সূর্যমুখী – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সূর্যমুখী

এ মেয়ে সেই মেয়ে। নবীন খুবই চেনে। পাড়াগাঁয়ের পথে দুপুরবেলার ভিড়ে অনেক সোনামুখ রাঙামুখ ঢলঢলে মুখের এক মুখ। কত নামে নবীন তাদের ডাকে। মুখের নামে ডাকে। আর এই মেয়েই তো বলে, ‘কাপুড়ে’র মনে যেন নামের লিস্টি নেকা আছে গো!

হুঁ, এই সেই মেয়ে। কিন্তু কোন গাঁয়ের পথে চেনাচিনি ঠিক মনে পড়ে না। কবে কিছু কিনেছিল কিনা—রাঙা ব্লাউজ কিংবা সাদা লেসের নকশা-কাটা সুনীল সায়া, অথবা বোনের জন্যে রঙ ঝিলমিল ফ্রক, ভায়ের জন্যে ডোরাকাটা পেণ্টুল—বলতে পারে না নবীন। কতজনে তো কেনেই না। শুধু হাত বুলিয়ে রঙ ছোঁয়, নরমতার স্বাদ নেয় টিকাল আঙুলে আর কত হাতে শাঁখা-নোয়া কত হাতে বেলোয়ারি চুড়ি, কত হাত শূন্য ধূসর ও বিষাদময়।

এ মেয়ে কি কিছু কিনেছিল কোনোওদিন? দু-চারবার খুঁজে ছেড়ে দেয় নবীন। হাতের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নেয়। সধবার হাত। মুখের দিকে একবার আলগোছে ঘুরে তাকিয়ে নেয়। বিকেলের নিস্তেজ রোদ্দুর উরুলিঝুরুলি রুক্ষ চুলের ওপর আচমকা হু হু ফেটে পড়ে এবং জ্বলে যায়। ঘোর লাল আর মারমূর্তি সিঁদুরটা তেড়ে আসে নবীনকে। সে চোখ নামায় পথের মাটিতে। কী নামে ডেকেছিল এই মেয়েকে? সোনামুখী না—রাঙামুখী, ঢলঢলমুখী? নামের লিস্টিতে কত নাম নেকা আছে নবীনের। ডেকেছিল শশীমুখী, বিধুমুখী, হাসিমুখী—নাকি মধুমুখী? নিশ্চয় একটা কিছু বলে ডেকেছিল। মনে নেই, মনে পড়ে না। ছটফট করে মনে মনে। এলোমেলো পা পড়ে তার। ধুলোয় ধূসর স্যান্ডেল দুটো সরু চিকন খটখটে আলপথে চাপা আওয়াজ তোলে। তারপর আর মন মানে না নবীনের। এই অগাধ নির্জনতা, সুবিশাল মাঠ, এই শান্ত বিকেল—তার মন ছটফট করে।

কী হল ‘কাপুড়ে’? দাঁড়ালে ক্যানে গো? …পিছন থেকে পাখির স্বরে কথা বলে ওঠে মেয়েটি।

একটা কথা। …বলে নবীন কাপুড়ে ঘোরে। খিকখিক করে একটু হাসে। বনকাপাসি—নাকি ঝাঁপুইহাটিতে দেখেছিলাম?

মেয়েটি হাসে। ভুরু কুঁচকে বলে, উঁহু—হলই না।

চণ্ডীতলা?

মরণ আমার! সব থাকত ওই গাঁয়ে? কথায় বলে, ‘এ গাঁয়ে ভাতার নাই তো নগাঁসিঙাড়!’*

কী ঠোঁটকাটা মেয়ে রে বাবা! এই অবেলায় ধুধু মাঠ—জন নেই মানুষ নেই গাছ নেই পালা নেই, গায়ে পায়ে ঢলঢল যৌবন এবং পরপুরুষ। নবীন বিবেচনা করে। সে বিব্রতমুখে বলে, শানকিভাঙা?

বুড়ো আঙুল নাচিয়ে মেয়েটি খিলখিল করে হাসে। …হল না, হলই না।

আমপাড়া?

চোখ পাখিয়ে সে জবাব দেয়, হুঁ—আর কাজ ছিল না। শ্যাখের গাঁয়ে জন্মো নিয়েছিলাম।

তাও বটে। …বলে নবীন পা বাড়ায়। আমপাড়ায় তো সবাই মুসলমান। পিঠের বোঁচকাটায় একটু ঝাঁকুনি দিয়ে সে কুঁজো হয়ে হাঁটে।

পিছন থেকে মেয়েটি বলে, তাহলে পারলে না তো?

নাঃ, পারলাম না।

হট মানছ?

মানছি।

নবীন কাপুড়ে একটু বিরক্ত হয়েছে। হয়ত নিজের ওপর, হয়ত মেয়েটির ওপর। কিন্তু এদিকে কী এক জ্বালায় পড়া গেছে। পিছনে কী টান, কী টান! এ মাঠ যেন মাঠ নয়—নদী। উজানে যেতে বড় কষ্ট হয়। বগলের ফাঁক দিয়ে বাঁধা বোঁচকাটা পিঠের ওপর চেপেয় বসছে আস্তে আস্তে। একটা চাপ কষ্ট শরীরে আর মনে গরগর করছে। নবীনের ঘাম হচ্ছে। কোথায় দেখেছিল—অনেক বার দেখা, দরাদরি, ব্লাউজ কিংবা সায়া কিংবা ফ্রক কিংবা পেণ্টুল, খুব চেনা মুখ—অথচ মনেই পড়ল না। যেন মনে পড়লে কিছু একটা ঘটে যায়।

কাপুড়ে!

হুঁ, বল।

কী বলে ডেকেছিলে মনে নাই?

না তো। খুঁজছি।

তাও ভুলে বসেছ! কী মানুষ রে বাবা! …পিছনে মেয়েটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে, তা নবীন অবিকল দেখতে পায়।

নবীন বিরক্ত হয়েই বলে, কত গাঁয়ে ঘুরি, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। অত কী মনে থাকে?

তবে যে খুব চেনা, বললে?

হ্যাঁ, বললাম। আমাদের এমন হয়। চেহারা দেখে চেনা লাগে—ওটুকুনই।

মেয়েটি যেন নিরাশ হল। হাসল একটু। কিন্তু কেমন দুঃখিত হাসি। …কপাল আমার! নিত্যিকার চেনা মানুষ দেখে দৌড়ে এসে সঙ্গ নিলাম, তো এ কী বুলি মানুষের! জানো কাপুড়ে, আজ আমার আসাই হত না—তোমাকে না দেখতে পেলে? পিসি একা একা ছাড়ত ভেবেছ? যা তা লয় বাবা, ধুল্লোউড়ির মাঠ—বুক ফেটে চ্যাঁচালেও কেউ আসবে না।

মুখ তুলে মাঠটা একবার দেখে নবীন। সামনে পুবে দূরে—অনেক দূরে ধূসর গ্রাম পিছনের পড়ন্ত সূর্যের লালচে রোদ্দুর মুছে ফেলছে গা থেকে। শূন্য খেতে বন-চড়ুই শালিখ পায়রার ঝাঁক শস্যদানা থেকে ঠোঁট তুলে অন্যমনস্ক তাকাচ্ছে। দূরে আল কেটে কেটে তৈরি মরশুমি গাড়িচলা পথে ছইঢাকা একটা গরুর গাড়ি চাকায় চাকায় ধুলো উড়িয়ে চলেছে। আরও দূরে ঘরে-ফেরা গরুবাছুরের ক্ষুরের চাপে উড়ন্ত পুঞ্জ পুঞ্জ ধুলোয় ধোঁওয়া ভাসছে। এই মাঠে চৈত্র থেকেই ধুলো ওড়ে দিনরাত। যেতে যেতে নখের আঁচড়ে মুঠো মুঠো ধুলো ওড়ায় হাওয়া। ধুলোয় ধুলোয় ঘূর্ণি বয়ে যায় অগ্নিকোণ থেকে বায়ুকোণে—মাথায় তাদের খড়কুটো পাখির পালক শুকনো পাতা আর সাপের খোলাস দিয়ে গড়া অদ্ভুত ‘মটুক’। এ মাঠ তাই ‘ধুল্লোউড়ির মাঠ’ দুপুরে এ মাঠে সোনালি ঝড়ের ছবি আঁকা থাকে। থরথর করে সেই ছবিখানা কাঁপে। আর উদাস নিঝুম পাড়াগেঁয়ে দুপুরে কাঁথা সেলাই করতে মেয়েরা গুনগুন করে গায় :

‘ধুল্লোউড়ির মাঠে রে ভাই

 রোদ ঝনঝন করে।

পানের সখার সঙ্গে দেখা

 বেলা দুপহরে।।’…

…’আর যাব না আর যাব না

 ধুল্লোউড়ির মাঠে।

একলা পেয়ে গায়েগতরে

 ডংশালে কালসাপে।।’…

…’ও ছুঁড়ি তোর পিঠে কী

 মর্ চোখখাকী তোর তা কী,

ধুল্লোউড়ির মাঠে

বসতে ধুলো শুতে ধুলো

আমি করব কী।।’…

তবে কিনা নবীন কাপুড়ে ফেরিওলা মানুষ। সূর্যকে পিছনে নিজের ছায়া সামনে রেখে সে ধুল্লোউড়ির মাঠ পেরিয়ে গাঁওয়ালে যায়, আবার সূর্যকে পিছনে নিজের ছায়া সামনে নিয়ে সে ধুল্লোউড়ির মাঠ পেরিয়ে ঘরে ফেরে। সূর্যটি তখন যেমন মাটি ছুঁইছুঁই, ফেরার সময়ও তেমনি মাটি ছুঁইছুঁই—রঙ ঘোর লাল, ডিমের কুসুম। তখন যেমন নবীনের ছায়াটি লম্বা, এখনও তেমনি লম্বা। ধুল্লোউড়ির মাঠের সোনলি ধুলোমাটির ওপর সে দু’বেলায় শুধু বেড়ে যায় আর বেড়ে যায়। নবীন পিঠের বোঝাটির চাপে একটু ঝুঁকে শুধু ছায়াটিকেই দেখতে দেখতে হাঁটে। নিজের চেয়ে ছায়াটি বেড়ে যায়, কেবলই বড় হতে থাকে—এ এক আশ্চর্য বটে।

আজ অন্য রকম। তার ছায়ায় ওপর আরেক ছায়া। ধুল্লোউড়ির মাঠের ওপর আজ আরেক ধুল্লোউড়ির মাঠে এসে পড়েছে। বিকেলের ওপর দুপুরের উৎপাত—সেই সোনালি ঝড়ের ছবি। আর ধুল্লোউড়ির মাঠটি এখন কাঁসর ঘণ্টা। একটু ছুঁলেই ঢঙঢঙ করে বেজে উঠবে ভয় আছে। নবীন সাবধানে হাঁটে। কী কথা বলে বসলে মুখরা মেয়েটি, গা বাজে নবীন কাপুড়ের। যা তা নয় বাবা, ধুল্লোউড়ির মাঠ—বুক ফেটে চ্যাঁচালেও কেউ আসবে না।

কী একটা হয় নবীনের। গুরুগুর করে কোথাও কী চাপা আওয়াজ ফোটে নাকি? যেমন কিনা সারা আকাশ খালি, অথচ দিগন্তের কোথায় চুপিচুপি ঝিলিকি, থমথমে ভাব, সামান্য আবছা ওদিকটা, কোথাও কোনও দূরের দেশে নাকি ঝড় চলেছে—ঠিক রকম লাগে।

তখনই শনশন করে একটা হাওয়া এল গায়ে। চুলগুলো দুলতে লাগল। কিছু ধুলো উড়ে গেল সামনে দিয়ে। …কাপুড়ে, তাহলে বুঝলে তো? …হাঁটুর ওপরটা ঢাকতে ঢাকতে মেয়েটি বলল।

হুঁ।

চেনা মুখের সাহসে সাহস। তাইতে আসতে দিলে পিসি। কিন্তু ওম্মা! …আবার খিলখিল করে সে হাসে।…এসে দেখি, কাপুড়ে বলছে কি না—আমাদের অমন হয়। কী হয়, কেমন হয় শুনি? হ্যাঁ গো কাপুড়ে, তা হলেও বাপু কথা আছে। কাকেও-কাকেও তো মনে পড়বে? সব্বাই তো এক ছাঁচে গড়া লয়। না কী?

নবীন ঘোঁত ঘোঁত করে বলে, পড়ছে বই কি মনে।

ছাই পড়ছে। আমাকে তুমি কী বলে ডেকেছিলে, শুনবে? সুজ্জমুখী।

নবীন দাঁড়ায়। পিছনে ঘুরে বলে, সূর্যমুখী?

হুঁ, সুজ্জমুখী।

অন্যমনস্ক নবীন বলে, ক্যানে?

মরণ। তা তুমিই জানো ক্যানে বলেছিলে।

নবীন আবার হাঁটতে থাকে। ঊরু দুটো ভারি লাগে তার। বুকের ভিতর হাতুড়ি পড়তে থাকে। কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারে না। একটু পরে সে বলে, তুমি আগে যাও না বাপু। পিঠে ভার নিয়ে ঘুরতে অসুবিধে হচ্ছে। আগে আগে চল, সোজামুখে কথা বলতে বলতে যাই।

উঁহু। …মাথা দোলায় সে। …বেশ তো যাচ্ছি।

নবীন আবার দাঁড়ায়। শুকনো হেসে বলে, কাজের কথা নয়। এস, এগোও। কথায় বলে, পিছের মানুষকেই পোকায় (সাপে) কাটে।

আর আগে গেলে যে বাঘে খায় তার বেলা? …সে চাপা হাসে। নবীন একটু সাধে। …আহা শোনই না কথাটা। পিছনে একটা কিছু হলে জানতেই পারব না।

ভুরু কুঁচকে তাকায় মেয়েটি। নাকের ফুটো মৃদু কাঁপে। নাকছাবিটা ধুধু জ্বলে। …কী হবে, শুনি?

কথার কথা। আগে আগে যেতে হয় মেয়েছেলেদের।

রূপ দেখতে দেখতে যাবে নাকি? ও কাপুড়ে! …বাঁকা ঠোঁটে হাসে সে।

মলোচ্ছাই! …ফের বিরক্ত হয়ে নবীন পা বাড়ায়। …সূর্যমুখীর মুখ কি পিঠের দিকে নাকি? বলে সে একটু জোরেই হাঁটে।

ধুপ ধুপ শব্দ ওঠে পিছনে। …একটু আস্তে চল বাপু। অত রাগ ক্যানে তোমার? কাপড় গছাবার সময় তো দেখি না—তখন মুখে মধু ঝরে যেন।

নবীন রা কাড়ে না। সেই চাপা গুরুগুরু আওয়াজটা মন দিয়ে শোনে। একবার করে মুখ তুলে আদিগন্ত বিশাল ব্যাপকতা মেপে নেয়। নির্জন ধুধু ধুল্লোউড়ির মাঠ। মাথার ওপর বালিহাঁসের ঝাঁক চলে যায় শনশন শব্দে। ফিনফিনে রেশমি রোদ্দুরটাও কিছুক্ষণ কেঁপে ওঠে কুচিকুচি ছায়ার আঁচড়ে।

হ্যাঁ কাপুড়ে, সেদিন সেই জামাটা দেখলাম—সামান্য দু আনার জন্যে দিলে না, মনে পড়ছে না? বেচে দিয়েছ, না আছে গো? হুঁ, কাপুড়ের রাগ হয়েছে।

পিঠের ওপর কণ্ঠস্বর, যেন দু’কানে এসে শ্বাসপ্রশ্বাসের ঝাপটানি লাগে—নবীন চমকায়। তবু কথা বলে না। কী জানি, অমর্ত ফুলের ঘ্রাণে আত্মা কোটরে সাপের মতন নড়ে ওঠে।

চপলতা করে সে পিছনে। …একবার তোমার বুলিটা শোনাও না বাপু। ফক-সায়া-বেলাউস! ফক-সায়া-বেলাউস।

পিছনে অদৃশ্য ফুলের বনে ঝড় বইছে। ফুলের বনে এখন সোনালি ঝড়ের ছবি—ধুল্লোউড়ির মাঠে একটা দুপুর থরথর করে কাঁপছে নবীন দরদর করে ঘামে। কোনও কথা বলে না।

আর কী বলো যেন? …’নিলাম নিলাম। কী নিলাম?’ ‘পছন্দ!’ ‘নিলাম নিলাম। কী নিলাম!’ ‘পয়সা!’ পাখির বুলি শিখেছ বাপু! আহা, বলই না একবার, ও কাপুড়ে! ‘নিলাম পয়সা, দিলাম কী?’ তারপর কী বল যেন? ছাই, মনে পড়ছে না। নিলাম পয়সা, কী দিলাম… ও কাপুড়ে, কী দাও বল না?

নবীন হঠাৎ মুখটা ঘোরায়, চোখ দুটো কাঁপে—বলে, নিলাম পয়সা দিলাম রূপ-যৌবন।

পলকে লজ্জায় রাঙা ‘সূর্যমুখী’ মুখ নামায়। …যাঃ!

হাঁ, তাই তো দিই।

তুমি বড্ড কী যেন। যাও!

নবীন বলে, সেই জামাটা দেখবে না?

এখন পয়সা নেই সঙ্গে। …মুখ নামিয়ে সে পা বাড়ায়। কণ্ঠস্বরও কাঁপছিল।

পয়সা পরের কথা। …নবীনের কণ্ঠস্বরও কাঁপে। অমন জিনিস কখন কোথায় কার হাতে চলে যাবে, ঠিক নেই। কোনও প্যাঁচামুখীর ময়লা গতরে। ছ্যা, ছ্যা! কেন মনে খেদ থেকে যাব—সূর্যমুখী বলে ডেকেছি। এস দ্যাখ।

নবীন বোঁচকাটা আলের ওপর ঝকঝকে কঠিন মাটিতে ধুপ করে ফেলে দেয়। পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। ছোট্ট আকন্দ ঝাড়ের কাছে মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেছে। আলতারাঙা পায়ের আঙুলে শুকনো ঘাস টানে সে। ঘাস দেখে। চিবুক বুকে বিঁধে থাকে। খোঁপা সামান্য টলে পড়ে চৈত্রের হাওয়ায়। রুক্ষু উরুলিঝুরুলি কিছু চুল ওড়ে কানের পাশে, কপালের ওপর। নাকের ডগায় ঘামের ফোঁটা টলটল করে। নাকছাবিটা হু হু জ্বলে যেতে থাকে। দুটো বাহু এসে তলপেটের নিচে মিলে থাকে, আঙুলে আঙুলে জড়ানো। কী বাহু, নাকি দুটো লাজুকতাময় নরম প্রতিরোধ। কী বুক, ওঠে পড়ে, শ্বাসপ্রশ্বাসে পুষ্পের ঘ্রাণ, অসামান্য সুখবৃক্ষের দুটি স্বাদু ফল। আর নবীনের মনে হয়, ওখানে কোথাও জল দাঁড়ায় না, রেশমি ব্লাউজ পিছলে খসে পড়ে যায়। আর রক্তে কাতর হতে থাকে নবীন কাপুড়ে, মাংসে ছটফট করে তার ফেরিওলার আত্মাটা। সে বলে, হাঁ, দেখ—দেখতে দোষ নেই। সব—সব দেখ, যা পছন্দ হয়। এইটে, এইটে… কিংবা এইটে…। একটার পর একটা রঙিন ব্লাউজ বের করে তুলে ধরে সে। দাঁতে হাসি চকচক করে তার। …কী হল? সূর্যমুখী বলে ডেকেছিলাম, তুমিই বললে। তাই ডাকছি, সূর্যমুখী, রাগ করলে নাকি? আর লজ্জাই বা কিসের? ধুল্লোউড়ির মাঠের এ বাজারে আর তো কেউ নাই। শুধু দুজনা—তাই না সূর্যমুখী? তুমি একলা খদ্দের, আমি একলা দোকানদার। কী বলো…ঘোঁত ঘোঁত করে হাসে নবীন।

আড়চোখে তাকিয়ে আছে সূর্যমুখী, নবীন টের পায়। নবীন ‘কাপুড়ে-মানুষ’ বলেই মেয়েমানুষের কত কিছু টের পায়। একটা করে ভাঁজ খোলে, পড়ন্ত বেলায় রোদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, লাল রঙের আগুন জ্বলে, নীল রঙের আগুন জ্বলে। সূর্যমুখীর শরম সঙ্কোচ ভীরুতা জড়তার ওপর অতি প্রযত্নে আঁচ বোলাতে থাকে নবীন। বুক ঢিপঢিপ করে তার। টেরচা চোখে তাকিয়ে ধুল্লোউড়ির নির্জনতা বার বার দেখতে ভোলে না। তার এমন হয়, এক দেহ ঊর্ধ্বমুখে কিছু প্রার্থনা করে চলে—আরেক দেহ পায়ের তলে বসে অস্থির আর মিটিমিটি চোখে প্রার্থনা দেখে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতন প্রতীক্ষায়।

সূর্যমুখী এবার ঠোঁট কামড়ায় একবার। তারপর অস্ফুটে বলে, সেইটে কই?

নবীনের নাভিমূল থেকে প্রচণ্ড চিৎকারটা ঠোঁটে এসে মৃদু হয়, স্খলিত পাতার মতন সামান্য খসখস করে মাত্র। …কোনটা, কোনটা গো সূর্যমুখী?

দু পা এগিয়ে সূর্যমুখী অল্প হেসে বলে, সেইটে—সেদিন এটা দেখেছিলাম।

নবীন দু’হাতে জামাগুলো ওলটপালট করতে করতে বলে, কী রঙ? হাতকাটা, না গোটা হাতা? সাইজ কত?

হাঁটু দুমড়ে নিঃসঙ্কোচে বোঁচকার ওপারে বসে পড়ে সূর্যমুখী। …হাতকাটা গো, হাতকাটা। ওই তো পরছে সবাই আজকাল। বেশ দগদগে জবাফুলের রঙ। …আলতো আঙুলে একটা করে ওলটপালট করে সেও, ঠোঁট বাঁকা, তাচ্ছিল্যের ভ্রূভঙ্গী।

নবীন ছটফট করে একটা মোড়ক প্রায় ছিঁড়ে ফেলে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, এই হচ্ছে গে সবচেয়ে সরেস মাল। বাবুবাড়ির মেয়েদের জন্যে রাখা। দেখছ কী জিনিস! কী চেকন মিহি সুতো। জেল্লাখানা দেখ। ম্লান রোদে একটা ব্লাউজ তুলে ধরে সে। প্রজাপতি যেন ছটফট করে হাতে-ধরা। প্রচণ্ড আশায় ফুলে ওঠে নবীন।

সূর্যমুখীও তাকিয়ে থাকে। একবার ছোঁয়। তারপর ফের বোঁচকার বিশৃঙ্খল রঙের বাগানে ঢুকে পড়ে। ছোট্ট কপালে লালচে রোদ সুখে খেলা করতে থাকে। কাচপোকার কালো টিপ ঝলমল করে।

নবীন আপসোসে বলে, এতেও মন ভরল না? সুর্যমুখী, তোমার চোখ নেই, তুমি কানা। …এবং নবীনের মনে রাগ ফুঁসে ওঠে। ছোটলোকের মেয়ে! তুই কী বুঝবি এর মর্ম মাগী। তোকে ফুল শোঁকানোও যা, গু-গোবর শোঁকালেও তাই। তোর কাছে সব সমান।

সূর্যমুখী সব ওলটপালট করে দিচ্ছে। কখনও কোনও একটা ব্লাউজ তুলে বুকের ওপর ধরে রাখছে। ফেলে দিচ্ছে অবহেলায়। তার চোখে তীব্র অনুসন্ধান টলমল করছে, দেখতে পায় নবীন। ফের একটা তুলে বুকের ওপর মেলে নবীন তার দু’কাঁধের ওপর আঙুল চেপে বলে ওঠে, আহা! টানটান করে ধর। তবেই তো সাইজ বোঝা যাবে।

ইচ্ছে করেই ব্লাউজটা ফেলে দেয় সূর্যমুখী। ঝাঁজে বলে, খুব হয়েছে! …তারপর দেখে নবীন তার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। তক্ষুনি চকিতে বুকের কাপড় ঠিকঠাক করে সে তেড়ে ওঠে, এই কাপুড়ে! কী দেখা হচ্ছে, শুনি?

সাইজ। তোমার চৌত্রিশ লাগবে। …নবীন অপ্রস্তুত হাসে।

কিন্তু সেই জামাটা কই? সেদিন যেটা দেখেছিলাম?

এতগুলোর কোনওটাতেও মান উঠল না?

নাঃ।

আবার বল তো, কী রঙ? হাতকাটা?

হাতকাটা। জবাফুলের মতন দগদগে রঙ।

এইটে?

নাঃ।

এইটে।

না, না।

নিশ্চয় এইটে।

না, না, না।

নবীন কাপুড়ের হাতে রক্তলাল হাতকাটা চৌত্রিশ ব্লাউজ এক প্রচণ্ড সোনলি ঝড়ের দাপটে থরথর করে কাঁপে। দু’চোখে করুণ কামনা টলটল করে। রক্ত-মাংসে ছটফট করে সে। একটু ঝুঁকে আসে। ফিসফিস করে বলে, নাও। দাম নেবে না নবীন। তুমি নাও। এটাই নাও।

মুখ নামিয়ে নাকছাবি খোঁটে সূর্যমুখী। মাথাটা সামান্য দোলায়। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ক্যানে? এমনি এমনি দেবে ক্যানে?

ক্যানে? ….নবীন জবাব খুঁজে পায় না। তার মুঠো শক্ত হয়ে যায়। জামাগুলো ঘামে ভেজে। এই বিরাট পৃথিবীতে নবীন কাপুড়ের জীবনটা কী ব্যর্থ, আজও তার নারীসঙ্গ হয়নি, সে স্বভাবত ভীতু, দুর্বলচেতা, নির্বান্ধব আর কৃপণ মানুষ। গ্রামের একপ্রান্তে একা থাকে সে। কেউ তাকে ভালবাসে না। সবাই জানে, ভীষণ বদমেজাজি আর হাড়ে হাড়ে কৃপণতা আছে নবীনের। সামান্য পুঁজি নিয়ে গাঁওয়ালে কাপড় বেচে বেড়ানো পেশা যার, তাকে কোনও বাপ মেয়ে দিতে চায়নি। সব বাপই বলেছে, ওর পাল্লায় পড়লে মেয়ে আমার না খেয়ে মরবে। প্রাণে ধরে দু’মুঠো খেতে-পরতে দেবার লোক নাকি ও? দ্যাখো না, ঘরের চাল ফুটো—বর্ষায় জল পড়ে মেঝেয়। তাও পয়সা খরচের ভয়ে সারাতে চায় না ব্যাটা। উঠোনে আগাছার বন। সবখানে মাকড়সার ঝুল, চামচিকের নাদি, টিকটিকি ডিম পাড়ে। তবু কি হুঁশ আছে লোকটার? শুধু পয়সা ছাড়া আর কিছু চিনলেই না সংসারে। কখন দাঁতকপাটি খেয়ে পড়ে থাকবি ঘরে, তখন দেখবি—পয়সা সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিস নাকি!

এত বেরসিক বদমেজাজি নবীন কাপুড়ে গাঁওয়ালে গিয়ে কিন্তু অন্য রকম। তার বুলি শুনলে অবাক লাগে। কিন্তু সেও তো চালাকি তার। পয়সার জন্যে ওটুকু না করলেই নয়। বোঁচকা বেঁধে ফেরার পথে মুখখানা দেখলেই চমকে উঠতে হয়। এ মানুষ কি সেই মানুষ? এই তিরিক্ষি ভুরু বাঁকানো নিস্পৃহ মুখই আসল মুখ নবীনের।

আজ হঠাৎ এতদিন পরে ধুল্লোউড়ির মাঠে একটা বিকেল সেই নবীন কাপুড়েকে গুরুতরভাবে বদলে দিয়েছে। পিছনে আচমকা ধুপধুপ শব্দ শুনে মুখ ফেরামাত্র সে শুনছে—ও কাপুড়ে দাঁড়াও দাঁড়াও—আমি তোমার সঙ্গে যাব।

আর মুহূর্তে নবীন বদলে গেছে। ধুল্লোউড়ির বিশাল নির্জন মাঠ, পড়ন্ত বিকেল, এই ঢলাঢল ডাগর মেয়ে।…

আবাব নবীন হাঁসফাঁস করে বলে ক্যানে? সূর্যমুখী, তা কি কষ্ট করে বলতে পারি? পারি না। আমার মন বললে, সূর্যমুখী বলে যাকে ডেকেছি—তাকে বিনি দামেই দিই। তোমার দিব্যি তোমাকে বিনি দামে দিলেই যেন সার্থক হই। হ্যাঁ, মন বললে এ কথা।

পা দুটো শুকনো ঘাসে একটু দুলিয়ে এবার হঠাৎ ফিক করে হেসে ওঠে সূর্যমুখী। …দেবে যদি, সেইটে দাও। আমার পছন্দ সেটা।

ভাঙা গলায় নবীন বলে, সেটা—সেটা হয়ত নাই। সেটা যে নাই!

তা হলে আর কী? ওঠ, বেলা পড়ে এল। …বলে সে উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত মাথার ওপর তুলে একবার আড় ভেঙে নেয় দেহের। আবার বলে, কই ওঠ কাপুড়ে!

নবীন ব্যস্ত চোখে মাঠের চারদিকটা দেখে নেয়। এ কী হতে লাগল—হঠকারী প্রাকৃতিক উপদ্রব! শান্ত নিঃসাড় তার ভীতু যৌবন বিকেলের ধুল্লোউড়ির মাঠের মতন চুপচাপ শুয়ে ছিল এতদিন। ফেটেফুটে একটা উগ্র দুপুর বেরিয়ে এল। ঝাঁঝাল লু হাওয়া বইতে লাগল। সোনালি ধুলোর ঘূর্ণি এল একটার পর একটা—মাথায় তাদের খড়কুটো, শুকনো পাতা, পাখির পালক আর সাপের খোলসের রহস্যময় ‘মটুক’। জ্বরজ্বর নবীন কাপুড়ে আবার তাকাল মেয়েটির দিকে। ও ঠোঁট কামড়াচ্ছে। নাসারন্ধ্র কাঁপছে। নাকছাবিটা জ্বলছে। সিঁদুরটা ভয়ঙ্কর ধুধু ধোঁয়াচ্ছে। আর বুকে এক সোনালি ঝড়ের ঝাপটানি লেগে সুখবৃক্ষের দুটি স্বাদু ফল দুলছে, দুলছে। আর দেহে ওর নাগিনীছন্দ। ধুল্লোউড়ির মাঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে চৈত্র বিকেলের মরমী হাওয়া।

নবীন ওঠে। পায়ের নিচে রঙের বাজারে আজ চড়া নিলামের ওলটপালট। নবীন একবার জামা তুলে পেট চুলকোয়। একটা ব্লাউজ ভুল গাঁয়ে চলে গেছে—কোন গাঁয়ে কোন অন্যমনস্ক দুপুরবেলায়। সেই ব্লাউজটার জন্যে আক্ষেপে গলায় বোবা ধরে। হায়, অজান্তে বিকিয়ে গেছে তার জীবন যৌবনের শ্রেষ্ঠ আস্বাদ! যদি জানত নবীন, তা হলে ধুল্লোউড়ির মাঠের এই বিকেলের জন্যে মজুত রেখে দিত। নবীন কাপুড়ে গলা ঝেড়ে বলে, সেইটে থাকলে নিতে?

নিতাম বইকি।

বিনি দামেই নিতে?

নিতাম। তুমি দিতে চাইছ বড় মুখ করে, আর আমি নেব না? অত ছোট মন নই, কাপুড়ে।

নবীনের চোখ জ্বলে। নাক মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোয়। …সেটার বদলে যদি এইগুলো—যা আছে, সব—সব দিই? …চাপা ফিসফিস আওয়াজ আসে তার গলা থেকে। …নেবে, নেবে সূর্যমুখী?

না! …ভুরু কুঁচকে সাঁত করে ফণা তোলে ধুল্লোউড়ি মাঠের মোহিনী সাপ। হুহু করে ধুলোর ঘূর্ণি চলে যায় গায়ের ওপর দিয়ে। খোঁপা খসে পড়ে। রুক্ষ চুল ওড়ে। শাড়ি সরে লাল শায়ার দেয়াল দেখা যায়। তারপর সে নবীনের নিলামের বাজার এবং নবীনকে রেখে হনহন করে এগিয়ে যায়।

নবীন ভারি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তাকিয়ে তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখে। তারপর দুর্বল কাঁপা হাতে বোঁচকাটা গুছিয়ে নেয়। এত ওজন বেড়ে গেছে বোঝাটার!! পিঠে ফেলতে কষ্ট হয়। তখন সে উঁচু আল থেকে ক্ষেতে নামে। অনেক কষ্টে বগলের ফাঁক গলিয়ে পিঠে নেয়। হাঁচড়-পাঁচড় করে আহত জন্তুর মতন হাঁফাতে হাঁফাতে আলপথে উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় নবীন কাপুড়ে।

সেই সময় হঠাৎ কোত্থেকে অবেলায় নিম ফুলের গন্ধ ভেসে এল।

সে নাক উঁচু করে শোঁকে। ধুল্লোউড়ির মাঠে গাছ নেই, কোত্থেকে এল এই উপদ্রব? এ কি মিথ্যে নিম ফুলের গন্ধ—নাকি সত্যিকার নিম ফুলের গন্ধ? তার গা শিউরে ওঠে। অপার নিরালায় চিকন মিহি রোদ। চৈত্রের হাওয়া বয়ে যায়। ধুলো ওড়ে মৃদু মৃদু। দূরে ধূসর হয়ে যায় সূর্যমুখী সেই কি রেখে গেল ওই গন্ধটা?

ক্লান্ত বিষণ্ণ নবীন কাপুড়ে আবার নাক উঁচু করে অসম্ভব নিম ফুলের গন্ধটা হাতড়াতে হাতড়াতে ধুলোর মাঠ পেরোতে থাকে।

….’ধুল্লোউড়ির মাঠে রে ভাই রোদ ঝিলমিল করে।

নিম ফুলের গন্ধে আমার মন চনমন করে।।’

…’আর যাব না আর যাব না ধুল্লোউড়ির মাঠে।

কানের সোনা হারিয়ে এলাম মুখ দেখাব কাকে।।’

আবার বয়ে যায় অন্যমনস্ক হাওয়া। আবার খড়কুটো পাখির পালক শুকনো পাতা আর সাপের খোলসের ‘মটুক’ পরা ঘূর্ণি আসে ছুটে। ধুলোমাখা ছেঁড়া দুটো স্যান্ডেলের বিষণ্ণ শব্দ ওঠে দিনশেষে।

____

* মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের প্রবাদ। লালবাগ মহকুমার একটা রানা নবগ্রাম বা নগাঁ। তার পাশেই সিঙাড় নামে একটা গ্রাম আছে। কেন এ প্রবাদ চালু জানা নেই। কোনওকালে বুঝি ওখানে প্রচুর বর কিংবা স্বামী সুলভ ছিল! —লেখক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *