সাত নম্বর খাদান

সাত নম্বর খাদান

হঠাৎই একটা ঘস ঘস শব্দ করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা৷ সুনন্দ তার পাশের ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হল?’

ড্রাইভার বলল, ‘মনে হয় পিছনের একটা টায়ার ফেঁসে গেল!’

সে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে৷ সুনন্দও নীচে নামল৷ হ্যাঁ, পিছনের বাঁ পাশের টায়ারটা চুপসে গিয়েছে৷ সেদিকে তাকিয়ে সুনন্দ বলল, ‘টায়ারটা পুরোনো নাকি?’

ড্রাইভার একটু আক্ষেপের সুরে বলল, ‘না স্যার, একদম নতুন টায়ার৷ কোলিয়ারির রাস্তা তো, ভারী ভারী ট্রাক চলে৷ লোহালক্কড়ের টুকরো পড়ে থাকে রাস্তায়, তাতেই মনে হয় ফেঁসে গিয়েছে৷ এ রাস্তায় এর আগেও একবার আমার এরকম হয়েছে৷’

সুনন্দ প্রশ্ন করল, ‘এখান থেকে ম্যাকেঞ্জি কোলিয়ারি কত দূর?’

ড্রাইভার দূরে অন্ধকারের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওদিকে ওই যে ওপাশে একটা টিলা দেখা যাচ্ছে, তার আর-একটু ওদিক থেকেই তো কোলিয়ারি শুরু হয়েছে৷’

ড্রাইভার যেদিকে দেখাল, সুনন্দ তাকাল সেদিকে৷ আকাশে চাঁদ থাকলেও তার আলো কেমন যেন ম্লান৷ সেই আলোয় বেশ কিছু দূরে অস্পষ্ট কয়েকটা টিলা চোখে পড়ল সুনন্দর৷ গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে জায়গাটা আধ মাইল মতো হবে৷ আর-একটু এগোলেই পৌঁছে যাওয়া যেত সেখানে৷ সুনন্দ ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত ন-টা বাজতে চলেছে৷ কোলিয়ারিতে গিয়ে কাজ সেরে কাল ভোরেই কলকাতায় ফিরতে হবে৷ তার কোম্পানির সেই রকমই নির্দেশ৷ ড্রাইভার গাড়ির ডিকি খুলে যন্ত্রপাতি নামাতে শুরু করল চাকাটা পালটে ফেলার জন্য৷ সুনন্দ তাকে বলল, ‘তোমার কত সময় লাগবে?’

ড্রাইভার বলল, ‘বেশিক্ষণ নয়, আধ ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে যাবে৷’

চারপাশে গুমোট গরম, আকাশে মেঘ আছে, তার আড়ালে মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ৷ এখানে এর আগে কোনোদিন আসেনি সুনন্দ৷ সে যে কোম্পানিতে চাকরি করে তাদের বেশ কয়েকটা কয়লাখনি আছে এ অঞ্চলে৷ কোম্পানি তাদের গাড়িতে সুনন্দকে পাঠিয়েছে ম্যাকেঞ্জি খনি থেকে একটা রিপোর্ট সংগ্রহ করে হেড অফিসে জমা দেওয়ার জন্য৷ কোলিয়ারির ম্যানেজারের রিপোর্ট তৈরি করে রাখার কথা৷ সুনন্দ অফিসে তার উপরওয়ালার মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে, তাতে সে জানতে পেরেছে যে, কোম্পানি সম্ভবত বন্ধ করে দেবে তাদের খনি৷

হঠাৎই তার কানে এল একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ৷ শব্দটা শুনে সুনন্দ ভালো করে ঠাওর করবার পর বুঝতে পারল, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে রাস্তার পাশের মাঠের ভিতর দিয়ে একটা গাড়ি যেন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে৷ গাড়িটায় কোনো আলো নেই, শুধু তার শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ শব্দটা কানে গিয়েছে সুনন্দর ড্রাইভারেরও, সে-ও উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল সেদিকে৷ তারপর বলল, ‘মনে হয় একটা জিপ আসছে৷’

গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কি ম্যাকেঞ্জি খনিতে যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে আসছেন?’

তাঁর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেল সুনন্দ৷ উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আপনি?’

গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন ভদ্রলোক৷ তাঁর পরনে সাদা জামা-প্যান্ট৷ ভদ্রলোকের বয়স বছর পঞ্চাশ হবে৷ ভদ্রলোক সুনন্দকে নমস্কার করে বললেন, ‘আমি ম্যাকেঞ্জি কোলিয়ারির ম্যানেজার৷ কোম্পানির হেড অফিস থেকে তার পেয়েছি আপনি আসছেন৷ দেরি হচ্ছে দেখে আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছি৷’

এই ভদ্রলোকের থেকেই সুনন্দর রিপোর্ট সংগ্রহ করার কথা৷ সুনন্দ ভদ্রলোকের কথা শুনে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আমি আগেই পৌঁছে যেতাম৷ আসলে দুর্গাপুরের কাছে একটা জ্যামে আটকে থাকতে হয়েছিল ঘণ্টা দুয়েক, তারপর এ পর্যন্ত এসে আবার গাড়িটা পাংচার হয়ে গেল৷’

ভদ্রলোক বললেন, ‘এত দূর আসতে রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার খুব ধকল গিয়েছে৷ এদিকের রাস্তাঘাট তো বেশ ভাঙাচোরা৷’

কথাটা ভুল বলেননি ভদ্রলোক৷ শেষ মাইল কুড়ি পথ আসতে আসতে সুনন্দর মনে হচ্ছিল, ঝাঁকুনিতে তার হাড়-পাঁজর যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে৷ ভদ্রলোকের কথার জবাবে সুনন্দ বলল, ‘হ্যাঁ, একটু ধকল গেল৷’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি বরং সামনের রাস্তাটুকু আমার জিপে চলুন৷ বেশিক্ষণের পথ নয়, মাত্র মিনিট পনেরো লাগবে৷’

তাঁর কথা শুনে সুনন্দ তাকাল তার ড্রাইভারের দিকে৷ ড্রাইভার বলল, ‘আপনি ওঁর সঙ্গে চলে যান, আমি পৌঁছে যাব ওখানে৷’

সুনন্দ ড্রাইভারকে বলল, ‘তুমি এই অন্ধকার রাস্তার মধ্যে গাড়ি নিয়ে একলা থাকবে নাকি! তার চেয়ে বরং গাড়িটা সারিয়ে নাও, তারপর এক সঙ্গেই যাওয়া যাবে৷’

তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘ওর জন্য আপনার চিন্তা নেই, আমি একজন লোক এখানে রেখে যাচ্ছি৷’

এই বলে তিনি ‘মংলু’ বলে একটা হাঁক দিতেই জিপের পিছন দিক থেকে নেমে এল একজন৷ লোকটি মনে হয় সাঁওতাল শ্রমিক গোছের, তার শরীরের কালো রং যেন মিশে গিয়েছে অন্ধকারের সঙ্গে৷ সে নীচে নেমে দাঁড়াবার পর তার ড্রাইভার বলল, ‘আপনি যান না, এরকম অন্ধকার রাস্তায় একলা থাকার অভ্যেস আমার আছে৷ তা ছাড়া ম্যানেজারসাহেব একজন লোক তো রেখেই যাচ্ছেন, আপনি ভাববেন না৷’

যদিও ভদ্রলোক নিজেকে ম্যানেজার বলে পরিচয় দিচ্ছেন, আর সুনন্দর এই ভদ্রলোকের কাছ থেকেই রিপোর্টটা নেওয়ার কথা, কিন্তু ইনিই সত্যি সত্যি ম্যানেজার তো? অচেনা লোকের গাড়িতে চড়ে বসার আগে পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া দরকার৷ ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন সুনন্দর মনের কথা৷ তিনি একটু হেসে সুনন্দকে বললেন, ‘এই অন্ধকার রাস্তার মাঝে হঠাৎ এসে হাজির হলাম বলে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি সত্যিই ম্যানেজার কি না! আপনার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন, ও আমাকে এর আগে দেখেছে৷’

ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, উনিই ম্যানেজারসাহেব৷ আগে যখন এখানে কোম্পানির সাহেবদের নিয়ে এসেছিলাম, তখন ওঁকে দেখেছি৷’

সুনন্দ একটু লজ্জা পেল৷ সে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, চলুন আপনার গাড়িতেই যাওয়া যাক৷’

ভদ্রলোক মংলু নামের লোকটিকে সেখানে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে চেপে বসলেন জিপে৷ সুনন্দও তার নিজের গাড়ি থেকে ব্রিফকেসটা বের করে নিয়ে উঠে পড়ল জিপে৷ ভদ্রলোক চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করতেই গাড়িটা গোঁ-গোঁ শব্দ করে উঠল৷ গাড়ির মুখটা প্রথমে ঘুরে গেল, তারপর রাস্তা ধরে চলতে লাগল৷ গাড়িতে হেডলাইট নেই, সুনন্দ তাই প্রশ্ন করল, ‘লাইট ছাড়া আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন কীভাবে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট আমি হাতের তালুর মতো চিনি, অন্ধকারে তাই আমার কোনো অসুবিধে হয় না৷’

সুনন্দ বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই অনেককাল আছেন এখানে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক দিন, তা প্রায় তিরিশ বছর হবে৷’

সুনন্দর হঠাৎ খেয়াল হল ভদ্রলোকের নামটা এখনও পর্যন্ত জানা হয়নি৷ তাই বলল, ‘আচ্ছা আপনার নামটা কী?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম নীলমাধব মজুমদার৷ যদিও এ নামে আমাকে এখানে কেউ খুঁজে পাবে না৷ সকলেই আমাকে এখানে ম্যানেজারবাবু বলেই ডাকে৷ এ পরিচয়ের আড়ালে আমার আসল নামটাই হারিয়ে গিয়েছে৷’

সুনন্দ কোনো কথা বলল না৷ বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল৷ তার হঠাৎ চোখে পড়ল কিছুটা দূরে অন্ধকারে একটা রেখা যেন চিকচিক করছে৷ সুনন্দ প্রশ্ন করল, ‘ওটা কী?’

গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে নীলমাধব বললেন, ‘ওটাই হল দামোদর নদ, আমাদের খাদানের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে৷ খাদান কাকে বলে জানেন তো?’

খাদান কয়লাখনির গর্তকে বলে সুনন্দ জানে সেটা৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ বুঝি৷’

টিলা থেকে নামতে শুরু করল জিপ৷ নীচে নেমে কিছু দূর এগোবার পরই সুনন্দ বুঝতে পারল তারা কোলিয়ারি অঞ্চলে ঢুকছে৷ মাঝে মাঝেই রাস্তার দু-পাশে ডাঁই করে রাখা আছে কয়লা, চোখে পড়ল বেশ কয়েকটা ওয়াগনও৷ কয়লার পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে তারা ঢুকল একটা রাস্তায়৷ তার দু-পাশে খাপড়ার নীচু ছাদওয়ালা সার সার বাড়িঘর৷ মনে হয় শ্রমিকদের বস্তি৷ কিন্তু কোথাও কোনো আলো জ্বলছে না৷ লোকজনও চোখে পড়ছে না৷ মিনিট পাঁচেক চলার পর আবার বাঁক নিল গাড়ি৷ তারপর কয়লার স্তুপের মধ্যে দিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল জিপটা৷ নীলমাধববাবু বললেন, ‘আমরা এসে গিয়েছি৷’

গাড়ি থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে নেমে পড়ল সুনন্দ৷ নেমে পড়লেন নীলমাধববাবু৷ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটা পুরোনো আমলের বাড়ি৷ বাড়িটা দেখে সুনন্দর ধারণা হল, ভালো করে পরিচর্যা করা হয় না, বেশ কিছু ঝোপজঙ্গল জন্মে গিয়েছে বাড়ির চারপাশে৷ গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে নীলমাধববাবু বললেন, ‘সাহেবরা যখন প্রথম এখানে এসে খনি ব্যাবসা চালু করে, তখন এটাই ছিল খনির অফিসবাড়ি৷ এখন অবশ্য কয়েক বছর ধরে নতুন অফিসবাড়ি তৈরি হয়েছে তিন নম্বর খাদানের কাছে৷’

সুনন্দ প্রশ্ন করল, তাহলে এ বাড়িটা?’

সদর দরজার তালাটা খুলতে খুলতে নীলমাধববাবু বললেন, ‘আমি এ বাড়িটায় থাকি৷’

‘আপনি একলা থাকেন এখানে? আপনার ফ্যামিলি?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘সারা জীবন এই কয়লাখনির শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে করতেই সময় কেটে গেল, বিয়ে-থা আর আমার করা হয়নি৷ তাই বলতে পারেন ঠিক ফ্যামিলি বলতে যা বোঝায়, তা আমার নেই৷ খাদানে যে শ্রমিকরা কাজ করে, বলতে পারেন ওরাই আমার ফ্যামিলি৷’

বাড়ির ভিতরটা অন্ধকার৷ দরজা খোলার পর নীলমাধববাবুর পিছন পিছন সুনন্দ একটা ঘর পেরিয়ে ঢুকল আর-একটা ঘরের মধ্যে৷ ঘরে ঢোকার পর একটা লন্ঠন জ্বালালেন৷ মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ ঘরটা বেশ বড়ো, দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে সার সার লোহার আলমারি, সেলফ৷ তার মধ্যে গাদা করে রাখা আছে পুরোনো কাগজপত্র, ছেঁড়া ফাইল ইত্যাদি৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা বড়ো টেবিল৷ তার এক পাশে একটা পুরোনো গদি-লাগানো চেয়ার, অন্য পাশে কয়েকটা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার৷ টেবিলের উপর রাখা আছে কিছু ফাইলপত্র, পেপার ওয়েট, কলমদানি ইত্যাদি৷ লন্ঠনটা টেবিলে রেখে সুনন্দকে একটা চেয়ারে বসতে বলে, গদি দেওয়া চেয়ারটায় বসলেন নীলমাধববাবু৷ সুনন্দও ব্রিফকেসটা টেবিলের উপর রেখে একটা চেয়ারে নীলমাধববাবুর মুখোমুখি বসল৷ লন্ঠনের আলোয় সুনন্দ দেখতে পেল নীলমাধববাবুর মুখটা৷ তার চেয়ে তাঁর বয়স কিছুটা বেশি হবে বলে মনে হল সুনন্দর৷ তাঁর মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, সাদা ছোপ লেগেছে গোঁফে৷ তবে তাঁর মেদহীন শরীর দেখে মনে হল, ভদ্রলোক এখনও যথেষ্ট পরিশ্রম করেন৷ আরও একটা ব্যাপার লক্ষ করল সুনন্দ, ভদ্রলোকের চোখ-মুখের ভাব কেমন যেন বিষণ্ণ৷

চেয়ারে বসার পর সুনন্দ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চলে গেল কাজের কথায়৷ নীলমাধববাবুকে বলল, ‘যে রিপোর্টটা আমার হাতে আপনার দেওয়ার কথা সেটা তৈরি তো? কাল বিকেলের মধ্যেই কিন্তু রিপোর্টটা আমাকে হেড অফিসে জমা দিতে হবে৷’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তৈরি করে রেখেছি৷’ এর পর তিনি টেবিলের একটা ড্রয়ার থেকে রেক্সিনমোড়া একটা কভার ফাইল বের করে এগিয়ে দিলেন সুনন্দর দিকে৷

সুনন্দ ফাইলটা খুলল৷ একগোছা টাইপ করা কাগজপত্র রাখা আছে৷ কাগজপত্রগুলো অবশ্য কী, তা দেখার কোনো দরকার নেই সুনন্দর৷ তার উপর শুধু নির্দেশ আছে, ম্যানেজারের কাছ থেকে কাগজপত্রগুলো নিয়ে হেড অফিসে জমা দেওয়ার৷ ব্যস, ওই পর্যন্তই তার কাজ৷ তাই ফাইলটা আবার বন্ধ করে ফেলল সে৷ নিজের ব্রিফকেসে ফাইলটা রেখে দেওয়ার পর সুনন্দ তাকাল নীলমাধববাবুর দিকে৷ সুনন্দর আসল কাজ চট করে শেষ হয়ে গেল৷ এখন রাতে তার মাথা গোঁজার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে জেনে নিতে হবে নীলমাধববাবুর কাছ থেকে৷

নীলমাধববাবু বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

সুনন্দ বলল, ‘করুন৷’

নীলমাধববাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোম্পানি কি খাদান বন্ধ করে দেবে?’

তাঁর প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ঠিক বুঝতে পারল না সুনন্দ৷ এ ব্যাপারটা সেও শুনেছে৷ তবে তার সত্যতা কতটা তা সুনন্দর জানা নেই৷ সবটাই শোনা কথা৷ তাই বলল, ‘কী জানি, সবই তো মালিকদের ব্যাপার৷’

নীলমাধববাবু বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘আমি কিন্তু বুঝতে পারছি খাদান বন্ধ হয়ে যাবে, সে জন্যই রিপোর্টটা চেয়ে পাঠিয়েছে ওরা৷’ একটু থেমে নীলমাধববাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা বলতে পারেন, খাদান যদি সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শ্রমিকদের কী হবে? এখানকার মাটি তো কালো পাথর, দিনের বেলায় বাতাস আগুন ছড়ায়, চাষবাস হয় না৷ খাদানের পারিশ্রমিকের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে মানুষগুলো৷ কী হবে ওদের?’

কথাগুলো অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়েও মনে এসেছিল সুনন্দর৷ সে বলল, ‘আপনি ওদের কথা খুব ভাবেন, তাই না?’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ওরাই তো আমার সবকিছু৷ ওদের নিয়েই তো জীবনটা কাটিয়ে দিলাম৷’

সুনন্দ চুপ করে রইল৷ এ প্রসঙ্গে আর কিছু আলোচনা করা উচিত কি না বুঝে উঠতে পারল না৷

আবার মুখ খুললেন নীলমাধববাবু৷ সুনন্দর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার একটা কাজ করে দেবেন?’

তাঁর গলায় অনুরোধের স্পষ্ট সুর বুঝতে পারল সুনন্দ৷ জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন, সম্ভব হলে করব৷’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘একটা কাগজ আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে হেড অফিসে৷ একটা ক্ষতিপূরণের ব্যাপার আছে৷ খাদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে যদি কাগজটা হেড অফিসে পৌঁছোনো যায়, তা হলে কিছু গরিব মানুষ আর ক-টা দিন হয়তো বাঁচতে পারে৷’

সুনন্দ বলল, ‘ঠিক আছে, কাগজটা আপনার নাম করে হেড অফিসে জমা দিয়ে দেব৷’

তার কথা শুনে ম্লান হাসি ফুটে উঠল নীলমাধববাবুর মুখে৷ তিনি বললেন, ‘ধন্যবাদ, খুব উপকার করবেন আপনি৷ কিন্তু কাগজটা তো এখানে নেই, অন্য জায়গায় আছে৷ আপনি কোনোদিন খাদান দেখেছেন?’

সুনন্দ বলল, ‘না৷’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘দেখবেন নাকি খাদান? আপনাকে যে কাগজটা দেব সেটা সাত নম্বর খাদানের ভিতর রাখা আছে৷ চলুন, আপনার খাদান দেখাও হবে আর একা একা বসে থাকতেও হবে না৷’

সুনন্দ অবাক হয়ে বলল, ‘রাতেও খাদানে কাজ হয় নাকি?’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘সব সময় না হলেও কোনো কোনো সময় হয়৷ এই মুহূর্তে তিরিশ জন শ্রমিক রয়েছে সেখানে৷’

সে বলল, ‘ঠিক আছে চলুন, কিন্তু আমার গাড়িটা এখনও এল না৷’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, গাড়ি ঠিক চলে আসবে৷’

বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সুনন্দ দেখতে পেল, চাঁদ ঢেকে গিয়েছে মেঘের আড়ালে৷ চারদিক অন্ধকার৷ আকাশের কোণে একবার বিদ্যুতের ঝিলিক চোখে পড়ল তার, হয়তো বৃষ্টি নামবে৷ অন্ধকার রাস্তায় সুনন্দকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে নীলমাধববাবু বললেন, ‘দেখবেন খনির ভিতর কী অসম্ভব পরিশ্রম করে শ্রমিকরা৷’

অন্ধকারের মধ্যে মিনিট পাঁচেক চলার পর সুনন্দ যেখানে এসে হাজির হল, তার চারদিক ছোটো-বড়ো কয়লার পাহাড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ একপাশে রাখা আছে সার সার ট্রলি৷ ওতেই কয়লা নীচ থেকে রেল লাইনের মতো লাইনের উপর দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে উপরে আনা হয়৷ কাছেই একটা বড়ো ওয়াচটাওয়ার অন্ধকারে ভূতের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনেই একটা জায়গা উঁচু জাল দিয়ে ঘেরা৷ টর্চ জ্বাললেন নীলমাধববাবু৷ জালে ঘেরা জায়গাটার ভিতর ঢোকার জন্য একটা দরজা মতো আছে৷ সুনন্দ দেখল তার মাথার উপর লটকানো একটা টিনের সাইনবোর্ডে হিন্দিতে লেখা আছে ‘সাত নম্বর খাদান, ম্যাকেঞ্জি কোলিয়ারি’৷ জালে ঘেরা জায়গাটায় ঢোকার পর নীলমাধববাবু বললেন, ‘এ খাদানে লিফট নেই, পায়ে হেঁটে নামতে হবে৷ তবে আপনার কোনো ভয় নেই৷’ এই বলে তিনি টর্চের আলো ফেললেন সামনের জমির উপর৷

সুনন্দ দেখতে পেল বিরাট একটা গহ্বর হাঁ করে আছে সেখানে৷ রেল লাইনের মতো ট্রলির লাইন এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে সেই অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে৷ নীলমাধববাবু টর্চ জ্বালিয়ে ঢুকলেন গহ্বরের মধ্যে, পিছনে সুনন্দ৷ ঢালুপথ ক্রমশ নীচের দিকে নেমে গিয়েছে৷ নামতে নামতে নীলমাধববাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি ভয় করছে?’

মনের ভিতর একটু ভয় ভয় করলেও সুনন্দ মুখে বলল, ‘না৷’

আনুমানিক চার-পাঁচ-তলা বাড়ির সমান নীচে নামার পর যেন আলোক রেখা চোখে পড়ল সুনন্দর৷ অস্পষ্ট শব্দও যেন কানে আসতে লাগল৷ আর-একটু নীচে নেমে সুনন্দ হাজির হল একটা প্রায় সমতল জায়গায়৷ সে জায়গাটা ঠিক যেন নীচু ছাদওয়ালা বিরাট হলঘরের মতো৷ সেখানে দেওয়ালের গায়ে হলদেটে আলো জ্বলছে৷ লম্বা ধরনের ঘরটার শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে ঠক ঠক শব্দ৷ কালো কয়লার দেওয়ালে গাইতি চালাচ্ছে শ্রমিকরা৷ নীলমাধববাবুর সঙ্গে সুনন্দ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল৷ বেশ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছে সেখানে৷ ওখানে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা সুড়ঙ্গও চোখে পড়ল সুনন্দর৷ তার ভিতর থেকেও গাঁইতি চালানোর ঠক ঠক শব্দ ভেসে আসছে৷ ঠিক যেন যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে লোকগুলো৷ খনির ভিতর জ্বলতে থাকা ঘোলাটে আলোয় মনে হচ্ছে তারা যেন ঠিক মানুষ নয়, কালো ছায়ামূর্তি৷ কয়েক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর নীলমাধববাবু বললেন, ‘দেখছেন তো কত পরিশ্রম করে ওরা!’

সুনন্দ বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যিই অমানুষিক পরিশ্রম!’

নীলমাধববাবু তারপর বললেন, ‘আসুন, কাজটা সেরে ফেলি৷’ এই বলে তিনি এগিয়ে গেলেন ঘরের একটা কোণের দিকে৷ সেখানে একটা অতি সাধারণ কাঠের টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা আছে৷ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন তিনি৷ সুনন্দও বসল একটা চেয়ারে৷ টেবিলের উপর একটা বাতি আর-একটা মোটা খাতা রাখা আছে৷ নীলমাধববাবু চেয়ারে বসে খাতাটা টেনে নিয়ে বললেন, ‘এটা হল হাজিরা খাতা, এখন যারা কাজ করছে তাদের নাম, ঠিকানা লেখা আছে৷’ এই বলে কাগজ, কলম বের করে খাতা থেকে কয়েকটি নাম-ঠিকানা টুকতে থাকলেন৷ সুনন্দ তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷

হঠাৎ পায়ের পাতায় কীসের স্পর্শ অনুভব করল সুনন্দ৷ নীচের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, হঠাৎই যেন ঘরের মেঝেটা ইঞ্চি খানেক জলে ডুবে গিয়েছে৷ একটু আগেই তো মেঝেটা শুকনো খটখটে ছিল! তা হলে জল এল কোথা থেকে? পা-টা একটু উঠিয়ে বসল সুনন্দ৷ এক মনে লিখে চলেছেন নীলমাধববাবু৷ কয়েক মুহূর্ত পরই সুনন্দর মনে হল, আবার যেন জল ছুঁয়ে যাচ্ছে তার পা৷ হ্যাঁ সত্যিই, জল যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরও ইঞ্চি খানেক উপরে উঠে এসেছে৷ নীলমাধববাবুর কোনো ভাবান্তর নেই৷ সুনন্দ দেখতে পেল টেবিলের নীচে নীলমাধববাবুর গোড়ালি পর্যন্ত জলে ডুবে গিয়েছে৷

এবার সে বাধ্য হয়েই নীলমাধববাবুকে বলল, ‘এ কী, এত জল এসে গেল কীভাবে? আমার পা তো জলে ভিজে যাচ্ছে!’

নীলমাধববাবু লিখতে লিখতে বললেন, ‘দামোদরের জল৷’

সুনন্দ তাকিয়ে রইল নীলমাধববাবুর দিকে৷ কয়েক মুহূর্ত পর লেখা শেষ করে নীলমাধববাবু যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন জল আরও উপরে উঠে গিয়েছে৷ নীলমাধববাবু তাঁর কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘ব্যস, কাজ শেষ, চলুন, ফেরা যাক৷’

জল ভেঙে উপরে উঠছেন নীলমাধববাবু৷ তাঁর পিছন পিছন সুনন্দ৷ পথের মুখটায় একবার পিছনের দিকে ফিরে তাকাল সুনন্দ৷ ঘরের যেদিকে লোকগুলো কাজ করছে সেদিকটা বেশি ঢালু৷ সুনন্দ দেখতে পেল, তাদের হাঁটুর উপর পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে জলে৷ তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, আগের মতোই গাইতি চালিয়ে যাচ্ছে তারা৷ প্রতি মুহূর্তেই জল যে বেড়ে চলেছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না সুনন্দর৷ নীলমাধববাবুর পিছনে উঠতে উঠতে সুনন্দ বলল, ‘ঘরটা যে জলে ভরে গেল, লোকগুলো কি এখনও কাজ করবে?’

কোনো উত্তর দিলেন না নীলমাধববাবু৷ চুপচাপ উঠতে লাগলেন৷ কয়েক মুহূর্ত পর সুনন্দ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের খাদানের জল বাইরে বের করার জন্য পাম্পের ব্যবস্থা নেই?’

একটা অদ্ভুত হাসি হেসে জবাব দিলেন নীলমাধববাবু, ‘আছে, আছে৷ কিন্তু গোটা দামোদরটাকে তো আর পাম্প দিয়ে শুষে নেওয়া যায় না!’ এর পর একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘একটু দ্রুত পা চালাতে হবে৷ এখনই তো জল আমাদের পিছু ধাওয়া করবে৷’

সুনন্দ অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

কোনো উত্তর দিলেন না নীলমাধববাবু৷ তিনি যেন বাতাসের বেগে উপরে উঠতে লাগলেন৷ তাঁর পিছন পিছন প্রায় ছুটতে শুরু করল সুনন্দ৷ আর তার মনে হতে লাগল, তাদের পিছন পিছন আরও কী একটা যেন উপর দিকে উঠে আসছে৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই খাদানের মুখটার ঠিক বাইরে বেরিয়ে এল সুনন্দ৷ বাইরে তখন শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি৷ তাঁরা দু-জনের সঙ্গেসঙ্গে ভিজে গেলেন৷ বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে নীলমাধববাবুর দিকে তাকিয়ে হাঁফাতে লাগল সুনন্দ৷ খনির ভিতর জলের ব্যাপারটা, আর কেন ঝড়ের বেগে নীলমাধববাবু উপরে উঠলেন, তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না সুনন্দর৷ কয়েক মুহূর্ত সুনন্দর দিকে তাকিয়ে থাকার পর নীলমাধববাবু টর্চ আর তাঁর কাগজটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম, কাগজটা কিন্তু দয়া করে পৌঁছে দেবেন৷ আমি এবার যাই!’

সুনন্দ অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায়?’

নীলমাধববাবু বললেন, ‘এত দিন যাদের সঙ্গে কাটালাম তাদের কাছে৷’

সুনন্দ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলমাধববাবু ঢুকলেন খাদানের অন্ধকার গহ্বরে৷ ঠিক সেই সময় কাছেই কোথাও যেন প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷ চমকে উঠল সুনন্দ৷ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সে চিৎকার করে বলল, ‘নীলমাধববাবু শুনুন, এভাবে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

তার কথার কোনো উত্তর এল না৷ সুনন্দ টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ফেলল খাদানের ভিতর৷ সে দেখতে পেল, জল প্রায় খাদানের মুখ পর্যন্ত উঠে এসেছে৷ মুহূর্তের জন্য একবার যেন নীলমাধববাবুকে দেখতে পেল সুনন্দ, আর তার পরেই তিনি নিমেষে হারিয়ে গেলেন জলপূর্ণ খাদানের গভীরে৷ সুনন্দ চিৎকার করে উঠল, ‘নীলমাধববাবু . . .!’ আর তার পরেই জ্ঞান হারাল সুনন্দ৷

পরদিন সকালে কোলিয়ারির রেস্টরুমের বিছানায় জ্ঞান ফেরার পর সুনন্দ যখন উঠে বসল তখন সে দেখতে পেল, তার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই গাড়ির ড্রাইভার ও আর-একজন সাদা জামা-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক৷ সেই ভদ্রলোক নিজেকে কোলিয়ারির ম্যানেজার বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘কী মশাই, আপনি সাত নম্বর খাদানের কাছে চলে গিয়েছিলেন কীভাবে! আপনার ড্রাইভার আর আমি অনেক খোঁজার পর আপনাকে পেয়েছি৷’

তাঁর কথা শুনে সুনন্দ বলল, ‘আপনি ম্যানেজার৷ তাহলে নীলমাধববাবু?’

তার কথা শুনে একটু চুপ করে থাকার পর ভদ্রলোক বললেন, ‘নীলমাধববাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল বুঝি? কিন্তু তিনি আর এখন নেই৷’

‘নেই মানে?’ সুনন্দ আবার জিজ্ঞেস করল৷

ভদ্রলোক বললেন, ‘ঘটনাটা হয়তো আপনার জানা নেই৷ মাস তিনেক আগে গার্ড-ওয়াল ভেঙে দামোদরের জল এক রাতে ঢুকে পড়ে সাত নম্বর খাদানে৷ নীলমাধববাবু আর জনাতিরিশেক লোক তখন কাজ করছিলেন৷ তাঁরা কেউই আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি৷ সকলেরই সলিল সমাধি ঘটে৷ নীলমাধববাবুর পর আমি ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি৷’

এর পর ভদ্রলোক সুনন্দকে বললেন, ‘আপনি এখানে বিশ্রাম নিন৷ আপনার রিপোর্টটা তৈরি আছে৷ আমি অফিস থেকে সেটা নিয়ে আসছি৷’ বলে ভদ্রলোক ঘর ছেড়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেলেন৷

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বিছানায় বসে থাকার পর সুনন্দ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘মংলু বলে যে লোকটাকে কাল রাতে ম্যানেজারবাবু গাড়ি থেকে তোমার কাছে নামিয়ে দিয়েছিলেন, সে কোথায় গেল?’

‘আপনারা চলে যাওয়ার পর তার দেখা আমি আর পাইনি৷’ বলল ড্রাইভার৷ এর পর সে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সুনন্দর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ কাগজটা নিন, আপনার হাতে ছিল কাগজটা৷’

কাগজটা হাতে নিয়ে সেটা খুলল সুনন্দ৷ তার মধ্যে লেখা আছে একটা নামের তালিকা৷ সে তালিকার মধ্যে মংলু বলেও একটা নাম আছে৷ আর তালিকার নীচে আছে একটা সই, নীলমাধব মজুমদার, ম্যানেজার, ম্যাকেঞ্জি কোলিয়ারি৷ কাগজটা যত্ন করে পকেটে রেখে দিল সুনন্দ৷ এ কাগজটা তাকে হেড অফিসে জমা দিতে হবে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *