১৫
সুসানের যখন ঘুম ভাঙল। তখন রোদ ঘরের কোনো স্পর্শ করেছে। উঠে বসল সুসান। বাঘটা কি মরে গেছে? সুসান উঁকি দিল দরজার দিকে। কালো প্রাণীটা একইভাবে পড়ে আছে। দূরে দেখা যাচ্ছে সূর্যের আলোতে আলোকিত পাথুরে চত্বর। কিন্তু কোনো লোকজন নেই সেখানে। কোথাও কোনো শব্দও নেই। সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে এ নগরী। সুসান উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানলার সামনে। চারপাশে রুক্ষ পাহাড়। কোনো নয়নাভিরাম দৃশ্য নেই। নীচে অতলান্ত খাদ, নিষিদ্ধ নগরীতে ওঠার পাকদন্ডী। ওই বেয়েই এ নগরীতে প্রবেশ করেছে সুসানরা। বাইরে চড়া রোদ। সূর্য মাঝ আকাশের দিকে এগোচ্ছে। সুসান অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। সুসান তাকালো আকাশের দিকে। মেঘহীন আকাশ। ঝাঁক বেঁধে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কনডোর পাখিরা। মাঝে মাঝে তাদের কর্কশ ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড়ে। ‘তার দাদু এখন কোথায়?’ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সুসান ভাবতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর একটা শব্দে দরজার দিকে ফিরে তাকাল সুসান। কালো প্রাণীটা টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। সুসানের দিকে সে তাকিয়ে আছে। প্রাণীটার চোখে হিংস্রতার লেশ মাত্র নেই, বরং কেমন যেন একটা করুণ ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে। সুসানকে কিছুক্ষণ দেখার পর প্রাণীটা একটা ঘড়ঘড় শব্দ করতে শুরু করল। জন্তুটাকে দেখে সুসানের হঠাৎ অন্য একটা প্রাণীর কথা মনে পড়ে গেল। তাদের ভ্যালপারাইজোর বাড়িতে একটা কুকুর আছে। গ্রেট ডেন, বিরাট কুকুর, তার পিঠের উচ্চতা এই কালো বাঘের চেয়েও বেশি। সুসানকে সে খুব ভালোবাসে। সেও এমন ঘড়ঘড় শব্দ করে। সুসানের হঠাৎ মনে হল, ‘এ প্রাণীটা সত্যিই কি বাঘ? অন্য কোনো প্রজাতির কুকুর নয়তো? নইলে এ লোকগুলো বাঘকে কুকুরের মতো পোষ মানিয়েছে কীভাবে? বাঘ কি কখনো পোষ মানে? এ দেশেতো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত দেখতে প্রাণী আছে! লামা, টেপির, ভিসুনিয়া আরও কত কি! দাদুতো সুসানকে বলেছিল, লামা আসলে হল উটজাতীয় প্রাণী! অথচ তাদের চেহারার কত তফাত! এই বাঘের মতো দেখতে প্রাণীটা আসলে এদেশীয় কুকুর নয়তো?’
ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে প্রাণীটা ঘরের ভিতর আনাচেকানাচে তাকাতে লাগল। যেন কী খুঁজছে ও। তারপর এক সময় ও জলের পাত্রটার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। একটা সোনার প্যানের মতো পাত্রে জল রাখা আছে। প্রাণীটা সেটা দেখতে পেয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পাত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে ঘরে ঢুকতে গেল পাত্রটার কাছে যাবার জন্য। গলার শিকলে টান পড়ল প্রাণীটার। চৌকাঠে আটকে গেল সে। প্রাণীটা এরপর করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকাতে লাগল জলের পাত্রর দিকে, আর একবার সুসানের দিকে। সুসান বুঝতে পারল কালো জন্তুটার জল তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু পাত্রটা এগিয়ে দিতে প্রথমে তার সাহস কুলালো না। সেও দেখতে লাগল প্রাণীটাকে। সতৃষ্ণ নয়নে সে বারবার তাকাচ্ছে পাত্রর দিকে। কিছুক্ষণ পর সুসান সাহস সঞ্চয় করল। জলের পাত্রটা দরজার কাছে নিয়ে এসে, সে সেটা ঠেলে দিল বাঘটার দিকে। বাঘটার গলা তবুও পাত্রর কাছে পৌঁছল না। সুসান এবার বাঘটার আরও কাছে গিয়ে পাত্রটা আর একটু ঠেলে দিল। মনে হয় খুব তেষ্টা পেয়েছিল তার, সঙ্গে সঙ্গে সে অতবড়ো পাত্রের প্রায় অর্ধেক জল খেয়ে নিল, তারপর লম্বা জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে তাকিয়ে রইল সুসানের দিকে। সুসান খেয়াল করেনি যে সে বাঘটার এত কাছে চলে এসেছে যে ঘরের মধ্যে ঢুকতে না পারলেও থাবা বাড়ালেই সে সুসানকে পেয়ে যাবে। সূর্যমন্দিরের প্রহরী কিন্তু তার দিকে থাবা বাড়াল না, একটা শুধু মোলায়েম শব্দ করল। যেন সুসানকে জল দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাল। সুসানের এরপর মনে হল, হয়তো প্রাণীটার খিদেও পেয়েছে। থালায় তখনও অনেকটা ঝলসানো মাংস পড়ে রয়েছে। সুসান খেয়ে দেখেছে তার স্বাদটা কেমন যেন কাঁচা কাঁচা, আঁশটে গন্ধও আছে তাতে। খুব খিদে পেয়েছিল বলে তাই সে খেয়েছিল মাংসটা। হয়তো ওই মাংস বাঘটার খেতে ভালো লাগবে! এই ভেবে এরপর সুসান ঘরের মাঝখান থেকে মাংসের পাত্রটা এনে বাঘটার একদম মুখের কাছে নামিয়ে রাখল। সে সেটা একবার শোঁকার পর খেতে শুরু করল। সুসান একদম চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। তাঁর ঠিক সামনের বিরাট বড়ো কালো মাথাটা নীচু করে খাচ্ছে প্রাণীটা। তার তেল চুকচুকে কালো শরীরের অনেক জায়গাতে কেটে বসে গেছে চাবুকের দাগ। দেহের জায়গায় জায়গায় রক্ত আর লোম জমাট বেঁধে দলা পাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বেশ কষ্ট হল সুসানের। তার ইচ্ছা হল প্রাণীটার মাথায় একবার হাত দেয়। এরপর এক সময় হয়তো নিজের অবচেতনেই বাঘটার মাথায় হাত দিয়ে বসল। বাঘটা কিছু বলল না। সে চুপচাপ খেতে লাগল। সুসানের ছোটো ছোটো আঙুল চলে ফিরে বেড়াতে লাগল প্রাণীটার মাথায়, ঘাড়ে।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে এল সুসানের। সে কার গায়ে হাত দিচ্ছে! চমকে উঠে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সুসান। কালো প্রাণীটা ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুসানের দিকে। একবার হাই তুলল প্রাণীটা। কি ভয়ঙ্কর তার দাঁতগুলো! ইচ্ছা হলে সে এখন মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে দিতে তার ছোট্ট শরীরটাকে! কিন্তু বাঘটা এরপর সুসানের পায়ে মাথা ঘসতে ঘসতে একটা অন্যরকম ঘড় ঘড় শব্দ করতে লাগল। এ শব্দের ধরন সুসানের চেনা। তাদের গ্রেটডেনটা যখন আদর খেতে চায় তখন সে পায়ে মাথা ঘসে এমনই শব্দ করে!
আবার সাহস ফিরে পেল সুসান। সে বাঘটার গায়ে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে তাকে আদর শুরু করল। প্রাণীটাও মাথা নীচু করে শব্দ করে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সুসানের মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন জাগল,—ইনকা পুরোহিত কি ফিরে এসে আবার চাবুক মারবেন ওকে?’ চাবুক হাতে ইনকা পুরোহিতের পৈশাচিক চেহারার কথা ভেবে কেঁপে উঠল সুসান। কিন্তু ওকে যদি এখন শিকল থেকে মুক্ত করে দেওয়া যায় তাহলে তো আর তিনি তাকে চাবুক মারতে পারবেন না! কথাটা মাথায় আসতেই সুসান এরপর তার গলার শিকলটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝনঝন শব্দে খসে পড়ল ভারী শিকলটা। শব্দটা শুনে চমকে উঠল সুসান। কালো বাঘটাও এবার ঘাড়টা তুলল। সে যে এখন মুক্ত তা সম্ভবত প্রাণীটা বুঝতে পারল। সে একবার তাকাল সুসানের দিকে, আর একবার তাকাল চত্বরের দিকে। মুহূর্তখানেক সে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তারপর বিরাট একটা লাফ দিয়ে তিরের বেগে কোনাকুনি ছুটল চত্বরের দিকে। মাত্র কিছুটা সময়, লম্বা লম্বা লাফে বিদ্যুৎ গতিতে সে পার হয়ে গেল জায়গাটা। গিয়ে দাঁড়াল চত্বর প্রান্তের পাহাড়ি দেওয়ালের সামনে। সে দেওয়ালে মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে একটা গুহামুখ। প্রাণীটা মুহূর্তের জন্য একবার থমকে দাঁড়াল সেই দেওয়ালটার সামনে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কী যেন একবার দেখল। তারপর খাড়া দেওয়াল বেয়ে সেই গুহাটার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল!
সুসান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চত্বরের ওপাশে সেই গুহাটার দিকে। তার পর দরজার বাইরে বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ভালো করে তাকাল চত্বরের চারপাশে। চত্বরের এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে খোদিত বিশালাকৃতির মন্দির। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ইনতিহুয়ানাতাগুলো। ওখানেই আছে বিচামার মূর্তি। মন্দিরের এক পাশ থেকে টানা বারান্দাঅলা কালো পাথরের তৈরি ঘর অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এসেছে সুসান যে ঘরে আছে সে দিকে। আর অন্য পাশে পাহাড়ের দেওয়ালের গায়ে সার সার গুহামুখ। সব কিছু ভালো করে তাকিয়ে দেখতে লাগল সুসান। চড়া রোদে খাঁ খাঁ করছে চত্বরটা। কেউ কোথাও নেই। যেন এই নিষিদ্ধ মৃত্যু নগরীতে সুসানই একমাত্র জীবিত প্রাণী! কাল রাতের অত রক্ষী, লোকজন, সব দিনের আলোতে কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। দিনের আলোতেও মৃত্যু নগরীতে থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সুসান যখন আবার ঘরে ফিরতে যাচ্ছে তখন একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল সুসানের। মন্দিরের কিছু দূরে বারান্দাঅলা কালো পাথরের বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। বারান্দার বাইরে বেরিয়ে সে সম্ভবত চারপাশে তাকাতে লাগল। বেশ অনেকটা দূরে হলেও তার পোশাক দেখে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাকে চিনতে পারল সুসান। লোকটা, পিনচিও আঙ্কল! তিনি চারপাশ দেখে নিয়ে এর পরই হঠাৎ ছুটতে শুরু করলেন চত্বরের মধ্য দিয়ে। তিনি ছুটছেন কেন বুঝতে পারল না সুসান। তিনি ছুটছেন পাহাড়ের গায়ে গুহাগুলোর দিকে। চত্বরের মাঝখানে ইনতিহুয়ানাতা দৌড়ে পার হতেই আকাশ থেকে নেমে এল একঝাঁক কনডোর! তাঁরা আক্রমণ করল পিনচিওকে। কোনো রকমে তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে দৌড়াতে লাগলেন পিনচিও। শকুনের মতো বিরাট পাখিগুলোর ধারালো ঠোঁট আর নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগল তাঁর পোশাক। আতঙ্কিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল সুসান। গুহার কাছাকাছি পৌঁছে পাখিগুলোর বিশাল ডানার ঝাপটায় মটিতে পড়ে গেলেন পিনচিও। হিংস্র পাখিগুলো যেন জয়ের উল্লাসে বিভৎস চিৎকার করে উঠল। আতঙ্কে সুসানের গলা থেকেও একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। এর পরমুহূর্তেই ঝাঁকে ঝাঁকে তির ছুটে গেল, মাটিতে পড়ে থাকা পিনচিও আর কনডোর পাখিদের দঙ্গলের দিকে। বারান্দার আড়াল থেকে তাদের লক্ষ্য করে তির ছুড়ছে রক্ষীরা! দুটো পাখি তির খেয়ে পড়ে গেল, কিন্তু আরও পাখি ওপর থেকে নেমে আসছে নর মাংসের লোভে। বাঁচার একটা শেষ, চেষ্টা করলেন পিনচিও, আর কয়েক হাত দূরে একটা গুহামুখ। কনডোরের দঙ্গল থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা তির এসে বিঁধল তার কোমরের নীচে। আবার পড়ে গেলেন তিনি। তারপর সেই অবস্থাতেই হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন গুহার ভিতর। তির চালানো এবার বন্ধ করল রক্ষীরা। কনডোর পাখিগুলো এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মটিতে পড়ে থাকা তির বেঁধা তাদের সঙ্গীদের ওপর, তাদের নিজেদেরই মাংস ছিঁড়েখুঁড়ে খাবার জন্য! সুসান পাথরের মূর্তির মতো আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। হঠাৎই তার কিছুদূরে পাথর বসানো সূর্যালোকিত মাটিতে সে দেখতে পেল একটা ছায়া। চমকে সে মাথা তুলে তাকাতেই দেখল, তার প্রায় কাছেই অনেক নীচে নেমে এসেছে একটা কনডোর! বিরাট কালো ডানা মেলে স্থির হয়ে বাতাসে ভেসে সে হিংস্র চোখে সুসানকে দেখছে। তার বিরাট বাঁকানো ঠোঁট আর তীক্ষ্ণ নখ এখনই নেমে আসবে সুসানের ওপর! তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সুসান ঘরে ছুটল ভিতরে ঢোকার জন্য, আর পাখিটাও তির বেগে নেমে এল সুসানের মাথা লক্ষ্য করে। সুসান ঘরের মধ্যে পা রাখার মুহূর্তেই শুনতে পেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হিংস্র পাখিটার ঠোঁট ঠক করে শব্দ তুলে সজোরে ধাক্কা খেল পাথরের দেওয়ালে।
ঘরের ভেতর ঢুকে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল সুসান। ঘরের দরজারতো কপাট নেই, যদি ওই রাক্ষুসে পাখিটা ঘরে ঢুকে পড়ে! পাখিটা ঘরে ঢুকল না। সে এর পর উড়ে গেল। তার সতীর্থদের মাংস দিয়ে চত্বরে যেখানে ভোজের অনুষ্ঠান চলছে তাতে যোগ দেবার জন্য। তখনও সে দিক থেকে ঘরের মধ্যে ভেসে আসছে হিংস্র পাখিগুলোর উল্লাস।
আতঙ্কিত সুসান বসে রইল ঘরের মধ্যে। সময় এগিয়ে চলল। এক সময় বাইরে পাখিগুলোর চিৎকার চ্যাঁচামেচি মিলিয়ে গেল। ভোজ সভা শেষ করে নতুন শিকারের সন্ধানে আকাশে আবার টহল দিতে শুরু করল পাখিগুলো। এতক্ষণ যেন কোথাও কিছু হয়নি! আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করল মৃত্যু নগরীকে।
রোদ তখন মাথার ওপর। একটু ধাতস্থ হয়ে ঘরের এক কোণায় শুয়ে পড়ল সুসান, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝে একবার ঘুম ভেঙেছিল সুসানের। ঘুমের ঘোরে বেশ কয়েকবার তার মনে হয়েছিল ঘরের মেঝেটা যেন দুলছে! একবার ওরকমই একটা দুলুনি মনে হওয়াতে উঠে বসেছিল সে। কিন্তু উঠে বসার পর আর কিছু বুঝতে না পেরে সুসান আবার শুয়ে পড়ল, সুর্যদেব এগিয়ে চললেন পশ্চিমের দিকে।
সুসান এরপর যখন ঘুমে ভেঙে উঠে বসল তখন বাইরে সূর্য ডুবে গেছে। আধো অন্ধকার ঘরে বসে রইল সুসান। অন্ধকার হলে ইনকা পুরোহিতের তাকে নিতে আসার কথা। তিনি তাকে নিয়ে যাবেন সূর্য মন্দিরে। সেখানে সুসানকে কী একটা যেন কাজ করতে হবে। তারপর তিনি তাকে পৌঁছে দেবেন তার দাদুর কাছে। তিনটি দিন যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করে চলেছে সে। আর তার দাদুকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগছে না। দাদু কেন এখানে এসে তার জন্য অপেক্ষা না করে অন্য জায়গাতে চলে গেল! সুজয় আঙ্কল বা বিল আঙ্কল তারাওতো একজন এখানে থাকতে পারত! তাহলেও তো সুসানকে এই ভয়ঙ্কর জায়গাতে একলা থাকতে হত না। দাদু কি দেখেনি, এখানে লোকজন, পশু-পাখি, এ সবই কেমন ভয়ঙ্কর ধরনের! তা সত্ত্বেও তারা তাকে এখানে রেখে গেল কেন? একটা প্রচন্ড অভিমান দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল সুসানের গলা দিয়ে। কান্না চেপে রেখে ঘরে বসে ইনকা পুরোহিতের আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের আবছা আলোও মুছে গেল। গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে নিল ঘরটা। এরপর ধীরে ধীরে দু-একটা করে মশালের আলো জ্বলে উঠতে শুরু করছে চত্বরে, শোনা যেতে লাগল, রক্ষীদের হাঁকডাক, নানারকম শব্দ। অন্ধকার নামার সাথে সাথেই আবার জেগে উঠছে মৃত নগরী। অন্ধকার ঘরে বসে খোলা দরজা দিয়ে সুসান দেখতে লাগল, মশালের আলোতে ক্রমশই আলোকিত হয়ে উঠছে চত্বর। রক্ষীর দল ভিড় করতে শুরু করেছে সেখানে। চত্বরে রক্ষীদের উপস্থিতি, ব্যস্ততা ক্রমশ বেড়েই চলল। তার পর মন্দিরের দিক থেকে গম্ভীর স্বরে ঢাক বাজতে লাগল। বিরামহীন সেই শব্দ। অন্ধকার ঘরে বসে সুসান শুনতে লাগল সেই আওয়াজ। সময় ক্রমশ এগিয়ে চলল। কিন্তু ইনকা পুরোহিতের দেখা নেই।
ঘণ্টাখানেক পরে অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়াল সুসান। সে একবার ভাবল, ঘর ছেড়ে সে চত্বরে নামে। তার পরক্ষণেই সুসানের মনে হল, একলা বাইরে বেরলে যদি তার কোনও বিপদ হয়! এই ভেবে সে বাইরে না গিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বিরাট বড়ো রূপালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার আলোতে বিধৌত নেড়া পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো। অনেক দূর পর্যন্ত চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুসান মাথা ঝুঁকিয়ে তাকাল নীচের দিকে। একটা অদ্ভুত জিনিস এবার তার চোখে পড়ল। অনেক অনেক নীচে পাহাড়ের পাদদেশে জোনাকির মতো অসংখ্য বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে। সুসান বেশ কয়েকমূহূর্ত সে দিকে তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারল, ওগুলো আসলে মশালের আলো, এত ওপর থেকে দেখছে বলে তাদের জোনাকি মতো মনে হচ্ছে! আরও ভালো করে দেখার পর সুসানের মনে হল, যেন সেই জোনাকির আলো পাকদন্ডী বেয়ে ধীরে ধীরে নগরীর দিকে এগোচ্ছে! ওরা কারা তা বুঝতে পারল না সুসান। হয়তো তারা নগরীরই রক্ষী হবে। মনে মনে ভাবল সুসান। সে দেখতে লাগল সেই জোনাকির ঝাঁক।
হঠাৎ দরজার বাইরে কাদের পায়ের শব্দ শুনে সুসান ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, ইনকা পুরোহিত, আর সেই দুজন লোক এসে উপস্থিত হয়েছে, যারা বাঘটাকে বেঁধে রেখে গেছিল। বাঘটা না দেখতে পেয়ে তারা একটু আশ্চর্য হয়ে ইনকা পুরোহিতকে কী যেন বলল! তিনি একবার ঘাড় নাড়লেন, তারপর ইশারায় সুসানকে বাইরে আসতে বললেন। সুসান ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসার পর তিনি সুসানকে নিয়ে চত্ত্বরের মাঝখান দিয়ে এগোলেন মন্দিরের দিকে।
পুরো চত্বরটাই আজ মশালের আলোয় আলোকিত। অনেক অনেক মশাল আর রক্ষী রয়েছে চত্বর জুড়ে। রক্ষীরা আজ পুরোদস্তুর যুদ্ধ সাজে সেজেছে। কাঁধে ধনুক, চামড়ার ফিতে বাঁধা তূণীর, হাতে বর্শা। কোমর থেকে ঝুলছে লম্বা দা-এর মতো অস্ত্র। তাদের দীর্ঘ কালো বেণী বুকের দুপাশ বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। প্রত্যেকের কপালে বাঁধা লাল রঙের ফেট্টি। ভাবলেশহীন ইস্পাত কঠিন মুখ। কারও কারও হাতে শিকলে বাঁধা কালো বাঘ। প্রাণীগুলো মাঝে মাঝে লাল জিভ বার করে ঠোঁট চাটছে। যেন তার প্রভুর নির্দেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কারও ঘাড়ে! পাহাড়ের খাঁজে খাঁজেও আজ দাঁড়িয়ে আছে মশাল হাতে তিরন্দাজরা। ওপর থেকে সতর্ক চোখে তারা নজর রাখছে চত্বরের ওপর। রক্ষীদের নজর এড়িয়ে স্বয়ং মৃত্যুদেবতা বিচামাও এই মৃত্যু নগরীতে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ইনকা পুরোহিত ইল্লাপাও আজ নতুন পোশাকে সেজেছেন। তার পরনে ধবধবে সাদা রঙের পশমের পোশাক। তার গলায়, হাতে রঙিন সুতোর কাজ। চওড়া সোনার কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে সোনালি খাপে ঢাকা দীর্ঘ টুমি। মাথায় বিশাল ঝালরের মতো লাল পালকের বিরাট সাজ। কানে স্বর্ণকুন্ডল। ইনকা পুরোহিত আগে আগে, তার পিছনে কয়েক হাত তফাতে চলল সুসান। আর তার পিছনে সেই দুজন রক্ষী। সুসানরা তখন চত্বরের মাঝখানে ইনতিহুয়ানাতাগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে। অনেক রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। চলতে চলতে হঠাৎ একটা সাদা ছোট্ট গোলাকার বস্তু তার সামনেই মাটিতে পড়ে আছে দেখল সুসান। জিনিসটা কুড়িয়ে দেখার পরই সুসান ভয় পেয়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিল। মাটিতে কিছুটা গড়িয়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল হুইকোর পাথরের চোখটা। আর এর পরই সে তাকাল ইনতিহুয়ানাতাগুলোর দিকে। পরপর চারটে স্তম্ভে বাঁধা আছে চারজন লোক। তাদের মাথাগুলো বুকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সারা বুক লাল। নিঃস্পন্দভাবে ইনতিহুয়ানাতা স্তম্ভের সাথে শিকল বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তারা। তাদের মধ্যে তিন জন অর্ধউলঙ্গ, চতুর্থ জনের পরনে পোশাক আর মাথায় একটা টুপিও আছে। রক্ষীদের ভিড়ের ফাঁক দিয়ে মুহূর্তের জন্য সেই টুপিটা যেন চেনা মনে হল সুসানের। ও টুপিটা হুইকো বলে লোকটার!
ইনতিহুয়ানাতাগুলো পার হয়ে ইনকা পুরোহিত সুসানকে নিয়ে উপস্থিত হলেন বিচামা মুর্তির সামনে। তার চারপাশে অনেক লোকজন। এক কোণে ঢাক বাজছে। বিচামা পুরোহিতও দাঁড়িয়ে সেখানে। মশালের আলোতে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কালো পাথরের তৈরি মূর্তিটাকে। অস্ত্রধারী, অদ্ভুত মুখমন্ডলের মূর্তির জেড পাথরের চোখ দুটো যেন জ্বলছে! সত্যিই এ মূর্তি যেন মৃত্যুর প্রতিরূপ! তাঁকে দেখে ভয় লাগল সুসানের। মূর্তির পাথরের বেদিমূলে কৃষ্ণবর্ণের কিছু বুনো ফুল ছড়ানো। আর রয়েছে একটা পাথরের থালা ও তারপাশে শোয়ানো একটা বেশ লম্বা খাপ খোলা টুমি। থালাটা লাল রঙের তরলে পরিপূর্ণ, টুমিতেও লেগে আছে সেই রং। একটা আঁশটে গন্ধ বাতাসে ভাসছে।
সুসান সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই বিচামা মূর্তি আর তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। জোরে জোরে বাজতে শুরু করল ঢাক। বিচামা পুরোহিত সুসান আর মুর্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুসানের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে শুরু করলেন। প্রথমে ধীর গতিতে, তারপর ক্রমশ বাড়তে লাগল তার গলার শব্দ। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল কান ফাটানো ঢাকের বাজনা। দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীদল পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে সুসানের দিকে। বিচামা পুরোহিতের কন্ঠস্বর আর ঢাকের শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই এক সাথে থেমে গেল বিচামা পুরোহিতের গলা আর ঢাকের বাদ্যি। বিচামা পুরোহিত নতজানু হয়ে কয়েক মুহূর্ত মাথা ঝুকিয়ে বসলেন সুসানের সামনে, তারপর উঠে গিয়ে লাল রঙের তরলপূর্ণ পাথরের থালাটা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তার কাছে। থালাটা কাছে আনতেই লাল তরলের তীব্র আঁশটে গন্ধে গাটা গুলিয়ে উঠল সুসানের। ইনকা পুরোহিত এবার ওই তরলে আঙুল চুবিয়ে সুসানের ললাটে পরিয়ে দিলেন রক্ত টিকা। বিচামা পুরোহিত থালাটা নামিয়ে মূর্তির কাছে গিয়ে তার মুখগহ্বরের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বার করে আনলেন দুটো পাখির পালক। লাল, কালো, সাদা ডোরা আঁকা তাতে। পালক দুটো এনে তিনি গুঁজে দিলেন সুসানের মাথার লান্টুতে। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘পাঁচাকুটি ইনকা ইপানকুই! পাঁচাকুটি ইনকা ইপানকুই!! পাঁচাকুটি ইনকা ইপানকুই!!!’ আবার জোরে জোরে বেজে উঠল ঢাক। মুহূর্তের জন্য সুসানের মনে হল তার পায়ের নীচের মাটিটা যেন হঠাৎ কেঁপে উঠল!
রক্ষীদল এরপর বিচামা মুর্তির কাছ থেকে মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত মশাল হাতে দু-পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের মাঝখান দিয়ে ইল্লাপা সুসানকে নিয়ে এগিয়ে চললেন মন্দিরের সিঁড়ির দিকে। বিচামা পুরোহিত আর তিনজন রক্ষীও তাদের পিছনে চলল। দুজন ভয়ঙ্কর দর্শন রক্ষী চামড়ার ফিতেয় বাঁধা বাঘ হাতে দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মুখটাতে। তাদের ভ্রূক্ষেপ না করে ইনকা পুরোহিত দৃপ্ত ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন মন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে। বিচামা পুরোহিত আর রক্ষী তিনজনও উঠল সেখানে। নীচে থেকে নিষ্পলক চোখে সুসানদের দিকে তাকিয়ে আছে সমবেত জনতা। বাঘ দুটোও ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখছে বেদির ওপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুসানদের। সম্ভবত তারাও বিস্মিত। কোনো জ্যান্ত মানুষকে ওই দরজার সামনে পৌছঁতে দেখেনি তারা!
বিশাল দরজাতে কোনো খিল নেই। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বন্ধ দরজার কপাট। ইনকা পুরোহিতের নির্দেশে রক্ষী তিনজন ধাক্কা দিয়ে কপাট খোলার চেষ্টা করতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর দুই পুরোহিতকেও তাদের কাজে সঙ্গী হতে হল। সমবেত চেষ্টাতে এক সময় দরজার কপাট কিছুটা ফাঁক হল। সুসান দেখল দরজার ওপাশে বিরাজ করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার! ইনকা পুরোহিত একটা মশাল হাতে সুসানকে নিয়ে দরজার ফাঁক গলে প্রবেশ করলেন মৃত্যু মন্দিরের গহ্বরে। বিচামা পুরোহিত আর অন্যরা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করলেন দরজার ফাঁকটুকু।
মন্দিরের ভিতরটা আসলে একটা গুহা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ গুহামুখ বন্ধ। পুরু ধুলোর আস্তরণ জমেছে মাটিতে। বাতাস ভারী। ভিতরে ঢুকে সুসানের যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। মশালের আলোতে সুসান দেখল একটা রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। মাকড়সা জাল বুনেছে সেই প্রবেশ মুখে। ইল্লাপা পুরু ধুলোর আস্তরণ মাড়িয়ে সুসানকে নিয়ে প্রবেশ করলেন সেই রাস্তাতে। রাস্তা মানে সুড়ঙ্গ। দু-পাশে পাথরের দেওয়াল। নীচু ছাদ। এঁকে বেঁকে পথ এগিয়েছে সামনের দিকে। নির্বাক ইল্লাপার সাথে সুসান চলল সুড়ঙ্গ ধরে। মাঝ মাঝে ছোটোছোটো ঘরের মতো জায়গা, সেখান থেকে নানা গুহামুখ বেরিয়েছে। সে সব ঘর অতিক্রম করে এগিয়ে চলল তারা। মশালের আলোতে মাঝে মাঝে সুসানের চোখে পড়ছে পাথর খোদিত বিভৎস সব মূর্তি, নানা রকম সব হুয়াকা! চলতে চলতে একসময় একটা সুড়ঙ্গে কীসে যেন ঠোক্কর খেলেন ইল্লাপা। মৃদু ধাতব শব্দ হল। মশালটা নীচু করে তিনি দেখলেন নানা রকম ছোটো বড়ো ধুলোমাখা পাত্র মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। একটা ছোটো পাত্র তিনি হাতে তুলে মশালের কাছে ধরলেন। মন্দিরের পূজা সামগ্রী হবে হয়তো। মশালের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল পাত্রর কানাটা। সোনার তৈরি!! পাত্রটাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার এগোলেন তিনি। এরপর আরও কয়েকটা জায়গাতে এ রকম পাত্র মেঝের ধুলোতে পড়ে থাকতে দেখল সুসান। ইনকা পুরোহিত এ সবে আর ভ্রূক্ষেপ না করে সুসানকে নিয়ে এগিয়ে চললেন।
এ সুড়ঙ্গ ও সুড়ঙ্গ বেয়ে বেশ অনেকটা পথ চলার পর সুসানরা অবশেষে এসে উপস্থিত হল বিরাট হলঘরের মতো গুহাতে। জায়গাটার চারপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকটা অন্ধকার গুহামুখ। মাথার ওপর ছাদ অনেক উঁচুতে। দেওয়ালের চতুর্দিকে দেওয়ালের গায়ে ছোটো ছোটো সিঁড়ির মতো থাক বৃত্তাকারে দেওয়ালকে বেষ্টন করে উঠে গেছে ছাদের দিকে অনেক উঁচুতে। ঘরে ঢুকে মশালটা চারপাশে একবার ঘুরালেন ইনকা পুরোহিত। সুসান দেখতে পেল ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা নীচু বেদি। তার চারকোণে বসে আছে চারজন বর্শাধারী ইনকা সৈনিক আর বেদির ঠিক মাঝখানে একটা পাথরের স্তম্ভের ওপর বসানো আছে বেশ বড়ো গোলাকার একটা চাকতি আকৃতির জিনিস। এ সব কিছুই ধুলোর আবরণে ঢাকা।
সুসানরা গিয়ে দাঁড়াল বেদির সামনে। ইনকা রক্ষীরা কিন্তু তাদের দেখে উঠে দাঁড়াল না। মুর্তিগুলো পাথরের নয় ঠিকই। কিন্তু মাকড়শা জাল বুনেছে তাদের গায়ে, স্তম্ভ-চাকতিতে। যুগযুগ ধরে এই চারজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছে বেদিটাকে। সূর্য মন্দিরের যক্ষ এঁরা! সুসান দেখল একটা টিকটিকি জাতীয় প্রাণী ধুলোমাখা একজন ইনকা রক্ষীর চোখের একটা কোটর থেকে বেরিয়ে তার মুখের ওপর ঘোরাঘুরি করে চোখের অন্য কোটরে ঢুকে পড়ল। মুর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভয় করতে লাগল সুসানের। মাকড়শার জাল মেখে ইনকা পুরোহিত সুসানকে নিয়ে বেদিতে উঠলেন। তারপর স্তম্ভের সামনে গিয়ে তার খাঁজে বসানো চাকতিটার সামনে মশাল তুলে ধরলেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত তিনি ধুলোর আস্তরণ ঢাকা চাকতিটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আঙুল দিয়ে একটা ঢেরা কাটলেন চাকতির গায়ে। ধুলো সরে গিয়ে একটা লম্বা রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠল চাকতিতে। হাসি ফুটে উঠল ইনকা পুরোহিতের কঠিন মুখে। যত তিনি আঁক কাটতে লাগলেন ততই যেন আলোক ছটা ফুটে বার হতে লাগল সেখান থেকে।
এরপর সুসানের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন ইনকা পুরোহিত। মশালটা ছাদের দিকে তুলে ধরে দুর্বোধ্য ভাষাতে দেওয়ালের মাথার দিকে একটা কোণা দেখিয়ে কী যেন বললেন তিনি। সুসান প্রথমে তার কথা বুঝতে পারল না। তারপর এক সময় তার মনে হল ইনকা পুরোহিত যেন তাকে দেওয়ালের থাক বেয়ে ওই জায়গাতে উঠতে বলছেন! সে দিকে তাকিয়ে ভয় লাগলেও ইনকা পুরোহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে আরও ভয় লাগল তার। বেদি থেকে নেমে সে গিয়ে দাঁড়াল দেওয়ালের সামনে। এই থাকগুলো বেয়ে শুধু বাচ্চা ছেলেদেরই ওপরে ওঠা সম্ভব। বড়ো মানুষ ওপরে উঠতে পারবে না। ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে থাক বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। ইনকা পুরোহিত নীচে দাঁড়িয়ে তার দিকে মশাল তুলে ধরে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় অনেক ওপরে উঠে ইনকা পুরোহিতের দেখিয়ে দেওয়া জায়গাতে পৌঁছে গেল সুসান। সে জায়গাটা একটা বারান্দা মতো। মশালের আলো সেখানে পৌঁছচ্ছে না। গুহার দেওয়ালগুলো নীচ থেকে উঠে এসে সুসানের মাথার ওপর কিছু দূরে মিশেছে। অন্য দেওয়ালের থাকগুলোও এখানে কাছাকাছি। সুসান জায়গাটাতে উঠে নীচের দিকে তাকাতেই ইনকা পুরোহিত ইশারাতে কি যেন খুঁজতে বললেন তাকে। ইনকা পুরোহিতের ইঙ্গিত অনুমান করে অন্ধকারের মধ্যেই ধুলো হাতড়ে সুসান পেয়ে গেল জিনিসটা। একটা ছোটো বাক্স! সুসান ওপর থেকে বাক্সটা তুলে দেখাতেই ইনকা পুরোহিত সেটা নিয়ে তাকে নীচে নেমে আসতে বললেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই সুসানের নজর পড়ল, তার কাছেই উলটো দিকের দেওয়ালের একটা থাকে। সে দেখতে পেল থাকের অন্ধকারের ভিতর থেকে দুটো জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে!! এ নিশ্চয় বিচামা মন্দিরের ভূত!! আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সুসানের শরীর। আর একটু হলে নীচে পড়ে যাচ্ছিল সে। সুসান বাক্সটা কোনো মতে আঁকড়ে ধরে নীচের দিকে নামতে লাগল। ইনকা পুরোহিত তার দিকে লক্ষ রেখে চাকতি থেকে ধুলো সরাতে লাগলেন। সুসান যত নীচে নামতে লাগল ততই মশালের আলো চাকতিতে প্রতিফলিত হয়ে আলোকিত হয়ে উঠল গুহা।