সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – ৪

চড়াই বেয়ে উঠছে সুজয়দের গাড়ি। মসৃণ পাথর বিছানো রাস্তা। দু-পাশে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে নীচের দিকের তাকালে চোখে পড়ছে গভীর বনানীর মাঝে রূপালি রেখা। চুলের কাঁটার মতো নাম না-জানা পাহাড়ি নদীর বাঁক। দূরের তুষারধবল পর্বতমালাগুলো ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।

বেশ ঝলমলে সকাল। কুজকো থেকে যাত্রা শুরু করার পর ঘণ্টা খানেক সময় কেটে গেছে। দু-পাশের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চলেছে সবাই। মার্কেজ বললেন, ‘আমরা যে রাস্তা ধরে চলেছি, এর নাম ‘ইনকা রোড’। এ রাস্তা কিন্তু ইনকা সম্রাটদের আমলে তৈরি করা। ভালো করে লক্ষ করুন রাস্তার পাথরের ব্লকগুলো কী নিখুঁতভাবে কেটে পাশাপাশি বসানো আছে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে যে ইনকারা লোহার ব্যবহার জানত না! তবে আমরা যে-পথ আজ গাড়িতে চলেছি, এপথ কিন্তু তৈরি হয়েছিল পায়ে চলার জন্যই। আমরা ওপর দিকে উঠলেও রাস্তার ঢাল খুব সামান্য। মানুষ এবং পণ্য বহনকারী লামাদের চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল এ পথ।’

সুজয় প্রশ্ন করল, ‘এ রাস্তা কার আমলে তৈরি হয়?’

মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘এ রাস্তা ঠিক কার আমলে হয়েছিল তা সঠিক বলতে পারব না। তবে মজার ব্যাপার হল, ইনকারা লোহার মতো ‘চাকা’-র ব্যবহার না-জানলেও তাদের সড়ক ব্যবস্থা কিন্তু খুব উন্নত ছিল। সাম্রাজ্যের পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের তটরেখা বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তরে নির্মাণ করা হয়েছিল প্রধান সড়ক। এসড়ক পথ তার শাখাপ্রশাখা মিলিয়ে কুড়ি হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত ছিল। সমুদ্র উপকূল থেকে বাইশহাজার ফুট উচ্চতাতেও উঠেছে এসব পথ। ভাবতে পারেন!?’

এরপর একটু আবেগ মথিত কন্ঠে তিনি বললেন, ‘আমরা যে পথ ধরে ওপরে উঠছি সে-পথ ধরেই একদিন স্বর্ণনির্মিত চতুর্দোলায় চেপে, বর্শাধারী পদাতিক সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে পবিত্র মাচুপিচুতে যেতেন ইনকা সম্রাটরা। সৈন্যদের কাঠের জুতো পরা পায়ের সংঘবদ্ধ পদচারণার শব্দ প্রতিধ্বনিত হত পাথুরে দেওয়ালে। এদের রঙচঙে পোশাক, সোনার সাজ সূর্যের আলোতে এমন ঝলমল করত যে চোখ ধাঁধিয়ে যেত অনেক দুর থেকে চেয়ে থাকা পথিকদের। রাস্তার পাশে ছড়িয়ে থাকা প্রজারা পরমসম্ভ্রমে মাথা নোয়াতো সম্রাটের উদ্দেশ্যে। কারণ, তিনি স্বয়ং সূর্যপুত্র! তুষার-ধবল পর্বতমালা, বিস্তীর্ণ সমুদ্রপকূল, নদী-বনজঙ্গল এসব কিছুরই মালিক হলেন তিনি—ইনকা। কিন্তু কালের অমোঘ নিয়মে সেদিনের সোনাঝরা ইনকা সাম্রাজ্য হারিয়ে গেছে। পড়ে আছে এ পথটাই। যে পথ আমাদের পৌঁছে দেবে ইনকাদের স্মৃতিমন্দির মাচুপিচুতে।’

বেশ কিছু টুরিস্ট গাড়ি চলছে সুজয়দের গাড়ির আগে-পিছে। রাস্তার স্পিড লিমিট বাঁধা আছে পঁচিশ কিলোমিটার। নিয়ম মেনেই চলছে সবাই। রাস্তা সংরক্ষণের জন্য বড়ো-ভারি গাড়ি চলা নিষিদ্ধ এ রাস্তায়। অধিকাংশই জিপ বা ল্যাণ্ডরোভার জাতীয় গাড়ি চোখে পড়ছে। আর চলছে ভারবাহী লামাদের কাফেলা। উট জাতীয় প্রাণীগুলো নানা ধরনের পুঁতির মালা দিয়ে সাজানো। টুং-টাং মিষ্টি শব্দ হচ্ছে তাদের গলার ঘণ্টা থেকে। পিঠের দু-পাশে ঝুলছে পণ্যের বস্তা। মার্কেজ জানালেন ওই সব বস্তায় কুজকো থেকে মাচুপিচুতে টুরিস্টদের জন্য রসদ যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে এ ভাবেই পণ্য পরিবহণ হয়। তবে বিজ্ঞানের আর গতির যুগে এ ব্যবস্থা আর কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে আসছে। ইউনেস্কো মাচুপিচুকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর তালিকার অন্তর্ভুক্ত করায় এমনিতেই ভিড় বাড়ছিল। তার ওপর সম্প্রতি মাচুপিচু পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকাভুক্ত হওয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটক এখানে ছুটে আসছে। এই অবস্থা সামাল দিতে ভিলকন্টানদীর ওপর আধুনিক ব্রিজ তৈরি করছে গভর্নমেন্ট। অতিদ্রুত পণ্যবাহী যানবাহন আর টুরিস্ট যে পথে পৌঁছে যেতে পারবে মাচুপিচুতে।

দু-পাশের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চলল সুজয়রা। সুসানকেও আজ বেশ চনমনে দেখাচ্ছে। পথের পাশে নানা দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে এটা কী? এটা কী বলে প্রশ্ন করতে লাগল তার দাদুকে। মার্কেজ তার প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন, আর তার পাশাপাশি সুজয় আর বিলের উদ্দেশ্যে বলে চললেন ইনকা সভ্যতার খন্ড খন্ড কথা। প্রয়োজন মতো সুজয়ও তাঁকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগল।

আরও এক ঘণ্টা পথ চলার পর পথের বাঁকে নীচের দিকে চোখে পড়ল এক নদী। নদীটা যে বেশ বড়ো তা ওপর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। বাঁক নিয়ে সে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের ঢালে গভীর অরণ্যের মধ্যে। এত দূর থেকেও তার কলোচ্ছ্বাস যেন কানে আসছে। মার্কেজ বললেন, ‘ওই দেখুন বিখ্যাত উরুবাম্বা নদী। এ নদী আমাজনের উৎস। আমরা আমাদের গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’ গাড়ি থামিয়ে ওপর থেকে উরুবাম্বার ছবি তুলল বিল আর সুজয়। বাইরের বাতাস বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। ছবি তোলার পর গাড়িতে উঠে হালকা গরম পোশাক গায়ে চাপিয়ে নিল সকলে। আর আধঘন্টার মধ্যেই তাদের গাড়ি পৌঁছে গেল পাহাড় ঘেরা উপত্যকার পাদদেশে।

সুজয়দের গাড়ি যেখানে এসে থামল সে জায়গাতে লোকজন গাড়িঘোড়ার ভিড়। তার একটা বড়ো অংশই বিদেশি টুরিস্ট। রাস্তার পাশে সার সার দোকান। কাঠের তৈরি দোতলা-তিনতলা বেশ বড়ো বড়ো আধুনিক কয়েকটা হোটেলও আছে সেখানে। সুজয়ের মনে ধারণা ছিল এ জায়গাটা হয়তো ফাঁকা ফাঁকা হবে। গাড়ি থেকে নামার পর সে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ জায়গাই কি মাচুপিচু?’ মার্কেজ হেসে বললেন, ‘আমরা দাঁড়িয়ে আছি মাচুপিচুর পাদদেশে। ওই দেখুন!’ এই বলে তিনি আঙুল তুলে দেখালেন সুজয়ের পিছন দিকে পাহাড়ের দিকে। সে দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সুজয়। পাশাপাশি দুটো পাহাড় সে দিকে উঠে গেছে আকাশের দিকে। আর সেই দুই পাহাড়ের খাঁজে থাক থাক পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। কালচে-হলদেটে গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি সার সার বাড়ি-ঘর-স্তম্ভ। প্রাচীনত্বের গাম্ভীর্য নিয়ে বিরাজমান পাহাড়ের বুকে। আকাশ আর পাহাড়ের রং দুটোই ঘন নীল। একেবারে ওপরের দিকের বাড়ি-ঘরগুলো ঢেকে আছে ঘন কুয়াশার মধ্যে। সময় যেন সত্যিই থমকে আছে ওখানে। মার্কেজ বললেন, ‘ওই হল মাচুপিচু, ‘দ্য সেক্রেড প্লেস অব ইনকা।’

এখানে হোটেল বুকিং কুজকো থেকেই করা ছিল মার্কেজের। গাড়ি ছেড়ে কিছুটা হেঁটে ছিমছাম দেখতে দোতলা একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মার্কেজ বললেন, ‘এই আমাদের হোটেল।’ হোটেলের গায়ে সোনালি হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘গোল্ডেন ইনকা’। মার্কেজ কাচের দরজা ঠেলে সুজয়দের নিয়ে প্রবেশ করলেন গোল্ডেন ইনকার রিসেপশনে। বেশ সুন্দরভাবে সাজানো রিসেপশন রুম। মাটিতে লাল কার্পেট পাতা। দেওয়াল জুড়ে মাচুপিচুর বাঁধানো ফটোগ্রাফ—দর্শনীয় স্থানের ছবি।

সুজয়রা বসল রিসেপশনের সোফায় আর মার্কেজ এগিয়ে গেলেন ঘরের এক কোণায় কাউন্টারের দিকে। সেখানে বসেছিলেন এক সুবেশী তরুণী। মার্কেজ পকেট থেকে বুকিং স্লিপ বার করে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। কী সব কথাবার্তা হল তাদের দুজনের মধ্যে। মার্কেজকে একটা খাতায় সই করালেন রিসেপশনিস্ট, তারপর ডেকে পাঠালেন এক বেয়ারাকে। মার্কেজের ইশারাতে উঠে পড়ল সুজয়রা। লাগেজগুলো তুলে নিল বেয়ারা। সবাইকে নিয়ে তার পিছন পিছন হোটেলের ভিতর প্রবেশ করলেন মার্কেজ।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে সুজয়ের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘আপনার হয়তো একটু অসুবিধা হবে। আসলে আমার দুটো রুমের বুকিং ছিল। আর একটা রুম পাওয়া গেল না। আপনাকে আর বিলকে একটা রুমে থাকতে হবে। তবে রিসেপশনিস্ট বলল, একটা ঘরে দুজনের থাকার কোনো অসুবিধা নেই।’

সুজয় বলল, ‘বিলের কোনো অসুবিধা না-হলে আমার অসুবিধা হবে না।’

বিল বলল, ‘আমার আবার কী অসুবিধা হবে! মাস খানেকতো আমাজনের জঙ্গলে তাঁবুর মধ্যেই রাত কাটালাম! একবার তো একটা প্যান্থারের বাচ্চা সারা রাত কাটিয়ে গেল তাঁবুতে আমার ক্যাম্পখাটের নীচে। হোটেলের ঘর তো সে তুলনায় স্বর্গ। রাতবিরেতে জন্তুজানোয়ার ঢুকে পড়ার ভয় নেই।’

বিলের কথা শুনে মার্কেজ বললেন, ‘তাঁবুর কথা শুনে মনে পড়ে গেল, ‘রিসেপশনিস্ট বলল যে পাহাড়ের ওপর মাচুপিচু চত্বরের মধ্যেই নাকি ‘গোল্ডেন ইনকার’ তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন হলে সেখানেও আমরা থাকতে পারি।’

সুজয় বলল, ‘পাহাড়ের ওপর প্রাচীন নগরীতে রাত কাটানো বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার হবে। আমি কিন্তু ব্যাপারটাতে আগ্রহী।’ মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘ঠিক আছে দেখা যাক কী করা যায়।’

ঘরে ঢোকার পর সুজয়রা বুঝতে পারল ঘরগুলো বেশ বিরাট, অনায়াসে দুজন থাকা যায়। প্রফেসর বললেন, ‘আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। অনেকটা ছড়ানো জায়গা মাচুপিচু। দেখতে বেশ সময় লাগবে।’

মার্কেজ সুসানকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাবার পর সুজয় আর বিল ঢুকে পড়ল তাদের ঘরে। বিল দরজা বন্ধ করার পর ফ্রেশ হবার জন্য শার্ট খুলে ফেলতেই সুজয় একটু চমকে উঠে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিল তার কারণ বুঝতে না-পেরে প্রথমে বলল, ‘কী হল!?’

তার পরক্ষণেই ব্যাপারটা ধরতে পেরে বলল, ‘ও এইটা?’ এরপর সে তার কোমরের বাইরে বেরিয়ে থাকা রিভলবারের বাঁটটা ধরে সেটা টেনে বার করে আনল। সুজয় তাকিয়ে রইল সেটার দিকে।

বিল একটু হেসে বলল, ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করিতো, তাই সঙ্গে রাখতে হয়। আমার নামে লাইসেন্সড করা। এটা নিয়ে ঘোরার অনুমতিপত্রও আছে।

বিল রিভলবারটা সুজয়ের হাতে তুলে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তুমি রাইফেল-রিভলবার চালিয়েছ?’

জিনিসটা বেশ ভারি। হাতে নিয়ে সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে সুজয় বলল, ‘না, সত্যিকারের রিভলবার এই প্রথম হাতে নিলাম।’

বিল উত্তর শুনে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেন তুমি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং নাওনি?’

জিনিসটা বিলের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সুজয় জবাব দিল, ‘না।’

বিল রিভলবারটা খাটের ওপর নামিয়ে রেখে কোমরের বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, ‘আমাদের দেশে ওই ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। ওই ট্রেনিং-এর সময় মেশিনগান পর্যন্ত চালিয়েছি আমি। তুমি যদি আমার সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে তাহলে রিভলবার চালানোটা অন্তত শিখিয়ে দিতে পারতাম।’

সুজয় হেসে বলল, ‘আমি সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার। রিভলবার চালানো শিখে আমি কী করব?’

বিল বলল, ‘সব কিছুই একটু-আধটু শিখে রাখা ভালো। জীবনে চলার পথে কখন কোন শিক্ষাটা কাজে লেগে যায় তা আগাম বলা যায় না।’

হোটেলে ঢোকার ঠিক আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে হালকা খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ল সুজয়রা। মার্কেজ বললেন, ‘পায়ে হেঁটেই ওপরে উঠব আমরা।’ সুজয়রা হাঁটতে শুরু করল। হোটেল, বাজার চত্বর ছাড়িয়ে একটু এগোবার পরই পাথরের ব্লক বিছানো রাস্তা ওপরে উঠে গেছে। ওপরে ওঠার পথের মুখে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরল তারা। অধিকাংশ টুরিস্টই হেঁটে ওপরে উঠছে। নানা দেশের নানা বর্ণের পোশাক তাদের পরনে। তার মধ্যে যেমন আছে শ্বেতবর্ণের দীর্ঘদেহী আমেরিকান বা ইউরোপীয়ান, তেমনই আছে পীত বর্ণের ছোটোখাটো চেহারার এশীয়রা। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে বলতে বা গাইডের কথা শুনতে শুনতে ওপরে উঠছে তারা। কেউ কেউ আবার ঘোড়ায় চেপেও চলেছে। মার্কেজ বললেন, ‘ঘোড়া নামের প্রাণী কিন্তু এদেশে আমদানি করে স্পেনীয়রা। তারা এ দেশে আসার আগে ঘোড়া চোখে দেখেনি ইনকারা। পিজরোর দূত যখন ঘোড়ায় চেপে সম্রাট আতাহুয়ালাপার সাথে সাক্ষাত করলেন, তখন সেই প্রথম ঘোড়া দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলেন ইনকা সম্রাট ও তার সঙ্গীরা। তারা ভেবেছিলেন এই অদ্ভুত প্রাণীরা কোনো দৈত্য বা অপদেবতা গোছের কিছু হবে!’

তার দাদুর কথা শুনে সুসান হেসে ফেলে বলল, ‘কই, আমিতো ঘোড়া দেখে ভয় পাইনি! আমিতো ঘোড়ার পিঠে চেপেওছি। আর, অতবড়ো রাজা ঘোড়া দেখে ভয় পেয়ে গেল!?’

বিল সুসানের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তুমিতো সাহসী ছেলে, তাই ভয় পাওনি।’

চলতে চলতে সুজয় অবশেষে একসময় উঠে এল নগরীর প্রবেশ তোরণের সামনে। গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি বিশাল তোরণ মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ভিনদেশি অভ্যাগতদের স্বাগত জানাচ্ছে। তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে মার্কেজ সুজয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোরণের গঠনটা লক্ষ করুন, ট্র্যাপিজিয়ম আকৃতির। এই ইনকা নগরীর বৈশিষ্ট হল, এখানের সব স্থাপত্যই জ্যামিতিক আকৃতির। গঠন বৈচিত্র্যে এ জায়গা পৃথিবীর অন্য সব প্রাচীন শহরের থেকে আলাদা।’ তোরণের মাথায় ছটাসহ সূর্যদেব ইনতির মুখ বসানো আছে। মসৃণ দেওয়ালের গায়ে খোদিত আছে ফুল-পাখি-জীবজন্তুদের বিভিন্ন পবিত্র চিহ্ন বা হুয়াকা, সময় যাদের এখনও সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিতে পারেনি। সুজয় বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তোরণের কারুকাজের দিকে। বিল ছবি তুলল প্রবেশ তোরণের। তারপর সকলে মিলে প্রবেশ করল তোরণের ভিতর।

সামনেই একটা পাথুরে চত্বর। মার্কেজ বললেন বেশ কিছুটা চড়াই ভাঙলাম তো, চলুন ওখানে বসে একটু জিরিয়ে নেই। এ নগর ঘুরে দেখতে হলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেকবার ওঠানামা করতে হবে। কোনো কোনো জায়গায় আবার রাস্তা ধসে গেছে, সেখানে পাথরের খাঁজে ভর দিয়ে ওপরে উঠতে হয়।’ চত্বরের ঠিক মাথার ওপর ঢাল বেয়ে সার সার দাঁড়িয়ে পাথরের তৈরি ছাদহীন ঘর, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। তার ছায়া এসে পড়েছে চত্বরের এক পাশে। সেই ছায়ায় ছড়িয়ে থাকা পাথরের স্তূপের ওপর সকলে গিয়ে বসল।

মিনিট পাঁচেক চুপচাপ বসে থাকার পর প্রফেসর মার্কেজ সুজয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এ জায়গার সম্বন্ধে আপনি নিশ্চই গাইড বইতে পড়েছেন, তবু দেখা শুরু করার আগে মাচুপিচু সম্পর্কে কয়েকটা কথা আপনাকে বলি। তাতে এ জায়গা সম্বন্ধে আপনার একটা ধারণা হবে।’ সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ বলুন। আমি এখনই আপনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম।’

প্রফেসর বক্তৃতার ঢঙে বলতে শুরু করলেন—‘‘মাচুপিচু। কোয়েচুয়া ভাষায় এ শব্দের অর্থ হল ‘বৃদ্ধপর্বত শৃঙ্গ’। এ নগরীর আসল নাম কী ছিল তা আজ সঠিক জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন, এ নগরীর নাম নাকি ছিল সূর্যনগরী’—ইনতির উপাসনার পবিত্র ভূমি। যাই হোক এ নগরী আজ মাচু-পিচু নামেই পরিচিত। সম্ভবত ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট পাচাকুটির আমলে, আমাজান উপত্যকার ট্রপিকাল রেনফরেস্টের উরুবাম্বা নদীর দু-হাজার ফিট ওপরে, প্রায় আট হাজার ফিট উচ্চতায়, চারপাশে কুয়াশা ঘেরা পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা এ জায়গাতে এ নগরী নির্মিত হয়। এ নগরীর স্থায়িত্ব কাল ছিল মাত্র একশো বছর। তারপরই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। একদিন যে জঙ্গল কেটে পাহাড়ের মাথায় ইনকারা এই আশ্চর্য নগর নির্মাণ করে ছিলেন তা আবার ঢেকে যায় গভীর জঙ্গলের আড়ালে। স্পেনীয়রা তাই একে খুঁজে পায়নি। এ শহরের কথা মুছে যায় সাধারণ মানুষের মন থেকে। শুধু কিছু ইনকা পুরোহিত নাকি বংশপরম্পরায় জানতেন এই লুপ্ত শহরের কথা। সযত্নে তারা এ কথা গোপন রেখেছিলেন সভ্য পৃথিবীর কাছে। তারা মনে করতেন, এ লুপ্ত নগরী হল প্রেতাত্মাদের আশ্রয় স্থল। প্রাজ্ঞ আত্মারা এখানে উপাসনা করেন। তারা চাননি যে বাইরের পৃথিবীর লোক তাঁদের শান্তি ভঙ্গ করুক। আজও কিন্তু স্থানীয় মানুষ এ ধারণা পোষণ করেন। ১৯১১-তে হিরাম বিংগহ্যাম এ শহর খুঁজে বার করার পরও বহুবছর স্থানীয় মানুষরা এ অঞ্চলে বাইরের পৃথিবীর মানুষকে প্রবেশ করতে দিত না। বিশেষত, সাদা চামড়ার ইউরোপীয়দের প্রতি ছিল তাদের প্রবল ঘৃণা।

পাহাড়ের ঢালে প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে এ নগরী। এ নগরীর দু-ভাগে বিভক্ত। পাহাড়ের ওপর দিকে ওই যে কুয়াশা ঘেরা জায়গা, ওকে বলে হানান। সূর্যমন্দির, ইনকাদের বিখ্যাত ‘তিন-জানলা ঘর’ ইত্যাদি রয়েছে ওখানে। আর নীচের অংশ অর্থাৎ আমরা যেখানে রয়েছি, অর্থাৎ পাহাড়ের নীচের এই অংশের নাম ‘হুরিন।’ বেশ অনেকটা চত্বর অতিক্রম করে হুরিন থেকে হানানে যেতে হয়। হানান ও হুরিনে প্রায় আড়াইশোটি স্থাপত্য আছে। তবে হানান অংশের স্থাপত্য বেশি আকর্ষণীয়।

এখানে ঘরের সংখ্যা দেখে অনুমান করা হয়, খুব বেশি হলে এক হাজার মতো লোকের বাসস্থান ছিল এখানে। কৃষিই ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। সূর্যদেবের উৎসবের সময় বহুমানুষ সমবেত হতেন এখানে। ইনকারা চাকা-লোহা বা লিপির ব্যবহার না-জানলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে যে তারা অনেক এগিয়ে ছিল তার বহুপ্রমাণ পাওয়া যায়। এই নগরীর বেশ কিছু জ্যামিতিক স্থাপত্য সে-প্রমাণ দেয়। এ নগরীর প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা নাকি নির্ভুলভাবে সূর্যের পরিক্রমণের গননা করতেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে আবহাওয়ার ভবিষ্যদবাণীর খবর ছড়িয়ে দিতেন সাম্রাজ্যে। সূর্যনগরীর ভবিষ্যদবাণীর ওপর নির্ভর করেই পরিলক্ষিত হত বিশাল সাম্রাজ্যের কৃষি কাজ। একদিকে মাচুপিচু ছিল সূর্যদেব ইনতির পবিত্র উপাসনা স্থল, অন্যদিকে এ স্থান ছিল কৃষিভিত্তিক ইনকাদের সামাজিক-দৈনন্দিন কাজের নিয়ন্ত্রক।’

কথাগুলো বলার পর উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর বললেন, ‘চলুন, এবার তাহলে ঘোরা শুরু করা যাক।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *