৬
তিন-জানলা চত্বরের কাছেই তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল সুজয়রা। গোল্ডেন ইনকা হোটেল কর্তৃপক্ষ এ জায়গাতেই দুটো তাঁবুতে তাদের রাত কাটাবার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁবুর ভিতরে ঢুকে বিছানাতে শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে সুসান। ঘোড়ায় চেপে আধ ঘণ্টা হল তারা এখানে এসে পৌঁছেছে। সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের ঢালে তার খাঁজে খাঁজে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুরে ঘরবাড়ি-স্তম্ভের মাথায়। এ রকম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত সূর্যাস্ত-সূর্যদেবের সাক্ষী হয়ে আছে মূক-বধির এই স্থাপত্যগুলো! আঁধার ঘনিয়ে আসছে প্রাচীন নগরীর বুকে। ইতিমধ্যে পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া গ্রাস করে নিয়েছে নগরীর একাংশ। সুজয়রা যখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসছিল, তখন এক বৃদ্ধ সহিস তাদের গল্প করছিল যে, রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি জেগে ওঠে এ নগরী, জেগে ওঠে প্রেতাত্মারা! এখানে রাত কাটাতে এসে অনেকেই নাকি দেখেছে দীর্ঘদেহী, মাথায় পালকের টুপি গোঁজা, বর্শাধারী সেইসব প্রাচীন ইনকা পুরুষদের! এমনিতে তাঁরা কাউকে কিছু বলেন না, কিন্তু কখনও তাঁদের পিছু ধাওয়া করতে নেই। একবার নাকি একদল সাহেব-মেমের চোখে পড়েছিল এরকমই এক প্রাচীন ইনকা। ওই দলের এক দুঃসাহসী সাহেব চাঁদের আলোতে পিছু নিয়েছিল তার। পর দিন সেই সাহেবের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ইনতিহুয়ানাতার সামনে। তার ঘাড়টা ছিল ভাঙা। আর তার পাশে পড়েছিল কনডোর পাখির বিরাট বড়ো একটা কালো পালক। যা একসময় নিজেদের মাথায় দিতেন প্রাচীন ইনকা যোদ্ধারা!
—এ রকম আরও বেশ কয়েকটা ঘটনার কথা বলছিল সে। স্থানীয় লোকটার সন্ধ্যার পর এ জায়গার ছাওয়া মাড়ায় না। সন্ধ্যার আগেই তাঁরা নীচে চলে যায়। এখানে যে প্রেতাত্মারা বাস করে এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস তাদের। আর বিশ্বাস হবে নাই বা কেন? বংশপরম্পরায় তারা এই একই কথা শুনে আসছে যে! ঘোড়ার সঙ্গে যারা এখানে এসেছিল, তাঁবুর দায়িত্বে থাকা হোটেলের লোকটাকে নীচে ফেরার জন্য তাড়া দিচ্ছিল তারা। সুজয়দের এখানে নামাবার পর টাকা বুঝে নিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব ফেরার পথ ধরল লোকগুলো।
ঘোড়াঅলাদের বা স্থানীয় লোকদের বক্তব্যের সারবত্তা কতটা আছে তা সুজয়ের জানা নেই। সে নিজেও ভূত-অপদেবতা বিশ্বাস করে না। কিন্তু তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল ‘সত্যি সত্যিই যদি আজ রাতে কোনো ইনকা প্রেতাত্মার সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে মন্দ হয় না! ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা মানুষকে তাহলে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করা যাবে।’
একথা ভাবতে ভাবতে সুজয় বিলকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা বিল, তুমি কি ভূত-প্রেত-এসব ব্যাপার বিশ্বাস করো?’ বিল জবাব দিল, ‘না। অনেক বনবাদাড়ে তো ঘুরে বেড়িয়েছি, তারা যদি থাকত, তবে নিশ্চই তাদের সাক্ষাত পেতাম আমি।’
মার্কেজ সুজয়ের প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘ও আপনি বুঝি ঘোড়াঅলাদের গল্পগুলোর কথা ভাবছেন? আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?’ সুজয় হেসে ফেলে বলল, ‘না। তবে ভূতের গল্প পড়তে আমার ভালো লাগে।’
মার্কেজ হেসে বললেন, ‘আমারও ভালো লাগে। উইলিয়ম জেকবস এর লেখা, দ্য মাঙ্কি’জ প গল্পটা আমার অন্যতম প্রিয় গল্প। আপনি পড়েছেন গল্পটা? সেই যে এক ভারতীয় ফকিরের দেওয়া অলৌকিক বাঁদরের পাঞ্জার গল্প…’
তিনি আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বিল হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওই যে আমাদের দিকে যারা এগিয়ে আসছে, আশা করি তারা কোনো প্রেতাত্মা নন।’
বিলের কথা শুনে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুজয়রা দেখল, তিন-জানলার ওদিক থেকে তাদের দিকে হেঁটে আসছে দুজন লোক। সুজয় দূর থেকেই চিনতে পারল তাদেরকে। মি. পিনচিও আর তার গাইড হুইকো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের তাবুর সামনে এসে দাঁড়াল তারা দুজন। কাছে এসে পিনচিও মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কি আপনাদের বেড়ানো কেমন হল? আপনারা যে এখানে থাকবেন তা বলেননি তো! আপনাদের হোটেলের লোকের মুখে জানতে পারলাম যে আপনারাও এখানে রাত কাটাবেন।’
মার্কেজ বললেন, ‘বেড়ানো বেশ ভালোই হল। তা আমাদের হোটেলের লোকের সঙ্গে কোথায় দেখা হল আপনার? আপনি কীভাবে জানলেন আমরা কোন হোটেলে উঠেছি?’
পিনচিও জবাবে বললেন, ‘বিকাল থেকেই আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। নীচের হোটেলগুলোতে আপনাদের খোঁজে গিয়েছিলাম। গোল্ডেন ইনকাতে আপনাদের খবর পেলাম।’
মার্কেজ তাঁর কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেন? কোনো বিশেষ দরকারে কি?’ পিনচিও মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। বিশেষ একটা খবর জানাবার জন্যই আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। চলুন কোথাও একটু বসে কথা বলি।’
মার্কেজ বললেন, ‘ও তাঁবুতে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে ওর ওপর। চলুন কোথাও একটু বসে কথা বলি।’
বসার পর পিনচিও মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনার জন্য একটা খবর আছে। আপনিতো অজানা প্রাচীন শহরের খোঁজ করছেন। পুরোহিত ইল্লাপা আপনাদের তার খবর না-জানানোতে বেশ খারাপ লাগছিল আমার। আপনারা চলে আসার পর আমি তাকে বোঝালাম আপনাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে। কত দূর থেকে আপনারা এখানে এসেছেন এই সুমহান সভ্যতাকে প্রত্যক্ষ করার জন্য, ইল্লাপাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবগাথা আজকের পৃথিবীর কাছে তুলে ধরার জন্য। আপনারা এসেছেন এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। এদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে কলুষিত করতে আপনারা আসেননি, এসেছেন ইনকাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানাতে। তা ছাড়া আমারও এ রকম কোনো প্রাচীন নগরী দেখার খুব ইচ্ছা। একা তো ওসব জায়গাতে যাওয়া যায় না, ইল্লাপার কাছ থেকে সন্ধান পেয়ে আপনারা যদি ওরকম কোনো নগরীতে যান, তাহলে আমিও আপনাদের সঙ্গী হতে পারি। অনেক বোঝাবার পর শেষপর্যন্ত ইনকা পুরোহিত রাজি হলেন এক প্রাচীন নগরীর সন্ধান দিতে। আর এ খবরটা জানাবার জন্যই আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।’—একটানা কথাগুলো বলে থামলেন মি. পিনচিও।
তাঁর কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে মার্কেজ বললেন, ‘তাই নাকি! ইনকা পুরোহিত সেই নগরীর ব্যাপারে আরও কিছু বলেছেন নাকি আপনাকে? কোথায় সে নগরী? কীভাবে যেতে হয়?
পিনচিও তাঁর চোখ থেকে পারকল খুলে নিয়ে বললেন, ‘ইল্লাপা যেখানে যাচ্ছেন সেখানে ইনকা পুরোহিত ছাড়া সাধারণ ইনকাদেরও প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু তাঁর যাত্রাপথে আরও-এক প্রাচীন নগরী আছে, যার সন্ধান বাইরের পৃথিবী জানে না। গভীর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে সে নগর। পাহাড়-নদী-জঙ্গল পার হয়ে তিনদিন সময় লাগে সেখানে যেতে। ওখানে যারা বাস করে খাঁটি ইনকা রক্ত নাকি বহমান তাদের শরীরে। গত তিন-চারশ বছরের মধ্য ইনকা পুরোহিতরা ছাড়া কোনো সভ্য পৃথিবীর মানুষ সেখানে পদার্পণ করেনি। ইল্লাপা কাল তার গন্তব্যের অভিমুখে রওনা হচ্ছেন। যদিও তার যাত্রা পথের সেই প্রাচীন নগরীতেও বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু তিনি কথা দিয়েছেন তাঁর গন্তব্যে যাবার পথে সে নগরীতে তিনি আমাদের নিয়ে যাবেন। তার কথা শুনে মার্কেজ একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ইল্লাপাতো আমাকে প্রাচীন নগরীর কোনো সন্ধানই দিতে রাজি ছিলেন না! তিনি আপনার কথায় আমাদের তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যেতে রাজি হলেন? শেষপর্যন্ত তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে যাবেন তো?’
পিনচিও হেসে বললেন, ‘আমার মনে হয় আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাদের নিয়ে যাবেন। আসলে আমার প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে আমার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি।’
প্রফেসর তাঁর এই কথা শুনে বললেন, ‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি, কিছু মনে করবেন না! এমনিতে ইনকা পুরোহিতরা বিদেশিদের ঠিক পছন্দ করেন না, তার ওপর আপনি আবার স্পেনীয়, পিজরোর দেশের লোক! এরা তো ঘৃণা করে স্পেনীয়দের। এর পরিবর্তে আপনার প্রতি তাঁর দুর্বলতা জন্মাল কীভাবে?’
মার্কেজের প্রশ্নের জবাবে পিনচিও বললেন, ‘এর পিছনে বিশেষ একটা কারণ আছে। আপনাকে তো বলেছি আমার কিউরিওর ব্যাবসা। যে দেশেই যাই আমি সেখানেই কিউরিওশপে একবার ঢুঁ মারি আমি। লিমার এক কিউরিও শপ থেকে একটা ‘টুমি’ কিনেছিলাম আমি। কিনেছিলাম বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই। আজ সকালে গাড়িতে মাচুপিচু আসার পথে গাড়িতে সেটা ইল্লাপাকে দেখাতেই তিনি চেয়ে বসলেন আমার কাছে। তাঁর নাকি একটা ও জিনিসের ভীষন প্রয়োজন। অর্থাভাবে কিনতে পারছেন না। তার কথা শুনে শেষপর্যন্ত টুমিটা আমি তাকে উপহার দিয়েছি। এ কারণে তাঁর আমার প্রতি দুর্বলতা জন্মে গেছে।’
মার্কেজ শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘টুমিটা’ কি ইনকা আমলের? এমন একটা দুর্মূল্য জিনিস আপনি হাত ছাড়া করলেন!
তিনি বললেন, ‘না ওটা ইনকা আমলের নয়, রেপ্লিকা। তবে, গোল্ড প্লেটেড। হাজার ডলার দাম নিয়েছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা তো অনেক কিছু এ দেশ থেকে নিয়ে গেছিল, ইল্লাপা যখন জিনিসটা চাইলেন তখন ভাবলাম ওটা ওকে দিয়েই দি। লিমার সেই দোকানে আরও বেশ কয়েকটা ও জিনিস আছে, ফেরার পথে একটু কিনে নেওয়া যাবে।’
মার্কেজ মৃদু হেসে বললেন, ‘ওটা দিয়ে কি পূর্বপুরুষদের পাপস্খলন করলেন?’
পিনচিও একটু আনমনা ভাবে বললেন, ‘না, না, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।’ তারপরই তিনি মূল প্রসঙ্গে চলে গিয়ে বললেন, ‘তাহলে কী করবেন বলুন। ইনকা পুরোহিত কিন্তু কাল সকালেই রওনা হবেন।’
মার্কেজ বললেন, ‘আপনার প্রস্তাব যে লোভনীয় তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, তিন দিনের জন্য যেতে হলে তো কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন। তা ছাড়া খরচপত্র…’ তাঁকে কথা শেষ করতে না-দিয়ে স্পেনীয় ব্যবসায়ী বললেন, ‘ওসব ব্যাপার নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওখানে যেতে হলে, হোটেল-ট্যাক্সি বা এয়ার টিকিটের তো বুকিং লাগবে না। পদব্রজেই আমাদের যেতে হবে। আমার গাইড হুইকো খুব কাজের লোক। আপনি রাজি থাকলে রসদপত্র যা লাগবে, আজ রাতের মধ্যেই ও জোগাড় করে নেবে। শুধু আপনার মতামতের অপেক্ষা।’
মার্কেজ এবার তাকালেন সুজয় আর বিলের দিকে। সুজয়ের দেশে ফেরার জন্য হাতে বেশ সময় আছে। সম্ভবত দিন আষ্টেক সময় লাগবে ও জায়গা দেখে আসতে। এসব দেখার সুযোগ চট করে সাধারণ টুরিস্টদের হয় না। আবার তার সঙ্গে রয়েছে প্রফেসর মার্কেজের মতো পন্ডিত মানুষের দুর্লভ সাহচর্য! এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি হল না সে। মার্কেজের উদ্দেশ্যে সে বলল, ‘আপনার যদি আপত্তি না-থাকে তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যেতে আগ্রহী।’
মার্কেজ সুজয়ের উদ্দেশ্যে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে চাইলেন বিলের দিকে। বিল একটু ইতস্তত করে বলল ‘মি. পিনচিওর মুখ থেকে সে জায়গার সম্বন্ধে যা শুনলাম তাতে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। ওখানে যেতে পারলে ভালোই হয়। কিন্তু আমি যে কাজটার জন্য এখানে এসেছি সে কাজটা তাহলে পিছিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে একটু ভাবার সময় পেলে ভালো হয়।’ এই বলে চিন্তা করতে লাগল বিল।
পিনচিও বিলের কথা শুনে মার্কেজকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উনি কি বিশেষ কোনো কাজ নিয়ে এখানে এসেছেন? বলতে বাধা না-থাকলে জানাবেন সেটা কী কাজ?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘না, বলতে বাঁধা নেই। কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ও ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করে তো, ও পেরুতে এসেছে কেশরহীন আন্দীয় সিংহ, অর্থাৎ পুমার ছবি তোলার জন্য। ও সে-কাজের কথাই বলছে।’
পিনচিও বললেন, ‘আমরাও তো জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই যাবো। ওই যে পূব দিকের ঘন জঙ্গল, ইল্লাপা বলেছেন, ওই জঙ্গল-পাহাড় ভেঙে যেতে হবে আমাদের। ওখানেও ওয়াইল্ড লাইফ আছে নিশ্চই।’
তাঁর কথা শুনে বিল প্রশ্ন করলেন, ‘ওখানে কি ওয়াইল্ড লাইফ আছে জানেন আপনি?’
তিনি জবাব দিলেন তা জানি না। গাইড বইতে লেখা আছে দেখলাম ওই অরণ্য আমাজন অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। উকেয়ালির বেশ কয়েকটা শাখা ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে কী কী প্রাণী আছে তা বলতে পারব না। হুইকো হয়তো বলতে পারবে। ও এর আগে একবার গেছিল ওই জঙ্গলে।’ এই বলে তিনি তাকালেন হুইকোর দিকে।
হুইকো এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনছিল। এবার সে ফিরে তাকাল সুজয়দের দিকে। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, আমি একবার এ সাহেবের সঙ্গে গেছিলাম ওখানে। ও জঙ্গলে, জাগুয়ার আছে, শ্লথ আছে, টেপির আছে। বন্য ভিসুনিয়া আছে, লামা আর আলপাকাতো আছেই।’
‘তাহলে পুমা নেই!’ তার কথা শুনে একটু হতাশভাবে বলল বিল।
হুইকো বলল, ‘পুমা থাকে নেড়াপাহাড়ের ঘাস-জঙ্গলে। কখনো কখনো অবশ্য খাবারের অভাব পড়লে তারা নীচের জঙ্গলে নামে। গভীর জঙ্গলে তারা থাকে না।’
বিল একটু ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, ‘জাগুয়ার বা ভিসুনিয়ার ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আমি এসেছি পুমার ছবি তুলতে।’ কয়েক মুহূর্তে কী যেন চিন্তা করে নিয়ে হুইকো এবার বলল, ‘পুমার দেখা হয়তো মিলবে না। কিন্তু ও জঙ্গলে এমন এক পাখি আছে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। আমি যে সাহেবের সঙ্গে ওই বনে গেছিলাম, তিনি ওখানে গেছিলেন ওই পাখির ছবি তুলতে।’
সম্ভবত আর একজন ফটোগ্রাফারের কথা শুনে বিল একটু উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, ‘কী নাম সেই ফটোগ্রাফারের? কী পাখির ছবি তিনি তুলতে গেছিলেন?’
বিলের কথার জবাব দেবার আগে যেন একটু ইতস্তত করল হুইকো। তারপর পাথরের চোখটা কোটরে বসিয়ে নিয়ে, বিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেই সাহেবের নাম ছিল, ‘নিক কার্টার’। তিনি ‘কোরাকেঙ্কু’-র ছবি তুলতে গেছিলেন।’
হুইকোর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বিল। সুজয়ের মনে হল প্রফেসর মার্কেজও যেন এটু চমকে উঠলেন হুইকোর কথা শুনে।
উঠে দাঁড়াবার পর বিল মার্কেজের উদ্দেশ্যে বলল, ‘বিখ্যাত মার্কিন ফটোগ্রাফার নিকের তোলা ‘কোরাকেঙ্কুর’ ছবি আমি নেচার পত্রিকা-য় দেখেছি। একটাই মাত্র ছবি। ছবির সঙ্গে প্রবন্ধটাও পড়েছি। ছবিটা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়তির অভিযোগ এনেছিলেন কিছু পক্ষীবিদ। ছবি আর প্রবন্ধ ছাপা হবার কিছু দিনের মধ্যে নিক মারা যায়, ফলে ব্যাপারটাও ধামা চাপা পড়ে যায়। লোকে ধারণা করে নেয়, বৃদ্ধ বয়সে নিক আরও খ্যাতি পাওয়ার লোভে এ কান্ড করেছিলেন। ও পাখির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে ও পাখি কি সত্যিই আছে! তুমি দেখেছ সে পাখি?’ মার্কেজের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হুইকোর চোখের দিকে তাকাল বিল।
হুইকো বিলের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি’। মাচাকুয়ে নদীর জঙ্গলে গাছের ডালে বসে ছিল পাখিটা। সোনালি রং। লম্বা ল্যাজে লাল-সাদা-কালো ডোরা। অপূর্ব পাখি। নিক সাহেব একটাই ছবি তুলতে পেরেছিলেন পাখিটার। তারপর সে উড়ে গেল। আর খুঁজে পেলাম না।’
‘তুমি সত্যিই দেখেছ!’ বিস্ময় নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল বিল।
‘হ্যাঁ দেখেছি। ইনতির শপথ!’ শান্তভাবে বলল হুইকো।
তাদের কথাবার্তা শুনে সুজয় পাশে বসে থাকা মার্কেজকে বলল, ‘এরা যে পাখির কথা বলছে তার কথা আপনি জানেন?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘বইতে পড়েছি। তবে নেচার পত্রিকা-য় নয়, ইনকা সভ্যতা নিয়ে লেখা একটা ইতিহাস বইতে।’
‘ইতিহাস বইতে?’
মার্কেজ বললেন, ‘হ্যাঁ। সেখানে কোরাকেঙ্কুর কথা ছিল। ইনকা সম্রাটরা যে তাজ মাথায় দিতেন তার নাম ‘ল্লান্টু’। ওই তাজের ওপর বসানো থাকত কোরাকেঙ্কুর লেজের দুটো পালক, রাজশক্তির প্রতীক। সেই সময়ের সাধারণ মানুষ কোনোসময় চোখে দেখতে পেত না সেই পাখিকে। দুর্গম স্থানে, সতর্ক পাহারার মধ্যে পালন করা হত সেই দুষ্প্রাপ্য পাখি। তার লেজের দুটো পালক নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য প্রাপ্তির পর সে পালক দুটো খুলে নিয়ে পাখিটা মেরে তার দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হত। আর কোনো চিহ্নই থাকত না সে-পাখির। কেবলমাত্র সেই পালক দুটো ছাড়া, তারা বৈভব আর শৌর্যের প্রতীকরূপে শোভা পেত সূর্যপুত্র ইনকা নরেশের ল্লান্টুতে।’ এই বলে চুপ করে গেলেন তিনি।
বিল মাথা নীচু করে কী যেন ভাবছে, অন্য কারো মুখে কোনো কথা নেই। হুইকোর দুটো চোখই স্থির। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে প্রাচীন নগরীর বুকে। মি. পিনচিও এরপর উঠে দাঁড়িয়ে মৌনতা ভঙ্গ করে বললেন, ‘তাহলে কী ঠিক করলেন আপনারা?’
মার্কেজ তাকালেন বিলের দিকে।
বিল, তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি, হয়তো, যে কাজের জন্য আমার এখানে আসা সে কাজটা আমার পিছিয়ে যাবে। আমি যাব আপনার সঙ্গে। একটা চান্স নিই। যদি ওই দুর্লভ পাখি কোনো ভাবে চোখে পড়ে…।’
মার্কেজ এবার, মি. পিনচিওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে আমরা যাব।’
পিনচিও হেসে বললেন, ‘ভালোই হল, আমরা তাহলে সবাই যাচ্ছি। তবে প্রফেসরকে একটা কাজ করতে হবে। একটা সরকারি কাগজে সইসবুদ করতে হবে। সাধারণ টুরিস্টদের বনের ভিতর ঢুকতে দেয় না এখানকার সরকার। তবে ইতিহাস গবেষকদের ক্ষেত্রে নিয়মটা শিথিল। কারণ, তাঁরা কিছু খুঁজে পেলে লাভ সরকারেরই। তেমন হলে ভবিষ্যতে সেখানে তারা পর্যটক টানতে পারবে। এই বনের ভিতর এখনও কী কী লুকিয়ে আছে তা বলা কঠিন। কাগজ-কলমে প্রফেসর হবেন আমাদের দলপতি, আপনারা, আমি আর হুইকো হলাম ওনার কম্পেনিয়ন।’ কথাগুলো বলে তিনি তাকালেন সুজয়ের দিকে। সুজয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘আর পুরোহিত ইল্লাপা?’
পিনচিও হেসে বললেন, ‘ইনকা পুরোহিতরা জাদুবিদ্যাচর্চা করে বলে এখানকার সাধারণ মানুষ তাঁদের বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, ভয়ও করে। সরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারটাও একই। তার ওপর আবার ইল্লাপা কুজকোর করিকাঞ্চার পুরোহিত। তাঁর প্রতাপ আরও বেশি। সর্বত্র অবাধ তাঁর গতিবিধি। তার জন্য তার সরকারি কাগজের দরকার হয় না।’
মার্কেজ তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘ বুঝলাম। কিন্তু আমাদের জন্য যেসব কাগজপত্র লাগবে তা পাব কোথায়?’ তার জন্যও তো সময়ের প্রয়োজন।’ পিনচিও তাঁর বুকের ভিতর থেকে রোল করা একটা কাগজ বের করতে করতে বললেন, ‘আপনাদের হোটেল থেকে ফেরার পথে ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস থেকে ফর্ম তুলে এনেছি। কাল ভিতরে ঢোকার সময় জমা দিতে হবে। এই যে…।’
বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। কাগজটা হাতে নেবার পর প্রফেসর মার্কেজ সকলকে নিয়ে ঢুকলেন তাঁর তাঁবুতে। শুধু হুইকো বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। প্রত্যেক তাঁবুতে একটা করে ছোটো পেট্রোম্যাক্স বাতি রাখা আছে। সেটা জ্বালিয়ে নিলেন মার্কেজ। ক্যাম্প খাটে কম্বল মুড়ি দিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে সুসান। তার ছোট্ট মুখটা শুধু কম্বলের বাইরে। পেট্রোম্যাক্সের আলোতে ফর্মটা দেখতে লাগলেন মার্কেজ, আর পিনচিও তাকিয়ে রইলেন সুসানের ঘুমন্ত মুখের দিকে।
ফর্মটা হাতে নিয়ে পড়ল সুজয়ও। ফর্মের মূল বক্তব্য মোটামুটি স্বাভাবিকই, ‘ব্রাজিলের আন্তর্জাতিক সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনাঞ্চলের যাবতীয় প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদই ‘রিপাবলিকা-ডেল-পেরু’-র সম্পত্তি। অনুপ্রবেশকারীরা যেন এ ব্যাপারে সচেতন থাকে। এ বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত যেকোনো বস্তু বা তথ্য তুলে দিতে হবে পেরু সরকারের হাতে।’ এ ছাড়া তাতে লেখা আছে যে, ‘এ অরণ্যে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র জন্তু ও অর্ধসভ্য বেশ কিছু উপজাতি গোষ্ঠীর বাস। অরণ্যে প্রবেশকারীদের এই মর্মে অবগত করা হচ্ছে যে জন্তু বা উপজাতীদের দ্বারা তাদের প্রাণহানি বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতিসাধনের দায়িত্ব পেরু সরকারের ওপর বর্তাবে না।’ আছে আবেদনকারীর উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিগত বিষয় সম্বন্ধে কিছু প্রশ্নও। যেগুলো পূরণ করতে হবে।
মার্কেজের ফর্মটা পূরণ করতে মিনিট দশেকের মতো সময় লাগল। তারপর তিনি সেটা পিনচিওর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আর কিছু?’ পিনচিও একবার কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘না, আর কিছুর দরকার নেই। থ্যাঙ্ক য়ু প্রফেসার।’
মার্কেজ বললেন, ‘তাহলে আগামীকাল কখন, কীভাবে যাত্রা শুরু করব আমরা?’
তিনি উত্তর দিলেন, ‘এখানে ইনতিহুয়ানাতা বলে একটা স্তম্ভ আছে জানেন নিশ্চয়ই। কাল সকাল সাতটায় ওর নীচেই মিলিত হব আমরা। ইল্লাপা বলেছেন ওর পূর্ব দিকের ঢাল বেয়েই জঙ্গলে যাবার রাস্তা। তবে সময়টা খেয়াল রাখবেন। ইল্লাপা আবার কী সব গ্রহনক্ষত্র হিসাব করে ওই সময়টাই যাত্রারম্ভের শুভ সময় নির্বাচন করেছেন। এসব ব্যাপারে ওঁর আবার প্রবল বিশ্বাস।’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘ওই সময়ের আগে আমরা ইনতিহুয়াতানার নীচে পৌঁছে যাব।’
পিনচিও চলে যাবার পর মার্কেজ ক্যাম্প খাটের ওপর বসে পড়ে সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি কিন্তু মনে মনে চাইছিলাম যে আমরা সবাই সেখানে যাই। আমার বয়স হয়েছে, সঙ্গে ছোটো একটা বাচ্চা ছেলে রয়েছে। আপনারা দুজন থাকলে বনজঙ্গলে ভরসা পাব।’
বিলের মাথায় সম্ভবত সেই কোরাকেঙ্কুর কথা এখনও ঘুরছিল। সে মার্কেজকে বলল, ‘আচ্ছা, আপনার কি মনে হচ্ছে, ‘হুইকো যা বলে গেল তা সত্যি?’ মার্কেজ বললেন, ‘ও তো দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলল, এসব ব্যাপার সত্যি কী মিথ্যা তা চট করে বলা যায় না। তবে অনেক সময় গাইডদের কোনো কথা, বা একটুকরো বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাগজে আঁকা ম্যাপ, এসব জায়গাতে অনেক সময় অনেক বড়ো কিছুর খোঁজ দিয়েছে। ব্রিংহ্যামও তো সামান্য লোককথার সূত্র ধরে আবিষ্কার করেছিলেন মাচুপিচু।’
বিল এরপর বলল, ‘আপনাকে আরও একটা কথা বলি, ‘মি. পিনচিও প্রাচীন নগরীতে যাবার ব্যাপারে হঠাৎই যেন বড়ো বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে না? ইনকা পুরোহিতকে রাজি করানো! আমাদের খুঁজতে আসা! কাল যখন এ প্রসঙ্গে ওর সঙ্গে আপনার কথা হল তখনতো এ উৎসাহ দেখিনি?’
এ ব্যাপারটা কিন্তু সুজয়েরও মনে হচ্ছিল।
মার্কেজ বিলের কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘এ কথাটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। এর কারণ আমি বলতে পারব না।’ তারপরই তিনি একটু লঘুভাবে বলল, ‘ওর দেহে স্পেনীয় রক্ত আছে তো! একসময় পূর্বপুরুষরা পালতোলা নৌকায় মহাসমুদ্র পাড়ি দিত নতুন দেশের খোঁজে, সোনার সন্ধানে। হয়তো ও ভেবেছে কোনো হারানো নগরীর সন্ধান পেলে সেখানে সোনার খোঁজও পাওয়া যেতে পারে। আর তা না-পাওয়া গেলেও পিজরোর মতো আবিষ্কারক হিসেবে অন্তত ইতিহাস বইতে তার স্থান হতে পারে।’
বিলও এবার লঘুভাবে বলে উঠল, ‘ইতিহাস বই মানে কি আপনার লেখা বই?’ তাহলে দেখবেন, আবিষ্কারক হিসেবে আমার নামটা যেন সেখানে বাদ না-হয়ে যায়! তবে আপনার বই লেখার আগে প্রাচীন নগরী খুঁজতে গিয়ে আমরাই আবার ইতিহাস হয়ে যাব-না তো?’ বিলের রসিকতায় হেসে উঠলেন মার্কেজ। হেসে উঠল সুজয় আর বিল নিজেও।
হাসি থামার পর সুজয় মার্কেজের কাছে জানতে চাইল, ‘মি. পিনচিও ইনকা পুরোহিতকে ‘টুমি’ বলে যে জিনিসটা দিয়েছে সেটা আসলে কী? কোনো অলংকার বা জাদুদন্ডের মতো দেখতে কিছু?’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘টুমি’, হল পুত ছুরিকা। ছোটো আকৃতির দেখতে হয়। সোনার তৈরি এই ছুরি দিয়ে প্রাচীনকালে লামা বলি দেওয়া হত ইনতির উদ্দেশ্যে। ধর্মীয় উৎসবে এখনও টুমির সাহায্যেই লামাবলি দেওয়া হয়। এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘জাদুকর ইনকা পুরোহিতরা টুমির সাহায্যেই লামার বুক চিরে হৃৎপিন্ড বাইরে বার করে আনতেন। তারপর তখনও স্পন্দিত সেই হৃৎপিন্ড হাতের মুঠোতে ধরে ভবিষ্যদবাণী করতেন। ইনকা পুরোহিতদের কাছে টুমি জিনিসটা তাই মূল্যবান।’
এরপর শুরু হল ইনকা পুরোহিতদের জাদুবিদ্যাচর্চা নিয়ে গল্প। কীভাবে ইনকা পুরোহিতরা লামার হৃৎপিন্ড, মাকড়সা, টিকটিকি, ব্যাঙ ইত্যাদির সাহায্যে ঝড়, বৃষ্টি, খরা ইত্যাদি সম্বন্ধে ভবিষ্যদবাণী করতেন, কীভাবে তারা সম্রাটের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন এসব গল্প। বক্তা অবশ্যই মার্কেজ। শ্রোতা বিল আর সুজয়।
প্রায় এক ঘণ্টা গল্প করার পর তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল সকলে। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার আকাশ না-হলেও বেশ উজ্জ্বল আলো। সেই আলোতে বিধৌত পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন ইনকা নগরীর ধ্বংসাবশেষ। পাথুরে স্তম্ভ, প্রাচীর, ছাদহীন ঘরগুলো যেন আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে চাঁদের আলোতে! কোথাও কোনো শব্দ নেই। পর্যটকদের কোলাহল সূর্য ডোবার অনেক আগেই থেমে গেছে। শুধু এক বুক কথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূক-ম্রিয়মাণ প্রাচীন সৌধগুলো। সুজয় প্রফেসরের কাছে শুনেছে যে, ইনকারা বিশ্বাস করতেন, ‘সোনা হল সূর্যদেবের ঘর্ম, আর রুপা হল চন্দ্রদেবের অশ্রু। তার মনে হল চাঁদের করুণা যেন সত্যিই রুপোলি অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে মাচুপিচুর বুকে! কারো মুখে কোনো কথা নেই, বিল শুধু একবার অস্ফুট স্বরে বলল, ‘বিউটি ফুল!’
তাঁবুর কিছুটা দূরেই একটা খাদ। চাঁদের আলোতে নীচের হুরিন চত্বরকে ভালোভাবে দেখার জন্য তাঁবু দুটোকে পিছনে ফেলে পায়ে পায়ে সুজয়রা গিয়ে দাঁড়াল খাদের ধারে। খাদের নীচে ঘুমিয়ে আছে হুরিনের পাথুরে সৌধগুলো। মৃত নগরীতে কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই। শুধু একটা ঘাসে ঢাকা চত্বরে নড়াচড়া করছে বেশ কয়েকটা সাদা বিন্দু, লামার দল। কাল ভোরের প্রতীক্ষায় সম্ভবত ওদের মালিক ছেড়ে রেখে গেছে প্রাণীগুলোকে। কিছুক্ষণ নীচের দিকে তকিয়ে থাকার পর সুজয় মাথা তুলে তাকাল ওপর দিকে। তাদের সামনেই কিছু দূরে আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাহাড়,—ওর নাম ‘হুয়ানাপিচু’। তার মাথার ওপর নির্মেঘ আকাশে ফুটে উঠেছে অসংখ্য নক্ষত্ররাজি। ঠিক কেউ যেন মুঠোমুঠো আলোকবিন্দু ছিটিয়ে রেখেছে আকাশের বুকে! নীচের চন্দ্রস্নাত মাচুপিচুর মতো মাথার ওপরে সেই দৃশ্যও কম সুন্দর নয়! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মার্কেজ আকাশের একজায়গায় আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে উত্তর দিকে নক্ষত্রমন্ডলী দেখছেন, ওর নাম ‘ভালপেকূলা’ নক্ষত্রমন্ডল। এ নাম ইনকাদেরই দেওয়া। এ নামের অর্থ হল ‘শৃগাল নক্ষত্রমন্ডল।’ ইনকা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমনই নির্মেঘ আকাশের রাতে এই মাচু-পিচুর মানমন্দির থেকে নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন। খালি চোখে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের সূচনা করে ইনকারা। তবে তারা নির্দিষ্ট কোনো নক্ষত্রর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন না, নক্ষত্র-মন্ডলীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। তাঁদের চোখে দৃশ্যমান নক্ষত্রপুঞ্জকে বিভিন্ন প্রাণীর আকারে কল্পনা করতেন তারা, এবং সেই মর্মে তাদের নামকরণও করেছিলেন। ভালপেকূলা বা শৃগাল, মাচাকুয়ে বা সর্প, উনালামাচা বা ছোটোলামা, কনডোর, পিউমা,—এ জাতীয় সব নাম। বিভিন্ন ঋতুতে এখান থেকে খালি চোখে যত নক্ষত্রমন্ডলী দৃশ্যমান, তাদের সব ক-টিকেই চিনতেন প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কোন নক্ষত্রমন্ডলীর, কোথায় অবস্থান কীসের আগমনবার্তা সূচিত করছে, তা তারা জানিয়ে দিতেন কুজকো নগরীতে সম্রাটের কাছে।’ এই কথা বলার পর মার্কেজ বেশ কিছুক্ষণ ধরে সুজয়দের একে একে চিনিয়ে দিতে লাগলেন কোনটা কোন নক্ষত্রমন্ডলী। তাঁর কথা শুনে সুজয় বুঝতে পারল, প্রফেসরের বুৎপত্তি শুধু ইনকাদের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বেশ কিছুটা জ্ঞান আছে ভদ্রলোকের। চন্দ্রালোকে পাহাড়ের গায়ে রহস্যময় প্রাচীন নগরীতে দাঁড়িয়ে, আরও রহস্যময় আকাশের দিকে তাকিয়ে মার্কেজের কথা শুনতে শুনতে সুজয় তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থান, গণনা, এইসব জটিল হিসাবনিকাশ সে আমলে কীভাবে রাখতেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘এসব হিসাবও রাখা হত ওই খিপু পদ্ধতির মাধ্যমেই।’
এরপর তিনি সম্ভবত ওই হিসাব পদ্ধতি সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই একটা চিৎকারের শব্দ ভেসে এল পিছনে তাদের তাঁবুর দিক থেকে!
মার্কেজ বললেন, ‘সুসানের গলা না?’ আর তারপরই তারা ছুটতে শুরু করল তাঁবুর দিকে।
খাদের কাছ থেকে তাঁবুতে এসে ঢুকতে বড়ো জোর এক মিনিট সময় লাগল সুজয়দের। ভিতরে ঢুকে তারা দেখল, সুসান কম্বল মুড়ি দিকে ক্যাম্পখাটে বসে আছে। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মৃদু-মৃদু কাঁপছে সে। সুজয় তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমার কি হল সুসান? তুমি কি ভয় পেয়েছ?’ তার কথার কোনো জবাব দিল না সুসান, সে শুধু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বিল তাড়াতাড়ি ফ্লাস্ক থেকে জল এনে ধরল সুসানের সামনে। ইতিমধ্যে মার্কেজও প্রবেশ করলেন তাঁবুতে। তিনি সুসানকে বললেন, ‘কি হয়েছে তোমার স্বপ্ন দেখেছ?’ তাঁকে দেখে এবার মনে হল আশ্বস্ত হল সুসান। বিলের হাতে ধরা গ্লাসের জলটা পান করে সে ভয়ার্ত স্বরে বলল, ‘ভূত এসেছিল। ইনকার ভূত!’
প্রফেসর বললেন, ‘কোথায় ভূত? এখানে তো কেউ নেই! তুমি মনে হয় স্বপ্ন দেখেছ!’
সুসান ধীরে ধীরে বলল, ‘না, স্বপ্ন নয়, সত্যি ভূত এসেছিল। আমি ঘুমাচ্ছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল। আমি দেখলাম তাঁবুর বাইরে একটু দূরে কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন লম্বা লোক পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম সে বিল আঙ্কেল, শুয়ে শুয়ে আমি তাকে বললাম, ‘বিল আঙ্কল, দাদু কোথায়?’ সে আমার কথার কোনো জবাব দিল না। তারপর আবার তাকে ডাকলাম। সে তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি দেখলাম সে বিল আঙ্কল নয়, একটা ইনকা ভূত! তার মুখে উলকি আঁকা, চোখ দুটো যেন জ্বলছে। তাঁর হাতে রয়েছে একটা লাঠি। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে ভ্যানিশ হয়ে গেল! আর তারপরই তোমরা চলে এলে।’
বিল এবার তাকে জিজ্ঞেস করল ঠিক কোথায় দেখেছিল তুমি তাকে? আমরাতো তাঁবুর কাছাকাছিই ছিলাম!’
সুসান আবার বলল, ‘ওইতো ওইতো ওখানে তাঁবুর দরজার একটু বাইরে।’
মার্কেজ বসলেন সুসানের পাশে। সুজয় আর বিল তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে তাকাল চারদিকে। না, কোথাও কেউ নেই। ঘুমিয়ে থাকা প্রাচীন নগরী শুধু প্লাবিত হয়ে আছে চাঁদের আলোতে। ভালো করে চারপাশ একবার দেখে নেবার পর বিল বলল, ‘এখানে আসার পথে ঘোড়াঅলারা ইনকা ভূতের গল্প বলেছিল তো। এমনিতেই বাচ্চাদের মন কল্পনাপ্রবণ হয়। ও সব শুনে সুসানের হ্যালুমনেশন হয়েছে।’
সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ, তা হতে পারে।’
বিল এরপর আমাজনের অরণ্যে তাঁবুতে রাত কাটানো নিয়ে সুজয়কে গল্প বলতে শুরু করল।
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর মার্কেজের তাঁবুর ভিতর থেকে তাঁর ডাক শোনা গেল, ‘চলে আসুন, রাতের খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক।’ বিল তার কথা শুনে সুজয়কে বলল, ‘চলো তাহলে। আজ তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে শুয়ে পড়া ভালো। কাল থেকে তো আমাদের পায় হাঁটা শুরু হবে। এরকম ভ্রমণের আগে একটা রাত টানা ঘুম খুব জরুরি। হয়তো দেখবে জঙ্গলের ভিতর তাঁবুতে রাত জাগা পশুপাখির ডাকে কাল রাতে ঘুমই হবে না তোমাদের।’ সে একথা বলার পর তারা দুজন তাঁবুতে ঢোকার জন্য পা বাড়াল। এক পা সেদিকে এগোবার পরই হঠাৎ সুজয়ের চোখে পড়ল তাঁবুর কয়েক হাত দূরে ঘাসের ওপর কী যেন একটা জিনিস চাঁদের আলোতে চকচক করছে। সুজয় আঙুল তুলে বিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘কী ওটা?’ বিল কাছে গিয়ে জিনিসটা কুড়িয়ে নিল। সুজয় দেখল সেটা, একটা পালক! সাদা-কালো ডোরা আঁকা একটা পালক। বেশ বড়ো আকারের। পালকটা একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বিল বলল, ‘এ পালকটা এখানে আগে পড়ে থাকতে দেখিনিতো!’ তারপরই সে বলল, ঠিক এরকমই পালক আমি ইনকা পুরোহিতের মাথায় দেখেছি।’ তাঁবুতে ঢোকার আগে বিল পালকটা গুঁজে দিল তাঁবুর মাথায়।
হোটেল থেকেই খাবার এনে ছিল তারা। মার্কেজের তাঁবুতে একসঙ্গে বসে খাওয়া সারার পর সকলে এক সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না তারা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে পাহাড় ঘেরা জায়গাটাতে। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে তাদের। তাই কিছুক্ষণ কথা বলার পরই মার্কেজ বিল আর সুজয়কে শুভরাত্রি জানিয়ে সুসানকে নিয়ে শুতে চলে গেলেন তাঁর তাঁবুতে। সুজয় আর বিলও গিয়ে ঢুকল তাদের নিজেদের তাঁবুতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ক্যাম্পখাটে শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সারাদিনের ক্লান্তিতে সুজয়ের চোখে ঘুম নেমে এল।