১১
বিলের ধাক্কায় ঘুম ভাঙল সুজয়ের। ভোরের নরম আলো খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘরের ভিতর। চোখ কচলে উঠে বসতেই সুজয় দেখল তার সামনে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছেন মার্কেজ। তিনি যেন কী বলতে গেলেন সুজয়কে। কিন্তু গলা বুজে এল। থরথর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। সুজয় কিছু বুঝতে না-পেরে ফিরে তাকাল বিলের দিকে। তার মুখ গম্ভীর। সুজয় তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
সে জবাব দিল, ‘সুসানকে খুঁজে পাচ্ছি না!’
সুজয় অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’
সে বলল, ‘মিনিট চল্লিশেক আগে ঘুম ভাঙে প্রফেসরের। তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। তিনি উঠে দেখেন সুসান পাশে নেই। প্রথমে ওঁর মনে হয় সুসান হয়তো বাথরুম করতে গেছে। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরও সুসান ঘরে না-আসায় উনি ঘরের বাইরে যান ওকে খুঁজতে। বাইরে তাকে খুঁজে না-পাওয়ায় উনি ফিরে এসে আমাকে ডেকে তোলেন। তারপর আধ ঘণ্টা ধরে আমরা বাড়িটার চারপাশে যতটা সম্ভব পারা যায় খুঁজেছি ওকে, কিন্তু কোথাও সে নেই!’
সুজয় কিছুক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক হয়ে বসে রইল। কম্পিত হাতে মাথা চেপে দাঁড়িয়ে আছেন মার্কেজ। বিলের মুখেও আর কোনো কথা নেই।
একটু ধাতস্ত হয়ে সুজয় বলল, ‘এমনও তো হতে পারে যে সুসান ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে এই প্রাচীন নগরীর গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছে। তারপর আর পথ চিনে ফিরতে পারছে না। আপনারা তো শুধু এই বাড়িটার আশেপাশে খুঁজেছেন, ও রাস্তা ধরে অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকলে? অনেক সময় বাচ্চাদের মনে নানারকম খেয়াল চাপে!’
মার্কেজ এবার কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, ‘কিন্তু ওর জুতো জোড়া তো ঘরের মধ্যেই আছে! খালি পায়ে ও কতদূর যাবে?’
সুজয় দেখল দরজার পাশে সুসানের জুতোটা রয়েছে। একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ও তো আর উবে যাবে না! নিশ্চই এ নগরীর মধ্যেই পথ হারিয়ে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে! ওর ভাষা এখানকার কেউ বুঝতে না-পারার কারণে ও ফিরতে পারছে না। আমাদের উচিত ব্যাপারটা এখনই গিয়ে মিস্টার পিনচিও আর হুইকোকে জানানো। তারপর সবাই মিলে তাকে খুঁজে বার করা।
বিল বলল, ‘আমিও এ কথাটাই ভাবছিলাম, মিস্টার পিনচিওর ওখানে এখনই আমাদের যাওয়া দরকার। তিনি তো কুইলোর প্রাসাদের কাছাকাছি আছেন। আর যাবার পথে যদি সুসানকে দেখতে পাই, তাহলে তো সব সমস্যা মিটে গেল।’
সুজয় উঠে দাঁড়িয়ে মার্কেজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন তাহলে, দেরি করা ঠিক হবে না।’
ঘর ছেড়ে তিন জন বেরিয়ে পড়ল। সূর্যদেব আলো ছড়াতে শুরু করেছেন প্রাচীন নগরীর বুকে। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে চারপাশে জেগে উঠেছে প্রাচীন ঘরবাড়ি, জীর্ণ স্তম্ভ, সৌধের ধ্বংসস্তূপ। তবে কুয়াশার একটা পাতলা আস্তরণ এখনো যেন রয়েছে তাদের গায়ে। হাঁটতে হাঁটতে সুজয় একবার রিস্টওয়াচের দিকে তাকালো। সাড়ে পাঁচটা বাজে। চারদিকে দেখতে দেখতে আন্দাজ মতো কুইলোর প্রাসাদের দিকে এগোল তারা, এবং একসময় প্রাসাদের কাছে পৌঁছেও গেল।
সেখানে আশেপাশে কুইলোর প্রাসাদ ছাড়া বেশ কয়েকটা বাড়ি রয়েছে। কয়েক জন লোক আর রক্ষী রয়েছে চত্বরে। চারদিকে তাকিয়ে বিল বলল, ‘কিন্তু মিস্টার পিনচিও কোন বাড়িটায় আছেন বুঝব কী করে?’
পরমুহূর্তেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। চত্বরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে জোর গলায় হাঁক দিল, ‘মিস্টার পিনচিও আপনি কোথায়?’ তার চিৎকার শুনে চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন রক্ষীরা তাকাল বিলের দিকে। বিল আবার ডাকল, ‘পিনচিও আপনি কোথায়…?’ দ্বিতীয় বারের চিৎকারে বাড়িগুলোর ভিতর থেকে দু-একজন লোক বাইরে বেরিয়ে এল বটে, কিন্তু পিনচিওর সাড়া মিলল না। কয়েকজন রক্ষী এবার ধীরে ধীরে সুজয়দের কাছে এসে দাঁড়াল। তাদের চোখমুখ দেখে মনে হল, তারাও কিছুটা আশ্চর্য হয়েছে, এই সাতসকালে বিদেশিদের চত্বরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে দেখে! বিল আরও কয়েকবার নিষ্ফলভাবে হাঁকডাক করার পর মার্কেজ একজন রক্ষীর কাছে এগিয়ে গিয়ে কুয়েচুয়া ভাষায় বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যে আর একজন বিদেশি এসেছে, সে কোথায় আছে বলতে পারো?’
লোকটা কোনো জবাব দিল না।
মার্কেজ এরপর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা এখানে কোনো বাচ্চা ছেলেকে দেখেছ?’
সেই রক্ষী এবারও কোনো কথার জবাব না-দিয়ে তাকাল তার পাশের রক্ষীর দিকে।
সুজয়ের মনে হল সম্ভবত তারা বুঝতে পারছে না মার্কেজের কথা। বিল আর মার্কেজ এরপর হাত নেড়ে, কুয়েচুয়াতে তাদের বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজেদের বক্তব্য বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না তারা। মার্কেজের উদ্দেশ্যে উদ্ভট ভাষায় একজন রক্ষী কী যেন বলল, তারপর রক্ষীরা ফিরে গিয়ে দাঁড়াল নিজেদের জায়গাতে।
বিল বলল, ‘এভাবে কিছু হবে না। চলুন আমরা কুইলোর প্রাসাদে যাই। হয়তো ওই লোকটা আমাদের কথা অনুমান করতে পারবে!’
সুজয়রা গিয়ে দাঁড়াল শাসনকর্তার প্রাসাদের সামনে। দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন আমাজনীয় রক্ষী। তাদের ভাবলেশহীন মুখ, হাতে ধরা আছে সুতীক্ষ্ণ বর্শা, কাঁধে তির-ধনুক। মার্কেজ তাদের একজনকে বলল, ‘আমরা শাসনকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
মার্কেজের কথা শুনে সে একবার শুধু ভুরু কুঁচকালো। তারপর নিস্পন্দ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
বিল বলল, ‘সম্ভবত এরাও আমাদের কথা বুঝবে না। চলুন আমরা ভিতরে যাই।’ এই বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াতে যেতেই আমাজনীয় দ্বাররক্ষী দুজন বর্শার লাঠি দুটো দিয়ে বিলের পথ আটকে দিল।
মার্কেজ কুয়েচুয়াতে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমাদের ভিতরে ঢুকতে দাও। আমরা শাসনকর্তার অতিথি।’ কিন্তু লোক দুটো পথ ছাড়ল না। বিল ছিল প্রথমে। সে এবার লাঠি দুটো সরিয়ে এগোতে যেতেই বিজাতীয় ভাষায় হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তারা। তারপর একজন আমাজনীয় প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল বিলকে। তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সুজয় আর মার্কেজ। তিনজনেই ছিটকে পড়ল পাথুরে মাটিতে!
আমাজনীয়দের চিৎকার কানে যেতেই চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা ইনকা রক্ষীরাও ছুটে এল সেখানে। সুজয়রা উঠে দাঁড়াবার আগেই ইনকা রক্ষী আর আমাজনীয় দুজনের তীক্ষ্ণ বর্শা ফলকের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গেল তারা। বিল মনে হয় কোমরে হাত দিতে যাচ্ছিল রিভলবারটা বার করার জন্য। কিন্তু তাই দেখে একজন ইনকা রক্ষী এমনভাবে তাঁর বর্শা উঁচিয়ে ধরল যে, সে আর হাত নাড়তে সাহস পেল না।
মাটিতে পড়ে আছে সুজয়রা। তাদের কী করা উচিত তারা বুঝতে পারছে না। ইনকাদের বর্শার ফলাগুলো চারপাশ থেকে উঁচিয়ে ধরা তিনজনের দিকে। সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে সেগুলো। এক-একটা মুহূর্ত যেন এক-একটা ঘণ্টা! হিংস্র চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো। সুজয়ের প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে লাগল, এই বুঝি বর্শার ফলাগুলো ছুটে আসবে তাদের দিকে। ঠিক এমন সময় সম্ভবত চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনেই প্রাসাদের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন কুইলো। তাঁর পিছনে মুখে উলকি আঁকা অস্ত্রধারী আরও দুজন আমাজনীয় দেহরক্ষী।
কুইলো বাইরে আসতেই সুজয়দের ঘিরে ধরা রক্ষীরা তাকাল তাঁর দিকে। শুধু যেন কুইলোর সামান্য ইশারার অপেক্ষা, আর তা পেলেই তারা মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে দেবে এই বিদেশিদের।
কুইলো প্রথমে সব কিছু ভালো করে দেখে দুর্বোধ্য ভাষায় রক্ষীদের সরে যাবার নির্দেশ দিলেন। কয়েক পা পিছু হটে সার বেঁধে দাড়াল তারা। সুজয়রা এরপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কুইলো কুতকুতে চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুজয়দের দিকে। তাঁকে দেখে সুজয়ের মনে হল সম্ভবত সদ্য ঘুম ভেঙেছে তাঁর। মাথায় পালকের সেই বিশাল সাজ এখন তাঁর নেই। কুইলোর উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে মাথা শুদ্ধ একটা পুমার চামড়া শালের মতো জড়ানো। প্রাণীটার মাথাটা এমন ভাবে কুইলোর ডান কাঁধে রাখা যে দেখলে মনে হবে একটা মানুষের দুটো মাথা!
সুজয়রা তিনজন উঠে ধুলো ঝেড়ে কুইলোর সামনে দাঁড়াবার পর মার্কেজ তাঁকে কুয়েচুয়াতে বললেন, ‘মিস্টার পিনচিও, তাঁর সঙ্গী হুইকো কোথায় আছে বলতে পারেন? আমাদের দারুণ বিপদ হয়েছে! আমার সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটাকে খুঁজে পাচ্ছি না! দয়া করে যদি তাকে খোঁজার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে উপকার হয় আমাদের।’
কুইলো মার্কেজের কথা শুনে নিরুত্তর ভাবে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে!
মার্কেজ আবার একই কথা বললেন তাঁর উদ্দেশ্যে। কুইলোর হাবভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। সুজয়রা বুঝতে পারল শাসনকর্তা কুইলোও অন্য ইনকা রক্ষীদের মতোই নিজেদের কথ্য ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বোঝেন না!
অন্যদের মতো এরপর তাঁকেও আকার-ইঙ্গিতে নানাভাবে নিজেদের কথা বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল সুজয়রা। কিন্তু তাদের কথা মিনিট পাঁচেক ধরে শোনার পরও তা বোধগম্য না-হওয়াতে সম্ভবত ধৈর্যচ্যুতি ঘটল কুইলোর। স্বজাতীয় ভাষায় তিনি রক্ষীদের কী একটা নির্দেশ দিয়ে সুজয়দের দিকে পিছন ফিরে পা বাড়ালেন আবার বাড়ির ভিতরে যাবার জন্য।
প্রফেসর মার্কেজ এবার একটা শেষ চেষ্টা করে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘করিকাঞ্চার পুরোহিত ইল্লাপা কি এখনও আপনার প্রাসাদে আছেন?’
ইল্লাপা নামটা কানে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মার্কেজের দিকে ফিরে তাকালেন কুইলো। কয়েক মুহূর্ত তিনি তার দিকে তাকিয়ে থেকে দূরে আঙুল তুলে দেখিয়ে শুধু বললেন, ‘ইনতিহুয়ানাতা।’ এরপর আর তিনি দাঁড়ালেন না। ঢুকে পড়লেন প্রাসাদের ভিতর। আমাজনীয় রক্ষী দুজন এসে দরজা আগলে দাঁড়াল। অর্থাৎ, ভিতরে প্রবেশ নিষেধ!
কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মার্কেজ। সুজয় বলল, ‘কুইলোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ইনকা পুরোহিত ইনতিহুয়ানাতার দিকে গিয়েছেন। তার তো ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করার কথা। তাড়াতাড়ি ওখানে চলুন। ওকে ধরতে পারলেও কাজ হবে!’
বিলও প্রফেসরকে বলল, ‘ও ঠিকই বলেছে। এখনই ইল্লাপার খোঁজে ওখানে যাওয়া প্রয়োজন। হয়তো মিস্টার পিনচিও আর হুইকোও ওখানেই আছে! তা ছাড়া অন্য একটা ব্যাপারও হতে পারে! সেটা হল…’—বিল তার কথা শেষ না-করেই কার্যত ছুটতে শুরু করল ইনতিহুয়ানাতার দিকে। তার পিছনে সুজয় আর প্রফেসর মার্কেজও এগোল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল সূর্যস্তম্ভের শীর্ষদেশ। কাজেই সেটা লক্ষ করে এগোতে তাদের অসুবিধা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে উপস্থিত হল ইনতিহুয়ানাতা চত্বরে।
চত্বরটা একটা টিলার ওপর অবস্থিত। চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। আর তারপর দিগন্ত ব্যাপী মহারণ্য। ভোরের সূর্যালোক এসে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যস্তম্ভের মাথায়, তার চারপাশে ঘিরে থাকা পাথুরে চত্বরে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই, চড়াই জাতীয় ছোটো কয়েকটা পাখি শুধু খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে। ধাপ বেয়ে সুজয়রা এসে দাঁড়াল ইনতিহুয়ানাতার বেদিমূলে। চারপাশে অনেকটা জায়গা দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। না, কোথাও চোখে পড়ছে না ইনকা পুরোহিত বা অন্য কাউকে। বিল বলল, ‘ইনকা পুরোহিত সম্ভবত চলে গেছেন। চলুন এবার আমরা সুসানকে নগরের ভিতর খুঁজতে শুরু করি। মিস্টার পিনচিও তো নিশ্চই এই নগরের ভিতরেই কোথাও আছেন।’ প্রফেসর আশাহত হয়ে বললেন, ‘তাই চলো।’
কথাটা বলার পরই মার্কেজ হঠাৎ দু-পা এগিয়ে মাটি থেকে কী একটা ছোট্ট জিনিস কুড়িয়ে নিলেন। মুহূর্তখানেক সেটা ভালো করে দেখে ফ্যাকাশে মুখে হাতের তেলোটা বাড়িয়ে দিলেন সুজয়দের দিকে। একটা ছোট্ট সোনালি রঙের বোতাম!
মার্কেজ অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘সুসানের জামার বোতাম! কাল রাতে ও এ জামাটাই পরেছিল’!
মার্কেজ সম্ভবত এরপর কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বিল হঠাৎ একটু দূরে মাটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওটা কী!?’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেখানে তাকাতেই চমকে উঠল সুজয়। একটা লাল রঙের ধারা বেদির ওপাশ থেকে বেদিমূলের ধাপ বেয়ে এদিকে এগিয়ে এসেছে। রক্ত! জমাট বাঁধা রক্তধারা! নির্বাক হয়ে সকলে তাকিয়ে রইল সেদিকে। একটা অশুভ চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে গ্রাস করল সুজয়কে! বিলই প্রথম সাহসে ভর করে রক্তধারা অনুসরণ করে বেদির ওপাশে এগিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। ওপাশে বিলের কোনো সাড়াশব্দ নেই! সুজয়ের বুকের ভিতর কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। মার্কেজের মুখ রক্ত শূন্য!
একসময় ওপাশ থেকে বিলের গলার স্বর শোনা গেল, ‘প্রফেসর ভয় পাবেন না, এদিকে আসুন!’
সুজয় আর মার্কেজ তার গলার স্বর শুনে একটু আশ্বস্ত হয়ে বেদির ওপাশে এগিয়ে গেল। তারপর তাদের চোখে পড়ল ব্যাপারটা! ইনকা পুরোহিতের সঙ্গে আনা সেই সাদা রঙের বাচ্চা লামাটা পড়ে আছে মাটিতে। তার কন্ঠনালি ছিন্নভিন্ন! তার দেহ আর চারপাশ লাল হয়ে আছে রক্তে। তার কাছেই এক জায়গাতে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে আছে কিছু ফুল-পাতা।
কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর মার্কেজ বললেন, ‘সম্ভবত ইনতির উদ্দেশ্যে লামাটাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই ভাবে টুমি দিয়ে কন্ঠনালি ছিন্ন করে লামা বলি দেয় ইনকারা! তার মানে ইল্লাপা চলে গেছেন, আর তিনিই সম্ভবত সঙ্গে নিয়ে গেছেন সুসানকে! নইলে তার জামার বোতাম এখানে পড়ে থাকবে কেন?’ মার্কেজের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল, বৃদ্ধ কপাল চেপে ধরে পাথরের ধাপে বসে পড়লেন। সুজয় আর বিল নির্বাক হয়ে রইল।
ভেঙে পড়েছেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ পর বিল সুজয়কে বলল, ‘এখন কী করা উচিত বলোতো? ইল্লাপা কোন দিকে গেছেন কিছুই আমাদের জানা নেই। মিস্টার পিনচিও আর হুইকোও তাদের সঙ্গে গেছেন কিনা তাও বুঝতে পারছি না! সুসান যদি সত্যিই ইল্লাপার সঙ্গে গিয়ে থাকে তবে তাকে আমরা কীভাবে খুঁজব?’
সুজয় একটু চিন্তা করে বলল, ‘ইনকা পুরোহিত গতকাল রাতে বলেছিলেন, চারদিন বাদে তিনি আবার সুসানকে নিয়ে এখানে ফিরে আসবেন। এই চারদিন অপেক্ষা করা ছাড়াতো এই মুহূর্তে অন্য কোনো রাস্তা দেখছি না।’
বিল মার্কেজের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে বলল, ‘কিন্তু তারা যদি আর না-ফেরে?’
এ প্রশ্নের জবাব সুজয়ের কাছে নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো কোনো লাভ নেই। তবুও চলো আমরা একবার নগরীর ভিতর সুসানকে খুঁজে দেখি।’
বিল বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো।’
সে মার্কেজের কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাসের সুরে বলল, ‘চলুন প্রফেসর। আমরা দুজনতো আপনার সঙ্গে আছিই। দেখা যাক কী করা যায়। আপনি ভেঙে পড়লে চলবে না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।’
তার কথা শোনার পর মার্কেজ পকেট থেকে রুমাল বার করে চশমার কাচ মুছলেন, তারপর বিলের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বিল সুজয়কে বলল, ‘আমরা প্রথমে এখান থেকে আমাদের থাকার জায়গাতে একবার গিয়ে দেখব, তারপর নগরীর ভিতর খুঁজতে বেরব।’—এই বলে সে প্রফেসরকে নিয়ে পা বাড়াতে যেতেই হঠাৎ তাদের কানে একটু দূর থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল, সেনর! সেনর!—’
তারা শব্দ লক্ষ করে তাকিয়ে দেখতে পেল কিছু দূরে একটা ভগ্ন প্রাচীরের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা লোক। তারা তার দিকে তাকাতেই সে হাতছানি নিয়ে ডাকল তাদের। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সুজয়রা চিনতে পারল লোকটাকে, সুজয়দের সঙ্গে আসা সেই বুড়ো লামাঅলা! যাকে কাল খুঁজে পাচ্ছিল না হুইকো!
সুজয়রা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা ইশারায় তাদের প্রাচীরের আড়ালে আসতে বলল। সুজয়রা প্রাচীরের ওপাশে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই সে সম্ভবত কুয়েচুয়া ভাষায় মার্কেজকে কী একটা বলল!
তার কথা শুনে মার্কেজ সুজয়দের বললেন, ‘ও বলছে, ও নাকি সুসানকে দেখেছে!’
এরপর মার্কেজ লোকটাকে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু লোকটা হঠাৎ দূরে আঙুল তুলে দেখাল। দূর থেকে দুজন ইনকা রক্ষী ইনতিহুয়ানাতা চত্বরের দিকে আসছে। সম্ভবত সকালবেলা রোদে বেরিয়েছে তারা, কিংবা হয়তো সুজয়দের ওপর নজরদারি করার জন্যই তারা এদিকে আসছে! তাদেরকে দেখাবার পর লামাঅলা আর সেখানে দাঁড়াল না। সুজয়দের তার সঙ্গে আসতে বলে সে প্রাচীরের আড়াল ঘেঁসে এগোল কিছু দূরের একটা দেউলের ধ্বংসস্তূপের দিকে। তাকে অনুসরণ করে সুজয়রা ঢুকে পড়ল তার ভিতর। তারপর তাদের নিয়ে ছাদহীন, চারপাশে দেওয়াল ঘেরা একটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল লোকটা। বাইরে থেকে সে জায়গাটা দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সুজয়রা লোকটাকে ঘিরে দাড়াবার পর প্রফেসর মার্কেজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুসানকে তুমি কোথায় দেখেছ?’ সে জবাব দিল, ‘ইনতিহুয়ানাতাতেই। করিকাঞ্চার পুরোহিতের সাথে। একটা লামার পিঠে বাঁধা ছিল সে। তখনও সূর্য ভালো করে ওঠেনি। তারা চলে গেল!’
‘তারা কোথায় গেছে তুমি জানো! আর কে ছিল তাদের সঙ্গে?’ উত্তেজিত ভাবে জানতে চাইলেন মার্কেজ।
লোকটা বলল, ‘তারা গেছে নিষিদ্ধ নগরীতে। সেনর পিনচিও, হুইকো আর সঙ্গে আছে।’
মার্কেজ বললেন, ‘ওরা যে দিকে গেছে তুমি সে দিকে আমাদের এখন নিয়ে যেতে পারবে? সে পথ তুমি চেনো?’
সে বলল, ‘নগর ছেড়ে তারা এতক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে। নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার রাস্তা আমার জানা নেই। তা ছাড়া আমাকে দেখতে পেলেই রক্ষীরা ধরে নিয়ে গিয়ে ইনতিহুয়ানাতায় বেঁধে পুড়িয়ে মারবে। করিকাঞ্চা পুরোহিত কুইলোকে এ কাজ করতে বলেছেন। কাল রাতে দুজন রক্ষী এই আলোচনা করছিল ইনতিহুয়ানাতার বেদিতে বসে। আমি আড়াল থেকে শুনেছি!’
প্রফেসর এবার লোকটা কুয়েচুয়াতে কী বলছে তা জানালেন সুজয় আর বিলকে। সুজয় শুনে মার্কেজের মাধ্যমে তাকে প্রশ্ন করল, ‘এ ঘটনা যে ঘটবে তা কি তুমি জানতে? তুমিতো ওদেরই সঙ্গে এসেছিলে, তুমি ওখানে গেলে না কেন? ব্যাপারটা একটু খুলে বলতো?
লোকটা দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিল। সে বলল, ‘নিষিদ্ধ শহরে গেলে কেউ আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসে না। সে হল মৃত্যু নগরী। তা ছাড়া, ওদের কথাবার্তা যা শুনেছি, তাতে আর ওরা এপথে ফিরবে না। আমাজনের দিকে চলে যাবে।’
তার কথা শুনে মার্কেজ মৃদু আর্তনাদ করে বললেন, ‘তার মানে সুসানকে নিয়ে তারা আর এখানে ফিরবে না!?’
লোকটা জবাব দিল, ‘ওরা তাই বলেছিল।’
এরপর লোকটা সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আমি প্রথমে এসব ব্যাপার জানতাম না। হুইকো আমাকে বলেছিল, একদল সাহেবকে সে জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে গেলে দিন পিছু একশো ডলার পাওয়া যাবে। কোচা নদী পর্যন্ত যাবে তারা। এত টাকা কেউ দেয় না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখনও আমি জানতাম না যে করিকাঞ্চার পুরোহিত আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। পরদিন যাত্রা শুরুর সময় তাকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম আমি। তবে তখনও ব্যাপারটা সেভাবে আন্দাজ করতে পারিনি। সেটা বুঝতে পারলাম সে দিন রাতে জঙ্গলের মধ্যে আপনারা সবাই তাঁবুতে শুতে চলে যাবার পর। অগ্নিকুন্ডের ধারে আমাদের সবাইকে ডাকলেন করিকাঞ্চা পুরোহিত। তখনই আমি জানতে পারলাম আমরা আসলে তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি নিষিদ্ধ নগরীতে। তবে সবাই নয়, বিদেশিদের মধ্যে শুধু সেনর পিনচিও আর আপনাদের বাচ্চা ছেলেটা সেখানে যাবে। আমাদের এও নির্দেশ দেওয়া হল যে, আপনাদের ওপর যেন সবসময় নজর রাখা হয়, আর কোনো কারণে আপনারা করিকাঞ্চা পুরোহিত আর সেনর পিনচিওর সঙ্গে না-এগোতে চাইলে তাঁদের নির্দেশ মতো আমরা যেন আপনাদের খতম করে দেই। আর এও শুনলাম এই সূর্যনগরী পর্যন্ত আপনাদের নিয়ে আসা হবে, তারপর আপনাদের এখানে ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া হবে নিষিদ্ধ নগরীতে!’
কথাগুলো বলে একটু থামল লোকটা, তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার কথা আর খুনোখুনির ব্যাপার শুনে আমি হুইকোকে বললাম, ‘আমি ফিরে যাব।’ সেনর পিনচিও আমাকে অনেক টাকার লোভ দেখালেন। আমি তবুও সঙ্গে আসতে রাজি ছিলাম না। করিকাঞ্চা পুরোহিত তখন আমাকে ভয় দেখিয়ে বললেন যে ফেরার চেষ্টা করলে আমাকেও গুলি করে মারা হবে! আমি তখনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমাকে ফিরতে না-দিলে সুযোগ মতো পালাতে হবে, আর আপনাদেরও সাবধান করে দিতে হবে। কিন্তু তা আর হল না। রাতে আমি তাঁবুতে ঢুকলাম, সেনর আমার কথা বুঝতে পারলেন না। সারাটা পথ ওরা আমাকে চোখে চোখে রাখল, পালাতে পারলাম না। কাল সন্ধ্যায় ইনতিহুয়ানাতা লোকজনের ভিড়ে সুযোগ এসে গেল, আমি গা ঢাকা দিলাম…।’ কথা শেষ করল লোকটা।
সুজয়রা পুরো ব্যাপারটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বিল বলল, ‘তার মানে, মিস্টার পিনচিও প্রথম থেকেই এই চক্রান্তের শরিক। আমাদের প্রাচীন নগরী দেখাতে আনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুসানকে ঠিকমতো এ পর্যন্ত নিয়ে আসা!’
বিল লোকটাকে মার্কেজের মাধ্যমে প্রশ্ন করল, ‘তুমি জানো, ছেলেটাকে ওরা ওখানে কেন নিয়ে যাচ্ছে?’
সে জবাব দিল, ‘তা ঠিক জানি না। তবে, করিকাঞ্চা পুরোহিতকে একবার সেনর পিনচিওর উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছিলাম, ‘বাচ্চাটা না-থাকলে আমিও ওখানে ঢুকতে পারব না।’
প্রফেসর মার্কেজ সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কন্ঠে বললেন, ‘সবই তো শুনলেন, এখন কী করা যায় বলুন? যে ভাবেই হোক সুসানকে ফিরে পেতেই হবে।’
সুজয় বলল, ‘এই লোকটাই এখন আমাদের ভরসা। ও নিজে নিষিদ্ধ নগরীর রাস্তা না-চিনলেও, ও যদি এমন কোনো সূত্র দিতে পারে যার মাধ্যমে আমরা সেখানে পৌঁছোতে পারি, তাহলে একটা উপায় হয়তো হবে। ওর কর্মপন্থাও আমাদের জানা প্রয়োজন?’
প্রফেসর এরপর লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখান থেকে কোন দিকে যাবে? তোমার এমন কেউ জানা আছে যে ওই নিষিদ্ধ নগরীর রাস্তার সন্ধান দিতে পারে?’
লোকটা বলল, ‘আমি আগে এ নগরীতে না-এলেও অনেক বছর আগে এক সাহেবের সঙ্গে এ নগরীর কাছাকাছি এসেছিলাম। এই নগরীর পুব দিকে পঁচিশ মাইল দূরে চিমু জাতীর একটা ছোটো গ্রাম আছে। এই নগরীর পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেখানে গেছিলাম আমরা। সাহেব গেছিলেন ছবি তুলতে। আজ রাতে আমি ওই গ্রামের দিকে পালাব। ওখানে পৌঁছোতে পারলে তারপর ওদের সাহায্য নিয়ে নদীপথে আমি কোচা নদী পর্যন্ত পৌছোতে পারব। সেখান থেকে আমি একলাই ফিরতে পারব মাচুপিচুতে।
সুজয় তাকে প্রশ্ন করল, ‘তারা তোমাকে সাহায্য করবে কেন?’
সে উত্তর দিল, ‘আমার নাম, টিহুয়াচান।’ চিমু উপজাতির লোক। চিমুরা এমনিতে দুর্ধর্ষ হলেও স্বজাতীয়দের প্রতি তাদের দারুণ টান, তা তারা যেখানেই থাকুক না কেন! প্রয়োজন হলে তারা নিজেদের লোকের জন্য জানও দিতে পারে!
মার্কেজ এবার তাকে বলল, ‘তুমি নিষিদ্ধ নগরীর রাস্তা না চিনলেও সে জায়গা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ দিতে পারো?’
টিহুয়া চান জবাব দিল, ‘শুনেছি জায়গাটা রুক্ষা নেড়া পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানে নাকি বিচামার মন্দির আছে। কাকা কুজকোদের এলাকা সেটা। ওখানে গেলে কেউ ফেরে না। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিচামার সামনে বলি দেওয়া হয়!’
এরপর একটু যেন ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে যে গাঁও বুড়ো আছে তার অনেক বয়স। সে অনেক কিছু জানে। হয়তো সে আপনাদের নিষিদ্ধ নগরীর রাস্তা বাতলাতে পারে। আপনারা চাইলে আমার সাথে সে গ্রামে যেতে পারেন। তারপর নিষিদ্ধ নগরীর সন্ধান না পেলে নয় আমার সাথেই ফেরার পথ ধরবেন।’
টিহুয়াচানের প্রস্তাব শুনে মার্কেজ তাকালেন সুজয়দের দিকে। সুজয় বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে ওর প্রস্তাবটা খারাপ নয়। ওই গাঁও বুড়ো হয়তো আমাদের কোনো আশার আলো দেখাতে পারে। তাছাড়া যত দ্রুত সম্ভব এ নগরী ত্যাগ করা প্রয়োজন। ইল্লাপা আমাদের সম্বন্ধে কুইলোকে কী নির্দেশ দিয়ে গেছেন কে জানে! হয়তো কুইলো যে কোনো মুহূর্তে আমাদের গ্রেপ্তার করবেন! এ সব ঘটার আগেই অন্তত এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া ভালো।’
বিল বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়। আর সে ক্ষেত্রে এই লোকটাই আমাদের একমাত্র সাহায্য করতে পারে।’
প্রফেসর মার্কেজ, সুজয় আর বিল এরপর বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করল নিজেদের মধ্যে। তারপর মার্কেজ টিহুয়াচানকে বললেন, ‘আমরা যেতে চাই তোমার সাথে। কিন্তু কীভাবে পালাব আমরা?’
টিহুয়াচান বলল, ‘আজ সূর্য ডোবার পর ইনতিহুয়ানাতার মাথার ওপর যখন চাঁদ উঠবে তখন ইনতিহুয়ানাতার পশ্চিমে যে ‘আকল্লা কুনা’ আছে তার পিছনে আসবেন। আমি অপেক্ষা করব। ও জায়গাটা ফাঁকাই থাকে। দু-একজন মহিলা রক্ষী ছাড়া সেখানে পুরুষ রক্ষীরা যায় না। ওদের চোখ এড়ানো সহজ হবে। যাবার সময় জায়গাটা দেখে যান। আকল্লা কুনার দেওয়ালে নাক ভাঙা একটা বড় সূর্যমূর্তি খোদাই করা আছে। তার পায়ের নীচে একজন নারী। দেখলে চিনতে পারবেন।’
টিহুয়াচান এরপর দেওয়ালের বাইরে একবার উঁকি মেরে বলল, ‘আপনারা এখন যান, আমিও যাই। রক্ষীরা খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসতে পারে। অনেকক্ষণ আমরা এখানে আছি। আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি আকল্লাকুনাতে থাকব।’
সবাই এরপর সেই চার দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে আসার পর মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল টিহুয়াচান। তাকে আর দেখতে পেল না কেউ। সুজয়রা এগোলো আকল্লাকুনা খুঁজে বার করার জন্য। মাথার ওপর রোদ অনেকটা উঠে গেছে। প্রফেসরের বয়স যেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আরও দশ বছর বেড়ে গেছে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে কত প্রাচীন স্থাপত্য। যা দেখতে এসেছিল সুজয়রা। সে সব দিকে এখন আর তাদের নজর নেই। গভীর চিন্তায় ডুবে হাঁটতে লাগল তারা। কীভাবে পৌঁছানো যাবে সুসানের কাছে?