সেই নদীটার নাম
এক
আই—টি সেক্টরের সৌগত সেনগুপ্ত দিনের মধ্যে দশ—ঘণ্টা অফিস নিয়ে খুব চাপে থাকে, আর সেইজন্যেই যদি কখনও উইক—এন্ডে তিন চার দিনের ছুটি পায়, পালিয়ে আসে এই কুসুমপুরের মতন কোনো নিরিবিলি ফরেস্ট বাংলোয়। বনের সবুজ আলো আর তাজা হাওয়ায় তার চোখ—মন—মগজের ওপর জমে থাকা মরচেগুলো যখন ধুয়ে সাফ হয়ে যায়, তখন সে আবার নতুন উদ্যমে ফিরে যায় সল্টলেকে সেক্টর ফাইভের ছোট্ট খুপরিটায়।
খড়্গপুর থেকে লোধাশুলি হয়ে যে রাস্তাটা গোপিবল্লভপুরের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তারই ডানদিকে, পিচ—রাস্তা থেকে তিন—চার কিলোমিটার ভিতরে কুসুমপুরের বন।
কুসুমপুর খুব একটা বড় জঙ্গল নয়। বনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে সৌগতর চোখে পড়েছে চাষের খেত আর মানুষের ঘরবাড়ি। তার খারাপ লাগেনি। কেন খারাপ লাগবে? ঝকঝকে তকতকে আদিবাসী গ্রামগুলোও কি কম সুন্দর নাকি? আর পূর্ণিমার রাতে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা ‘দ্রিদিম দ্রিদিম’ মাতলের বোল— যেন বনদেবতার হৃদপিণ্ডের লাবডুব। সেই অলৌকিক শব্দও কি সে শুনতে পেত, বনের পাশে গ্রাম না থাকলে? গত তিনদিন কুসুমপুরের ফরেস্ট বাংলোর বিছানায়, অনেক রাত অবধি ওই মাদলের শব্দে জেগে থেকেছে সৌগত।
গত তিনদিনে সৌগত একটাও বুনো হাতি দেখেনি, বাইসন দেখেনি, পাইথন দেখেনি। বাঘ দেখার তো প্রশ্নই নেই, কারণ, কুসুমপুরের জঙ্গলে বাঘ নেই। তাতে সৌগতর কিচ্ছু আসে যায় না। সে বাঘ দেখবার জন্যে জঙ্গলে আসে না। আসে সুন্দরকে দেখবার জন্যে।
যদি একটা নির্জন পুকুরের বুকে ফুটে থাকে অজস্র শালুক, যদি ভোরের শিউলি গাছের গলায় মাকড়শার জালের নেকলেসে দুলতে থাকে হীরের কুচির মতন হাজারটা শিশিরের ফোঁটা, তাহলেই সৌগত খুশি। আজ সকালেই সে যখন ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় বসে চায়ের সঙ্গে টোস্ট খাচ্ছিল, তখন দুটো বুলবুলি আর একটা শালিখ পাঁউরুটির টুকরোর লোভে একদম তার হাতের নাগালে এসে বসেছিল। সৌগতর কুসুমপুরে আসা তাতেই সার্থক হয়ে গেছে।
কুসুমপুর এত সুন্দর বলেই সৌগতর মনে হচ্ছিল, চারটে দিনের ছুটি যেন চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। আজ রোববার। এক ভাড়াগাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়ে আছে, সে তাকে সন্ধেবেলায় খড়্গপুর স্টেশন থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরিয়ে দেবে। তাহলে কাল সোমবার সে অফিস করতে পারবে।
মনখারাপ লাগে। প্রত্যেকবারই এই চলে যাওয়ার দিনটায় ভীষণ মনখারাপ লাগে সৌগতর। তার মনে হয়, শেষ দিনটায় যতক্ষণ পারি বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই। যতটা পারি পাখি, প্রজাপতি আর গাছের ছবি চোখে ভরে নিয়ে যাই। নদীর বুক থেকে কুড়িয়ে নিই কয়েকটা আঁকিবুঁকি কাটা নুড়িপাথর কিংবা বনের পথ থেকে একটা কুসুমগাছের টুকটুকে লাল পাতা।
খাওয়া—দাওয়ার পর তাই বাংলোর কেয়ারটেকারকে ডেকে সৌগত বলল, একটু ঘুরে আসছি সনাতনদা। বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব।
বাংলোর বাগান থেকে একটা উটকো ছাগলকে তাড়াতে তাড়াতে কেয়ারটেকার সনাতন মুর্মু বললেন, ঠিক আছে স্যার। ঘুরে আসুন। কোনো অসুবিধে নেই।
বনে পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে সৌগতর একটা অভ্যেস হয়ে গেছে— অচেনা কোনো পাখি, প্রজাপতি, কোনো বুনো ফুল কিংবা গাছের নাম—টা যতক্ষণ অবধি সে না জানতে পারছে, ততক্ষণ অবধি তার স্বস্তি হয় না। এমনিতে তার ব্যাকপ্যাকে সবসময়েই অজয় হোমের পাখির বই, নওয়াজেশ আহমদের বাংলার বনফুল, কিংবা রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর গাছের হ্যান্ডবুক মজুত থাকে। তাতেও না কুলোলে সে লোকাল লোকজনকে জিগ্যেস করে জেনে নেয় ওদের নাম। তারপর একটা ডায়েরিতে লিখে রাখে।
নদী কিংবা পাহাড়ের নাম জানার জন্যে অবশ্য পুরোপুরি স্থানীয় লোকজন—ই ভরসা। তবে না জেনে ছাড়ে না সৌগত।
আজ অবশ্য সেরকম অচেনা কিছু চোখে পড়ল না। কুসুমপুরের জঙ্গলে গাছ বা পাখির ভ্যারাইটি খুব বেশি নেই। যা কিছু চোখে পড়ল, সবই সৌগতর আগে থাকতেই চেনা।
ঘুরতে ঘুরতে কোনদিকে যে চলে এসেছিল ঠিক বুঝতে পারছিল না সৌগত। শালবনের ভেতর দিয়ে অজস্র শুঁড়িপথ এ ওকে কাটাকুটি করতে—করতে, এদিকে ওদিকে চলে গেছে। আশেপাশের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা শুকনো ডালপালা কিংবা শালপাতা কুড়োবার জন্যে জঙ্গলের ভেতরে ঢোকে। এসব তাদেরই পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা পথ। তারই একটা ধরে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সৌগত হঠাৎই দেখল সে বনের বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
দুই
গত তিনদিনের মধ্যে সে এদিকটায় কখনও আসেনি। এখানে তার সামনে কোনো গ্রাম নেই, ফসলের খেত নেই। তার বদলে রয়েছে এক ধু ধু বালির চরা। তার শুরু দেখা যায় না, শেষ দেখা যায় না। অনেক দূরে আবছা একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এই বনের সীমানা থেকে সেই পাহাড় অবধি শুধুই কাশের ঝোপ আর নলখাগড়ার বন। মাঝে মাঝে একটা—দুটো খেজুর আর বাবলাগাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সৌগতর খুব কাছেই ওরকমই একটা বাবলা গাছের ওপর দুটো শকুন এসে বসল।
সৌগত হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র আড়াইটে বাজে। এখনই বাংলোয় ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই সে ঠিক করল, ওই চরাটার বুক ধরেই একটু হেঁটে আসবে। ওখানে শুকনো শরঘাসের ঝোপের মধ্যে কয়েকটা পাখি ওড়াউড়ি করছে। কাছে গিয়ে দেখতে হবে ওগুলো কী পাখি। তাছাড়া আরও একটু দূরে একটা ময়ূর আর কয়েকটা ময়ূরী বালির ওপরে পায়চারি করছিল। ওদেরও আরেকটু কাছ থেকে দেখবার লোভ সামলাতে পারল না সৌগত। সে ঢালু পাড় বেয়ে চরার বুকে নেমে পড়ল।
সৌগত ভাবতে পারেনি ওখানে একটা নদী থাকবে, অথচ ছিল। ওপর থেকে দেখতে পায়নি, কিন্তু চরায় নামতেই সৌগত নদীটাকে দেখতে পেল।
নদীটা বেশি চওড়া নয়, কিন্তু অদ্ভুত তার জলের রং। সাধারণত এরকম পাথুরে জায়গায় নদীর জল হয় কাচের মতন স্বচ্ছ। কিন্তু এই নদীটার জল একদম কুচকুচে কালো। সৌগত ভাবল, নদীটা কি কোনো পাথুরে কয়লার বেডের ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে। সেইজন্যেই কি এরকম কয়লা—গোলা জলের রং?
সৌগত জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জল নয়, যেন গলানো পিচের মতন ভারী কোনো জিনিস এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করল সৌগত। এইসব বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা নদীর জলের মধ্যে কত ভাঙা গাছের গুঁড়ি, কাঠকুটো এইসব পড়ে থাকে। কিন্তু এই নদীটার বুকে একটা শুকনো পাতা অবধি ভাসছে না।
হঠাৎ সৌগতর খেয়াল হল, সে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওই কালো জলের নদীটা তাকে যেন এক সম্মোহনে বেঁধে ফেলেছে। মাথাটা একবার জোরে ঝাঁকিয়ে সৌগত নদীর পাড় ধরে আবার হাঁটতে শুরু করল।
তখনই সে ছেলেটাকে দেখতে পেল। এই ফাঁকা জায়গায় হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলেকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে সৌগত বেশ চমকিয়েই গিয়েছিল।
ছেলেটা নদীর ধারে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসেছিল। যাকে বলে জড়সড় হয়ে বসে থাকা, একেবারে তাই। কত বয়স হবে ছেলেটার? বড়জোড় দশ কি এগারো। পরনে একটা খাঁকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। গেঞ্জিটার অন্তত চার জায়গায় বড় বড় ছ্যাঁদা। বাঁ হাতের ওপরের দিকে কালো কারে বাঁধা একটা মাদুলি। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এদিকেরই কোনো গ্রামের ছেলে।
ছেলেটার গা থেকে একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। খুব চেনা কোনো সেন্টের গন্ধ, কিন্তু নামটা মনে করতে পারল না সৌগত। কান্তা? নাকি জেসমিন? ব্যাটা ছেঁড়া গেঞ্জির ওপরে সেন্ট মেখেছে! গাঁইয়াদের কারবার—ই আলাদা।
ও কি নদীর চরায় ছাগল চরাতে এসেছে? কিন্তু তাহলে ছাগলগুলো গেল কোথায়? আর ও ওরকম জবুথবু হয়ে, দু হাতের মধ্যে হাঁটুদুটো জড়িয়ে বসেই বা আছে কেন?
যাই হোক, ওর কাছেই এই নদীর নামটা জেনে নেওয়া যেতে পারে। এই কুসুমপুরে জীবনে আর কখনও আসা হবে কিনা ঠিক নেই। নদীটার নাম না জেনে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না সৌগতর।
ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে সৌগত জিগ্যেস করল, হ্যাঁ রে, এই নদীটার নাম কী?
ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সৌগত দেখল ওর বড় বড় দুটো চোখে রাজ্যের ভয়। আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলল, জানি না।
জানিস না! তুই এখানে থাকিস না?
থাকি তো। এইটুকু বলেই ছেলেটা আবার নদীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। একটু আগে সৌগত যেমন জলের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না, ওর অবস্থাও যেন ঠিক সেইরকম।
সৌগত একটু চুপ করে থেকে বলল, তাহলে নদীটার নাম জানিস না কেন? তোদের দেশের নদী তো।
এই নদীটা আগে কখনও দেখিনি।
সৌগত ভাবল, তা হতে পারে। ছেলেটা বড্ড ছোট। হয়তো এতদূরে আগে কখনও আসেনি। ওর বাবা মা কি সঙ্গে রয়েছে? কোথায় তারা?
সৌগত জিগ্যেস করল, কার সঙ্গে এসেছিস? তোর বাবা মা কোথায়?
ছেলেটা আবার নদীর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সৌগতর দিকে তাকাল। সৌগত দেখল, ভয় নয়, এবার ওর চোখে স্পষ্ট অভিমান। দুদিকে ঘাড় নেড়ে ছেলেটা বলল, মাইয়া, বাপু, কেউ আসেনি। কেউ না। আমাকে একা ছেড়ে দিয়েছে।
সৌগতর এবার একটা অন্যরকম সন্দেহ হল। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেনি তো বাচ্চাটা? হয়তো বাবা—মার ওপর রাগ করে ঝোঁকের মাথায় একা একা এতদূর চলে এসেছে। তারপর প্রাণে ভয় ঢুকেছে। এখন না পারছে এগোতে, না পারছে পেছোতে। সৌগতর নিজেরই একবার এরকম হয়েছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে গিয়ে বসেছিল, যদি কেউ আদর করে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এসেওছিলেন— বাবা। পুরনো কথা ভেবে সৌগত নিজের মনেই হাসল। তারপর সে নরম গলায় ছেলেটাকে ডাকল, বাড়ি যাবি? চল, আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
উঁহু। ছেলেটা নদীর দিকে তাকিয়েই জবাব দিল। আমাকে ওই নদীটা পেরোতে হবে। কিন্তু আমার ভয় করছে। ভীষণ ভয় করছে।
ছেলেটার বাড়ি কি নদীর ওপারে? নিশ্চয়ই তাই।
সৌগত ওকে সাহস দিয়ে বলল, ভয় কীসের? এইটুকু একটা নদী। তুই তো হেঁটেই পেরিয়ে যেতে পারবি। আসবার সময়েও তো হেঁটেই এসেছিলিস, না কি? যা, ফিরে যা। আর দেরি করিস না। এই বলে সৌগত আবার পা চালাল। একটু দূরে নদীটা একটা বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকে ওদিক থেকেই যেন মানুষের গলা পেল সে। ওদের কাছেই জেনে নেওয়া যাবে নদীটার নাম।
তিন
সৌগত আর সময় নষ্ট না করে জোরে পা চালিয়ে নদীর বাঁকটার কাছে পৌঁছিয়ে গেল। সেখান থেকেই একবার পিছনদিকে তাকিয়ে দেখল— বাচ্চাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এতক্ষণে নিশ্চয় ও নদী পেরিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। যাকগে। ওকে নিয়ে আর চিন্তা করার কিছু নেই।
বাঁক ঘুরতেই সৌগতর চোখে পড়ল সামনে একটা চালাঘর। বালির মধ্যে চারটে বাঁশ পুঁতে চারদিক খোলা চালাঘরটা তৈরি করা হয়েছে। মাথার ওপর খেজুর পাতার ছাউনি। ছাউনির নিচে একজন বুড়ো লোক একটা বাঁশের বেঞ্চির ওপরে বসে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছিল। সৌগত এতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে একটু হাঁফিয়ে গিয়েছিল। সে গিয়ে সেই লোকটার পাশেই বসল। তারপর জিগ্যেস করল, এই নদীটার নাম কী?
কোথায় নদী? বুড়ো অবাক গলায় সৌগতকে পাল্টা প্রশ্ন করল।
সৌগত সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে গিয়েছিল, ওই যে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। কারণ, সত্যিই সে সামনে তাকিয়ে কোনো নদী দেখতে পেল না। বালির চর, এখন শুধুই বালির চর। সেই কালো নদীটা আর নেই।
বুড়ো তার আঙুলে ধরে রাখা বিড়িটা একদিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, অনেককাল আগে এখানে একটা নদী ছিল বলে শুনেছি। তবে আমি কেন, আমার বাপ ঠাকুর্দাও সে নদী চোখে দ্যাখেনি। এখন চরের মধ্যে একটা মজা পুকুর রয়ে গেছে। হয়তো সেই নদীটারই ফেলে যাওয়া জল। ওখানেই আমরা পাঁচ গ্রামের লোকেরা দাহ—টাহ করি।
দাহ!
হ্যাঁ, মড়া পোড়াই। এটা শ্মশান। এই আজ যেমন আমরা শিরালি গ্রাম থেকে এসেছি। ভোরবেলা অজয় মণ্ডলের ছোট ছেলেটা মারা গেল। মাত্র তিনদিনের জ্বর…কী বলব বলুন? ওই দেখুন না, সৎকারের জোগাড়যন্তর চলছে।
বুড়ো থুতনি তুলে যেদিকটা দেখাল, সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সৌগত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ওখান থেকেই সে একটা কিছু দেখেছিল, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিল না। সে তাই ভূতে পাওয়া মানুষের মতন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওইদিকে, যেদিকে অজয় মণ্ডলের ছেলের দাহকার্যের প্রস্তুতি চলছিল।
কয়েকজন লোক মিলে একটা চিতা সাজাচ্ছিল। তারা সৌগতকে দেখেও দেখল না। আর একজন লোক একটু দূরে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। তার টকটকে লাল দুটো চোখে শূন্য দৃষ্টি। হয়তো সে—ই অজয় মণ্ডল, যার ছেলে মারা গেছে। তবে ওসব কিছুই আর সৌগতর চোখে পড়ছিল না। সে শুধু তাকিয়ে ছিল চিতার পাশেই বাঁশের চালির ওপর শুইয়ে রাখা মৃতদেহটার দিকে।
বড় বড় চোখদুটো এখন তুলসীপাতা দিয়ে ঢাকা। কিন্তু তবু ওই মুখ ভুল হবার নয়। ওর গা থেকে সেই নাক জ্বালানো মিষ্টি গন্ধটা এখনও পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের স্মৃতির কি অদ্ভুত মতিগতি! তখন মনে পড়েনি, এখন কিন্তু সৌগতর চট করে মনে পড়ে গেল সুগন্ধীটার নাম। অগুরু— মৃতদেহের দুর্গন্ধ ঢাকার জন্যে যে লিকুইডটা ছিটোনো হয়। ছেলেটা যখন একটু আগে নদীর ধারে জড়সড় হয়ে বসেছিল, তখনও ওর গা থেকে অগুরুর গন্ধই ছাড়ছিল।
ছেলেটাকে চালির ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। এখনও তার পরনে সেই খাঁকি হাফপ্যান্ট আর চার জায়গায় ফেঁসে যাওয়া গেঞ্জি। এমনকী বাঁ হাতের ওপরের দিকে বাঁধা সেই মাদুলিটা অবধি খোলা হয়নি। চিতায় তোলার আগে ওরা সবকিছুই খুলে নেবে নিশ্চয়। সেইরকমই নিয়ম।
বড়জোড় দশ—মিনিট আগে এই ছেলেটাকেই নদীর ধারে বসে থাকতে দেখেছে সৌগত। নদীটা এখন আর নেই, কিন্তু একটু আগেই ছিল। এই বাচ্চাটা তখন বলেছিল, আমাকে ওই নদীটা পেরোতে হবে। কিন্তু আমার ভয় করছে। ভীষণ ভয় করছে।
সৌগত আস্তে আস্তে পিছন ফিরল। আজ কিছুক্ষণ বাদে সে কুসুমপুর ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যাওয়ার আগে নদীর নামটা জানা বড় দরকার…বড় দরকার।
মাতালের মতন টলতে টলতে সে আবার সেই বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, বলতে পারেন, সেই যে নদীটা এককালে এখান দিয়ে বইত, তার নাম কী ছিল?
বুড়ো বলল, কেন পারব না? বাপ—ঠাকুর্দার কাছেই শুনেছি, নামটি ছিল বড় বাহারের। একেবারে ইহলোক আর পরলোকের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নামে তার নাম। আমাদের সকলকেই একদিন না একদিন সে নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে।
কী, বুঝলেন না?
সৌগতকে চুপ করে থাকতে দেখে খিকখিক করে হেসে বুড়ো নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিল—
বৈতরণি।