৯
রাতটা নিরুপদ্রবেই কাটল। কিন্তু ভোরবেলা তাঁবু গুটিয়ে যাত্রা শুরুর মুহূর্তে একটা গোলযোগ বাঁধল। দাঁড়িয়ে পড়ল সেই বৃদ্ধ লামাঅলা। সে এগোতে রাজি নয়, ফিরে যেতে চায়! ইল্লাপা, পিনচিও, হুইকোসহ অন্য লোকগুলো বুড়োটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সুজয়, মার্কেজ আর বিল সুসানকে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। সুজয়ের মনে পড়ে গেল গত রাতের ঘটনাটা। ব্যাপারটা শুনে মার্কেজ বেশ আশ্চর্য হলেন। বিল চাপাস্বরে বলল, ‘লোকটা কি তাহলে আমাদের কোনো গোপন ব্যাপার বলতে এসেছিল? নইলে, ও চুপি চুপি আমাদের তাঁবুতে আসবে কেন?’
প্রফেসর তার কথার জবাবে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় একটা ঘটনা ঘটল। সেই বুড়ো সম্ভবত কিছুতেই আর এগোতে রাজি হচ্ছিল না। সমানে তর্ক করছিল অন্যদের সঙ্গে। সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে ইল্লাপার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে তিনি এক ধাক্কায় লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে, পাশের একজনের রাইফেল টেনে নিয়ে সেটা তাক করলেন লোকটার বুকের দিকে! একটা ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে বিল তিরের মতো সেখানে ছুটে গিয়ে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে আড়াল করে দাঁড়াল বুড়োটাকে। সুজয়ও দৌড়ে গেল সেখানে। বিল ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়াতে তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন ইনকা পুরোহিত। সুজয়ের ভয় হল রাগের মাথায় বিলকেই না গুলি চালিয়ে দেন তিনি। ইতিমধ্যে প্রফেসরও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। পিনচিও, হুইকো সবাই যেন হতভম্ব ঘটনাটা দেখে। বিলেরও একটা হাত কোমরের কাছে জামার নীচে। হাতটা ওখানে কেন তা অনুমান করতে পারল সুজয়। বিল আর ইল্লাপা তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। এভাবে কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর একসময় ইনকা পুরোহিত ধীরে ধীরে রাইফেলটা নামিয়ে নিয়ে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মাটিতে পড়ে থাকা বুড়ো লোকটা তখনও ভয়ে কাঁপছে। বিল হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল তাকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রা শুরু হল। বুড়োটাও চলতে শুরু করল তাদের সঙ্গে।
সেই ঝোপঝাড় ভেঙে, গাছের গুঁড়ির ফাঁক গলে একই রকম পথ চলা। সুজয় খেয়াল করল, একজন রাইফেলধারী সবসময় সেই বুড়োটার পাশাপাশি হাঁটছে। সম্ভবত সে আগলে রাখছে তাকে। সুজয় পিনচিওর কাছে জানতে চাইল, ‘বুড়ো লোকটা আমাদের সঙ্গে আর আসতে চাইছিল না কেন?’
উত্তরটা এল হুইকোর কাছ থেকে। সে বলল, ‘লামাটা নদীতে পড়ে যাবার পর ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! ওর ধারণা, ঘটনাটা অশুভ। আমরা আর এগোলে ভয়ংকর কোনো বিপদ হতে পারে।’
এরপর কিছুটা স্বগতোক্তির সুরে সে বলল, ‘আসলে চিমু উপজাতির লোকগুলোই এরকম! ওকে সঙ্গে আনাই উচিত হয়নি।’
সুজয় বলল, ‘এই লোকগুলো একই গোষ্ঠীর নয়?’
হুইকো জবাব দিল, ‘না, অন্যরা সব কুয়েচুয়া গোষ্ঠীর।’
বিল, প্রফেসর মার্কেজকে জিজ্ঞেস করল, ‘চিমুরা কি ইনকাদেরই আর-একটা গোষ্ঠী?’
তিনি বললেন, ‘না।’ চিমু জাতি ছিল পৃথক আন্দীয় জনগোষ্ঠী। ‘চিমু’ এবং ‘মোচে’ নামের আর-এক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস কিন্তু ইনকাদের চেয়েও প্রাচীন। এরা ছিল ইনকাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। চিমুদের সঙ্গে বহুযুদ্ধ হয় ইনকাদের। শেষপর্যন্ত অবশ্য তারা ইনকাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১০০০ থেকে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই সভ্যতা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। চিমুদের রাজধানী ‘চানচান’ ছিল সে-সময় দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম নগর। আপাদমস্তক পাখির পালকের সাজে সজ্জিত চিমুরা, স্বর্ণ ও পটারি শিল্পে উৎকর্ষ লাভ করেছিল, কুজকো মিউজিয়ামে এর বেশ কিছু নির্দশন সংরক্ষিত আছে।’ এরপর মার্কেজ চলতে চলতে সুজয়দের উদ্দেশ্যে বলে যেতে লাগলেন চিমুদের ইতিহাস। তাই শুনতে শুনতে এগোতে লাগল সুজয়রা।
ঘণ্টা পাঁচেক একনাগাড়ে চলার পর হুইকো একসময় বলল, ‘আমরা মাচাকুয়ে নদীর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি এখন।’ তাই শুনে বিল উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল, ‘তাই নাকি! ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন হয়, তাহলে হয়তো তার দেখা এখন যাত্রাপথেই মিলে যেতে পারে!’ এই বলে সে তার কিট ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ছোটো বাইনোকুলার বার করল।
মার্কেজ বিলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার উদ্দেশ্য যেন সফল হয় তাই কামনা করি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার এ জঙ্গলে একটা পাখিও চোখে পড়েনি আমার! তাহলে কি কোরাকেঙ্কু যেখানে থাকে, সেখানে অন্য কোনো পাখি থাকে না?’ কথাটা বলে তিনি তাকালেন হুইকোর দিকে। হুইকো যেন মার্কেজের কথাটা শোনেনি এমন ভাব করে আগের মতোই হাঁটতে লাগল।
বিল মাঝে মাঝে তার বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সে জিনিসটা চোখে লাগিয়ে বলল, ‘গাছের ডালে সাদা কাপড়ের ফালি ঝুলছে কেন? এখানে কি মানুষ থাকে?’ তার কথাটা কানে যেতেই হুইকো দাঁড়িয়ে পড়ে বাইনোকুলারটা হাতে নিয়ে একঝলক সে-দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা বলল ইল্লাপার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সুজয়ও কাচের মধ্যে চোখ রেখে দেখল দূরে গাছের ডালের দিকে। হ্যাঁ, একটা সাদা রঙের লম্বা কাপড়ের ফালি যেন ঝুলছে গাছের ডাল থেকে!
হুইকো ইনকা পুরোহিতের সামনে এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কী যেন আলোচনা করল। তারপর সম্ভবত সন্দেহ নিরসনের জন্যই একজন রাইফেলধারীকে সঙ্গে নিয়ে কিছু দূরে সেই গাছের দিকে এগোল। অন্যরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেও কৌতূহলবশত তাদের পিছু নিল বিল আর সুজয়। ঝোপঝাড় ভেঙে সেই গাছটার কাছাকাছি পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়ে গাছের ডালে ঝুলতে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালেন তিনি। দাঁড়িয়ে পড়ে সেদিকে তাকাল সুজয়রাও। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা বুঝতে পারল, তারা যেটাকে কাপড়ের ফালি বলে মনে করেছিল, সেটা আসলে বিরাট লম্বা একটা সাপের খোলস! অন্তত পনেরো ফুট লম্বা হবে! বিল অস্ফুট স্বরে সুজয়ের কানের কাছে বলল, ‘অ্যানাকোণ্ডা!’ ইনকা পুরোহিত ঝুঁকে পড়ে একমুঠো মাটি তুলে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে বললেন, ‘এক্ষুনি এখান থেকে আমাদের যেতে হবে, সাপটা ধারেকাছেই আছে।’ কথাটা বলার পর আর-এক মুহূর্ত সেখানে না-দাঁড়িয়ে দ্রুত পা চালালেন ফেরার জন্য।
তারা আগের জায়গায় ফিরে আসার পর ইনকা পুরোহিত দ্রুত পা চালাবার জন্য সকলকে নির্দেশ দিলেন। তার নির্দেশ মেনে তাকে অনুসরণ করল সবাই. চলতে চলতে ইল্লাপা সকলকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময় সাবধান, ‘বড়ো মাচাকুয়ে’ গাছের ওপর থেকে শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর তার পেশির প্রচন্ড চাপে হাড়গোড় চূর্ণ করে মানুষকে মাথার দিক থেকে গিলতে শুরু করে!’ তাঁর কথা শোনার পর গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে চলতে লাগল সবাই।
সুজয়ের কানে এল পিনচিও চাপাস্বরে ইল্লাপাকে বললেন, ‘আপনি এ পথটা বাছলেন কেন? এ ছাড়া কি অন্য কোনো পথ ছিল না?’
ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘বড়ো মাচাকুয়ে’ এ জায়গা ছেড়ে চলেগেছিল। আবার যে তাদের এখানে খাবারের ব্যবস্থা করে ডেকে আনা হয়েছে এ খবর আমি পাইনি।’
পিনচিও তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডেকে আনা হয়েছে মানে?’
তার একথার কোনো উত্তর দিলেন না ইনকা পুরোহিত। সতর্ক দৃষ্টিতে গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পা চালালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপস্থিত হল মাচাকুয়ে বা সর্পনদীর ধারে। দু-পাশে গহীন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়েছে সর্পনদী। তবে এ নদী চওড়ায় খুব বেশি নয়। একটা গা-ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে, কোথাও কোনো শব্দ নেই, যেন কোনো অজানা আতঙ্কে গাছের পাতাও এখানে নড়ছে না! নদীর পাড়ে এক জায়গাতে গাছের গুঁড়ির তৈরি একটা নৌকা রাখা আছে। ইল্লাপা, সুজয়দের সঙ্গে আসা লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নৌকো নামাও। তাড়াতাড়ি এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে!’ দুজন লোক ঠেলে নৌকা জলে নামাতে লাগল।
বিল হুইকোকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কোথায় কোরাকেঙ্কু পাখি দেখেছিলে তুমি?’ বিলের কন্ঠস্বর শুনে সে যে ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত তা বুঝতে পারল সুজয়।
প্রশ্ন শুনে হুইকো দূরে নদীর বাঁকের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওদিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে।’
বাইনোকুলার দিয়ে সেদিকটা দেখতে দেখতে বিল বলল, ‘এখন ওদিকে একটু যাওয়া যায় না?’
হুইকো জবাব দিল, ‘এখন নয়। ফেরার পথে।’
বিল আরও কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল হুইকোকে। কিন্তু ততক্ষণে নৌকা নামানো হয়ে গেছে। ইল্লাপা সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, এখানে দাঁড়ানো যাবে না।’ এই বলে তিনি এগোলেন নৌকার দিকে। তার কথা শুনে আর কিছু নাবলে একটু অসন্তুষ্টভাবেই সুজয়দের সঙ্গে বিলও পা বাড়াল সেদিকে। কোনো ধরনের নৌকা, একটা লম্বা গাছের গুঁড়ির মধ্যে খোঁদল করা। ইনকা পুরোহিতের সঙ্গে সুসানকে সঙ্গে নিয়ে সুজয়রা, পিনচিও আর হুইকো উঠে বসল সেই খোঁদলের মধ্যে। সব শেষে নৌকায় তোলা হল লামার বাচ্চাটাকে। আর জায়গা নেই। হুইকো নৌকা নিয়ে আবার এপারে ফিরে এলে দ্বিতীয় দফায় ও পাড়ে পৌঁছোবে লামাগুলোকে নিয়ে বাকি চারজন। নৌকতে তখন উঠে বসেছে সবাই। হুইকো লগি তুলে নিয়েছে হাতে। ঠিক সেই সময় সুসান পাড়ের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওটা কি?’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দেখল, একটু আগে তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার হাত পনেরো দূরে জঙ্গলের গা ঘেঁসে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের তৈরি প্রাচীন এক মানুষের মূর্তি! এতক্ষণ সুজয়রা সেটা খেয়াল করেনি। স্তম্ভাকৃতি মূর্তিটা অন্তত কুড়ি ফুট হবে। বিকট দর্শন তার মুখ। পরনে প্রাচীন ইনকাদের পোশাক। আর সেই মূর্তিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে পাথরের তৈরি এক মহাসর্প! তার ভয়াল মুখগহ্বরে যেন গিলতে চলেছে মূর্তির মাথাটাকে! বেশ কিছু দড়িদড়া আর কিছু ছেড়া কাপড়ের টুকরোও ঝুলছে মূর্তির গা থেকে। সেসব অবশ্য পাথরের নয়, আসল! মূর্তিটা যে বেশ প্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই।
মার্কেজ ইল্লপার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এখানে এটা কীসের মূর্তি আপনি জানেন? এই মূর্তিতো আগে দেখিনি!’
ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘ইনতিকে যারা মানে না, সেসব লোকদের দু-ভাবে শাস্তি দেয় প্রাচীন নগরীর ইনকারা। হয়, সূর্যস্তম্ভে বেঁধে তাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়, অথবা নদী পার করে এখানে আনা হয়।’
‘এখানে আনা হয় মানে?’ পাশ থেকে প্রশ্ন করল বিল।
পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘এখানে এনে অপরাধীকে বাঁধা হয় ওই স্তম্ভ-মূর্তির সঙ্গে, তারপর তার পায়ে ঢেলে দেওয়া হয় বাঁদর বা লামার কাঁচা রক্ত। রক্তের গন্ধ বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলে। আর সেই গন্ধ পেয়ে এখানে ছুটে আসে বড়ো মাচাকুয়ে। আর তারপর …? একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘বহুপ্রাচীন কাল থেকে এ ব্যবস্থা চলে আসছে। মাঝে কিছুদিন অবশ্য বন্ধ ছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে দেখছি।’ ইনকা পুরোহিতের কথা শুনে শিউরে উঠল সবাই। বিল বলল, ‘তার মানে এ জায়গাটা মশান! এখন বুঝলাম কেন এ জঙ্গলে কোনো পশুপখি চোখে পড়ল না!’ ইনকা পুরোহিতের ইশারাতে লগি ঠেলতে শুরু করল হুইকো। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো তাকিয়ে রইল সেই ভয়াল মূর্তির দিকে। নৌকা থেকে সুজয় বুঝতে পারল তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আতঙ্কের চিহ্ন!
মিনিট পাঁচেক সময় লাগল নদী পার হতে। সুজয়দেরকে পাড়ে নামিয়ে হুইকো কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপারে পড়ে থাকা লোকগুলো আর ভারবাহী পশুদের নিয়ে ফিরে এল। নৌকা থেকে এ পারে পৌঁছে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল লোকগুলো। নতুন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবার শুরু হল পথ চলা। আবার এ জঙ্গলের মধ্যে শোনা যেতে লাগল পাখির ডাক। এক-এক করে ছোটোখাটো পশুপাখিও চোখে পড়তে লাগল। তবে এ জঙ্গলও কম গভীর নয়, মাঝে মাঝেই ঝোপঝাড় কেটে এগোতে হচ্ছিল। মাঝে একবার খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য থামতে হল, তারপর আবার চলা। বেলা তিনটে নাগাদ জঙ্গলের মধ্যে বিশালাকৃতির এক প্রাচীন তোরণের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেল সবাই। তার ওপরের খিলান ধসে পড়েছে। মোটা মোটা বুনো লতার নিবিড় বেষ্টনীতে স্তম্ভ দুটো শুধু মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ডালপালার চাঁদোয়ার ফাঁক দিয়ে শেষ দুপুরের আলো এসে পড়েছে সেখানে। স্তম্ভ দুটোর গায়ে খোদিত আছে ইনকা যোদ্ধার মূর্তি, পরনে পাথর খোদিত অদ্ভুত সাজ-পোশাক। হাতে ধরা তরবারি জাতীয় অস্ত্র। একটা কনডোর ডানা মেলে বসে আছে মূর্তির মাথার ওপর। পাথরে ‘ফুটে ওঠা, তীক্ষ্ণ নখ আর ধারাল ঠোঁটের পাখিটা যেন ডানা মেলে আগলে রেখেছে তাকে। সুজয়রা বিস্মিত হয়ে এসে দাঁড়াল সেই স্তম্ভ দুটোর সামনে। মার্কেজের অনুরোধে একজন লোক স্তম্ভর গা থেকে লতাপাতা একটু সরিয়ে দিতেই স্তম্ভ বেদীতে চোখে পড়ল আশ্চর্য সব হুয়াকা। পুমা, লামা, কুমির ইত্যাদি নানা পশুপাখির ছবি খোদিত আছে সেখানে। মুগ্ধ চোখে সবাই দেখতে লাগল সেই কারুকাজ। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ইনকা পুরোহিত ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে পিনচিওকে বললেন, ‘আমরা প্রাচীন নগরীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। একসময় এ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই নগরী।’
প্রফেসর উৎসাহিত হয়ে ইল্লাপাকে বললেন, ‘তার মানে এটা নগরীর প্রবেশ তোরণ ছিল! আর কত সময় লাগবে সেখানে পৌঁছোতে?’
ইনকা পুরোহিত একবার মাথার ওপর তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আলো থাকতেই পৌঁছোব।’
সুসান হঠাৎ তার দাদুকে প্রশ্ন করল, ‘আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে কি ইনকারা এখনও আছে?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘তারাতো এখন আর নেই, তাদের ঘরবাড়িগুলো আমরা দেখতে যাচ্ছি।’
মার্কেজের জবাব শুনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইল্লাপা এবার বললেন, ‘না কিছু মানুষ এখনও আছে সেখানে। ইনতির উপাসক তারা। আজও খাঁটি ইনকা রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাদের শরীরে। ওই নগরী, এ জঙ্গলের বাইরে তারা পা রাখে না কখনও। বাইরের পৃথিবীও তাদের কোনো খবর রাখে না।’
মার্কেজ ইনকা পুরোহিতের কথায়, উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি! এতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এতটা আমি আশা করিনি।’ এ কথা বলার পর তিনি ইল্লাপাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, ওই লোকগুলো কি এখনও সে যুগেই পড়ে আছে?’
ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘এখন তারা চাকা আর লোহার ব্যবহার জানে। কিন্তু অন্য সব কিছুই আগের মতোই আছে। একটা ব্যাপার সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সেখানে তাদের রীতিনীতি মেনেই সবাইকে চলতে হবে। বিদেশিদের এমনিতে তারা নগরীতে প্রবেশ করতে দেয় না, আমি সঙ্গে আছি তাই। কিন্তু, আমার কথা শুনে না চললে বিপদ হতে পারে।’
সকলে চুপচাপ শুনলেন ইনকা পুরোহিতের কথা। বিল বেশ কয়েকটা ছবি তুলল তোরণের। তারপর ইনকা পুরোহিতের সঙ্গে সবাই এগোল প্রাচীন নগরীর উদ্দেশ্যে। কিছুটা সময় এগোবার পর হঠাৎ দূর থেকে যেন ভেসে আসতে লাগল ঢাকের শব্দ। প্রথমে ধীর লয়ে তারপর দ্রুতছন্দে বেজে চলেছে ঢাক। মার্কেজ ইল্লাপাকে একটু শঙ্কিত ভাবে বললেন, ‘ঢাক বাজাচ্ছে কারা? অসভ্য জংলিরা নাকি!’
ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘না, এটা পুমাটিনির শব্দ। পুমার চামড়া থেকে তৈরি ঢাক। আমাদের আগমনবার্তা পেয়ে গেছে নগরবাসীরা। নগরের বাইরে যারা গেছে, এই ঢাক বাজিয়ে তাদের নগরে ফিরে আসতে বলা হচ্ছে।’
‘কীভাবে তারা এ খবর পেল?’ জানতে চাইল বিল।
‘জঙ্গলে তাদের লোক ঘুরে বেড়ায়। তারাই কেউ দেখেছে আমাদের।’ জবাব দিলেন ইল্লাপা।
ইনকা পুরোহিত তার চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। প্রাচীন নগরীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে জানতে পেরে উৎসাহিত হয়ে সবাই তাঁর সঙ্গে পা মেলালেন। বিল শুধু হুইকোকে একবার বলল, ‘ফেরার পথে মাচাকুয়ে নদীর তীরে সেই জায়গাতে আমাকে কিন্তু অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। ওই জন্যই কিন্তু আমার এখানে আসা।’
বিলের কথা শুনে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল হুইকো।
আরও এক ঘণ্টা চলার পর ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে লাগল জঙ্গল। তারপর তিন দিনের যাত্রা শেষে তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল জঙ্গল ঘেরা প্রাচীন এক নগরীর ছবি।
সুজয়রা এসে দাঁড়াল প্রাচীন নগরীর প্রধান প্রবেশ তোরণের সামনে। বিশাল তোরণ। বয়সের ভারে সে কিছুটা জীর্ণ হলেও মহাকাল এখনও তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিতে পারেনি। তোরণের মাথাতে ছটাঅলা সূর্যমূর্তি আজও বর্তমান। তারা সেখানে উপস্থিত হতেই দুজন দীর্ঘকায় বর্শাধারী তোরণের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তাদের পরনে রঙিন ডোরাকাটা
র্যাপারের মতো দেখতে রেশমের পোশাক। পায়ে কাঠের তৈরি জুতো। মুখমন্ডলে কালো রঙের বিচিত্র উলকি। ঠিক যেন তারা ছবির মানুষ। ইনকা পুরোহিত তাঁদের উদ্দেশ্যে কী একটা বলতেই তারা প্রথমে সম্ভ্রমে মাথা নোয়াল তার প্রতি। তাদের একজন এগিয়ে এসে হাতে নিল সাদা লামার বাচ্চার দড়িটা। এরপর রক্ষী দুজনের পিছন পিছন সকলে প্রবেশ করল নগরীতে।
একটা পাথর বিছানো সোজা রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। চারপাশে ছোটো ছোটো টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে পাথরের তৈরি বাড়িঘর। বয়সের ভারে জীর্ণ তারা। ছাদহীন, দেওয়াল ধসে পড়ছে। বহু শত বছর ধরে তারা পরিত্যক্ত বলেই মনে হয়। বেশ কিছু ছোটো-বড়ো পাথরের তৈরি স্তম্ভও চোখে পড়ছে পথের ধারে। কিন্তু কোথাও কোনো লোকজন নেই। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট স্তম্ভের শীর্ষদেশ। ইনকা রক্ষীরা তাদের নিয়ে চলল সেই স্তম্ভের দিকে। মার্কেজ সে দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে ইল্লাপার কাছে জানতে চাইল, ‘ওদিকে কী আছে?’ ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘ওটা হল এই নগরীর প্রধান ইনতিহুয়ানাতা। নগরবাসীরা সব ওখানেই বাস করে। ‘আউকুইকননা’র প্রাসাদও ওদিকে।
সুজয় মার্কেজকে জিজ্ঞাসা করে ‘আউকুইকননা’ মানে কী?’
প্রফেসর বললেন, ‘এ শব্দের একাধিক অর্থ,—পুরোহিত, জাদুকর, ওঝা, কোনো কোনো সময় শাসনকর্তা অর্থেও শব্দটা ব্যবহৃত হয়।’
কথাটা বলার পর তিনি এবার ইনকা পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা এ নগরী কার সময় তৈরি হয়েছিল?’
‘টুপাক ইনকা ইপানকুই।’ সংক্ষিত জবাব দিলেন ইনকা পুরোহিত।
মার্কেজ সুজয়ের দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত ভাবে বললেন, ‘অর্থাৎ এ নগরী প্রায় ছশো বছরের প্রাচীন! কাল ভোরবেলা উঠেই কিন্তু বেরিয়ে পড়তে হবে জায়গাটা দেখার জন্য।’
কিছুটা পথ ইনতিহুয়ানাতার দিকে এগোবার পর আস্তে আস্তে দু-একটা লোক চোখে পড়তে লাগল। তাদের পরনে প্রাচীন আমলের পোশাক, মাথায় রঙবেরঙের পালকের সাজ, পাথরের তৈরি অলংকার। সুজয়রাও যেমন তাদের দেখতে লাগল, সেই লোকগুলোও তেমনই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।
ইনতিহুয়ানাতা চত্বরের কাছাকাছি পৌঁছোতেই শেষ বিকালের সোনালি আলোতে সূর্যস্তম্ভের বেদীর ঠিক নীচে বেশ জমায়েত দেখতে পেল সুজয়রা। সেই জমায়েতের সামনে উপস্থিত হবার পর আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল তাদের। ইনতিহুয়ানাতা বেদীতে একজন জমকালো পোশাক পরা বিশাল বপু মাঝবয়সি লোক বসে আছে। মাথায় তার ছবির বইয়ে দেখা রেড ইন্ডিয়ানদের মতো পখির পালকের বিরাট তাজ। গলায় ঝুলছে সবুজ পাথরের তৈরি অনেকগুলো মালা। ইল্লাপাকে দেখে জমায়েত দু-ভাগে ভাগ হয়ে তাদের মাঝখান দিয়ে বেদীর দিকে যাবার জন্য রাস্তা করে দিল। বেদীর ওপর বসে থাকা লোকটাও উঠে দাঁড়াল তাঁকে দেখে। সুজয়রা বুঝতে পারল, সম্ভবত এ লোকটাই এখানকার আউকুইকননা। বেদীর ঠিক নীচে উপস্থিত হবার পর ইল্লাপা অন্য সবাইকে নীচে দাঁড়াতে বলে হুইকোর হাতে কনডোর সমেত লাঠিটা ধরিয়ে দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গীতে বেদীতে উঠে পড়লেন। জমকালো পোশাক পরা লোকটা বেশ খাতির করে তাঁকে নিজের পাশে বসাল। ইনকা পুরোহিত আস্তে আস্তে কি যেন বলতে লাগলেন সেই লোকটাকে। সে ইনকা পুরোহিতের কথা শুনতে শুনতে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সুজয়দের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল।
মার্কেজ হুইকোকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ লোকটা কে?’
সে জবাব দিল, ‘ওঁর নাম কুইলো। প্রাচীন নগরীর প্রধান পুরোহিত ও শাসনকর্তা।’
বিল চাপা স্বরে মার্কেজকে বলল, ‘শাসনকর্তার দরবারে বেশ খাতির দেখছি ইনকা পুরোহিতের!’
মার্কেজ বললেন, ‘কুজকো মন্দিরের পুরোহিতরা হলেন, ‘পুরোহিত শ্রেষ্ঠ’। ইনকা আমলেও তারা সম্রাট থেকে শুরু করে সর্বত্রই খাতির পেতেন।
বেদীর ঠিক নীচেই সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে চারজন অতিদীর্ঘকায় লোক। এ লোকগুলো যেন অন্যদের থেকে আলাদা। তাদের পোশাকের কোনো বাহুল্য নেই। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। নিম্নদেশে সামান্য পশুচর্মের আচ্ছাদন, কাঁধে তিরধনুক, ভাবলেশহীন কঠিন মুখ নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো তারা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারা কেমন যেন জান্তব! তাদের ইশারায় দেখিয়ে মার্কেজ চাপাস্বরে বললেন, ‘এ লোকগুলো সম্ভবত,’ আমাজন ইন্ডিয়ান! ভয়ংকর যোদ্ধা জাতি! এরা ইনকা সম্রাটদের দেহরক্ষী হিসেবে থাকত। এদের বলা হত, ‘কাকা কুজকো।’ সম্ভবত এরাও শাসনকর্তা কুইলোর দেহরক্ষী।’