সাপের চোখের ভিতর দিয়ে
জন্মাবার আগে খুব চিন্তায় ফেলেছিল। নলিনীর মেয়ের ডাক নাম তাই চিন্তি। আজ চার তলায় উঠে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই চিন্তি বলল, ‘বাবা, দশ মিনিট আগে এখানে দিয়ে একটা সাপ গেছে।’ বলে, করিডোরের দেওয়াল বরাবর হাত স্ট্রেচ করে সে নলিনীর ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, আর সব ফ্ল্যাট অন্ধকার, শুধু তাদের ফ্ল্যাটটাই ঝমমল করছিল আলোয়, দূর থেকে, ঠিক যেন একটা ফানুস। নলিনী ভেবেছিল, আজ রাত হয়েছে, এ বুঝি তাকে অভ্যর্থনা করার জন্যেই, ভেবে খুশি হয়েছিল।
নলিনীর স্বভাবের একটা মাধুর্যময় দিক হল তার বিশ্বাসপ্রবণতা। স্বচক্ষে কিছু ঘটতে দেখলে তো কথাই নেই, এমন কি, কেউ, কোথাও, কোনো-কিছু ঘটেছে বললেও সে তৎক্ষণাৎ তা বিশ্বাস করে ফ্যালে। আর যে-কেউ হলে এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করতই। হোক না ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে রথতলা, না হয় লিফট নেই, জেনারেটর নেই— মাল্টি-স্টোরিড তো বটে। বাকি বাহান্নটা ফ্ল্যাটের যে-কোনো বাবা এমনাবস্থায় ‘যাঃ’, ‘সে কী রে’ বা অন্তত ‘তাই নাকি’ বলতই। কিন্তু শুনে, নলিনী শুধু দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিঃসন্দেহ হবার জন্যে বলল, ‘কোন ঘরে ঢুকল সাপটা?’
তাদের ৭৫০ স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটে দুটি ঘর। এইটুকুর মধ্যে তুলনায় বড়ো ঘরটি, বলা বাহুল্য, চিন্তি ও মমতার শোবার জন্য। অপর ঘরটি একাধারে আপ্যায়নখানা ও নলিনীর শয়নকক্ষ। সারাদিন ধোপা থেকে বাড়িঅলাসহ যাবতীয় আত্মীয়-অতিথির নিতম্ব-লাঞ্ছিত হয়ে, মেয়ে বড়ো হবার পর থেকে, সোফাটি নিজের ভাঁজ খুলে রাত্রে বিছানায় পরিণত হয়, সেখানেই নলিনীর শোবার ব্যবস্থা।
আসলে, আদৌ বিচলিত হবার আগে একটা প্রশ্নের জবাব পাওয়াই ছিল ঢের বেশি জরুরি। বিচলিত হওয়া অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু প্রশ্নটি পারে না। নলিনী তাই নিঃসন্দেহ হতে চেয়েছিল। যে, সাপ তো ঢুকেছে। কিন্তু কোন ঘরে। তার ঘরে, না চিন্তিদের ঘরে? মেয়ের উত্তরের জন্যে তার সর্বস্ব বাজি ধরে সে অপেক্ষা করছে, সে দ্যাখে। ‘ঐ স্টোর রুমে ঢুকে গেল।’ চিন্তি বলল।
মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চিন্তি এতক্ষণ তার ডান হাতটা মেলে রেখেছিল। এবার সে হাত নামায়। চিন্তি যে দিকে হাত তুলেছিল বা তার অলীক অঙ্গুলি-সংকেত এখানে যে দিকে, সেদিকে যে আরও একটা ঘর আছে—মমতার স্টোর রুম—এটা ভুলেই গিয়েছিল নলিনী। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল, স্টোর রুমের দরজা নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ। নিশ্ছিদ্র? আর-এ! না তো। একটা কেঁচোরও আরামে বেরুবার উপায় নেই, এমন একটা গর্ত এতদিনে চোখে পড়তে নলিনী গুটি-চার ঝাঁটার কাঠি সহযোগে সেটাও বন্ধ করে দিল।
‘অবিকল রেপসীড রংয়ের, এই লিকলিকে সাপটা!’ মমতা এতক্ষণে শুরু করল, ‘আমি রান্নাঘরের সামনে, দেখি, একটা আরশোলা ঢুকছে আর বেরুচ্ছে— তারপর দেখলাম সাপের মাথাটা— আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আরশোলাটাই, সাপের মাথা অনেকটা আরশোলার মতো না? আর রংটাও একই রকম। চুপচাপ পড়ে ছিল। যেই আমি হুশ-হুশ করেছি— আরশোলা ভেবেই—অমনি স্রিক স্রিক করে জিবদুটো…’
‘ও বাবা গো’, দাঁড়ানো সাপিনীর মতো এঁকে-বেঁকে দুলে উঠে শিউরানিতে নরম হাতটা বাড়িয়ে দিল চিন্তি, ‘বাবা, হাত দিয়ে দেখ!’ হাত দিতে হবে না, নলিনী স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছে, গাত্রবর্ণের সঙ্গে এতদিন মিশে-থাকা চিন্তির হাতের রোমরাজি এখন পাখার হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে।
”আমি ‘চিন্তি, সাপ সাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই হিলবিল করে ছুটে সাপটা স্টোরে ঢুকে গেল। তুমি মাত্র দশ মিনিট আগে এলেও…” মমতা বলল।
‘বাঞ্চোৎ!’
মাথার ভিতরে দাঁতে-দাঁতে ঘসার শব্দ শুনতে পেল নলিনী। বহুদন্তী করাতের মতো আত্মকর্মক্ষম এক ক্রোধ কেটে দু-ফাঁক করে দিচ্ছে তার মাথা, তবু নলিনী দেখল, আজ ৪৬ বছরে সে কারও উদ্দেশে, কখনও, একা-একাও, ‘খানকির ছেলে’ কথাটি বলতে পারেনি এবং সামন্তদাকে মনে-মনেও ঐ বলে সে আজও সম্বোধন করতে পারল না। অথচ, আজকালকার ছেলেরা কত না অবলীলায় দু-ক্ষরের ছাপার অযোগ্য শব্দটি ব্যবহার করে। এই তো সেদিন, ঝকঝকে সকালবেলা, বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগেই, মিনিবাস থেকে প্যারেডের স্পটলেশ শাদা পোশাকে হেয়ার স্কুলের সামনে নামল স্টার পেতে-পারে-এমন-দেখতে দুটি ছেলে। তিনজনের সিটে তার পাশেই বসেছিল তারা। সালমা আগার ‘দিল কি আরমা আঁসুও সে বহে গয়ে’ গানটি সুর-সহযোগে শুনিয়ে দিয়ে একজন তার সতীর্থকে কেমন নিষ্পাপ কণ্ঠে জানাল, ‘যা গেয়েছে না, চোখে বাঁড়া জল এসে যায়!’ নলিনীদের টাইমে এক্ষেত্রে তারা বড়ো জোর ‘মাইরি’ বলত।
আজ হয়েছিল কী, সামন্তদা তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অম্বর-এ। তিনজনের সিনিঅরিটি ড্রিবল করে এই ঘোর বামফ্রণ্ট আমলে সামন্তদা সুপারিনটেন্ডিং এঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন, মন্ত্রী আজই নলিনীকে অফিস-অর্ডার করতে বলেছেন। এখন কিছুদিন অফিসিয়েট করবেন, পরে ভেকেন্সি হলেই…কংগ্রেস আমলে এক্সিকিউটিভও ঠিক এইভাবেই হয়েছিলেন। সেবারেও খানা ও পিনা হয়েছিল এবং এই অম্বরেই। এবার মন্ত্রী কাল ভোরেই জলপাইগুড়ি যাচ্ছেন, ফিরতে সাত দিন। সই না হওয়া পর্যন্ত, এবার পুরো এক সপ্তাহ খবরটা চেপে রাখতে হবে। অবশ্য উনি সে-কথা উল্লেখও করবেন না, নলিনী নিজেই এটা করবে, বন্ধু কিনা! তবে, পুরো এক সপ্তাহ, এবার তাই খানা-পিনার ঘটা একটু বেশিই ছিল। বস্তুত, ফেরার পথে, গাড়িতে, সোনাগাছির শেফালির ঘরে একবার ঢুঁ মেরে যাবার প্রস্তাব উনিই তুলেছিলেন। কিন্তু সোনাগাছির কাছাকাছি বিবেকানন্দ-সেন্ট্রাল অ্যাভিনুর নাথু-সংকটে পৌঁছে সতীরই জয় হল। হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠে সামন্তদা হেঁকে উঠলেন, ‘পরিতোষ’ বাঁয়া চল। না:, তোর বৌদি জেগে আছে রে!’
‘বৌদি এখনও আপনার জন্যে জেগে থাকেন বুঝি সামন্তদা?’ কল্পনাশক্তিহীন, অ-দেখা বোকা রমণীটির জন্য স্মিত হাসিতে ভরে গিয়েছিল নলিনীর মাথা। মাত্র চোদ্দ বছর তাদের বিয়ে হয়েছে, মমতা আর জেগে থাকে না। লোড-শেডিং, এত রাতে সব ফ্ল্যাট অন্ধকার, শুধু তার ঘরে মমতার বদলে একটি সরু মোমবাতি জ্বলছে, সে মনশ্চক্ষে দেখতে পেয়েছিল।
যাবে তো বেলগাছিয়া, বাঞ্চোৎ কেন যে শ্যামবাজার দিয়ে গেল না। গাড়ি ছুটল মানিকতলা-পেরিয়ে দীনেন্দ্র স্ট্রীট হয়ে। বেলগাছিয়া রোড ক্রশিং-এর আগে সামন্তদা ড্রাইভার পরিতোষকে হিন্দিতে ‘রোককে’ ও নলিনীকে তুই-তোকারি করে সস্নেহে ‘এ-টুকু হেঁটে যেতে পারবি তো’ বললেন।
পাঁচ-পেগের টলমলে ফুটপাথ ডাইনে-বাঁয়ে রেখে সে যখন ঈষৎ মনঃক্ষুণ্ণভাবে হেঁটে আসছিল শ্যামবাজারের দিকে, তখন, কে জানত, আজ কুড়ি বছরের সহকর্মীর সবচেয়ে নিরীহ অতটুকু খচরামিতে তার এক জীবনের ভুলচুক হয়ে যাচ্ছে! রাত তখন সবে সওয়া ১১টা। হাতে ঘড়ি না থাকলেও, হ্যাঁ, কারেক্ট টাইম। কেননা, যেতে-যেতে, ১১ এবং এল-নাইনের লাস্ট বাসদুটো—মাত্র দশ-বিশ গজ দূরে সে তখন—শ্যামবাজার মোড় দিয়ে হুশ হুশ করে বেরিয়ে গেল। তারপর তিন টাকার শেয়ার-ট্যাক্সি ভরতি হল, তারপর ডানলপ। তারপর রিক্সায় রথতলা। এতেই সাপ বেরনোর চেয়ে ১০ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল নলিনীর।
মমতা টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়েছে। মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে নলিনী বলল, এত রাত্তিতে তো কিছু করা যাবে না মা। আজ দরজা-টরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। আমি কাল শালাকে ঘর থেকে বের করব।
‘থালা-বাটি সব বাথরুমে রেখো কিন্তু’ বলে মমতাও মেয়ের সঙ্গে শোবার ঘরে ঢুকে ক্যাচ করে ছিটকিনি তুলে দিল।
খাবার টেবিলে বসতেই সামন্তদার উদ্দেশে আবার তার ফণা খুলে যাচ্ছে, সে টের পেল। সত্যি, অফিসের গাড়ি, কনট্রাকটররা প্যান্টুল নামিয়ে তোর পোঁদে অত টাকা গোজে— আর মাত্র একটা স্টপ এগিয়ে দিলে সে লাস্ট বাসটা পায় ও সাপ বেরবার মিনিট পনের আগেই পৌঁছে যায়। সে তো কিছু দেখামাত্রই ‘চিন্তি, সাপ সাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠত না, সাপটা শুয়েই থাকত এবং আশা তো করে সে সাপটাকে মারতে পারত। মমতার ১৪ বছর ধরে জমানো গুদোমে সে এখন কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে।
‘তোর বৌদি জেগে আছে রে!’ মুখ ভেঙিয়ে সে বলে ওঠে। আমার বৌদি কি ঝাঁপির ডালা তুলে বসে ছিল নাকি রে বাঞ্চোৎ, যে তড়িঘড়ি ফিরে সাপখানা না সেঁদিয়ে দিলেই চলছিল না? অত রাত্তির, আর মাত্র ৫০ গজ এগিয়ে দিলেই—
খাবার আগে আসনে বসে থালার পাশে সামান্য ভাত রেখে তাতে জল-ছিটে দিয়ে ‘নমঃ শ্রীবিষ্টু’, ‘নমঃ শ্রীবিষ্টু’, ‘নমঃ শ্রীবিষ্টু’, বলে বাবা তিনবার গণ্ডুষ করতেন। জীবনে এই প্রথম খাবার আগে জল-ভাতসহ গণ্ডুষ করে, নলিনী সামন্তদার উদ্দেশে তিনবার উচ্চারণ করে ‘বাঞ্চোৎ’ বলল। এর বেশি কিছু পারল না।
শুতে গিয়ে নলিনী দেখল, বিছানা আজ খুবই পরিপটি এবং মশারিটিও দুর্ভেদ্যভাবে গোঁজা। অধিকন্তু, বালিশের পাশে আজ তাদের ছয়-সেলের প্রকাণ্ড টর্চটি রয়েছে। মশারির ভেতর থেকে প্রকাণ্ড টর্চ জ্বালিয়ে ঘরের খাঁজ-খোঁজ ভালো করে দেখে নিতে গিয়ে টর্চের আলো গিয়ে পড়ল মমতাদের শোবার ঘরের দরজায়। নলিনীর হঠাৎ মনে পড়ল তারা ভদ্রেশ্বরে। বিয়ে তিন পেরিয়ে চার বছরে পড়ল, অথচ তখনো চিন্তিত হয়নি, বা, কিছুতেই হচ্ছে না—এ রকম অবস্থায় বৌকে তৈরি করে, একবার পেচ্ছাপ করে আসবে বলে সে গিয়েছিল উঠোন পেরিয়ে টিনের চালের বাথরুমে। টর্চ জ্বালাতেই দ্যাখে একটা সাপ নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। না, ঠিক সাপ নয়, সাপের লেজটাই সে দেখেছিল। দেখে ভয় পেয়েছিল খুব। ফিরে এসে মমতাকে বলতেই, ‘দূর, ও কিছু নয়, ওটা একটা টিকটিকি। তুমি এসো তো…’ বলে যে বিপুল আগ্রহে কেঁপে উঠে দুহাতে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল মমতা, সেটা কাম বা গর্ভ-উন্মাদনা যা হয় একটা কিছু হবেই। সাপ দেখলে নাকি বংশবৃদ্ধি হয়। সে মাসেই চিন্তি পেটে এসেছিল।
কাল সকালে সাপটাকে পাওয়া যাবে কী? নলিনী টর্চ নেবায়। স্টোর রুমে আলো জ্বলছে। আজ সারারাত জ্বলবে।
।। ২ ।।
নীল নাইলনের মশারির মধ্যে পরদিন নলিনীর ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। ঘুম ভাঙতে সে প্রথমেই যা বুঝল, তা হল, কাল রাতে তাহলে সাপটা তাকে কামড়ায়নি। চিন্তি বা মমতাকেও যে কামড়ায়নি, সেটা তো বোঝার অপেক্ষাই রাখে না, কারণ, তাহলে সে এতক্ষণ ঘুমাত না। ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও, রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ-ডিস নাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এ-ঘর থেকে বেরলেই করিডর, বাঁ দিকে মমতার গুদোম ঘরটা। রাতের ঝাঁটার কাঠিসহ দরজাটা বন্ধই আছে দেখে সে বুঝল, ওটা এখনও খোলাই হয়নি। এমনিতেই কালে-ভদ্রে খোলা হয়, প্রয়োজনে মমতাই মাঝে মাঝে খোলে। ওতে আছে মাসের পর মাসের খবরের কাগজ, এ-যাবৎ সমস্ত বাঙলা ও ইংরেজি ক্যালেণ্ডার, চিন্তি যখন ফ্যারেক্স কি ল্যাক্টোজেন খেত সেই তখন থেকে যাবতীয় খালি টিন ও কৌটো, নলিনীর ছয়মাসের প্লুরিসির সময়কার যাবতীয় ওষুধের শিশি, শ-পাঁচেক লিভ-ফিফটি-টু’র খোল, এ-যাবৎ ব্যবহৃত সমস্ত প্রসাধনী মায় সাবান ও টুথপেস্টের যাবতীয় অবশেষ। আজকাল খাবার জলে যে দু-চার ফোঁটা করে ওষুধ দেওয়া হয়, শুধু সেই জিওনিল-এর কৌটোগুলো যা খুব বেশি হবে না, এটা সাম্প্রতিক ব্যাপার। সত্যি গাড়-ভাঙা টেবিল ল্যাম্প থেকে বাতিল রেডিয়ো, হাটাগোমারিয়ার বাঘ, ড্রাম-পেটা ভাল্লুক, শিলং-এর ঝুমঝুমি, ভদ্রেশ্বরের পাতকুয়ার দড়ি, দুমকার হাটে কেনা চাকা-বসানো কাঠের ওয়াকার যা ধরে চিন্তি প্রথম হাঁটতে শেখে, কী যে নেই ওখানে। তাদের ১৪ বছরের দাম্পত্যের সমস্ত ছেঁড়াখোঁড়া লেপ-তোশক ও জামাকাপড়ও ওখানে। গতবছর শাশুড়ি মারা গেলে, মায়ের যাবতীয় উত্তরাধিকারও মমতা ঐ ঘরেই গচ্ছিত করেছে।
বস্তুত, তাদের ছোটখাটো ফ্ল্যাটটি যে এমনিতে এত স্ট্রীম-লাইনড তথা বাহুল্য-বর্জিত— অত্যুক্তি বলতে একটা কুটোও নেই—তার আসল রহস্য মমতার ঐ গুদোমে। আজ ১৪ বছর ধরে একটা জিনিস ভাঙল কি বাতিল হল, অমনি দরজাটা প্রয়োজন মাফিক ফাঁকা করে (যে জিনিশের জন্য যতটুকু), দাও গুদোমের মধ্যে ফেলে। নলিনী ঠাট্টা করে ঐ ঘরের নাম দিয়েছে ‘মমতালয়’।
বেশ কিছুমাল আগে, কী কারণে যেন, একবার দরজাটা খুলেছিল নলিনী। ব্যাস, আর যাবে কোথা, যেন বিনানুমতিতে তার প্রাইভেট পার্টস-এ হাত দেওয়া হয়েছে, হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসেছিল মমতা। কিন্তু ততক্ষণে সে একটা মেমেন্টো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে। তার আজানুলম্বিত বাঁ হাত আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত তুলে ধরে, জিনিসটা নাড়াতে নাড়াতে ও হাসতে হাসতে সে জানতে চেয়েছিল, ‘আচ্ছা, এটা কী?’
‘ওটা একটা প্যানের ডাঁটি’, বলে তিড়িং-লাফে মমতা সেটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে।
‘উঁ-হুঁ।’ উত্তোলিত ডাঁটিসহ সরে গিয়ে নলিনী বলেছিল, ‘আগে বল, এটা ওখানে কেন?’
‘দাও বলছি! ভাল হবে না বলছি…’
‘না। আগে বল।’ স্মিতচক্ষু লিবার্টি-স্ট্যাচুর মতো সে এবার ঘাড় হেঁট করে।
‘ওটা অ্যালুমিনিয়ম। বিক্রি হবে।’ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে আরক্ত মুখে মমতা বলেছিল।
‘বিক্রি?’ হাত নামিয়ে ডাঁটিটা হ্যান্ড-ওভার করতে করতে নলিনী সস্নেহে বলেছিল, ‘কিন্তু মমতা, আজ ১৪ বছর ধরে জিনিস ঠাসছ ঐ একখানা পুঁচকে ঘরে, কাগজগুলো তো দেখলাম সিলিং ছুয়েছে— তোমার ক্রেতা কই! সে তো এল না?’
বলে অবশ্য, মেয়েরা গাড়িতে ওঠার আগে দরজা খুলে দাঁড়ানো সিভালরাস পুরুষের মত, সে গুদামের দরজাটা ঠিক ততটুকু ফাঁক করে দাঁড়ায়, যাতে মমতা ডাঁটিটা ভিতরে নিক্ষেপ করতে পারে। সত্যি, আজ ১৪ বছর ধরে ব্যবহৃত যত টুথপেস্ট, যত অবশেষ সাবানের, সব মমতা ঐ ঘরে গুদামজাত করেছে। তা সংখ্যায় তারা, যথাক্রমে, ২০০ ও ৫০০ তো হবেই।
‘রিটায়ার করার পর ঐ সব জিনিশ ব্যাগে করে নিয়ে আমি শিয়ালদায় বসব।’ মমতাকে বুকে টেনে নিয়ে, কপালে চুম্বন করে ও চুলে জবাকুসুমের রক্তিম ঘ্রাণ নিতে নিতে সে সেদিন বলেছিল, ‘স্রেফ সাবান আর টুথপেস্ট বেচেই বেশ কিছুদিন চলে যাবে আমাদের, কী বল?’
যুগান্তব্যাপী তাদের বিধুর দাম্পত্যে, সেদিনের মত অমন রোমান্টিক মুহূর্তে আর কখনও আসেনি।
তো, সাপটা যে এ-হেন মমতা-গুদোমের ঠিক কোথায় লুকিয়েছে, তা মানুষের পক্ষে সত্যিই অননুমেয়, দাঁত মাজতে মাজতে সে বুঝতে পারল। চিন্তির খেলাদেলির বেডরুম সেটের সোফা থেকে বিছানায় শুতে যাচ্ছে হয়ত— এই মুহূর্তে! ও-হো, বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠা বলতে ঠিক কী বোঝায় সে টের পেল। শিউরে উঠল গা-টা। তবে যত ঘোরো-ফেরো বাছাধন, বেরোবার কোনো রাস্তা নেই। ও-ঘরে নর্দমা নেই। দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারলেও কথা ছিল। ঘুলঘুলি ছিল। চেষ্টা করবে নিশ্চয়। কিন্তু, অত্রু�র হাসিতে নলিনীর ঠোঁট আরও পাতলা হয়ে এল, বৃথা এ সাধনা, ধীমান!
চিন্তির বাস এল বলে সে স্কুলড্রেস পরছে। টেবিলে চায়ের কাপ ও কাগজ রেখে আঁচলে হাত মুছে মমতা বলল, ‘সাপটা এমনিই বেরিয়ে যাবে, কী বল?’
‘বেরুবে কী করে? নর্দমা তো তুমিই বুজিয়ে দিয়েছ? তা ছাড়া চার তলা..’
‘ধুস! ও যেখানে দিয়ে এসেছে সেখানে দিয়েই বেরিয়ে যাবে।’ সত্যি, এইসব তাচ্ছিল্য করার সময় মমতার ঠোঁটের পাউটিং দেখার জিনিস। সম্রাজ্ঞীর এক-একটি ঠোঁট-ওলটানোয় কত যে জাহাজডুবি হয়েছে আটলান্টিকে!
আজ ঊষা উত্থুপ মামলার রায় বেরিয়েছে। আজ কাগজের হেডলাইন : ঊষার জিৎ, যতীন চিৎ। দেখেই নলিনী হেসে ফেলল। ঊষা-হাসি হাসতে হাসতে সে বলল, ‘তাহলে তো ঝাঁটার কাঠিগুলো দরজা থেকে খুলে ফেলতে হয়!’
‘ওমা, না-না’ বলে একপায়ে কেডস পরে ছুটে এল চিন্তি।
‘তবে থাক ওখানে মুখপোড়া। দরজাটা মাসখানেক না খুললেই হবে। পচে মরুক।’
‘মরবে কেন?’ নলিনীর এখন শুধু ঠোঁটে হাসি, ‘তোমার গুদোমে যা ইঁদুর! বহু বছর বেঁচে থাকবে।’
‘আমাদের ফ্ল্যাটে ইঁদুর আর বিশেষ নেই।’
‘এ্যাঁ!’ এতক্ষণে বজ্রাঘাত হল নলিনীর মাথায়। ইঁদুরগুলো গেল কোথায়?
‘পালিয়ে-টালিয়ে গেছে’ ঠোঁট উলটে মমতা বলল, ‘মাঝে ফ্লিট-টিলট খুব দিয়েছিলাম না? আরশোলাও তো নেই।’
ফ্লিট! মশাই মরে না যাতে, তাতে ইঁদুর!
একটা গোটা দিগন্তকে যদি স্টেজ ভাবা যায়, যার ওপর এতক্ষণ ঝুলে ছিল মেঘের পর্দা—পুলিতে লগ্ন দড়ি টেনে কেউ যেন তা দু-দিকে সরিয়ে দিল। সে হঠাৎ বুঝতে পারল, কেন তাদের বাড়িতে আর একটাও ইঁদুর নেই, এমন কি আরশোলাও নেই। ত্রূর পাতলা হাসি ঠোঁট ছেড়ে ভরে দিতে থাকল তার মাথা, ও তাহলে এই ব্যাপার! মহারাজ তাহলে নৈশ ভোজনের কারণে বেরিয়ে ঐ ঘরে প্রবেশ করেছেন। আই সী। ঐ কেঁচোর গর্তটা দিয়েই? নয়ই বা কেন। লখিন্দরের বাসরে তো সূচাগ্র ছিদ্রও ছিল না! ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। অন্তত, একটি টিকটিকির আশায় সে দেওয়াল থেকে দেওয়ালে তাকায়।
‘আঁচ্ছা, আজকাল টিকটিকিও কত কমে গেছে দেখেছে মমতা! এও তোমার ঐ ফ্লিটের জন্যেই, কী বল?’
‘তা কেন?’ মমতা বলল, ‘আমি কি দেওয়ালে ফ্লিট দিয়েছি নাকি? বোশেখ মাসে কলি ফিরিয়ে দিল না? তারপর থেকেই’, মমতা জানাল, ‘এখন নেই বললেই চলে।’
এই গৃহস্থ বাড়িতে আর আরশোলা নেই। টিকটিকি নেই। ইঁদুর তো নেই-ই। মহারাজ তাহলে পুরোনো অতিথি, সব সাবাড় করে মুখ-টুক মুছে বসে আছেন। এবার তাঁর আহার না-জানি কী দিয়ে হবে! চাযের কাপ নামিয়ে রেখে নলিনী ধীরে উঠে দাঁড়াল।
‘স্টোরের দরজা একদম খুলো না, আমি অফিস যাই খোঁজ-খবর করি। দেখি, কী করা যায়’—অফিস যাবার আগে এর বেশি একটা কথাও সে বলল না।
।। ৩ ।।
অফিসে অনেকের সঙ্গে কথা হল। সে দেখল, প্রায় সকলেই সর্প-বিশারদ এক-একটি। কেউ বলল, একটা বেঁজি কিনে ফেল। এউ বলল, ময়ূর। সন্তোষদার সঙ্গে সেই ভদ্রেশ্বর-আমল থেকে পরিচয়। ভদ্রলোকের একটা করে দাঁত পড়ছে আর এক এক দাঁতে লম্বা লাফে পৌঁছে যাচ্ছেন শৈশবের দিকে। হাসিটি হচ্ছে ক্রমাগত সুন্দর। সুন্দরতর হেসে সন্তোষদা বললেন, ‘তুমি এক কাজ কর নলিন। তুমি একটা ব্যাঙ কিনে নিয়ে যাও মার্কেট থেকে। জ্যান্ত পাওয়া যায়। দুটো ডালকোলেক্স পুরে দিতে বল ব্যাঙের পেটে। তারপর ওটাকে সাপের ঘরে ছেড়ে দাও। বাঞ্চোৎ, হেগে-হেগে—’ সবাই হেসে উঠল। নলিনীও যোগ দিল। মেঘ যেন অনেকটা কেটে গেল।
সব শেষে সে গেল সামন্তদার ঘরে। লাইব্রেরি ফ্রেমের ডাঁটি ভেঙেছে, টেবিলের কাছে মুখ এনে সামন্তদা চশমা মেরামত করছিলেন। মাইনাস-৬, নলিনী জানে, মুখ তুলে উনি এখন অন্ধকার দেখছেন। বর্ণনা শুনে উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘সে কী রে, এ তো খরিশ। গোখরোর বাচ্চা। বেহুলার বাসরে ঢুকেছিল।’
সন্তোষদার ডালকোলেক্স-প্রস্তাব তখনও নলিনীর মাথায় ঘুরছিল। জীবজগতের তুলনায় মানুষের উচ্চমন্যতার কমপ্লেকস থেকে সে হেসে বলল, ‘বেহুলার বাসর? ও বাবা, তবে তো লখিন্দরকেই কামড়াবে।’
‘হুডেড, না, ননহুডেড?’
‘সে তো ছোবল দেবার সময় জানা যাবে। মরবার আগে একটা ডাইং ডিক্লারেশন রেখে যাবে’খন।’
‘না-না, ঠাট্টা নয়, হুডেড হলে তোর গোখরো। বা, কেউটে! নন-হুডেড হলে ভাইপার। মানে সিরাম না অ্যান্টি-ভেনাম কী দেবে,’ চশমার কব্জায় একটা আলপিন ঢোকাতে ঢোকাতে সামন্তদা বললে, যেন বন্ধু, ‘বলতে হবে তো ডাক্তারকে। তুই এক কাজ কর— চিড়িয়াখানার দাশগুপ্তকে ফোন কর, ডিরেক্টর। আমি বলে দিচ্ছি। যদি স্নেক-ক্যাচার কাউকে পাস একদম ট্যাক্সি করে নিয়ে যা’ মুগা পাঞ্জাবির ঢোলা হাতা তর্জনী দিয়ে সরিয়ে সোনার ঘড়ি দেখলেন সামন্তদা, ‘এখনও সময় আছে।’ বলে গাইড আর একটা ১০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন যেন বন্ধু। ঘুষ, নলিনী বুঝল। এক সপ্তাহ চুপচাপ থাকতে হবে। ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে সে অবাক হয়ে দেখল, সামন্তদা ইতিমধ্যেই চশমা মেরামত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন চোখে।
শূশূ করে তিনবার সিগারেট টেনে ডিরেক্টর বললেন, ‘দেখুন, শুনে মনে হচ্ছে চন্দ্রবোড়া। যদি বোড়ার বাচ্চা হয়, উই আর ইন্টারেস্টেড। লোক যাবে ধরতে। উই আর শর্ট অব আ বোড়া। এই, এঁকে স্নেক-হাউজের পীর মহম্মদের কাছে নিয়ে যাও।’
শ্বেতির দাগে ভরতি কালো নূর-অলা পীর মহম্মদ ছেলেটি যুবাবয়সী। জলার পাশে চিড়িয়াখানার অদ্বিতীয় উইলো গাছের ধারে বসে তার সঙ্গে অনেক কথা হল। পীর প্রথমেই গোলাকার সর্প-গৃহটা দেখিয়ে বলল, ‘চলুন সার, আগে সাঁপগুলো চিনে লিন।’ অর্থাৎ আগে আপনার সাপটা আইডেনটিফাই করুন।
নলিনীর চোখের সামনে একটা ভয়াবহ দৃশ্যমালা ভেসে উঠল। মর্গে যেমন ডোম, একটার পর একটা গ্লাস-কেস টেনে বের করে মৃত সাপের মুখ দেখাচ্ছে তাকে পীর— কেসের ওপর লেখা : ‘খরিশ (বিষাক্ত)’…
— না!
লাউডগা (নির্বিষ)— না। হলুদের ওপর মোটা কালো ডোরা— শাঁখামুটি (বিষাক্ত)— না। কাল নাগিনী— লিকলিকে সরু, ছোট্ট, কালো সোনার ওপর যেন চুনি-সেটের নেকলেশ, আ, অপূর্ব— (নির্বিষ)— না। শিশু চন্দ্রবোড়া— জমাট রেপসিড রঙের— লিকলিকে— বি-ষা-ক্ত— ল্যাজটা একটু নড়ে উঠল যেন কেসের ভেতর, মরেনি, বা, অমর বলে ঐ আবার বেঁচে উঠছে!
‘না!’ চমকে একটু সরে গিয়ে নলিনী বলল, ‘আমি তো নিজে দেখিনি। চিনতে পারব না।’
।। ৪।।
চিড়িয়াখানা কি সাপুড়ের ঝাঁপির বাইরে এবং ভদ্রেশ্বর বাদে নলিনী জীবনে দু-বার সাপ দেখেছিল।
সে জীবনে প্রথম সাপ দেখেছিল বাঙলা-বিহার সীমান্ত বরাবর, দুমকা রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে। সঙ্গে ছিল স্থানীয় স্কুল-শিক্ষক পল্টু সাহা। বিয়ের পরে-পরেই ড্রাই প্লুরিসির চিকিৎসা-অন্তে মমতার সঙ্গে সে ওদিকে গিয়েছিল মাসখানেকের চেঞ্জে। তখন সন্ধেবেলা। শেষ বাস বেরিয়ে গেছে। পাতাবেড়িয়ার দিকে টিলার পিছন থেকে একটু দেরিতে উঠছে পূর্ণিমার চাঁদ, দুমকা রোড ধরে চাঁদের আলো একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তাদেরই দিকে। দুধারে শালবীথি।
গায়ে খোঁচা দিয়ে, ঠান্ডা গলায়, হঠাৎ পল্টু বলল, ‘নলিনীদা, দেখবেন।’
পল্টু কী বলছে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে ভাগ্যিস বাঁ-পাটা আর ফেলেনি সে। তার পায়ের সঙ্গে উত্তোলিত কোলাপুরি চটির নীচে, আর-এ, দ্যাখো-দ্যাখো, কী সুন্দর কুচকুচে ভেলভেট-কালো সাপের বাচ্চা একটা! তার ছোট্ট তুলতুলে শরীরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে, আহা; বুঝি জীবনে এই প্রথম ফণা তুলেছে। যেন সে করজোড়ে বলছে, তার আধো-আধো গলা আজো কানে বাজে নলিনীর, ‘ওগো পথিক, ওগো পা, ওগো চটি, দয়া করে আমাকে। আমাকে পিষে মেরো না!’ নলিনী পা আর নামায়নি।
সে আর-একবার সাপ দেখেছিল রাজাভাতখাওয়া থেকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, সাইকেলে, মেসোমশাই-এর সঙ্গে জয়ন্তীর দিকে যেতে যেতে। স্কুল-ফাইনালের গেজেটে থার্ড ডিভিসন দেখেই সেবার মেসোমশাই-এর কাছে পালিয়ে গিয়েছিল। স্কুল ফাইনাল যখন, ১৯৫৩ সাল জুন-জুলাই হবে।
ডুয়ার্স সরলবর্গীয় বনাঞ্চল, এখানে সব গাছই আকাশ ছোঁয়া। মনে পড়ে, একটা কদম-বীথির পাশ দিয়ে উতরাই বেয়ে তরতরিয়ে নেমে যাচ্ছে— মেসোমশাই অনেকটা এগিয়ে—অত উঁচুতে আর এত কদমফুল একসঙ্গে নলিনী আগে কখনও দ্যাখেনি তাই তার চোখ আকাশে, আর কদমফুল যখন, নিশ্চয়ই বাদল-দিনের ব্যাপার—হঠাৎ ক্যাঁচ করে ব্রেক কষার শব্দ। মেসোমশাই দূর থেকে হাত তুলে তাকে দাঁড়াতে বললেন। কাছাকাছি গিয়ে নলিনী দ্যাখে সরু বনপথ জুড়ে, পাঁচ/সাত ফিট দূরে, কদমকেশরের হলুদ কার্পেটের ওপর একটা শ্যাওলা-ধরা গাছের ডাল পড়ে আছে। সে তো অন্তত তাই ভেবেছিল। নড়ে উঠতে ক্রমে বুঝেছিল সাপ। রাস্তা পেরিয়ে সাপটা বনের মধ্যে ঢুকে যাবার পরেও, সেখানে দাঁড়িয়ে, সে যে কতক্ষণ ধরে সে শুকনো ঝরা পাতার ওপর দিয়ে তার চলে যাবার ঝুম-ঝুম ঝুম-ঝুম শব্দ শুনেছিল। মেসোমশাই বলেছিলেন, প্রমাণ সাইজের শঙ্খচূড় লম্বায় ১০/১২ ফিট পর্যন্ত হয়, ফণা এত উঁচু হয় যে বুকের নীচে ছোবলের দৃষ্টান্ত নেই। রান-ওভার হলে, কী যে হত সেদিন, ওঃ-হো, ভাবা যায়!
ঝুরি-নামা উইলোর ধারে বসে পীরের সঙ্গে সেদিন অনেক কথা হল। পীরদের দেশ মুর্শিদাবাদে ভৈরব নদীর ধারে, চক ইসমাইলপুর থেকেও মাইল চারেক দূরে, গ্রামের নাম বাঁটি। চর একটা। সাপের সঙ্গেই তারা মানুষ। ‘ছোট বেলায়, বুঝলেন সার, ডিম ফাটিয়ে খেউটের বাচ্চাগুলোখে বের খর্থুম— আর সে এই টুখুটুখু— আর দু দিখে দু পাও রেকে তা-তা-তা-তা-তা-তা-তা-তা বলে তাঁড়া খর্তম—যতক্কণ না শালারা গরতে ষেঁদোয়। পরে সার, এই জু-গার্ডেনে খাজ খরতে এসে শুনলুম কি, ওই বাচ্চাগুলোতেও পুরা পয়জিন। তা, আমরা তো সার এমনিভাবেই মানুষ হয়েছি।’ অর্থাৎ, দু পায়ের ফাঁকে মৃত্যুকে রেখে, ঐ তা-তা-তা-তা করে তাড়া করে।
‘তবে ও সাঁপ সার আপনার ঘরে আর নেই, বেরিয়ে গেছে। সে আপনার চার তল্লা হোখ, দশ তল্লা হোখ, তার বেরবার রাস্তা শে ঠিখ খুঁজে লেবে। আর যদি থাখে, শুনুন সার, আপনাখে বলি। আমার চাচাতো ভাই এরফান আলি— তখুন এই দু বচ্ছরের হোবে—বাড়ির সামনে উঠানে চটের উপরে শুয়ে হাত-পাও ছুঁড়ে খুব খেলছে আর হাসচ্ছে—ইয়াব্বড়া একটা গোকরো তার পায়ের খাছে। আমিই পরথম দেকেছিলুম। তা-তা-তা-তা-তা-তা করে ছেলেটা পাও ছুঁড়ছে আর গোকরোটা ইয়া ফণা তুলে মাথা দোলাচ্ছে আর ফোঁস-ফোঁস করছে,’ ফোঁস বাদে বাঁ-হাতে কনুই-এর এপর ডান হাত রেখে পীর দুলিয়ে দেখায়, ‘সাঁপটা সার আমার ভাই-এর গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।’
হাত নামিয়ে পীর এবার তিন-আঙুল দেখায়, ‘সেই ভাই-এর সার আজ তিন খানা মিনি বস, মিটিয়াবুরুজে ভূষির কারখানা। লাখো রুপিয়ার মালিক। আর দেকুন সার, আমরা আর তেরোটা ভাই অ্যানা-ত্যানা করছি— দুজন ভিকারি…
‘তাই বলছিলাম সার যদি ঘরমে থাখে তো থাখ, আপনি রাজা হবেন। জানবেন কী, আপনার রাইজের টাইম আসছে।’ এবার হাত দিয়ে ফণা তুলে সে রাইজ-এর রূপকল্প দেখায়। মানুষের কী যে কখন মনে পড়ে, কেন যে। এমনি এক শোকাকুলা উইলো-ঝুরির নীচে একদিন ওফেলিয়া ভেসে উঠেছিল, তার কেন যে মন পড়ল। আজ সেখানে থেকে একটা শাদা রাজহংসী জল ঝেড়ে তীরে উঠে আসছে, সে দেখল।
চিড়িয়াখানা বন্ধর ঘণ্টা বাজছে। পীরের হাতে ১০ টাকা আগাম দিয়ে নলিনী উঠে পড়ল। সে কাল আসবে।
সন্ধ্যার কিছু পরে মিনিবাসে সে বাড়ি ফিরল।
সামন্তদার দেওয়া টাকাটা পুরোটাই থেকে গেছে। ধর্মতলায় পৌঁছে একবার ভেবেছিল, অম্বর-এ একটু বসে যাবে নাকি। সামন্তদাও থাকতে পারে। মদ না খেয়ে সে কী সসর্প সারারাত কাটাতে পারবে! কালকের রাতটা কেমন গ্লোরিয়াসলি কেটে গেল! এক ঘুমে রাত কাবার। কিন্তু আজ… তারপরই মনে হল, নাঃ, লাভ কী। মদ একটা চোখের ঠুলি বই তো কিছু না। সে তো মদ খায়নি। ঠুলি পরেনি! সে সবই দেখবে, খোলা চোখে। আর সে দেখবে এমন দুটি চোখ দিয়ে, যে চোখে নিমেষের জন্যেও পলক পড়ে না। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া একরকম অ-মানবেয়, বিষণ্ণ মনে সে মাথা নাড়ায়।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই সে একটা তীব্র, অনাঘ্রাত কিন্তু সামহাউ ফ্রেন্ডলি গন্ধ পেল। কার্বলিক? হ্যাঁ, খাঁটি কার্বলিক অ্যাসিডের কৃষ্টাল কিনে এনে, শিশির মধ্যে রেখে, গরম জলে ডুবিয়ে, গালিয়ে, প্রতিটি নর্দমার মুখে আর দরজার চৌকাঠে ছড়িয়ে দিয়েছে মমতা। ‘বাবা, দ্যাখো-দ্যাখো’, দুহাতে ঠেলে স্টোরের দরজাটা দু’হাট করে খুলে দেয় চিন্তি। একটা আলপিনও নেই এমন আসবাবহীন শূন্য ঘর থেকে সেই অনাঘ্রাত, তীব্র কিন্তু মূলত স্বস্তিদায়ক গন্ধ নলিনীর নাকে এসে লাগে।
ব্রাভো, আর-এ, এ যে দেখছি ‘গুদাম সাফ!’ করছে কী মমতা, একদিনে এ যে এক জীবনের কাজ করে বসে আছে। পাড়ার খোকা-গুন্ডা কালা আর ভোলাকে এলে সে ৭২ টাকার খবরের কাগজ বিক্রি করিয়েছে। লে-লে-বাবু ৩০ পয়সা রেটে টুথপেস্ট-সাবান থেকে কৌটো-টিন-শিশি-চিন্তির ওয়াকার— মায়, মায়ের উত্তরাধিকার—সব, সব বেচে দিয়েছে। ‘বাবা দ্যাখ, এটা নিল না’, শাদা সাবান-টুকরো দিয়ে তার তৈরি ছোট্ট তাজমহলটা দেখিয়ে চিন্তি ঠোঁট ফোলায়, ‘বলল, এটা কেউ নেবে না।’
‘পালিয়ে গেছে সাপটা। কোত্থাও নেই, কিছুতে নেই। কালা আর ভোলা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। মা রবিবার ওদের মাংস খাওয়াবে বলেছে,’ চিন্তি সোৎসাহে বলে চলে, ‘বাবা, এবার আমাকে একটা ছোট খাট কিনে দেবে। টেবিল-চেয়ার কিনে দেবে। এটা আমার ঘর। আমি এই ঘরে থাকব। শোব। পড়াশোনা করব।’ অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হবার আশায় তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
রাতে সে এসে হাজির।
ঝুম-ঝুম… ঝুম-ঝুম… ঘরের মধ্যে চকিতও ত্রূর, স্খলিত ঘুঙরের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই, মশারির মধ্যে থেকে, বাঁ হাত প্রকাণ্ড টর্চটা পাকড়ে ধরে নলিনী, ছয়-সেলের তীব্র আলো জ্বলে ওঠে।
ঐ! বিছানা থেকে অদূরে পিত্তলবর্ণের বিচ্ছুরিত শোভার মধ্যে সে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে। গা থেকে গলে গলে পড়ছে তরল পিত্তল। মাথা দুলছে ঘিয়ের পঞ্চপ্রদীপ।
ডলফিনের যেমন, তার দুদিকে দুটি ডানা। একটি ডানা ধর্মতলা স্ট্রিটের দপ্তরি-পাড়ার এইটুকু সস্তা, সফট-কভার খাতা নাড়িয়ে করুণ, মিনতি-মাখা সুরে ডানাদুটি জড়ো করে, সে বলছে, ‘ওগো মানুষ, তুমি কি তোমার একটা অটোগ্রাফ আমাকে দেবে?’
অটোগ্রাফ? স্বপ্ন দেখছে নাকি নলিনী। না-আঃ, ঐ তো তাদের পুবের বারান্দা, বারান্দায় জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্নায় গ্রিলের ছায়া। ওখানে টবে, আজই তিনটে রক্ত-জবা ফুটেছে।
মমতার নাম ধরে চেঁচাবে নাকি সে? ভারি টর্চটা সে আর বাঁ-হাতে ধরে রাখতে পারছে না। তার হাত ভেরে আসছে। হাত পালটাবে নাকি নলিনী?
‘না’, কি যেন বলেই গেল তাকে, ‘আলোর একটু নড়চড় হলেই মৃত্যু!’ সাপের চোখের ওপর ছয়-সেলের তীব্র আলো ফেলে সে প্রস্তুরীভূত বসে থাকে। তার ফণা দুলে চলেছে। উজ্জ্বল পঞ্চপদীপের একটির বুকে ঘৃতহীন পলতে চিড়বিড় করে পুড়ছে।
‘ওগো, তুমি কি তোমার…’
ধুউস! নিশ্চয়ই স্বপ্ন। আচ্ছা, যদি সত্যি হয়, যদি সত্যিই জেগে উঠে থাকি, দেখি তো টর্চটা নেবাতে পারি কিনা। তাহলে না হয় স্বীকার করব যে, জেগে উঠেছি… সুইচ নামাতেই ঘর, একি, অন্ধকার হয়ে গেল!
তবে বুঝি আর কোনো সন্দেহ নেই যে, সে, নলিনী, নিঃসন্দেহে জেগে উঠেছে। জেগে উঠে, জীবনের বিশ্বাসযোগ্য অবিশ্বাস্যকে আজ, অবশেষে, সে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছে : সে এসেছে।
‘মমতা!’
ফাঁসা গলায় নলিনী চেঁচিয়ে ডাকে।
উত্তর নেই।
‘চিন্তি!’
সাড়া নেই।
টর্চের ভারে খসে পড়ছে বাঁ-হাত, ও-হো, এই অনন্ত শাস্তির চেয়ে ওর ছোবল শ্রেয়। নলিনী আর পারে না। সে আবারও চর্ট জ্বালায়। কই, কিছু নেই তো। সে যত্র-তত্র আলো ফ্যালে : নেই। সে এখন তবে কোথায়। স্বপ্ন দেখছে কিনা শেষবারের মতো নিঃসন্দেহ হবার জন্যে নলিনী বারান্দায় টর্চ ফ্যালে। ঐ—তিন-তিনটে রক্ত-জবা টবে টকটকে করছে!
সন্তর্পণে মশারি তুলে সে মেঝেয় পা রাখে। না, গায়ে পড়েনি। সারা ঘরে টর্চ-আলোর চাবুক মারতে মারতে পিছন ফিরে বারান্দায় গিয়ে সে মমতাদের ঘরের গরাদ ধরে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে হাঁফায়।
নাইট-ল্যাম্পের নীল আলোয় প্রশস্ত মশারির মধ্যে চিন্তি বহু-ভর্ৎসিত ভঙ্গিমায় হাঁ করে শুয়ে। পাখার হাওয়ায় একগাছি চুল উড়ে এসে পড়েছে মমতার উসুখুসু ঠোঁটে। সে ঠোঁট চকাচ্ছে। মা ও মেয়ের এই নিশ্চিন্ত ঘুম, আহা, এই নিরাপত্তা—এতে তারও কিছু অবদান আছে ভেবে নলিনী বেঁচে-থাকার এক বড়ো দীন চরিতার্থতা খুঁজে পায়। জিরো পাওয়ার নাইট ল্যাম্পের মায়াময় বাজাজ-নীলিমায় মা ও মেয়েকে গরাদ ধরে দেখতে দেখতে সহসাই মনে হয় নলিনীর—আচ্ছা, এমন তো নয় যে আমার এই জেগে-ওঠাও স্বপ্নেরই একটা অংশ—স্বপ্নের একটা ছলনা—আসলে আমি এখনো স্বপ্ন দেখছি?
গরাদের ওপারে মমতা ও চিন্তি—এরা স্বপ্ন না এরা সত্যি, জানার জন্যে নলিনী ব্যাকুল হয়। এই মুহূর্তে এর মীমাংসা না হলে সে এখুনি পাগল হয়ে যাবে টের পেয়ে, সর্পভীতির চেয়ে তুলনাবিহীনভাবে ভয়াবহ এক ভয়ে সে বিপন্ন হয়ে পড়ে।
‘মমতা!’ সে গরাদ নাড়া দিয়ে ডাকে। হাঁউমাউ করে উঠে বসল মমতা। মেটিং কল মনে বিরক্ত ঝংকার তুলে বলল, ‘কী ব্যাপার, এত রাতে! বাঁদরামির আর সময় পেলে না। সারাদিন খাটাখাটনি— উঃ মাগো!’
‘মমতা!’ বাইরে এসো—
‘চিন্তি ওঠ তো।’ ঠেল দিয়ে মমতা তাকে তোলে।
‘কী ব্যাপার, বাবা? এত রাতে? চিন্তির গলায় গরল, ‘কী মনে করে?’
‘চিন্তি, বাইরে আয়। সাপটা এসেছে।’
‘এসেছে তে কী করব?’
‘অটোগ্রাফ চাইছে।’
‘অটোগ্রাফ চাইছে তো তুমি দাও, আমাদের কাছে তো চায়নি।’ বলে কেমন যেন একটু অস্বাভাবিকভাবে, দুহাত তুলে বিছানার ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে, তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ল চিন্তি। চিন্তিই, তবু ঠিক চিন্তি নয় যেন। অবিকল পাথরের মূর্তির মতো কেমন অদ্ভুতভাবে কথা কয়ে উঠল। একটা মূর্তি হঠাৎ তার নিমীলিত চোখ খুললে যেমন…
‘মর মুখপোড়া।’ মমতা বলল।
বলুক মমতা। সে তো বলবেই। কিন্তু চিন্তির কথায় বহুকাল পরে বুকে বড়ো ব্যথা পেল নলিনী।
পায়ের কাছে কী যেন সুড়সুড় করছে? টর্চ জ্বালতে হল না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুমকা রোডের জ্যোৎস্না প্রলম্বিত হতে হতে আজ অবশেষে তাকে ছুঁয়েছে।
ঠিক ১২ বছর আগে দেখা দুমকা রোডের সেই কচি, তুলতুলে কেউটের বাচ্চাটা, নলিনীর পায়ের ফাঁকে জীবনের প্রথম ফণা তুলে করজোড়ে দাঁড়িয়ে।
কোথা থেকে যে কী। নলিনী হঠাৎ সেটার বাঁ-দিকে বাঁ-পা ফেলে বলে ওঠে, ‘তা!’ সঙ্গে সঙ্গে তাকে অবাক করে তার পায়ে ‘ঝম’ করে ঘুঙুর বেজে ওঠে। দু-পায়ের ফাঁকে ফোঁস করে ওঠে সাপটা।
নলিনী এবার ডান-পা না ফেলে পারে না। আবার ‘ঝম’ শব্দ, আবার ফোঁস, নলিনী আবার বলে ওঠে, ‘তা!’ চিরায়ত ছন্দের অমোঘ ডাকে এবার তার আঙুলে চলে আসে কত্থকের তৃতীয় মুদ্রা।
ডান হাত মাথার ওপর ঘুরিয়ে তুলে সে বলে ওঠে, ‘থেই’। অর্থাৎ, আকাশ।
নলিনীর মাথার ওপর এখন রাতের আকাশ। নক্ষত্রহারা, গ্রহহীন, চন্দ্রলুপ্ত আকাশের নীচে কেউটের ফোঁসফোঁসানির দুদিকে দুপা রেখে ‘তা-তা-থেই-থেই’ ‘তা-তা-থেই-থেই’ বোলের ছন্দে নলিনী নেচে চলে। তার পায়ে ঘুঙুর।
১৯৮৩