২
বিশাল এক পাথুরে চত্বরে এসে গাড়ি থেকে নামল সুজয়রা। চত্বর থেকে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো থাক থাক ধাপ ওপর দিয়ে উঠে গেছে বিরাট প্রাচীর ঘেরা সাকসাহুয়ামানে প্রবেশ করার জন্য। যেখানে সুজয়রা গাড়ি থেকে নামল সেখানে আরও বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছু টুরিস্ট আর গাইড গোছের স্থানীয় কিছু লোকও ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সুজয়দের দেখে বুকে আই কার্ড ঝোলানো একজন লোক এগিয়ে এসে বলল, ‘গাইড স্যার? ওনলি, ‘হান্ড্রেড নুয়েভো সোল।’ ‘নুয়েভো সোল’ হল পেরুর মুদ্রা। মার্কেজ তাকে বললেন, ‘না আমাদের গাইডের দরকার নেই, আমিই গাইড।’ লোকটা তাঁর কথায় কী বুঝল কে জানে, দুর্বোধ্য ভাষায় প্রফেসরের উদ্দেশ্যে কী একটা বলে অন্য দিকে হাঁটা শুরু করল। হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে প্রফেসর সুজয়কে বললেন, ‘ও আমাকে ‘বুড়ো গুয়ানাকো’ বলল। ‘গুয়ানাকো’ এখানকার এক ধরনের প্রাণী। আমরা ওর সঙ্গে যাব না শুনে চটে গেল লোকটা।’
চত্বরের একপাশে টিকিট কাউন্টার। প্রফেসর মার্কেজ সবাইকে নিয়ে এগোলেন সেদিকে। সেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পেল কাউন্টারের এক পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু সাদা চামড়ার টুরিস্ট। আর সেই বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে একজন স্থানীয় মানুষ বা যাদেরকে বলা হয় নেটিভ আমেরিকান। তার পরনে প্রাচীন ইনকাদের মতো পোশাক, মাথায় ছুঁচলো ধরনের কান ঢাকা ঝলমলে টুপি, পায়ে কাঠের পাদুকা। গালে আঁকা বিচিত্র উলকি। ঠিক যেন ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো প্রাচীন মানুষ। লোকটার সঙ্গে একটা প্রাণীও আছে। তার দেহও ঝলমলে কাপড় দিয়ে সাজানো। প্রাণীটাকে সুজয় এই প্রথম চাক্ষুষ করলেও তার ছবি এর আগে সে দেখেছে,—লামা! প্রফেসর সুজয়কে বললেন, ‘ইনকা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে পবিত্র প্রাণী ছিল এই ‘লামা।’ এখনও নেটিভ আমেরিকানরা এখানে একে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। ঠিক আপনাদের দেশে যেমন, ‘হোলি কাউ।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানে দাঁড়ান, ‘আমি টিকিটটা নিয়ে নিই।’ সুজয় তাঁর কথা শুনে পয়সা দেবার জন্য পার্স বার করতে যাচ্ছিল। তা বুঝতে পেরে প্রফেসর বললেন, ‘এখন থাক। পরে নেব।’ টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর আর সুজয়রা দাঁড়িয়ে সেই নেটিভ আমেরিকানের বাঁশি বাজানো দেখতে লাগল। ব্যাগ থেকে তার ক্যামেরা বার করে লোকটার গোটা দুই ছবিও তুলল বিল। বেশ মন দোলানো সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে লোকটা। বাঁশিটাও বড়ো অদ্ভুত ধরনের। ফাঁপা কঞ্চি জাতীয় জিনিস পরপর পাশাপাশি বসিয়ে বানানো বাঁশিটা। সুজয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুসান। সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি বাঁশি? সুজয় বলল, ‘আমি নাম জানি না। তোমার দাদু হয়তো বলতে পারবেন।’ টিকিট কাটা হয়ে গেছিল প্রফেসরের, সুজয়দের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সম্ভবত তিনি শুনতে পেয়েছিলেন সুসানের প্রশ্নটা। তাই কাছে এসে তিনি বললেন, ‘এ বাঁশির নাম হল, ‘রনডাডর’। বাঁশ বা নলখাগড়া দিয়ে তৈরি হয়। নেটিভ আমেরিকানদের খুব প্রিয় জিনিস।’ সুজয়রা এরপর হাঁটতে শুরু করল দুর্গে ওঠার পথের দিকে।
পাহাড়ের গায়ে নিখুঁতভাবে থাক থাক করে পাথর কেটে তৈরি ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ওপরে উঠতে শুরু করার আগে সেই সোপানশ্রেণির সামনে দাঁড়িয়ে প্রফেসর বিলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার কাজ এখান থেকেই শুরু করো। এই সিঁড়ির ধাপের একটা ছবি তোলো।’ এরপর তিনি সুজয়কে বললেন, ‘ধাপগুলোর দিকে ভালো করে লক্ষ করুন। প্রতিটা পাথর কেমন নিখুঁতভাবে কাটা! আর ওই যে দুর্গ-প্রাকার দেখছেন, ওর কাছে গেলে বুঝতে পারবেন, যে পাথরগুলো এই নীচ থেকে ইটের মতো দেখাচ্ছে সেগুলো আসলে কি বিশাল! ওর এক-একটার ওজন হল একশো আঠাশ টন! আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এর মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যাপার কি আছে? অস্বাভাবিক ব্যাপার হল, ইউরোপীয়নরা লোহার ব্যবহার জানলেও ইনকারা কিন্তু তা জানত না। তাহলে তারা কীভাবে এত নিখুঁত-মসৃণ ভাবে এই সোপানশ্রেণি বা ওই পাথরের ব্লকগুলোকে কাটল? ইনকা সভ্যতায় বেশ কিছু মিস্ট্রিয়াস ব্যাপার আছে, যার সমাধান এখনও বিশেষজ্ঞরা করে উঠতে পারেননি। তার মধ্যে এটা হল একটা মিস্ট্রি।
পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে শুরু করল সবাই। সুসান বেশ মজা পেয়েছে। সে সবার আগে উঠছে। আর সবার পিছনে প্রফেসর মার্কেজ। সুজয় সিঁড়ির একটা ধাপে দাঁড়িয়ে প্রফেসরকে বলল, ‘আপনার কি উঠতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে আমার হাতটা ধরতে পারেন।’ প্রফেসর বললেন, ‘আসলে বয়স হচ্ছে তো, কামিং ফেব্রুয়ারি সুইট এইট্টি হবে। তাই একটু হাঁপ ধরছে। তবে হাত ধরতে হবে না’। সুজয় একটু অবাক হল তাঁর কথা শুনে। প্রফেসরের যে এতটা বয়স তা বুঝতে পারেনি সে। প্রথমে সুসান, তারপর বিল আর সবশেষে প্রফেসর আর সুজয়, এইভাবে সিড়ি ভেঙে তারা একসময় সাকসাহুয়ামানের প্রবেশ পথে উঠে এল। ভিতরে ঢোকার মুখে একবার প্রফেসর বিলকে দাঁড় করালেন প্রবেশ পথের একটা ছবি তোলাবার জন্য। প্রবেশ পথের এক পাশে প্রাচীরের ওপর বিরাট একটা পাখির মূর্তি বসানো। ছবি তোলা হয়ে গেলে বিল প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কী?’ প্রফেসর বললেন, ‘ওটা হল কনডোর বা বাজপাখি। এরকম আটটা কনডোর মূর্তি বসানো আছে দুর্গ-প্রাকারে। যুদ্ধে যাদের মৃত্যু হত তারা বিশালাকার কনডোর পাখিদের খিদে মেটাত। নর মাংসের লোভে দুর্গ-প্রাকারে সার বেঁধে বসে থাকত তারা। অনেকে বলেন, এ কারণেই এ দুর্গের নাম ‘তৃপ্ত বাজ’। কনডোরের স্বভাব বাজের মতো আক্রমণাত্বক। আর চেহারা শকুনের মতো।’
ত্রিস্তর জিগজ্যাগ দেওয়াল ঘেরা দক্ষিণমুখী সংকীর্ণ প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল সুজয়রা। চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। একটু এগোবার পর দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে দু-ভাগে বিভক্ত পাথুরে আবাস স্থল। প্রফেসর জানালেন তাদের একটার নাম, ‘মাল্লাকামারকা’ অপরটার নাম ‘পাতকামারকা’। ধীরে ধীরে প্রফেসরের পিছন পিছন সবাই ঘুরতে শুরু করল দুর্গের ভিতর এ জায়গা থেকে সে-জায়গা। প্রফেসরের নির্দেশ মতো বিল ছবি তুলতে লাগল। আর প্রফেসর জায়গাগুলো সম্বন্ধে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন সুজয়কে। এত সুন্দরভাবে প্রফেসর বলছিলেন যে, সুজয়ের মনে হচ্ছিল যে প্রফেসর মার্কেজ যেন নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন এই দুর্গের ইতিহাস। দুর্গের ভিতর সম্রাটের স্নানাগার, ইনকা অর্থাৎ সম্রাট যেখানে বসে প্রজাদের দর্শন দিতেন, সূর্যদেব ইনতির মন্দির সব জায়গাগুলো ঘুরে-ফিরে দেখল সুজয়রা। অবশ্য দেখল মানে, তার কোনো কিছুই আজ আর আস্ত নেই। কোথাও হয়তো দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন কক্ষ, কোথাও দাঁড়িয়ে আছে সার সার পাথরের স্তম্ভ, কোথাও আবার স্তূপাকৃত পাথরের রাশি। যে দুর্গ নগরীর ধুলোতেও নাকি একদিন সোনার গুঁড়ো মিশে থাকত বলে প্রবাদ আছে, ইনকাদের সেই বৈভব নগরী আজ শুধুই স্মৃতির শ্মশান। সারা নগরীতে ছড়িয়ে আছে ‘চেকান’ বা জলাধারের চিহ্ন। পাথরের ধাপে ধাপে পাথরের নল দিয়ে চেকানের জলে অসংখ্য ফোয়ারা দিয়ে নাকি সাজানো ছিল এই দুর্গ। সূর্য উপাসক ইনকারা খুব সৌখিন ছিলেন। বাগান-ফোয়ারা দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন তাদের আবাস স্থল। তার কিছু কিছু চিহ্ন সময় আজও ধরে রেখেছে।
ঘণ্টা তিনেক নানা জায়গা দেখার পর সুজয়রা এসে উপস্থিত হল বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। বেশ কয়েকটা ধাপে বিভক্ত হয়ে সেটা নীচের দিকে নেমে গেছে। একদম ওপরের ধাপে গ্যালারির মতো সার সার বসার আসন। পাথরে তৈরি আসনগুলোর পিঠের দিকটা লম্বা। বেশ কিছু টুরিস্ট বসে আছে সেখানে। প্রফেসর সুজয়দের নিয়ে বসলেন সেখানে। পুরো প্রাঙ্গণটা নীচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রফেসর বললেন, ‘এটা ছিল অ্যামফিথিয়েটর’, সুজয় বলল, ‘কী হত এখানে, এখানেও কি রোমের মতো গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই হত নাকি?’ মার্কেজ বললেন, ‘না না, এখানে সে-সময় ধর্মীয় কারণে বলি প্রথা থাকলেও ইনকারা অত হিংস্র ছিলেন না। সূর্যদেব ইনতির পার্বণে এখানে সমবেত হত নগরবাসীরা। আমরা যেখানে বসে আছি সেখানে স্বর্ণভূষণে সজ্জিত হয়ে সম্রাট তাদের পার্ষদবর্গদের নিয়ে বসতেন। তাঁর সঙ্গে থাকত ইনতির সোনার প্রতিকৃতি। তিনি জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। আর আমাদের সামনে ঢালু জমিতে নানা রঙের উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত সমবেত নগরবাসী সম্রাটের উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি করত, ইনতির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাত, যেন তাদের সাম্রাজ্যের শান্তি, বৈভব, সম্মান অটুট থাকে, সূর্যদেব যেন তাঁর পুত্রদের সব বিপদ থেকে মুক্ত রাখেন।’
এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘কিন্তু স্বর্ণলোভী স্পেনীয় সানফ্রান্সিসকো পিজরো ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে যেদিন পেরুর তুমবেজ উপকূলে নৌকা ভেড়ালেন সে দিন থেকেই ইনকাদের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। পিজরো ও তাঁর সঙ্গীদের ফর্সা, দীর্ঘ চেহারা, হাতে আগুন ছোড়া লাঠি মানে বন্দুক দেখে, স্থানীয় ইনকা জনজাতি তুমপিরা ভাবল আগন্তুকরা সাক্ষাত সূর্যের সন্ততি। সরল-মনা তুমপিরা তাদের বরণ করল সোনার তৈরি নানা পাত্র, হাঁসের ডিমের আকারের পান্না দিয়ে। পান্না জিনিসটা চেনা ছিল না পিঞ্জরোদের। শোনা যায় তাঁর সঙ্গীরা নাকি খেলার জিনিস ভেবে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল পান্নাগুলোকে। তবে সোনা তারা বিলক্ষণ চিনত। পিজরো ঘুরে-ফিরে দেখলেন ইনকাদের বৈভব, তাদের সোনায় মোড়া মন্দির, প্রাসাদ, ইনকাদের পোশাক। এরপর পিজরো ফিরে গেলেন ঠিকই কিন্তু তারপর আবার যখন তিনি এ মাটিতে পা রাখলেন, তাঁর হাতে তখন ইনকা সাম্রাজ্যের মৃত্যুর পরোয়ানা। স্বর্ণ লুন্ঠনের অতৃপ্ত-উদগ্র বাসনা পেয়ে বসেছে তাঁকে। ছলেবলেকৌশলে কীভাবে তিনি ইনকা সাম্রাজ্যের দখল নিয়েছিলেন তা এক দীর্ঘ ইতিহাস। তা যেমন চমকপ্রদ তেমনই ভয়াবহ। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালাপার গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়ে পেরু বিজয়ের চূড়ান্ত কাজ সম্পন্ন করেন পিজরো। ছাব্বিশ টন সোনা পেয়েও পিজরোর খিদে সেদিন মেটেনি। মন্দির-প্রাসাদের গায়ে আরো যত সোনা রুপো ছিল সব তারা খুবলে তুলে নিল। সোনার তৈরি ইনকাদের অসাধারণ সব শিল্প সামগ্রীকে গলিয়ে সোনার বাটে পরিণত করল। কারণ, স্বর্ণলোভী পিজরো বাহিনীর কাছে শিল্পের কোনো মূল্য ছিল না। এমনকি সোনার বাকল খুলে নেবার পর পাথরের কাঠামোগুলোকেও তারা রেহাই দেয়নি। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনীয়রা এই সাকসাহুয়ামান থেকে পাথর কেটে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র তাই দিয়ে নিজেদের গির্জা ইত্যাদি তৈরি করে। পেদ্রো সানচের ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সে-সময় এই সাকসাহুয়ামান দুর্গের মতো সুন্দর ও বিশাল দুর্গ ইউরোপের কোথাও ছিল না। পিজরো আর তাঁর বাহিনীর বর্বরতা একটা জাতির ইতিহাসকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে দিল।
প্রফেসর মার্কেজ এরপর আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ কাছ থেকে ভেসে এল একটা অপরিচিত কন্ঠস্বর,—‘পিজরো কি শুধু নিছকই একজন স্বর্ণলোলুপ হানাদার ছিলেন? তাঁর মত সাহসী, বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী ব্যক্তি সেই সময় সারা ইউরোপে আর কেউ ছিল কি? নাবিকদের মুখে শোনা গল্পকে পাথেয় করে, সামান্য অবলম্বন নিয়ে, মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি যে এদেশ আবিষ্কার করলেন ইতিহাসে তার কি দামই নেই! পিজরোর মতো সাহসী মানুষরাইতো অজানা পৃথিবীকে চিনিয়েছেন সভ্য জগতের কাছে। এ কথা কি অস্বীকার করা যায়?’
সুজয়রা তাকিয়ে দেখতে পেল তাদের কয়েক হাত দূরে পেছনের সারির আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে একজন লোক। বয়স তার সম্ভবত বছর পঁয়তাল্লিশ হবে। বেশ সুঠাম চেহারা। ছুঁচলো দাড়ি, ডান চোখে একটা পারকোল, তার থেকে সোনার চেন ঝুলছে। পরনে ধূসর রঙের সুট। ভদ্রলোক এরপর এসে দাঁড়ালেন প্রফেসরের সামনে। প্রফেসর উঠে দাঁড়ালেন তার আসন ছেড়ে, তার সঙ্গে সঙ্গে বিল আর সুজয়ও। সেই ভদ্রলোক প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ‘মাফ করবেন আমাকে, আপনাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম বলে। কিন্তু আমি কথাগুলো কি খুব ভুল বললাম?’ প্রফেসর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘না, আপনার কথা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না, তবে আমার কথাগুলোও কিন্তু একবর্ণ মিথ্যা নয়।’ ভদ্রলোক আর একবার হেসে বললেন, ‘সে-কথা কিন্তু আমিও বলিনি। আমি শুধু আমার কথা বললাম। তা আপনারা উকেয়ালি রিসর্টে আছেন তো?’ তাঁর কথা শুনে প্রফেসর মার্কেজ একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি কি করে জানলেন?’ ভদ্রলোক সুসানকে দেখিয়ে বললেন, ‘কাল বিকালে এই বাচ্চাটাকে আমি রিসর্টের লনে খেলতে দেখেছি।’ এরপর তিনি প্রফেসরের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি সিয়েরো পিনচিও, ফ্রম, স্পেন। আপনারা?’ প্রফেসর তাঁর সঙ্গে করমর্দন করে নিজের পরিচয় দিলেন। অন্যদের সাথেও তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। পিনচিও, বিল আর সুজয়ের সাথেও করমর্দন করলেন।
প্রফেসর এরপর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তা আপনিও কি টুরিস্ট?’
পিনচিও বললেন, ‘হ্যাঁও বলতে পারেন, আবার নাও বলতে পারেন। এ দেশটা দেখার সাথে সাথে একটা কাজও করতে এসেছি আমি। একটা ‘এনজিও’ চালাই আমি। ছোটো শিশুদের জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করি। এ দেশটাতো খুব গরিব। দেখি এখানকার কিছু শিশুকে কোনো সাহায্য করা যায় কিনা। এ কাজের জন্য বহুজায়গাতে যাই। তার সাথে সাথে সে জায়গাটাও দেখে নেই।’
ছুঁচলো দাড়ি, ডান চোখে একটা পারকোল, তার থেকে সোনার চেন ঝুলছে।
প্রফেসর মার্কেজ শুনে বললেন, ‘বাঃ, বেশ মহৎ উদ্দেশ্য আপনার। তা এ জাতীয় কাজ তো বেশ ব্যয় সাপেক্ষ?’
পিনচিও একটু হেসে জবাব দিলেন। ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। আসলে উত্তরাধিকার সূত্রে এক-সময় বেশ কিছু অর্থ পেয়েছিলাম আমি। তা ছাড়া ‘মাদ্রিদ’ আর ‘ভ্যালেন্সিয়াতে’ দুটো কিউরিও শপ আছে আমার। এসব থেকে আমার যা আয় হয় তারই একটা অর্থ ‘এনজিও’-র মাধ্যমে দুঃস্থ শিশুদের জন্য খরচ করি।
ভদ্রলোক যে বেশ ধনী, তার তার কথা শুনে বুঝতে অসুবিধা হল না সুজয়ের।
পিনচিও এরপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা মাচুপিচু দেখা হয়ে গেছে নাকি?’
মার্কেজ বললেন, ‘না, কালই এখানে এসেছি আমি। আজ কুজকো দেখে কাল মাচুপিচুর দিকে রওনা হবার ইচ্ছা আছে।’ পিনচিও বললেন, আমারও কাল ওদিকে যাওয়ার কথা। শুনেছি জায়গাটা খুব ইন্টারেস্টিং। অনেক কিছু দেখার আছে।’
প্রফেসর মার্কেজ তার কথা শুনে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ তাঁর আর সুজয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুসান প্রফেসর মার্কেজের জামা খামচে ধরল। থেমে গেলেন প্রফেসর। সুজয় দেখল, সুসানের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। প্রফেসর সুসানকে ‘কি হল?’ বলতেই সে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল গ্যালারির এক পাশে। সে দিকে তাকিয়ে একটা লোককে দেখে সুজয়ও যেন মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল প্রথমে। এমন বীভৎস মুখাবয়ব সে আগে দেখেনি। লোকটার মুখের ডান পাশটা যেন পুড়ে একদম ঝামা হয়ে গেছে। সে পাশের কান কুঁকড়ে ছোটো হয়ে মাথার সঙ্গে মিশে আছে, অক্ষি কোটর শূন্য। এক চোখে সে তাকিয়ে আছে সুজয়দের দিকে। পোশাক দেখে সুজয়ের মনে হল লোকটা স্থানীয় ইন্ডিয়ান উপজাতীয় কেউ হবে। একটা ঘাসের তৈরি টুপি ধরা আছে তার হাতে। কয়েক মুহূর্ত সুজয়রা সবাই তাকিয়ে রইল তার দিকে। পিনচিও এরপর মৃদু হেসে সুজয়দের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘ওর চেহারা দেখে ঘাবড়াবেন না। ওর নাম ‘হুইকা’, আমার গাইড। এখানকার সব কিছু ও হাতের তালুর মতো চেনে।’
হুইকা বলে লোকটা এবার সুজয়দের কাছে এগিয়ে এল। তারপর তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা পাথরের চোখ বার করে তার শূন্য কোটরের মধ্যে তা ভরে ফেলে সুসানের উদ্দেশ্যে হেসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘এবার নিশ্চয় আমাকে দেখে তোমার ভয় লাগবে না?’ সুসান তার কথার কোনো জবাব দিল না।
লোকটা তারপর পিনচিওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বার্লো’। এ শব্দের অর্থ অবশ্য বুঝতে পারল না সুজয়। পিনচিও মৃদু হাসলেন লোকটার কথা শুনে। এরপর তিনি রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সুজয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভারি ভালো লাগল। এক হোটেলে যখন আছি, তখন নিশ্চই আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে। আপনাদের সময় এখন আর নষ্ট করব না। ভালো করে বেড়ান। ‘গুড বাই।’—এই বলে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন তিনি।
প্রফেসর মার্কেজও তাঁকে ‘গুড বাই’ জানালেন। পিনচিও এরপর তার এক চক্ষু গাইডকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন অন্য দিকে। আর প্রফেসরও সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলুন এবার ফেরা যাক। নীচে নেমে লাঞ্চ সেরে কারিকানচার দিকে রওনা হতে হবে।’ সুজয়রা ফেরার পথ ধরল। চলতে চলতে মার্কেজ মন্তব্য করলেন, পিনচিওর পূর্বপুরুষরা যে পাপ করেছিলেন হয়তো তার কিছুটা স্খলন হবে পিনচিওর কাজের দ্বারা। লোকটাকে খারাপ বলে মনে হল না। ধনী লোকরা সাধারণত নিজেদের নিয়ে ভোগবিলাসে ব্যস্ত থাকে। এ লোকটা তবু কিছু করছে।’ বিল বলল, ‘তবে ওর সঙ্গীটা কেমন যেন! ওর তাকানোটা ভারী অদ্ভুত!’
প্রফেসর বললেন, ‘মুখ দেখে কারো সম্বন্ধে কোনো ধারণা করা ঠিক নয়, অনেক সময় কুৎসিত মানুষের মধ্যেই সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।’ সুজয় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে নামতে নামতে প্রফেসরকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, গাইডটা যে মি. পিনচিওকে ‘বার্লো’ না কি একটা বলল, তার মানে কী?’
মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘যতটুকু জানি, তা হল, ইনকা সম্রাটরা কপালে যে রাজটিকা বা তিলক আঁকতেন তাকে বলা হত ‘বার্লো’। তবে শব্দটার অন্য কোনো অর্থও থাকতে পারে যা হয়তো আমার জানা নেই।’
কথা বলতে বলতে সুজয়রা কিছুক্ষণের মধ্যে সাকসাহুয়ামান থেকে বাইরে বেরিয়ে নীচের সেই চত্বরটিতে নেমে এল। জায়গাটাতে বেশ ভীড় হয়ে গেছে। অনেক ক-টা টুরিস্ট গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে। সেই বাঁশিঅলা বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। তাকে ঘিরে টুরিস্টের ভীড়। আরও বেশ কয়েকটা বড়ো লামাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে আনা হয়েছে। তাদের গলার ঘণ্টা বাজছে টুং টাং শব্দে। বেশ জমে উঠেছে চারপাশ।
নিজেদের গাড়ির কাছে পৌঁছে লাঞ্চ প্যাক বার করে খাওয়া সেরে নিল তারা। মিনিট কুড়ি মতো সময় লাগল। তারপর তারা রওনা হল করিকানচার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে ছিল সুজয়। ঘণ্টাখানেক বাদে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন তারা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেছে।
গাড়ি থেকে নামার পর সুজয়ের চোখে পড়ল চার দিকে বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট প্রাচীন স্থাপত্যের ধংসস্তূপ, ছাদহীন পাথুরে কাঠামো, স্তম্ভ, প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে শান বাঁধানো রাস্তা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। তারপর তা হারিয়ে গেছে করিকানচার গোলকধাঁধার মাঝে। গাড়ি থেকে নেমে প্রফেসরের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল সবাই। বেশ চড়া রোদ। রাস্তার পাশে তাঁবুর নীচে তরমুজ বিক্রি করছে মেয়েরা। পরনে ঝলমলে পোশাক। মাথায় টুপি। মেয়েরা এখানে যে টুপি পরে তা দেখতে ভারি অদ্ভুত। একটা বড়ো থালা যেন তাদের মাথার ওপর বসানো আছে! দুপুরবেলা বলেই সম্ভবত জায়গাটা বেশ ফাঁক ফাঁকা লাগছে। দু-চার জনের বেশি টুরিস্ট চোখে পড়ল না সুজয়ের। দু-পাশের মাঝখান দিয়ে সোজা সামনের দিকে এগোতে এগোতে মার্কেজ বললেন, এই জায়গা এক সময় ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের পবিত্রতম স্থান। আমরা যে পথ ধরে এগোচ্ছি এর নাম ‘ইনতি কিজল্লো’ বা রাজপথ। এ পথ ধরেই একদিন সোনার শিবিকায় চেপে সূর্যদেব ইনতি-র মন্দিরে পূজো দিতে যেতেন ইনকা সম্রাটরা। আশেপাশে আমরা যেসব পাথুরে ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাচ্ছি তা এক সময় সবই ছিল সোনা দিয়ে মোড়া। ইনকা সাম্রাজ্যের যে স্বর্ণনগরীর গল্প শোনা যায় তা সম্ভবত এই করিকানচাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। মন্দিরে পুজো সেরে বাগানে সোনার গাছ রোপণ করতেন সম্রাট। সে বাগানের গাছফুল-পাখি সব কিছুই ছিল, সোনা আর পান্না দিয়ে তৈরি। বর্বর স্পেনীয়রা এসব কিছুই লুটপাট করে নিয়ে যায়।
বেশ কিছুটা এগোবার পর একটা প্রশস্ত চত্বরে উপস্থিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন মার্কেজ। পথের ডানপাশে ছাদহীন সার সার ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে তিনি বললেন, এর নাম ‘আকল্লাকুনা’ অর্থাৎ ‘সূর্য্যকন্যাদের আবাস’। ইনকাদের আমলে সুন্দরী কন্যাদের সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। ওই সব মেয়েদেরই বলা হত সূর্যকন্যা। প্রায় পাঁচশো সূর্য্যকন্যা থাকতেন এখানে। ইনকা সম্রাট যেহেতু সূর্যদেবের পুত্র বা অংশরূপে বিবেচিত হতেন, তাই কেবল মাত্র তিনিই শুধু আকল্লা কুনাতে প্রবেশ করতে পারতেন। অন্য কোনো পুরুষের এখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। কয়েকশো মহিলা রক্ষী পাহারা দিত আকল্লাকুনা। বাইরের কেউ এখানে প্রবেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হত বা জ্যান্ত কবর দেওয়া হত।’
সুজয় জিজ্ঞেস করল। ‘সূর্য কন্যারা কী করতেন?’
প্রফেসর বললেন, ‘সূর্যকন্যাদের আকল্লাকুনার বাইরে যাবার অনুমতি ছিল না, যদি না তাদের কাউকে সম্রাট তাঁর রানি করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যেতেন। সূর্যকন্যারা ইনতি অর্থাৎ সূর্যদেবের দৈনন্দিন পূজার উপকরণ প্রস্তুত করতেন, আর বুনতেন পশমের তৈরি পোশাক। ইনকা সম্রাট যে পোশাক পরতেন, তা তৈরি করতেন তাঁরা।’ এরপর একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘আর হতভাগ্য কিছু সূর্যকন্যাকে নির্দিষ্ট দিনে ইনতির উদ্দেশ্যে বলিও দেওয়া হত।’
‘বলি?’ অবাক হয়ে বলল সুজয়।
‘হ্যাঁ, বলি। ‘কাপাক সিতুওয়া’ অর্থাৎ আগস্ট মাসে ‘প্রধান শুদ্ধিকরণ’ অনুষ্ঠান হত। পবিত্র চিহ্ন যুক্ত কোনো সূর্যকন্যাকে বলি দিয়ে তার রক্তে ইনতির মন্দির শুদ্ধ করা হত। তারপর তাকে মমি করে রাখত ইনকারা। এখানের মিউজিয়ামে একটা মেয়ের মমি আছে। সম্ভবত তাকে ইনতির সামনে বলি দেওয়া হয়েছিল।’
সুজয়রা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ‘আকল্লাকুনা’। প্রফেসর বলে যেতে লাগলেন সূর্যকন্যাদের গল্প। আর তার নির্দেশে মাঝে মাঝে ছবি তুলতে লাগল বিল। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটাবার পর একসময় তারা এসে উপস্থিত হল করিকানচার সামনে।
করিকানচা! ইনকাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির-স্থাপত্য। মহাকাল আজ এর অনেক কিছু গ্রাস করে নিয়েছে। কোথাও ছাদ ধসে পড়েছে, প্রাচীর হেলে পড়েছে, বিরাট বিরাট স্তম্ভগুলো আশ্রয় নিয়েছে মাটিতে। তবু যতটুকু আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সুজয়। কী বিরাট তার পরিধি! কী সুবিশাল চত্বর! সর্বোপরি কী অদ্ভুত তার গঠনশৈলী! ভগ্ন মন্দিরের দেওয়াল-স্তম্ভের অপূর্ব সুন্দর কারুকাজগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করে চলেছে সমৃদ্ধশালী এক অতীতের। গঠনভঙ্গিতে পার্থক্য থাকলেও মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে সুজয়ের কেন জানি মনে পড়ে গেল তার দেখা নিজের দেশের কোণার্কের সূর্যমন্দিরের কথা। এ মন্দিরও কালো পাথরের তৈরি।
মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে করতে মার্কেজ বললেন, ‘এই মন্দিরের বাইরে ভিতরে সব কিছুই একদিন সোনার পাতে মোড়া ছিল। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো যেমন মিশরীয়, সুমেরীয়, ভারতীয় সভ্যতায় বেশ কিছু মন্দিরের সন্ধান আমরা পাই যার বৈভব-সম্পদ কিছু কম ছিল না, কিন্তু এই মন্দিরের কাছে যেসব কিছুই তুচ্ছ ছিল বলা যেতে পারে। এই মন্দিরের ধূলিকণাতেও সত্যি সত্যি সোনার গুঁড়ো ছড়ানো থাকত। পিজরোর দলবল সব সোনা নিয়ে যাবার পর তাদের ভৃত্য স্থানীয় অনুচরের মন্দির চত্বর ঝাঁট দিয়ে যে সোনার গুঁড়ো পেয়েছিল। তাতে তাদের পাঁচ পুরুষের আরামে বসে খাবার সংস্থান হয়ে গেছিল।
মন্দির গাত্রের কালো পাথরগুলো দেখিয়ে বিল জানতে জাইতে চাইল, ‘এ পাথরগুলো কি’ গ্র্যানাইট?’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘এ পাথর হল ‘ব্ল্যাক আন্দেসাইট।’ এখান থেকে পনেরো মাইল দূরে হুয়াকোটো নামক পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আনা হয়েছিল এই পাথর। শুধুমাত্র সূর্যদেব ইনতি আর তার পুত্র ইনকা সম্রাটদের প্রাসাদ এই পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হত।’
সুজয়রা সবাই মিলে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল সূর্যমন্দিরের ভিতর। বিশাল বিশাল আলো-আঁধারি কক্ষ। বিরাট বিরাট স্তম্ভ ছড়িয়ে আছে মন্দিরের ভিতর। তার গায়ে নানা ধরনের ছবি, বাজপাখি, পুমা, কুমির, সাপ, বিভিন্ন বিচিত্র ধরনের কল্কা, অদ্ভুত ধরনের শিরস্ত্রান পরা মানুষের মুখ, আরও কত কী। মার্কেজ জানলেন এ ছবিগুলো হল ইনকাদের হুয়াকা বা পবিত্র চিহ্ন। বিল নির্দেশ মতো হুয়াকার ছবি তুলতে লাগল। আরও বেশ কিছু টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে সুজয়দের পাশে পাশে। সবাই নীচু গলায় কথা বলছে। দৈবাৎ কেউ উচ্চগ্রামে কথা বললেই তা অনুরণিত হচ্ছে পাথরের দেওয়ালে। মার্কেজ বললেন, ‘পিজরো বাহিনী করিকানচার দখল নেবার পর একে গির্জায় পরিণত করে ছিল। মন্দিরের এক অংশে তার অস্তিত্ব আজও বর্তমান।
একটার পর একটা ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগল সুজয়রা। প্রত্যেক ঘরগুলোর পাথুরে দেওয়ালে নানা বিচিত্র জিনিস খোদিত করা আছে। মার্কেজ প্রয়োজন মতো সব কিছু বুঝিয়ে দিতে লাগলেন বিল আর সুজয়কে। প্রায় এক ঘণ্টা তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে এ কক্ষ থেকে ও কক্ষে ঘোরার পর প্রফেসর মার্কেজ তাদের নিয়ে প্রবেশ করলেন একটা ঘরে। ঘরটা আলোআঁধারিতে ঢাকা, বেশ লম্বা ঘর, ছাদও অনেক উঁচুতে। সমস্ত ঘরটাই কালো পাথরে মোড়া। ঘরের মেঝে থেকে শুরু করে সর্বত্রই খোদাই করা আছে বিভিন্ন ধরনের হুয়াকা, অস্ত্র হাতে ভীষণ দর্শন মানুষের ছবি। কেমন যেন গা-ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে ঘরের মধ্যে। ভিতরে ঢোকার পর সুসান চাপা স্বরে তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘মমিটা এখানেই রাখা আছে নাকি!?’ মার্কেজ শুধু উত্তর দিলেন, ‘না’। তারপর তিনি সুজয়দের নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ঘরের শেষপ্রান্তে একটা বেদীর সামনে। সেই বেদীর ওপর অধিষ্ঠান করছে অপূর্ব সুন্দর বিরাটকার এক পাথরের মূর্তি। তাঁর সামনে জ্বলছে একটা প্রদীপ। পূজার কিছু উপকরণও ছড়িয়ে আছে মূর্তিটার পায়ের কাছে। দুজন বিচিত্র পোশাক পরা বর্শাধারী স্থানীয় ইন্ডিয়ান কঠিন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির দু-পাশে। তারাও যেন পাথরের তৈরি। বিগ্রহর পিছনের ছটা দেখে সেটা যে সূর্যমূর্তি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না সুজয়ের। মার্কেজ চাপা স্বরে বললেন, ‘এই হল মন্দিরের গর্ভগৃহ। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেবতা ইনতির সামনে। এই দেবমূর্তি আজও পূজা পেয়ে আসছেন। বিল স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ক্যামেরাটা চোখের সামনে ওঠাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাই দেখে মূর্তির পাশে দাঁড়ানো এক বর্শাধারী দুর্বোধ্য ধমকের স্বরে কি যেন বলে উঠল। প্রফেসর মার্কেজ তাড়াতাড়ি বিলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই পবিত্র মূর্তির ছবি তোলা নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে এখনই এই গার্ডরা তোমার পেটে বর্শা বিঁধিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। এতটাই প্রবল এদের ধর্মীয় বিশ্বাস। ছবি তোলা-তো দূরের কথা। কিছুকাল আগে পর্যন্ত সাদা চামড়ার মানুষদের প্রবেশ অধিকার ছিল না এখানে। এখনও এরা ঘৃণা করে সাদা চামড়ার লোকদের। কারণ, সাদা চামড়ার পিজরো অপবিত্র করেছিলেন এই মন্দির।’
সুজয় বলল, ‘এই ঘরও নিশ্চই সোনায় ভর্তি ছিল!’
দেয়ালের হুয়াকাগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু চাপা স্বরে মার্কেজ বললেন, হ্যাঁ, তা তো ছিলই, তবে সবচেয়ে মূল্যবান যে দুটো জিনিস এ ঘরে রাখা ছিল, তা হল সূর্যদেবের সোনার চাকতি আর সম্রাট পাচাকুটির উৎসর্গ করা হাঁসের ডিমের আকারের একটা পান্না। অন্য সব সম্পদের সঙ্গে পিজরো এ দুটো পবিত্র জিনিসও লুঠ করেন। ইনকাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেননি।’ বিল তার কথা শুনে বলল, ‘ও জিনিসগুলো নিশ্চয়ই এখন ইউরোপের কোনো মিউজিয়ামে শোভাবর্ধন করছে?’
মার্কেজ আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘না, তাহলেও তো অন্তত চর্মচক্ষু সার্থক করা যেত। এ ব্যাপারে যতটুকু জানা যায় পিজরো এ জিনিসগুলো দান করেছিলেন, তার বিশস্ত সঙ্গী ‘মানচিও সিয়েরো দ্য লেন-গুইসামো’-কে। লেনগুইসামো ছিলেন জুয়াড়ি। যেদিন তিনি ওগুলো হাতে পেলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই সব কিছু তিনি খুইয়ে বসেন। তারপর ওসবের আর কোনো সন্ধান মেলেনি।’
গর্ভগৃহ ভালো করে দেখে নেওয়া হলে, সুজয়রা বাইরে বেরিয়ে এল। মার্কেজ বললেন, ‘চলুন, আমরা এবার এখানকার মিউজিয়াম দেখতে যাব। ওখানে ইনকা মমি রাখা আছে। দেখবেন কী অদ্ভুত!’ এই বলে তিনি সবাইকে নিয়ে এগোতে যেতেই সুসান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল তুলে এক দিকে দেখিয়ে বলল ‘ওই যে সেই লোকটা!’ সুজয়েরা তাকিয়ে দেখল, একটু দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পিনচিও আর তার সেই সঙ্গী। তাদের সঙ্গে রয়েছে আর একজন দীর্ঘদেহী লোক। তার পরনে আলখাল্লার মতো দেখতে ঝলমলে পোশাক। মাথায়, পাখির পালক লাগানো তাজ। মুখে উলকি আঁকা। বেশ দৃপ্ত ভঙ্গীতে পা ফেলছে সেই লোকটা। পিনচিওরা সুজয়দের লক্ষ করেনি। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল একটা ভগ্নস্তূপের আড়ালে। প্রফেসর মার্কেজ সেদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘ওদের সঙ্গের লোকটা সম্ভবত একজন ইনকা পুরোহিত।’ তারপর সুজয়ের দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘এখনও এসব অঞ্চলে ইনকা পুরোহিতদের অত্যন্ত প্রভাব আছে। স্থানীয় লোকেরা বেশ সমীহ করে চলে এদের।’ এই বলে তিনি সুজয়দের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে।