‘সুখ সুখ’ মুক্তো – আশাপূর্ণা দেবী

‘সুখ সুখ’ মুক্তো

আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই বিশাল প্রাসাদখানায় অনেক লোকের বাস। তবে রাজারাজড়াদের আকাশ-চুম্বি প্রাসাদের মতো একনায়ক আধিপত্যের ব্যাপার যে নেই এখানে, তা সকলেই জানে।

আজকাল বড় বাড়ি মানেই তো ছোট বাড়ি। ছোট পরিবার। যার অর্থ সুখে মগ্ন পরিবার। এই বিশাল বাড়িখানার নামও তাই ‘সুখনীড়’।

এই সুখনীড় যেন এই একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে যাকে বলে নানা ভাব নানা ভাষা, নানা পরিধান! তবে এই বিবিধের মাঝে কোন মহান মিলনের পরিচয় পরিস্ফুট নয়।

কে কার কড়ি ধারে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে যার সঙ্গে যার যেটুকু দেখা হয়ে যায়। সেও প্রধানত প্রবণতা অপর পক্ষের ছায়া বাঁচিয়ে দৃষ্টি এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে পড়া অথবা উঠে পড়া।

বারে বারে দেখার সূত্রে মোটামুটি একটু মুখ চেনা হয়ে যায়, কাজেই দৈবাৎ—সরাসরি চোখাচোখি হয়ে গেলে একটু একটু সৌজন্য হাসির বিনিময়, একটু ঘাড় নাচিয়ে ইসারায় প্রশ্ন—ভালো তো?…. এই পর্যন্ত।

মোটামুটি এই।

তবে ওরই আড়ালে অন্তরালে স্বেচ্ছাকৃত দৃষ্টিবিনিময় পাশ কাটাবার বদলে, পাশ ঘেঁষে ওঠা বা নামার কৌশল এবং নামা ওঠার সময়টাকে একটু ছন্দবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা, এসব কি আর হয় না? হয়তো নিশ্চয়ই কিন্তু সে খবর অসীমার গোচরে যে কী ভাবে এসে যায়, সুব্রত জানে না।

অসীমা যখন সুব্রতকে জ্ঞান দিতে আসে অজ্ঞান সুব্রত অবাক হয়ে ভাবে এত খবর অসীমা রাখে কী করে?

অথচ অসীমা তো ঘোরতর একটি কর্মী মহিলা। তার মহিলা সমিতি (লম্বা-চওড়া একটা নাম অবশ্য আছে ডজন দুই লেটার সম্বলিত) দক্ষিণ কলিকাতায় একটি বিশেষ নাম। যথার্থ সমাজসেবী বলে খ্যাত আছে এ সমিতিটির।

সুব্রত অসীমার গুণগরিমায় মুগ্ধ, তবে ওর বেশি নয়। কী কী কাজকর্ম হয় ওদের, সপ্তাহে সপ্তাহে কিসের অধিবেশন হয়, অথবা মাঝে মাঝে কিসের মিটিং, সুব্রত জানে না। সুব্রত জানে ওগুলো সুখে থাকতে ভূতের কীল!

সুব্রত হচ্ছে ওই পাশ কাটানোর দলে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে সুব্রত এই সুখনীড় ভবন-এর কোন একটু গভীর খাঁজের মধ্যে একটু নীড় জোগাড় করে ফেলে এখন বড় আনন্দে আছে।

তবে জোগাড় করে ফেলার ক্রেডিটটা সবটাই অসীমাকে দেওয়া উচিত।

দারুণ করিৎকর্মা মেয়ে অসীমা, নিদারুণ চৌকস!

সুব্রত যে বলে, আমি তো তোমার আগ্রহের আশ্রিত প্রজা, তোমার কৃপাতেই সুখের তরণী ভাসিয়ে তরঙ্গ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছি, সেটা ঠাট্টা করে বললেও প্রকৃত সত্যি।

সুব্রতকে তার অফিসের কাজটুকু ছাড়া, আর কিছু তাকিয়ে দেখতে হয়? হয় না।

অথচ এ যুগে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য অনেক কাঠখড়েরই তো দরকার? এবং সেই কাঠখড় পোড়াতে অনেক তেল। সে সবের ধারই ধারতে হয় না সুব্রতকে। বড় নিশ্চিন্ত সুব্রত।

বড় সুখী!

এই যে এখন?

সুব্রতকে তার অফিসের গাড়িটি নিত্যনিয়মে তার সুখনীড় ভবনের দেউড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল, এরপর আর কী ভাবনা আছে তার?

নাঃ। কোনো ভাবনা নেই। নীড়ে ঢুকে পড়তে পারলেই হাতের মুঠোয় স্বর্গ।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে সুব্রত আস্তে আস্তে।

একটু অসুবিধে, সুব্রতর ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায়।

তো কী আর করা?

পেয়েছে এই ঢের। পঁচাশি হাজারের মধ্যে এরকম ফ্ল্যাট এখন আর পাবে কেউ? অসীমার প্রবল প্রেরণায় লোন-ফোন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাই।

অবশ্য ফ্ল্যাট কেনার সূচনা থেকেই শোনা গিয়েছে লিফট হবে। তার প্ল্যান রয়েছে, জায়গাও ঠিক রয়েছে। তবে কবে হবে সেটা এখন আর কেউ জানে না।

উঁচুতলার বাসিন্দারা তাদের আত্মজনকে গৌরব করে খবরটা পরিবেশন করে বলে, লিফটা হলেই ব্যাস!

তা সেই ভবিষ্যৎ নিকটের স্বপ্ন দেখতে দেখতে সিঁড়ি ভাঙার কষ্টটা যেন কিঞ্চিৎ লাঘব হয়ে যায়।

আবার—

উঠতে উঠতে যখন দেখা যায় সহযাত্রী হঠাৎ গতিছন্দ ভঙ্গ করে পাশের দিকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দরজার গায়ে আঙুলের টিপি সাড়ে আর টুক করে একটু চিচিংফাঁক হয়ে যাওয়া গহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন ঈর্ষা হয়। ……আবার যখন নিজে সেই ভাগ্যের অধিকারী হয়ে তাকিয়ে দেখে ছতলা সাততলারা তখনো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে উচ্চমার্গে উঠে চলেছে, তখন বেশ একটা আত্মতৃপ্তির ভাব আছে। নিজেকে বিজয়ী বিজয়ী বলে মনে হয়।

পাঁচটা তলা উঠতে পারলেই তো ব্যাস! বেল টিপে সেই চিচিংফাঁকের মধ্যে ঢুকে পড়া এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা চেপে বন্ধ করে ফেলে বহিঃপৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা। একার সাম্রাজ্য। বাইরে থেকে কেউ চোখ ফেলবে এমন পথ নেই।

এই সুখনীড়ের বাসিন্দারা কেউ এমন অভব্য নয় যে, হঠাৎ বেল টিপে এসে ঢুকে পড়ে আড্ডা দিতে বসবে।

অতএব খুব নিশ্চিন্ত মনে ঢুকে পড়ে সামনের ডাইনিং-কাম-ড্রইং রুমে পাতা আরামদায়ক সোফাটিতে বসে পড়ে। জীবনের পরম সাফল্যের স্বাদটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা।

তবে ইদানীং একটু ফাঁকা-ফাঁকা ভাব হত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই অসীমাকে দেখতে পাওয়া যাবে না। অসীমাদের সমিতি থেকে সম্প্রতি একটা বয়স্ক শিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে, বেশ মোটা হাতে সরকারি অনুদান পাওয়া যাচ্ছে। এই শিক্ষণকেন্দ্রের ইভনিং ক্লাসের ভার নিয়ে বসেছে অসীমা।

অসীমার এই দুম করে সান্ধ্য ক্লাসটা নেওয়ায় সুব্রত একটু খুঁৎ খুঁৎ করেছিল, কিন্তু অসীমার ঝঙ্কারের ধাক্কায় যে খুঁৎখুঁতুনি মুহূর্তে পালাতে পথ পায়নি।

অসীমা তার টানা টানা চোখ আরও টান টান করে প্লাগ করে তুলে ফেলা ভুরুর আঁকা রেখায় পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, সমাজের মানুষ বলে পরিচয় দিতে হলে সমাজের জন্যে কিছু করতে হয় বুঝলে?

তবু সাহসে ভর করে বলেছিল সুব্রত, আরে বাবা করছও তো অনেক। শুনি তো দুপুরে বস্তি-ফস্তিতে ঘুরে ঘুরে—তাদের জন্যে কত কী কর তোমরা।

তাদের জন্যে? তাদের জন্যে কিছুই করতে পারা যায় না! কী অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে যে কাটায়! মিসেস মজুমদার তো বলেন প্রতিটি মানুষের উচিত এদের জন্যে কিছু করা। তোমার মতো উদাসীন মনটা পেলে অবশ্য সুবিধে হত আমার। কিন্তু মনটা নিয়েই যে হয়েছে যত প্রবলেম!

তথাপি সুব্রত পিঙ্কির কথা তুলেছিল।

আমার তো ফিরতে প্রায় সাতটা বাজে, ও বেচারী বড় একা হয়ে যায়।

অসীমা সে প্রশ্নও নস্যাৎ করে দিয়েছিল।

একা আবার কী? গীতা থাকে। টি ভি আছে। তাছাড়া ওর পড়া নেই? আমি সন্ধেবেলা তোমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকব?

এই সুখনীড়ের পাড়ায় এসে অসীমার চাল-চলন আমূল বদলে গেছে, শুধু কথার ভঙ্গীতে মাঝে মাঝে খাস কলকাতার দর্জিপাড়া উঁকি দিয়ে বসে। জন্মাগার বলে কথা!

তা সে ভঙ্গীটা তো অসীমা বাড়িতে ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ করতে যায় না?

স্ত্রীর মহিমায় সুব্রত এখানের অনেকেরই ঈর্ষার পাত্র। রূপটাও তো কম নয় অসীমার।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সুব্রত একবার হাত উল্টে ঘড়িটা দেখে নিল। সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট। ঠিক সময় মতই এসে গেছে। এক একদিন রাস্তায় জ্যামে পড়ে গিয়ে যা অবস্থা হয়।

আর একটা তলা উঠতে পারলেই সন্দেহভঞ্জন, তবু সুব্রত ভাবতে চেষ্টা করল, আজ অসীমার অফ আছে কিনা। সপ্তাহে দুদিন করে অফ থাকে। সেদিন সকাল করে ফেরে অসীমা। বাড়ি ফিরে দেখতে পাওয়া যায় তাকে। মানে হাতে চাঁদ পাওয়া অথচ এমনি আশ্চর্য কিছুতেই মনে রাখতে পারে না সুব্রত, কোন কোন বারে ক্লাশ থাকে না অসীমার।

অনেকবার জিগ্যেস করা আর ভুলে যাওয়া হয়ে গেছে, এখন আর তাই বেরোবার সময় লজ্জায় জিগ্যেস করতে পারে না।

এখন তাই চারতলা পর্যন্ত উঠেও সুব্রত মনে মনে হিসেব করতে চেষ্টা করল, কোন কোন বারে কেন? আজ কী বার?

বেল বাজানোর পর যদি অসীমা এসে দরজা খুলে দেয়, শুধু সুব্রতর মনটাই নয়, সারা বাড়িটাই যেন বেশি পাওয়ারের আলোয় ঝলসে ওঠে।…. অনুভব করা যায় সুখ জিনিসটা কাকে বলে।

আজ আর সে অনুভূতি আসার সুবিধে হল না। দরজা খুলে দিল গীতা।

পিঙ্কির ছোট হয়ে যাওয়া ফ্লক পরে, বাড়ন্ত গড়ন হৃষ্টপুষ্ট গীতাকে যেন কেমন বোকা, চোর-চোর লাগছে।

সুব্রত বলতে গেল, কী রে, মাসিমা নেই? কিন্তু বলল না। একটু লজ্জা করল। নেই তা তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে।

বসল সোফাটায়।

সিঁড়ি ভেঙে তেষ্টা পেয়ে গেছে।

জল চাইল একটু।

গীতা জল আনতে গেল।

সুব্রত পরিতৃপ্ত, পরিতৃপ্ত চোখে একবার পরিবেশটি অবলোকন করে নিল।

বলতেই হবে বাহাদুরী আছে অসীমার। এই সুখ-স্বর্গটুকুতে, যেখানে যা সাজে ভাল করে সাজিয়েছে। বাঁকুড়ার ঘোড়া থেকে ঘূর্ণির দুর্গাপুতুল, কোথাকার যেন লক্ষ্মীর সরা, তার সঙ্গে দেওয়ালে নেপালী থালাও। দেওয়ালে এয়ার-ইন্ডিয়ার ক্যালেন্ডার। কী নয়?

আর আশ্চর্য, সারাদিনই তো অসীমা বাড়ির বাইরে, কিন্তু বাড়িটি সারাক্ষণ ঝকঝকে চকচকে।

জল খেয়ে গেলাশটা গীতার হাতে নামিয়ে দিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে জিগ্যেসই করে ফেলল সুব্রত, তোর মাসিমা কখন আসবে, কিছু বলে গেছে?

কই? কিছুতো বলে যায় নাই!

সুব্রত আশ্বস্ত হল।

বলে যখন যায়নি, বাড়তি দেরি কিছু হবে না।

হাতমুখ ধুয়ে ন্যান মেসোমশাই। বলে গীতা চায়ের জল চাপাতে গেল। সুব্রত চলে এল ঘরের মধ্যে!

অন্যদিন ঢুকেই টেলিভিশনের উপস্থিতি অনুভব করে, আজ তার সাড়া নেই। মাত্র দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট, তবু কেমন যেন খাঁ-খাঁ করা লাগল!

পিঙ্কি পড়ার টেবিলে ঝুঁকে গল্পের বই পড়ছিল, বাবাকে আসতে দেখে সেটা নিঃশব্দে কৌশলে বড় খাতার তলায় চালান করল। এই বড় খাতাখানা বোধহয় ম্যাপ-ট্যাপ আঁকার। মাঝে মাঝেই ওসব এঁকে দিতে হয় সুব্রতকে। যেমন অসীমাকে মেয়ের স্কুলের সেলাই বোনাগুলো করে দিতে হয়।

সুব্রত অবশ্য সাহস করে বলে উঠতে পারল না, কী পড়ছিলি রে?

না, এত সাহস নেই সুব্রতর। মেয়েকে শাসন করা তো দূরস্থান, এই প্রশ্নটুকু করারও! হলেও মাত্র ক্লাশ নাইনের ছাত্রী, এ ধরনের প্রশ্ন করলে দলিতা ফণিনীর মত ফোঁস করে উঠবে।

ওপথে গেল না সুব্রত।

দেখল মেয়ের টেবিলে এক গ্লাস দুধ।

সেই কথাটাই সে পাড়ল, তোর দুধ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে?

পিঙ্কি বাপকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে আসবার প্রয়োজন অনুভব করল না, যেমন বসেছিল সেইভাবেই বসে থেকে অবজ্ঞাভরে ঠোঁট উল্টে বলল, বহুক্ষণ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

আরে সে কী? ঠিক সময় খেয়ে নিতে হয়তো? গীতাকে বল আর একবার গরম করে দিতে।

বলতে হল না, গীতার কানে আপনিই গেল। এই সাড়ে আটশো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটে কারও কোনো কথাই কারও কর্ণগোচর হতে বাকি থাকে না।

গীতা এগিয়ে এসে গেলাশটা তুলে নিয়ে বলল, দুবার গরম করা হল, দুবার ঠাণ্ডা হল।

সুব্রত বলল, সে কী, কেন? খিদে নেই?

গীতা বলল, মাসিমা বাড়ি না থাকলে তো দিদি দুধ খেতে চায় না।

পিঙ্কি কড়া গলায় বলে উঠল, ফের সর্দারী? বড্ড বাড় বেড়েছ না? ফেলে দিগে যা দুধ!

সুব্রত এই কথান্তরের মধ্যে নাক গলাতে ভরসা পেল না। মেয়ের মার ওপর যদিবা কিছু বাদ প্রতিবাদ চালানো যায়, মেয়ের ওপর নয়। সাহস করে কথা বলা যায় তখনই, যখন বাপি বলে গলা ধরে ঝুলে পড়ে। তখন কৃতার্থমনা হয়ে সেই মুড ভাল থাকা মেয়ের সঙ্গে গাল-গল্প হয়। দেখা যাচ্ছে আজ মেয়ের মুড ভাল নেই!

একটু মায়া হল সুব্রতর।

কিসেই বা ভালো থাকবে? এই নিথর নিঃস্তব্ধ বাড়িতে শুধু পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বসে থাকা, সঙ্গ বলতে ওই গীতা! ভেবে চিন্তে একটা নিরীহ প্রশ্ন করল সুব্রত, টি ভি আজ নীরব কেন?

পিঙ্কি মুখ বাঁকিয়ে বলল, বাজে প্রাোগ্রাম। বন্ধ করে দিয়েছি।

বই খুলল।

সেই চাপা দেওয়াটা নয় অবশ্য।

সুব্রতর মনে হল, অসীমাকে একবার বলতে হবে, একটু লক্ষ্য করো তো, পিঙ্কি কী বই-টই পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে অসীমার সেই বিদ্রুপরঞ্জিত এবং লিপষ্টিক রঞ্জিত ঠোঁটটা মনে পড়ে গেল। সুব্রতকে ওরকম কথা বলতে দেখলে ঠিক ওই বিদ্রুপ হাসিটি হেসে বলবে অসীমা, ওরে ব্বাস! পিতৃ কর্তব্য সম্বন্ধে খুব হুঁশিয়ার হয়েছ তো? ওর বয়েসটা একটু মনে রেখ। টিনএজারদের বেশি ট্যাকল করতে যাবার চেষ্টা করতে নেই।

গীতা বলল, মেসোমশাই, চা ঢালব?

ঢাল। এই চায়ের সঙ্গে বেশি কিছু দিস না।

মেয়েটা বিশেষ স্বল্পভাষিণী নয়, সুযোগ পেলেই একটু বাড়তি কথা কয়ে নেয়। তবে এই সুযোগটা প্রায়শঃ মেসোমশাইয়ের কাছেই জোটে। মাসিমা তো সব সময় বলে, বেশি কথা বলার দরকার নেই, চুপচাপ কাজ কর তো।

আর দিদি বলে, কথার ওপর কথা বলবি তো থাপ্পড় খাবি। বকবক করার ইচ্ছে থাকে তো ঘর থেকে বেরিয়ে যা!

একদিন বলতে চেষ্টা করেছিল সুব্রত। আহা ছেলেমানুষ, বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, হয়তো অনেক ভাই-বোনের মধ্যে মানুষ হয়েছে, সুব্রতর সেই সহানুভূতিটি পিঙ্কির হাসির খোরাক হয়েছিল। বলেছিল, বাপী, তুমি এবার ধর্মযাজক হয়ে পড়ো।

আর অসীমা ওই সহানুভূতিটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল।

একেই তো কুঁড়ের সর্দার বাক্যবাগীশ, ওর ওপর যদি মেসোমশাইয়ের প্রশ্রয় পায় তাহলে তো আর রক্ষে নেই। ও লোনলি ফীল করছে বলে ওর সঙ্গে গল্প করতে হবে?

তা এখন মাসিমা বাড়ি নেই!

কাজেই গীতার স্বভাবটা বাক্সর ঢাকনি খোলা হয়ে বেরিয়ে পড়ল। অতএব বলে উঠল বেশি আবার কোথায় কী পাব মেসোমশাই? গ্যাস তো জবাব দিল।

এই সেরেছে। তাই বুঝি?

হ্যাঁ এই একটু আগে রাঁধতে রাঁধতে গেল। তা’লে শুধু বিস্কুট দেব?

তাই দে।

বাড়ির গিন্নী বাড়িতে না থাকলে যেন বাড়ির লোকের ক্ষিধে-টিদেও কমে যায়।

চায় ধোঁওয়া গন্ধ কেন রে গীতা? মুখটা একটু কুঁচকে প্রশ্ন করে সুব্রত।

গীতা থতমত খেল।

ধোঁয়া গন্ধ? ধোঁয়া গন্ধ কোথা থেকে আসবে মেসোমশাই? একি আমাদের মজিলপুর? যে পাতানাতা জ্বেলে চায়ের জল গরম করা! তাতে ধোঁয়া গন্ধয় ভর্তি। জানেন মেসোমশাই, এখন একদুদিন যে বাড়ি যাই, ওখেনে চা খেতে পারিনে। তবে হ্যাঁ, আজ এখেনে কেরোসিনের গন্ধ হতে পারে। গ্যাস গেল তো? এস্টোপেই জল গরম করতে হল। উপায় তো নাই।

তা সত্যি, উপায় তো নেই।

এই সুখনীড়ে কয়লা জ্বালাবার আইন নেই। গ্যাস আছে সকলেরই, কিন্তু কদিন থাকে সেই ‘আছের’ সুখ? শেষ ভরসা, প্রধান ভরসা সবই তো ওই কেরোসিন। অতএব তার জন্যে লাইন লাগাও, হত্যে দাও। আর রান্নার তালিকা থেকে শক্ত জিনিসগুলো বাদ দাও।

অবশ্য খুব বেশি শক্ত জিনিস আর কী হয়? রাঁধুনি তো ফ্রকপরা গীতা। তাও একবার রেঁধে তিনবার খাওয়া হয় ফ্রিজের কল্যাণে।

সংসারের কোনো কিছুই দেখতে হয় না সুব্রতকে, তবে, ওই গ্যাস না থাকাটা শুনতে হয় দারুণভাবে। তাই সুব্রত গ্যাস ফুরোনোয় বলে উঠেছিল, এই সেরেছে।

কেরোসিন-গন্ধ চা, আর গোটাকতক বিস্কুট খেয়ে সুব্রত আবার মেয়ের কাছে চলে এলো। আবার সেই বই চালানের দৃশ্যটা চোখে ঝলসে উঠল।

কী পড়ছে মেয়েটা! খুব একটু নিষিদ্ধ কিছু নয় তো? নাঃ। একটু বলতে হবে অসীমাকে।

সুব্রত কিছু বলার আগে পিঙ্কিই বলে উঠল ব্যঙ্গের গলায়, বাপীর গল্প করার সঙ্গীটি ভালই জুটেছে। তা আর কিছুক্ষণ মজিলপুরের গল্প শুনলে না কেন বাপী? তোমার যখন এত ইন্টাররেস্টিং লাগে!

ঠিক মায়ের মত বিদ্রূপের ভঙ্গীটা শিখেছে। তার ওপর যোগ হয়েছে ঔদ্ধত্য। যেটা অসীমার মধ্যে এতটা নেই। সুব্রত বলল, ইন্টাররেস্টিং লাগে, এটা আবার কখন জানলি?

সর্বদাই তো দেখতে পাচ্ছি। বেশ এনজয় কর বোঝা যায়।

তা একটা মানুষ কথা বলছে, না শুনে উপায়?

একটা মানুষ ভাবতে বসলে অবশ্য উপায় নেই। বলে আর একটু তীক্ষ্ণ হাসি হাসল সুব্রতর প্যান্ট গেঞ্জি পরা বয়ছাঁট চুল মেয়েটা!

সুব্রতর মাঝে মাঝেই সন্দেহ হয়, পিঙ্কি যেন তার পুরনো জামা পরে বর্ধিত, উদয়াস্ত খেটে সারা মেয়েটা কেমন একরকম ঈর্ষার চোখে দেখে।

কেউ একটু প্রশংসা করলে (বহিরাগতরাই অবশ্য, আর কে?) বা ভাল কথা বললে জ্বলে যায়। ভাল করে কথা আর কে বলে? অসীমা তো নয়ই। এক সুব্রতই! পিঙ্কি এর জন্যে বাপকে বিদ্রুপ করেই ক্ষান্ত হয় না, গীতার ওপরও অন্য ছুতোয় একহাত নেয়। সেটা সুব্রতর বুঝতে বাকি থাকে না।

অদ্ভুত লাগে সুব্রতর।

এত পায় তবু মন এত সংকীর্ণ কেন? উদারতা তবে আসে কোন জানলা দিয়ে?

মেয়ের কাছ থেকে সরে এসে এই সুখনীড়ের পরম সম্পদ ছোট্ট ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়াল। হুহু করা দুরন্ত বাতাস এসে গায়ে লাগল, শরীর মন সব যেন জুড়িয়ে দিল। ….আঃ! কী আরাম, কী ঐশ্বর্য!

পাঁচতলার ওপর থেকে নিচের জিনিসগুলো কেমন ছোট্ট দেখতে লাগে। আর আকাশটা যেন হাতের কাছাকাছি এসে যায়। শহরের একটা বিশেষ নামকরা রাস্তার কর্ণার প্লটে এই সাততলা সুখনীড় ভবন। শহরের অন্য সব ঘরবাড়ি, আর তাদের তাকিয়ে থাকা চোখের মতো আলোগুলো, কী একটা মায়াময় সৌন্দর্য বিস্তার করে রয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয় যেন কোনো শৈলাবাসে রয়েছে। পাহাড় অঞ্চলে বেড়াতে গেলে এ ধরনের দৃশ্য চোখ পড়ে। উঁচু-নিচু দূরে-কাছে আলোর চোখ।

এই পাহাড়চূড়ায় বাসা বাঁধতে পেরেছে সুব্রত। তবে অসীমা বলে রেখেছে আগে থেকে ওয়েটিং লিস্টে নাম দিয়ে রাখ, লিফট হলে যেন আমাদের সাততলায় ট্রান্সফার করে দেয়।

ওরে ব্যস! আরও উঁচুতে?

লিফট থাকলে অসুবিধে কী? দশ বারো চোদ্দ তলায় থাকছে না মানুষ? যত উঁচুতে থাকবে ততই রাস্তার ধুলো বালি থেকে দূরে থাকতে পারবে। ওপরের তলা কত নির্মল।

সুব্রতর মুখে আসছিল, কিন্তু হরবকৎ যে লোডশেডিং তার কী?

কিন্তু বলেনি। নেতিবাচক কথা শুনলে বিষম চটে যায় অসীমা।

মনে মনে ভেবেছে, রাধাও নেচেছে, আর সাতমন তেলও পুড়েছে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যেন নেশা লাগছিল সুব্রতর। অসীমার যে ফিরতে দেরি হচ্ছে তা মনে পড়েনি। চমকে উঠল তার কলঝঙ্কারে।

উঃ! একেবারে ধ্যানমগ্ন অবস্থা!

কৃতার্থমন্য সুব্রত ঘুরে দাঁড়াল, এই তুমি এসে গেছ?

হুঁ। তা দেখে তো মনে হচ্ছে না-এলেও কোনো ক্ষতি হত না।

সুব্রত একটু ঘনিষ্ঠ হল, আর যদি বলি অনুপস্থিতার ধ্যান করছিলাম।

সাজিয়ে বললে অনেক কিছুই বলা যায়।

বলতে বলতেই অবশ্য ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে এসেছে। শোবার ঘর। যুগল শয্যা।

এঘরেও অসীমা যেখানে যা প্রয়োজন, সেইভাবেই সাজিয়েছে। প্রায় নব-দম্পতীর মতই সাজসজ্জা। তা করবেই তো, এখানে আসার আগে কোথায় ছিল? কী ভাবে? কালীঘাট অঞ্চলে একটা পচা গলির ভাড়াটে বাড়িতে। ঘর অবশ্য ছিল সেখানে দুতলা মিলিয়ে গোটা পাঁচেক। কিন্তু যেমন ছিরি তেমনি ছাঁদ। আর ফার্নিচার বলতেই বা কী ছিল? বিয়ের পাওয়া ঢাউস একখানা খাট ছিল, সেটাতেই তিনজনে শোওয়ার ব্যবস্থা।

এখানে পিঙ্কির পড়ার ঘরেই পিঙ্কির শোবার ব্যবস্থা। মা-বাপের হৃদয়হীনতায় নয়, পিঙ্কিরই দাপটে। বলেছিল, আমি এই ঘরেই পড়ব শোব সব করব। ওঘরে রাত্তিরে মার লেকচার শুনতে শুনতে ঘুমের বারোটা বেজে যায়।

বেঁচে গিয়েছিল অসীমা।

অতএব এই নবদম্পতী-জনোচিত শয়নকক্ষ।

সুব্রতর যেন এখনও, এই দুবছরেও বিশ্বাসে আসে না, এই সুন্দর ঘরটার মালিক সে। এই শৌখিন বেডকভার, এই বেড সুইচের সুখ। অসীমা যে কীভাবে কী করে। ঘরে এসেই অসীমা নিজের হাতব্যাগ থেকে একখানা খামের চিঠি বিছানার ওপর ফেলে দিয়ে বলে উঠল, চমৎকার একখানি চিঠি এসেছে দেখ।

সুব্রত অবাক হল, এ সময় চিঠি?

এ সময় কেন, ঠিক সময়েই এসেছে। বিকেলে বেরোবার সময়ই লেটার বক্সটা খুলি—

সুব্রতর হঠাৎ বুকটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগল। নিশ্চয় বর্ধমানের ব্যাপার। চমৎকার যখন বলেছে, তখন দুঃসংবাদ নয়, তবে সুব্রতর পক্ষে সুসংবাদও নয়। যখন তার নামেই চিঠি।

চিঠিটা অবশ্য খোলা হয়েছে, পড়াও হয়েছে। তা তাই হয়। লেটার বক্সের চাবি তো অসীমার কাছেই থাকে।

চিঠিটা বার করল সুব্রত। দাদার চিঠি। না, তা নয়। ঠিকানাটা দাদার হাতের হলেও চিঠিটা বৌদির। বর্ধমানের বাড়ি আগলে দাদা বৌদিই থাকে। নিঃসন্তান দুটো মানুষ! দাদা ওখানের কাছাকাছি একটা গ্রামের স্কুলের মাস্টার। একবার যেন শুনেছিল হেডমাস্টার হয়েছে। খবরটা সুব্রতর কাছে গোয়ালার দুধের মতই লেগেছিল। হেডমাস্টার হলেও এখনো তো সাইকেল চালিয়ে পাঁচ পাঁচ দশ মাইল রাস্তা ঠেঙাতে হয়।

কালে কস্মিনেই চিঠি, মোটামুটি খবর জানা। ছেলে-মেয়েও তো নেই যে মাঝে মধ্যে কিছু খবর গজাবে।

বৌদির চিঠি দেখছি।

হুঁ। তাইতো দেখছি—

কিন্তু এটা লিখেছেন কেন?

সুব্রত একটু থমকাল, স্নেহের ঠাকুরপো, কিছুদিন আগে যে চিঠি দিয়েছি সে চিঠি কি পাওনি? কলকাতায় শুনি আজকাল ডাকের খুব গোলমাল হয়। যাক তাই আবার লিখছি, তোমার দাদার চোখটা একবার কলকাতার বড় ডাক্তারকে দেখানো দরকার হচ্ছে। ….জানোই তো মানুষটিকে? নিজের ব্যাপারে সবই উড়িয়ে দেন। কিন্তু এবারে রাজী হয়েছেন। এখানে হাসপাতালের ডাক্তার বলেছে, ছানি। আর তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। এই বয়েসে ছানি, আমার তো বিশ্বাস হয় না। কী ভুলভাল দেখেছে হয় তো। তাই তোমার কাছে একবার চলে যেতে বলছি, তুমি বুঝে-সুঝে কোনো বড় ডাক্তারকে দেখানোর ব্যবস্থা করে দাও ভাই। টাকার জন্যে দ্বিধা কোর না। এখন তো আর স্কুলমাস্টারদের মাইনে আগের মতো খারাপ নয়? আর আমাদের দুটো মানুষের কীইবা খরচ? সে যাই হোক, তোমাকে এ কথা বলা বাহুল্য। তুমি শুধু একটু তোড়জোড় করে—

সুব্রত চোখ তুলে আবার বলল, কিছুদিন আগের চিঠি মানে? এরমধ্যে কবে আবার বৌদির চিঠি এল?

ওটা?

অসীমা মুচকি হেসে বলল, ওটা মফঃস্বলী চাল। চিঠিকে জোরদার করতে একটা কল্পিত আগের চিঠি অ্যাড করা। আমার পিসিমাও করতেন এরকম। প্রথমেই লিখতেন আমার আগের পত্রে অবগত আছ যে—

কিন্তু বৌদি তো ঠিক সেরকম—

তুমি যেরকম সন্দেহের টোনে কথা বলছ, যেন চিঠিটা আমি গাপ করে ফেলেছি।

(উঃ ভাগ্যিস সমিতিতে যেতে যেতে রাস্তাতেই চিঠিটার সৎকার করা হয়ে গিয়েছিল।) গাপ করবে না? দেখেই তো হাড় পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। সাতজন্মে খবর নেই, বড়ভাই বলে একটু ইয়ে নেই। শুনতে পাওয়া যায় দেশের বাড়িতে নাকি অনেক আম কাঁঠাল পেয়ারা বাতাবীর গাছ আছে, কখনও তো সে সবের মুখ দেখা যায় না। দরকারের সময় —স্নেহের ঠাকুরপো। গাইয়ার মতো ঠাকুরপো শুনলে গা জ্বলে যায়। এবং সুব্রতকে সেই গাঁইয়া গাঁইয়া মহিলাটির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ঠাকুরপো বলে ভাবতে বিচ্ছিরি লাগে। অসীমা ভেবেছিল উত্তর না পেয়ে বোধহয় মানী মহিলাটি আর উচ্চবাচ্য করবেন না। সুব্রতর মুখে আগে আগে শুনেছে তো বৌদির যা অভিমান। বৌদি যা অভিমানী! সেই অভিমানের উদাহরণও কিছু কিছু বলেছে। তবে কিছু পরে থেকে আর বৌদি প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। বোধহয় যেদিন অসীমা বলেছিল, উঃ তোমার বৌদি প্রসঙ্গ আর শুনতে পারি না বাবা! স্মৃতির জগৎটা একেবারে বৌদিময় হয়ে আছে। তারপর থেকেই।

একবার বোধহয় বলেছিল সুব্রত, বাবা-মা তো ছিলেন না, দাদার আর আমার সংসার। বৌদিই যত্ন-টত্ন করেছে।

অসীমা নিজস্ব প্যাটার্নে হেসে বলেছিল, ওঃ! মাতৃতুল্য? তাই বল!

সে যাক। মাঝে মাঝে প্রিয়ব্রতরই এক একটা পোস্টকার্ড আসে। কখনও এমনি কুশলপত্র। কখনও বা বাড়িটা নিয়ে সমস্যার কথা। এতবড় বাড়ি কে বা থাকে। এদিকে এখান ওখান ভেঙে পড়ছে।

সুব্রত সেসব কথার উত্তর দেয় না। সব চিঠিরও না। দেব দেব করে ভুল হয়ে যায়।

সুব্রত বলল, কী আশ্চর্য! গাপ করার কথা কে বলছে? চিঠিটা মারাই গেছে। তবে বৌদি বেচারি ভাবছে আমি এরকম একটা খবর শুনেও চুপ করে বসে আছি। সত্যি এই বয়েসে ক্যাটারাক্ট! খুব স্যাড ব্যাপার।……..

এখন পিঙ্কি এ ঘরে চলে এসেছে। বলল, তোমার দাদার বয়েস কত বাপী?

বাবার দাদাকে জ্যাঠা বলতে হয়, একথা পিঙ্কি জানে না।

সুব্রত এখন আর ও নিয়ে কিছু বলে না। বলল, আমার থেকে দশ বছরের বড়। তার মানে বাহান্ন।

দশ বছরের! এ বয়সে চোখে ছানি পড়ে না?

আরে বাবা, রোগের কি আর বয়েস আছে আজকাল? আমারও পড়তে পারে। তবে সচরাচর এ বয়েসে পড়ে না!

হঠাৎ হিহি করে হেসে উঠে মার থমথমে মুখের দিকে একটি কটাক্ষপাত করে বলে উঠল পিঙ্কি, তার মানে তোমার সেই বেঁটে ধুতি আর লম্বা শার্ট পরা দাদাটি এখানে এসে থাকছেন? অতএব তার গিন্নীটিও হিহি!

থাকছেন।

সুব্রত একটু বিরক্ত গলায় বলল, থাকছেন মানে?

অসীমার থমথমে মুখ থেকে উচ্চারিত হল, তা খুব ভুল বলে পিঙ্কি। এসে বড় ডাক্তার দেখানো, নার্সিং হোম, হাসপাতাল যাহোক একটা কিছু ঠিক করা, অপারেশনের পর আফটার কেয়ার টাইম, সে দীর্ঘ সময়ই।

সুব্রত আস্তে বলল, উপায় বা কী!

চমৎকার।

ঠিকরে উঠল অসীমা, একেবারে নিরুপায়ের খাতায় নাম লিখে দেওয়া হয়ে গেল? প্রতিকারের চিন্তা মাথায় এল না? কেন, বর্ধমানের হাসপাতাল কিছু খারাপ নাকি? যথেষ্ট সুনাম আছে ওখানকার।

সুনামটা যে কী বাবদ শুনেছে অসীমা ভগবান জানেন।…. সে বলল।

সুব্রত ম্রিয়মাণভাবে বলল, তা সেটা তো আর বলা যায় না? কক্ষনো কিছু বলেন না।

বলার আবার কী আছে? তুমিই বা দাদার কাছে কবে কী বলতে গিয়েছ, কবে কী পেয়েছ?

সুব্রতর হঠাৎ মনে হল, ঘরের আলোটার যেন পাওয়ার কমে গেল। জানলা দিয়ে এসে পড়া লুটোপুটি বাতাসটা থেমে গেল।

আস্তে বলল, কখনো কিছুই পাইনি? জানো তো মা মারা যাওয়ার পর দাদাই আমায় মানুষ করেছিলেন অসীমা। আমায় ভাল স্কুলে পড়াবেন বলে, সাততাড়াতাড়ি গ্রামে একটা স্কুল-মাস্টারি নিয়ে বসেছিলেন। অথচ এম.এ পড়ার কত ইচ্ছে ছিল—

অসীমা কিছু বলার আগেই হঠাৎ সমস্ত পরিবেশটাকে খান খান করে পিঙ্কির অভ্যস্ত হি হি হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল।

বাপী ঠিক সিনেমার অনুতপ্ত নায়কের মত কথা বলছে দেখছ না। হিহি—ডায়লগগুলো পর্যন্ত এক। আর চোখে জলও পড়-পড়।

আঃ মেয়ে। থামো তো তুমি।

মেয়েকে যখন শাসনের ভান করে অসীমা, তখন ‘মেয়ে’ বলে। কথা হচ্ছে, হয়তো এটা তোমার বাপীর পক্ষে একটা কর্তব্যই। তবে এদিকটাও তো দেখতে হবে? এর মধ্যে কোথায় আর দুটো মানুষকে জায়গা দেওয়া সম্ভব? তাহলে আমাকে আর পিঙ্কিকে দিদির বাড়ি গিয়ে থাকতে হয়। তা তাতেও তো আমার কতর্ব্যের ত্রুটির নিন্দে হবে?

সুব্রত পিঙ্কিকে মলিনভাবে বলল, ওখানের ডাক্তার বলেছে বলেই যে এখানের ডাক্তার অপারেশানের কথা বলবে, তা নাও হতে পারে। হয়তো দেখিয়ে টেখিয়ে দু-চারদিন পরে চলেই যাবেন।

ওই আনন্দেই থাকো বাপী। হি হি হি। কলকাতায় এসে তোমার বৌদি কালীঘাট দেখতে যাবেন না? গঙ্গায় নাইতে যাবেন না? চিড়িয়াখানা যাদুঘর দেখে নেবেন না? তাঁর তো আর—হি হি—চোখে কিছু হয়নি? পাড়াগাঁ থেকে এখানে এসে এতো সুখ আরাম ছেড়ে সহজে নড়বেন ভেবেছ? গেঁটিয়ে বসে থাকবেন।

এতো সাহস আসে কোথা থেকে পিঙ্কির? মার চোখের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের দৃষ্টির মধ্যে থেকে?

যদিও অসীমা বলে ওঠে, আঃ মেয়ে, তুমি একটু বকবকানিটা থামাবে? এই সুব্রত শোন, (হ্যাঁ এই সুখনীড় ভবনে এসে আরও একাট উন্নতি হয়েছে অসীমার। সুব্রতকে সুব্রত বলে ডাকা! বলেছে, সেই পিতামহীদের মত ওগো হ্যাঁগো করতে আর ভালো লাগে না বাপু! সব্বাই আজকাল নাম ধরে ডাকে!) একটা কিছু ব্যবস্থা করার চিন্তা বরং হোক। এভাবে হঠাৎ এসে পড়ার কোনো মানে হয় না। সামনের সপ্তাহে আমার সমিতির বার্ষিক অধিবেশন, আমি তো এখন বাড়িতে থাকতেই পারি না! পিঙ্কিরও উইকলি একজামিনেশান। তাছাড়া দারুণ গ্যাসের অভাব এইমাত্র জবাব দিয়েছে। দুসপ্তাহের আগে তো আশা নেই। একটু চক্ষুলজ্জার দায়ে মরতে তো পারি না? তুমি বরং তাড়াতাড়ি একটু গুছিয়ে গাছিয়ে চিঠি লিখে দাও, কলকাতার ডাক্তারও কিছু ভগবান নয়, বর্ধমানের ডাক্তার যা করবে তার বেশি কিছু করবে না। তাছাড়া ওখানের হসপিটালে ভীড় কম, ভালভাবে কেয়ার নিতে পারবে। আর সম্ভব হয়তো তুমি বরং একদিন দেখে আসবে।

সুব্রত প্রায় মিশিয়ে যাওয়া গলায় বলল, এভাবে লেখা ঠিক হবে? লেখা সম্ভব?

কী আশ্চর্য! অসম্ভব কিসে? মানুষ নিজের দিকটা দেখবে না? তুমি নিজেই বল, এই বাড়িতে কোথায় থাকবেন তাঁরা?

তাকিয়ে দেখল সুব্রত।

সত্যিই বটে! কোথায় জায়গা দেওয়া যাবে দু’দুটো গ্রামজীবনে অভ্যস্ত মানুষকে? এ তো আর অসীমার মেজদি নয়? হায়দ্রাবাদ থেকে এসে অনায়াসেই এখানে তিন-চার দিন থেকে গিয়েছিলেন। অবশ্য এমন সুন্দর ফ্ল্যাটে একটা গেস্ট রুম রাখেনি কেন বলে একটু আক্ষেপ প্রকাশও করেছিলেন।

সে যাক!

অসীমার মেজদি আর সুব্রতর বৌদি এক ক্যাটিগরির মানুষ নয়।

বৌদি এলেই হোল না তাঁর কিছু ঠাকুর দেবতার ছবি গঙ্গাজলের ঘটি বিচার-আচারের ধুয়ো ইত্যাদি থাকবে। সর্বোপরি গীতার রান্না। ভগবান জানেন গীতা কোন জাতের মেয়ে। বৌদি হয়তো বামুন নয় শুনে শিউরে উঠবে!

তাছাড়া বাথরুমে কমোড ছাড়া অন্য ব্যবস্থা নেই! আনাড়ি মানুষ কি না কি করে বসবে।

না! অসীমার বুদ্ধিই নিতে হয়।

চক্ষুলজ্জার থেকে স্বস্তি অনেক বড় জিনিস।

তাকিয়ে দেখে—

ক্ষীণভাবে বলল, ওসব ভাষা-ফাষা আমার আসবে না, তুমি বরং একটা—

তা জানি। সে আর তোমায় বলতে হবে না। লিখে রাখব কাল, পরশুই কপি করে পোস্ট করে দিও। দারুণ টায়ার্ড লাগছে, নাহলে আজই লিখে রাখতাম। কালই পোস্ট করা যেত।

একটা দিন আর—

বলে সুব্রত যুগপৎ হালকা এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে খেতে বসতে এল।

সুন্দর করে সাজানো টেবিল, নুন মরিচের দানীটি পর্যন্ত সুরুচির পরিচায়ক। কিনারায় ফুলকাটা দামী ডিশ, ফাইন কাচের গ্লাস। ভাঙলে মাইনে কাটা যাবে এই শাসানিতে গীতা বড় সাবধানে মাজে ঘষে।

এই ঔজ্জ্বল্যের অনুপাতে অবশ্য খাদ্যবস্তুটা মানানসই নয়। রুটি বেগুন ভাজা আর ফ্রীজ থেকে বার করা আগের দিনের যৎসামান্য মাংস।

রুটিগুলো মোটা মোটা করার অপরাধে দুঃস্থজন দুঃখে বিগলিতা সোশ্যাল ওয়ার্কার অসীমা রায় গীতা নামের চোর চোর ভীতু মেয়েটাকে বকুনির চোটে কাঁদিয়ে ছেড়ে রুটিগুলোর পাশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল, আর পিঙ্কি ‘পাজীটা ইচ্ছে করে খারাপ করেছে যাতে আমরা না খেতে পারি’ বলে ফেলে দিয়ে পাউরুটি নিয়ে খেল।

সুব্রতই শুধু সেই মোটা মোটা আধকাঁচা রুটি দুটো (এই ধরনেরই প্রায়ই হয় অবশ্য। ওর বেশি ক্ষমতা ওর নেই) নীরবে খেয়ে নিয়ে উঠে পড়ে ভাবল গীতা মেয়েটা বোধহয় পিঙ্কির থেকে ছোটই। ওর ছোট হয়ে যাওয়া জামাগুলোই তো পরে।

কিন্তু অতঃপর?

অতঃপর সেই বিলাস-বহুল শয়নকক্ষ।

মৃদুনীল মায়াবী আলোয় আচ্ছন্ন! এবং পাশে এখনো যথেষ্ট যুবতী, সুন্দরী স্ত্রী। যে স্ত্রী আজ স্বামীর মনোবৈকল্য নিঃশেষে মুছে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে বিছানায় এসেছে।

এর পরেও আর মনোবৈকল্য? এর পরেও বিবেক দংশন? সকালে উঠেই ভাবল সুব্রত সত্যিই তার অসীমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সব রকম সমস্যাকে ম্যানেজ করবার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে ওর। ওই যে বলল, চিঠিতে এখনকার কলকাতার হাসপাতালের হালচাল ভাল করে বুঝিয়ে দিতে। এবং যে-কোনো একজন স্পেশালিস্টকে ইচ্ছে করলেই দেখানো যায় না, ডেট পাবার সাধনা করতে হয়, এগুলো উল্লেখ করতে এটা কম বুদ্ধির কথা? আপাততঃ তো একটা বাঁধ দেওয়া হবে! তারপর ভেবে চিন্তে—

কিন্তু হায়! সুব্রতর ভাগ্যে যে বাঁধ দেবার আগেই বন্যা! অকস্মাৎই বজ্রাঘাত!

অসীমার লেখা পরম মুসাবিদাকরা খসড়াখানা অফিসে নিয়ে গিয়ে নিজ হস্তাক্ষরে কপি করে নিয়ে কাল পোস্ট করব বলে বাড়ি ফিরে দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠল সুব্রত।

দাদা!

সুব্রতর ড্রইংরুম-কাম-ডাইনিং রুমের সেই মনোরম সোফার ওপর খাটো ধুতি আর লম্বা ঝুল সার্ট পরা প্রিয়ব্রত নামের লোকটা বসে। ধুতির দোষ নেই, লোকটা এমন ঢ্যাঙা যে সব ধুতিই তার খাটো হয়। দুই ভাইয়ের চেহারা ঠিক বিপরীত! লোকটা দীর্ঘাকৃতি বলেই কি এখানে বেখাপ্পা লাগছে ওকে?

সুব্রতর মাথার মধ্যে একটা বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল।

সুব্রতর চোখের সামনে একটা কালো পর্দা দুলে উঠল।

সুব্রতর মনে হল ওই মাত্রাছাড়া ঢ্যাঙা লোকটা যেন তার লম্বা লম্বা পা ফেলে সুব্রতর এই সুখের স্বর্গটুকুকে তচনচ করে দিতে এসেছে।

খুব রাগ হল সুব্রতর। একেবারে বিনা খবরে কখন এসেছেন ইনি? অসীমা দেখে গেছে, না যায়নি? যদি দেখে না গিয়ে থাকে, ফিরে আসার পর কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে সুব্রতকে এই আকস্মিক বজ্রাঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে?

তবু মুখে হাসি টেনে বলতেই হয়, কখন এলে?

এই তো খানিক আগে। প্রিয়ব্রত একটু হেসে বলল, তোর নিজের বাড়ি হয়েছে, দেখব দেখব বলে কবে থেকেই ইচ্ছে। তা আসা আর হয়ে ওঠে না। এখন ছানিপড়া চোখে দেখতে এলাম। তোর বাড়ি—কত আহ্লাদের কথা।

দেখব দেখব করে।

সুব্রতর ভেতরে কী যেন একটা ঠ্যালা মারল।

সুব্রত কি কোনোদিন ডেকেছিল, দাদা তোমার ছোট ভাইয়ের বাড়িটা একবার দেখবে এসো বলে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু নিচু হয়ে নমস্কারের মত করে বলল, আসতে কষ্ট হয়নি তো?

না না, কষ্ট আর কী? একটা চোখ তো ঠিকই আছে। তোর বৌদি অবশ্য কিছুতেই একা ছাড়তে চাইছিল না, নাছোড়বান্দা সঙ্গে আসবে বলে। অনেক কষ্টে নিবৃত্তি করেছি। জানি তো এসে দাঁড়ালেই স্পেশালিস্ট মেলে না, অনেক অপেক্ষা করতে হয়। কতদিন আর ঘরবাড়ি ফেলে—আমি ক’দিন থেকে দেখিয়ে নিই, দেখি কী বলে! যদি এক্ষুণি অপারেশানের তাড়াহুড়ো না পড়ে ও আর কী করতে আসবে শুধু শুধু? আমি তো খুব কিছু খারাপ বুঝছি না, একটা চোখে দেখতে পাইনা এই যা। তোর বৌদি একেবারে অস্থির। কে নাকি বলেছে ছানি কাটাতে দেরি হয়ে গেলে দু চোখই নষ্ট হয়ে যায়। সবাই তো ডাক্তার আর পণ্ডিত! এতো ব্যস্ত হল যে আমায় না বলে কয়েই নাকি পাড়ার কাকে দিয়ে ঠিকানা লিখিয়ে চিঠি দিয়ে বসেছিল। তা সে চিঠি এসে পৌঁছেছে কিনা জানি না। আবার ব্যস্ত হয়ে—

সুব্রত শুকনো গলায় বলল, আমি তো সবে কালই বৌদির একটা চিঠি পেয়েছি, তোমার হাতেরই ঠিকানা।

ওই তো শেষেরটা। শেষ অবধি ফাঁস করেই ফেলল। বুদ্ধি দেয় আমায় নিয়ে আসবে, আমাকেই লুকনো।

সুব্রত বলল, আমি তো কালই—

এই দেখ যেতে তো? ভাগ্যিস! না না আনতে যাবার কী দরকার? শরীর তো আর খারাপ নয়। চোখই খারাপ। এই আজ আমি চলে না এলে তোকে আবার ছুটতে হত। অবিশ্যি যাসনি অনেক দিন। গেলে তোর বৌদি হাতে চাঁদ পেত। তা সে একটা ভাল সময় হবে। তো এসে বেশ তো দেখছি বাড়ি ভোঁ ভোঁ। বৌমা বাড়ি নেই, তুই তো থাকবিই না, তোর মেয়ের একটু ছায়ামাত্র দেখলাম একবার—ব্যাস!

সুব্রত কষ্টে বলল, ভীষণ শাই। কারুর সামনে বেরোতে চায় না।

আশ্চর্য তো! কলকাতায় জন্ম কর্ম, নিশ্চয় ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়ে-টড়ে, এতো লাজুক কেন?

তো কী আর করি, এই মেয়েটির সঙ্গেই গল্প চালাচ্ছিলাম এতক্ষণ। বেশ মেয়েটি। আমি বর্ধমান থেকে এসেছি শুনে মহা খুশি! বর্ধমান জেলায় কোতুলপুরে নাকি ওর মামার বাড়ি, বর্ধমান শহর ও দেখেছে। অতএব আমাকে ওর চেনা মানুষ বলে ঠেকছে।

হা হা করে হেসে উঠল প্রিয়ব্রত। গীতার ভাষাটা কোট করে। তা যাক, তুই হাত-মুখ ধো! সারাদিনের পর এলি।

আমি একেবারে স্নান করে ফেলি।

তা ভাল করিস! বাইরে কত ধুলো ধোঁয়া জার্ম। আমি যাহোক করে সেরে নিয়েছি। এই মেয়েটাই ছাড়ল না। বলল মাসিমার আসতে দেরি হবে। আপনি মুখ ধুয়ে চা খেয়ে নাও। চা খাইনা শুনে কী আক্ষেপ। রেল গাড়িতে এয়েছেন। বলে একটু লেবুর শরবৎ করে ঝুলোঝুলি। তা হ্যাঁরে সুবা, বাড়ি করলি, তো এমন ঢঙের ওপর কেন? বাড়িতে উঠছি না কেদারবদরীতে উঠছি।

সুব্রত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, শীগগিরই লিফট হবে।

হবে! নেই তো। দু-বছর যাবৎ এই পাহাড় ভাঙছিস তো? হার্টের অসুখ ধরে যাবে যে?

সুব্রত কি কোণঠাসা হয়ে যাবে? আবারও তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, তোমাদের একতলা বাড়িতে থাকা অভ্যাস, তাই এত বেশি মনে হচ্ছে। কলকাতায় পাঁচ ছ-তলা ফ্ল্যাট তো আকছার! দশ-বারোতলাও রয়েছে।

আহা সে তো অফিস বাড়িটাড়ি, তাদের লিফট আছে—থাকার বাড়িও আছে। সকল রাস্তায়ই তো বড় বড় ম্যানসন। দেখলে না?

দেখলাম তো—

দাদা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসল, দেখে কী মনে হচ্ছিল জানিস? সেই যে ছেলেবেলায় তোকে খালি দেশলাই বাক্সের খোল দিয়ে অনেকতলা বাড়ি বানিয়ে দিতাম, ঠিক যেন তেমনি। তোর বাড়ি ঠিক এরকমটা ভাবিনি।

সুব্রত কী বলতে যাচ্ছিল কে জানে। পরিচিত বেল বেজে উঠল, তীব্র অসহিষ্ণু।

পাঁচতলায় উঠে আসার কষ্টে আরক্ত মুখ অসীমা এসে থমকে দাঁড়াল।

প্রিয়ব্রত বলল, এত রাত পর্যন্ত কাজ করে বেড়াও বৌমা? নাইট ক্লাশে পড়াও বুঝি?

অসীমা সে-কথার উত্তর না দিয়ে বলল, কতক্ষণ এসেছেন?

অনেকক্ষণ! এই তোমার কাজের মেয়েটি বলল, মাসিমা এই মাত্তর বেরুল। আজকাল তো আর মা বলা নেই, সব মাসিমা।

অসীমা ওই পচা কথায় কান না দিয়ে বলল, একটা খবর টবর না দিয়ে—

খবর তো তোমার দিদি দিয়েছিল বৌমা, মনে হচ্ছে তোমরা সে চিঠি পাওনি। আমায় একেবারে অস্থির করে ঠেলে পাঠাল। যেন আজ রাতেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি আমি। হেসে উঠলেন হা হা করে।

অসীমাও এতক্ষণে একটু নিচু হয়ে প্রণামের ভঙ্গী করল, প্রিয়ব্রত বলল, থাক। তারপর বলে উঠল, তোমায় তো বেশ বুদ্ধিমতী বলেই জানি বৌমা, তা সুবোর এই দুর্মতিতে মত দিলে যে?

দুর্মতি।

দুর্মতি!

দুটো গলা থেকে একই শব্দ উচ্চারিত হল।

তা দুর্মতি ছাড়া আর কী? লাখখানেক টাকা খরচ করে এই বাড়ি? বাড়ি না পায়রার কোটর! বাস কর কী করে? প্রাণ হাঁপিয়ে আসে না? অথচ ওখানে কত বড় ঘর দালান পড়ে আছে।

অসীমা একটু বঙ্কিম হাস্যে বলল, সেকথা বলে তো লাভ নেই। হাজার হাজার লোকের যদি প্রাণ না হাঁপায়, তো আমাদেরই বা হাঁপাবে কেন?

প্রিয়ব্রত একটু গম্ভীরভাবে হাসল।

অনেক বছর মাস্টারি করা হেডমাস্টারের হাসি। কোনো অর্বাচীনের কথা শুনে যেমন অবহেলার হাসি হাসে পাড়াগাঁয়ের আদর্শবাদী মাস্টার!

বলল, ওটা তো তর্কের ভাষা বৌমা। হাজার হাজার লোকে কী করছে তা ভেবে তো কাজ করা হয় না। আমার পক্ষে কোনটা ভালো, লোকে তাই দেখে। এর চাইতে শহরতলীতে একটু জমি কিনে খোলামেলা একটা একতলা বাড়ি করলে অনেক ভালো করতিস সুবো। একে কি বাড়ি বলে রে? পায়ের তলায় নিজের বলতে মাটি নেই, মাথার ওপর নিজের বলতে ছাত নেই, পাশ ফেরার জায়গা নেই। নাইবার ঘরে—হেসে ফেলে বলল, একটা মোটা মানুষ ঢুকলে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তার ভেতরে আবার বাসনমাজা। দেখে অপ্রবৃত্তি এল। তোর বৌদি তো এখানে একদিনও থাকতে পারবে না। আমি অবশ্য যা হোক করে পারতাম। এই সোফাটা সরিয়ে মাটিতে একটা বিছানা বিছিয়ে হয়ে যেত। তা ভেবে দেখছি তোদেরই অসুবিধেয় ফেলা।

হঠাৎ নিজস্ব ভঙ্গীতে হা হা করে হেসে উঠল প্রিয়ব্রত।

বলল, তোদের এই হোমিওপ্যাথিগুলির শিশিতে কবিরাজী ডোজ ধরাতে গেলে, শিশিটা ফেটে যাবে। হা হা হা! আসলে তোর বৌদির বাতিকেই আসা। নইলে বর্ধমান হাসপাতালে ডাক্তার টাক্তার কিছুই খারাপ নয়।

পরদিন সক্কালেই চলে গেল প্রিয়ব্রত।

বলল, সাতটার ট্রেনটা ধরতে পারলে সুবিধে।

চলে যাবার পর মা মেয়ে দুজনেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সুব্রতর ওপর। খুবতো শুনিয়ে গেলেন তোমার দাদা। একটি জবাবও তো দিতে পারলে না! বাড়ি বয়ে এসে এ অপমানের মানে?

ভ্যাঙানো গলায় বলল, দেশলাই বাক্সর মত বাড়ি। রান্নাঘর দেখে অপ্রবৃত্তি হয়! পায়ের তলায় মাটি নেই, মাথার ওপর ছাত নেই! এতদিনেও কেন হার্টের অসুখ হয়নি, এই আশ্চর্য। আশ্চর্য! ঘাড় হেঁট করে শুনলে বসে বসে। নেহাত তুমি ইয়ে করবে তাই, না হলে ঝেড়ে শুনিয়ে দিতে পারতাম। আর কিছু না, হিংসে। ভাইয়ের এত সুখ ঐশ্বর্য দেখে হিংসেয় বুক ফেটে যাচ্ছিল। চিরকাল গাঁয়ে পড়ে থাকলে, ওই রকম সংকীর্ণ চিত্তই হয়ে যায় মানুষ।

যাক, সহজে পার পাওয়া গেল এই বাঁচোয়া।

মা আর মেয়ের মধ্যে বক্তব্যের কোনো পার্থক্য নেই, পার্থক্য শুধু যা ভাষায় আর বলার ভঙ্গীতে।

অনায়াসেই এরা এগুলো সুব্রতর সামনে উচ্চারণ করে চলেছে, কারণ সে সাহস তাদের আছে। জানে এ লোকটা কামড়ানো তো দূরের কথা, ফোঁসও করবে না। আর নেহাৎই যদি করে বসে, শায়েস্তা করতে দেরি হবে না।

তা ফোঁস আর করছে কই লোকটা?

করছে না।

সুব্রত নির্বাক। সুব্রত নিথর।

সুব্রত আজকের সকালটাকে দেখতেই পাচ্ছে না। দেখতে পাচ্ছে গত কালকের সন্ধ্যাটাকে।

দেখতে পাচ্ছে সুব্রত নামের লোকটা অফিসের গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, এই ফ্ল্যাটটার দরজায় বেল বাজাল। ক্ষীণ প্রত্যাশাটুকু ব্যর্থ করে দিয়ে গীতা এসে খুলে দিল দরজাটা। হাত বাড়িয়ে মেসোমশাইয়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে পিছিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। আর সুব্রত ঢুকে পড়েই একটি দীর্ঘাকৃতি মানুষকে খুব বেমানানভাবে সুব্রতর সুখনীড়ের সব থেকে সুন্দর জায়গাটায় বসে থাকতে দেখল।

দেখেই ভয়ানকভাবে আঁৎকে উঠল সুব্রত।

অথচ সুব্রতর আহ্লাদ হওয়ার কথা। অন্ততঃ সভ্যতার নিয়ম তাই বলে। কিন্তু সুব্রত খুশি হওয়ার বদলে আঁৎকে উঠল। কারণ সুব্রত এই বেমানান বসে থাকার দৃশ্যে একটা অশুভ সঙ্কেত দেখতে পেল। সেই সঙ্কেতটা যেন জানিয়ে গেল, ওই মানুষটা তার লম্বা লম্বা পা ফেলে সুব্রতর সুখের ঘরে ঢুকে পড়ে সব সুখ মাড়িয়ে-গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিতে এসেছে।

কেন এরকম মনে হয়েছিল জানে না সুব্রত। সে কী ওই ভারী মজবুত লম্বা লম্বা হাত পা-ওয়ালা দীর্ঘ মানুষটার কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হওয়ার জন্যে? কিন্তু কেন তা হবে? চিঠিটা তো তখনও পোস্ট করা হয়নি, সুব্রতর পকেটেই ছিল। অসীমার চোখের আড়ালে পোস্ট করে ফেলার প্রশ্ন ছিল না বলেই পকেটে ছিল।

তবু সেই সঙ্কেতটা পেয়েছিল সুব্রত, আর সেটা ভুল ছিল না। সুব্রতর এতদিনকার সঞ্চয়, বুকটা ভরাট করে রাখা, নিটোল মসৃণ সুখ সুখ মুক্তোটিকে ওই লোক মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে নস্যাৎ করে দিয়ে চলে গেল।

আর কোনো দিনও সুব্রত সেটি ফিরে পাবে না। সেই জায়গাটায় থেকে যাবে একটা গভীর শূন্যতার গহ্বর। সেই গহ্বরটা প্রতিনিয়ত সুব্রতর তুচ্ছতাটাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *