সেই ন্যাদোশ

সেই ন্যাদোশ

এখন যারা ‘সন্দেশ’ পড়ো, তারা জানোই না, যখন সত্যজিৎ রায় ‘সন্দেশ’ হাতে নিলেন, তাঁর অনুরোধেই সেবারকার সংখ্যায় ‘ন্যাদোশ’ লিখেছিলাম। এক সময়ে আমার মা বহরমপুরে গরু পোষা শুরু করেন। আমাদের বাড়ি তো! আমাদের বাড়ির গরু বলো, মুরগি বলো, সকলেই মুক্তমনে স্বাধীনভাবে চিন্তা করত, আচরণও ছিল সে রকম।

যেমন অতীব মিলিট্যান্ট মুরগি দলি বুড়ি ডিম পাড়ত বাবার জুতোর মধ্যে, তাঁর কোটের পকেটে, আমার বোনদের ড্রেসিং টেবিলের দেরাজে।

আর ন্যাদোশ, আমাদের গরু, সে বর্ষার দিনে (ওখানে বর্ষা সময়ে ৩—৪ দিন ধরেও হত) মাছ মাংস মাখা এঁটো কলাপাতা খেয়ে বিদ্রোহী হয়ে গেল। নিয়মিত মাছের লোভে রান্নাঘরেও ঢুকে যেত। সে ‘গরু শাস্ত্র বিরোধী’ সব কাজই করত। ‘সন্দেশ’ কাগজ যখন আবার বেরোল, সম্পাদকের অনুরোধেই গল্প লিখতে শুরু করি, এ ভাবেই ন্যাদোশের বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব।

স্বভাবতই যখন তার গল্প লিখছি, ততদিনে ন্যাদোশ গো—লোকে গেছে। এই গো—লোক, গোলক নয়, যে গোলকধামের কথা গানে—কীর্তনে—ভজনে শোনা যায়। এটা গরুদের স্বর্গ, তাই গো—লোক!

আমার ন্যাদোশের গল্পে ন্যাদোশ গো—লোক থেকেই আসে এবং ন্যাদোশোচিত বক্তব্য রেখে যায়। এ গল্পতেও তাই ঘটবে। কেননা, যতদিন পারব, ন্যাদোশের গল্পই লিখে চলব।

এবার বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে হবার কথা, হচ্ছে না। তা নিয়ে মনে অনেক চিন্তা। কেননা জানলার বাইরে চাইলে অনেক গাছপালা, ঝোপঝাড় দেখতে পাই। ন্যাদোশের কথাও মনে যথারীতি সামনের জানলা দিয়ে ভেসে চলে এল। আমার লেখার টেবিল, আর সামনের জানলার মধ্যে আরাম করে বসল। বলল, কি গো! সুকো তো এসে যাচ্ছে। এবার আমার গল্প লিখবে না?

—এতদিন আস নি কেন?

—আহা! ব্যস্ত ছিলাম! ব্যস্ত ছিলাম!

—কিসে?

—ওই যে তোমরা বলছ পরিবর্তন চাই! আমিও তা কেনে… যাকে বলে খাপচুরিয়াস হয়ে গেলাম! গো—লোকে, অর্থাৎ আমাদের লোকে, সব গরুই তো পৌঁছয়… তাদের বোঝালাম। সব কিছু ওরা করবে? আমরা গরুরা কিছুই করব না! একটা ‘কল’ দিলাম।

—কাকে?

—কেন? গরুদের? স্বর্গে গরু কম আছে?

—স্বর্গে গরু? ন্যাদোশ! বাজে বোকো না!

ন্যাদোশ বজ্র কণ্ঠে গলা খাঁকারি দিল। বলল, কিছুই জানোনা! বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণর গরুগুলো পালে পালে এসেছে না? এত গরু পেলাম যখন, তখন তোমার খবর নিলাম।

—কার কাছে?

—আহা! মর্ত্যের সঙ্গেও যোগাযোগ তো থাকে! তেমন একজনই জানাল… যে তোমরা না কি বিদ্রোহী হয়েছো। সর্বদা বলছ, ‘পরিবর্তন চাই!’ ঘাবড়ে গেলে?

—ভাবছি, তোমার মতো…

—বজ্জাত গরু আর দেখ নি।

—না।

—দেখবে কি করে? আরেকটা ন্যাদোশ করেছে?

—তোমারও যাকে বলে…

—বিদ্রোহী হয়েছি।

—কি করছ?

—আমি যা বলছি, ওরাও তাই করছে।

—সেটা কি?

—স্বর্গের সেরা সেরা বাঁধাকপি বলো, ফুলকপি বলো, সব ওঠাচ্ছি আর খাচ্ছি।

—সে সবের চাষও হয়?

—হয় না? হল্যাণ্ডের গরু! আমাদের হরিয়ানার গাই! সকলের খাওয়ার যুগ্যি সব কি চাষ হয়।

—এটাই বিদ্রোহ?

—সবে তো শুরু হয়েছে। দেখ! পরিবর্তনকামী গরুরা কি কাণ্ডটা করে! ভেবো না, খবর পাবে। ব্যস, নিমেষে ন্যাদোশ হাওয়া! ভাবলাম, জিজ্ঞেস করব, স্বর্গেও কি মাছ মাংস খাও?

সময় পেলাম না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *