সাপ বিষয়ে একটি উপাখ্যান
সাপটিকে আমি প্রথম দেখি লালীর জন্মদিনে। রঙচঙে চিত্রিত এক সুন্দর বিভীষিকা, কারণ সাপটি ছিল নিস্পন্দ, কয়েক মিনিটের জন্য যেন লালী আর আমার মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল হয়ে উঠেছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। জিব ব্লটিং পেপারের মত লালীর জন্য ক্ষরিত সমস্ত গ্রন্থিরস শুষে নিয়েছিল। লালীর জন্মদিনে একগোছা রজনীগন্ধাই শ্রেষ্ঠ উপহার ভেবে সেই শরৎকালের ভোরবেলায় যখন আমি বাগানের দিকে হেঁটে যাই, এখনও মনে আছে, সারারাতের শিশিরের মত আমিও প্রচুর সিক্ত ও কোমল ছিলাম। অথচ রজনীগন্ধার ঝাড়ের ভেতর সাপটিকে দেখামাত্র টের পেলাম কোথাও একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। তাই আমি নিমেষে শুকনো বিবর্ণ টেরাকোটার মত সময়ের দেয়ালে সেঁটে গিয়েছিলাম।
একটু পরে লালীর বাবা দয়াময় দোতলার ছাদ থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমি এভাবে দাঁড়িয়ে কী করছি। দয়াময় ছিলেন বড় কুটিলমনা আর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ। তাঁর প্রশ্নের জবাবে আমি ভাঙা গলায় বলি, সাপ। তখন দয়াময় ছাদ থেকে অদৃশ্য হন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের বাগানে এসে ঢোকেন। তাঁর হাতে বন্দুক ছিল। কিন্তু তাঁকে একটুও উত্তেজিত দেখাচ্ছিল না। খুব শান্ত গলায় তিনি সাপটিকে দেখিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যেটুকু সময় লেগেছিল, সাপটির লুকিয়ে পড়ার পক্ষে তাই যথেষ্ট এবং আর তন্নতন্ন খুঁজে তাকে আমরা দেখতে পাইনি। তখন দয়াময় বাগানের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলেন, বাগানটা একেবারে জঙ্গল করে ফেলেছ তোমরা।
আসলে গ্রামের প্রান্তে পুরনো একটা নালার ধারে এই বাগানটা করেন আমার ঠাকুর্দা। কিছু ফলের গাছের সঙ্গে ফুলের গাছও পুঁতেছিলেন তিনি। আমার বাবা ছিলেন ন্যালাভোলা মানুষ। প্রকৃতি সম্পর্কে উদাসীন এক শহুরে কেরানি। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর মা কোনও কারণে প্রকৃতির দিকে মুখ ফেরান। তাঁকে যখন-তখন এই বাগানের ভেতর দেখতে পেতাম। শীতের সময় নিজের হাতে ঝাঁটা ধরে শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন ধরাতেন। আগাছা ওপড়াতেন। টিনের ঝাঁঝিতে প্রতি বিকেলে জল ঝরাতেন ফুলফলের গাছপালার মূলে এবং গাছটি তাঁর তুলনায় নিচু হলে তার সর্বাঙ্গ ধুইয়ে দিতেন। তাঁর চোখে বাৎসল্যের উজ্জ্বলতা ঝলমল করতে দেখেছি।
আর দয়াময়কে দেখতাম দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে বাগান-পরিচারিকা আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। স্কুল থেকে ফিরে প্রতি বিকেলেই জানতাম মাকে কোথায় দেখতে পাব। বাবা সাইকেলে চেপে শহরের আপিসে যেতেন। তাঁর ফিরে আসতে সন্ধা গড়িয়ে যেত। কোনও কোনও মধ্যরাতে পাশের ঘর থেকে মায়ের চেঁচামেচি শুনতে পেতাম। তারপর আমার ন্যালাভোলা, শান্ত ও মৃদুভাষী বাবাকে এক বসন্তকালের ভোরবেলায় এই বাগানের ঈশানকোণের আমগাছের উঁচু ডাল থেকে ঝুলতে দেখা যায়। সেই প্রথম বাবাকে আমি উলঙ্গ দেখি। আমার বয়স তখন সাত বছর।…
দয়াময়ের মেয়ে লালী ছিল আমার সহপাঠিনী। লালী চুপি চুপি আমাকে বলেছিল, জানিস বীরু, কেন পানুকাকা গলায় দড়ি দিয়েছেন? আমার বাবার সঙ্গে তোর মায়ের ভাব ছিল।
ওই বয়সে ‘ভাব’ ব্যাপারটা আমার বোধগম্য ছিল না। অথচ পরে বুঝেছিলাম মেয়েরা কত আগে জীবনের অনেক গূঢ় জিনিস টের পেয়ে যায়। আর লালীই একদিন মুক্তকেশীর ভাঙ্গা মন্দিরতলায় কল্কেফুলের জঙ্গলে কল্কে ফুল তুলে কীভাবে মধু চোষা যায় শেখানোর সময় হঠাৎ মুখ টিপে হেসে বলেছিল, বীরু, আমিও তোর সঙ্গে ভাব করব, রাজি?
কিছু না বুঝেও বলেছিলাম, রাজি।
তারপর কত দিনভর রাতভর ভেবেছি, ভাব কী জিনিস জেনে নিতে হবে লালীর কাছে। অথচ বাবার ন্যালাভোলা ধাতটি আমার মধ্যে এমনই প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, জিগ্যেস করতে সাহস পেতাম না। লালী ছিল তেজী ছটফটে মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে স্কুলের ময়দানে খেলাধুলো করত। ছেলেদের মধ্যে মাতব্বরি করত। সংস্কৃত পণ্ডিত মশাইয়ের ঘুমন্ত হাঁ-করা মুখে সে একটুকরো চক ফেলে দেওয়ায় ক্লাসসুদ্ধ বেতের ঘা খাওয়া সত্বেও কেউ তার নাম করে দেয়নি। তার বাবা দয়াময় স্কুলের সেক্রেটারি, সেজন্যও নয়। আসলে লালীকেই যেন সবাই ভয় পেত।
তো এই লালীর জন্মদিনে ফুল উপহার দেওয়ার কথা কেন আমার মাথায় এসেছিল, জানি না। আমি তখন রীতিমত যুবক। মেয়েদের জন্য কামনাবাসনা অথবা ভালবাসার বোধে জ্বরো-জ্বরো। যে আবেগে পাখিরা বাসাগড়ার জন্য খড়কুটো কুড়িয়ে বেড়ায়, সেইরকম জীব-জাগতিক আবেগ আমাকে সবসময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। পাড়াগাঁয়ে প্রচলিত ‘ভাব’ শব্দটি কী, ততদিনে আমার ওতপ্রাোত জানা হয়ে গেছে। অথচ তখনও সাহস পাই না যে লালীকে স্মরণ করিয়ে দিই মুক্তকেশীর মন্দিরতলার সেই বিস্ময়কর মুহূর্তটিকে।
লালীর চেহারায় রুক্ষতাময় লাবণ্য ছিল। যত বয়স বাড়ছিল, তত তার লাবণ্যকে ক্ষইয়ে দিচ্ছিল সেই উগ্র রুক্ষতা। তাই কি তার বিয়ে হচ্ছিল না? বুঝি না। পাড়াগাঁয়ে জন্মদিন পালনের ব্যাপারটা মোটেও ছিল না। আসলে আমাদের গ্রামের একটি প্রান্ত ঘেঁষে হাইওয়ে এবং বিদ্যুৎ আসার পর এই ব্যাপারটা শহর থেকে আরও সব আধুনিক পণ্যের সঙ্গে চলে আসে। শুনেছিলাম লালীর জন্মদিনে অনেক সরকারি কর্তাব্যক্তি সস্ত্রীক আসবেন। আসবে লালীর কলেজের মেয়ে ও পুরুষ বন্ধুরা। আর তার আগের দিন সন্ধ্যায় লালী এসে আমাকে নেমন্তন্ন করে যায়। বাড়িতে আমি একা ছিলাম। মা গিয়েছিলেন তাঁর অসুস্থ দাদাকে দেখতে। সেই সন্ধ্যায় লালীকে জনহীন বাড়িতে একা পেয়ে আমি কি কিছু করতে পারতাম! অসম্ভব। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, লালীর রুক্ষ চেহারায় ঠিকরে পড়ছিল কী এক দুর্দান্ত চঞ্চলতা, যার সামনে হয়ত পৃথিবীর সেরা সাহসী যুবকেরাও নেতিয়ে যেত ভিজে বেড়ালের মত।
সারারাত, আমি ঘুমোতে পারিনি লালীর জন্মদিনে কী উপহার দেব ভেবে। ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে যেই মনে পড়েছিল আজ লালীর জন্মদিন, অমনি মনে হয়েছিল, আরে তাই তো! ফুলের চেয়ে সুন্দর উপহার আর কী থাকতে পারে তার জন্য, যে আমার সঙ্গে প্রথম কৈশোরে ‘ভাব’ করতে চেয়েছিল?
কিন্তু রজনীগন্ধার ঝাড়ের ভেতর ওই চিত্রিত সুন্দর বিভীষিকা আমাকে ও লালীকে নিমেষে দু’দিকে বিশাল দূরত্বে সরিয়ে দেয়। আমি লালীর জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে যাইনি। লালীও কৈফিয়ত চাইতে আসেনি। আর বাবার আত্মহত্যার পর মা কে জানে কেন প্রকৃতির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত উল্টোদিকে সরে এসেছিলেন। বাগানটি সত্যিই জঙ্গল হয়ে উঠেছিল। মা ফিরে এলে তাঁকে সাপের কথা বলায় গম্ভীর মুখে এবং আস্তে বলেন, এ বাড়িতে একটা বাস্তুসাপ আছে।…
সাপটিকে দ্বিতীয়বার দেখি, নালার ধারে জরাজীর্ণ পাঁচিলের কাছে। আর একটু হলেই তার ওপর পা ফেলতাম। পা ফেলতে গিয়ে কেন জানি না কোথায় পা ফেলছি দেখতে গিয়েই তাকে আবিষ্কার করি। পাঁচিল থেকে ভেঙে পড়া ছোট্ট ইটের স্তূপে কিছু বুনো কচুর ঝোপ গজিয়েছিল। সাপটি তার ওপর খুব আস্তে ওঠার চেষ্টা করছিল। সেবারও আমি নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে পড়ি এবং সাপটিকে ইটের স্তূপের ভেতরে ঢুকে যেতে দেখি। মা মৃত্যুর আগে বহুবার বলে গিয়েছিলেন, বাস্তুসাপ মারতে নেই। বাস্তুসাপ কখনও বাড়ির লোককে দংশায় না।
তারপর কোনও কোনও রাতে সাপটিকে আমি স্বপ্নে দেখতে পেতাম। তার চিত্রবিচিত্র শরীর, জ্বলজ্বল নীল দুটি চোখ, চেরা লকলকে জিভ অবিকল দেখতে পেতাম। আমি তাকে পার হবার জন্য পাখির মত উড়ে যেতাম। একরাতে দেখলাম, তাকে পেরিয়ে উড়ে যেতে যেতে যেখানেই নামবার চেষ্টা করি, সেখানেই মাটির ওপর তাকে দেখতে পাই। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়। গলা-বুক শুকিয়ে কাঠ এবং আলো জ্বেলে কুঁজোর দিকে পা বাড়াতে সাহস পাই না। তন্নতন্ন খুঁজি, সাপটা কোথাও আছে কি না। কোনও কোনও রাতে হঠাৎ মনে হয়, সাপটা আমার পাশে এসে শুয়েছে। কোনও রাতে সবে তন্দ্রার ঘোর এসেছে, মনে হয় সাপটি আমার বুকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ফণা তুলে উজ্জ্বল নীল চোখে আমাকে দেখছে।
সাপটির কথা লালীকে বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু বলতে পারিনি তার বিদ্র+পের ভয়ে। লালী ছিল বড্ড ঠোঁটকাটা মেয়ে। এমনিতে সে সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলত। তার বাঁকা হাসিটি ছিল ব্লেডের চেয়ে ধারাল। প্রতিবেশীরা বলত, অমন পুরুষালি ঢঙ আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা—কে বিয়ে করবে অমন মেয়েকে? দয়াসিঙ্গি সোনা দিয়ে মুড়েও গছাতে পারবে না কাউকে।
একদিন সকালে হাসিমুখে দয়াময় এলেন আমার কাছে।… বীরু, কী করছ-টরছ বল শুনি?
তাঁকে খাতির দেখিয়ে বসিয়ে বললাম, কিছু না জ্যাঠামশাই।
কিচ্ছু না? অবাক হবার ভঙ্গি করলেন দয়াময়। তাহলে চলছে কী করে তোমার?
কয়েকটা টিউশনি করছি। ওতেই চলে যাচ্ছে।
শুনে একটু গুম হয়ে থাকার পর দয়াময় বললেন, তুমি আমাদের স্কুলে একটা অ্যাপ্লিকেশন করতে পার। একজন সায়েন্স টিচার দরকার।
কিন্তু আমি তো আর্টস গ্র্যাজুয়েট।
তাতে কী? দয়াময় একটু হাসলেন। সে আমি দেখব’খন। তুমি আজই অ্যাপ্লিকেশন লিখে হেডমাস্টারমশাইকে দিয়ে এস।…
দয়াময়ের কথামত দরখাস্ত দিয়ে এলাম। হেডমাস্টারমশাই কেমন মুখ করে দরখাস্তটা হাতে নিয়ে শুধু বললেন, ঠিক আছে।
দিনকতক পরে দুপুরবেলায় হন্তদন্ত হয়ে লালী এল। তার চেহারায় খুনির আদল। নাসারন্ধ্র স্ফুরিত। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সে বলল, বীরু, তোকে একটা কথা বলতে এলাম।
হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, কী রে?
লালী ত্রু�দ্ধস্বরে বলল, তোর বড্ড বাড় হয়েছে। তোকে আমি ভাল ছেলে বলে জানতাম। তোর পেটে-পেটে এত—
হঠাৎ সে থেমে রাক্ষসীর মত কটমটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ভয়-পাওয়া গলায় বললাম, কী ব্যাপার খুলে বল না লালী। আমি তো কিছু জানি না।
জানো না! নেকু! লালী ভেংচি কাটল। তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।
লালী, কী হয়েছে?
লালী হিসহিস করে বলল, এ লালী তোর জন্য জন্মায়নি জেনে রাখিস। ইস! আমি যেন গাছের ফলটি—হাত বাড়িয়ে টুপ করে পেড়ে নিবি।
বলেই সে তেমনি জোরে বেরিয়ে গেল। আমি ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। পরে মনে হল, ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারছি। দয়াময় কি তাহলে লালীর সঙ্গে আমার—
বাস্তুসাপটাকে আমি তৃতীয়বার দেখি বন্যার বছর এবং সেবারই সাপটির সঙ্গে আমার একটি নিগূঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সেবারকার মত ভয়ঙ্কর বন্যা কখনও আমরা দেখিনি। তিনদিন তিনরাত একটানা বৃষ্টিতে আমাদের বাগানের পেছনের খালটি এমনিতেই কানায়-কানায় উপচে পড়ছিল। চতুর্থ রাতে ডুমডুম ঢোলের বাজনায় আর কোলাহলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সুইচ টিপে দেখি আলো জ্বলল না। বাইরে এ রাতে ঝোড়ো হাওয়ার শনশন শব্দের সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ মিশে একটি প্রাকৃতিক অস্থিরতার শব্দচিত্র আঁকা হচ্ছিল। আর তার সঙ্গে অন্ধকারের রঙ, বজ্রবিদ্যুতের রঙ, মানুষের আর্তি, ঢোলের ঘোষণার সঙ্গে পঞ্চায়েতি খবর জড়িয়ে-মড়িয়ে শব্দ-বর্ণময় দুর্বোধ্য একটি চিত্রকলা—যা মানুষ ও প্রকৃতি যথেচ্ছভাবে এঁকে যাচ্ছিল, যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
কিছু পরে বিদ্যুতের আলোয় কয়েকটি পলকের জন্য উঠোনের জল দেখতে পাই। তখনই আমার টর্চের কথা মনে পড়ে। ঘরে ঢুকে বালিশের পাশ থেকে টর্চটি তুলে নিই। বারান্দায় বেরিয়ে টর্চটি জ্বালি এবং আমার পা থেকে কয়েক হাত দূরে সেই চিত্রিত সুন্দর বিভীষিকাকে আবিষ্কার করি।
আলোর মধ্যে ধরা পড়ে সাপটির আঁকাবাঁকা ছন্দময় গতি রুদ্ধ হয়। দ্রুত সে মাথা তোলে। তার ফণা দুলতে থাকে। চেরা লকলকে জিভ আর দুটি নীল উজ্জ্বল চোখ দিয়ে আলোর আড়ালে সম্ভবত আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করছিল।
এবার তার সঙ্গে আমার এক বিপজ্জনক লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। টর্চ নিভিয়ে ফেলি। আবার জ্বালি। মধ্যেকার কয়েকটি সেকেণ্ড সে ফণা গুটিয়ে আবার এঁকেবেঁকে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু যেই টর্চ জ্বালি, সে হিসহিস শব্দ করে ফণা তোলে ও থমকে যায়।
কতক্ষণ এই খেলা চলছিল বলা কঠিন, শেষবার টর্চের ক্ষয়াটে আলোয় তাকে বারান্দায় কোণায় জমিয়ে রাখা আসবাবপুঞ্জের ভেতর ঢুকে যেতে দেখেছিলাম। যে ঘরটাতে আমি শুই, তার দরজা থেকে দূরত্বটা ছিল হাত দশেকের মত। কাজেই ঘরে গিয়ে দরজা এঁটে এবং সাপটার এঘরে ঢোকার মত ফাঁক বা ফাটল আছে কিনা সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে যখন আমি শুয়ে পড়লাম, তখন আমার শরীর পাথরের চেয়ে ভারি আর নির্জীব। আমার স্নায়ুকোষগুলি নিষ্ক্রিয়। নেপথ্যের প্রাকৃতিক ও মানবিক যাবতীয় শব্দচিত্র নিতান্তই প্রতিভাসিক হয়ে উঠেছিল। বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায় আছি, কিংবা জীবিত না মৃত, নাকি এতদিনকার দেখা ঘুমের অন্তর্বর্তী সমস্ত স্বপ্ন একত্রিত হয়ে আমাকে অবচেতনায় ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিভাসময় প্রায় জড় আমার অস্তিত্বের ভেতর সারাক্ষণ ফণা তুলে হিসহিস করছিল ওই সুন্দর বিভীষিকা—তার কুণ্ডলী-পাকানো শরীর আমার বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হিম করে দিচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির গভীর এক সন্ধিস্থলে, যেখানে জড় ও প্রাণের সীমান্তরেখা, সেই জীবন্মৃত্যুময় রেখাটির ওপর আমি শুয়ে আছি।
শেষরাতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কেউ ডাকছিল। তিনি দয়াময়। দরজা খুলতেই একরাশ জল ঢুকে পড়ল ঘরে। পায়ে সাড়া ছিল না বলেই দরজার নিচের সূক্ষ্ম ফাটল দিয়ে চুইয়ে পড়া জলে ঘরের মেঝের সিক্ততা টের পাইনি, অথবা স্বপ্নাচ্ছন্নতাই এর কারণ। দয়াময়ের হাতে টর্চ ছিল। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কী বীরু? পৃথিবী ভেসে গেলেও চিরদিন তোমার হাঁটু জল।
দয়াময় আমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন। আমি তাঁকে সাপের কথাটা বলেছিলাম। কিন্তু উনি কান করলেন না। আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামালেন। উঠোনের জল দু’জনেরই কোমর পর্যন্ত জড়িয়ে ধরল। নীলধূসর আলোয় একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু নিষ্প্রভ দেখতে পেলাম। বাতাস বন্ধ। চারদিকে শুধু জলের শব্দ। মাঝেমাঝে মানুষজনের চিৎকার। দয়াময় যখন আমাকে তাঁর দোতলায় পৌঁছে দিলেন, তখন প্রথমেই আমি লালীকে খুঁজলাম। কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না। দয়াময় আমাকে একটা লুঙ্গি পরতে দিলেন। আমার আমি সাপের কথাটা বলতে গেলাম। অমনি দয়াময় চাপা স্বরে রুষ্টভাবে বললেন, সাপ তোমার মাথার ভেতর।
আলো আরও স্পষ্ট হলে দয়াময়ের গেটের কাছে রিলিফের নৌকা এল। দয়াময় তখন রিলিফের কাজে বেরিয়ে গেলেন।…
সাপটির সঙ্গে আমার চতুর্থবার দেখা হয় বন্যার জল গ্রাম থেকে নেমে যাওয়ার ক’দিন পরে। বারান্দার কোণায় রাখা আসবাবপত্র ফেলে দেবার জন্য যে লোকটিকে ডেকে এনেছিলাম, তার নাম ছিল শুকুর। সে ছিল নিতান্তই এক খেতমজুর। কিন্তু সাপ মারতে তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। গ্রামের বহু সাপ সে মেরেছিল। আমাদের এলাকায় দু’চারজন ওঝা ছিল বটে, কিন্তু সাপধরা বেদে ছিল না। তাই কোথাও বিষাক্ত সাপ দেখতে পেলে শুকুরকে ডাকা হত। শুকুর বারান্দার কোণা থেকে সব বাতিল জিনিস সরিয়ে ফেলে রায় দিয়েছিল, সাপটা চলে গেছে। আর ঠিক সেদিনই বাগানে আগাছার ঝোপের ভেতর হঠাৎ সাপটিকে আমি দেখতে পাই।
বাগানের ঘাসেভরা মাটিটা তখনও ভেজা ছিল। আকাশে ছিল গনগনে সূর্য। ঝলমল করছিল গাছপালা। আসলে আমি সাপটিকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আগাছার তলায় স্যাঁতসেঁতে নগ্ন মাটিতে তার চিত্রিত সুন্দর শরীর একেবারে নিস্পন্দ। তার গলার নিচেটা স্ফীত দেখে বুঝলাম সে কিছু গিলেছে, তাই এমন চুপচাপ আর ক্লান্ত।
খুব দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। সাপটিকে মেরে ফেলা এখন হয়ত খুবই সহজ। ছায়ার ভেতর ভিজে মাটিতে ছত্রাক আর খড়কুটোর পাশে সামান্য বাঁকাচোরা তার শরীর প্রাকৃতিক লাবণ্যে ও কোমলতায় বড় উজ্জ্বল। তাকে আদর করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু ওর ওই সৌন্দর্যের মধ্যে মৃত্যুর বিভীষিকাও ওতপ্রাোত। প্রতি সেকেণ্ডে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে স্ফীত হতে হতে আমাকে স্বয়ং জীবন এসে ভূতের মত পেয়ে বসল। আমি জীবনচেতনায় অস্থির হয়ে একটা লাঠি আনতে গেলাম।
আর সেই সময় ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে লালীকে আসতে দেখলাম। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। লালী সোজা বারান্দায় উঠল এবং আমার ঘরে ঢুকে গেল।
ঘরে গিয়ে দেখি, সে আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছে। খাটের একটা বাজু আঁকড়ে ধরে সে মুখ নামিয়ে আছে। খোঁপা ভেঙে তার চুল উপচে পড়ছে একদিকে। তার পিঠটা কাঁপছে। আমি আস্তে বললাম, কী হয়েছে রে?
লালীকে সেই প্রথম আমি কাঁদতে এবং ভেঙে পড়তে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরে সে সোজা হয়ে বসল। চুলগুলো খোঁপা করে বেঁধে নিল। ভিজে চোখ মুছে ফেলল। তখন আবার জিগ্যেস করলাম, লালী, কী হয়েছে?
লালী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আমার একটা কথা রাখবি বীরু?
কী কথা রে?
লালী আমার চোখে চোখ রেখে বলল, আগে আমার গা ছুঁয়ে বল, রাখবি।
কিন্তু কথাটা কী, আগে বলবি তো?
লালীর ভিজে চোখ জ্বলে উঠল। বীরু, তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি!
খুব হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, তুই মরবি কেন?
লালী শক্ত মুখে বলল, মরব। আর মরার আগে লিখে রেখে যাব আমার মরার জন্য তুই দায়ী।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম, কেউ বিশ্বাস করবে না।
লালী উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বলল, এবার যদি আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করি?
এবং এ কথা বলেই সে ঝটপট শাড়ি খোলার ভঙ্গি করল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম সে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। ঝটপট বলে ফেললাম, ঠিক আছে। কথা রাখব। বল কী কথা?
লালী নিষ্ঠুর নিঃশব্দ হেসে বলল, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। তারপর সে কয়েক পা এগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, আমার গা ছুঁয়ে বল।
ওর কাঁধ ছুঁয়ে বললাম, ঠিক আছে। বল।
লালী ষড়যন্ত্রসঙ্কুল কণ্ঠস্বরে বলল, তুই এখনই বাবাকে গিয়ে বল—স্ট্রেটকাট বল গিয়ে, আমাকে বিয়ে করবি।
ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, লালী! সেবার তুই নিজে এসে—
আমার কথা কেড়ে লালী বলল, তুই একটা ইডিয়েট বীরু! সত্যি সত্যি তো তুই বিয়ে করছিস না। শুধু—মুখে গিয়ে কথাটা বল।
কিন্তু ব্যাপারটা খুলে বলবি তো?
লালী শান্তভাবে আবার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। তারপর পা দোলাতে দোলাতে বলল, বাবা একটা লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দিচ্ছে। সে কে জানিস? স্কুলে যে নতুন একজন টিচার জুটিয়েছে—ভূতের মত দেখতে। আচ্ছা, তুই বল তো বীরু, আমি কি দেখতে খারাপ?
কক্ষনো না। সায় দিয়ে বললাম। তুই সত্যি সুন্দর। তোর কেন যে বিয়ে হচ্ছে না!
লালী একটু হাসল। হচ্ছে না নয়। আমি নিজেই বাগড়া দিই জানিস?
বলিস কী!
হুঁ। দেখেশুনে পছন্দ করে যায়। তারপর আমি বেনামে চিঠি লিখে জানিয়ে দিই, মেয়ের চরিত্র খারাপ। কতজনের সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করে নষ্ট হয়েছে। একটা চিঠিতে তোর নামও করেছিলাম।
লালী চাপা হাসিতে অস্থির হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অসম্বৃত শাড়ির আড়ালে ওর মেয়েশরীরের কথা ভেবে আমরা শরীরে যৌবনের দুর্দান্ত লোভ গরগর করে উঠল। আর দরজাবন্ধ ঘর। জানালার একটা পাশ খোলা। আবছা আলো এবং নির্জনতা। হঠাৎ আমি দুঃসাহসে বলে উঠলাম, তোর কথা আমি রাখছি। কিন্তু—
লালী ভুরু কুঁচকে তাকাল, বলল, কিন্তু কী রে?
লালী! ছোটবেলায় মুক্তকেশীর মন্দিরতলায় তুই বলেছিলি আমার সঙ্গে ভাব করবি।
হুঁ, বলেছিলাম।
লালীর কণ্ঠস্বরে নির্লিপ্ততা ছিল। আমার শরীর কাঁপছিল। ঊরু ভারি হয়ে উঠেছিল। নিজের ঘামের বিকট গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। তারপরই হঠকারিতায় ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম।
লালী আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একই কণ্ঠস্বরে বলল, পাবি। আগে কথাটা বলে আয় বাবাকে। আমি এখানেই থাকছি। বাবা বাড়িতে আছে। গিয়ে স্ট্রেটকাট বলবি।
আমি বেরিয়ে গেলাম। ভারি শরীর টানতে টানতে দয়াময়ের দোতলা বাড়ির গেটে পৌঁছলাম। আর তখনই মনে পড়ল সাপটার কথা। বিস্ময়কর ও ভিন্ন এক হঠকারিতা লালীর শরীরের চেয়ে সাপটির শরীরকে আমার চোখের পর্দায় সেঁটে দিল। দয়াময় সামনের দিকে দোতলার ব্যালকনিতে বসে বন্দুকের নল সাফ করছিলেন। বন্দুক দেখামাত্র জোরে চেঁচিয়ে ডাকলাম ওঁকে, জ্যাঠামশাই! সেই সাপটা বেরিয়েছে।
দয়াময় উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্তভাবে বললেন, চল! যাচ্ছি।…
সাপটি সেদিনও অদৃশ্য হয়ে যায়। হাট করে খোলা আমার ঘরের দরজায় উঁকি মেরে লালীকেও অদৃশ্য দেখতে পাই। আর ঠিক যে ভঙ্গিতে দয়াময় সাপটির গতিরেখা তন্নতন্ন খুঁজছিলেন, আমিও একই ভঙ্গিতে আমার বিছানায় এবং মেঝেতে লালীর গতিরেখা অন্বেষণ করেছিলাম। শুধু এটুকুই তফাৎ যে, দয়াময় সাপটির গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করেননি কিংবা করলেও পেতেন কি না সন্দেহ—আমি ঘরভরা লালীর গন্ধে কিছুক্ষণ আবিষ্ট ছিলাম। আর লালীর শরীরের গন্ধের সঙ্গে আমার শরীরের গন্ধও মিশে ছিল। ক্রমশ সেই মিশ্রিত গন্ধ উবে গেলে প্রচণ্ড উত্তেজনার পর ঠাণ্ডা, হিম এক অবসাদ এসে আমাকে ছুঁল। আমি ভিজে পুতুলের মত নেতিয়ে গেলাম।
সারাদুপুর বিছানায় শুয়ে সেদিন যতবার লালীর কথা ভাবতে যাই, ঝলমলে রোদে চেকনাই সবুজ আগাছার ঝাড়ের তলায় রহস্যময় ছায়ার পরিপ্রেক্ষিতে চিত্রিত সুন্দর বিভীষিকাটি অবচেতনা থেকে হিসহিস শব্দে সাড়া দেয়। তার চেরা জিভ, নীল দুটি চোখ আমার চোখে প্রতিবিম্বিত হয়। প্রকৃতির নিজের হাতে আঁকা আলপনা দিয়ে সাজানো তার ফণাটি দুলতে থাকে। তাকে বলতে ইচ্ছে করে, তুমি এত সুন্দর! অথচ আমার মুখে কথা সরে না। আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি তো জানি, তার সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমি তাকে মনে মনে আশ্বাস দিই, আর কোনওদিন দয়াময় বা শুকুর শেখকে ডাকব না। তুমি বেঁচে থাক। আমিও বেঁচে থাকি।
পঞ্চম ও শেষবার সাপটির সঙ্গে আমার দেখা হল এক বিকেলবেলায়। সেদিন আকাশ ছিল নির্মেঘ। ফিকে লাল-হলুদ আলোয় নিসর্গকে দেখাচ্ছিল কনে-বউয়ের মত সলজ্জ আর কোমল। বাগানের কোণায় কেয়াঝাড়ের গোড়ার খাঁজের ভেতর থেকে সে সবে মাটিতে নেমে আসছিল, সহজাত প্রবৃত্তিবশে আমি এক পা পিছিয়ে আসতেই সে ফণা তুলল। মাটিতে আমার পায়ের শব্দের স্পন্দন সে টের পেয়েছিল। কিন্তু আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলে সে ফণা গুটিয়ে নিল। তারপর চলতে শুরু করল। ঘন ঘাসের ভেতর সে গা ঢাকা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে দয়াময়ের ডাক শুনতে পেলাম। দেখলাম উনি বাড়ির ভাঙা গেটের নিচে বাঁশের আগড় ঠেলে ভেতরে ঢুকছেন। বললেন, ওখানে কী করছ?
কিছু না। এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
দয়াময় একটু হাসলেন। সাপ দেখছ নাকি? তোমার মাথায় আসলে—তো শোনো। সামনে রোববার লালীর বিয়ে। এই নাও—
দয়াময় আমার হাতে একটা সুন্দর খাম এগিয়ে দিলেন। তাতে প্রজাপতির ছবি আঁকা। কোণায় একটু হলুদ ছোপ। বললেন, আসবে যেন। না—না, নেমন্তন্ন খেতে নয়, সব দেখাশুনো করবে-টরবে। বলতে গেলে তুমি একরকম বাড়িরই ছেলে।
আমি চুপ করে থাকলাম। দয়াময় কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকলেন। তাঁর ভুরু কুঞ্চিত। দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে একটু কাসলেন। তারপর ধরা গলায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ভবিতব্যের ওপর মানুষের হাত নেই। তোমার মায়ের বড় ইচ্ছে ছিল—আমারও। তো তুমি বেঁকে বসলে। আমি তো তোমাকে বাধ্য করতে পারি না—
বলেই মুখ তুললেন। চোখে চোখ পড়ামাত্র আমি আস্তে বললাম, জ্যাঠামশাই! আমি জানি লালীর এ বিয়েতে মত নেই।
দয়াময়ের মুখটা তখনই বদলে গেল। যেন আমার কথা বোঝেননি এমন ভঙ্গিতে বললেন, কোন বিয়েতে?
এই বিয়েতে।
দয়াময় নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বরে বললেন, দয়াসিঙ্গি যার জন্ম দিয়েছে, তার মতামত নিয়ে মাথা ঘামায় না।
একটা আবেগ—হয়ত প্রতিবাদেরই আবেগ, কিংবা হয়ত লালীকে বাঁচানোর জন্য একটা জোরালো তাগিদ আমাকে সাহসী করে দিল। বললাম, লালী শিক্ষিতা মেয়ে। তার মতামতের একটা মূল্য দেওয়া উচিত নয় কি জ্যাঠামশাই? যাকে সে পছন্দ করে না, তার সঙ্গে সে কীভাবে ঘর করবে, ভেবে দেখা উচিত নয় কি?
দয়াময় চাপা গর্জন করে বললেন, হুম! তুমি যে এত লম্বা-চওড়া কথাবার্তা আওড়াচ্ছ, তার বেসিস কী? লালী তোমাকে বলেছে বুঝি?
মুখ নামিয়ে বললাম, হুঁ।
দীর্ঘ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর দয়াময় বললেন, আমি যেমন জানতাম, তোমার মাও তেমনি জানতেন, লীলার সঙ্গে তোমার একটা সম্পর্ক ছিল। ঠিক এজন্যই আমি কথাটা তুলেছিলাম। কিন্তু তুমি—ইউ কাওয়ার্ড! আমার মেয়ের সর্বনাশ করে ছাড়লে! তারপর তুমি—
প্রায় আর্তনাদ করে বললাম জ্যাঠামশাই! বিশ্বাস করুন, আমি লালীর কোনও সর্বনাশ করিনি!
দয়াময় দ্রুত ঘুরে গেটের দিকে পা বাড়ালেন। কয়েক পা এগিয়ে পিছু ফিরলেন এবং আমার কাছে ফিরে এলেন। ভাঙা গলায় বললেন, তোমার একটা চাকরিবাকরি না জোটা পর্যন্ত কথাটা বলব না ভেবেছিলাম। তা ছাড়া আমার ইচ্ছে ছিল, লালীর সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে কথাটা বলার দরকারও হবে না। কিন্তু এখন মনে হল, বলার সময় হয়ে গেছে।
একটু অবাক হয়ে বললাম, কী কথা জ্যাঠামশাই?
দয়াময় নির্দয়মুখে বললেন, তোমার পড়াশুনো আর সংসার খরচের জন্য তোমার মা এই বাস্তুজমি পুরোটাই আমার কাছে একরারনামা ডিড করে দিয়ে গেছেন। পাঁচবছরে সুদ সমেত টাকা ফেরত না দিলে এর মালিকানা আমার ওপর বর্তাবে। ডিডের মেয়াদ দু’বছর আগে শেষ হয়েছে।
আমি মনে মনে সাপটিকে ডাকছিলাম। এখন দয়াময়ের হাতে বন্দুক নেই।
দয়াময় কেশে গলা ঝেড়ে বললেন, যাই হোক—আমি অত খারাপ লোক নই। আশা করব তুমি লালীর বিয়ের দিনে সক্কাল-সক্কাল যাবে। কাজকর্ম দেখাশুনো করবে। খুব দুঃখের সঙ্গে অপ্রিয় ব্যাপারটা তোমাকে বলতে হল—তুমিই বলিয়ে ছাড়লে। তুমি নিশ্চিন্তে থাক, অন্তত তোমার মায়ের মুখ চেয়ে তোমাকে আমি বাড়ি থেকে উৎখাত করব না—অন্তত যতদিন তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারছ।
শেষ কথা বলে দয়াময় শান্তভাবে চলে গেলেন। গেটের বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি আগড়টাও ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন।…
বছরতিনেক পরে একদিন সদর শহরের রাস্তায় মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় লালীর সঙ্গে। আমিই তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমি আকাশ-বাতাস আর সারা শহরটাকে প্রতিধ্বনিত করার মত প্রচণ্ড জোরালো একটি চিৎকার তুলতে চেয়েছিলাম, লালী, তুমি মরনি? লালী, তুমি বলেছিলে ‘মরামুখ দেখবে’!
লালীর কোলে একটা বাচ্চা ছিল। তার পাশে পাশে হেঁটে আসছিলেন রোগাটে গড়নের শ্যামবর্ণ এক ভদ্রলোক, পরনে ধুতি ও মটকার পাঞ্জাবি এবং তাঁর ঠোঁট খুবই পুরু এবং তাঁর সামনের দাঁতের পাটি ঠেলে বেরুনো। অথচ ওই মুখে গাঢ় অমায়িক ও আলাপী ভাব ছিল।
লালীর আমাকে চিনতে সেকেণ্ড দু’তিন দেরি হয়েছিল। চেনামাত্র সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, বীরুদা, তুমি! দাড়ি রেখেছ কেন? সে খুব ব্যস্তভাবে তার সঙ্গীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। …সেই বীরুদা গো—যার কথা তোমাকে প্রায়ই বলি!
আমরা দুটি ভদ্রলোক নমস্কার বিনিময় করি। বাচ্চাটির গাল টিপে আমি আদর করতে গেলে লালী তাকে আমার কোলে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করে। …তোমার মামা! বীরু মামা! কিন্তু বাচ্চাটি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর লালী খিলখিল করে হাসে। …বড্ড লাজুক—একেবারে বাবার স্বভাবটি পেয়েছে।
তারপর লালী অনর্গল কথা বলে। গ্রামের খবরাখবর দিতে থাকে। শেষে বলে, একদিনের জন্যও তো যেতে পার বীরুদা। আর শোন, তোমাদের বাড়িটা এখন পুরোটাই ফুলের বাগান! ও নিজের হাতে সব করেছে-টরেছে। দেখলে ভাববে কোথায় এলাম—চোখ জ্বলে যাবে তোমার—সত্যি।
ভাবলাম, ওকে সাপটার কথা বলি। আমার জানার ইচ্ছে হচ্ছিল, সাপটাকে ওরা দেখতে পায় কি না। কিন্তু সেই সময় লালীর স্বামী ভদ্রলোক, সেই স্কুলশিক্ষক চলমান একটা সাইকেল রিকশকে ‘রোখো’, ‘রোখো’ বলে দাঁড় করান এবং লালী-সহ ওতে উঠে বসেন। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। রিকশটা গড়িয়ে চলার সময় লালী হাসিমুখে ঘুরে বলে যায়, একদিন যাবে যেন বীরুদা!
আর সঙ্গে সঙ্গে আমি টের পাই, লালীর মুখের সেই পুরুষালি রুক্ষতা তো দেখলাম না! আমি দেখলাম সুন্দরী নারীর প্রসাধিত লাবণ্য আর কোমলতা। চিত্রিত সুন্দর বিভীষিকা—যাকে অন্তত বার পাঁচেক আমি নিসর্গের গাঢ় ছায়ায় আবিষ্কার করেছিলাম, এতদিনে কি তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল? জানি না। আমি সত্যিই জানি না।…