইনভেস্টিগেট করছেন। সৈকত চৌধুরির স্ত্রী আমার কাছে এসেছিলেন। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির গোয়েন্দা ওকে খুব বিরক্ত করছে। বললেন, আমি যদি ওকে হেল্প করতে পারি।’

কথাগুলো বলতে বলতে আদিত্য লক্ষ করছিল অচিন্ত্য সাহার মুখটা ক্রমশ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর কথাগুলো শেষ হবার পর অচিন্ত্য সাহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমরা সকলে খুব সম্মান করি। তার থেকেও বড় কথা আপনাকে আমরা নিজের লোক মনে করি। তাই আপন ভেবে আপনাকে বলছি, আমাদের স্থির বিশ্বাস ওই মহিলাই ওর স্বামীকে খুন করেছে। আমার ইনভেস্টিগেশন অন্তত তাই বলছে। দেখুন, বাড়ির গেটে একজন সিকিউরিটি বসে থাকে। তার চোখ এড়িয়ে বাইরের লোকের পক্ষে বাড়িতে ঢোকা সম্ভব নয়। সিকিউরিটির ছেলেটা জোর দিয়ে বলছে সেদিন বিকেলে বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢোকেনি। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে বাড়ির ভিতরের কেউ সৈকত চৌধুরিকে খুন করেছে। কিন্তু অন্য ফ্ল্যাটের কারও সঙ্গে তো সৈকতের কোনও শত্রুতা ছিল না। সৈকতের মৃত্যুতে কারও কোনও লাভের সম্ভবনাও ছিল না। তাহলে একমাত্র বাকি রইল সৈকতের স্ত্রী অনিতা, সৈকত মারা গেলে যার পাঁচ কোটি টাকা পাবার কথা।’

‘সিকিউরিটি ছেলেটা কখনও গেট ছেড়ে যায়নি?’

‘আমি এটা বারবার জিজ্ঞেস করেছি। ছেলেটা হলফ করে বলছে সকালে ডিউটিতে আসার পর থেকে সে গেট ছেড়ে কোত্থাও যায়নি। বাড়িটা নতুন বলে এখনও সিসি টিভি বসেনি। তাই সিকিউরিটির কথাই আমাদের একমাত্র এভিডেন্স।’

‘সেদিন বাড়ির লোক কারা কারা বাইরে গিয়েছিল? সিকিউরিটি কিছু বলেছে?’

‘হ্যাঁ স্যার, বলেছে। আমি একটু আমার ডায়েরিটা দেখে বলতে পারব। দেখে বলছি স্যার।’

অচিন্ত্য সাহা তার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা ডায়েরি বার করল। তারপর দেখে দেখে বলল, ‘প্রদীপ চক্রবর্তী বেরিয়েছিল খুব সকালে। সিকিউরিটি ডিউটিতে আসার আগে। সিকিউরিটি ছেলেটা তাকে বেরোতে দেখেনি। বিকেলবেলা সে ফিরে আসে। পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে প্রদীপ চক্রবর্তী বলেছে সে তার স্ত্রীর জন্যে একটা ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিল। ওষুধটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। সারাদিন ঘুরে বড়বাজারের মেহতা বিল্ডিং, মানে যেখানে ওষুধের হোলসেলারদের দোকান, সেখানে সে ওষুধটা পেয়েছিল।’

‘অত সকালে বেরিয়েছিল কেন? অত সকালে ওষুধের দোকান খোলে নাকি?’

‘এই প্রশ্নটা স্যার আমার মাথাতেও এসেছিল। প্রদীপ চক্রবর্তী বলল, এস এস কে এম-এর কাছে কিছু দোকান আছে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। ওখানেই প্রথম ওষুধটা খুঁজেছিল। তারপর না পেয়ে অন্য জায়গায় খুঁজেছিল।’

‘বুঝলাম। আর কে কে বেরিয়েছিল?’

‘দীপক শাসমল দুপুরবেলা বেরিয়েছিল। ফিরেছিল প্রায় আটটা নাগাদ। কাছেই তার কলেজের একজন সহকর্মীর বাড়ি গিয়েছিল।’

‘আর?’

‘সকালে সৈকত চৌধুরি নিজে বেরিয়েছিল। বিকেলে ফিরে এসেছিল। অনিতা চৌধুরিও বেরিয়েছিল।’

‘আচ্ছা, সৈকত আত্মহত্যা করেনি কী করে বুঝলেন?’ আদিত্য প্রসঙ্গ পাল্টালো।

‘এই প্রশ্নটা প্রথম থেকেই আমাদের মাথায় ছিল। সৈকত আত্মহত্যা করেনি তো? কিন্তু ব্যালিস্টিক রিপোর্ট জোর দিয়ে বলছে এটা কিছুতেই আত্মহত্যা হতে পারে না। এটা নিঃসন্দেহে খুন। যেভাবে, মানে যে দিক থেকে, গুলিটা শরীরে এসে ঢুকেছে সেটা ভিক্টিম নিজে গুলি চালালে কখনই সম্ভব হত না।’

‘ব্যালিস্টিক রিপোর্ট থেকে আর কী জানা যাচ্ছে?’

‘বিশেষ কিছু না। শুধু এটাই যে একটা ছোট .৩২ ক্যালিবারের পিস্তল থেকে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল।’

‘মার্ডার ওয়েপনটা কি পাওয়া গেছে?’

‘না, সেটা অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি’ অচিন্ত্য সাহাকে একটু অপ্রস্তুত দেখাল, ‘তবে আমরা ওটার খোঁজে আছি। মনে হয়, পেয়ে যাব।’

‘তাহলে আপনারা কি শিগগির অনিতা চৌধুরিকে অ্যারেস্ট করছেন?’

‘আমরা একটু সময় নিচ্ছি। আসলে কেসটায় আরেকটা অ্যাঙ্গেল আছে। আমরা সেই ব্যাপারে কিছু এভিডেন্স জোগাড় করছি।’

আদিত্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অচিন্ত্য সাহার দিকে তাকাল। অচিন্ত্য সাহা বলল, ‘এই বাড়তি অ্যাঙ্গেলটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির গোয়েন্দা বিপ্লব সমাদ্দার। বিপ্লবদা আমাদের চেনা লোক। আমাদের সার্ভিস থেকেই রিটায়ার করে সদ্য এই জাপানি ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিতে জয়েন করেছেন, যে কোম্পানি ইনশিয়োরেন্সটা বিক্রি করেছে। বিপ্লবদা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন ইদানীং অনিতা চৌধুরি একটা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। মলয়া বিশ্বাস বলে অনিতাদের একজন পড়শি বলেছেন, যখন সৈকত চৌধুরি বাড়িতে থাকত না, একটি ছেলে অনিতাদের ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসা যাওয়া করত। মলয়া বিশ্বাস অনিতাদের ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে থাকেন। তাই হয়তো তাঁর চোখে পড়েছে। আমরা এই ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর নিচ্ছি।’

‘ছেলেটি অনিতার ভাই নয় তো?’

‘না, না। ভাই নয়। ভাই তো অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। এটা তার পরের ঘটনা। তাছাড়া অনিতার ভাইকে মলয়া বিশ্বাস ভাল করেই চেনেন। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি অনিতার ভাই অনেক দিন দেশে আসেনি। অতএব অনিতার বাড়িতেও আসেনি।’

‘তাহলে তো কেসটা বলতে গেলে সলভডই হয়ে গেছে।’

‘একরকম তাই। আমরা শুধু আরও এভিডেন্স সংগ্রহ করছি যাতে আদালতে কোনও সমস্যা না হয়।’

‘আমাকে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ এই বিপ্লব সমাদ্দারের ফোন নম্বরটা দিতে পারেন?’

‘অন্য কেউ হলে দিতাম না। কিন্তু আপনি তো স্যার আমাদের ঘরের লোক। আপনাকে তো দিতেই হবে। তবে আপনাকে যে কথাগুলো বললাম সেগুলো, বুঝতেই তো পারছেন, হাইলি কনফিডেন্সিয়াল। আপনাকে বলার দরকার নেই জানি। তবু বলছি, এসব কথা পাঁচ কান হলে স্যার আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।’ অচিন্ত্য সাহা তার মুখটা করুণ করে দেখাল।

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন এসব কেউ জানতে পারবে না।’

আদিত্য যখন গড়িয়াহাট থানা থেকে বেরোল তখন আড়াইটে বেজে গেছে।

(৪)

কয়েকটা দিন রিপোর্ট লিখে কেটে গেল। রিপোর্টের মূল অংশটা বিবাদী বাগের কাছে একটা গোপন সরকারি দপ্তরে জমা দেবার পর আদিত্যর একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। একটানা পরীক্ষা শেষ হবার পর যেমন লাগে। অবশ্য আরেকটা অংশ এখনও জমা দেওয়া বাকি রইল। সেটা ততটা গোপনীয় নয়, তাই মেল করে দিলেও হবে। সই করা একটা হার্ড কপি কুরিয়ারও করে দিতে হবে। কিন্তু আজ সে আর এই হতচ্ছাড়া রিপোর্ট নিয়ে ভাববে না। মিনিট দশেক হেঁটে বৌবাজারে তার আপিসে পৌঁছে আদিত্য ভাবল আজ বাকি দিনটা আরাম করবে। সে কেটলিতে কফির জল বসিয়ে সিগারেট ধরাল। ল্যাপটপে সঞ্চয় করে রাখা আলি আকবর খাঁ সাহেবের লঙ্কাদহন সারং চালাল। বাজনা শুনতে শুনতে আদিত্য একেবারে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রচলিত বৃন্দাবনী সারং-এ অবরোহণের সময় কোমল গান্ধার লাগাচ্ছেন খাঁ সাহেব। কখনও কখনও শুদ্ধ ধৈবতও লাগাচ্ছেন। এই তাহলে লঙ্কাদহন সারং! অমিতাভর কাছ থেকে অনেকদিন আগেই এটা আদিত্য পেয়েছিল। এতদিনে শোনার সময় হল। অমিতাভ বলেছিল, এই রাগটার পেছনে একটা গল্প প্রচলিত আছে। হনুমান লঙ্কা জ্বালিয়ে দেবার পর খেয়াল করলেন এই লঙ্কা শহরেই তো মা সীতা বন্দিনী রয়েছেন। শহর জ্বলে গেলে তাঁর কী হবে? লঙ্কাদহন সারং হনুমানের সেই ভয়, উৎকণ্ঠা এবং বিষাদের প্রকাশ। গল্পটা যাই হোক, আদিত্যর মনে হল সুরগুলো হাহাকার করছে। বিশেষ করে খাঁ সাহেবের এক-একটা দিগন্তব্যাপী মিড় আদিত্যকে একেবারে পেড়ে ফেলেছিল।

বাজনা শেষ হবার পরেও আদিত্যর ঘোর কাটছিল না। মোবাইলটা বেজে না উঠলে কতক্ষণে কাটত বলা শক্ত। কেয়া ফোন করছে।

‘এই শোনো, আমরা সামনের রবিবার, মানে পরশুদিন, স্কুলের সবাই পিকনিকে যাচ্ছি। সব্বার বর যাবে। বাচ্চারাও আসছে। তুমিও যাচ্ছ কিন্তু। আমি বলে দিয়েছি তুমিও যাচ্ছ। তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। না বলতে পারবে না।’ একটানা কথাগুলো বলে কেয়া থামল।

‘পিকনিক? কোথায় পিকনিক?’ আদিত্য একটু একটু করে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে।

‘ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে, গঙ্গার ধারে একটা বাগানবাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সকালবেলা যাব, বিকেল অবধি প্রোগ্রাম। তুমি যাচ্ছ কিন্তু। আমাদের বিয়েতে তো কাউকে নেমন্তন্ন করতে পারিনি, তাই কেউ তোমাকে দেখেনি। সবাই তোমাকে দেখতে চায়।’

‘আমি কি একটা দেখার জিনিস?’ আদিত্য মৃদু আপত্তি জানাল। ‘ঠিক আছে যাব। শাশ্বতী শাসমল আসছেন তো? মানে, যিনি অনিতা শর্মা চৌধুরিকে আমার কাছে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’

‘শাশ্বতী অবশ্যই আসবে। শাশ্বতী আর কেমিস্ট্রির অদ্রিজাই তো মেন অরগানাইজার।’

‘তোমাদের কি কেমিস্ট্রির অদ্রিজা ছাড়া আরও অদ্রিজা আছে?’

‘আছে তো। হিস্ট্রিতে আর একজন অদ্রিজা আছে। সেও যাচ্ছে। হিস্ট্রির অদ্রিজা আবার তোমার বিরাট ফ্যান। প্রায়ই জিজ্ঞেস করে তুমি এখন কী করছ। কোন কেস নিয়ে কাজ করছ। এইসব। খবর কাগজে তোমার কথা পড়েছে।’

‘সর্বনাশ করেছে।’ আদিত্যর গলাটা শঙ্কিত শোনাল। ‘আমার তাহলে বোধহয় না যাওয়াই ভাল।’

‘আরে ধ্যাৎ। তুমি কি উত্তমকুমার নাকি যে মবড হয়ে যাবে? কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।’

‘না, না। আমি মবড হবার কথা বলিনি। আসলে, তুমি তো জান, আমার প্রফেশনটা নিয়ে আমার খুব সংকোচ আছে। মজুমদার বাড়ির ছেলে আর কিছু করতে না পেরে পেটের দায়ে টিকটিকির কাজ করছে, এটা কি বড়াই করে বলার মতো কিছু?’ আদিত্যর গলাটা বিষণ্ণ শোনাল।

‘তোমার সব কিছুই অদ্ভুত। সংকোচের কী আছে? খবর কাগজে তোমার নাম বেরোচ্ছে, সবাই তোমার কথা বলছে। আমার তো তোমাকে নিয়ে খুব গর্ব।’

 কেয়া ফোন রেখে দেবার পর আদিত্য অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সৈকত চৌধুরির মৃত্যু রহস্যটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। অচিন্ত্য সাহা যদিও বলছে রহস্য কিছু নেই, অনিতাই টাকার লোভে এবং সম্ভবত তার প্রেমিকের প্ররোচনায় স্বামীকে খুন করেছে, অনিতাকে দেখে আদিত্যর একবারও মনে হয়নি যে সে বন্দুক চালিয়ে নিজের হাতে স্বামীকে খুন করতে পারে। হয়তো লোক লাগিয়ে খুন করানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল, কিন্তু সিকিউরিটি ছেলেটাই তো বলছে সেই বিকেলে বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢোকেনি। তাছাড়া সৈকত চৌধুরির পার্টনার মণিময় গুপ্তর সঙ্গেও কথা বলা দরকার। অনিতা চৌধুরি বলছে মণিময় নাকি সৈকতকে ঠকিয়েছিল। কথাটা সত্যিও হতে পারে, আবার অনিতার বানানোও হতে পারে। আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর না পেলে আদিত্যর স্বস্তি হচ্ছে না। অনিতা চৌধুরির রহস্যময় প্রেমিকটি কে? তার বাপের বাড়ির লোকজনই বা এখানে কোন ভূমিকা পালন করছে? স্ত্রীকে না জানিয়ে সৈকত চৌধুরি অত মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন? যদি ধরে নেওয়া যায় ইনশিয়োরেন্সের কথা অনিতা জানত তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, অনিতা কি এতই বোকা যে সে বুঝতে পারবে না মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স করে তার স্বামী খুন হয়ে গেলে পুলিশ তাকেই সন্দেহ করবে? তাহলে সে এই কাঁচা কাজটা করতে গেল কেন?

আদিত্য মোবাইলটা তুলে অচিন্ত্য সাহার নম্বরটা লাগাল।

‘আর একবার একটু বিরক্ত করছি।’ আদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলল।

‘না, না। বিরক্ত বলবেন না স্যার। আমরা অলোয়েজ অ্যাট ইয়োর সারভিস। আপনি বলুন স্যার।’

‘আমার ছোট্ট প্রশ্ন, তখন জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। প্রশ্নটা হল, আপনারা কি সৈকত চৌধুরির পার্টনার মণিময় গুপ্তকে ট্রেস করতে পেরেছেন?’

‘না স্যার। এখনও পারিনি। তবে ওই অফিসের অনেকে বলছে এরকম অজ্ঞাতবাসে মণিময়বাবু আগেও কয়েকবার গিয়েছিলেন। এতদিনে তাঁর ফিরে আসার সময় হয়েছে।’

‘মণিময়বাবুর খবর পেলে আমাকে একবার জানাবেন?’

‘নিশ্চয় জানাব স্যার। আর কিছু?’

‘আর যদি অনিতা চৌধুরির গোপন প্রেমিকের সন্ধান করতে পারেন, একটু জানাবেন প্লিজ।’

‘ঠিক আছে স্যার। জানাব।’ অচিন্ত্য সাহার গলায় আদিত্য একটু দ্বিধা লক্ষ করল। আদিত্যর মনে হল এই প্রেমিকের ব্যাপারটা অচিন্ত্য খানিকটা জানে। হয়তো ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ বিপ্লব সমাদ্দারের কাছ থেকে জেনেছে। হয়ত বিপ্লব সমাদ্দার অন্য কাউকে ব্যাপারটা জানাতে তাকে বারণ করেছে। অনিতাকে খুনি প্রমাণ করার ব্যাপারে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি এবং বিপ্লব সমাদ্দার দু’তরফেরই স্বার্থ আছে। সে মুখে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অচিন্ত্যবাবু। আজ রাখছি, কেমন?’

‘ঠিক আছে স্যার। ভাল থাকবেন।’

অনিতার গোপন প্রেমের ব্যাপারে অচিন্ত্য আর কিছু জানাবে বলে মনে হচ্ছে না। সে আর বিপ্লব সমাদ্দার দুজনে মিলে অনিতার বিরুদ্ধে ঘুটি সাজাচ্ছে। অনিতার গোপন প্রেমের ব্যাপারটা অন্যভাবে জানতে হবে। আদিত্য মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে আবার ডায়াল করল। বিমল।

‘আপনি স্যার যাদু জানেন। এই আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই আপনার ফোন। কেমন আছেন স্যার?’

‘ভাল আছি। তোমরা কেমন আছ?’

‘আমরা সবাই ভাল আছি স্যার। ম্যাডাম কেমন আছেন?’

‘ম্যাডাম ভাল আছে। তুমি আমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলে কেন?’

‘স্যার আমার মেয়ের বিয়ে। এই ফাল্গুন মাসে। ১৬ই ফাল্গুন। দিনটা ১লা মার্চ পড়েছে।’

‘সেকি ? তোমার মেয়ে তো ইস্কুলে পড়ে। এর মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ? মেয়ের বয়েস কত?’

‘মেয়ের বিয়ের বয়েস হয়ে গেছে স্যার। গত ডিসেম্বর মাসে আঠেরো পূর্ণ করে উনিশে পড়ল। ও একটু বেশি বয়েসে পড়ছে স্যার।’

‘তাও এমন কিছু বয়েস হয়নি। আর একটু লেখাপড়া করত না হয়। এখনই বিয়ে দিয়ে দেবার কী আছে?’ আদিত্য ধমকের স্বরে বলল।

‘আমরা বিয়ে দেবার কে স্যার? মেয়ে নিজেই তার বিয়ে ঠিক করেছে। পাড়ারই ছেলে। দুজনে এত বেশি মিশছিল যে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম বিয়েটা দিয়েই দিই।’

‘ছেলে কী করে?’

‘আমাদের ওদিকে তৃপ্তি ক্যাটারার বলে একটা ক্যাটারার আছে স্যার। তার মালিক বোসবাবু আমাদের পাড়াতেই থাকেন। তৃপ্তি ক্যাটারারের খুব নামডাক আমাদের ওদিকে। আমার হবু জামাই তৃপ্তি ক্যাটারারের কুক। ও যা বিরিয়ানি বানায় না স্যার, একবার খেলে বারবার খেতে হবে।’

‘বয়েস কত ছেলের? মেয়ের সঙ্গে মানাবে তো?’ আদিত্য এখনও যেন খবরটা মেনে নিতে পারছে না।

‘তিরিশের কাছাকাছি বয়েস হবে স্যার। আর একটু কম হলে হয়তো ভাল হত, কিন্তু মেয়ে নিজে পছন্দ করেছে। আমাদের আর কী বলার আছে? মেয়ে তো এখন সাবালিকা। আমরা আপত্তি করলে আমাদের অমতেই বিয়ে করে নেবে। যাই হোক, আপনাকে আর ম্যাডামকে কিন্তু আসতেই হবে স্যার। আমি বাড়ি গিয়ে পত্তর দিয়ে নেমন্তন্ন করে আসব। এখন শুধু বলে রাখছি। ওই দিনটা কোনও কাজ রাখবেন না যেন।’

‘রাখব না, রাখব না। কোনও কাজ রাখব না। তোমার মেয়ের বিয়ে বলে কথা। যেতে তো হবেই। এখন শোনো, যে কারণে তোমাকে ফোন করেছি। আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। পারবে? খুব বেশি সময় লাগবে না।’

‘নিশ্চয় পারব স্যার। আপনার জন্যে আমি সব সময় হাজির আছি। বলুন কী করতে হবে।’

‘জামির লেনের একটা ঠিকানা দিচ্ছি। ফ্ল্যাটবাড়ি। ছটা ফ্লাট আছে। কিছুদিন আগে তিনতলার একটা ফ্ল্যাটে খুন হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী থাকত। স্বামী খুন হয়েছে। স্বামীর নাম সৈকত চৌধুরি। স্ত্রীর নাম অনিতা। অনিতার একজন পুরুষ বন্ধু আছে। সে বোধহয় মাঝে মাঝে অনিতার সঙ্গে দেখা করতে আসে। অন্তত আগে আসত। সৈকত খুন হবার পর আসে কিনা জানি না। তোমাকে কোনওভাবে ওই পুরুষ বন্ধুটির সম্বন্ধে জানতে হবে। সে কোথায় যায়, কী করে, অনিতার সঙ্গে তার কতদিনের সম্পর্ক, কতটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক, আমার সবটা জানা দরকার। পারবে তো?’

‘পারব স্যার। এটা কোনও ব্যাপারই না। আমার তো এখনও রাত্তিরের ডিউটি। দিনের বেলাটা ঘুমিয়েই কাটে। কটা দিন না হয় না ঘুমিয়ে আপনার কাজটা করে দেব স্যার।’

‘ঠিক আছে তুমি তাহলে ঠিকানাটা টুকে নাও।’

‘আপনি মুখে বলে দিন স্যার। ও আমার মনে থাকবে। আর ওই ১ মার্চ তারিখটা যেন ভুলবেন না।’

বিমল ফোন রেখে দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এবার অমিতাভ।

‘শোন, তোর সঙ্গে একটা খুব জরুরি আলোচনা আছে। কাল দুপুরের দিকে ফ্রি আছিস?’

‘কাল দুপুরে? ঠিক আছে। তেমন কোনও কাজ নেই। কিন্তু কী ব্যাপার বলত?’

‘আমাকে খুব শিগগির একটা সিরিয়াস ডিসিশন নিতে হবে। স্কুল অফ হিস্টোরিকাল স্টাডিজ আছে নিউ ইয়র্কে, আজকাল ওখানে খুব ভাল কাজ হচ্ছে। ওরা আমাকে একটা চেয়ার অফার করেছে। খুবই প্রেস্টিজিয়াস চেয়ার। অফারটা অ্যাকসেপ্ট করতে গেলে দেশের পাততাড়ি গোটাতে হবে। ওরা বলছে রত্নারও একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। এদিকে এখানে আর টিকতে পারছি না। পদে পদে পলিটিকাল ইন্টারফিয়ারেন্স। কোনও রিক্রুটমেন্ট ঠিকঠাক হয় না। সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছি। অ্যামেরিকায় চলে গেলে টুবলুর কেরিয়ার অপশানগুলোও অনেক বেটার হবে মনে হয়। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। কিন্তু তোর সঙ্গে আলোচনা না করে কোনও ফাইনাল ডিসিশন নিতে পারছি না। তাহলে কাল দুপুরে, ধর একটা নাগাদ, তোর অফিসে চলে যাচ্ছি। ঠিক আছে?’

‘এখানকার চাকরি ছেড়ে একেবারে পাকাপাকি চলে যাবি?’

‘না, এক্ষুনি চাকরি ছাড়ছি না। ছুটি নিয়ে যাব ভাবছি। নৌকো পুড়িয়ে না যাওয়াই ভাল। ওখানে গিয়ে কেমন লাগবে তো জানি না।’

‘বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, তুই চলে আয়, তখন কথা হবে।’

আদিত্য মোবাইলটা টেবিলে রেখে চুপ করে বসে রইল। তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। অমিতাভ-রত্না তার নিকটতম বন্ধু। তারাও যদি কলকাতা ছেড়ে চলে যায় তাহলে বন্ধু বলতে কে আর রইল?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *