সাক্ষীগোপাল

সাক্ষীগোপাল

এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পুরী যাচ্ছেন তীর্থ করতে। পথের মধ্যে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। তীর্থসহচরদের মধ্যে তার এক গ্রামবাসী যুবক অনেক সেবাযত্ন করে তাকে সুস্থ করে তোলে। বৃদ্ধ যুবকটিকে কথা দিলেন যে, তীর্থ থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি তার সাথে নিজ কন্যার বিয়ে দিবেন।

যুবক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মুখের কথায় আস্থা স্থাপন করতে না পেরে তাকে নিয়ে গেল নিকটবর্তী শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে। সেখানে গোপাল (শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের সামনে গিয়ে বিগ্রহকে সাক্ষী রেখে মেয়ের সাথে ঐ যুবকের বিয়ে দিবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি বাক্য উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ।

তীর্থভ্রমণশেষে দেশে ফিরলেন ব্রাহ্মণ। যুবক মাঝে মাঝে তাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেয়। দিন যায়, মাস যায়। ব্রাহ্মণ আর তার কথা রাখেন না। বিয়ের ব্যাপারে কথাও বলেন না। যুবকের চাপাচাপিতে একদিন ব্রাহ্মণ তার প্রতিশ্রুতির কথা পুরোপুরি অস্বীকার করলেন।

নিরুপায় নাছোরড়বান্দা যুবক আবার সেই শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে গেল। শ্রীকৃষ্ণকে সে তার আর্জি জানিয়ে বললো—

‘হে গোপাল, তুমি তো জানো যে, ঐ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তোমার সামনেই আমাকে তার কন্যা সম্প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন তিনি তা অস্বীকার করছেন। অতএব সবার সামনে গিয়ে তোমাকে সাক্ষ্য দিতে হবে।’

গোপালমূর্তি সঙ্গে সঙ্গে যুবকের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে বললো— “ঠিক আছে। তুমি সামনে এগুতে থাকো। আমি তোমার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। আমার চরণের নূপুরধ্বনি শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে যে, আমি ঠিক ঠিক যাচ্ছি তোমার পিছে পিছে। তবে তুমি যদি পিছন ফিরে দেখো তবে আমি আর যাবো না।’

যুবক চলতে লাগলো। পেছনে নৃপরধ্বনি করে যাচ্ছেন গোপাল। কিছুক্ষণ পর নূপুরধ্বনি শুনতে না পেয়ে পিছন ফিরলো যুবক। গোপালমূর্তি থেমে গেল। যুবক বললো— ‘আমি তোমার নূপুরের শব্দ না পেয়ে পিছন ফিরেছি।’ শ্রীকৃষ্ণ (গোপাল) বললেন, ‘বালুর মধ্যে চলতে চলতে নূপুরের মধ্যে বালু ঢুকে শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। যাহোক, শর্ত মোতাবেক আমি আর অগ্রসর হতে পারবো না। তবে তোমার ভাবনার কারণ নেই। তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে ব্রাহ্মণকে এই ঘটনার কথা বলবে।’

গোপালমূর্তি ঐ স্থানেই স্থির হয়ে গেল। যুবক বাড়ি ফিরে সবাইকে এই ঘটনার কথা বললো। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও শুনলেন বিস্তারিত ঘটনা। দলে দলে লোকজন ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। সবাই গোপালমূর্তির অবস্থান দেখে গেল। লোকমতের প্রভাবে ব্রাহ্মণ তার মেয়ের সাথে ঐ যুবকের বিয়ে দিয়ে প্রতিশ্রুতি পালন করলেন!

পুরী যাবার পথে সাক্ষীগোপালের এই মন্দির অবস্থিত। সর্বদর্শী হয়েও এই গোপাল নিজে কারো পাপ বা পুণ্যের ফল দান করেন না। যে ব্যক্তি নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে অন্যের কার্যকলাপ দর্শন করে অর্থাৎ প্রত্যক্ষকারী অথচ পুতুলের মতো জড় পদার্থ হয়ে থাকে তাকে আমাদের প্রবাদে বলা হয় সাক্ষীগোপাল। অনেকের বিশ্বাস যে, সাক্ষীগোপালের মন্দির দর্শন ছাড়া পুরীর তীর্থযাত্রা পরিপূর্ণ হয় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *