সিয়াং পাহাড়

সিয়াং পাহাড়

গত বছরের মার্চ মাসের দিকে রাই একটা পাহাড়কে ভালোবেসে ফেলেছিল৷ তারপর থেকে আর কাউকে ভালোবাসতে পারেনি৷

যে কোনও পাহাড় নয় কিন্তু, কিংবা ধরুন ‘পাহাড় আমায় ডাকছে’ গোছের একটা ঢলঢলে অনুভূতি নয়৷ মার্কামারা গ্যাদগ্যাদে বাঙালি প্রেম৷ মানুষ নয়, একটা নাম না-জানা পাহাড়কে ভালোবেসেছিল সে৷ নাম অবশ্য একটা দিয়েছিল৷ তবে সে সময়মতো বলব৷ তার আগে রাইয়ের ব্যাপারে দু-চার কথা বলা দরকার৷

রাই দাশগুপ্তকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ক্লাস ইলেভেনে৷ আমাদের স্কুল ক্লাস টেন অবধি বয়েজ ছিল৷ ইলেভেন আর টুয়েলভ কো-এড৷ ও সম্ভবত দক্ষিণ কলকাতার কোনও একটা স্কুল থেকে বদলি হয়ে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল৷

বায়োলজি ক্লাসে অসিত স্যার ব্যাঙের হৃৎপিণ্ড আঁকতে দিয়েছিলেন৷ আমি এঁকে খাতা জমা দিয়েছিলাম৷ আমার বন্ধু তন্ময় শয়তানি করে সেই হৃৎপিণ্ডের অলিন্দে একটা ছোট ব্যাঙ এঁকে ‘ব্যাঙের বউ’ বলে পয়েন্ট আউট করে দিয়েছিল৷ স্যার সেটা আমারই আঁকা ভেবে কাছে ডাকলেন৷ তারপর একটা পেল্লাই চড় হাঁকিয়ে ক্লাসেরই একধারে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন৷

অতগুলো নতুন মেয়ের সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম৷ স্যার চলে যেতে কোনওরকমে মাথা নিচু করে বেঞ্চে ফিরে আসছি, এমন সময় পাশ থেকে একটা মেয়ে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অন্য গালেও ঠাসিয়ে আর একটা চড় হাঁকড়ে দিল৷

তার আগে মেয়েদের হাতে মার খাইনি কোনওদিন৷ গর্জে উঠলাম, ‘এই, তুই চড় মারলি কেন রে?’

সে অম্লান বদনে বলল, ‘ওমা! একগালে চড় খেলে বিয়ে হয় না তো, শুধু ব্যাঙের বউয়ের কথা ভাবলে হবে? নিজের বউটা আর একটু হলেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল৷’

আমি শালা খচে বোম হয়ে গেলাম৷ প্রেস্টিজ ফুল পাউডার৷ হেডস্যারের কাছে গেলাম নালিশ করতে৷ সমস্ত কিসসা শুনে খচে যাওয়ার বদলে দেখলাম তার মুখে একটা করুণ হাসি ফুটল৷ আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘মেয়েটার জীবনটা বাকিদের মতো সহজ নয় রে শুভময়, ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে…’

‘কিন্তু হাতে নেই স্যার, সরু সরু আঙুলে কী জোরে মেরেছে!’

হেডস্যারের পাশেই সুধাংশু স্যার বসে ছিলেন৷ আমি চলে আসতে আসতে শুনতে পেয়েছিলাম হেডস্যার বলছেন, ‘ট্রমাটিক চাইল্ডহুড মানুষকে কীভাবে শেষ করে দেয় সুধাংশুদা! আপনারা ওর একটু স্পেশাল কেয়ার…’

কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে মেটেনি৷ গার্জেন কল হয় ওর৷ মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে এসে রাইয়ের মা সেদিন ওকে স্কুলের গেটে ফেলেই কুকুরের মতো মেরেছিলেন৷ চুলের মুঠি ধরে একটার পর একটা চড় কষিয়েছিলেন গালে৷ লোক জড়ো হয়ে গেছিল৷ ওরা ফর্সা মুখটা রক্তের মতো লাল হয়ে ছিল৷ সেদিন আমি দুটো জিনিস জেনেছিলাম৷ এক, ‘পেটের শত্রু’ নামে একটা শব্দ, আর দুই, রাই খুব যন্ত্রণা হলে কাঁদে না৷ ফিকফিক করে হাসে৷

অমন নৃশংস মার খেতে দেখে সেই প্রথম আমার রাইয়ের জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল৷ যত কষ্ট হয়েছিল, তত যত্নে রাখতে ইচ্ছে করেছিল ওকে৷

আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন, মানুষের জীবনে যত বদ নেশা আছে তার মধ্যে এইটেই সব থেকে ডেঞ্জার— দুম করে কোনও অচেনা মানুষকে যত্নে রাখার ইচ্ছা৷ ভারি বেয়াড়া নেশা৷ আপনি তাকে মন খুলে বলতেও পারবেন না যে ‘সিগারেটটা ছেড়ে দে’, ‘আগের মতো সন্ধে হলে একটু হারমোনিয়াম নিয়ে বস’ কিংবা ‘ভারী শীত পড়লে জ্যাকেট না চাপা অন্তত টুপি দিয়ে কানটা ঢাকা দে’৷ অথচ মনের ভেতর এত কিছু বলার গুজগুজুনিটা কিছুতেই থামবে না৷ একবার সেই কী একটা ঝড় এল, আমার খুব চিন্তা হয়েছিল আমাদের কার্নিসের পায়রাগুলো কোনওভাবে মরে টরে না যায়, কিংবা নতুন হওয়া বিড়ালের বাচ্চাগুলোর ঘাড়ে জানলা ভেঙে না পড়ে৷ এদিকে ওদের যত্ন নেওয়ার উপায় নেই আমার৷ কার্নিস ডিঙানো আমার কম্ম নয়, বিড়ালের বাচ্চাগুলো ধরতে গেলে পালিয়ে যায়৷ সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম অপরিচিত কাউকে যত্নে রাখার ইচ্ছাটা বিশ্রী একটা নেশা৷

সেদিন থেকে স্কুলে একটা ছোটোখাটো গসিপ শুরু হল৷ রাইয়ের কোন বান্ধবীই বলেছিল কথাগুলো আমাদের৷ বছরখানেক আগে ওর বাবা মারা যাওয়ার রাইয়ের মা ওকে নিয়ে মামার আশ্রয়ে থাকতে শুরু করে৷ সেই মামা নাকি রোজই সন্ধের দিকে ওকে পড়াতে বসানোর অছিলায় ছাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে মোলেস্ট করত৷ ওর মা ভাইয়ের দোষ খানিকটা জেনে বুঝেই দেখতে পায়নি৷ উলটে সব রাগ এসে পড়ে নিজের মেয়ের উপর৷ দিনের পর দিন ছাদের বন্ধ ঘরে ওইভাবে কষ্ট পেতে পেতে আর মায়ের হাতে মার খেয়ে খেয়ে মেয়েটার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ এমনিতে হার্মফুল না, কিন্তু মাঝে মধ্যে উৎপটাং কাণ্ড ঘটিয়ে বসে৷

ইলেভেনে উঠে আমরা আর স্কুলের মাঠে খেলতে যেতাম না৷ ছোটো ক্লাসের ছেলেরা খেলত৷ আমরা কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেট খেতাম, কেউ কেউ আবার মাঠের পাশেই কোনও গাছের গুঁড়ি খুঁজে নিয়ে সেখানে বসে গল্পগুজব করত৷ আমাকে সুপ্রতিম একবার একটা ক্লাসিক ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘টান ভাই, লাইফ মাজামা৷’

আমি দু’বার টান দিয়েছিলাম৷ ক’বার কাশি হয়েছিল, কিন্তু আর কিছুই হয়নি৷ সুপ্রতিম ঘাড়ে রদ্দা মেরে বলেছিল, ‘ধুর শালা, টানতেই পারিস না এদিকে নেশা করতে এসেছিস৷ যতক্ষণ না পা টলছে বুঝবি নেশা হয়নি৷’

সে যাই হোক, টিফিন হলে ক্লাসরুমে বসে থাকা যাবে না — এমন একটা অলিখিত নিয়ম চলে আসত আমাদের মধ্যে৷

সেদিন কিন্তু মাঠে পৌঁছাতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল৷ এমন ঝপ করে নেমেছে বৃষ্টিটা যে এর মধ্যে স্কুলে ফিরতে গেলেই চুপচুপে হয়ে ভিজে যাব৷ ফলে অন্তত জনাপঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে যে যেদিকে কিছু আশ্রয় পেল সেখানে গিয়েই মাথা গুঁজল৷

আমি একটা ঝাঁকড়া আমগাছের গায়ে সরে আসতেই দেখলাম রাই গাছ থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপছে আর বৃষ্টিতে ভিজছে৷ সেই প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম ওকে৷ লম্বাটে রোগা চেহারা, ফ্যাকাসে ফর্সা গাঁয়ের রং, মুখের উপর চুলের কয়েকটা রেখা বৃষ্টির জলে লেপ্টে আছে৷ হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে৷ ঠান্ডা হাওয়ার ধাক্কায় মৃদু কাঁপছে৷

ছোটোবেলায় দুপুরে পড়তে বসলে মাঝে মাঝে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি আসত৷ জানলা দিয়ে আসা ছাটে ব্যাকরণ বইয়ের পাতা ভিজে যেত৷ বিকেলে ভিজে মাঠে খেলা হবে না ভেবে মন খারাপ করত প্রথম প্রথম৷ তারপর লেপের তলায় ঢুকে গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম৷ আমার ছোটোবেলার দুপুরের বৃষ্টির সঙ্গে রাইয়ের কোথায় যেন মিল ছিল চিরকাল৷

আমি একটু অবাক হলাম, আজব মেয়ে তো! গাছের তলায় সরে এলেই তো মাথা বাঁচানো যায়৷ সমস্যা কোথায়?

গলা তুলে ডাকলাম, ‘তুই এদিকটায় এসে দাঁড়া, ভিজছিস তো…’

সে কথাটা শুনে একবার আমার দিকে তাকিয়ে দু-পাশে মাথা নাড়াল, ‘না, আমি যাব না৷’

আমি এবার নিজেই এগিয়ে গেলাম তার দিকে, ‘ভিজে কাক হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নিউমোনিয়া হবে৷ চ…’

‘না, আমার ভয় লাগে…’ সে নড়তে চাইল না৷

‘কীসের ভয়?’

সে থমথমে মুখ করে বলল, ‘আমার ছোটোবেলা থেকে মনে হয় আমি গাছ চাপা পড়ে মরে যাব!’

জিন্দেগিতে এমন অদ্ভুত ভয়ের কথা আমি শুনিনি৷ প্রথমটা একটু থতমত খেলাম, তারপর একরকম জোর করেই টেনে আনলাম তাকে, ‘আয়, ভয় লাগবে না৷’

হালকা কিছু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল রাই, কিন্তু আমি সেসবে কর্ণপাত করলাম না৷ গাছের সামনে এসে সে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ আমি সময় নষ্ট না করে মোটা গুঁড়ির দু-চার জায়গায় পা ফেলে গাছের উপরের দিকের একটা ডালে উঠে এলাম৷

নিচ থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, ‘একী! তুই গাছে উঠছিস কেন?’

‘তাতে আর গাছ চাপা পড়ার ভয় থাকবে না৷ আবার মাথাও বাঁচবে৷ চলে আয়… এই যে…’

আমি উপর থেকে নিচের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম৷ মুখ দেখে বুঝলাম প্রস্তাবটা তার পছন্দ হয়েছে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার পাশের ডালে এসে বসে পড়ল সে৷ তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিল মুখটা৷

এতক্ষণে মাঠের উপরে পায়ের চাপে তৈরি হওয়া গর্তে একটু আধটু জল জমেছে৷ ঝিরঝির করে ভারী বৃষ্টির আওয়াজ ভেসে আসছে চারদিক থেকে৷ আমাদের গায়ের উপর গাছের পাতা চুঁইয়ে টুপটুপিয়ে জল পড়ছে৷ সেটা আটকানোর উপায় নেই৷

আমি গাছ থেকে একটা কাঁচা আম পেড়ে নিলাম৷ খুব যে খেতে ভালো লাগে তা নয়, তবে এখন চুপচুপ একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে বসে থাকাটা কেমন যেন অস্বস্তিকর৷ সেটা কাটানোর জন্যই একটা কামড় বসালাম তাতে, তারপর চিবোতে চিবোতেই বললাম, ‘আমার না কাল খুব খারাপ লাগছিল…’

‘কেন?’

‘আমার জন্য তোকে কত চড়থাপ্পড় খেতে হল…’

‘সাতাশটা…’

‘অ্যাঁ?’

‘সাতাশটা মেরেছে সব মিলে…’ কথাটা বলে আমার দিকে এগিয়ে এসে একদিকের গাল থেকে চুল সরিয়ে দিল সে, ‘তুই এই গালে একবার মেরে নে৷ নইলে আমারও বিয়ে হবে না৷’

চুল সরে যেতে এখন তার বামদিকের গালটা স্পষ্ট হয়েছে আমার সামনে৷ তাকিয়ে দেখলাম চড় খেয়ে খেয়ে সে জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে আছে৷ চড় মারার অছিলাতেই একবার হাত রাখলাম তাতে আমি৷ ভারী মায়া হল৷

মুখের উপর ফোঁটা ফোঁটা জল এসে পড়েছে ওর৷ আমার মনের ভিতর কে যেন বলে দিল কাল বাড়ি গিয়েও কেঁদেছিল রাই৷ তখনও ওর মুখে ঠিক ওইভাবেই জল জমেছিল৷ জানি না কেন আমি হাত বাড়িয়ে ওর মুখ থেকে জলটা মুছে দিলাম৷ ও কোনও আপত্তি করল না৷

দু-জনে কেউ কোনও কথা বললাম না৷ মাঠের বুক থেকে ভিজে মাটির গন্ধ আসছে৷ সেই সঙ্গে চুলের নরম তেলের গন্ধ৷ মুখে একটা চেনা টকটক স্বাদ৷ জোলো হাওয়া গায়ে এসে লেগে হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে৷ রাইয়ের চোখের মাঠের উপর স্থির হয়ে আছে৷ দেখে মনে হয় ও বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে না, আবার এখানে থাকার খুব যে ইচ্ছা আছে তাও নয়৷ ও কেবল বসে আছে, স্রেফ বসে আছে৷

অস্বস্তিটা কাটানোর জন্যেই একবার গলা খাঁকরে জিগ্যেস করলাম, ‘তোর আর গাছ পড়ার ভয় লাগছে না তো?’

‘উঁহুঁ..’

‘ঠিক লাগছে এখন?’

আমার দিকে ফিরে ও হেসে বলেছিল, ‘একদম৷’

সেই প্রথম ওকে সত্যিকারের হাসতে দেখেছিলাম৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রথম অনুভব করেছিলাম ব্যাপারটা— আমি ওই বিশ্রী নেশাটার খপ্পরে পড়ে গেছি৷ সুপ্রতিমের কথামতো আমার পা টলেছিল ভয়ানক৷ মাথাটা ঝিমঝিম করেছিল একবার৷ আর… আর মনে হয়েছিল আমি রাইয়ের পাশের ডালে বসে ওর হাসি মুখটা দেখার আশায় ওই প্রশ্নটা সারাজীবন ধরে করতে পারি, ‘ঠিক লাগছে এখন?’

ওই মানুষটার অকারণ ছিটলামি সামলানোর ঠিকেদারি নিয়ে আমি আমার গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি৷

বিশ্বাস করুন, আমি তার আগে কোনওদিন আঁতেল টাইপের রোম্যান্টিক ছিলাম না, শরৎচন্দ্র ফরৎচন্দ ছুঁয়ে দেখিনি৷ কিন্তু সেদিন ওই অভিব্যক্তিহীন মুখের দিকে গোটা টিফিনবেলা তাকিয়েছিলাম৷ কখন ঘণ্টা পড়েছে, কখন বৃষ্টি থেমেছে, কখন সে আমাকে কিছু না বলেই গাছ থেকে নেমে চলে গেছে আমি খেয়ালই করিনি৷ ওর চুলের গন্ধটা ঘিরে ছিল আমাকে৷ যেমন বৃষ্টি থেমে যাওয়ার অনেক পরেও মাটির গন্ধ থাকে, যেমন বিকেল ফুরিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও খেলা থামায় না ছেলের দল…

আমার শালা তারপর থেকেই নেশাটার বাড়বাড়ন্ত হল৷ রোজ স্কুলে এক্সট্রা পেন আর টেস্টটিউব নিয়ে যেতাম রাইয়ের জন্য৷ নিচু ক্লাসের বাচ্চারা মাঝে মাঝে বেঞ্চের উপর উঠে দাপাদাপি করে, আমি নিজের বেঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে কেউ আসার আগে রাইয়ের বসার জায়গাটা পরিষ্কার করে দিতাম৷ একবার বাড়ি ফেরার বাস ভাড়া হারিয়ে ফেলে ও কাঁদছিল খুব৷ আমার কাছেও পয়সাকড়ি ছিল না তেমন৷ আমি ওকে সাহস দেওয়ার জন্য ওর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ওর বাড়ি অবধি গেছিলাম৷ অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম সেদিন৷

নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে৷ আমার শালা কী ঠেকা পড়েছে? প্রেমে পড়লে ছেলেপুলে এসব ধ্যাস্টামো করে থাকে বটে, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি আমি রাইয়ের প্রেমে পড়িনি৷ তাহলে কেসটা কী?

একদিন খেলার ছলে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা মা, এই যে তুমি আমার এত খেয়াল রাখো, ভালো-মন্দের হিসেব রাখো, এটা ঠিক কবে থেকে শুরু করেছিলে?’

মা চট করে বলেছিল, ‘হসপিটালে যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন থেকে৷’

‘মানে যতদিন পেটে ছিলাম তখন যত্ন নিতে না?’

মা মনে হয় ব্যাপারটা এতটা তলিয়ে দেখেনি, একটু সময় নিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, তখনও রাখতাম৷ তাহলে মনে হয় যেদিন ডাক্তার বলেছিল তুই আমার পেটে আছিস, সেদিন থেকে…’

এই ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখিনি, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলাম ‘আচ্ছা ধরো যদি ডাক্তার তোমায় মিথ্যে কথা বলত তাহলে? তুমি একটা মিথ্যেকে ভালোবাসতে?’

মা কোনও উত্তর দিতে পারেনি৷ কিন্তু সেদিন আমি বুঝেছিলাম মাতৃত্ব ব্যাপারটার সঙ্গে জন্ম দেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই৷ নারী-পুরুষ, গর্ভ, জরায়ু, আম্বিলিকাল কর্ড, দশমাস-দশদিন, এসবের কোনও রিলেশন নেই৷ ব্যাপারটা বায়োলজিক্যালও নয়, ম্যাজিক্যাল৷

রাইয়ের প্রতি আমি বোধহয় কিছুটা মাতৃত্ব অনুভব করতাম৷ তাই ওটা আমার কোনওদিন আলাদা করে আসেনি, কোনওদিন চলেও যায়নি, ওটা আমার ভেতরেই ছিল৷ কাল হুট করে রাই একটা ব্যাঙাচি হয়ে গেলে কিংবা একটা কচুরিপানার ফুল হয়ে গেলে, আমার কাছে ব্যাপারটা আলাদা কিছু হবে না৷

স্কুলে আমি রাইয়ের পিছনের বেঞ্চে বসতাম৷ ফলে মুখ না দেখতে পেলেও চুলের ক্লিপ আর খাতায় কী লিখছে সেইটা পরিষ্কার দেখতে পেতাম৷ রাইয়ের মেজাজ কেমন আছে সেটা ওর চুল বাঁধা দেখে খানিকটা বোঝা যেত৷ কেমিস্ট্রি ক্লাস ওর একেবারে পছন্দ ছিল না৷ কারণ গোটা ক্লাস জুড়ে ও লুকিয়ে লুকিয়ে খাতার পিছনে পাহাড়ের ছবি আঁকত৷

আমি একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোর খুব পাহাড় ভালো লাগে, তাই না?’

ও জানলার দিকে সরে বসতে বসতে বলেছিল, ‘কী করে জানব ভালো লাগে কি না, ছোটবেলায় গেছিলাম৷ আর এখন মনে নেই…’

সেদিন জানলা দিয়ে আসা দুপুরের রোদ পড়েছিল ওর মুখে, সারারাত বরফে ঢাকা পাহাড়ের উপর যেভাবে পড়ে৷

‘তাহলে আঁকিস কেন?’

‘যেতে ইচ্ছা করে তাই৷ আমি রোজগার করলে না, একবার পাহাড়ে যাব…’ কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাই, তারপর মুখে পেনসিল দিয়ে কী জানি ভেবে বলে, ‘তুই কী করবি?’

আমি একটু মাথা চুলকে বলি, ‘মাকে একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দেব৷ বাতের ব্যথা তো, নিচু হয়ে জামাকাপড় কাচতে পারে না৷ বাবার খুব বাটিকের পাঞ্জাবির শখ… আর…’

‘আর?’

‘যদি তোর আগে চাকরি পাই তাহলে একবার তোকে পাহাড়ে নিয়ে যাব৷’

‘অদ্ভুত তো! তুই নিজের জন্য কিছুই চাস না?’

আমি একটু ভাবুক গলায় বলি, ‘আমার বাবা বলে মানুষের যতদিন পয়সাকড়ি থাকে না ততদিন তার নিজেকে নিয়ে শখ থাকে৷ যখন পয়সাকড়ি হয় তখন খালি অন্যকে কিনে দিতে ইচ্ছা করে৷’

‘মানে তুই বলছিস এখন তোর কাছে পয়সা আছে?’

আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা কুড়ি টাকার নোট আর গোটা তিনেক কয়েন ওর দিকে এগিয়ে দিই, ‘এই দেখ, পঁচিশ টাকা আছে৷’

রাই হেসে ফেলেছিল৷ আমি ওকে অনেকগুলো পেন্সিল কিনে দিয়েছিলাম৷ ও সেগুলো দিয়ে পাহাড়ের ছবি একেছিল খাতার পেছনে৷ কিন্তু আমি কোনওদিন ভাবতে পারিনি রাই একটা পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যাবে৷

মাকে ওয়াশিং মেশিন আর বাবাকে বাটিকের পাঞ্জাবি আমি কিনে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু রাইকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি৷ ও প্রথম পাহাড়ে গিয়েছিল ওর বরের সঙ্গে৷ বিয়ের পর হানিমুনে৷ আর সেখানেই সিয়াং পাহাড়কে ও ভালোবেসে ফেলে৷

দেখুন, আমার বরাবর মনে হয় বিবাহিত লোক পাহাড়ে যায় মোট দুটো কারণে৷ এক, বউয়ের খিটিরখিটির থেকে বাঁচতে৷ ঠান্ডায় আর পাথুরে পথে এদিকে ওদিকে হাঁটার পর শরীরে আর অন্যের উপর চিৎকার করার এনার্জি থাকে না৷ আর দুই, অফিসে গিয়ে ‘পাহাড় থেকে ঘুরে এলাম’ বলতে পারলে একটা বড়োলোক বড়োলোক ফিল আসে৷ নর্থ বেঙ্গলের টিকিটের দাম নেহাত কম নয়, তার উপর গাড়ি করে দিকে ওদিক ঘোরারও খরচ আছে৷

আমি কলেজে উঠে তিন বন্ধু মিলে প্রথম পাহাড়ে গেছিলাম মদ খেতে৷ মানে বাড়ি ফেরার ফ্যাচাং নেই, ফোন করে কোনও এক্সকে খিস্তি করার মতো নেটওয়ার্ক নেই, উলটে মিহি ঠান্ডায় দিমি দিমি গান চালিয়ে মাথার উপর খোলা আকাশের তলায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকা৷

কিন্তু যা ভেবে গেছিলাম তা হল না৷ আমার দুই বন্ধুর অপক্ক লিভার তখন সিঙ্গেল মল্টের ছোঁয়ায় ডিগবাজি খেয়েছে৷ দুটোই দেখলাম হোমস্টের বাইরের ঘাসে চিতপটাং হয়েছে৷ আমি সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে হোমস্টের ছাদে উঠে এলাম৷ রাত ক-টা হবে তখন? আড়াইটের কম নয়৷ খোলা ছাদেরই একদিকে পা ঝুলিয়ে মদের বোতল পাশে নিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ আর তখনই হুট করে মনে পড়ে গেল রাইকে৷

কলেজে ওঠার পর বছর খানেক ওর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল৷ তারপর সেটা নিজে থেকেই একটু কমে আসে৷ ফোন নম্বর ছিল, কিন্তু খোঁজখবর নিতে ইচ্ছে করেনি তেমন৷ কিন্তু সেদিন সেই তারাভরা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আমার মনে হল—ভুল হয়ে গেছে৷ ভিতর থেকে বিচ্ছিরি একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরল আমাকে, অনেকদিন রাইয়ের খোঁজ নেওয়া হয়নি৷ ওকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, ‘এবার ঠিক লাগছে?’

ফোনটা বের করলাম পকেট থেকে৷ পাহাড়ের একেবারে মাথায় আছি বলে হালকা নেটওয়ার্ক আছে৷ ওপাশ থেকে কয়েকবার রিং হওয়ার পর মেয়েটার গলা শুনতে পেলাম, ‘কী রে তুই এতদিন পর?’

‘কেমন আছিস ভাই?’

আমি কি হাঁফাচ্ছিলাম? এত উঁচুতে ওঠার জন্য না ভিতরের জমাট বাঁধা অস্থিরতার জন্য?

‘ভালো আছি৷ কিন্তু তোর কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না রে, কোথায় আছিস তুই?’

‘এমন কোথাও যেখানে আমার একটুও ভালো লাগছে না৷’

‘তাহলে আছিস কেন? চলে আয়…’

‘তোরও মামার বাড়িতে ভালো লাগে না৷ কোথায় যেতে পেরেছিস বল তো?’ কথাটা বলে আমি ওকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিই না, ‘বাড়ির অবস্থা কেমন তোর?’

‘ভালো না৷’

মদের নেশাটা কি চড়েছে৷ আমার হাত হুট করেই আকাশের দিকে উঠে আসে৷ একটা একটা করে তারা যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকে৷ তাদের মিহি উত্তাপ আমার আঙুলের ডগায় লাগে, ‘রাই…’

‘বল…’

‘তোর মন ভালো নেই, না রে?’

‘কে বলল তোকে?’

‘পেছনের বেঞ্চে বসতাম তো, এই আড়াই বছরে তোকে কতটুকুই বা দেখেছি? মাথার চুল, নেলপলিশ, গলার আওয়াজ এসব দিয়েই চিনি…’

ওপাশ থেকে কোনও উত্তর আসে না৷ আমি জানতাম আসবে না৷ হাতটা আকাশ থেকে মাথার পেছনে নেমে আসে আমার৷

‘কিন্তু আমাকে ফোন করলি যে তুই…’ কয়েক সেকেন্ড পরে ওপাশ থেকে প্রশ্ন শোনা যায়৷

‘বড়ো হওয়ার একটা লক্ষণ কী জানিস?’

‘কী?’

‘রাত হলে খুব বাড়ির জন্য মন কেমন করে৷’

‘তাহলে বাড়িতে ফোন করতিস…’

‘বাড়ির জন্য মন কেমন করলে তোর জন্য দুশ্চিন্তা হয়…’

আবার কয়েক সেকেন্ড কোনও কথা শোনায় যায় না৷ রাইয়ের গলার স্বর বদলে যায়, ভিজে ভাবটা কমে আসে সেখানে, ‘অদ্ভুত লোক শালা তুই, চিরকাল অন্যের ভালো থাকার কথাই ভেবে গেলি…’

‘পাহাড়ের সব থেকে ভালো ব্যাপার কী বল তো, রাই?’

‘কী?’

‘রাতে মন খারাপ হলে তারা গোনা যায়৷ আকাশে এত তারা থাকে যে গুনতে গুনতে রাত কেটে যায়, মন খারাপও চলে যায়৷’

‘তো?’

‘আমার গোটা জীবনটাও একটা মন খারাপের রাত৷ তোর হাসিমুখ গুনতে গুনতে ঠিক ভোর হয়ে যাবে…’

মদ খেয়ে ছিলাম বলে কি না জানি না৷ এসব কথা হুট করে কোনওদিন রাইকে বলে ফেলব ভাবতে পারিনি৷

রাই প্রথম প্রেমে পড়ে কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে৷ ওদের কলেজেরই একটা সিনিয়র দাদা, অভিজিৎ৷ ছেলেটা প্রেমে পড়ার মতোই ছিল অবশ্য৷ লম্বা চওড়া চেহারা, ভালো গান গায়, ফেস্ট না কীসে তুমুল গিটার ফিটার বাজিয়েছিল৷ তবে রাইয়ের অবশ্য ছেলেটাকে ঠিক এই কারণে পছন্দ হয়নি৷ ওর সঙ্গে রাইয়ের ছোটোবেলাটা অনেকটা মিলে যায়৷ দু-জনেরই ট্রমাটিক চাইল্ড হুড৷ ছেলেবেলায় মা মারা যায় অভিজিতের৷

রাইয়ের জন্য একরকম পাগল ছিল ছোকরা৷ ওর মন খারাপ হলেই ফুল-টুল নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে যেত৷ আমাকে একবার ছবি দেখিয়েছিল৷ মুখ দেখে খুব একটা খারাপ মনে হয়নি৷ অন্তত রাইয়ের পাশে বেশ মানিয়ে যায়৷

দেখুন, আপনি যদি কোনওদিনও হাফ বেলার জন্যও প্রেম করে থাকেন তাহলে জানবেন যে এই দুনিয়ার সমস্ত প্রেমের মাঝখানে প্রেমিক বা প্রেমিকার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ বলে একটা কেওড়া মাল থাকে৷ এর মতো হারামজাদা পাবলিক আপনি দুনিয়ায় দু-খানা পাবেন না৷ কখনও আপনার সঙ্গে দেখা হলে সে এন্তার দাঁত কেলাবে, ‘বিয়ে কবে খাচ্ছি?’, ‘কোনও ঝামেলায় পড়লে আমি তো আছি…’ টাইপের বালবাজারি করবে আর যেখানে আপনার গতিবিধি নেই, যেমন ধরুন আপনার প্রেমিক-প্রেমিকার ইনবক্স, তার বাড়ির লোক, কিংবা তার মন খারাপে আপনার নামেই চুকলিবাজি করবে৷ আপনি খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন এদের মুখে বোল্ড, ইটালিক, আর আন্ডারলাইনে একসঙ্গে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ লেখা থাকে৷

রাই প্রেম করার সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমি রিয়েলাইজ করলাম যে এই হারামি চরিত্রটায় আমি নিজেই অভিনয় করতে শুরু করেছি৷ অনুতাপ হল৷ দেখুন, নিজের জীবন আমি হেব্বি ইন্টালেকচুয়াল ভাইভে কাটিয়েছি৷ পোষাল না৷ দুম করেই একদিন ওকে ব্লক ফক করে যোগাযোগ সালটে দিলাম৷

বছর দুয়েক তেমন ব্লকড অবস্থাতেই ছিল৷ একদিন হুট করেই রাই ফোন করে বসল আমাকে৷ ততদিনে দু-জনেরই কলেজ শেষ হয়েছে৷ আমি সদ্য একটা চাকরি জয়েন করেছি৷ ফোন করে যে প্রশ্নটা করল সেটা শুনে আমার পিলে চমকে উঠল, ‘ভাই তোর কাছে রক্ত হবে একটু?’

আমি একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘আমি কি ভ্যাম্পায়ার নাকি? জীবিত মানুষের কাছে আর কিছু না থাক রক্ত থাকবেই, কিন্তু কী করবি তুই?’

‘তন্ত্র করব…’

‘সেকী! কেন?’

‘একমাত্র তন্ত্র সাধনা ছাড়া আমার প্রেম টিকবে না ভাই…’

‘সেকি তোর অভিজিৎ কেটে গেছে নাকি?’

‘কাটিয়ে দিয়েছি৷ আমি পারব না এসব সামলাতে…’

কেন জানি না আমার বরাবর মনে হত রাই কাউকেই দীর্ঘদিন ভালোবাসতে পারবে না, আমাকেও না৷ কোনও রাম-শ্যাম-যদু-মধুকেও না৷ ওর জীবনে যত পুরুষ ফুরুষ এসেছে তাদের এই ব্যাপারটা বুঝতে যতদিন লেগেছে ততদিনই তারা থাকত৷

ও তখনও বলে চলেছে, ‘নিগূঢ় তন্ত্রে কুমারি মেয়ের ঋতুস্রাবের রক্ত দিয়ে সাধনা করলে পূজারির মনস্কামনা পূরণ হয়৷ আমার বান্ধবীগুলো সব খেলে ফেলেছে, কাজ হবে না৷ অগত্যা পুরুষের রক্ত…’

‘কিন্তু আমি ভার্জিন তোকে কে বলল?’ আমি গর্জে উঠলাম৷

‘কেউ বলবে কেন? তোর মুখের উপর ভরসা আছে আমার৷ দে না ভাই একটু রক্ত…’

রাই কিন্তু ইয়ার্কি মারেনি৷ ও সত্যি মাসখানেকের জন্য কোনও তান্ত্রিকের কাছে দীক্ষা নিয়ে কীসব সাধনা ফাধনা করেছিল৷ ওদের তিনতলার ছাদে যজ্ঞ করে লাল শাড়ি পরে বিদঘুটে কীসব মন্ত্র উচ্চারণ করতে দেখেছিলাম আমি৷ সেই আগুনে ব্লেড দিয়ে খানিক রক্তও ঝরিয়েছিলাম৷

ক্রিয়াকর্ম শেষে আমার পাশে ধপ করে বসে পড়ে ও বলেছিল, ‘আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসা হবে না শুভ…’

‘কেন?’

রাই মুখের ঘাম মুছে বলেছিল, ‘কেন জানি না কারও সঙ্গে কানেক্ট করতে পারি না৷ আমার কাছে কেউ কিছু চাইতে এলে আমার নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব মনে হয়…’

‘সব সময় যে চাওয়াটা খারাপ, তাও না৷ তুই সব সময় ভালো থাক – এটাও তো একরকম চাওয়া, তাই না?’

‘সেটাও তো আমি দিতে পারি না৷ যাকে ভালোবাসি তাকে হতাশ করতে ভালো লাগে না৷ আচ্ছা…’ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে জীবনে প্রথমবার প্রশ্নটা করেছিল রাই, ‘তোর কখনও মনে হয়নি তুই আমাকে ভালোবাসিস?’

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলাম, ‘আমি তো বোকা না৷’

‘মানে? ভালোবাসায় বোকামির কী আছে?’

আমি একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলাম, ‘কাউকে ভালোবেসে ফেললে তাকে ভালোবাসাটা বেশি দরকারি হয়ে যায়, ভালো রাখতে চাওয়ার থেকেও… আমি ওই বোকামিটা করব না…’

সেদিন তন্ত্র সাধনায় লাল শাড়িটা পরে ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছিল রাইকে৷ নিজে হাতে আমার হাতের কাঁটাটায় ডেটল লাগিয়ে দিয়েছিল ও৷ আগুন নিভে যাওয়ার অনেক পরেও তার সামনে বসেছিলাম আমরা৷ একসময় ক্লান্ত হয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখেই ও ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ ঘুমানোর আগে ও বিড়বিড় করে বলছিল, ‘আচ্ছা বেশ শুভ, আমাকে ভালোবাসতে হবে না…’

আমি খেয়াল করেছিলাম কথাটা বলতে বলতে ও ফিকফিক করে হাসছে৷

এরপর আমার জীবনে একটা মারকাটারি প্রেম আসে — রূপা৷ ফেসবুকেই পরিচয়৷ তুমুল দেখতে৷ আমাকে যে কেন তার ভালো লেগে গিয়েছিল তা আমি আজও বুঝতে পারিনি৷ একদিন দেখা-টেখা করলাম, কফি খেলাম, যাওয়ার সময় কোত্থেকে যেন একটা গোলাপ বের করে আমার হাতে দিয়ে চকাস করে গালে চুমু খেয়ে চলে গেল৷

আমাদের যখন বাইশের আশেপাশে বয়স তখন একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে৷ এক, আমার বাবা মারা যায়, দুই, রাই একটা সরকারি চাকরি পেয়ে যায়৷ আমরা কেউই খবর দুটো কাউকে জানাই না৷ কেবল আমি জেনেছিলাম ও মামার বাসা ছেড়ে মাকে নিয়ে একটা ভাড়ার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে৷

বছর দেড়েক রাইয়ের সঙ্গে কোনও কথাবার্তা ছিল না৷ ফেসবুকে ছিল অবশ্য, পোস্ট দেখতে পেতাম মাঝেমধ্যে৷ ছবি দেখে বুঝতে পারলাম এর মধ্যে ওর আরও গোটা দুয়েক ব্রেকআপ হয়ে গেছে৷ এবং হয়েছেও ভারী বিশ্রী ভাবে৷

আমি নিজে যেহেতু রিলেশনশিপে ছিলাম তাই ও নিজে থেকে সাহায্য না চাইলে আমার আগ বাড়িয়ে গায়ে পড়তে ইচ্ছা করেনি৷ তবে রাইএর জন্য আমার মন খারাপ করত মাঝে মাঝে৷ কিছু কিছু মানুষ কাউকেই সেভাবে ভালোবাসতে পারে না৷ তাদের ভালোবাসা পাওয়ার একটা আধা-ইচ্ছা গোছের থাকে৷ সেটা পেয়ে গেলে সে বেচারা কনফিউজড হয়ে যায়৷ জোর করে সে মনের ভিতরে পুরো ইচ্ছা জাগাতে পারে না, আবার যেটা পেয়েছে সেটা ফেলেও দিতে পারে৷ হাতে নিয়ে টালমাটাল করতে করতে একসময় মাটিতে পড়ে হারিয়ে যায়৷

বার কয়েক ল্যাং খেয়ে একদিন হঠাৎ করেই আবার আমাকে ফোন করে ও, ‘ভাই, সহজে কী করে মরে যাওয়া যায় বল তো?’

‘বেঁচে থেকে৷’ আমি তৎক্ষণাৎ জবাব দিই, ‘মানে ইভেনচুয়ালি তুই মরেই যাবি৷ তাই বেঁচে থাকাটাও একরকম মরে যাওয়া৷’

আমার কথাটা পছন্দ হয় না রাইয়ের, ওর গলাটা অসহায় শোনায়, ‘আমার আর কিছু ভালো লাগছে না৷’

‘কী ভালো লাগছে না?’

‘আমার খুব কষ্ট হয় শুভ, আমার খুব একা লাগে…’

‘ছোটো থেকেই একা আছিস, এতদিনে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা৷’

‘কিন্তু আমি পারছি না রে, আমার কিছু ভালো লাগছে না… ভাবছি…’

‘কী ভাবছিস আবার?’

‘ভাবছি বিয়ে করে ফেলব৷’

আমি হাসলাম, ‘তোর এই সিদ্ধান্তটা অনেকটা সেই তন্ত্র সাধনার মতো৷ জানি লাভ হবে না৷ কেবল মনে মনে ভাবা কিছু তো একটা হবে…’

রাই এত সহজ উত্তরটা আশা করেনি, খানিক থম মেরে থেকে বলল, ‘আচ্ছা আমার বিয়ে হলে তুই আর যোগাযোগ রাখবি না, তাই না?’

‘কে বলল তোকে?’

‘আমি দেখেছি৷ আমি রিলেশনে গেলেই তুই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যাস…’

আমি চুপ করে ছিলাম৷ জানি না কী ভেবে রাই বলেছিল, ‘যেদিন সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসব, সেদিন তোকে কোথাও যেতে দেব না৷’

কথাটার মানে আমি সেদিন বুঝিনি৷ আজ বুঝি৷ কিন্তু সে কথা সময়মতো বলা যাবে নাহয়৷

এরপর বছরকয়েক ভালো যোগাযোগ ছিল আমাদের৷ মাঝে মধ্যে এদিক সেদিক দেখাও করেছি কয়েকবার৷ কখনও ও জিমে ভর্তি হত, কখনও গিটার ক্লাসে৷ ওর সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও ভর্তি হতে হত৷ আমি ওকে বাবার কথা বলতাম, চাকরিতে হওয়া খিটিমিটির কথা বলতাম, ও আমাকে ওর পাঞ্জাবি বয়ফ্রেন্ড নভজ্যোতের কথা বলত৷

রাইয়ের বিয়েটা মোটামুটি নড়বড় করে বছরখানেক টিকেছিল৷ এবং বিয়েটা না টেকার জন্য ওর বরকে দোষ দিতে পারিনি আমি৷ রাইয়ের সঙ্গে থাকা প্রায় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়৷ ডিভোর্সের আগে একবার নাকি হাতের শিরা কেটে সুইসাইড করতে গেছিল৷ হসপিটালে ভর্তি ছিল কিছুদিন৷ আমি অত গা করিনি, অন্যের বউয়ের সুইসাইড নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই৷ ডিভোর্সটা হোক, তারপর ভেবে দেখা যাবে৷

ওর যে ডিভোর্স হতে চলেছে সেটা মাসদুয়েক আগেই জানতে পেরেছিলাম আমি৷ একদিন হুট করেই একটা মেসেজ এল আমার কাছে — ‘আমাদের স্কুলের সেই আমগাছটার কথা মনে আছে শুভ? ওটার সামনেই দাঁড়াস৷ আমার তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে৷’

পরদিন সকালবেলা আমগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ স্কুলটা আগের মতোই আছে৷ মনে হয় নতুন রং করা হয়েছে৷ আজ রবিবার বলে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় নেই৷ গোটা মাঠটা খাঁখাঁ করছে৷

আমগাছের সামনে পৌঁছে দেখলাম রাই আগে থেকেই বসে আছে সেখানে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর এখন আর গাছ পড়ে মরার ভয় করে না?’

দু-দিকে মাথা নাড়ে রাই৷ ওর মুখটা দেখে ভারি কষ্ট লাগে আমার৷ কেমন যেন শুকিয়ে গেছে মেয়েটা৷ মুখ জুড়ে একটা লালচে শুকনো ভাব৷ চুলগুলো আগের মতো পরিপাটি নেই আর৷ উজ্জ্বল চোখদুটোয় আর রোদ ঝলকায় না৷ পড়ন্ত বিকেলের মতো বিষণ্ণ হয়ে গেছে মেয়েটা৷

কেবল ওর পাশে গিয়ে বসতেই সেই বৃষ্টির গন্ধটা পেলাম৷ দু-জনের কেউ কোন কথা বললাম না অন্তত মিনিটখানেক৷

গাছের পাতাগুলো কি চিনতে পেরেছে আমাদের? নাঃ অত পুরনো পাতা এতদিন থাকার কথা নয়৷ কবেই ঝরে গেছে ওরা৷ আমাদের কৈশোরের খেলার মাঠ আর এই পরিণত যুবক-যুবতীকে চিনতে পারবে না৷

অনেকক্ষণ সেভাবেই বসে থেকে আমি নিজেই বললাম, ‘দেখ, ডিভোর্স জিনিসটা আজকাল আকছার হচ্ছে৷ আমার তো মনে হয় যত না বিয়ে হচ্ছে তার থেকে বেশি ডিভোর্স…’

আমার দিকে মুখ না ফিরিয়েই আমাকে থামিয়ে দেয় রাই, ‘আমার ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে তোকে আমি এখানে ডাকিনি৷’

‘তাহলে?’

সালোয়ার কামিজের একটা অংশ আঙুলে গোল করে ঘোরাতে থাকে রাই, তারপর নরম গলায় বলে, ‘আমি… আমি প্রেমে পড়েছি…’

‘প্রেমে! কবে?’

‘হানিমুনে গিয়ে…’

আমি প্রমাদ গুনলাম, ‘মানে পরকীয়া?’

কাঁধ ঝাঁকায় রাই, ‘ওসব কিয়া ফিয়া জানি না৷ মোটকথা আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি৷’

‘কাকে?’

‘নাম জানি না৷ সত্যি বলতে নাম নেই ওর…’

‘তাহলে তুই ভালোবেসে ফেললি কী করে?’

এবার আমার দিকে ঘুরে বসে রাই৷ ওর চোখ দুটো যেন আবার আগের মতো জ্বলে ওঠে, ঠোঁটের কোণে সেই পরিচিত হাসিটা খেলে যায়, ‘তুই তো জানিস আমার ছোটোবেলার ব্যাপারটা, ওই মামা ছাদে নিয়ে গিয়ে…’

‘জানি, কী হয়েছে তাতে?’

‘বড়ো হতে হতে ভেবেছি ব্যাপারটা একটা চাইল্ডহুড ট্রমা৷ বয়স বাড়তে বাড়তে কেটে যাবে৷ কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারলাম জিনিসটা আমার আজীবনের সঙ্গী৷ আমি ইম্পটেন্ট শুভ… আমি নভজ্যোতকে খুশি করতে পারিনি৷’

আমি কিছু বললাম না৷ থম মেরে বসে রইলাম৷ ও একটা হাত আমার কাঁধে রাখল, তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগল, ‘রিসেপশনের দিন রাতে তেমন কিছু হয়নি৷ দু-জনেই টায়ার্ড ছিলাম৷ ঘুমিয়ে পড়লাম৷ হানিমুনে আমরা গেছিলাম নেপালে৷ যে হোমস্টেটায় ছিলাম তার মাথার কাছের জানলা দিয়ে হিমালয়ের একটা অংশ দেখা যায়৷ দূরের অনেকগুলো পাহাড় চোখে পড়ে৷

নভজ্যোত প্রথমে সফট ছিল৷ ভেবেছিল আমিই ‘হার্ড-টু-গেট’ খেলছি৷ শেষে যখন বুঝতে পারল আমার শরীরে কোনও বদল আসছে না তখন খুব মারল আমাকে৷ চড়, লাথি, ঘুসি… পাঞ্জাবি মাল — হাতে বিশাল জোর৷ ওদের দেশোয়ালি ভাষায় খিস্তি করল, সিগারেট জ্বালিয়ে ছ্যাঁকা ফ্যাঁকা দিল৷ তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল…’

আমি স্থির চোখে চাইলাম রাইয়ের মুখের দিকে৷ চোখ ছলছল করছে কি? হাওয়াটা বেড়ে উঠেছে৷

‘তারপর?’

‘আমার কিন্তু ঘুম এল না৷ সারারাত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে গেলাম আমি৷ মাথার কাছের ওই জানলাটা দিয়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলাম৷ চেয়েই রইলাম৷ কিছুই ভাবলাম না, জাস্ট অন্ধকারের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ… তারপর… তারপর ভোর হল একসময়৷ আলো ফুটল৷ আর আমি প্রথমবার দেখতে পেলাম ওকে…’

‘কাকে?’

উত্তর না দিয়ে ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা আর্ট পেপার বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল রাই৷ দেখলাম পেন্সিলে একটা মাউন্টেন রেঞ্জ আঁকা আছে সেখানে৷ গোটা কয়েক বরফঢাকা পাহাড় দেখা যাচ্ছে সেখানে৷

আমার কোলের উপর কাগজটা ফেলে রেঞ্জের মধ্যে থেকে একটা ছোট চূড়া আঙুল দিয়ে দেখাল রাই, ‘এই যে, একে…’

‘এটা তো একটা পাহাড়৷’

‘হ্যাঁ, ভোরের আলোয় ওকেই সবার আগে দেখতে পেয়েছিলাম৷ অনেকগুলো বড়োসড়ো তাগড়াই পাহাড়ের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানি না কেন আমার মনে হল ওই পাহাড়টাকে আমি ভালোবাসি৷ অন্য কোনও পাহাড়কে নয়, শুধু ওই পাহাড়টাকেই৷ ওই যে চূড়ায় জমে থাকা গলন্ত বরফ, তার উপরে ভরা সূর্যের আলো… ওরকম করে আমি কোনওদিন কোনও ছেলের দিকে তাকাইনি শুভ… ওরকম স্থির গম্ভীর! যেন কিছুতেই কিছু যায়—আসে না৷ আমি যেভাবে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি ও চেয়ে আছে আমার দিকে৷ কাল সারারাত আমাকে মার খেতে দেখেছে… আমার সমস্ত যন্ত্রণা… শুভ তুই বুঝতে পারছিস…’

বুঝতে আমি কিছুই পারছিলাম না৷ ওর ছিটলামোগুলো এতদিন ধরে দেখে আসছি৷ কিন্তু এবার মনে হয় সব বেড়া টপকে গেছে৷ তাও প্রতিবাদ করলাম না, বললাম, ‘তারপর কী হল?’

‘সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেন বেলা হয়ে গেল৷ পিক ফাইন্ডার অ্যাপটা বের করে ছবি তুলে দেখলাম পাহাড়টার কোনও নাম নেই৷ হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জে এরকম কত পাহাড় আছে কেউ নাম দেয়নি, ও সেইরকম৷ আমি ওর একটা নাম দিয়েছি জানিস, সিয়াং পাহাড়!’

আমি কাগজের উপর আঁকা ছবিটার দিকে তাকালাম৷ ভারি যত্ন নিয়ে আঁকা৷ হালকা কুয়াশা ঘিরে রেখেছে পাহাড়টাকে৷ বরফের স্তরের মধ্যে মধ্যে জেগে থাকা গাছপালার সার দেখা যাচ্ছে৷

‘সেদিন রাতেই নভজ্যোত ভেবে নিয়েছিল ডিভোর্স নেবে আর আমি ভেবে নিয়েছিলাম আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না৷ পরদিন হোমস্টে ছেড়ে বেরনোর আগে শেষবার দেখেছিলাম দূর থেকে ওকে৷ মনে হয়েছিল বুক জুড়ে গলন্ত বরফ নিয়ে ও আমার দিকেই চেয়ে আছে৷ যেমন করে প্রিয় কেউ ছেড়ে চলে গেলে মানুষ চেয়ে থাকে৷ কিন্তু বাধা দেয়নি৷ আমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করেনি…’ কথাগুলো বলতে বলতে দূরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল রাই৷ হুট করেই মাঠে ফিরে আসে ও, ‘কলকাতায় ফিরে খুব বেশি ভাবিনি ব্যাপারটা নিয়ে৷ আমার মাথা জানিসই তো, কখন কী চলে নিজেই জানি না৷ এই ব্যাপারটা কিন্তু কিছুতেই কাটল না৷ কেবল মনে হল অনেক, অনেক দূরের দেশে ওই হোমস্টের জানলার দিকে চেয়ে কেউ যেন অপেক্ষা করছে আমার জন্য৷ কবে আবার ওই জানলার আমার মুখটা দেখতে পাবে… আমি আর থাকতে পারলাম না, জানিস? রাই দাশগুপ্তের আজ অবধি কারও জন্যে এমন করে প্রাণ কাঁদেনি৷ এক মাস কাটতে না কাটতে নিজেই টিকিট কেটে আবার চলে গেলাম ওখানে…কথাগুলো বলে আমার দিকে ফিরল রাই, ‘গত ছ-মাসে আমি মোট সতেরোবার নেপাল গেছি৷ ও আমাকে ডাকছে শুভ৷ সিয়াং আমাকে ডাকছে…’

মেয়েটার মাথায় হাত দিলাম আমি৷ এই মেয়েটাকে ভীষণ চেনা লাগে আমার৷ একটু আগের হাওয়াটা আর বেড়ে উঠেছে৷ ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে থেকে থেকে৷ আমি ওর কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে বললাম, ‘বেশ তো, মানুষকে ভালো লাগছে না যখন পাহাড়কেই ভালোবাস না হয়৷ কিন্তু আমাকে এখানে ডাকলি কেন বল তো?’

‘কথাগুলো কাউকে বলার দরকার ছিল৷ এসব কথা কাউকে বলা যায় না৷ পাগল ভাবে সবাই৷ আচ্ছা তোর কখনও পাগল মনে হয় না আমাকে?’

আমি হাসি, ‘আমি একেবারে প্রথমেই পাগল ভেবে নিয়েছিলাম তোকে৷ তাই আলাদা করে আর মনে হয় না৷’

ওর থুতনিটা ধরে নেড়ে দিই আমি৷ একটু ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, বলে তো দিলি৷ ঠিক লাগছে এখন?’

‘একদম…’

ওর মুখে নরম হাসি খেলে যায়৷ আমার মনটা হালকা হয়ে আসে৷ রাইয়ের মাথাটা আমার কাঁধের উপর ঝুঁকে পড়তে আমি উপরের দিকে তাকাই৷ এখনও আগের মতো অবিরাম পাতা পড়ে যায় গাছ থেকে, সেই আগের মতো৷ এখনও রাইয়ের স্পর্শটা বৃষ্টির ফোঁটার মতো৷ কে যেন একটা আধ খাওয়া কাঁচা আম ফেলে গেছে গাছের পাশে৷ আমাদের খাওয়া আমটাই কি? কে বলতে পারে…

মাসখানেক কাটতে আমি বুঝতে পারলাম রাইয়ের অবসেশনের ব্যাপারটা আমি যতটা ভেবেছিলাম ততটা সহজ না৷ থেকে থেকে আমাকে ফোন করে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করত সে৷ কখনও জিগ্যেস করত, ‘হ্যাঁ রে, পাহাড়ের কোনও ঠিকানা হয় না, তাই না? হলে একটা চিঠি লিখতাম বড়ো করে…’ আবার কোনওদিন আচমকা মাঝরাতে ফোন করে জিগ্যেস করেছে, ‘আচ্ছা শুভ, আমি এই বয়সে কি মাউন্টেনিয়ারিং শিখতে পারব? আমি ওরা আমাকে ভর্তি নেবে?’

আমি যতটা পারতাম জবাব দিতাম৷ সত্যি কথা বলতে কী পাহাড়ে চড়ার ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আমার তেমন আইডিয়া তার আগে ছিল না৷ গুগল খুঁজে খানিক গবেষণা করলাম৷ খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম রাইয়ের সিয়াং পাহাড় প্রায় বারো হাজার ফিট উঁচু একটা নন ক্লাইম্বেবল মাউন্টেন৷ মানে সোজা কথায় খানিক ওঠার পর আর পথ নেই বলে লোকজন ওর ধারে-কাছে খুব একটা যায় না৷ শীতের সময় তুষারপাত হয়৷ উপর থেকে নিচ অবধি ঘন, দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢাকা৷

অথচ এই পাহাড় নিয়ে পাগলামিতেই দিনদিন মেয়েটার অবস্থা খারাপ হতে লাগল৷ ওর ফ্ল্যাটে একদিন নেমন্তন্ন করল আমাকে৷ গিয়ে দেখলাম চারিদিকের দেওয়াল জুড়ে শুরু সেই সিয়াং পাহাড়ের ছবি৷ কোনওটা তার নিজের হাতে তোলা, কোনওটা আবার স্যাটেলাইট ইমেজ প্রিন্ট করা৷ খাতা ভর্তি সেই পাহাড়ের আউটলাইন৷ সেসবের মাঝে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকেই কেমন পাগল পাগল মনে হল৷

ওকে বারকয়েক একজন কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে গেছিলাম আমি৷ দেখে টেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখো ভাই, ছোটোবেলা থেকে হাজারটা কারণে মেয়েটা সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ভুগছে৷ সোশ্যাল অ্যাংজাইটির চরম লেভেলে৷ ছোটো থেকে ডিলিউশনের শিকার৷ বড়ো হতে হতে ব্যাপারটা বেড়েছে৷ থরো ট্রিটমেন্ট দরকার৷’

কিন্তু রাই ওসব করতে চায়নি৷ আমিও জোরজার করিনি ওকে৷ সত্যি বলতে স্কুলে প্রথমদিন থেকে আমি ওর ভালো চেয়েও কোনওদিন জোর করিনি কিছু৷

তবে একদিন করেছিলাম৷

দিন পনেরো আগে আমাকে ফেসবুকে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ করে রাই—ভাই পরশুদিন আমার মা মারা গেছে৷ তুই একবার আমার ফ্ল্যাটে আয়৷ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি৷

গোলমেলে কিছু একটা যে করতে চলেছে সেটা আমি রাস্তায় যেতে যেতেই আন্দাজ করেছিলাম৷ ওর ফ্ল্যাটে পৌঁছে বুঝলাম ওর পাগলামি চরমে উঠেছে৷

পড়ার টেবিলে বসে আনমনে কী যেন হিসেব করছিল সে৷ খুব একটা দুঃখে টুক্ষে আছে বলে মনে হল না৷ ঘরের অবস্থা দেখে বুঝলাম আজ সকাল অবধিও আত্মীয়স্বজন ছিল বাড়িতে৷ কিছুক্ষণ আগেই তারা বিদায় নিয়েছে৷

আমাকে দেখেই উঠে পড়ল৷ আমি এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলাম তার গালে, ‘এতকিছু ঘটে গেল আর তুই আমাকে…’

রাই কাঁধ ঝাঁকায়, ‘মা একদিন চলেই যেত৷ আজ না হোক কাল, তাছাড়া তোকে আমি বিয়ে করিনি, অত হিসেব দিতে যাব কেন?’

আমার মাথাটা গরম হল, বললাম, ‘তাহলে আজই বা আমাকে ডাকলি কেন?’

রাইয়ের মুখে চেনা হাসিটা খেলে যায়, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাতে তোর হেল্প দরকার৷’

‘কী সিদ্ধান্ত?’

‘আমি ওর কাছে চলে যাব শুভ৷ আর ফিরব না…’

‘ওর কাছে বলতে?’

‘সিয়াং পাহাড়ের কাছে৷ মা-ও চলে গেল৷ আমার আর কোনও পিছুটান নেই৷ কিন্তু একা যেতে মন কেমন করবে৷ তুই আমাকে শেষবার দিয়ে আসবি ওখানে৷ আমি আর ফিরব না…’

বিরক্তি চরমে উঠল আমার, ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম, ‘ফিরবি না মানে? তোর মাথা খারাপ হয়েছে? এটাকে সুইসাইড বলে রাই…’

রাইয়ের মুখে অভিমানের হাসি খেলে যায়, ‘তুই তো একদিন বলেছিলি শুভ, বেঁচে থাকা মানে আসলে মরে যাওয়া৷ আমিও তো বাঁচতে চাইছি মরার আগে৷’

ওর গালে সজোরে একটা চড় কষাই আমি, ‘দেখ, এতদিন তোর অনেক পাগলামি সহ্য করেছি আমি৷ কিন্তু এটা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়… আমি…’

হুট করেই আমার ভীষণ কাছে এগিয়ে আসে রাই, দু-হাতে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে আমাকে৷ কান্নার দমক ঠেলে আসে ওর গলা বেয়ে, ‘তুই আমাকে কোনওদিন ভালোবাসলি না তো শুভ৷ শুধু ভালো রাখতে চেয়েছিলি যখন, আজ তোর কষ্ট হচ্ছে কেন বল তো?’

হঠাৎ মনে পড়ে গেল এতগুলো বছরে আজ অবধি ও আমাকে একবারও জড়িয়ে ধরেনি৷

আমি দুটো হাত রাখলাম ওর পিঠে৷ সত্যি তো, রাইকে আমি ভালোবাসলাম না কেন?

রাই তখনও আমার বুকের মধ্যে ফুঁপিয়ে চলেছে, ‘আমি যাদের কিচ্ছু দিতে পারব না কোনওদিন, যাদের সঙ্গে মিশতে পারব না কোনওদিন, যাদের আনন্দে, দুঃখে, জন্মে, মৃত্যুতে আমার কোনও ভাগ নেই, আমি তাদের সঙ্গে কেন থাকব বল তো?’

আমার হাতটা ওর পিঠ থেকে মাথায় উঠে আসে, বিড়বিড় করে বললাম, ‘বেশ, আমি তোকে রেখে আসব ওখানে৷ তুই ভালো থাকবি তো তাতে?’

সেই প্রথম আফসোস হল, আঃ, যদি রাইকে ভালোবাসতাম তাহলে কি ওকে আটকে রাখতে পারতাম? ভালোবাসলেই তো জোর করা যায়৷ তারপর কী মনে হল জানেন? একমাত্র ভালোবাসলেই জোর করা যায় না৷ আটকে রাখা যায় না৷

বড়োবাজারের শাড়িওলাকে দাম কমানোর জন্য জোর করা যায়, হাড়কাটা গলির বেশ্যাকে জোর করা যায়, রাজনীতিতে, যুদ্ধে, লোভে, হিংসায় জোর করা যায়—কেবল ভালোবাসায় যায় না৷

আমার বুক থেকে যখন মুখ তুলল রাই তখন ওর মুখ ভেসে যাচ্ছে উজ্জ্বল আলোয়৷ ঝট করে বিছানার তলা থেকে একটা ছোট্ট কাগজ আমার হাতে তুলে দিয়েছিল সে৷ আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম সেই পুরনো হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জের ছবিটা৷ এখনও পাহাড়ের কোল থেকে উঁকি দিচ্ছে সিয়াং পাহাড়৷ পার্থক্য কেবল একটাই৷

তার ঠিক পাশে আরেকটা ছোট্ট পাহাড় দেখা যায় ছবিটায়৷ এই পাহাড়টারও কোনও নাম ছিল না৷ রাই পেন্সিল দিয়ে ছোট ছোট করে সেই পাহাড়টার নাম লিখে দিয়েছে—শুভময়৷ আমার দিকে তাকিয়ে হাসে ও, ‘বলেছিলাম না, আমার পাশেই তুই থাকবি সবসময়…’

তো যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আবার ফিরে আসি৷ গত বছরের মার্চ মাসের দিকে সিয়াং পাহাড়কে ভালোবেসে ফেলেছিল রাই৷ তারপর থেকে প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে৷

আমি আপাতত দাঁড়িয়ে আছি একটা বিচিত্র জায়গায়৷ আমার দু-পাশে জঙ্গলে ঢাকা দুটো পাহাড় উঠে গেছে৷ ডানদিকের জঙ্গলটা সিয়াং পাহাড়ের শুরু৷ এখন অগাস্ট মাস, ফলে এতটা নিচে বরফ পড়া শুরু হয়নি৷ ঘনসন্নিবিষ্ট গাছগুলো উপর থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে৷

একটু আগে রাই ওর ছোট্ট পিঠব্যাগটা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো হেসে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেছে ওই জঙ্গলের মাঝে৷ আমি জানি এই জনবিহীন পাথরে প্রান্তরে সপ্তাহখানেকের বেশি বাঁচতে পারবে না ও৷ জঙ্গলে লেপার্ড আছে, রোগ-ব্যাধির ভয় কম নেই, কিংবা হয়তো খেতে না পেয়ে অনাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে মরবে কোনও গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে৷

কেউ ভালোবেসে যন্ত্রণা পেতে চাইলে তাকে আটকে রাখা যায় না৷ আমি রাইকে ভালো রাখতে চেয়েছিলাম, বেঁধে রাখতে চাইনি৷ কেবল ও চলে যাওয়ার আগে শেষবার ওর গালে হাত রেখেছিলাম৷ আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলাম কপালে৷ তারপর সেই পরিচিত প্রশ্নটা শেষবারের মতো করেছিলাম, ‘ঠিক লাগছে এখন?’

‘একদম…’

কথাটা বলে ও আর দাঁড়ায়নি৷ একবার পেছনে ফিরেও তাকায়নি৷ আমার ছোটোবেলার ক্লাস ইলেভেনের বেঞ্চে বসা, ঝরঝরিয়ে হেসে ফেলা, পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটা পাথুরে পথে পাহাড়ি ঝরনার মতো লাফাতে লাফাতে হারিয়ে গেছে দূরে৷ এই কয়েকশো মাইল বিস্তৃত ঘন জঙ্গলের মধ্যে ওকে আর কেউ খুঁজে পাবে না কোনওদিন৷ আর ফিরবে না৷ মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পেলে আর কোথাও ফেরে না…

সেখানে দাঁড়িয়েই পিঠের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে কিছুটা জল খেলাম আমি৷ বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷

আমার ঠিক বাঁদিকে অন্য পাহাড়টা উঠে গেছে৷ এই পাহাড়টার একটা নাম দিয়ে গেছে রাই৷ শুভময়৷

আমি আনমনে হেঁটে সেদিকে খানিকটা এগিয়ে এলাম৷ মোবাইলে সিম কার্ডটা অনেকক্ষণ আগেই ফেলে দিয়ে এসেছি৷ এখন ফোনটা একটা পাথরের তলায় চাপা দিয়ে রাখলাম৷ ওটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কখনও৷

পিঠের ব্যাগটা ভালো করে কাঁধে চাপিয়ে আমি পাহাড়ি পথে খানিকটা উঠে এলাম৷ চারপাশে মধ্যে মধ্যে পাখি ডাকছে৷ জলের আওয়াজ আসছে যেন কোথা থেকে৷ তাছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷ মনটা হালকা হয়ে গেল আমার৷

খানিক দূর এগিয়ে আরেকটু ঘন হয়েছে জঙ্গল৷ আমার ট্রেক করার অভ্যাস খুব একটা নেই৷ তাই হাঁটতে একটু অসুবিধাই হচ্ছে৷ ছোট বড় পাথর জড়ো হয়ে হয়ে সংকীর্ণ রাস্তা৷ এ পাহাড়ে মানুষ আসে না, ফলে বিশেষ কোনও রাস্তা নেই৷ যেদিকে ওঠা যায় সেদিকেই এগিয়ে চলেছি৷

মোটামুটি ঘণ্টাদুয়েক সেভাবে উঠে আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ হ্যাঁ! এতক্ষণে আমিও হারিয়ে গেছি৷ আমাকেও আর খুঁজে পাওয়ার কোনও উপায় নেই৷

আমার সামনেই একটা আকাশছোঁয়া গাছ৷ এ গাছটার নাম আমি জানি না৷ বড়ো করে একটা শ্বাস নিয়ে কাণ্ডের খাঁজে পা রেখে খানিক দূর উঠে এলাম৷ হ্যাঁ, এখান থেকে সিয়াং পাহাড়ের বেশ অনেকটা জায়গা দেখা যায়৷ মন বলল ওই পাহাড়েরই কোনও একটা গাছের গুঁড়িতে বসে প্রাণ খুলে হাসছে রাই৷ মন খুলে সব কথা বলছে পাহাড়টাকে৷

আমি গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসলাম৷ কী জানি কোন এক ফাঁকে ওর শরীরটা হয়তো দেখতে পাব এখান থেকে…

ব্যাপারটা ভাবতেই মুখে হাসি খেলে গেল আমার৷ নাহ, আর কোথাও ফিরে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না৷ এখানে এই পাহাড়ের বুকে গা এলিয়ে থেকে তাকিয়ে থাকব ওই পাহাড়ের দিকে৷ প্রেমিকের শরীরে লুকিয়ে থাকা রাইয়ের হাসি মুখটা একবারও কি দেখতে পাব না?

সেই যে স্কুলের আমগাছটায় ঝুলতে ঝুলতে মনে হয়েছিল ওর হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে আমি আমার গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি৷ সে নেশাটা আর ছাড়ল না আমায়…

আমি এখানেই থেকে যাব৷ যতদিন এই মানুষের চেনা জগৎ থেকে বহু দূরে পাহাড়ি জঙ্গলে বেঁচে থাকা যায়…

রাই কি পাগল ছিল? আমি কি পাগল ছিলাম? জানি না, শুধু এটুকু জানি, ক্লাস ইলেভেনে স্কুলের মাঠে এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে আমার মনে হয়েছিল, রাই দাশগুপ্তর হাসি মুখের দিকে চেয়ে আমি একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *