সেই তুমি মূর্তিতে দিবে কি ধরা!

সেই তুমি মূর্তিতে দিবে কি ধরা!

মহাকবির হৃদয় এমনই মহাসমুদ্রের মতো গভীর, যেখানে উপরিতলের তরঙ্গগুলি সব-সময় নব-নবোন্মেষের সূচনা দিতে থাকে। নতুন তরঙ্গের মধ্যে পুরাতন তরঙ্গ যখন হারিয়ে যায়—জলের এবং হৃদয়ের উচ্ছ্বাসটা তৈরি হয় তখনই। পুরাতনের হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটাও কিন্তু সেখানে নতুনের মধ্যে অনুস্যূত হয়। আমাদের দেশে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বোধহয় সেইরকম এক আভ্যুদয়িক কবি, যিনি চতুর্বেদ বিভাগ করে, মহাভারতের মতো এক মহাকাব্য রচনা করার পরেও শান্তি পান না। তাঁকে আবার শ্রীমদ্ভাগবতের মতো এক কৃষ্ণজীবন লিখতে হয়। কিন্তু তবু তাঁর হৃদয় শান্ত হয় না। আর সত্যিই তো কবির হৃদয় যদি এত শান্ত হয়ে যায়, তাহলে এই জঙ্গম জগজ্জীবনের চলমান ছবি ভেবে উঠবে কোন হৃদয়ে? কবিই তা বলেছিলেন—শান্তকল্লোল তরঙ্গহীন সমুদ্রের মধ্যে স্নান করে আনন্দ পায় বর্বরেরা, আমি চাই তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ—বিপুল তরঙ্গ রে—সমুদ্রে শান্তকল্লোলে স্নাতুমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ।

ব্যাস তো প্রথমত ব্রহ্মদর্শী পুরুষ। সমস্ত ভূতবর্গের মধ্যে তিনি নিজেকে দেখতে পান এবং নিজের মধ্যে দেখতে পান সমস্ত জগৎকে। সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ, জয়-পরাজয় সব তাঁর কাছে সমান হয়ে গেছে। অদ্ভুত এক নির্বিকার অবস্থা যেখানে পরম আনন্দও উচ্ছ্বাসহীন গভীর সমুদ্রবৎ সমাধির মতো মনে হওয়ার কথা। ঠিক এই অবস্থায় তাঁর নিজের মানসলোকের বর্ণনাটা এইরকম হওয়া উচিত—সম্পূর্ণং জগদেব নন্দনবনম—সম্পূর্ণ এই জগৎটাই তো নন্দনবনের মতো আনন্দময়, এখানে পৃথক কোনো স্থান নেই যেটা দেখলে বেশি আনন্দ হয়, অথবা যেখানে গেলে কম আনন্দ হয়। এ দুনিয়ায় যত বৃক্ষ আছে, সবই কল্পদ্রুম—তাদের কাছে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়।

যিনি দুনিয়ার সর্ববৃক্ষের মধ্যে কল্পদ্রুম দেখতে পান, তাঁর আসলে চাহিদাটাই বড় কম। দ্রুমপর্ণ আর গাছের বাকল পেলেই যাঁর পরিধান তৈরি হয়ে যায়, গাছ থেকে দু-একটি ফল পেলেই যাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়ে যায়, তাঁর কাছে বৃক্ষ মানেই কল্পবৃক্ষ। এ বারে বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্রে এসে ব্রহ্মদর্শী ঋষির ভাষণ হল—যেখানে যতটুকু জল দেখি—দিঘি-নদী-পুষ্করিণী—যাই হোক, সব জলই আমার গঙ্গাজল; যেখানে থাকি, সেখানে বসি, সবই আমার বারাণসী—গাঙ্গং বারি সমস্ত-বারি-নিবহঃ… বারাণসী মেদিনী।

জগৎ এবং জীবন সম্বন্ধে এই যে একটা মনোভাব, এটা ব্রহ্মদর্শী ঋষির মনোভাব, শঙ্করাচার্যের মনোভাব, এমনকি ব্যাসও এই মনের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু সর্বত্র এই আনন্দের মধ্যে একটা শান্তরসের ব্যঞ্জনা আছে, দ্বৈপায়ন ব্যাস কিন্তু এটাকেও অতিক্রম করেছেন বলেই তিনি মহাভারতের মতো এক মহাকাব্য লেখেন, ভাগবত পুরাণের মতো একটা কৃষ্ণজীবন লেখেন। মহাভারতের মধ্যেই এই কাহিনি আছে যে, ব্যাসদেবের ছেলে ব্রহ্মদর্শী শুকদেব তিনি ব্রহ্মানন্দে পাগলপারা উলঙ্গ হয়ে চলেছেন মানস-পুষ্করিণীর ধার বেয়ে। সেই পুষ্করিণীতে স্নান করছিল নবযুবতী অপ্সরারা। তাঁরা শুকদেবকে দেখে বুকের আঁচলটুকু পর্যন্ত এদিক-ওদিক করল না। শুকদেব যদি বা তাকিয়েও থাকেন তাঁদের দিকে, তবু যুবতী রমণীদের মনে হচ্ছিল, শুকদেব কিছুই দেখছেন না—শূন্যাকারং নিরাকারাঃ শুকং দৃষ্ট্বা বিবাসসঃ। অথচ ব্যাস যখন অপস্রিয়মাণ পুত্রকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তাঁর অনুগমন করার চেষ্টা করছেন, তখন সেই বয়স্ক ব্যাসকে দেখেও মন্দাকিনীর নির্ঝরে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্সরা-রমণীরা কেউ গলা পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে দিল নদীর জলে, আবার কেউবা লুকিয়ে পড়ল গাছের আড়ালে—জলে নিলিল্যিরে কাশ্চিৎ কাশ্চিদ গুল্মান প্রপেদিরে।

ঠিক এইখানে ব্যাস দ্বৈপায়নের অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। তিনি পরম আনন্দ লাভ করলেন। ভাবলেন—তাঁর পুত্রের জীবন্মুক্তি ঘটেছে, তাই তাঁকে নগ্ন দেখেও কারও বিকার হয় না। বস্তুত স্বয়ং শুকদেবেরই জাগতিক বিষয়ে কোনো বিকার নেই বলেই তাঁকে দেখে নগ্না রমণীদেরও বিকার হয় না। অথচ স্বয়ং ব্যাসও কিন্তু অবশ্যই জীবন্মুক্ত মানুষ, অথচ তাঁকে দেখে অপ্সরা রমণীদের মনে যে একপ্রকার নঞর্থক আন্দোলন হল, এটা তাহলে কী? এমনকী পুত্রের প্রতি তুলনায় নিজের অবস্থা দেখে পুত্রের কারণে তিনি আনন্দ পেলেন এবং নিজেকে নিয়ে তিনি দুঃখিত হলেন—প্রীতো’ভূদ ব্রীড়িতশ্চ হ। আমরা শুধু ভাবি—ভাগ্যিস ব্যাসের মনে ওই বৈরাগ্যহীন বিকারটুকু ছিল! তা নইলে আমরা মহাভারতের মতো একখানা ‘ধর্ম-কামার্থ-মোক্ষদ’ গ্রন্থ পেতাম না; পেতাম না কৃষ্ণলীলার সরস্বতীকে ভাগবত পুরাণের মধ্যে।

আসলে জীবন্মুক্ত হওয়ার পরেও যে মানুষ আবার স্বেচ্ছায় বন্ধন স্বীকার করেন, তাঁর মধ্যেই আছেন সেই আভ্যুদয়িক কবি—যিনি এই জগজ্জীবনের সাংসারিকতাকে অক্লিন্ন মধুরতায় বর্ণনা করতে পারেন। ব্যাসের মতো ওই হৃদয়টা নিয়েই রবীন্দ্রনাথ বলতে পেরেছিলেন—অসংখ্য-বন্ধন-মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ। বস্তুত মুক্তির এই আস্বাদনটাই কবি-মহাকবির মনের মধ্যে জীবন এবং জগতের ভূমাবোধ তৈরি করে। তৈরি করে সেই ‘বর্ণনীয়-তন্ময়ীভবন-যোগ্যতা’, অহেতুক যেখানে সর্বমুক্ত পুরুষও বন্ধনের মধ্যে উচ্ছ্বাস খুঁজে পান। ঠিক এই পরিপূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষের চেয়েও তাই একজন ভক্তের উচ্ছ্বাস অনেক বেশি, অনেক মধুর, রস-চমৎকারী তাঁর বাসনালোক। একটা উদাহরণ তো এখানে দিতেই পারি, এমনকী দিতে পারি দুটিও। কিন্তু সে উদাহরণ দিতে গেলে আমি ধ্বনিকার আনন্দবর্ধনকে নিয়েই এমন মুখর হয়ে পড়ব যে, মহাকবি দ্বৈপায়ন ব্যাসের এক বিরাট ভুল যে এই ভারতবর্ষের মানুষকে কত বড়ো এক আনন্দলোকে পৌঁছে দিয়েছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, মহাকবি যখন ভুল স্বীকার করেন, তখন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কবিতার মাধুর্য। আসলে ব্যাস এখানে এক ব্রহ্মবাদীর ভূমা দৃষ্টিকে সংকীর্ণতার মধ্যে নিয়ে এসে বিরাট পুরুষকে সাধারণের উপযোগী করে তুলছেন। কেননা সাধারণ মানুষকে এটা বলে কী-ই লাভ যে, যা কিছু দেখছ সবই তিনি। তিনি অগ্নিতে তিনি জলেতে/তিনি তৃণতরুময় স্থলেতে। এই ভূমা দৃষ্টি তো সাধারণের থাকে না, আর ব্রহ্মজ্ঞানের এই পরিসরে রস-চমৎকার অনুভবের সুযোগ কোথায়? সাধারণ মানুষ এমন এক ভগবান চায়, যিনি ডাকলে পরে সাড়া দেন, যাঁকে স্পর্শ করা যায়, এমনকী এমন একটা জায়গাও তারা খুঁজে বার করতে চায়, যেখানে ঠাকুরের ঘরবাড়ি ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য-জনকের নিরাকার-নির্বিশেষ—অথবা যাঁর কোনো শব্দ-স্পর্শ নেই অরূপ অথবা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন এক ঈশ্বর কখনও সাধারণ মানুষের বোধগম্যও নন, ভোগগম্য তো ননই। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকেও ভোগ করতে চায় বলেই কবি বলেন, ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।’ আমাদের এই জঙ্গম জগতে আমাদের অনন্ত ভোগবাসনার মধ্যে ঈশ্বরকেও আমরা ভোগ করতে চাই বলেই ভগবান মহাকবি আজ ভুল স্বীকার করছেন।

ব্যাস লিখছেন—এই জীবনে আমি তিন-তিনটে বড়ো ভুল করে ফেলেছি, প্রভু! আমি দোষ স্বীকার করছি, তুমি আমায় ক্ষমা দাও, হে জগদীশ্বর—ভুলটা আমারই বিকলতাবশে হয়ে গেছে, কেন যে আমি অমন বিকল ব্যাকুল হয়ে পড়লাম বুঝিনি। তাই একটা নয়, দুটো নয়, তিন-তিনটে দোষ করেছি আমি, তুমি ক্ষমা করো, প্রভু—ক্ষন্তব্যং জগদীশ তদ-বিকলতা-দোষত্রয়ং মৎকৃতম। সত্যিই ব্যাস যা করেছেন তা এক ধরনের বিকলতাই বটে। মানুষ যদি ঘন তমিস্রার মধ্যে আলোর ঝলক দেখতে পায়, তবে সে আকুল হবে না? মহাকবি যদি নিশ্চিহ্ন অরূপের মধ্যে রূপ দেখতে পান, নিশ্ছিদ্র শূন্যতার মধ্যে তিনি যদি আকার দেখতে পান, তাহলে কি বিকল হয়ে উঠবে না তার মন? স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত কেমন বিকল হয়ে পড়েন, তার একটা জনমুখী বর্ণনা আছে সপ্তম শতাব্দীর কবি মাঘের শিশুপালবধ কাব্যে।

এখানে কৃষ্ণ ভগবান মনুষ্যলীলায় মানুষভাবেই একদিন বসেছিলেন বসুদেবের ঘরে—জগন্নিবাস বসুদেবসদ্মণি। কবি কিন্তু কৃষ্ণের বর্ণনায় প্রথমেই এখানে এক বিরাট ব্যাপ্ত ভগবৎস্বরূপের কথা বলছেন, যাঁর মধ্যে চরাচর বিশ্ব ব্যাপ্ত হয়ে থাকে—যিনি ‘জগন্নিবাস’, তিনি পিতা বসুদেবের ঘরের দাওয়ায় বসেছিলেন একদিন। সেখানে বসেই তিনি দেখতে পেলেন—যেহেতু নরলীলায় থাকলেও মাঝে মাঝে ভগবত্তার আবেশটুকু থেকে যায়—তাই তিনি দেখতে পেলেন—সুদূর আকাশ থেকে সোনার বরণ একজন মুনি যেন নেমে আসছেন। কোন মুনি—এটা কিন্তু তিনি বুঝলেন না, কেননা তিনি মানুষের শরীরে লীলায়িত। কবি পরের শ্লোকেই বুঝিয়ে দিলেন—ভগবান বলে একটু ছাড় দিয়েছেন প্রথম শ্লোকে, কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি আকাশের মধ্যে এইরকম একটা সোনা-ঝরানো চেহারা দেখত, তাহলে সেই আকস্মিকতা তাদেরও বিহ্বলতা দিত, বিকলতা দিত।

কবি লিখছেন—সাধারণ মানুষ আকাশ-মাঝে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ভাবল—এটা সূর্যদেব অন্য একটা চেহারায় নীচে নেমে আসছে, নাকি আগুনের শিখা পুঞ্জীভূত হয়ে নেমে আসছে আকাশ থেকে। একটা অদ্ভুত তেজঃপুঞ্জ চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে আকাশ থেকে পড়ছে যেন। এমন দৃশ্য দেখে সাধারণ লোকের মন যেন আকুল হয়ে উঠল, তারা শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আকাশস্থ সেই তেজঃপুঞ্জের দিকে—শুধু ভাবতে লাগল—কী হতে পারে এটা—পতত্যধো ধাম বিসারি সর্বতঃ/কিমেতদিত্যাকুলমীক্ষতং জনৈঃ।

আমরা মহাকবি ব্যাসের কথা বলছিলাম। অদ্ভুত কিছু করতে গিয়ে তাঁর মন বিকল হয়ে উঠেছে এবং সেই বিকলতার জন্য তিনি দোষ স্বীকার করছেন তাঁর আত্মারাম প্রভুর কাছে। আমরা এখানে মহাকবির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর বিকলতা-দোষের বহুমানন করে বলছি—এমনটা হতেই পারে—নিরাকার শূন্যের মধ্যে আকার দেখতে পেলে যে বিস্ময় তৈরি হয় সেটাই তো অদ্ভুত-রসের সার, মহাকবির ব্যঞ্জনায় সেটা বিকলতার মতো একটা দোষ।

বসুদেব-গৃহে বসে থাকা সেই ভগবৎপ্রতিম মানুষটিও কম অবাক হচ্ছেন না। তিনি দেখলেন—একটা জ্যোতিঃপুঞ্জ যেন আকাশ থেকে নেমে আসছে ভুঁয়ে—চয়স্ত্বিযাম ইত্যবধারিতং পুরঃ। তার পর দেখলেন—এই জ্যোতিপুঞ্জের একটা আকার আছে, একটা শরীর আছে; তার পর দেখলেন—সেই শরীরী মানুষটি একটি পুরুষ। আস্তে আস্তে যিনি তাঁর সম্মুখে স্পষ্ট-প্রকট হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁকে দেখে কৃষ্ণ বললেন—আরে! এ যে আমাদের নারদ মুনি! দেবর্ষি নারদ! ক্রমাদমুং নারদ ইত্যবোধি সঃ।

সম্পূর্ণ এক নিরাকার জ্যোতিঃপুঞ্জ মধ্য থেকে এক স্পষ্ট সাকার রূপ আবিষ্কার করার পর বিস্ময়াকুল যে ভাবটা ভগবানের মধ্যেও আসে, মহাকবি ব্যাস সেই বিস্ময়টাকেই রসশাস্ত্রীয় প্রশ্রয়ে ব্যাখ্যা করে বলেছেন—আমি মহাব্যাকুল হয়ে যে তিনটে দোষ করে ফেলেছি, সেই দোষগুলি আমায় ক্ষমা করে দিয়ো তুমি—দোষত্রয়ং মৎকৃতম। কী দোষ করেছেন কবি? ব্যাস দ্বৈপায়ন প্রথম দোষ স্বীকার করে বলেছেন—বার বার এই কথা শুনেছি প্রভু। শুনেছি—তোমার কোনো রূপ নেই, শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ নেই—অশব্দম অস্পর্শম অরূপম অব্যয়ম—তুমি অথচ নিত্য আছ সর্বকালে সর্বদেশ জুড়ে—তোমার আদি-অন্ত-মধ্যহীন এই রূপ অবধারণ করা তো মুনি-ঋষি-যোগীদের পক্ষে সম্ভব—যোগিভির্ধ্যনগম্যম—সেই বিরাট অরূপকে আমরা অবধারণ করব কী করে?

ব্যাসের এই জিজ্ঞাসার উত্তর ব্যাস জানেন নিজেই—বস্তুত সেই অরূপের স্বরূপ তাঁর ভালোই জানা আছে। যিনি চতুর্বেদ বিভাগ করার পর বেদান্তদর্শন ব্রহ্মসূত্র রচনা করেছেন—সেই ব্রহ্মসূত্রের ওপরেই তো শঙ্করাচার্য-রামানুজদের যত খেলা, সেই পরব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাস-বাদরায়ন জানবেন না, এটা তো হতে পারে না। তিনি সব জানেন এবং জানেন বলেই আজ বলেছেন—আমি আবারও ধ্যানে বসেছিলাম, প্রভু! সেই ধ্যানের মধ্যে তোমার অরূপের মধ্যে রূপ দেখতে পেয়েছি, সেই মনোহরণ রূপ দেখে আমি মুগ্ধ-বিহ্বল হয়ে গেছি, প্রভু। আমার এই বিকলতা তুমি ক্ষমা কোরো। ব্যাস যে রূপ দেখতে পেয়েছিলেন, সেই রূপের ব্যাখ্যান হল মহাভারত, ভাগবত পুরাণ।

মহাভারতে কী আছে? ব্যাস বলেছেন—এখানে এই মহাভারতের আদিতেও অবস্থান করছেন বাসুদেব কৃষ্ণ, মধ্যেও কৃষ্ণ এবং অন্তভাগেও সেই কৃষ্ণ—আদাবন্তে চ মধ্যে চ বাসুদেবো’ত্র কীর্ত্যতে। এটা ভীষণ রকমের সত্যি কথা। মহাভারতের অনুভবী পাঠক-মাত্রেই এটা জানেন যে, মহাভারত যতই পাণ্ডব-কৌরবের বিসংবাদের কথা হোক, এই মহাকাব্যের ‘সেন্ট্রাল ফিগার’ হলেন কৃষ্ণ। মহাভারতের কাহিনি আরম্ভ হওয়া থেকে শেষ পর্যন্ত আপ্রবন্ধ স্থায়ীভাবের মতো কৃষ্ণ আছেন সর্বত্র, কোনো না কোনোভাবে। সম্পূর্ণ মহাভারত-কাহিনি লেখার পর ব্যাস বিস্ময়-মুকুলিত-নেত্রে অনুভব করেছেন—এমনই বুঝি হওয়া উচিত সেই রূপবিবর্জিত জ্যোতিস্বরূপের রূপকল্পনা। ধ্যানগম্য সেই অনির্বচনীয় স্বরূপের রূপকল্প যে এটাই, সেটা মহাভারতের মধ্যে ভগবদগীতার বিশ্বরূপ উপন্যস্ত করে নিজেরই একান্ত অনুভূতি ব্যাস প্রকাশ করেছেন অর্জুনের মধ্যে দিয়ে।

ভগবদগীতায় কর্মযোগের শেষে জ্ঞানযোগে সেই অরূপ-অশব্দ পরব্রহ্মের সমস্ত লক্ষণ নিঃশেষে বলার পর কৃষ্ণ বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন অর্জুনের সামনে। অর্জুন সেই বিশ্বরূপের মধ্যে সব দেখতে পাচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তা ভগবান ব্রহ্মা থেকে মুনি-ঋষি, দেব-মনুষ্য, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সব দেখতে পাচ্ছেন। অর্জুন বুঝতে পারছেন—এর আদি নেই, অন্ত নেই, মধ্যদেশ বলেও কিছু নেই—নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং/ পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ। অর্জুন হঠাৎই এই রূপ দেখে এক দিকে যেমন আকস্মিকতার বিভ্রান্তি অনুভব করছেন—বীক্ষন্তে ত্বাং বিস্মিতাশ্চৈব সর্বে—তেমনি তিনি ভয়ও পাচ্ছেন সমানভাবে। তিনি বলছেন—তোমার এমন সর্বগ্রাহী বিরাট রূপ তো কোনো দিন দেখিনি, তাতে একটা আনন্দ হচ্ছে বইকি? কিন্তু আমি ভয়ে কষ্ট পাচ্ছি অনেক বেশি—ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে। দেবতার দেবতা আমার! তোমার এই রূপ আর দেখতে চাই না। তুমি সেই রূপ দেখাও যে রূপে আমি তোমায় চিনতাম—তদেব মে দর্শয় দেব রূপম।

বস্তুত অর্জুন যে এত কিছু দেখছেন একই জায়গায়—এই ব্যাপ্তি মানেই এক ধরনের শূন্যতা অরূপ এবং নির্গুণ নিরাকারের আসল ঠিকানা সেখানেই। অর্জুন একবার বলেও ফেলেছেন—আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কোনো কিছুই এখানে মাপা যায় না, তুমি অপ্রমেয়, যা দেখছি তা অনেকটা আগুন আর সূর্যের মিলিত জ্যোতির মতো দুর্নিরীক্ষ্য, আমি তেমনই দেখছি। অথচ এই বিশ্বের তুমি আশ্রয়—পশ্যামি ত্বাং দুর্নিরীক্ষ্যং সমন্তাদ / দীপ্তানলার্ক-দ্যুতিমপ্রমেয়ম। সত্যি বলতে কী, উপনিষদগুলি একদিকে যেমন পরম ব্রহ্মকে নিরাকার, নির্বিশেষ, নিরুপাধি বলছে, তেমনই অন্যদিকে বলছে—এই আত্মা ব্রহ্ম, তিনি আকাশের মতো নির্মল। এই সমস্ত তাঁরই কর্ম, সমস্ত কামনা তাঁরই কামনা, সমস্ত গন্ধই তাঁর গন্ধ, সমস্ত রসই তিনি, সমস্ত জগতে যিনি পরিব্যাপ্ত—আকাশাত্মা সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদমভাত্তঃ।

এই যে সবই তিনি, অথচ কোনোটাই তিনি নন—এই অনির্বচনীয়তা, এই বিভ্রান্তি যখন আমাদের পাগল করে তোলে—একজন দার্শনিক কিন্তু সেখানে শান্ত দৃষ্টিতে সত্যটা বোঝাতে পারেন, এমনকি একজন পদার্থবিদ্যাবিদ ফিজিসিস্ট আবার সেখানে দার্শনিক হয়ে ওঠেন। পদার্থবিদ্যার অন্যতম গুরু যাদবপুরের দীপক ঘোষ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছিলেন—দ্যাখো, অর্জুনের অবস্থাটা বলে দিয়েছেন Pascal. তিনি বলেছেন—Man is incapable of seeing the ‘nothingness’ from which he emerges and the ‘infinity’ in which he is engulfed.

হয়তো এই শূন্য-দর্শন অথবা সর্বব্যাপ্তির এই শূন্যতা অর্জুন সহ্য করতে পারেননি বলেই তিনি পরিচিত স্বরূপে ছোটর মধ্যে বড়োকে দেখতে চেয়েছেন। বিশ্বরূপী ভগবানকে তিনি বলেছেন—না হয় তোমার ওই চতুর্ভুজ মূর্তিটাই আমাকে দেখাও। বেদ-উপনিষদ পড়ে-শুনে ওই রূপটি আমার চেনা। এই সহস্রবাহু শশী-সূর্য-নেত্র চেহারাটা আমি বুঝি না—তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন /সহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে। কৃষ্ণ আর দেরি করেননি, তিনি তখনই আপন সখ্যমূর্তিতে সৌম্য-সুন্দর হয়ে দাঁড়ালেন অর্জুনের সামনে—ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা।

ব্যাস মহাকবির নিজের হাতে লেখা মহাভারতের মধ্যে ভগবদগীতার অংশে অর্জুনের এই উদাহরণ মনে ছিল বলেই তিনি নিজে রূপবিবর্জিত নিরাকারের পূর্ণ প্রতিভাসে পরম ঈশ্বরের মূর্তি কল্পনা করলেন। তিনি জানেন—ধরাধাম থেকে কৃষ্ণ, অর্জুন, যুধিষ্ঠিরেরা চলে গেলে তাঁদের আকার, চরিত্র, রূপ, গুণ মনে রাখতে পারবে না কেউ। আর মানুষের এমন সাধ্যও নেই যে, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র, কিংবা চৈতন্যদেব যখন ধরাধামে থাকবেন, তখনই তাঁদের সমকালে সকলেই জন্ম নেবেন। ব্যাস তাই পরম ঈশ্বরের মূর্তি কল্পনা করে বললেন—এই বিগ্রহের মধ্যেই তিনি আছেন।

এখানে নিশ্চয়ই অনেকেই হাঁ-হাঁ করে চেপে ধরবেন আমাকে। বলবেন—এই সেই পৌত্তলিকতা অর্থাৎ পুতুল-পুজোর প্রশস্তি আরম্ভ করলেন আপনারা। আমি এখানে এতটুকুও বিবাদে যাব না, তর্কও করব না একফোঁটা। কেননা তর্কযুক্তি দুই পক্ষেই আছে, কিন্তু এখানে যাঁরা তাঁকে নিরাকার, নির্বিশেষ, পরম জ্যোতি হিসেবে অনুভব করেন, তাঁরা অভিজাত দার্শনিক হয়ে থাকুন, তাঁদের চরণে আমার প্রণাম। কেননা তাঁদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করলে আমি প্রথমেই বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করে পঞ্চাশ পা পিছিয়ে যাব। তারপরেই বিশ্বাসের জায়গায় ফিরে ভগবান ব্যাসের গুণ গেয়ে বলব—রূপবিবর্জিত মহাজ্যোতির তুমি একটিমাত্র রূপ দেখিয়েই ক্ষান্ত হওনি, তুমি একই কৃষ্ণের দুই রূপ দেখিয়েছ। এক তাঁর ঐশ্বরিক রূপ, আর একটা তাঁর মাধুর্যময় রস-রূপ। মানুষের মন এই রূপ দেখে পরম ঈশ্বরকে মনুষ্যদেহের সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে।

এ কথা তো ঠিকই যে, মানুষই ঈশ্বরের রূপ দেয়, সে যে ভাবে ঈশ্বরের সজ্জা-অলঙ্করণ তৈরি করে সেটাই ঈশ্বরের সজ্জা হয়ে ওঠে, এমনকি খাদ্য-পানীয় মানুষ যেভাবে যেটা পছন্দ করে ঈশ্বরকেও তাই খাওয়ায়—মানুষের অভীষ্ট পান-ভোজনই ঈশ্বরেরও পান-ভোজন হয়ে ওঠে। আমার মনে পড়ে আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে আমি আমার পিতাঠাকুর এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে নবদ্বীপের হরিবোল কুটিরে গেছি মুকুন্দদাস বাবাজির আশ্রমে। মুকুন্দদাসজি ছিলেন বহু বৈষ্ণব গ্রন্থপ্রণেতা বিখ্যাত হরিদাস দাসজির ছোট ভাই। আমরা আশ্রমে গিয়ে দেখলাম—বাবাজি কুটিরে নেই, তিনি ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। বাবাজিমশায় স্বধর্মে কঠোর সাধক ছিলেন। রোগা-পাতলা চেহারা, কিন্তু ভীষণ পরিশ্রমী, সন্ন্যাসীর ধর্মেও ততটাই স্থিত যে, প্রতি-দিন ভিক্ষান্নেই তাঁর ঠাকুর সেবা চলত। রান্নাও করতেন নিজেই।

আমরা সকাল দশটা নাগাদ ওঁর আশ্রমে উপস্থিত হওয়ার পর কুটির-দুয়ার বন্ধ দেখে সামনে উঠোনেই বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবাজিমশায় ফিরলেন ভিক্ষা সেরে। কুশল-বিনিময়, প্রণাম-বিনিময় শেষ হওয়ার পর বাবাজির মধ্যে খানিক অস্থিরতা লক্ষ করলাম এবং আমরা সকলে আছি দেখেই তিনি ঠাকুর-ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বললেন—আপনারা আরও একটু বসুন, দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন করে তার পর যাবেন। আমি একটু আসছি। খুব বেশি দেরি হল না অবশ্য। মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই ফিরে এলেন মুকুন্দদাসজি। আমরা বুঝলাম—তিনি অতিথি সমাগম দেখে দ্বিতীয়বার ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন। বাবাজি-মশায়ের ভোগরান্না আরম্ভ হল। তিনি রান্নাও করছেন, আবার মাঝে মাঝে এসে আমাদের সঙ্গে কথাও বলছেন এবং বিভিন্ন ভাগবত-প্রসঙ্গও আলোচিত হচ্ছিল কথা-প্রসঙ্গে।

ভোগরান্না শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। ঠাকুর-ঘর বন্ধ করে খানিক ভোগারতির কীর্তন শুরু হল—ভজ পতিতোদ্ধারণ শ্রীগৌরহরি… ভোগান্তে, প্রণামান্তে আমরা খেতে বসলাম এক তমাল-তরুর তলে। মুকুন্দদাসজির আশ্রম প্রাঙ্গণে বিশালছায়া তমাল-তরুটিকে আমি আজও ভুলিনি। মুকুন্দদাসজি আমাদের প্রথম পাতে পরিবেশন করলেন—তিন চামচ করে বাড়িতে তৈরি করা সুগন্ধি ঘি। বললেন—এক ভক্ত মহাপ্রভুর সেবার জন্য এই ঘি দিয়ে গেছে, আজ আপনাদের মতো ভক্তদের সেবায় এই ঘি লাগল বলে আমি আজ কৃতার্থ। তা না হলে কী করতাম আমি এই দেবভোগ্য বস্তুটা নিয়ে। আমরা বললাম—আপনার এই অমৃত-মধুর বস্তুটি জলে গেল। বরঞ্চ প্রতিদিন একটু একটু করে মহাপ্রভুর সেবায় লাগতেন, সেই তো ভালো ছিল।

মুকুন্দদাসজি বললেন—আমার প্রভু ভক্তপ্রাণধন। তিনি সদাই অপেক্ষা করেন কবে তাঁর মনোমতো ভক্তরা আসবে, আজ আমাকে সেই সুযোগ দিলেন প্রভু। নইলে আমার তো এই রোগা-পাতলা শরীর, কুত্তার পেটে ঘি সহ্য হয় না। ভক্তের দেওয়া ঘি, ভক্তদের সেবায় লেগে গেল। বাবাজি-মশায় দ্বিতীয় পাতে একটা দশ-মিশেলি ডাল পরিবেশন করলেন। ভিক্ষার ডাল একেক বাড়ি থেকে এক-একরকম দিয়েছে—খেসারি ডাল থেকে মুগ, ছোলা, মাষ, মটর কিছুই বাদ নেই, এমনকি ঘুগনি কলাইও গোটা-গোটা মুখে পড়ল ডাল-ভাত খাবার সময়। এ বার তৃতীয় পাতে কালচে-সবুজ একটা বস্তু দিলেন বাবাজি-মশায়; সে অল্পখানিক দিয়েই অনেকটা ভাত মাখা যায়, সঙ্গে একটি করে কাঁচা লঙ্কা। কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া সেই বস্তুটি দেখে মনে হল—কিছু একটা বেটে সেটা সামান্য ভেজে দেওয়া হয়েছে।

সেই ঘন-শ্যাম বস্তুটি দিয়ে ভাত মাখাতে আরম্ভ করলেই বাবাজি-মশায় বললেন—আমি আরও একটু ভাত দিই, পুরোটাই এটা দিয়ে মাখিয়ে নিন, আমার আর কিছু নেই আপনাদের পাতে দেওয়ার মতো। আজ্ঞা পালন করে খেতে আরম্ভ করলাম এবং দেখলাম বস্তুটি চমৎকার খেতে। ওইরকম বিশেষ এবং বিচিত্র আস্বাদনের একটা খাদ্যবস্তু লাভ করে আমাদের জিজ্ঞাসা তৈরি হল—কী খাচ্ছি আমরা? প্রশ্ন শুনে মুকুন্দদাসজি বললেন—এই যে তমাল গাছের ছায়ায় আপনারা বসে আছেন, এই গাছের বেশ কিছু পাতা তুলে আমি নিফাস করে বেটেছি। আজ আমার প্রভুর ইচ্ছে হল তমাল-পাতা-বাটা খাবেন, তাই আজ তাঁর সেবায় লাগালাম। তাঁর ভক্তরা আজ প্রসাদ পেলেন, এই আমার আনন্দ।

বাবাজির কথা শুনে সবাই হরিধ্বনি দিল বটে, কিন্তু আমার মতো দুষ্ট-প্রকৃতি মানুষের কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রসঙ্গত বলি, মুকুন্দদাসজির সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়েছে, তখন আমি সদ্য স্নাতক স্তরে পড়তে ঢুকেছি। তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো ছিলেন এবং হয়তো সেই কারণেই আমার সঙ্গে তাঁর একটা বিষম সখ্যতা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে বাবাজি-মশায়ের বড়ো ভাই বিখ্যাত হরিদাস দাসের গ্রন্থগুলিতে আমার প্রগাঢ় কৌতূহল দেখে এই সংস্কৃত-পড়া বাচাল যুবকের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল মাত্রাছাড়া। এমন অনেক কথাই তাঁকে আমি বলতাম, যা অন্যেরা তাঁকে বলার সামান্য সাহসও করত না। তাঁর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধাটাও তিনি অনুভব করতেন।

আমিই তমাল-পাতা-বাটা চতুর্মুখে খেয়ে বাবাজিমশায়কে বললাম—আজই আপনার মহাপ্রভুর তমাল-পাতা-বাটা খাবার ইচ্ছে হল, তাই না? আচ্ছা প্রভু! এ বার আপনি বলুন তো—আমাদের দেখেই তো আপনি তড়িঘড়ি দ্বিতীয়বার ভিক্ষায় বেরোলেন। কিন্তু সে ভাবে আপনি ভিক্ষা আর পেলেন না, মানে আপনার মহাপ্রভু আর জোটালেন না বেশি কিছু। ফলে তরি-তরকারি দিয়ে আপনি যে, এক কড়াই লাবড়া রাঁধলেন, সেটা আর হল না। ভাগ্যিস সেই বেগুন-মুলো, আলু-পটল আপনি পাননি, যার জন্য আজ অগত্যা আপনাকে তমাল-পাতা বাটতে হল, যেটা আপনি মহাপ্রভুর খাবার ইচ্ছে বলে চালাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ, এটা প্রভুর ইচ্ছাই বটে, তা নইলে এমন অপূর্ব এই খাদ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। আপনার কাছে প্রার্থনা—আমরা কাল-পরশু আবার আসব এবং আপনার মহাপ্রভুর যেন আবার এই তমাল-পাতা-বাটা খেতে ইচ্ছে হয়।

বাবাজি-মশায় ধরা পড়ে গেছেন বলে আমার কথার খুব প্রতিবাদ করলেন না। শুধু বললেন—পরের দিন আমার প্রভুর কী খেতে ইচ্ছে হবে, সে কথা কি আগে থেকে বলা যায়। ওই যে এক ভক্ত গাওয়া ঘি দিয়ে গেল, তেমনই একদিন হয়তো এক সের ছানাও নিয়ে আসতে পারে সে, তো সেদিন আমি প্রভুকে ছানার রসা খাওয়াব। আমি ফুট কেটে বললাম—তাহলে এটা স্বীকার করুন আগে যে, আপনার যেদিন ছানা জুটছে, সে দিন আপনি প্রভুকে ছানার রসা খাওয়াচ্ছেন, আর যেদিন সেটা জুটল না, সে দিন আপনি প্রভুকে তমাল-পাতা-বাটা খাওয়াচ্ছেন, আর তারপর বলছেন—আজ আপনার মহাপ্রভুর তমাল পাতা খাবার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আপনি সেই ব্যবস্থা করছেন।

আমার মুখ-ঝামটা শুনে মুকুন্দদাসজি কেমন থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর বেশ একটু রাগতস্বরেই আমাকে খানিক কটু ভাষাতেই কথা বলা আরম্ভ করলেন। কিন্তু আমি তাঁকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই বললাম—শুনুন বাবাজি-মশায়! আমি সব বুঝি। আমরা এতগুলি লোক সকাল দশটায় আপনার আশ্রমে এসেছি; আপনার প্রভুর প্রসাদ জল-বাতাসাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু না আপনি আমাদের মাধ্যাহ্নিক প্রসাদ না খাইয়ে ছাড়বেন না। তার জন্য আপনি দ্বিতীয়বার ভিক্ষায় বেরোলেন। কিন্তু কাঁড়া-নাকাঁড়া ভিক্ষের চাল তো কিছু আপনার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ছিল খানিক। কিন্তু তবু আপনি এই হাড়-জিরজিরে শরীর নিয়ে ভিক্ষা করতে বেরোলেন। তরি-তরকারি কিছু পেলেনও না, পেলেন একখানা মিষ্টি কুমড়ো। কিন্তু সেটা খানিক কাঁচা রয়েছে বলে অখাদ্য-বোধে আপনি রসুই করলেন না। আপনি বসে বসে কষ্ট করে এতখানি তমাল-পাতা বাটলেন। আপনি কী ভাবেন, আপনার এই পরিশ্রমটা আমাদের সহ্য হল! আবার এই পরিশ্রম করার পর আপনি বলছেন—আপনার মহাপ্রভুর আজ তমাল-পাতা-বাটা খাবার ইচ্ছে হয়েছে। খাওয়া এবং খাওয়ানোর ব্যাপারে আমাদের নিজের ইচ্ছেগুলি কত দিন আর মহাপ্রভুর ওপর চাপাবেন?

বাবাজি-মশায় কিন্তু এ বার আর রাগ করলেন না। বরঞ্চ খুব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বললেন স্মিত হেসে। বললেন—এটা তুমি খুব বড়ো কথা বলেছ ভাই। আমরা নিজেরা যখন যা খেতে চাই, সেটাই আমরা ঠাকুরের ওপর চাপাই। এখানে অনেকটাই আমাদের বৈষ্ণবীয় শিষ্টাচার কাজ করে। এইভাবেই আমাদের বলা অভ্যেস। খুব সুখাদ্য বস্তু যদি পাই, তখনও তো এটাই বলি যে, আজ প্রভুর সরভাজা খেতে ইচ্ছে হয়েছে, তাই তো অমুক ভক্ত এটা দিয়ে গেল। আমরা ভিখারি মানুষ, ভিক্ষায় জীবন চলে সেখানে সুখাদ্য পেলে যেমন মহাপ্রভুর দোহাই দিই, তেমনই বিপদে পড়লে তমাল-পাতা-বাটার ব্যবস্থা করে বলি যে, প্রভুর আজ এটাই খাবার ইচ্ছে হয়েছে। আমি আজ কুমড়ো সেদ্ধ ভাতে দিতে পারতাম, কিন্তু ওই যে পাতা-বাটার পরিশ্রমটুকু করলাম—ওই চেষ্টাটুকুই আমার দিক থেকে আতিথেয়তার মর্যাদা পায়, প্রভু সেই আর্তি, চেষ্টাটুকু দেখতে পান বলেই আমরা বলতে পারি—আজ আমার প্রভুর তমাল-পাতা-বাটা খাবার ইচ্ছে হয়েছে।

আমি বললাম—তাহলে এটা স্বীকার করলেন তো যে, ঠাকুর খেতে চান না, আমরা যা খেতে চাই, সেটা আমরা মহাপ্রভুর নামে চালাই। মুকুন্দদাসজি এ বার আর মামুলি কথায় গেলেন না। এ বার তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই দার্শনিক শব্দরাশি, যা আমাদের দ্বৈতবাদী দেবতার দার্শনিক প্রতিষ্ঠা তৈরি করে। মুকুন্দ বাবাজিমশায় কৃপাসুন্দর চক্ষে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন—এটা খুব সত্যি যে, আমরাই ঠাকুরকে খাওয়াই এবং আমাদের যেটা খেতে ভালো লাগে, সেটাই আমরা দেবতাকে খাওয়াই। যার বাড়িতে যেমন আছে, যেমনটা যে যতটুকু দিতে পারে, দেবতার খাদ্যও সেটাই। দেবতার কোনো বাঁধা খাবার থাকতে পারে না, কেননা মানুষ একরকম নয়, তাতে আবার ভক্তের বিত্ত, ধন, ইচ্ছা, উন্মাদনাও পৃথক, দেবতার খাদ্যও তাই পৃথক। মানুষের বৃত্তি, বৃত্ত এবং ক্ষমতা যার যেরকম, দেবতার খাদ্যও সেইরকম এবং এ কথাটা বলেছেন স্বয়ং রামচন্দ্র। বাল্মীকির রামায়ণেই কথাটা আছে।

একজন অনুভবী বৈষ্ণবাচার্যের মুখে এই কথা শুনে আমরা উদগ্রীব হলাম মুকুন্দদাসজির মুখোদগীর্ণ শাস্ত্রকথা শোনার জন্য। তিনি বললেন—আমি কী বলব, মুখ্যু মানুষ! এ কথা শুনেছিলাম আমার দাদা হরিদাস দাসজির কাছে। তিনি বলেছিলেন—ভরত-শত্রুঘ্নরা বনবাসী রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তাঁকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সেই প্রস্তাব রাখার আগেই ভরত যখন রামকে পিতার মৃত্যুসংবাদ দিলেন, তখন বনবাসে থাকলেও রামচন্দ্রের প্রথম কৃত্য দাঁড়াল—পিতার উদ্দেশে জলতর্পণ করা এবং তাঁর আহার হিসেবে একটা পিণ্ড দান করা। কিন্তু বিজন বনের মধ্যে কী পাবেন রামচন্দ্র। কিন্তু ওই যে লৌকিক ভাবনা—অলৌকিক দেবতার প্রিয়সাধন করার জন্য মানুষ যা পারে সেটাই দেয় তাঁকে—এই ভাবনা থেকেই রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বললেন, ভাই—এই বনের মধ্যে যা পাওয়া যায়, তুমি ইঙ্গুদি-ফল তুলে আনো কতগুলি। সেগুলিই খানিক পাথরে ছেঁচে ‘পিণ্যাক’ তৈরি করে পিতার পারলৌকিক পিণ্ড দান করব। তুমি তার সঙ্গে একটা গাছের নতুন বাকলের ব্যবস্থাও কর—আনয়েঙ্গুদি-পিণ্যাকং চীরমোহর চোত্তরম।

লক্ষ্মণ ইঙ্গুদি-পিণ্যাকের ব্যবস্থা করলে রামচন্দ্র কুশগাছির ওপর যেমনটা আমরা এখনও করি—সেগুলি সাজিয়ে ফেললেন। তার পর পিণ্ডাকৃতি তৈরি করে তার মধ্যে রামচন্দ্র বন্য পাকা কুলও চটকে দিলেন খানিক—ঐঙ্গুদং বদরৈর্মিশ্রং পিণ্যাকং দর্ভসংস্তরে। এ বার পিতার উদ্দেশে সেই কুল-মাখা পিষ্ট ইঙ্গুদি-পিণ্যাক নিবেদন করে রামচন্দ্র পিতা দশরথের উদ্দেশে বললেন—মহারাজ! আপনি নিজগুণে প্রীত হয়ে আমার দেওয়া এই খাদ্যবস্তু গ্রহণ করুন। আমরা যা খাই, তাই আপনাকে দিলাম—ইদং ভুঙ্ক্ষ মহারাজ প্রীতো যদশনা বয়ম। ঠিক এর পরেই রামচন্দ্র যেটা বললেন, সেটাই কিন্তু দেবতার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো আত্মবোধ। রামচন্দ্র বলেছেন—আমরা যা খাই, সেটাই তোমাকে দিতে পারছি এই জন্যই যে, আসলে মানুষ যা নিজে খায়, সেটাই দেবতাকে খেতে দেয় এবং দেবতাও সেই খাদ্যও খান—যদন্নঃ পুরুষো ভবতি তদন্নাস্তস্য দেবতাঃ।

মুকুন্দদাস বাবাজি মশায়ের কথাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো এক সমাহিত তর্ক ছিল, যা সবচেয়ে বড়ো বাস্তবও বটে এবং তা ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে অলৌকিক দেবতার সবচেয়ে মধুর সম্পর্কসেতু। স্বয়ং রামচন্দ্র, যিনি নরলীলায় এই বাস্তবটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ দেবতার ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে ঠাকুর-ভোগ রান্না করে খাওয়ায় না; বরঞ্চ মানুষ নিজে যা খায় বা খেতে চায়, সেটাই সে ঠাকুরকে খাওয়ায় এবং ঠিক এইখানেই পিতৃদেবতার উদ্দেশে নিবেদিত রামচন্দ্রের ইঙ্গুদি-বদরী, আর মহাপ্রভুর ইচ্ছে হওয়া মুকুন্দদাসজির তমাল-পাতা-বাটা একাকার তত্ত্ববস্তু হয়ে ওঠে।

আসলে এটাকে তত্ত্ববস্তু বলছি এই কারণে যে, মানুষই তার দেবতার ভোগ নিরূপণ করে। এ কথা খাদ্যবস্তুর সম্বন্ধে যেমন সত্য, তেমনই তাঁর রূপ, তাঁর সাজসজ্জা, এমনকি তাঁর বিশেষ বিশেষ কর্ম সম্বন্ধেও সত্য। এই যে নিরাকার, নির্বিশেষ সম্পূর্ণ রূপবিবর্জিত এক পরম জ্যোতিকে বিশেষ বিশেষ নাম-রূপের মধ্যে বেঁধে ফেলা—এটাই সেই মহান চিত্রকর মহাকবির কাজ। তিনি যদি ভগবান কৃষ্ণের ‘কুঞ্চিতাধর-পুটে’ মধুর মুরলীটি না দিতেন, তাহলে কেমন হত আমাদের বহুনিন্দিত এই পৌত্তলিকতার পরম আস্বাদন। তিনি যদি বাগীশ্বরী সরস্বতীর হাতে একটি বীণা না দিতেন, তাহলে কেমন করে স্ফুরিত হত সংগীত এবং সাহিত্য একত্তর ব্যঞ্জনায়, তিনি যদি লম্বোদর গণেশের শনির দৃষ্টিপাত না ঘটাতেন, তাহলে কোথায় পেতেন সেই গজমুখ, যেটা এক চিত্রকরের মানসলোক আধুনিকতায় আলোকিত করে দিয়েছে আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে।

মহামতি ব্যাস তির্যক ব্যঞ্জনায় যে দোষ স্বীকার করে বললেন—আমাকে ক্ষমা করো প্রভু! আমি তোমার রূপ-বিবর্জিত জ্যোতি-স্বরূপের রূপ সৃষ্টি করেছি—আমরা বলি—ভাগ্যিস! তোমার মতো এক মহাকবি ছিল ভারতবর্ষে! তুমি নইলে ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষের মনের কথা এমন করে কে বুঝত। ঈশ্বরের যে মধুর রূপ তুমি সৃষ্টি করেছ, সেটা তো সর্বসাধারণ মানুষের ইচ্ছের রূপ। যে মহাকবি বলেছিলেন ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’—দেবতার রূপ সেই শত শত মানুষের ইচ্ছের রূপ। মানুষই তাঁকে গড়েছে আপন অন্তর দিয়ে। গ্রিক দার্শনিক জেনোফেনিস লিখেছিলেন—গোরু, কিংবা ঘোড়া, অথবা সিংহের যদি হাত থাকত, কিংবা এমনও যদি হত যে, তাদের হাত নেই, শুধু পা দিয়েও তারা ছবি আঁকতে পারত, তাহলে মানুষ যা পারে, তারাও সেই কাজই করত; অর্থাৎ গোরু যদি দেবতার ছবি আঁকত, তাহলে সে দেবতার চেহারা হত গোরুর মতোই; ঘোড়া যদি তার দেবতার ছবি আঁকত, তাহলে সে দেবতার চেহারা হত ঘোড়ার মতোই; আর সিংহ যদি আঁকত তার দেবতাকে, তাহলে সে দেবতার রূপও হত সিংহের মতোই; মানুষ নিজের আদলেই তার দেবতার চেহারা বানিয়েছে—They would make the god’s bodies the same shape as their own… men create the gods in their own image.

পণ্ডিতেরা বলেছেন—জেনোফেনিস একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন বলেই এমন তির্যক মন্তব্য করেছেন। আমরা বলি—ভারতবর্ষের দার্শনিকেরা এইসব একেশ্বরবাদীদের পিতা হতে পারেন। মহামতি ব্যাস; যিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা করে একেশ্বরবাদ, অদ্বৈতবাদ নিঃশেষ পান করে ফেলেছিলেন, তিনিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখলেন—তত্ত্ববিদ মানুষেরা অদ্বয় জ্ঞানের তত্ত্বটাকে তিনি ভাবে সম্বোধন করেন—ঔপনিষদিক জ্ঞানী মানুষেরা তাঁকে বলেন এক এবং অদ্বয় ব্রহ্ম, সাংখ্য যোগীরা তাঁকে বলেন পরমাত্মা, আর ভক্তেরা তাঁকে বলেন ভগবান—

বদন্তি তৎ তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজজ্ঞানমদ্বয়ম।

ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে।।

এই যে ভক্তের ভগবান—এইখানেই তো নিরাকার নির্বিশেষ ব্রহ্ম ভাবনার ক্লান্তি থেকে ‘অখিল-রসামৃত-মূর্তি’-ভাবনার উল্লাস সৃষ্টি হয়; শান্ত সমুদ্রের নিশ্চেষ্ট বিশ্রান্তি থেকে তরঙ্গিত সমুদ্রের নব-নবায়মান রূপবৈচিত্র্যের আস্বাদন তৈরি হয়—আমার হৃদয় হইতে তোমার হৃদয়ে। অদ্বৈতবাদ, একেশ্বরবাদের অবশেষ তৈরি হয় আমি-আমি করে—আমিই ব্রহ্ম—সো’হম; আমিই তিনি—অহং ব্রহ্মাস্মি; অথবা তুমিই সেই ব্রহ্ম। গুরু বলবেন—তিনিই তুমি—তত্ত্বমসি। তোমার মুক্তি হয়ে গেল, তুমি মিশে গেলে সেই বিরাটের মহিমার মধ্যে, জীবাত্মা পরমাত্মায় মিশে গেল, ছোট আমি বিলীন হয়ে গেল বড়ো আমির মধ্যে। এত আমি-আমি, তিনিই তুমি শুনে ভাগীরথীর তীরে বসে সাধক রামপ্রসাদ কেঁদে বললেন—মাগো! নির্বাণে কী আছে ফল? (ও তো) জলেতে মিশায় জল, চিনি হওয়া ভালো নয় মন, চিনি খেতে ভালোবাসি।

ভক্তের রাজ্য এই রকমই। ভক্ত ভগবানের মধ্যে মিশে গিয়ে মুক্তি চায় না, সে তার প্রভুকে আস্বাদন করতে চায়। একভাবে এটাও কিন্তু অদ্বৈতবাদ। ‘স্বাদ’ কথাটার মানেই তো জানেন না অনেকে। ‘স্ব’ মানে নিজে স্বয়ং। আর ‘অদ’ ধাতুর অর্থ খাওয়া—’স্বম অত্তি’—আমরা যখন নিজেকেই খাই তখনই স্বাদ পাই। কিন্তু নিজেকে আস্বাদন করতে একটা দ্বিতীয় মানুষ লাগে। খুব সাধারণ উদাহরণ হল আয়না। আমি নিজে কতটা সুন্দর, আমি নিজে কতটা ভালো, আমার মুখের মধ্যে কতটা ‘ইনোসেন্স’ আছে, কিংবা আমি এইভাবে হাসলে আমাকে কেমন লাগে, এমনকি আমি মুখে ভেংচি কাটলেই বা কেমন লাগে, এ সব কিন্তু আয়নায় দেখেই আমরা নিজেকেই খাই, আস্বাদন করি। কিন্তু সমস্যা হল—আয়নায় দেখে যে আত্মরতি তৈরি হয়, তাতে আস্বাদনের চমৎকারিতা থাকে না, আস্বাদন তাতে পূর্ণ হয় না। চরিতামৃতের কবি লিখেছেন—

দর্পণাদ্যে দেখি যদি আপন মাধুরী।

আস্বাদিতে সাধ হয় আস্বাদিতে নারি।।

আসলে নিজেকে প্রাণহীন আয়নার মধ্যে দেখে নিজের সম্বন্ধে যে আস্বাদন হয়, সেটা অনেকটাই নিজের মুখে নিজের ঢাক পেটানোর মতো। তাতে এক প্রকারের স্বমেহনী আত্মতৃপ্তি হতে পারে, কিন্তু চরম সুখের কোনো আস্বাদন হয় না। এই কথাটা ভীষণ তির্যকভাবে বলেছিলেন এক অসামান্য কবি। তিনি বলেছিলেন—নিজের গুণ নিজে বর্ণনা করার মধ্যে কোনো সুখও নেই, তাতে কোনো সৌভাগ্যেরও উদয় হয় না। তাই স্বমুখে স্বয়ং স্বগুণবর্ণনা করার ব্যাপারটা অনেকটাই সেই কুলরমণীর বদভ্যাসের মতো—যিনি ঘরে বসে নিজেই নিজের স্তনমর্দন করে সুখ পান—যথৈব চ কুলস্ত্রীণাং স্বয়ং স্বকুচমর্দনে।

অতএব আস্বাদনের জন্য দ্বিতীয় একজন প্রাণবন্ত মানুষই চাই, যার ‘বিশদীভূত মনোমুকুরে’ যখন তোমার ছায়া পড়ে, তাতে যখন তাঁর প্রাণ-মন-বাক্য উচ্ছ্বসিত, উদ্ভাসিত হয়, বস্তুত তখনই সেই উচ্ছ্বাস, সেই উদ্ভাস তুমি উপভোগ কর, তখনই তুমি নিজেকে খাও, নিজেকেই আস্বাদন কর—সেইরকম এক চরম আস্বাদনের প্রয়োজনেই মহাভক্ত মহাকবি গেয়ে ওঠেন—এবার কালী তোমায় খাব। এইরকম এক ‘অনাস্বাদিত-পূর্ব’ আস্বাদনের জন্যই বিদর্ভ দেশে বসে বৈদর্ভী রুক্মিণী দ্বারকার কৃষ্ণের উদ্দেশে পত্র লেখেন—তিন ভুবনের সেরা সুন্দর আমার! রুক্মিণী তখনও কৃষ্ণকে দেখেনইনি, তবু লেখেন—তিন ভুবনের সেরা সুন্দর আমার! তোমার অপার গুণরাশির কথা শুনতে শুনতে আমার শরীরের তাপ-জ্বালা জুড়িয়ে যায়। আর চক্ষুষ্মান ব্যক্তি, যাঁরা তোমার রূপ দেখে ‘সব পেয়েছি’ বলে ভেবেছে, তোমার সেই রূপের কথা শুনে আমার মতো কুলরমণীর সমস্ত লজ্জা চলে গেছে, আমার মন আবিষ্ট হয়ে গেছে তোমার মধ্যে—ত্বয়্যচ্যুতাবিশতি চিত্তম অপত্রপং মে।

দ্বিতীয় একজনের মধ্যে নিজেকে আবিষ্ট করেই কিন্তু রুক্মিণী নিজেকে আস্বাদন করছেন এবং সেই আস্বাদনের তীব্রতা এমনই যে, স্ত্রী-স্বভাবা রুক্মিণী তাঁর রমণীসুলভ লজ্জাটুকুও ধরে রাখতে পারছেন না। এখানে এই লজ্জা বিসর্জনের মধ্যে যেমন ভক্তভাব আছে, তেমনই সেই ভক্তভাবের মধ্যেই আছে তাঁর অন্যতে বিলীন হওয়া—সেই পৌরুষেয় দর্পণ, যেখানে রমণী রুক্মিণী নিজের রমণীয়তা আস্বাদন করেন। এখানে সমস্যা একটাই—ভক্ত না হয় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে নিজের ভক্তিরস আস্বাদন করল, সেখানে ভগবান কী করেন? তাঁরও কি ইচ্ছা হয় নিজেকে আস্বাদন করার? বিশেষত স্বয়ং ভগবান—তিনি তো সর্বশক্তিমান আত্মারাম পুরুষ, নিজের মধ্যেই তিনি সমস্ত আনন্দলাভ করতে পারেন। এক এবং অদ্বৈতের কোনো অপেক্ষা নেই দ্বিতীয়ের জন্য।

এখানে উপনিষদের মহাবাক্য হল—ভগবানকেও যদি নিজেকে আস্বাদন করতে হয়, তাহলে তাঁরও একজন দ্বিতীয় লাগে। উপনিষদের কথায় পরে আসি, আগে মহাজনের অনুভূতির কথা বলে নিই। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ রূপ গোস্বামীর নাম শুনেছেন সকলেই। তিনি ললিত-মাধব নামে একখানি নাটক লিখেছিলেন। সেখানে রাধা-বিরহিত কৃষ্ণ এক স্থানে স্বচ্ছ মণিভিত্তির মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলেন। তার পরেই চমকে উঠে বললেন—আরে মণিভিত্তিতে কার প্রতিফলন দেখছি! আরে, এ তো আমিই আমাকে দেখছি! কৃষ্ণ বললেন—আমি যে এত সুন্দর তা তো আমি জানতাম না। আমি নিজেকে তো নিজে এমন করে দেখিনি কখনো; আমার মনে হচ্ছে—আমাকে দেখে আমার রাধা যেভাবে আমাকে উপভোগ করে, আমি নিজেকে সেই রাধার মতো আস্বাদন করতে চাই—অয়মহমপি হন্ত প্রেক্ষ্য যং লুব্ধচেতাঃ/সরভসমুপভোক্তুং কাময়ে রাধিকেব।

সত্যি কিন্তু এটা যন্ত্রণা, আমাদের প্রাণীদেহের অঙ্গ-সংস্থান এমনই যে, আমরা কেউ নিজেকে দেখতে পাই না। দেখতে হলে একটা প্রতিভাসী মুকুর লাগে, আর সে মুকুর যদি মানব-মুকুর হয়, তবে শুধু শরীরের প্রতিচ্ছায়া নয়, মানুষের মতো একটা আয়না পেলে তাতে কায়-মধুর ভগবানের কায়-মনোবুদ্ধি এবং ভাব সবটুকু ধরা পড়ে। ঠিক এই কারণেই কৃষ্ণ রাধা হয়ে কৃষ্ণকে ভোগ করতে চেয়েছেন। আর রাধা হয়ে কৃষ্ণকে উপভোগ করলে রাধার কেমন লাগে, তার উদাহরণ হয়ে আছেন চৈতন্য মহাপ্রভু—

রাধা-ভাব-কান্তি দুই অঙ্গীকার করি।

জনমিলা নবদ্বিপে গৌরাঙ্গ শ্রীহরি।।

ভাব কথাটাই সব। ওই যে একটু আগে বলছিলাম—আস্বাদনের জন্য একজন দ্বিতীয়কে প্রয়োজন হয় এবং সেই প্রয়োজনেই আপন-আপন রুচি অনুসারে মানুষ আপন স্বরূপেই দেবতাকে দেখেছে, তার রূপ কল্পনা করেছে, দেবতার বাসভূমি রচনা করেছে এমনকি সেই সব কর্মও তাঁকে দিয়ে করিয়েছে, যা সে মনে করেছে দেবতারই করা উচিত। এই অদ্ভুত আস্বাদনের মানুষগুলি কিন্তু মুক্তি চায় না, কেননা মুক্ত হলে সে তার প্রিয়তম প্রভুকে আস্বাদন করতে পারবে না—জলের সঙ্গে জল মিশে যাবে, চিনির সঙ্গে চিনি। ভগবান যদি এঁদের জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তি দিতেও চান, তবু তাঁরা মুক্তি নিতে চান না। তাঁরা বলেন—ভোগ-দুর্ভোগ যাই আসুক এই জীবনে, আমরা তার মধ্যে থেকেই ভগবানের সেবা করব। বরং তিনি দুর্ভোগ দিন আমাকে, তবু মুক্তি চাই না। ভাগবত পুরাণ বলেছে—এই মানুষগুলি এইরকমই পাগল, ওরা আমার সেবা করতে চায়, মুক্তি দিলেও এরা নেবে না—দীয়মানং ন গৃহ্নন্তি বিনা সংসেবনং জনাঃ।

কাশ্মীরের এক আলঙ্কারিক মম্মটাচার্য তিনি রসশাস্ত্রের বিচার করতে করতে এক শিবভক্তের উদাহরণ দিয়েছেন। ভগবান শিব তাঁর সেবা-উপাসনা-তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভাবলেন—সবাই তো মুক্তি পেলে চরম সুখী হয়, অতএব একে মুক্তিই দিয়ে দিই। তিনি শিবভক্তের মুখে কোনো কথা না শুনেই আগে তাঁকে মুক্তিলাভের বর দিয়ে দিলেন। এই মুক্তি-বর লাভ করার পর সেই শিবভক্ত কেঁদে-কেঁদে তাঁর সমস্ত অভিমান শিবের ওপরেই উগরে দিয়ে বললেন—এত কাল কত ছাই-ভস্ম মেখেছি গায়ে, আমার প্রভু শিবের অঙ্গরাগ, আমি ভস্ম মাখলে তিনি খুশি হবেন, তাই ভস্ম মেখেছি এত কাল, কিন্তু আজ থেকে আর মাখতে হবে না, অতএব এই ভস্মাঙ্গরাগ! তুমি ভালো থেকো। তোমারও মঙ্গল হোক। হে রুদ্রাক্ষের মালা, আর ধারণ করতে হবে না তোমাকে! সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে এই শিবমন্দিরে ওঠার সোপানগুলির জন্য—এই সিঁড়িগুলিই তো প্রতিদিন আমাকে এবং আর সমস্ত শিবভক্তদের পৌঁছে দিত আমার গিরিনন্দিনীর প্রিয়তম স্বামী মহেশ্বর শিবের মূর্তির সামনে। এই সিঁড়িগুলি আমি প্রতিদিন ধুয়ে-মুছে রাখতাম, আজ থেকে সে সব আর কিছুই করতে হবে না আমাকে, হায়! হা সোপান-পরম্পরা-গিরিসুতা-কান্তালয়ালংকৃতিম!

শিবভক্ত এ বার সাভিমানে বলছেন—এত কাল আমি যে আমার প্রভুর সেবা-পরিচর্যা নিয়ে থাকতাম, প্রতিদিন শিব-শিবানীর শিঙার, মন্দার-কর্ণিকার পুষ্পে তাঁদের মূর্তি ভক্তদের সামনে উজ্জ্বল করে রাখা, ভোগ-নৈবেদ্যের আয়োজন—এই সমস্ত সেবা-সপর্য্যার সুখ, আমার আরাধনায় তুষ্ট হয়ে আমার প্রভু আজ আমাকে সেই মুক্তি দিয়েছেন, সে মুক্তি আমার কাছে এক অন্ধকার মহামোহের মতো লাগছে, কেননা শিব-শিবানীর সেবা-আরাধনা করে আমি যে পরম সুখ পেতাম, সেই সুখ থেকে আমাকে ছিন্ন করে নিয়ে এ কেমন এক তমসাচ্ছন্ন মুক্তির মধ্যে স্থাপন করলে তুমি—যুস্মৎ-সপর্য্যা-সুখাৎ/লোকচ্ছেদিনি মোক্ষনামনি মহামোহে নিধীয়ামহে।

এই শিবভক্তের মূর্তিসেবার আর্তি-কথা শুনে এ বার যদি সেই মহামতি ব্যাসের ‘বৈদগ্ধ্য-ভঙ্গি-ভনিতি’টুকু খেয়াল করি, তাহলে বুঝবেন যে, এই শিবভক্ত যে কারণে মুক্তির মতো এক সাধ্য বস্তুকে হেলায় প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, তার মূলে আছে ব্যাসের সেই দোষ—ব্যাস এক রূপবিবর্জিত অরূপের রূপ নির্ধারণ করেছেন—শুধু একটি মাত্র রূপ নয়—কৃষ্ণ, কালী, রাম, নৃসিংহ, বামন কত রূপ—রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব। ব্যাস দু’পক্ষের ইচ্ছে রেখেই এই রূপ সৃষ্টি করেছেন। বৃহদারণ্যকের ঋষি দেখেছিলেন যে, রসস্বরূপ পরম পুরুষ কিছুতেই আনন্দ পাচ্ছিলেন না। কেননা একাকী আনন্দ পাওয়া যায় না—স বৈ নৈব রেমে। তস্মাৎ একাকী ন রমতে। তিনি দ্বিতীয় একজনকে চাইলেন। তিনি নিজেকে দুই ভাগে ভাগ করলেন—তিনি পতি হলেন এবং পত্নী হলেন। তাঁরই উৎস থেকে পৃথিবীর যত মানুষ।

তিনি এক এবং অদ্বিতীয় হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আস্বাদন করার জন্যই যেমন তিনি দ্বিতীয় হলেন, তেমনই সেই দ্বিতীয় যে মানুষ, সে-ও তাঁর কল্পনায় নিজেরই প্রতিভাসে সৃষ্টি করল ঈশ্বরের রূপ—আর অপূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ সেই কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস সেই রূপের মধ্যে সৌন্দর্য-মাধুর্য ঢেলে দিলেন শব্দ-বর্ণের যোজনায়। তার পর বললেন—আমার এই দোষটা তুমি ক্ষমা করে দিও প্রভু—আমি অরূপকে রূপময় করেছি। বিশ্বাস করুন, এটা শুধু ব্যাসের দোষ নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যিক ক্রান্তদর্শীরা সর্বত্র এই কাজ করেছেন। তবু তো সেই দ্বীপজন্মা মহাকবি বেঁচে গেছেন—আমাদের দেশের অতিবুদ্ধি দার্শনিকদের অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, অচিন্তভেদাভেদবাদের তর্কচক্রে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, পরম ব্রহ্মের কোনো আকার-প্রকার না থাকলেও ভক্তদের প্রয়োজনেই তাঁর রূপকল্পনা করা হয়—’উপাসকানাং কার্য্যার্থং ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’। কিন্তু নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদীরা এ সব ভক্ত-টক্তের ভাবনা মানবেন কেন! কবি তবু ঝগড়া করেন না। তিনি বলেন—ভুল হয়ে গেছে প্রভু ক্ষমা চাই।

তবু তো ব্যাস বেত্রাঘাত হজম করেননি। মহাকবি হোমারের ইলিয়াড-ওডিসিতে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মাখামাখি দেখে জেনোফেনিসের বছর পঞ্চাশেক পরেই হেরাক্লিটাস (Heraclitus) নামে এক গ্রিক দার্শনিক বললেন—এই হোমার লোকটা—গ্রিকদের মধ্যে জ্ঞানীতম মানুষ হতে পারেন বটে, কিন্তু এই লোকটাকে বিদ্যা-অবিদ্যার সমস্ত দার্শনিক চেষ্টার বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আচ্ছা করে চাবুক মারা দরকার। আর চাবকানো দরকার ওই আর্চিলোকাস (Archilocus) নামের লোকটাকেও—হোমারের জুড়ি—Homer should be thrown out of contests and whipped–– and Archilocus along with them. আমরা জানি বিখ্যাত Theogony-র লেখক Hesiod-কেও তিনি চাবুক মারতেই চাইতেন, কিন্তু আমাদের ধারণা হোমারের বহুল জনপ্রিয়তার বিপ্রতীপে হেসিয়ডকে তিনি বেশি পাত্তা দিতে চাননি। কিন্তু গ্রিক দেব-দেবীর মূর্তি কল্পনায় হেসিয়ড-ও একটা বড়ো নাম। কিন্তু হোমারের তুলনায় হেসিয়ডকে কোনো গণ্যের মধ্যেই ধরেননি হেরাক্লিটাস। তিনি বলেছেন—হেসিয়ড লোকটা অনেক লোককে অনেক কিছু শেখায়, কিন্তু লোকটার দিন-রাত্রির জ্ঞান নেই। দিন আর রাত যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, সেটা ও জানে না। ও ভাবে দিন আলাদা, রাত আলাদা।

আসলে হেসিয়ডের দোষ হয়েছিল—তিনি দিন আর রাতের ব্যাপারটাকে একটু কাব্য করে বলেছিলেন—রাতের অন্ধকার হল সেইরকম এক শক্তি যা দিনের আলোকে স্তব্ধ করে দেয়, নষ্ট করে দেয় মানুষের দৃষ্টি, ঠিক যেমন মৃত্যু শেষ করে দেয় জীবনকে। হেরাক্লিটাস এ সব কাব্য-কথা সইবেন না, তাই বলেছেন—হেসিয়ড লোকটার পড়াশুনো আছে, কিন্তু বুদ্ধি! বুদ্ধি থাকলে কিছু শিখত, কিছু বোধ করত অন্তত। আসলে হেরাক্লিটাসের রাগের কারণ অন্য জায়গায়—হোমার এবং হেসিয়ড দেবতাদের মনুষ্যোচিত ব্যবহারে বর্ণনা করেছেন, তাঁদের রূপকল্প তৈরি করেছেন, তাঁদের সুখ, দুঃখ, ক্রোধ, করুণা—এইসব মানবগুণ আরোপ করেছেন দেবতাদের আচারে। অন্তরীক্ষ-লোকের এক পরম শক্তিপুঞ্জকে এইরকম মানব ব্যবহারে আকারিত করার দোষেই হেরাক্লিটাস হোমার, আর্চিলোকাস অথবা হেডিয়ডকে চাবকাতে চেয়েছেন। অথচ গ্রিক ঐতিহাসিকতার জনক হেরোডোটাস তাঁর মহাকাব্যিক পূর্বসূরি হোমার আর হেসিয়ডের ওই দোষগুলিকেই মহাকবির গুণের কথায় আবর্তিত করে লিখেছেন—It is they–– Hesiod and Homer––who created the Greek theogony, who gave the gods their epithets, distributed honours and aptitudes among them, and gave substance to their figures.

আমাদের দ্বৈপায়ন ব্যাসও তো এই কাজটা করেছেন। তিনি স্বরূপে আবদ্ধ ভগবানকে স্বর্গ বৈকুণ্ঠের কল্পিত লোক থেকে নামিয়ে আনলেন ভুঁয়ে। লোকের ভাব এবং ভাবনা বুঝে তিনি ভগবানের রূপও এক প্রকার সৃষ্টি করলেন। তিনি শ্রুতি-প্রমাণের বলেই এটা জানেন যে, একই আদিত্য কিংবা বিষ্ণুকে ঋষিরা বহুরূপে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, যম কিংবা মাতরিশ্বা বলে সম্বোধন করেন—একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি—সেখানে কলিকালের মানুষের জন্য ব্যাসই বা নতুন করে কৃষ্ণ, রাম, শিব কিংবা দুর্গা, কালীকে কেন রূপ দেবেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা ব্যাস তো মহাকবি, আর এই অপার কাব্য-সংসারে কবিই হলেন স্রষ্টা—কবিরেকঃ প্রজাপতিঃ। অতএব তিনি মানুষের ভাব বুঝে দেবতারও ভাব সৃষ্টি করেছেন। শত শত মানুষের মধ্যে যেমন শৃঙ্গার, মধুর, বীর, করুণ, ভয়ানকের রসভাব আছে, মহাকবি সেই সেই ভগবানকেও লীলায়িত করেছেন।

এটা তো ঠিক যে, একটা সাধারণ প্রবচন তো এইরকম যে, দেবতা কাষ্ঠমূর্তির মধ্যেও থাকেন না, পাষাণময়ী কিংবা মৃন্ময়ী মূর্তির মধ্যেও থাকেন না, দেবতা বাস করেন মানুষের ভাবের মধ্যে, তাই ভগবানকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ভাবই সব—ভাবে হি বিদ্যতে দেবঃ তস্মাদ ভাবো হি কারণম। তাই বলে এটাও ভাবি না যেন কাষ্ঠ, পাষাণ বা মৃন্ময়ী মূর্তিতে দেবতা থাকেন না। আমরা ভাব দিয়েই তাঁর মূর্তি গড়ি; পাষাণীতে, মৃন্ময়ীতে ভাব-দেবতার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়। রামকৃষ্ণদেবের দক্ষিণেশ্বরী কালীমূর্তি, কিংবা বৃন্দাবনে চৈতন্যপার্ষদ গোপালভট্টের প্রাণধন শালগ্রামের রাধারমণ বিগ্রহ বাদ থাকুক এখানে, বাড়িতে সরস্বতী মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে দুদিন ভোগ-নৈবেদ্য দেওয়ার পর সেই মৃন্ময়ী জলে ফেলে বিসর্জন দিতে গেলেও চোখে জল আসে, সেখানে শত শত সাধকের ভাবাশ্রিত সব দেব-মূর্তিগুলির মধ্যে কত চিন্ময়তা লুকিয়ে আছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।

সত্যি বলতে কী, এই ভগবদভিন্ন দেববিগ্রহ নিয়ে অনেক কথা বলার ছিল আমার। কিন্তু আমার এত কথায় পাঠকের ভাব-বুদ্ধিতে কত আঘাত লাগবে ভেবে বিরত থাকছি এখন। কিন্তু তবু দুটি মূর্তির কথা না জানিয়ে পারছি না, কেননা ভগবানের রূপ উপহার দিয়ে ব্যাস মহামতি যে দোষটুকু করেছিলেন, সেই দোষে আমরা কেউ কেউ অজ্ঞানতাবশতই নষ্ট হয়েছি, আর এর মধ্যে কেউ কেউ ভাবনষ্ট লোক আছেন, যাঁরা আমাদের নষ্ট করেছেন, অথচ কী মধুর এই বিনাশ, যার জন্য এক-একদিন কাকভোরে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যাই অথবা ছুটে যাই কাশীতে বিশ্বেশ্বরের কাছে, কিংবা জয়পুরে গোবিন্দজির কাছে।

রাজস্থানের জয়পুরে গোবিন্দজির মন্দির। এই মন্দিরের রাধাগোবিন্দের বিগ্রহ মানুষের ভাব-ভালোবাসার সৃষ্টি। শোনা যায়, চৈতন্য মহাপ্রভুর আদেশে রূপ গোস্বামী লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের মানস নিয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলেন। স্বয়ং শ্রীগোবিন্দের স্বপ্নাদেশ লাভ করে বৃন্দাবনে গোম-টিলার কাছে একটি পরিত্যক্ত স্থান খনন করে ‘লাবণ্যামৃত জন্মস্থান’ গোবিন্দজির মূর্তি লাভ করেন শ্রীরূপ গোস্বামী। ছোট্ট একটি মন্দিরে সেই গোবিন্দ-বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর কিছু দিন কেটে গেলে পুরীধাম থেকে রাধারানির মূর্তি আসে কৃষ্ণের বাম-ভাগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বল সেবায় রাধা-গোবিন্দের এই বিগ্রহ এমনই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল যে, রাজস্থানে অম্বরের (আমের) রাজা মানসিংহ ১৫৯০ সালে লাল পাথর দিয়ে অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে বহু কারুকার্য-খচিত একটি মন্দির তৈরি করে দেন গোবিন্দজির সেবা-সুখের জন্য।

চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী অবশ্য তত দিন বেঁচে ছিলেন না। তিনি ওই মন্দির দেখেও যাননি। তিনি যখন বেঁচেছিলেন তখন ভিক্ষাজীবী রূপ গোস্বামীর পর্ণকুটিরেই তাঁর সেবা হত। শ্রীরূপ দেহ রাখার পর রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামীর এক শিষ্য গোবিন্দজির একটি ছোট্ট মন্দির এবং জগমোহন নির্মাণ করে সাভরণ গোবিন্দজির বিগ্রহসেবা চালাতে থাকেন। ভক্তের ইচ্ছায় সেদিন তাঁর চূড়া বাঁশি তৈরি হয়, কানে জোটে মকরকুণ্ডল। কিন্তু তাঁর ভিখারি ভক্ত রূপ গোস্বামী বেঁচে থাকতে এত সুখ তাঁর জোটেনি বলেই আমাদের বিশ্বাস। চৈতন্য মহাপ্রভুর আদেশে রূপ গোস্বামীকে একের পর এক ভক্তিগ্রন্থ রচনা করতে হয়েছে, কিন্তু তাই বলে পরম আর্তি সহকারে গোবিন্দজির পূজার্চনায় কোনোদিন অবহেলা করেননি। কিন্তু আন্তরিক ভাবে বিগ্রহ সেবা করলেও বিগ্রহ নিয়ে ঐশ্বর্যের আড়ম্বর করা তাঁর ভাবনার মধ্যে আসেনি। সম্ভবত তাঁর ভোগ-নৈবেদ্যের জোগাড়ও ছিল অতি সাধারণ। মাধুকরী যা পেতেন, তাই গোবিন্দজির সেবায় লাগত।

এই অনাড়ম্বর বিগ্রহ সেবাই যে তাঁর জীবন ছিল, সেটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে শ্রীরূপের দাদা সনাতনের জীবন যাপনের পদ্ধতি থেকে। সনাতনের বৈরাগ্য এমনই ছিল যে, তিনি এক গাছের তলায় এক দিনের বেশি থাকতেন না। তাঁর অতিজাগ্রত মদন-মোহনের মূর্তি সঙ্গে নিয়েই তিনি বৃন্দাবনের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর আপন সেবিত বিগ্রহের প্রতি এতটাই তাঁর ভাবাবেশ ছিল যে, সেই ভাবাবেশে বিগ্রহের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তাও চলত নিরন্তর। সনাতনের দৈনন্দিন ধর্মক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম ছিল গিরিরাজ গোবর্ধনের পরিক্রমা। পরিক্রমায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, তার পর মাধুকরী করে ঘরে ফেরা, ঠাকুরের ভোগ তৈরি করা ভিক্ষান্ন দিয়েই। সনাতনের বৈরাগী জীবন বৃন্দাবনের ব্রজবাসীরা জানতেন, তাঁরা এটাও জানতেন যে, ভিক্ষালব্ধ বস্তু দিয়েই সনাতন বিগ্রহসেবা করেন। ফলে তাঁরা রান্না করা জিনিস দিতেন না, দিতেন আটা-ময়দা-যবের ছাতুর মতো জিনিস।

প্রতিদিন একইরকম হয়। সনাতন আটার সঙ্গে যমুনার জল মিশিয়ে সেটাকে লাড্ডু পাকানোর পর দুই হাতের চাপে খানিক থেবরে নিয়ে কাঠের আগুনে ফেলেন। তারপর খানিক পোড়া-পোড়া সেদ্ধ হলে বেশ একটি বাটির মতো চেহারা হয় তার—বৃন্দাবনী ভাষায় সেই বাটি-চাপাটি মদনমোহনকে নিবেদন করে সেই প্রসাদ পাওয়া সনাতনের নিত্যদিনের কাজ। এইখানেই সনাতনের ভাববিগ্রহ মদনমোহনের নামেই একটা কাহিনি পরম্পরাবাহিত হয়ে চলে এসেছে আমাদের কাছে। মদনমোহন সনাতনের দেওয়া বাটি-চাপাটি খেতে খেতে খানিক অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। অথচ পরম ভক্তের ওই সাগ্রহ ভোগ-নিবেদন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই—তাঁর নিজের মুখের কথা—অহং ভক্তপরাধীনঃ।

অবশেষে একদিন সনাতনের স্বপ্নে এলেন মদনমোহন। ঠাকুর বললেন—প্রতিদিন বাটি-চাপাটি দিস আমাকে, আমি তোর ভোগ-নৈবেদ্য প্রতিদিন পরম আনন্দে খাই। কিন্তু কী জানিস, বড়ো অলোনা লাগে খাবারটা, তুই একটু নুনের ব্যবস্থা করে যদি চাপাটিগুলোর মধ্যে দিস তাহলে খাওয়াটা আরও একটু ভালো হয়। খাবারটা একটু স্বাদু হয়, এই আর কী। স্বপ্নের কথোপকথনের মধ্যেও কিন্তু সনাতনের স্বভাব পালটাল না। তিনি বললেন—ঠাকুর! তুমি আর বোলো না। তোমার অভ্যাস তো আমি জানি। তুমি নন্দরাজার ছেলে, মা যশোমতীর প্রশ্রয়ে ক্ষীর-ননী খেয়ে খেয়ে তুমি বড়ো হয়েছ। কিন্তু আমি সে সব কোথায় পাব। ব্রজবাসীদের ঘরে ভিক্ষে চাইলে তারা আটা দেয়, ছাতু দেয়, তাদের এই দয়ার দানের ওপর আমি বলতে পারব না—হ্যাঁ হে ব্রজবাসী! আমার ঘরে লবণের ব্যবস্থা করো তুমি।

ঠাকুর মদনমোহন একটু হালকা চালেই বললেন—লবণ তো আর খাবলা-খাবলা লাগে না রে, ব্রজবাসীরা পরম করুণ, একটুকুন চাইবি দিয়ে দেবে। সনাতন বললেন—আমি চাইব না। তুমি বললে বলেই আরও চাইব না। তোমার বড়ো লোভ ঠাকুর। আজকে তুমি লবণ চাইছ, কালকে তুমি ঘিয়ে মাখানো চাপাটি চাইবে। পরশু দিন বলবে—আমার রাবড়ি চাই। শোনো প্রভু! আমার প্রভু চৈতন্য আমাকে অনেক কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন বৃন্দাবনে। তোমার দশমস্কন্ধিনী ভাগবতী লীলা-ভাষ্য রচনা করে আমি বৈষ্ণবতোষিণী টীকা লিখছি। বৃহদ্ভাগবতামৃতের মতো এক বিরাট কাব্য রচনা করে তোমারই রূপ-গুণ-লীলার বিস্তার-লিখন করছি আমি। এতেও তোমার পেট ভরছে না। তোমার চাপাটিতে লবণ চাই। আমি এই বলে দিলাম—আমি পারব না চাইতে। ভিখারি বলে কি আমার মান-সম্মান নেই। তোমার যদি এত লবণ খেতে ইচ্ছে হয়, তবে তোমার লবণ তুমি জোগাড় করে নাও।

মদনমোহনের আর কথা বলার উপায় হল না। সনাতনের ঘুম ভেঙে গেল। তবে জেগে উঠে তিনি যে এতটুকুও অনুতপ্ত বোধ করলেন, তা নয়। যেমন প্রভু, তেমনই তাঁর ভক্ত। তবে এই কাহিনির বিশ্লেষণ যাঁরা করেন, তাঁরা বলেন—এই লবণের ব্যাপারে সনাতনের অনুৎসাহ যতখানি, তার চাইতে প্রভু মদনমোহনের উৎসাহ অনেক বেশি—তিনি তাঁর বিষয়-বিরাগী ভক্তকে অন্তত একটু স্বাদু চাপাটি খাওয়াতে চান। যে ভগবান ত্রিভুবনেশ্বর, যাঁর ভ্রুকুটিতে পৃথিবী আন্দোলিত হতে পারে, তিনিও কিন্তু এতটাই ভক্তপ্রেমের অধীন যে, অলৌকিক উপায়ে এক বস্তা লবণ এনে ফেলেন সনাতনের পর্ণকুটিরে এমন সাহসও তাঁর নেই।

যাই হোক, রাত্রির স্বপ্নে সেই লাবণ্য-বিধুর ঘটনাটি পরের দিন একবার মাত্র সনাতনের মনে পড়ল দ্বিপ্রহরে বাটি-চাপাটি ভোগ নিবেদন করার সময়। প্রভু মদনমোহন হাসলেন মনে মনে। তারপর অপরাহ্নে একটা ঘটনা ঘটল চতুর-চূড়ামণি কৃষ্ণেরই কৌশলে। যমুনার স্রোতে চলতে চলতে কৃষ্ণদাস কাপুর, মতান্তরে রামদাস বণিকের জাহাজ আটকে গেল নদীর চড়ায়, ঠিক যেখানে টিলার উপর এখনও মদনমোহন বিগ্রহের অবস্থান তার কাছাকাছি। এমনই আটকে গেল জাহাজ যে, সে আর কিছুতেই স্রোতে নামানো গেল না। মাঝিমাল্লাদের নিয়ে বণিক চেষ্টা করলেন, ব্রজবাসী যুবক রাখালেরাও অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু ছোট্ট জাহাজ, তাও যমুনার স্রোতে নিয়ে ফেলা গেল না। কৃষ্ণদাস কাপুর হতাশ হয়ে জানাল—তার বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে, যদি সময়মতো আগ্রায় গিয়ে তার জাহাজের মালপত্তর পৌঁছে না দিতে পারে। ব্রজবাসীরা বণিককে বলল—কোনো উপায় যখন নেই, তখন বৈরাগী সাধু সনাতনের কাছে কৃপা ভিক্ষে করো। ওই সাধুর কৃপায় অনেক কিছুই সম্ভব হতে পারে।

কৃষ্ণদাস কাপুর সনাতন গোসাইয়ের পায়ে গিয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর মুখে বিষয়-আশয়, ধন-সম্পত্তির কথা শুনে খুব একটা কথা বলার রুচিবোধ করছিলেন না সনাতন। কিন্তু বণিক বার বার তার বিপদের কথা বলতে লাগল—জাহাজের মাল নিয়ে আগ্রা পৌঁছোতে না পারলে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে, সে ধনে-প্রাণে মারা যাবে। সনাতন অনেকক্ষণ বণিকের কথা শুনলেন, কিন্তু তবু ভজন-সাধন ছেড়ে, স্মরণ-বন্দন-অর্চন ইত্যাদি সাধন-মার্গের পথ ছেড়ে এই উটকো ঝামেলার মধ্যে তিনি যেতে চাইলেন না। সনাতন চুপ করে আছেন দেখে বণিক কৃষ্ণদাস হতাশ, হতোদ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ফিরে যাবার পথ চেয়ে। বণিকের অবস্থা দেখে সনাতনের একটু মায়াই হল মনে। সামান্য একটা কৌতূহল থেকেই বণিককে একটা প্রশ্ন করে সনাতন বললেন—আচ্ছা বণিক! তুমি যে মালপত্তর আগ্রায় না পৌঁছলে ধনে-প্রাণে মরে যাবে বলছ, তা তোমার ওই জাহাজ-বোঝাই মালপত্তরটা কী? কী আছে তোমার জাহাজে?

বণিক শুকনো মুখে বলল—সাধুবাবা! আমার জাহাজ ভরতি লবণ আছে। শুধুই লবণ, যা আমাকে আগ্রায় বাদশাহের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। সনাতন এ বার মনে মনে হেসে তাঁর বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে বললেন—ওরে রাখাল! এই তোর খেলা! লবণ দিয়েই বাটি-চাপাটি খাবি তুই! সনাতন এ বার কৃষ্ণদাস বণিকের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে বললেন—এ বারে আমি বুঝেছি—কী করে তোমার এই বড়ো নৌকাখানি চড়া ছেড়ে ভেসে যাবে যমুনার স্রোতে। বণিক খুশিতে ডগমগ হয়ে আবার নুয়ে পড়ল সনাতনের পদতলে। মুখে বলল—কী বুঝেছেন? কেমন করে নামবে আমার ছোট্ট জাহাজখানি? সনাতন বললেন—তোমার আর কিছু করতে হবে না, সন্ধ্যা নামলে—আমার প্রভু মদনমোহনের রাত্রিভোগ দিতে হবে। তুমি দু-চিমটি লবণ নিয়ে এসো। আমার প্রভুর ইচ্ছে হয়েছে—তিনি লবণ-মেশানো বাটি-চাপাটি খাবেন।

বণিক অবাক চোখে পরম লজ্জায় খানিক নুন এনে সনাতনের হাতে দিলেন। সনাতন এবার আটায় নুন মিশিয়ে যমুনার জল দিয়ে আটা মাখলেন, তারপর বাটি-চাপাটি তৈরি করে ভোগ দিলেন মদনমোহনের। বণিক চাপাটি প্রসাদ পেয়ে জাহাজ ঠেলালেন মাঝিমাল্লাদের দিয়ে। সামান্য আয়াসেই লবণ-ভরতি জাহাজ বয়ে চলল আগ্রার পথে। বাণিজ্য শেষ করে কৃষ্ণদাস কাপুর ফিরে এলেন সনাতনের কাছে। তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করে মদনমোহনের মন্দির নির্মাণ করালেন, যে মন্দির এখনও বৃন্দাবনে বিরাজমান।

আর সনাতনের কথাই ঠিক হল—তাঁর প্রভু মদনমোহন যতদিন সনাতনের পর্ণকুটিরে ছিলেন, ততদিন তাঁর বাটি-চাপাটিতে লবণও জোটেনি। সনাতন মুখে যতই তিরস্কার করুন ঠাকুরকে, নন্দ-যশোমতীর প্রাণারাম রাধারানির প্রাণসমান মদনমোহনের ভিক্ষাজীবীর জীবন সনাতন মনে মনে সইতে পারতেন না। তাই অযাচিত অর্থব্যয়ে যখন মদনমোহনের মন্দির নির্মাণ হল, তখন মদনমোহন লবণ ছেড়ে ঘি, ঘি ছেড়ে রাবড়ি খাওয়া ধরেছেন। আমরা সে প্রসাদ পাই, যেদিন বৃন্দাবনে ‘মুড়িয়া পুনোঁ’-র উৎসব হয়। বৃন্দাবনের ব্রজবাসীরা মুণ্ডিত মস্তক সনাতন গোস্বামীকে আদর করে ‘মুড়িয়া’ অর্থাৎ ন্যাড়া সাধু বলে ডাকত। গুরুপূর্ণিমার দিন সনাতন গোস্বামীর তিরোভাব তিথি। এইদিন সনাতন গোস্বামীর স্মরণে ‘মুড়িয়া’-র (মুণ্ডিত) মেলা হয় এখনও, এখনও সেদিন প্রভু মদনমোহনের আঙিনায় তাঁর প্রেমী ভক্ত সনাতনের স্মরণ-মনন-উৎসব চলে।

আমি শ্রীরূপের গোবিন্দজির কথা বলতে-বলতে তাঁর দাদা সনাতনের কথাটা তুললাম এইজন্য যে, ভক্তই ভগবানকে তাঁর মতো করে রূপ দেন, তাঁর ইচ্ছেতেই তাঁর অন্নপানের ব্যবস্থা নগণ্য থেকে রাজকীয় হয়ে ওঠে। আমার বিশ্বাস, রূপ গোস্বামীর গোবিন্দজির সেবা-পূজাও সনাতনের মতোই দারিদ্র্যে ভরা ছিল, এবং তিনি বেঁচে থাকতে গোবিন্দজির শ্রীবৃদ্ধি হয়নি তেমন। রঘুনাথ ভট্টের এক শিষ্যের কল্যাণে গোবিন্দজির গলায় হার ওঠে, একটা সোনার বাঁশি জোটে ‘কুঞ্চিতাধরপুটে’, কানে ওঠে মকরকুণ্ডল। তারপর সেই ‘ধন্য রাজা মানসিংহ/ বিষ্ণুপদাম্ভোজ-ভৃঙ্গ’—শ্রীরূপের দরিদ্র গোবিন্দজি অম্বরাধিপতি মানসিংহের নজরে পড়লেন। শ্রীরূপের সঙ্গে থাকা গোবিন্দজির সহস্থায়ী জীবন দরিদ্র হলে কী হবে, শ্রীরূপের সেবায় উজ্জ্বল গোবিন্দজির কৃপা হল মানসিংহের ওপর। ১৫৯০ সালে মানসিংহ বৃন্দাবনেই সেই গোমা টিলার উপর—যেখানে শ্রীরূপ মাটির তলা থেকে উদ্ধার করে তাঁর ভাব-বিগ্রহকে প্রকট করে তুলেছিলেন—সেই গোমা টিলার উপরেই লাল পাথর দিয়ে এমন অপূর্ব কারুকার্যখচিত একখানি মন্দির নির্মাণ করলেন মানসিংহ যে, ১৮৭৩ সালে সেই মন্দিরের নষ্ট-গরিমা দেখেও মথুরার তদানীন্তন কালেক্টর F. A. Growse মন্তব্য করেন—The temple of Govinda Dev is not only the finest of this particular series, but is the most impressive religious edifics that Hindu art has ever produced, at least in upper India.

‘দুঃখের বিষয়, মানসিংহের এই সুচারু নির্মাণকার্যের ওপর স্থূলহস্তাবলেপ চিহ্নিত হয়ে পড়ে সপ্তদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ শেষ হওয়ার আগেই। এই মন্দিরের প্রধান চূড়াটি এত উঁচু ছিল যে, সেই চূড়ার ঊর্ধ্বে অবস্থিত আলোকমঞ্চ থেকে বিচ্ছুরিত আলো আগ্রায় বসেও একদিন দেখতে পেলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। ওমনি আদেশ নেমে এল সম্রাটের। ফৌজদাররা আগ্রা থেকে এল। তারা গোবিন্দজির মূল মন্দির এবং তার সংলগ্ন সৌধের পাঁচটি চূড়া ভেঙে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু মন্দির ভাঙা পড়লেও গোবিন্দজির বিগ্রহ, তাঁর সঙ্গে রাধারানি এবং ললিতা-বিশাখার সখী-মূর্তি রক্ষা পেল জয়পুরের রাজা জয়সিংহের চেষ্টায়। আগ্রা থেকে ফৌজিরা বৃন্দাবনে রওনা হওয়ার সময়েই জয়সিংহ সম্রাট আওরঙ্গজেবের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে যান। মন্দির নিয়ে এতটুকুও চিন্তা না করে তিনি শ্রীরূপের ভাবাশ্রিত বিগ্রহ রাধা-গোবিন্দের যুগল মূর্তি সহ অন্যান্য দেবমূর্তি তিনি প্রধান সেবায়েতদের দিয়ে অন্যত্র কোনো গুপ্তস্থানে সরিয়েছেন।’

এই সময়টায় কিছুদিন যাযাবর-বৃত্তি চলে গোবিন্দজির। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে তিনি স্থানান্তরিত হন বৃন্দাবনেই দ্বাদশ বনের একটিতে কাম্যবনে। সেখান থেকে ১৭০৭ সালে গোবিন্দপুরা বা রোখাড়ায়। ১৭১৪ সালে রাজস্থানের অম্বরে (আমের-এ)। অবশেষে ১৭১৬ সালে একেবারে জয়পুরে। সময়টা বড়ো কম নয়। ১৫৯০ থেকে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ—এই পুরো সময়টা জুড়ে রূপ গোস্বামীর মতো এক প্রেমী ভক্তের পর্ণকুটির ছেড়ে আসার ফল পেয়েছেন তিনি। অবশ্য রূপ গোস্বামী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তাঁর ঘর ছেড়ে আসার সাহস হয়নি গোবিন্দজির। এমনকী রূপের মাধুকরী-ভোগ খেতে-খেতে অরুচি ধরে গেলেও গোবিন্দজির ক্ষোভের কোনো আঁচ পাওয়া যায়নি কখনো এবং তাঁর এই ভক্তের তিরোধানের পরেও এমন কোনো আভাস তিনি দেননি যে, তিনি ভিক্ষান্ন ছেড়ে রাজভোগ খেতে চান।

বস্তুত রূপ গোস্বামী অপ্রকট হওয়ার পর বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীর অন্যতম রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামীই গোবিন্দজির সেবা-পূজা চালাতেন। কেননা রঘুনাথ ভট্ট চৈতন্যের আদেশে রূপের ঘরেই থাকতেন এবং গোঁসাইকে ভাগবত পাঠ করে শোনাতেন প্রতিদিন। শ্রীরূপের ঘরে থাকতে থাকতেই তাঁর প্রিয় ভাব-বিগ্রহ গোবিন্দজির সেবাসুখও অনুভব করতে থাকেন তিনি। সম্ভবত ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরূপের দেহান্তরের পর রঘুনাথ ভট্টই গোবিন্দজির প্রেমসেবা চালাতে থাকেন। কিন্তু রঘুনাথ ভট্টেরও যখন বার্ধক্য ঘনিয়ে এল, তখন কিন্তু গোবিন্দজিকে নিয়েই তাঁর দুশ্চিন্তা দাঁড়াল সবচেয়ে বেশি। আমরা এটা জানি, বিগ্রহ নিয়ে এই দুশ্চিন্তা হয়। যাদের বাড়িতেই বিগ্রহ আছেন, এতদিন যাঁর সাড়ম্বরে পূজার্চনা, ভোগরাগ, শিঙার হয়ে এসেছে, সেই বিগ্রহ নিয়ে প্রেমী ভক্ত, মরমী সাধকের অনেক দুশ্চিন্তা হয়। সেখানেই এই মনস্তত্ত্ব তৈরি হয় যে, ব্যক্তিগত স্তরের সেবা থেকে সেই ভাব-বিগ্রহকে যদি সাধারণের চোখের সামনে তুলে দেওয়া হয়।

গোবিন্দজির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শ্রীরূপের পর রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামীও যখন বার্ধক্যের প্রৌঢ়াবস্থায় পৌঁছোলেন, তখনই তিনি গোবিন্দজির সেবা চলমান রাখার জন্য এক ভক্ত শিষ্যকে দিয়ে মন্দির বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন—চৈতন্যচরিতামৃতে দেখছি—

গোবিন্দচরণে কৈলা আত্মসমর্পণ।

গোবিন্দ-চরণারবিন্দ যাঁর প্রাণধন।।

নিজ শিষ্যে কহি গোবিন্দের মন্দির করাইলা।

বংশী মকর-কুণ্ডলাদি ‘ভূষণ’ করি দিলা।।

রঘুনাথ ভট্ট এই যে শিষ্যের মাধ্যমে শ্রীরূপসেবিত গোবিন্দজির একটা মন্দির তৈরি করালেন, সেটা অবশ্যই ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দের আগে, কেননা ওই সালে রঘুনাথ অপ্রকট হন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে ভট্ট রঘুনাথের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে সেবাপুষ্ট হতে হতে ১৫৯০ সালে গোবিন্দজি লাল পাথরের মন্দিরে—শ্রীরূপ-রঘুনাথের ভিক্ষান্নজীবী গোবিন্দজি রাজকীয় ভোগে অভ্যস্ত হলেন মানসিংহের কল্যাণে।

আমি শুধু বলতে চাইছি—ভগবান ব্যাস দ্বৈপায়ন সেই যে মিষ্টি ভুলটা করেছিলেন, রূপবিবর্জিত অক্ষর পুরুষকে মানুষের রূপ দিয়ে তাঁর প্রতিরূপ তৈরি করেছিলেন ভগবদ-বিগ্রহের মধ্যে, সেই প্রতিরূপে পাষাণ, মৃন্ময় এবং দারুব্রহ্ম হয়েও তাঁর নিস্তার নেই। তাঁর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাঁর ভক্তরা এত ব্যাকুল বলেই তাঁর বিগ্রহ জীবনও মানুষের মতোই সংকুল হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ভগবানের বিগ্রহবপু কখনো কখনো মানুষের মতোই ‘স্ক্র্যাচ’ থেকে আরম্ভ করে নানান বাধা-বিপত্তি সইতে সইতে একেবারে রাজপুরুষ হয়ে ওঠেন। শ্রীরূপের ভিক্ষান্নভোজী গোবিন্দজিরও তাই হয়েছে। পর্ণকুটিরের তৃণ-শয়ন ছেড়ে মানসিংহের লালপাথরের বাড়িতে গিয়েও গোবিন্দজি স্থায়ী আবাস পেলেন না, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা রিফিউজিরা যেরকম পরের কৃপায় একবার রানাঘাট, একবার গ্রে স্ট্রিট, একবার প্রতাপাদিত্য রোড ঘুরে শেষে ঢাকুরিয়ায় এসে স্থায়ী আবাস পায়, শ্রীরূপের গোবিন্দজিও সেইরকম। একবার লালপাথরের বাড়ি ছেড়ে কাম্যবনে, তারপর গোবিন্দপুরা-রোষাপাড়ায়, তারপর অম্বরে, অবশেষে একেবারে নবনির্মিত জয়পুরে দ্বিতীয় সোয়াই জয়সিংহের রাজবাড়িতে।

জয়পুরের রাজবাড়িতে রাজকীয় সংস্পর্শে গোবিন্দজির মেজাজটাও খানিক রাজবৎ হয়ে উঠল। সওয়াই জয়সিংহ শ্রীরূপের গোবিন্দজিকে জয়পুরে এনে খানিকটা বৃন্দাবনের ‘অ্যামবিয়েন্স’ দিতে চেয়েছিলেন। জয়পুরে গোবিন্দজির প্রতিষ্ঠা করে তিনি সামান্য ঐশ্বর্যমিশ্রা ভক্তিতে জায়গাটার নাম দিলেন ‘কনক-বৃন্দাবন’। কিন্তু বৃন্দাবনের রাখাল রাধিকার প্রেমমূর্তি যদি একবার মথুরা-দ্বারকায় আসেন, তবে তাঁরও তো ভাব পালটে যায়। দ্বিতীয় সওয়াই থাকতেন জয়-নিবাসের সুরজ মহলে, যার একদিকে বাদলমহল, অন্যদিকে চন্দ্রমহল। রাজা হঠাৎ স্বপ্নাদেশ পান যে, সুরজ মহল জায়গাটা স্বয়ং কৃষ্ণের অধিকারে আছে, জয়সিংহ কেন সে জায়গা দখল করে আছেন? রাজা পরের দিনই চন্দ্রমহলে চলে যান এবং সুরজ মহলে মন্দির তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন গোবিন্দজির মন্দির। এখনও জয়সিংহের চন্দ্রমহলের রাজবাড়ির উপরিতলে একটি প্রসারিত নির্মাণ রয়ে গেছে, যেখানে সওয়াই জয়সিংহ ঘুম থেকে উঠেই আগে দাঁড়িয়ে গোবিন্দজির মুখ-দর্শন করতেন মঙ্গল-আরতির সময়। লক্ষণীয়, সওয়াই জয়সিংহ যখন গোবিন্দজির দর্শন করতেন, তখন কিন্তু তাঁর বৃন্দাবনের বেশ, বেশ-ভূষা কম, কেমন ভাব যেন—এমন আভরণহীন/বদন মলিন/ আমারে হেরিয়া কবে কী—কিন্তু বেলা বাড়তে থাকলেই এই তাঁর ধূপগন্ধী বেশ, এই শিঙার, রাজভোগ—আরও কত কী! বাম পাশে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনের রাধারানি তখন মথুরা-দ্বারকার কৃষ্ণের কথা ভেবে কানা কেষ্টর গলায় গান ধরেন নিশ্চয়—কালে কালে আর কত কী দেখিব/ ভেক হল পশুরাজ।

আমরা শেষে ব্যাস মহামতির বালাই লয়ে মরে যাই। তাঁরই একটা সামান্য ভুলের জন্য আজ আমরা পরম ঈশ্বরের প্রতিরূপের সঙ্গে দিন-রজনী যাপন করতে পারি, তাঁকে সাজসজ্জায় শিঙার করতে পারি, এমনকি তাঁকে খাওয়াতেও পারি ছাপ্পান্ন ভোগ আর ছত্রিশ ব্যঞ্জন দিয়ে—জয়তি পরাশর-সূনুঃ সত্যবতী-হৃদয়-নন্দনো ব্যাসঃ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *