৫
সুজয়রা ধীরে ধীরে দেখে বেড়াতে লাগল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাহাড়ের গায়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা, মানুষের লোভকে উপেক্ষা করে আজও দাঁড়িয়ে আছে ইনকাদের স্থাপত্যকীর্তিগুলো। সার সার পাথরের তৈরি বাড়ি-ঘর-স্তম্ভ-প্রাচীর। ইনকারা লিপির ব্যবহার জানতেন না। প্রাচীন স্থাপত্যগুলো দেখে বেড়াতে বেড়াতে সুজয়ের মনে হল, ‘এই স্থাপত্যগুলোই যেন ইনকাদের লিপি। এ লিপি যারা পাঠ করতে জানে, তারা জানে, কত অজানা কাহিনি লুকিয়ে আছে গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি প্রাচীন স্মারকগুলোর গায়ে! সোনাঝরা ইনকাদের কত স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে মূক-বধির স্থাপত্যগুলো!’ পাথরে লেখা ইনকা কাহিনি সুজয় পাঠ করতে না পারলেও তার অভাব পূরণ করে দিতে লাগলেন মার্কেজ। দেখতে দেখতে-ঘুরতে ঘুরতে সে-কাহিনি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল সুজয়। তাঁর কথা শুনতে শুনতে একসময় যেন তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল এই সূর্যনগরী। সত্যিই অপূর্ব বলেন মার্কেজ! সম্ভবত সুসানেরও যাতে বুঝতে অসুবিধা না-হয় তার জন্য যথাসম্ভব সহজভাবেই সব কিছু বুঝিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। আর বিল পেশাদারি ঢঙে মার্কেজের নির্দেশে ছবি তুলতে লাগল।
মার্কেজ জানালেন, হুরিন অংশ মূলত ছিল আবাসিক স্থল। আর হানান অংশ ছিল ইনতির উপাসনা স্থল ও জ্যোতির্গননা কেন্দ্র। সম্ভবত হুরিনের সবার অনুমতি ছিল না হানান অংশে ওঠার। হানান অংশে শুধু যেতেন প্রাজ্ঞ জ্যোতির্গণনাকারী ও জাদুকর পুরোহিতরা। হানানের কাজকর্মের গোপনীয়তা সযত্নে রক্ষা করা হত। পুরোহিতরা সেখানের কাজকর্ম সম্বন্ধে যতটুকু জানাতেন ঠিক ততটুকুই জানতেন সাধারণ প্রজারা। ইনকা সম্রাটরা মাঝে মাঝে আসতেন হানান পরিদর্শনে। তখন তাঁর রক্ষী বাহিনীরও সকলকে হানানে উঠতে দিতেন না সম্রাট।
হুরিন অংশ দেখতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল সুজয়দের। তারপর ধীরে ধীরে তারা পাহাড়ের ঢালে বেশ কয়েকটা চত্বর অতিক্রম করে, সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল হানানে। এ জায়গাটা পাহাড়ের মাথায়। অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে এ জায়গা থেকে। তিনদিকে পাহাড়ের সারি। আকাশ আর পাহাড়ের রং নীলে নীল। খাদের নীচ থেকে ভেসে উঠছে ঘন কুয়াশা। নীচের দিকে তাকাল চোখে পড়ছে উরুবাম্বা নদীর বাঁক, আর পূর্বের পাহাড়ের ঢালে অন্তহীন গভীর জঙ্গল। সে জঙ্গলের শেষ কোথায় এত ওপর থেকেও তা বোঝা যাচ্ছে না। কুয়াশার একটা আস্তরণ দিগন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে আছে জঙ্গলের মাথায়। আর এসব কিছুর মাথার ওপর আপন গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনকাদের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য চিহ্ন হানানের পাথর নির্মিত স্মারকগুলো। আকাশ নির্মেঘ। সূর্যের আলো এসে পড়েছে সৌধগুলোর গায়ে। কয়েকটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রঙিন পতাকা ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ছে। হানানেরও বেশ কয়েকটা ধাপ আছে। দুটো ধাপের মধ্যের ফাঁকা অংশগুলো সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া। লামার দল চলছে সেখানে। স্মারকগুলোর আশেপাশে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে টুরিস্টরা। কেউ কেউ আবার বসে জিরিয়ে নিচ্ছে পাথর বা সবুজ ঘাসের ওপর। সুজয়রাও হানানে উঠে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। সঙ্গে আনা কিছু শুকনো খাবারও সেখানে বসেই খেয়ে নিল তারা। তারপর উঠে দাঁড়াল সৌধগুলো ঘুরে দেখার জন্য। একটু উঁচুতে আঙুল তুলে দেখিয়ে মার্কেজ বললেন, ‘আমরা প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে ওখানে যাব, তিন-জানলা ঘর’ দেখতে। তারপর দেখব সূর্যমন্দির আর ‘ইনতিহুয়ানাতা।’
শেষ শব্দটার মানে কি?’ প্রশ্ন করল সুজয়।
সূর্যকে বেঁধে রাখার স্তম্ভ, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন প্রফেসর।
পাথরের ধাপ বেয়ে সুজয়রা পৌঁছে গেল তিন-জানলা চত্বরে। খাদের ধারে সার সার দাঁড়িয়ে আছে ঘর। পাথরের তৈরি ঘরগুলোর তিনটে করে দেওয়াল। তিনটে জানলা। ঘরে ঢোকার মুখটা ট্রাপিজিয়াম আকৃতির। তবে ঘরগুলো ছাদহীন। মসৃণ দেওয়ালগুলোতে বিভিন্ন হুয়াকা আঁকা আছে, কোথাও ছটাসহ সুর্যের ছবি, কোথাও পুমা, কোথাও লামা, সাপ বা কনডোর পাখির ছবি। পাথরের তৈরি বাটালি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা ছবিগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করছে ইনকা শিল্পরীতির। ঘরগুলো ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মার্কেজ বললেন, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছেন নিশ্চই যে, ঘরগুলো ছাদহীন। আসলে ইনকারা পাকা ছাদ দিত না। হালকা কাঠ, মাদুর অথবা শন জাতীয় জিনিস দিয়ে ছাদ ছাওয়া থাকত। এইসব ছাদহীন ঘর, জামিতিক আকৃতির স্থাপত্য কিন্তু ইনকা স্থপতিরা নিছক মনের খেয়ালে তৈরি করেননি। আসলে আন্দিজ পর্বতমালার বেশির ভাগ অঞ্চলই ভূমিকম্প-প্রবণ। ভূমিকম্পর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই স্থাপত্যগুলো এভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখনও এ সব অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। নির্মাণ শৈলীর বিশিষ্টতার জন্যই এখানকার এই ঘরবাড়িগুলো আজও টিকে আছে।’
অত বছর আগেও যে ইনকাদের স্থাপত্য ভাবনা এত উন্নত ছিল তা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল সুজয়।
সুসান হঠাৎ তার দাদুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, এই ঘরগুলোতেই কি প্রেতাত্মারা থাকে?’
মার্কেজ তার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘এখানকার মানুষেরাতো তাই বলে।’
‘তাদের দেখতে কেমন?’ সুসান আবার প্রশ্ন করল।
মার্কেজ বললেন, ‘যদিও, আমি তাদের দেখিনি, তবু অনুমানে বলতে পারি। তাদের দীর্ঘ চেহারা, গায়ের রং লালচে তামাটে, চওড়া কপাল, মাথার চুল বিনুনি বাঁধা। পরনে রঙচঙে পোশাক। পায়ে কাঠের জুতো, হাতে বর্শা।’
‘তাদের না-দেখলে, তারা কেমন দেখতে জানলে কীভাবে?’ দাদুর কথা শুনে জানতে চাইল সুসান।
প্রফেসর হেসে জবাব দিলেন। ‘আমি তাদের ছবি বইতে দেখেছি।’
পরপর ঘরগুলোতে ঘুরে বেড়াতে লাগল সবাই। একটার পর একটা ঘরে কত রকমের যে হুয়াকা রয়েছে তা দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। মার্কেজ বললেন, ‘হুয়াকা আঁকা তিন-জানলা ঘরগুলোকে বলে ‘মিসমা।’ এই মিসমা স্থাপত্য ইনকা সভ্যতা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।’ বিভিন্ন রকম হুয়াকার বেশ কিছু ছবি তুলল বিল। সার বন্দি শেষ ঘরটা দেখার পর তার বাইরে বেরিয়ে বিল বলল’, ফিলম শেষ হয়ে গেল, একটু দাঁড়ান আমাকে একটা নতুন রোল ক্যামেরায় লোড করতে হবে।’ এই বলে একটা পাথরের ওপর ক্যামেরাটা কোলে নিয়ে সে বসল।
সুজয়রা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে একটু দূরে একদম খাদের কিনারে একলা দাঁড়িয়ে আছে বেশ বড় একটা ট্রাপিজিয়ম আকৃতির ঘর। এমনভাবে ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে যে দেখে মনে হচ্ছে, বাতাসের ধাক্কায় এখনই মনে হয় সে নীচে পড়ে যাবে। ঘরের দরজা দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তার মুখ খাদের দিকে। মার্কেজ বিলের কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি কাজ সারো, আমরা খাদের ধারে ওই ঘরটা দেখে আসি।’ এই বলে সুজয় আর সুসানকে নিয়ে ঘরটার দিকে এগোতে যাচ্ছিলেন তিনি। সুসান বলল, ‘তোমরা যাও, বিল আঙ্কল কীভাবে ফিলম লোড করে দেখব।’ বিল ক্যামেরাটা ততক্ষণে খুলতে শুরু করেছে। সে বলল, ‘ঠিক আছে, ও আমার কাছে থাক। আমার এখনই হয়ে যাবে।’ সুসান বসে পড়ল বিলের পাশে। মার্কেজ আর সুজয় ঘাসের গালিচা বিছানো ঢাল বেয়ে এগিয়ে গেল সেই ঘরটার দিকে।
ঘরটার কাছাকাছি পৌঁছে মার্কেজ বললেন, ‘এ ঘরটার মাথায় দেখছি ছাদ দেওয়া। চট করে এ ঘর এখানে চোখে পড়ে না। কাছে গিয়ে তারা বুঝতে পারল, আর তিন দিকের দেওয়াল থেকে ছাদে ওঠার জন্য সিঁড়ি উঠে গেছে। মার্কেজ বললেন, ‘ও বুঝেছি, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনে এ ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্ভবত এটা একটা ক্ষুদ্র মানমন্দির’। ঘরের বাইরের দিকের হুয়াকাগুলো লক্ষ করুন,—ফুল-পাখি-জীবজন্তুর পরিবর্তে সব জ্যামিতিক নকশা আঁকা আছে!’ এরপর মার্কেজ প্রায় নিজের মনেই বললেন, ‘ভাগ্যিস ঘরটা দেখতে এলাম। আগের বার এ ঘরটা চোখে পড়েনি।’
ঘরে ঢোকার দরজাটা খাদের দিকেই। একটা সুঁড়ি পথ দিয়ে দেওয়ালকে বেড় দিয়ে মার্কেজ আর সুজয় উপস্থিত হল সে জায়গায়। দরজার সামনে কয়েক হাত জায়গা মাত্র। তারপরই অতলান্ত খাদ। তার নীচে রুপোলি ফিতার মতো বয়ে চলা উরুবাম্বা। ওপর থেকে কোনোভাবে নীচে পড়লে মৃত্যু একদম নিশ্চিত। ট্রাপিজিয়ম আকৃতির দরজার ভিতরটা প্রায় অন্ধকার। ঘরে কোনো জানলা নেই। আর দরজাটা উত্তরমুখী বলে সূর্যের আলো ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। দরজার ঠিক মাথার ওপর চিত্রিত আছে সূর্যমূর্তি। আর দু-পাশে আঁকা আছে নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা। সুজয় লক্ষ করল, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা সহ্য করতে হয় বলেই মনে হয় ঘরটার সামনের দিকের পাথুরে দেওয়াল কেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। অলংকরণগুলোও স্থানে স্থানে নষ্ট হয়ে গেছে। মানমন্দির বা ঘর, যাই হোক-না-কেন, এ স্থাপত্য যে অনেক প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কয়েক মুহূর্ত ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পর মার্কেজ বললেন, ‘চলুন এবার ঘরের ভিতরটা একবার দেখা যাক। তার কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভিতর থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এল। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুজয়রা। আর তার পরক্ষণেই সেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দুজন লোক। তাদের দেখে অবাক হয়ে গেল প্রফেসর মার্কেজ আর সুজয়। লোক দুজনের একজন মি. পিনচিও, আর একজন যেন ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কোন ইনকা পুরুষ। সে দীর্ঘদেহী। উচ্চতায় সুজয় বা বিলের থেকেও লম্বা, অন্তত সাড়ে ছ-ফুট হবে। তার পরনে রঙিন ‘টিউনিক’ বা ‘উনকু’ আর কম্বলের মতো আচ্ছাদন ‘ইয়াকোলা’। কোমরে চওড়া কোমর বন্ধ। একরাশ কালো চুল ঘাড় ছাপিয়ে নীচের দিকে নেমেছে, মাথার ফেট্টিতে বেশ বড়ো দুটো কালো পালক গোজা। মনে হয় বাজ বা ওই জাতীয় কোনো প্রাণীর হবে। লোকটার গলায় বেশ কয়েকটা রঙিন পাথরের মালা। সারা মুখে আর পেশিবহুল বাহুতে আঁকা আছে উলকি।
সুজয়রা যেমন তাদের দেখে একটু অবাক হল, পিনচিও যেন বাইরে বেরিয়ে তাদের দেখে মুহূর্তের জন্য একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন, তারপর মার্কেজের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, ‘হাই প্রফেসর। এখানে কখন এসে পৌঁছোলেন?’
মার্কেজ বললেন, ‘এই তো ঘণ্টা তিনেক আগে। হোটেলে মালপত্র রেখে দেখতে বেরিয়ে পড়েছি।’
পিনচিও বললেন, ‘ও। আমি এখানে পৌঁছেছি বেলা ‘ন-টা নাগাদ। তারপর দেখতে বেরিয়েছি। তবে হোটেল নিইনি। এখানে থাকার জন্য তাঁবু পাওয়া যায়। ওতেই থাকব রাতে। চাঁদের আলোতে পাহাড়ের মাথায় এই প্রাচীন নগরীতে রাত কাটানো নাকি বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার। সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাই না। তা ছাড়া ইনিও এখানে থাকবেন…’ এই বলে পিনচিও তাকালেন তাঁর দীর্ঘকায় সঙ্গীর দিকে।
মার্কেজ পিনচিওর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উনি…?’
পিনচিও বললেন, ‘ওহো! পরিচয়টা করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। উনি হলেন করিকানচা মন্দিরের পুরোহিত। যাঁর কথা আপনাকে কাল বললাম।’ সুজয় বুঝতে পারল একেই তাহলে কাল তারা দেখেছিল পিনচিওর সঙ্গে।
ইনকা পুরোহিত নিশ্চয়ই ইংরেজি বোঝেন, কারণ এরপর তাঁর দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতেই মার্কেজ আর সুজয়ের পরিচয় দিলেন পিনচিও। মার্কেজ করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালেন ইনকা পুরোহিতের দিকে। তিনি কিন্তু মার্কেজের দিকে হাত বাড়ালেন না। ডান হাতটা বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাবে এনে, সামান্য মাথা ঝোঁকালেন মাত্র। সুজয়ের তাই দেখে মনে হল, সম্ভবত এটা ইনকাদের সম্ভাষণের রীতি হতে পারে। প্রফেসর হাতটা গুটিয়ে নিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনার কথা মি. পিনচিও আমাদের বলেছেন। আপনার কাছে আমি কিছু জানতে চাই—।’
‘কী জানতে চান?’—একটু যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মার্কেজকে জরিপ করে, ভাঙা ইংরেজিতে গম্ভীর স্বরে বললেন ইনকা পুরোহিত ইল্লাপা। মার্কেজ বললেন, ‘শুনেছি, এখানে আরও বেশ কিছু প্রাচীন নগরী আছে, যার খবর কেবল মাত্র স্থানীয় মানুষরা কেউ কেউ জানেন, বাইরের পৃথিবীর কাছে তা অজানা। ও সব জায়গার খোঁজ নিশ্চই আপনার জানা আছে। মি. পিনচিও বলছিলেন, সে-রকম কোনো একটা জায়গাতে কী একটা উৎসবে আপনি যাচ্ছেন। দয়া করে যদি ওরকম কোনো একটা জায়গার সন্ধান আমাকে দেন তাহলে আমার উপকার হয়।’
মার্কেজের কথা শুনে ইল্লাপা প্রথমে একবার তাকালেন পিনচিত্তর দিকে। যেন তাঁর প্রাচীন নগরীতে উৎসবে যাবার কথাটা সুজয়দের কাছে ব্যক্ত করায় পিনচিত্তর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি। তাঁর তাকানোর ভঙ্গী দেখে সুজয়ের তাই মনে হল।
এরপর ইল্লাপা একটু কঠিন স্বরে মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ও সব শহরের খোঁজ জেনে আপনি কী করবেন? সোনা খুঁজতে যাবেন?’ মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘না, না, সোনা খোঁজার ইচ্ছা আমার নেই। আসলে আমি একটা বই লিখছি। তার প্রয়োজনেই ও রকম কোনো জায়গায় যেতে চাই আমি।’
ইল্লাপার এবার তার কন্ঠের কঠিনতা ও গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘ওসব গোপন নগরীর হদিশ আমরা বাইরের লোককে দিই না। ওসব জায়গা লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছি আমরা। ওখানে বাইরের পৃথিবীর মানুষের পা পড়ুক তা চাই না আমরা।’
‘কেন?’ প্রফেসর, ইনকা পুরোহিতের কথা শুনে কিছু বলার আগেই হঠাৎই নিজের অজান্তে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল সুজয়ের মুখ থেকে। ইল্লাপা এবার স্থিরদৃষ্টিতে একবার তাকালেন সুজয়ের দিকে। তারপর বললেন, ‘ওসব নগরী সূর্যদেব ইনতির পবিত্র বাসভূমি। সূর্যপুত্ররা ইনতির সাধনা করেন সেখানে। তোমরা বিদেশিরা একবার তার সন্ধান পেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ছুটতে শুরু করবে ওসব জায়গাতে। হারিয়ে যাবে আমাদের উপাসনাস্থল। ঠিক যেমন হল এই মাচুপিচুতে। পৃথিবীর মন থেকে এ পবিত্র স্থান মুছে গেলেও এ নগরীর সন্ধান আমরা ইনকা পুরোহিতরা বংশপরম্পরায় জানতাম। এখানে ইনতির উপাসনা আর জাদুবিদ্যাচর্চা করতে আসতেন ইনকা পুরোহিতের দল। তারপর একদিন এক সাদা চামড়া খুঁজে বার করল এ শহর। লোকজন এক এক করে আসতে শুরু করল এখানে। সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল।’ এরপর ইনতি পুজারি দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব যেন বললেন স্বগতোক্তির সুরে। যার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না সুজয়। মার্কেজের ওসব কথা বোধগম্য হল কিনা তাও সে ধারণা করতে পারল না।
ইনকা পুরোহিতের কথা শেষ হলে, একটু চুপ করে থেকে মার্কেজ তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আচ্ছা, ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। আপনাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।’
ইল্লাপা কোনো জবাব দিলেন না তার কথায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতে লাগলেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকাতেই সুজয় আর মার্কেজের চোখে পড়ল তাদের মাথার ওপরেই আকাশের বুকে ডানা মেলে ভাসছে বেশ বড়ো আকারের কী একটা পাখি! একমাত্র চিল বা বাজ জাতীয় পাখিরাই ওভাবে স্থির হয়ে বাতাসে ভাসতে পারে। ইনকা পুরোহিত এরপর হঠাৎ তার দীর্ঘ ডান বাহু প্রসারিত করে তুলে ধরলেন আকাশের দিকে। আর তারপর মুহূর্তেই পাখিটা তির বেগে নীচে নেমে এসে ডানা ঝটপট করে বসল ইল্লাপার বাহুতে। ইল্লাপা পাখিটার মাথায় একবার হাত বোলাবার পর সে হাত বেয়ে তার কাঁধে গিয়ে বসল। সুজয় ভালো করে দেখতে লাগল পাখিটাকে। সত্যিই বেশ বড়ো পাখি। ছাই রঙা পাখিটার পিঠ ইল্লাপার মাথার সমান প্রায় উঁচু। তার সবল পায়ে ধারালো নখ, বাঁকানো সবল ঠোঁট। সে যে শিকারি গোত্রের তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইল্লাপার ডান কাঁধের ওপর পাখি বসার জন্যই সম্ভবত পোশাকের গায়ে একটা চামড়ার পটি লাগানো আছে। কাঁধে বসার পর পাখিটা বার দুই সেই চামড়ার পটিতে ঠোঁট ঘসে মাথা তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সুজয়ের দিকে। তার লাল চোখ দুটো হিংস্রতা মাখা। সেদিকে তাকিয়ে সুজয়ের গা-টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। পাখিটার ধারালো নখ আর ঠোঁট যেকোনো প্রাণীকে মুহূর্তে চিরে ফালা ফালা করে দিতে পারে! সে ইল্লাপার কাঁধে বসার পর মি. পিনচিও মনে হয় তার ভয়ে তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
মার্কেজ পাখিটাকে ভালো করে দেখার পর অবাক হয়ে ইল্লাপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি পাখি?’
ইল্লাপা জবাব দিলেন, ‘কনডোরের বাচ্চা’।
ইনকা পুরোহিতের থেকে প্রাচীন নগরীর সন্ধান পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পালটে মার্কেজ পিনচিওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা এখানে এসে এখন পর্যন্ত কী কী দেখা হল আপনার? সূর্য মন্দির, ইনতিহুয়ানাতা এসব দেখা হয়ে গেছে আপনার?’
পিনচিও বললেন, ‘না ওসব কিছু এখনও আমার দেখা হয়নি। এখানে এসে সরাসরি এ জায়গাতে চলে এসেছি। ইনকা পুরোহিত এ ঘরেই রাত কাটাবেন। আমার গাইড ওঁরই একটা কাজে গেছে। সে ফিরলে তাকে নিয়ে দেখতে বেরোব।’
এরপর পিনচিও সুজয়দের আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই পিছনে একটা খসখস শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে মার্কেজ আর সুজয় দেখতে পেল তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে পিনচিওর সেই একচক্ষু গাইড। তার সঙ্গে রয়েছে একটা ধবধবে সাদা লামার বাচ্চা। তার লাগামটা ধরা আছে লোকটার হাতে। সে লামাটা আনার পর ইল্লাপা যেন মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করলেন প্রাণীটাকে। তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় গাইডটাকে কী বললেন, তার কথা শুনে লোকটা সুজয়দের পাশ কাটিয়ে প্রাণীটাকে নিয়ে পাথুরে ঘরটার ভিতরে গিয়ে ঢুকল।
মার্কেজ পিনচিওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এ প্রাণীটা দিয়ে কি হবে?’
পিনচিও বললেন, ‘ইনকা পুরোহিত যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে সঙ্গে নিয়ে যাবেন লামাটাকে। ওকে সেখানে বলি দেওয়া হবে।’
মার্কেজ তাঁর কথা শোনার পর সুজয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে জানানোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘প্রাচীন কালেও কিন্তু ইনকারা ধর্মীয় উৎসবে লামা বলি দিতেন। যুগ যুগ ধরে সে প্রথা আজও চালু আছে। তবে সে-সময় নরবলি দানও করা হত। বিশেষত যুদ্ধ যাত্রার প্রাক্কালে জয়লাভের আশায় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে নর রক্ত তারা ইনতিকে উৎসর্গ করত। সুলক্ষণা সূর্যকন্যা বা বালকদেরই নির্বাচন করা হত বলির জন্য। একবার একসঙ্গে দুশোজনকে বলি দিয়ে ছিল তারা…।’
প্রফেসর কথাগুলো সুজয়কে বললেও পিনচিও তা শুনে বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এক সাথে দুশোজনকে! এটাতো জানা ছিল না! কেন?’
মার্কেজ তাঁর কথার উত্তর দেবার আগেই শোনা গেল সুসানের গলা, ‘ওঃ কী বাতাসের ঝাপটা এখানে!’।
সুসান বিলের সঙ্গে এসে উপস্থিত হল সুজয়দের পিছনে। তারপর সুজয়দের সঙ্গে পিনচিও আর পাখি কাঁধে অদ্ভুত পোশাক পরা একজন লোককে দেখতে পেয়ে একটু থতোমতো খেয়ে মার্কেজের কোল ঘেষে দাঁড়াল। বিলও ইনকা পূজারিকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ইল্লাপা এবার শুধু নবাগতদের তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দৃষ্টিপাত করে আকাশের দিকে তাকালেন।
পিনচিও ইল্লাপার উদ্দেশ্যে এবার সুসান আর বিলের পরিচয় দিলেন। আকাশের দিকে চোখ রেখেই ইনকা পুরোহিত নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবেই যেন তাঁর ডান হাত নিজের বুকের কাছে এনে সম্ভাষণ জানালেন বিলকে।
ঠিক এই সময় লামাটাকে ঘরের ভিতর রেখে বাইরে বেরিয়ে ইল্লাপার পাশে এসে দাঁড়াল পিনচিওর গাইড হুইকো। একচোখে সে একবার নিরীক্ষণ করল সকলকে। সুজয়ের মনে হল, সকলকে দেখার পর তার দৃষ্টি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল সুসানের দিকে। আর তার -পরই সে ইল্লাপার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কি বলল! তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইনকা পুরোহিত আকাশের থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা তাকালেন সুসানের দিকে। কয়েক মুহূর্ত ভালো করে তাকে দেখার পর ইনকা পুরোহিত দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা বললেন তার পাশে দাঁড়ানো হুইকোর উদ্দেশ্যে।
সুসান মনে হয় পিনচিওর গাইডকে দেখে আবার ভয় পেয়ে গেল, সে তার দাদুর কোটের হাতা ধরে টান দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘এবার চলো, আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।’
ঘরের ভিতরটা দেখার ইচ্ছা থাকলেও সেখানে ঢোকা আর সমীচীন মনে হল না মার্কেজের। ইনকা পুরোহিতের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র হয়তো রাখা আছে ঘরের মধ্যে। ভিতরে ঢুকলে তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ হতে পারে। তা ছাড়া ইল্লাপা লোকটা যেন একটু রুক্ষ ধরনের। কাজেই সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করে তিনি পিনচিওর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমরা তাহলে এবার যাচ্ছি। আরও দেখা বাকি আছে আমাদের। এত বড়ো জায়গা দেখতে বেশ সময় লাগে। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল।
পিনচিও প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমারও ভালো লাগল। আপনারা বেড়ান। আমিও হুইকোর সাথে একটু পরে দেখতে বেরব। আবার নিশ্চই আপনাদের সাথে আমার দেখা হবে।’
মার্কেজ বললেন, ‘একই জায়গায় যখন বেড়াচ্ছি তখন নিশ্চয়ই দেখা হবে। ভালো করে বেড়ান, অনেক কিছু দেখার আছে এখানে।’ একথা বলে তিনি তাকে বিদায় জানিয়ে সুজয়দের সঙ্গে নিয়ে সে জায়গা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন অন্য গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে বিল মন্তব্য করল, ‘মাথায় পালক লাগানো লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল, ও যেন আমাদের ঠিক পছন্দ করল না।’ মার্কেজ বললেন, ‘ওই লোকটা করিকানচার পুরোহিত। খাঁটি ইনকা রক্ত গায়ে আছে ওর। এখানকার স্থানীয় মানুষরা কেউই এসব জায়গা অর্থাৎ তাদের প্রাচীন ধর্মস্থানে বাইরের লোকের আনাগোনা পছন্দ করে না। নেহাত দেশটা গরিব। টুরিস্টদের আসা-যাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এখানকার বর্তমান অর্থনীতি। তাই ওরা মুখে কিছু বলে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অপছন্দ করে আমাদের। তাই ইনকা পুরোহিতের এ ব্যবহার আশ্চর্যের কিছু নয়।’
সুজয় বলল, ‘তাহলে তো তাঁর পিনচিওকেও অপছন্দ করা উচিত?’
প্রফেসর বললেন, ‘তাইতো করা উচিত।’
বিল প্রশ্ন করল, ‘আমরা এবার কোন দিকে যাচ্ছি?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘সূর্যমন্দিরের দিকে।’
আশেপাশের স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে, পাহাড়ের ধাপ ভেঙে উঠে নেমে সুজয়রা এক সময় পৌঁছে গেল মাচুপিচুর করিকানচা বা সূর্যমন্দির চত্বরে। মন্দিরটা বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এক সময় যে কলেবরে যে বেশ বড়ো ছিল তা বোঝা যায়। তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আকাল্লাকুনা বা সূর্যকন্যাদের আবাস। পর্যটকদের বেশ ভিড় আছে এ জায়গাতে। বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ নানা রকম জিনিসও ফেরি করছে সেখানে। তাদেরই একজনের হাতে ধরা লাঠি থেকে ঝুলছিল ফুট তিনকে করে লম্বা নানা রঙের রেশমের দড়ি। সুজয়রা চত্বরে গিয়ে উপস্থিত হতেই লোকটা তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে দড়িগুলো দেখিয়ে বলল, ‘খিপু স্যার?’ ‘খিপু? ভেরি চিপ…’ দড়িগুলো কী কাজে লাগে তা বুঝতে না-পেরে সুজয় তাকাল মার্কেজের দিকে। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর সুজয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই দড়িগুলোর নাম খিপু’। ইংরেজি বানান, ‘QUIPU’। ইনকারা সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপারে অবগত থাকলেও সংখ্যা লিখন তাঁদের জানা ছিল না। খিপু নামের এই দড়িগুলোর সাহায্যেই তারা হিসাব রাখত। একটা দড়ি হাতে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ভালো করে দেখুন, দড়িটার স্থানে স্থানে গিঁট দেওয়া আছে। গিঁটের সংখ্যা, ধরন, তাদের মধ্যে দূরত্ব, দড়ির বুনোন, উপকরণ আর রং দিয়ে সংখ্যা ও কীসের গণনা করা হচ্ছে তা চিহ্নিত করা হত। যেমন আমার হাতের দড়ির রংটা সাদা। পাঁচটা গিঁট আছে এতে। প্রত্যেকটা গিঁট সমদূরত্বে। সাদা রং নির্দেশ করত লামার সংখ্যা। পাঁচটা গিঁটের অর্থ ‘পাঁচ’। আর সমদূরত্ত্বের অর্থ, প্রত্যেকের পিছনে একটা ‘শূন্য’ বর্তমান। অর্থাৎ এ দড়ির সাহায্যে পঞ্চাশটা লামা বোঝান হচ্ছে। ঠিক এমনভাবে গৃহপালিত পশু বোঝানোর জন্য সবুজ রঙের দড়ি, সৈন্য সংখ্যা বোঝানোর জন্য লাল রঙের দড়ি ইত্যাদি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল। এখনও পর্যন্ত প্রায় দুশো রকমের খিপু আবিষ্কার হয়েছে। শস্যের হিসাব থেকে শুরু করে জনগণনা, সবকিছুরই হিসাব তারা খিপুর মাধ্যমেই রাখত। সেদিনের স্মৃতি ধরে রাখতে এগুলো বিক্রি করা হয়। টুরিস্টরা সুভিনির হিসেবে কেনে।’
মার্কেজের কথা শোনার পর সুজয় গোটা দু-এক খিপু কিনল দেশে ফিরে বন্ধুবান্ধবদের দেবে বলে। মার্কেজ বললেন, তার প্রত্যেক ক-টার অর্থ পরে তিনি সুজয়কে বুঝিয়ে দেবেন।
এরপর তারা সকলে প্রবেশ করলেন মন্দিরে। কুজকোর মন্দিরের সঙ্গে এ মন্দিরের পার্থক্য হল, এখানকার দেওয়ালের গায়ে খোদিত হুয়াকাগুলো অন্য ধরনের। ফুল-পশুপাখির নকশার পরিবর্তে এখানে দেওয়ালের গায়ে আঁকা আছে বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক নকশা, মার্কেজ জানালেন, এই আঁকজোকগুলো সম্ভবত বিভিন্ন ঋতুতে সূর্যের গতিপথের অঙ্কন। এ ছাড়া বিভিন্ন আকারের স্তম্ভ ও অদ্ভুত জ্যামিতিক স্থাপত্যও রয়েছে এখানে। মন্দিরের ভিতরে কোনো বিগ্রহ নেই। কোনো কোনো পন্ডিতের নাকি অভিমত, এ জায়গা আসলে ছিল মানমন্দির। ইনকা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের গতিপথ ও রাতের আকাশে নক্ষত্রমন্ডলের অবস্থান নির্ণয় করতেন এখান থেকে। তাঁরা আবহাওয়ার ভবিষ্যদবাণী করতেন। যার ওপর নির্ভর করে ইনকারা তাদের কৃষিকাজ সম্পূর্ণ করতেন।
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে এই মানমন্দির ঘুরে ঘুরে দেখল সুজয়রা। প্রফেসর মার্কেজ বুঝিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো। তারপর একসময় সে জায়গা ছেড়ে তারা রওনা হল অন্যদিকে। এ রকমই একটা চত্বরে বেশ কয়েকটা তাঁবু চোখে পড়ল সুজয়দের। তাঁবুগুলোর সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রিল্যাক্সড মেজাজে বসে রয়েছে সাদা চামড়ার বেশ কয়েকজন টুরিস্ট। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে তারা। মার্কেজ তা দেখে বললেন, ‘সম্ভবত এই তাঁবুগুলোতেই রাত কাটাবে এরা। দেখি, হোটেলে ফিরে কথা বলি। আমারও আজ রাতটা এই প্রাচীন নগরীতেই থাকতে ইচ্ছা করছে।’ তাঁর কথা শুনে সুজয় মনে মনে বলল, ‘তাহলে তো বেশ ভালোই হয়। একটা দুর্লভ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়া যাবে।’
গোটা দশেক চত্বর অতিক্রম করার পর অবশেষে সুজয়রা উঠে এল পাহাড়ের মাথার ওপর। সেখানে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে রয়েছে অতিপ্রাচীন বেশ কিছু ছাদহীন পাথরের ঘর। আর তার একপাশে বেশ উঁচু একটা বেদীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের তৈরি স্তম্ভ। তার চারদিক থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে স্তম্ভর পাদদেশে পৌঁছোবার জন্য। সুজয়রা গিয়ে দাঁড়াল স্তম্ভ বেদীর নীচে। মার্কেজ সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই হল মাচুপিচুর বিখ্যাত ‘ইনতিহুয়ানাতা’ বা সূর্যকে বেঁধে রাখার স্তম্ভ। এর ছায়া দেখেই সূর্যর ক্রান্তি পথ ও সময় গণনা করা হত। তা ছাড়া উৎসবের দিনে এই স্তম্ভর ওপর আগুন জ্বালানো হোত।’
‘কীভাবে?’ জানতে চাইল সুজয়।
তিনি বললেন, ‘আগুন জ্বালাবার জন্য ইনকারা বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করত। তাঁরা কাচের ব্যবহার জানতেন না। বিরাট বিরাট অবতল আকৃতির সোনার চাকতি দিয়ে সূর্যরশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করে তারা দাহ্যবস্তুর ওপর ফেলে প্রচন্ড উত্তাপ সৃষ্টি করে আগুন জ্বালত তারা। ওই অবতল চাকতিগুলো যেখানে আগুন জ্বালানো হত তার চারপাশে অনুচ্চ স্তম্ভের গায়ে এমনভাবে লাগানো থাকত যে উলম্বভাবে নাড়াচাড়া করা যায়।’ এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘এই পদ্ধতিতে স্তম্ভর গায়ে বেঁধে অপরাধী বা সাদা চামড়ার বিদেশিদের সূর্যরশ্মি দিয়ে পুড়িয়ে মারা হত।’
বিল তার কথা শুনে বলল, ‘হ্যাঁ, এরকম ব্যাপার কোনো একটা বইতে পড়েছিলাম!’
সুসান বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও পড়েছি, টিনটিনের গল্পে!’
বিল ক্যামেরা বার করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল ইনতিহুয়ানাতার। সুজয়ও তুলল। তারপর বিল সিঁড়ি বেয়ে বেদীর ওপর উঠে চারপাশে তাকিয়ে নীচে দাঁড়ানো সুজয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এখানে উঠে এসে তোমার ক্যামেরায় ছবি নাও। মাচুপিচুর পুরো ভিউ পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে! মার্ভেলাস!’ তার কথা শুনে সুজয়ও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল। মার্কেজ আর সুসান দাঁড়িয়ে রইল নীচে। সত্যিই বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে, প্রাচীন নগরীর প্রায় সম্পূর্ণটাই চোখে পড়ছে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পবিত্র ইনকা নগরীর চিহ্ন। সূর্য পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করেছে। নগরীর এক অংশে পড়েছে পাহাড়ের ছায়া। তবে পূর্বদিকের জঙ্গলের মাথায় কুয়াশার আস্তরণ এখন আর নেই। সেদিকে অনেক অনেক দূরে নীল আকাশের বুকে চোখে পড়ছে নাম না-জানা পর্বতশৃঙ্গ। সুজয় ওপর থেকে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা নগরীর বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। বিল প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, সে ক্যামেরা এক হাতে চোখের সামনে তুলে ধরে অন্য হাতে ক্যামেরার জুমটা ঘুরিয়ে কীভাবে তুললে ছবিটা ভালো হবে তা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ক্যামেরা ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ থমকে গিয়ে লেন্সে চোখ রেখে সে বলল, ‘আরে ওই লোকটা ওখানে কী করছে!’ পাশে দাঁড়ান সুজয় বিলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কে?’ বিল কোনো কথা না-বলে বেশ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একসারি পাথুরে ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে তার ক্যামেরাটা সুজয়ের হাতে তুলে দিল। ক্যামেরায় চোখ রাখল সুজয়। জুম লেন্সটা দূরের ঘরগুলোকে কাছে নিয়ে এসেছে। সুজয় দেখল পাথরের ঘরগুলোর একটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মি. পিনচিওর গাইড হুইকো! সুজয়ের মনে হল সে যেন দূর থেকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। কিন্তু ঘরগুলোর আশেপাশে পিনচিওকে কোথাও দেখতে পেল না সে। কয়েক মুহূর্ত পর ধীরে ধীরে লোকটা একটা ছাদহীন ঘরের দেওয়ালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্যামেরাটা বিলের হাতে তুলে দিয়ে সুজয় বলল, ‘মনে হল লোকটা যেন আমাদেরই দেখছিল।’ বিল জবাব দিল আমারও তাই মনে হল, তাই তোমাকে দেখালাম।’ এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে বিল কয়েকটা ছবি তোলার পর তারা দুজন নীচে নেমে এল।
বিল মার্কেজের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এবার কোন দিকে যাওয়া হবে?’
মার্কেজ তার রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিনটে বেজে গেছে। নীচে নেমে আমরা এখন সোজা হোটেলে ফিরব। যদি হোটেলে গিয়ে রাতে এখানে থাকার বন্দোবস্ত হয়ে যায় তাহলে তো আবার আমাদের সন্ধ্যার আগেই এ জায়গাতে ফিরতে হবে। কাজেই বলা যেতে পারে এখনকার মতো আমাদের কাজ শেষ।’
তাঁর কথা শুনে ঘাড় নেড়ে বিল তার ক্যামেরা চামড়ার কেসের মধ্যে পুরে ফেলল। তারপর সকলে ইনতিহুয়াতানা চত্বর ছেড়ে নীচে নামতে শুরু করল। নামতে নামতে মার্কেজ বললেন, ‘আবার ফিরতে হলে এবার ঘোড়াতেই ফিরব। দু-বার পাহাড় ভাঙার ধকল এ বয়সে সহ্য হবে না।’
দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে যত সময় লেগেছিল, নীচে নামতে তত সময় লাগল না তাদের। ঘোড়া চলাচলের একটা পথ ধরে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে আসা গেল। তারপর তারা পা বাড়াল হোটেলের দিকে।