সেই লোকটা!

সেই লোকটা!

প্ল্যান করা হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই৷ কিন্তু কিছুতেই সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছিল না৷ কারণ একটাই৷ তিনজনের একসঙ্গে ছুটি নেওয়াটা আর কিছুতেই হয়ে উঠছিল না৷ মৈনাক কলেজে পড়ায়৷ তার ছুটি নিয়ে মোটেই সমস্যা নেই৷ পুজোয় তো এমনিতেই লম্বা ছুটি৷ গরমের সময় পরীক্ষার খাতা দেখা থাকলেও ছুটি নিতে খুব বেশি সমস্যা হয় না৷ প্রতীক ব্যাংকে চাকরি করে৷ মার্চ মাস ছাড়া অন্য সময় আগে থেকে ঠিক করে নিলে তারও ছুটি নেওয়া খুব একটা অসুবিধা নয়৷ ঝামেলা হল শান্তনুকে নিয়ে৷ তার চাকরি আইটি সেক্টরে৷ একে তো ডিউটি শিফটের কোনো মাথামুন্ডু নেই৷ ছুটি পাওয়াও ভারী কঠিন৷ তারমধ্যে শান্তনুর এমন একটা হাবভাব যেন সে অফিসে না গেলে অফিসের কাজকর্মই লাটে উঠবে৷ এদিকে আবার বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেটিও ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা৷ ফলে আলাপ-আলোচনা, জায়গা বাছা সব হয়ে গেলেও দিনটা আর কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছিল না৷

শেষ পর্যন্ত অবশ্য হয়েছে৷ এবার পুজো বেশ দেরিতে৷ পুজোর বেড়ানো শেষ করে লোকজন যখন বাড়িমুখো তখনই ওরা চাপবে ট্রেনে৷ কালীপুজোর এক সপ্তাহ আগে বেরিয়ে ঠিক ভাইফোঁটার পরের দিন ফেরা৷ গন্তব্য গাড়োয়াল হিমালয়৷ প্রথমে নৈনিতাল৷ সেখান থেকে কৌশানি, তারপর বিনসর, চকোরি, শেষে পিথোরাগড় হয়ে ফেরা৷ প্রতীকের ইচ্ছে ছিল মাঝখানে আলমোড়াতেও একদিন থেকে যাওয়ার৷ কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি৷ যাওয়া-আসা নিয়ে এগারো দিনের ট্যুর৷

মৈনাক, শান্তনু আর প্রতীক আসলে স্কুলের বন্ধু৷ কিন্তু একই পাড়ায় থাকে বলে স্কুল পাশ করে যাওয়ার পরেও বন্ধুত্বে কোনো ছেদ পড়েনি৷ ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার তিনবাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে৷ কলেজে পড়ার সময় তারা তিনজনে লম্বা ট্যুর করেছে৷ চাকরি পাওয়ার পর অবশ্য এবারই প্রথম একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া৷

তিনজনে খুব বন্ধু হলেও স্বভাব-চরিত্র অনেকটাই আলাদা রকম৷ মৈনাক ধীর-স্থির, শান্ত প্রকৃতির, মাথা ঠান্ডা ছেলে৷ তবে একটু আলসে ধরনের৷ চট করে কিছু করে ফেলা তার দ্বারা হয় না৷ প্রতীক আবার ভারী চটপটে, সপ্রতিভ৷ যে কোনো জায়গায়, অচেনা লোকজনের সঙ্গে জমিয়ে ফেলতে তার জুড়ি নেই৷ তুলনায় শান্তনু বেশ খানিকটা নাক উঁচু, সামান্য হামবাগ ধরনের৷ যদিও সেটা কখনোই বিপজ্জনক মাত্রায় নয়৷ আর শান্তনুর বেশ রসবোধ আছে৷ মজার মজার আজগুবি কথা বলে সে অন্যদের দিব্যি হাসাতে পারে৷ তিনজনে একসঙ্গে থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেও কোনো অসুবিধা হয় না৷ হাওড়া থেকে রাত পৌনে দশটায় ছাড়ে কাঠগোদাম এক্সপ্রেস৷ তাতেই রিজার্ভেশন করা ছিল৷ বাড়ি থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিনজনে৷ ব্যাগ বলতে অবশ্য একটি করে পিট্টু মানে বড়সড় রুকস্যাক৷ বেশি জিনিসপত্র নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার পক্ষপাতী নয় কেউই৷ ট্যাক্সি ধরে সোজা হাওড়া স্টেশন৷ তিনজনেই মোটামুটি ভালো চাকরি করছে৷ তাই এসি টু-টিয়ারেরই টিকিট কাটা হয়েছে৷ ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দিলে, নম্বর মিলিয়ে উঠে পড়া গেল৷ চারজনের একটা ক্যুপেতে, দুটো লোয়ার বার্থ প্রতীক আর শান্তনুর৷ শান্তনুর ওপরের বার্থটা মৈনাকের৷ প্রতীকের সঙ্গে একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক৷ সন্ধে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোনো হয়েছে৷ রাত্তিরের খাবার তো আর খেয়ে আসা যায়নি৷ তাই ট্রেন ছাড়তেই সবার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ল প্লাস্টিকের ঢাকনা দেওয়া কৌটো৷ লুচি, মুরগির কষা, আলুর দম আর চমচম৷ খাওয়া-দাওয়া সেরে, খানিকক্ষণ গল্পগুজব হল৷ কামরার বেশির ভাগ লোকই অবশ্য ততক্ষণে, কম্বল মুড়ি দিয়ে বালিশে মাথা রেখেছে৷ বড় আলো নিভে গেছে৷ পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে৷ অন্যরা বিরক্ত হতে পারে ভেবে শুয়ে পড়ল তিনজনেই৷

পরের দিন সকালে উঠে শুরু হল টুকটাক আড্ডা৷ ট্রেন তখন চলছে বিহারের ভিতর দিয়ে৷ চারপাশে রুক্ষ জমি৷ মাঝে-মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম৷ কুয়োতলা৷ ঝিরঝিরে নদী৷ এসি কামরার মোটা কাচের ভিতর থেকে সবই বেশ মনোরম, চোখ জুড়ানো৷ সেদিনটা ট্রেনেই কাটবে৷ পরের দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ কাঠগোদাম পৌঁছানোর কথা৷ সেখান থেকে গাড়ি নেওয়া হবে৷ গাড়িতে করে সব জায়গা ঘুরে আবার কাঠগোদামে ফিরে এসে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে৷ হোটেল অবশ্য সব জায়গাতেই বুক করা আছে৷ এখন যেহেতু ইন্টারনেটেই সব করা যায়, তাই আগে থেকেই বুকিং সেরে ফেলতে অসুবিধা হয়নি৷ ট্রেনটা চলছিল ভালোই৷ কিন্তু দুপুরের পর হঠাৎ একটা অজানা ছোট্ট স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আধঘণ্টা-একঘণ্টা, গাড়ির নড়ার কোনো লক্ষণ নেই৷ লোকজনের কাছে জানা গেল, সামনের লাইনে কোথায় নাকি ফিশ-প্লেট খোলা ছিল৷ সময়মতো নজরে আসায় দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি৷ কিন্তু লাইনটা পরীক্ষা করা হচ্ছে আর কোথাও কোনো গণ্ডগোল আছে কিনা দেখার জন্য৷ সেটা হয়ে গেলে তবেই গাড়ি ছাড়বে৷ বদ্ধ কম্পার্টমেন্টে বসে থাকাটা খুবই বিরক্তিকর৷ তিন বন্ধুই তাই প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে দেখছিল৷ দেখার অবশ্য বিশেষ কিছুই নেই৷ নেহাতই ছোট একটা স্টেশন৷ টিনের চালা দেওয়া স্টেশন মাস্টারের ঘর৷ তার ওপাশে দুটো-চারটে মাটির বাড়ি৷ লোকজনও বিশেষ নেই৷ একটা দেহাতি বউ ছেলে কোলে ঘোমটা টেনে বসে আছে৷ সঙ্গের লোকটা সম্ভবত তার বর৷ পান চিবোচ্ছে আর পায়চারি করছে৷ হাঁটতে হাঁটতে তিন বন্ধু প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে, এমন সময় নজরে পড়ল, প্ল্যাটফর্মটা যেখানে ঢালু হয়ে গেছে ঠিক তার আগেই বসে আছে একটা ভিখারি৷ সর্বাঙ্গে একটা ময়লা সাদা কাপড় জড়ানো৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও বোঝা যায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা৷ একমাথা ঝাঁকড়া চুল৷ প্রতীকরা কাছে যেতেই খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, দয়া লাগে বাবা৷ দোদিন সে খানা নেহি খায়া৷ পাঁচঠো রূপয়া দে দো গরিবকো৷

বেড়াতে বেরোলে মানুষের মন এমনিতেই খুশি থাকে৷ তা ছাড়া মৈনাকের আবার দয়ার শরীর৷ সে পকেটে হাত দিয়েছিল৷ কিন্তু শান্তনু তার হাত চেপে ধরে বলল, মোটেই দিবি না৷ দিব্যি নধর চেহারাখানা৷ খেটে খেতে পারে না? কুঁড়ের হদ্দ৷ ভিক্ষা করে অন্যের পয়সায় থাকার অভ্যাস৷ এইসব পরগাছাকে একটুও প্রশ্রয় দিতে নেই৷

কথা বলতে বলতে ভিখারিটাকে ছাড়িয়ে তিনজনেই এগিয়ে গেছিল খানিকটা৷ হঠাৎ দেখা গেল সিগন্যাল সবুজ হয়েছে৷ গাড়ি ছাড়বে৷ তাড়াহুড়ো করে ফেরার সময়, হয়তো খানিকটা অনিচ্ছাতেই শান্তনুর পায়ে লেগে ভিখারিটার সামনে রাখা খুচরো পয়সার বাটিটা গেল উলটে৷ কিন্তু তখন আর পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই৷ তিনজনেই দৌড়ে এসে কামরায় উঠতে না উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল৷ প্রতীক আর মৈনাক ভিতরে চলে গেলেও শান্তনু দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ ট্রেন ধীরে ধীরে চলছে৷ দূর থেকেই শান্তনু দেখল ভিখারিটা কীরকম যেন অদ্ভুতভাবে খুচরোর বাটিটার ওপর উপুড় হয়ে কিছু একটা করছে৷

কামরার দরজাটা যখন ভিখারিটাকে পেরোচ্ছে, তখন লোকটা হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল শান্তনুর দিকে৷ তার দু-চোখে একটা অসম্ভব জ্বলজ্বলে হিংস্র দৃষ্টি৷ শান্তনুর বুকের ভিতরটা কীরকম যেন অজানা আতঙ্কে শিরশির করে উঠল৷

রাত তখন বেশ গভীর৷ ট্রেন চলছে প্রচণ্ড গতিতে৷ কামরায় সবাই গভীর ঘুমে৷ ক্যুপেতে আজ ওরা তিনজন৷ কারণ প্রতীকের ওপরের বার্থে যিনি ছিলেন তিনি বিকেল নাগাদ নেমে গেছেন৷ কীরকম একটা অস্বস্তিতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল শান্তনুর৷ আধো অন্ধকারে চোখ খুলতেই মনে হল, তার উলটোদিকের ওপরের খালি বার্থটায় কে যেন শুয়ে আছে৷ তাহলে কি মাঝখানে কোনো প্যাসেঞ্জার উঠেছে? ভালো করে তাকাল শান্তনু৷ নাঃ, বার্থ তো ফাঁকা৷ আবার চোখ বুজতেই শুরু হল অস্বস্তি৷ বারেবারেই মনে হচ্ছে, ওই বার্থটাতে আপাদমস্তক সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে কে যেন শুয়ে আছে৷ অথচ চোখ খুললে দেখা যাচ্ছে না৷ শান্তনুর কেমন যেন মনে হচ্ছে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা লোকটার সঙ্গে দুপুরে দেখা ভিখারিটার চেহারার মিল আছে৷ তার একবার ইচ্ছে হল প্রতীককে ডাকে৷ কিন্তু ব্যাপারটা এতই আজগুবি যে শেষ পর্যন্ত না ডেকে উলটোদিক ফিরে শুল এবং অনেকক্ষণ অস্বস্তিতে ছটফট করে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়েও পড়ল৷

পরদিন সকালবেলায় ঝকঝকে রোদে অবশ্য রাতের সবকিছুই ভারী অবাস্তব আর হাস্যকর ঠেকল শান্তনুর৷ নামার সময় হয়ে এসেছে৷ প্রতীকের তাগাদায় জিনিসপত্র যেটুকু যা বার করা হয়েছিল গুছিয়ে ব্যাগে পুরে ফেলল সবাই৷ ট্রেন মোটামুটি সময়মতোই কাঠগোদাম পৌঁছোল৷ সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে নৈনিতাল৷ লেকের ধারেই হোটেল বুক করা হয়েছে৷ বেশ কনকনে ঠান্ডা৷ জিনিসপত্র রেখে তখনই চারিদিকে এক চক্কর দিয়ে আসা হল৷ তারপর সন্ধের মুখে হোটেলে ফিরে গরম কফির সঙ্গে চিকেন পকোড়া খেয়ে দিলখুশ হয়ে গেল তিনজনেরই৷ পাহাড়ি জায়গায় এমনিতেই লোকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে৷ তার ওপর দু-রাত ভালো করে ঘুম হয়নি৷ তাই রাতের খাওয়া সেরে কম্বলের তলায় ঢুকে একটু গল্পগুজবের পরই নাক ডাকতে লাগল প্রতীকের৷ মৈনাকেরও হাই উঠছে দেখে আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল শান্তনু৷ একটা মস্ত ডাবল বেড রুমে একস্ট্রা কট ঢুকিয়ে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে৷ ঘরটার চারপাশেই মস্ত মস্ত কাচের জানলা ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা৷ তবে ঘরটা যাতে পুরোপুরি অন্ধকার না হয়ে যায়, তাই প্রতীক একটা জানলার পর্দা খানিকটা সরিয়ে রেখেছে৷

পাশের দুটো খাটে দুই বন্ধুই ঘুমোচ্ছে৷ কিন্তু ক্লান্তিতে চোখ ভারী হওয়া সত্ত্বেও শান্তনুর কিছুতেই ঘুম আসছে না৷ বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছে ওই পর্দা সরানো জানলাটার দিকে৷ এরকম করতে করতেই বোধহয় একটু চোখটা লেগে এসেছিল৷ হঠাৎ চটকা ভেঙে শান্তনুর মনে হল ঘরটা যেন একটু বেশি অন্ধকার৷ চমকে জানলার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাদা কাপড় জড়ানো একটা লোক৷ নিজের অজান্তেই গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল শান্তনুর৷ আওয়াজটা হতেই জানলা ফাঁকা৷ কেউ কোথথাও নেই৷ কিন্তু ততক্ষণে তার চিৎকারে মৈনাক ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে৷

কী রে, কী হয়েছে?

বন্ধুর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন শুনে শান্তনু বলল, মনে হল ওই জানলাটার সামনে কেউ যেন দাঁড়িয়েছিল৷

অচেনা জায়গা৷ শান্তনুর কথা শুনে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠল মৈনাক৷ প্রতীকেরও ঘুম ভেঙে গেছে৷ জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে জানলার কাছে গিয়ে সেটা খুলে ভালো করে চারপাশটা দেখে মৈনাক বলল, দূর, তুই ঘুমের ঘোরে ভুল দেখেছিস৷ এপাশে তো কিছুটি নেই৷ নীচে সোজা খাদ নেমে গেছে৷ কারুর পক্ষে এই জানলার সামনে এসে দাঁড়ানোই সম্ভব নয়৷

জানলাটা বন্ধ করে পর্দাটা টেনে দিল মৈনাক৷ তিনজনেই শুয়ে পড়ল আবার৷ ঘুমিয়ে পড়ল শান্তনুও৷ গভীর ঘুম নয়, ছেঁড়া ছেঁড়া৷ পরদিন সকালে উঠে নিজেও একবার জানলাটা খুলে দেখল৷ ঠিকই বলেছে মৈনাক৷ তাহলে কি কোনো পাখি-টাখি উড়ে যাচ্ছিল? রাতচরা পাখির চওড়া ডানার ছায়া পড়েছিল জানলায়? কিন্তু সে তো ঘুমোয়নি৷ জেগেই ছিল৷ বেশ স্পষ্ট দেখেছে একটা মানুষের অবয়ব৷ আবছা অন্ধকারে মনে হচ্ছিল গায়ে যেন সাদা কাপড় জড়ানো৷ জোর করে মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাপারটাকে মন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করল শান্তনু৷ নৈনিতালে আজই তাদের শেষদিন৷ ভালো করে ঘুরে দেখে নিতে হবে সবকিছু৷ উলটোপালটা চিন্তায় মন ভারী হয়ে থাকলে চলবে না৷

সেদিন রাতে জানলার সব পর্দা ভালো করে টেনে শোয়া হয়েছিল৷ রাতে আর কোনো গণ্ডগোল হয়নি৷ শান্তনুরও ঘুম হয়েছিল ভালোই৷ পরদিন সকালে জলখাবার খেয়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া হল কৌশানির দিকে৷ যাওয়ার পথে একপাশে ঘন সবুজ পাহাড়৷ অন্যপাশে খাদ৷ মাঝে মাঝে নেমে আসছে রুপোলি ঝরনা৷ পরিষ্কার ঝকঝকে নীল আকাশ৷ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া৷ সব মিলিয়ে দারুণ লাগছিল তিনজনেরই৷ মাঝে দু-একবার নেমে ছবিও তোলা হল৷ কৌশানি যখন পৌঁছানো হল তখন বারোটা বেজে গেছে৷ খিদেও পেয়েছে জোরে৷ কিন্তু মুশকিল হল যে হোটেলটা তারা বুক করে এসেছে সেটা অপেক্ষাকৃত নতুন৷ তাই ড্রাইভার আগেই জানিয়ে দিয়েছিল সে হোটেলটা চেনে না৷ তাতে অবশ্য চিন্তার কিছু নেই৷ কৌশানি নেহাতই ছোট একটা ট্যুরিস্ট স্পট৷ একটু খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে ধরে নিয়ে গাড়িটা দাঁড় করানো হল একটা বাজার মতো জায়গায়৷ ছোট-খাটো দোকান-পাট৷ ফল, সবজি, জামা-কাপড় সবই বিক্রি হচ্ছে৷ স্থানীয় লোকজনই ঘোরাফেরা করছে৷ শান্তনু হিন্দিটা ভালো বলে৷ তাই সে গাড়ি থেকে নেমে একটা লোককে হোটেলের নাম আর ঠিকানাটা বলল৷ কিন্তু সে লোকটা হয় আনাড়ি না হয় হিন্দিও ঠিকমতো বোঝে না৷ তাই কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে চলে গেল৷ বাধ্য হয়েই শান্তনু আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একজন বয়স্ক দোকানদারকে হোটেলের ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখালে, তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলেন৷ বলেও দিলেন, বড় রাস্তা বরাবর আরও খানিকটা এগোলে, বাঁ হাতে পাহাড়ে ওঠার একটা পথ আছে৷ সেটা ধরে ওপরে উঠে একটু গেলেই হোটেল সামারিটান৷ খুশি হয়ে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসছে শান্তনু৷ একটু দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷

হঠাৎ রাস্তার পাশে তাকিয়ে সাংঘাতিক চমকে গেল শান্তনু৷ একটা ছোট বাড়ি৷ রাস্তা থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে৷ সিঁড়ির পাশেই বসে আছে একটা ভিখারি৷ ময়লা সাদা কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা৷ ট্রেনের দরজা থেকে শান্তনু যেমন দেখেছিল, ঠিক সেইরকমভাবে উপুড় হয়ে আছে পয়সার বাটিটার ওপর৷ মুখটা দেখা যাচ্ছে না৷ দিনের বেলা৷ চারপাশে লোকজন৷ তবু শান্তনুর মনে হল তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাবে৷ কোনোদিকে না তাকিয়ে সে ছুটল গাড়ির দিকে৷ প্রতীক আর মৈনাক তো তাকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক৷ কোনোরকমে একটু শ্বাস নিয়ে শান্তনু ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, সেই লোকটা রে….৷

কোন লোকটা? অবাক হয়ে জানতে চাইল প্রতীক৷

সেই স্টেশনের ভিখারিটা৷ সেই যে পয়সার বাটিটা আমার পা লেগে উলটে গেল৷

কী বলছিস পাগলের মতো! সে এখানে আসবে কোথা থেকে! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

শান্তনু চোখ বিস্ফারিত করে বলে, না আমি দেখেছি রে৷ ঠিক দেখেছি৷ সেই লোকটাই…৷

আচ্ছা চল, আমরাও দেখব৷

গাড়ি থেকে নেমে আসে প্রতীক আর মৈনাক৷ তিনজনে মিলে এগোয়৷ শান্তনু একটু পিছনে৷ কাঠের সিঁড়িটার সামনে আসে৷ সিঁড়ির পাশে একজন মোটাসোটা বয়স্ক মহিলা বসে আছেন৷ হাতে একটা কুলোতে কিছু মশলাপাতি৷ মহিলা সেগুলো বেছে পরিষ্কার করছেন৷

কোথায় দেখেছিলি?

এই তো এখানেই বসেছিল৷

মৈনাক এগিয়ে গিয়ে ভাঙা হিন্দিতে মহিলার সঙ্গে দু-চার কথা বলে জেনে নেয় যে তিনি প্রায় একঘণ্টা হল এখানে বসে মশলা বাছছেন৷ এর মধ্যে অন্য কেউ আসেনি৷

গাড়ির ড্রাইভারের সামনে তিনজনের কেউই কোনো কথা বলেনি৷ কিন্তু হোটেলে ঢুকে জামাকাপড় বদলানোর পর প্রতীক বলল, কী ব্যাপার বল তো শান্তনু? তোর হঠাৎ এরকম মনে হল কেন?

হঠাৎ মনে হয়নি রে৷ ক-দিন ধরেই মনে হচ্ছে৷ ইনফ্যাক্ট আমার মনে হচ্ছে লোকটা আমাকে ফলো করছে৷ সারাক্ষণ আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে৷

কিন্তু সেটা কি সম্ভব? লোকটা একটা ভিখারি৷ আমরা ট্রেনে করে এতদূর চলে এসেছি৷ কীভাবে লোকটা এখানে আসতে পারে তুই নিজেই বল?

আমি তো বুঝতে পারছি যে বাস্তবে এটা সম্ভব নয়৷ কিন্তু মনে হচ্ছে৷ বলতে পারিস সিক্সথ সেনস কাজ করছে৷

তোমার সিক্সথ সেনসটাকে এবার ফিফথে নামিয়ে আনো গুরু৷ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই যথেষ্ট৷ তার বেশি ঈশ্বর যখন দেননি তখন প্যাঁচ কষে লাভ নেই৷ আমার মনে হচ্ছে প্রতীক, শান্তনুর বোধহয় প্রোটিন ডায়েট কম হচ্ছে৷ আমরা রোজ মুরগি খাচ্ছি তো৷ মুরগিটা আজকাল প্রায় ঘাসপাতার মতোই হয়ে গেছে৷ আজ দুপুরে মাটন কারি বলি৷ তাহলেই দেখবি ব্যাটার ভুলভাল দেখা কমে যাবে৷

মৈনাকের কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে প্রতীক আর শান্তনু দুজনেই৷ ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটে যায়৷

কৌশানিতে দু-দিন থেকে সেখান থেকে বিনসর৷ জঙ্গলের ভিতর টিলার ওপরে গাড়োয়াল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট লজ থেকে অপূর্ব সূর্যোদয়৷ রাস্তার দু-ধারে রকমারি ফুলের শোভা৷ শুকনো ওক গাছের মাথার ওপর বসে থাকা সোনালি ঈগল৷ সব মিলিয়ে বেড়ানোর আনন্দ এমন জমজমাট হয়ে ওঠে যে শান্তনুর মন থেকে ভয়ের কালো ছায়াটা অনেকটাই সরে যায়৷

বিনসরের পরের গন্তব্য চকৌরি৷ এখানেও বুকিং ছিল গাড়োয়াল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট লজেই৷ তবে ঘর পাওয়া যায়নি৷ ডরমিটরিতে তিনটে বেড৷ চকৌরিতে পৌঁছোনো হল দুপুর নাগাদ৷ লজের বারান্দা থেকেই দেখা যায় দিকচক্রবাল জুড়ে বরফে ঢাকা হিমালয়ের ধ্যানমগ্ন মূর্তি৷ বেলা হয়ে গেছে বলে বরফের চূড়া কিছু কিছু জায়গায় মেঘে ঢাকা৷ সামনে যতদূর চোখ যায় সবুজ চা-বাগান৷ তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট লাল টালির বাংলো৷ চারিদিক শান্ত, শুনশান৷ শুধু অজানা পাখির ডাক আর চিলের তীক্ষ্ণ স্বর৷ লজের ম্যানেজার বলে দিয়েছিলেন সন্ধের পর বাংলোর হাতার বাইরে না বেরোতে৷ এদিকটা লেপার্ড বেরোয় প্রায়ই৷ তাই দুপুরের খাওয়া সেরেই তিনজনে পুরো এলাকাটা এক চক্কর দিয়ে এল৷ সন্ধে নামতে প্রথমটায় বারান্দায় বসা হলেও একটু পরেই অবশ্য ঘরে ঢুকে যেতে হল৷ কারণ ঠান্ডা বাড়ছে দ্রুত৷ রাত ন’টা নাগাদ একজন বেয়ারা এসে জানাল ডাইনিং হলে খাবার দেওয়া হয়েছে৷ শান্তনুর একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল৷ সে তাই কম্বলের ভিতরে ঢুকেছিল৷ প্রতীক আর মৈনাক তাকে তৈরি হতে বলে ডাইনিং হলের দিকে এগোল৷ শান্তনুও মিনিট দশেকের মধ্যেই সোয়েটার, জ্যাকেট চাপিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে খাবার ঘরের দিকে রওনা দিল৷ লম্বা একটা করিডর৷ তার এক মাথায় শান্তনুদের ডরমিটরি৷ অন্য মাথায় ডাইনিং হল৷ পুরো করিডরটাই টিউব লাইটের আলোয় আলোকিত৷ একটু ঘুম ঘুম চোখ হাঁটছে শান্তনু৷ উলটোদিক থেকে আর একটি লোক আসছে৷ একদম কাছাকাছি আসতেই লোকটা চোখ তুলে তাকাল আর শান্তনুর মনে হল তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল৷ লোকটার গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়ানো, ঝাঁকড়া চুল৷ চোখদুটো অদ্ভুত জ্বলজ্বলে৷

কীভাবে যে হেঁটে ডাইনিং হল পর্যন্ত পৌঁছল শান্তনু নিজেই বোধহয় ঠিক জানে না৷ মৈনাক আর প্রতীক ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে৷ শান্তনুর ফ্যাকাশে মুখ তারা লক্ষ করেনি৷ শান্তনুও কেন জানি বন্ধুদের কিছু বলতে পারল না৷ মনে হল, যদি ওরা হাসাহাসি করে৷ একবার তো বোকা হতেই হয়েছে৷ তাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ফিরে এল ঘরে৷ ততক্ষণে চারিদিক নিঃঝুম হয়ে এসেছে৷ ঘড়িতে রাত মোটে দশটা৷ কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মধ্যরাত৷ জামাকাপড় বদলে শুয়ে পড়া হল৷

কম্বলের ওমে আর আরামে মাখামাখি হয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিল শান্তনু৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই কী একটা প্রবল অস্বস্তিতে তার ঘুম ভেঙে গেল৷ ডরমিটরিতে ছটা বেড৷ তারমধ্যে তিনটে খালি৷ তিনটে খাটে পরপর তারা তিন বন্ধু শুয়েছে৷ বিশাল ঘরটার চারপাশে বড় বড় কাচের জানলা৷ পর্দার কোনো বালাই নেই৷ শান্তনুর পায়ের কাছে যে জানলাটা সেটা দিয়ে বাইরের গেটটা দেখা যায়৷ কী একটা অজানা কারণে ওই জানলাটা থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না শান্তনু৷ একটু পরেই দেখা গেল, গেট দিয়ে একটা লোক ঢুকছে৷ হাতে একটা লণ্ঠন৷ তার অস্পষ্ট আলোয় বোঝা যাচ্ছে লোকটার গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়ানো৷ চুলগুলো ঝাঁকড়া৷ লোকটা বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে জানলাটার সামনে দাঁড়াল৷ লণ্ঠনটা উঁচু করে ঘরের ভিতর কী যেন দেখার চেষ্টা করল৷ শান্তনু বুঝতে পারছে ও কী খুঁজছে৷ লোকটা আস্তে আস্তে এগোচ্ছে৷ প্রতিটা জানলার সামনে দাঁড়াচ্ছে৷ লণ্ঠন তুলে দেখছে৷ এবার দরজার সামনে এসেছে৷ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ শান্তনু জানে৷ ক্যাঁচ করে একটা হালকা শব্দ৷ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া বুঝিয়ে দিল দরজাটা খুলে গেছে৷ পায়ের শব্দটা এগিয়ে আসছে৷ শান্তনুর খাটের পাশে এসে থামল৷ প্রাণপণ চেষ্টা করেও চোখটা বুজতে পারছে না শান্তনু৷ লণ্ঠনটা তুলে ধরছে লোকটা৷ আলোটা পড়ছে তারই মুখের ওপর৷ সেই দুটো ভয়ংকর জ্বলজ্বলে চোখ৷ আলোটা আরও একটু উঠল৷ শান্তনু বিস্ফারিত চোখে দেখল সাদা চাদরটা সরে গেছে৷ লণ্ঠনটা ধরা আছে কনুইয়ের খাঁজে৷ হাতের বাকি অংশটা নেই৷ ততক্ষণে অন্য হাতটাও তুলে ধরেছে ভিখারিটা৷ সেটাও কনুইয়ের কাছ থেকে কাটা৷

বিকট একটা চিৎকার করে ছুটে খাট থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছিল শান্তনু৷ তারপর আর কিছু তার মনে নেই৷ প্রতীকদের পিথোরাগড় যাওয়া হয়নি৷ সাংঘাতিক অসুস্থ শান্তনুকে নিয়ে কোনোরকমে প্লেনে করে ফিরে এসেছিল কলকাতায়৷ তার প্রবল জ্বর আর ভুল বকা দেখে চকৌরির ডাক্তার সেরকমই পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ কলকাতায় ফেরার পরও প্রায় দিন সাতেক সময় লেগেছিল সুস্থ হয়ে উঠতে৷ সেরে ওঠার পর শান্তনু জানতে পেরেছিল সে নাকি ডরমিটরির দরজার কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল৷ লজের চৌকিদার, যে সারারাত লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারিদিক পাহারা দেয় সেই প্রথম শান্তনুকে ওই অবস্থায় দেখতে পায়৷ বন্ধুরা তাকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি৷ কিন্তু শান্তনু নিজেই অনেকবার ভেবে দেখেছে, সে কি তাহলে ওই চৌকিদারকেই দেখেছিল? কিন্তু চৌকিদার বন্ধ ঘরের ভিতর ঢুকবে কী করে? তথ্য-প্রযুক্তি কেন্দ্রের কর্মী শান্তনু দত্ত কোনো বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খুঁজে পায়নি৷ তবে রাস্তাঘাটে গরিব, অসহায় মানুষ কিংবা ভিখারিকে তাচ্ছিল্য করার অভ্যাসটা সে বদলে ফেলেছে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *