সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – ১৪

১৪

অনেক রক্ষী রয়েছে জায়গাটাতে। তাঁদের দাঁড়িয়ে রয়েছে বিচামার মূর্তি ঘিরে। আর কিছু লোক জল দিয়ে ধোয়ামোছা করছে, চত্বর আর স্তম্ভগুলো। সম্ভবত পরদিনের ‘কাপাক সিতুওয়া’ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ইনকা পুরোহিত সুসানকে নিয়ে উপস্থিত হলেন বিচামার মূর্তির কাছে। রক্ষীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে সুসানদের সামনে এসে দাঁড়াল একজন। সে ঠিক অন্য রক্ষীদের মতো দেখতে নয়, আকারে একটু ছোটোখাটো। পরনে রক্তবর্ণের পোশাক। মাথায় সাদা রঙের পালকের সাজ, কানে স্বর্ণকুন্ডল, গলায় নানা রঙের পাথরের মালা। তার কোমরে একটা টুমি গোঁজা আছে। ইনকা পুরোহিত আর সুসান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা ইল্লাপার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলল, তার উদ্দেশ্যে ঘাড়টা একটু ঝোঁকালেন ইল্লাপা। সেই লোকটা এরপর নতজানু হয়ে বসল সুসানের কাছে। একজন রক্ষী এরপর রেশমবস্ত্রে ঢাকা একটা থালা নিয়ে এসে দাঁড়াল সেই লোকটার সামনে। তাতে রাখা আছে একটা পাখির পালক। আর ছোট্ট টুমি। লোকটা সেই পালকটা গুজে দিল সুসানের কপালের সোনার চাকতিতে, আর টুমিটা ধরিয়ে দিল তার হাতে। পিনচিও চাপা স্বরে ইনকা পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ লোকটা কে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘বিচামার পুরোহিত। এই কাল নরবলি দেবে।’

টুমিটা সুসানের হাতে দিয়ে বিড়বিড় করে তাকে কী একটা বলার পর উঠে দাঁড়াল বিচামা পুরোহিত। সুসান চারপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে পিনচিওকে বলল, ‘কই, দাদু, সুজয় আঙ্কল ওরা সব কই? ওদের তো দেখতে পাচ্ছি না!’

পিনচিও বললেন, ‘ওরা কাছেই কোথাও হয়তো আছে। তুমি ঠিক দেখতে পাবে।’

ইল্লাপা এরপর দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন বিচামা পুরোহিতের সাথে। সে ভাষার মর্ম বুঝতে পারলেন না পিনচিও বা হুইকো। দীর্ঘ সময় ধরে দুই পুরোহিতের মধ্যে কথা চলতে লাগল। লাল পোশাকের পুরোহিত কথা বলতে বলতে মাঝেমাঝেই তাকাতে লাগল, সুসান, পিনচিও আর হুইকোর দিকে। সুসানের চোখ খুঁজতে লাগল মার্কেজদের।

কিছুক্ষণ পর সুসান দেখল, কয়েকজন লোককে একদল রক্ষী একটা গুহা থেকে বার করে ধাক্কা দিতে দিতে তাদের দিকে নিয়ে আসতে লাগল। রক্ষীরা তাদের এনে দাঁড় করাল দুই পুরোহিতের সামনে। দঁড়ি বাধা লোকগুলোও অসভ্য জাতির। তিনজন লোক। পরনে নামমাত্র পোশাক। উলঙ্গই বলা চলে! সর্বাঙ্গে উল্কি আঁকা। পুরোহিতদের সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল অসভ্য তিনজন। যেন প্রবল মৃত্যুভয় গ্রাস করেছে তাদেরকে। দুই পুরোহিত সেই লোক তিনজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, আর সম্ভবত তাদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগল। ইল্লাপার লোকগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর তাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। সম্ভবত পুরোহিতদের দেখানোর জন্যই তাদের নিয়ে এসেছিল রক্ষীরা।

বন্দিরের নিয়ে তারা চলে যাবার পর লাল পোশাকের পুরোহিত আর ইল্লাপা সুসানদের নিয়ে এগোলেন চত্বরের অন্য প্রান্তে। সার সার পাথুরে ঘর দাঁড়িয়ে আছে সে দিকে। তাদের সাথে চলল একদল আমাজনীয় রক্ষী। সুসানের মনে হল, তারা যেন সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘরগুলোর দিকে এগোতে এগোতে পিনচিও, ইল্লাপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে তিনজনকে রক্ষীরা বেঁধে আনল তারা কারা?’

ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘ওরা মোচে উপজাতি গোষ্ঠীর অসভ্য। যারা আমাদের তাঁবু আক্রমণ করেছিল, সেই গোষ্ঠীর লোক। জঙ্গল থেকে কয়েক দিন আগে ওদের ধরে আনা হয়েছে কাপাক সিতুওয়া অনুষ্ঠানের জন্য।’

পিনচিও শুনে বললেন, ‘তার মানে ওই তিনজনকেই…!!!’

গম্ভীর ভাবে ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘হ্যাঁ, ওদের তিনজনকেই উৎসর্গ করা হবে দেবতার উদ্দেশ্যে।’’

বিচামা পুরোহিত সবাইকে এনে তুললেন চত্বরের একপাশে একটা ঘরের মধ্যে। মশাল জ্বলছে ঘরে। মাটিতে ঘাসে বোনা মাদুর পাতা। তাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে ইনকা পুরোহিতের সাথে কয়েকটা কথা বলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন লাল পোশাকের পুরোহিত। সকলে বসল মাদুরে। ইল্লাপা তার কাঁধের থেকে কনডোরের বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে পিনচিওর মুখোমুখি বসলেন।

পিনচিও ইনকা পুরোহিতকে বললেন, ‘ওই পুরোহিতের সাথে কথা বলে কী বুঝলেন? পরিকল্পনা মতো কাজ হবে তো?’

ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘দেখা যাক কী হয়। মন্দিরের ভিতরে কিন্তু আমি আর এই বাচ্চাটা ছাড়া কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেবে না এরা। এমনকী বিচামা পুরোহিতকেও আমাজনীয় রক্ষীরা কোনোদিন প্রবেশ করতে দেয়নি মন্দিরের ভিতর। কারণ ও মন্দির এখন বিচামা নয়, সূর্যদেবের আবাসস্থল।

ইল্লাপার কথা শুনে পিনচিও বললেন, ‘তাহলে আমরা কোথায় থাকব? আপনিতো আর ওই দরজা দিয়ে বাইরে আসবেন না!’

ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘একটু পরে রক্ষীরা এসে আমাদের এক জায়গাতে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে এ সব কথাবার্তা হবে। বাচ্চাটাকে কিন্তু কাল সন্ধ্যা নামার আগে পর্যন্ত একলা এ ঘরেই থাকতে হবে। দিনের বেলা আমরা কেউ বাইরে বের হতে পারব না। সন্ধ্যাবেলায় আমি ওকে নিতে আসব মন্দিরে নিয়ে যাবার জন্য। ও যেন আমার নির্দেশ মেনে চলে সে ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সম্ভবত মন্দিরের ভিতর ঢোকার আগে তোমাদের সাথে ওর আর দেখা হবে না।’ ইনকা পুরোহিত আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, সুসান বুঝতে পারছিল না তাদের কথাবার্তা, তাদের কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘আমার দাদু কোথায়? তার কাছে আমাকে কখন নিয়ে যাবে?’

সুসানের কথা শুনে থেমে গেলেন ইনকা পুরোহিত। পিনচিও একবার তাকালেন পুরোহিতের দিকে, তারপর সুসানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই কথাইতো আমরা আলোচনা করছিলাম। এখানে এসে শুনলাম তোমার দাদু এখান থেকে একটা অন্য জায়গাতে গেছেন। আমাদের এখানে একটা কাজ আছে। সে কাজ না করে আমরা তোমাকে তোমার দাদুর কাছে নিয়ে যেতে পারব না। যদি তুমি সে কাজে আমাদের সাহায্য করো তাহলে আমরা তোমাকে তোমার দাদুর কাছে পৌঁছে দেব।’

সুসান জিজ্ঞেস করল, ‘কী কাজ?’

পিনচিও বললেন, ‘কাজটা খুব সামান্য। এখানে একটা মন্দির আছে, সেটা নিশ্চই তুমি দেখেছো? কাল রাতে ইনকা পুরোহিত তোমাকে সেই মন্দিরের ভিতর নিয়ে যাবেন। তারপর তিনি তোমাকে যা যা করতে বলবেন, সে কাজগুলো তুমি করে দিলেই আমাদের কাজ মিটে যাবে। আর তারপরই তোমার দাদুর কাছে পৌঁছে যাবে তুমি।’ এই বলে হাসলেন পিনচিও।

হুইকোও হেসে সুসানকে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই! তারপরই তুমি পৌঁছে যেতে পারবে সেখানে!’

সুসান বলল, ‘এখন সেই মন্দিরে যাওয়া যায় না? তাহলে তো আজই আমি দাদুর কাছে যেতে পারি!’

পিনচিও বললেন, ‘তাহলে তো আমাদেরও ভালো হত। কিন্তু এখানকার লোকগুলো আজ সেখানে তোমাদের ঢুকতে দেবে না। কাল সারাদিন তুমি এই ঘরের মধ্যে থাকবে। তারপর অন্ধকার হলে ইনকা পুরোহিত এসে তোমাকে মন্দিরে নিয়ে যাবেন।’

সুসান কিছু বলল না, সে উঠে গিয়ে ঘরের জানলার সামনে দাঁড়াল। ঘরটা একদম খাদের কিনারে। বাইরে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। অনেক নীচ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই আলোতে। সে দিকে তাকিয়ে সুসান তার দাদুর কথা ভাবতে লাগল। ইনকা পুরোহিত, পিনচিও আর হুইকো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর একদল রক্ষী এসে হাজির হল ঘরের বাইরে। তাদের মধ্যে একজন ঘরের ভিতর ঢুকে মাদুরের ওপর দুটো পাত্র নামিয়ে রাখল। মশালের আলোতে পাত্র দুটো ঝলমল করে উঠল। সম্ভবত সেগুলো সোনার তৈরি। সুসানের জন্য খাবার আর জল আছে তাতে। সেগুলো নামিয়ে রেখে সেই লোকটা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। ইনকা পুরোহিত, পিনচিওকে বললেন, ‘এবার রক্ষীদের সাথে আমাদের যেতে হবে। ওরা সে জন্যই দাঁড়িয়ে আছে।’

কথাটা বলে কনডোরের বাচ্চাটাকে আবার কাঁধে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পিনচিও আর হুইকোও উঠে পড়ল।

ইনকা পুরোহিত এরপর হুইকোকে বললেন, ‘তোমার কাঁধের বন্দুকটা আমাকে দিয়ে দাও। আসলে, এই আমাজনীয় রক্ষীরা বন্দুকধারীদের সহ্য করতে পারে না। ওরা ভাবে বন্দুকধারী মানেই স্বর্ণ লুন্ঠনকারী স্পেনীয়। পিজরোর অভিযানের সময় থেকেই এ ধারণা তাদের মনে গেঁথে গেছে। ওটা তোমার সঙ্গে থাকলে বিপত্তি ঘটতে পারে।’

ইনকা পুরোহিতের কথা শুনে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুইকো রাইফেলটা তুলে দিল তাঁর হাতে।

পিনচিও এরপর সুসানকে একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, কাল দিনের বেলায় সে যেন ঘর ছেড়ে বাইরে না যায়। কারণ, এখানকার পাখিরা মানুষের মাংস খায়!

তিনি কথাগুলো বলার পর সুসানকে ঘরে একলা রেখে ইনকা পুরোহিতের সাথে হুইকোকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তারা চলে যাবার পর সুসান এগিয়ে গেল মাটিতে নামিয়ে রাখা পাত্রগুলোর কাছে। একটা পাত্রে রাখা আছে অনেকটা আধপোড়া মাংস। বেশ খিদে পেয়েছিল তার। কয়েকটা বড়ো মাংসের টুকরো আর জল খেয়ে মাদুরের ওপর শুয়ে পড়ল সে। শুয়ে শুয়ে খোলা জানলা দিয়ে চাঁদটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল সে। কী বিরাট বড়ো রুপোর থালার মতো চাঁদ। সেই চাঁদ যেন কাঁদছে নিঃসঙ্গ সুসানের দিকে তাকিয়ে। প্রাচীন ইনকাদের বিশ্বাস ছিল চাঁদের অশ্রু পৃথিবীতে ঝরে পড়ে জমাট বেঁধে তৈরি হয় রুপো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে দাদুর কাছে শোনা গল্পটা সুসানের মনে পড়ে গেল। ‘সত্যিই ব্যাপারটা কি তাই?’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর দরজার বাইরে পায়ের শব্দ পেয়ে আবার উঠে বসল সুসান। দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন রক্ষী। তাদের একজনের হাতে শিকলে বাঁধা বিরাট বড়ো একটা কালো বাঘ। বেশ ভয় পেয়ে গেল সুসান। ওরা সঙ্গে এই প্রাণীটাকে এনেছে কেন?

সুসান তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। লোক দুজন দরজার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে সুসানের উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে কী যেন বলতে লাগল! সুসান তাদের কথার মধ্যে একটা শব্দই শুধু বুঝতে পারল,—‘ইনকা’।

বেশ কিছুক্ষণ একটানা কথা বলার পর লোকদুটো প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর দরজার বাইরে একটা পাথরের থামে বাঘের শিকলটা বেঁধে দিয়ে চলে গেল।

তারা চলে যাবার পর বাঘটা এগিয়ে এল ঘরের দরজার দিকে। ভয় পেয়ে গেল সুসান। ও যে ঘরে ঢুকতে চাচ্ছে! টুমিটা শক্ত করে হাতে চেপে ধরল সুসান। বাঘটা ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই তার গলার শিকলে টান পড়ল। ঘরের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে সুসানের দিকে তাকিয়ে গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় শব্দ করল সে, তারপর ঠিক দরজার বাইরে থাবার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।

ঘরের ভিতর মশালের আলো নিভে গেল একটু পরেই। জানলা দিয়ে আবছা চাঁদের আলো ভেসে আসছে ঘরে। বাঘটাকে আর ভালো করে চোখে পড়ছে না সুসানের। অন্ধকারের মধ্যে যেন সে মিশে গেছে। দরজার ঠিক সোজাসুজি বসে আছে সুসান। দূরে চত্বরটার একটা অংশ সুসান দেখতে পাচ্ছে ঘরের ভিতর থেকে। মশাল হাতে রক্ষীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। নানা রকম অস্পষ্ট শব্দও ভেসে আসছে। সারা রাত ধরেই মনে হয় এ নগরীর লোকেরা কাজ করে। বসে থাকতে থাকতে এক সময় নিজের অজান্তেই সুসান মাদুরের ওপর ঘুমে ঢলে পড়ল।

রাত তখনও শেষ হয়নি। আবার সুসানের ঘুম ভেঙে গেল। সুসান দেখল তার মুখের ওপর মশাল হাতে ঝুঁকে পড়েছেন ইনকা পুরোহিত। তার পাশে লাল পোশাক পরা বিচামা পুরোহিতও আছে। সুসান উঠে বসতেই ইনকা পুরোহিত তাকে ইশারায় বললেন তাকে তাদের সাথে বাইরে যেতে হবে। তাহলে কি তিনি এখনই সেই মন্দিরে যাবেন? ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ইনকা পুরোহিতের পিছন পিছন পা বাড়ল দরজার দিকে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে শিকল বাঁধা বিরাট বাঘটা হঠাৎই ইনকা পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে গজরাতে শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ইনকা পুরোহিত বিচামা পুরোহিতের দিকে তাকালেন। বিচামা পুরোহিত একটু তাচ্ছিল্যের ঢঙে হেসে ওই ভয়ঙ্কর প্রাণীটাকে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিল। অতবড়ো হিংস্র প্রাণীটা ঠিক যেন পোষা কুকুর! এর পর সে তার ভাষায় ইল্লাপাকে বলল, ‘আপনার কাঁধের পাখিটাকে দেখে ও এমন করছে। কনডোর আর এই বড়ো বিড়ালগুলো চিরশত্রু। এখানে মাঝেমাঝেই প্রচন্ড লড়াই হয় এদের মধ্যে।’ সুসান বিচামা পুরোহিতের কথা বুঝতে পারল না। শুধু ইনকা পুরোহিতের পিছন পিছন ঘরের বাইরে পা রাখার সময় ভয়ে ভয়ে বাঘটার দিকে তাকিয়ে দেখল, কালো প্রাণীটা যেন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইল্লাপার কাঁধে বসা পাখিটার দিকে। আর পাখিটাও ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে তাকে।

ইনকা পুরোহিত কিন্তু সুসানকে মন্দিরে নিয়ে গেলেন না। তাকে নিয়ে যাওয়া হল চত্বরের মাঝখানে এক জায়গাতে। সেখানে মশালের আলোতে দাঁড়িয়েছিল বেশ কয়েকজন লোক। তারা ঠিক সৈনিক নয়। রেশম বস্ত্রে আচ্ছাদিত কয়েকটা থালা ধরা আছে তাদের হাতে। বেশ কয়েকটা কাঠের বালতিতে জলও রাখা আছে সেখানে। ইনকা পুরোহিত সেখানে সুসানকে নিয়ে গিয়ে তার শিরোবস্ত্র, চাকতি সহ সেই কাপড়ের ফেট্টিটা মাথা থেকে খুলে নিলেন, তারপর তাঁকে স্নান করতে বললেন, ইচ্ছা না থাকলেও ভয়ে ভয়ে স্নান সেরে নিল সুসান। লোকগুলোর হাতে থালাতে রাখা ছিল তার পোশাক। একজন লোক তাকে সেই পোশাক পরিয়ে দিল। সে পোশাকের রংও লাল, তবে আরও উজ্জ্বল। সবশেষে তার মাথায় বেঁধে দেওয়া হল সোনার সুতোয় বোনা একটা জমকালো শিরোবস্ত্র বা লান্টু। ইনকা পুরোহিত সেই সোনার চাকতিটা আগের লান্টু থেকে খুলে নিয়ে সেটা লাগিয়ে দিলেন নতুনটাতে। এরপর তিনি সুসানকে ফিরিয়ে নিয়ে চললেন ঘরের দিকে। বিচামা পুরোহিত, আর দুজন রক্ষীও চলল তাদের সাথে। সে দুজনই বাঘটাকে বেঁধে গিয়েছিল সুসানের ঘরের সামনে। সম্ভবত তারা চলল বাঘটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। সুসান দেখল পুব আকাশে শুকতারা ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

সুসানরা ঘরের কাছে পৌঁছতেই বাঘটা তাদের দেখে উঠে দাঁড়াল। তার নাকের ডগা দিয়েই ইনকা পুরোহিতের সাথে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। বিচামা পুরোহিত আর রক্ষীরা রইল ঘরের বাইরে। তাদের মধ্যে একজন রক্ষী এগিয়ে গেল পাথরের থেকে বাঘের শিকলটা খোলার জন্য। ইনকা পুরোহিত যখন সুসানকে ঘরে ঢুকিয়ে আবার ঘরের বাইরে পা রাখলেন ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত কান্ড হল! কালো প্রাণীটা দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশেই। ইনকা পুরোহিত তার দিকে পিছন ফিরে এক পা এগোতেই প্রাণীটা হঠাৎ দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কামড়ে ধরল পুরোহিতের পিঠের কাছে ঝুলতে থাকা কনডোরের লেজটা। কর্কশ চিৎকার করে পাখিটা লাফিয়ে উঠল, কিন্তু তার লেজটা রয়ে গেল বাঘটার মুখে। এক রাশ পালক উড়ল বাতাসে। লেজহীন পাখিটা চিৎকার করতে করতে পাক খেতে লাগল ইল্লাপার মাথার ওপর। তার চিৎকার শুনে জেগে উঠল নগরীর ঘরবাড়ি মন্দিরের ছাদে, পাহাড়ের কোটরে থাকা তার জাত ভাইরা। কর্কশ চিৎকারে শেষ রাতের আকাশ তারা বিদীর্ণ করে ফেলল। তাঁর আদরের পাখিটার দুর্দশা দেখে খেপে উঠলেন ইল্লাপা। যে লোকটা শিকল খুলছিল সে ব্যাপারটা দেখে শিকল না খুলেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার কোমরে ঝুলছিল একটা চামড়ার চাবুক। ডগায় ধাতুর টুকরো বাঁধা। সম্ভবত ওই দিয়েই এই কালো প্রাণীগুলোকে বশে রাখা হয়। ইনকা পুরোহিত রক্ষীর কাছে ছুটে গিয়ে তার কোমর থেকে চাবুকটা খুলে নিলেন, তারপর বাঘটার কাছে ফিরে প্রচন্ড জোরে চাবুক চালাতে লাগলেন প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। চাবুকের প্রথম আঘাতে আর্তনাদ করে কুঁকড়ে গেল অত বড়ো প্রাণীটা। কিন্তু থামলেন না ইনকা পুরোহিত। তিনি যেন পাগল হয়ে গেছেন। বাতাস কেটে চাবুকটা এসে পড়তে লাগল প্রাণীটার গায়ে। বিস্ফারিত সুসান দেখল প্রাণীটার কালো অঙ্গ লাল হয়ে যেতে শুরু করেছে। বাঘের আর্তনাদে আর কনডোর পাখিদের কর্কশ চিৎকারে নগরীর নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যেতে লাগল! বিচামা পুরোহিত আর রক্ষী দুজন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ইনকা পুরোহিত যে ভাবে চাবুক চালাচ্ছেন তাতে তাঁর দিকে এগোতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। এরপর বাঘটা শুয়ে পড়ে গোঙাতে শুরু করল। তারপর ধীরে ধীরে এক সময় সেই শব্দটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে প্রাণীটার আর সাড়া শব্দ নেই দেখে ক্ষান্ত হলেন ইল্লাপা। চাবুকটা তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বিচামা পুরোহিতকে বললেন, ‘বড় বেয়াদপতো বাঘটা! ওকে ভালো করে শিক্ষা দিতে পারেনি?’

বিচামা পুরোহিত ইল্লাপার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ও বাঘ নয় বাঘিনী। মন্দিরের সবচেয়ে শিক্ষিত পাহারাদার। আসলে, একটা কারণে, ও কনডোর পাখিদের ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাই এই ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলল!’

ইল্লাপা বললেন, ‘সেটা কী ব্যাপার?’

বিচামা পুরোহিত বলল, ‘সপ্তাহ দুই আগে ওর দুটো বাচ্চা হয়েছিল। বাচ্চা দেবার সময় হলে আমরা ওদের ছেড়ে দেই। ওরা এখানে যে গুহাগুলো আছে তার মধ্যে ঢুকে বাচ্চা দেয়। তারপর বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটলে তাদের সেখান থেকে তুলে এনে আমরা তাদের মানুষ করি। চারদিন আগে, ওর পিছন পিছন একটা বাচ্চা কীভাবে যেন বিকালের দিকে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। কনডোরের ঝাঁক তখনও আকাশে। একটা পাখি ছোঁ মেরে ওর বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে গেল। আমরা ঘরের ভিতর থেকে ব্যাপারটা দেখলাম কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। বাইরে গেলে আমাদেরও ছিঁড়ে খেত পাখিরা। ওই ঘটনার পর সেই যে গুহায় ঢুকল বাঘিনী, দু-দিন আর বাইরে এলো না। গতকাল ওর অন্য বাচ্চার খোঁজ নিতে গুহায় ঢুকেছিল রক্ষীরা। ওর দেখা পেলেও তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বাচ্চাটার দুটোর সন্ধান মেলেনি। সম্ভবত সে বাচ্চাটাও দিনের বেলায় গুহার বাইরে বেরিয়ে ছিল, এবং তাদেরও একই পরিণতি ঘটেছে। এ ব্যাপারটা হয়তো কারও চোখে পড়েনি। সারা রাত জাগতে হয় বলে, সাধারণত আমাজনীয়রা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটায়। যাই হোক বাচ্চা না পাওয়াতে রক্ষীরা গতকাল ওকে গুহার বাইরে বার করে এনেছে। এ কারণে কনডোরের ওপর ওর এত রাগ!’

কথাগুলো বলার পর একটু চুপ করে থেকে আকাশের দিকে তাকালেন মৃত্যু নগরীর পুরোহিত। চাঁদ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা দেবে ভোরের প্রথম আলো। কিন্তু এ নগরীতে দিন হল রাতের সমার্থক। বরং রাতেই সামান্য হলেও কিছুটা প্রাণ স্পন্দন ফিরে পায় এই মৃত নগরী।

কনডোরের বাচ্চাটা আবার এসে বসল ইনকা পুরোহিতের কাঁধে। বিচামা মন্দিরের পুরোহিত তারপর করিকাঞ্চার পুরোহিতকে বলল, ‘চলুন এবার ফেরা যাক। ভোর হয়ে আসছে, কনডোরের ঝাঁক উড়তে শুরু করবে। তাছাড়া নতুন বন্দিদের একবার দেখে যাই। আমার কাজ বেড়ে গেল। সারা দিন ঘরে বসে টুমি ঘসতে হবে পাথরে।’

তার কথা শুনে, একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল ইনকা পুরোহিতের ঠোঁটের কোণে। ঘরের ভিতর সুসানের দিকে একবার তাকিয়ে তিনি জায়গাটা ছেড়ে বিচামা পুরোহিতের সাথে পা বাড়ালেন। বাঘিনীটা আর রক্ষীদের সাথে নিয়ে যাবার মতো ছিল না। প্রাণীটাকে ফেলে রেখেই রক্ষী দুজনও পুরোহিতদের পিছু নিল।

চলে গেল তারা। বাঘিনী নিঃস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে ঘরের দরজার সামনে। সুসান ব্যাপারটা দেখে বেশ ভয়ে পেয়ে গেছে। বাঘটাকে যখন ইনকা পুরোহিত মারছিলেন, তখন তাঁকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছিল সুসানের। ইনকা পুরোহিত যেন একটা দানব! অত বড়ো বাঘটাকে তিনি একদম চুপ করিয়ে দিলেন!

বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। ইনকা পুরোহিতরা চলে যাবার পর ঘরের কোণায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল সুসান। তারপর আবার সে ঘুমিয়ে পড়ল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *