সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – ৮

পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা শুরু করল সুজয়রা। কিছুটা এগোবার পরই হালকা হয়ে এল বন। সুজয়রা উপস্থিত হল কোচা নদীর ধারে। নদী চওড়াতে বেশি বড়ো নয়। তার ওপাশে বিরাট বিরাট গাছের ঘনজঙ্গল। সকালের সূর্যের আলোও সেখানে প্রবেশ করছে না। কেমন যেন থমথমে ভাব বিরাজ করছে সেখানে। নদীর পাড়ে একটা কাঠের ভেলা চোখে পড়ল সুজয়দের। ভেলা মানে, গোটা দশেক বালসাগাছের গুঁড়ি পাশাপাশি সাজিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ইল্লাপা আর পিনচিও বেশ কিছুক্ষণ ভেলাটা পরীক্ষা করার পর, ইল্লাপা লামাঅলাদের উদ্দেশ্যে কী যেন বললেন, তার কথা শুনে তাদের মধ্যে দুজনে ভেলাটা ঠেলে জলে নামাতে লাগল, আর অন্য দুজন লামাগুলোর পিঠ থেকে মালপত্রগুলো খুলতে শুরু করল।

মার্কেজ হুইকোকে বললেন, ‘এই ভেলাতেই আমরা নদী পেরব নাকি! এটা কাদের ভেলা?’

হুইকো সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে কিছু উপজাতি লোকজন নদী পারাপার করে। এ ভেলা তাদেরই তৈরি।’

লোকগুলো কিছু সময়ের মধ্যেই প্রথমে লামার পিঠের মালপত্রগুলো ভেলাতে তুলে ফেলল। লামা, মালপত্র, আর এতজন লোকের সংকুলান একবারে ভেলাতে হবে না। প্রথমে তাই মালপত্রর সঙ্গে নেওয়া হল চারটে ভারবাহী লামা। হুইকো আর তিনজন লোক চড়ে বসল তাতে। তারপর লগি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে ভেলাটাকে তারা এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ওপারের দিকে। ওপারে পৌঁছোতে তাদের মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। সেদিকে মালপত্র, লামা, আর অন্যদের নামিয়ে দিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই একজন আবার ভেলা নিয়ে ফিরে এল এপাড়ে।

অন্যরা সবাই এরপর লামার বাচ্চাটা আর অবশিষ্ট ভারবাহী লামাটাকে নিয়ে উঠে বসল ভেলাতে। ভেলাতে ওঠার পর ইল্লাপা সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সবাই বসে পড়ুন। জলে পড়ে গেলে বিপদ হবে।’ এই বলে তিনি লামার বাচ্চাটার দড়ি ধরে নিজে বসে পড়লেন। তার কথা শুনে সকলে বসে পড়ল। লগির ঠেলায় ভেলা এগোতে লাগল মাঝ নদীর দিকে। বিল ইল্লাপার উদ্দেশ্যে বলল, ‘জলতো বেশি গভীর নয়, নদীতে ‘কেম্যান’ আছে নাকি?’ ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘না, তবে নদীতে পড়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত।’

বিল আবার জানতে চাইল, ‘জলও গভীর নয় কেম্যানও নেই তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত কেন? তাহলে কি অ্যানাকোণ্ডা আছে?’

ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ইনকা পুরোহিত শুধু ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, না। তার আসল প্রশ্নের জবাব পেল না বিল।

সুসান ‘কেম্যান’ শব্দটা শুনে চাপা স্বরে বলল, ‘বিল আঙ্কেল’ কেম্যান কী?’

বিল উত্তর দিল, ‘এক ধরনের আমেরিকান কুমির।’

বিলের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এমন একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল যে বিল যে কথাটা জানতে চেয়েছিল ইল্লাপার কাছে তার উত্তর মিলে গেল। সকালবেলা সুজয়দের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই কনডোরের বাচ্চাটা চুপচাপ বসে ছিল ইল্লাপার কাঁধে ফেলা লাঠির মাথায়। ইল্লাপার কাছেই ভারবাহী লামাটার দড়ি ধরে বসেছিল তার বুড়ো মালিক। হঠাৎ কী খেয়াল হওয়াতে কনডোরটা লাঠির আগা ছেড়ে ডানা ঝটপট করে বসল গিয়ে লামাটার ঘাড়ে। তাতে ভয় পেয়ে লামাটা ঘাবড়ে গিয়ে লাফ দিল জলে। তাই দেখে চিৎকার করে উঠল সবাই। লামার দড়িটা তখনও বুড়োটার হাতে ধরা। সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল তাকে ভেলায় টেনে তোলার। লামাটাও উঠে আসতে চেষ্টা করতে লাগল ভেলায়। ভেলাটা দুলতে লাগল। সুসান ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরল সুজয়কে। যে লগি ঠেলছিল সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল ভেলাটা স্থির রাখার। কিন্তু এরপরই হঠাৎ বীভৎস একটা চিৎকার করে উঠে জলের মধ্যে দাপাদাপি শুরু করল প্রাণীটা। সুজয়রা দেখল লামার চারপাশের জলটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে! দাঁড়িয়ে পড়ল ভেলা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে লামাটা হারিয়ে গেল জলের নীচে। সেখানকার জল তখনও ঘোর রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। লামার গলার দড়িটা তখনও ধরা আছে বুড়ো লোকটার হাতে। ফ্যালফ্যাল করে সে চেয়ে আছে লাল জলের দিকে। কোনো একটা ভয়ংকর কিছু যে ঘটে গেল তা বুঝতে পারল সবাই। তখন একটু আতঙ্কের ভাবও ফুটে উঠেছে সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু ইনকা পুরোহিত নির্বিকার। লামাটা জলে পড়ে গেলে সে যে আর উঠবে না তা যেন তিনি জানতেন। আকাশে কনডোরটা একটা চক্কর মেরে ফিরে এসে তাঁর কাঁধে আবার বসল। ইল্লাপা এরপর ধমকের সুরে প্রথমে সম্ভবত তাঁর পাখিটার উদ্দেশ্যে কিছু বললেন, তারপর যে লগি ঠেলছিল তাকে ইঙ্গিত করলেন ভেলা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।

মিনিট তিনেক পর ওপারে গিয়ে নামল সুজয়রা। বুড়ো লোকটা সব শেষে ডাঙায় নেমে তার হাতের দড়িটা ধরে টান দিল। দড়ির শেষ মাথায় উঠে এল লামার একটা কঙ্কাল! একটুও মাংস লেগে নেই হাড়ের গায়ে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন সুনিপুণ ভাবে ছুরি দিয়ে হাড়ের গা থেকে মাংস চেঁছে ফেলেছে! খুব বেশি হলে মিনিটচারেক জলের নীচে ছিল প্রাণীটার দেহ। মাত্র এইটুকু সময়ের মধ্যে এত বড়ো প্রাণীর দেহ থেকে সব মাংস সরিয়ে ফেলল কে? বিল প্রথমে, তারপর সুজয় হঠাৎ খেয়াল করল, কঙ্কালটার পাঁজরে আটকে আছে ছোটো আকৃতির চাঁদা মাছের মতো একটা মাছ। সূর্যের আলোতে সেটা চিকচিক করছে। কঙ্কালটার বুকের খাঁচায় আটকে মাছটা উঠে এসেছে। তার ছোট্ট লেজটা তখনও মৃদু মৃদু কাঁপছে। ইল্লাপাও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তারপর তিনি কঙ্কালটার কাছে ঝুঁকে পড়ে মাছটাকে বার করে আনলেন সুজয়দের ভালোভাবে মাছটাকে দেখানোর জন্য। ইল্লাপার কঠিন আঙুলের চাপে মাছটার অবশিষ্ট প্রাণ বায়ু বার হবার পর তিনি সাবধানে মাছটার মুখ ফাঁক করলেন। সুজয়রা দেখল মাছটার চোয়ালে সাজানো আছে খুদে খুদে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। দাঁতগুলো ব্লেডের মতো ধারালো! দাঁতগুলো দেখাবার পর ইল্লাপা মাছটাকে ছুড়ে ফেলে কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘পিরানহা!’ রাক্ষুসে মাছের ঝাঁক! এরপর তিনি বিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি জলে পড়লে, সময় লাগত মাত্র, ‘দেড় মিনিট।’ মাছটা দেখে আর ইল্লাপার কথা শুনে এই নদী-জঙ্গলে মৃত্যু কতটা ভয়ংকর হতে পারে এই প্রথম তা প্রত্যক্ষ করতে পারল সুজয়রা। লামাটা যখন জলে পড়ে দাপাদাপি করছিল তখন যদি ভেলা থেকে কেউ নদীতে পড়ে যেত, তাহলে তারও অবস্থা হত ওই কঙ্কালটার মতো!

এপাড়ে আগে চলে আসা লোক ইতিমধ্যেই লামার পিঠে মালপত্র বাঁধাছাঁদা শুরু করেছে। যে লগি ঠেলছিল সেও গিয়ে হাত লাগাল তাদের সঙ্গে। শুধু সেই বুড়ো লোকটা একটু দূরে তাকিয়ে রইল নদীর পাড়ে পড়ে থাকা তার লামার কঙ্কালের দিকে। সুজয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সুসান একবার শুধু বলল, ‘ওই লামাটারই পিঠে চড়ে ছিলাম আমি।’ সুজয় সস্নেহে তার কাঁধে হাত রাখল।

কিছুক্ষণের মধ্যই মালপত্র তোলা হয়ে গেল লামাগুলোর পিঠের দু-ধারে। শুধু সেই লম্বা কাঠের বাক্স দুটো পড়ে রইল মাটিতে। হুইকো বাক্সদুটোর ডালা খুলে তার মধ্য থেকে যা বার করল তা দেখে চমকে উঠল মার্কেজ, সুজয় আর বিল। রাইফেল! দুটো, দুটো করে মোট চারটে। আর তার সাথে কার্তুজের বেল্ট! সেগুলো দেখে মার্কেজ পিনচিওকে বললেন, ‘রাইফেল সঙ্গে এনেছেন কেন? এগুলো কি ইনকা পুরোহিতের সম্পত্তি? এ সবের অনুমতিপত্র আছে তো?’

পিনচিও বললেন, ‘না, রাইফেলগুলো ইল্লাপার সম্পত্তি নয়। তবে তারই পরামর্শে হুইকো জিনিসগুলো সংগ্রহ করেছে। ইনকা পুরোহিত বলেছেন, বন্যজন্তু বা অসভ্য উপজাতিরা যদি আমাদের আক্রমণ করে তাহলে তখন রাইফেলগুলো আমাদের কাজে আসবে।’

এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আর অনুমতিপত্র বলতে আপনি যা বোঝাতে চাচ্ছেন তা আমাদের কাছে নেই। হুইকো হাত ভাড়ায় জিনিসগুলো এনেছে। এ সবের লাইসেন্স হয় না। তবে আপনার ঘাবড়াবার কিছু নেই। এখানে নাকি এটাই দস্তুর। নদীর এপাড়ে কোনো বনরক্ষী রাইফেলের লাইসেন্স দেখতে আসবে না। ফেরার সময় হুইকো নিজ দায়িত্বে জিনিসগুলো জঙ্গলের বাইরে নিয়ে জায়গা মতন ফেরত দিয়ে আসবে। আমাদের কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না।’

প্রফেসর তাঁর কথা শুনে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘তার মানে অস্ত্রগুলো বেআইনি। আপনি যাই বলুন, এ কাজটা কিন্তু ঠিক হয়নি। কোনো অজুহাতেই আইন ভাঙা ঠিক নয়। আমি কিন্তু এসবের কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নই।’

পিনচিও কোনো উত্তর দিলেন না তার কথায়।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকার পর বিল হঠাৎ বলল, ‘কিন্তু রাইফেল চালাবে কারা?’

পিনচিও এবার বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে আসা লোকগুলো। ওরা শুধু লামাঅলাই নয়, ওরা রাইফেল চালাতেও জানে। বলতে পারেন ওরা আসলে আমাদের রক্ষী।’

পিনচিওর কথা শুনে মার্কেজ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ও ব্যাপারটা বুঝলাম।’

রাইফেল আর কার্তুজগুলো বের করার পর হুইকো তিনজন লামাঅলার হাতে তিনটে রাইফেল কার্তুজ তুলে দিল। তারপর নিজেও একটা রাইফেল আর কার্তুজের বেল্ট গলায় ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর যাত্রা শুরুর আগে ইল্লাপার নির্দেশ মতো সুসানকে তুলে দেওয়া হল একটা লামার পিঠে ঝুলতে থাকা মালপত্রর খাঁজে। প্রথমে ইল্লাপা, আর তার সঙ্গে লামার বাচ্চাটা, তারপর একজন লামাঅলা বা রক্ষী সুসানের লামাটা নিয়ে, মাঝে সুজয়রা তিনজন আর তারপর অন্য ভারবাহী পশুগুলো নিয়ে অন্য তিনজন। এ ভাবেই তারা প্রবেশ করল সেই জঙ্গলের মধ্যে। কি গহীন অরণ্য। বিরাট বিরাট গাছ অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে যেন আকাশকে ছুঁতে চাইছে। পাশাপাশি কয়েকটা গাছ আবার অনেক জায়গাতে মাথার ওপর মিলেমিশে গিয়ে চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে। সেসব জায়গাতে মাটিতে সূর্যালোক এসে পৌঁছোয় না। সেখানে গাছের মোটাসোটা গাছের গুঁড়িতে শতাব্দী প্রাচীন শ্যাওলার পুরু আস্তরণ, গাছের নীচে স্তূপীকৃত হয়ে আছে পচা পাতার রাশি। এ ছাড়া ছোটো-ছোটো ঝোপজঙ্গলতো আছেই। সেগুলো ভেঙেই চলতে থাকল সুজয়রা।

ধীরে ধীরে যত তারা বনের ভিতর প্রবেশ করতে লাগল ততই ঘন হতে লাগল অরণ্য, এ যেন এক অন্য পৃথিবী! কত প্রাচীন গাছ! তাদের থেকে ঝুলছে কত বিচিত্র ধরনের লতা! কোনো কোনো লতা নৌকার কাছির মতো মোটা! বিচিত্র তাদের বর্ণ, সবুজ, হলুদ, কালো, লাল! সেসব দেখতে দেখতে এগোল সকলে। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে নানা ধরনের শব্দ। সেই শব্দ সন্দেহজনক মনে হলেই দাঁড়িয়ে পড়ছেন ইল্লাপা। তাঁর পিছন থেমে যাচ্ছে অন্যরাও। ইনকা পুরোহিত শব্দের প্রকৃ«তি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলেই তবে আবার চলা শুরু হচ্ছে। আস্তে আস্তে নানা ধরনের জীবজন্তুও চোখে পড়তে লাগল সুজয়দের। গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ঝুলতে থাকা শ্লথ, ঝোপজঙ্গল ভেঙে ইঞ্জিনের মতো ছুটে যাওয়া টেপির, লামা পরিবারেরই অন্যতম সদস্য বন্য ভিসুনিয়া, এ ছাড়া নানা ধরনের অচেনা ছোটো ছোটো প্রাণী। একবার, হরিণ আর ক্যাঙারুর সঙ্গে মিল আছে, এ জাতীয় একটা ছোটো প্রাণী দেখতে পেয়ে বিল সুজয়কে বলল, ‘এই প্রাণীটার নাম হল ‘অপোসাম,’ বইতে ওর ছবি আমি দেখেছি। অপোসাম দ্বিগর্ভ প্রাণী। দ্বিগর্ভ অর্থাৎ এই ক্যাঙারু গোত্রের প্রাণী অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। লক্ষ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকা যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এখানে অপোসামের উপস্থিতি তারই প্রমাণ দেয়।’

তার কথা শুনে সুজয় বলল, ‘জীবজন্তু আর জঙ্গলের কথা শুনলেই মানুষের প্রথমে মনে হয় আফ্রিকার কথা, এখানেও তো দেখছি তার চেয়ে কম কিছু নেই!’

বিল বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক কথা। এসব অঞ্চলের জঙ্গল সম্বন্ধে আমার কিছু পড়াশোনা আছে। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে এমন অনেক প্রাণী আছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। লামা, টেপির, ভিসুনিয়াতো আছেই, আছে আন্দিজের পুমা, ব্রাজিলের কালো বাঘ, পিরানহার মতো রাক্ষুসে মাছ, অ্যানাকোণ্ডার মতো বৃহত্তম সর্প এমনকি রক্তচোষা বাদুড় অর্থাৎ ভ্যাম্পায়ারও আছে এখানে!’

ভ্যাম্পায়ারের কথা শুনে সুজয় একটু অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘সে কী! ব্রাম স্ট্রোকারের ‘ড্রাকুলা’ গল্পেতো পড়েছি সে তো ট্রান্সেলভেনিয়ার বাসিন্দা?’ বিল হেসে বলল, ‘না, তোমার গল্পে পড়া বিষয়টা ঠিক নয়। ব্রামস্ট্রোকার তার কাহিনির প্রয়োজনে ভ্যাম্পায়ারকে রোমানিয়া-ট্রান্সেলভেনিয়ার পটভূমিতে নিয়ে গেছিলেন। আদতে দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে এদের বাস। ইকুয়েডর, পেরু ও ব্রাজিলের কিছু কিছু বনে এদের দেখা মেলে।’

সুজয় শুনে বলল, ‘ধন্যবাদ বিল। আমার মনে অনেকদিন ধরে রাখা একটা ভ্রান্ত ধারণা তুমি ভেঙে দিলে।’

চলতে থাকল সুজয়রা। জঙ্গল যেন ক্রমশই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তাদেরকে। কখনও মাথা সমান উঁচু ঝোপজঙ্গল সাফ করে। কখনও বা কোনো রকমে মোটা গাছের গুঁড়ির ফোকর গলে এগোতে থাকল তারা। সবচেয়ে অসুবিধা হচ্ছিল ভারবাহী প্রাণীগুলোকে নিয়ে। মাঝে মাঝেই গাছের ওপর থেকে নেমে আসা লতাগুল্মে আটকে যাচ্ছিল তারা। একজন বন্দুকধারী ছুরি দিয়ে লতা কেটে মুক্ত করছিল তাদের। সময়ও এগোতে থাকল।

বেলা বারোটা নাগাদ খাবার আর বিশ্রামের জন্য থামতে হল সবাইকে। খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেবার পর যাত্রা শুরুর আগে ইল্লাপা জানালেন, এবার একটু দ্রুত চলতে হবে। এ জঙ্গলের শেষে একটা বিরাট জলা আছে। সন্ধ্যার আগে সেই জলা পার হয়ে ওপাশের জঙ্গলে পৌঁছোতে হবে। আবার শুরু হল চলা। সেই একই বিরাট গাছের জঙ্গল, মানুষ সমান উঁচু ঝোপঝাড়, আধো অন্ধকার পথ! অবশ্য পথ বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু নেই। ইনকা পুরোহিত সবার আগে আগে যে ভাবে হাঁটতে থাকলেন অন্যদের কাছে সেটাই হল পথ! অতিকষ্টে আদিম মহিরুহদের নাগপাশ ভেদ করে এগোতে এগোতে একসময় সুজয়ের মনে হতে লাগল এই মহারণ্য মনে হয় কোনোদিন শেষ হবে না! কিন্তু এ অরণ্যও একসময় শেষ হল। ঘণ্টা তিনেক পর ফিকে হয়ে এল জঙ্গল। ডালপালার চাঁদোয়া ছেড়ে বেরিয়ে তারা উপস্থিত হল এক উন্মুক্ত স্থানে।

সামনে একটা বিরাট জলা জমি। স্থানে স্থানে ডোবা। পচা জলে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ, মাঝে মাঝে কিছু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মাঝারি আকৃতির নেড়া গাছ। ঠিক যেন মূর্তিমান প্রেতের মতো জলা পাহারা দিচ্ছে তারা। জলার ওপাশে আকাশ যেখানে মাটির সঙ্গে মিশেছে সেখানে একটা কালো রঙের মোটা রেখা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত জঙ্গল! জলা পার হয়ে ওই জঙ্গলেই প্রবেশ করতে হবে সুজয়দের।

সুজয়রা যে জঙ্গল থেকে বাইরে এল, সে জঙ্গল আর জলার মধ্যের ছোট্ট জমিটা পুরোটাই কাদা মাখা। নানা ধরনের জন্তুর পায়ের ছাপ আঁকা হয়ে আছে কাদামাটিতে। এখানে জল খেতে আসে ওরা।

জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে জলার সামনে এসে দাঁড়ালেন ইনকা পুরোহিত। তারপর সুজয়দের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একজনের পর একজন, এ ভাবে সার বেঁধে এগোব আমরা। যাদের হাতে বন্দুক আছে তারা থাকবে দু-পাশে।’

পিনচিও হুইকোকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘ডোবাগুলো কত গভীর?’

সে জবাব দিল, ‘কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও আবার কোমর পর্যন্ত।’

তার উত্তর শুনে পিনচিও বললেন, ‘তাহলে তো বিশেষ চিন্তার কিছু নেই। কি বলো?’

হুইকো তার কথার কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু ইনকা পুরোহিত কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসলেন পিনচিওর কথা কানে যেতে। এরপর তিনি মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বাচ্চাটাকে লামার পিঠে রাখা যাবে না। জলায় পড়ে গেলে বিপদ হবে। ওকে কাঁধে নিতে হবে!’

ইল্লাপার কথা শুনে বিল প্রফেসরকে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি সুসানকে কাঁধে নিয়ে নিচ্ছি।’ এই বলে সে সুসানের দিকে এগোতে যেতেই একটা অদ্ভুত কান্ড করলেন ইল্লাপা। তিনি নিজেই এগিয়ে এসে সুসানকে লামার পিঠ থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন নিজের কাঁধে!

ইনকা পুরোহিত এরপর সুসানকে শক্ত হাতে কাঁধে ধরে পা বাড়ালেন জলার দিকে। সুসানের দিকে তাকিয়ে সুজয় বুঝতে পারল সে বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। ইল্লাপার কথা মতো তাঁর পিছন পিছন সার বেঁধে সুজয়রা নেমে পড়ল জলাতে। তাদের দু-পাশে রইল লামা-সহ বন্দুকধারীরা।

হুইকো ঠিকই বলেছে। জল কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও কোমর অব্দি। জলের নীচে পাঁক ভর্তি। পা বসে যাচ্ছে সুজয়দের। মাঝে মাঝে কোনো কোনো জায়গাতে ঢিপির মতো একটু উঁচু জমি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ পাতাহীন গাছ! এরকমই একটা গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় সুজয় দেখতে পেল পাতাহীন গাছের ডালে হলুদ রঙের ফিতের মতো বেশ কয়েকটা সাপ জড়িয়ে আছে। তা দেখে সে বিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ওই দেখো!’ বিল কয়েক মুহূর্ত সে দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘বোড়া’’ প্রজাতির সাপ। ভয়ংকর বিষধর! কামড়ালেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। গাছের মধ্যে যখন আছে, তখন এই ডোবাগুলোর মধ্যেও নিশ্চই আছে! আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’ তার কথা শুনে শিউরে উঠল সুজয়। জলায় হাঁটতে হাঁটতে খালি তার মনে হতে লাগল, জলের নীচে তার ডুবে থাকা পায়ে কী যেন জড়িয়ে যাচ্ছে! ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগল সুজয়।

তাদের কাউকে সাপে না-কামড়ালেও একটা দমবন্ধকর ঘটনা কিন্তু সেখানেই ঘটল। এক ঘণ্টা পর জলাটা তখন প্রায় পার হয়ে এসেছে। চোখে পড়ছে ওপাশের গহীন অরণ্য। সুজয়ও মনে মনে ভাবছে, ‘যাক, সাপের ফাঁড়াটা কেটে গেল!’ ঠিক এমন সময় লাঠির আগায় বসা কনডোরটা হঠাৎ কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল জলার এক দিকে তাকিয়ে। সুজয়রা তখন কোমর সমান পাঁক জলে। পাখির চিৎকার শুনে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লেন ইনকা পুরোহিত। তার পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল অন্যরাও। চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে ইল্লাপার দৃষ্টি এসে থেমে গেল এক জায়গাতে। পাখিটাও তাকিয়ে আছে ও দিকেই। ইল্লাপার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুজয়রাও তাকাল সে দিকে। সুজয় দেখতে পেল তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে একটু কোনাকুনি ডোবার জলে ভাসছে একটা শ্যাওলা মাখা গাছের গুঁড়ি। একটু ভালো করে লক্ষ করার পর সুজয়ের মনে হল গুড়িটা যেন ভাসতে ভাসতে তাদের দিকেই আসছে। হঠাৎ ইল্লাপা সেটা দেখিয়ে চাপা স্বরে কি যেন বললেন। সুজয়দের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রাইফেলধারীকে। সে লোকটাও তাকিয়ে ছিল সে দিকেই। ইনকা পুরোহিতের কথা কানে যাওয়া মাত্রই লোকটা দ্রুত তার রাইফেলটা খুলে নিল তার কাঁধ থেকে, তারপর সেই গাছের গুঁড়িটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিল! গুলির শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক! কনডোরটা ভয় পেয়ে কর্কশ একটা ডাক ছেড়ে উড়ে গেল। গুলিটা সম্ভবত গাছের গুড়ির গায়ে লাগল না। তার পাশের একটু জল ছিটকে উঠল। কিন্তু তার পরমুহূর্তেই সেই গাছের গুঁড়িটা একটু নড়ে উঠে মাথা তুলল। সুজয়রা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার তুলনায় প্রাণীটা যেখানে রয়েছে সেখানকার জল মনে হয় কম। কারণ, তার সামনের দুটো পায়ে ভর দিয়েই সম্ভবত মাথা তুলে সুজয়দের দেখছে সে। একটা চ্যাপটা ধরনের মুখঅলা কুমির! বিল সুজয়দের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘কেম্যান!’

মুহূর্ত মাত্র সময়ের ব্যবধান। এর পরের গুলিটা চালাল হুইকো। অব্যর্থ লক্ষ্য, গুলিটা গিয়ে বিঁধল প্রাণীটার টাগরাতে! তার পরমুহূর্তেই সেখানকার জলে তোলপাড় শুরু হল। লাল হয়ে উঠল সেখানকার জল। সুজয়রা দেখতে পেল আরও বেশ কয়েকটা সবুজ গুঁড়ি প্রথমে ভেসে উঠল যে জায়গাতে জল ছিটকাচ্ছে তার আশেপাশে। তারপর তারা দ্রুত এগিয়ে গেল সেই হতভাগ্য কেম্যানটার দিকে! প্রচন্ড একটা হুড়োহুড়ি শুরু হল জলের মধ্যে। আকাশের দিকে ছিটকে উঠতে লাগল জল। ইল্লাপা আর সময় নষ্ট করলেন না। সুসানকে কাঁধে নিয়ে তিনি দ্রুত এগোতে লাগলেন ডাঙার দিকে। সতীর্থর মাংস দিয়ে ভোজ সারতে লাগল ক্যেমানগুলো। এর কিছু কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাঙায় উঠে এল সবাই।

সুজয়দের সারাদেহ জল-কাদায় মাখামাখি। জঙ্গলের চেয়ে জলা পার হতে যেন অনেক বেশি পরিশ্রম হল তাদের। ওপরে উঠেই ভেজা অবস্থায় মাটিতে বসে পড়লেন পিনচিও আর মার্কেজ। কনডোরটা আকাশে চক্কর কাটছিল। সে আবার এসে বসল লাঠির মাথায়। সুজয় ক্যেমানের ঘটনাটা ঘটার পর পাখিটার ব্যাপারে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে, কনডোরটা নিছকই ইল্লাপার শখের পোষ্য নয়, লাঠির মাথায় বসে পাখিটা নজরদারেরও কাজ করে। শকুনজাতীয় পাখিদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়, বহুদূরের জিনিস দেখতে পায় তারা।

সুজয়ও ক্লান্তিতে মাটিতে বসে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু ইনকা পুরোহিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সূর্য ডুবতে দেরি আছে এখনও। থামলে চলবে না।’ অগত্যা বসা হল না সুজয়দের। ইল্লাপা সুসানকে নামিয়ে দিলেন লামার পিঠে। তারপর ঘাস-জমি ভেঙে এগোলেন জঙ্গলের দিকে। আর তার পিছনে অন্যরা।

এ বনও আগের মতোই গহীন। চারপাশে মহাবৃক্ষরাজি, গাছের মাথার ওপর থেকে নেমে আসা বড়ো বড়ো লতা, ঝোপঝাড়। তবে একটা পার্থক্য আছে। নদী পার হবার আগে বনের ভিতর অবিশ্রান্তভাবে নানা পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিল তারা, কিন্তু এ অরণ্য যেন একদম নিঃঝুম, নিঃশব্দ। ঘণ্টাখানেক চলার পরও কোনো পশুপাখি চোখে পড়ল না। অবশেষে এক সময় সূর্য ঢলে পড়ল। জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা মতন জায়গাতে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিলেন ইল্লাপা। তাঁবু খাটানোর সঙ্গে সঙ্গেই পরিশ্রান্ত দেহে সুজয়রা গিয়ে ঢুকল তাঁবুর মধ্যে। তারপরই তারা শুয়ে পড়ল।

রাতে খাওয়া সেরে তাঁবুর বাইরে এল বিল আর সুজয়। একটু দূরে বিরাট অগ্নিকুন্ডের কাছে বসে কথা বলছেন পিনচিও আর হুইকো।

সুজয়রা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই পিনচিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রফেসর কই? শুয়ে পড়লেন?’

অগ্নিকুন্ডের পাশে বসার পর সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ, বৃদ্ধ মানুষ, ওঁরই বেশি পরিশ্রম হচ্ছে!’

বিল সুজয়ের পাশে বসে হুইকোকে বলল, ‘এই জঙ্গলের শেষেইতো মাচাকুয়ে নদী, তাই না?’

হুইকো বলল, ‘হ্যাঁ। তবে যাবার পথে আমরা কিন্তু থামব না, সোজা নদী পেরব। আমি যেখানে কোরাকেঙ্কু দেখেছিলাম, সে জায়গা নদীর পাড় ধরে বেশ কিছুটা উত্তরে। ইনকা নগরী দেখে ফেরার পথে আমি সেখানে নিয়ে যাব।’

বিল বলল, ‘জায়গাটা তুমি চিনতে পারবে তো?’

‘হ্যাঁ, পারব।’ জবাব দিল হুইকো।

চারপাশে তাকাল সুজয়। ইল্লাপা মনে হয় তাঁবুর ভিতরে। তাকে দেখা গেল না। কিছুদূরে অগ্নিকুন্ডের পাশে জটলা করছে তিনজন বন্দুকধারী। আর যার লামা পিরানহার পেটে গেছে সেই লোকটা একপাশে হাঁটুতে মুখগুঁজে বসে আছে। বুড়ো লামাঅলা মনে হয় তার লামার শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি! সারাটা পথ সে চুপচাপ সবার পিছনে হেঁটেছে।

কিছুক্ষণ অগ্নিকুন্ডের ধারে বসে থাকার পর বিল সুজয়কে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ, মেঘ ডাকছে। রাতে মনে হয় বৃষ্টি নামবে।’ সুজয়ও এবার শুনতে পেল গুরু গুরু মেঘ গর্জনের শব্দ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। সে বলল, ‘হ্যাঁ, পাচ্ছি!’

তাদের কথা শুনে হুইকো বলল, ‘আপনারা যাকে মেঘ গর্জনের শব্দ ভাবছেন, তা আসলে অসভ্য উপজাতিদের ঢাকের শব্দ। জঙ্গলে যে বাইরের মানুষ প্রবেশ করেছে তা টের পেয়েছে ওরা। তাই ঢাক বাজিয়ে তাদের অন্য সঙ্গীদের বার্তা পাঠাচ্ছে। এ ভাবেই জঙ্গলে খবর আদান-প্রদান চলে!’

বিল প্রশ্ন করল, ‘ওরা কি আমাদের আক্রমণ করতে পারে?’

হুইকো তার পাশে মাটিতে নামিয়ে রাখা রাইফেলটা তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, পারে। যদি ওদের মনে হয় আমরা ওদের ক্ষতি করতে এসেছি, অথবা যদি ওদের আমাদের চামড়ার দরকার হয়।’ শেষের কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসল সে।

‘আমাদের চামড়ার দরকার হয়’ ‘মানে?’ বিল জানতে চাইল।

হুইকো জবাব দিল, ‘ওরা মানুষের চামড়া দিয়ে এক ধরনের ঢাক বানায়, তার নাম ‘রুনটিনি।’ ওরা এত সুন্দর মানুষের গায়ের চামড়া ছাড়ায় যে তা শুকিয়ে বোতাম লাগিয়ে জামার মতো গায়ে দিতে পারবেন।’

বিল আর সুজয় চমকে উঠল তার কথা শুনে।

মার্কেজ এবার তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তবে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। ইল্লাপা বলে দিয়েছেন আমাদের লোকেরা বন্দুক নিয়ে রাত জেগে তাঁবুর বাইরে পাহারা দেবে।’

মার্কেজের থেকে বিদায় নিয়ে এরপর তাঁবুতে ফিরে গেল সুজয়রা। প্রফেসর আর সুসান আগেই শুয়ে পড়েছে। তারাও ফিরে শুয়ে পড়ল। বিল ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু সুজয়ের ঘুম এল না। তার মনে হতে লাগল বাইরের সেই ঢাকের শব্দ যেন ক্রমশই বেড়ে চলেছে! পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সব দিক থেকেই যেন গুরু গুরু-দ্রিমিদ্রিমি শব্দ ভেসে আসছে! তারা অনেকে যদি একসঙ্গে আক্রমণ করে তাহলে চারটে রাইফেল কি তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে?—এসব কথা ভাবতে ভাবতে সুজয়ও একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুজয়ের। মনে হল, কে যেন মৃদু ধাক্কা দিচ্ছে তাকে। তাহলে কি সেই অসভ্য জাতিরা তাঁবু আক্রমণ করতে এসেছে? কম্বল মুড়ি দিয়ে উঠে বসল সুজয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মূর্তি। তাকে চিনতে পরল সুজয়, তাদের সঙ্গে আসা বুড়ো লামাঅলাটা! সুজয় তার দিকে তাকাতেই লোকটা তাঁবুর বাইরে একবার তাকিয়ে নিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল তাকে। সুজয় শুয়েছিল তাঁবুর দরজার কাছাকাছি। তারপর অন্যরা সার বেঁধে শুয়ে আছে। বুড়ো লোকটা হাঁটু মুড়ে সুজয়ের পাশে বসল। তারপর সুজয়ের কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে কী যেন বলতে শুরু করল। সে ভাষার বিন্দুবিসর্গ বোধগম্য হল না তার। সুজয় প্রফেসরকে ডাকতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় তাঁবুর বাইরে কার যেন গলার শব্দ শোনা গেল। সেই শব্দ কানে যেতেই বুড়োটা কথা বন্ধ করে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর তাঁবুর বাইরেটা উঁকি মেরে একবার দেখে, সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘুম চোখে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আবার শুয়ে পড়ল সে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *