৩
উকেয়ালি রিসর্টের ব্যালকোনিতে পাশাপাশি চেয়ার সাজিয়ে বসেছিল সুজয়রা। রিসর্টে ফিরতে সাড়ে চারটে বেজে গেছিল। তারপর নিজেদের ঘরে ঘণ্টা দেড়েক বিশ্রাম নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে সকলে। একটু আগেই বারান্দায় বসে সান্ধ্য জলযোগ সেরেছে। রিসর্টের লোক কফি আর খাবার দিয়ে গেছিল। খাবারটার নাম ‘পিকানটে-ডি-কুই’। স্থানীয় খাবার। শুকরের হার্ট, বিন আর নুডুলস দিয়ে বানানো। খেতে খুব একটা মন্দ লাগল না সুজয়ের।
সুজয়ের রিস্টওয়াচে সাতটা বাজে। বারান্দার আলো নিভিয়ে দিয়েছে সুজয়রা। চাঁদ ধীরে ধীরে মাঝ আকাশে উঠছে। তার মৃদু আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। আশেপাশের হোটেলগুলোর ঢালু কাঠের ছাদের মাথার ওপর দিয়ে চাঁদের আলোতে উঁকি দিচ্ছে আন্দিজের শিখর। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও পড়তে শুরু করেছে। পাহাড়ি উপত্যকায় যেমন হয়। কোথা থেকে যেন মৃদু বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। কাছের কোনো হোটেলের বলরুম থেকে হয়তো। এ ছাড়া অন্য কোনো সাড়া শব্দ নেই। সুজয়ের বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা। ইতিমধ্যে প্রফেসরের সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে যে তার সাথেই সুজয় মাচুপিচু রওনা হবে পরদিন ভোরে। সেখানে একদিন কাটাবে তারা। তারপর প্রফেসর আর সুজয় নিজ নিজ চিন্তাভাবনা অনুযায়ী নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করে নেবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর সুজয় প্রফেসরকে বলল, ‘এখনতো আমাদের বসে থাকা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। আপনি বরং ইনকাদের গল্প বলুন। তাতে সময়টাও কাটবে আর গল্পের ছলে এখানকার ইতিহাস সম্বন্ধেও আমার আরও কিছু জানা হয়ে যাবে।’ সুজয়ের কথা শুনে বিলও বলল, ‘হ্যাঁ, ডিনারের জন্য ডাক আসবে সেই রাত ন-টায়। আপনি গল্প বলুন, শুনি।’
মার্কেজ হেসে বললেন, ‘ইনকাদের ইতিহাস বেশ বিস্তৃত। তার কোন কাহিনি আপনাদের বলি বলুনতে? তার চেয়ে আমি আপনাদের ইনকা সভ্যতায় মানুষরা কেমন জীবন কাটাত সে সম্বন্ধে বলি। তাতে তাদের সম্বন্ধে আপনাদের একটা ধারণা হবে।’
এই বলে একটু চুপ করে থেকে প্রফেসর মার্কেজ বলতে শুরু করলেন, ‘‘ওই যে চাঁদের আলোতে জেগে আছে আন্দিজ পর্বতমালা, ওই পর্বতমালাকে কেন্দ্র করে উত্তর থেকে দক্ষিণে ইকুয়েডর থেকে চিলি পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য, ইনকা সাম্রাজ্য। দক্ষিণের প্রশান্ত মহাসাগর, তারপর শুষ্ক মরুভূমি, তার গা দিয়ে উঠে যাওয়া আন্দিজ পর্বতমালা। আন্দিজের তুষারধবল শৃঙ্গ, তার পূর্ব দিকে পাহাড়ের ঢালে, আমাজান অববাহিকার গহীন জঙ্গল, এ সবই ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। প্রকৃতি দিয়েছিল অফুরন্ত সম্পদ। আর তাকে ব্যবহার করে সৎ পরিশ্রমী ইনকা গোষ্ঠী সাজিয়ে তুলেছিল তাঁদের সভ্যতাকে। ইনকা সভতা সত্যিই ছিল সোনার সভ্যতা। সমকালীন ইউরোপীয় সভ্যতার চেয়ে প্রকৃত অর্থেই অনেক এগিয়ে ছিল এ সভ্যতা। তাদের সমাজজীবনও ছিল নৈতিকতার দিক থেকে ইউরোপীয়দের থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। চুরি কাকে বলে তা বলতে গেলে জানা ছিল না ইনকাবাসীদের। কাজের জন্য কোথাও কেউ বাড়ি ছেড়ে গেলে সে তার ঘরের দরজা খোলা রেখে যেত। শুধু ঘরের মালিকের লাঠিটা শোয়ানো থাকত দরজার সামনে। যাতে অন্য কেউ এলে তা দেখে সে বুঝতে পারে যে ঘরের মালিক অন্যত্র গেছে। পিজরোর অনুচররা যখন ইনকা গ্রামে পা রাখে তখন এ ব্যাপারটা দেখে তারা ভীষণ আশ্চর্য হয়। ঘরে ভর্তি সোনার জিনিস, অথচ ঘরের দরজা হাট করে খোলা! ঘরের মালিক তখন হয়তো গেছে একশো মাইল দূরে আন্দিজের জঙ্গলে শিকার করতে! দৈবাৎ কেউ চুরি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। তবে তার বিচারের সময় বিচারক দেখতেন তার চুরির কারণ। স্বভাবজাত না-অভাবজাত? প্রথমটা হলে কঠিন শাস্তি। কিন্তু দ্বিতীয়টা হলে চোরের পরিবর্তে শাস্তি দেওয়া হত গ্রাম প্রধানকে। কারণ, তাঁর শাসনকার্যের গাফিলতিতেই অভাবগ্রস্ত হয়ে লোকটা চুরি করতে বাধ্য হয়েছে। কৃষিভিত্তিক ইনকা সমাজে খাদ্যের কোনো অভাব ছিল না। প্রতিবন্ধী এবং বৃদ্ধদেরও তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য দান সুনিশ্চিত ছিল। অনাহারে কারও মৃত্যু হত না ইনকা রাজ্যে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আজও পৌঁছোতে পারেনি এ উচ্চতাতে, যা করে দেখিয়েছিল ইনকারা। ভাবতে পারেন?’ কথাগুলো বলে মার্কেজ তাকালেন সুজয়ের দিকে।
সুজয় বলল, ‘বাঃ সত্যিই বিস্ময়কর!’
মার্কেজ আবার বলতে লাগলেন, ‘এই সমৃদ্ধশালী সভ্যতার শাসন কাঠামোও ছিল। বেশ কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল সাম্রাজ্য, তার কেন্দ্র ছিল কুজকো। প্রতিটি প্রদেশে ছিল গ্রাম দিয়ে ঘেরা নগর। সম্রাট বছরে অন্তত একবার বড়ো বড়ো নগর পরিদর্শনে যেতেন। সেসব নগরেও সম্রাটের প্রাসাদ থাকত। নগরীগুলো ছিল প্রাচুর্য আর বৈভবে পরিপূর্ণ। প্রত্যেক নগরীতে থাকত একটা করে সূর্যমন্দির আর মন্দির সংলগ্ন সূর্যকন্যাদের আবাস। আর যা থাকত তা হল সরকারি কোষাগার। সেখানে সঞ্চিত থাকত সোনা আর রুপো। তবে একটা ব্যাপার জেনে রাখা প্রয়োজন যে সোনা-রুপো কিন্তু কখনই ইনকাদের কাছে সে অর্থে লেনদেনের মাধ্যমে ছিল না। শ্রমদান ও তার বিনিময়ে খাদ্য এই ছিল সে-সময়ের ব্যবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রেও এই প্রথাই চালু ছিল। আসলে তাঁরা মনে করতেন যে সোনা হল সূর্যদেবের ঘর্ম আর রুপো হল চন্দ্রদেবের অশ্রু। তাদের বিশ্বাস ছিল যে এই দুটি ধাতু যার কাছে থাকবে, সূর্যদেব ও চন্দ্রদেবের আশীর্বাদ তত তার ওপর বর্ষিত হবে। অর্থনৈতিক কারণে নয়, এই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই সম্রাট থেকে সাধারণ প্রজা সবাই সোনার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। শহরের উন্নতি কামনায় সোনা দিয়ে সাজানো হত শহর।’
মার্কেজ এই পর্যন্ত বলার পর বিল তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘ইনকাদের যে স্বর্ণনগরী ‘এল ডোরাডো’-র গল্প শোনা যায় সে নগরী কি সত্যিই ছিল?’
প্রফেসর তার কথা থামিয়ে বিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না। ইনকা সাম্রাজ্যে সোনার তৈরি মন্দির-প্রাসাদ থাকলেও ওরকম সোনার তৈরি কোনো নগরী ছিল না। বিখ্যাত অভিযাত্রী আলেকজাণ্ডার ফন হুমবোল্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইনকাদের ‘এল ডোরাডো’ একটা মরীচিকা। যার পিছনে ছুটে বেড়িয়েছে স্বর্ণ সন্ধানী ইউরোপীয়রা।’
সুজয়ও বিভিন্ন বইতে ‘এল ডোরাডো’-র কথা পড়েছে। তার মনের মধ্যেও একটা ধারণা ছিল, ইনকাদের এ নগরী হয়তো সত্যিই ছিল। মার্কেজের কথা শুনে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে যুগ যুগ ধরে এ কাহিনি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল? বহুবিখ্যাত বই সিনেমাওতো তৈরি হয়েছে ওই নগরীকে নিয়ে। এমনকি বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক তাঁর জগদবিখ্যাত উপন্যাস কাঁদিদ-এর পাত্র-পাত্রীকেও তো ‘এল ডোরাডো’তে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন!’
প্রফেসর মার্কেজ তার প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘আপনার কথার উত্তর দিতে হলে আমাকে একটু প্রসঙ্গান্তরে যেতে হবে। তবু ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি—’
‘স্পেনীয়রা যখন ইনকা সাম্রাজ্যে লুন্ঠন শুরু করে তখন নগরীগুলোর সোনার প্রাচুর্যের কথা লোক মুখে মুখে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। যা পল্লবিত হয়ে জন্ম দেয় এক কল্পিত স্বর্ণনগরীর—যার পথের ধুলাও সোনা! এল ডোরেডো শব্দের উৎপত্তি হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। আসল শব্দ হল, ‘EL INDIO DOREDO’। যার অর্থ ‘সোনার তৈরি ইন্ডিও’ বা ‘সোনার তৈরি মানুষ’। শহর নয়। সেই সময় ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত কলম্বিয়ার বোগেটা অঞ্চলে চিবচা জনগোষ্ঠী এক ধর্মীয় উৎসব করত। প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে একজন ইন্ডিয় যুবককে বলি দিয়ে তার দেহ সোনায় মুড়ে গিয়েনা অঞ্চলের এক হ্রদ বা নদীতে ফেলে দিত। ওই চিবচা জনগোষ্ঠী যে নগরীতে বাস করত তা সোনায় মোড়া বলে জনশ্রুতি ছিল। তারা নাকি সোনার তৈরি পোশাক পরতেন! কিন্তু ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে সানফ্রান্সিসকো পিজরোর ভাই গনজালো পিজরো ও ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে অভিযাত্রী আন্তেনিও বহু-সন্ধান চালিয়েও, সেই হ্রদ, সেই নগরী বা এমন কোনো ইন্ডিওদের সন্ধান পাননি যারা সোনার পোশাক পরেন।
এবার বলি, এল. ডোরাডোর কথা ইউরোপ ছাড়িয়ে কীভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। বিখ্যাত ব্রিটিশ পুরুষ, স্যার ওয়াল্টার র্যালের নাম নিশ্চই আপনার জানা আছে। এল. ডোরাডোর অলীক কাহিনি বিশ্বব্যাপী প্রচারের কৃতিত্ব তাকেই দেওয়া যেতে পারে। গনজালো পিজরোর অন্বেষণ ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে একটা মতামত দিয়ে যান। তিনি বলেন যে, তাঁর অনুমান গিয়েনা অঞ্চলে আমাজন নদী ও ওরিনাকো অঞ্চলের মাঝামাঝি কোনো স্থানে গভীর অরণ্যের মধ্যে সেই হ্রদ আর স্বর্ণনগরী লুকানো আছে। সেই স্থানের একটা কল্পিত ম্যাপও তিনি আঁকেন। কী’ভাবে যেন সেই ম্যাপ গিয়ে পড়ে স্যার র্যালের হাতে। ১৫৯৬ সালে স্যার র্যালে ওই ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে এল. ডোরাডোর সম্বন্ধে একটি বই লেখেন। এমন বিশ্বাস যোগ্যতার সঙ্গে তিনি স্বর্ণনগরীর বাস্তবতা ওই বইতে উপস্থাপিত করেন যে সে বই পড়ে সারা পৃথিবী ব্যাপী সাড়া পড়ে যায়। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে এল ডোরাডোর গল্প। এই সময় কি একটা ভিন্ন রাজনৈতিক কারনে ব্রিটেনে গ্রেপ্তার হল র্যালে। ব্রিটিশ সরকার এই শর্তে তাঁকে মুক্তি দেন যে তিনি ওই স্বর্ণনগরী অভিযানে যাবেন এবং সেখানে যা সোনা পাবেন তা তুলে দেবেন ব্রিটিশ সরকারকে। এ ঘটনায় নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে র্যালের লেখা বই কী পরিমাণ বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকারের মনেও! যাই হোক ১৬১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত
র্যালে গনজালোর ম্যাপে বর্ণিত স্থানে স্বর্ণনগরী আর সেই হ্রদ খুঁজতে যান। কিন্তু সেই নগরী বা হ্রদ কোনোটাই তিনি খুঁজে পাননি। ১৬১৮ সালে ব্যর্থ অভিযান শেষে র্যালে ব্রিটেনে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তার বই যুগযুগ ধরে এল ডোরাডো সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে রাখে মানুষের মনে।’
এক টানা কথাগুলো বলে একটু থামলেন প্রফেসর। তারপর বললেন, ‘তবে, বেশ কিছু ইনকা নগরীতে প্রচুর পরিমাণ সোনা সঞ্চিত ছিল সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কেউ কেউ বলেন যে, যে পরিমাণ সোনা পিজরো হস্তগত করেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সোনা নাকি ছিল ইনকাদের।’
‘তাহলে সে-সব সোনা কোথায় গেল?’ প্রশ্ন করল বিল।
তিনি বললেন, ‘পিজরোর লুন্ঠনের সময় ভীত ইনকারা নাকি সেসব সোনা পাহাড়-অরণ্যের মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন ছোটো ছোটো নগরীতে লুকিয়ে ফেলে। দুর্গম স্থানে অবস্থিত সেসব নগরী খুঁজে বার করতে পারেনি পিজরো বাহিনী। কালের নিয়মে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে-সব সোনা আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। যদিও পিজরোর পরবর্তীকালে গত চারশো বছর বেশ কিছু অভিযান হয়েছে সেসব স্বর্ণসন্ধানে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য তেমন কেউ পাননি। কেউ হয়তো পেয়েছেন, একটা আধ ভাঙা রূপার পাত্র, কেউ পেয়েছেন কর্ণকুন্ডলের সামান্য অংশবিশেষ। ব্যাস এ পর্যন্তই।’
সুজয় এবার জানতে চাইল, ‘সোনার সন্ধান না-পাওয়া যাক, ওই সব হারিয়ে যাওয়া নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে কি?’
মার্কেজ উত্তর দিলেন, ‘মাচুপিচুই তো ওই রকম একটা স্থান। দুর্গম পর্বতমালা আর অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত ছিল বলে স্পেনীয়রা তার সন্ধান পায়নি। ফলে ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায় জায়গাটা। ১৯১১ সালে মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ ‘হিরাম বিংগহ্যাম’ খুঁজে বার করেন ইনকাদের এই পবিত্র নগরীর ধ্বংসাবশেষ। মাচুপিচুর মতন বিরাট না-হলেও আরও কিছু ছোটো খাটো জনপদের ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কৃত হয়েছে কিছু জায়গাতে, ঐতিহাসিক গবেষকদের কাছে সে-সব জায়গার কাঞ্চনমূল্য যথেষ্ট।’
‘আপনি সে-সব নগরীতে গেছেন কখনও?’ আবার প্রশ্ন করল সুজয়।
মার্কেজ বললেন, ‘না। বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখেছি ঠিকই। কিন্তু ওসব জায়গাতে যাওয়া হয়নি। আসলে ওসব জায়গায় যাওয়া একটু কষ্ট সাধ্য। পায়ে হেঁটে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে যেতে হয়। স্থানীয় কিছু মানুষ ওসব পথের সন্ধান জানে। মাচুপিচু যাবার পর এবার ওরকমই কোনো জায়গার সন্ধানে যাবার ইচ্ছা আমার। এ ব্যাপারে আমাকে খোঁজ খবর নিতে হবে।’
‘ওরকম একটা জায়গার সন্ধান কিন্তু আমার কাছে আছে।’
মার্কেজের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকে ভেসে এল কথাগুলো। সুজয়রা তন্ময় হয়ে শুনছিল মার্কেজের গল্প। কথাগুলো কানে যেতেই সুজয় একপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল একটু দূরে বারান্দায় আধো আলো-ছায়াতে একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। লোকটার মুখ অন্ধকারে থাকলেও চাঁদের আলোতে তার পোশাক দেখে তাকে চিনতে পারল সুজয়। পর-মুহূর্তে থামের কাছ ছেড়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন সিয়েরো পিনচিও! মাকসাহুয়ামানে আজ যাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সুজয়দের।
তিনি সামনে এসে দাঁড়াতে প্রফেসর মার্কেজ সৌজন্যবশত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আসুন, আসুন মিস্টার…মিস্টার…’ মার্কেজ মনে হয় তাঁর নামটা মনে করতে পারছিলেন না। ‘সিয়েরো পিনচিও’, মার্কেজের অসম্পূর্ণ বাক্যটা সম্পূর্ণ করলেন পিনচিও নিজেই। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে একটু সময় কাটালে নিশ্চই আপনাদের আপত্তি হবে না। আসলে ঘণ্টাখানেক আগে রিসর্টে ফিরেছি। রুমে একলা সময় কাটছিল না। মনে হল, যখন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হলই, তখন আপনাদের সঙ্গে একটু দেখা করি। তাই চলে এলাম।’
মার্কেজ চেয়ারে বসে বললেন, ‘ভালোই করেছেন। আমরাও সময় কাটাবার জন্য বসে বসে গল্প করছি।’
সিয়েরো পিনচিও পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে নিয়ে মার্কেজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি কিন্তু বেশ গল্প বলেন। আমি দাঁড়িয়ে শুনছিলাম।’
মার্কেজ জবাবে বললেন, ‘এখানকার ইতিহাস নিয়ে আমার কিছুটা পড়াশোনা আছে। আগে বার দুই এসেছি এখানে। আমার সঙ্গীরা শুনতে চাইল, তাই বলছিলাম।’ এরপর তিনি পিনচিওকে প্রশ্ন করলেন, ‘তা আপনি ইনকাদের প্রাচীন সন্ধান সম্বন্ধে কী জানা আছে বলছিলেন?’
পিনচিও বললেন, ‘হ্যাঁ। মাচুপিচু থেকে নাকি দিন তিনেকের পথ সে-জায়গা। ইনকাদের ভাঙা ঘর বাড়ি, সূর্য মন্দির-টন্দির সেখানে আছে। সেখানে যারা বাস করেন তারা নাকি আজও ইনকা যুগে পড়ে আছে। মানে তারা নাকি সত্যিকারের ইনকা! ভিকুয়ার পশমের রঙচঙে পোশাক পরে, পায়ে কাঠের চটি, মাথায় পাখির পালক গোঁজে, বর্শা দিয়ে শিকার করে। তবে তাদের সোনা-দানা আছে কিনা জানি না।’
মার্কেজ উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘সে-জায়গার নাম কী? আপনি রুট ম্যাপ জানেন?’
চেয়ারে হেলান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পিনচিও বললেন, ‘না সে জায়গার নাম বা রুট ম্যাপ আমার জানা নেই। আসলে, আজ করিকানচাতে আমার গাইড’ হুইকা, সূর্যমন্দিরের এক পুরোহিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। কথা প্রসঙ্গে তার কাছ থেকেই শুনলাম জায়গাটার কথা। বাইরের লোকজনের যাওয়া-আসা সেখানে নেই। দিন চারেক পর সেখানে কি একটা উৎসব হবে। করিকানচার পুরোহিত যাবেন সেখানে। পাহাড়-নদী-জঙ্গল পার হয়ে অনেক কষ্টে ওই স্থানে যেতে হয়।’
এরপর একটু থেমে পিনচিও বললেন, ‘ওই পুরোহিত লোকটার নাম, ইল্লাপা। বংশপরম্পরায় সে সূর্যমন্দিরের পুরোহিত। হুইকা বলছিল, লোকটা নাকি এ অঞ্চলের অনেক কিছুর খোঁজ খবর জানে। তা ছাড়া সে নাকি জাদুবিদ্যারও চর্চা করে!’
মার্কেজ শুনে বললেন, ‘ইনকা পুরোহিতদের অনেকেই এ বিদ্যার চর্চা করে থাকেন। স্থানীয় মানুষেরা এ কারণে তাদের বেশ ভয়ভক্তি করে থাকে। লোকটার সঙ্গে পরিচয় হলে কিছু খোঁজ খবর হয়তো পেতে পারতাম।’
পিনচিও বললেন, ‘আমি কাল মাচুপিচু দেখতে যাচ্ছি। ওই পুরোহিত আমাকে অনুরোধ জানিয়েছে, আমার গাড়িতে সে পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে যেতে। আমার সঙ্গে কাল সে যাবে। আপনারা যদি…’
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই মার্কেজ বললেন, ‘আমরাও তো কাল ওখানেই যাচ্ছি। পুরোহিত লোকটার সঙ্গে তাহলে নিশ্চই আপনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন।’
পিনচিও মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘ও কাজটা মনে হয় করতে পারব।’
এরপর পিনচিও অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়ে সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তা আজ যা যা দেখলেন, তার মধ্যে কোন জায়গাটা ভালো লাগল আপনাদের?’
সুসান এতক্ষণ চুপচাপ বসে কথোপকথন শুনছিল। সম্ভবত সে তার প্রতি পিনচিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই হঠাৎ শিশু সুলভ ভঙ্গীতে বলে উঠল, ‘করিকানচার সূর্যমন্দির।’
পিনচিও তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাঃ, তাই নাকি! তা ওখানে তোমার কী কী ভালো লেগেছে?’
সুসান জবাব দিল, ‘মিউজিয়ামে মমি আর সূর্যদেবের ঘরটা। অনেকদিন আগে যেখানে একটা সোনার চাকতি আর পান্না রাখা ছিল। পিজরো বলে একটা লোক সেগুলো নিয়ে নিয়েছে।’
পিনচিও আবার বললেন, ‘বাঃ, তুমিতো বেড়াতে এসে অনেক কিছু জেনে ফেলেছ দেখছি! গুড বয়!’
প্রশংসা শুনে সুসান সলজ্জ ভঙ্গীতে বলল, ‘দাদু বলেছে’।
এরপর পিনচিও মার্কেজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘আচ্ছা, ওই সোনার চাকতি আর পান্নার ব্যাপারে আপনার ইতিহাস কী বলে?’ মার্কেজ বললেন, পিজরো ও-জিনিসগুলো তাঁর এক জুয়ারি সঙ্গীকে দান করেছিলেন। সে জুয়ার আসরে ওগুলো খুইয়ে বসে।’
‘ও ব্যাপারটা সবার জানা, কিন্তু তারপর?’ আবার প্রশ্ন করলেন পিনচিও।
‘এর চেয়ে বেশি কিছু ইতিহাসে লেখা নেই’। ‘এটা একটা মিস্ট্রি বলতে পারেন,’—জবাব দিলেন প্রফেসর।
পিনচিও কয়েক মুহূর্ত যেন কী চিন্তা করলেন। তারপর মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘আমি এখন যাই। কাল দেখা হবে। গুড নাইট এভরিবডি।’ সুজয়রাও উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার পর, যেমন হঠাৎ তিনি এসেছিলেন, তেমনই হঠাৎ চলে গেলেন পিনচিও।
তিনি চলে যাবার পর মার্কেজ বললেন, ‘পিনচিও ভদ্রলোক কিন্তু বেশ মিশুকে। দু-দু-বার নিজেই পরিচয় করতে আর কথা বলতে এলেন।’
বিল মন্তব্য করল, হ্যাঁ, তবে লোকটার একটু আড়িপাতার স্বভাব আছে। আপনারা যখন ওকে দেখলেন তার মিনিটপাঁচেক আগেই উনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন থামের কাছে। আমি লক্ষ করেছি।’
প্রফেসর পালটা কোনো মন্তব্য করলেন না তার কথা শুনে। এরপর তিনি আবার ফিরে গেলেন ইনকার গল্পে। চাঁদের আলোতে বসে সুজয়রা শুনতে লাগল সেই ফেলে আসা যুগের নানা কথা। টুকরো টুকরো ভাবে সেই সময় যেন মার্কেজের কথার মাধ্যমে ধরা দিতে লাগল সুজনের সামনে।
ঠিক রাত ন-টায় নীচে ডাইনিংরুমে ডাক পড়ল তাদের। বিরাট ডাইনিং-এ ধবধবে সাদা চাদর বিছানো টেবিল। বেশ কিছু টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেতে বসেছে টুরিস্টরা। হালকা আলো জ্বলছে ঘরে। সুজয়রা একটা টেবিলে বসল। পেরুভিয়ান খাবারই সার্ভ করা হল তাদের। তার একটা পদের নাম, ‘আন্দিয়ান পাঁচামানকা’। মাংস, বিন আর ওল জাতীয় কন্দ দিয়ে রান্না। অন্যটার নাম ‘লোমো সলতাদো’। মাংস, টম্যাটো ও পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি। ভাত দিয়ে মেখে খেতে হয়। পেরুতেও যে ভাত খাওয়া হয় তা দেখে অবাক হল সুজয়। তার ধারণা ছিল ভাত জিনিসটা শুধু এশীয়দেরই খাবার। বেশ তৃপ্তি করে খেল সকলে।
খাওয়া শেষ হবার পর যখন সুজয়রা তাদের ঘরের কাছে ফিরে এল তখন রাত দশটা বাজে। বিল আর সুজয় নিজেদের ঘরে ঢোকার আগে মার্কেজ জানিয়ে দিলেন, পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে মাচুপিচুতে যাবার জন্য। আর গাড়িতে ওঠার সময় হাত ব্যাগে গরম জামাকাপড় নিতে হবে, কারণ ও জায়গাটা একদম পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। এ হোটেল থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে মাচুপিচুতে গিয়ে থাকবে তারা।
অন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে সারাদিনের কথা ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সুজয়।