১৬
নেড়া পাহাড় বেষ্টিত এক রুক্ষ প্রান্তরে ভোরের আলো ফুটতেই নৌকা থেকে নেমে পড়ল সুজয়রা। চিমুরা কিন্তু সে মাটিতে পা রাখল না। যদিও এই বিদেশি লোকগুলোর ফিরে আসার সম্ভাবনা কম, তবুও যদি কেউ ফেরে, এই ভেবে সুজয়দের জন্য একটা নৌকা ছেড়ে রেখে তারা চলে গেল। কী অদ্ভুত ভোর এখানে! কোনো পাখির ডাক নেই, সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। বাতাস যেন থেমে আছে এখানে। ভোর যে এত নিষ্প্রাণ হতে পারে তা জানা ছিল না সুজয়দের। এ যেন সত্যিই মৃত্যুভূমি!
সুজয়রা যেখানে নামল তার কিছু দূরেই পাহাড়ের গায়ে বেশ কয়েকটা গুহামুখ। তার একটা যেন ঠিক পুমার মুখের মতো! কাঁকর বিছানো রুক্ষ মাটিতে হেঁটে তারা গিয়ে দাঁড়াল গুহা মুখের সামনে। তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারী পাথরের এক ভয়ঙ্কর মুর্তি। সময় তার দেহে থাবা বসিয়েছে। কিছু অঙ্গ খসে পড়ে গেছে। তাতে যেন আরও বিভৎস লাগছে তাকে। মার্কেজ গুহায় ঢোকার আগে একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘প্রাচীন ইনকারা গুপ্ত নগরীর প্রবেশ মুখে এ জাতীয় মূর্তি বসিয়ে নরবলি দিয়ে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করত। তারা ভাবত তাদের অনুপস্থিতিতে এই মুর্তিগুলো জেগে উঠে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের প্রবেশ রোধ করবে।’
গাঁওবুড়োর নির্দেশমতো টিহুয়া সুজয়দের নিয়ে প্রবেশ করল গুহার ভিতর। লম্বা সুড়ঙ্গ এঁকে বেঁকে চলে গেছে সামনের দিকে। আধো অন্ধকার পথ। মাঝে মাঝে পাথরের ফাটল চুঁইয়ে আলো আসছে ভিতরে। চলতে থাকল সুজয়রা। পথ কখনো ওপরে উঠছে, কখনো নীচে নামছে। বিল জানতে চাইল, ‘কতক্ষণে আমরা সেই নগরীর কাছাকাছি পৌঁছব?’ টিহুয়া জবাব দিল, ‘গাঁওবুড়ো যা বলেছে, তাতে ঘণ্টা পাঁচেক সময় লাগার কথা। তিন চারটে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে, তারপর নাকি নগরীতে পৌঁছেছে এই সুড়ঙ্গ। আমরা আসলে এগোচ্ছি নগরীর পিছন দিক থেকে। আর ইনকা পুরোহিতরা জঙ্গল ভেঙে পাহাড় অতিক্রম করে নগরীর সম্মুখ ভাগ দিয়ে সম্ভবত নগরীতে প্রবেশ করেছেন।’ এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। নির্বাক ভাবে টিহুয়াকে অনুসরণ করে চলল সবাই। মাঝে মাঝে নিঃশ্চিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে তারা। তখন মশাল জ্বেলে নিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-এক সময় মাটিতে হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একবার একটা বর্শা বেঁধা নরকঙ্কালও চোখে পড়ল সুজয়ের। তবে তা অনেক দিনের পুরনো। বিল তাকে স্পর্শ করতেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল কঙ্কালটা। বহু বছর আগে, গাঁওবুড়োদের সেই নগরীতে প্রবেশ প্রস্থানের পর হয়তো আর কেউ ঢোকেইনি এই গুহাতে।
গুহা পথে এগোতে লাগল সুজয়রা। আর বাইরে সূর্য ক্রমশ মাথার ওপর উঠতে শুরু করল। সুজয়রা যে নিষিদ্ধ নগরীর দিকে এগোচ্ছে, তার আকাশে পাক খেতে শুরু করল কনডোর পাখির ঝাঁক। ঘণ্টা তিনেক চলার পর সুড়ঙ্গর দেওয়ালের গায়ে মানুষ খোদিত নানা ধরনের হুয়াকা দেখতে পেল সুজয়রা। মার্কেজ মশালের আলোতে হুয়াকাগুলো ভালো করে দেখে বললেন, ‘সম্ভবত আমরা নগরীর কাছাকাছি কোথাও পৌঁছে গেছি।’ বিল ঘড়ি দেখে বলল, ‘হ্যাঁ, তিন ঘণ্টা হাঁটছি আমরা। হুয়াকা খোদিত দেওয়াল ক্রমশ এগিয়েছে সামনের দিকে। সে পথ ধরে আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে তারা উপস্থিত হল ভূগর্ভস্থ এক পাথুরে চত্বরে। জমাট অন্ধকার সেখানে। কিছুই সামনে দেখা যাচ্ছে না। মশালটা নিভিয়ে ফেলা হয়েছিল। সেখানে পৌছে মশালটা আবার জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই একটা ঠাণ্ডা স্রোত যেন সুজয়ের মেরুদন্ড বেয়ে নীচে নেমে গেল। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। টিহুয়ার হাতে ধরা মশালের আলো সামনে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোতে সুজয়রা দেখল চত্বরে সার বেঁধে বসে আছে অসংখ্য ইনকা মূর্তি! অনেক অনেক মানুষ সেখানে! শুধু অম্রধারী পালক গোঁজা মাথার সারি! সামনে থেকে দেওয়ালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তারা বসে আছে। যেন তারা সুজয়দের জন্যই এখানে অপেক্ষা করছে! এখনই উঠে আক্রমণ করবে সুজয়দের! বেশ কিছুক্ষণ সুজয়রা তাকিয়ে রইল লোকগুলোর দিকে। তারা কিন্তু উঠে এল না। কিছুক্ষণ পর টিহুয়া বলে উঠল, ‘ও মনে পড়েছে, গাঁওবুড়ো আমাকে বলেছিলেন সুড়ঙ্গতে একটা প্রাচীন কবরখানা আছে।’
সবাই এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। মার্কেজ বললেন, ‘তার মানে এসব মমি! ইনকারা বসার ভঙ্গিতে মানুষের মমি তৈরি করতেন। এটাই ছিল তাদের মমি তৈরির রীতি। এরপর মমির সারির মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকল তারা। বেশ বড়ো কবরখানা। অসংখ্য মমি, পুরুষের-নারীর। বিচিত্র তাদের পোশাক, মাথার সাজ। মমিগুলোর বুকের দুপাশ থেকে ধাতুর শিকল বেঁধে পাথরের ছোটো ছোটো স্তম্ভের সাথে তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে। নারী মূর্তিগুলো ভালো করে দেখে প্রফেসর বললেন, ‘‘এদের প্রত্যেকের কন্ঠনালিতে কাটা চিহ্ন আছে। টুমি দিয়ে কন্ঠনালি ছিন্ন করে বলি দিত ইনকারা। এদের দেহে সোনার অলঙ্কারও আছে। সম্ভবত এই নারীরা প্রত্যেকেই এক সময় সূর্য কন্যা ছিলেন। ইনতি বা বিচামার উদ্দেশ্যে এঁদের উৎসর্গ করার পর মমি বানানো হয়।’
কবরখানাটা পার হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। তারপর সুড়ঙ্গ বেয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠতে শুরু করল তারা। টিহুয়া বলল, ‘মনে হচ্ছে আমরা এবার মৃত্যু নগরীর দিকে উঠছি।’ তার কথা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই সুড়ঙ্গটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর মার্কেজ বললেন, ‘সম্ভবত ভূমিকম্প হল। পেরুর সব অঞ্চলই ভূমিকম্পপ্রবণ। যে কারণে ভূকম্পনরোধী জ্যামিতিক আকৃতির স্থাপত্য নির্মাণ করত প্রাচীন ইনকারা। সে রকম ভূমিকম্প হলে হয়তো এই সুড়ঙ্গতেই পাথর চাপা পড়ে মরতে হবে সকলকে!’ তার কথা শুনে কেউ কোনো মন্তব্য করল না।
অতি কষ্টে প্রায় এক ঘণ্টা ওপরে ওঠার পর সুড়ঙ্গর ভিতর একটা বেশ প্রশস্ত জায়গাতে উঠে এল তারা। আরও বেশ কয়েকটা সুড়ঙ্গ সেখান থেকে নানা দিকে চলে গেছে। পাথরের দেওয়ালের দু-পাশে দুটো ফোঁকর গলে বেশ কিছুটা আলোও ঢুকছে সেখানে। মার্কেজ আর সুজয় বিশ্রাম নেবার জন্য সেখানে বসে পড়ল, আর বিল গিয়ে উঁকি মারল একটা ফোঁকরে। আর তার পরই সে বলে উঠল, ‘আরে আমরাতো পৌঁছে গেছি!’ তার কথা শোনার সাথে সাথেই সুজয়রা তিনজন ফাটলটার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল। তারা দেখতে পেল তাদের হাত তিরিশেক নীচেই একটা প্রশস্ত চত্বর। টানা বারান্দা অলা শ্রীহীন পাথুরে বাড়িঘর রয়েছে চত্বরের দুপাশে। একপাশে পাথরে খোদাই করা বিরাট এক মন্দির। কালো রং তার। বেশ কয়েকটা ইনতিহুয়ানাতা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। আর পুরো চত্বরটাকে ঘিরে রেখেছে পাহাড়ের প্রাচীর। তবে চত্বরের কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই, মৃত্যুর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চত্বরে। আকাশে পাক খাচ্ছে কালো কালো হিংস্র পাখির ঝাঁক। তারা মাঝে মাঝে কর্কশ চিৎকারে নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে। মার্কেজ ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুসান যদি সত্যি এ পর্যন্ত এসে পৌঁছে থাকে তাহলে ওই ঘরগুলোর মধ্যেই কোথাও সে বন্দি আছে।’
টিহুয়া বলল, ‘আপনি ভাববেন না। সে এখানে থাকলে আমরা তাকে খুঁজে বার করবই।’
এরপর মার্কেজ মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সম্ভবত ওটাই সেই মন্দির।’ বিল ততক্ষণে ক্যামেরার টেলিফটো লেন্সটা বার করে সেটা ক্যামেরাতে লাগিয়ে দূরবিনের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তার মাধ্যমে বিচামার মূর্তিটাও দেখতে পেল সুজয়রা। তবে লেন্সের মাধ্যমে চত্বর আর ঘর বাড়িগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেও একটা মানুষও কোথাও চোখে পড়ল না। টিহুয়া বলল, ‘এখনতো বাইরে যাওয়া যাবে না, আমরা বরং সুড়ঙ্গর ভিতর দিয়ে চত্বরটাকে বেড় দিয়ে মন্দিরের দিকে এগোই। তারপর রাত নামলে দেখা যাবে।’ তার কথায় সবাই সম্মত হয়ে মন্দিরের দিকে যাবার সুড়ঙ্গটা অনুমান করে এগোল সে দিকে।
সর্পিল সুড়ঙ্গ। ধুলোতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে দেহ। কিছুটা সে দিকে এগোবার পর হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারল কাছেই একটা সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে শব্দটা হচ্ছে। মানুষের গোঙানির শব্দ!! বর্শা তুলে ধরে টিহুয়া এগোল সে দিকে। তার পিছনে এগোল অন্যরা। ক্রমশ শব্দটা স্পষ্ট হতে লাগল। তারপর তারা দেখতে পেল সুড়ঙ্গর আলোআঁধারির মধ্যে মাটিতে পড়ে থাকা একটা মানুষকে। টিহুয়া বর্শা দিয়ে তাকে শেষ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের দেখতে পেয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মানুষটা। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার গলার শব্দে সবাই মুহূর্তের মধ্যে চিনে ফেলত তাকে, মিস্টার পিনচিও!!!
টিহুয়া বর্শা ছাড়ল না। সবাই ছুটে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা পিনচিওকে ঘিরে দাঁড়াল। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে তার দেহ, ছিন্নভিন্ন তার পোশাক! একটা তির বিঁধে আছে তার কোমরের কাছে, মুখের চামড়া ফালা ফালা! মার্কেজ তার ওপর ঝুঁকে পড়ে উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘সুসান? সুসান কোথায়?’ পিনচিও মনে হয় চিনতে পারলেন মার্কেজকে। তিনি জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘সুসান এখানেই আছে। শয়তান ইল্লাপা তাকে আজ নিয়ে যাবে মন্দিরে। সে আর ফিরবে না। আমাকে ক্ষমা করুন প্রফেসর। আমার পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি! ও কি কষ্ট! জল, একটু জল।’ সুজয় এরপর তাড়াতাড়ি জল বার করে ঢেলে দিল পিনচিওর মুখে। সুজয়দের সব কিছু জানার জন্য তার আরও কিছু সময় বেঁচে থাকা প্রয়োজন।
জল পান করানোর পর পিনচিওকে ধরাধরি করে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল বিল। মৃত্যু পথযাত্রী যেন কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি পেল তাতে। প্রফেসর উৎকন্ঠার সাথে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুসান ভালো আছে তো? আপনারা কেন তাকে চুরি করে আনলেন? আপনার এ অবস্থাই বা করল কে?’
মিস্টার পিনচিও বললেন, ‘হ্যাঁ, সে ভালো আছে এখনও পর্যন্ত। ওর ললাটে বার্লো আঁকা আছে। ইনকা সম্রাটের উত্তরাধিকারীর চিহ্ন। ওই টিকা না থাকলে সূর্য মন্দিরে কারও প্রবেশের ক্ষমতা নেই। তাই আমরা ওই ছেলেটার জন্যই আপনাদের ভুলিয়ে এনেছিলাম। তারপর ছেলেটাকে চুরি করে পালালাম। পথে আমাদের সঙ্গীরা অসভ্যদের হাতে মারা গেল। আমি, হুইকো আর ইল্লাপা শুধু পৌঁছলাম এখানে। ছেলেটাকে একটা ঘরে রাখল ইল্লাপা। তারপর ইল্লাপার রূপ বদলে গেল। আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে যাবার নাম করে বিচামা পুরোহিতকে দিয়ে আমাদের কয়েদ করাল আজ রাতের উৎসবে বলি দেবার জন্য। দিনের আলোতে চত্বর রক্ষীহীন দেখে আমি পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আকাশ থেকে নেমে আসা ভয়ঙ্কর পাখিগুলো ঠুকরে আমাকে শেষ করে দিল। তাও কোনোরকমে আমি গুহায় ঢুকতে যাচ্ছিলাম। রক্ষীরা আড়ালে দাঁড়িয়ে তির চালাল। এ তিরে বিষ আছে! আমি আর বাঁচব না!’ একটানা কথাগুলো বলে হাঁফাতে লাগলেন পিনচিও।
মার্কেজ এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘মন্দিরের ভিতর কী আছে? যেখানে ঢুকবে বলে ছেলেটাকে চুরি করলে!’
পিনচিওর বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করতে শুরু করেছে। যেন তার বুকের বাইরে আসার জন্য ছটফট করছে। অতিকষ্টে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘পিজরো ইনকা সাম্রাজ্যের দখল নেবার পর লুঠ করা সামগ্রীর মধ্যে দুটো মহার্ঘ্য বস্তু তার সঙ্গী সিয়েরো দ্য লেনগুইসমোকে দান করেছিলেন নিশ্চই জানেন?’
মার্কেজ বললেন, ‘হ্যাঁ কুজকোর সূর্যমূর্তির পিছনে বসানো একটা সোনার চাকতি, আর পাঁচাকুটি ইনকার পান্না।’
পিনচিও শ্বাস ছেড়ে বললেন ‘ঠিক। আর এও নিশ্চই জানেন নেশার ঘোরে ও দুটোই তিনি জুয়ায় খুইয়ে বসেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসে তার সন্ধান মেলেনি। আসলে যিনি জিনিসগুলোর দখল পেয়েছিলেন তাকে হত্যা করে কুজকো মন্দিরের এক পুরোহিত সেগুলো নিয়ে পিজরোর সেনাদের নজর এড়িয়ে এখানে পালিয়ে আসেন। জিনিসদুটোকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি ওগুলোকে রাখেন বিচামা মন্দিরে। সূর্যদেবের প্রতীক সেই চাকতি গর্ভ গৃহে স্থান পায়। বিচামার স্থান হয় মন্দিরের বাইরে। ইনকা সাম্রাজ্যের প্রধান মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে তিনি ঘোষণা করেন, ‘একদিন পাঁচাকুটি ইনকার পুনর্জন্ম হবে। তার কপালে আঁকা থাকবে বার্লো। দশম বর্ষ যখন সম্রাটের অতিক্রম হবে তখন কুজকো মন্দিরের পুরোহিত তাঁকে এখানে আনবে। তাঁরা দুজনেই কেবল মন্দিরে প্রবেশ করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে ও দুটো জিনিস।’ এ কথা বলার পর বিড়বিড় করে বললেন, ‘ঠিক ছিল আমি পান্নাটা নেব, আর ইল্লাপা নেবে চাকতিটা। কিন্তু, কিন্তু…।’ গলা বুজে এল পিনচিওর, চোখও বুজে এল।
মার্কেজ তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘এ কথা আপনারা জানলেন কীভাবে?’
চোখ বন্ধ অবস্থাতে তিনি জবাব দিলেন, ‘বংশপরম্পরায় করিকাঞ্চা মন্দিরের কয়েকজন পুরোহিত এ কাহিনি জানে। ইল্লাপা তাঁদের একজন। আর আমি জেনেছিলাম পরবর্তীকালে, ‘সিয়েরো দা লেনগুইসমো’ ব্যাপারটা জেনেছিলেন বলে। তিনি তার ডায়েরিতে ব্যাপারটা লিপিবদ্ধ করে যান।’ সুজয়ের মনে হল পিনচিওর কন্ঠস্বর যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে!
মার্কেজ তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি সে ডায়েরি পেলেন কোথায়?’
জড়ানো গলায় পিনচিও জবাব দিলেন, ‘আমার বাড়িতে, পারিবারিক সিন্দুক ঘাঁটতে গিয়ে।’
‘মানে!!?’ বিস্মিত কন্ঠস্বর বেরিয়ে এল প্রফেসরের গলা দিয়ে।
ধীরে ধীরে চোখ খুললেন পিনচিও। এত যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর ঠোঁটের কোণায় মুহূর্তের জন্য একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘পেরু বিজয়ের নেতা সানফ্রান্সিসকো পিজরোর ঘনিষ্ঠ অনুচর ‘সিয়েরো দা লেনগুইসমো ছিলেন আমার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ।’ এরপরই পিনচিওর চোখের তারা স্থির হয়ে গেল!
মার্কেজ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘মিস্টার পিনচিও! মিস্টার পিনচিও!!!’
পিনচিও কোনো সাড়া দিলেন না। কয়েক মুহূর্ত পর বিল তাঁর চোখের পাতা বুজিয়ে দিয়ে বলল, ‘পাপের বেতন মৃত্যু। ঈশ্বর ওর আত্মাকে শান্তি দিক।’
বিল আর টিহুয়া মিলে পিনচিওর দেহ থেকে তিরটা খুলে নিল, তারপর যথাসম্ভব সুন্দরভাবে তাঁর মরদেহ একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে শায়িত করে সুড়ঙ্গর মুখে পাথর চাপা দিয়ে দিল।
মার্কেজ শুধু অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘আসলে ওঁর রক্তেই বংশানুক্রমে অ্যাডভেঞ্চার আর লোভ প্রবাহিত হচ্ছিল। তারাই ওঁকে এখানে ছুটিয়ে এনে মারল। যুগ যুগ ধরে ওই গুহার মধ্যে শায়িত থাকতে হবে ওঁকে।’
সুজয়রা আবার সুড়ঙ্গ ধরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলল। মার্কেজ বললেন, ‘আশা করি পিনচিও আমাদের সত্যি কথা বলেছেন। মন্দিরের ভিতরে আমাদের প্রবেশ করতেই হবে। তাহলেই আমরা সুসানকে পেতে পারি।’
সুড়ঙ্গ কিন্তু সোজা মন্দিরের কাছে যায়নি। তার পাশ ছুঁয়ে চলে গেছে অন্যত্র। তারপর আবার ফিরে এসেছে মন্দিরের কাছে। বেশ কিছুটা চলেও তারা মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করতে পারল না। এক সময় তারা উঠে এল সুড়ঙ্গর ভিতরেই একটা চওড়া জায়গাতে। সেখানে দেওয়ালের গায়ে একটা ছিদ্র দিয়ে বাইরের আলো আসছে। তারা কোথায় আছে? সেই অবস্থান বোঝার জন্য বিল সেই ছিদ্র দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারল তারা ঠিক মন্দিরের উলটো দিকে নগরীর প্রধান প্রবেশ পথের দিকে চলে এসেছে। নীচে তাকালেই চোখে পড়ছে ওপরে ওঠার পাকদন্ডী। বিল ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখল জায়গাটা দেখার জন্য। তার একটু পরই সে বলল, ‘আরে মানুষ দেখা যাচ্ছে! এরাই কি এখানে থাকে?’
পাহাড়ের নীচে একটু দূরে এদিকটাতে ছোটো গাছের জঙ্গল আছে। বিলের নির্দেশমতো সুজয় টেলিফটো লেন্সে চোখ রেখে দেখল, সেই জঙ্গলের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে অসংখ্য মানুষ। তারা সব উলঙ্গ! এত দূর থেকে তাদের পুতুলের মতো লাগছে। টিহুয়া ক্যামেরার সাহায্যে তাদের অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পর বলল, ‘এরা কাকাকুজকো নয়। জঙ্গলের অসভ্য জাতি। ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়। সম্ভবত মোচে জনজাতির। আমার মনে হচ্ছে সম্ভবত এরা এ নগরী আক্রমণ করতে এসেছে!’
সুজয় বলল, ‘কেন?’
টিহুয়া বলল, ‘নইলে ওরা এদিকে আসবে কেন? জঙ্গলে সকলের এলাকা ভাগ করা আছে। ওরা থাকে গভীর জঙ্গলে, আর এটা হল কাকা কুজকোদের এলাকা। সম্ভবত কাকা কুজকোরা ওদের কাউকে ধরে এনেছে, অথবা এ জাতীয় কোনো ব্যাপার ঘটেছে। রাতের অন্ধকারে ওপরে উঠবে ওরা।’
বিল বলল, ‘তাহলে তো ভয়ঙ্কর লড়াই হবে দু-দলের মধ্যে?’
টিহুয়া জবাব দিল, ‘তাই মনে হচ্ছে!’
সুসানরা এরপর যে পথ ধরে এগিয়েছিল, সেই পথ ধরেই ফিরতে শুরু করল। কিছু সময় পর তারা আবার ফিরে এল মন্দিরের কাছাকাছি এক জায়গাতে। বাইরে ইনতি ততক্ষণে পশ্চিম দিকে পরিক্রমণ শুরু করেছেন। সেখানে বসে পড়ল সকলে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর টিহুয়া বলল, ‘এভাবে মন্দিরে পৌঁছান যাবে না। এ জায়গাটা একটা গোলকধাঁধা! বেশ কয়েকটা সুড়ঙ্গ পথ নানা দিকে চলে গেছে জায়গাটা থেকে। মার্কেজ আর টিহুয়া উঠে গিয়ে সুড়ঙ্গ মুখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গর দেওয়ালে অস্পষ্ট কিছু হুয়াকা চোখে পড়ল প্রফেসরের। ধুলো ঝাড়তেই দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠল কনডোর পাখির একটা মুর্তি। সুড়ঙ্গটা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা এগিয়েছে মন্দিরের বিপরীত দিকে। প্রফেসর বললেন, ‘আগের সুড়ঙ্গটা মন্দিরমুখী হয়েও সেখানে যায়নি। আমার মনে হচ্ছে এটা বিপরীত মুখী হয়েও মন্দিরের দিকে যেতে পারে। হয়তো ধোঁকা দেবার জন্যই এই ব্যবস্থা করে রাখা আছে।’
তাঁর কথা শোনার পর সুজয়রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, সে পথেই যাবে ঠিক করল। তারা প্রবেশ করল সেই পথে। কিছুটা এগোবার পরই অন্ধকারে ডুবে গেল তারা। বাধ্য হয়ে মশাল জ্বালিয়ে নিতে হল। পথ এগিয়েছে এঁকেবেঁকে, নীচু ছাদ, ঘেঁসাঘেসি পাথরের দেওয়াল যেন পিষে ধরতে চাচ্ছে সুজয়দের। কোনো কোনো সময় হামাগুড়ি দিয়ে চলতে লাগল সবাই। সময়ের সাথে সাথে ওদিকে বাইরে আলোও কমে আসতে লাগল। এক সময় দেওয়ালের গায়ে মশালের আলোতে চোখে পড়তে লাগল সার সার হুয়াকা, পুমা, কনডোর, মাচাকুয়ে ইত্যাদি বিভিন্ন পশুপাখির সাপের মূর্তি। নানা রকমের অদ্ভুত আকৃতির মানুষের মুখ। এ রকম হুয়াকা এখানে কোন সুড়ঙ্গে চোখে পড়েনি কারও। বেশ কিছুটা পথ হুয়াকা আঁকা সুড়ঙ্গ দিয়ে চলার পর হঠাৎ দূর থেকে একজন মশালধারী রক্ষী চোখে পড়ল। একটা ছোটো ঘরের মতো জায়গাতে সুড়ঙ্গর মুখ আগলে সুজয়দের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী আমাজনীয় রক্ষী। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মশাল নিভিয়ে দিয়ে টিহুয়া সন্তর্পণে এগোতে লাগল রক্ষীর দিকে। তার পিছনে দেওয়াল ঘেঁসে এগোল অন্যরা। কিছুটা এগিয়ে কোমর থেকে ব্লো পাইপ বার করে মুখের কাছে ধরল টিহুয়া। রক্ষী তখন সুজয়দের হাত কুড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। একটা মৃদু শিসের মতো শব্দ হল ব্লো পাইপ থেকে। কাঁটাটা গিয়ে বিঁধল রক্ষীর ঘাড়ে। একবার যেন শুধু ঘাড়ে হাত বুলাল রক্ষী। তারপর মুহূর্তেই দড়াম করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। সুজয়রা তার কাছে গিয়ে পড়ে থাকা মশালটা তুলে নিয়ে দেখল লোকটার মুখটা নীল হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যেই মরে কাঠ হয়ে গেছে অতবড়ো মানুষটা! মার্কেজ অবাক হয়ে টিহুয়াকে বললেন, ‘তুমি লোকটাকে মেরে ফেললে!?’ টিহুয়া জবাব দিল, ‘ওর কপালে আজ মৃত্যু লেখা ছিল। আমি না মারলেও মোচেদের সাথে লড়াইয়ে বা অন্য কোনো ভাবে মৃত্যু হত ওর।’ এই বলে সে আবার এগোতে লাগল। আরও কিছু সময়ের পর আরও একজন রক্ষী দেখতে পেল তারা। তাকে একই ভাবে সাবাড় করার পর টিহুয়া বলল, ‘আমরা মনে হয় ঠিক পথেই এগোচ্ছি, নইলে এদিকে সুড়ঙ্গে রক্ষী থাকবে কেন?’
সময় এগিয়ে চলল, এক সময় বাইরে থেকে শোনা যেতে লাগল ঢাকের শব্দ। সুড়ঙ্গও বেশ কয়েকবার কেঁপে উঠল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কেউ আর কোনো কথা বলল না। তারপর সুড়ঙ্গর গায়ে একটা ফাটল চোখে পড়ল। সেই ফাটল দিয়ে বাইরে তাকাতেই সুজয়দের চোখের সামনে ভেসে উঠল মশাল আলোকিত, রক্ষী পরিবৃত চত্বর। একটু খেয়াল করার পর ইনতিহুয়ানাতা বাঁধা চারজন লোক চোখে পড়ল তাদের। একজনকে চিনতে পারল সুজয়। পিনচিও-র সহচর হতভাগ্য হুইকো! লোকগুলো নড়ছে না। সম্ভবত তাদের বলি দেওয়া হয়ে গেছে! টিহুয়া বাকি তিনজনকে দেখে বলল, ‘এবার বুঝলাম অসভ্যরা কেন এদিকে আসছে? ওদের লোককে এরা ধরে এনেছিল!’
হঠাৎ প্রফেসর বলে উঠলেন, ‘ওই যে! ওই যে! বিচামা মূর্তির কাছে। সুজয়রা দেখল বিচামা মূর্তির সামনে রক্ষী পরিবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাক পরা ইনকা পুরোহিত আর তার পাশে ঝলমলে পোশাক পরা সুসান। সুসানের সামনে নতজানু হয়ে বসে আছে লাল পোশাক পরা একজন লোক! সম্ভবত সে বিচামা পুরোহিত হবে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুজয়রা তাকিয়ে রইল সে দিকে। এক সময় ইল্লাপা সুসানকে নিয়ে এগিয়ে চলল মন্দিরের দিকে। টিহুয়া এবার সুজয়দের হুঁস ফিরিয়ে বলল, ‘আর আমাদের দেখার কিছু নেই। ওরা মন্দিরে ঢুকতে যাচ্ছে! আমাদেরও এগোতে হবে।’
সুজয়রা আর দাঁড়াল না। দ্রুত চলতে লাগল সুড়ঙ্গ ধরে। পথ যেন আর ফুরায় না। প্রতিটি মিনিট যেন এক একটা ঘণ্টা! মার্কেজ এক সময় বললেন, ‘এ পথ আমাদের ঠিক মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছে তো?’ অবশেষে এক সময় সুড়ঙ্গর শেষ প্রান্তে একটা আলোকরেখা দেখতে পাওয়া গেল। মশাল নিভিয়ে সে দিকে এগিয়ে সুড়ঙ্গর শেষ প্রান্তে পৌঁছে আলোক উৎসের দিকে উঁকি দিল তারা।
সুজয়রা দেখতে পেল বিশাল একটা গুহার মাঝখানে একটা নীচু বেদির ওপর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ইনকা পুরোহিত ইল্লাপা। বেদির চার কোণে বসে আছে চারটে মমি। আর বেদির মাঝখানে ছোটো একটা স্তম্ভের গায়ে বসানো আছে বিরাট বড়ো গোল চাকতি। মশালের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে চাকতিটা! মার্কেজ একবার চাপা স্বরে সুজয়ের কানের কাছে বললেন, ‘সূর্যদেবের সোনার চাকতি!’
সুড়ঙ্গের ভিতর সুজয়রা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ঘরের একটা অংশই চোখে পড়ছে। ছাদ আর দু-পাশের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে না। সুসানকে তারা প্রথমে দেখতে পেল না। সুজয়ের মনে হল, মশাল ধরে ইল্লাপা যেন ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভিতরে ঢুকে পড়বে নাকি চিন্তা করতে লাগল সুজয়রা। কয়েক মুহূর্ত পরই তারা দেখতে পেল সুসানকে! একটা ছোটো বাক্স হাতে সে এগিয়ে আসছে বেদির দিকে। তার দিকে তাকিয়ে বেদি থেকে নেমে দাঁড়ালেন ইনকা পুরোহিত। সুসান তার হাতে বাক্সটা তুলে দিতেই মশালটা একটা মমির হাতে গুজে দিয়ে বাক্সটা খুলে ফেললেন। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল হাঁসের ডিমের মতো বড়ো প্রায় গোলাকৃতি সবুজ রঙের একটা পাথর! মশালের আলোতে ঝলমলে সবুজ দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে ইনকা পুরোহিতের হাতে ধরা পাথর থেকে। সুজয় বুঝতে পারল, ওই হল সেই, ‘পাঁচাকুটি ইনকার পান্না!’ যার জন্য এ মৃত্যু নগরীতে ছুটে আসতে হয়েছে সকলকে! এরই লোভে প্রাণ দিলেন পিনচিও, মরতে হল হুইকোকে!
বেশ কয়েক মুহূর্ত পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর ইল্লাপা পাথরটা তার কোমর বন্ধনিতে গুঁজে নিলেন, তারপর তিনি সেই বাক্সটা ছুড়ে ফেললেন সুড়ঙ্গের দিকে। সুজয়ের প্রায় গায়ে এসে সুড়ঙ্গর ভিতর পড়ল সেটা। বাক্সটা ফেলে দিয়ে ইনকা পুরোহিত আবার বেদিতে উঠে স্তম্ভের খাঁজে বসানো বিরাট থালার মতো চাকতিটা দু-হাত দিয়ে খুলে ফেললেন। ঝিলিক দিয়ে উঠল সূর্যদেবের সোনার চাকতি! তিনি চাকতিটা নিয়ে বেদি থেকে নীচে নামতেই সুসান বলে উঠল, ‘এবার তাহলে আমাকে দাদুর কাছে পৌঁছে দাও!’ সুড়ঙ্গর ভিতর দাঁড়িয়ে সে কথা শুনতে পেল সকলে।
ইনকা পুরোহিত সুসানের কথা বুঝতে পারলেন কিনা কে জানে! তিনি শুধু ঘাড় নেড়ে, চাকতিটা সাবধানে মাটিতে নামিয়ে রেখে কোমরে হাত দিয়ে সুসানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মশালের আলো এসে পড়েছে ইল্লাপার মুখে। সুজয় দেখল ধীরে ধীরে ইনকা পুরোহিতের মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠছে! হঠাৎই তার চোখ দুটো কেমন হিংস্র হয়ে উঠল। তিনি এগোতে লাগলেন সুসানের দিকে। ভয় পেয়ে সুসানও পিছু হটতে শুরু করল। মশালের আলোতে কী যেন চকচক করে উঠল ইনকা পুরোহিতের হাতে! কোমর থেকে দীর্ঘ টুমিটা খুলে নিয়ে সুসানের দিকে এগোচ্ছেন তিনি! বিলও রিভলবারটা উঁচিয়ে ধরেছে সুড়ঙ্গর মুখে দাঁড়িয়ে, টিহুয়ার মুখের কাছে ধরা ব্লো পাইপ। কিন্তু তারা কেউই ব্যবহার করতে পারছে না সেগুলো। ইল্লাপা আর সুসান এত ঘনিষ্ঠ যে সুসানের গায়ে লেগে যেতে পারে তা। ইনকা পুরোহিত এক পা এগোচ্ছেন আর সুসান পিছোচ্ছে। সুসানের পিঠ সুজয়দের দিকে। ইল্লাপা আর সুসানের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে! ইনকা পুরোহিত মাথার ওপর টুমিটা তুলে ধরলেন। মশালের আলোতে ঝলসে উঠল তার ফলাটা! হঠাৎই যেন আবার মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করল সুজয়দের পায়ের তলার মাটি। বিল আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। ইল্লাপা আর সুসানের মধ্যে হাত দুয়েকের পার্থক্য। টুমিটা সুসানের ওপর নেমে আসার আগেই সুড়ঙ্গর মুখে দাঁড়িয়ে সুসানের মাথার ওপর দিয়ে ইল্লাপাকে লক্ষ্য করে বিল গুলি চালিয়ে দিল। প্রচন্ড শব্দ আর বারুদের ধোঁয়ায় ভরে গেল চারপাশ। বিলের গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেটা বিদ্ধ করল ইল্লাপার কাঁধের কনডোরটাকে। এক গোছা পালক উড়িয়ে কর্কশ আর্তনাদ করে পাখিটা ছিটকে পড়ল ঘরের কোণে। সুড়ঙ্গর মুখ থেকে সুজয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিল ঢুকে পড়ল ঘরের মতো গুহাটার ভিতর। ব্যাপারটা ঘটতে কয়েক মুহূর্ত মাত্র সময় লাগল। ইল্লাপা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে ছুটে গিয়ে মাটি থেকে চাকতিটা তুলে নিলেন। তারপর সেটা ঢালের মতো উঁচিয়ে ধরে ফিরে দাড়ালেন বিলের দিকে। বিল ততক্ষণে রিভলবার উঁচিয়ে ধরে প্রায় তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
সুজয়রাও ততক্ষণে গুহার ভিতর ঢুকে পড়েছে। তাদের দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে মার্কেজকে জড়িয়ে ধরল সুসান। বিল ইল্লাপার কাছে পৌছেই আর একটা গুলি চালাল। চাকতিতে লেগে ছিটকে পড়ল গুলিটা। আর একটাই মাত্র গুলি আছে বিলের রিভলবারে। ইনকা পুরেহিত এবার উলটো দিকের দেওয়ালের দিকে পিছোতে শুরু করলেন চাকতিটাকে ঢালের মতো আঁকড়ে ধরে। আর বিলও এগোতে লাগল তার দিকে। টিহুয়ার ব্লোপাইপটা বিল সুড়ঙ্গ থেকে বেরবার সময় হাত থেকে কোথায় খসে পড়েছে। সুসানকে নিয়ে সুজয়, মার্কেজ আর টিহুয়া তাকিয়ে দেখতে লাগল বিলদের। ইনকা পুরেহিত ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন গুহার অন্ধকার কোণের দিকে। গুহার চার দেওয়াল থেকে বারান্দার মতো অসংখ্য থাক ক্রমশ ওপর দিকে উঠে ছাদের কাছে পৌঁছে মিলেমিশে গেছে। ইনকা পুরোহিত পিছু হটতে হটতে এক সময় দেওয়ালের এক কোণায় পৌঁছে গেলেন, ঠিক সেই সময় মশালের আলোটাও হঠাৎই কমে গেল। প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল সেই কোণটা। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন ইনকা পুরোহিত। প্রচন্ড জোরে চাকতিটা তিনি ছুড়ে মারলেন বিলের দিকে! বিল আঘাতটা এড়াল ঠিকই, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে গেল মাটিতে। রিভলবারটাও ছিটকে মাটিতে পড়ল! সোনার চাকতিটা দেওয়ালে আছড়ে পড়ার আর রিভলবারের অবশিষ্ট গুলিটা বেরিয়ে যাবার মিলিত বিভৎস শব্দে কানে তালা লেগে গেল সুজয়দের। পরক্ষণেই রক্ত জল করা একটা হাসির গররা বেরিয়ে এল ইনকা পুরোহিতের গলা থেকে। মানুষের হাসি যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে সুজয়ের তা জানা ছিল না! এরপর ইনকা পুরোহিত দুর্বধ্য ভাষায় একটা চিৎকার করে টুমিটা উঁচিয়ে ধরে এগোলেন মাটিতে পড়ে থাকা বিলের দিকে। কিছুটা দূরে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে সুজয়রা। হঠাৎ সুজয়ের মনে হল ইনকা পুরোহিতের ঠিক পিছনে মাথার ওপর দেওয়ালের একটা থাকের অন্ধকারটা যেন একটু দুলে উঠল, মুহূর্তের জন্য যেন সুজয় দেখতে পেল একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ! এরপর মুহূর্তেই সেই অন্ধকারটা পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইনকা পুরোহিতের ঘাড়ে! মন্দিরের শেষ প্রহরী আমাজনের কালো বাঘ টুঁটি কামড়ে ইল্লাপাকে পেড়ে ফেলল মাটিতে। টুমি খসে গেল ইল্লাপার হাত থেকে। প্রাণীটার হাত থেকে বাঁচবার জন্য ঝটাপটি শুরু করলেন ইনকা পুরোহিত। ক্রুদ্ধ কালো প্রাণীটা গজরাতে গজরাতে থাবা চালাতে লাগল তাঁর শরীরে। তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে ফালা ফালা হয়ে যেতে লাগল ইল্লাপার শরীর। তার সাদা পোশাক মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে গেল। এ লড়াই বেশিক্ষণ চালানো সম্ভব হল না ইনকা পুরোহিতের পক্ষে। তার শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এল, নিথর হয়ে গেল কুজকো করিকাঞ্চার ইনকা পুরোহিত ইল্লাপার দেহ। বাঘটা এর পরও বেশ কিছুক্ষণ কামড়ে ধরে রইল ইনকা পুরোহিতের গলা। তারপর তাকে ছেড়ে ফিরে তাকাল মাটিতে পড়ে থাকা বিলের দিকে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে প্রাণীটার উজ্জ্বল চোখ দুটো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল বিলকে। ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো বার করে একবার ঠোঁট চাটল প্রাণীটা! তার চিবুকে লেগে আছে ইনকা পুরোহিতের টাটকা রক্ত।
সুজয়রা কখন যে পায়ে পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেছে তা তারা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ টিহুয়ার খেয়াল হল তার হাতে ধরা বর্শার কথা। প্রাণ ভয়ে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল বিল। তার দিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে মিশমিশে কালো প্রাণীটা। তার লেজের ডগাটা শুধু মৃদু মৃদু নড়ছে। ঝাঁপ দেবার আগের মুহূর্ত! সে বিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই টিহুয়া তার বর্শাটা তাগ করল প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। ঠিক তখনই সুসান এক কান্ড করল, হঠাৎ সে তির বেগে ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বিল আর প্রাণীটার মাঝে! বর্শা ছোড়া হল না টিহুয়ার, প্রাণীটাও লাফ দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্ত কেমন যেন থমকে গেল! সুজয়ের পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে। সুসান আর বাঘটার দিকে তাকিয়ে তার হৃৎপিন্ডও কাঁপছে। একই অবস্থা প্রফেসর মার্কেজেরও। টিহুয়া বর্শা ছুড়তে পারছে না, বাঘের দেহর একটা অংশ আড়াল করে সুসান দাড়িয়ে আছে। সুসান আর বাঘটা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা ঘণ্টা! আর এর পরই একটা বিস্ময়কর ঘটনার সাক্ষী হল সবাই। সুসান কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল প্রাণীটার মাথায়! আর বাঘটাও পোষা কুকুরের মতো ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে মাথা ঘসতে লাগল সুসানের গায়ে! কয়েক মুহূর্ত পর আরও একটা অদ্ভুত জিনিস দেখল সুজয়। দেওয়ালের গায়ের খাঁজ বেয়ে একটা কালো রোমশ বল গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এসে দাঁড়াল, বাঘটার পাশে। খুদে খুদে চোখ দিয়ে সে তাকাচ্ছে চারপাশে! বাঘটা লম্বা জিভ দিয়ে তার গা চাটতে লাগল। সুসান এরপর সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুজয় আঙ্কল এদিকে এগিয়ে এসো। বাঘটা কিছু বলবে না।’ মাটি কাঁপছে। সুজয় এগিয়ে গেল সুসান আর বাঘটার দিকে। তার পিছনে প্রফেসর মার্কেজ আর টিহুয়া। সুজয় সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই সুসান বলল, ‘ওর গায়ে হাত দাও।’ কাঁপা কাঁপা হাতে সুজয় প্রাণীটার গায়ে হাত দিল। বাঘটা একবার শুধু তার দিকে তাকিয়ে আবার তার বাচ্চাটার গা চাটতে লাগল। সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল তাদের। একটু দূরেই পড়ে আছে ইনকা পুরোহিতের রক্তাক্ত মৃতদেহ। তাঁর খোলা চোখ দুটো তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। তাঁর সেই চোখ দুটোকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মনে হল সুজয়ের।
হঠাৎ টিহুয়া বলে উঠল, ‘শুনতে পাচ্ছেন? বাইরে থেকে গোলমালের শব্দ আসছে! সম্ভবত অসভ্য মোচেরা নগরী আক্রমণ করেছে!’
সুজয়রা তার কথা শুনে এতক্ষণ পরে খেয়াল করল, সুড়ঙ্গর মোটা পাথুরে দেওয়াল ছাপিয়ে ভেসে আসছে কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ!
আর এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হঠাৎ প্রচন্ড জোরে দুলতে শুরু করল সুজয়ের পায়ের তলার মাটি, কোনো প্রকান্ড দৈত্য যেন ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে গুহাটাকে।
মার্কেজ চিৎকার করে উঠলেন, ‘এখনই আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে। ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।’
বাঘটাও মুহূর্তের মধ্যে তার বাচ্চাটাকে মুখে তুলে নিয়েছে! ছাদ থেকে খসে পড়ছে পাথর! মাথা বাঁচিয়ে টলোমলো পায়ে সুজয়রা এগোল, যে সুড়ঙ্গ দিয়ে তারা গুহার ভিতরে ঢুকেছে সে দিকে। কিন্তু তারা সে পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই ওপর থেকে প্রচন্ড বড়ো একটা পাথরের চাঁই ধসে পড়ে সেই সুড়ঙ্গ মুখ বন্ধ করে দিল! পাথর সরাবার আর সময় নেই, পাথর বৃষ্টি শুরু হয়েছে ওপর থেকে। কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। টিহুয়া দেখতে পেল বাঘটা তার বাচ্চাটাকে মুখে তুলে দ্রুত এগোচ্ছে গুহার অন্য পাশে একটা সুড়ঙ্গর দিকে। তাই দেখে টিহুয়া বলে উঠল, ‘ওই দেখুন! বাঘটা মনে হয় বাইরে যাবার রাস্তা জানে! ওকে শীগগির অনুসরণ করতে হবে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি!’ এই বলে সে ছুটে গিয়ে মমির হাতে ধরা মশালটা তুলে নিল। সুসানকে নিয়ে সকলে ছুটল বাঘটার পিছু পিছু। বিচামা মন্দিরের গর্ভ গুহায় পড়ে রইল ইনকা পুরোহিতের দেহ, পাঁচাকুটি ইনকার মহার্ঘ পান্না আর সূর্যদেবের সোনার চাকতি। বাঘটার পিছু পিছু গুহা ছেড়ে একটা সুড়ঙ্গ ধরে কিছুটা এগোতেই সুজয়রা পিছনে প্রচন্ড একটা শব্দ শুনতে পেল। ধসে পড়ল তাদের ফেলে আসা গুহাটা! বাঘটার পিছু পিছু একটার পর একটা সুড়ঙ্গ অতিক্রম করতে লাগল তারা। অবশেষে এক সময় তারা পৌঁছে গেল সেই চেনা সুড়ঙ্গ পথে। যে পথে সুজয়রা প্রবেশ করেছিল নগরীতে। বাঘটা সেই সুড়ঙ্গর মুখে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরে তাকাল সুসানের দিকে। নির্বাক দৃষ্টিতে সুসানের দিকে তাকিয়ে সে যেন বলল, ‘বিদায়, হে অচেনা বন্ধু!’ আর তার পরই বাচ্চাটাকে মুখে নিয়ে লাফ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাইরে শোনা যাচ্ছে অসভ্য মোচেদের বর্বর উল্লাস, আমাজনীয় নগর রক্ষীদের আর্তনাদ আর পাথর খসে পড়ার বিভৎস শব্দ! ভূমিকম্পে ধসে পড়ছে ইনকাদের শতাব্দী প্রাচীন এই মৃত্যু নগরী! সুড়ঙ্গ পথ ধরে বাইরে যাবার জন্য ছুটতে শুরু করল সুজয়রা। তারা চলল তো চললই। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে তারা যখন নদীর পাড়ে পৌঁছে নৌকায় উঠে বসল তখন পাহাড়ের মাথায় সূর্যোদয় হচ্ছে। মৃত্যু নগরীর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রয়ে গেলেন, পিনচিও, হুইকো, ইনকা পুরোহিত। সুজয়দের নৌকো জল কেটে রওনা হল চিমু গ্রামের দিকে।
পুনশ্চ : তিন দিন পর চিমু গ্রামের এক পাতায় ছাওয়া কুঁড়েতে বসে নিজেদের মালপত্র গোছগাছ করছিল সুজয়রা। পরদিন তারা ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করবে। সবার মনই বেশ উৎফুল্ল, কেবল বিলের মন একটু খারাপ। গাঁওবুড়ো বেশ কিছু মৃৎপাত্র উপহার দিয়েছেন প্রফেসর মার্কেজকে। সেগুলো প্যাক করতে করতে মার্কেজ বললেন, ‘এ সব জিনিস হল খাঁটি চিমু শিল্পের নিদর্শন। কুজকো মিউজিয়ামেও এ জিনিস নেই! এগুলো যে কোনোদিন আমার হাতে আসবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি! আমার এখানে আসা সার্থক।’
তার কথা শুনে বিল বলল, ‘আমার আশা পূর্ণ হল না। কোরাকেঙ্কুর দর্শন মিলল না। তবে একটা ব্যাপারে কিন্তু আমি নিশ্চিত। ও পাখি ঠিক আছে। কোনো দিন যদি সুযোগ পাই তবে কোরাকেঙ্কুর সন্ধানে আবার পেরুতে অভিযানে আসব আমি।’
সুজয় তার কথা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুমি এতটা নিশ্চিত কীভাবে হলে? আমার তো মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই নিছক গল্প কথা!’
বিল কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘না সে পাখি আছে। নইলে এদুটো কোথা থেকে এল?’ এই বলে সে তার জামার তলা থেকে সাবধানে বেশ বড়ো দুটো পালক বের করে আনল। লাল, সাদা, কালো ডোরা আঁকা তাতে! এরপর বিল বলল, ‘নিকের লেখাতে বা হুইকোর বর্ণনাতেও কিন্তু এরকম পালকের কথাই ছিল!’
অবাক হয়ে পালকের দিকে তাকিয়ে সুজয় বলল, ‘এ পালক তুমি কোথায় পেলে?’
সে জবাব দেবার আগেই সুসান হঠাৎ বলে উঠল, ‘মন্দিরে ঢোকার আগে এ পালক দুটোইতো আমার মাথায় গুঁজে দিয়েছিল বিচামা পুরোহিত!’
বিল তার কথার সাথে সংযুক্ত করল, ‘হ্যাঁ, এ দুটো সুসানের ল্লান্টুতে ছিল। আপনারা খেয়াল করেননি। সুড়ঙ্গতে পালাবার সময় খসে পড়েছিল। আমি কুড়িয়ে নিয়েছি। এই পালক মাথায় গুঁজে দিয়ে ইনকা হিসাবে সুসানের অভিষেক করা হয়েছিল।’
ঠিক সেই সময় টিহুয়া ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন একটা জিনিস দেখে যান!’
সুজয়রা ঘরের বাইরে পা রাখতেই টিহুয়া আঙুল তুলে দেখাল একটা বিরাট গাছের দিকে। শেষ বিকালের পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে গাছটার মাথায়। একটা বিরাট বড়ো পাখি বসে আছে উঁচু একটা ডালে। সোনালি দেহ, লাল-সাদা-কালো-ডোরা আঁকা দীর্ঘ লেজ। কোরাকেঙ্ক!! সত্যি অপূর্ব সুন্দর পাখি! বিল ক্যামেরা আনতে যাচ্ছিল, কিন্তু পাখিটা তার আগেই ডানা মেলে দিল আকাশে। তারপর ছোটো হতে হতে এক সময় হারিয়ে গেল দূরদিগন্তে।
সমাপ্ত