৭
ভোরবেলা যখন ঘুম ভেঙে সুজয় তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল তখন পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়েছে মাচুপিচুর বুকে। ঝলমল করছে নীল আকাশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা তুষারধবল শৃঙ্গরাজি। তবে পুবদিকের সেই অরণ্যের মাথা এখনও কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা। ওই অরণ্যতেই আজ প্রবেশ করতে হবে সুজয়দের। ওই কুয়াশার চাদরের নীচে তাদের জন্য কত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে!’ সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল সুজয়।
সুজয়ের আগেই ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছেন প্রফেসর মার্কেজ, বিল, এমনকি সুসানও। তাঁবুর কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছিল। সবার শেষে ঘুম ভাঙায় মনে মনে একটু লজ্জা পেল সে। প্রফেসর তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গুড মর্নিং। আশা করি ভালো ঘুম হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। ইনতিহুয়ানাতা পর্যন্ত আমাদের মালপত্র নিজেদেরই টেনে নিয়ে যেতে হবে, তাই একটু আগেই বেরোব আমরা।’ সুজয়ের রিস্টওয়াচে ঠিক ছ-টা বাজে। সময়টা দেখে নিয়ে সুজয় বলল, ‘আমার তৈরি হতে ঠিক দশ মিনিট সময় লাগবে’।
মার্কেজ হেসে বললেন, ‘অত তাড়াতাড়ির দরকার নেই, সাড়ে ছ-টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলেই হবে।’ সুজয় বলল, ‘আচ্ছা’।
ঠিক সাড়ে ছ-টার সময় তাঁবু ছেড়ে মালপত্র নিয়ে ইনতিহুয়ানাতা চত্বরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল সকলে। জিনিসপত্র নিয়ে পাহাড়ের খাঁজ বেঁয়ে, সঙ্কীর্ণ পাথুরে ধাপে পা ফেলে ওপরে উঠতে বেশ কষ্টই হল সুজয়দের। তারা যখন ইনতিহুয়ানাতা চত্বরে পৌঁছোল তখন তাদের চোখে পড়ল ইনতিহুয়ানাতার ঠিক নীচে পিনচিও আর হুইকো দাঁড়িয়ে আছে ইনকা পুরোহিত ইল্লাপার সঙ্গে। তাদর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক আর একদল লামা।
সুজয়রা তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পিনচিও বললেন, ‘গুড মর্নিং প্রফেসর। আমরা আগেই চলে এসেছি। আপনাদের মালপত্রগুলো এবার চটপট তুলে ফেলতে হবে প্রাণীগুলোর পিঠে। আমাদেরগুলো বাঁধা হয়ে গেছে।’ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইল্লাপা একটা কথাও বললেন না। তিনি নির্লিপ্তভাবে একবার সুজয়দের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে তাকালেন সামনের পাথুরে মাটির দিকে। ইনতিহুয়ানাতার একটা আবছা ছায়া এসে পড়েছে সে জায়গাতে। পাথুরে মাটিতে সে জায়গাতে পর পর কতগুলো সরলরেখা আঁকা, আর একটা লাঠি শোয়ানো আছে সেখানে। সুজয়ের মনে হল সূর্যঘড়িতে সময় দেখছেন ইল্লাপা।
মোট পাঁচটা ভারবাহী লামা, আর চারজন স্থানীয় পোশাক পরা লোক। আর সেই সাদা লামার বাচ্চাটাও আছে। লোকগুলোর মধ্যে একজন বেশ শক্তপোক্ত, আর একজন বেশ বৃদ্ধ। তিনটে লামার পিঠে ইতিমধ্যেই মালপত্র বাঁধা। পিনচিওর নির্দেশে কিছুক্ষণের মধ্যেই হুইকো, আর একজন লোক সুজয়দের মালপত্র দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল অন্য দুটো লামার পিঠে।
বাঁধাছাঁদা শেষ হবার পর মার্কেজ, পিনচিওকে বললেন, ‘সাতটাতো প্রায় বাজে, আমরা কি তাহলে এখনই রওনা হচ্ছি?’
পিনচিও ইল্লাপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সূর্যঘড়িতে সাতটা বাজলেই রওনা হব আমরা।’
ইল্লাপা তখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইনতিহুয়ানাতার ছায়ার দিকে। সে তাকানোর অর্থ এবার বুঝতে পারল সুজয়।
বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর ইনকা পুরোহিত হঠাৎ সূর্যের দিকে মুখ তুলে বিড় বিড় করে কী যেন বলতে শুরু করলেন। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। মার্কেজ চাপা স্বরে সুজয়ের কানের কাছে বললেন, ‘যাত্রা শুরুর আগে সূর্যস্তুতি করছে ইনকা পুরোহিত। মিনিট পাঁচেক মন্ত্রোচ্চারণের পর মাটি থেকে লাঠিটা তুলে কাঁধে রাখলেন ইল্লাপা। সুজয়রা কেউই খেয়াল করেনি, ইল্লাপার পোষা সেই কনডোরের বাচ্চাটা এতক্ষণ বসেছিল ইনতিহুয়ানাতার মাথায়। তিনি লাঠিটা কাঁধে ফেলে মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করতেই পাখিটা ওপর থেকে উড়ে নীচে নেমে এসে বসল লাঠিটার মাথার কাছে এক জায়গাতে। আর তারপরই ইঙ্গিতে সবাইকে তাঁকে অনুসরণ করতে বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন ইনকা পুরোহিত। সুজয়ের ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে চার। সবাই এবার ইল্লাপার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। প্রথমে ইনকা পুরোহিত, তারপর পিনচিওসহ সুজয়রা, আর সব শেষে লামার বাচ্চা আর ভারবাহী লামাগুলোকে নিয়ে অন্য লোকগুলো। যেতে যেতে সুজয় মার্কেজকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার ঘড়ির সাথে সূর্যঘড়ির মিনিট চারেক সময়ের পার্থক্য হল কেন?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘ইনতিহুয়ানাতা তৈরি হয়েছিল সাড়ে পাঁচশো বছর আগে। এই সাড়ে পাঁচশো বছরে সূর্য ও পৃথিবীর গতিপথের যে পরিবর্তন হয়েছে তার জন্য সময়ের ওই পার্থক্য।’
ইনতিহুয়ানাতা চত্বর ছেড়ে পূব দিকের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল সুজয়রা। সুসান চলেছে সুজয়ের হাত ধরে। সে জানতে চাইল আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
সুজয় তাকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘আমরা যাব ওই জঙ্গলে।’ সুসান আবার প্রশ্ন করল, ‘কী আছে ওই জঙ্গলে?’
সে জবাব দিল, ‘এ রকম একটা পুরোনো শহর আছে ওই জঙ্গলের মধ্যে। আমরা সেটা দেখতে যাচ্ছি। তা ছাড়া জঙ্গলের মধ্যে নানা রকম পশুপাখি আছে। তাদেরও নিশ্চই দেখতে পাব আমরা।’
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একসময় সুজয়রা নীচে নেমে এল। তারপর উপত্যকা রেখে হাঁটতে শুরু করল পূবের জঙ্গলের দিকে। ক্রমশই কাছে এগিয়ে আসতে লাগল পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জঙ্গলের প্রবেশমুখ। তারা যখন সে জায়গাতে পৌঁছোল তখন প্রায় এক ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আসলে মাচুপিচুর ওপর থেকে জঙ্গলটা যত কাছে মনে হচ্ছিল আসলে তা ততটা কাছে নয়। জঙ্গলের প্রবেশমুখে একটা ছোট্ট চেকপোস্ট। ফরেস্ট গার্ডরা তাদের পথ আটকাতেই পিনচিও পকেট থেকে আগের দিনের সেই কাগজটা বের করে তুলে দিলেন অফিসার গোছের লোকের হাতে। সেই অফিসার একবার কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভ্রুকুঁচকে সুজয়দের দিকে তকিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর মার্কেজ কোন জন?’ মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘এই যে আমি।’
অফিসার একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। তারপর প্রশ্ন করল, ‘এসব লোকজন সবাই আপনার সঙ্গেই যাচ্ছে! গাইড কে?’
মার্কেজ জবাব দেবার আগেই হুইকো বলে উঠল, ‘আমরা সবাই ওনার লোকজন, আর আমি হলাম গাইড।’ এই বলে সে পকেট থেকে তার পরিচয়পত্র গোছের কিছু একটা বার করে এগিয়ে গেল অফিসারের দিকে। অফিসার এরপর হুইকোকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে কী সব জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। মিনিট তিনেক তারা কথাবার্তা বলার পর হুইকো ফিরে এসে বলল, ‘কাগজ ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের মালপত্র খুলে পরীক্ষা করতে চাইছে ও। বিশেষত ওই লম্বা কাঠের বাক্সগুলো। ওর ধারণা ওর মধ্যে আপত্তিকর কিছু থাকতে পারে।’
হুইকোর কথা শুনে কেমন যেন চুপসে গেলেন পিনচিও। একটা লামার পিঠে বেশ লম্বা ধরনের দুটো পালিশ করা কাঠের বাক্স ঝোলানো আছে। একজন বেশ শক্তপোক্ত পেরুভিয়ান সেই লামাটার লাগাম ধরে পথ চলছে। সুজয় লক্ষ করল, সে তার পাশের সঙ্গীকে চাপাস্বরে কী যেন বলল।
ইল্লাপা দাঁড়িয়ে ছিলেন একটু দূরে একটা গাছের ছাওয়াতে। এবার তিনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন সুজয়দের কাছে। এতক্ষণ তাঁকে মনে হয় খেয়াল করেননি সেই ফরেস্ট অফিসার। ইল্লাপাকে দেখে তিনি যেন কেমন চমকে উঠলেন! ইল্লাপা, কী হয়েছে তা জেনে নিলেন হুইকোর কাছে, তারপর সেই অফিসারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলল! তাঁর কথা শোনার সাথে সঙ্গেই কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন সেই পেরুভিয়ান অফিসার। সুজয়ের মনে হল, জাঁদরেল চেহারার অফিসারটি যেন ভয় পেয়ে গেলেন। এরপর তিনি তার সঙ্গী ফরেস্ট গার্ডদের সুজয়দের পথ ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন, মালপত্র পরীক্ষা করার কোনো কথা আর মুখে আনলেন না তিনি। তাদের পাশ কাটিয়ে ইল্লাপা সকলকে নিয়ে প্রবেশ করলেন জঙ্গলের পথে, এগোতে এগোতে সুজয় মার্কেজকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইনকা পুরোহিত এমনকি বলল, যে ফরেস্ট গার্ডরা ভয় পেয়ে গেল?’ মার্কেজ বললেন, ‘ইল্লাপা বললেন, ও সব তাঁর জিনিস। তাঁর সময় নষ্ট করলে করিকানচার পুরোহিত তাঁকে অভিশাপ দেবেন। অফিসার হলেও লোকটাতো পেরুভিয়ান, অভিশাপ-টভিশাপে ওরা বিশ্বাস রাখে, তাই ভয় পেয়ে পথ ছেড়ে দিল।’
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল তারা। প্রথমে ঝোপঝাড়, একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো বড়ো গাছ, জমি কখনও উঁচু, কখনও নীচু। তারপর এক সময় চারপাশের বনজঙ্গল যেন ঘন হয়ে চেপে ধরতে শুরু করল তাঁদেরকে। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ধীর পায়ে চলতে লাগল তারা। গাছের মাথার ওপর থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে, কিন্তু তাদের চোখে দেখা যাচ্ছে না। ইল্লাপা সবার আগে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন।
ঘণ্টাখানেক চলার পর একসময় সুজয়রা সত্যিই প্রবেশ করল গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে যে দিকেই তাকানো যায় সেদিকেই বিরাট বিরাট গাছ। অনেক ওপরে তাদের ডালপালাগুলো চাঁদোয়ার মতো আকাশকে ঢাকার চেষ্টা করছে। বিলের বনজঙ্গল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে। তাই মার্কেজ তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাজনের জঙ্গল কি এর চেয়ে বেশি ঘন?’
বিল বলল, ‘এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি ঘন। এখানেতো তাও পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো কিছু হলেও আসছে। সেখানে একদম নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।’ তবে এ জঙ্গলের ভিতরটা কেমন, এখনই তা বলা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় এখনও বাফার এলাকাতেই আছি কোর এলাকাতে ঢুকিনি।’
মার্কেজও বিলের কথাবার্তা শুনে পিনচিও বললেন, ‘কোর এলাকা মানে?’
বিল বলল, ‘সে-সব জায়গাতে রাস্তা এত ঘন থাকে যে অনেক সময় জঙ্গল কেটে রাস্তা বানিয়ে এগোতে হয়। ঠাস বুনোট গাছের ফাঁক দিয়ে মাছিও গলতে পারে না আর কোর এলাকার বাইরের অঞ্চল হল বাফার।’
সুজয় বলল, ‘এই বাফার এলাকাতে জন্তুজানোয়ার থাকে না?’
সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চই আছে। আমাদের চোখে পড়ছে না। জন্তুজানোয়ারেরা তাদের স্বভাব অনুযায়ী জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গাতে বাস করে।’ এসব নানা কথা আলোচনা করতে করতে এগোতে লাগলেন তারা। শুধু ইল্লাপাই নিশ্চুপভাবে সুজয়দের কয়েক হাত তফাতে নিজের মনে হেঁটে চললেন। মাঝে মাঝে মিনিট দশেকের বিশ্রাম, তারপর আবার হাঁটা। একসময় সুসান আর হাঁটতে পারছিল না। থামতে হল সুজয়দের। সমস্যার সমাধান করে দিল লামা নিয়ে যারা চলছিল তাদের মধ্যে বৃদ্ধ লোকটা। এমনিতে লামার পিঠে ঘোড়ার মতো বসা যায় না। সে লামার পিঠে ঝুলন্ত মালপত্রের খাঁজে বসিয়ে দিল সুসানকে। তারপর শুরু হল পথ চলা। দু-পাশের জঙ্গল ক্রমশই আরও ঘন হয়ে উঠছে। সুজয়ের মনে হল তারা যেন প্রবেশ করছে এক আদিম পৃথিবীতে। কী বিশাল মোটাসোটা গাছের গুঁড়ি, সেইসব আদিম মহাদ্রুম যেন ঊর্ধ্বে উঠে আকাশকে ছুঁতে চাইছে। আর গাছের গুঁড়িগুলোকে ঘিরে রয়েছে মানুষ সমান উঁচু ঝোপঝাড়। তার মধ্য দিয়েই চলছে সকলে।
জঙ্গলে প্রবেশের পর যে প্রাণীটা প্রথম চোখে পড়ল সেটা একটা ‘শ্লথ’। সুজয়দের যাত্রাপথের পাশে একটা মোটা গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ঝুলছিল প্রাণীটা। তার ঝুলন্ত রোমশ লেজটা প্রথম চোখে পড়ল বিলেরই। প্রাণীটাকে ভালো করে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল সুজয়রা। খয়েরি-সাদা ফুট তিনেকের প্রাণীটাও ঘাড় ফিরিয়ে তার গোলগোল সবুজ চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা দু-পেয়ে জীবগুলোর দিকে। তারপর শ্লথ গতিতে পাতার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ততক্ষণে অবশ্য পেশাদারি দক্ষতায় তার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে বিল। এরপর আবার হাঁটা।
বেলা বারোটা নাগাদ দুপুরের খাবার জন্য থামল সুজয়রা। শুকনো খাবার আর জল দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সারা হল। সুজয়দের সঙ্গে সঙ্গে লামা নিয়ে চলা লোকগুলো খাওয়া সারলেও ইনকা পুরোহিত কিন্তু কিছুই ছুঁলেন না। একটা শোয়ানো গাছের গুঁড়ির ওপর বসে, তিনি লক্ষ করতে লাগলেন সুজয়দের। হুইকো হিসাব করে বলল, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত খুব বেশি হলে মাইল পনেরো এগিয়েছে তারা। মার্কেজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ আরও কতটা পথ হাঁটব আমরা?’
হুইকো জবাব দিল, ‘এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা নদী আছে, তার নাম ‘কোচা’ নদী। পুরোহিত বলেছেন ওই নদী পর্যন্ত আজ যাব আমরা।
বিল প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা সেই মাচাকুয়ে নদীটা কোথায়?’
হুইকো বলল, ‘সে এখনও অনেক দূরের পথ। কোচা নদীর ওপারে বিরাট বন। তারপর পড়বে একটা জলা। তারপর আবার জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে মাচাকুয়ে নদী। পরশু দুপুরের আগে সেখানে আমরা পৌঁছোতে পারব না। ইল্লাপা যাবেন মাচাকুয়ে নদী পার হয়ে ওপারের জঙ্গলে।’
তার কথা শুনে মার্কেজ বললেন, ‘কুয়েচুয়া ভাষায় ‘মাচাকুয়ে’ শব্দের অর্থতো ‘সাপ’ তাই না? সে নদীতে কি অনেক সাপ আছে?’
‘বিষধর সাপ?’ মার্কেজের প্রশ্নের সাথে সাথেই হুইকোকে প্রশ্ন করলেন পিনচিও।
হুইকো উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ সাপ আছে, তবে তারা বিষধর নয়।’
তার উত্তর শুনে পিনচিও হেসে বললেন, ‘বিষধর যখন নয়, তখন আর তেমন ভাবনার কিছু নেই আমাদের। কি বলুন?’—এই বলে তিনি তাকালেন বিলের দিকে।
বিল কিন্তু হুইকোর কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকে প্রশ্ন করল, ‘বিষধর’ নয়তো তারা কী সাপ?’
তার প্রশ্ন শুনে হুইকোর এক চোখের দৃষ্টি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে এরপর সে জবাব দিল,—‘অ্যানাকোণ্ডা।’ ‘অ্যানাকোণ্ডা!’—মানে পৃথিবীর বৃহত্তম সাপ! যে শিকারকে পিষে মারে?’—হুইকোর কথা শুনে বিস্ময়ে বলে উঠল সুজয়।
হুইকো মুখে কোনো কথা না-বলে শুধু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়াল। কারণ, ইনকা পুরোহিত ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুজয়রা আবার দ্বিতীয় দফার যাত্রা শুরু করল।
অরণ্যের মধ্যে দিয়ে শুধু চলা আর চলা। চারপাশে খালি গাছের গুঁড়ির প্রাচীর। একধরনের গাছ প্রায়ই জঙ্গলের মধ্যে চোখে পড়ছে। ঋজু গাছগুলোর গুঁড়ি শাখাহীন ভাবে ওপরে উঠে যাবার পর ডালপালার চাঁদোয়া বিস্তার করেছে। সুজয় হুইকোকে জিজ্ঞেস করল, ‘এগুলো কি গাছ?’ সে উত্তর দিল, ‘এ গাছের নাম ‘বালসা।’ এ গাছের গুঁড়ি খুব মজবুত আর হালকা হয়। জলে শোলার মতো ভাসে। নৌকা তৈরি হয় এ গাছের কাঠ দিয়ে।’ তার কথা শুনে মার্কেজ বললেন, ‘এ তো বিখ্যাত গাছ! বইতে এ গাছের কথা পড়েছিলাম, আজ তাহলে চোখে দেখলাম! ষোলোশো বছর আগে ইনকাদের পূর্বপুরুষরা কনটিকির নেতৃত্বে এই বালসা কাঠের সামান্য ভেলায় চেপে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি অতিক্রম করে পেরু থেকে সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে পলিনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়ে ছিলেন।’
বিল জানতে চাইল, ‘কনটিকি কে?’
মার্কেজ উত্তর দিলেন, ‘‘ইনকা কাহিনি অনুযায়ী ‘কনটিকি ছিলেন সূর্যদেব ইনতির পুত্র। তবে তিনি মানুষরূপে পেরুদেশে জন্মেছিলেন।’
সুজয় জিজ্ঞেস করল, ‘এ ঘটনা কি সত্যি? সামান্য কাঠের ভেলায় চেপে সাড়ে চার হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে ছিল তারা?’
চলতে চলতে মার্কেজ বললেন, ‘‘কনটিকি বলে সত্যি কেউ ছিলেন কিনা ইতিহাসে কোনো প্রমাণ না-মিললেও পেরুবাসীদের পূর্বপুরুষরা যে সমুদ্র অতিক্রম করে সুদূর পলিনেশিয়ায় পৌঁছে ছিলেন তার সমর্থনে ঐতিহাসিক যুক্তি আছে। পেরুতে কোনো কোনো জায়গাতে পাথরের তৈরি তিন-চার তলা উঁচু মানুষের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। হুবহু একই রকমের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় পলিনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপেও।’
এরপর তিনি সুজয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত লেখক ‘থর হেইয়েরডাল’-এর কালজয়ী একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি আছে, ‘কনটিকি এক্সপিডিশান’, সম্ভব হলে দেশে ফিরে পড়ে নেবেন।’
লামার সঙ্গের লোকগুলো কেমন যেন নির্বাক প্রকৃতির। ইনকা পুরোহিতের মতো তাদের মুখেও কোনো কথা নেই। সুসান যে লামার পিঠে বসে আছে, সেই লামার লাগাম ধরে সেই বৃদ্ধ লোকটা চলছে সুজয়দের পাশেপাশেই। আর তার অন্য সঙ্গীরা চলছে সুজয়দের পিছনে। সুসানও লামার পিঠে বসে চারপাশের এই অজানা পৃথিবীকে দেখতে দেখতে চলেছে। সুজয় একসময় তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার লামার পিঠে চড়তে কেমন লাগছে সুসান?’
সে জবাব দিল, ‘ভালো।’ এরপর সে বলল, ‘সেই যে কখন একটা শ্লথ দেখলাম, তার পরতো কিছুই আর দেখতে পেলাম না!’
সুসানের কথাটা মনে হয় কানে গেছিল বনদেবতার। কারণ, সুসানের একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যে সুজয়রা দেখতে পেল একটা ‘টেপির!’ বেশ বড়ো আকারের প্রাণীটা এটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে সুজয়দের পথ আগলে দাঁড়াল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে যেন তাদের দেখে বিস্মিত ভাবে একবার বলল, ‘তোমরা বাপু কোথা থেকে উদয় হলে এ জঙ্গলে?’ আর তার পর মুহূর্তেই বিলকে তার ছবি তোলার সুযোগ না-দিয়ে উলটো দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
হুইকো বিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘাবড়াবেন না, এ বনে টেপির অনেক আছে। আবার তাদের দেখা মিলবে।’
সুজয়দের এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মাথার ওপর ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যদেবও পশ্চিমে হাঁটতে লাগলেন। অবশেষে বিকাল পাঁচটা নাগাদ জঙ্গলের মধ্যে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় পৌঁছে ইনকা পুরোহিত ইঙ্গিত দিলেন যাত্রা এ দিনের মতো সাঙ্গ করার। সুজয়ের পা যেন আর চলছিল না। যাত্রা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটিতে বসে পড়ল। সুসান লামার পিঠ থেকে নামার পর তাকে নিয়ে বসে পড়লেন মার্কেজ, পিনচিও আর বিলও। হুইকো বসল না। সে লেগে গেল লামাগুলোর পিঠ থেকে মালপত্র নামানোর তদারকির কাজে। আর ইল্লাপা তাঁর লাঠির মাথা থেকে কনডোরের বাচ্চাটাকে নামিয়ে তাকে একটা গাছের ডালে বসিয়ে দিয়ে নিজে বসলেন একটা শুয়ে থাকা গাছের ওপর।
কিছুক্ষণের মধ্যে মালপত্র সব নামানো হয়ে গেল। তারপর খাটানো হল তিনটে তাঁবু। একটা বড়ো, অন্য দুটো ছোটো। পিনচিও জানালেন বড়ো তাঁবুটা বরাদ্দ সুজয়দের জন্য। আর অন্য দুটোর একটায় থাকবেন তিনি আর হুইকো, অপরটাতে থাকবেন ইনকা পুরোহিত। লামাঅলাদের জন্য কোনো তাঁবুর ব্যবস্থা নেই। তারা রাত কাটাবে খোলা আকাশের নীচে।
মালপত্র প্রাণীগুলোর পিঠ থেকে নীচে নামাবার পর প্রাণীগুলোকে ছেড়ে দিয়ে তাদের মালিকরা শুকনো ডালপাতা সংগ্রহ করতে লেগে গেল রাতের আগুন জ্বালাবার জন্য। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বিল সুজয়দের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এবার উঠে পড়ো। অনেক পথ হেঁটেছি তো, বেশিক্ষণ এখন বসে থাকলে পায়ের মাংসপেশিতে খিঁচ ধরে যাবে, কাল সকালে আর হাঁটতে পারবে না। বিলের কথা শোনার পর উঠে দাঁড়াল সবাই, তারপর গাছের গুঁড়ির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গাটাতে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল, দিন শেষ হতে চলেছে। দিনান্তের রং ধরেছে গাছের পাতায়। বনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক, যদিও তাদের চোখে দেখা যাচ্ছে না। ঝিঁঝির ডাকও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে। অন্ধকারের আবাহনী গীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। সুসানও ঘুরে বেড়াচ্ছিল নিজের মতো করে। সুজয়দের কাছ থেকে কিছুটা দূরে চলে গেছিল সে, হঠাৎ সুজয়ের চোখে পড়ল, একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ইশারায় সে তাদের ডাকছে, আর মাঝে মাঝে গাছের ওপর দিকে তাকাচ্ছে। নিশ্চই কিছু দেখতে পেয়েছে সে! সুজয়, বিল আর মার্কেজ তার কাছে এগিয়ে যেতেই সুসান গাছের মাথার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘দ্যাখো কী বিরাট পাখি!’ তার কথা শুনে ওপর দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সুজয়রা। দিনের সেরা চমক যেন তাদের জন্য যেন এখানেই অপেক্ষা করেছিল। এত বড়ো পাখি সুজয় জীবনে এই প্রথম দেখল। গাছের ডালে বসে থাকা বর্ণময় পাখিটার দৈর্ঘ্য অন্তত পাঁচফুট হবে। তার মাথা, পিঠ, আর দীর্ঘ লেজ উজ্জ্বল লাল বর্ণের। ডানার হলুদ বর্ণের পালকের শেষে সমুদ্রের ঘন নীল, চোখের চারপাশে সাদা রিং। বিরাট ঠোঁটের গঠন টিয়া পখির মতো! শক্তপোক্ত পা দিয়ে গাছের ডালে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে সুজয়দের দেখছে সে। কৌতূহলী দৃষ্টি, তার চোখে ভয়ের কোনো লক্ষণ নেই। শেষ বিকালের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে তার শরীরে এসে পড়ে তাকে যেন আরও বর্ণময় করে তুলেছে। সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে। তারপর বিল চাপা স্বরে বলল, ‘স্কার্লেট ম্যাকাও! প্যারাকিড বা তোতা পরিবারের সবচেয়ে বর্ণময় আর বিরাটাকৃতির পাখি। দক্ষিণ আমেরিকার গভীর জঙ্গল এদের বাসস্থান। আমাজনের জঙ্গলে এ পাখির ঝাঁক আমি দেখেছি। তবে এত কাছ থেকে নয়!’ সুজয় এবার বিলকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি যে পাখি খুঁজতে যাচ্ছ সেই ‘কোরাকেঙ্কু’ কি এর থেকেও সুন্দর হবে?’
ক্যামেরার লেন্সের ক্যাপ খুলতে খুলতে বিল পাখিটার দিকে চোখ রেখে বলল, ‘আমি ঠিক জানি না।’
বিল বেশ কয়েকটা ছবি তুলল পাখিটার, সুজয়ও তুলল তার ছোটো ক্যামেরা দিয়ে। পাখিটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে একইভাবে দেখছে সুজয়দের, আর মাঝে মাঝে ঠোঁট ঘষছে গাছের ডালে।
প্রফেসর বললেন, ‘দেখেছেন, ও কিন্তু আমাদের ভয় পাচ্ছে না!’
বিল বলল, ‘সম্ভবত এ জায়গাতে মানুষের আসা-যাওয়া নেই। ও প্রথম মানুষ দেখছে, তাই ভয় পাচ্ছে না।’ এরপর একটু থেমে বিল বলল, ‘আমার মন বলছে, আমরা যে উদ্দেশ্যে এগোচ্ছি তা সফল হবে।’
‘কেন?’ জানতে চাইলেন মার্কেজ।
বিল জবাব দিল, ‘আপনারা হয়তো মানতে চাইবেন না, কিন্তু আমরা যারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই, শিকারি বা ফটোগ্রাফার যাই হই না কেন, কিছু সংস্কার মেনে চলি। এই স্কার্লেট ম্যাকাও-এর দর্শন সৌভাগ্য বয়ে আনে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে। যে কারণে একসময় পালতোলা জাহাজের জলদস্যুরা এই তোতা তাদের সঙ্গে রাখত।’
সুজয়দের গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহলবশত এরপর পিনচিও, হুইকো, এমনকি ইল্লাপাও এসে দাঁড়ালেন সেখানে। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল পাখিটাকে। তারপর একসময় সন্ধ্যা নেমে আসছে বলেই বোধ হয় পাখিটা একটা ডাক ছেড়ে ডানা ঝাপটিয়ে সুজয়দের চোখের আড়ালে চলে গেল।
গাছের নীচে জটলাটা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেল। সুজয়রা হাঁটতে লাগল তাঁবুর দিকে। সেদিকে ফেরার সময় ইল্লাপা হঠাৎ তার মৌনব্রত ভঙ্গ করে মার্কেজকে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বললেন, তার মধ্যে একটা শব্দ শুধু বুঝতে পারল সুজয়,—‘কোরাকেঙ্কু’। কথাগুলো বলার পর ইল্লাপা এগোলেন যেখানে তিনি বসেছিলেন সেদিকে। তিনি সেদিকে এগোবার পর সুজয় মার্কেজকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইনকা পুরোহিত আপনাকে কী বললেন?’
মার্কেজ বললেন, ‘ইল্লাপা কুয়েচুয়াতে বললেন, ‘এ পাখিটা সুন্দর, কিন্তু স্বর্গীয় পাখি কোরাকেঙ্কুর মতো সুন্দর নয়।’
মার্কেজের কথা শুনে, বিল উৎসাহ প্রকাশ করে বলল, ‘তার মানে, কোরাকেঙ্কুর গল্প মিথ্যা নয়! ইনকা পুরোহিতও দেখেছেন সেই পাখি!’ ‘তাঁর কথা শুনে তাইতো মনে হচ্ছে’,—মন্তব্য করলেন মার্কেজ।
সুজয়রা তাঁবুর কাছে ফিরে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল অরণ্যের বুকে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রাম নেবার জন্য সুজয়রা গিয়ে ঢুকল তাদের জন্য নির্ধারিত তাঁবুতে। তাঁবুতে ঢুকেই পোশাক পালটে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজয়ের চোখে ঘুম নেমে এল।
বিলের ডাকে সুজয়ের যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত সাড়ে আটটা বাজে। সুজয় উঠে দেখল অন্যরা সবাই বসে আছে। তাদের চোখ-মুখ দেখে বোঝা গেল তারাও সদ্য ঘুম থেকে উঠে বসেছে। তাঁবুর ভিতর একটা মোম জ্বলছে। খাবার দিয়ে গেছে পিনচিওর লোকেরা। মার্কেজ একটা হাই তুলে সুজয়ের দিকে তাকালেন। তাঁবুর মধ্যে গোল হয়ে খেতে বসল সবাই। রুটি আর ওল জাতীয় জিনিসের তরকারি দিয়ে রাতের খাবার সারা হল সুজয়দের। তারপর সকলে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল।
তাঁবুর একটু দূরেই জ্বলছে বেশ বড়ো একটা অগ্নিকুন্ড। তার কাছে বসে আছেন ইনকা পুরোহিত, পিনচিও আর হুইকো। তারা নিজেদের মধ্যে মনে হয় কথাবার্তা বলছিল। সুজয়রা বাইরে আসতেই তারা কথা থামিয়ে তাকাল তাদের দিকে। চারপাশে অন্ধকার। একটা বিরাট গাছের ঘন ডালপালা আড়াল করে রেখেছে চাঁদটাকে। সেই অন্ধকারের মধ্যে পিনচিওর লোকজন আর লামাগুলো কোথায় রয়েছে তা ঠিক ঠাহর করতে পারল না সুজয়। তাঁবু থেকে বেরোবার পর সুজয়রাও গিয়ে বসল সেই অগ্নিকুন্ডের ধারে, পিনচিওদের মুখোমুখি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সকলে। তারপর মার্কেজ পিনচিওর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কাল সকালে কখন যাত্রা শুরু করব আমরা?’
পিনচিও একবার তার পাশে বসে থাকা ইল্লাপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উনি বলছেন, ‘কাল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হতে হবে আমাদের।’ তাঁর জবাবের পর ইল্লাপা গম্ভীর স্বরে মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কাল যে পথে আমরা এগোব সে পথ দুর্গম। যেকোনো সময় বিপদের সম্ভাবনা আছে। সবাইকে এক সঙ্গে সাবধানে পথ চলতে হবে। আমার নির্দেশ অমান্য করলে বিপদ হতে পারে। বাচ্চা ছেলেটা যেন কোনো সময় চোখের আড়াল না-হয়।’ একথা বলার পর হুইকোকে তিনি বললেন, ‘লামার বাচ্চাটাও সাবধানে রাখতে হবে। ওকে শেষপর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে মার্কেজ বললেন, ‘কালকের যাত্রাপথ কি তাহলে খুবই বিপজ্জনক?’
অগ্নিকুন্ডের ওপাশে উঠে দাঁড়ালেন ইল্লাপা। কয়েক মুহূর্ত তিনি চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘হ্যাঁ, খুবই বিপজ্জনক। জলে-জঙ্গলে হিংস্রপ্রাণীতো আছেই আর আছে তার চেয়েও হিংস্র কিছু উপজাতী গোষ্ঠী। তাদের কেউ কেউ ইনতিকেও মানে না।’ গম্ভীর স্বরে একথা বলার পর ইনকা পুরোহিত এগোলেন তার তাঁবুর দিকে।
সুজয়রা এরপর কিছুক্ষণ অগ্নিকুন্ডের পাশে বসে সারা দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলল। তারপর পিনচিওকে শুভরাত্রি জানিয়ে তাঁবুতে ফিরে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল।