সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – ১২

১২

মহিলারক্ষী পরিবৃত আকল্লাকুনা জায়গাটা চিনে নিজেদের থাকার জায়গাতে ফিরে এল সুজয়রা। তারপর সারা দিন তারা কাটিয়ে দিল ঘরের মধ্যেই। মার্কেজ যেন পাথর বনে গেছেন। ঘরে ফিরে আসার পর সারাটা দিন তিনি আর একটাও কথা বললেন না। কুইলোর কোনো লোকজন তাদের খোঁজ নিতে এল না। একজন রক্ষী শুধু ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় সম্ভবত কৌতূহলবশতই ভিতরে একবার উঁকি দিয়েছিল। এক সময় দিন ফুরিয়ে এল। সূর্যদেব দিন শেষের রক্তিম আভা ইনতিহুয়ানাতার মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে ডুব দিলেন দূরের অরণ্যের আড়ালে। দ্রুত অন্ধকার গ্রাস করে নিতে লাগল প্রাচীন নগরীকে। সুজয় ঘরের বাইরে তাকিয়ে দেখল দূরে কুইলো প্রাসাদের দিকে ফুটে উঠছে জোনাক বিন্দু। প্রাসাদ চত্বরে মশাল জ্বালাচ্ছে রক্ষীরা। সে এরপর তাকাল আকাশের দিকে। ক্ষীণ চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। সুজয়রা প্রস্তুত হতে লাগল নতুন পথে যাত্রা শুরুর জন্য। এ যাত্রাপথে বোঝা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, শুধু অতি দরকারি কিছু জিনিসপত্র আর সামান্য কিছু খাবার নিজেদের পিঠের কিট ব্যাগে ভরে নিল তারা।

ঠিক যখন ইনতিহুয়ানাতার মাথার ওপর সোনার থালার মতো গোল চাঁদ উঠল, তখন তিনজন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। দিনের সূর্য নগরী রাতের জ্যোৎস্নালোকে প্লাবিত। জ্যোৎস্নাস্নাত প্রাচীন সৌধ, মিনার। এত উত্তেজনার মধ্যেও বিল চারপাশে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘অপূর্ব!’ সামনের চত্বরটা পার হয়ে নির্দিষ্ট দিকে এগোল তারা। কোনো লোক তাদের চোখে পড়ল না। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা উপস্থিত হল আকল্লাকুনার কাছে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আকল্লাকুনা। পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ এখানে। প্রবেশ তোরণের পাশে দেওয়ালের গায়ে একটা মশাল জ্বলছে, আর তার কাছেই একটা পাথরের বেদিতে বসে আছে একজন অস্ত্রধারী মহিলা দ্বাররক্ষী। এ জায়গাটা দিনের বেলা ভালো করে দেখে নিয়েছে সুজয়রা। সন্তর্পনে তারা রক্ষীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রাচীরের অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর সতর্ক চোখে বেড় দিয়ে আকল্লাকুনার পিছনে এসে উপস্থিত হল। জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আকল্লাকুনার পাথুরে দেওয়াল চাঁদকে আড়াল করে রেখেছে সেখানে। চারপাশ ঝোপঝাড় পরিপূর্ণ। ভলো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুজয়রা সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার পর কাছেই একটা ঝোপ হঠাৎ নড়ে উঠল। তার ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল একটা আবছা ছায়ামূর্তি! তারপরই পরিচিত চাপা কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সেনররা আমার সঙ্গে আসুন।’ টিহুয়াচান। তাকে অনুসরণ করল তারা।

কিছুটা ঝোপজঙ্গল ভাঙার পর আবার চাঁদের আলোর নীচে তারা এসে দাঁড়াল। পথের দুপাশে নানা ধরনের অজস্র ধ্বংসস্তূপ। ছাদহীন পাথুরে ঘর, ধসে পড়া প্রাচীর, হেলে পড়া স্তম্ভ। তার মধ্যে দিয়ে সতর্কভাবে টিহুয়ার পিছনে সুজয়রা এগোতে থাকল। আধঘণ্টাটাক চলার পর চারপাশের ঘর বাড়ি ফাঁকা হয়ে এল। সামনে চোখে পড়ল একটা প্রাচীর, তার ওপাশে চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গল। টিহুয়া, মার্কেজকে বলল, ‘আমরা নগরীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। প্রাচীর পার হয়ে ওই জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারলেই আপাতত নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।’ প্রাচীরের গায়ে বাইরে যাবার জন্য একটা ভগ্ন তোরণও চোখে পড়ল। তারা এগোল সেদিকে।

সুজয়রা যখন তোরণের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল! কোথা থেকে যেন মশাল হাতে একজন বর্শাধারী ইনকা রক্ষী উদয় হল সেখানে। এক হাতে মশাল আর অন্য হাতে বর্শা নিয়ে সুজয়দের দিকে পিছন ফিরে সে তোরণ আগলে দাঁড়াল। এখানে কোনো রক্ষী থাকবে ধারণা করতে পারেনি কেউ। পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। মাত্র হাত কুড়ির ব্যবধান। কোথাও আড়াল নেই সেখানে। কোনো কারণে সে পিছনে তাকালেই দেখতে পাবে সবাইকে! রক্ষী তাকিয়ে আছে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। সুজয়রাও দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতো। কী করবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বিল হঠাৎ তার ক্যামেরার ব্যাগটা সুজয়ের হাতে ধরিয়ে শ্বাপদের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল রক্ষীর দিকে। উত্তেজনায় সুজয়দের হৃৎপিন্ড স্তব্ধ হয়ে যাবার যোগাড়! বিল লোকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত কান্ড করল। সে মৃদু টোকা দিল রক্ষীর কাঁধে। রক্ষী ঘুরে দাঁড়াল। আর তার পর মুহূর্তেই বিল তার ডান হাতের পোঁচরা দিয়ে সজোরে আঘাত করল রক্ষীর কন্ঠনালিতে! একটাও শব্দ না করে বিরাট দেহ নিয়ে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে গেল সে। সুজয়রা এবার দৌড়ে গেল সেখানে। রক্ষীর দেহ একদম স্থির। বিল বলল, ‘ভোরের আগে ওর আর জ্ঞান ফিরবে না।’ সুজয় বিলকে বলল, ‘এ বিদ্যে তুমি শিখলে কোথায়?’ বিল জবাব দিল, ‘তোমাকে বলেছিলাম না যে আর্মি ট্রেনিং নেওয়া আছে আমার। এটাও ওই সময় শেখা।’

মশালটা নিভিয়ে ফেলে সেটা সঙ্গে নিল টিহুয়া, বর্শাটাও সে সঙ্গে নিল। তারপর সকলে তোরণ অতিক্রম করে সামনের একটা ফাঁকা মাঠ পার হয়ে প্রবেশ করল জঙ্গলের মধ্যে। আন্দাজ মতো পূর্ব দিক বরাবর তারা হাঁটতে শুরু করল।

বিচিত্র এই পথচলা। ডালপালার ফাঁক দিয়ে আবছা চাঁদের আলো ভেসে আসছে। যত তারা বনের গভীরে প্রবেশ করতে লাগল ততই কাছে দূরে শোনা যেতে লাগল নানা ধরনের শব্দ। নৈশ বিহারে বেরিয়েছে অরন্যের শিশুরা! তাদেরই শব্দ ও সব! এক সময় ডালপালার চাঁদোয়ার আড়ালে ঢেকে গেল চাঁদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলো জ্বলছে নিভছে। অরণ্যের প্রেতাত্মারা যেন ঝোপঝাড়-গাছের গুড়ির আড়াল থেকে লক্ষ নিযুত চোখ মেলে দেখছে অরণ্যচারী এই অদ্ভুত অভিযাত্রীদের। সুজয়দের খুব কাছ দিয়েই ঝোপজঙ্গল ভেঙে কী যেন একটা ভারী প্রাণী দৌড়ে গেল। অনেকদূর পর্যন্ত তার পায়ের শব্দ শোনা গেল। টিহুয়া এরপর দাঁড়িয়ে পড়ে মার্কেজকে বলল, ‘মশালটা এবার জ্বালিয়ে নেওয়া দরকার। এ বনে অনেক জন্তু আছে দেখছি! সঙ্গে আগুন থাকলে তারা কাছে ঘেঁষবে না।’

মার্কেজ বললেন, ‘কিন্তু আগুন জ্বাললে যদি ওরা আমাদের সন্ধান পেয়ে যায়?’

সে জবাব দিল, ‘ইনকাই হোক বা চিমু, ভূতের ভয়ে তারা কেউ রাতে জঙ্গলে ঢোকে না। এ সবে তারা খুব বিশ্বাস করে। সূর্য নগরীর ইনকারা দিনের বেলা আমাদের খুঁজতে যদি জঙ্গলে ঢোকে, ততক্ষণে আমরা অনেক দূর চলে যাব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মশাল জ্বালিয়ে আমাদের পথ চলতে হবে।’ বিল লাইটার দিয়ে মশালটা জ্বালিয়ে দিল। আবার শুরু হল পথ চলা। প্রফেসর, টিহুয়াকে প্রশ্ন করল, ‘কাল আমরা চিমু গ্রামে কখন পৌঁছব?’

টিহুয়া জবাব দিল, ‘তাড়াতাড়ি চললে কাল সূর্য মাঝ আকাশে ওঠার আগেই সেখানে পৌঁছে যাব আমরা।’

সময় এখন খুব মূল্যবান। তাই তার কথা শূনে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সকলে। সুজয় চলতে চলতে শুধু লক্ষ করতে লাগল মার্কেজকে। এই বয়সেও তাঁর পরিশ্রম করার কত ক্ষমতা। মশালের আলোতে তার মুখ দেখে মনে হল সুসানের প্রতি তার অসীম স্নেহ আর একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তি যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তাঁকে। যে ভাবেই হোক তাঁকে পৌঁছতে হবে সুসানের কাছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে লাগল। তারপর এক সময় যেন গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে শুকতারা চোখে পড়ল সুজয়ের। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন পুব আকাশে লাল রং ধরতে শুরু করল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কেটে গিয়ে বনের মধ্যে ফুটে উঠতে লাগল আবছা আলো। আস্তে আস্তে শোনা যেতে লাগল দু-একটা পাখির ডাক। রাত্রি শেষ হল।

সুজয়রা এসে উপস্থিত হল জঙ্গলের মধ্যে ছোটো নদীর ধারে। সাদা নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে শীর্ণ জলধারা তিরতির করে প্রবাহিত হচ্ছে সেখানে। গোড়ালির একটু ওপর সমান জল হবে সেখানে। চওড়াও বেশি নয়। অনায়াসে হেঁটে পার হওয়া যায় এ নদী। নদীর দু-পাশে হাত দশেক ফাঁকা জমি তারপর ছোটো ছোটো ঝোপ ঝাড়। এ পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সুজয়রা নদী পার হবার আগে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য বসল। চারপাশে অপূর্ব পরিবেশ। সূর্যদেব দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন, গাছের মাথায়, নদীর জলে। বনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে পাখির কলকাকলি। একটা বেশ বড়ো প্রজাপতি সুজয়ের নাকের সামনে দিয়ে ডানা মেলে উড়ে গেল। তার ডানায় রামধনুর সাত রং। যেন সূর্যদেবের জিয়ন কাঠির স্পর্শে নতুন করে জেগে উঠেছে এই অরণ্যময় পৃথিবী!

সুজয় বিলকে প্রশ্ন করল, ‘তুমিতো অনেক অরণ্যে গেছো! সেখানেও কি ভোর এই রকমই সুন্দর?’

বিল জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ভোর সর্বত্রই একই রকম সুন্দর। শুধু তাকে চেনার চোখ থাকা চাই।’

সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ, ভোর মানেই তো জীবন!’

প্রফেসর কিন্তু নিশ্চুপ। জীবনের সৌন্দর্য আহরণ করার মতো মানসিক অবস্থা তাঁর এখন নেই। সুজয়দেরও নেই। কিন্তু মুহূর্তের জন্য এই সুন্দর সকাল যেন তাদের সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল।

বিলের পাশেই বসে ছিল টিহুয়া। সে হঠাৎ উঠে নদীর ধারে এগিয়ে গেল জল খাবার জন্য। স্বচ্ছ জল আঁজলা ভরে পান করার পর সে যখন সুজয়দের দিকে ফিরতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই সুজয়দের একটু দূরে একটা ঝোপ হঠাৎ দুলে উঠল। আর তারপরই সুজয়দেরই চমকে দিয়ে নদীর পাড়ে বেরিয়ে এল একটা বাঘ জাতীয় প্রাণী। কুচকুচে কালো তার গায়ের রং। সুবজ রঙের চোখ দিয়ে সে তাকিয়ে আছে টিহুয়ার দিকে। ঠিক যেন একটা কষ্টি পাথরের মূর্তি! শুধু তার লেজের ডগাটা মৃদুমৃদু নড়ছে। টিহুয়া তাকে খেয়াল করেনি। সে নদী থেকে উঠে মুখ মুছছে। হিংস্র প্রাণীটা আর তার মধ্যে হাত পনেরোর মাত্র ব্যবধান। মার্কেজ তাকে সাবধান করতে গেলেন কিন্তু গলা দিয়ে তার শব্দ বেরল না। সুজয় নিজেও যেন পাথর বনে গেছে। চোখের পাতা বোজার ক্ষমতাও যেন তার নেই! প্রাণীটা তার দেহের সামনের অংশটা মাটির দিকে একটু ঝোঁকালো। এবার সে লাফ দেবে! ঠিক সেই সময় প্রচন্ড জোরে একটা কান ফাটা শব্দ হল সুজয়ের পাশে! প্রাণীটাও লাফিয়ে উঠল শূন্যে। পর মুহূর্তে আরও একটা প্রচন্ড শব্দ। শূন্যেই একটা প্রচন্ড আর্তনাদ করে প্রাণীটা আছড়ে পড়ল টিহুয়ার ওপর। তারপর দুজনেই মাটিতে পড়ে একদম স্থির হয়ে গেল! পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সম্ভবত তিন সেকেণ্ড সময় লাগল। বিলের রিভলবার থেকে তখনও ধোঁয়া বার হচ্ছে। সুজয়রা উঠে দৌড়ে গেল জায়গাটাতে। রক্তমাখা দুটো দেহ মাটিতে পড়ে আছে। প্রাণীটা মরে গেছে। তার নীচে টিহুয়া। বিল টেনে প্রাণীটাকে সরিয়ে দিতেই উঠে বসল টিহুয়া। বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রইল মৃত প্রাণীটার দিকে। বিলের একটা গুলি বিঁধেছে তার শিরদাঁড়াতে। আর অন্যটা চূর্ণ করে দিয়েছে তার মাথার খুলি। বিল প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কালো বাঘ বা ব্ল্যাকপ্যান্থার। একমাত্র আমাজন অববাহিকার অরণ্যে এদের দেখা মেলে।’

টিহুয়ার আঘাত তেমন গুরুতর নয়। শুধু বাঘটা পড়ার সময় দুটো নখ বিঁধে গেছিল তার হাতে। সামান্য একটু রক্তপাত হচ্ছে। সুজয় ব্যাগ থেকে কাপড়ের টুকরো বার করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল তার হাতে। উঠে দাঁড়াল টিহুয়া। বিস্ময়ের ঘোর তার তখন সম্পূর্ণ কাটেনি। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মাটিতে পড়ে থাকা নিস্পন্দ মৃত্যুদূতের দিকে। তারপর বিলের ডান হাতটা টেনে নিয়ে তাতে একটা চুমু খেয়ে আবেগ মথিত স্বরে বলল, ‘সেনর, তুমি দুবার আমার প্রাণ রক্ষা করলে। আমি কথা দিলাম, গাঁও বুড়ো যদি নিষিদ্ধ নগরীর যাবার রাস্তা বাতলাতে পারে, তাহলে আমি তোমাদের সঙ্গে সেখানে যাব।’ তার কথাটা অনুবাদ করার পর মার্কেজও বিলকে জড়িয়ে ধরলেন। টিহুয়া এরপর বলল, ‘চলুন এবার নদী পার হওয়া যাক।’

বিল নদী পার হবার জন্য তার কিট ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে সুজয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘একটু আগেই তুমি বলছিলে না যে, ভোর মানেইতো জীবন! দেখলে, মৃত্যু আমাদের জন্য কেমন ওৎ পেতে বসেছিল নদীর ধারে? আসলে, ভোর হোক বা রাত, জীবন-মৃত্যু এখানে সব সময়ে পায়ে পায়ে ঘোরে! জীবন এখানে যতটা সুন্দর, ঠিক ততটাই নিষ্ঠুর! খাদ্য-খাদকের নিরন্তর সংগ্রাম চলে এখানে। আমার গুলি দুটো ফস্কালেই বাঘটার বদলে টিহুয়া এখানে পড়ে থাকত।’

নদীটা পার হল সুজয়রা। তারপর ওপারের জঙ্গলে প্রবেশ করে হাঁটতে শুরু করল। টিহুয়া বলল, ‘এ জঙ্গলের শেষেই চিমুদের গ্রাম। যে গতিতে আমরা চলেছি তাতে ঘণ্টা ছয়-সাতের মধ্যেই গ্রামের কাছে পৌঁছে যাব।’

সুজয় হিসাব করে দেখল, তাহলে বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদই সেখানে পৌঁছে যাবার কথা। পুব বরাবর এগোতে থাকল তারা।

এই নতুন জঙ্গলে ঝোপ-ঝাড়ের তুলনায় বড়ো বড়ো গাছের সংখ্যাই বেশি। আদিম মহাবৃক্ষগুলো যেন ডালপালা বাড়িয়ে ছুতে চাইছে আকাশকে। মোটা মোটা লতাগুল্ম ঝুলছে তাদের ডাল থেকে। বিচিত্র ধরনের অর্কিডের সমারোহ চারপাশে। আর রয়েছে, বিভিন্ন পাখি। তাদের অধিকাংশই টিয়া বা প্যারাকিড প্রজাতির। লাল, নীল, হলুদ, কত রঙের টিয়া!

চলতে চলতে বনের মধ্যে এক জায়গাতে গাছের মাথার ওপর থেকে হাসির শব্দ কানে এল! মার্কেজ আর সুজয় চমকে উঠে ওপর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল একদল ছোটো আকৃতির লাল রঙের বাঁদর বসে আছে গাছের ডালে। নীচে সুজয়দের দিকে তাকিয়ে হাসছে তারা। অবিকল মানুষের মতো হাসির শব্দ! সুজয়রা আশ্চর্য হয়ে গেল!

বিল বলল, ‘এদের আমি দেখেছি। আমাজন অববাহিকার জঙ্গলে এদের দেখা মেলে। এদিককার গাছগুলোও চেনা লাগছে আমার। সম্ভবত আমাজন অববাহিকার দিকেই এগোচ্ছি আমরা, অর্থাৎ ব্রাজিল সীমান্তের দিকে। কালো বাঘ আর এই বাঁদরগুলো তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।’

বাঁদরের দল মাথার ওপর বুনো লতায় ঝুলতে ঝুলতে বেশ কিছুটা পথ চলল তাদের সাথে। বাঁদরগুলোর বাঁদরামি দেখে এত কষ্টের মধ্যেও এক সময় হেসে উঠলেন মার্কেজ।

ঘণ্টা পাঁচেকের যাত্রাপথে জঙ্গলের মধ্যে বেশ কয়েকটা শীর্ণ নদী পার হতে হল সুজয়দের। সম্ভবত এরা সব উকেয়ালির শাখা নদীর কোনো উপশাখা। এ সব অজস্র নদীর মিলিত জলধারায় পুষ্ট হয় আমাজন। অবশেষে জঙ্গল এক সময় ফাঁকা হয়ে আসতে লাগল। টিহুয়া মার্কেজকে বলল, ‘এ জঙ্গল শেষ হলেই চিমুদের গ্রাম দেখা যাবে।’

আরও কিছু পথ এগোবার পর হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর একটা পাখি ডেকে উঠল। আর তার পরই জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসতে লাগল একই ধরনের পাখির শব্দ। জঙ্গলে পাখিতো ডাকতেই পারে। তাই ব্যাপারটা তেমন ভাবে গুরুত্ব দেয়নি সুজয়রা। কিন্তু টিহুয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। ডেকেই চলেছে পাখিগুলো। কখনো একটানা, কখনো বা থেমে থেমে। কান খাড়া করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে শব্দ শুনে টিহুয়া, মার্কেজকে বলল, ‘আমরা গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি। জঙ্গলের নজরদাররা আমাদের দেখতে পেয়েছে। সে খবরই পাখির ডাকের সংকেতের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বনের ভেতর।’

মার্কেজ শুনে চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘তার মানে তো তারা আমাদের কাছাকাছি আছে। কিন্তু কোথায় তারা?’

টিহুয়া জবাব দিল, ‘জঙ্গলের আড়াল থেকে তারা আমাদের লক্ষ করছে। আপনি তাদের দেখতে পাবেন না। ঠিক সময় তারা দেখা দেবে।’

এরপর সে বিলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনি তাদের দেখে অস্ত্র বার করবেন না কিন্তু! তাহলে গোলমাল হবে। তারা যেন কখনো আমাদের শত্রু না ভেবে বসে!’

টিহুয়ার কথা যে সত্যি তা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণিত হল। জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে ঘাস জমি। তারা সে জায়গাতে উপস্থিত হতেই হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল জনা দশেক লোক। ঘিরে ধরল সুজয়দের। লোকগুলোর মাথায় পালকের সাজ, দেহের পোশাকও পালকের তৈরি, তবে এদের মুখে উল্কি আঁকা নেই। সুজয়দের দিকে তাক করে ধনুকের ছিলা টেনে দাঁড়াল তারা। পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সুজয়দের।

টিহুয়া এরপর তার পকেট থেকে বার করল কয়েনের মতো দেখতে একটা কালো রঙের চাকতি। সেটা সে দু-আঙুলের ফাঁকে ধরে লোকগুলোকে দেখিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল!

লোকগুলোর মধ্যে একজন এবার টিহুয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার হাত থেকে চাকতিটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল।

তারপর সেই লোকটা আর টিহুয়ার মধ্যে চলল দুর্বোধ্য ভাষায় কথোপকথন। তার মর্মার্থ প্রফেসরও উদ্ধার করতে পারলেন না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই চিমুরা সুজয়দের নিয়ে চলল তাদের গ্রামের দিকে।

যেতে যেতে মার্কেজ টিহুয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি চাকতিটা দেখিয়ে কী বললে?’

টিহুয়া বলল, ‘আমি যে ওদের স্বজাতি তার পরিচয় চিহ্ন এই চাকতি। বংশ পরম্পরায় এটা আমার কাছে আছে। এই বলে সে সেটা প্রফেসরের হাতে দিল। তিনি সেটা দেখার পর সুজয়ও হাতে নিয়ে দেখল জিনিসটা। সেটা ধাতব নয়, পোড়া মাটির তৈরি। দু-পাশে খোদিত আছে অদ্ভুত দর্শন মানুষের ছবি। চিমুদের কোনো দেবদেবী হবে হয়তো!

ঘাস জমি পার হয়ে চিমুদের গ্রামে এসে উপস্থিত হল সুজয়রা। মাটির নীচু দেওয়াল দিয়ে গ্রামটা ঘেরা। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল তারা। দেওয়ালের গায়ে কিছু দূর দূর একটা করে লম্বা লাঠি পোঁতা। তার মাথায় বসানো আছে নরমুন্ড!

টিহুয়া বলল, শত্রু নিধনের পর নাকি তাদের মুন্ডু কেটে চিমুরা এই ভাবে সাজিয়ে রাখে। ওই সব মুন্ডুগুলো অধিকাংশই হল ইনকাদের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চিমুদের সাথে ইনকাদের শত্রুতা চলে আসছে।

গ্রামের ভিতর বাড়িগুলো ইটের তৈরি। মাথায় খড়ের ছাউনি। দেওয়ালের গায়ে অপূর্ব সুন্দর জ্যামিতিক নকশা ও রঙের মোজেকের কাজ। কোথাও আবার দেওয়ালের গায়ে মাটির প্রলেপের ওপর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা পশুপাখি ও অদ্ভুত দর্শন দেবদেবীর মূর্তি। গ্রামের ভেতর রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে মার্কেজ বললেন, ‘মোজেক শিল্পের জনক কিন্তু চিমুরাই। পরে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে বলেন, চিমুদের শিল্পকলা নাকি ইনকাদের থেকে বেশি উন্নত ছিল।’

গ্রামের ভিতর বেশ অনেক লোকজন। তার মধ্যে অস্ত্রধারী চিমু যোদ্ধাদেরও যেমন সুজয়রা দেখতে পেল, তেমনই দেখা মিলল কাঁখে শিশু নিয়ে দাড়িয়ে থাকা চিমু রমণীদেরও। তাদের দীর্ঘ বেণী। পাথর আর সোনার অলঙ্কারে সজ্জিত তারা। নারী-পুরুষ প্রত্যেকের কানেই রয়েছে কর্ণকুণ্ডল। তবে তা ইনকাদের মতো মাকড়ি ধরনের নয়, দেখতে কানপাশার মতো। আর স্ত্রী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রত্যেকের পরনেই পালকের পোশাক! নানা রঙের নানা ধরনের পালক দিয়ে তা তৈরি।

চিমুদের পোশাক দেখে বিল বলল, ‘এত পালক এরা পায় কোথা থেকে? নিশ্চই অনেক পাখির প্রাণ যায় এর জন্য!’

টিহুয়া তার কথা শুনে বলল, ‘খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া চিমুরা পাখি শিকার করে না। বরং পাখিদের এরা ভালোই বাসে। নির্দিষ্ট এক একটা ঋতুতে এক এক ধরনের পাখির পালক ঝরে যায়। বন থেকে সেই পালক কুড়িয়ে এনে তাই দিয়ে পোশাক বানানো হয়।’

মার্কেজ টিহুয়ার কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমার সেই গাঁওবুড়ো এখনও বেঁচে আছে তো?’

সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ’, তার কাছেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজয়রা গ্রামের মাঝখানে একটা খোলা জায়গাতে এসে উপস্থিত হল। সেখানে বিরাট একটা গাছের তলায় বেদিতে বসে আছেন এক অতিবৃদ্ধ। তার দেহের চামড়া সব ঝুলে পড়েছে। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। পরনে পালকের পোশাক, মাথায় বিরাট পালকের সাজ। বৃদ্ধ গাছের নীচে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। এক পাল বাচ্চাকাচ্ছা খেলা করছিল তার চারপাশে। সুজয়দের সঙ্গের রক্ষীরা বাচ্চাগুলোকে হটিয়ে দিয়ে তাদের গাঁওবুড়োর সামনে এনে দাঁড় করাল। তারপর একজন রক্ষী তাঁর উদ্দেশ্যে কী যেন বলল। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন গাঁও বুড়ো। তারপর সামনে প্রথমেই বিলকে দেখতে পেয়ে তার লোকজনের উদ্দেশ্যে স্বজাতীয় ভাষায় বললেন, ‘ও, সাদা চামড়া! তা আমার কাছে আনলে কেন? শুধু মুন্ডুগুলো আনলেই তো হত!’

রক্ষীদের মধ্যে একজন বলল, ‘ওদের মধ্যে একজন চিমুও আছে। সে আগেও এসেছে আমাদের এখানে। ওই এনেছে বিদেশিদের!’

লোকটার কথা শুনে এবার একটু নড়েচড়ে বসে ভালো করে তাকালেন সুজয়দের দিকে। টিহুয়া তার একদম সামনে দাঁড়িয়ে একবার ডানপাশে আর একবার বাঁপাশে থুতু ছিটিয়ে টুপি খুলে মাথা ঝোঁকাল গাঁওবুড়োর উদ্দেশ্যে। সম্ভবত এটাই সম্ভাষণের রীতি! এরপর সে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করল। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকিয়ে গাঁওবুড়ো বলল, ‘ও এবার মনে পড়েছে! সেবার ছিল আমার বড়ো নাতির পঞ্চাশতম জন্ম বছর। এক সাদা চামড়াকে নিয়ে এসেছিলে তুমি। এক চাঁদ এ গ্রামে ছিলে।’

টিহুয়া বলল, ‘হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছেন আপনি।’

মার্কেজ বা সুজয়রা অবশ্য এই সব কথোপকথন বুঝছিল না। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল।

গাঁওবুড়োর দৃষ্টি পড়ল সুজয়ের ওপর। তিনি বললেন, ‘সাদা চামড়ার সাথে এ লোকটা কে। এতো চিমু, ইনকা, বা মোচে নয়! এ কোন জাতির লোক?’

টিহুয়া সুজয়কে তাঁর কথা অনুবাদ করে দেওয়াতে সুজয় বলল, ‘আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি।’

গাঁওবুড়ো তার কথা শুনে আবার জানতে চাইলেন, ‘সে দেশটা কোথায়? কুজকোর ওদিকে কি? তোমাদের আরাধ্য দেবতা কি ইনতি? নাকি এই বন, পাহাড় নদীর সৃষ্টিকর্তা ‘মহান ওলাওলা’?’

টিহুয়া তাকে খুশি করতে এবার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, দেশটা কুজকোর ওদিকেই। আর মহান ওলাওলাই হল আরাধ্য দেবতা।’

সুজয়ের আরাধ্য দেবতা ওলাওলা শুনে গাঁওবুড়ো প্রসন্ন দৃষ্টিতে সুজয়ের দিকে তাকিয়ে সোনা বাঁধানো দাঁতে হাসলেন। সুজয় অবশ্য ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না।

গাঁওবুড়ো এরপর প্রফেসর মার্কেজ আর বিলের পরিচয় জানতে চাইলেন। টিহুয়া কিছু সত্যি কিছুটা মিথ্যা মিলিয়ে মিশিয়ে তাদের পরিচয় ব্যক্ত করল তার কাছে।

সুজয়দের পরিচয় জানার পর তারা গ্রামে থাকতে এসেছে ভেবে গাঁওবুড়ো টিহুয়াকে বললেন, ‘তুমি চিমু। সারা পৃথিবীর চিমুরা হল সহোদর ভাই। তা তারা আমাজন বা কুজকো যেখানেই থাকুক না কেন! আর তোমার সঙ্গীরা যখন প্রত্যেকেই এই পৃথিবীর স্রষ্টা ওলাওলাকে মানে, তখন তোমাদেরকে এ গ্রামে থাকতে দিতে আমার আপত্তি নেই। তোমরা ‘দু-চাঁদ’ থাকতে পার এখানে।

টিহুয়া তাঁকে বলল, ‘আমরা এখানে এসেছি আপনার সাহায্য পাবার আশায়। কুজকো কারিকাঞ্চার পুরোহিত আমাদের সঙ্গের একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তার সাথে বেশ কয়েকজন লোকও আছে। বাচ্চাটাকে খোঁজার ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।’

গাঁওবুড়ো টিহুয়ার কথা শুনে বললেন, ‘কুজকো করিকাঞ্চার পুরোহিত! ওরাতো ওই রকমই হয়। অনেক অনেক চাঁদ আগে ইনকা সম্রাট আর করিকাঞ্চার পুরোহিতরা মিলেই মহান সৃষ্টিকর্তা ওলাওলার সন্তান চিমুদের রাজধানী ‘চানচান’ ধ্বংস করেছিল! অস্ত্রের জোরে আমাদের ইনকা সম্রাটদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করিয়েছিল! চানচান ছেড়ে এই বনে জঙ্গলে পালিয়ে এসেছিলাম আমরা। তারাও অবশ্য রেহাই পায়নি। ওলাওলার অভিশাপে তাদের সোনার নগরীও ধ্বংস হয়েছিল একদিন। লাঠির থেকে আগুন ঝরানো একদল বিদেশি ইনকা সম্রাটকে ফাঁসিতে লটকে সব সোনা লুঠ করে নিয়েছিল। করিকাঞ্চার পুরোহিতরাও রেহাই পায়নি সেদিন। বিদেশিরা তাদের ধরে তামার ষাঁড়ে জ্যান্ত সিদ্ধ করেছিল। উচিত শিক্ষা হয়েছিল তাদের।’

এ সব প্রাচীন ইতিহাস গাঁওবুড়ো বিজ্ঞের মতো টিহুয়াকে জানাবার পর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তা করিকাঞ্চার পুরোহিত বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় পালিয়েছে? কুজকো ছেড়ে তারা আবার কোথাও নতুন শহর স্থাপন করল নাকি?’

টিহুয়া জবাব দিল, ‘পুরোহিত তাকে নিয়ে গেছে নিষিদ্ধ নগরীতে। আপনি যদি সে নগরীর পথ বলে দেন, তাহলে ছেলেটাকে উদ্ধার করতে পারি আমরা।’

টিহুয়ার কথা শুনে এবার চমকে উঠলেন গাঁওবুড়ো। তিনি বললেন, ‘নিষিদ্ধ নগরী! সে নগরীতে গেলে বেঁচে ফেরা সম্ভব নয়! বাচ্চাটা যদি সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে সে আর ফিরবে না। তোমরা সেখানে পৌঁছবার আগেই সে বলি হয়ে যাবে। পরে তোমাদেরও ওই দশা হবে।’ ভাগ্যিস টিহুয়া আর গাঁওবুড়োর কথাবার্তা বুঝতে পারছিলেন না মার্কেজ। নইলে গাঁওবুড়োর শেষ কথাগুলো তাঁর পক্ষে শোনা কষ্টকর হত।

গাঁওবুড়ো এরপর বললেন, ‘সেখানে হেঁটে যেতে হলে দুই চাঁদ লাগে। নৌকায় উজান বেয়ে গেলে অবশ্য তাড়াতাড়ি পৌছানো যায়। কিন্তু সে এক ভয়ঙ্কর দেশ। সেখানে গাছপালা নেই, খালি ছোটো ছোটো রুক্ষ পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় আছে ইনকাদের মন্দির। কাকা আমাজনীয়রা যুগযুগ ধরে পাহারা দিয়ে আসছে সে মন্দির। আকাশে সেখানে উড়ে বেড়ায় হিংস্র কনডোর পাখির ঝাঁক! মানুষ দেখলে তারা ছিঁড়ে খায়! যুবক বয়সে অনেক লোকজন মিলে একবার আমরা একবার সেই নগরীর দখল নিতে গেছিলাম। কিন্তু পারিনি। অনেক কষ্টে মাত্র কয়েকজন প্রাণ নিয়ে সেখান থেকে ফিরতে পেরেছিলাম! এই দ্যাখো তার চিহ্ন—’

এই বলে গাঁওবুড়ো তাঁর পালকের জামা বুকের ওপর টেনে তুলতেই বেরিয়ে পড়ল, তার বুক থেকে পেট পর্যন্ত এক বিঘত লম্বা একটা প্রাচীন ক্ষতচিহ্ন! তিনি বললেন, ‘কনডোরের ঠোঁটের দাগ এটা!’

টিহুয়া বলল, ‘যাই হোক আমাদের সেখানে যেতে হবে। ছেলেটাকে না নিয়ে আমরা ফিরতে পারব না। আপনি আমাদের যাবার রাস্তা বলে দিন।’ গাঁওবুড়ো প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না টিহুয়ার কথায়। তিনি খালি বলে যাচ্ছিলেন, ‘ওলাওলার উপাসকদের কিছুতেই আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না! তোমরা কেউই আর ফিরবে না সেখান থেকে। তোমাদের মৃত্যুর জন্য ওলাওলা আমাকে অভিশাপ দেবেন।’

ইতিমধ্যে সুজয়দের চারপাশে আরও বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। সুজয়রা গাঁওবুড়ো আর টিহুয়ার কথা শুনে কিছু বুঝতে না পারলেও সে সব কথা শুনে তারা নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে আলোচনা শুরু করেছে, আর বিস্মিত ভাবে তাকাচ্ছে সুজয়দের দিকে।

গাঁওবুড়ো এরপর টিহুয়ার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর নাছোড়বান্দা টিহুয়ার কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন। তিনি সম্মত হলেন নিষিদ্ধ নগরীর রাস্তা বাতলাতে। ভিড়ের মধ্যে থেকে তিনি কয়েকজন প্রবীণ চিমুকে ডেকে নিয়ে শলাপরামর্শ করতে বসলেন। দীর্ঘক্ষণ চলল সেই আলোচনা। অবশেষে গাঁওবুড়ো টিহুয়াকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা সেখানে যেতে চাচ্ছ যখন যাও। এখান থেকে দূরে উজানের পথে ‘পুমার মুখ’ নামে এক গুহা আছে। সেই পুমার মুখ দিয়ে পৌছে যাওয়া যায় সেই নগরীতে। আজ বিকালে নৌকায় যাত্রা শুরু করলে কাল ভোরে পুমার মুখে পৌঁছে যাবে তোমরা। আমাদের লোকরা সে জায়গা পর্যন্ত তোমাদের পৌঁছে দেবে। ওলাওলা যেন তোমাদের রক্ষা করেন।’

গাঁওবুড়ো এরপর তাঁর স্মৃতি হাতড়ে পুমার মুখ দিয়ে কীভাবে সেই মৃত্যু নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে তাও মোটামুটিভাবে বলল টিহুয়াকে। মার্কেজ ও সুজয়রা দীর্ঘ সময় ধরে কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। টিহুয়া এবার তাদের সমস্ত কথাবার্তা ব্যক্ত করল মার্কেজ আর সুজয়দের কাছে। শুধু সুসান আর তাদের পরিণতি সম্পর্কে গাঁওবুড়োর বক্তব্য বাদ দিল সে। সব কথা শুনে প্রফেসর তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সত্যি যদি আমি সুসানকে ফিরে পাই তাহলে বৃদ্ধ বয়সে তোমাকে আর লামা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ভাতের জোগাড় করতে হবে না। তোমার ভরপোষণের ব্যবস্থা আমিই করব।’

বিল হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা নিষিদ্ধ নগরীর বিচামার মন্দিরে এমনকী আছে, যা পাহারা দেয় আমাজনীয়রা?’

গাঁওবুড়ো তাঁর সভা ভেঙে উঠতে যাচ্ছিলেন, টিহুয়া তাকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, ‘ঠিক জানি না। আগে মাঝে মাঝে কাকা কুজকোরা সেখান থেকে স্থলপথে এখানে আসত বলি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। জঙ্গলের মধ্যে চিমু বা অন্য জাতীয় কোনো লোককে একলা পেলে ধরে নিয়ে যেত। অনেক বছর আগে একটা উলটো ব্যাপার ঘটেছিল। বলি সংগ্রহ করতে আসা একজন দলছুট কাকা কুজকোকে ধরে ফেলেছিলাম আমরা। তার মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তা হল, বিচামার বিগ্রহ নাকি পাহাড়া দেয় সে মন্দির। মন্দিরের দরজা নাকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বন্ধই আছে। ভিতরে ঠিক কী আছে তা নাকি তাদেরও জানা নাই। তারা শুধু ওই মন্দির রক্ষা করে মাত্র। যে ওই দরজা খুলবে তাকে নাকি পুড়ে মরতে হবে! এর চেয়ে আর বেশি সে বলেনি আমাদের। আমরাও তাকে ওলাওলার থানে বলি দিই।’ এরপর বেদি ছেড়ে উঠে তার লোকজনকে যাত্রার বন্দোবস্ত করতে বলে গাঁওবুড়ো রওনা হলেন তাঁর কুঁড়ের দিকে।

সেখানেই বসল সুজয়রা। কিছুক্ষণ পর তাদের খাবার দিয়ে গেল চিমুরা। মৃৎপাত্রগুলোতে অসাধারণ সুন্দর কারুকাজ। খাবার পর দুটো ছোটোপাত্র তাদের ব্যাগের মধ্যে নিয়ে নিল বিল আর সুজয়। যদি কোনো দিন সভ্য জগতে ফেরা যায় তখন চিমুদের পটারি শিল্পের আশ্চর্য নমুনা তারা দেখাতে পারবে অন্যদেরকে। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে সময় কাটাবার জন্য গ্রাম দেখতে বেরল তারা। চিমুদের পটারি শিল্পের বহু নিদর্শন দেখল তারা। দেখল কিভাবে তৈরি হয় পালকের পোশাক। তাছাড়া চিমুদের বিখ্যাত মোজেক শিল্পগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। নিষিদ্ধ নগরীর সন্ধান জানার পর মার্কেজ তার বিহ্বলতা অনেকখানি কটিয়ে উঠেছেন। মোজেকের স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে সুজয়কে তিনি বললেন, ‘আপনাদের মনে হয় বলেছিলাম যে, চিমুদের রাজধানী চানচান এক সময় দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম জনপদ। সেখানে ছিল বিশাল বিশাল চত্বর, পিরামিড, জলাধার, বাগান, সমাধিক্ষেত্র। তার সব জায়গাতেই ছিল অপূর্ব সুন্দর মোজেকের কাজ। নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চিমুরা ইনকাদের থেকেও উন্নত ছিল। ইনকারা তাদের পরাজিত করার পর চিমুদের শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে এ জায়গা দখল করতে থাকে ইনকা শিল্পরীতি। সভ্য জগৎ থেকে অনেক দূরে বলে বংশপরম্পরায় এ সব শিল্পকলা আজও এরা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।’

গ্রাম দেখতে দেখতে এক সময় বেলা পড়ে এলে সুজয়রা ফিরে এল সেই গাছের নীচে। গাঁওবুড়ো আবার তখন ফিরে এসেছেন। যারা সুজয়দের নিয়ে যাবে তারাও একে একে উপস্থিত হল সেখানে। সুজয়দের প্রত্যেককে একটা করে বর্শা, মশাল, আর কিছু খাবার দেওয়া হল। বিকাল নাগাদ সুজয়রা গাঁওবুড়োর থেকে বিদায় নিয়ে চিমুরক্ষীদের সাথে গ্রাম ত্যাগ করল। গ্রামের পূর্ব দিকে একটা ছোটো জঙ্গল অতিক্রম করে তারা এসে উপস্থিত হল নদীর ধারে। এ নদীর নাম ‘নিয়া’। ম্যারিনিয়নের শাখা নদী। নদীর পাড়ে পৌঁছে সুজয়রা দেখল সেখানে একটা গাছের নীচে বেশ কয়েকটা নৌকা রাখা আছে। নৌকা মানে পনেরো কুড়ি হাত লম্বা মোটা গাছের গুঁড়ি। তার ভিতর বসবাস করার জন্য খোঁদল করা আছে। চিমুরা লেগে গেল দুটো গাছের গুঁড়িকে ঠেলে জলে নামানোর কাজে। নদীর পাড়ে মাঝেমাঝে নীচু জমিতে জল জমে ছোটোছোটো ডোবা সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ বড়ো আকারের অজস্র ব্যাং। তাদের গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ। পিঠের ওপর তিনটে লম্বা কালো দাগ যেন তিন আঙুলের ছাপ। জলে নামার আগে টিহুয়া হঠাৎ একটা ডোবার সামনে দাড়িয়ে পড়ে তার জামার নীচ থেকে টেনে বার করল একটা ফুট দুয়েক লম্বা কাঠের সরু পাইপ আর একটা ছোটো থলি। সেই থলির মধ্যে থেকে বার হল ছোটো ছোটো বেশ কয়েকটা কাঁটা। মার্কেজ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী এটা?’ টিহুয়া জবাব দিল, ‘ব্লো পাইপ। গ্রামের একজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।’

সুজয় ‘ব্লো পাইপের’ কথা বইতে পড়েছিল। জিনিসটা এই প্রথম চাক্ষুস করল। মার্কেজ বললেন, তুমি ব্লো পাইপ ছুড়তে পারো? টিহুয়া জবাব দিল, ‘হ্যাঁ পারি’। এরপর সে একটা অদ্ভুত কান্ড করল! ডোবার ধারে বসে পড়ে খপ করে একটা ব্যাঙ ধরে ফেলল! তারপর ব্লো পাইপের কাঁটাগুলো ব্যাঙটার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে আবার তা বার করে আনতে লাগল। কাঁটাগুলো ভিজে যেতে লাগল ব্যাঙের মাথা নিঃসৃত হলুদ রসে!

বিল সুজয়কে বলল, ‘ও কী করছে জানো? ব্লো পাইপের তিরে বিষ মাখাচ্ছে। এই ব্যাং একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়। নাম, ‘থ্রি-স্ট্রাইপড পয়জন ফ্রগ।’ এদের আরও একটা প্রজাতি আছে তারা কালোর ওপর হলুদ বর্ণের। তার নাম ‘অ্যারো পয়েজন ফ্রগ’। আমাজনে দেখেছি আমি। এই ব্যাংগুলোর দেহরস সাপের বিষের চেয়েও তীব্র! আমাজনীয় উপজাতিরা তাদের তিরের ফলায় এই বিষ মাখিয়ে নেয়। ওই তিরের একটা খোঁচা খেলে মুহূর্তের মধ্যে মানুষ অচৈতন্য হয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে!’

তার কাজ শেষ হয়ে গেলে ব্যাংটাকে ডোবার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল টিহুয়া। মার্কেজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত সব তুমি শিখলে কোথায়?’ টিহুয়া হেসে জবাব দিল, ‘সেনর, আমার বয়সও তো কম হল না! ছোটোবেলা থেকেই লামা নিয়ে সাহেবদের সাথে বনে জঙ্গলে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। অনেক উপজাতিদের সাথেও মিশেছি আমি। নানা জায়গাতে নানা জনের থেকে অনেক কিছু জেনেছি আমি। জীবনের শিক্ষাইতো হল ‘জানা’ তাই না?’ কথার শেষে টিহুয়া যেন দার্শনিকের মতো একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল প্রফেসরের দিকে!

মার্কেজ বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। আর তার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। পুঁথি পড়ে সব জানা যায় না। জীবনের থেকেই শিক্ষা নেয় মানুষ। আমিও এই যাত্রাপথে অনেক কিছু শিখলাম, জানলাম, যা ঘরে বসে জানা সম্ভব ছিল না!’

জলে নৌকা নামিয়ে ফেলল চিমুরা। সুজয়রা চারজন গিয়ে বসল তার একটাতে। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। নদীর ওপর দিয়ে পাখিরা তাদের বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। দাঁড় বাইতে শুরু করল চিমুরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এল পৃথিবীর বুকে। আকাশ, জঙ্গল, নদী, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল গাঢ় অন্ধকারে। তারপর এক সময় ধীরে ধীরে চাঁদ উঠল। নদীর জলে ধরা পড়ল তার প্রতিবিম্ব। দু-পাশে গভীর জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে চন্দ্রালোকে চিমুদের নৌকা ছপছপ শব্দে উজান বেয়ে সুজয়দের নিয়ে চলল এক অজানা দেশের দিকে। যে দেশের নাম, ‘নিষিদ্ধ নগরী’! ইনকা পুরোহিত সুসানকে নিয়ে গেছেন সে মুলুকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *