১০
চারপাশের কৌতূহলী জনতা চুপচাপ তাকিয়ে দেখছে সুজয়দের। তারাও দেখছে তাদের। ইল্লাপা আরও কিছুক্ষণ কুইলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ইশারায় হুইকোকে কাছে ডাকলেন। সে বেদীর ওপর উঠে ইনকা পুরোহিতের কথা শুনে তার পরমুহূর্তেই নীচে ফিরে এসে মার্কেজকে বলল, ‘আপনার সঙ্গের বাচ্চাটাকে ডাকছেন ইল্লাপা।’
‘কেন?’ একটু বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন প্রফেসর।
হুইকো বললেন, ‘এরা বিদেশিদের পছন্দ না-করলেও আমরা সবাই ইনকা পুরোহিতের সঙ্গী বলে আউকুইকননা আমাদের অতিথি বলে গ্রহণ করছেন। এখানকার নিয়ম অনুসারে ওর হাতে উপহার তুলে দিয়ে অতিথি বরণ করতে চাচ্ছেন তিনি।’
তার কথা শুনে মার্কেজ তাকালেন সুসানের দিকে।
সুসান বেশ উৎসাহিত হয়ে তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি যাব ওখানে?’
মার্কেজ বললেন, ‘ডাকছে যখন যাও।’
সুসান এরপর কোনো ভয় না-করে বেশ স্মার্টলি বেদীর ওপর উঠে ইল্লাপা আর কুইলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কুইলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকে নিরীক্ষণ করার পর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে কী যেন বললেন। একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল জনতার মধ্যে। কথা শেষ করে দু-বার হাততালি দিলেন কুইলো। ভীড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল চারজন বাচ্চা মেয়ে। তাদের বেশ সুন্দর দেখতে। কাজল কালো চোখ, পাতা করে আঁচড়ানো ঘন কালো চুলের শেষে দীর্ঘ বিনুনি, পরনে ঝলমলে পোশাক। বয়স মনে হয় দশ-বারো বছর হবে। তাদের মধ্যে মাথায় যে সবচেয়ে বড়ো তার হাতে রেশমবস্ত্রে আবৃত একটা থালা। তারা বেদীর ওপর উঠে কুইলোর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল।
বিল বলল, ‘এরা কি সূর্যকন্যা নাকি!?’
মার্কেজ জবাব দিলেন ‘হতে পারে!’
কুইলো আর ইল্লাপা উঠে দাঁড়ালেন এরপর। থালার আচ্ছাদন সরিয়ে কুইলো একটা সবুজ পাথরের মালা আর একগোছা সাদা সুতলি নিয়ে সেগুলো তুলে দিলেন সুসানের হাতে। তারপর ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে সুসানের কপালটা একটু ঘসে দিলেন। হয়তো এটা তাদের অতিথি বরণের কোনো প্রথা। সুসান জিনিসগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কুইলো জিনিস দুটো তার হাতে দেবার পর বেদীর নীচে সমবেত ইনকা জনতার উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে শুরু করলেন!
দীর্ঘ বক্তৃতা। তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সুজয়। সে প্রফেসরকে প্রশ্ন করল, ‘লোকটা কী বলছে?’
মার্কেজ বললেন, ‘এ ভাষাটা বর্তমানে প্রচলিত কুয়েচুয়া ভাষা নয়। তার পূর্বসূরি স্থানীয় কোনো কথ্য ভাষা। দু-একটা শব্দ ছাড়া আমিও তাঁর কথা বুঝতে পারছি না।’
মিনিট দশেক পর কুইলো বক্তৃতা শেষ করলেন। বেদীর নীচে জমায়েতটা ভেঙে গেল এরপর। সে জায়গাটা মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যাবার পর মাথায় কনডোরের পালক গোঁজা একজন লোক ফুট তিনেক লম্বা রঙবেরঙের পাথর বসানো ধাতব দন্ড নিয়ে বেদীর ওপর উঠে সেটা তুলে দিল কুইলোর হাতে। সুজয়ের মনে হল সেটা শাসনকর্তার দন্ডগোছের কিছু হবে। কুইলো দন্ডটা হাতে তুলে নিয়ে কী যেন নির্দেশ দিলেন সেই লোকটাকে। লোকটা মাথা নেড়ে সুসানকে নিয়ে নীচে নেমে এল। এরপর ওপরে ডাক পড়ল হুইকোর। সে ওপরে উঠে ইল্লাপার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কনডোরের পালক গোঁজা লোকটাকে দেখিয়ে মার্কেজকে বলল, ‘ও আপনাদের থাকার জায়গাতে নিয়ে যাবে এখন।’ তারপর সে পিনচিওর উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনাকে এখানেই দাঁড়াতে বলেছেন ইনকা পুরোহিত।’
পিনচিও তার কথা শুনে সুজয়দের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনারা যান। আমিও যেতে পারলে ভালো হত। সারদিন যা ধকল গেছে, বিশ্রামের দরকার। কিন্তু ইল্লাপার কথা না-শুনলে তিনি আবার রাগ করবেন।’
মার্কেজ বললেন, ‘ঠিক আছে আমরা তাহলে এগোচ্ছি।’
হুইকো এরপর যে দুটো লামার পিঠে সুজয়দের মালপত্র আছে সে দুটো লামাকে টেনে এনে তাদের দড়ি ধরিয়ে দিল কনডোরের পালক গোঁজা লোকটার হাতে। সে দড়িটা হাতে নিয়ে ইশারায় সুজয়দের তাকে অনুসরণ করতে বলল। ইনতিহুয়ানাতাকে বেড় দিয়ে একটা রাস্তা ধরল সে। পথের দু-পাশে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরীর নানা চিহ্ন। কোথাও ছাদহীন জ্যামিতিক আকৃতির ঘর, কোথাও কারুকাজ করা তোরণ বা প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ, কোথাও বা পথের পাশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা স্তম্ভ। দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসতে শুরু করেছে প্রাচীন নগরীর বুকে। দু-পাশের প্রাচীন সৌধগুলো ভৌতিক আকার নিচ্ছে। খন্ডহর নগরীর আনাচেকানাচে অন্ধকার জেগে উঠছে। মার্কেজ লামা নিয়ে চলা লোকটাকে কুয়েচুয়াতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে এখনও কত লোক থাকে?’ লোকটা মনে হয় তাঁর কথা বুঝতে পারল না, সে চুপচাপ চলতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর লোকটা সুজয়দের নিয়ে উপস্থিত হল এটা পাথুরে চত্বরে। সে চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা স্তম্ভ। আর তাকে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের ছাদঅলা সারসার পাথুরে ঘর। হাতে বর্শা নিয়ে বেশ কয়েকজন ইনকা পুরুষ উপস্থিত আছে সেখানে। দুটো লোক জ্বলন্ত মশাল গুঁজছে দেওয়ালের খাঁজে। কনডোরের পালক গোঁজা লোকটা সুজয়দের নিয়ে ঢুকল একটা ঘরে। ভিতরে মশাল জ্বলছে। লোকটা ইশারাতে বুঝিয়ে দিল এ ঘরটাই সুজয়দের থাকার জায়গা। এরপর লামা দুটোর পিঠ থেকে মালপত্র খুলে সেগুলো ঘরে ঢুকিয়ে বিদায় নিল সে।
বেশ বড়ো ঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কাঠের সিলিং, মেঝেতে মাদুর পাতা। একটা গরাদহীন জানলা আছে ঘরে। চারপাশে তাকিয়ে বিল বলল, ‘এদের অতিথিশালাটা দেখছি মন্দ নয়! রাতে ভালো করে ঘুমানো যাবে।’
ঘুমের কথা শোনার পরই সুসান তার হাতে ধরা মালা আর সুতলির গোছটা তার দাদুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো রাখো, আমি এখন ঘুমোব।’ এরপর সে গিয়ে শুয়ে পড়ল মাদুরে।
সুজয়রা এরপর ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করে পোশাক পরিবর্তন করে নিল। জামাকাপড় পালটিয়ে মার্কেজ সুসানের দেওয়া জিনিস দুটো নিয়ে মশালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সবুজ মালাটা মশালের আলোতে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, ‘মালার পাথরগুলো সম্ভবত ‘আনকাট এমারেল্ড!’ সুজয় শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তাহলে তো মালাটার অনেক দাম হবে।’
মার্কেজ তাঁর সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা হয়তো হবে। আর এর যদি কোনো অ্যান্টিক ভ্যালু থাকে তবে আরও বেশি দাম হবে।’
বিল হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করল, ‘পিজরো তার সঙ্গীকে যে হাঁসের ডিমের মতো পান্না দিয়েছিলেন, তা যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবে তার দাম কত হবে?’ প্রফেসর হেসে বললেন, ‘যদিও আমি রত্ন বিশেষজ্ঞ নই, তবে একটা বইতে পড়েছিলাম ওরকম আকারের পান্নার বিনিময়ে অনায়াসে একটা এরোপ্লেন বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোটোখাটো একটা দ্বীপ পাওয়া যেতে পারে। ওর রত্ন মূল্য আর অ্যান্টিক মূল্য দুটোই অসাধারণ।’
বিল শুয়ে পড়ে বলল, ‘ওরকম একটা রত্ন যদি পেতাম, তাহলে বনেবাদাড়ে ক্যামেরা কাঁধে আমাকে আর ঘুরে বেড়াতে হত না।’ তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে সুজয় আর মার্কেজ হেসে ফেলল।
মালাটা দেখার পর মার্কেজ সুতলির গোছাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তাঁর মুখ দেখে সুজয়ের মনে হল তিনি যেন পান্নার মালাটার চেয়ে সুতলির গোছাটার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটা দেখার পর মার্কেজ বললেন, ‘আশ্চর্য! সাদা রঙের সুতোর আড়ালে একটা সোনালি আর তিনটে বেগুনি সুতো কেন?’
সুজয় মার্কেজের কাছে গিয়ে বলল, ‘তার মানে?’
তিনি সুতোগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘এটা হল একটা খিপু। সাদা সুতোর অর্থ হল শান্তি বা আতিথেয়তা। এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু যতটুকু জানি, সোনালি সুতো দিয়ে ‘রাজা বা রাজবংশধর’ আর বেগুনি সুতো দিয়ে ‘রাজবন্দি’ বোঝানো হোত।’ এই দু-রঙের সুতো খিপুতে কেন। ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।’ এরপর তিনি সুতোর গোছা আর মালাটা পকেটে রেখে বললেন, ‘হয়তো ওই দুটো রঙের অন্য কোনো অর্থও থাকতে পারে। আমার তো সামান্য পুঁথিগত বিদ্যা। বইতে ভুলও জানা হতে পারে। তবে খিপু সম্বন্ধে যদি এদের কাছে ভালো করে জেনে নেওয়া যায়, তাহলে সেটাও বিরাট কাজ হবে ঐতিহাসিক মহলে। কারণ, এখনও সব খিপুর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।’
মার্কেজ এরপর আর কোনো কথা না-বলে মাদুরের ওপর শুয়ে পড়লেন। সুসান ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুজয়ও শুয়ে পড়ল তার পাশে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর সুজয়দের ঘরে ঢুকলেন পিনচিও। তাকে দেখে উঠে বসল সকলে। সুজয় তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘এতক্ষণ কি ইনতিহুয়ানাতার ওখানেই ছিলেন?’
পিনচিও পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছে বললেন, ‘ওখান থেকে ইনকা পুরোহিতের সঙ্গে আমি কুইলোর প্রাসাদের দিকে গেছিলাম। ওর কাছাকাছি একটা জায়গাতে আমার আর হুইকোর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আর ইনকা পুরোহিত থাকবেন কুইলোর প্রাসাদে।’
মার্কেজ প্রশ্ন করলেন, ‘ইনকা পুরোহিতের যেখানে যাবার কথা, তার উদ্দেশ্যে কি তিনি কালই রওনা হবেন?’
পিনচিও বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম। তবে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। সব ব্যবস্থা তিনি করে যাচ্ছেন।’ এই বলে হাসলেন তিনি। মার্কেজ এরপর জানতে চাইলেন, ‘আপনি তো অনেকক্ষণ সময় বাইরে ছিলেন, তা কী কী দেখলেন?’ কুইলো লোকটা কেমন?
পিনচিও বললেন, ‘অন্ধকারে তেমন কিছু ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। ভাঙাচোরা ঘর-বাড়ি মন্দির সব ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তবে শুনলাম অনেক কিছুই, অবশ্য তা সবই প্রায় হুইকো আর ইনকা পুরোহিতের মাধ্যমে। এখানে নাকি সূর্যকন্যাদের আবাস, অপরাধীকে পুড়িয়ে মারার স্তম্ভ, এসব কিছুই সত্যি সত্যি আছে। দেবতা ইনতি আর বিচামার উদ্দেশ্যে নরবলিও নাকি হয় এখানে। নগরীতে প্রায় পাঁচশো জন লোক বাস করে। ইনকাদের প্রাচীন নিয়ম মেনেই তাদের জীবনযাত্রা পরিচালিত হয়। আর কুইলো লোকটাকে ভদ্র-সভ্য বলেই মনে হল। তবে তাঁর ‘ন’-জন স্ত্রী, সাতাশ জন সন্তান! স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি সূর্যমন্দিরের পাশে তাঁর প্রাসাদে থাকেন।’
মার্কেজ শুনে বললেন, ‘বাঃ, এর মধ্যেই তো আপনি অনেক খবর সংগ্রহ করে ফেলেছেন!’
পিনচিও হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এবার আসল খবরটা বলি, কুইলো আজ রাতে তার প্রাসাদে আমাদের সকলকে খাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিল তার কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘এতো দারুণ ব্যাপার! তাঁর ‘ন’ জন স্ত্রী যখন তাহলে নিশ্চই ন-টা পদ রান্না হবে! আমার তো এখনই খিদে পাচ্ছে। তা কখন যেতে হবে সেখানে?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘একটু পরেই। আমার সঙ্গে একজন রক্ষী এসেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিয়ে যাবে।’
এরপর আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু ঘরের মধ্যে হঠাৎ এসে প্রবেশ করল হুইকো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে মার্কেজের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, ‘আমাদের সঙ্গে যে বুড়ো লামাঅলাটা ছিল, সে কি এখানে এসেছিল?’
মার্কেজ বললেন, ‘না তো।’
পিনচিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
হুইকো একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ইনতিহুয়ানাতা চত্বর থেকে কোন ফাঁকে যেন উধাও হয়ে গেছে বুড়োটা। তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তাই দেখতে এলাম যদি এখানে এসে থাকে।’
পিনচিও বললেন, ‘লোকটা পালিয়ে গেল না তো! ভারি পাজিতো লোকটা!’
হুইকো তাঁর কথার জবাবে শুধু বলল, ‘আপনারা কুইলোর প্রাসাদে আসুন, আমি আসছি।’ এই বলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পিনচিও স্বগতোক্তির স্বরে বললেন, ‘বুড়োটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পালাতে গেলে জঙ্গলে বেঘোরে মারা পড়বে।’
সুসান ঘুমিয়ে পড়েছে। তার দিকে তাকিয়ে মার্কেজ পিনচিওকে বললেন, ‘ও তো ঘুমোচ্ছে। সারা দিন অনেক ধকল গেছে, একটা কাজ করলে হয় না, বিল আর সুজয় আপনার সঙ্গে ভোজ খেতে যাক, আমি না-হয় এখানে সুসানকে নিয়ে এখানে থাকি!’
তাঁর কথা শুনেই পিনচিও বলে উঠলেন, ‘না না, আপনাকে সেখানে যেতেই হবে। কুইলো না-হলে কুপিত হতে পারেন। তা ছাড়া ইনকা পুরোহিত আপনার সঙ্গে কী একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান।’
মার্কেজ বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে তো যেতেই হবে।’ এরপর তিনি সুসানকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজয়রা ঘর ছেড়ে বাইরে বার হল। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বর্শা হাতে একজন ইনকা রক্ষী। সুজয়দের নিয়ে চলতে শুরু করল সে। মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে। তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে ভগ্নপ্রায় সৌধগুলোর মাথায়। তাদের জঠরে বিরাজ করছে জমাটবাঁধা অন্ধকার। মাঝে মাঝে ছোটোছোটো চত্বরে মশাল হাতে পাহারা দিচ্ছে ইনকা রক্ষীরা। বেশ কিছুটা এগোবার পর পথের পাশে বিরাট একটা মন্দির জাতীয় স্থাপত্য। তার চুড়ো ধসে পড়েছে, সামনে চত্বরে বেশ কয়েকটা স্তম্ভ চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় মিস্টার পিনচিও বললেন, ‘এটা হল প্রাচীন নগরীর সূর্যমন্দির। এই চত্বরেই নকি ওই স্তম্ভগুলোর সঙ্গে বেঁধে শত্রুদের পুড়িয়ে মারা হয়।’
মার্কেজ বললেন, ‘কাল তাহলে এখান থেকেই দেখা শুরু করব আমরা। নিশ্চই এখানে অনেক প্রাচীন হুয়াকা আছে!’
মন্দির থেকে একটু এগোতেই একটা আলোকিত চত্বরে এসে উপস্থিত হল সবাই। বর্শাধারী বেশ কয়েকজন রক্ষী সেখানে পদচারণা করছে। তার একপাশে বেশ বড়ো একটা পাথুরে বাড়ি। কাঠের ছাদ। বাইরের দেওয়ালে মশাল গোঁজা। কুইলোর প্রাসাদ।
প্রাসাদের দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন ভীষণ দর্শন আমাজনীয় রক্ষী। নিশ্চল পাথরের মূর্তি। তাদের পাশ কাটিয়ে প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করল সুজয়রা। তাদের সঙ্গের লোকটা কয়েকটা নীচু ছাদঅলা ঘর পার হয়ে তাদের নিয়ে উপস্থিত হল লম্বাটে ধরনের একটা হল ঘরের মধ্যে। ঘরটা মশালের আলোতে আলোকিত। মেঝেতে মাদুর পাতা। মাথার ওপরের সিলিংয়েও মাদুরের আচ্ছাদন। ঘরের শেষ মাথায় একটা নীচু বেদীর ওপর বসে আছেন ইল্লাপা আর কুইলো। সঙ্গের লোকটা সুজয়দের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেল। তারা সেই বেদীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইল্লাপা ইশারায় তাদের সেখানে বসতে বললেন। তাদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে সুজয়রা বসল বেদীতে। কুইলো একবার সকলকে ভালোভাবে দেখলেন। তারপর ইল্লাপার কানে কানে কী একটা কথা বলে সুজয়দের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। মিনিট তিনেক বলার পর থামলেন তিনি। তারপর মাথা দোলাতে লাগলেন।
মার্কেজ ইনকা পুরোহিতকে বললেন, ‘উনি আমাদের উদ্দেশ্যে কী বললেন? ভাষাটা আমাদের বোধগম্য হল না।’
ইল্লাপা, শাসনকর্তা কুইলোর বক্তব্যের যা তর্জ্জমা করে দিল তা মোটামুটি হল এই,—‘প্রাচীন ইনকা নগরীর শাসনকর্তা ও প্রধান পুরোহিত কুইলো এ নগরীতে বিদেশিদের স্বাগত জানাচ্ছে। বিদেশিরা নোংরা ও ঘৃণ্য জীব। ইনতি পুত্রদের ধর্ম নষ্ট করো তোমরা। ইনতির পবিত্র গ্রামের ওপর তোমাদের দারুণ লোভ। সেই লোভে তোমরা সূর্যপুত্র আতাহুয়ালাপাকে ফাঁসি দিয়েছিলে, টুপাক আমরুর মুন্ড কেটে নিয়েছিলে। তাঁদের আত্মারা যেন তোমাদের পুড়িয়ে মারেন। আমরা বিদেশিদের এ নগরীতে প্রবেশ করতে দিই না। দৈবাৎ কেউ এখানে পা রাখলে তাকে ইনতিহুয়ানাতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু তোমরা কুজকো করিকাঞ্চার মহান পুরোহিতের সঙ্গী। তাই তোমরা আমার অতিথি। আমি তোমাদের রাজকীয় ভোজে আপ্যায়িত সম্মানিত করছি।’
কুইলোর বক্তব্য শুনে বিল মার্কেজকে চাপা স্বরে বলল, ‘নিমন্ত্রণ কর্তা স্বাগত ভাষণটাতো চমৎকার! কিছুই বলতে আর বাকি রাখলেন না!’ মার্কেজ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ওঁর কথা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি কথাই বলেছে ও। এই সুমহান প্রাচীন সভ্যতাকে বিদেশিরাই নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিল স্বর্ণ আহরণ আর ধর্মপ্রচারের অভিলাষে।’
মিনিটখানেক সবাই এরপর চুপচাপ বসে রইল, তারপর বিরাট একটা বারকোষ হাতে ঘরে ঢুকল একজন লোক। তার মধ্যে দুটো পাত্রে খাদ্যদ্রব্য রাখা। বারাকোষটা নিয়ে লোকটা কুইলোর সামনে এসে দাঁড়াল। কুইলো পাত্র দুটোতে ডান হাতের কড়ে আঙুল ছুইয়ে তা জিভে ঠেকাবার পর লোকটা বারকোষটা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের এককোণাতে মশালের কাছে মাটিতে নামিয়ে রাখল। ইনকা পুরোহিতকে এবার কী যেন বললেন কুইলো। তিনি কথাটা সুজয়দের অনুবাদ করে দিলেন,—‘শাসনকর্তা খাবারের আস্বাদ গ্রহণ করলেন, অতিথিরা যেন এবার খাওয়া শুরু করে।’
সুজয়রা বেদী ছেড়ে গিয়ে বসল ঘরের কোনায় বায়কোষের কাছ। বিল যা ভেবেছিল, সেই কুইলোর নয় রানির রান্না করা নয়টি পদ সেখানে নেই। রাজকীয় ভোজ বলতে একটা পাত্রে রাখা আছে সেদ্ধ আলু জাতীয় কন্দ, আর একটাতে কীসের যেনও ঝলসানো মাংস! বেশ খিদে পেয়েছিল সকলের। তারা খেতে শুরু করল। খাবার মুখে তোলার পর সুসান হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা এই বাটিগুলোও কি সোনার?’ তার কথা শুনে পাত্র দুটোর দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠল সবাই। এতক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি, পাত্রদুটো সম্ভবত সত্যিই সোনা দিয়ে তৈরি! বিল একটা পাত্র মশালের দিকে উঁচু করে ধরতেই তার কানটা ঝিলিক দিয়ে উঠল! এরপর মুহূর্তেই কিছুদূরে বসে থাকা কুইলোর সাথে চোখাচোখি হল বিলের। প্রাচীন সভ্যতার রক্ষক কুইলোর চোখে যেন ফুটে উঠেছে একটা হাসি। সে হাসি যেন বিদ্রূপ করছে আধুনিক সভ্যতার প্রতিনিধিদের! পাত্রটা বিল নামিয়ে রাখল।
মার্কেজ বললেন, ‘এ জাতীয় স্বর্ণপাত্র কোনো মিউজিয়ামে নেই! পিজরো বাহিনী শুধু স্বর্ণ লুন্ঠন আর ইনকা সম্রাটদের হত্যাই করেনি। লুন্ঠিত সব স্বর্ণ সামগ্রী গলিয়ে তারা সোনার বাটে পরিণত করেছিল। এটাও তাদের কম বড়ো অপরাধ নয়!
তার কথা শোনার পর সুজয় প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা কুইলো তার বক্তব্যে যে টুপাক আমরুর কথা বললেন, তিনি কে ছিলেন?’
প্রফেসর খেতে খেতে বললেন, ‘তিনি ছিলেন ইনকা সম্রাট, যিনি মাতৃভূমিতে ইনকাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার করার জন্য স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। আত্মসমর্পণ করলে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এই আশ্বাসে পরাজিত সম্রাট ধরা দেন স্পেনীয়দের হাতে। কিন্তু প্রবঞ্চক স্পেনীয়রা কথা রাখেনি। টুপাক আমরুকে সোনার শিকলে বেঁধে কুজকোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর বিচারের নামে এক প্রহসন হয়। ‘দিয়েগো ওর্তি’ নামের এক ধর্মযাজক হত্যার মিথ্যা অপবাদে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শিরচ্ছেদ করা হয়।’
এরপর একটু থেমে তিনি সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাঁকে যখন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন হাজার জনতা পরিবৃত বধ্যভূমির জল্লাদের উদ্যত খড়্গর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি শেষ, যে কথা বলেছিলেন তা হল, ‘ককোল্লান পাচাকামাক রিকুই আউক্কাকুনাক ইয়াহুয়ারনি হি চাস কান কুতা!’ অর্থাৎ, ‘হে আমার মাতৃভূমি, তুমি দেখো শত্রুরা তোমার সন্তানের কীভাবে রক্ত ঝরাচ্ছে!’
মার্কেজ হয়তো এরপর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঘরের ভিতর প্রবেশ করল হুইকো, সকলের দৃষ্টি চলে গেল তার দিকে। সে এসে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল সুজয়দের কাছে। পিনচিও তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি লোকটাকে খুঁজে পেলে?’
সে শুধু জবাব দিল, ‘না,’ তারপর সে সোজা ইল্লাপার দিকে এগিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে কী বলতে শুরু করল!’
খাওয়া শেষ হবার পর আবার বেদীর কাছে ফিরে এল তারা। ইল্লাপা বসতে বললেন সকলকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হুইকো। বিশাল বপু কুইলো তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে। বিশেষত সুসানকে যেন লক্ষ করছেন তিনি। এক জন ভৃত্য গোছের লোক সুজয়দের সামনে পানীয় ভর্তি বেশ কয়েকটা পাথরের গেলাস এনে রাখল।
মার্কেজ গেলাসগুলো দেখে ইল্লাপার দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘চিচা’, পান করুন।’
‘চিচা কী?’ জানতে চাইল বিল।
মার্কেজ বললেন, ‘ইনকাদের প্রিয় পানীয়। বিভিন্ন ফলের বীজ থেকে তৈরি হয়। সাধারণত মাদকহীন। প্রাচীনকালে সূর্যদেবের উৎসবের সময় ইনকা সম্রাট প্রজাদের সাথে একসাথে বসে চিচা পান করতেন।’ কথাগুলো বলে কৌতূহল ভরে একটা গেলাস তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিলেন তিনি। সুজয়ও একটা গেলাসে চুমুক দিল। পানীয়টা অনেকটা ঘোলের মতো। বেশ মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ! বিলও পান করে বলল, স্বাদটা মন্দ নয়। শুধু পিনচিও গেলাসটাতে একটা চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘আপনারা যাই বলুন, আমার কিন্তু স্বাদটা ভালো লাগল না। এক চুমুকেই গা গোলাচ্ছে। সম্রাটরা যে কীভাবে চিচা পান করতেন কে জানে!’
চিচা পান শেষ হবার পর মার্কেজ ইল্লাপার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনিতো কালই চলে যাবেন তাই না?’
ইনকা পুরোহিত জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। কাল ভোরেই ইনতিহুয়ানাতা চত্বরে লামাবলি দিয়ে যাত্রা শুরু করব।’
মার্কেজ এরপর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি যেখানে যাবেন সে জায়গাটা কত দূর?’
ইল্লাপা জবাব দিলেন, ‘আরও দু-দিনের পথ।’ এরপর একটু চুপ করে থেকে ইনকা পুরেহিত মার্কেজের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমি একটা আলোচনা করতে চাই।’
কী আলোচনা? ‘সেখানে আপনি আমাদের নিয়ে যাবেন?’ সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন মার্কেজ।
ইনকা পুরোহিত বললেন, ‘না, সেখানে আপনাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এক বিশেষ প্রয়োজনে আমি আপনার সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। আপনারা এই প্রাচীন নগরী ভালো করে দেখে বেড়ান, কুইলোর সব রকম সাহায্য পাবেন। চার দিন পর বাচ্চাটাকে নিরাপদে এখানে ফিরিয়ে আনব আমি। তারপর সকলে একসঙ্গে কুজকোতে ফিরব।’
ইনকা পুরেহিতের প্রস্তাব শুনে মার্কেজসহ সুজয়রা হতভম্ব হয়ে গেল।
ইল্লাপা আবার বললেন, ‘আপনার আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কুজকো করিকাঞ্চার পুরোহিত যার সঙ্গে থাকে মৃত্যুদেব বিচামাও তাকে স্পর্শ করে না। মহান ইনতি সর্বদা তাকে রক্ষা করেন।’
প্রফেসর মার্কেজ এবার বিস্ময়ের ঘোর কটিয়ে উঠে বললেন, ‘আমি দুঃখিত ইনকা পুরোহিত। একটা অসম্ভব প্রস্তাব করে বসলেন আপনি। এইটুকু ছেলেকে আমি এখানে কোনোভাবেই কাছছাড়া করতে পারব না। এমনিতেই আমার পথে বার বার মনে হচ্ছিল, ওর মতো বাচ্চাকে এ পথে আনা উচিত হয়নি।’ এই বলে ব্যাপারটাকে একটু হালকা করার জন্য ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে তুললেন প্রফেসর।
ইনকা পুরোহিত কিন্তু হাসলেন না। গম্ভীরভাবে তিনি বললেন, ‘আপনারা যেখানে এসেছেন এ জায়গাতে আমি না-নিয়ে এলে আপনাদের আসা সম্ভব হত না। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে কোনো বিদেশি এ মাটিতে পা রাখেনি। দু-এক জন যারা এ নগরীর কাছাকাছি পৌঁছেছিল তারা আর ফিরে যায়নি, আপনারা সৌভাগ্যবান, এ নগরী দেখে নিরাপদে আবার ফিরবেন আপনারা। কিন্তু তার পরিবর্তে আমাকে আপনারা সাহায্য করবেন না?’
মার্কেজ বললেন, ‘আপনি না-নিয়ে এলে এখানে আমার আসা হত না, এ ব্যাপারের জন্য সত্যি সত্যি আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাকে আমার সাধ্যমতো অন্য যেকোনো ধরনের সাহায্য করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু আপনার এ প্রস্তাব মানা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি আমাকে আর এ ব্যাপারে অনুরোধ করবেন না।’ শেষ কথাগুলো বেশ একটু দৃঢ় ভাবেই বললেন মার্কেজ।
সুজয়ের মনে হল মার্কেজের কথা শুনে মুহূর্তের জন্য যেন দপ করে জ্বলে উঠল ইনকা পুরোহিতের চোখ। ক্রুদ্ধভাবে কী যেন বলতে গিয়েও শেষমুহূর্তে নিজেকে যেন সংযত করে নিলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ সময় কারো মুখে কোনো কথা নেই। কুইলো চোখ বন্ধ করে দুলে চলেছেন। ইল্লাপা স্থির-দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মার্কেজের দিকে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে হুইকো চোখের কোটোর থেকে পাথরের চোখটা বার করে গম্ভীর ভাবে সেটা হাতের তেলোতে ঘোরাচ্ছে। সুসান একটু ভয় পেয়ে তাকাল সুজয়ের দিকে। সুজয় তার পিঠে হাত রাখল।
শেষপর্যন্ত নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ইল্লাপা বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা এখন বিশ্রাম গৃহে ফিরে যান। তবে আমার কথা শুনলে ভালো করতেন।’ একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ইনকা পুরোহিতের ঠোঁটের কোণে।
মার্কেজ আর কথা বাড়ালেন না। সুসান বিল আর সুজয়কে নিয়ে বেদী ছেড়ে উঠে তিনি ঘরের বাইরে এগোলেন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সেই লোক, যে তাদের পিনচিওর সঙ্গে এখানে এনেছিল। তার সঙ্গে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে সুজয়রা তার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল।
তাদের পথপ্রদর্শক আগে। একটু তফাতে সুজয়রা। চত্বরের মশালের আলোগুলো নিভে গেছে। চাঁদের আলোয় নীচে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরীর ভগ্নপ্রায় সৌধগুলো। মাঝে মাঝে পথের পাশে দু-একটা গাছ। তারা যেন এ নগরীর রক্ষক প্রাচীন প্রেতাত্মা! তার নীচে জমাট বাঁধা অন্ধকার। সবাই চুপচাপ চলছে। একসময় বিল মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, ‘ইল্লাপার প্রস্তাবটা বড়ো অদ্ভুত ছিল তাই না! আচ্ছা সুসানকে ইনকা পুরোহিত তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন কেন?’
এ প্রশ্নটা সুজয়ের মাথাতেও ঘুরপাক খাচ্ছে। মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘জানি না।’
তারপর একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘ইল্লাপা কিন্তু অসন্তুষ্ট হলেন আমাদের প্রতি। কিন্তু তাঁর বোঝা উচিত তাঁর ওই প্রস্তাবে সায় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
বিল এবার বলল, ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন!, মিস্টার পিনচিও কিন্তু কোনো কথা না -বলে চুপচাপ বসে রইলেন! পিনচিও আর হুইকোর আচরণও একটু অদ্ভুত। আমাদের আড়ালে বেশ কয়েকবার ইল্লাপার সঙ্গে তাদের পরামর্শ করতে দেখেছি। তারা যেন কোনো কিছু গোপন করছেন আমাদের থেকে।’
সুজয় বলল, ‘আমিও ব্যাপারটা লক্ষ করেছি!
সুসান এবার হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি যখন মাথায় পালক গোঁজা পুরোহিতের কাঁধে চেপে যাচ্ছিলাম তখন পিনচিও আঙ্কল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, বাবা-মা কে ছেড়ে আমার এখানে থাকতে মনে কষ্ট হচ্ছে কিনা?’
আমি বললাম, কষ্ট হবে কেন? আমিতো বড়ো হয়ে গেছি! বেড়াতে আমার ভালো লাগছে। তা ছাড়া দাদুওতো সঙ্গে আছে।
এরপর তিনি আমাকে বললেন, ‘ধরো, যদি কেউ তোমাকে এমন কোনো জায়গাতে বেড়াতে নিয়ে যায়, যেখানে দাদুও তোমার সঙ্গে নেই তাহলে থাকতে পারবে তুমি?’—এই কথা বলে সুসান চুপ করে গেল।
তার কথা শুনে একটু অবাক হয়ে মার্কেজ বললেন, ‘কই, কথাটা তুমি আমাকে বলোনি তো! তা তুমি কী উত্তর দিলে? আর কী জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি?’
সুসান জবাব দিল। ‘আমি বললাম, ‘আমিতো বড়ো হয়ে গেছি থাকতে পারব। তবে দাদুর জন্য একটু মন খারাপ হবে।’ এরপর আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি পিনচিও আঙ্কল।’
তার কথা শুনে বলল, ‘ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে মিস্টার পিনচিও, ইনকা পুরোহিতের প্রস্তাবের ব্যাপারটা জানতেন! ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে!’
প্রফেসর একটু চিন্তান্বিত ভাবে বললেন, ‘যাই হোক আমরা যতদিন না-ফিরে যাচ্ছি ততদিন আচার ব্যবহারে ওঁদেরকে খুশি রাখতে হবে। ওরা পথ না-দেখালে আমরা এখান থেকে ফিরতে পারব না।’
এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা পৌঁছে গেল তাদের থাকার জায়গাতে।