সাপ-লুডোর উৎস সন্ধানে

সাপ-লুডোর উৎস সন্ধানে

তিব্বতের হিমশীতল পরিবেশে একটি ছোট্ট বাড়ি। এখানে একটি যুবক তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে থাকেন। যুবকটি এই বয়সেই বুদ্ধের অভয় মন্ত্র নিয়ে বৌদ্ধ হয়েছেন। যুবকটির নাম স-স্ক্য পণ্ডিত। স-স্ক্য পণ্ডিতের মায়ের বড় অসুখ। ঘর থেকে তিনি বেরোতে পারেন না। ফলে অসুস্থ মাকে রেখে স-স্ক্য পণ্ডিতের পক্ষে সমস্ত সময়টা ধর্মের অনুশীলনে কাটানো সম্ভব হয়নি। পার্থিব বস্তুগুলি তাঁর কাছে অনিত্য হলেও মায়ের ওপর তাঁর অসীম মমতা। মায়ের কষ্টের কথা মনে হলেই বুদ্ধের করুণাঘন চোখদুটির কথা তাঁর মনে পড়ে। তিনি তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন না।

আমরা যে সময়কার কথা বলছি, তা দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ অথবা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু। বঙ্গদেশে তখন হিন্দু রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে। মুসলিম রাজারা পাকাপাকি শাসন জারি করেছেন এখানে। লক্ষ্মণসেনের গৌড় অধিকার করার জন্য বকতিয়ার খিলজি যখন বিহারের মধ্যে দিয়ে আসেন, তখন অনেক বৌদ্ধ বিহার তিনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি নাকি বোকামি করে বৌদ্ধ স্তূপগুলিকে হিন্দুদের দুর্গ বলে মনে করেছিলেন। যাই হোক, দলে দলে বৌদ্ধরা তখন নেপালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই নেপাল থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার আগেও এখানে হয়েছিল, কারণ স্বয়ং বুদ্ধের জন্মভূমি কপিলাবস্তুই তো নেপালে। সে আর তিব্বত থেকে কত দূর!

স-স্ক্য পণ্ডিতের হয়তো এই কথাটাই মনে হত। মায়ের অসুখ দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং আরও চলবেও। তাঁর বড় ইচ্ছে—বুদ্ধের নামাঙ্কিত স্থানগুলি অন্তত একটু ঘুরে আসা। ব্যবস্থাও একটা হল। দেখাশোনা করার জন্য একটি ভালো লোক জোগাড় করে তিনি তিব্বত থেকে বেরিয়ে পড়লেন বুদ্ধের নামে। বেশি দূর কিন্তু যাওয়া হল না। কাঠমাণ্ডু থেকে ৫০ মাইল গিয়ে কেরুঙ-এ এসেই তাঁর যাত্রা থেমে গেল। এখানে এসে তিনি একটা অদ্ভুত জিনিস পেলেন। ঘরে বসে খেলা যায়—এমন একটা খেলার ছক। নাম ‘নাগপাশ’। স-স্ক্য পণ্ডিত বাড়ি ফিরে এলেন। নাগপাশের ছকে ৭২টা ঘর বা খোপ আছে। তার মাঝে-মধ্যে লাল সাপ আর কালো সাপ। আর বিভিন্ন ঘরে আছে মানুষের মূর্তি, দেব-মূর্তি। আর আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—তিন মূর্তি। নাগপাশ তো ঘরে নিয়ে এলেন স-স্ক্য পণ্ডিত। কিন্তু একজন বৌদ্ধ হয়ে কী করে তিনি এই হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ছবি নিরন্তর দেখবেন? বাড়িতে এসে তিনি নতুন একটি ছক তৈরি করলেন। তাতে থাকল বৌদ্ধদের ভাবনাচিন্তা। সাপের স্থান হল না স-স্ক্য পণ্ডিতের ছকে। শিব-পদ বা বিষ্ণু-পাদপদ্মের বদলে পরম স্থানটির নাম হল নির্বাণ অথবা পরম আনন্দ-ভূমি সুখাবতী।

স-স্ক্য পণ্ডিত নেপাল থেকে নাগপাশ তিব্বতে নিয়ে এলেন। কিন্তু এই খেলাটা মূলত নেপালের না ভারতবর্ষের—সেটা একটু খুঁটিয়ে বুঝতে হবে। অবশ্য সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সেকালের ভারতবর্ষে নেপাল বলে কোনও আলাদা জায়গা ছিল না, ভারতবর্ষের কৃষ্টিই সেখানে চলত। এবারে বলি স-স্ক্য পণ্ডিত যে ছক পেয়েছিলেন, সেই খেলার ছক আসলে কোথাকার।

১৯৭৭ সালের এক দুপুরে দীপক সিংখাদা নামের এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি বিভাগের ফিলড মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের নানা ছবির সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। হঠাৎই মিউজিয়ামের আবছা অন্ধকার কোণে রাখা,একটি অদ্ভুত ছবির ওপর তাঁর নজর পড়ে যায়। মিউজিয়ামের রেজিস্টারে ছবিটির বিষয়ে শুধু লেখা হয়েছে, ধর্মীয় বিষয়—’রিলিজিয়াস ওয়র্ক’। ছবিটা উত্তর ভারতের একজন আর্ট-ডিলারের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল এবং ছবির মধ্যে যেহেতু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সশরীরে বর্তমান, অতএব মিউজিয়ামের কর্মকর্তারা এটাকে একটা ধর্মীয় চিত্রপট হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। নানা পুথিপত্র পড়ে দীপকের মনে হল ব্যাপারটা নিছক ধর্মীয় নয়, সঙ্গে আরও কিছু আছে, যেটা ধর্মের চেয়েও বেশি। তিনি আরও বুঝলেন, উত্তর ভারত থেকে ছবিটা কেনা হলেও ছবিটার মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। গবেষণার এই সূত্রটুকু দীপক জোগাড় করেছিলেন ‘ওহায়ো স্টেট ইউনির্ভাসিটির শিক্ষক প্রোফেসর হান্টিংটন-এর কাছ থেকে। তিনি দীপককে প্রথম বলেন, ”তুমি কাঠমান্ডু যাও। মনে হচ্ছে, সেখানকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে’ এরকমই একটা ছবি আমি দেখেছি।’ ব্যস! পরের বছর দীপক চলে এলেন নেপাল। নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে দীপক লক্ষ করলেন, একই রকম একখানি চিত্রপট, ঠিক যেমনটি তিনি শিকাগোতে দেখেছেন—ঠিক সেইরকমই আরও একটি চিত্রপট সেখানে আছে এবং তার নাম নাগপাশ। এটা সেই অর্থে নৈষ্ঠিকভাবে ধর্মীয় কিছু নয়, এটা একটা খেলার ছক। নেপালিরা শুদ্ধ করে এটাকে নাগপাশ বলেন, কিন্তু মৌখিকভাবে এটাকে ওঁরা বলেন ‘বৈকুণ্ঠ-খেল’। আসলে এটাই মূলত আমাদের সাপ-লুডো।

ছেলেবেলায় যারা রামায়ণ পড়েছে, তারা নাগপাশ শব্দটা শুনেছে। সেই যে ইন্দ্রজিৎ রাম-লক্ষ্মণকে বিষে-বিষে জর্জরিত বিষবাণ ছুড়েছিলেন, সেই বাণের শক্তিতে অসংখ্য সাপ রাম-লক্ষ্মণের শরীর জড়িয়ে ধরল এবং বিষ-দংশন করতে থাকল তাঁদের শরীরের নানা জায়গায়। রাম-লক্ষ্মণ আর সাপের কবল থেকে বেরোতে পারলেন না, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। শেষে পক্ষিরাজ গরুড়ের সাহায্যে রাম-লক্ষ্মণ সাপের কবল থেকে মুক্তি পান।

নেপালে পাওয়া নাগপাশের ছকেও রয়েছে এই সাপ। লাল সাপ আর কালো সাপ। লাল সাপ শুভ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। আর কালো সাপ অশুভ এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে কৃষ্ণ সর্প, কালো-সাপ, কালো সাপ অথবা গোখরো সাপের কথাটা প্রায়ই ব্যবহার করি। নেপালি নাগপাশে এই কালো সাপগুলোই যত গণ্ডগোলের মূল। এর মাথায় গুলি পড়লে একেবারে লেজের শেষে নামতে হবে। অন্যদিকে লাল-সাপের লেজে পৌছতে পারলে সে খেলোয়াড়কে অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেয়।

আমরা যে সাপ-লুডো খেলি, তাতে সাপগুলো সব ঠিকই আছে, খেলোয়াড়কে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে সাপগুলি মূর্তিমান অজগরের মতো নিথর হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু খেলোয়াড়কে সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখানে মই, তির অথবা একেবারে আধুনিককালে রকেটও ব্যবহার করা হচ্ছে। লাল সাপগুলি এখানে অনুপস্থিত।

এই খেলার কালো সাপের মাথা আর লাল সাপের লেজের চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ এই খেলার উদ্দেশ্য। আমরা যেমন শুধু খেলার মজাটুকু পাওয়ার জন্যই সাপ-লুডো খেলি, নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য কিন্তু তা ছিল না। বরং এই খেলার উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর এবং সেটা খানিকটা ধর্মীয়ও বটে। এই খেলার উদ্দেশ্য ছিল কর্মফল মাপা। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্মে আমরা ভালো কাজও করি, মন্দ কাজও করি। ভালো কাজের ফল পুণ্য, মন্দ কাজের ফল পাপ। সেকালের মানুষ বিশ্বাস করত, মানুষের এই পাপ-পুণ্য বা শুভাশুভ ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য জমা হয়ে থাকে। অথবা এই পাপ-পুণ্যের ফলেই মানুষ মৃত্যুর পর নরকে বা স্বর্গে যায়। ভালো কাজ করলে মানুষ স্বর্গে যায় এবং দেবতাদের সঙ্গে সে বসবাস করে। আর খারাপ কাজ করলে মানুষ নরকে যায় এবং অনন্ত দুঃখ-কষ্ট পায়। কিন্তু এই জন্মে আমরা যে কাজ করেছি—সেগুলো ভালো করেছি না মন্দ করেছি, সে-সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকলেও মানুষের তবু সন্দেহ থাকে। অর্থাৎ, আমি সত্যিই ভালো কাজ করেছি তো? না কি মন্দ করেছি? অথবা ভালো-মন্দ যাই করে থাকি না কেন, তার ফল কী হতে পারে? এই যে কর্মফলে মানুষের বিশ্বাস, এই বিশ্বাস থেকেই নাগপাশ খেলার জন্ম। অর্থাৎ নাগপাশ হল মানুষের কর্মফল মাপার একটা মজাদার উপায়।

নেপালি নাগপাশের যে দুটি চিত্রপট পাওয়া গেছে, সেই দুটিই শক্তপোক্ত কাপড়ের তৈরি ছক। নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত খোপ আছে ৭২টা। তাতে লাল-কালো মিলিয়ে সাপ আছে ১৫টা। খোপগুলির নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত যে আটটা সারি আছে, তার বেশিরভাগ সারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কিছু মানুষের ছবি, যারা সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষের আত্মজ্ঞান লাভের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ—যেগুলো মানুষকে তার নিজস্ব সত্তা, চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, তার অভিব্যক্তি চিত্রিত হয়েছে নীচের দিকের সারিগুলোতে। আর একেবারে ওপরের দিকের সারিগুলোতে জ্ঞান, চেতনা, আত্মোপলব্ধি এবং পরিশেষে একেবারে ওপরের সারিতে পরম ঈশ্বরের সান্নিধ্য-লাভ। কারণ, সেখানেই বিচিত্র বর্ণের সমাবেশে চিত্রিত হয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—এই তিন মূর্তি।

খেলোয়াড়ের কাজ হল এক-দুই তিন ইত্যাদি সংখ্যাবিশিষ্ট একটি ঘুটি চালা অথবা কড়ি চিতিয়ে খেলা। যা দান উঠবে সে তত ঘর যাবে। এই যাওয়ার পথেই সে সাপের ফাঁদে পড়বে। অর্থাৎ, নাগপাশে বাঁধা পড়বে এবং তাকে নীচে নামতে হবে। অথবা লাল-সাপ তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে উন্নত ভূমিতে। খেলার সময় কালো সাপের মুখে পড়লে বুঝতে হবে, ইহজন্মে অথবা গতজন্মে তুমি বহু খারাপ কাজ করেছ। সেই সঞ্চিত কর্মফলে সাপ তোমাকে গিলে খেল এবং শরীরের ভেতর দিয়ে চালান করে দিল একেবারে নীচে কর্মভূমিতে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল—এখন থেকে সু-চিন্তা করো, ভালো কাজ করো। লাল সাপের কাজ কিন্তু একেবারে উলটো, আগেই তা বলেছি। এই যে মানুষের ছবি, কর্মভূমি, আত্মজ্ঞান—এতসবের অভিব্যক্তি শিকাগোর চিত্রপটে নেই। সেটা অনেক সহজ-সরল। কিন্তু নেপাল মিউজিয়ামের চিত্রপটটি অনেক জটিল, ছবিও সেখানে অনেক বেশি। গবেষণার সুবাদে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, নেপালে এই নাগপাশের খেলা চালু হয়ে গিয়েছিল মোটামুটি দশম খ্রিস্টাব্দেরও অনেক, অনেক আগে। এই নেপাল থেকেই খেলাটি আবার তিব্বতে ঢোকে। সে-কথা আমি বলেছি স-স্ক্য পণ্ডিতের কাহিনিতে। ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে কীভাবে চলত, তা এবার জানাই।

হরিশ জোহারি নামে এক পণ্ডিত ‘লীলা’ বলে একখানি বই লিখেছিলেন ১৯৭৫ সালে। তিনি দেখিয়েছিলেন, ভারতবর্ষে বহুকাল ধরেই সাপ-লুডো খেলার চল ছিল এবং তারও উদ্দেশ্য ছিল আত্মজ্ঞান। সেই খেলার ছকেও ছিল ৭২টা খোপ। মানুষের মুক্তির পথে চলার বাধা হিসেবে এখানেও ছিল ছোট-বড় সাপ। কিন্তু তাকে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এক লাফে উঁচুতে ঠেলে দেওয়ার জন্য এখানে লাল সাপের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে তির বা বাণ। এই তির বা বাণই কালে কালে পরিবর্তিত হয়ে ভারতীয় সাপ-লুডোর ছকগুলোতে মই বা সিঁড়ির চেহারা নিয়েছে। আধুনিকতা সাপ-লুডোর ব্যবসায়ীদের আরও নতুনত্ব শিখিয়েছে। তারা এখন মইয়ের বদলে রকেট ব্যবহার করছে, সাপের বদলে প্যারাশুট ব্যবহার করছে। ফলে সাপ-লুডোর মধ্যে যে কর্মফল, আত্মজ্ঞান অথবা দেবদর্শনের প্রতীকী ব্যাপারগুলো ছিল, তা হারিয়ে গিয়ে খেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরিশ জোহারি জানিয়েছেন, ভারতীয় সাপ-লুডোর ছকে তিরচিহ্নের প্রচলন আর নেই অনেকদিন। সাপ আর তিরযুক্ত ছকগুলো এখন বাজারে পাওয়াই যায় না, যদিও ভারতের মূল ভূখণ্ডে এই ছকটাই আগে প্রচলিত ছিল, যার নাম ছিল ‘জ্ঞান-চৌপার’। এই জ্ঞান-চৌপারের আরও একটা নাম ছিল ‘মোক্ষ-পতমু’। দীপক সিংখাদা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, আধুনিক সাপ-লুডোতে যে সাপ এবং মইয়ের ব্যবহার হয় তা এই জ্ঞান-চৌপার থেকে এসেছে, অথবা এসেছে নেপালি নাগপাশের মডেল থেকে। লক্ষণীয় ব্যাপার নেপালি নাগপাশ তিব্বতি স-স্ক্য পণ্ডিতের ছক এবং ভারতীয় জ্ঞান-চৌপার—এই দুটিরই মূলে ৭২টি খোপ ছিল। তিব্বতি ছকে খেলাটা শুরু হত ২৪-সংখ্যক ঘর থেকে, কারণ, বৌদ্ধ-মতে ২৪-এর ঘরটাই হল অসীম আনন্দভূমি সুখাবতীর দ্বার। হিন্দুদের নাগপাশে যে কর্মফলের ব্যাপারটা আছে, সেই কর্মফল বা কর্মপথের সঙ্গে বৌদ্ধদের কোনো বিরোধ নেই। কারণ, তাঁরাও কর্মে বিশ্বাস করেন। জ্ঞান-চৌপারের ছকে খেলা শুরু হত ৬৮ নম্বর ঘর থেকে, কারণ সেখানেই ভগবান বিষ্ণুর আসন। খেলোয়াড় বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারে না, যেহেতু দান চালার পর এগোতে-এগোতে তাকে সাপের মুখে পড়তে হয়। কুকর্মের ফল আর কী! কিন্তু খেলতে খেলতে খেলোয়াড়কে আবার ফিরে আসতে হবে সেই ৬৮ নম্বর ঘরেই। ভাবটা এই, সেই পরম আনন্দ থেকে তুমি জন্মেছ, ফিরেও যেতে হবে সেই আনন্দে। মাঝখানে কর্মভোগ আছে, অতএব সাপের মুখোমুখি তো হতেই হবে কোনও-না-কোনও সময়। একমাত্র নেপালি নাগপাশ কিন্তু শুরু হয় একেবারে এক নম্বর ঘর থেকে, যা সৃষ্টি বা জন্মের সঙ্গে একার্থক। যেহেতু সৃষ্টি দিয়েই ঈশ্বর তাঁর কাজ শুরু করেন, অতএব খেলাও শুরু হয় ওই এক-সংখ্যক ঘর থেকেই। জীবনের গতিতে শৈশব, যৌবন, জরার পথ ধরে খেলোয়াড় এগোতে থাকে। এই যাওয়ার পথ নিয়ন্ত্রিত করে লাল আর কালো সাপ। ফলে কখনও সে লাফ দিয়ে ওপরে ওঠে, আবার কখনও এক ঠেলায় নীচে নামে। শেষে অন্তিম পুণ্যফলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু অথবা মহেশ্বর শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মানুষের।

গোলোকধাম বলে একটা খেলা এখানে চালু ছিল। গরানহাটার কৃষ্ণচন্দ্র ধর প্রকাশিত ‘সচিত্র গোলোকধাম’ কিনতেন অনেকে। এই গোলোকধাম সেকালের বটতলার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হত এবং পরে আরও উন্নত হয়ে নব-গোলোকধামে পরিণত হয়েছিল। এই খেলার ছকে ঘর ছিল ৬৪টি এবং খেলা শুরু হত এক নম্বর ঘর থেকে। এই এক নম্বর ঘরের নাম মাতৃভূমি বা জন্মভূমি।

এদিক দিয়ে দেখতে গেলে নেপালি নাগপাশের প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। কারণ নাগপাশেও খেলা শুরু হত ১ সংখ্যা থেকে এবং সে-ঘরটা সৃষ্টির। গোলোকধামে মানুষের পতনের জায়গাগুলি ছিল—নরককুণ্ড এবং যমপুরী। আর পুণ্য থাকলে মানুষের নানা তীর্থে বাস ঘটত, যেমন—বদরিকাশ্রম, দ্বারকা, নবদ্বীপ ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে গোলোকধামের ঘরের সংখ্যা বেড়ে ১০০ হয়। পতনের কারণ হিসেবে এখানে যেমন চৌর্যবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, লোভ, লালসা ইত্যাদি সাপের মুখে পড়তে হত, তেমনই বিশ্বস্ততা, সাত্ত্বিকতা, জ্ঞান—ইত্যাদি ছিল মই বেয়ে ওঠার ঘর। সচিত্র গোলোকধামে ‘শ্বশুরবাড়ি’ বলেও একটা সংখ্যা ছিল, তবে পাপের ফলে সেখানে যাওয়া ঘটত, না কি পুণ্যের ফলে সেখানে যাওয়া ঘটত, সেটা তত স্পষ্ট নয়। গোলোকধাম ‘খেলায় ৮৪ সংখ্যা থেকে ৯৯ সংখ্যা পর্যন্ত চারটি ঘর ছিল, সেগুলোর নাম—ক্রোধ (৮৪), লোভ, গর্ব, লালসা (৯৯)। ৯৯-র সাপটাই সবচেয়ে লম্বা। খেলার দিক দিয়ে এতে হয়তো একেবারে শেষে গিয়ে চরম উত্তেজনা তৈরি হত। কিন্তু নেপালি নাগপাশে এইসব ঘর অনেক আগেই পেরিয়ে আসতে হয়। কারণ, ধর্মের জগতে লালসার পরেই হঠাৎ করে নির্বাণে পৌঁছনো যায় না। তার জন্য ক্রমিক উত্তরণ এবং সাধনা শুরু হয় নীচের ছ’-সাত সারির পর থেকেই। গোলোকধামে নির্বাণ শব্দটা অবশ্য তিব্বতি স-স্ক্য পণ্ডিতের প্রভাব। অন্যদিকে, এটাও লক্ষ করতে হবে, বাঙালির গোলোকধাম নামটির সঙ্গে নেপালি নাগপাশের কথ্য পরিভাষা ‘বৈকুণ্ঠ খেল’-এর কোনও তফাত নেই। কারণ, গোলোক আর বৈকুণ্ঠ একই কথা। যাই হোক, ছকটা উত্তর ভারতীয় জ্ঞান-চৌপার বা মোক্ষ-পতমুই হোক, নেপালের নাগপাশই হোক অথবা স-স্ক্য পণ্ডিতের তিব্বতি ছকটাই হোক, সব ছকেই কিন্তু মূলে ৭২টি খোপ ছিল। পরে তিব্বতের ছকে ১০৪টা খোপ এসেছে, জ্ঞান-চৌপার বা মোক্ষ-পতমুতেও ১০০টা ঘর এসেছে এবং বৈকুণ্ঠ-খেলেও খোপের সংখ্যা এখন ১০০। কিন্তু দীপক সিংখাদা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, মূলে সবক-টি খেলাতেই ৭২টা ঘর ছিল। দীপকের বক্তব্য—এই ‘৭২’ সংখ্যাটা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলিতে খুব বড় একটা প্রতীক। বৌদ্ধ মতে সংসার-চক্রের যে বিভিন্ন স্তর আছে, তার সংখ্যা ৭২। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যেতে পারে—জাভা দ্বীপে যে বিশাল বরবুদুর বৌদ্ধস্তূপ আছে, তার স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল জাগতিক বিশ্ব-প্রপঞ্চের অনুকরণে এবং সেখানে ৭২টা ছোট্ট স্তূপ নির্মিত হয়েছে ঘণ্টার আকারে। বৌদ্ধধর্ম এবং স্থাপত্যে এই ৭২ সংখ্যাটাই দীপককে বুঝিয়েছে, সাপ-লুডো খেলার মূল লুকিয়ে আছে বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই। অর্থাৎ, ভারতীয় জ্ঞান-চৌপার, নেপালি নাগপাশ বা তিব্বতি স-স্ক্য পণ্ডিতের ছক—এই সবকিছুরই উৎসভূমি হল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। দীপক একটি সুপ্রাচীন পালি গ্রন্থের উল্লেখ করে বলেছেন, ভগবান বুদ্ধ ঠিক স্পষ্ট করে না বললেও কর্মফল এবং মানুষের জীবনের যাবতীয় উত্থান-পতন এবং ধর্মপথের সাফল্যগুলোকেও একটা ছকেই বেঁধে ফেলেছেন। সে-ছক হিন্দুরাও মেনেছেন, বৌদ্ধরা তো মেনেছেনই। তারই সুফল এই নিতান্ত ধর্মনিরপেক্ষ খেলা সাপ-লুডো, যার মূল উৎসের খোঁজে আমাদের হয়তো খ্রিস্টের জন্মের আগের শতাব্দীগুলোতেও ফিরে যেতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *