সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – ১৩

১৩

ঘুম ভেঙে পাশ ফিরে, তার দাদু, সুজয় বা বিল কাউকে দেখতে পেল না সুসান। কিন্তু সবাইতো তার পাশেই শুয়েছিল! উঠে বসতে গেল সে। কিন্তু পারল না। মাথাটা বড্ড ভার লাগছে! সে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। সুসান মনে মনে ভাবল, ‘তাহলে কি ভোর হয়ে গেল! সবাই কি তাকে ঘরে রেখে বাইরে বেড়াতে চলে গেল! কিন্তু তাতো হবার কথা নয়, নিশ্চই তারা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সুসান কান খাড়া করল। হ্যাঁ, ওইতো! অস্পষ্ট কথার শব্দ যেন বাইরে শোনা যাচ্ছে! নিশ্চই তাহলে তারা!

দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় সুসান উঠে বসল। কিন্তু এটাতো সেই ঘর নয়, এটা তো একটা তাঁবু! এখানেই কি তাহলে রাতে শুয়ে ছিল? সুসানের মাথাটা গুলিয়ে গেল। বাইরে থেকে একটা আলো এসে ঢুকছে তাঁবুতে। কিন্তু তা যেন কেমন ম্যাড়মেড়ে, বিষণ্ণ। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর সুসান ধীরে ধীরে উঠে তাঁবুর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে তাকাতেই সুসান অবাক হয়ে গেল, আরে, বাইরেতো বিকেল! একটা জঙ্গলের মধ্যে তারা রয়েছে! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার পর সুসান দেখল, কিছু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মিস্টার পিনচিও আর ইনকা পুরোহিত। সুসান ভালো করে বাইরে চারপাশে তাকিয়েও সুজয়দের কাউকে না দেখতে পেয়ে পিনচিওর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘আঙ্কেল, আমার দাদুরা কই?’

তার গলা শুনে তাঁরা দুজন কথা বন্ধ করে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন সুসানের সামনে। পিনচিও হাসি মুখে জানতে চাইলেন, ‘কি ব্রেভ বয়, তোমার ঘুম কেমন হল?

সুসান বলল, ‘ভালো। আমার দাদু, সুজয় আঙ্কল, এরা কোথায়?’

ইনকা পুরোহিতের সাথে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে নিয়ে পিনচিও সুসানকে বললেন, ‘তাঁরা সব চলে গেছেন।’

‘কোথায়?’ বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল সুসান।

পিনচিও বললেন, ‘তোমার দাদুর যে শহর দেখতে যাবার কথা সেখানে। তিনি আগে গেছেন, আমরা কাল সকালে যাব।’

সুসান অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু আমরাতো একটা শহরে গেছিলাম! রাতে সেখানে একটা ঘরে শুয়েছিলাম, সে শহরটা কোথায় গেল?’

পিনচিও অবাক হবার ভান করে প্রথমে বললেন, ‘কই না তো! আমরাতো কোনো শহরে যাইনি! এরপর তিনি হেসে ফেলে বললেন, ‘ও বুঝেছি, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছ!’

সুসান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল, ‘সেই যে একটা পুরনো শহরে তারা গেল, সেখানে কুইলো বলে একটা লোক তার প্রাসাদে সবাইকে নিমন্ত্রণ করল! ইনকা পুরোহিত তাকে কোথায় নিয়ে যাবার কথা বললেন! তারপর সেখান থেকে ফিরে গিয়ে পাথরের ঘরটাতে সবাই মিলে এক সাথে শুয়ে পড়ল,—এ সবই কি তাহলে স্বপ্ন!’

কিন্তু তার দাদু তাকে এখানে রেখে গেল কেন? সুজয় আঙ্কল, বিল আঙ্কল, তারাও তো নেই! ব্যাপারটা চিন্তা করে দাদুর ওপর অভিমানে কান্না পেয়ে গেল তার। সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আমাকে ওরা সঙ্গে নিল না কেন?’

ইতিমধ্যে হুইকোও এসে দাঁড়াল সেখানে। তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পিনচিও বললেন, ‘চলতে চলতে এক জায়গাতে থেমেছিলাম আমরা। সেখানে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে। কিছুতেই তোমার ঘুম ভাঙানো গেল না। এদিকে তোমার দাদুকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তখন আমি তাকে বললাম, ‘ও তো বড় হয়ে গেছে। আর ও তো খুব সাহসী। ঠিক টিনটিনের মতো! আপনারা এগোন, ওর ঘুম ভাঙলে ওকে নিয়ে আমি পরে যাচ্ছি।’

এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘তুমিতো আমাকে বলেছিলে যে দাদুকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে, কি মনে আছে? এ কথাটাও আমি বলেছি প্রফেসর মার্কেজকে। তিনি এটাও দেখতে চেয়েছেন যে তুমি সত্যি সাহসী ছেলে কিনা? দাদুকে ছেড়ে আমাদের সাথে থাকতে পার কিনা?’

সুসান কাঁদতে গিয়েও চুপ করে গেল, পাছে এই লোকগুলো তাকে ভীতু ভাবে এই ভেবে।

পিনচিও এর পর সুসানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি ম্যাজিক দেখবে ম্যাজিক?’ ইনি খুব ভালো ম্যজিক জানেন! ‘এই বলে তিনি ইল্লাপাকে দেখালেন।

ইনকা পুরেহিতরা যে জাদুকর হয় তা তার দাদুকে বলতে শুনেছিল সুসান। কান্নাটা চাপার চেষ্টা করে, ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখব।’

পিনচিও তাকালেন ইনকা পুরোহিতের দিকে। ইনকা পুরোহিত, তার পাশে হুইকোকে কী যেন বলতেই, সে তার পাথরের চোখটা খুলে তাঁর হাতে দিল। তিনি চোখটা হাতের তালুতে নিয়ে প্রথমে মেলে ধরলেন সুসানের সামনে। তারপর মুঠিটা বন্ধ করলেন। কয়েক মুহূর্ত সে ভাবে হাতটাকে তিনি ধরে রেখে মুঠিটা ধীরে ধীরে খুলতেই সুসান দেখল তার হাতে রাখা চোখটা একদম ভ্যানিশ! এর পরই তিনি আবার সেই চোখটা সুসানের জামার পকেট থেকে বার করলেন!

অবাক হয়ে গেল সুসান। পিনচিও বললেন, ‘উনি আরও অনেক ম্যাজিক জানেন। তুমি যদি ভালো ছেলের মতো ওনার কথা শোন, তাহলে উনি আরও দেখাবেন, তোমাকে শিখিয়েও দেবেন। কিন্তু যারা ওঁর কথা শোনে না তাদের উনি কী করেন জানো? মন্ত্র পড়ে তাদের তিনি লামা বানিয়ে দেন! ‘সুসান চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘সত্যি?’

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, একদম সত্যি। যে লামাগুলো মোট বইছে, তারাওতো মানুষ ছিল, ইনকা পুরোহিতের কথা না শোনাতে তিনি তাদের লামা বানিয়ে দিয়েছেন। এখন মোট বয়ে মরছে ব্যাচারারা।’

কথাটা শোনার পর সুসান তাকিয়ে রইল ইনকা পুরোহিতের দিকে।

পিনচিও এরপর বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি এখন তাঁবুর ভিতরে থাকো। কোনো ভয় নেই, রাতে আমি তোমার সাথে শোব।’

সুসান আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল তাঁবুর ভিতর। তারপর তার দাদুর কথা, বিল আঙ্কল, সুজয় আঙ্কলের কথা ভাবতে লাগল। ঘুম ভাঙার পরইতো সকলে এক সাথে যেতে পারত। দাদুদের কি তর সইল না! আবার কান্না পেয়ে গেল তার। কিন্তু, তার কান্না শুনে ইনকা পুরোহিত যদি রেগে গিয়ে তাকে লামা বানিয়ে দেন!? সুসান এই ভেবে কান্না চেপে কম্বলে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল।

বাইরে অন্ধকার নামল এক সময়। কে যেন একটা মশাল পুঁতে দিয়ে গেল তাঁবুর বাইরে। সুসান চুপচাপ শুয়ে রইল। অন্ধকার নামার পর থেকেই একটা শব্দ অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসতে শুরু করল। ঢাকের বাজনা। দ্রিমি-দ্রিমি শব্দে বেজে চলেছে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। রাত যত বাড়তে লাগল, সেই বাজনা তত যেন কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। এক সময় উঠে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল সুসান। তাঁবুর কাছেই একটা বড় অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হয়েছে। তার পাশে গম্ভীর মুখে কী যেন আলোচনা করছেন পিনচিও, ইনকা পুরোহিত আর হুইকো। তাদের আরও একটু দূরে রান্নাবান্না করছে লামা নিয়ে আসা লোকগুলো। ঢাকের শব্দ এখন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একটানা শব্দ।

এর কিছুক্ষণ পর তাঁবুতে দুজনের খাবার নিয়ে এলেন পিনচিও। তার মুখ গম্ভীর, খেতে খেতে তিনি শুধু বললেন, ‘কাল কিন্তু খুব ভোরে উঠব আমরা। অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদের।’

সুসান বলল, ‘কালই কি আমরা দাদুদের কাছে পৌঁছে যাব?’

তিনি শুধু বললেন, ‘হুঁ।’

সুসান এরপর তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই যে শব্দ হচ্ছে, ঢাক বাজাচ্ছে কারা?’

পিনচিও এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘এখন আমরা শুয়ে পড়ব। আর রাতে তাঁবুর বাইরে যাবার দরকার হলে আমাকে ডাকবে। জঙ্গলে অনেকরকম হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে, একলা বেরোলে বিপদ হতে পারে।’

সুসান ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা’।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়া শেষ হল। সুসান শুয়ে পড়ল কম্বল মুড়ি দিয়ে। কিছু তফাতে শুলেন পিনচিও। এর পর ঢাকের শব্দ শুনতে শুনতে আর দাদু, সুজয় আঙ্কেলের কথা চিন্তা করতে করতে আবার সুসানের চোখে ঘুম নেমে এল।

মাঝ রাতে প্রচন্ড চিৎকার চ্যাঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সুসান। তাঁবুর বাইরে একটু দূরেই যেন খুব জোরে অনেকগুলো ঢাক বাজছে! আর তার সাথে মানুষের কোলাহল। বেশ কয়েক বার রাইফেলের শব্দও শোনা গেল, দুড়ুম দুম! দুড়ুম দুম! সুসান দেখল পিনচিও আঙ্কেলও উঠে বসে তাকিয়ে আছেন তাঁবুর বাইরের দিকে। তারও হাতে ধরা রাইফেল। বাইরে কী হচ্ছে সুসান বুঝতে পারল না। এর পর মুহূর্তেই দৌড়ে এসে তাঁবুতে ঢুকল, হুইকো আর ইনকা পুরোহিত। হুইকোর হাতেও ধরা আছে রাইফেল। ইনকা পুরোহিতের কাঁধে বসা পাখিটা কর্কশ স্বরে চিৎকার করছে। তাঁবুতে ঢুকেই হুইকো পিনচিওকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে চলুন, এখুনি আমাদের পালাতে হবে! অসভ্য মোচে গোষ্ঠীর জংলিরা তাঁবু আক্রমণ করেছে! আমাদের রক্ষীরা গুলি চালাচ্ছে। কিন্তু ওরা সংখ্যায় অনেক। তিন চারটে রাইফেল দিয়ে ওদের বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!’

তার কথা শোনার সাথে সাথেই পিনচিও সুসানকে নিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন। জঙ্গলের মধ্যে একটু ফাঁকা জায়গাতে তাঁবু ফেলা হয়েছিল। সুসান দেখল, দক্ষিণের জঙ্গলটা মশালের আলোয় আলোকিত। অনেক অনেক মশাল। সেই আলোতে জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ! মুখে উল্কি আঁকা, অর্ধউলঙ্গ ভূতের মতো সব মানুষ! মশালের আলোতে তাদের উদ্যত বর্শাফলক ঝলকাচ্ছে! মুখে বিভৎস চিৎকার! মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে দুজন রক্ষী রাইফেল চালাচ্ছে তাদের লক্ষ্য করে। সুসানরা বাইরে এসে দাঁড়াতেই তৃতীয় একজন লামাঅলা রক্ষী পিনচিওর হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে তাক করল জঙ্গলের দিকে। এবার জঙ্গলের ওদিক থেকেও ছুটে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে বর্শা। যে রক্ষী পিনচিওর হাত থেকে রাইফেল নিল, সে দুটোমাত্র গুলি ছুঁড়তে পারল। তার পরই একটা বর্শা এসে তার পাঁজর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল! একটা বিকট আর্তচিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা! ইনকা পুরোহিত, আর অপেক্ষা করলেন না। এক ঝটকায় তিনি সুসানকে নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন পুব দিকের জঙ্গলের দিকে। তার পিছন পিছন ছুটলেন পিনচিও আর হুইকো। তাদের তাঁবু, লামা, সব সেখানে পড়ে রইল। অন্য রক্ষী দুজনও গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছু হঠার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা বর্শার আঘাতে তারাও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। জঙ্গলের অনেক দূর পর্যন্ত সুসানরা শুনতে পেল রক্ষীদের কাটা মুন্ডু নিয়ে অসভ্য জংলিদের নারকীয় উল্লাসের শব্দ!

সুসানকে কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললেন ইনকা পুরোহিত। ক্রমে ক্রমে এক সময় পিছনে মিলিয়ে গেল জংলিদের কোলাহল, ঢাকের শব্দ। তবু থামলেন না ইনকা পুরোহিত। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে এগোতে থাকলেন তারা। তাদের এ চলার যেন বিরাম নেই। সুসানের মনে হল স্বপ্নের ঘোরে ইনকা পুরোহিতের কাঁধে চেপে যেন চলছে সে। তার পর এক সময় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। হাঁটার গতি এবার একটু শ্লথ করলেন ইল্লাপা। ভোরবেলা তারা পৌছল একটা নদীর ধারে। সেখানে পৌঁছে সুসানকে কাঁধ থেকে নামালেন ইনকা পুরোহিত। সকলে জিরিয়ে নেবার জন্য একটু বসল নদীর ধারে।

মাটিতে বসে পড়ে পিনচিও বললেন, ‘জংলিগুলো আবার আমাদের পিছু ধাওয়া করবে নাতো?’

ইনকা পুরেহিত একটু যেন চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। এমনিতে ওরা ওদের গ্রামের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে। হঠাৎ ওরা ওদের গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আমাদের আক্রমণ করল কেন তাও বুঝতে পারছি না!’

এরপর একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘যে ভাবে ওরা ঢাক আর লোকজন নিয়ে বেরিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ওরা দীর্ঘ সফরের জন্য তৈরি। হয়তো ওদের যাত্রাপথের মধ্যে পড়ে গেছিলাম আমরা। তাই ওরা আমাদের আক্রমণ করল। নইলে ওদের গ্রাম থেকে অন্তত দশ মাইল পশ্চিমে ছিল আমাদের তাঁবু।

পিনচিও আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কী মনে হয়, ওরা কোথায় যাচ্ছে?’

ইল্লাপা বললেন, ‘ঠিক বলতে পারব না। এ সব অঞ্চলে পনেরো বিশ মাইল দূরে দূরে অসভ্য উপজাতিদের ছোটো ছোটো গ্রাম আছে। তাদের নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝেই ঝগড়া ঝামেলা হয়। এ ওর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, শত্রুর মাথা কাটে। হয়তো সে রকমই কোনো অভিযানে বেরিয়েছে ওরা!’ হুইকো এবার তাঁর কাছ জানতে চাইল, ‘নিষিদ্ধ নগরীতে পৌঁছোতে আর কত সময় লাগবে আমাদের?’

ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘বিকাল নাগাদই আমরা সেখানে পৌঁছে যাব। কিন্তু যতক্ষণ না কনডোর গুলোর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে ততক্ষণ সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম নিল সুসানরা। কাদের যেন একটা ভেলা রাখা ছিল নদীর ধারে। সেটাতে চেপে নদী পার হয়ে ওপাশের জঙ্গলে পৌঁছে আবার তারা চলতে থাকল। কখনো ইনকা পুরোহিত, কখনো হুইকো সুসানকে কাঁধে নিয়ে চলল। সূর্য ক্রমশ মাথার ওপর উঠতে শুরু করল। আরও একটা বেশ বড়ো নদী পার হল তারা দুপুরের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে গাছপালা যেন কমে আসতে লাগল। পায়ের নীচে ঘাস মুছে গিয়ে পাথুরে জমি বেরিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে তাদের চোখে ভেসে উঠল ছোটো ছোটো নেড়া পাহাড়ের সারি। ইনকা পুরোহিতের ঠোঁটের কোনায় এবার হাসি ফুটে উঠল। দূরের পাহাড়গুলোর দিকে আঙুল তুলে তিনি পিনচিওকে বললেন, ‘ওই পাহাড়গুলোর মধ্যেই সেই নগরী। যার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম আমরা।’ তাঁর কথা শুনে পিনচিওর চোখ দুটোও যেন চিকচিক করে উঠল। তিনি ইল্লাপাকে কী একটা বলতে গিয়েও সুসানের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন। ক্রমশই কাছে এগিয়ে আসতে লাগল সেই পাহাড় শ্রেণি। দু-পাশের প্রকৃতিও তত রুক্ষ হয়ে উঠতে লাগল। মাঝে মাঝে শুধু ঘাস ঝোপ। সূর্যের তাপে পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে। এছাড়া অন্য কোনো গাছপালা নেই। পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হল সুসানরা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা পাহাড়। সুসানরা যে পাহাড়ের সামনে এসে উপস্থিত হল তার একটা পাহাড় পরেই আর একটা পাহাড়ের মাথাতে যেন অস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ছে প্রাকার স্তম্ভ ইত্যাদি। তার মাথার ওপর পাক খাচ্ছে কালো কালো পাখি। অনেক উঁচুতে বলে তাদের ঠিক চেনা যাচ্ছে না! ইনকা পুরোহিত সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কনডোরের ঝাঁক আকাশ থেকে নগরী পাহারা দিচ্ছে। ওখানেই যাব আমরা।’

ইনকা পুরোহিত পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চড়াই-উতরাই ভেঙে এগোলেন সেই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে ছোটো বড়ো গুহা মুখ। পিনচিও ইল্লাপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ সব গুহাগুলো কীসের?’

পুরোহিত বললেন, ‘এর ভিতর অনেক জায়গাতে ইনকাদের সমাধি আছে। ইনকা পাচাকুটির আমলে এ জায়গা ছিল সমাধি স্থল। কিছু কিছু গুহার মধ্যে দিয়ে ওই নগরীতেও পৌঁছান যায়। পাহাড়ের ওপাশে একটা নদী আছে। কিছু কিছু রাস্তা সে পর্যন্তও গেছে।’

জায়গাটা গাছপালাহীন বলে রোদের তাপ প্রচন্ড। সম্ভবত তাই পিনচিও বললেন, ‘এ রকম একটা সুড়ঙ্গ পথে আমরা নগরীতে পৌঁছতে পারি না?’

ইল্লাপা বললেন, ‘হ্যাঁ, পারি। তবে প্রাচীন সুড়ঙ্গ, নানান রকম বিপদ থাকতে পারে ভিতরে। ওপাশের নদীর থেকে অনেক সময় বড়ো মাচাকুয়ে বাসা বাঁধে সুড়ঙ্গের ভিতর। তাই ও পথ নিরাপদ নয়। চোরের মতো নগরীতে ঢুকতে হলে আমাদের গুহাপথই ধরতে হত। কিন্তু করিকাঞ্চার পুরোহিত নগরীতে প্রবেশ করবে নগরীর প্রধান তোরণ দিয়ে। আজ সাক্ষাৎ ইনকা আছেন আমার সাথে।’ এই বলে হাসলেন তিনি।

সুসান যাচ্ছিল হুইকোর কাঁধে চেপে। এতক্ষণ পর সে হঠাৎ পিনচিওকে প্রশ্ন করল, ‘আমার দাদু, সুজয় আঙ্কল, এরা তো সবাই ওখানে আগেই পৌছে গেছে তাই না?’

তার কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করল। সুসান অবাক হয়ে পিনচিওকে প্রশ্ন করল, ‘তোমরা হাসছ কেন?’

হাসি থামিয়ে পিনচিও বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এতক্ষণে তারা নিশ্চয় পৌঁছে গেছেন!’

ইনকা পুরোহিত যে পথ ধরে চললেন, মাঝে মাঝেই সে পথের ধারে পড়ে আছে লামার কঙ্কাল, হাড়গোড়। পিনচিও তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত প্রাণীর কঙ্কাল কীভাবে এখানে এল?’

ইল্লাপা বললেন, ‘বিচামার মূর্তির সামনে লামা বলি দেবার পর তাদের দেহগুলো এখানে ফেলে যাওয়া হয়। মৃত্যু দেবতা বিচামার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণীর মাংস আমাজনীয় রক্ষীরা খায় না। আর কোনো অজানা কারণে কনডোররাও ছোঁয় না এ মাংস।’

বেশ কিছুটা এগোবার পর পথের পাশে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। সুসান অবশ্য তা দেখে একটু ভয়ও পেয়ে গেল! একটা গুহা মুখের ঠিক সামনে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা নর কঙ্কাল। তার দেহে কোনো পোশাক আশাকের আজ কোনো চিহ্ন না থাকলেও লোহার নাল লাগানো চামড়ার জুতো জোড়া এখনও তার পায়ের সাথে আটকে আছে। একটা মরচে ধরা বন্দুক তার কোলে রাখা। ভঙ্গিটা এমন যে বন্ধুকটা হাতে ধরে যেন এখনই উঠে দাঁড়াবে লোকটা! ইনকা পুরোহিত কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে পিনচিওর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার মতোই এ লোকটা কোনো ভাগ্যান্বেষী ইউরোপীয় ছিল। সোনা খুঁজতে হয়তো এসেছিল এখানে। ফিরে যেতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে হাত পা ছড়িয়ে এখানেই বসে আছে!’ পিনচিওর লোভী চোখ হঠাৎ খেয়াল করল, কঙ্কালটার দাঁতগুলো যেন চকচক করছে। সে বলল, ‘ওর দাঁতগুলো দেখছি সোনার! ওঁরতো আর এখন খাবার চিবুতে হয় না। দাঁতগুলো তাহলে খুলে নেই।’ এই বলে তিনি পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন সে দিকে, কিন্তু ইনকা পুরোহিত দুর্বোধ্য ভাষায় তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘মৃত মানুষের জিনিস চুরি করলে প্রেতাত্মারা অভিশাপ দেন। আমাদের উদ্দেশ্য তাহলে পন্ড হবে।’ এই বলে এরপর আবার চলতে শুরু করলেন ইনকা পুরোহিত।

তৃতীয় পাহাড়টা যত কাছে মনে হচ্ছিল আসলে সেটা তত কাছে নয়। ঘণ্টা দু-এক পাথুরে পাকদন্ডী বেয়ে চলার পর অবশেষে সেই পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হলেন ইনকা পুরোহিত। একটা গুহার মতো জায়গাতে আশ্রয় নিল তারা। এখনও বেশ বেলা আছে। সন্ধ্যা নামতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক দেরি। পাহাড়ের মাথায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নগর প্রাকার, ঘর, বাড়ি, ইনতিহুয়াতানা, পাখিগুলোও ওড়াউড়ি করছে আকাশে। তবে প্রাকারে কোনো মানুষ চোখে পড়ছে না। ইনকা পুরোহিত, পিনচিওকে বললেন, ‘নগরীতে পাহাড়ের দেওয়াল ঘেঁষে পাথুরে ছাদঅলা বৃত্তাকার টানা বারান্দা আছে। কনডোরগুলোর জন্য রক্ষীরাও দিনের বেলা কেউ খোলা আকাশের নীচে আসে না। ওই বারান্দা দিয়েই নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া আসা করে। কনডোররা ওদেরও রেয়াত করে না। যতক্ষণ না কনডোরদের ওড়াউড়ি বন্ধ হয় ততক্ষণ ওপরে ওঠা যাবে না। এ নগরী সম্রাট পাচাকুটি বানিয়ে ছিলেন তার বিপদকালীন আশ্রয়স্থল হিসাবে। ইনকা সম্রাট, তাঁর প্রধান সেনাপতি, কুজকো সূর্যমন্দিরের পুরোহিতরা ও খিপুকামেওক অর্থাৎ সম্রাটের প্রধান হিসাবরক্ষক ছাড়া কেউ নগরীতে প্রবেশ করতে পারতেন না। ইনকা আতাহুয়ালপা যদি এখানে পালিয়ে আসতে পারতেন তাহলে বিদেশিরা তার কোনো ক্ষতি করতে পারত না।’

পিনচিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিচামার মন্দির নগরী কোথায়?’

ইল্লাপা বললেন, ‘আমরা যে রাস্তায় নগরীতে প্রবেশ করব তার বিপরীত প্রান্তে নগরীর শেষ মাথায় পাহাড় কুঁদে তৈরি সেই মন্দির। গত পাঁচশ বছর ধরে সে মন্দিরের দরজা বন্ধ। বিচামা তার ঘর ছেড়ে মন্দিরের বাইরে অবস্থান করছেন। আর ঘরের ভিতর আছেন সূর্যদেব। তাই ও মন্দিরকে সূর্যমন্দিরও বলা যায় এখন। সূর্যদেব বলতে আমি কী বলতে চাচ্ছি তা নিশ্চই বুঝতে পারছো? রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল ইল্লাফার ঠোঁটে।

পিনচিও মৃদু হেসে বললেন, ‘কালইতো বিচামার ঘর খালি হয়ে যাওয়ার কথা তাই না?’

ইনকা পুরোহিত গম্ভীরভাবে বললেন, ‘সব ঠিক থাকলে তাই হবে। কাল সন্ধ্যার পর নগরীতে ‘কাপাক সিতুওয়া’ অর্থাৎ ‘বলিদান’ অনুষ্ঠান হবে। বলির রক্তে নগরী শুদ্ধিকরণ হবে। সারা রাত ধরে সেই অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকবে সবাই।’

সুসান যাতে শুনতে না পায়, এমন ভাবে চাপাস্বরে পিনচিও জানতে চাইলেন, ‘বলি মানে, লামা না নরবলি?’

ইল্লাপা মৃদু স্বরে জবাব দিলেন, ‘নরবলি।’

‘কাদের বলি দেওয়া হবে?’ আবার জানতে চাইলেন পিনচিও।

ইনকা পুরোহিত তাঁর এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলেন পাহাড়ের মাথায় নগরীর দিকে।

গুহার ভিতরে বসে সন্ধ্যা নামার প্রতীক্ষা করতে লাগলেন ইনকা পুরোহিত। সুসান এক কোণে ঘুমিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে এক সময় সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল। আর তার সাথে সাথেই পাখির ঝাঁক হারিয়ে যেতে লাগল নগরীর আকাশ থেকে। ইনকা পুরোহিতের ইশারাতে সুসানের ঘুম ভাঙিয়ে দিল হুইকো। সে উঠে বসার পর ইনকা পুরোহিত তাঁর পোশাকের নীচ থেকে একটা থলে বার করে সেটা হুইকোকে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো বাচ্চাটাকে পরাতে হবে। তারপর নগরীর দিকে উঠব আমরা।’ থলে থেকে বার হল, লাল রঙের রেশমের তৈরি একটা ঝলমলে পোশাক, সোনালি সুতোর কাজ করা একটা চওড়া ফিতে। আর একটা ছোট্ট কাঠের পাদুকা। সেই পাদুকার ওপরও সোনালি পাত বসানো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পোশাকে সুসানকে সাজিয়ে তুলল হুইকো। ফিতেটা বেঁধে দেওয়া হল তার কপালে। সব শেষে ইল্লাপা সোনার তৈরি ব্রোচ আটকে দিলেন সুসানের কপালের ফেট্টিতে। ছটা সহ সূর্যদেবের মুখমন্ডল খোদিত আছে তাতে।

পিনচিও ইল্লাপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা লাগালেন কেন?’

ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘এটা একটা প্রাচীন জিনিস। ইনকা রাজবংশের পরিচয় জ্ঞাপক চিহ্ন। এতদিন কুজকো মন্দিরে রক্ষিত ছিল।’

সুসানকে পুরদস্তুর ইনকা পোশাকে সাজিয়ে ইনকা পুরোহিত গুহার বাইরে এসে দাড়ালেন। বাইরের আলো তখন নিভে যেতে বসেছে।

ধাপ বেয়ে পাহাড়ের ওপর নগরীর দিকে উঠতে শুরু করল সুসানরা। অন্ধকার গাঢ় হতেই বিন্দু বিন্দু মশালের আলো একটা দুটো করে জ্বলে উঠতে শুরু করল পাহাড়ের মাথায়। মৃদু কোলাহলও যেন ভেসে আসতে শুরু করল সেখান থেকে। সূর্য ডোবার পর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে মৃত্যু নগরী। এ নগরী সম্রাট পাচাকুটি উৎসর্গ করেছিলেন মৃত্যু দেবতা বিচামার উদ্দেশ্যে। ধাপ বেয়ে কিছুটা ওপরে ওঠার পর পাথর বিছানো রাস্তা এগিয়েছে নগরীর দিকে। সে রাস্তা ধরে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চলল সকলে। সবার আগে সুসানের হাত ধরে ইনকা পুরোহিত, তারপর পিনচিও আর হুইকো। অন্ধকারের মধ্যেও ইনকা পুরোহিত যেভাবে পা ফেলে এগোচ্ছিলেন তাতে বোঝা যাচ্ছিল, এ পথ তার চেনা। অর্ধেক রাস্তা ওঠার পর হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল এক ঝাঁক আলোক বিন্দু দ্রুত গতিতে পাক দন্ডী বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে। ইল্লাপা বললেন, ‘রক্ষীরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। তাই দেখতে আসছে আমরা কারা!’ সুসানরা ওপরে উঠতে লাগল, আর আলোগুলো নামতে লাগল নীচের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই মশালের আলোগুলো এসে পড়ল তাদের কাছে। দাঁড়িয়ে পড়লেন ইনকা পুরোহিত। তাদের কিছুটা তফাতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মৃত্যুনগরীর রক্ষীরাও। গোটা কুড়ি মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল জায়গাটা। মুখে বীভৎস উল্কি, লম্বা বেণী, কর্ণকুন্ডল পরা দীর্ঘদেহী আমাজনীয় যোদ্ধা সব! কাঁধে তির ধনুক। প্রায় উলঙ্গ তাদের দেহ। শুধু নামমাত্র বস্ত্র খন্ড তাদের কোমরে জড়ানো। ঠিক যেন মৃত্যু দূত তারা। পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে দেখতে লাগল মৃত্যু নগরীর অতিথিদের। বেশ কয়েক মুহূর্ত উভয় পক্ষের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময়ের পর ইনকা পুরোহিত দুর্বোধ্য ভাষায় তাদের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটা কথা বললেন। এক জন যোদ্ধা এগিয়ে এসে মশালটা ভালো করে তুলে ধরে দেখল সুসানকে। মশালের আলোতে ঝলমল করে উঠল তার কপালের ফেট্টিতে আটকানো সোনার চাকতিটা। সেটা দেখার পর সেই যোদ্ধা যেন কী যেন বলল তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে। ওমনি তারা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্ভাষণ জানাল সুসানকে। এরপর দুজন রক্ষী দ্রুত ছুটল নগরীর দিকে সুসানদের আগমন বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য। আর অন্যরা ইনকা পুরোহিত আর সুসানদের দুপাশে সারবদ্ধ হয়ে প্রথমে দাঁড়াবার পর তাদের নিয়ে চলল নগরীর দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনকা পুরোহিতের হাত ধরে সুসান পা রাখল মৃত্যু নগরীতে। পাহাড়ের মাথায় কালো পাথর কুঁদে তৈরি করা এ নগরী। বাড়িঘরগুলোর গঠন-শৈলীগুলোও যেন কেমন রুক্ষ, কারুকাজহীন, নিষ্প্রাণ। যেন কোথাও প্রাণের স্পর্শ নেই। পাথরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে ছাদঅলা লম্বা লম্বা বারান্দা চলে গেছে নানা দিকে। মশাল জ্বলছে চারপাশে, সেই আলোতে পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র চেহারার কাকা কুজকোরা। দিনের আলোতে যারা এ নগরী পাহারা দেয় সেই কনডোর পাখির ঝাঁক আবছা মূর্তির মতো সার বেঁধে বসে আছে বারান্দাগুলোর ছাদের কার্নিশে। রক্ষী পরিবৃত সুসানরা নগরীর প্রধান রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে চলল। এ নগরী বেশি বড়ো নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল নগরীর শেষ প্রান্তে মশাল আলোকিত এক চত্বরে। সেখানে এক পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের তৈরি এক মন্দির। সারা নগরীর মধ্যে এই মন্দিরের গায়েই একমাত্র কারুকাজ করা। বিরাট বড়ো তার দরজা। সিঁড়ি ভেঙে সেই দরজার কাছে পৌঁছতে হয়। সিড়ির ধাপের দু-ধারে দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী। তাদের হাতে চামড়ার ফিতেতে বাঁধা আছ দুটো প্রাণী। কালো মিশমিশে তাদের দেহ। সবুজ চোখ দুটো মশালের আলোতে জ্বলছে। মাঝে মাঝে লাল জিভ বার করে ঠোঁট চাটছে প্রাণী দুটো। আমাজনের বিখ্যাত কালো বাঘ!

চত্বরের ঠিক মাঝখানে বেশ কয়েকটা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই স্তম্ভ আর মন্দিরের মাঝখানে একটা বেদির ওপর বসানো আছে অস্ত্রধারী বিকট দর্শন এক মূর্তি! ইনিই হলেন ইনকাদের মৃত্যু দেবতা বিচামা। তার মুখ ফেরানো মন্দিরের দিকে। সেই সংহার মূর্তি যেন পাহারা দিচ্ছেন সূর্যদেবের মন্দির। আর চত্বরের দক্ষিণ দিকে পাহাড়েরই একটা অংশ উঠে গেছে অন্ধকার আকাশের দিকে। সেখানে সার সার গুহামুখ। তার সামনেও সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মশালধারী একদল রক্ষী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *