১
উকেয়ালি রিসর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সুজয়। আশেপাশের কাঠের বাড়ি-ঘরের মাথার ওপর দিয়ে দূরে নীল আকাশের বুকে জেগে আছে তুষার ধবল পর্বতমালা। দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত। সকালের সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল পর্বতশৃঙ্গ, উদ্ভাসিত এই উপত্যকা। ওই পর্বতমালার নাম আন্দিজ! উপত্যকার নাম কুজকো, আর এ ভূমির নাম ‘ইনকা ভূমি!’ এখন অবশ্য এ দেশের পোশাকি নাম ‘রিপাবলিকা ডেল পেরু’ বা ‘পেরু সাধারণতন্ত্র’। দূরের পর্বতশ্রেণির দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব করছিল সুজয়। বইতে সে কত পড়েছে এই পাহাড়ের কথা। একসময় এই পাহাড়, এই উপত্যকাতেই জন্ম নিয়েছিল সুমহান এক সভ্যতা, ‘ইনকা সভ্যতা।’ যে সভ্যতার কাহিনি আজও হাতছানি দেয় আধুনিক পৃথিবীর মানুষকে। ‘ইনকা’ মানেই ছেলেবেলায় গল্পের বইতে পড়া, সোনার শহর ‘এল ডোরাডো’-র গল্প, ‘ইনকা’ মানেই ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা, গায়ে-মুখে বিচিত্র উলকি আর বিচিত্র পোশাকের বর্শাধারী মানুষ, যারা বসবাস করে আন্দিজ পর্বতে, তার পাদদেশে আমাজনের গহীন জঙ্গলে!
ছেলেবেলার গল্প কাহিনিতে পড়া সোনা-ঝরা ইনকার দেশে সে-যে কোনোদিন উপস্থিত হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সুজয়। না-ভাবাটাই স্বাভাবিক। কারণ কোথায় ইন্ডিয়া, আর কোথায় পেরু! অর্ধেক পৃথিবী সত্যি পার হতে হয় এখানে আসতে হলে। বাঙালি ভ্রমণপিপাসু হলেও ছাপোষা বাঙালির পক্ষে শুধুমাত্র ভ্রমণের জন্য পেরুতে আসাটা একটু কষ্টসাধ্য কল্পনাই বলা চলে। সুজয়েরও এখানে আসা কোনোদিন সম্ভব হত না, যদি না সে যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেই মাইনিং কোম্পানি একটা কাজে তাকে লিমাতে পাঠাত। লিমাতে দিন তিনেক ছিল সুজয়। সেখানে কাজ মিটে যাবার পর ইনকা সভ্যতার পীঠস্থান, কুজকো আর ‘মাচুপিচু’ দেখার লোভ সামলাতে পারেনি সে। এ সুযোগ আর তার জীবনে আসবে না। তার ভিসার মেয়াদ ‘ফুরাতে সপ্তাহ দুই বাকি আছে, সুযোগ আর সময়ের সদব্যবহার করতে রাজধানী লিমা থেকে গতকাল রাতে এসে পৌঁছেছে কুজকোতে।
‘আপনি কি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন?’ প্রশ্নটা কানে যেতেই সুজয় ফিরে তাকিয়ে দেখল, একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন তার পিছনে। তার সঙ্গে বছর দশেকের একটা বাচ্চা ছেলেও আছে। ভদ্রলোকের পরনে ধবধবে সাদা জামা-প্যান্ট, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মাথায় পানামা হ্যাট। তার সাদা চাপদাড়ির সঙ্গে সাদা পোশাক খুব সুন্দর মানিয়েছে।
সুজয় তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘হ্যাঁ। আপনি কীভাবে জানলেন?’ বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, ‘রিসেপশনিস্ট বলছিল, একজন ইন্ডিয়ান যুবক এসেছেন এখানে, আপনাকে দেখে মনে হল আপনি তিনি হবেন।’ এই বলে দু-পা এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি, হোসে মার্কেজ। চিলি থেকে আসছি।’
সুজয় তার সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ‘সুজয় রয়, ফ্রম কলকাতা। এখানে বেড়াতে এসেছি। আপনিও কি টুরিস্ট?’
ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন, ‘তা বলতে পারেন, আবার নাও বলতে পারেন। চিলির ‘ভ্যালপ্যারাইজো ইউনিভার্সিটি’-র ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করতাম আমি। সেখান থেকে অবসর নেবার পর একটা বই লেখার কাজে আমি হাত দিয়েছি। সে প্রয়োজনেই আমার পেরুতে আসা। এর আগেও আমি দু-বার এসেছি এখানে।’
প্রফেসর মার্কেজের পাশে দাঁড়ানো বাচ্চাছেলেটা এবার সুজয়কে লক্ষ করে তার ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি সুসান। তুমি আমার সাথে পরিচয় করবে না?’ তার কথা শুনে সুজয় হেসে ফেলে তার সাথে করমর্দন করে বলল, ‘ও আই অ্যাম সরি। অবশ্যই তোমার সাথে পরিচয় করব।’ প্রফেসর মার্কেজ সুসানের মাথায় স্নেহের হাত রেখে সুজয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এ হল আমার গ্র্যাণ্ডচাইল্ড। ওর বাবা-মা সান্ডিয়াগোতে থাকে। ও থাকে ভ্যালপ্যারাইজোতে আমার কাছে। বাচ্চাটাকে দেখতে বেশ সুন্দর। ফরসা রং, কালো চুল, টানা টানা, ভ্রু-চোখ। সুসানের কপালের ঠিক মাঝখানে হালকা লাল রঙের একটা জড়ুল আছে। প্রথম দর্শনে সেটা দেখলে মনে হতে পারে, কেউ যেন একটা তিলক এঁকে দিয়েছে ছেলেটার কপালে। সুসানের বাঁ-হাতে ধরা আছে একটা বই, ‘টিনটিন ইন আমেরিকা’।
প্রফেসর এরপর সুজয়কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা আজ কি দেখতে যাবেন ভেবেছেন?’ সুজয় তার প্রশ্ন শুনে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আসলে কি দেখতে যাব এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। গাইড বইতে কুজকোর বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থানের নাম দেখলাম ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে কোন জায়গাগুলো বেশি ইম্পর্টান্ট তা আমার জানা নেই। আপনি তো এর আগে এখানে এসেছেন এখানে কোথায় কোথায় যাওয়া যায় বলবেন?’
প্রফেসর বললেন, ‘কুজকো আর তার আশেপাশে ইনকা সাম্রাজ্যের বহুনিদর্শন ছড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিকদের কাছে সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার মধ্যে সাকসাহুয়ামান দুর্গ, করিকানচা সূর্যমন্দির, কুজকোর চন্দ্রমন্দির,—এগুলো অবশ্যই দেখে নেবেন আপনি। ইনকাদের আশ্চর্য স্থাপত্য-কৌশল, তাদের ধর্মীয় চেতনা, বৈভব ইত্যাদি সম্পর্কে তাহলে আপনি ধারণা করতে পারবেন।’-এ জায়গাগুলোর কথা জানাবার পর কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন প্রফেসর মার্কেজ, তারপর বললেন, ‘আমি যে জায়গাগুলোর কথা বললাম তার মধ্যে সাকসাহুয়ামান আর করিকানচাতে যাচ্ছি আমি। আর একটু পরেই বেরব। আরও একজন যাবে আমার সঙ্গে। তবে চারজনের জায়গা হয়ে যাবে গাড়িতে, আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন।’
প্রস্তাবটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিলে সুজয়। সে বলল, ‘এ তো সৌভাগ্যের বিষয়। আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। আপনার মতো মানুষের সঙ্গী হতে পারলে এখানকার ইতিহাস ভালোভাবে জানা যাবে আর দ্রষ্টব্যগুলোও ভালো করে বুঝতে পারব। তবে একটা কন্ডিশন, শেয়ারে যাব কিন্তু।’
প্রফেসর হেসে বললেন, ‘সে দেখা যাবে।’
সুজয় এবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সঙ্গে আর-একজন যিনি যাবেন তিনি কে?’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘একজন আমেরিকান ‘ফটোগ্রাফার। নাম, ‘বিল’। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করার জন্য পেরু এসেছে। কাল এই রিসর্টে আলাপ। আমার বইয়ের জন্য কিছু ছবির দরকার। ওকে কাজটা করার প্রস্তাব দিতেই ও রাজি হয়ে গেল। ওই যাবে আমার সঙ্গে।’
প্রফেসরের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল, ‘হাই প্রফেসর, গুড মর্নিং’। সুজয় দেখল বারান্দার অপর প্রান্ত থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে একজন। প্রফেসরও তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গুড মর্নিং বিল।’ সুজয়ের মনে হল বিলের বয়স তারই মতো অর্থাৎ পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। বেশ লম্বা, ফরসা, একমাথা সোনালি চুল, পরনে জিন্স-টিশার্ট। সে এসে সামনে দাঁড়াতেই সুজয়কে দেখিয়ে প্রফেসর তাকে বললেন, ‘ইনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। আমাদের সঙ্গে যাবেন।’ তাঁর কথা শুনে বিল সুজয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বিল সয়ার। ‘ফ্রম, ‘কানেক্টিকাট,’ ‘ইউএসএ।’
প্রাথমিক পরিচয় পর্বে বিল সম্বন্ধে সুজয় যা জানতে পারল, তা হল, সে একটা ওয়াইল্ড লাইফ ম্যাগাজিনে চাকরি করে। তারই কাজে সে মাস দেড়েক হল ঘর ছেড়েছে। পেরুতে আসার আগে বেশ কিছুদিন ব্রাজিলে কাটিয়েছে সেখানকার বিখ্যাত ‘ব্ল্যাকপ্যান্থার’ অর্থাৎ কালো বাঘের ছবি তোলার জন্য। পেরুতে এসেছে আন্দিজের কেশরহীন সিংহ ‘পুমা’-র ছবি তুলতে।
সুজয়ের সঙ্গে পরিচয় পর্ব মেটাবার পর, প্রফেসর একবার নিজের রিস্টওয়াচের দিকে দেখে বিলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি কি রেডি?’ সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। শুধু ক্যামেরার ব্যাগটা নিতে হবে, আর গায়ে জ্যাকেটটা চাপাতে হবে।’
তিনি শুনে বললেন, ‘তাহলে তুমি নীচে নেমে কাজ দুটো সেরে ফেলো। আমি মিনিট দশেকের মধ্যেই নীচে নামছি। আর রিসেপশনে কাইণ্ডলি একটু বলে দিও যে, আমাদের এই নতুন বন্ধুর লাঞ্চের জন্য আর একটা প্যাকেটও যেন আমার গাড়িতে তুলে দেয়।’
বিল বলল, ‘আচ্ছা।’
বিল চলে যাবার পর প্রফেসর সুজয়কে বললেন, ‘আপনার যদি তৈরি হবার থাকে তবে তৈরি হয়ে নিন। ঠিক আটটায় বাইরে যাব আমরা।’ এই বলে তিনি বিদায় নিলেন।
সুজয়ের তৈরি হবার তেমন ব্যাপার ছিল না। শুধু ঘরে ঢুকে স্নিকারটা পরে নিল। তারপর তার ছোট্ট ক্যামেরাটা নিয়ে ঘর বন্ধ করে কমপ্লিট রেডি হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মিনিট সাতেকের মধ্যেই সুজয়ের ঘরের দুটো ঘর পরে একটা ঘর থেকে প্রফেসর সুসানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর একসঙ্গে তিনজন নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোল।
রিসর্টের লবির ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল জিপ জাতীয় একটা গাড়ি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিল। গায়ে কালো রঙের অনেকগুলো পকেটঅলা হাত-কাটা জ্যাকেট, কাঁধে ক্যামেরা ব্যাগ। সুজয়রা রিসেপশনের কাচের দরজা ঠেলে বাইরে পা রাখতেই সে প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনার গাড়ি এসে গেছে। খাবারও গাড়িতে উঠে গেছে।’ সুজয়রা এসে উঠে বসল গাড়িতে। বিল বসল ড্রাইভারের পাশে। প্রফেসর, সুসান, সুজয় বসল পিছনের আসনে। গাড়ি যখন স্টার্ট নিল, সুজয়ের ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে।
রিসর্ট কম্পাউণ্ডের বাইরে এসে রাস্তায় নামার পর ড্রাইভার দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন জানতে চাইল প্রফেসরের কাছে। প্রফেসরও ওই ভাষাতেই তার কথার জবাব দিলেন। তাঁর কথা শুনে ড্রাইভার ঘাড় নেড়ে অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল। সুজয় কৌতূহল বশত প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি ভাষায় কথা বললেন, স্প্যানিশ?’ প্রফেসর মৃদু হেসে বললেন, ‘না এটা স্প্যানিশ নয় ‘কোয়েচুয়া’ বা ‘কেচুয়া’। পেরুর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোয়েচুয়াতে কথা বলে। কোয়েচুয়া, আইমারা ও স্প্যানিশ-এ তিনটি হল এখানকার সরকারি ভাষা। স্প্যানিশ আমার মাতৃভাষা, কোয়েচুয়াটা শিখতে হয়েছে আমার কাজের জন্য। চিলির পেরু কনসুলেটের এক ভদ্রলোক শিখিয়েছেন, আর আইমারা ভাষা এর আগে এখানে কাজ করতে আসার সুবাদে কিছুটা বুঝতে পারি, তবে বলতে পারি না।’ এই বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন, ‘লিমা, আরেকুইপা, ফ্যালাও, ইত্যাদি বড়ো বড়ো শহরে স্প্যানিশটাই বেশি চলে, তবে এন্টিরিয়ার অঞ্চলে কাজ করতে হলে, স্থানীয় ভাষা জানা থাকলে বাড়তি অ্যাডভানটেজ পাওয়া যায়।’
সুজয়দের গাড়ি মিনিট দশেকের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে উপত্যকার ফাঁকা পথ ধরল। কালো পিচের রাস্তা চড়াই-উতরাই ভেঙে, নানা বাঁক অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। পথের পাশে মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম চোখে পড়ছে। বাড়িঘরগুলো সব কাঠের তৈরি। গ্রাম সংলগ্ন পাহাড়ের ঢালে কফি, আলু, ভুট্টা নানারকম খেত। এ রকমই একটা ছোটো গ্রামের গায়ে পথের পাশে একটা ছোটো খেত দেখিয়ে প্রফেসর সুজয়কে বলল, ‘এটা কীসের খেত জানেন?’ সুজয় খেতের দিকে তাকিয়ে চিনতে না-পেরে বলল, ‘না, এ গাছ আমি চিনি না।’ প্রফেসর বললেন, ‘এগুলো হল, ‘কোকাগাছ।’ যার থেকে নেশার ওষুধ কোকেন তৈরি। পৃথিবীতে কোকাগাছের সর্বাধিক চাষ হয় এই পেরুতে। আর-একটা জিনিস জানবেন, কন্দ বা আলু কিন্তু এখান থেকেই স্পেনীয়দের হাত ধরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আলু আন্দীয় জনগোষ্ঠীর বা ইনকাদের দান। পার্বত্য অঞ্চলে ৯০০০ ফুট উচ্চতায় প্রথম আলুর চাষ শুরু করে তারা।’
আলু বাঙালিদেরও প্রিয় জিনিস। তার উৎস যে এ জায়গা তা জানা ছিল না সুজয়ের। তথ্যটা চমকপ্রদ লাগল সুজয়ের কাছে। সুজয় এর পর প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘গাইড বুকে তো লেখা আছে এই কুজকো একসময় ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, এখানকার ইতিহাস আমাকে একটু বলবেন? তাহলে আমার বেড়াতে সুবিধা হবে।’ বিলও বলল, ‘হ্যাঁ, এ জায়গার ইতিহাস আমিও জেনে নিতে চাই।’ তাদের কথা শুনে প্রফেসর বললেন, ‘কুজকোর ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনই চমকপ্রদ। সংক্ষেপে বলা সম্ভব নয়। তবুও আমি এ জায়গা সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা দেবার চেষ্টা করছি।’ এই বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর জানলার বাইরে তাকিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন—‘আসলে ইনকারা ছিল এক আদীম জনজাতি। আপনারা নিশ্চই পেরুর বিখ্যাত টিটিকাকা হ্রদের নাম শুনেছেন। আন্দিজ পর্বতমালার ৩৮১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত টিটিকাকা বা তিতিকাকা। ইনকারা ওই অঞ্চলেই প্রথমে বসবাস করত। আনুমানিক ১১০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো একসময় তারা তিতিকাকা অঞ্চল ছেড়ে নেমে এসে কুজকোতে বসতি স্থাপন করে। তবে তার আগে এখানে ছিল তিয়াহুয়ানকো, হুয়ারি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বাস। পৃথিবীর প্রত্যেক জনজাতির উৎপত্তির পিছনে একটা করে দৈবকাহিনি আছে। যাকে বলে ‘মায়া কাহিনি’। ইনকাদেরও ‘মায়া কাহিনি’ আছে। সেই কাহিনি অনুসারে তিতিকাকা অঞ্চলে হাজার বছর আগে মানকো কাপাক ও মামা ওকল্লো নামে দুই ভাই-বোন বাস করতেন। একদিন তারা সূর্যদেব ‘ইনতি’-র দৈববাণী শুনলেন, ‘তোমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো। আশেপাশের সবাইকে শিক্ষিত করে তোলো। আমার সোনার ছড়ি তোমাদের পথ দেখিয়ে যেখানে তোমাদের নিয়ে যাবে, সেখানে বসতি স্থাপন করবে তোমরা। সে জায়গা কেন্দ্র করেই জ্ঞানের আলো তোমরা ছড়িয়ে দেবে চারপাশে।’ ইনতির এ ঘোষণার পরই তাদের চোখের সামনে আবির্ভূত হল এক সোনার ছড়ি। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ভাই-বোন। ছড়ি তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন এক উপত্যকায় এসে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছড়ি। সূর্যদেবের নির্দেশ মতো সেই উপত্যকাতেই বসতি স্থাপন করল দুই ভাই-বোন। সেই উপত্যকাই হল এই কুজকো উপত্যকা। মানকো কাপাক আর ওকল্লো এ অঞ্চলে গড়ে তুললেন নতুন সভ্যতা। মানকো কাপাককেই কুজকো নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ও ইনকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। মানকো কাপাকই ছিলেন প্রথম ইনকা সম্রাট। বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক ‘জোশেফ বুমব্লিশ’ তাঁর কাস্কারা নামক গ্রন্থেও এই একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।’
একটু থামলেন প্রফেসর। পাহাড়ি পথের বাঁক ভেঙে এগিয়ে চলেছে সুজয়দের গাড়ি। পথের পাশে পাহাড়ের ঢালে এবার শুরু হয়েছে জঙ্গল। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সম্রাট মানকো কাপাক ১১৯০ থেকে ১২৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কুজকো নগরী গড়ে তোলেন। ‘কুজকো’ শব্দের অর্থ হল, ‘নাভি’। মানকো কাপাক ভেবেছিলেন কুজকোই হল পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সূর্য দেবতা ‘ইনতি’ ও স্রষ্টা দেবতা ‘বীরকোচা’-র উদ্দেশ্যে এই নগরীকে উৎসর্গ করেন। তিনি এখানে ইনতিকানচা-সূর্যমন্দির স্থাপন করেন। মানকো কাপারের পরবর্তী সম্রাটদের প্রত্যেকের আমলেই এই নগরীর উন্নতিসাধন হয়। তবে এ ব্যাপারে চার জন ইনকা সম্রাটের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হলেন, তৃতীয় ইনকা সম্রাট, ‘লোক ইপানকুই’, পঞ্চম সম্রাট’, ‘কাপাক ইপানকুই’, নবম সম্রাট পাচাকুটি ইনকা ইপানকুই ও দশম ইনকা সম্রাট, ‘টুপাক ইনকা ইপানকুই।’ সম্রাট লোক ইপানকুই ১২৬০ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি এখানে এক বিরাট বাজার তৈরি করেছিলেন। যার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়। ওই স্থায়ী বাজারে আন্দিজ পর্বতমালার নানা প্রান্তের মানুষ ব্যবসা করতে আসতেন। এ ছাড়া তিনি কুজকো নগরীতে ‘আকলাহুয়াসি’ নির্মাণ করান। এই আকলাহুয়াসিতে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুন্দরি মেয়েদের এনে রাখা হত। তাদের উৎসর্গ করা হত সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে। তাদের বলা হত ‘সূর্য্য-কন্যা’। অনেকটা আপনাদের দেশের হিন্দু মন্দিরের দেবদাসীর মতো। তবে, সূর্য-কন্যাদের অনেক সময় বলিও দেওয়া হত। কাপাক ইপানকুইয়ের আমলে কুজকো নগরীর সর্বাধিক উন্নতি হয়। ঐতিহাসিক গার্সিলাসো দালা ভেগার রচনা থেকে জানা যায় যে, কুজকো নগরীর আশ্চর্য্য স্থাপত্য তার আমলেই বিকশিত হয়। বহু-রাস্তাঘাট-সেতুও তিনি নির্মাণ করান। সেচ ও নগরীর জল নিকাশিব্যবস্থাও তিনি গড়ে তোলেন। নবম সম্রাট পাচাকুটি ইনকা ছিলেন ইনকা সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি ১৪৩৮ থেকে ১৪৬৩ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর আমলে কুজকোসহ সাম্রাজ্যের সর্বাধিক উন্নতি হয়। আক্ষরিক অর্থে শুধু নয়, পাচাকুটির আমলে সত্যি সত্যিই নগরীর প্রধান সৌধগুলো ছিল সোনায় মোড়া। আর দশম ইনকা সম্রাট কুজকো নগরীকে প্রসারিত করেন। আমরা যে সাকসাহুয়ামান দুর্গ দেখতে যাচ্ছি, তার নির্মাণও সম্পূর্ণ করেন দশম ইনকা টুপাক ইনকা ইপানকুই। এই ভাবে মানকো কাপাকের রাজত্বকাল থেকে টুপাক বা টোপা ইনকার রাজত্বকাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিনশো বছর ধরে গড়ে ওঠে কুজকো। টোপা ইনকার পরবর্তী আমলে, হুয়ানাকাপাক, হুয়াসকার বা সম্রাট আতাহুয়ালপা-র আমলেও কুজকোর বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই কুজকোকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্য ছিল তার বিস্তার ছিল লম্বায় ২৫০০ মাইল, ইকুয়েডর থেকে চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত। ইনকা সাম্রাজ্যের এককোটি কুড়ি লক্ষ মানুষের রাজধানী ছিল এই কুজকো। নগরীর কেন্দ্রস্থলে ছিল ‘ইনকা প্রাসাদ’ বা ‘হাউজ অভ সান’। সূর্য পুত্র ইনকা সম্রাটরা বসবাস করতেন সেখানে…।
প্রফেসর মার্কেজ বলে যেতে লাগলেন কুজকোর ইতিহাস। সুজয় শুনে যেতে লাগল তার কথা। ইনকাদের নামগুলো একটু খটমট শোনালেও কুজকোর কাহিনি শুনতে ভালোই লাগছিল তার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তারা এসে উপস্থিত হল উন্মুক্ত এক পাহাড়ি প্রান্তরে। সেখানে তাদের চোখে পড়ল দূরে, অনেক উঁচুতে পাশাপাশি দুটো পাহাড়ের গায়ে বেশ অনেকটা অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে আছে বিশাল এক স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। তাই দেখে এতক্ষণ পর সুসান হঠাৎ তার দাদুর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘ওইটা কি?’ প্রফেসর মার্কেজ জবাব দিলেন, ‘ওই হল সাকসাহুয়ামান দুর্গ। ওখানেই এখন যাব আমরা।’ এরপর তিনি সুজয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কুজকো নগরীর উত্তর দিকে এখন উপস্থিত হয়েছি আমরা। বলতে পারেন ওই দুর্গই হল কুজকোর সীমারেখা। স্পেনীয়দের আক্রমণের সময় ইনকারা নগরী ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল ওই দুর্গে। মানকো কাপাক স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালান সাকসাহুয়ামান থেকে। ‘সাকসাহুয়ামান’ শব্দটা আমরা এক সঙ্গে উচ্চারণ করলেও আসলে কিন্তু তা দুটো শব্দ,—সাকসা, হুয়ামান। অর্থাৎ ‘তৃপ্ত-বাজপাখি’। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজয়দের গাড়ি পৌঁছে গেল সাকসাহুয়ামানের কাছে।